সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যক অঙ্গগুলো যেমন হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক, ইউটেরাস ইত্যাদি হয়তো শরীরের তুলনামূলক বড় বড় ও জোড়ায় জোড়ায় থাকা অঙ্গগুলোর চেয়ে অধিক ক্যন্সার প্রতিরোধী হিসেবে বিবর্তিত হয়েছে।
সম্প্রতি ট্রেন্ডস ইন ক্যান্সার জার্নালে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলে গবেষকগণ বলেছেন, মানুষ বড় ও জোড়ায় জোড়ায় থাকা অঙ্গগুলোতে ছোট ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর তুলনায় টিউমার অধিক সহজে সহ্য করতে পারে। তাই বড় বড় অঙ্গগুলোতে সম্ভবত কিছু ক্যানসার প্রতিরোধী মেকানিজম বিবর্তিত হয়েছে।
ম্যালিগনেন্ট টিউমারগুলো তুলনামূলকভাবে বড়, জোড়ায় জোড়ায় থাকা অঙ্গগুলোতে পাওয়া যায় যেই অঙ্গগুলো বেঁচে থাকা বা বংশবৃদ্ধির জন্য তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ। পূর্বের গবেষণাগুলোতে এরকম অঙ্গভিত্তিক ক্যান্সার ভিন্নতা বা অরগান স্পেসিফিক ক্যানসার ডিফারেন্স এর জন্য ধূমপানের মত এক্সটারনাল ফ্যাক্টর এবং সেই অঙ্গের কোষ বিভাজনের হারের মত ইন্টারনাল ফ্যাক্টরগুলোকে দায়ী করা হয়েছিল।
কিন্তু এক্সটারনাল ও ইন্টারনাল ফ্যাক্টরগুলো পুরোপুরিভাবে এই অঙ্গভিত্তিক ক্যনসার ভিন্নতার ব্যাখ্যা দিতে পারে না। তাই এখন গবেষকগণ একে ব্যাখ্যা করার জন্য ন্যাচারাল সিলেকশন থিওরি বা প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদের সাহায্য গ্রহণ করছেন। তারা বলছেন, ছোট ও অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গগুলোতে সামান্য কিছু টিউমার থাকলেও সেগুলোর সাথে আপস করা যায় না, যেখানে বড় বড় অঙ্গগুলো ম্যালিগনেন্ট ট্রান্সফরমেশনের বোঝা বহন করতে পারে।
গবেষকগণ বলছেন, আমরা বলছি না যে এটা আসলেই ক্যান্সারের প্রতি বিভিন্ন ধরণের অঙ্গের বিভিন্ন ধরণের সহনশীলতার একটা ব্যাখ্যা দিচ্ছে। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করছি যে, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হতে পারে। ক্যান্সার গবেষণার এই নতুন বিবর্তনীয় ব্যাখ্যাটি ক্যানসারের থেরাপিউটিক সল্যুশনের বা থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি নতুন ধারা যুক্ত করতে পারে।
হাতি এবং মানুষ
ক্যান্সারের চিকিৎসা সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার এবং চিকিৎসাপদ্ধতির অগ্রসরতা সত্ত্বেও মানুষের এই আবিষ্কারগুলো ১৯৫০ সাল থেকে এপর্যন্ত হওয়া ক্যান্সারজনিত কারণে মৃত্যুর মাত্র শতকরা ৫ ভাগ কমাতে পেরেছে। ক্যান্সারের ক্ষেত্রে চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই অনগ্রসরতা দূর হতে পারে ক্যান্সার চিকিৎসায় বিবর্তনবাদের প্রয়োগের স্বারা।
ক্যান্সারের চিকিৎসার মহৌষধ আবিষ্কারের ব্যর্থতার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে ক্যান্সারের উন্নয়ন আসলে একটি বিবর্তনগত প্রক্রিয়া। ক্যান্সারের উদ্ভব হয়েছে অর্ধ বিলিয়ন বছরেরও পূর্বে এবং এটাকে প্রাণীজগতেই প্রায় সকল ক্ষেত্রেই দেখা যায়।
ক্যান্সারের উদ্ভব প্রক্রিয়াটি এককোষী পর্যায়ের জীব থেকে বহুকোষী পর্যায়ের জীবে ইভোল্যুশনারি ট্রাঞ্জিশন বা বিবর্তনগত রূপান্তরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। বহুকোষী অবস্থার ক্ষেত্রে কোষগুলোর মধ্যে উচ্চমাত্রার সহযোগীতা এবং অনিয়ন্ত্রিত কোষবিভাজনকে দমন করার প্রয়োজন পড়ে। এই অনিয়ন্ত্রিত কোষবিভাজনকে প্রোলিফারেশন বলা হয়।
