যখন মস্তিষ্কে কেবল একটি নিউরনে উদ্দীপিত হয়, এটা কেবলই একটি আলাদা কেমিকেল ব্লিপ তৈরি করে। কিন্তু যখন অনেকগুলো নিউরন একসাথে উদ্দীপিত হয় তখন তারা মস্তিষ্কে একটি চিন্তার সৃষ্টি করে। কিভাবে মস্তিষ্ক এই দুই ধরণের নিউরাল এক্টিভিটি অর্থাৎ নিউরনের উদ্দীপনা এবং চিন্তার সৃষ্টির এই দুই ধরণের ঘটনার মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপন করে তা একটি রহস্য হয়েই ছিল। কিন্তু একটি নতুন ধরণের টেকনোলজি সম্প্রতি এই রহস্যের সমাধানের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে।
উপরের ছবিটিতে সায়ান বর্ণের উজ্জ্বল আলো এসেছে এক ধরণের বায়োসেন্সর থেকে যা অনেক কম পরিমাণের নিউরোট্রান্সমিটারের নিঃসরণকেও সনাক্ত করতে পারে। নিউরোট্রান্সমিটার হল একধরণের সিগনালিং মলিক্যুল (অণু) যা ব্রেইন সেল বা নিউরনরা নিজেদের মাঝে যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করে থাকে। CNiFERs (উচ্চারণ স্নিফারস) নামের এই সেন্সরগুলো বিজ্ঞানীদেরকে খুব গভীরভাবে মস্তিষ্কের কার্যাবলি পরীক্ষা করার একটি উপায় করে দিয়েছে। এই স্নিফারস ফ্লুরোসেন্ট এর মাধ্যমে নিউরোট্রান্সমিটারের নিঃসরণের খবর গবেষকদের দান করে।
এই টেকনোলজিটি ডেভলপ করা হয়েছে হোয়াইট হাউজ ব্রেইন ইনিশিয়েটিভ এর একটি অংশ হিসেবে। এর সাহায্যে কিভাবে আলাদা আলাদা নিউরনের নিজেদের মধ্যে জটিল আন্তক্রিয়ার ফলে বিভিন্ন ব্রেইন ফাংশন বা মস্তিষ্কের কার্যাবলির উদ্ভব হয় এবং এডিকশন বা নেশার মত জটিল আচরণের জন্ম হয় সেসম্পর্কে আমাদেরকে আরও বেশি তথ্য দিতে পারে। আইকান স্কুল অব মেডিসিনের নিউরোসাইন্টিস্ট পল স্লেসিংগার এই গবেষণার অন্যতম সিনিয়র রিসার্চার। তিনি এই গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এবং আমেরিকান কেমিকেল সোসাইটির ২৫২ তম ন্যাশনাল মিটিং এন্ড এক্সপোজিশনে এই সেন্সরটিকে প্রদর্শন করেছেন।
বর্তমান টেকনোলজিগুলো দেখিয়েছে কিভাবে অনেকগুলো কোষের পাশে সামান্য পরিমাণ নিউরোট্রান্সমিটার চিন্তা তৈরির ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। বিজ্ঞানীরা অনেকক্ষণ সময় ধরে ব্রেইন এক্টিভিটি দেখার জন্য মস্তিষ্কে ব্লাড ফ্লো বা রক্তপ্রবাহ পরিমাপ করতে ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং টেকনোলজি ব্যবহার করেছেন। অথবা কয়েক সেকেন্ডের জন্য কিছু নিউরন থেকে একটি নির্দিষ্ট নিউরোট্রান্সমিটারের নিঃসরণকে ফলো করার জন্য ট্রেসার ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এই সব টেকনোলজির থেকে স্নিফারস কয়েক ধাপ এগিয়ে। কারণ স্নিফারসের সাহায্যে বিজ্ঞানীরা তুলনামূলক বেশি সময়ের জন্য অনেক কোষ থেকে অনেকগুলো নিউরোট্রান্সমিটারকে পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
