ট্রাম্পের পদক্ষেপে বিশ্ব আতঙ্কিত: নতুন এক বিশ্ব মহামন্দার (Great Global Recession) আশঙ্কা?

ভূমিকা: এক ঐতিহাসিক ঘোষণার প্রেক্ষাপট

২ এপ্রিল, ২০২৫ মার্কিন রাজনীতির ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত দিন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। স্টক মার্কেট, বিভিন্ন বাজার এবং এমনকি নিজের দলের অনেকাংশের সতর্কতা সত্ত্বেও ডোনাল্ড ট্রাম্প তার আরোপিত শুল্ক (Tariffs) থেকে পিছু হটেননি। বরং এর ঠিক উল্টো ঘটেছে। হোয়াইট হাউসের মতে, বিশ্বের বাকি দেশগুলো শুল্ক ব্যবহার করে এবং নিজেদের মুদ্রা বিনিময়ের হারকে সুবিধামত পরিবর্তন (Manipulating their currencies) করে মার্কিন অর্থনীতির উপর পরজীবী (Parasitized) হয়ে থেকেছে, আর এখন তাদের মূল্য পরিশোধ করার পালা। কিন্তু সত্যিটা হলো, ট্রাম্পের দাবি অনুযায়ী যেসব দেশ তাদের মুদ্রা ম্যানিপুলেট করে, তাদের মধ্যে ইকুয়েডরও রয়েছে, যা সম্পূর্ণভাবে ডলারাইজড (Dollarized) একটি অর্থনীতি।

ট্রাম্পের শুল্কনীতির অদ্ভুত যুক্তি

শুল্ক গণনার জন্য তারা যে পদ্ধতি ব্যবহার করেছে, তার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপদেষ্টাদের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো দেশের সাথেই বাণিজ্য ঘাটতি (Trade Deficit) না থাকাটাই স্বাভাবিক। সুতরাং, অন্যান্য দেশের মুদ্রাগত হস্তক্ষেপের (Monetary Intervention) পরিমাণ পরিমাপ করা খুব সহজ। আপনার আমার সাথে যে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত (Trade Surplus) আছে, তাকে আমদানির (Imports) পরিমাণ দিয়ে ভাগ করলে যদি ৪০% হয়, তাহলে আপনি আপনার মুদ্রা ম্যানিপুলেট করছেন অথবা অন্য কোনো উপায়ে ৪০% মূল্যের বাণিজ্য প্রতিরোধ করছেন। বিষয়টা এতটাই সহজ। আর যেহেতু আমি এত মহান একজন মানুষ, তাই আমি এর অর্ধেক, অর্থাৎ ২০% শুল্ক আরোপ করব!

যখন মানুষ বুঝতে শুরু করে যে শুল্ক আরোপের জন্য এই সূত্রটিই বেছে নেওয়া হয়েছে, তখন একজন সরকারি মুখপাত্র তা অস্বীকার করতে এগিয়ে আসেন। তিনি বলেন যে, না, সবার শান্ত থাকা উচিত; মার্কিন সরকার আসলে বাকি দেশগুলোকে শাস্তি দেওয়ার জন্য একটি অত্যন্ত জটিল গাণিতিক মডেল ব্যবহার করেছে। কিন্তু মজার বিষয় হলো, এই আপাতদৃষ্টিতে জটিল মডেলটি আসলে বাণিজ্য ঘাটতিকে কয়েকটি উৎপাদক (Factors), আমদানি এবং কিছু নির্বাচিত গ্রিক অক্ষর (Greek letters) দিয়ে ভাগ করার চেয়ে বেশি কিছু নয়। এই গ্রিক অক্ষরগুলো ফলাফলের উপর কোনো প্রভাব ফেলে না, কারণ সেগুলোকে একসাথে গুণ করলে তার মান দাঁড়ায় এক (1)। ওহ, আর যদি কোনো কারণে কোনো দেশের আমেরিকার সাথে বাণিজ্য ঘাটতি থাকে, তাহলে আমরা ন্যূনতম ১০% শুল্ক আরোপ করব। এমনকি তিনি এমন একটি দ্বীপের উপরও ১০% শুল্ক আরোপ করেছেন, যেখান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিছুই রপ্তানি হয় না, কারণ সেখানে কেবল পেঙ্গুইন থাকে! সংক্ষেপে, এটি একটি পুরোপুরি তামাশা।

