পার্শাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়াম: এক অসমাপ্ত বিপ্লবের আখ্যান যা বাংলাদেশের কাঠামোগত উন্নয়নের অন্তরায়

ভূমিকা

কখনো ভেবে দেখেছেন, কেন আমাদের দেশে বড় বড় ব্যাংক কেলেঙ্কারির তেমন কোনো সুরাহা হয় না, অথচ ছোটখাটো ঋণ খেলাপি হলে তার বাড়ি ক্রোক হয়ে যায়? কিংবা কেন সরকারি সেবা পেতে আজও এত ভোগান্তি, এত ঘুষের লেনদেন, যেখানে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর ছড়াছড়ি? কেন তৈরি পোশাক শিল্প ছাড়া আর তেমন কোনো শিল্পখাত মাথা তুলে দাঁড়াতে পারল না? আমরা উন্নয়নের অনেক পরিসংখ্যান শুনি, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনে তার ছোঁয়া কতটা লাগে? কেন মনে হয়, এত কিছুর পরেও দেশটা যেন কিছু জায়গায় আটকে আছে, কিছু মৌলিক সমস্যার সমাধান হচ্ছেই না?

এই ‘আটকে থাকা’, এই অসম্পূর্ণ পরিবর্তনের পেছনে একটি গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। যখন কোনো দেশে সংস্কার বা পরিবর্তনের যাত্রা শুরু হয়, তখন প্রায়শই দেখা যায় কিছু প্রভাবশালী গোষ্ঠী সেই প্রাথমিক পরিবর্তনের সুযোগে বিপুল সুবিধা লুফে নেয়। কিন্তু পরবর্তীতে যখন আরও গভীর, কাঠামোগত সংস্কারের প্রয়োজন হয় যা তাদের অর্জিত সুবিধার জন্য হুমকি হতে পারে, তখন এই নব্য সুবিধাভোগীরাই হয়ে দাঁড়ায় সেই সংস্কারের প্রধান বিরোধী। তারা চায় পরিস্থিতি ঠিক এখানেই, এই আংশিক পরিবর্তিত অবস্থায় ‘স্থিতিশীল’ থাকুক, কারণ এটাই তাদের জন্য সবচেয়ে লাভজনক।

রাজনৈতিক অর্থনীতির গবেষকরা এই জটিল ও আপাত স্থিতিশীল অবস্থাকেই বলেন “পারশাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়াম” বা আংশিক সংস্কারজনিত ভারসাম্য। এটি এমন এক অচলায়তন, যেখানে সংস্কারের প্রথম ধাপের বিজয়ীরাই নিজেদের স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে পরবর্তী, পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের পথ রুদ্ধ করে দেয় – যেন এক অসমাপ্ত বিপ্লব, যার প্রাথমিক অর্জনগুলোই তার পূর্ণতাকে গলা টিপে ধরে।

স্বাধীনতার পর সমাজতান্ত্রিক পথ ছেড়ে উদার অর্থনীতির পথে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতির বাস্তবতায় এই ধারণাটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। আশির দশক থেকে, বিশেষত নব্বইয়ের দশকে কাঠামোগতল সমন্বয়ের হাত ধরে আসা বেসরকারিকরণ, বাণিজ্য উদারীকরণ, এবং আর্থিক খাতের সংস্কার অর্থনীতিতে নতুন গতি আনলেও, প্রায়শই তা পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের লোকসান, আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা, কিংবা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মতো মৌলিক চ্যালেঞ্জগুলো রয়েই গেছে। কেন এই অসম্পূর্ণতা? কেন কিছু খাতের অভাবনীয় উন্নতির পাশাপাশি বহু সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়? এর উত্তর লুকিয়ে আছে ঐ “আংশিক সংস্কারজনিত ভারসাম্য”-এর মধ্যেই, যেখানে প্রাথমিক সংস্কারের সুবিধাভোগী শক্তিশালী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী, দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, এবং স্বল্পমেয়াদী রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ একজোট হয়ে গভীরতর, কাঠামোগত পরিবর্তনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই লেখায় আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে এই আংশিক সংস্কার ভারসাম্যের স্বরূপ, এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, প্রয়োগ এবং পরিণতি বিশ্লেষণ করব।

ধারণা ও তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট: কেন থামে সংস্কারের রথ?

