জাদু (Magic)

Table of Contents

ভূমিকা

জাদু, বা ম্যাজিক – শব্দটা শুনলেই কেমন যেন রহস্যময় লাগে, তাই না? এর মূলে আছে কিছু বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান বা কাজ, যার মাধ্যমে মানুষ ভাবে, তারা প্রকৃতির নিয়ম বা অলৌকিক শক্তিকে নিজেদের ইচ্ছেমতো চালাতে বা প্রভাবিত করতে পারবে (Hutton, 2017)। এই জাদুর জগতটাকে প্রায়শই ধর্ম বা বিজ্ঞানের জগৎ থেকে আলাদা করে দেখা হয়; এটা যেন তাদের থেকে ভিন্ন এক পথে হাঁটা (Hutton, 2017)। তবে জাদু সম্পর্কে মানুষের ধারণা কিন্তু সবসময় একরকম ছিল না। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায়, কখনও একে দেখা হয়েছে ভালো চোখে, আবার কখনও বা খুব খারাপভাবে (Bailey, 2018)। বিশেষ করে পশ্চিমা দুনিয়ায়, জাদুকে প্রায়ই জুড়ে দেওয়া হয়েছে ‘অপর’ বা ‘অন্য’ (the Other) কিছুর সাথে (Bogdan, 2012; Graham, 2018)। একে দেখা হয়েছে ভিনদেশি (foreignness) (Bailey, 2018), এমনকি আদিম (primitivism) ব্যাপার হিসেবেও (Davies, 2012)। যেন জাদু মানেই সংস্কৃতির ভিন্নতা তুলে ধরার একটা জোরালো চিহ্ন, যা আধুনিকতার ছাঁচে ঠিক খাপ খায় না (Styers, 2004)। উনিশ-বিশ শতকের দিকে পশ্চিমা পণ্ডিতরা তো প্রায় ধরেই নিয়েছিলেন যে, জাদু হলো সেকেলে বা আদিম মানসিকতার পরিচায়ক, আর এটা চর্চা করে কেবল সমাজের পিছিয়ে পড়া বা প্রান্তিক মানুষেরা (Styers, 2004)।

তবে এই ধারণার জগতে নতুন হাওয়া নিয়ে আসেন ব্রিটিশ অকাল্টিস্ট (occultist) অ্যালিস্টার ক্রাউলি (১৮৭৫-১৯৪৭)। তিনি জাদুকে (বানান করতেন ‘magick’) নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করলেন, বললেন, এটা হলো “ইচ্ছার সাথে সঙ্গতি রেখে পরিবর্তন ঘটানোর বিজ্ঞান এবং শিল্প” (the Science and Art of causing Change to occur in conformity with Will) (Crowley, 1997)। তিনি ম্যাজিক (magic) বানানটির শেষে একটা ‘k’ জুড়ে দিয়েছিলেন (‘magick’), যাতে মঞ্চে দেখানো হাতসাফাইয়ের জাদু (stage magic) থেকে তাঁর বর্ণিত গভীর সাধনার বা আনুষ্ঠানিক জাদু (ceremonial or ritual magic)-কে আলাদা করে চেনা যায় (Bogdan, 2012; Bailey, 2018)। ক্রাউলির এই ভাবনা আধুনিক জাদুচর্চার জগতে বেশ প্রভাব ফেলেছে। আজকের দিনে আধুনিক অকাল্টিজম (occultism) বা নিওপ্যাগান (neopagan) ধর্মগুলোতে, যেমন উইকা (Wicca) বা থেলিমা (Thelema)-তে, অনেক স্ব-ঘোষিত জাদুকর বা ডাইনি (witches) নিয়মিতই এই ধরনের ধর্মীয় বা আনুষ্ঠানিক জাদু (ritual magic) চর্চা করেন (Berger & Ezzy, 2007)। এমনকি ক্যাওস ম্যাজিক (chaos magic)-এর মতো নতুন ধারাতেও এর দেখা মেলে।

শব্দটির সাতকাহন: কোথা থেকে এলো ‘ম্যাজিক’?

আমরা যে ইংরেজি শব্দগুলো হরহামেশা ব্যবহার করি – ম্যাজিক (magic), মেজ (mage), ম্যাজিশিয়ান (magician) – সেগুলোর জন্ম কিন্তু ল্যাটিন শব্দ ‘ম্যাগাস’ (magus) থেকে। এই ল্যাটিন শব্দটি আবার এসেছে গ্রিক ‘মাগোস’ (μάγος) হয়ে, যার মূল শেকড় প্রোথিত প্রাচীন পারস্যের ‘মাগুশ’ (maguš) শব্দে (যেমন, চীনা ভাষায়: 巫覡 巫師, জাদুকর) (Hanegraaff, 2012; Otto & Stausberg, 2013)। ভাবছেন, ‘মাগুশ’ কোথা থেকে এলো? এর উৎস হলো প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার একটি শব্দ – ‘মেঘ’ (*megʰ-) বা ‘মাগ’ (*magh), যার সহজ অর্থ হলো “সক্ষম হওয়া”।

মজার ব্যাপার হলো, এই ফার্সি শব্দটি সম্ভবত পাড়ি জমিয়েছিল প্রাচীন চীনেও, জন্ম দিয়েছিল ‘মাগ’ (Mág) শব্দের, যার অর্থও ঐ মেজ বা শাম্যান (Mair, 2015)। শুধু তাই নয়, প্রাচীন সেমিটিক ভাষাগোষ্ঠীতেও এর দেখা মেলে। যেমন, তালমুডিক হিব্রুতে এটি হয়েছে ‘মাগোশ’ (magosh), আরামাইক ভাষায় ‘আমগুশা’ (amgusha) মানে জাদুকর, আর ক্যালডিয়ান ভাষায় ‘মাগদিম’ (maghdim) বলতে বোঝাতো জ্ঞান ও দর্শন। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী নাগাদ সিরিয়াক ভাষার ‘মাগুসাই’ (magusai) শব্দটি জাদুকর আর ভবিষ্যদ্বক্তা হিসেবে বেশ নাম (কিংবা কুখ্যাতি) কামিয়েছিল (Mair, 2015)।

প্রাচীন গ্রিসে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ আর পঞ্চম শতাব্দীর শুরুর দিকে, ‘গোয়েটিয়া’ (goetia) নামে আরেকটি শব্দের আগমন ঘটে। তবে এর কপালে জুটেছিল শুধুই দুর্নাম। যেসব আচার-অনুষ্ঠানকে গ্রিকরা প্রতারণাপূর্ণ, অদ্ভুত আর বিপজ্জনক বলে মনে করত, সেগুলোর বর্ণনাই দেওয়া হতো এই ‘গোয়েটিয়া’ শব্দটি দিয়ে (Otto & Stausberg, 2013)। বিশেষ করে, এর সাথে জড়িয়ে ছিল ডেমন (daimons) – মানে ছোটখাটো দেবদেবী বা আত্মা – এদের ডেকে এনে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনা বা কোনো বিশেষ ক্ষমতা হাসিল করার চেষ্টা। এই ধারণাটি পরবর্তী হেলেনিস্টিক যুগ পর্যন্ত বেশ ভালোভাবেই টিকে ছিল।

হেলেনিস্টিক যুগে এসে ব্যাপারটা আরও ছড়ালো। লেখকরা তখন জাদুবিদ্যা (enchantment), ডাকিনীবিদ্যা (witchcraft), মন্ত্রতন্ত্র (incantations), ভাগ্যগণনা (divination), মৃতের আত্মা নিয়ে কারবার (necromancy) আর জ্যোতিষচর্চা (astrology) – এই সবকিছুকেই ঢালাওভাবে “জাদু” (magic) বলে দাগিয়ে দিতে শুরু করেন (Graf, 1997)।

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে ল্যাটিন ভাষা এই গ্রিক অর্থটিকেই গ্রহণ করে নেয়। আর ল্যাটিনের হাত ধরেই খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে শব্দটি ঢুকে পড়ে খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বে। গোড়ার দিকের খ্রিস্টানরা (Early Christians) জাদু বলতে বুঝত ডেমন বা শয়তানের কারসাজি। তাই স্বাভাবিকভাবেই, তাদের চোখে জাদু ছিল ধর্মবিরোধী।

এরপর এলো প্রারম্ভিক আধুনিক ইউরোপের যুগ। প্রোটেস্ট্যান্টরা তখন প্রায়শই রোমান ক্যাথলিকদের আচার-অনুষ্ঠানকে জাদু বলে উড়িয়ে দিত। আবার, ষোড়শ শতাব্দীতে যখন ইউরোপীয়রা দুনিয়াজুড়ে উপনিবেশ গাড়তে শুরু করল, তখন তারা যেখানেই অ-খ্রিস্টান বিশ্বাস বা আচারের দেখা পেল, সেগুলোকে দেগে দিল ‘জাদুকরী’ (magical) বলে। অবশ্য, ঠিক একই সময়ে ইতালির মানবতাবাদী চিন্তাবিদরা ‘প্রাকৃতিক জাদু’ (natural magic) নামে একটি ধারণার জন্ম দেন এবং ‘ম্যাজিক’ শব্দটিকে একটি ইতিবাচক মোড় দেওয়ার চেষ্টা করেন। সেই থেকে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে জাদু নিয়ে এই টানাপোড়েন চলছেই – কখনও তা ভালো, কখনও মন্দ।

উনিশ শতকে এসে বিভিন্ন বিষয়ের পণ্ডিতরা জাদু শব্দটি নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করেন। কিন্তু কে কীভাবে একে সংজ্ঞায়িত করবেন, তা নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। একদল পণ্ডিত, যেমন নৃবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টেইলর (Edward Tylor) আর জেমস জি. ফ্রেজার (James G. Frazer), মনে করতেন জাদু হলো বস্তুর মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক গোপন যোগাযোগের (hidden sympathies) উপর বিশ্বাস। তাদের মতে, এই বিশ্বাসের মাধ্যমেই এক বস্তু অন্য বস্তুকে প্রভাবিত করতে পারে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, জাদু হলো বিজ্ঞানের ঠিক উল্টো পিঠ। অন্যদিকে, সমাজবিজ্ঞানী মার্সেল মাউস (Marcel Mauss) আর এমিল ডুর্খেইম (Émile Durkheim) ভিন্ন পথে হাঁটলেন। তারা বললেন, জাদু হলো ব্যক্তিগত বা গোপন আচার-অনুষ্ঠান, যা ধর্মের থেকে আলাদা। কারণ ধর্ম হলো একটি সামাজিক বা গোষ্ঠীগত ব্যাপার, যেখানে সবাই মিলেমিশে অংশগ্রহণ করে। তাদের চোখে জাদু ছিল মূলত অসামাজিক।

কিন্তু ১৯৯০ এর দশকে এসে অনেক পণ্ডিতই গবেষণার ক্ষেত্রে ‘জাদু’ শব্দটি ব্যবহার করা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন। তাদের যুক্তি ছিল, এই শব্দটি প্রায় একই ধরনের বিশ্বাস বা আচারের মধ্যে একটা কৃত্রিম দেয়াল তুলে দেয় – কোনোটাকে বলে জাদু, কোনোটাকে ধর্ম। সবচেয়ে বড় আপত্তির জায়গাটি ছিল, ‘জাদু’ শব্দটি পশ্চিমা ও খ্রিস্টান ইতিহাস থেকে উঠে আসা একটি ধারণা। এই নির্দিষ্ট চশমা দিয়ে অন্য সংস্কৃতির বিচিত্র সব বিশ্বাস ও আচারকে বিচার করাটা আসলে একপেশে এবং নিজেদের সংস্কৃতিকে একমাত্র ভাবার নামান্তর, যা একরকম এথনোসেন্ট্রিক দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল।

জাদুর রকমফের: কত পথ, কত মত

উচ্চ ও নিম্ন

জাদুবিদ্যা কি একটাই? নাকি এরও আছে নানা শাখা-প্রশাখা? ঐতিহাসিক আর নৃবিজ্ঞানীরা অন্তত দুই ধরনের জাদুর কথা বলেন: উচ্চ জাদু (high magic) আর নিম্ন জাদু (low magic) (Bailey, 2018)।

  • উচ্চ জাদু (High Magic): একে থিয়ার্জি (theurgy) বা আনুষ্ঠানিক জাদুও (ceremonial/ritual magic) বলা হয়। এটা বেশ জটিল আর নিয়মকানুনে ভরা। এর জন্য দরকার পড়ে দীর্ঘ সময় ধরে করা গভীর আচার-অনুষ্ঠান, নানা ধরনের নকশা, জিনিসপত্র (paraphernalia), যা জোগাড় করাটাও বেশ খরচসাপেক্ষ হতে পারে (Bailey, 2018)। এর লক্ষ্য থাকে আরও বড় – যেমন স্বর্গীয় শক্তিকে আকর্ষণ করা বা দেবত্বের সাথে একাত্ম হওয়া, যেমনটা রেনেসাঁর সময় থেকে ভাবা হয়েছে (Greenwood, 2000)। এই ধরনের জাদুচর্চা সাধারণত হয় ঘরের ভেতরে, লোকচক্ষুর আড়ালে (Greenwood, 2000)।

  • নিম্ন জাদু (Low Magic): এই জাদু অনেক সহজ সরল। এর দেখা মেলে সাধারণ মানুষের লোককথায় (folklore), কৃষকদের মাঝে (Greenwood, 2000)। এর জন্য লাগে না কোনও জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন, শুধু মুখে বলা ছোট ছোট মন্ত্র (spells) বা টোটকাই যথেষ্ট (Bailey, 2018)। একে অনেক সময় প্রাকৃতিক জাদুও (natural magic) বলা হয়। তবে এর সাথে প্রায়শই জড়িয়ে যায় জাদুবিদ্যা (sorcery) বা ডাকিনীবিদ্যা (witchcraft)-র মতো বিষয়গুলোও (Russell, 1972)। নিম্ন জাদুর চর্চা অনেক সময় খোলা আকাশের নিচেই হয়ে থাকে (Greenwood, 2000)।

সাদা, কালো, নাকি ধূসর: জাদুর রঙ বিচার

সাদা, কালো ও ধূসর জাদু সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে যান এখানে – সাদা জাদু, কালো জাদু, এবং ধূসর জাদু

জাদুর জগতে আবার রঙের বাছবিচারও আছে। সাদা, কালো আর ধূসর – এই তিন রঙে ভাগ করা হয় জাদুকে।

  • সাদা জাদু (White Magic): যখন ভালো উদ্দেশ্যে, অন্যের উপকার করার জন্য বা নিঃস্বার্থভাবে জাদু ব্যবহার করা হয়, তখন তাকে বলে সাদা জাদু।

  • কালো জাদু (Black Magic): ঠিক এর উল্টোটা হলো কালো জাদু। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য, অন্যের ক্ষতি করার জন্য বা কোনও খারাপ উদ্দেশ্যে যে জাদু ব্যবহার করা হয়, সেটাই কালো জাদু (Miller, 2010)। একে বলা যায় সাদা জাদুর অশুভ প্রতিপক্ষ।

  • ধূসর জাদু (Gray Magic): এমন কিছু জাদুও আছে যা ঠিক সাদা বা কালো – কোনওটাতেই পড়ে না। এগুলো হয়তো সরাসরি কারও উপকার করার জন্য করা হয় না, আবার পুরোপুরি ক্ষতি করাও এর উদ্দেশ্য থাকে না। একে বলা হয় ধূসর জাদু বা নিরপেক্ষ জাদু (neutral magic)।

তবে মুশকিল হলো, কোনটা সাদা, কোনটা কালো বা ধূসর – তা নিয়ে সবাই একমত নন। ঐতিহাসিক ওয়েন ডেভিস (Owen Davies) যেমন বলেছেন, ‘সাদা ডাইনি’ (white witch) কথাটা কিন্তু বিশ শতকের আগে তেমন শোনা যেত না (Davies, 2007)। আবার ফিল হাইন (Phil Hine) মনে করিয়ে দেন, “আসলে কে কোনটা বলছে, তার ওপর নির্ভর করে কোনটা কালো জাদু হিসেবে পরিচিতি পাবে, যেমনটা জাদুবিদ্যার অন্য অনেক ক্ষেত্রেই হয়” (Petersen, 2009)। তাই বলা যায়, জাদুর রঙ বিচার করাটা বেশ আপেক্ষিক।

ডাইনিবিদ্যা (Witchcraft): এক শব্দের নানা অর্থ

‘ডাইনিবিদ্যা’ বা উইচক্র্যাফট (witchcraft) – শব্দটা শুনলেই নানা ধারণা ভিড় করে আসে। ঐতিহাসিক রোনাল্ড হাটন (Ronald Hutton) এই শব্দটির অন্তত চারটি ভিন্ন অর্থ খুঁজে পেয়েছেন:

  • ঐতিহাসিক অর্থ: সবচেয়ে পুরোনো আর প্রচলিত ধারণা হলো, অতিপ্রাকৃত বা জাদুকরী উপায়ে অন্যের ক্ষতি করাটাই ডাইনিবিদ্যা। হাটনের মতে, এটাই এখনও সবচেয়ে বেশি প্রচলিত অর্থ (Hutton, 2017)।
  • সাধারণ অর্থ: আজকাল ভালো বা মন্দ যাই হোক না কেন, কেউ জাদু ব্যবহার করলেই তাকে ডাইনি বা ডাইনিবিদ্যার চর্চাকারী বলা হতে পারে।
  • ধর্মীয় অর্থ: আধুনিক প্যাগান ধর্ম উইকার (Wicca) অনুসারীদেরও এই নামে ডাকা হয়।
  • প্রতীকী অর্থ: কখনও কখনও এই শব্দটি দিয়ে সেইসব নারীদের বোঝানো হয় যারা পুরুষতান্ত্রিকতার বিরোধিতা করে নিজেদের স্বাধীন সত্তা প্রতিষ্ঠা করতে চান (Hutton, 2017)।

