বিবর্তনের ধারায় অনেক প্রাচীন আচারই পরিবর্তন হয়েছে, যেমন হয়েছে সতীদাহ প্রথা, বিধবা বিবাহ চালু বেশ কিছু সমাজ সংস্কারকের জন্য। নিন্মে কিছুটা হিন্দু সংস্কৃতির অবস্থা তুলে ধরা হলো যা দেখে সহজেই অনুমান করতে পারি আমরা কতটা বিবর্তিত হয়েছে কয়েক হাজার বছরের মধ্যে যে আমরা এই আচার সংস্কৃতি গুলো আমাদের কাছে এখন অমানবিক ।
হিন্দু ধর্মের বা আচারে জাত-পাত এর একটা বড় সমস্যা। এই সমস্যা এখনো হিন্দুরা অনুসরণ করে চলেছে। কিন্তু কেন? আর কিভাবেই বা এই জাত-পাত এই ধর্মে আসলো?
প্রশ্ন গুলোর উত্তর একটু কঠিন না হলেও হিন্দুরা তা জানতেও চায় না। হিন্দুদের বিধানেই কি সেই উচু-নিচু জাত-বেজাত এর শ্রেণী করা আছে? হয়তো আছে। তা না থাকলে তারা জানলো কিভাবে? একটা লোকাচার দিয়ে এতদুর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করতে পারে না। এবং সেই বিধানটাই বা কি? আসুন আমরা একটু আলোচনা করি।
হিন্দুদের ধারণা ‘মনু’ থেকে মানব আর মনুবাদ হচ্ছে ‘মানবতাবাদ’ বা মনুর বিধান। মনুর অনুশাসন বস্তুত হিন্দুর সংবিধান। বহুকাল ধরে বিনা প্রতিবাদে চালু থাকায় রাষ্ট্রের আইনের চেয়ে ‘মনুর’ বিধান অনেক বেশী শক্ত ও দৃঢ়মূল হয়েছে। আইনী বিচারের ক্ষেত্রে একজন বিচার প্রার্থী হয়ে আদালতে যেতে পারে। সন্তুষ্ট না হলে সে যেতে পারে হাই-কোর্টে। কিন্তু ‘মনুর’ আইনের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। এর বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ব্রাহ্মণ ও মনুবাদী সমাজ সদা নিয়োজিত। সময় পরিবর্তনের সাথে সমাজ পরিবর্তন হচ্ছে এর সাথে দেশের আইনের পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু মনুর বিধানের আইন পরিবর্তন হচ্ছে না। কারণ মনুর বিধানকে বলা হয় ব্রহ্মার মুখনিঃসৃত বিধান। যেমন ইসলাম ধর্মে ‘কোরাণ’ হচ্ছে আল্লাহর বিধান। আল্লাহর বিধান যেমন পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, তেমনি মনুর বিধানও।
ধর্মের প্রবক্তারা খুব বেশী চালাক না হলেও তাদের চেয়ে চালাক এবং ধুরন্ধর হচ্ছে এই বিধান গুলো দিয়ে যারা শাসন করে এসেছে তারা। সেই শাসকরা সাধারণ জনগণকে এতটা প্রভাবিত করেছে যে এই বিধানের বাইরে যাওয়াই সৃষ্টিকর্তাকে অমান্য করা এবং তাঁর শাস্তি মৃত্যুদন্ড।
মনুর বিধান বলতে আমরা যেটা বুঝি তা হচ্ছে ‘মনুসংহিতা’ বা ‘মনুস্মৃতি’। মনু কতজন কার পুত্র ইত্যাদিতে যাচ্ছি না। কারন সেটা অনেক হিন্দুই জানে। এর চেয়ে বরং যাওয়া যাক ‘মনুসংহিতা’য় কি কি আছে। মনুস্মৃতিতে মোট ২৬৮৪ টি শ্লোক আছে। এই শ্লোকগুলোতে সন্নিবেশিত গুরুত্বপূর্ণ বিধান গুলোর হচ্ছেঃ ক) পৃথিবীর উৎপত্তি খ) বিভিন্ন সংস্কারের নিয়ম গ) ব্রতাচারণ ঘ) বিবাহের নিয়মাবলী ঙ) অপরাধের শাস্ত্রীয় বিধি চ) শ্রাদ্ধবিধি ছ) খাদ্যাখাদ্য বিধি জ) বিভিন্ন বর্ণের কর্তব্য ঝ) বর্ণাশ্রম বিধি ঞ) স্ত্রী-পুরুষের পারস্পরিক ধর্ম ট) সম্পত্তি বন্টনের বিধি ঠ) সংকর বর্ণের বিবরণ ড) জাতিধর্ম ঢ) কুলধর্ম ণ) ব্রাহ্মণের অধিকার ও করণীয় এবং ত) রাজা-প্রজার পারস্পরিক কর্তব্য ইত্যাদি।