পার্শাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়াম তত্ত্বটি একটি প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। দীর্ঘকাল ধরে মনে করা হতো, অর্থনৈতিক সংস্কারের মূল বাধা আসে সংস্কার প্রক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত বা পরাজিত (losers) গোষ্ঠী থেকে। সংস্কার মানেই শুরুতে কিছু বেদনা, কিছু ত্যাগ – অর্থনীতির গ্রাফে যাকে বলে ‘J-Curve’ প্রভাব, যেখানে উন্নতির আগে আসে সাময়িক অবনতি। ধারণা ছিল, এই সাময়িক ক্ষতির শিকার যারা, তারাই সংস্কারের চাকাকে পেছনের দিকে টানতে চায়। তাই সরকারকে দৃঢ় হাতে, জনমতের চাপ অগ্রাহ্য করে সংস্কার এগিয়ে নিতে হবে।

কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে, বিশেষ করে সমাজতন্ত্রের পতনের পর পূর্ব ইউরোপ ও সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোর রূপান্তর প্রক্রিয়া নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে এক নতুন এবং আরও জটিল সত্য উঠে আসে। বিশ্লেষকরা, বিশেষ করে জোয়েল হেলমান, দেখতে পান যে সংস্কারের পথে প্রধান বাধা পরাজিতরা নয়, বরং প্রাথমিক পর্বের বিজয়ীরাই (early winners)। আংশিক বা অসম্পূর্ণ সংস্কার এমন কিছু নীতিগত বিকৃতি বা ফাঁকফোকর তৈরি করে, যা ব্যবহার করে এই নব-উত্থিত প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলো (যেমন, প্রাক্তন রাষ্ট্রীয় পরিচালক, নব্য ব্যবসায়ী বা অলিগার্ক) বিপুল ব্যক্তিগত মুনাফা বা রেন্ট (rent) অর্জন করতে শুরু করে। এই মুনাফা প্রায়শই আসে বাজারের স্বাভাবিক নিয়ম মেনে নয়, বরং নীতি বা আইনের অসম্পূর্ণতাকে কাজে লাগিয়ে। যেমন, সরকারি সম্পদ নামমাত্র মূল্যে পাওয়া, বিশেষ লাইসেন্স বা পারমিট লাভ করা, কিংবা নিয়ন্ত্রিত মূল্যের পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি করার সুযোগ।

যখন এই ‘আদি বিজয়ীরা’ এমন অনার্জিত বা অস্বাভাবিক মুনাফার স্বাদ পায়, তখন তাদের কাছে এই আংশিক সংস্কারের অসমাপ্ত অবস্থাটিই হয়ে ওঠে স্বর্ণখনি। তারা চায় এই পরিস্থিতি চিরস্থায়ী হোক। পরবর্তী ধাপের সংস্কার – যেমন, বাজারের পূর্ণ উদারীকরণ, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা, কিংবা শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি – তাদের এই অনায়াস লাভের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই, তারা তাদের অর্জিত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে পরবর্তী সংস্কারগুলোকে আটকে দেয়। এভাবেই জন্ম নেয় পার্শাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়াম – এক আপাত শান্ত, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাওয়া স্থিতাবস্থা। সংস্কার প্রক্রিয়া একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে এসে থেমে যায়, গতি হারায়। এটি এক ধরনের “বিজয়ীর ফাঁদ” (winner’s trap), যেখানে বিজয়ীরা তাদের প্রাপ্তিটুকু ধরে রাখতে গিয়ে পুরো সমাজকে দীর্ঘমেয়াদী সুফল থেকে বঞ্চিত করে। এই ভারসাম্য টেকসই মনে হলেও, তা আসলে অর্থনীতির স্বাভাবিক বিকাশ ও বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণের পথে এক গভীর চোরাবালি।

গবেষণা ও সাহিত্য পর্যালোচনা: তত্ত্বের কারিগর ও বিস্তার

এই ধারণাকে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক ভিত্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ জোয়েল এস. হেলমান (Joel S. Hellman)। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত তার যুগান্তকারী প্রবন্ধ “Winners Take All: The Politics of Partial Reform in Postcommunist Transitions” পার্শাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়াম ধারণাটিকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। হেলমান দেখান, পোস্ট-কমিউনিস্ট দেশগুলোতে যেখানে সংস্কার দ্রুত এবং সমন্বিতভাবে হয়নি, সেখানেই প্রাথমিক বিজয়ীরা সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং তারাই পরবর্তী সংস্কারের গতি রোধ করেছে। তার গবেষণা প্রচলিত ধারণার বিপরীতে গিয়ে প্রমাণ করে যে, যেসব সরকার জনমানুষের চাপ বা সম্ভাব্য ‘পরাজিতদের’ দাবিকে কিছুটা আমলে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক পথে হেঁটেছে, তারাই বরং তুলনামূলকভাবে গভীর সংস্কার করতে পেরেছে। অন্যদিকে, যেসব সরকার আপাতদৃষ্টিতে শক্তিশালী এবং জনপ্রিয় জবাবদিহিতা এড়িয়ে সংস্কার করতে চেয়েছে, তারাই অভ্যন্তরীণ সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর ফাঁদে আটকে পড়েছে বেশি। এটি ছিল রাজনৈতিক অর্থনীতির চিন্তাজগতে এক মৌলিক পরিবর্তন – সংস্কারের শত্রু কেবল বাইরে নয়, ভেতরেও জন্মায়, এবং অনেক সময় সেই অভ্যন্তরীণ শত্রুই বেশি শক্তিশালী।