যেসব সমাজে জাদুতে বিশ্বাস বা জাদুকরী বিশ্বদর্শন (magical world view) প্রচলিত, সেখানে ডাইনিবিদ্যায় বিশ্বাসও প্রায়শই দেখা যায় (Russell, 1972)।

জাদুকর ও সমাজ: সন্দেহ আর সংঘাত: যারা জাদু চর্চা করেন বা জাদুকর হিসেবে পরিচিত, তাদের প্রায়শই সমাজের চোখে সন্দেহের পাত্র হতে হয়েছে (Bailey, 2018)। এই সন্দেহ আরও বেড়ে যায় যদি তারা এমন কোনো গোষ্ঠী থেকে আসেন যাদের সমাজ এমনিতেই বাঁকা চোখে দেখে – যেমন ভিনদেশি, নারী অথবা নিম্নবর্গের মানুষ (Bailey, 2018)। অবশ্য, যারা জাদু চর্চা করেন, তাদের অনেকেই জোর গলায় বলেন যে তাদের কাজ আসলে মানুষের ভালোর জন্য, উপকারী (beneficial) (Bailey, 2018)। কিন্তু এই দাবি আবার চিরাচরিত খ্রিস্টান ধারণার সাথে মেলে না। খ্রিস্টান ধর্মমতে, যেকোনো জাদুই খারাপ, কারণ এর পেছনে থাকে শয়তানের (demons) সাহায্য, এর উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন (Bailey, 2018)। অনেক সময় একই জাদুকরের কাজ নিয়ে সমাজে দুই রকম মনোভাবও দেখা গেছে। যেমন ইউরোপের ইতিহাসে, সরকারি কর্তৃপক্ষ প্রায়শই গ্রামের হাতুড়ে বৈদ্য বা ওঝাদের (cunning folk/traditional healers) ক্ষতিকর বলে মনে করত, কারণ তাদের কাজকে জাদু বা শয়তানের কারসাজি ভাবা হতো। অথচ গ্রামের সাধারণ মানুষ হয়তো তাদের খুব সম্মান করত, কারণ তাদের বিদ্যা বা চিকিৎসায় মানুষের উপকার হতো (Bailey, 2018)।

জাদু আর নারী: এক দীর্ঘকালীন যোগসূত্র: পশ্চিমের দেশগুলোতে জাদুর চর্চা, বিশেষ করে ক্ষতিকর জাদু, প্রায়শই নারীদের সাথে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে (Bailey, 2018)। এর একটা বড় উদাহরণ হলো ইউরোপের ডাইনি বিচার (witch trials) এর সময়কাল। তখন যাদের ডাইনি সন্দেহে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, তাদের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই ছিলেন নারী (Bailey, 2018)। এর একটা কারণ হতে পারে, সেই সময়ে নারীদের আইনি অধিকার ছিল খুব সীমিত, পুরুষ আত্মীয় ছাড়া তাদের তেমন কোনও স্বাধীন সত্তাই ছিল না (Bailey, 2018)। তাছাড়া, সমাজে প্রচলিত অনেক আচার-অনুষ্ঠান, যেমন উর্বরতা বাড়ানোর চেষ্টা বা গর্ভপাত করানোর ওষুধপত্র – যা কিনা নারীকেন্দ্রিক (female sphere) বিষয় ছিল – সেগুলোকেও জাদুর সাথে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে (Bailey, 2018)। এর পেছনে হয়তো এটাও কাজ করেছে যে, অনেক সংস্কৃতিতেই নারীদের বুদ্ধি, নৈতিকতা বা শারীরিক শক্তিতে পুরুষদের চেয়ে দুর্বল বলে মনে করা হতো (Bailey, 2018)।

ইতিহাসের পাতায় জাদু

জাদুর ধারণা বা চর্চা কিন্তু আজকের নয়। হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন সভ্যতায় এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। আসুন, ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখি কোথায় কেমন ছিল জাদুর জগৎ।

মেসোপটেমিয়া (Mesopotamia): যেখানে জাদু ছিল জীবনের অঙ্গ

প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় জাদু ছিল দৈনন্দিন জীবনেরই অংশ। নানা ধরনের আচার-অনুষ্ঠান, চিকিৎসা, এমনকি অশুভ লক্ষণ কাটানোর জন্যও জাদুর সাহায্য নেওয়া হতো। তারা এক ধরনের প্রতিরক্ষামূলক বা বৈধ জাদু (আক্কাদিয়ান ভাষায় আসিপুতু/মাস্‌মাস্‌সুতু – asiputu/masmassutu) ব্যবহার করত, যার উদ্দেশ্য ছিল মন্ত্র আর আচারের মাধ্যমে বাস্তবতাকে বদলে ফেলা। তাদের বিশ্বাস ছিল, যতসব ডেমন (demons), ভূত-প্রেত (ghosts) আর দুষ্ট জাদুকরদের (evil sorcerers) হাত থেকে বাঁচতে জাদুই একমাত্র ভরসা (Sasson, 1995)।

কেউ যদি কারও ক্ষতি করত, তবে তার আত্মার রোষানল থেকে বাঁচতে মৃতের কবরে ‘কিসপু’ (kispu) নামে খাবার বা পানীয় উৎসর্গ করা হতো (Sasson, 1995)। তাতেও কাজ না হলে, মৃতের একটা মূর্তি বানিয়ে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হতো, আর দেবতাদের কাছে আবেদন করা হতো যেন সেই আত্মাকে দূর করে দেওয়া হয় বা সে যেন পিছু ছেড়ে দেয় (Sasson, 1995)।

আবার, কেউ যদি অভিশাপ (curses) দিত, তার হাত থেকেও বাঁচতে জাদুরই শরণাপন্ন হতে হতো (Sasson, 1995)। মজার ব্যাপার হলো, মেসোপটেমীয়রা ভালো জাদু আর কালো জাদুর (Black magic) মধ্যে তেমন তফাৎ করত না। কেউ যদি অন্যের দেওয়া অবৈধ জাদুকে কাটাতে বৈধ জাদু ব্যবহার করত, সেও কিন্তু একই পদ্ধতিই অনুসরণ করত (Sasson, 1995)। পার্থক্য ছিল শুধু একটাই – অভিশাপ দেওয়া হতো গোপনে, আর তার প্রতিকার করা হতো প্রকাশ্যে, দশজনের সামনে (Sasson, 1995)। দুষ্ট জাদুকরকে শাস্তি দেওয়ার একটা বিশেষ উপায় ছিল ‘মাকলু’ (Maqlû) বা ‘দহন’। এতে অভিশপ্ত ব্যক্তি জাদুকরের একটা মূর্তি বানিয়ে রাতে সেটার বিচার করত, দোষ প্রমাণ হলে মূর্তিটা পুড়িয়ে দিত, আর বিশ্বাস করত এতেই জাদুকরের ক্ষমতা শেষ হয়ে যাবে (Sasson, 1995)।

তারা নিজেদের অজান্তে করা পাপ থেকে মুক্তি পেতেও জাদুকরী আচার পালন করত। যেমন ‘শুর্পু’ (Šurpu) বা ‘দহন’ নামে এক আচারে খেজুর, পেঁয়াজ বা উলের মতো জিনিসে নিজের পাপ স্থানান্তর করে সেগুলো পুড়িয়ে ফেলা হতো, যাতে পাপমুক্ত হওয়া যায় (Sasson, 1995)। ভালোবাসার জাদু বা বশীকরণের (love spells) মন্ত্রও ছিল অনেক। এগুলো দিয়ে কাউকে প্রেমে ফেলা, পুরোনো প্রেম জাগিয়ে তোলা, বা পুরুষদের যৌন ক্ষমতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হতো (Sasson, 1995)। এমনকি দেবতা বা স্বামীর সাথে সম্পর্ক ভালো করার জন্যও মন্ত্র ছিল (Sasson, 1995)।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, প্রাচীন মেসোপটেমীয়রা বিজ্ঞান (rational science) আর জাদুর মধ্যে কোনো দেয়াল টানেনি (Sasson, 1995; Abusch, 2002; Brown, 1995)। কেউ অসুস্থ হলে ডাক্তাররা ওষুধের পাশাপাশি জাদুমন্ত্রও পাঠ করতে বলতেন (Abusch, 2002; Brown, 1995; Sasson, 1995)। এই জাদুকরী আচারগুলো যিনি করতেন, তাকে বলা হতো ‘আশিপু’ (āšipu)। তিনি ছিলেন জাদুবিদ্যায় পারদর্শী এক বিশেষজ্ঞ (Abusch, 2002; Brown, 1995; Sasson, 1995; Kuiper, 2010)। এই পেশা বংশপরম্পরায় চলত (Sasson, 1995), আর সমাজে আশিপুদের খুব সম্মান ছিল, তারা রাজা-বাদশাহদের পরামর্শদাতাও হতেন (Sasson, 1995)। একজন আশিপু একইসাথে জাদুকর, চিকিৎসক, পুরোহিত, লেখক এবং পণ্ডিত – সবই হতে পারতেন (Sasson, 1995)।

তাদের দেবতা এনকি (Enki) (যিনি পরে ইয়া (Ea) নামেও পরিচিত হন) ছিলেন জাদু আর মন্ত্রের দেবতা। তিনি ছিলেন ‘বারু’ (bārû) আর ‘আশিপু’দের রক্ষাকর্তা, সমস্ত গুপ্ত জ্ঞানের (arcane knowledge) ভাণ্ডার (Sasson, 1995; Delaporte, 2013; Abusch & Van Der Toorn, 1999)। এছাড়া মেসোপটেমীয়রা অশুভ লক্ষণেও (omens) খুব বিশ্বাস করত, তা সে চাওয়া হোক বা না চাওয়া (solicited/unsolicited), যেকোনো লক্ষণকেই তারা অত্যন্ত গুরুত্ব দিত (Sasson, 1995)।

মন্ত্র লেখা মাটির বাটি (Incantation bowls): অশুভ তাড়ানোর প্রাচীন কৌশল: অশুভ শক্তি কেন আসে আর তাদের তাড়ানো যায় কীভাবে – এই ধারণা থেকেই জন্ম নিয়েছিল এক ধরনের প্রাচীন প্রতিরক্ষামূলক জাদু, যার নাম মন্ত্র বাটি (incantation bowl) বা জাদু বাটি (magic bowls)। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতাব্দীর দিকে মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে আজকের ইরাক-ইরানের উচ্চ মেসোপটেমিয়া আর সিরিয়া অঞ্চলে এই বাটিগুলো খুব জনপ্রিয় ছিল (Noegel et al., 2010; Birmingham Museums and Art Gallery, 2013)। বাটিগুলোর ভেতরে নানা রকম মন্ত্র বা নকশা খোদাই করা থাকত। এগুলোকে উপুড় করে মাটিতে পুঁতে রাখা হতো। বিশ্বাস ছিল, এতে দুষ্ট ডেমনরা (demons) আটকা পড়বে। সাধারণত বাড়ির চৌকাঠের নিচে, উঠোনে, সদ্য মৃত ব্যক্তির ঘরের কোণে বা কবরস্থানে এগুলো রাখা হতো (Michigan Library, 2013)। এই বাটিগুলোর মধ্যে কিছু কিছু আবার ইহুদিদের জাদুকরী অনুশীলনেও (Jewish magical practice) ব্যবহৃত হতো। বিশেষ করে আরামাইক ভাষায় লেখা মন্ত্র বাটিগুলো (Aramaic incantation bowls) থেকে প্রাচীন ইহুদি জাদুবিদ্যা সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায় (Gordon, 1941; Orientalia, 1996; Montgomery; The International Standard Bible Encyclopedia; A Dictionary of biblical tradition in English literature, 1992)।

মিশর (Egypt): যেখানে ‘হেকা’ ছিল জীবনেরই নামান্তর

প্রাচীন মিশরে (যার মিশরীয় নাম ‘কেমেত’ – Kemet) জাদু ছিল ধর্ম আর সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা জাদুকে এতটাই গুরুত্ব দিত যে, এর জন্য একজন দেবতাও ছিলেন – হেকা (heka)। মিশরীয়দের লেখা অসংখ্য প্যাপিরাস আর লিপিতে এই জাদুর নিদর্শন ছড়িয়ে আছে (Bell et al.)।

আধুনিক মিশরবিদরা (Egyptology) অবশ্য ‘জাদু’ শব্দটি ব্যবহার করা নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় ভোগেন, কিন্তু প্রাচীন মিশরীয়দের নিজস্ব পরিভাষাতেই এর স্পষ্ট প্রমাণ মেলে (Ritner, 2001)। যেমন, তাদের ‘হেকা’ (heka) শব্দটিই পরবর্তী কপটিক (Coptic) ভাষায় ‘হিক’ (hik) হিসেবে টিকে ছিল। তবে ফারাওদের যুগে ‘হেকা’ শব্দটির সাথে কোনো অন্যায় বা অবৈধ কাজের ধারণা জড়িত ছিল না, যেমনটা পরে কপটিক ‘হিক’ এর ক্ষেত্রে হয়েছিল। প্রাচীন রাজত্ব (Old Kingdom) থেকে শুরু করে রোমান যুগ (Roman era) পর্যন্ত ‘হেকা’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে (Ritner, 2001)। মিশরীয়রা মনে করত ‘হেকা’ হলো এক নিরপেক্ষ শক্তি – ভালোও নয়, মন্দও নয়। এটা যেমন মিশরীয়রা ব্যবহার করত, তেমনি বিদেশিরাও করত (Ritner, 2001)। ‘Instructions for Merikare’ (মেরিকারের জন্য নির্দেশনা) নামে এক প্রাচীন লেখায় বলা হয়েছে, স্রষ্টা নিজেই মানবজাতিকে এই ‘হেকা’ শক্তি দিয়েছেন, যাতে তারা “জীবনের আকস্মিক বিপদ বা আঘাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে” (Ritner, 2001)।

মিশরে জাদু চর্চা শুধু শিক্ষিত পুরোহিতরাই করতেন না, সাধারণ নিরক্ষর কৃষক বা পশুপালকরাও এর ব্যবহার জানতেন। মন্দিরের বড় বড় আচার-অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বাড়ির ছোটখাটো ব্যক্তিগত প্রার্থনা – সবকিছুতেই ‘হেকা’র নীতি কাজ করত (Ritner, 2001)।

মিশরীয় জাদুর মূল ভিত্তি ছিল শব্দের শক্তি। তারা বিশ্বাস করত, ঠিকঠাক শব্দ উচ্চারণ করলে তা বাস্তব রূপ নিতে পারে, অর্থাৎ কথার জোরেই সৃষ্টি করা সম্ভব (Brier & Hobbs, 2009)। কারেঙ্গা (Karenga) যেমনটা বলেছেন, মিশরীয়রা মনে করত স্রষ্টা যেমন কথা দিয়ে জগৎ সৃষ্টি করেছেন (Karenga, 2006), তেমনি ‘ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি’ (snnw ntr) হিসেবে মানুষও কথার সৃজনশীল শক্তি ব্যবহার করতে পারে (Karenga, 2006)।

মৃতের বই (Book of the Dead): পরকালের ছাড়পত্র: মিশরের পঞ্চম রাজবংশের শেষ ফারাও উনাসের (Unas) পিরামিডের ভেতরের দেয়াল জুড়ে খোদাই করা আছে শত শত জাদুমন্ত্র আর নকশা। এগুলোকে বলা হয় পিরামিড টেক্সট (Pyramid Texts)। উদ্দেশ্য? যাতে ফারাও পরকালে (afterlife) নিরাপদে থাকতে পারেন, সেখানকার বিপদ আপদ থেকে বাঁচতে পারেন। এই মন্ত্রগুলো ছিল শুধুই রাজপরিবারের জন্য, সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে, লেখা হতো শুধু রাজার সমাধির ভেতরেই। কিন্তু প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন যুগে (First Intermediate Period) যখন মিশরে অরাজকতা চলছিল, তখন সমাধি চোরেরা পিরামিডে ঢুকে এই গোপন লেখাগুলো দেখে ফেলে। ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষও এই মন্ত্রগুলো শিখতে শুরু করে। মধ্য রাজত্বের (Middle Kingdom) শুরু নাগাদ তারা নিজেদের কফিনের গায়েও একই ধরনের লেখা খোদাই করতে থাকে, এই আশায় যে ফারাওদের মতো তারাও পরকালে বেঁচে থাকার সুযোগ পাবে। এই লেখাগুলোই পরিচিতি পায় কফিন টেক্সট (Coffin Texts) নামে (Brier & Hobbs, 2009)।

মিশরীয়রা বিশ্বাস করত, মৃত্যুর পর যতদিন শরীর টিকে থাকবে, ততদিন আত্মাও পরকালে বেঁচে থাকবে (Mark, 2017)। তাই তারা প্রিয়জনের মৃতদেহ মমি (mummified) করে রাখত, লিনেন কাপড়ে জড়িয়ে দিত যত্ন করে (Mark, 2017)। মৃতদেহ সমাধিতে রাখার ঠিক আগে একটা বিশেষ অনুষ্ঠান হতো, যার নাম ‘মুখ খোলার অনুষ্ঠান’ (Opening of the Mouth) (Mark, 2017)। এই অনুষ্ঠানে পুরোহিতরা কিছু জাদুকরী জিনিস দিয়ে মমির মুখের বিভিন্ন অংশ স্পর্শ করতেন। বিশ্বাস ছিল, এতে মৃতের আত্মা পরকালে দেখতে, শুনতে, স্বাদ নিতে আর গন্ধ শুঁকতে পারবে (Mark, 2017)।

