মানব বিবর্তনের গল্পে নতুন এক রহস্য: হোমো নালেডি

হোমো নালেডি এর ফসিল স্কাল

গত বছর একটি নতুন আবিষ্কার বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। সেই আবিষ্কারটি ছিল মানুষের পূর্বপুরুষ হোমো নালেডির (Homo naledi)। দক্ষিণ আফ্রিকার গুহা রাইজিং স্টারে হোমো নালেডির জীবাশ্ম পাওয়া যায়। জানা যায় যে, সেই গুহায় হোমো নালেডিরা তাদের নিজস্ব প্রজাতিদের মৃতদেহ সমাহিত করত।

সময়ের সাথে সাথে অন্যান্য হোমো প্রজাতির অন্যান্য পূর্বপুরুষদের সাথে এদের সাদৃশ্যের উপর ভিত্তি করে ধারণা করা হয় যে, হোমো নালেডির বয়স প্রায় ২ মিলিয়ন বছর। দেখা যায় হোমো নালেডিরা আসলে হোমো ইরেক্টাসের চেয়েও পুরোনো। হোমো ইরেক্টাস হল আমাদের অন্যতম এক পূর্বপুরুষ যাদেরকে আমরা প্রথম জটিল পাথরের সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী বলে জানতাম।   যাই হোক, জার্নাল অব হিউম্যান ইভোল্যুশন জার্নালে  এই হোমো নালেডি সম্পর্কে আবারও নতুন কিছু বলা হচ্ছে।

গবেষকদের এই নতুন টিম সাবধানে হোমো নালেডির জীবাশ্মের (জীবিত ও মৃত উভয়ের) দাঁত এবং খুলির বৈশিষ্ট্য তুলনা করেছেন। সময়ের সাথে সাথে তাদের কঙ্কাল কাঠামোর বৃদ্ধিজনিত গঠন দেখে গবেষকরা হিসাব করেছেন যে, তারা পূর্বে  হোমো নালেডিকে যতটা প্রাচীন বলে মনে করেছিলেন, এরা আসলে অত প্রাচীন নয়, এর চেয়ে অনেক নবীন।

সাইমন ফ্রেজার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন নৃতত্ত্ববিদ ও সায়েন্স নিউজের লেখক মানা ডেমবো বলেছেন, হোমো নালেডি এক মিলিয়নের চেয়ে কম বয়সী হতে পারে। সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে বলা যায়, তারা ৯,১২,০০০ বছর বয়সী।

এরকম কালানুক্রমিক ঘটনাগুলোর নতুন আবিষ্কার নিঃসন্দেহেই মানব বিবর্তনের গল্পে পরিবর্তন আনে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই নতুন আবিষ্কৃত হোমো নালেডি আমাদের ইভোল্যুশনারি ট্রির ঠিক কোন জায়গায় অবস্থান খুঁজে নেবে।

 

হোমো গণের বিভিন্ন প্রজাতির মাথার খুলির মধ্যে তুলনা
হোমো গণের বিভিন্ন প্রজাতির মাথার খুলির মধ্যে তুলনা

 

চলুন পূর্বের কিছু কথা ঝালিয়ে নেয়া যাক।

প্রায় ১.৮৯ মিলিয়ন বছর পূর্বে হোমো ইরেক্টাস প্রজাতি আফ্রিকায় বিবর্তিত হয়েছিল এবং এটি এশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপর সম্ভবত হোমো ইরেক্টাস থেকে হোমো হাইডেলবারগেনসিস (হাইডেলবার্গ মানব) প্রায় সাত লক্ষ বছর পূর্বে বিবর্তিত হয়। একটি ইউরোপিয়ান গ্রুপ থেকে হোমো নিয়ান্ডারথাল প্রজাতির (নিয়ান্ডারথাল মানব) জন্ম হয় প্রায় চার লক্ষ বছর পূর্বে। আরেকটি আফ্রিকান গ্রুপ আমাদের প্রজাতি হোমো সেপিয়েন্সে বিবর্তিত হয় প্রায় দুই লক্ষ বছর পূর্বে যা তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক।