মোটামুটি বলা যায় হিন্দুর দৈনন্দিন সামাজিক ও ধর্মীয় কর্তব্যের অলঙ্ঘনীয় বিধি-বিধান নিয়েই ‘মনুস্মৃতি’। এগুলো চালু মনুর নামে। মনুর ধর্ম চারবর্ণ ভিত্তিক ধর্ম; মনুর মোট ২৬৮৪ শ্লোকের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আর্যদের দেবতা ব্রহ্মার পুত্র মনু তাঁর ধর্মের নাম দিয়েছেন ‘সনাতন ধর্ম’। এই ধর্মে তিনি মানুষকে চার ভাগে ভাগ করেছেন। যথাঃ ১) ব্রাহ্মণ ২) ক্ষত্রিয় ৩) বৈশ্য ও ৪) শূদ্র এর প্রথম তিনটি দ্বিজ। এই কাঠামো দ্বারা তিনি ব্রাহ্মণকে প্রকৃতপক্ষে দেবতার আসনে বসিয়ে একটি স্থায়ী বৈষম্যপূর্ণ ধর্ম প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছেন। প্রতিটি বিধানের কেন্দ্রবিন্দুতে ব্রাহ্মণ। তাঁর স্বার্থকে রক্ষা, সংহতকরার নিরঙ্কুশ করাই হচ্ছে মনুর একমাত্র উদ্দেশ্য। এর জন্য যত ধরণের নিষ্ঠুরতা দরকার মনু তা অনায়সেই করেছেন। শুরু করেছেন চার বর্ণের অলৌকিক ও অবিশ্বাস্য জন্ম কাহিনী দিয়ে।
নিম্নে একটু দেখি কোথা থেকে এই বর্ণ গুলোর জন্ম হয়ঃ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বৈশ্য ও শূদ্রের সৃষ্টি যথারীতি মুখ, বাহু, ঊরু ও পদ থেকে। কোন মানুষের জন্ম যে মুখ বাহু ঊরু ও পদ থেকে যে হয় না এ কথা মনু কি জানতেন না, তা তো বিশ্বাস করা কঠিন। তবু এমন ধরণের একটা কাজ করলেন কেন? করেছেন, করেছেন অনেক ঠান্ডা মাথায়। শুধু ব্রাহ্মণ, শূদ্র ও নারীদের সম্পর্কে মনুর বিধানগুলো জানলেই এর ঠান্ডা মস্তিকের জটিল বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যাবে।
আসুন ব্রাহ্মণদের জন্য মনু কি কি বলেছেন তা দেখে নেওয়া যাকঃ ক) স্রষ্টা ব্রাহ্মণদেরকে মুখ থেকে সৃষ্টি করেছেন ( ৩১ নং শ্লোক) খ) স্থাবর জঙ্গমাদির মধ্যে প্রাণী শ্রেষ্ঠ, প্রাণীদের মধ্যে বুদ্ধিজীবীরা শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমানদের মধ্যে মানুষ এবং মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ (৯৬ নং শ্লোক) গ) জাতমাত্রই ব্রাহ্মণ পৃথিবীতে সকল লোকের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হন এবং সকল সৃষ্টি পদার্থের ধর্মসমূহ রক্ষার জন্য তিনিই প্রভু (৯৯) ঘ) পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তাঁর সবই ব্রাহ্মণের সম্পত্তি। শ্রেষ্ঠত্ব ও অভিজাত্য হেতু ব্রাহ্মণ সবই পাওয়ার যোগ্য (১০০) ঙ) ব্রাহ্মণ নিজের অন্নই ভক্ষণ করেন, নিজের বস্ত্র পরিধান করেন এবং নিজের দ্রব্য দান করেন। অন্য লোকেরা যা ভোগ করে তা ব্রাহ্মণের দয়া হেতু