তাবিজ (Amulets): সুরক্ষার প্রাচীন কবচ: প্রাচীন মিশরে ছোট ছোট তাবিজ (amulets) বা কবচ (মিশরীয় ভাষায় ‘মেকতে’ – meket) ব্যবহারের খুব চল ছিল। জীবিত বা মৃত – সবাই এগুলো ব্যবহার করত (Teeter, 2011)। উদ্দেশ্য ছিল নানা রকম বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া আর “মহাবিশ্বের যে এক অমোঘ নিয়ম আর সুবিচার আছে, তা পুনরায় নিশ্চিত করা” (Teeter, 2011)। মিশরের প্রাগৈতিহাসিক বদরিয়ান যুগ (Badarian Period) থেকে শুরু করে একেবারে রোমান আমল পর্যন্ত এসব তাবিজের ব্যবহার দেখা যায় (Andrews, 1994)।

জুডিয়া (Judea): যেখানে জাদু ছিল নিষিদ্ধ আবার চর্চিতও

প্রাচীন ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী, মোজেসের আইনে (Mosaic Law) জাদুবিদ্যা (কিশেফ – קֶשֶׁף), ভাগ্য গণনা (মে’ওনেন – מְעוֹנֵן), জাদু করা (মেকাশেফ – מְכַשֵּׁף), মন্ত্র পড়া (খোভের খেভের – חֹבֵר חֶבֶר) বা মৃতের আত্মা ডাকা (দোশ এল-হ্যামেটিম – דֹרֵשׁ אֶל־הַמֵּתִים) – এই সবই ছিল প্রভুর চোখে ঘৃণ্য এবং কঠোরভাবে নিষিদ্ধ (Deuteronomy 18:9–18:14)।

তাদের ধর্মীয় আইন, হালাখা (Halakha), ভবিষ্যদ্বাণী বা ওই জাতীয় ভাগ্য গণনার চর্চা নিষিদ্ধ করে। তালমুডেও (Talmud) এমন অনেক ভাগ্য গণনার কথা বলা আছে যা সমাজে চলত, কিন্তু ধর্ম সেগুলো সমর্থন করত না (Plaut & Stein, 2004)। তবে ইহুদি রহস্যবাদের (Jewish mysticism) একটি ধারা হলো ব্যবহারিক কাব্বালাহ (Practical Kabbalah), যা জাদুর ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করে। এর চর্চাকারীরা মনে করতেন, এটা এক ধরনের অনুমোদিত সাদা জাদু (white magic), তবে তা কেবল অভিজাতদের জন্য। শর্ত ছিল, এটি করতে হবে খুব পবিত্র (Q-D-Š) ও শুদ্ধ (তোমাহ ভেতাহারাহ – טומאה וטהרה) পরিবেশে, যাতে অশুভ শক্তির (qlippothic realms) ছোঁয়া না লাগে (“A Little Hebrew”, 2014)। অপবিত্র জাদুর প্রতি ইহুদি ধর্মের কঠোর মনোভাবের কারণে ব্যবহারিক কাব্বালাহ ইহুদি ইতিহাসে তেমন প্রভাবশালী হতে পারেনি। এই ধারায় তাবিজ (amulets) তৈরি বা মন্ত্র (incantations) পড়ার জন্য ঈশ্বরের বা দেবদূতদের নাম ব্যবহার করা হতো (Elber, 2006)। ইহুদি লোকধর্মে (Judaic folk religion) এই জাদুকরী চর্চাগুলো (যা পরে ব্যবহারিক কাব্বালার অংশ হয়) তালমুডের সময় থেকেই চলে আসছে (Elber, 2006)। তালমুডে রোগ সারানোর জন্য কবচ (charms) ব্যবহারের উল্লেখ আছে, এবং রাব্বিরাও (rabbis) নানা ধরনের জাদুকরী চিকিৎসার অনুমোদন দিয়েছিলেন। নিয়ম ছিল, যে উপায়ে সত্যিই রোগ সারে, তাকে কুসংস্কার বলা যাবে না। তাই যুগ যুগ ধরে ইহুদি সমাজে অসুখ-বিসুখের জন্য তাবিজ বা ঘরোয়া টোটকা (সেগুল্লোত – segullot) ব্যবহারের চল ছিল (Person, 2003)।

যদিও হিব্রু বাইবেলে (Hebrew Bible) লেভিটিকাল আইন (Levitical law) জাদু নিষিদ্ধ করেছিল, তবুও দ্বিতীয় মন্দির যুগের (Second Temple period) শেষের দিকে এর ব্যাপক চর্চা ছিল। বিশেষ করে, ৭০ খ্রিস্টাব্দে মন্দির ধ্বংসের পর থেকে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে এর প্রচুর প্রমাণ পাওয়া যায় (Belser; Bohak, 2011; Wahlen, 2004)।

গ্রেকো-রোমান বিশ্ব (Greco-Roman world): জাদু যখন ভিনদেশি ও বিপজ্জনক

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ আর পঞ্চম শতাব্দীর শুরুতে, পারস্যের ‘মাগুশ’ (maguš) শব্দটি গ্রিক ভাষায় ঢুকে পড়ে ‘মাগোস’ (μάγος) আর ‘মাগেইয়া’ (μαγεία) নামে (Otto & Stausberg, 2013)। কিন্তু এই যাত্রাপথে শব্দটার অর্থ বদলে যায়, জুটে যায় এক নেতিবাচক তকমা। ‘মাগোস’ বলতে তখন বোঝানো হতো কোনো ভণ্ড বা প্রতারককে (charlatan), যার কাজকর্মগুলো অদ্ভুত, নিয়মবহির্ভূত, আর বিপজ্জনক (Otto & Stausberg, 2013)। ঐতিহাসিক ডেভিসের (Davies) কথায়, প্রাচীন গ্রিক (এবং পরে রোমানদের) কাছে, “জাদু আসলে ধর্ম থেকে আলাদা কিছু ছিল না, বরং ছিল ধর্মেরই এক অনাকাঙ্ক্ষিত, ভুল প্রকাশ – সোজা কথায়, ‘অন্য’ লোকেদের ধর্ম” (Davies, 2012)। রিচার্ড গর্ডন (Richard Gordon) আরও বলেছেন, প্রাচীন গ্রিসে কাউকে জাদু চর্চার অভিযোগে অভিযুক্ত করাটা ছিল “এক ধরনের অপমান” করার সামিল (Gordon, 1999)।

এই অর্থ পরিবর্তনের পেছনে ছিল গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলোর সাথে বিশাল পারস্য সাম্রাজ্যের (Persian Empire) যুদ্ধবিগ্রহ (Otto & Stausberg, 2013)। সেই সময়ের লেখা, যেমন সোফোক্লিসের (Sophocles) ‘ওডিপাস রেক্স’ (Oedipus Rex), হিপোক্রেটিসের (Hippocrates) ‘ডি মরবো স্যাক্রো’ (De morbo sacro), বা গর্গিয়াসের (Gorgias) ‘এনকোমিয়াম অফ হেলেন’ (Encomium of Helen) – এগুলোতে ‘মাগোস’ শব্দটির এই নতুন ব্যবহার দেখা যায় (Otto & Stausberg, 2013)। সোফোক্লিসের নাটকে যেমন, ওডিপাস চরিত্রটি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা টাইরেসিয়াসকে (Tiresius) ব্যঙ্গ করে ‘মাগোস’ বলে ডাকে – এখানে এর মানে দাঁড়ায় হাতুড়ে বা ভণ্ড – যা থেকে বোঝা যায়, শব্দটি আর শুধু পার্সিয়ানদের জন্যই ব্যবহৃত হচ্ছিল না (Gordon, 1999; Bremmer, 2002; Bailey, 2018)।

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে, গ্রিকদের এই ‘মাগোস’ ধারণাটি ল্যাটিন ভাষায় জায়গা করে নেয় ‘ম্যাগাস’ (magus) আর ‘মাগিয়া’ (magia) নামে (Otto & Stausberg, 2013)। ল্যাটিনে এর প্রথম ব্যবহার দেখা যায় ভার্জিলের (Virgil) ‘একলগ’ (Eclogue)-এ (আনুমানিক ৪০ খ্রিস্টপূর্ব), যেখানে ‘ম্যাজিসিস স্যাক্রিস’ (magicis sacris) বা জাদুকরী আচারের কথা বলা হয়েছে (Gordon, 1999)। অবশ্য, রোমানদের অতিপ্রাকৃত শক্তির খারাপ ব্যবহারের জন্য আগে থেকেই ‘ভেনেফিকাস’ (veneficus) বা ‘সাগা’ (saga) জাতীয় শব্দ ছিল (Gordon, 1999)। তারা ‘মাগিয়া’ শব্দটিকে গ্রিকদের মতোই ব্যবহার করত, তবে এর আইনি প্রয়োগের ওপর বেশি জোর দিত (Otto & Stausberg, 2013)। রোমান সাম্রাজ্যে (Roman Empire) জাদু হিসেবে গণ্য করা কাজকর্মগুলোকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে আইনও তৈরি করা হয়েছিল (Otto & Stausberg, 2013)।

প্রাচীন রোমানরা মনে করত জাদু এসেছে পূর্বের দেশগুলো থেকে। যেমন, প্রথম শতাব্দীর লেখক প্লিনি দ্য এল্ডার (Pliny the Elder) দাবি করেছিলেন, জাদুর স্রষ্টা হলেন ইরানের দার্শনিক জোরোস্টার (Zoroaster), আর সেখান থেকে পশ্চিমে গ্রিসে এটি নিয়ে আসেন জাদুকর ওস্থানেস (Osthanes), যিনি পারস্যের রাজা জারক্সেসের (Xerxes) সেনাবাহিনীর সাথে এসেছিলেন (Davies, 2012)।

বিশ শতকের দিকে গ্রিক জাদু নিয়ে গবেষণা শুরু হলে, পণ্ডিতরা (সম্ভবত খ্রিস্টীয় ভাবধারার প্রভাবে এবং গ্রিক সংস্কৃতিকে যুক্তির ভিত্তি হিসেবে দেখানোর তাগিদে) বলতে শুরু করেন যে, গ্রিক জাদু ছিল আদিম, গুরুত্বহীন এবং হোমারীয় বা নগরকেন্দ্রিক (polis) ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু শতাব্দীর শেষের দিকে এসে এই ধারণা বদলাতে শুরু করে। যখন দেখা গেল ‘কাটাডেসমোই’ (katadesmoi) বা বাঁধন মন্ত্রের মতো জাদু (যা প্রাচীন ও আধুনিক উভয় পর্যবেক্ষকই জাদু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন) গ্রিক সমাজে কতটা প্রচলিত ও স্বাভাবিক ছিল, তখন পণ্ডিতরা তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হন (Kindt, 2012)। মজার বিষয় হলো, গ্রিক ‘মাগেউও’ (mageuo) – যার মানে জাদু চর্চা করা – শব্দটি নিজেই এসেছে ‘মাগোস’ (Magos) থেকে, যা ছিল আসলে ধর্মচর্চার জন্য পরিচিত এক পার্সিয়ান গোত্রের নাম (Copenhaver, 2015)! একইসাথে, নগরকেন্দ্রিক ধর্মের বাইরের রহস্যবাদী গোষ্ঠীগুলোকেও (mystery cults) নতুনভাবে মূল্যায়ন করা শুরু হয় (Kindt, 2012):

যে পথগুলো প্রচলিত নাগরিক আচারের বাইরে ছিল, সেগুলো শুধু মেন্যুতে নতুন কিছু যোগ করেনি, বরং… কখনও কখনও প্রচলিত নাগরিক আচার বা প্যানহেলেনিক উপকথাগুলোর সমালোচনাও করেছে, অথবা সেগুলোর সত্যিকারের বিকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে।
— সাইমন প্রাইস, রিলিজিয়নস অফ দি অ্যানসিয়েন্ট গ্রিকস (১৯৯৯) (Price, 1999)

‘কাটাডেসমোই’ (Katadesmoi) (ল্যাটিনে ‘ডেফিক্সিওনেস’ – defixiones) ছিল মোম বা সিসার পাতে খোদাই করা অভিশাপ, যা মাটির নিচে পুঁতে রাখা হতো। গ্রিক সমাজের প্রায় সব স্তরের মানুষই এটা ব্যবহার করত, কখনও কখনও পুরো শহরকে রক্ষা করার জন্যও (Kindt, 2012)। ক্লাসিক্যাল যুগের পর প্রকাশ্যে দেওয়া অভিশাপ কমে গেলেও, ব্যক্তিগত অভিশাপ প্রাচীনকাল জুড়েই চালু ছিল (Hinnells, 2009)। এগুলোকে জাদু হিসেবে চেনা যেত এদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক (individualistic), উদ্দেশ্যপ্রণোদিত (instrumental) আর কিছুটা অশুভ (sinister) ধরনের জন্য (Kindt, 2012)। এই বৈশিষ্ট্যগুলোই, আর সমাজের স্বাভাবিক নিয়ম থেকে এদের বিচ্যুতি, প্রাচীন জাদুকে সেই ধর্মীয় আচারগুলো থেকে আলাদা করে, যার অংশ হয়েও এগুলো ভিন্ন ছিল (Kindt, 2012)।

গ্রিক, কপটিক আর ডেমোটিক (Demotic) ভাষায় লেখা প্রচুর জাদুকরী প্যাপিরাস (magical papyri) পাওয়া গেছে ও অনুবাদ করা হয়েছে (Betz, 1986)। এগুলোতে আমরা প্রথমবারের মতো দেখতে পাই:

  • এমন সব জাদুকরী শব্দের (magic words) ব্যবহার, যা দিয়ে আত্মাদের আদেশ দেওয়া যায় বলে বিশ্বাস করা হতো (Lewy, 1978);
  • রহস্যময় প্রতীক (symbols) বা নকশার (sigils) ব্যবহার, যা আত্মাদের ডাকতে বা বশ করতে কাজে লাগে বলে মনে করা হতো (Betz, 1996)।

তবে রোমান সাম্রাজ্যের শেষের দিকে জাদু নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ৪৩৮ খ্রিস্টাব্দের কোডেক্স থিওডোসিয়ানাস (Codex Theodosianus)-এ পরিষ্কার বলা আছে: (Drijvers & Hunt, 1999)

যদি কোনো জাদুকর বা জাদুকরী দূষণে দুষ্ট ব্যক্তি, যাকে লোকে ম্যাজিশিয়ান বলে, আমার বা সিজারের বাহিনীতে ধরা পড়ে, তবে সে তার পদমর্যাদার দোহাই দিয়ে শাস্তি বা নির্যাতন থেকে রেহাই পাবে না।

মধ্যযুগ (Middle Ages): জাদু যখন নিন্দিত ও ভয়ংকর

মোজেসের আইনে (Mosaic Law) যেমন ভবিষ্যদ্বাণী (divination), লক্ষণ বিচার (interpretation of omens), জাদুবিদ্যা (sorcery) বা তাবিজ-কবচ (charms) ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল (Deuteronomy 18:9–18:14), তেমনি বাইবেলের রাজাদের কাহিনীতেও এগুলোকে খারাপ চোখে দেখা হয়েছে (2 Chronicles 33:1–33:9)। নতুন নিয়ম বা নিউ টেস্টামেন্টেও (New Testament) এসবের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়েছে (Acts 13:6–13:12; Galatians 5:16–5:26)।

কিছু পণ্ডিত মনে করেন, প্রথম শতাব্দীতে খ্রিস্টধর্ম যখন ছড়াচ্ছে, তখন এর লেখকরা গ্রেকো-রোমান জাদু সম্পর্কিত ধারণাগুলো নিজেদের ধর্মতত্ত্বে ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন (Otto & Stausberg, 2013)। তারা জাদু সম্পর্কে আগে থেকেই চলে আসা নেতিবাচক ধারণাগুলো বজায় রাখেন এবং ইহুদি ধারণা, বিশেষ করে জাদু আর অলৌকিক ঘটনার (miracle) মধ্যকার বিরোধিতার ধারণা যোগ করে সেগুলোকে আরও জোরালো করেন (Otto & Stausberg, 2013)। কিছু খ্রিস্টান লেখক আবার গ্রিক-রোমান চিন্তার ধারা অনুসরণ করে জাদুর উৎপত্তি মানুষ, বিশেষত জোরোস্টার বা ওস্থানেসের ঘাড়ে চাপান। তাদের মতে, জাদু হলো ব্যাবিলনীয়, পারসিক বা মিশরীয়দের সৃষ্টি (Davies, 2012)। তবে তারাও মানতেন যে জাদু আর আসল ধর্ম এক জিনিস নয়, যদিও তারা এই পার্থক্যটা নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করতেন (Bailey, 2006)।

হিপ্পোর অগাস্টিনের (Augustine of Hippo) মতো প্রভাবশালী খ্রিস্টান লেখকদের কাছে, জাদু শুধু ভণ্ডামি বা নিয়মবিরুদ্ধ আচার ছিল না, বরং ছিল ধর্মের একেবারে বিপরীত। কারণ তারা মনে করতেন, জাদু নির্ভর করে ডেমন (demons) বা শয়তানের (Satan) চেলাদের ওপর (Otto & Stausberg, 2013)। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, জাদু আর প্যাগানিজম (paganism) বা পৌত্তলিকতা হাত ধরাধরি করে চলে (Davies, 2012), আর দুটোই হলো ‘সুপারস্টিটিও’ (superstitio) বা কুসংস্কার – যে শব্দটি আবার রোমানদের কাছ থেকে ধার করা (Bailey, 2006)। ভালো ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক হিসেবে জাদুকে সহজাতভাবে অনৈতিক বা ভুল মনে করার এই খ্রিস্টান প্রবণতা সেই সময়ের অন্য বড় একেশ্বরবাদী ধর্ম – ইহুদি বা ইসলামের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর ছিল (Bailey, 2018)। যেমন, খ্রিস্টানরা যেখানে ডেমনদের পুরোপুরি শয়তান মনে করত, সেখানে ইসলামে জিনদের (jinn) দেখা হতো কিছুটা ভালো-মন্দ মেশানো চরিত্র হিসেবে (Bailey, 2018)।

