আমাদের মহাবিশ্বে ১০০ বিলিয়ন গ্যালাক্সি থাকতে পারে যাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্র, গ্যাস ও ধূলিকণার বিশাল বিশাল মেঘ এবং সম্ভবত প্রচুর পরিমাণ গ্রহ, উপগ্রহ এবং ধ্বংসাবশেষ। নক্ষত্রগুলো রেডিও ওয়েভ থেকে এক্সরে ওয়েভ পর্যন্ত প্রচুর পরিমাণে শক্তি উৎপাদন করে যা মহাবিশ্বে আলোর বেগে ছড়িয়ে যায়।
কিন্তু তারপরও আমরা এই মহাবিশ্বে যেটুকু দেখতে পারি তা হল বিশাল কসমিক আইসবার্গের সামান্য একটি প্রান্তবিন্দু। এটা মহাবিশ্বের মোট ভর ও শক্তির মাত্র ৫ শতাংশ। অন্যদিকে ডার্ক এনার্জি হল প্রায় ৬৮ শতাংশ এবং ডার্ক ম্যাটার প্রায় ২৭ শতাংশ।
মহাবিশ্বের প্রায় এক চতুর্থাংশ ডার্ক ম্যাটার দিয়ে তৈরি যা কোন ধরণের ডিটেক্টেবল বা সনাক্ত করা সম্ভব এমন শক্তির নিঃসরণ করে না, কিন্তু মহাবিশ্বের দৃশ্যমান বস্তুর উপর গ্র্যাভিটেশনাল পুল বা মহাকর্ষীয় টান প্রয়োগ করে।
নামের কারণে ডার্ক ম্যাটারের সাথে ডার্ক এনার্জিকে গুলিয়ে গেলে খুবই স্বাভাবিক। আর তারা সম্পর্কযুক্ত হলেও তাদের প্রভাব বা এফেক্ট সম্পুর্ণ ভিন্ন। সংক্ষেপে বলতে গেলে ডার্ক ম্যাটার আকর্ষণ করে, অন্যদিকে ডার্ক এনার্জি করে বিকর্ষণ। যেখানে ডার্ক ম্যাটার পদার্থগুলোকে ভেতরের দিকে ঠানে, সেখানে ডার্ক এনার্জি পদার্থগুলোকে বাহিরের দিকে ঠেলে। আবার যেখানে ডার্ক এনার্জি নিজেকে বৃহৎ মহাবিশ্বের পরিসরে নিজের প্রভাব প্রকাশ করে থাকে, সেখানে ডার্ক ম্যাটারের প্রভাব থাকে আলাদা আলাদা গ্যালাক্সিতে। তাহলে এবারে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক।
ডার্ক ম্যাটার
এস্ট্রোনোমারগণ আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ের বাইরের অঞ্চল বা আউটার রেজিয়ন নিয়ে গবেষণা করার সময় ডার্ক ম্যাটার আবিষ্কার করেছিলেন।
মিল্কিওয়ে এর আকৃতি একটি চাকতির মত যা প্রায় এক লক্ষ আলোকবর্ষ জুড়ে রয়েছে। এই চাকতি বা ডিস্কের নক্ষত্রগুলো গ্যালাক্সিটির কেন্দ্রের চারদিকে পরিভ্রমণ করে থাকে, যা একইসাথে গ্যালাক্সিটির সেন্টার অব মাস বা ভরকেন্দ্র। ল অব গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষীয় নীতি অনুসারে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের নিকটবর্তী নক্ষত্রগুলোর গ্যালাক্সির প্রান্তের নক্ষত্রগুলোর চেয়ে দ্রুতবেগে গমন করার কথা।
তারপরেও যখন এস্ট্রোনোমারগণ সমগ্র ছায়াপথ বা গ্যালাক্সির সকল নক্ষত্র নিয়ে পরিমাপ করলেন, তারা দেখতে পেলেন এগুলো্র সবাই সেন্টার অব গ্যালাক্সিকে প্রায় একই বেগে প্রদক্ষিণ করছে। এটা সাজেস্ট করে, কোন কিছু আছে যা গ্যালাক্সি ডিস্কের বাইরের দিকের নক্ষত্রগুলোকে এরকম গতি দিচ্ছে। তারা এই পদার্থেরই নাম দেন ডার্ক ম্যাটার।
