প্রাণীরা এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে যে তাদের মাঝে গড়ে উঠেছে সামাজিক হয়ে উঠার গুণ। আর সামাজিক বলেই প্রাণীরা অসুস্থ অবস্থাতেও একে অপরের পাশে অবস্থান করে। তাই অসুস্থ হলে সেবা যত্ন করতে এগিয়ে আসায় প্রাণীদের মাঝে রোগ জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতাও বৃদ্ধি পায়। যেহেতু প্রাণীরা খুব বেশি সামাজিক, সেহেতু তাদের খুব দ্রুত রোগজনকের (প্যাথোজেন) সংস্পর্শে আসা এবং আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই তাদের শক্তিশালী রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার প্রয়োজন হয়। নতুন গবেষণা বলছে আমাদের সোশিয়েবিলিটি বা সামাজিক হবার ক্ষমতা বিবর্তিত হয়েছে আমাদের মাঝের ইমিউন সিস্টেম বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে।
ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়য়ের একটি গবেষক দল প্রথমবার একটি পরীক্ষার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, ইঁদুরের সামাজিক আচরণ সরাসরি তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার সাথে জড়িত। এ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, প্রতিরক্ষা প্রণালী প্রাণীদের মাঝে সামাজিক হয়ে উঠার ক্ষেত্রে বিবর্তন ঘটাচ্ছে। অর্থাৎ, সামাজিক হয়ে উঠার অস্তিত্বের সাথে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অস্তিত্ব নির্ভরশীল। মস্তিষ্কের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স (PFC) অঞ্চল সামাজিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে। তারা আবিষ্কার করেছেন যে, এই প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স (PFC) অঞ্চল কারো অতিরিক্ত সামাজিক হওয়ার জন্য দায়ী। নেচার জার্নালে গবেষক দল একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন।
গবেষণাটিতে উঠে এসেছে যে, ইন্টারফেরন গামা (IFN-γ) নামক একটি বিশেষ অণুর ঘাটতি জনিত কারণে ইঁদুরদের মাঝে অটিজম এবং সোশ্যাল ডেফিসিট (সামাজিকতার অভাব) মত আচরণ প্রদর্শিত হয়। আরও বিশদভাবে বোঝার জন্য তারা ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রিসোনেন্স ইম্যাজিন (fMRI) স্ক্যানিং ব্যবহার করে ইঁদুরের মস্তিষ্কের কর্মকান্ড পর্বেক্ষণ করেন । তারা দেখেন যে, ইন্টারফেরন গামা (IFN-γ) অণুর অভাবে প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স (PFC) যা প্রাণীদের সামাজিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে সে অঞ্চল খুব বেশি উদ্দীপিত হয়ে উঠে। এথেকে বোঝা যায় যে মানুষ কতটা সামাজিক হবে আর কিরকম সামাজিক আচরণ করবে তা নির্ভর করবে তার মস্তিষ্কের ইন্টারফেরন গামার উপর।
মজার বিষয় হচ্ছে এই ইন্টারফেরন গামা আসলে একটা প্যাথোজেন ফাইটিং ইমিউন মলিক্যুল। প্যাথোজেন এর অর্থ হল যেসব জিনিস দেহে রোগ তৈরি করে। ইন্টারফেরন গামা হল এমন একটি ইমিউন মলিক্যুল বা রোগপ্রতিরোধকারী অণু যা প্যাথোজেনের বিরুদ্ধে কাজ করে। দেখা যায়, ইন্টারফেরন গামা (IFN-γ) অণুর তারতম্যের কারণে ইঁদুরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার তারতম্য ঘটে। এই বিষয়টি জানার পরে আরও বিশদ ব্যাখ্যা খোঁজার জন্য গবেষকগণ এই অণু বাহির থেকে ইঁদুরের মস্তিষ্কে প্রবেশ করান। তারা আবিষ্কার করেন যে, IFN-γ গামা নিউরোট্রান্সমিটারের GABA এর মাত্রা বৃদ্ধি করে। যা প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্সের নিউরনের হাইপারেক্টিভিটিকে কমিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ করে।
গবেষণার সহ লেখক জনাথন কিপিন্স মন্তব্য করেন যে, “এতকাল মস্তিষ্ক ও অ্যাডাপ্টিভ ইমিউন সিস্টেম একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করা হত এবং মস্তিষ্কে যেকোন ইমিউন একটিভিটিকে প্যাথোলজির অবদান বলে মনে করা হত। আর এখন আমরা দেখছি যে, এগুলো কেবল একে অপরের সাথে খুব ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্তই নয়, বরং আমাদের অনেক আচরণই প্যাথোজেনের (যে সব জিনিস শরীরে রোগ সৃষ্টি করে) প্রতি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার প্রতিক্রিয়ার কারণে বিবর্তিত হয়েছে”।
রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এবং সামাজিক আচরণের বৈশিষ্ট্যগুলো মধ্যে বিবর্তনীয় সংযোগ নিশ্চিত করতে গবেষকগণ পূর্ববর্তী ল্যাব পরীক্ষায় ফলের মাছি, জেব্রাফিশ এবং রোডেন্টের (তীক্ষ্ণ দাঁত বিশিষ্ট ইঁদুর) উপর পরীক্ষা করেন। চমকপ্রদ সব ব্যাপার উঠে আসে এই গবেষণার ফলে। তারা আবিষ্কার করেন যে, সামাজিক পরিবেষ্টনের ব্যাপারগুলো IFN-γ জিনের সাথে সম্পৃক্ত। পশুদের নির্জন কারাবাসে রাখার সময় এই জিনের প্রভাব খুব কম প্রদর্শিত হয়। এর মানে দাঁড়ায় যে, এই প্রজাতির জিনগত বৈশিষ্ট্য তখনই প্রদর্শিত হবে যখন তারা অন্যদের সাথে সামাজিক হবে। অর্থাৎ IFN-γ উৎপাদন করতে আপনাকে অবশ্যই সামাজিক হয়ে উঠতে হবে। নির্বিশেষে প্যাথোজেন দ্বারা আক্রান্ত হতে হবে! এই গবেষনার উপর ভিত্তি করে বলা যায়, আমাদের দৈনন্দিন আচরণ এবং ব্যক্তিত্বের জন্য দায়ী আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। অর্থাৎ দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর ব্যক্তিত্ব নির্ভর করে।
তথ্যসূত্র:
http://www.nature.com/nature/journal/vaop/ncurrent/full/nature18626.html
Leave a Reply