“Scientific Theory” – “বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব” আধুনিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার অন্যতম উপাদান। আজকের দিনে যত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, দৈনন্দিন জীবনে যত প্রমাণিত বিজ্ঞান আছে তার জন্ম দেখা যায় খুব সাধারণ কিছু তত্ত্ব থেকে। একটি বৈজ্ঞানিক সূত্র যতটা গুরুত্বপূর্ণ ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ একটা তত্ত্ব। বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞানের বৃহৎ আবিষ্কারগুলো একসময়কার সাদামাটা তত্ত্ব থেকেই সম্ভব হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে দেখা যাক নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব – “দুটি বস্তু একে অপরকে সর্বদা আকর্ষণ করে” এমন খুব সাধারণ একটা তত্ত্বের ফলাফল হিসাবে মানুষ আজ পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোন গ্রহে বসবাসের চিন্তা করছে।
একটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে “বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আসলে বিজ্ঞান নয়, এটির কোনো প্রমাণ নেই, এটি কিছু বৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনা মাত্র, এর কোনো ভিত্তি নেই” – আসলেই কি তাই? না। এটি একটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
প্রথম পদক্ষেপ হাইপোথিসিস বা অনুকল্প (Hypothesis)
সাধারণত প্রাকৃতিক কোনো ঘটনার বিজ্ঞান সম্মত ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সাহায্যে। একটি প্রাকৃতিক ঘটনা কেন ও কিভাবে ঘটছে তার বিজ্ঞানসম্মত কারণ খুঁজতে চান বিজ্ঞানীরা। এই ঘটনা সম্পর্কে বহুদিন ধরে পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা ও গবেষণা করে তথ্য, উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। তারপর বিভিন্ন তথ্য ও পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে একটি সাময়িক বা অস্থায়ী অনুকল্প (hypothesis) প্রস্তুত করা হয় যা ব্যাখ্যা করতে পারবে ঘটনাটিকে। একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কখনোই কোন বিজ্ঞানীর মনগড়া কথা নয়। বহু তথ্য ও পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করেই গঠিত হয় প্রত্যেকটি তত্ত্ব।
অনুকল্প তৈরি হয়ে যাবার পর রয়েছে তার সত্যায়ন। বহু তথ্যের সমন্বয়ে একটি অনুকল্প তৈরি করা হলেই এটিকে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের মর্যাদা দেয়া হয় না। একটি তত্ত্বকে বিজ্ঞান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে তাকে প্রাথমিকভাবে কমপক্ষে তিনটি শর্তের ভিত্তিতে তার যোগ্যতা যাচাই করতে হয়।
১. তত্ত্বের মূল নিয়ম গুলো যাদৃচ্ছিক (arbitrary), সরল ও কম পরিমাণে আনুষাঙ্গিক বিষয়ের উপর নির্ভরশীল হতে হবে।
২. তত্ত্বের সাহায্যে পর্যবেক্ষণকৃত ঘটনার বিশাল একটি অংশ কে নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে।
৩. তত্ত্বের সাহায্যে বহুবার এই ঘটনার পুনরাবৃত্ত ভবিষ্যৎবাণী করা যাবে যা হুবহু মিলে যাবে।
এই তিনটি শর্ত পূরণ করার পরই একটি অনুকল্প মর্যাদা পেতে পারে একটি পূর্ণাঙ্গ তত্ত্বের। আর এই তিনটি শর্ত পূরণের জন্য অনেক অনেক বার ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করা হয়-ব্যাখ্যা করা হয়, তত্ত্বের সাহায্যে ভবিষ্যৎবাণী করা হয় অনেক ঘটনার এবং ঘটে যাবার পর মেলানো হয় ভবিষ্যৎবাণীর সাথে। এরকম বার বার পরীক্ষার পর পরীক্ষা দিয়েই টিকে থাকে এক একটি তত্ত্ব, যে পরীক্ষাগুলো করাই হয়ে থাকে তত্ত্বটিকে ভুল প্রমাণিত করার জন্য।
হাইপোথিসিসের তত্ত্বের মর্যাদায় উত্তরণ
একটি হাইপোথিসিস তৈরি হবার পর তাকে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব এবং বৈজ্ঞানিক সূত্র হিসাবে আত্মপ্রকাশের জন্য বেশ কয়েকটি ধাপে বারবার পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়।
১. প্রথমেই তাকে বিজ্ঞান ও যুক্তি দিয়ে আঘাত করা হয়। সেই আঘাতে ভেঙ্গে না পড়লে সেটি নির্বাচিত হয় পরবর্তী ধাপের পরীক্ষার জন্য।
২. হাইপোথিসিস থেকে প্রাপ্ত ভবিষ্যদ্বাণী যাচাই করার জন্য কৃত্রিম পরিবেশ তৈরী করা হয় বা প্রাকৃতিক পরিবেশের ঘটনা থেকে তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়।