হিসাব থেকে দেখা যায়, মিল্কিওয়ে জুড়ে ডার্ক ম্যাটারের একটি বিশাল চক্র অবস্থান করছে। এই হ্যালো বা চক্রটি গ্যলাক্সির উজ্জ্বল চাকতিটির থেকেও ১০ গুণ ভারি হতে পারে যেকারণে এটি একটি শক্তিশালী গ্র্যাভিটেশনাল পুল বা মহাকর্ষীয় টান প্রয়োগ করতে পারে।
একই এফেক্ট দেখা যায় আরও অনেক গ্যালাক্সির ক্ষেত্রেও। আর গ্যালাক্সির ক্লাস্টার বা ছায়াপথগুচ্ছের বেলাতেও একই ঘটনা দেখা যায়। তাদের গ্র্যাভিটি সেখানকার সকল দৃশ্যমান নক্ষত্র এবং গ্যাস ক্লাউডের সম্মিলিত টানের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী।
ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে আমরা যা জানতে পেরেছি সেগুলোকে একত্র করলে বলা যায়, প্রথমত, এটা ডার্ক, এর অর্থ হল আমাদের দৃশ্যমান নক্ষত্র, গ্রহ ইত্যাদির আকারে একে দেখা যায় না। অবজার্ভেশনের ফলে দেখা যায় যে, এই অদৃশ্য বস্তুই মহাবিশ্বের ২৭ শতাংশ। দ্বিতীয়ত, এটা নরমাল ম্যাটার বা সাধারণ পদার্থের ডার্ক ক্লাউড ফর্মে থাকে না। নরমাল ম্যাটার যে পদার্থ দিয়ে তৈরি হয় তাকে ব্যারিয়ন বলা হয়। আমরা এটা জানি কারণ বিজ্ঞানীরা ব্যারিয়নিক ক্লাউডকে সনাক্ত করতে পারেন। এটা করা হয় ব্যারিয়নিক ক্লাউডের মধ্য দিয়ে পাস করা রেডিয়েশনকে তাদের দ্বারা এবজর্ব করার মাধ্যমে। তৃতীয়ত, ডার্ক ম্যাটার এন্টিম্যাটার নয়। কারণ এক্ষেত্রে কোনরকম বিশেষ গামা রে দেখা যায় না, যা কিনা ম্যাটার-এন্টিম্যাটার পরষ্পরের সাথে মিলিত হয়ে নির্মূল হয়ে গেলে দেখা যায়। আর সর্বশেষ, আমরা কতগুলো গ্র্যাভিটেশনাল লেন্স দেখতে পারি তার উপর ভিত্তি করে আমরা বড় বড় গ্যালাক্সি সাইজের ব্ল্যাকহোলকে বাতিল করে দিতে পারি। কোন উচ্চ ঘনত্বের বস্তু তাদের কাছে আসা আলোকে বাঁকিয়ে দিতে পারে, কিন্তু ২৫ শতাংশ ডার্ক ম্যাটার কন্ট্রিবিউশন দ্বারা হতে পারে এরকম লেন্সিং ইভেন্ট আমরা যথেষ্ট পরিমাণে দেখি না।
যাই হোক, এক্ষেত্রে তবুও কিছু সাম্ভাব্য ডার্ক ম্যাটার পসিবিলিটি রয়েছে। ব্যারিয়নিক ম্যাটার দ্বারা ডার্ক ম্যাটার তৈরি হতে পারে যদি এটা কোন বাদামী ডোয়ার্ফে অথবা কোন ছোট, ঘন ও ভারী পদার্থে আবদ্ধ থাকে। এই সম্ভাবনাকে মেসিভ কমপ্যাক্ট হ্যালো অবজেক্টস বা MACHOs বলা হয়। কিন্তু ব্যারিয়নিক ম্যাটার নিয়ে সবচেয়ে পরিচিত মতামতটি হল এটা কোনভাবেই ব্যারিয়নিক নয়, বরং এটা অন্য কোন আরও বেশি এক্সোটিক পার্টিকেল দিয়ে তৈরি যেমন এক্সিয়ন বা WIMPS (Weakly Interacting Massive Particles)।
ডার্ক এনার্জি
এবারে আসি ডার্ক এনার্জি প্রসঙ্গে। এব্যাপারে আমাদের জানার চেয়ে অজানার পরিমাণই বেশি। আমরা জানি মহাবিশ্বে কি পরিমাণ ডার্ক এনার্জি আছে, কারণ আমরা জানি এটা কিভাবে আমাদের মহাবিশ্বের প্রসারণে প্রভাবিত করছে। এটা ছাড়া এর সম্পর্কে সবই রহস্যের চাদরে ঢাকা। কিন্তু এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রহস্য। দেখা যায়, মহাবিশ্বের প্রায় ৬৮ শতাংশ হচ্ছে ডার্ক এনার্জি, ডার্ক ম্যাটার হল ২৭ শতাংশ, আর বাদবাকি ৫ শতাংশ হল মহাবিশ্বের বাকি অংশ যাকে আমরা দেখতে পাই।
