ধর্মের সাথে আমাদের দেশের ব্যক্তির নামের একটা সম্পর্ক খুঁজতে শুরু করেন আমাদের ধর্মপ্রাণ ভাইয়েরা। এটা অবশ্য জন্ম হতেই আমরা দেখছি। প্রণব দাস নাম শুনলেই ধরে নেওয়া হয় এই লোকটা অন্তত মুসলিম হতে পারে না।
ঠিক কতটা এই দেশের মানুষ নিজস্ব সত্ত্বা বা পরিচয় হারিয়ে ফেলে ধর্ম পরিবর্তনের সাথে সাথে তা এই বাংলাদেশের মানুষদের দিকে না তাকালে বুঝা মুশকিল হয়ে যাবে। রতন পাল যখন মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করলো হোক সেটা কোন না কোন কিছুর চাপে, তাকে আর রতন পাল নামে ডাকা যাবে না, সঙ্গে সঙ্গে রই রই পড়ে গেল নাম পাল্টানোর জন্য। নাম খোজা শুরু হলো, যাই হোক ফাইনালি কনভার্টেড ব্যক্তিই নিজের নাম কিভাবে বুঝতে না পেরে অফিসের বড় বাবু সাহায্য করলেন, রতনের আগে রাইসূল ইসলাম লাগিয়ে নাম রাখা হলো “রাইসূল ইসলাম রতন”। আগে অফিসের সকলে রতন দা বলে ডাকতো, এখন সকলেই রতন ভাই বলে। কারন ‘দা’ শব্দটা ডাকলে গুনা টাইপ কিছু হয় কি না, যা নাকি হিন্দু হিন্দু টাইপ। অর্থাৎ মুহূর্তেই রতন পাল তাদের পূর্ব বংশের সব ভুলে নতুন রুপে পৃথিবীতে আসলেন।
ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম ধর্মপ্রচারকেরা যে পরিমাণ আরবীভাষী দেশ থেকে এসেছিলেন, নিকটবর্তী হওয়ায় তার চেয়ে অধিক পরিমাণে এসেছিলেন পারস্য থেকে। সে কারণে আমাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান আরবী প্রভাবের তুলনায় ফার্সী প্রভাব বেশ দেখা যায়। মোগলদের শাসন আমলে ফার্সী রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা পেয়েছিল। ফার্সী প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা ছিল বলেই সমাজজীবনে ফার্সী অধিক বিস্তৃতি লাভ করেছিল। ব্যক্তির নামকরণসহ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের নামকরণের আরবীর তুলনায় ফার্সীর প্রভাব বেশী। যেমন খোদা, খোদা হাফেজ, নামাজ, রোজা, শবেবরাত, শবেকদর ইত্যাদি। ফার্সী ভাষায় ব্যক্তির নাম সেলিম অত্যন্ত ইতিবাচক হলেও আরবীভাষী ইরাকীরা কুকুরকে সেলিম বলে থাকে। আরবী এবং ফার্সী ভাষার পার্থক্যে ব্যক্তির নামও ভিন্ন অর্থ বহন করে।
আমাদের দেশে বর্তমানে হিন্দুদের ধর্মালম্ব্বীদের নাম এই দেশের বাংলা ভাষার অর্থ বহন করে এমন কিছু শব্দ দিয়েই রাখে যদিও ডাক নামের সাথে খাতা কলমে রেজিস্টার নাম বা প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট নাম আলাদা হয়। কিন্তু ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা নাম রাখেন মূলত আরবী বা ফার্সি শব্দে। যেমন সেলিম নামটা ফার্সী ভাষায় ইতিবাচক কিছু হলেও আরবীভাষী ইরাকীরা কুকুরকে সেলিম বলে থাকে।
অর্থাৎ বলা যায় এই দেশের মানুষেরা ইসলাম গ্রহণ করার সাথে সাথে নিজদের সমৃদ্ধ ভাষা ও সস্কৃতি সেটাকে হারিয়ে ফেলেছে হোক না সেটা পল্টু বা বল্টু ইত্যাদি, সেটাতো আমাদের পূর্বপুরুষদেরই পরিচয় বহন করে।
ইরানীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও নিজদের সমৃদ্ধ ফার্সী ভাষা-সস্কৃতি পরিত্যাগ করেনি। মুসলিম-অধ্যুষিত এবং মুসলিম রাষ্ট্র ইরানে নামাজ আদায় ব্যতীত অপর কোন ধর্মীয় আচারে আরবী ভাষার প্রচল নেই। এমনকি ইরানীদের জীবনাচারের ক্ষেত্রেও আরবী ভাষার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন।
ইরানের পার্সী ধর্মালম্বরীরা যাদের অগ্নিউপাসক বলা হয়, ধর্মীয় নিপীড়ণের মুখে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তারা ছড়িয়ে রয়েছে। ভারতবর্ষেও প্রচুর পার্সী সম্প্রদায়ের লোক সুদীর্ঘকাল যাবৎ বসবাস করে আসতেছে।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওরলাল নেহেরুর একমাত্র সন্তান প্রয়াত ইন্দিরা নিজ পছন্দে বিয়ে করেছিলেন পার্সী সম্প্রদায়ের ফিরোজ গান্ধীকে, যার বাবার নাম জাহাঙ্গীর গান্ধী। স্বামীর পদবীতে ইন্দিরা হয়ে যান ইন্দিরা গান্ধী। গান্ধী অবশ্য বণিক পদবী যা হিন্দু – পার্সী উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরাই রাখে।
ভারতের টাটা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জামশেদ টাটা পার্সী ধর্মালম্বী। বিহারে টাটানগর, জামশেদপুর তারই নামানুসারে। ফিরোজ, জাহাঙ্গীর এবং জামশেদ অগ্নিপূজারী। তবে ফার্সী ভাষার তাদের নাম দিয়ে সম্প্রদায়গত পরিচয় নির্ধারণ অসম্ভব। ফার্সী ভাষার ঐ নাম মুসলিম বিবেচনায় প্রচুর মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্যক্তির নাম ফিরোজ, জাহাঙ্গীর এবং জামশেদ রয়েছে। সম্প্রদায় ভিন্ন হলেও ফার্সী জাতিসত্তার প্রত্যেকের নাম মাতৃভাষাভিত্তিক। সেজন্য ফার্সী ভাষাভিত্তিক নাম দিয়ে সম্প্রদায়গত পরিচয় চিহ্নিত করা যায় না।
চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, মঙ্গোলিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম এবং মিয়ানমার, দুই কোরিয়াসহ এশিয়ার দেশগুলোতে কারো নামই ধর্মভিত্তিক নয়, যার যার মাতৃভাষা ভিত্তিক। একমাত্র মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের নাম আরাকান এবং আরবী-ফার্সী ভাষায় দেখা যায়।
তাহলে আমাদের দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের নাম মাতৃভাষাভিত্তিক হতে সমস্যা কোথায়? মূল কারণ হতে পারে ধর্মীয় গোড়ামী। কিন্তু কম ধার্মিক ও বেশী ধার্মিক বলে তো কোন টার্ম নেই। তাহলে কি এশিয়ার অন্যান্যদেশের মানুষেরা ধার্মিক নয়?
তথ্যসূত্র: নতুন দিগন্ত, জানু-মার্স ২০১৩ সংখ্যা
Leave a Reply