বি.পি.এ. বিতর্ক এবং নতুন গবেষণায় ক্যানে থাকা খাবারের সাথে বি.পি.এ. রিস্ক এর সম্পর্ক

বর্তমানে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত একটি বিষয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে। আর বিষয়টি হচ্ছে, ক্যানে থাকা খাদ্য বা ক্যানড ফুডে কতটুকু ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিকেল বিসফেনল এ বা বি.পি.এ.(BPA) আছে এবং এতে কি পরিমাণ স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে?

চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে কনজিউমার প্রোডাক্ট বা ভোক্তাপণ্যগুলোতে বিপিএ সর্বত্রই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ক্যানের লাইনিং এর ভেতরে সহ আরও বিভিন্ন জায়গায় এটা ধাতুর ক্ষয়ে যাওয়া ও ভেঙ্গে যাওয়া প্রতিরোধ এবং খাদ্যবস্তুকে সংরক্ষণ করার জন্য ব্যবহৃত হয়।

যাইহোক, সম্প্রতি এনভায়রনমেন্ট রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ক্যানড ফুডের খাদ্য গ্রহণ করার ফলে আমাদের শরীর বিপিএ দ্বারা আক্রান্ত হয়। এছাড়াও ঠিক কোন ধরণের খাদ্যে বিপিএ ঝুঁকি কিরকম থাকে সেসম্পর্কেও ধারণা দেয়া হয়েছে গবেষণাপত্রটিতে।

গবেষণাটি বলছে ক্যানে থাকা স্যুপ এবং পাস্তা দ্বারা শরীরে সব থেকে বেশি পরিমাণে বিপিএ প্রবেশ করে। ক্যানে থাকা সবজি এবং ফলের ক্ষেত্রে এই বিপিএ কনসেন্ট্রেশন তুলনামূলকভাবে কম থাকে। আর ক্যানে থাকা বেভারেজ বা পানীয় এবং মাছ-মাংসের ক্ষেত্রে বিপিএ থাকে না।

ইউনিভারসিটি অব ক্যালগারি এর এসিস্টেন্ট প্রফেসর ডেবোরাহ কুরাশ জানান, “এই জ্ঞান ভোক্তাদেরকে কোন ক্যানড প্রোডাক্ট কিনতে হবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সহায়তা করবে। আমাদের এই গবেষণাটি থেকে জানা গেল যে ক্যানড ফুডগুলো আমাদের আমাদের শরীরে বিপিএ সংক্রমণের অন্যতম উৎস্য”।

যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৩ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ছয় বার তার চেয়ে বেশি বয়সের ৭,৬৬৯ জনের ডেটা নিয়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। এটা ন্যাশনাল হেলথ এন্ড নিউট্রিশন এক্সামিনেশন সার্ভে এর একটি অংশ ছিল। গবেষণাটিতে গবেষকগণ কোন অংশগ্রহণকারী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কি খাদ্য গ্রহণ করেছেন এবং সেই সময়ে তার মুত্রে কি পরিমাণ বিপিএ কনসেন্ট্রেশন ছিল এসব তথ্য সংরক্ষণ করেন।

স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিন এর পোস্টডক্টোরাল রিসার্চ ফেলো এবং গবেষণাপত্রটির প্রধান লেখক জেনিফার হারটল বলেন, “ইউরিনারি বিপিএ কনসেন্ট্রেশন (মুত্রে পাওয়া বিপিএ এর ঘনত্বের পরিমাণ) হল বিপিএ দ্বারা আক্রান্ত হবার নির্দেশক”। গবেষণার দ্বারা গবেষকগণ দেখেন, যেসকল লোক গতদিনে একটি ক্যানড ফুড খেয়েছেন তাদের মুত্রে ক্যানড ফুড না খাওয়া ব্যক্তিদের থেকে ২৪ শতাংশ বেশি বিপিএ কনসেন্ট্রেশন থাকে। আবার দুটি বা তার চেয়ে বেশি ক্যানড ফুড খেলে এই বিপিএ কনসেন্ট্রেশনের পরিমাণ প্রায় ৫৪ শতাংশ বেড়ে যায়। হার্টল বলেন, “এখান থেকেই আমরা ক্যানড ফুডের সাথে বিপিএ কনসেন্ট্রেশনের সম্পর্কের একটি পরিষ্কার চিত্র দেখতে পাই”।

 