ডোনাল্ড ট্রাম্প এই দিনটিকে ‘স্বাধীনতা দিবস’ (Liberation Day) বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যে একটি স্বাধীনতা দিবস রয়েছে – ৪ঠা জুলাই। সেই দিনটি স্বাধীনতার ঘোষণার দিন এবং আমেরিকানদের অভিযোগগুলোর মধ্যে একটি ছিল ব্রিটিশরা তাদের বিশ্বের বাকি অংশের সাথে অবাধে বাণিজ্য (Free Trade) করতে বাধা দিয়েছিল। বিষয়টা খুবই আয়রনিক, না? যাই হোক না কেন, আজ এখানে আমি বাণিজ্য ঘাটতি বা এই জাতীয় কিছু নিয়ে আলোচনা করতে আসিনি।

অভূতপূর্ব পদক্ষেপ ও মন্দার পূর্বাভাস

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ট্রাম্পের এই শুল্কনীতি এককথায় অভূতপূর্ব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতদিন ধরে তার সীমানার ভেতরে এবং বাইরে বাণিজ্যের বাধা (Barriers to Trade) কমাতে সম্ভাব্য সবকিছু করেছে। কিন্তু আজকাল রিপাবলিকান প্রশাসন কেবল সংরক্ষণবাদী আমেরিকার (Protectionist America) যুগে ফিরে গিয়েই সন্তুষ্ট নয়, বরং আরও অনেক দূরে যেতে চায়। বিংশ শতাব্দীতে এর সর্বোচ্চ পর্যায়ে মার্কিন শুল্ক আমদানির ২০% পর্যন্ত পৌঁছেছিল। কিন্তু এই তথাকথিত ‘স্বাধীনতা দিবসের’ পর, সেই সংখ্যা ৩০% পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।

যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে এসেছিলেন, তখন মার্কিন অর্থনীতি দুরন্ত গতিতে চলছিল। এটি অন্য যেকোনো জি-৭ (G7) দেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিল, প্রায় চীনের প্রবৃদ্ধির হারের কাছাকাছি। অবশ্যই, এর কারণ হলো আমেরিকা অনেক বেশি ধনী। কিন্তু এখন আমরা এই ধরনের খবর শুনতে শুরু করেছি:

  • জেপি মরগ্যান চেজ (JP Morgan Chase) এই বছর মার্কিন মন্দার (US Recession) সম্ভাবনা ৪০% দেখছে।

  • জেপি মরগ্যান এই বছরের জন্য মন্দার সম্ভাবনা বাড়িয়ে ৬০% করেছে।

  • এদিকে, আটলান্টা ফেড (Atlanta Fed) অনুমান করছে যে আগামী ত্রৈমাসিকে মার্কিন অর্থনীতি ১% সংকুচিত (Shrink) হবে।

বাজার আতঙ্কিত (Panicking) হয়ে পড়েছে এবং অনেক বিশ্লেষক এখনও আত্মবিশ্বাসী যে এটি দর কষাকষির একটি কৌশল (Bargaining Chip) ছাড়া আর কিছুই নয়। সংক্ষেপে, কেউ জানে না কী ঘটতে চলেছে, কিন্তু পরিস্থিতি ভালো দেখাচ্ছে না। এবং বিশ্বাস করুন, আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কের সাথে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আমদানির উপর গড় শুল্কের হার কুখ্যাত স্মুট-হলি আইনের (Smoot-Hawley Act) দ্বারা আরোপিত হারের চেয়েও অনেক উপরে নিয়ে যাবে। এই আইনটি ঠিক কী? এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম বৃহত্তম শুল্ক বৃদ্ধির ঘটনা, যা ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দার (Great Depression) সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। হ্যাঁ, সেই একই মহামন্দা যা মার্কিন জিডিপি (GDP) ২৫% কমিয়ে দিয়েছিল।