ডার্ক এনার্জির একটি বৈশিষ্ট্য হল এটা স্পেস বা স্থানের একটি বৈশিষ্ট্য। আলবার্ট আইনস্টাইনই ছিলেন প্রথম যিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ফাঁকা স্থান “নাথিং” নয়। স্থানের একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলোর অনেকগুলোই আমরা সম্প্রতি বুঝতে শুরু করেছি। স্থানের প্রথম যে বৈশিষ্ট্যকে আইনস্টাইন আবিষ্কার করেছিলেন তা হল, অনেকগুলো স্থানের অস্তিত্ব সম্ভব। এরপর আইনস্টাইনের গ্র্যাভিটি থিওরির একটি ভারশন, যেই ভারশনে কসমলজিকাল কনস্ট্যান্ট এর ব্যাপারটি ছিল সেটি দ্বিতীয় ভবিষ্যদ্বাণীটি দান করে। এটা বলে, এম্পটি স্পেস বা ফাঁকা স্থানের একটি নিজস্ব শক্তি রয়েছে। যেহেতু এটা স্পেসের নিজেরই একটি বৈশিষ্ট্য, তাই সেই স্পেস বা স্থানের সম্প্রসারণের ফলে এই শক্তি কমে যাবে না। যত বেশি স্পেস বা স্থানের অস্তিত্ব তৈরি হবে, তত বেশি স্পেস বা স্থানের এনার্জি দৃষ্টিগোচর হবে। এরফলে শক্তির এই বিশেষ রূপ মহাবিশ্বের দ্রুত থেকে দ্রুততর প্রসারণ ঘটাবে। দুর্ভাগ্যবশত, কেউই বুঝতে পারেনি যে কেন তারপরও সেখানে কসমলজিকাল কনস্ট্যান্ট থাকবে।
স্পেস বা স্থান কিভাবে এনার্জি লাভ করে এই বিষয়ে আরেকটি ব্যাখ্যা আছে যা আসে কোয়ান্টাম থিওরি অব ম্যাটার থেকে। এই থিওরি অনুযায়ী, “ফাঁকা স্থান” আসলে অস্থায়ী (ভারচুয়াল) পার্টিকেলে পূর্ণ থাকে যা অনবরত তৈরি হয় এবং অদৃশ্য হয়। কিন্তু যখন পদার্থবিজ্ঞানীগণ নির্ণয় করার চেষ্টা করলেন যে, ফাঁকা স্থানে কি পরিমাণ শক্তি থাকে, তখন একটি ভুল উত্তর আসে। ভুল মানে বিশাল ভুল। যে উত্তর আসল তা ছিল 10120 গুণ বেশি, অর্থাৎ ১ এর পর ১২০টা শূন্য যোগ করলে যে সংখ্যাটি পাওয়া যায়, ভুলটি ছিল আসল মানের ততগুণ বেশি! এত বড় ভুল করাটা অনেক কষ্টের। সুতরাং রহস্যটি রহস্যই রয়ে গেল।
ডার্ক এনার্জি নিয়ে আরেকটি ব্যাখ্যা হল, এটা একটি নতুন ধরণের ডাইনামিক এনার্জি ফ্লুইড বা ফিল্ড। এটা এমন কিছু যা সম্পূর্ণ স্পেসকেই ভরে রাখে কিন্তু মহাবিশ্বের সম্প্রসারণে এর এফেক্ট হল পদার্থ এবং নরমাল বা সাধারণ এনার্জির ঠিক বিপরীত। কোন কোন তাত্ত্বিক এর নাম দিয়েছেন, “কুইনটেসেন্স”, গ্রীক দার্শনিকদের পঞ্চম এলিমেন্টের নাম অনুসারে। কিন্তু কুইনটেসেন্সই যদি উত্তর হয়, তাহলেও আমরা জানিনা যে এটা কিসের মত, এটা কার সাথে ইন্টারেক্ট করে এবং কেনই বা এর অস্তিত্ব রয়েছে। সুতরাং রহস্যটি থাকছেই।