যখন স্নিফার কোন নিউরোট্রান্সমিটারের সংস্পর্শে আসে তখন এটা ফ্লুরোসেন্সের মাধ্যমে তার জানান দেয়। এরপর মস্তিষ্কে একটি ক্ষুদ্র সেন্সর ইমপ্ল্যান্ট করে বিজ্ঞানীরা পরিমাপ করতে পারেন যে স্নিফার ঠিক কতটা আলোর নিঃসরণ করল। এবং এর সাহায্যে সেখানে কি পরিমাণ নিউরোট্রান্সমিটার উপস্থিত আছে তাও নির্ণয় করতে পারেন। স্লেসিংগার বলেন, স্নিফারে কয়েকটি ইন্টারলকিং পার্ট থাকায় এগুলো প্লাগ এন্ড প্লে সিস্টেম তৈরি করতে পারে এবং উচ্চমাত্রার কর্মদক্ষতা দেখায়। এই যন্ত্রের বিভিন্ন অংশ আলাদা আলাদা নিউরোট্রান্সমিটার সম্পর্কে তথ্য দিতে পারে। পূর্বের টেকনলজিগুলো যেখানে একইরকম বিভিন্ন মলিক্যুল বা অণু যেমন ডোপামিন, নরেপিনেফ্রিনের মধ্যে পার্থক্য করতে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হত সেখানে স্নিফারেসের বেলায় এসব ক্ষেত্রে কোন সমস্যাই হয় না।
এই সেন্সরগুলোকে প্রাণীদের মধ্যে নির্দিষ্ট ব্রেইন প্রোসেস বা মস্তিষ্কের ক্রিয়াকে পরীক্ষা করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। স্লেংগার এবং তার কলিগেরা এখন পাভলভিয়ান কন্ডিশনিং নামের একটি ক্লাসিক সাইকোলজিকাল ফেনোমেননকে কাছ থেকে পরীক্ষা করার জন্য স্নিফারসকে ব্যবহার করছেন। পাভলভ তার কুকুরকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন যাতে সে ডিনার বেল বাজার সময়েই লালা ঝড়ায়। এভাবে কুকুর বা অন্য কোন প্রাণীকে কন্ডিশনিং করার প্রক্রিয়াটির নাম দেয়া হয় পাভলভিয়ান কন্ডিশনিং। স্লেংগার আর তার দল একটি ইঁদুরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন যাতে এটি তাকে শোনানো অডিও এর সাথে তাকে দেয়া ফুড রেওয়ার্ড বা খাদ্য পুরষ্কারের মধ্যে একটি সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। গবেষণাটির শুরুতে, এই ইঁদুরটিকে যখন একটি শুগার কিউব দেয়া হয় তখন তার মস্তিষ্কে ডোপামিন এবং নরেপিনেফ্রিনের নিঃসরণ ঘটে। প্রথমদিকে এই প্রাণীগুলোর মধ্যে নিউরোট্রান্সমিটারগুলোর নিঃসরণ তাড়াতাড়ি হত, কিন্তু ধীরে ধীরে এদের কন্ডিশনিং করায় এদের মাঝে অডিও ক্যু এর সাথে চিনির মধ্যে একটি সম্পর্ক সৃষ্টির হয়। ফলে দেখা যায় আসল রেওয়ার্ড শুগারের বদলে অডিও ক্যু শোনানোর সময়েই তাদের মাঝে নিউরোট্রান্সমিটারের নিঃসরণ হয়।
ইদুঁরের উপর এই গবেষণা যথেষ্ট শোরগোল তুলেছে। পরবর্তীতে এটা মানুষের উপরেও ব্যবহার করা যাবে এবং এর ফলে পারকিনসন রোগী বা কনকাসন সাফারারদের চিকিৎসাতেও এটাকে ব্যবহার করে আরও ভাল চিকিৎসাপদ্ধতির উদ্ভাবন করা যাবে। কিন্তু স্লেংগার স্নিফারসকে নেশা বা এডিকশন নিয়ে গবেষণার কাজে ব্যবহার করতে বেশি উৎসাহী। তিনি দেখতে চান কিভাবে ইঁদুরের মস্তিষ্কে এডিকশন ডেভলপ করে, আর এর মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের মাঝে এডিকশনের বিরুদ্ধে কিভাবে লড়াই করা যায় তার উপায় বের করতে চান।
তথ্যসূত্র:
Leave a Reply