খ্রিস্টানদের চোখে আদর্শ দুষ্ট জাদুকর ছিলেন সাইমন ম্যাগাস (Simon Magus) বা সাইমন দ্য ম্যাজিশিয়ান, যিনি প্রেরিতদের কার্যবিবরণী (Acts of the Apostles) এবং পিটার এর কার্যবিবরণী (Acts of Peter) উভয় গ্রন্থেই সেন্ট পিটারের বিরোধিতা করেছিলেন (Bailey, 2018)। ঐতিহাসিক মাইকেল ডি. বেইলির (Michael D. Bailey) মতে, মধ্যযুগের ইউরোপে জাদু ছিল একটা “বেশ বড় আর অনেক কিছুকে ধারণ করা একটি ধারণা” (Bailey, 2018)। খ্রিস্টান ধর্মগুরুরা বিশ্বাস করতেন, জাদু নানা ধরনের হয়, যার বেশিরভাগই ভাগ্যগণনা সম্পর্কিত। যেমন, সেভিলের ইসিডোর (Isidore of Seville) একটা তালিকা বানিয়েছিলেন যাতে ছিল চার উপাদান দিয়ে ভাগ্যগণনা – জিওম্যান্সি (geomancy), হাইড্রোম্যান্সি (hydromancy), অ্যারোম্যান্সি (aeromancy) ও পাইরোম্যান্সি (pyromancy), সেই সাথে পাখির ওড়া বা জ্যোতিষ (astrology) দেখে ভবিষ্যৎ বলা। তিনি মন্ত্রতন্ত্র (enchantment) আর লিগেচার (ligatures) (রোগীর শরীরে জাদুকরী বস্তু বেঁধে চিকিৎসা) এগুলোকেও জাদুর আওতায় ফেলেছিলেন (Kieckhefer, 2000)।

মধ্যযুগে জাদুকে আবার রাজা সলোমনের (Solomon) সাথেও যুক্ত করা হয়। নানা রকম জাদুকরী বই বা গ্রিমোয়ার (grimoires) লেখা হয়, যেগুলোতে দাবি করা হতো এগুলো সলোমনেরই লেখা, যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো ‘সলোমনের চাবি’ (Key of Solomon) (Davies, 2012)।

মধ্যযুগের শুরুর দিকে ইউরোপে ‘মাগিয়া’ (magia) শব্দটি ছিল এক ধরনের গালি বা নিন্দাসূচক শব্দ (Flint, 1991)। সেসময় খ্রিস্টানরা প্রায়শই মুসলিম বা ইহুদিদের জাদু চর্চা করার সন্দেহে দেখত (Davies, 2012; Bailey, 2018)। কখনও কখনও এই সন্দেহের বশে, যেমন ইহুদিরা খ্রিস্টান শিশু বলি দেয় এমন গুজব রটিয়ে, খ্রিস্টানরা এই সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর ওপর গণহত্যাও চালিয়েছে (Davies, 2012)। আবার খ্রিস্টানরা নিজেদের মধ্যেই এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীকে (যেমন হুসাইটদের – Hussites) ধর্মবিরোধী (heretical) আখ্যা দিয়ে জাদু চর্চার অভিযোগে অভিযুক্ত করত (Bailey, 2018; Johnson & Scribner, 1996)। এই সময়েই ‘ম্যালেফিসিয়াম’ (maleficium) শব্দটি ব্যবহৃত হতে শুরু করে সেইসব জাদুর ক্ষেত্রে যা অন্যের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে করা হতো (Bailey, 2018)। পরে ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় এই ক্ষতিকর জাদুর চর্চাকারীদের জন্য নির্দিষ্ট শব্দ তৈরি হয়: ফরাসিতে ‘সোরসিয়ের’ (sorcière), জার্মানে ‘হেক্সে’ (Hexe), ইতালীয়তে ‘স্ত্রেগা’ (strega), আর স্প্যানিশে ‘ব্রুহা’ (bruja) (Bailey, 2018)। ইংরেজিতে যে ‘উইচ’ (witch) শব্দটি ব্যবহৃত হয়, তার উৎস হলো প্রাচীন ইংরেজি শব্দ ‘উইচ্চে’ (wicce) (Bailey, 2018)।

‘আর্স ম্যাজিকা’ (Ars Magica) বা জাদু ছিল মধ্যযুগের আধ্যাত্মিক, এবং অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক, চিকিৎসার বিশ্বাস ও অনুশীলনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু আজকের দিনে জাদু নিয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, যার মূলে আছে এর রহস্যময় আচার-অনুষ্ঠান। সাধারণ মানুষের কাছে এগুলো অদ্ভুত লাগত, তাই জন্ম নিত অস্বস্তি আর অগ্রাহ্য করার প্রবণতা (Flint, 1991; Kieckhefer, 1994)।

মধ্যযুগের ইহুদিরা আবার কাব্বালার (Kabbalah) রহস্যময় জগৎকে দুটো ভাগে ভাগ করেছিল: একটা হলো নিছক জ্ঞানচর্চা আর ধ্যানের পথ (কাব্বালাহ ইয়ুনিট – Kabbalah Iyyunit), আর অন্যটা হলো থিয়ার্জিক বা প্রায়োগিক পথ (কাব্বালাহ মাআসিত – Kabbalah Ma’asit), যা জাদুকরী ক্ষমতা লাভের সাথে সম্পর্কিত। এই ভাগাভাগিটা মোটামুটি ১৪ শতকের দিকে স্পষ্ট হয় (Josephy, 1975)।

সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী খ্রিস্টান চার্চ (Christian Church) সব ধরনের জাদুকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। কারণ তাদের মতে, এটা ছিল ডিউটারোনমি ১৮:৯-১২ (Deuteronomy 18:9–12) পদে বর্ণিত অতিপ্রাকৃত উপায়ে প্রকৃতির নিয়মে হস্তক্ষেপ করার সামিল। যদিও ‘জাদু’ শব্দটির সাথে অনেক নেতিবাচক ধারণা জড়িয়ে ছিল, তবুও এর মধ্যে এমন কিছু উপাদানও ছিল যেগুলোকে পবিত্র বা ঐশ্বরিক হিসেবে দেখা হতো (Lindberg, 2007)। যেমন, ইংল্যান্ডে মনে করা হতো, রাজাদের ঐশ্বরিক অধিকার (divine right of kings) আছে, যার জোরে তারা “পবিত্র জাদু” (sacred magic) ব্যবহার করে হাজার হাজার অসুস্থ প্রজাকে সারিয়ে তুলতে পারেন (Schama, 2003)।

মধ্যযুগের জাদুতে নানা রকম জিনিস আর আচার ব্যবহার করা হতো: যেমন তাবিজ (amulets), কবচ (talismans), ওষুধ (potions), বিশেষ মন্ত্র (chants), নাচ (dances), আর প্রার্থনা (prayers)। এগুলোর সাথে আবার ডেমন (demonic participation) বা অশুভ শক্তির জড়িত থাকার ধারণাও ছিল। গ্রিক জাদুকরী প্যাপিরাস বা ‘সেফের-হা-রাজিম’ (Sefer-ha-Razim) পড়লে মনে হতে পারত যে, জাদু আসলে ডেমনরাই শিখিয়েছে বা তারাই এগুলো করায়। কারণ এই বইগুলোতে রোগ সারানোর জাদুর পাশাপাশি মানুষ খুন করা, ধনসম্পদ লাভ করা বা নারীদের বশ করার উপায়ও লেখা থাকত (Kieckhefer, 1994)। প্রত্নতত্ত্ব এখন আমাদের দেখাচ্ছে যে, জাদু শুধু দূরে কোথাও নয়, বরং মানুষের ঘরে, শরীরে, এমনকি মঠ বা গির্জার ভেতরেও চর্চা করা হতো (Gilchrist, 2008; Gilchrist, 2012)।

ইসলাম জাদুকে ঢালাওভাবে খারাপ বলেনি। তারা রোগ সারানো বা অশুভ শক্তি তাড়ানোর জাদু (যা ঈশ্বরের দান) আর অন্যের ক্ষতি করার জাদু বা জাদুবিদ্যা (sorcery) (যা জিন (Jinn) বা শয়তানের (devils) সাহায্যে করা হয়) – এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করত। ইবনে আল-নাদিম (Ibn al-Nadim) মনে করতেন, যারা ভূত ছাড়ায় (exorcists) তারা ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্যের মাধ্যমে শক্তি পায়, আর যাদুকররা শয়তানকে খুশি করে তার কাছ থেকে ক্ষমতা আদায় করে (El-Zein, 2009)। ইবনে আরাবির (Ibn Arabi) মতে, আল-হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ (Al-Ħajjāj ibn Yusuf) তার ধার্মিকতার জোরেই জলের ওপর হাঁটতে পারতেন (Lebling, 2010)! কুরআন ২:১০২ (Quran 2:102) অনুসারে, জাদু মানুষকে শিখিয়েছিল শয়তান আর হারুত (Harut) ও মারুত (Marut) নামে দুই ফেরেশতা (Nasr et al., 2015)।

মধ্যযুগ আর রেনেসাঁর ইউরোপে আরব ও ইসলামিক জাদুর প্রভাব ছিল বিশাল। ‘পিকাট্রিক্স’ (Picatrix) বা আল কিন্দির (Al Kindi) ‘ডি রেডিস’ (De Radiis) এর মতো বইগুলো ইউরোপীয় জাদুর ভিত্তি তৈরি করেছিল। আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম লেখক ছিলেন আহমদ আল-বুনি (Ahmad al-Buni), যার ‘শামস আল-মাআরিফ’ (Shams al-Ma’arif) এর মতো বইগুলো আত্মা বা জিনদের বশ করে ক্ষমতা লাভ বা ইচ্ছা পূরণের উপায় নিয়ে লেখা ছিল (Davies, 2009)। এই বইগুলো আজও ইসলামিক বিশ্বে, বিশেষ করে ‘সিমিয়্যা’ (Simiyya) নামে পরিচিত সুফি-অকাল্ট (Sufi-occult) ধারায় গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয় (Geoffroy, 2010)।

রেনেসাঁ এবং তার পরেও: নতুন আলো, নতুন অন্ধকার

ইউরোপের রেনেসাঁ যুগে জাদু নিয়ে মানুষের ভাবনায় একটা বড় পরিবর্তন আসে। ‘মাগিয়া ন্যাচারালিস’ (magia naturalis) বা প্রাকৃতিক জাদু নামে একটি নতুন ধারণার জন্ম হয় (Otto & Stausberg, 2013)। ইতালির দুই মানবতাবাদী চিন্তাবিদ – মার্সিলিও ফিচিনো (Marsilio Ficino) আর জিওভান্নি পিকো ডেলা মিরান্ডোলা (Giovanni Pico della Mirandola) – এই ধারণাটিকে সামনে নিয়ে আসেন (Otto & Stausberg, 2013)। তারা মনে করতেন, জাদু আসলে প্রকৃতির মধ্যেই লুকিয়ে থাকা এক মৌলিক শক্তি, যা নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ করে (Otto & Stausberg, 2013)। এটা ডেমনিক বা শয়তানি জাদু (demonic magic) থেকে সম্পূর্ণ আলাদা (Kieckhefer, 2000; Hanegraaff, 2012)। তাদের এই ভাবনা প্যারাসেলসাস (Paracelsus), জিওর্দানো ব্রুনো (Giordano Bruno), জোহানেস রিউচলিনদের (Johannes Reuchlin) মতো অনেক পরবর্তী দার্শনিক ও লেখককে প্রভাবিত করেছিল (Otto & Stausberg, 2013)। ঐতিহাসিক রিচার্ড কিখেফারের (Richard Kieckhefer) মতে, ১৪শ ও ১৫শ শতকে প্রাকৃতিক জাদুর ধারণা ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে বেশ শক্তভাবেই জায়গা করে নেয় (Kieckhefer, 2000), এবং অ্যারিস্টটলীয় (Aristotelians), নিওপ্লেটোনিস্ট (Neoplatonists), হারমেটিস্ট (Hermeticists) সহ নানা ঘরানার দার্শনিকদের মধ্যে আগ্রহের জন্ম দেয় (Styers, 2004)।

এই ধারার অনুসারীরা বলতেন, জাদু ভালোও হতে পারে, খারাপও হতে পারে। যেমন, ১৬২৫ সালে ফরাসি গ্রন্থাগারিক গ্যাব্রিয়েল নডে (Gabriel Naudé) তার বিখ্যাত বইতে ‘মোসাইক্যাল ম্যাজিক’ (Mosoaicall Magick) (যা তার মতে ঈশ্বর প্রদত্ত এবং যাতে ভবিষ্যদ্বাণী, অলৌকিক ঘটনা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত) আর ডেমনদের দ্বারা সৃষ্ট ‘জিওটিক’ (geotick) জাদুর মধ্যে পার্থক্য করেন (Davies, 2012)। যদিও প্রাকৃতিক জাদুর প্রবক্তারা বলতেন এটা ডেমন-নির্ভর নয়, সমালোচকরা তা মানতে নারাজ ছিলেন। তাদের মতে, ডেমনরাই আসলে এই জাদুকরদের ধোঁকা দিচ্ছে (Hanegraaff, 2006b)। ১৭শ শতকের দিকে প্রাকৃতিক জাদুর ধারণাটি ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের কাছাকাছি চলে আসে, উভয়ের মধ্যকার সীমারেখা অস্পষ্ট হতে শুরু করে (Hanegraaff, 2006b)। অবশেষে, ১৮শ শতকে আলোকিত যুগে (Age of Enlightenment) এসে প্রাকৃতিক জাদুর ধারণাটি তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে এবং এর গ্রহণযোগ্যতা হারায় (Otto & Stausberg, 2013)।

তবে জাদুকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার এই প্রচেষ্টা পশ্চিমে এর প্রতি চিরাচরিত নেতিবাচক মনোভাবকে দূর করতে পারেনি (Otto & Stausberg, 2013)। একদিকে যখন প্রাকৃতিক জাদু নিয়ে আলোচনা চলছে, ঠিক সেই সময়েই ইউরোপ জুড়ে ‘ম্যালেফিসিয়া’ (maleficia) বা ক্ষতিকর জাদুর অভিযোগে অভিযুক্ত ডাইনিদের ওপর চলছে ভয়াবহ নিপীড়ন (Styers, 2004)। জাদুর সাথে জড়িয়ে থাকা এই নেতিবাচক ধারণার কারণেই প্রোটেস্ট্যান্টরা প্রায়শই ক্যাথলিকদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে জাদু বলে কটাক্ষ করত (Styers, 2004; Davies, 2012)। আবার ক্যাথলিকরাও এই অভিযোগ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন এবং বহু বছর ধরে তাদের লেখকরা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে তাদের কার্যকলাপ ধর্মীয়, জাদুকরী নয় (Styers, 2004)। এমনকি প্রোটেস্ট্যান্টরাও নিজেদের মধ্যে এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জাদুর অভিযোগ আনত (Styers, 2004)। এভাবেই ‘জাদু’ শব্দটি ঠিক কোনটা সঠিক ধর্মীয় বিশ্বাস আর কোনটা নয়, তা নির্ধারণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল (Styers, 2004)। একই ধরনের বিতর্ক আর অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ চলছিল ইসলামিক বিশ্বেও। যেমন, ওয়াহাবিজমের (Wahhabism) প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইবনে আবদ আল-ওয়াহাব (Muhammad ibn Abd al-Wahhab) ভাগ্যগণনা বা আত্মার উপাসনার মতো বেশ কিছু প্রচলিত প্রথাকে ‘সিহর’ (sihr) বা জাদু বলে নিন্দা করেন এবং একে ‘শিরক’ (shirk) বা মূর্তিপূজার সমতুল্য পাপ বলে ঘোষণা করেন (Davies, 2012)।

রেনেসাঁ যুগ একদিকে যেমন হারমেটিসিজম (hermeticism) আর নিও-প্লেটোনিক (Neo-Platonic) আনুষ্ঠানিক জাদুর পুনর্জাগরণ দেখেছিল, তেমনি অন্যদিকে দেখেছিল বিজ্ঞানের উত্থান। মহাবিশ্ব সম্পর্কে টলেমির তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হলো, জ্যোতিষ (astrology) থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান (astronomy) আর আলকেমি (alchemy) থেকে রসায়ন (chemistry) আলাদা হয়ে গেল (Kieckhefer, 2002)।

এই সময়ে কুসংস্কার, জাদুবিদ্যা আর সত্যিকারের জ্ঞান বা ধর্মীয় আচারের মধ্যে পার্থক্য করাটা খুব কঠিন ছিল। এই বুদ্ধিবৃত্তিক আর আধ্যাত্মিক টানাপোড়েনই প্রারম্ভিক আধুনিক যুগের ডাইনি-নিধন উন্মাদনার (witch craze) জন্ম দেয়, যাকে আরও উস্কে দিয়েছিল প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারের (Protestant Reformation) অস্থিরতা, বিশেষ করে জার্মানি, ইংল্যান্ড আর স্কটল্যান্ডে (Kieckhefer, 2002)।

