আপনি সম্ভবত হিগস বোজনের নাম শুনেছেন। এই অধরা পার্টিকেলটির ভবিষ্যদ্বাণী অনেক আগে করা হয়েছিল এবং এটা পৃথিবী যেভাবে কাজ করে সেভাবে কেন কাজ করে এটার ব্যাখ্যা দিতে সহায়তা করত। কিন্তু এই পারটিকেলটিকে সনাক্ত করতে বিজ্ঞানীদের আরও কয়েক দশক লেগে গিয়েছিল।
যাইহোক, কোয়ান্টাম ফিজিক্স ভবিষ্যদ্বাণী করে এরকম আরেকটি অধরা পার্টিকেল আছে। আর এটা আরও অনেক বেশি সময় ধরেই মিসিং। আমরা এখনও এটার একটাও খুঁজে পাই নি, আর সেটা খোঁজার প্রচেষ্টার অভাবের কারণে নয়।
এই পার্টিকেলটির নাম হল ম্যাগনেটিক মনোপল। এর কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য আছে যা একে আরও বেশি স্পেশাল করে তুলেছে।
প্যারালেলস
পদার্থবিজ্ঞানে আগ্রহ আছে এমন সকলেই সম্ভবত একটি শব্দের সাথে পরিচিত। শব্দটি হল ইলেক্ট্রিক মনোপল। যদিও বেশিরভাগ লোকই একে আরও একটি কমন নামে চেনে। নামটি হল “ইলেকট্রিক চার্জ”।
ইলেক্ট্রিক ফিল্ডের ইন্টারেকশনের কারণে বিপরীত ইলেক্ট্রিক চার্জ একে অপরকে আকর্ষণ করে এবং সমধর্মী চার্জ বিকর্ষণ করে যা পজিটিভ নেগেটিভ চার্জ এর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এই ইলেকট্রিক ফিল্ডকে সংজ্ঞায়িত করা হয় এভাবে যেন তা পজিটিভ থেকে নেগেটিভের দিকে গমণ করছে। ইলেক্ট্রিক মনোপল পার্টিকেলের আকারে থাকে যাদের এই পজিটিভ এবং নেগেটিভ চার্জ আছে। যেমন প্রোটন এবং ইলেক্ট্রন।
প্রথম দেখায় ম্যাগনেটিজমকে ইলেক্ট্রিসিটি এর সদৃশ বলে মনে হয়। কারণ ম্যাগনেটিক ফিল্ডেরও একটি দিক আছে যা নর্থ বা উত্তর মেরু থেকে সাউদ বা দক্ষিণ মেরুর দিকে গমন করে বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়। কিন্তু এই সাদৃশ্য বা এনালজি একটা জায়গায় এসে ভেঙ্গে পড়ে। কারণ ইলেক্ট্রন, প্রোটনের মত চার্জ পার্টিকেল এর আকারে ইলেক্ট্রিক মনোপলের সন্ধান পেলেও আমরা কখনও ম্যাগনেটিক মনোপল এর কোন পার্টিকেল খুঁজে পাই নি।
বরং ম্যাগনেটের অস্তিত্ব সবসময় ডাইপোলের আকারে থাকে যা একটি নর্থ এন্ড বা উত্তর মেরু এবং একটি সাউদ এন্ড বা দক্ষিণ মেরু নিয়ে গঠিত। যদি কোন বার ম্যাগনেটকে ভেঙ্গে দুটো টুকরো করা হয় তাহলেও আলাদা উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরু পাওয়া যাবে না। বরং এক্ষেত্রে দুটো নতুন, ছোট ম্যাগনেট পাওয়া যাবে যাদের উভয়েরই একটি করে নর্থ পোল এবং সাউদ পোল আছে। এমনকি আপনি যদি সেই ম্যাগনেটের আলাদা আলাদা পার্টিকেলেও ভেঙ্গে ফেলেন, তারপরও আপনি সেই ম্যাগনেটিক ডাইপোলই খুঁজে পাবেন।
যখন আমরা এই বিশ্বে ম্যাগনেটিজমের দিকে তাকাই, আমরা যাই দেখি তার সবই পুরোপুরিভাবে ম্যাক্সওয়েলের একুয়েশনগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে যেগুলো ইলেক্ট্রিক এবং ম্যাগনেটিক ফিল্ড থিওরিকে একীভূত করে ক্লাসিকাল ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম এর জন্ম দেয় এবং এই ইউনিফিকেশনকে ব্যাখ্যা করে। জেমস ম্যাক্সওয়েল ১৮৬১ এবং ১৮৬২ সালে এই ইকুয়েশনগুলোকে প্রথম প্রকাশ করেন এবং ইঞ্জিনিয়ারিং এবং টেলিকমিউনিকেশনের প্র্যাক্টিকেল দিকগুলোতে এখনও এই সূত্রগুলো ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই ইকুয়েশনগুলোর একটি হল “গাউসস ল ফর ম্যাগনেটিজম”। এটি বলে ম্যাগনেটিক মনোপল বলতে কিছু নেই।