যদি হোমো নালেডি নয় লক্ষ বার হাজার বছর পূর্বে বিবর্তিত হয়ে থাকে, তাহলে দেখা যাচ্ছে যে এটি হোমো হাইডেলবারগেনসিস এর আবির্ভাবের একটু আগে এবং হোমো ইরেক্টাসের আবির্ভাবের কিছু সময় পরেই বিবর্তিত হয়েছিল। এর শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে যে এরা হোমো ইরেক্টাস এবং হোমো হাইডেলবারগেনসিস এর কোন ইন্টারমিডিয়েট বা অন্তর্বর্তী প্রজাতি নয়। সুতরাং হোমো নালেডি কি হোমো ইরেক্টাস এবং আমাদের নিজেদের প্রজাতি হোমো সেপিয়েন্স এর একটি সিস্টার গ্রুপ? এরা কি আমাদের একটি বিবর্তনগত কাজিন যারা আমাদের লিনিয়েজেরই পাশাপাশি বিবর্তিত হয়েছে?

এর উত্তর খোঁজার জন্য, গবেষকদের দলটি “ক্ল্যাডিস্টিক এনালাইসিস” নামে একটি পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এটায় কম্পিউটার প্রোগ্রাম এবং হিউম্যান ইনপুট ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে সাম্ভাব্য বিবর্তনগত সম্পর্ক বা ইভোল্যুশনারি রিলেশনশিপ খুঁজে বের করা হয়।

 

গবেষকগণ যেসকল উপায়ে এটা করতে পারে তার মধ্যে একটি হল সিন্যাপোমরফিজ এর অস্তিত্বকে ট্র্যাক করা। সিন্যাপোমরফিজ হল সেই সব ফিজিকাল ট্রেইট বা শারীরিক বৈশিষ্ট্য যেগুলো দুটি প্রজাতি নিজেদের মধ্যে শেয়ার করে। যখন অনেকগুলো সম্ভাবনাকে কম্পিউটার সফটঅয়ারে পরীক্ষা করা হয়, তখন এটা সবচেয়ে বেশি সাম্ভাব্য বা “পারসিমোনিয়াস” ইভোল্যুশনারি ট্রি তৈরি করতে পারে। আর নতুন কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ না আসা পর্যন্ত এটাই বিজ্ঞানীদের দ্বারা গৃহীত হয়।

প্রায় সাত মিলিয়ন বছর পূর্ব থেকে বর্তমান পর্যন্ত মানুষের বিবর্তনের টাইমলাইন। হোমো গণের (লাল) উৎপত্তি হয়েছিল প্রায় ২.৮ মিলিয়ন বছর পূর্বে এবং এর থেকেই আধুনিক মানুষের উত্থান
প্রায় সাত মিলিয়ন বছর পূর্ব থেকে বর্তমান পর্যন্ত মানুষের বিবর্তনের টাইমলাইন। হোমো গণের (লাল) উৎপত্তি হয়েছিল প্রায় ২.৮ মিলিয়ন বছর পূর্বে এবং এর থেকেই আধুনিক মানুষের উত্থান

 

এখন পর্যন্ত পাওয়া সবকটি ফসিল এভিডেন্স নিয়ে ষাট হাজারটি সাম্ভাব্য ইভোল্যুশনারি ট্রি এর ক্লাডিস্টিকাল এনালাইসিসের উপর ভিত্তি করে গবেষকদের দলটি উপসংহার টানেন যে হোমো নালেডি মোটেও হোমো ইরেক্টাসের সিস্টার গ্রুপ নয়। এডিশনাল এনালাইসিসগুলো নির্ণয় করতে পারেনি যে হোমো নালেডি আমাদের নিজেদের স্পিসিজ হোমো সেপিয়েন্স, হোমো ফ্লোরেসিয়েন্সিস (হবিট মানব) অথবা হোমিনিন গ্রুপের অস্ট্রালোপিথেকাস এর কারও সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত কিনা।

এর অর্থ হল, অন্তত এখনকার জন্য হলেও হোমো নালেডি এবং আমাদের নিজেদের বিবর্তনের গল্প পুরোপুরি রহস্যময় হয়েই থাকছে।

 

তথ্যসূত্র:

  1. http://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0047248416300100
  2. http://news.nationalgeographic.com/2015/09/150915-humans-death-burial-anthropology-Homo-naledi/
  3. https://www.sciencenews.org/article/new-dating-suggests-younger-age-homo-naledi
  4. http://evolution.berkeley.edu/evolibrary/article/phylogenetics_06

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.