হেলমানের কাজের পাশাপাশি, বিশ্বব্যাংকের গবেষক ব্রায়ান লেভি (Brian Levy)-ও নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই সংস্কারের নকশা ও ক্রম (sequencing) নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও সুশাসনের দিকগুলো বিবেচনা না করে যদি খণ্ডিতভাবে (যেমন, শুধু বেসরকারিকরণ বা বাণিজ্য উদারীকরণ) সংস্কার শুরু করা হয়, তবে তা সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর উত্থানকে ত্বরান্বিত করতে পারে। লেভি তার ১৯৯৩ সালের এক নীতি গবেষণা পত্রে দেখান, ভুল ক্রমে শুরু হওয়া সংস্কার কীভাবে একটি “আংশিক সংস্কারগত ফাঁদ” তৈরি করতে পারে, যেখানে কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নীতি বা আইনের ফাঁক গলে অস্বাভাবিক মুনাফা অর্জন করে এবং পরবর্তীতে তারাই পরিবর্তনের প্রধান বিরোধী শক্তি হয়ে দাঁড়ায়।

এই ধারণা কেবল পোস্ট-কমিউনিস্ট দেশগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। টনি অ্যাডিসন (Tony Addison) ২০০১ সালে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সংস্কার প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে একই ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করেন। তিনি দেখেন, অনেক আফ্রিকান দেশে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা বা শর্তের চাপে কিছু প্রাথমিক সংস্কার শুরু হলেও, স্থানীয় প্রভাবশালী এলিটদের প্রতিরোধে তা দ্রুত গতি হারায়। সরকারগুলো মুখে বাজার অর্থনীতির কথা বললেও, বাস্তবে কাঠামোগত পরিবর্তনের গভীরে যেতে অনীহা দেখায়, কারণ তাতে বিদ্যমান ক্ষমতা ও সুবিধার কাঠামো ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। এটিও পার্শাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়ামেরই ভিন্ন রূপ – যেখানে সংস্কার একপ্রকার আনুষ্ঠানিকতার খোলসে বন্দী হয়ে পড়ে।

পরবর্তীকালে, বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণায় “রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল” বা স্টেট ক্যাপচার (State Capture) ধারণাটি পার্শাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়ামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়। হেলমান, গেরেইন্ট জোন্স এবং ড্যানিয়েল কফম্যানের ২০০০ সালের প্রভাবশালী গবেষণা “Seize the State, Seize the Day: State Capture, Corruption and Influence in Transition” দেখায়, কীভাবে রূপান্তরকালীন অর্থনীতির দেশগুলোতে শক্তিশালী ব্যবসায়িক গোষ্ঠী বা অলিগার্করা আইনপ্রণেতা, বিচারক এবং সরকারি কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করে বা কিনে নিয়ে রাষ্ট্রের নীতি ও আইনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। আংশিক বাজার সংস্কারের সুযোগে তারা দুর্নীতির এক বিশাল জাল বিস্তার করে, যা পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের পথে প্রাতিষ্ঠানিক বাধা তৈরি করে। এটি যেন রাষ্ট্রের আত্মাকেই কিনে ফেলার মতো – যেখানে আইন থাকে, কিন্তু তা নির্দিষ্ট কিছু মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে।

এই ধারণাকে আরও তাত্ত্বিক গভীরতা দেন অর্থনীতিবিদ কার্লা হফ (Karla Hoff) এবং নোবেল বিজয়ী জোসেফ স্টিগলিটজ (Joseph Stiglitz)। ২০০৪ সালের এক যৌথ কাজে তারা দেখান, যদি শক্তিশালী আইনি কাঠামো বা সুশাসন প্রতিষ্ঠার আগেই গণহারে বেসরকারীকরণ (mass privatization) করা হয়, তাহলে সম্পদের নতুন মালিকরা অনেক সময়ই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হয় না। বরং, তারা বিদ্যমান আইনি দুর্বলতা, অনিশ্চয়তা এবং দুর্নীতির পরিবেশ থেকেই বেশি লাভবান হয়। তাই তারা এমন একটি ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে চায়, যেখানে নিয়মকানুন নমনীয় থাকে এবং তাদের সুবিধা মতো ব্যবহার করা যায়। এটি পার্শাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়ামের মূল যুক্তিকেই সমর্থন করে – অসম্পূর্ণ সংস্কার সুবিধাভোগী তৈরি করে, এবং সেই সুবিধাভোগীরাই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা বজায় রাখতে চায়, যা পূর্ণাঙ্গ বাজার অর্থনীতি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এই বিশ্লেষণগুলো প্রমাণ করে, পার্শাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়াম শুধু একটি বিশেষ সময়ের বা অঞ্চলের ঘটনা নয়, বরং এটি একটি সাধারণ প্রবণতা যা যেকোনো দেশের সংস্কার প্রক্রিয়ায় দেখা দিতে পারে, যদি সেখানে ক্ষমতা ও সুবিধার ভারসাম্য সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত না হয়।