৩. সেটার সাথে অনুকল্প থেকে প্রাপ্ত পূর্বনির্ধারিত ভবিষ্যদ্বাণী মিলিয়ে দেখা হয় তা সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা। যদি সেটা সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় যদি বৈপরীত্য অথবা বড় পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় তবে পূর্বের অনুকল্পের ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধনপূর্বক নতুন অনুকল্প নিয়ে আসা হয় যা আবার পরিচালিত হয় প্রথম ধাপ থেকে। যদি পরীক্ষার ফলাফল ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তবে কৃত্রিম পরিবেশের পরীক্ষা অথবা প্রাকৃতিক পরিবেশের পর্যবেক্ষণের পুনরাবৃত্তি করা হয়। একাধিকবার পুনরাবৃত্তির ফলাফল না মিললে বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলে অনুকল্প বাতিল করা হয় এবং নতুন অনুকল্পের সন্ধান করা হয়। বারবার পুনরাবৃত্তির ক্ষেত্রে যদি সামঞ্জস্যপূর্ণ সঠিক ফলাফল পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রেই অনুকল্পটিকে ‘বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব’ হিসাবে গ্রহণ করা হয়।
৪. একটি অনুকল্প বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবার পর এই তত্ত্ব থেকে আরো কিছু অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। এসকল অনুসিদ্ধান্ত দ্বারা সেই প্রাকৃতিক ঘটনা ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য নতুন ঘটনাকে বারবার যথাযথ ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারলে তত্ত্বটিকে বৈজ্ঞানিক সূত্র বা scientific Law এর মর্যাদা প্রদান করা হয়।
একটি সঠিক ও প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব এরকম হাজারো পর্যবেক্ষণ ও ভবিষ্যৎবাণীর সাহায্যে প্রমাণিত হয়। একটি ভুল ভবিষ্যৎবাণী বা একটি প্রধান বিষয়ের ব্যাখ্যাহীনতা বা ভুলব্যাখ্যা কেড়ে নিতে পারে একটি তত্ত্বের বিজ্ঞান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবার মর্যাদা। আর তার এই ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করে তার স্থান নেয় আরেকটি হাইপোথিসিস, যেটি জন্ম দিতে পারে সঠিক তত্ত্বটিকে, যা হতে পারে একটি প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান। সূতরাং একটি প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বকে কোনোভাবেই প্রমাণিত বিজ্ঞানের চেয়ে কোনো অংশে ছোট করে দেখার উপায় নেই। হতেও পারে এই তত্ত্বটিই অদূর ভবিষ্যতে নিউটনের গতি সূত্রের মতই কোন বাস্তব, দৈনন্দিন ব্যবহার্য বিজ্ঞানের শিশুকাল।
স্টিফেন হকিং তার বিখ্যাত “A Brief History of Time” গ্রন্থে খুব সুন্দরভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে। তার সংজ্ঞাটি ছিল,
“A theory is a good theory if it satisfies two requirements. It must accurately describe a large class of observations on the basis of a model that contains only a few arbitrary elements, and it must make definite predictions about the results of future observations”
অর্থাৎ –
“একটা তত্ত্বকে ভাল তত্ত্ব বলা যেতে পারে যদি সে তত্ত্ব দুটি প্রয়োজন সিদ্ধ করে। অল্প কিছু স্বীকৃত নিয়মের ভিত্তিতে দাঁড় করানো কোনো মডেল যদি পর্যবেক্ষণের একটা বিরাট অংশকে নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা যায়; এবং যদি সেখান থেকে ভবিষ্যৎ পর্যবেক্ষণ সম্পর্কেও নিশ্চিত ও নির্ভুল ভবিষ্যৎবাণী করা যায়।”
এবার দেখে নেয়া যাক বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার বিভিন্ন সময়ের কিছু বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের উদাহরণ
প্রথমেই দেখুন কিছু পরিত্যাক্ত তত্ত্ব
এগুলোকে আসলে তত্ত্ব বলা যায় না। এরা পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব আকারে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি কখনোই। মডেল এবং অনুকল্প অবস্থাতেই এদের ত্রুটি ধরা পড়ে ও তত্ত্বে পরিপূর্ণতা পেতে ব্যর্থ হয়। তবে এদের তত্ত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবার ব্যর্থতা পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্ব ধারণাকে সম্পূর্ণ বাতিল করে মহাবিশ্বের নতুন ধারণা গঠনে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিলো। এদেরকে বাতিল করার মাধ্যমেই বিজ্ঞানের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিলো। বিজ্ঞানের ধারাবাহিকতায় এগুলোর ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করে এদের স্থান দখল করে নিয়েছে নতুন সংশোধিত তত্ত্ব, আর এদের স্থান হয়েছে পরিত্যাক্ত তত্ত্বের খাতায়।