বিবর্তন প্রক্রিয়ায় অর্গানিজমগুলো ধীরে ধীরে আরও জটিল কোষ নিয়ে গঠিত হতে থাকে এবং এর ফলে বড় বড় ও দীর্ঘজীবী প্রাণীর আবির্ভাব ঘটে। এই সময়ে প্রোলিফারেশনের সম্ভাবনাও বেড়ে যায় আর এর ফলে তৈরি হয় ম্যালিগনেন্ট টিউমার তৈরির সুযোগ। সুতরাং প্রাণী যত বড় হবে আর দীর্ঘজীবী হবে তার ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও তত বেশি হবার কথা। কিন্তু প্রকৃতিতে আসলে এই ব্যাপারটির ব্যতিক্রম দেখা যায়।
হাতির এত বৃহদাকার শরীর থাকা সত্ত্বেও তাদের ক্যান্সারের হার মানুষের তুলনায় ততটা বেশি নয়। এখান থেকে বলা যায় যে হাতিদের দেহের জটিল গঠন তাদের শরীরে অধিক টিউমার দমনকারী মেকানিজমের বিবর্তন ঘটিয়েছে। একটি নতুন গবেষণায় দেখা যায় এশিয়ান ও আফ্রিকান হাতিদের দেহে একটি টিউমার প্রতিরোধকারী জিন (P53) মানুষের তুলনায় ১৫ থেকে ২০ গুণ বেশি পরিমাণে রয়েছে। গবেষণাটির লেখক জানিয়েছেন, এই এত বিশাল সংখ্যক ক্যান্সার প্রতিরোধী জিন সম্ভবত দীর্ঘজীবী এবং বৃহদাকার প্রাণীগুলোর অধিক ক্যান্সারের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে একটি মেকানিজম হিসেবে বিবর্তিত হয়েছে।
একটি বিবর্তনগত প্রক্রিয়া
একটি ক্যান্সার কোষের প্রলিফারেশন করার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে এটা কিরকম টিকে থাকতে পারবে। যেসকল কোষ লোকাল টিস্যুগুলোতে সর্বোচ্চ প্রলিফারেশন ঘটায় সেগুলোর ক্ষেত্রে পরের জেনারেশনে তাদের জিনের ছড়িয়ে দেয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে।
বর্তমান ক্যান্সার থেরাপিগুলোর একটি সাধারণ সমস্যা হল যে, এই থেরাপিগুলোর লক্ষ্য থাকে টিউমারগুলোকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্মূল করা, যাতে চিকিৎসার বিরুদ্ধে ক্যান্সারের বিবর্তনকে রোধ করা যায় এবং অঙ্গের অন্যান্য অংশে এর ছড়িয়ে পড়া বা মেটাস্ট্যাসিসকে আটকানো যায়।
ম্যাক্সিমালি এগ্রেসিভ থেরাপি বা সর্বোচ্চ আক্রমণকারী থেরাপি নামে এরকম একটি থেরাপি আছে যেখানে একই ড্রাগ এবং ডোজ অনেকগুলো সাইকেলে প্রয়োগ করা হয়। এই থেরাপিটি ছোট টিউমারগুলোর ক্ষেত্রে ভাল কাজ করতে পারবে যেগুলোতে একইরকম কোষের সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু বেশিরভাগ টিউমার কোষগুলোই হয় জটিল যা মিরিয়াড সেল নামক একটি কোষ দিয়ে দেহের ইকোসিস্টেম পালটে দেয়। এই মিরিয়াড কোষগুলো যেকোন চিকিৎসা পদ্ধতিতে সহনশীল এবং নিজেকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়।
যদি চিকিৎসার দ্বারা সবগুলো ম্যালিগনেন্ট কোষকে নির্মূল করা ব্যর্থ হয় তাহলে কিছু কিছু কোষ পালিয়ে যায় এবং বেঁচে যায়। এগুলো আরও বেশি প্রোলিফারেট করার ক্ষমতা অর্জন করে এবং আরও বেশি আক্রমণাত্মক ও ম্যালিগনেন্ট হয়ে ওঠে যার ফলে হস্ট বা রোগীর মৃত্যু হয়।
এটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, ক্যান্সার চিকিৎসায় বিবর্তনবাদ প্রয়োগ করার ফলে, বহুকোষী অর্গানিজমের টিউমার দমনের মেকানিজমকে কাজে লাগিয়ে গবেষকগণ ম্যালিগনেন্ট টিউমার এর অগ্রগতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এবং ক্যান্সার চিকিৎসার থেরাপিউটিক ফেইলিয়রগুলোকে আটকাতে পারেন।
বিবর্তনভিত্তিক থেরাপি
ক্যান্সারের ক্ষেত্রে থেরাপিগুলোতে বিবর্তনগত পথ বা ইভোল্যুশনারি এপ্রোচগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি উপায় উদ্ভাবিত হয়েছে পেস্ট কন্ট্রোল বা কীট নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যাক্টেরিয়ার এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স সম্পর্কিত জ্ঞান থেকে। এগুলো থেকে আমরা জানতে পারি যে, যদিও আমরা এন্টিবায়োটিক দ্বারা বিবর্তনরত ব্যাক্টেরিয়া অথবা পেস্টিসাইড দ্বারা বিবর্তনরত পেস্টকে পুরোপুরিভাবে নির্মূল করতে পারি না, তবুও আমরা এদের এই বিবর্তন প্রক্রিয়ার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।