আংশিক সংস্কারের বিষাক্ত ফল: নীতি ক্যাপচার, অলিগার্কতন্ত্র এবং স্থবির অর্থনীতি

পার্শাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়ামের পরিণতি শুধু তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয় নয়, এর বাস্তব প্রভাব অর্থনীতি ও সমাজের গভীরে প্রোথিত। যখন সংস্কার আংশিকভাবে থমকে যায়, তখন জন্ম নেয় নানা বিষাক্ত ফল:

১. বাজার বিকৃতি ও রেন্ট-সন্ধানী আচরণ (Rent-Seeking Behavior): অসম্পূর্ণ সংস্কার অর্থনীতিতে নানা ধরনের অসামঞ্জস্য ও বিকৃতি জিইয়ে রাখে। এই বিকৃতিগুলোই কিছু গোষ্ঠীর জন্য অনার্জিত মুনাফা বা ‘রেন্ট’ হাতিয়ে নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ:

  • মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও বাণিজ্য উদারীকরণ: যদি অভ্যন্তরীণ বাজারে কোনো পণ্যের (যেমন জ্বালানি, সার) দাম সরকার নিয়ন্ত্রিত রাখে কিন্তু আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আংশিক খুলে দেওয়া হয়, তখন ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা কম দামে দেশের ভেতর থেকে পণ্য কিনে বা সংগ্রহ করে আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করতে পারে। রাশিয়ার গ্যাস বা ইউক্রেনের ধাতব শিল্পের ক্ষেত্রে এমন উদাহরণ দেখা গেছে।
  • একচেটিয়া ব্যবসার সুরক্ষা: উদারীকরণ করা হলেও যদি প্রতিযোগিতা সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট উদ্যোগ না নেওয়া হয় বা পুরনো একচেটিয়া ব্যবসার কাঠামো ভাঙা না হয়, তবে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মনোপলি ক্ষমতা ব্যবহার করে অস্বাভাবিক মুনাফা (monopoly rent) অর্জন করতে থাকে।
  • দুর্বল আর্থিক খাত: যদি ব্যাংকিং বা ঋণ ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত সংস্কার না করেই বেসরকারীকরণ বা অন্যান্য খাতে উদারীকরণ হয়, তবে নতুন মালিক বা প্রভাবশালী গোষ্ঠী কম সুদে বা সহজে সরকারি/বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে উচ্চ সুদে অন্যত্র খাটাতে পারে, কিংবা অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে ব্যক্তিগত সম্পদ বাড়াতে পারে।

এই প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা যায়, সম্পদের দক্ষ ব্যবহার হচ্ছে না, প্রতিযোগিতা সীমিত থাকছে, এবং মুষ্টিমেয় কিছু লোক অর্থনীতির বিকৃতিকে কাজে লাগিয়ে ফুলেফেঁপে উঠছে, যার বোঝা বহন করতে হচ্ছে পুরো সমাজকে। অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয় এক ধরনের “রেন্ট-নির্ভর সংস্কৃতি”।

২. নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়ার দখল (Policy Capture) ও অলিগার্কদের উত্থান: যখন এই রেন্ট-ভোগী গোষ্ঠীগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তখন তারা কেবল বাজার থেকে ফায়দা লুটে সন্তুষ্ট থাকে না। নিজেদের অবৈধ বা অন্যায্য সুবিধা টিকিয়ে রাখার জন্য তারা রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়াকেই প্রভাবিত বা ‘দখল’ করতে শুরু করে। লবিং, ঘুষ, রাজনৈতিক চাঁদা, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, এমনকি ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে তারা নিশ্চিত করে যেন এমন কোনো আইন বা নীতি গৃহীত না হয় যা তাদের স্বার্থে আঘাত হানে। এভাবেই জন্ম নেয় অলিগার্কতন্ত্র (Oligarchy) – যেখানে ক্ষুদ্র একটি ধনী ও প্রভাবশালী গোষ্ঠী রাষ্ট্রকে কার্যত নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করে।