ইহুদি হাসিডিজমে (Hasidism) দেখা যায় আরেক ধরনের পরিবর্তন। তারা সরাসরি জাদুকরী উপায়ে কাব্বালার চর্চা থেকে সরে এসে ধ্যান আর আধ্যাত্মিক চিন্তার ওপর বেশি জোর দেয়। তাদের কাছে বস্তুগত প্রাপ্তির জন্য ধ্যানমূলক থিয়ার্জি (meditative theurgy) গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে (Idel, 1995)। হাসিডিজম কাব্বালাকে আত্মস্থ করে ডিভেইকুট (deveikut) বা ঈশ্বরের সাথে একাত্ম হওয়া এবং জাদিক (Tzadik) বা হাসিডিক গুরুর (Hasidic Rebbe) প্রতি আনুগত্যের মাধ্যমে। তাদের বিশ্বাস, জাদিক তার গভীর ধ্যান আর আত্মবিলোপের (self-nullification) মাধ্যমে ঈশ্বরের ইচ্ছা পরিবর্তন করে (আসলে ঈশ্বরের গভীরতর ইচ্ছাকে প্রকাশ করে) অনুসারীদের জন্য জাগতিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ বয়ে আনতে পারেন। মেজেরিচের ডোভ বের (Dov Ber of Mezeritch) অবশ্য জাদিকের এই ইচ্ছা দিয়ে ঐশ্বরিক ইচ্ছা পরিবর্তনের তত্ত্বকে সরাসরি জাদুকরী প্রক্রিয়া থেকে আলাদা করার চেষ্টা করেছিলেন (Weiss, 1995)।

১৬শ শতক থেকে ইউরোপীয়রা যখন দুনিয়াজুড়ে উপনিবেশ স্থাপন শুরু করে, তখন তারা তাদের বিজিত অঞ্চলের মানুষদের আচার-বিশ্বাসকে নিজেদের ‘জাদু’ আর ‘ডাইনিবিদ্যা’র ছাঁচে ফেলে বিচার করতে থাকে (Styers, 2004; Bailey, 2018)। তারা সাধারণত স্থানীয়দের আদিম, বর্বর আর তাদের বিশ্বাসকে শয়তানি মনে করত, যা নির্মূল করে খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠা করা জরুরি (Bailey, 2018)। যেহেতু তারা স্থানীয়দের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নিজেদের চেয়ে নিচু মনে করত, তাই ধরেই নিত যে এই লোকগুলো জাদুচর্চার প্রতি বেশি আগ্রহী হবে (Bailey, 2018)। স্থানীয় যে নারীরা ঐতিহ্যবাহী আচার পালন করতেন, তাদের প্রায়শই ‘ডাইনি’ বলে দেগে দেওয়া হতো (Bailey, 2018)।

অনেক ক্ষেত্রে, ইউরোপীয়দের চাপিয়ে দেওয়া এই ধারণাগুলো স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে মিশে নতুন রূপ নেয় (Bailey, 2018)। যেমন, পশ্চিম আফ্রিকায় পর্তুগিজরা তাদের ‘ফেইটিচারিয়া’ (feitiçaria) (জাদুবিদ্যা) আর ‘ফেইটিকো’ (feitiço) (মন্ত্র) শব্দগুলো নিয়ে আসে, যা স্থানীয়ভাবে ‘ফেটিশ’ (fetish) ধারণায় রূপান্তরিত হয়। পরে যখন অন্য ইউরোপীয়রা সেখানে যায়, তারা ভুল করে ভাবে ‘ফেটিশ’ বুঝি আফ্রিকানদের নিজস্ব শব্দ, তারা বুঝতেই পারেনি যে এটা আসলে আগের আন্তঃমহাদেশীয় যোগাযোগের ফল (Bailey, 2018)! কখনও আবার উপনিবেশিত লোকেরাই নিজেদের প্রয়োজনে ইউরোপীয় ধারণা ধার করেছে। যেমন, উনিশ শতকের হাইতিতে, জ্যাঁ-জ্যাক দেসালিনের (Jean-Jacques Dessalines) সরকার ভুডু (Vodou) দমন করতে শুরু করে এবং ১৮৩৫ সালের আইনে সব ভুডু চর্চাকে ‘সর্টিলেজ’ (sortilège) বা ডাইনিবিদ্যা বলে ঘোষণা করে, যেন এর সবই ক্ষতিকর। অথচ ভুডু চর্চাকারীরা ক্ষতিকর আচারকে আগে থেকেই ‘মাজি’ (maji) নামে আলাদা করে চিনত (Bailey, 2018)।

বারোক যুগ (Baroque period): জাদু যখন বিজ্ঞান ও রহস্যের সন্ধানে

ইউরোপের বারোক যুগে (মোটামুটি ১৬০০-১৭৫০ সাল) এমন কিছু কৌতূহলী ব্যক্তিত্বের দেখা মেলে যারা প্রচলিত চিন্তার বাইরে গিয়ে জাদু, আলকেমি আর রহস্যবাদের জগতে ডুব দিয়েছিলেন। পোল্যান্ডের আলকেমিস্ট মাইকেল সেন্ডিভোগিয়াস (Michael Sendivogius) জোর দিয়েছিলেন হাতে-কলমে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর। ইতালির দার্শনিক টমাসো ক্যাম্পানেলা (Tommaso Campanella) তার ‘দ্য সিটি অফ দ্য সান’ বইতে খ্রিস্টধর্ম আর রহস্যবাদ মিলিয়ে এক আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন। জার্মানির রহস্যবাদী জ্যাকব বোম (Jakob Böhme) ঈশ্বর আর মানুষের সম্পর্কের গভীর তত্ত্ব অন্বেষণ করেন। ফ্লেমিশ রসায়নবিদ জ্যান ব্যাপটিস্ট ভ্যান হেলমন্ট (Jan Baptist van Helmont) ‘গ্যাস’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন আর গাছের বৃদ্ধি নিয়ে গবেষণা করেন। অন্যদিকে, স্যার কেনেলম ডিগবি (Sir Kenelm Digby) তৈরি করেন ‘সিমপ্যাথেটিক পাউডার’ নামে এক রহস্যময় ওষুধ। এমনকি বিজ্ঞানের দিকপাল আইজ্যাক নিউটনও (Isaac Newton) আলকেমি নিয়ে মেতেছিলেন আর গুপ্তবিদ্যার বইপত্র সংগ্রহ করতেন! এই ব্যক্তিরা তাদের সময়ের জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাশাপাশি লুকানো রহস্যের প্রতি তীব্র আকর্ষণকে ধারণ করেছিলেন।

আধুনিক যুগ (Modernity): নতুন ভাবনা, নতুন বিতর্ক

উনিশ শতকে এসে জাদু সম্পর্কে ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিভঙ্গি আবার পাল্টায়। তারা আর জাদুকে পাপ বা শয়তানের কাজ হিসেবে দেখছিলেন না। বরং তাদের কাছে জাদু হয়ে দাঁড়ায় এক ধরনের “ভ্রান্ত বা অস্বাভাবিক চিন্তাধারা, যা মানসিক দুর্বলতা বা জাতিগত ও সাংস্কৃতিক নিকৃষ্টতার পরিচায়ক” (Styers, 2004)।

যেহেতু শিক্ষিত সমাজ আর জাদুতে বিশ্বাস করত না, তাই আইনও বদলে যায়। ডাইনিবিদ্যা বা শয়তানের উপাসনার মতো অপরাধে শাস্তি দেওয়ার বদলে, জাদুকরদের তখন অভিযুক্ত করা হতে থাকে প্রতারণার দায়ে – অর্থাৎ এমন কিছু দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া যা তারা আসলে দিতে পারে না (Bailey, 2018)।

ইউরোপের ঔপনিবেশিক বিস্তারও জাদু সম্পর্কে অ্যাকাডেমিক ধারণাকে প্রভাবিত করে (Styers, 2004)। উনিশ শতকের অনেক পণ্ডিতই জাদুকে নেতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখেন (Otto & Stausberg, 2013), যদিও হেলেনা ব্লাভাটস্কির (Helena Blavatsky) মতো কেউ কেউ তখন জাদুকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছিলেন (Otto & Stausberg, 2013)। কেউ কেউ আবার জাদুকে হাতিয়ার করে ধর্মের সমালোচনা করেন, বলেন যে ধর্মের মধ্যেও জাদুর মতো অনেক অযৌক্তিক উপাদান রয়ে গেছে (যেমন এইচ. এল. মেনকেন তার ‘ট্রিটিজ অন দ্য গডস’ বইতে) (Styers, 2004)। মনোবিজ্ঞানের জগতেও ‘জাদু’ শব্দটি ঢুকে পড়ে, প্রায়শই ‘কুসংস্কার’ (superstition) এর সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে (Davies, 2012)।

উনিশ ও বিশ শতকে লোককাহিনীবিদরা (folklorists) ইউরোপের গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রাচীন জাদুকরী বিশ্বাসের টিকে থাকা নিদর্শন খুঁজছিলেন (Davies, 2012)। পরে, ১৯৬০ এর দশকে জেন ফাভরেট-সাদার (Jeanne Favret-Saada) মতো নৃবিজ্ঞানীরা ইউরোপের ভেতরেও জাদুর চর্চা নিয়ে গভীর গবেষণা শুরু করেন (Davies, 2012)। এমনকি পরাবাস্তববাদী (Surrealists) শিল্পীরাও জাদুতে আগ্রহ দেখান; আন্দ্রে ব্রেটন (André Breton) ১৯৫৭ সালে ‘ল’আর্ট ম্যাজিক’ (L’Art magique) বা ‘জাদুকরী শিল্প’ নামে বই লেখেন (Davies, 2012)।

জ্ঞানচর্চার জগতে জাদু শব্দটি ব্যবহার করাটা অনেক সময় পশ্চিমা আধুনিকতার ধারণা প্রাচ্য বা অন্যান্য সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে দেওয়ার একটা উপায় হিসেবেও কাজ করেছে (Hanegraaff, 2012)।

আজকের দিনে ‘জাদু’ শব্দটি আমাদের মুখের ভাষায়, প্রবাদ-প্রবচনে মিশে গেছে (Davies, 2012)। কখনও কখনও আমরা দারুণ কিছু বোঝাতে, উত্তেজনা বা বিস্ময় প্রকাশ করতেও ‘জাদু’ শব্দটি ব্যবহার করি – তখন এটা হয়ে দাঁড়ায় এক উচ্চ প্রশংসার শব্দ (Flint, 1991)। মজার ব্যাপার হলো, বিজ্ঞানের সাথে এর ঐতিহাসিক বিরোধ থাকা সত্ত্বেও, বিজ্ঞানীরাও ‘ম্যাজিক অ্যাসিড’ (magic acid), ‘ম্যাজিক বুলেট’ (magic bullets) বা ‘ম্যাজিক অ্যাঙ্গেল’ (magic angles) এর মতো শব্দ ব্যবহার করেন (Davies, 2012)।

আধুনিক পশ্চিমা জাদু অনেক ক্ষেত্রেই ধর্ম আর আধ্যাত্মিকতা নিয়ে আমাদের গতানুগতিক ধারণাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে (Bogdan, 2012)। জাদু নিয়ে অ্যাকাডেমিক বিতর্কগুলো আবার আধুনিক জাদুকরদের নিজেদের বুঝতেও সাহায্য করেছে। অনেকেই, যেমন অ্যালিস্টার ক্রাউলি (Aleister Crowley), এই বিষয়ে পড়াশোনা করে নিজেদের পথ খুঁজে নিয়েছেন (Bogdan, 2012)। হেনরিক বোগডানের (Henrik Bogdan) মতে, আধুনিক জাদুচর্চার জগতে ক্রাউলির দেওয়া সংজ্ঞাটিই (“ম্যাজিক হলো ইচ্ছার সাথে সঙ্গতি রেখে পরিবর্তন ঘটানোর বিজ্ঞান এবং শিল্প”) সম্ভবত সবচেয়ে পরিচিত (Bogdan, 2012)। তার এই সংজ্ঞা ডিওন ফরচুন (Dion Fortune) (“জাদু হলো ইচ্ছানুযায়ী চেতনা পরিবর্তন করার শিল্প”), জেরাল্ড গার্ডনার (Gerald Gardner) (“শারীরিকভাবে অস্বাভাবিক ঘটানোর চেষ্টা”), বা অ্যান্টন লাভে (Anton LaVey) (“নিজের ইচ্ছানুযায়ী পরিস্থিতি বা ঘটনার পরিবর্তন, যা স্বাভাবিক উপায়ে সম্ভব নয়”) এর মতো পরবর্তী জাদুকরদেরও প্রভাবিত করেছে (Bogdan, 2012)।

২০ শতকের শেষের দিকে ক্যাওস ম্যাজিক (chaos magic) নামে একটি ধারার উদ্ভব হয়, যার লক্ষ্য ছিল অন্যান্য জাদু ধারাগুলোর প্রতীক, আচার বা ধর্মতত্ত্বের মতো বাহ্যিক দিকগুলো বাদ দিয়ে জাদুকে এর মূল কৌশলে নামিয়ে আনা (Urban, 2006)।

আধুনিক পশ্চিমা জাদুর মূলে আছে এক বিশ্বাস – মহাবিশ্বে এক অজানা, লুকানো শক্তি (occult force) ছড়িয়ে আছে, আর সবকিছুর মধ্যে এক গোপন যোগসূত্র (correspondences) রয়েছে (Hanegraaff, 2006b)। উটার হানেগ্রাফ (Wouter Hanegraaff) যেমনটা বলেছেন, এটা আসলে “জাদুর এক নতুন অর্থ, যা আগের যুগে সম্ভব ছিল না, কারণ এটা তৈরি হয়েছে ‘বিশ্বের মোহমুক্তি’ বা যুক্তির শাসনের প্রতিক্রিয়ায়” (Hanegraaff, 2006b)। বেশিরভাগ আধুনিক পশ্চিমা জাদুকরের কাছে, জাদুর মূল লক্ষ্য হলো ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক উন্নতি (personal spiritual development) (Hanegraaff, 2006b)। এই আত্ম-উন্নয়নের (self-development) ধারণাটাই আধুনিক প্যাগানবাদ (modern Paganism) বা নিউ এজ (New Age) আন্দোলনে জাদুচর্চার পথ খুলে দিয়েছে (Hanegraaff, 2006b)। এই সময়ে যৌন জাদুও (sex magic) বেশ গুরুত্ব পায়, যা প্যাসচাল বেভারলি র‍্যান্ডলফ (Paschal Beverly Randolph) জনপ্রিয় করেন এবং পরে ক্রাউলি বা থিওডর রিউসের (Theodor Reuss) মতো জাদুকরদের মধ্যে গভীর আগ্রহের জন্ম দেয় (Hanegraaff, 2006b)।

কখনও কখনও আধুনিক রহস্যবাদীরা (occultists) ইচ্ছে করেই ‘জাদু’ শব্দটি ব্যবহার করেন। তারা এর মাধ্যমে সমাজের প্রচলিত ক্ষমতা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করতে চান, সেইসব বিষয়কে সামনে আনতে চান যেগুলোকে ঐতিহ্যগতভাবে দমিয়ে রাখা হয়েছে (Styers, 2004)। যেমন, প্রভাবশালী আমেরিকান উইকান লেখিকা স্টারহক (Starhawk) বলেছিলেন, “জাদু এমন একটা শব্দ যা মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলে, তাই আমি জেনেশুনেই এটা ব্যবহার করি… কারণ যে শব্দগুলো আমাদের স্বস্তি দেয়, যেগুলো গ্রহণযোগ্য, যুক্তিসঙ্গত, বৈজ্ঞানিক… সেগুলো স্বস্তিদায়ক কারণ ওগুলো বিচ্ছিন্নতার ভাষা” (Styers, 2004)। আজকের দিনে কিছু প্রতিসংস্কৃতি (counterculture) মহলে ‘জাদু’ শব্দটি বেশ ‘কুল’ (cool) হিসেবেও বিবেচিত হয় (Berger & Ezzy, 2007)।

জাদুকে বোঝা: নানা তত্ত্ব, নানা মত

জাদুকে সংজ্ঞায়িত করাটা যে সহজ কাজ নয়, তা আমরা আগেই দেখেছি। নৃবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড ইভান ইভান্স-প্রিচার্ড (Edward Evan Evans-Pritchard) যেমন আফ্রিকার আজান্দে (Azande people) জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাদুকে একটি যৌক্তিক বিশ্বাস ব্যবস্থা হিসেবে দেখেছিলেন (Hum & Drury, 2013), তেমনি ঐতিহাসিক ওয়েন ডেভিস (Owen Davies) মনে করিয়ে দেন, শব্দটির কোনো সরল সংজ্ঞা নেই (Davies, 2012), বরং এর আছে “নানা রকম অর্থ” (Davies, 2012)। মাইকেল ডি. বেইলি (Michael D. Bailey) তো একে বলেছেন “এক গভীর বিতর্কিত বিষয় আর খুবই জটিল এক তকমা” (Bailey, 2018), যা সময় আর সংস্কৃতির সাথে সাথে ভীষণভাবে বদলে যায় (Bailey, 2006)। পণ্ডিতদের মধ্যে জাদুকে সংজ্ঞায়িত করা নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছে (Styers, 2004; Otto & Stausberg, 2013), কিন্তু আজও তারা কোনো একক সংজ্ঞায় পৌঁছাতে পারেননি – যেমনটা পারেননি ধর্মের ক্ষেত্রেও (Otto & Stausberg, 2013)। মাইকেল স্টসবার্গের (Michael Stausberg) মতে, মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই নিজেদের বা নিজেদের চর্চাকে ‘জাদু’ বলে আসছে, কিন্তু যারা নিজেদের জাদুকর বলেছেন, তাদের মধ্যেও জাদু আসলে কী, তা নিয়ে কোনো মিল ছিল না (Otto & Stausberg, 2013)।