ক্যান্সার গবেষণার ক্ষেত্রে এরকমই একটি থেরাপি হল এডাপ্টিভ থেরাপি। এই থেরাপিটি একটা সিম্পল এজাম্পশনকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। আর সেটা হল, যেসব টিউমারে ট্রিটমেন্ট সেন্সিটিভ সেল বা ট্রিটমেন্ট সংবেদী কোষ এবং ট্রিটমেন্ট রেজিস্টেন্ট সেল বা ট্রিটমেন্ট প্রতিরোধী কোষ থাকে, সেসব টিউমারের ক্ষেত্রে হাই-ডোজ ট্রিটমেন্ট কেবল ট্রিটমেন্ট সেন্সিটিভ সেলগুলোকে নির্মূল করবে, কিন্তু উচ্চ প্রতিরোধী কোষগুলোকে এড়িয়ে যাবে। এই কোষগুলো তখন উচ্চমাত্রায় প্রোলিফারেট করবে এবং আরও বেশি মাত্রার এগ্রেসিভ বা ক্ষতিকর ক্যান্সার তৈরি করবে।
এডাপ্টিভ থেরাপির লক্ষ্য হল এই হাই-ডোজ ট্রিটমেন্ট এর ব্যর্থতাকে এড়িয়ে সর্বনিম্ন যেটুকু প্রয়োজন (সাম্ভাব্য সর্বোচ্চ নয়) ততটুকু ডোজ দিয়ে টিউমার গ্রোথ কমিয়ে ফেলা এবং টিউমার সম্পূর্ণভাবে দূর না করে অবস্থার উন্নতি ঘটানো। এর ফলে ট্রিটমেন্ট সেন্সিটিভ সেল এবং ট্রিটমেন্ট রেজিস্টেন্ট সেল এই দুধরণের কোষই বেঁচে যায়। এই দুধরণের কোষ একই উৎস্য এবং স্থানের জন্য প্রতিযোগীতা করে। ট্রিটমেন্ট সেন্সিটিভ সেলগুলোর উপস্থিতি ক্ষতিকর ট্রিটমেন্ট রেজিস্টেন্ট সেলগুলোর বৃদ্ধি এবং প্রোলিফারেশনকে নিয়ন্ত্রণ করে।
২০০৯ সালে, এই এডাপ্টিভ থেরাপিটিকে ওভারিয়ান ক্যান্সার মাউস মডেলে পরীক্ষা করা হয়েছিল। গবেষকগণ টিউমারের বৃদ্ধি পরিমাপ করেছিলেন। দুটি পরপর করা পরিমাপে যদি দেখা যেত টিউমারের আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছে তখন গবেষকগণ কেমোথেরাপি ড্রাগ কার্বোপ্লাটিনের ডোজ বাড়িয়ে দিতেন। আর যদি আয়তন কমে যেত তাহলে তারা ড্রাগের ডোজ কমিয়ে দিতেন।
যখন হাই-ডোজ কেমোথেরাপি ট্রায়ালের সাথে এর রেজাল্ট এর তুলনা করা হল, দেখা গেল এডাপ্টিভ থেরাপির ক্ষেত্রে টিউমারের বৃদ্ধ বেশি ভালভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে এবং ইঁদুরের জীবনকালও বৃদ্ধি পেয়েছে। একই ফলাফল ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত ইঁদুরের বেলাতেও পাওয়া গেছে। এই পরীক্ষাগুলো অনেক আশা জাগাচ্ছে। কিন্তু তারপরও এডাপ্টিভ থেরাপি মানবদেহে ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণের জন্য চূড়ান্ত সমাধান এই দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আরও বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করার দরকার।
ন্যাচারাল সিলেকশন বা প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন অরগানিজমের মাঝে ক্যান্সার এড়াতে এবং ক্যান্সারের সাথে এঁটে ওঠার মেকানিজম তৈরিতে লাখ লাখ বছর সময় লেগেছে। ঠিক তেমনি বিবর্তন এর ভিত্তিতে ক্যান্সার প্রতিরোধী উপায় বের করতেও আরও বেশ কিছু সময় লাগবে। কিন্তু আশা করা যায় যে, শীঘ্রই আমরা ক্যান্সার রোধের ক্ষেত্রে একটি নতুন যুগের সূচনা করতে যাচ্ছি।
তথ্যসূত্র
1. http://www.cell.com/trends/cancer/fulltext/S2405-8033(16)30079-6
2. https://books.google.com.au/books/about/The_Emperor_of_All_Maladies.html?id=5rF_31RVTnMC&redir_esc=y
3. http://bmcbiol.biomedcentral.com/articles/10.1186/1741-7007-8-66
4. http://jama.jamanetwork.com/article.aspx?articleid=2456041
5. http://onlinelibrary.wiley.com/doi/10.1002/ps.3773/abstract
6. http://journals.plos.org/ploscompbiol/article?id=10.1371/journal.pcbi.1004493
7. http://www.nature.com/news/cancer-therapy-an-evolved-approach-1.19746
Leave a Reply