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা যে ম্যাগনেটিজম দেখতে পাই তাকে ইলেক্ট্রিক চার্জ এর মুভমেন্ট দিয়ে প্রকাশ করা যায়। যখন একটি ইলেক্ট্রিকালি চার্জড পার্টিকেল কোন পথে গমন করে, যেমন একটি পরিবাহী তার দিয়ে, তখন এটাকে ইলেক্ট্রিকাল কারেন্ট বলা হয়। এই ইলেক্ট্রিকাল কারেন্টের সাথে একটি ম্যাগনেটিক ফিল্ড যুক্ত থাকে যা এই কারেন্টের দিকের চতুর্দিকে জড়িয়ে থাকে।
ম্যাগনেটিজমের দ্বিতীয় আরেকটি কারণ আছে যা কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর একটি বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পর্কিত। এর নাম হল “স্পিন”। এক্ষেত্রে কোন ইলেক্ট্রিকালি চার্জড পার্টিকেল কোন নির্দিষ্ট দিকে গমন করে না, বরং একটি অক্ষকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। এই স্পিনের ফলে পার্টিকেলে এঙ্গুলার মোমেন্টাম বা কৌণিক ভরবেগ তৈরি হয় যার ফলে ইলেক্ট্রন একটি ম্যাগনেটিক ডাইপোল (একটি ক্ষুদ্র চুম্বক এর বার) হিসেবে কাজ করে। এর অর্থ হচ্ছে আমরা ম্যাগনেটিক মনোপল ছাড়াই ম্যাগনেটিক ফেনোমেনার ব্যাখ্যা করতে পারছি।
কিন্তু আমাদের ক্লাসিকাল ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক থিওরিগুলো আমাদের অবজার্ভেশন বা পর্যবেক্ষণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে, এর মানে এই নয় যে ম্যাগনেটিক মনোপল বলতে কিছু নেই। বরং এর অর্থ এটা হবে যে, আমরা যা যা পর্যবেক্ষণ করেছি সেখানে ম্যাগনেটিক মনোপল এর কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় নি। কিন্তু বিজ্ঞানীগণ যখন থিওরিগুলোর গভীরে প্রবেশ করতে শুরু করলেন তখন মহাবিশ্বে ম্যাগনেটিক মনোপল এর উপস্থিতি নিয়ে তারা কিছু প্রলুব্ধকর ব্যাপার খুঁজে পেলেন।
ডুয়েলিটির প্রলোভন
১৮৯৪ সালে নোবেল লরিয়েট পিয়েরে কুরি এরকম একটি অনাবিষ্কৃত পার্টিকেল থাকার সম্ভাবনার কথা বলেন কিন্তু তিনি এর অস্তিত্বের কোন কারণ দেখাতে পারেন নি। পরবর্তীতে ১৯৩১ সালে নোবেল লরিয়েট পল ডিরাক দেখান, যখন ম্যাক্সওয়েলের ইকুয়েশনগুলোকে ম্যাগনেটিক মনোপলকে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য বর্ধিত করা হয় তখন দেখা যায় ইলেক্ট্রিক চার্জগুলোর অস্তিত্ব কেবল কিছু নির্দিষ্ট বিচ্ছিন্ন মানের জন্যই থাকতে পারে।
ইলেক্ট্রিক চার্জের এই কোয়ান্টাইজেশন হল কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর ক্ষেত্রে একটি অন্যতম রিকয়ারমেন্ট বা আবশ্যিক বিষয়। আর এভাবেই ডিরাক দেখান যে ক্লাসিকাল ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম এবং কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডাইনামিক্স একে অপরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