আফ্রিকার কিছু সংস্কৃতিতে জাদু বলতে বোঝানো হতো নিছক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা। এটা নিজে থেকে ভালোও নয়, মন্দও নয়; জাদুকরের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করত এর ফলাফল (Ki-Zerbo, 1990; Asanti, 2008)। প্রাচীন আফ্রিকানরা সাধারণত জাদু, ঔষধ, ভবিষ্যদ্বাণী আর ডাইনিবিদ্যার মধ্যে পার্থক্য করত (Labahn, 2007)। জাদু আর ধর্মের সম্পর্ক নিয়েও নানা মত আছে – কেউ মনে করেন দুটো একসাথেই জন্মেছে, কেউ বলেন ধর্ম এসেছে জাদু থেকে, আবার কারও মতে জাদু এসেছে ধর্ম থেকে (Konaté Deme, 2010)।

নৃতত্ত্ব আর সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো প্রায়শই জাদুকে সমাজের অন্য কিছু চর্চা থেকে আলাদা করার চেষ্টা করেছে (Bailey, 2006)। বেইলির মতে, “অনেক সংস্কৃতিতেই… জাদুর ধারণা দিয়ে ঠিক করে দেওয়া হয়েছে কোনটা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য আর কোনটা নয়… মূলত, এগুলো ঠিক করে দিয়েছে বিশ্বাসের সীমানা।” আর এই সীমানা টানাটা আসলে “ক্ষমতারই একটা খেলা” (Bailey, 2006)। এই বিতর্কের আঁচ পড়েছে গবেষণার জগতেও, অনেক পণ্ডিতই তাদের কাজের ওপর প্রভাব পড়ার ভয়ে জাদু নিয়ে খোলামেলা গবেষণা করতে দ্বিধা করেছেন (Blain, Ezzy & Harvey, 2004)।

র‍্যান্ডাল স্টায়ার্স (Randall Styers) মনে করেন, জাদুকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টাটাই আসলে এক ধরনের “বিভাজনরেখা টানার কাজ”, যার মাধ্যমে একে ধর্ম বা বিজ্ঞানের মতো অন্য সামাজিক চর্চা থেকে আলাদা করা হয় (Styers, 2004)। কারেন লুইস জোলি (Karen Louise Jolly) জাদুকে বলেছেন “বাদ দেওয়ার একটা ক্যাটাগরি, যা দিয়ে চিন্তার অগ্রহণযোগ্য উপায়কে ধর্ম বা বিজ্ঞানের বিপরীত হিসেবে দেখানো হয়” (Jolly, 1996)।

তবে আধুনিক গবেষণা জাদু নিয়ে নানা সংজ্ঞা আর তত্ত্ব হাজির করেছে (Bailey, 2006)। বেইলির মতে, এগুলো প্রায়শই জাদুকে ধর্ম বা বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত করে, অথবা এদের থেকে পৃথক করে দেখিয়েছে (Bailey, 2006)। ধর্ম বা সমাজবিজ্ঞান চর্চা শুরু হওয়ার পর থেকেই জাদু অ্যাকাডেমিক আলোচনার এক “কেন্দ্রীয় বিষয়” হয়ে থেকেছে (Styers, 2004)। ধর্ম অধ্যয়নের জগতে এটি সবচেয়ে বেশি তাত্ত্বিক আলোচনার জন্ম দেওয়া ধারণাগুলোর একটি (Hanegraaff, 2012), এবং নৃতত্ত্বের শুরুতেও এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল (Davies, 2012)। স্টায়ার্সের মতে, সামাজিক তাত্ত্বিকদের কাছে এর এত আবেদন কারণ এটি “আধুনিকতার প্রকৃতি আর সীমানা নিয়ে বিতর্ক করার এত উর্বর ক্ষেত্র” তৈরি করে (Styers, 2004)। পণ্ডিতরা প্রায়শই জাদুকে ধর্মের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন, একে ধর্মের “অবৈধ (এবং কিছুটা মেয়েলি) সহোদর” বলে অভিহিত করেছেন (Styers, 2004), অথবা একে ধর্ম আর বিজ্ঞানের মাঝামাঝি এক জায়গায় ফেলেছেন (Styers, 2004)।

এইসব অ্যাকাডেমিক আলোচনা আবার ইউরোপের ঔপনিবেশিক বিস্তারের প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছিল (Styers, 2004)। জাদুকে সংজ্ঞায়িত করার এই প্রচেষ্টাগুলো বৃহত্তর সামাজিক উদ্বেগকে প্রতিফলিত করে (Styers, 2004), আর ধারণাটির নমনীয়তার কারণে একে সহজেই “রাজনৈতিক বা মতাদর্শগত হাতিয়ার” হিসেবে ব্যবহার করা গেছে (Styers, 2004)। বুদ্ধিজীবীরা যখন নির্দিষ্ট কিছু জনগোষ্ঠীকে (যেমন অ-ইউরোপীয় বা গ্রামের দরিদ্র ইউরোপীয়) আদিম বলে চিহ্নিত করে তাদের সাথে জাদুকে জুড়ে দিয়েছেন, তখন তা প্রকারান্তরে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ আর উপনিবেশবাদকেই বৈধতা দিয়েছে। যুক্তিটা ছিল এমন – যারা জাদুতে বিশ্বাস করে, তারা নিজেদের শাসন করার যোগ্য নয়, তাদের শাসন করা উচিত তাদেরই, যারা জাদু নয়, বরং বিজ্ঞান বা (খ্রিস্টান) ধর্মে বিশ্বাসী (Styers, 2004)। বেইলির কথায়, “নির্দিষ্ট কিছু মানুষের সাথে জাদুর এই সংযোগ তাদের শাসকদের থেকে দূরত্ব তৈরি করতে এবং অনেকাংশে সেই শাসনকে ন্যায্যতা দিতে সাহায্য করেছে” (Bailey, 2018)।

জাদু নিয়ে যত সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেগুলোকে উটার হানেগ্রাফ (Wouter Hanegraaff) কয়েকটি মূল প্রভাবশালী তত্ত্বের নানা রূপ হিসেবে দেখেছেন (Hanegraaff, 2012)।

বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতি (Intellectualist approach): টেইলর ও ফ্রেজারের চোখে জাদু

জাদুকে বোঝার একটি প্রভাবশালী ধারা হলো বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতি, যার প্রধান প্রবক্তা ছিলেন ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টেইলর (Edward Tylor) আর জেমস জি. ফ্রেজার (James G. Frazer) (Hanegraaff, 2012)। তারা জাদুকে দেখতেন বিজ্ঞানের ঠিক বিপরীত হিসেবে (Hanegraaff, 2012; Otto & Stausberg, 2013), এবং তাদের এই ভাবনা দীর্ঘদিন নৃতত্ত্বের জগতে জাদু বিষয়ক চিন্তাকে প্রভাবিত করেছে (Otto & Stausberg, 2013)। এই চিন্তাধারার জন্ম হয়েছিল উনিশ শতকের বিবর্তনবাদী মডেলগুলোর ছত্রছায়ায় (Davies, 2012)। হার্বার্ট স্পেন্সারই (Herbert Spencer) প্রথম সমাজবিজ্ঞানী যিনি বলেন যে, মানব বিকাশের ধারায় জাদু এসেছে ধর্মের আগে (Davies, 2012)। তিনি সহানুভূতিমূলক জাদু (sympathetic magic)-র প্রসঙ্গে ‘জাদু’ শব্দটি ব্যবহার করেন (Cunningham, 1999)। স্পেন্সারের মতে, জাদু আর ধর্ম দুটোই বস্তুর প্রকৃতি আর তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে (Cunningham, 1999)।

টেইলরের কাছে জাদু ছিল অ্যানিমিজম (animism) বা সর্বপ্রাণবাদের ধারণার সাথে যুক্ত (Davies, 2012; Bailey, 2018)। তার বিখ্যাত বই ‘প্রিমিটিভ কালচার’ (Primitive Culture) (১৮৭১)-এ তিনি জাদুকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে – এটা হলো “ভাবগত সাদৃশ্যকে বাস্তব সাদৃশ্য বলে ভুল করার ত্রুটি” (the error of mistaking ideal analogy for real analogy) (Hanegraaff, 2006; Hanegraaff, 2012)। টেইলর মনে করতেন, আদিম মানুষ দেখেছে যে কিছু জিনিস বাস্তবে সম্পর্কিত, তাই তারা ভুল করে ধরে নিয়েছে যে জিনিসগুলো চিন্তায় সম্পর্কিত হলেও বাস্তবেও সম্পর্কিত হবে। আর এই ভুল ধারণা থেকেই তারা এমন সব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটনা ঘটানোর বা ভবিষ্যদ্বাণী করার চেষ্টা করেছে, যা আসলে শুধু ভাবগত বা প্রতীকী (Hanegraaff, 2006)। টেইলর জাদুকে খুবই খারাপ চোখে দেখতেন, একে “মানবজাতিকে যন্ত্রণা দেওয়া সবচেয়ে ক্ষতিকর বিভ্রমগুলোর একটি” বলে অভিহিত করেছেন (Cunningham, 1999; Davies, 2012)। তার এই মতবাদ অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল (Davies, 2012) এবং জাদুকে নৃতাত্ত্বিক গবেষণার এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত করে (Davies, 2012)।

জেমস ফ্রেজার টেইলরের ধারণাকে গ্রহণ করেন এবং আরও সরলভাবে উপস্থাপন করেন (Hanegraaff, 2006; Davies, 2012)। তিনি জাদু বলতে বুঝিয়েছেন সহানুভূতিমূলক জাদু (sympathetic magic) (Hanegraaff, 2006; Bailey, 2018)। তার মতে, এটা এমন এক বিশ্বাস যে “জিনিসগুলো এক গোপন সহানুভূতির টানে দূর থেকেও একে অপরের ওপর ক্রিয়া করে”, যেন এক “অদৃশ্য ইথার” এর মাধ্যমে (Hanegraaff, 2006)। তিনি এই জাদুকে আবার দুই ভাগে ভাগ করেন: “হোমিওপ্যাথিক বা অনুকরণমূলক” (homeopathic/imitative) আর “সংক্রামক” (contagious) (Hanegraaff, 2006)। প্রথমটির মূল কথা হলো “সদৃশ সদৃশ উৎপন্ন করে” (like produces like) – অর্থাৎ, দুটো জিনিসের মধ্যে মিল থাকলে একটা আরেকটাকে প্রভাবিত করতে পারে। আর দ্বিতীয়টির ভিত্তি হলো এই ধারণা যে, দুটো বস্তু একবার সংস্পর্শে এলে দূরে চলে গেলেও একে অপরকে প্রভাবিত করতে থাকে (Cunningham, 1999; Hanegraaff, 2006)। টেইলরের মতো ফ্রেজারও জাদুকে নেতিবাচকভাবেই দেখতেন, একে বলতেন “বিজ্ঞানের জারজ বোন” (the bastard sister of science), যা এক “বিশাল বিপর্যয়কর ভ্রান্তি” (one great disastrous fallacy) থেকে জন্মেছে (Cunningham, 1999)।

তবে ফ্রেজার টেইলরের থেকে এক জায়গায় ভিন্ন ছিলেন। তিনি মনে করতেন, মানব সংস্কৃতির বিকাশে জাদুতে বিশ্বাস ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। তিনি সংস্কৃতির বিকাশকে তিন ভাগে ভাগ করেন: প্রথমে জাদু, তারপর ধর্ম, আর শেষে বিজ্ঞান (Cunningham, 1999; Hanegraaff, 2006; Davies, 2012; Bailey, 2018)। ফ্রেজারের মতে, সব সমাজই জাদুতে বিশ্বাস দিয়ে শুরু করে, পরে কেউ কেউ ধর্ম বা বিজ্ঞানের দিকে এগোয় (Cunningham, 1999)। তিনি মনে করতেন, জাদু আর ধর্ম দুটোতেই আত্মায় (spirits) বিশ্বাস আছে, কিন্তু এদের সাথে আচরণের ধরনে পার্থক্য আছে। জাদু এই আত্মাগুলোকে “নিয়ন্ত্রণ বা বশ করার চেষ্টা করে” (constrains or coerces), আর ধর্ম তাদের “সন্তুষ্ট বা প্রসন্ন করার চেষ্টা করে” (conciliating or propitiating) (Cunningham, 1999)। তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন যে, অনেক ক্ষেত্রে জাদু আর ধর্মের উপাদান মিলেমিশেও যেতে পারে, যেমন পবিত্র বিবাহের (sacred marriage) মতো উর্বরতার আচারে (Cunningham, 1999)।

ফ্রেজারের এই বিবর্তনবাদী ধারণার সমালোচনাও হয়েছে। কেউ কেউ ক্রমটা উল্টে দিয়েছেন, যেমন উইলহেম শ্মিট (Wilhelm Schmidt) বলেছেন, প্রথমে ছিল একেশ্বরবাদী ধর্ম, যা পরে জাদু আর বহুদেবতাবাদে অধঃপতিত হয় (Davies, 2012)। আবার অ্যান্ড্রু ল্যাং (Andrew Lang) এর মতো পণ্ডিতরা ফ্রেজারের পুরো বিবর্তন তত্ত্বটাকেই বাতিল করে দেন। ল্যাং দেখান যে, ফ্রেজার তার তত্ত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের বিশ্বাস আর আচার সম্পর্কে নৃতাত্ত্বিক তথ্যকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছিলেন (Davies, 2012)।

কার্যকারিতাবাদী পদ্ধতি (Functionalist approach): মাউস ও ডুর্খেইমের দৃষ্টিতে জাদু

জাদুকে বোঝার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো কার্যকারিতাবাদী পদ্ধতি, যার সাথে জড়িয়ে আছে ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী মার্সেল মাউস (Marcel Mauss) আর এমিল ডুর্খেইম (Emile Durkheim) এর নাম (Hanegraaff, 2006)। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে, জাদুকে দেখা হয় ধর্মের ঠিক বিপরীত হিসেবে (Hanegraaff, 2012)।

মাউস ১৯০২ সালে তার বিখ্যাত প্রবন্ধ “এ জেনারেল থিওরি অফ ম্যাজিক” (A General Theory of Magic)-এ জাদু সম্পর্কে তার ধারণা তুলে ধরেন (Davies, 2012; Bailey, 2018)। তিনি জাদু বলতে বুঝিয়েছেন “এমন যেকোনো আচার যা কোনো সংগঠিত ধর্মের অংশ নয়; এমন আচার যা ব্যক্তিগত, গোপন, রহস্যময় এবং শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধের দিকে ধাবিত হয়” (any rite that is not part of an organized cult: a rite that is private, secret, mysterious, and ultimately tending towards one that is forbidden) (Hanegraaff, 2006)। এর বিপরীতে, ধর্ম হলো সংগঠিত বা গোষ্ঠীগত (organised cult) (Cunningham, 1999)। মাউস মনে করতেন জাদু স্বভাবতই অ-সামাজিক (non-social), আর এই ধারণায় তিনি চিরাচরিত খ্রিস্টান দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন (Hanegraaff, 2006)। তিনি সচেতনভাবেই ফ্রেজারের বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতি প্রত্যাখ্যান করেন এবং মনে করেন, জাদুকে শুধু সহানুভূতিমূলক জাদুর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাটা ঠিক নয় (Cunningham, 1999; Hanegraaff, 2006)। তিনি বলেন, “এমন অনেক জাদুকরী আচার আছে যা সহানুভূতিমূলক নয়, আবার সহানুভূতি শুধু জাদুর একচেটিয়াও নয়, কারণ ধর্মের মধ্যেও সহানুভূতিমূলক চর্চা দেখা যায়” (Cunningham, 1999)।

মাউসের এই ধারণাগুলোই ডুর্খেইম তার ১৯১২ সালের বই ‘দ্য এলিমেন্টারি ফর্মস অফ দ্য রিলিজিয়াস লাইফ’ (The Elementary Forms of the Religious Life)-এ গ্রহণ করেন (Hanegraaff, 2006; Davies, 2012)। ডুর্খেইম মনে করতেন, জাদু আর ধর্ম দুটোই “পবিত্র বিষয়, অর্থাৎ আলাদা করে রাখা এবং নিষিদ্ধ বিষয়ের” (sacred things, that is to say, things set apart and forbidden) সাথে সম্পর্কিত (Cunningham, 1999)। কিন্তু তাদের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো সামাজিক সংগঠনে। ডুর্খেইম জাদু শব্দটি ব্যবহার করেছেন সেইসব জিনিসের জন্য যা সহজাতভাবেই অসামাজিক, যা ধর্মের ঠিক উল্টো। ধর্ম হলো একটি গোষ্ঠীর সম্মিলিত বিশ্বাস বা চার্চ (Church)। তার বিখ্যাত উক্তি হলো, “জাদুর কোনো চার্চ নেই” (There is no Church of magic) (Hanegraaff, 2012; Davies, 2012)। তিনি আরও মনে করতেন, “জাদুকরের কার্যকলাপে সহজাতভাবেই ধর্ম-বিরোধী কিছু আছে” (there is something inherently anti-religious about the maneuvers of the magician) (Hanegraaff, 2012), এবং জাদুতে বিশ্বাস “বিশ্বাসীদের একসাথে বাঁধে না বা তাদের একটি সাধারণ জীবনযাপনকারী দলে পরিণত করে না” (does not result in binding together those who adhere to it, nor in uniting them into a group leading a common life) (Cunningham, 1999)। অবশ্য, ডুর্খেইমের এই সংজ্ঞা আধুনিক কিছু ক্ষেত্রে, যেমন উইকানদের (Wiccans) মতো যারা দলবদ্ধভাবে জাদু চর্চা করেন, সেখানে প্রশ্নবিদ্ধ হয় (Bailey, 2006)।