মাশরুমের ক্রিম বনাম ক্যানড পিচেস

এরপর যখন গবেষকগণ কোন ধরণের ক্যানড ফুডের কারণে বিপিএ কনসেন্ট্রেশন কিরকম হয় তা নির্ণয় করা শুরু করেন, তখন তারা দেখতে পান, ক্যানড স্যুপ খাবার ফলে মুত্রে বিপিএ কনসেন্ট্রেশন ২২৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। যেখানে ক্যানড পাস্তার ফলে বিপিএ কনসেন্ট্রেশন বৃদ্ধি পায় ৭০ শতাংশ এবং ক্যানড সবজি ও ফল খেলে এটা বৃদ্ধি পায় ৪১ শতাংশ। একারণে হার্টল জানান, কেউ যদি একটি ক্যানের মাশরুম ক্রিম গ্রহণ করেন তাহলেও তিনি তিনটি ক্যানের পিচেস (একধরণের ফল) খেয়েছেন এমন ব্যক্তির তুলনায় বেশি বিপিএ দ্বারা আক্রান্ত হবেন।

কিন্তু কেন ক্যানড সুপেই অধিক পরিমাণে বিপিএ কনসেন্ট্রেশন থাকবে? হার্টল বলেন, সম্ভবত এটা খাদ্যটিকে কি পরিমাণ তাপ দেয়া হয়েছে এবং এতে কি পরিমাণ ফ্যাট উপস্থিত আছে তার উপর নির্ভর করছে। তিনি বলেন, কঠিন বা তরল হিসেবে বিক্রি হওয়া যেকোন ক্যানড স্যুপকেই দীর্ঘ সময় ধরে উত্তপ্ত করা হয় যাতে সেটা জীবাণুমুক্ত হয়। এই অধিক তাপমাত্রার ফলে অধিক বিপিএ খাদ্যের সাথে মিশে যায়। অন্যদিকে অনেক ক্যানড বেভারেজ (বিয়ার, সোডা, জ্যুস) অ্যাসিডিক হয়। ফলে তাদের প্রোসেস করার জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা ভিন্ন হয়। এতে বেশি তাপ না লাগায় খাদ্যে বিপিএ তেমন ছড়ায় না। তরল ছাড়াও কঠিন বস্তুর মধ্য দিয়েও গমণ করতে পারে। ফলে কঠিন খাদ্যগুলোতেও বিপিএ ছড়িয়ে পড়ে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হচ্ছে ক্যানড ফুডের ফ্যাট কনটেন্ট (বা ফ্যাটের পরিমাণ) এবং লাইনিং এর রাসায়নিক গঠন। বিপিএ লিপোফিলিক, অর্থাৎ এটি ফ্যাট বা চর্বির প্রতি আকৃষ্ট হয়। ফলে যেসব খাদ্যে ফ্যাট কনটেন্ট বা ফ্যাটের পরিমাণ বেশি সেসব খাদ্যে খুব সহজে বিপিএ ছড়িয়ে পড়ে।

ক্যানড ফুড দ্বারা শরীরে বিপিএ প্রবেশ করলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি কিরকম থাকে এব্যাপারে এখনও গবেশকগণ গবেষণা করছেন। চিন্তার বিষয় হচ্ছে কিভাবে এবং কি মাত্রায় বিপিএ আমাদের শরীরে হরমোনগুলোর সারা প্রদানের ক্ষেত্রে বাঁধার সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় আমাদের শরীরে এটা এস্ট্রোজেনের প্রভাবকে মিমিক বা নকল করতে পারে। আর এর মাধ্যমে এটা আমাদের শরীরের কোষগুলোকে রিপ্রোগ্রাম করতে পারে যার ফলে আমাদের শরীরে প্লেথোরা সহ নানা রকম সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। হার্টল বলেন, “শরীরে বিপিএ প্রবেশের সাথে ডায়াবেটিস, ওবেসিটি, কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিস (হৃদরোগ) সহ অনেক রকম শারীরিক সমস্যা সম্পর্কযুক্ত”।

 

বিতর্ক

গত মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এবং ব্রেস্ট ক্যানসার ফান্ড থেকে প্রকাশিত হওয়া একটি রিপোর্টে বলা হয়, গ্রোসারি শেলভগুলোর ক্যানগুলো টেস্ট করে দেখা গেছে এদের তিনটির মধ্যে দুটো ক্যানেই বিপিএ এর প্রতি পজিটিভ রেজাল্ট দেয়। নর্থ আমেরিকান মেটাল প্যাকেজিং এলায়েন্স এর চেয়ারম্যান জন রস্ট বলেন, ক্যানড ফুডের ক্ষেত্রে সর্বোপরি বিপিএ এর পরিমাণ কম থাকে। তিনি বলেন, “ভোক্তাদের জন্য এটা জানা জরুরি যে, এই সব খাদ্যে বিপিএ এক পিপিএম (পার্ট পার মিলিয়ন) এর চেয়েও কম থাকে। এটাও জেনে রাখা জরুরি যে, এফডিএ, ইউরোপিয়ান ফুদ সেফটি অথোরিটি, হেলথ ক্যানাডা এবং অন্যান্য রেগুলেটরি সংস্থাগুলো জানিয়েছে যে যেকোন বয়স ও লিঙ্গের মানুষের জন্যই বর্তমান বিপিএ এক্সপোজার নিরাপদ”।

