ব্যাক্টেরিয়া নামের এককোষী অর্গানিজম ছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম কোষগুলোর কয়েকটি। ফসিল রেকর্ড বলছে, একসময় প্রচুর পরিমাণে ব্যাক্টেরিয়া তরুণ পৃথিবীকে আবৃত করে রেখেছিল। এদের মধ্যে কেউ কেউ সূর্য থেকে পাওয়া শক্তি এবং বায়ুমণ্ডল থেকে পাওয়া কার্বন ডাই অক্সাইড নিয়ে তাদের নিজেদের জন্য খাদ্য তৈরি করতে শুরু করেছিল। ফটোসিন্থেসিস বা সালোকসংশ্লেষণ নামের এই প্রক্রিয়াটির দ্বারা এতটাই অক্সিজেনের উৎপাদন হল যে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলই পরিবর্তিত হয়ে গেল। আর তাই খুব শীঘ্রই রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করল নতুন অক্সিজেন ব্রিদিং লাইফফর্ম বা অক্সিজেন নির্ভর জীবন। প্রভূত ও বর্ধিষ্ণু বৈচিত্র্যের বিশাল সংখ্যার ব্যাক্টেরিয়ার জন্য প্রকৃতিতে একের পর এক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটতে থাকে।
এন্ডোসিম্বায়োটিক থিওরি
বর্তমান প্রকৃত কোষে (বহুকোষী প্রাণীর কোষ) যে মাইটোকন্ড্রিয়া এবং ক্লোরোপ্লাস্ট দেখা যায় সেগুলো যে একসময় আদি ব্যাক্টেরিয়া কোষ ছিল তার প্রচুর এভিডেন্স আছে। এই এভিডেন্সগুলো এন্ডোসিম্বায়োটিক থিওরিতে আলোচনা করা হয়। এই থিওরিটির নাম এন্ডোসিম্বায়োটিক থিওরি কেন? সিম্বায়োসিস তখনই ঘটে যখন ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি একে অপরের সাথে বসবাস করে এবং কাজ করে উভয়ই সুবিধা লাভ করবে। যখন একটি অর্গানিজম বা জীবন আরেকটি জীবের মাঝে বসবাস করে এই সিম্বায়োসিস তৈরি করে তখন একে বলা হয় এন্ডোসিম্বায়োসিস। এই এন্ডোসিম্বায়োটিক থিওরি ব্যাখ্যা করে, কিভাবে একটি বড় হস্ট সেল বা পোষক কোষ এবং এর ভেতরে প্রবেশকৃত একটি ব্যাক্টেরিয়া খুব সহজেই জীবন ধারণের জন্য একে অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে যায়, যার ফলে তৈরি হয় একটি স্থায়ী সম্পর্কের। বিবর্তনের মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পর আজকের মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্ট আরও বেশি স্পেশালাইজড বা বিশেষিত হয়ে ওঠে যা কোষের বাইরে জীবনধারণ করতেই পারে না।
এটা কি কেবলই একটি থিওরি?