অনেক পণ্ডিতই অবশ্য জাদু আর ধর্মকে এভাবে দুটো আলাদা ভাগে ভাগ করার ধারণার সমালোচনা করেছেন (Otto & Stausberg, 2013)। সমাজ নৃবিজ্ঞানী আলফ্রেড র‍্যাডক্লিফ-ব্রাউন (Alfred Radcliffe-Brown) তো বলেই দিয়েছেন যে, “জাদু আর ধর্মের মধ্যে এই সরল বিভাজন” কোনো কাজের নয়, দুটোকেই বরং আচারের (ritual) বৃহত্তর ধারণার মধ্যে ফেলা উচিত (Cunningham, 1999)। পরবর্তী অনেক নৃবিজ্ঞানী তার পথই অনুসরণ করেছেন (Cunningham, 1999)। তবুও, আজও পণ্ডিতদের আলোচনায় এই পার্থক্যটা প্রায়শই করা হয়ে থাকে (Otto & Stausberg, 2013)।

আবেগবাদী পদ্ধতি (Emotionalist approach): যখন জাদু আবেগের প্রকাশ

জাদুকে বোঝার আরেকটি দৃষ্টিকোণ হলো আবেগবাদী পদ্ধতি, যার সাথে যুক্ত আছেন ইংরেজ নৃবিজ্ঞানী রবার্ট রেনুলফ ম্যারেট (Robert Ranulph Marett), অস্ট্রিয়ান মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud), আর পোলিশ নৃবিজ্ঞানী ব্রনিসলো মালিনোস্কি (Bronisław Malinowski) (Cunningham, 1999)।

ম্যারেট মনে করতেন, জাদু হলো মানসিক চাপ (stress) বা উদ্বেগের প্রতিক্রিয়া (Cunningham, 1999)। ১৯০৪ সালে তিনি লেখেন, জাদু হলো এক ধরনের মানসিক প্রশান্তি (cathartic) বা উত্তেজনা (stimulating) সৃষ্টির উপায়, যা ভেতরের টানাপোড়েন কমাতে সাহায্য করে (Cunningham, 1999)। পরে তিনি জাদু আর ধর্মের মধ্যেকার বিভেদটাকেই অস্বীকার করতে শুরু করেন এবং উভয়ের প্রাথমিক রূপ বোঝাতে “ম্যাজিকো-রিলিজিয়াস” (magico-religious) শব্দটি ব্যবহার করেন (Cunningham, 1999)। মালিনোস্কিও প্রায় একই রকম ভাবতেন। ১৯২৫ সালের এক লেখায় তিনি ফ্রেজারের বিবর্তনবাদী তত্ত্ব (জাদু > ধর্ম > বিজ্ঞান) বাতিল করে দেন এবং বলেন যে, তিনটিই সব সমাজে একই সাথে বিদ্যমান থাকে (Cunningham, 1999)। তার মতে, জাদু আর ধর্ম দুটোই “আবেগিক চাপের পরিস্থিতিতে জন্মায় এবং কাজ করে” (arise and function in situations of emotional stress)। তবে পার্থক্য হলো, ধর্ম মূলত প্রকাশধর্মী (expressive), আর জাদু মূলত ব্যবহারিক (practical) (Cunningham, 1999)। তাই তিনি জাদুকে সংজ্ঞায়িত করেছেন “একটি ব্যবহারিক শিল্প হিসেবে, যা কিছু কাজের সমষ্টি, যে কাজগুলো কেবল একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের উপায়, যে লক্ষ্য পরে অর্জিত হবে বলে আশা করা হয়” (a practical art consisting of acts which are only means to a definite end expected to follow later on) (Cunningham, 1999)। মালিনোস্কির কাছে, জাদুকরী কাজের একটা নির্দিষ্ট ফল চাওয়া হয়, আর ধর্মীয় কাজ নিজেই নিজের উদ্দেশ্য (Bailey, 2006)। যেমন, উর্বরতার আচারগুলো জাদুকরী, কারণ এগুলো একটা নির্দিষ্ট চাহিদা (ফসল বা সন্তান লাভ) পূরণের জন্য করা হয় (Cunningham, 1999)। কার্যকারিতাবাদী হিসেবে তিনি জাদুকে অযৌক্তিক মনে করতেন না, বরং মনে করতেন এটা একটা প্রয়োজনীয় কাজ করে, নির্দিষ্ট সামাজিক ও পরিবেশগত পরিস্থিতিতে যা যথেষ্ট অর্থপূর্ণ (sensible) (Davies, 2012)।

বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডও তার লেখায় ‘জাদু’ শব্দটি প্রচুর ব্যবহার করেছেন (Davies, 2012)। তিনিও মনে করতেন জাদুর জন্ম মানুষের আবেগ থেকে, তবে তার ব্যাখ্যা ছিল ম্যারেটের চেয়ে ভিন্ন (Cunningham, 1999)। ফ্রয়েড বলেন, “জাদুর তত্ত্ব শুধু এটাই ব্যাখ্যা করে যে জাদু কোন পথে চলে; এটা এর আসল সারমর্ম ব্যাখ্যা করে না, অর্থাৎ সেই ভুল বোঝাবুঝিটা ব্যাখ্যা করে না যা মানুষকে প্রকৃতির নিয়মকে মানসিক নিয়ম দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে বাধ্য করে” (Freud & Strachey, 1950)। ফ্রয়েডের মতে, আদিম মানুষের জাদুতে বিশ্বাসের মূলে ছিল তার ইচ্ছার শক্তি (power of wishes)। তিনি বলেন, “তার ইচ্ছার সাথে থাকে এক চালিকাশক্তি (motor impulse), যা পরে পৃথিবীকে বদলে দিয়ে তার ইচ্ছা পূরণ করতে চায়… এই চালিকাশক্তি প্রথমে সন্তুষ্টির একটা কাল্পনিক পরিস্থিতি তৈরি করে… অনেকটা শিশুদের খেলার মতো… পরে জোরটা সরে যায় ইচ্ছার কারণ থেকে কাজের পদ্ধতির দিকে… তখন মনে হয় যেন কাজটি নিজেই, কাঙ্ক্ষিত ফলের সাথে তার মিলের কারণে, ফলটা ঘটাচ্ছে” (Freud & Strachey, 1950)।

১৯৬০ এর দশকে মারে (Murray) আর রোজালি ওয়াক্স (Rosalie Wax) নামে দুই নৃবিজ্ঞানী বলেন, অন্য সংস্কৃতির জাদুকরী বিশ্বদর্শনকে পশ্চিমা বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে বিচার না করে, তাদের নিজেদের মতো করেই বোঝা উচিত (Davies, 2012)। তাদের এই ভাবনা সমালোচিত হলেও (কারণ সমালোচকরা মনে করেছিলেন তারা অ-জাদুকরী পশ্চিমা আর জাদুকরী অ-পশ্চিমা বিশ্বদর্শনের মধ্যে একটা মিথ্যা বিভেদ তৈরি করছেন) (Davies, 2012), ‘জাদুকরী বিশ্বদর্শন’ ধারণাটি ইতিহাস, লোককাহিনী, দর্শন, সংস্কৃতি ও মনোবিজ্ঞানে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে (Davies, 2012)। ‘জাদুকরী চিন্তাভাবনা’ (magical thinking) ধারণাটিও মনোবিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন, যেমন জ্যাঁ পিয়াজে (Jean Piaget) ১৯২০ এর দশকে শিশুদের মানসিক বিকাশের আলোচনায় এটি ব্যবহার করেন (Davies, 2012)।

অন্যদিকে, স্ট্যানলি তাম্বিয়াহ (Stanley Tambiah) মনে করেন, জাদু, বিজ্ঞান আর ধর্ম – সবগুলোরই নিজস্ব “যুক্তির ধরন” (quality of rationality) আছে, এবং এগুলো রাজনীতি ও মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত (Tambiah, 1991)। তিনি বলেন, ধর্মের তুলনায় জাদু মানুষকে ঘটনা নিয়ন্ত্রণের একটা ব্যক্তিগত অনুভূতি দেয়। আর বিজ্ঞান হলো “আচরণের এমন এক ব্যবস্থা যার মাধ্যমে মানুষ পরিবেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করে” (Tambiah, 1991)।

জাতিকেন্দ্রিকতা (Ethnocentrism): নিজেদের মাপকাঠিতে অন্যকে মাপা

ইউরোপে জাদু-ধর্ম-বিজ্ঞানের যে ত্রিভুজাকার বিবর্তন তত্ত্ব (magic -> religion -> science) তৈরি হয়েছিল (Hanegraaff, 2012), তা অন্য সংস্কৃতি বা এমনকি পশ্চিমা সমাজের অতীত রূপ বোঝার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করে। কারণ এটা আসলে ইউরোপীয় চিন্তার ছাঁচে অন্যদের ফেলার চেষ্টা (Otto & Stausberg, 2013)। ‘জাদু’ শব্দটি পশ্চিমা ইতিহাসে ভেতরকার বা এমিক (insider) শব্দ হলেও, অন্য সংস্কৃতিতে বা এমনকি পশ্চিমা সমাজের নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এটা বাইরের বা এটিক (outsider) শব্দ হিসেবেই থেকে যায়। এই কারণে মাইকেল ডি. বেইলির মতো অনেক পণ্ডিত অ্যাকাডেমিক আলোচনার জন্য ‘জাদু’ শব্দটি পুরোপুরি বাদ দেওয়ার কথাই বলেন (Bailey, 2018)। বিশ শতকে এশিয়া বা আফ্রিকার সমাজ নিয়ে কাজ করা অনেক গবেষকই ‘জাদু’ বা ‘ডাইনিবিদ্যা’র (witchcraft) মতো পশ্চিমা ধারণা ব্যবহার না করে, সেইসব সমাজে প্রচলিত নির্দিষ্ট শব্দ, যেমন ‘জুজু’ (Juju), ব্যবহার করার দিকে ঝোঁকেন (Bailey, 2018)। ইউরোপের প্রাচীন ইতিহাস, যেমন ক্লাসিক্যাল যুগের গবেষকরাও একই পথ ধরেছেন, তারা ‘জাদু’র আধুনিক ধারণাকে অনুপযুক্ত মনে করে প্রাচীন সংস্কৃতির নিজস্ব পরিভাষা ব্যবহার করাকেই শ্রেয় মনে করেন (Bailey, 2018)। অবশ্য এর বিপরীতে যুক্তি হলো, যেকোনো বর্গীকরণই কিছুটা নৃতাত্ত্বিক (ethnocentric), আর পশ্চিমা পূর্বধারণা অ্যাকাডেমিক গবেষণার অংশ হয়ে থাকবেই (Otto & Stausberg, 2013)। সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য গবেষকদের মধ্যে এমিক বা ভেতরকার দৃষ্টিকোণ থেকে গবেষণা করার প্রবণতা বাড়ছে (Blain, Ezzy & Harvey, 2004)।

অনেক পণ্ডিতই মনে করেন, অ্যাকাডেমিক গবেষণায় বিশ্লেষণাত্মক হাতিয়ার হিসেবে ‘জাদু’ শব্দটি ব্যবহার করাই উচিত নয় (Hutton, 2003; Styers, 2004; Otto & Stausberg, 2013; Bailey, 2018)। যেমন, জোনাথন জেড. স্মিথ (Jonathan Z. Smith) বলেছেন, বাইরের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবহারের জন্য এই শব্দটির কোনো উপযোগিতা নেই (Hanegraaff, 2012)। উটার হানেগ্রাফও (Wouter Hanegraaff) একই মত পোষণ করেন। তিনি বলেন, এর ব্যবহার পশ্চিমা শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং এটা “…অ-ইউরোপীয় জনগণকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করার ‘বৈজ্ঞানিক’ অজুহাত হিসেবে কাজ করেছে।” তার মতে, “জাদু শব্দটি ঐতিহাসিক গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কিন্তু গবেষণা করার হাতিয়ার নয়” (Hanegraaff, 2012)।

বেইলি লক্ষ্য করেছেন, ২১ শতকের শুরুতে গবেষকরা জাদুর কোনো সার্বজনীন সংজ্ঞা খোঁজার বদলে “নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটের প্রতি যত্নশীল মনোযোগ” দিচ্ছেন – অর্থাৎ, কোনো নির্দিষ্ট সমাজে ‘জাদু’ বলতে কী বোঝাত, তা বোঝার চেষ্টা করছেন। এই পদ্ধতি “একটি সার্বজনীন ক্যাটাগরি হিসেবে জাদুর বৈধতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে” (Bailey, 2006)। বার্ন্ড-ক্রিশ্চিয়ান অটো (Berndt-Christian Otto) আর মাইকেল স্টসবার্গ (Michael Stausberg) তো বলেই দিয়েছেন যে, তাবিজ, অভিশাপ, চিকিৎসা বা অন্য যেসব চর্চাকে পশ্চিমে জাদু বলা হয়, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্য ‘জাদু’ শব্দটি ব্যবহার করার কোনো প্রয়োজনই নেই (Otto & Stausberg, 2013)। ‘জাদু’কে বিশ্লেষণাত্মক শব্দ হিসেবে বর্জন করার ধারণাটি প্রথমে আসে নৃতত্ত্বে, পরে ১৯৮০-র দশকে ক্লাসিক্যাল স্টাডিজ আর বাইবেল সংক্রান্ত গবেষণাতেও ছড়িয়ে পড়ে (Hutton, 2003)। ১৯৯০ এর দশক থেকে ধর্ম বিষয়ক গবেষকদের মধ্যে শব্দটির ব্যবহার কমে আসছে (Hanegraaff, 2012)।

জাদুকর (Magicians): কারা তারা, কেমন তাদের জীবন?

যেসব কাজকে আমরা জাদু বলছি, তার অনেকগুলো কিন্তু যে কেউই করতে পারে (Davies, 2012; Bailey, 2018)। যেমন, কিছু সাধারণ মন্ত্র বা টোটকা ব্যবহার করার জন্য বিশেষ জ্ঞান বা ক্ষমতার প্রয়োজন হয় না (Bailey, 2018)। আবার কিছু জাদু আছে যা আয়ত্ত করতে বিশেষ প্রশিক্ষণ লাগে (Davies, 2012)। যারা নিয়মিত বা প্রায়ই এই ধরনের জাদুকরী কাজ করেন, তারাই সমাজে জাদুকর, যাদুকর/যাদুকরী, ডাইনি বা কানিং ফোক (গ্রাম্য ওঝা) হিসেবে পরিচিতি পান (Bailey, 2018)। এই পরিচিতিটা তিনি নিজে দাবি করতে পারেন, অথবা সমাজ তাকে এই নামে ডাকতে পারে (Bailey, 2018)। সমাজ যখন এই তকমা দেয়, তখন ব্যক্তি তা গ্রহণ করতে পারেন, আবার কখনও তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যানও করতে পারেন (Bailey, 2018)।

কখনও কখনও অর্থনৈতিক কারণেও মানুষ জাদুকর হিসেবে পরিচিতি পেতে চায় (Bailey, 2018)। যেমন, গ্রামের ঐতিহ্যবাহী কবিরাজ বা ওঝা, কিংবা আধুনিক কালের মঞ্চের জাদুকর বা ইল্যুশনিস্টদের ক্ষেত্রে, ‘জাদুকর’ পরিচিতিটা একটা পেশা হয়ে দাঁড়াতে পারে (Bailey, 2018)। আবার কেউ কেউ সত্যিই বিশ্বাস করেন যে তাদের বিশেষ ক্ষমতা বা প্রতিভা আছে, আর সেই বিশ্বাস থেকেই এই পরিচয় ধারণ করেন (Bailey, 2018)। কোন সমাজে কে জাদুকর হতে পারবে, তা নিয়ে নানা নিয়ম থাকতে পারে। যেমন, কোথাও হয়তো এটা বংশানুক্রমিক ব্যাপার, কোথাও বা লিঙ্গভিত্তিক বিধিনিষেধ থাকতে পারে (Davies, 2012)। মনে করা হয়, কিছু বিশেষ শারীরিক বা জন্মগত বৈশিষ্ট্য মানুষকে জাদুকরী ক্ষমতা দেয়। যেমন, হাঙ্গেরিতে বিশ্বাস ছিল, ‘টাল্টোস’ (táltos)-রা জন্মায় দাঁত নিয়ে বা হাতে একটা অতিরিক্ত আঙুল নিয়ে (Davies, 2012)। ইউরোপের অনেক জায়গায় মনে করা হতো, জন্মমুহূর্তে ঝিল্লি বা কউল (caul) নিয়ে জন্মালে শিশুর অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা থাকবে (Davies, 2012)। কিছু ক্ষেত্রে জাদুকর হতে গেলে বিশেষ দীক্ষা (ritual initiation) নেওয়ার প্রয়োজন হয়, আবার কোথাও হয়তো অন্য কোনো অভিজ্ঞ জাদুকরের কাছ থেকে শিক্ষা (mentorship) নিতে হয় (Davies, 2012)।