  • রাশিয়ার উদাহরণ: ১৯৯০-এর দশকে রাশিয়ায় ‘শক থেরাপি’র নামে দ্রুত উদারীকরণ ও বেসরকারীকরণ (বিশেষত কুখ্যাত ‘লোনস-ফর-শেয়ার্স’ প্রকল্প) মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তিকে রাতারাতি বিপুল সম্পদের মালিক বানিয়ে দেয়। এই নব্য অলিগার্করা কেবল তেল, গ্যাস বা খনিজ সম্পদের মতো রাষ্ট্রীয় সম্পদ কুক্ষিগত করেই থামেনি, তারা প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের ক্ষমতার বৃত্তে ঢুকে পড়ে এবং পরবর্তী সময়েও রাশিয়ার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে নিজেদের প্রভাব অক্ষুণ্ণ রেখেছে। তারা এমন একটি ব্যবস্থা কায়েম করেছে যেখানে প্রতিযোগিতা সীমিত, আইনের শাসন দুর্বল এবং তাদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য সুরক্ষিত। এটি ছিল পার্শাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়ামের এক ধ্রুপদী উদাহরণ, যেখানে আংশিক সংস্কার একটি শক্তিশালী স্বার্থগোষ্ঠী তৈরি করে এবং সেই গোষ্ঠীই পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের পথে হিমালয়সম বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
  • ইউক্রেনের অভিজ্ঞতা: রাশিয়া ছাড়াও ইউক্রেন, কাজাখস্তানসহ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক দেশেই একই চিত্র দেখা গেছে। ইউক্রেনে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক পরিবর্তন এলেও, দেশটির অর্থনীতি ও রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে কয়েকটি শক্তিশালী অলিগার্কিক গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে ছিল, যারা জ্বালানি, মিডিয়া, কৃষি বা শিল্প খাতে নিজেদের একাধিপত্য বজায় রেখেছিল। ২০১৪ সালের ইউরোমাইদান বিপ্লবের পর সংস্কারের চেষ্টা হলেও, এই অলিগার্কদের প্রভাব বলয় ভাঙা ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। পার্শাল রিফর্মের মাধ্যমে তৈরি হওয়া এই ভারসাম্য ভাঙতে প্রয়োজন হয় ব্যাপক রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কাঠামোগত পরিবর্তনের।
  • অন্যান্য উন্নয়নশীল বিশ্ব: এই সমস্যা কেবল রূপান্তরকালীন অর্থনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক দেশেও দেখা গেছে, প্রাথমিক উদারীকরণ বা বেসরকারীকরণের পর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার সুযোগে একটি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদ চক্র গড়ে উঠেছে। ঘানার উদাহরণে দেখা যায়, বহু বছর ধরে সংস্কারের কথা বলা হলেও, বাজেট স্বচ্ছতা, সরকারি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ বা দুর্নীতি দমনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলো আটকে ছিল প্রভাবশালী মহলের বাধার কারণে। দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশেও দেখা যায়, আংশিক বাণিজ্য উদারীকরণের ফলে গড়ে ওঠা কিছু দেশীয় শিল্পগোষ্ঠী শুল্কছাড়, ভর্তুকি বা অন্যান্য সুরক্ষা পেয়ে এতটাই শক্তিশালী হয়েছে যে, তারা এখন সরকারের নীতিকে প্রভাবিত করে আরও প্রতিযোগিতা বা বিদেশি বিনিয়োগ ঠেকিয়ে রাখতে চায়।

এই উদাহরণগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে, পার্শাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়াম কেবল একটি অর্থনৈতিক অচলাবস্থা নয়, এটি একটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দুষ্টচক্র। একবার এই ভারসাম্য তৈরি হলে, তা থেকে বেরিয়ে আসা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, যারা এই অবস্থা থেকে লাভবান হচ্ছে, তারাই পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় বিরোধী এবং তাদের হাতেই থাকে পরিবর্তনের চাকা ঘোরানোর কলকাঠি। এই পরিস্থিতিকে তাই যথার্থই “সংস্কারের ফাঁদ” (reform trap) বা এক ধরনের নীমজাঁতা ভারসাম্য (suboptimal equilibrium) বলা হয় – যেখানে অর্থনীতি তার পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে পারে না, কারণ পরিবর্তনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা তারাই, যারা এই অসম্পূর্ণ ব্যবস্থা থেকেই সবচেয়ে বেশি সুবিধা আদায় করছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে পারশাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়াম: একটি বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতির ইতিহাস আলোচনায় “পারশাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়াম” বা “আংশিক সংস্কার ভারসাম্য” একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। এই ধারণাটি ব্যাখ্যা করে কেন অনেক উন্নয়নশীল দেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশে, অর্থনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে এসে থমকে যায় বা পূর্ণতা পায় না। এর ফলে অর্থনীতি একটি মধ্যম বা আংশিক সংস্কারকৃত অবস্থায় স্থিতিশীলতা লাভ করে, যা দীর্ঘমেয়াদী প্রবৃদ্ধি ও কাঠামোগত রূপান্তরের পথে বাধা সৃষ্টি করে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার অর্থনীতি অনুসরণ করে। বেশিরভাগ শিল্প ও বাণিজ্য রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। তবে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে ধীরে ধীরে অর্থনীতিকে উদারীকরণের দিকে চালিত করার চেষ্টা শুরু হয়। আশির দশক থেকে এবং বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির (Structural Adjustment Program – SAP) আওতায় বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি গৃহীত হয়। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল:

  1. ব্যক্তিখাতকে উৎসাহিতকরণ ও বেসরকারিকরণ: রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান কমানো এবং দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়।

  2. বাণিজ্য উদারীকরণ: আমদানি শুল্ক হ্রাস, পরিমাণগত বিধিনিষেধ অপসারণ এবং রপ্তানিমুখী শিল্পকে উৎসাহিত করা হয়।

  3. আর্থিক খাত সংস্কার: ব্যাংকিং খাতে সুদের হার নির্ধারণে শিথিলতা, বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন বৃদ্ধির চেষ্টা করা হয়।