আর এরপরে কিছু পদার্থবিজ্ঞানী আসেন প্রকৃতির প্রাতিসাম্যের সৌন্দর্য বা বিউটি অব সিমেট্রির আশা নিয়ে। যেহেতু ম্যাগনেটিক মনোপলের অস্তিত্ব ইলেক্ট্রিসিটি এবং ম্যাগনেটিজমের মধ্যকার ডুয়েলিটি নির্দেশ করে, সেহেতু ম্যাগনেটিক মনোপল প্রস্তাব করা থিওরিটিও উত্তেজনায় ভরা।
ফিজিকাল সেন্সে, ডুয়েলিটি তখন হয় যখন দুটো ভিন্ন থিওরি একে অপরের সাথে এমনভাবে সম্পর্কযুক্ত থাকে যেন একটি আরেকটার সাথে এনালোগাস বা সদৃশ হয়।
যদি ইলেক্ট্রিক ফোর্স ম্যাগনেটিক ফোর্সের সাথে সম্পূর্ণভাবে এনালোগাস বা সদৃশ হত, তাহলে হয়তো অন্যান্য ফোর্স বা বলও একে অপরের সাথে এনালোগাস হত। হয়তো স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্সকে উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স এর সাথে কোনভাবে সম্পর্কিত করা যেত আর তার মধ্য দিয়ে আমরা সকল ফিজিকাল ফোর্সের একটি গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশনের পথ খুঁজে পেতাম।
যাই হোক, কোন থিওরি সিমেট্রি নির্দেশ করলেই তা সত্য হয়ে যায় না।
মনোপল মিরেজ
বিজ্ঞানীরা এখন ম্যাগনেটিক মনোপল তৈরির খুব কাছাকাছি চলে এসেছেন। এর জন্য তারা বোস-আইনস্টাইন কনডেন্সেটে ম্যাগনেটিক ফিল্ডের জটিল এরেঞ্জমেন্ট এবং সুপারফ্লুইড ব্যাবহার করে ল্যাবে মনোপল লাইক স্ট্রাকচার প্রস্তুত করছেন। কিন্তু এটা ম্যাগনেটিক মনোপলকে ফিজিকালি তৈরি করা অসম্ভব নয় প্রমাণ করলেও প্রকৃতিতে এরকম একটাকে আবিষ্কার করা সম্ভব হবে এমনটা বলে না।
পার্টিকেল ফিজিক্সের এক্সপেরিমেন্টগুলো থেকে প্রায়ই সাম্ভাব্য মনোপল ক্যান্ডিডেট পাওয়া যায়, কিন্তু এখনও পর্যন্ত এগুলোর কোন আবিষ্কারই ইরিফিউটেবল বা খণ্ডনঅযোগ্য এবং রিপ্রোডিউসেবল বা পুনরুৎপাদনযোগ্য হিসেবে দেখানো যায় নি। লার্জ হেড্রন কলাইডারের দ্য মনোপল এবং এক্সোটিক ডিটেক্টর (MoEDAL) এই মনোপল খুঁজে বের করার দায়িত্বটি গ্রহণ করেছে, কিন্তু এখনও সেখানে তেমন কোন মনোপল খুঁজে পাওয়া যায় নি। আর তাই ম্যাগনেটিক মনোপলে আগ্রহী গবেষকগণ তাদের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন। এখন তারা কেন আমরা কোন ম্যাগনেটিক মনোপল দেখি না তার ব্যাখ্যা খুঁজছেন।
যদি বর্তমান জেনারেশনের পার্টিকেল এক্সিলারেটরগুলো ম্যাগনেটিক মনোপল সনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়, তার অর্থ হয়তো এই হবে যে, এখন সেখানে যে পরিমাণ ভর তৈরি করা যায়, ম্যাগনেটিক মনোপলের ভর হয়তো তার চেয়েও বেশি। থিওরি ব্যবহার করে আমরা ম্যাগনেটিক মনোপলের সাম্ভাব্য সর্বোচ্চ ভরের মান হিসাব করে বের করতে পারি। আমরা এপর্যন্ত মহাবিশ্বের স্ট্রাকচার সম্পর্কে যতটুকু জানি সে অনুযায়ী হিসাব করে বের করা যায় যে মনোপলের ভর 1014 TeV এর মত বিশাল হতে পারে।
এইরকম কোন অবজেক্ট হয়তো মহাবিশ্বে বিগব্যাং এর পরে অনেক প্রাথমিক ধাপে কসমিক ইনফ্লেশন শুরু হবার আগেই তৈরি হতে পারে। মহাবিশ্ব ঠাণ্ডা হতে হতে এমন একটি অবস্থানে পৌঁছে গেলে, যখন মনোপলের তৈরি হওয়া এনার্জেটিকালি বা শক্তিগতভাবে আর সম্ভব নয়, তখন হয়তো আর মনোপল তৈরি হওয়া সম্ভব হয় নি, কেবল খুব কম পরিমাণ মনোপলই টিকে ছিল। এখন সেগুলোর একটাকে খুঁজে বের করাই হল লক্ষ্য।
তথ্যসূত্র:
Leave a Reply