আমাদের রোজকারের কথাবার্তায় থিওরি বলতে আমরা কোন মতামত এবং ধারণাকে বুঝে থাকি, এক্ষেত্রে থিওরিকে ফ্যাক্ট বা প্রকৃত ঘটনার ভিত্তি করে গঠিত হবার কোন আবশ্যকতা থাকে না। কিন্তু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, থিওরি হল অনেক এক্সপেরিমেন্টেশন ও অবজার্ভেশন বা পরীক্ষা নিরীক্ষার ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যাখ্যা। কোন সাইন্টিফিক থিওরি বা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কোন সাইন্টিফিক কমিউনিটি দ্বারা ডেভলপড এবং ভেরিফাইড হয় এবং সাধারণত একটি ফ্যাক্ট বা সত্য হিসেবেই গ্রহণ করা হয়।
মাইটোকন্ড্রিয়ার একটি ডিএনএ আছে
ব্যাক্টেরিয়া কোষের সাথে মাইটোকন্ড্রিয়া এবং ক্লোরোপ্লাস্টের প্রচুর সাদৃশ্য রয়েছে। তাদের সকলেরই নিজস্ব ডিএনএ আছে যা কোষের নিউক্লিয়াসে প্রাপ্ত ডিএনএ থেকে আলাদা। আর এই দুটো অঙ্গাণুর (মাইটোকন্ড্রিয়া ও ক্লোরোপ্লাস্ট) ডিএনএ আবার তাদের কার্যপ্রক্রিয়ার জন্য অনেক প্রোটিন ও এনজাইম প্রস্তুত করে থাকে। মাইটোকন্ড্রিয়া এবং ক্লোরোপ্লাস্ট উভয়েরই ডাবল মেমব্রেন বা দ্বিস্তর বিশিষ্ট ঝিল্লী থাকে, এটাও সাক্ষ্য দেয় যে উভয়ই কোন আদি প্রকৃতির পোষক কোষে প্রবেশ করেছিল। এই দুটো অঙ্গাণুই আবার ব্যাক্টেরিয়ার মতই নিজেদের ডিএনএ এর রেপ্লিকেশন এর নিজেদের বিভাগের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি বা রিপ্রোডিউস করে।
বিবর্তনের ইতিহাস জানতে সহায়তা
মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ (mtDNA) এর ইনহেরিটেন্স এর একটি নিজস্ব প্যাটার্ন আছে। এটা মা থেকে সন্তানের বেলায় সরাসরি পাস করে এবং অন্য রকম ডিএনএ এর তুলনায় মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ এর পরিবর্তনও অনেক ধীরে ধীরে হয়। মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ এর এই অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি ইভোল্যুশনারি হিস্টোরি বা বিবর্তনের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে সক্ষম। যেমন দুটি প্রজাতির মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ এর পার্থক্য দেখে নির্ণয় করা হয় এই দুটো প্রজাতি একে অপরের সাথে কতটা ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত।
আর্কিয়া: এস্ট্রোবায়োলজির একটি মডেল
৪ বিলিয়ন বছর পূর্বে পৃথবীর অবস্থা আজকের পৃথিবীর চেয়ে অনেক ভিন্ন ছিল। তখনকার বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের অভাব ছিল আর ওজন লেয়ারও তৈরি হয় নি যা পৃথিবীকে ক্ষতিকর বিকীরণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে। ভারি বৃষ্টিপাত, বজ্রপাত, অগ্ন্যুৎপাত খুব সাধারণ বিষয় ছিল। তারপরও এই চরম পরিবেশে প্রাথমিক কোষদের উদ্ভব হয়েছিল। আজও আর্কিয়াব্যাটেরিয়া অথবা আর্কিয়া নামের একটি এককোষী প্রাণীদের একটি গ্রুপ চরম পরিবেশে টিকে থাকতে সক্ষম।
এস্ট্রোবায়োলজিস্ট বা জোতির্জীববিজ্ঞানীগণ এখন আর্কিয়াকে পৃথিবী ও অন্য গ্রহে জীবনের উদ্ভব নিয়ে গবেষণার কাজে ব্যবহার করছেন। কারণ আর্কিয়া এমন পরিবেশে বাস করতে সক্ষম যাকে পূর্বে জীবন ধারণের জন্য অযোগ্য বলে মনে করা হত। তারা এমন কোন সূত্র দিতে পারে যেগুলো আমাদের এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল লাইফ সনাক্ত করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে। মজার বিষয় হল, সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে উঠে এসেছে যে আর্কিয়া মেটেওরাইট বা উল্কাপিণ্ডের মাধ্যমে স্পেসেও ট্রাভেল করতে সক্ষম। এরকম কোন ঘটনার দ্বারা পৃথিবীতেও প্রাণের উদ্ভব হয়ে থাকতে পারে।
তথ্যসূত্র:
Leave a Reply