বিশ্বের বিভিন্ন রেগুলেটর যখন নিরাপদ বিপিএ এর পরিমাণের উপর বিভিন্ন তথ্য দিচ্ছিল, তখন এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি জানায় আমাদের শরীরের প্রতি কেজি ভরের জন্য দৈনিক ৫০ মাইক্রোগ্রামের বেশি বিপিএ এক্সপোজার হওয়া উচিৎ না।

ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন এর একজন মুখপাত্র লরেন সুচার সিএনএনকে জানান, “বিপিএ এর নিরাপত্তা নিয়ে এফডিএ প্রচুর গবেষণা করেছে এবং শতশত গবেষণাপত্র পর্যালোচনা করেছে। আর এগুলোর দ্বারা এফডিএ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে ফুড প্যাকেজিংগুলোতে থাকা বিপিএ নিরাপদ। বিপিএ নিয়ে এফডিএ এর বিভিন্ন গবেষণাপত্র পর্যালোচনা এখনও চলমান”। তিনি আরও জানান, অনেক গবেষণাতেই দেখানো হয়েছে যে বিপিএ দ্বারা আমাদের ক্ষতির উচ্চ সম্ভাবনা আছে। এগুলো আসলে পক্ষপাতমূলক গবেষণা যেগুলোতে বিপিএ এর বাস্তবের চেয়েও উচ্চ কনসেন্ট্রেশনকে ফলাফল হিসেবে দেখানোর জন্য করা হয়েছে। সত্যি কথা হল, আমাদের পরিবেশের সর্বত্রই বিপিএ ছড়িয়ে আছে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এনভায়রনমেন্ট হেলথ সায়েন্স অনুসারে, যদিও প্রথম দিকে খাদ্যগ্রহণের সময় বিপিএ আমাদের শরীরে প্রবেশ করে, পরবর্তীতে বিভিন্ন বডি ফ্লুইড, বিশেষ করে মুত্রের মাধ্যমে বিপিএ আমাদের শরীর থেকে বের হয়ে যায়।

 

“এটা এমন ডেটাসেট যা আসলেই মাঠপর্যায়ের জন্য দরকারি”

যুক্তরাষ্ট্রে এই রাসায়নিক পদার্থটি আর বেবি বটলস এবং সিপি কাপে ব্যবহৃত হয় না। হার্টল বলেন, “সতেজ এবং আনপ্যাকেজড খাদ্যগ্রহনের দ্বারা সকলে তাদের বিপিএ এক্সপোজার কমিয়ে আনতে পারবেন”।

যাই হোক, শিকাগোর ইউনিভারসিটি অব ইলিনয়েস এর ইউরোলজি, ফিজিওলজি এবং এনভায়রনমেন্টাল হেলথ এর প্রফেসর গেইল প্রিনস বলেন, “নতুন এই গবেষণাটি আমাদের চলমান বিপিএ আলোচনার মধ্যে আরও প্রচুর ডেটা যুক্ত করল। বিপিএ নিয়ে অনেক সাংঘর্ষিক তথ্য উপাত্ত আছে, কিন্তু এধরণের ডেটাসেট আমাদের মনে একটি পরিষ্কার ধারণা দান করে। এটা এমন ডেটাসেট যা আসলেই মাঠপর্যায়ের জন্য দরকারি। আর এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটা পরিষ্কারভাবে আমাদের দেখাচ্ছে যে আমরা যা খাই তার ফলে আমাদের বিপিএ লেভেল পরিবর্তিত হয়”।

 

তথ্যসূত্র:

http://edition.cnn.com/2016/06/29/health/canned-foods-bpa-risk/index.html

http://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0013935116302407

http://www.bisphenol-a.org/human/herGeneralToxicity.html

http://www.cdc.gov/nchs/nhanes/

https://cfpub.epa.gov/ncea/iris2/chemicalLanding.cfm?substance_nmbr=356

http://www.fda.gov/food/ingredientspackaginglabeling/foodadditivesingredients/ucm064437.htm

http://www.niehs.nih.gov/health/topics/agents/sya-bpa/

 

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.