করে (১০০) উক্ত শ্লোক গুলো থেকেই স্পষ্ট বুঝা যায় ব্রাহ্মণদের মনু কোথায় রেখেছেন। এবার দেখি শূদ্র সম্পর্কে মনু কি বলেনঃ ক) শূদ্র বা দাসদের নিজস্ব কোন সম্পত্তি রাখার অধিকার নেই। খ) দাস ও শূদ্রের ধন ব্রাহ্মণ অবাধে নিজের কাজে প্রয়োগ করবেন। গ) শূদ্র অর্থ সঞ্চয় করতে পারবে না। কারণ তাঁর সম্পদ থাকলে সে গর্বভরে ব্রাহ্মণের উপর অত্যাচার করতে পারে। ঘ) প্রভু কর্তৃক পরিত্যক্ত বস্ত্র, ছত্র, পাদুকা ও তোষক প্রভৃতি শূদ্র ব্যবহার করবে। ঙ) প্রভুর উচ্ছিষ্ট তাঁর ভক্ষ্য। চ) দাস বৃত্তি থেকে শূদ্রের কোন মুক্তি নেই। ছ) যজ্ঞের কোন দ্রব্য শূদ্র পাবে না। জ) ব্রাহ্মণের পরিবাদ বা নিন্দা করলে শূদ্রের জিহব্বাছেদন বিধেয়। ঝ) ব্রাহ্মণ শূদ্রের নিন্দা করলে যৎসামান্য জরিমানা দেয়। ঞ) ব্রাহ্মণ কর্তৃক শূদ্র হত্যা সামান্য পাপ। এই রুপে হত্যা পেঁচা, নকুল ও বিড়াল ইত্যাদি হত্যার সমান। ট) শূদ্র কর্তৃক ব্রাহ্মণ হত্যার বিচার মৃত্যুদণ্ড। ঠ) শূদ্র সত্য কথা বলছে কিনা তাঁর প্রমাণ হিসেবে তাকে দিব্যের আশ্রয় নিতে হবে। এতে তাকে জলন্ত অঙ্গারের ওপর দিয়ে হাটতে হয় অথবা জলে ডুবিয়ে রাখা হয়। অদগ্ধ অবস্থায় অথবা জলমগ্ন না হয়ে ফিরলে তাঁর কথা সত্য বলে বিবেচিত হবে। ড) দ্বিজকে (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য) প্রহার করলে শূদ্রের হাত কেটে ফেলা বিধেয়। ঢ) ব্রাহ্মণের সঙ্গে একাসনে বসলে তাঁর কটিদেশে তপ্তলৌহদ্বারা চিহ্ন একে তাকে নির্বাসিত করা হবে অথবা তাঁর নিতম্ব এমনভাবে ছেদন করা হবে যাতে তাঁর মৃত্যু হয়। ণ) দ্বিজের ন্যায় উপবীত বা অন্যান্য চিহ্ন ধারণ করলে শূদ্রের মৃত্যুদণ্ড বিধেয়। ত) যে পথ দিয়ে উচ্চ বর্ণের লোকেরা যাতায়াত করেন, সেই পথ শূদ্রের মৃতদেহও বহন করা যাবে না। আপনারা বলবেন এই সকল বিধান এখন হিন্দু ধর্মে মানা হয় না।
এ ধরণের উক্তি যারা এখন বলেন তারা কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে বলেন তা দেখার বিষয়। কারন গ্রামে গেলেই তা স্পষ্ট বোঝা যায় তাঁর রেস যে এখনো কাটেনি। হয়তো মৃত্যুদন্ডের মত শাস্তি নেই। কিন্তু সেই মানসিকতা এখনো উঠে যায় নি। এবার দেখা যায় নারীর বিষয় কি কি বলেছেনঃ নারী সম্পর্কেও মনুর বিধান কঠোর ও বৈষম্যমূলক। নারীর বিষয়ে কিছু গৌরবমূলক থাকলেও সাধারণভাবে মনুর দৃষ্টিতে শূদ্র এর অবস্থান থেকে কোন মতেই উচ্চ নয়। ক) স্ত্রীলোক পতিসেবা করবে। তাঁর স্বাধীন কোন সত্তা নেই। খ) নারীকে কুমারী অবস্থায় পিতা, যৌবনে স্বামী, ও বার্ধক্যে পুত্র রক্ষা করবে। গ) স্ত্রীলোকের পৃথক কোন যজ্ঞ, ব্রত বা উপবাস বিধান নেই। ঘ) স্ত্রীলোকের সাক্ষী হওয়ার বা স্বাধীনভাবে ঋণ করার অধিকার নেই। ঙ) বিধবা সাধ্বী নারী ব্রহ্মচর্য পালন করবে। এই হলো মোটামুটি হিন্দু ধর্মের বৈষম্য।
Leave a Reply