ওয়েন ডেভিস (Owen Davies) জাদুকরদের দুটো মোটা দাগে ভাগ করেছেন: ধর্মীয় আর লৌকিক (lay) (Davies, 2012)। যেমন, রোমান ক্যাথলিক পুরোহিতরা তাদের ভূত ছাড়ানোর (exorcism) ক্ষমতা বা পবিত্র জল ব্যবহারের কারণে জাদুকরী ক্ষমতার অধিকারী বলে বিবেচিত হতে পারেন (Davies, 2012)। ঐতিহ্যগতভাবে, সাধারণ মানুষ থেকে জাদুকরদের আলাদা করার এবং তাদের পেশাগত স্বীকৃতি দেওয়ার প্রধান উপায় ছিল দীক্ষা। এই দীক্ষার আচারের মাধ্যমেই অতিপ্রাকৃত জগতের সাথে জাদুকরের সম্পর্ক স্থাপিত হতো এবং তিনি একটি বিশেষ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হতেন (এই আচারগুলো প্রায়শই মৃত্যু ও পুনর্জন্মের প্রতীকী হতো) (Mauss, Bain & Pocock, 2007)। তবে আধুনিক নিওপ্যাগানিজমের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। বার্গার (Berger) আর এজি (Ezzy) যেমনটা বলছেন, যেহেতু কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ বা নির্দিষ্ট নিয়মকানুন নেই, তাই কেউ যদি নিজেকে ডাইনি, উইকান বা প্যাগান বলে দাবি করেন, সাধারণত সেটাই মেনে নেওয়া হয় (Berger & Ezzy, 2007)। এজি আরও বলেন, অনেক সমাজতাত্ত্বিক বা নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় এই অনুশীলনকারীদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বা বিশ্বদর্শনকে অবহেলা করা হয়েছে, যার কারণ “বিজ্ঞানের এক সংকীর্ণ ধারণা যা জাদুকরী বিশ্বাসকে খাটো করে দেখে” (Blain, Ezzy & Harvey, 2004)।

মার্সেল মাউস (Marcel Mauss) যুক্তি দিয়েছেন, একজন জাদুকরের ক্ষমতা আসলে তার সমাজের সংস্কৃতি দ্বারাই নির্ধারিত হয় – অর্থাৎ, সমাজ কতটা বিশ্বাস করে যে তার ক্ষমতা আছে বা তার জাদুর উৎস কী। একজন জাদুকর চাইলেই নতুন কোনো জাদু বানিয়ে ফেলতে বা দাবি করতে পারেন না। বাস্তবে, তার ততটুকুই ক্ষমতা, যতটুকু তার আশেপাশের লোকেরা বিশ্বাস করে (Mauss, Bain & Pocock, 2007)।

অবশ্য, ইতিহাসজুড়েই জাদুকরদের তাদের দাবিকৃত ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে (Davies, 2012)। যেমন, ষোড়শ শতকের ইংল্যান্ডে লেখক রেজিনাল্ড স্কট (Reginald Scot) তার ‘দ্য ডিসকভারি অফ উইচক্র্যাফট’ (The Discoverie of Witchcraft) বইতে লেখেন যে, ডাইনিবিদ্যা বা জাদুকরী ক্ষমতার অভিযোগে অভিযুক্ত অনেকেই আসলে হাতসাফাই (illusionism) দেখিয়ে মানুষকে বোকা বানাচ্ছে (Davies, 2012)।

সাদা, কালো ও ধূসর জাদু সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে যান এখানে – সাদা জাদু, কালো জাদু, এবং ধূসর জাদু

তথ্যসূত্র (References)

  • Abusch, T. (2002). Mesopotamian Witchcraft: Towards a History and Understanding of Babylonian Witchcraft Beliefs and Literature. Brill. ISBN 978-90-04-12387-8.

  • Abusch, I. T., & Van Der Toorn, K. (Eds.). (1999). Mesopotamian Magic: Textual, Historical, and Interpretative Perspectives. Brill. ISBN 978-90-5693-033-2.

  • Andrews, C. (1994). Amulets of Ancient Egypt. University of Texas Press.

  • Asanti, M. K. (2008). Encyclopedia of African Religion. SAGE. ISBN 978-1-5063-1786-1.

  • Bailey, M. D. (2006). The Meanings of Magic. Magic, Ritual, and Witchcraft, 1(1), 1–23. doi:10.1353/mrw.0.0052

  • Bailey, M. D. (2018). Magic: The Basics. Routledge. ISBN 978-1-138-80961-1.

  • Bell, H. I., Nock, A. D., & Thompson, H. Magical Texts From A Bilingual Papyrus In The British Museum. Proceedings of The British Academy, XVII.

  • Belser, J. W. Book Review: Gideon Bohak, Ancient Jewish Magic. Academia. Retrieved July 9, 2021, from https://www.academia.edu/1798780

  • Berger, H. A., & Ezzy, D. (2007). Teenage Witches: Magical Youth and the Search for the Self. Rutgers University Press. ISBN 978-0-8135-4136-5.

  • Betz, H. D. (Ed.). (1986). The Greek Magical Papyri in Translation, Including the Demotic Spells. University of Chicago Press. ISBN 978-0-226-04444-6.

  • Betz, H. D. (Ed.). (1996). The Greek Magical Papyri in Translation (2nd ed.). University of Chicago Press. ISBN 978-0-226-04447-7.

  • Birmingham Museums and Art Gallery. (2013). Incantation bowls. Retrieved September 6, 2013, from http://www.bmagic.org.uk/objects/1961A316

  • Blain, J., Ezzy, D., & Harvey, G. (Eds.). (2004). Researching Paganisms. AltaMira Press. ISBN 978-0-7591-0523-2.

  • Bogdan, H. (2012). Introduction: Modern Western Magic. Aries, 12(1), 1–16. doi:10.1163/147783512X614812

  • Bohak, G. (2011). Ancient Jewish Magic: A History. In Ancient Jewish Magic: A History (pp. 70–142). Cambridge University Press. ISBN 978-0-521-18098-6.

  • Bremmer, J. N. (2002). The Birth of the Term Magic. In J. N. Bremmer & J. R. Veenstra (Eds.), The Metamorphosis of Magic from Late Antiquity to the Early Modern Period (pp. 1–12). Peeters. ISBN 978-90-429-1227-4.

  • Brier, B., & Hobbs, H. (2009). Ancient Egypt: Everyday Life in the Land of the Nile. Sterling. ISBN 978-1-4549-0907-1.

  • Brown, M. (1995). Israel’s Divine Healer. Zondervan. ISBN 978-0-310-20029-1.

  • Copenhaver, B. P. (2015). Magic in Western Culture: From Antiquity to the Enlightenment. Cambridge University Press. ISBN 978-1-107-07052-3.

  • Crowley, A. (1997). Magick: Liber ABA, Book 4, Parts I-IV (2nd rev. ed.). Weiser. ISBN 0-87728-919-0.

  • Cunningham, G. (1999). Religion and Magic: Approaches and Theories. Edinburgh University Press. ISBN 978-0-7486-1013-6.

  • Davies, O. (2007). Popular Magic: Cunning-folk in English History. Bloomsbury Academic. ISBN 978-1-84725-036-0.

  • Davies, O. (2009). Grimoires: A History of Magic Books. Oxford University Press. ISBN 978-0-19-920451-9.

  • Davies, O. (2012). Magic: A Very Short Introduction. Oxford University Press. ISBN 978-0-19-958802-2.

  • Delaporte, L.-J. (2013). Mesopotamia. Routledge. ISBN 978-1-136-19924-0.

  • Drijvers, J. W., & Hunt, D. (Eds.). (1999). The Late Roman World and Its Historian: Interpreting Ammianus Marcellinus (1st ed.). Routledge. ISBN 978-0-415-20271-8.

  • Elber, M. (2006). The Everything Kabbalah Book: Explore This Mystical Tradition—From Ancient Rituals to Modern Day Practices. Adams Media. ISBN 1-59337-546-8.

  • El-Zein, A. (2009). Islam, Arabs, and the Intelligent World of the Jinn. Syracuse University Press. ISBN 978-0-8156-5070-6.

  • Flint, V. I. J. (1991). The Rise of Magic in Early Medieval Europe. Princeton University Press. ISBN 978-0-691-03165-1.

  • Freud, S., & Strachey, J. (1950). Totem and Taboo: Some Points of Agreement Between the Mental Lives of Savages and Neurotics (Reprint ed.). W.W. Norton & Co. ISBN 978-0-393-00143-3.

  • Geoffroy, E. (2010). Introduction to Sufism: The Inner Path of Islam. World Wisdom.

  • Gilchrist, R. (2008). Magic for the Dead? The Archaeology of Magic in Later Medieval Burials. Medieval Archaeology, 52(1), 119–159. doi:10.1179/174581708×335468

  • Gilchrist, R. (2012). Medieval Life: Archaeology and the Life Course (Reprint ed.). Boydell Press. ISBN 978-1-84383-722-0.

  • Glucklich, A. (1997). The End of Magic. Oxford University Press. ISBN 978-0-19-535523-9.

  • Gordon, C. H. (1941). Aramaic Incantation Bowls. Orientalia, X, 116ff.

  • Gordon, R. (1999). Imagining Greek and Roman Magic. In B. Ankarloo & S. Clark (Eds.), The Athlone History of Witchcraft and Magic in Europe. Vol. 2: Ancient Greece and Rome (pp. 159–275). Athlone Press. ISBN 978-0-485-89002-0.

  • Graf, F. (1997). Magic in the Ancient World. Harvard University Press. ISBN 978-0-674-54151-1.

  • Graham, E. (2018). Do You Believe in Magic?. Material Religion: The Journal of Objects, Art and Belief, 14(2), 255–257. doi:10.1080/17432200.2018.1443843

  • Greenwood, S. (2000). Magic, Witchcraft and the Otherworld: An Anthropology. Berg Publishing. ISBN 978-1-85973-450-6.

  • Hanegraaff, W. J. (2006). Magic I: Introduction. In W. J. Hanegraaff (Ed.), Dictionary of Gnosis and Western Esotericism (pp. 716–719). Brill. ISBN 978-90-04-15231-1.

  • Hanegraaff, W. J. (2006b). Magic V: 18th-20th Century. In W. J. Hanegraaff (Ed.), Dictionary of Gnosis and Western Esotericism (pp. 738–744). Brill. ISBN 978-90-04-15231-1.

  • Hanegraaff, W. (2012). Esotericism and the Academy: Rejected Knowledge in Western Culture. Cambridge University Press. ISBN 978-0-521-19621-5.

  • Hinnells, J. (Ed.). (2009). The Penguin Handbook of Ancient Religions. Penguin. ISBN 978-0-14-195666-4.

  • Hum, L. L., & Drury, N. (2013). The Varieties of Magical Experience: Indigenous, Medieval, and Modern Magic. ABC-CLIO. ISBN 978-1-4408-0419-9.

  • Hutton, R. (2003). Witches, Druids and King Arthur. Hambledon and London. ISBN 978-1-85285-397-6.

  • Hutton, R. (2017). The Witch: A History of Fear, from Ancient Times to the Present. Yale University Press. ISBN 978-0-300-22904-2.

  • Idel, M. (1995). Hasidism: Between Ecstasy and Magic. SUNY Press.

  • Johnson, T., & Scribner, R. W. (1996). Popular Religion in Germany and Central Europe, 1400-1800. Bloomsbury Publishing. ISBN 978-1-349-24836-0.

  • Jolly, K. L. (1996). Popular Religion in Late Saxon England: Elf Charms in Context. University of North Carolina Press. ISBN 978-0-8078-4565-3.

  • Josephy, M. R. (1975). Magic & Superstition in the Jewish Tradition: An Exhibition Organized by the Maurice Spertus Museum of Judaica. Spertus College of Judaica Press.

  • Karenga, M. (2006). Maat, the Moral Ideal in Ancient Egypt: A Study in Classical African Ethics. University of Sankore Press. ISBN 978-0-943412-25-2.

  • Kieckhefer, R. (1994). The Specific Rationality of Medieval Magic. The American Historical Review, 99(3), 813–834. doi:10.2307/2167771. PMID 11639314.

  • Kieckhefer, R. (2000). Magic in the Middle Ages (2nd ed.). Cambridge University Press. ISBN 978-0-521-78576-1.

  • Kieckhefer, R. (2002). Forbidden Rites: A Necromancer’s Manual of the Fifteenth Century (2nd ed.). Pennsylvania State University Press. ISBN 978-0-271-01751-8.

  • Kindt, J. (2012). Rethinking Greek Religion. Cambridge University Press. ISBN 978-0-521-11092-1.

  • Ki-Zerbo, J. (Ed.). (1990). Methodology and African Prehistory (Vol. 1). James Currey. ISBN 0-85255-091-X. (Part of UNESCO General History of Africa)

  • Konaté Deme, M. (2010). Heroism and the Supernatural in the African Epic. Routledge. ISBN 978-1-136-93264-9.

  • Kuiper, K. (Ed.). (2010). Mesopotamia: The World’s Earliest Civilization. The Rosen Publishing Group. ISBN 978-1-61530-112-6.

  • Labahn, M. (2007). A Kind of Magic: Understanding Magic in the New Testament and Its Religious Environment. A&C Black. ISBN 978-0-567-03075-7.

  • Lebling, R. (2010). Legends of the Fire Spirits: Jinn and Genies from Arabia to Zanzibar. I.B.Tauris. ISBN 978-0-85773-063-3.

  • Lewy, H. (1978). Oracles and Theurgy: Mysticism, Magic and Platonism in the Later Roman Empire. Études Augustiniennes. ISBN 978-2-85121-025-8.

  • Lindberg, D. C. (2007). The Beginnings of Western Science: The European Scientific Tradition in Philosophical, Religious, and Institutional Context, 600 B.C. to A.D. 1450 (2nd ed.). University of Chicago Press. ISBN 978-0-226-48205-7.

  • Mair, V. H. (2015). Old Sinitic *Mǎg, Old Persian Maguš, and English “Magician”. Early China, 15, 27–47. doi:10.1017/S0362502800004995

  • Mark, J. J. (2017, November 14). Magic in Ancient Egypt. World History Encyclopedia. Retrieved from https://www.worldhistory.org/article/1019/

  • Mauss, M., Bain, R., & Pocock, D. F. (2007). A General Theory of Magic (Reprint ed.). Routledge. ISBN 978-0-415-25396-3. (Original work published 1902)

  • Michigan Library. (n.d.). Babylonian Demon Bowls. Lib.umich.edu. Retrieved September 6, 2013, from https://deepblue.lib.umich.edu/bitstream/handle/2027.42/108169/def2.html

  • Miller, J. L. (2010). Practice and perception of black magic among the Hittites. Altorientalische Forschungen, 37(2). doi:10.1524/aofo.2010.0015

  • Montgomery, J. A. A Syriac Incantation Bowl with Christian Formula. American Journal of Semitic Languages and Literatures, 34.

  • Nasr, S. H., Dagli, C. K., Dakake, M. M., Lumbard, J. E. B., & Rustom, M. (Eds.). (2015). The Study Quran: A New Translation and Commentary. Harper Collins. ISBN 978-0-06-222762-1.

  • Noegel, S., Walker, J. W., & Wheeler, B. (Eds.). (2010). Prayer, Magic, and the Stars in the Ancient and Late Antique World. Penn State Press. ISBN 978-0-271-04600-6.

  • Orientalia 65 3-4 Pontificio Istituto biblico. (1996).

  • Otto, B.-C., & Stausberg, M. (Eds.). (2013). Defining Magic: A Reader. Equinox. ISBN 978-1-908049-80-3.

  • Person, H. E. (Ed.). (2003). The Mitzvah of Healing: An Anthology of Jewish Texts, Meditations, Essays, Personal Stories, and Rituals. Union for Reform Judaism. ISBN 0-8074-0856-5.

  • Petersen, J. A. (Ed.). (2009). Contemporary religious Satanism: A Critical Anthology. Ashgate Publishing. ISBN 978-0-7546-5286-1.

  • Plaut, W. G., & Stein, D. E. S. (Eds.). (2004). The Torah: A Modern Commentary (Rev. ed.). Union for Reform Judaism. ISBN 0-8074-0883-2.

  • Price, S. (1999). Religions of the Ancient Greeks (Reprint ed.). Cambridge University Press. ISBN 978-0-521-38867-2.

  • Ritner, R. K. (2001). Magic: An Overview. In D. B. Redford (Ed.), Oxford Encyclopedia of Ancient Egypt. Oxford University Press.

  • Russell, J. B. (1972). Witchcraft in the Middle Ages. Cornell University Press. ISBN 978-0-8014-9289-1.

  • Sasson, J. M. (Ed.). (1995). Civilizations of the ancient Near East. Scribner. ISBN 978-0-684-19722-7.

  • Schama, S. (2003). A History of Britain 1: 3000 BC-AD 1603 At the Edge of the World? (Paperback 2003 ed.). BBC Worldwide. ISBN 978-0-563-48714-2.

  • Styers, R. (2004). Making Magic: Religion, Magic, and Science in the Modern World. Oxford University Press. ISBN 978-0-19-516941-6.

  • Tambiah, S. J. (1991). Magic, Science, Religion, and the Scope of Rationality (Reprint ed.). Cambridge University Press. ISBN 978-0-521-37631-0.

  • Teeter, E. (2011). Religion and Ritual in Ancient Egypt. Cambridge University Press. ISBN 978-0-521-84855-8.

  • The International Standard Bible Encyclopedia (Vol. 4, p. 217). (1988). G. W. Bromiley (Ed.). Eerdmans. (Original work published 1986)

  • Urban, H. B. (2006). Magia Sexualis: Sex, Magic, and Liberation in Modern Western Esotericism. University of California Press. ISBN 978-0-520-93288-3.

  • Wahlen, C. (2004). Jesus and the impurity of spirits in the Synoptic Gospels. Mohr Siebeck.

  • Weiss, J. (1995). The Saddik – Altering the Divine Will. In Studies in East European Jewish Mysticism and Hasidism. Littman Library.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.