  4. প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) আকর্ষণ: বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়।

পারশাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়ামের ধারণা ও বাংলাদেশে এর প্রয়োগ: অধ্যাপক মুশতাক খান (Mushtaq Khan) সহ অনেক অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি পারশাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়াম বা আংশিক সংস্কার ভারসাম্যের মধ্যে আটকা পড়েছে। এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:

  1. সংস্কারের অসম্পূর্ণতা: যদিও অনেক ক্ষেত্রে সংস্কার শুরু হয়েছে, কিন্তু তা পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি। যেমন, বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীরগতিতে চলেছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক বিবেচনায় বা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত অনেক লোকসানি প্রতিষ্ঠান এখনো সরকারের ভর্তুকিতে টিকে আছে। আর্থিক খাতে সংস্কার হলেও খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি, দুর্বল কর্পোরেট গভর্ন্যান্স এবং রাজনৈতিক প্রভাব কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।

  2. শক্তিশালী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাব: সংস্কার প্রক্রিয়া প্রায়শই শক্তিশালী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এলিট বা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর (vested interest groups) বাধার মুখে পড়ে। এই গোষ্ঠীগুলো বিদ্যমান আংশিক সংস্কারকৃত ব্যবস্থা থেকে সুবিধা (rent-seeking) ভোগ করে। পূর্ণাঙ্গ সংস্কার হলে তাদের এই সুবিধা কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাই তারা আরও গভীর বা কাঠামোগত সংস্কার প্রতিহত করে। উদাহরণস্বরূপ, তৈরি পোশাক শিল্পের মতো কিছু খাত দ্রুত বিকাশ লাভ করলেও অন্যান্য সম্ভাব্য খাত প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা বা সংস্কারের অভাবে বিকশিত হতে পারেনি। ঋণ খেলাপি প্রভাবশালীরা আর্থিক খাতের গভীর সংস্কারে বাধা দেয়।

  3. দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা: কার্যকর সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য শক্তিশালী, স্বচ্ছ ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান (যেমন: বিচার বিভাগ, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, প্রশাসন) অপরিহার্য। বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনেক সংস্কার নীতি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয় না বা এর সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায় না।

  4. রাজনৈতিক অর্থনীতির দুষ্টচক্র: রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য অনেক সময় অজনপ্রিয় কিন্তু জরুরি সংস্কার এড়িয়ে যেতে হয়। তারা বরং স্বল্পমেয়াদী জনপ্রিয় পদক্ষেপ বা প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোকে তুষ্ট রাখার নীতি গ্রহণ করে। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদী কাঠামোগত সংস্কার পিছিয়ে পড়ে এবং অর্থনীতি একটি নির্দিষ্ট ভারসাম্যে আটকে থাকে, যেখানে কিছু প্রবৃদ্ধি হলেও কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটে না।

  5. পথনির্ভরতা (Path Dependency): একবার অর্থনীতি একটি নির্দিষ্ট পথে চলতে শুরু করলে, সেই পথ থেকে সরে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রাথমিক সংস্কারগুলো যে ধরনের সুবিধাভোগী শ্রেণী তৈরি করে, তারা পরবর্তী সংস্কারের গতিপথকেও প্রভাবিত করে।

পরিণতি: এই আংশিক সংস্কার ভারসাম্যের কারণে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও কিছু মৌলিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না:

  • অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি: সংস্কারের সুফলগুলো অসমভাবে বণ্টিত হচ্ছে, যা আয় ও সম্পদ বৈষম্য বাড়াচ্ছে।

  • সুশাসনের অভাব: প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও দুর্নীতির কারণে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হচ্ছে।

  • শিল্পায়নে ধীরগতি: তৈরি পোশাক খাত ছাড়া শিল্পায়নের ভিত্তি এখনো যথেষ্ট প্রশস্ত হয়নি।

  • রাজস্ব আহরণে দুর্বলতা: কর ভিত্তি প্রসারিত করা এবং কর ফাঁকি রোধে কার্যকর সংস্কারের অভাব রয়েছে।

  • রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের লোকসান: বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ ভর্তুকি হিসেবে চলে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে পারশাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়াম একটি বাস্তব চিত্র। নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু হওয়া সংস্কার প্রক্রিয়া অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনলেও শক্তিশালী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে তা পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি। এই ভারসাম্য থেকে বেরিয়ে এসে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং প্রভাবশালী গোষ্ঠীর বলয় ভেঙে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সক্ষমতা অর্জন করা।

রাজনৈতিক অর্থনীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা

পার্শাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়াম তত্ত্বটি কেবল অতীতের ব্যর্থতা বিশ্লেষণের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের নীতি নির্ধারণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পথনির্দেশক হিসেবেও এর গভীর তাৎপর্য রয়েছে।