১. ডাল্টনের পরমাণুর গঠন ও ইলেক্ট্রন বিন্যাস তত্ত্ব
২. আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব ও ইথার তত্ত্ব
৩. সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্ব তত্ত্ব (শুধু সৌরজগতের গ্রহ সমূহ নয়, সকল গ্রহ-নক্ষত্র তথা সমগ্র মহাবিশ্ব সূর্য কে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান)
৪. টাইকোনিয় মহাবিশ্ব তত্ত্ব
এই তত্ত্বগুলো প্রতিষ্ঠিত হবার পূর্বেই অনেকটা হাইপোথিসিস পর্যায়েই গবেষণা ও পর্যবেক্ষণলদ্ধ ফলাফল দ্বারা এদের ভুল ধরা পড়ে। ফলে এদের সংশোধিত তত্ত্ব আসার পর আর এদেরকে বিজ্ঞানের অংশ হিসাবে দেখা হয় না, কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও এদের শেখানো হয় না। “এরকম একটা তত্ত্ব থেকে শুরু” শুধু এইটুকুই বলা হয়, কখনো তাও বলা হয় না।
এখন দেখুন কিছু প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব।
এই তত্ত্বগুলো বেশ কিছুকাল আগে থেকে শুরু করে সমসাময়িক তত্ত্ব সমূহ। এই তত্ত্বগুলো আমরা কম বেশি জানি, এই তত্ত্বগুলো বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিজ্ঞান শিক্ষায় শেখানো হয়। এগুলো এখন পর্যন্ত প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের মর্যাদা পেয়ে টিকে আছে।
১. নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব (যা এখন মহাকর্ষ সূত্র নামেই পরিচিত)
২. আলোর ডুয়েল নেচার থিউরী (আলো এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অতি ক্ষুদ্র কণাদের একই সাথে কণা ও তরঙ্গের মত আচরণ)
৩. রাদারফোর্ডের পরমাণুবাদ তত্ত্ব
৪. বৃহৎ বিস্ফোরণ তত্ত্ব (যেটির পরিবর্ধিত তত্ত্ব নিয়ে বর্তমানে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা)
৫. আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব
৬. ডারউইনের বিবর্তনবাদ ও প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব
এই তত্ত্বগুলো তার সত্যতা ও নির্ভুলতা প্রমাণ করে এসেছে ও আসছে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণা, ও যথাযথ ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে। এখন পর্যন্ত কোনো যথাযথ প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যা এদের বিপরীতে যায় বা যা এদেরকে ভুল প্রমাণিত করে। বর্তমান বিজ্ঞানে কোনো প্রমাণিত সায়েন্টিফিক ফ্যাক্টের চেয়ে এদের অবস্থান নিচে নয়।
এবার পরিচিত হন কিছু একবারেই নতুন ও শিশু তত্ত্বের সাথে ,
যারা এখনো তাদের প্রাথমিক অবস্থা অর্থাৎ পর্যবেক্ষণ ও গবেষণালদ্ধ ফলাফলের উপর ভিত্তি করে একটি প্রাথমিক তত্ত্ব প্রকাশ করার কার্যক্রমের পর্যায়ে আছে।
১. স্ট্রিং তত্ত্ব ( x,y,z,t ছাড়াও আরও ছয়টি অর্থাৎ মোট দশটি পৃথক মাত্রার মহাবিশ্ব, যার বিভাজন অযোগ্য অংশ কোনো কণা নয়, অতি সরু ও লম্বা দশ মাত্রায় কম্পমান সূতার ন্যায় স্ট্রিং)
২. টাইম ট্রাভেলিং, ওয়ার্ম হোল, ও নেগেটিভ এনার্জি (আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে জন্ম নেয়া তিনটি উপ-তত্ত্ব)
৩. মাল্টিভার্স তত্ত্ব (অসংখ্য মহাবিশ্ব তত্ত্ব, বিগ ব্যাং থেকে প্রাপ্ত বর্ধিত তত্ত্ব)
৫. বিগ বাউন্স তত্ত্ব (বিগ ব্যাং তত্ত্বের খানিকটা বর্ধিত রূপ; এ তত্ত্বে বৃহৎ বিস্ফোরণ একবার ঘটেনি, ঘটেছে অসংখ্য বার এবং ঘটবেও অসংখ্য বার। প্রতিটি মহাধ্বস অর্থাৎ বিগ ক্রাঞ্চ সংঘটিত হবার সময় একত্রিত বিপুল শক্তি থেকে ঘটে আরেকটি বৃহৎ বিস্ফোরণ)
এগুলো তুলনামূলকভাবে একেবারেই নতুন এবং প্রাথমিক পর্যায়ের তত্ত্ব, অনুকল্পের বৃদ্ধ পর্যায়ও বলা যেতে পারে। এগুলোর কোনোটি সঠিক বা প্রমাণিত বিজ্ঞানের মর্যাদা পেয়ে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে কিনা তা এখনই আন্দাজ করে বলা যাচ্ছে না। আবার এমনো হতে পারে, বর্তমানের কোনো তত্ত্বের পরিপূরক ও সংশোধন হিসাবে আবির্ভূত হতে পারে এদের যে কোনো তত্ত্ব।
তথ্যসূত্র: –
A Brief History of Time – Stephen W. Hawking
The Grand Design – Stephen W. Hawking
বিশ্বাসের ভাইরাস – অভিজিৎ রায়
অবিশ্বাসের দর্শন – অভিজিৎ রায়
Youtube (HD universe channel, Through the wormhole series)
Leave a Reply