সর্বশেষ সম্ভাবনাটি হচ্ছে, আইনস্টাইনের গ্র্যাভিটি থিওরিটি সঠিক নয়। এটা কেবল মহাবিশ্বের প্রসারণে প্রভাব ফেলে না, গ্যালাক্সি এবং গ্ল্যালাক্সির ক্লাস্টারের সাধারণ ম্যাটারের আচরণেও এটা প্রভাব ফেলে। এই ব্যাপারটি আমাদেরকে একটি সাজেশন দিচ্ছে যে, ডার্ক এনার্জি সমস্যার সমাধানটি একটি নতুন গ্র্যাভিটি থিওরি দেবে নাকি দেবেনা। আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি যে কিভাবে গ্যালাক্সিরা ক্লাস্টারে এসে ঐক্যবদ্ধ হয়। কিন্তু যদি দেখা যায় এগুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্য একটি নতুন থিওরির প্রয়োজন হল, তাহলে সেটা কিরকম থিওরি হবে? কিভাবে এটা সৌরজগতের বিভিন্ন উপাদানের গতির সঠিক ব্যাখ্যা দেবে, যেমনটা আজ পর্যন্ত আইনস্টাইনের থিওরিটি করে এসেছে এবং এখনও মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে চলেছে? এরকম অনেকগুলো গ্র্যাভিটি থিওরিই আছে, কিন্তু কোনটাই এতটা শক্তিশালী নয়। সুতরাং রহস্যটি থাকছেই।
ডার্ক এনার্জি পসিবিলিটিগুলো অর্থাৎ এটা স্পেসের একটি প্রোপার্টি নাকি একটি নতুন ধরণের ডাইনামিক ফ্লুইড নাকি গ্র্যাভিটির একটি নতুন থিওরি এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য আমাদের আরও বেশি ডেটা দরকার, আরও ভাল ডেটা দরকার।
উপসংহার
ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি কি একে অপরের সাথে সম্পর্কিত? কেউ জানে না। বর্তমানের সবচেয়ে ভাল থিওরিটি বলছে ডার্ক ম্যাটার একটি সাবএটোমিক পার্টিকেল দ্বারা গঠিত যাকে এখনও পর্যন্ত সনাক্ত করা যায় নি, যদিও সামনের গবেষণাগুলোর মাধ্যমে হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী পার্টিকেল এক্সিলারেটর এর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম হবে। সম্প্রতি মহাবিশ্বের পঞ্চম বল সম্পর্কে গুঞ্জন চলছে, এটাও হয়তো ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে কিছু তথ্য দিতে পারবে। ডার্ক এনার্জিরও হয়তো এর নিজস্ব পার্টিকেল আছে, যদিও এই ব্যাপারে অনেক কম সাক্ষ্যপ্রমাণই রয়েছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জি একে অপরের কাছে অনেকটা প্রতিযোগী শক্তি। তদের মধ্যে কেবল দুটি বিষয়েই সাদৃশ্য রয়েছে, তা হল দুটোই বিগব্যাং এর ফলে সৃষ্ট এবং দুটোই যথেষ্ট রহস্যময়। নিচের ছবিটিতে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির প্রতিযোগীতার একটা চিত্র দেয়া হল একটা ধারণা লাভের জন্য।
তথ্যসূত্র:
- http://hubblesite.org/newscenter/archive/releases/cosmology/2007/01/text/
- http://chandra.harvard.edu/xray_astro/dark_matter.html
- http://www.darkmatterphysics.com/
- http://www.nasa.gov/mission_pages/planck/news/planck20130321.html
- http://imagine.gsfc.nasa.gov/educators/galaxies/imagine/dark_matter.html
Leave a Reply