  • সংস্কারের নকশা ও ঝুঁকির উপলব্ধি: এই তত্ত্ব নীতিনির্ধারকদের সতর্ক করে দেয় যে, সংস্কার কোনো সরলরৈখিক বা যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়। ধাপে ধাপে সংস্কার করার বাস্তবসম্মত প্রয়োজন থাকলেও, প্রতিটি পদক্ষেপের সম্ভাব্য রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে। কোন নীতি বা পরিবর্তন কাদের জন্য অপ্রত্যাশিত সুবিধার (রেন্ট) সুযোগ তৈরি করতে পারে, এবং সেই সুবিধাভোগীরা কীভাবে বিদ্যমান ক্ষমতার কাঠামোকে প্রভাবিত করতে পারে – এই প্রশ্নগুলো সংস্কারের নকশা প্রণয়নের শুরুতেই মাথায় রাখা জরুরি। তত্ত্বটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, অর্থনৈতিক যুক্তি যতই অকাট্য হোক না কেন, পর্দার আড়ালে থাকা স্বার্থগোষ্ঠীর হিসাব-নিকাশ প্রায়শই সংস্কারের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়।

  • প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের অপরিহার্যতা: পার্শাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়াম তত্ত্বটি জোরালোভাবে প্রমাণ করে যে, অর্থনৈতিক সংস্কার ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার হাত ধরাধরি করে চলতে হয়। কেবল বাজার খুলে দেওয়া বা বেসরকারীকরণ করলেই হবে না; তার সাথে প্রয়োজন শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থা, কার্যকর আইনের শাসন, স্বচ্ছ বিচার ব্যবস্থা, এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা থাকলে অর্থনৈতিক সংস্কারের সুফল জনগণের কাছে পৌঁছায় না, বরং তা মুষ্টিমেয় কিছু লোকের পকেটস্থ হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের “সীমিত প্রবেশাধিকার ব্যবস্থা” (Limited Access Order) বা অর্থনীতিতে “নীতি বন্দিত্ব” (Policy Capture) এর ধারণাগুলো পার্শাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়ামের সাথেই সম্পর্কিত। এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে, কেন অনেক উন্নয়নশীল দেশে কাগজে-কলমে আধুনিক প্রতিষ্ঠান বা আইন থাকা সত্ত্বেও সেগুলো বাস্তবে অকার্যকর থেকে যায় – কারণ প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলো পর্দার আড়াল থেকে সেগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে রাখে বা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে।

  • অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কার কৌশল: হেলমানের গবেষণা থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাওয়া যায় – সংস্কার প্রক্রিয়ায় ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা বা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি (inclusive approach) গ্রহণ করা জরুরি। যদি সংস্কার প্রক্রিয়ায় সমাজের বৃহত্তর অংশকে (এমনকি যারা স্বল্পমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে) আস্থায় আনা যায় এবং তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করা যায়, তবে তা প্রভাবশালী ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর ক্ষমতাকে প্রতিহত করতে সাহায্য করে। জনগণ যখন সংস্কারের দীর্ঘমেয়াদী সুফলের বিষয়ে আশ্বস্ত হয় এবং প্রক্রিয়াটির স্বচ্ছতা নিয়ে সন্দিহান থাকে না, তখন তারা সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে সংস্কার এগিয়ে নিতে সহায়তা করতে পারে। বিপরীতে, যখন মুষ্টিমেয় কিছু টেকনোক্র্যাট বা কর্তৃত্ববাদী শাসক জনবিচ্ছিন্নভাবে সংস্কার চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, তখন তারা প্রায়শই পর্দার আড়ালের সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর ফাঁদে পা দেয়।

  • নীতি প্রণয়নে দূরদর্শিতা: এই তত্ত্ব নীতিনির্ধারকদের শেখায় যে, সংস্কারের প্রাথমিক পর্যায়েই এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত যা বড় ধরনের রেন্ট সৃষ্টির সুযোগ কমিয়ে দেয়। যেমন, যত দ্রুত সম্ভব প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করা, স্বচ্ছ নিলাম বা দরপত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ হস্তান্তর করা, তথ্য প্রবাহ অবাধ রাখা, এবং গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের নজরদারির সুযোগ তৈরি করা। একইসাথে, ক্ষমতাধর স্বার্থগোষ্ঠীর প্রভাব খর্ব করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং প্রয়োজনে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানসিকতা অপরিহার্য।

শেষ কথা: এক অন্তহীন লড়াই

সুতরাং, পার্শাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়াম কেবল একটি একাডেমিক তত্ত্ব নয়, এটি বাংলাদেশ সহ বহু উন্নয়নশীল ও রূপান্তরকালীন অর্থনীতির দেশের জন্য এক কঠিন এবং প্রায়শই অনতিক্রম্য বাস্তবতা। এই ধারণাটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, অর্থনীতির গতিপথ নির্ধারণে নিছক অর্থনৈতিক যুক্তির চেয়েও রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ, ক্ষমতার বিন্যাস এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থের দ্বন্দ্ব কতটা নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে। সংস্কারের পথ কখনোই সরলরৈখিক বা মসৃণ হয় না; এতে কেবল অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জই থাকে না, বরং থাকে গভীর রাজনৈতিক প্রতিরোধ – যার সবচেয়ে কঠিন রূপটি আসে প্রায়শই সংস্কারের প্রাথমিক সুফলভোগীদের কাছ থেকেই, যারা অর্জিত সুবিধাটুকু ধরে রাখতে পরবর্তী ধাপের সংস্কারকে প্রতিহত করে।

বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ থেকে শুরু করে জাতীয় সরকার এবং গবেষক মহল – সকলেই এই অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে ক্রমশ উপলব্ধি করছে যে, আংশিক বা অসম্পূর্ণ সংস্কার অনেক সময় কোনো সংস্কার না হওয়ার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর হতে পারে। এটি এমন এক জটিল ভারসাম্যহীনতা বা অচলায়তনের জন্ম দেয়, যা ভাঙতে প্রয়োজন হয় অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শী নেতৃত্ব, দৃঢ় ও স্বাধীন প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি এবং সর্বোপরি, বৃহত্তর জনগণের সচেতন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ। পার্শাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়ামের এই চোরাবালি এড়িয়ে একটি দেশ কীভাবে স্বীয় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর বলয় ভেঙে তার পূর্ণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্ভাবনার পথে টেকসই যাত্রা অব্যাহত রাখতে পারে – এটিই আজকের উন্নয়ন ভাবনার অন্যতম কেন্দ্রীয় এবং জরুরি প্রশ্ন। এই জটিল যাত্রাপথের বাধাগুলোকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে এবং তা অতিক্রম করার কার্যকর কৌশল নির্ধারণে পার্শাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়ামের তত্ত্বটি নিঃসন্দেহে এক মূল্যবান বিশ্লেষণাত্মক আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে।

তথ্যসূত্র

  • Hellman, Joel S. (1998). “Winners Take All: The Politics of Partial Reform in Postcommunist Transitions.” World Politics, 50(2): 203-234. ​cambridge.org
  • Hellman, Joel S., Geraint Jones, and Daniel Kaufmann (2000). “Seize the State, Seize the Day: State Capture, Corruption and Influence in Transition.” Policy Research Working Paper 2444, World Bank​. imf.org
  • Addison, Tony (2001). “Do Donors Matter for Institutional Reform in Africa?” WIDER Discussion Paper 2001/141​. papers.ssrn.com.
  • Hoff, Karla & Joseph E. Stiglitz (2004). “After the Big Bang? Obstacles to the Emergence of the Rule of Law in Post-Communist Societies.” American Economic Review, 94(3): 753-763.
  • Levy, Brian (2014). Working with the Grain: Integrating Governance and Growth in Development Strategies. New York: Oxford University Press.
  • World Bank (2002). Transition – The First Ten Years: Analysis and Lessons for Eastern Europe and the Former Soviet Union. Washington, DC: The World Bank. ​imf.org
  • Khan, Mushtaq H. (2000). “Rents, Efficiency and Growth.” In Rents, Rent-Seeking and Economic Development: Theory and Evidence in Asia. Cambridge University Press. (এই বইয়ে পারশাল রিফর্ম ইকুইলিব্রিয়ামের ধারণা এবং উন্নয়নশীল দেশে এর প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে)।
  • Sobhan, Rehman. (1993). Bangladesh: Problems of Governance. Konark Publishers Pvt. Ltd. (বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা ও সংস্কার প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা)।
  • Mahmud, Wahiduddin. (2002). “National Budgets, Social Spending and Public Choice: The Case of Bangladesh.” Working Paper No. 45. Centre for Policy Dialogue (CPD). (সরকারি ব্যয় ও নীতি নির্ধারণে রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রভাব)।
  • Ahmed, Sadiq & Mahmud, Wahiduddin. (Eds.). (2012). Bangladesh Confronts Climate Change: Keeping Our Heads Above Water. The University Press Limited (UPL). (যদিও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক, তবে এতে বাংলাদেশের উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা রয়েছে)।
  • Islam, Mirza Azizul. (2016). Governance and Development Management: A Bangladesh Perspective. The University Press Limited (UPL). (সুশাসন ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা)।
  • Sen, Binayak & Hulme, David. (Eds.). (2018). The Politics and Governance of Basic Education: A Tale of Two South Asian Countries. Oxford University Press. (শিক্ষা খাতের উদাহরণ দিয়ে শাসনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক অর্থনীতির মিথস্ক্রিয়া আলোচনা করা হয়েছে, যা অন্যান্য খাতের জন্যও প্রাসঙ্গিক)।
  • Raihan, Selim. (2021). Political Economy of Development: Bangladesh Perspective. Palgrave Macmillan. (বাংলাদেশের উন্নয়নের রাজনৈতিক-অর্থনীতি নিয়ে একটি সাম্প্রতিক ও বিস্তৃত আলোচনা)।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.