আর এখানেই আমরা মূল প্রসঙ্গে আসি। ইতিহাসের বই এবং অর্থনীতির বইগুলো মহামন্দাকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে খুব ভিন্ন ভিন্ন পথ অনুসরণ করে। একটি বিশ্লেষণ অনুসারে, এমন একটি বিষয় রয়েছে যা অনেক অর্থনীতির বই উল্লেখ করে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহৃত নয়টি সর্বাধিক জনপ্রিয় ইতিহাসের বইয়ের একটিও এই বিষয়টি উল্লেখ করে না – সেটি হলো স্মুট-হলি ট্যারিফ। অন্য কথায়, অনেক অর্থনীতিবিদ বিশ্বাস করেন যে এই শুল্ক হয়তো মহামন্দার কারণ ছিল না, কিন্তু এটি পরিস্থিতিকে আরও অনেক খারাপ করে তুলেছিল। স্বাভাবিকভাবেই, এই বিষয়টি মাথায় রেখে, আমি কয়েকটি প্রশ্ন করেছি: ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক কতটা ক্ষতি করতে পারে? তার নীতি ১৯৩০-এর দশকের স্মুট-হলি আইনের সাথে কতটা সাদৃশ্যপূর্ণ এবং কতটা ভিন্ন? আমি আজকের লেখায় এই সবকিছু বিস্তারিত আলোচনা করব।

ইতিহাসের পাতা থেকে: স্মুট-হলি ট্যারিফ ও মহামন্দা

১৯২০-এর দশকের ‘গর্জনশীল বিশের দশক’ (Roaring Twenties) চলাকালীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনীতিতে একটি স্বর্ণযুগ (Golden Era) উপভোগ করছিল। হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা ছিলেন ক্যালভিন কুলিজ (Calvin Coolidge)। কুলিজ কার্যত কিছুই করেননি। হয়তো সেজন্যই সবকিছু এত ভাল চলছিল! কুলিজ ছিলেন রিপাবলিকান পার্টির, যে দলটি ঐতিহাসিকভাবে সর্বদা উচ্চ শুল্কের পক্ষে ছিল। আপনাদের একটি ধারণা দেওয়ার জন্য বলি, আব্রাহাম লিংকন তার পুরো প্রচারণা দুটি নীতির উপর ভিত্তি করে চালিয়েছিলেন: প্রথমত, দক্ষিণে দাসদের মুক্ত করা এবং দ্বিতীয়ত, শুল্ক বৃদ্ধি করা। ক্যালভিন কুলিজও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না, তবে তাকে মার্কিন ইতিহাসে অন্যতম মুক্তবাজারপন্থী (Pro-Free Market) রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এখন, আমি কুলিজের প্রসঙ্গটা তার শুল্ক নীতি সম্পর্কে বলার জন্য এখানে টানিনি। দেখুন, ব্যাপারটা হলো, উত্তাল ১৯২০-এর দশক সবার জন্য ততটা মজার ছিল না। একটি গোষ্ঠী সেই সময়ে যথেষ্ট ক্রয়ক্ষমতা (Purchasing Power) হারিয়েছিল – তারা হলো কৃষি শ্রমিক (Farm Workers)। কারণটা বেশ সহজ – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (World War I) শেষের পর এই খাতটি খুব ধনী হয়ে উঠেছিল। ইউরোপ বিধ্বস্ত ছিল এবং আমেরিকান গম ইউরোপে খুব মূল্যবান ছিল। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই, ইউরোপ পুনরুদ্ধার হওয়ার সাথে সাথে কৃষকরা এই অসাধারণ আয়ের উৎস হারাতে শুরু করে। তবে এটি কোনো সমস্যাই হতো না যদি তারা সেই অতিরিক্ত আয় ব্যবহার করে ঋণে জর্জরিত না হতো। তাই যখন সোনার ডিম পাড়া হাঁসটি অদৃশ্য হয়ে গেল, তারা আর তাদের ঋণ পরিশোধ করতে পারল না। কৃষকরা সরকারের কাছে বেইলআউট চেয়েছিল, কিন্তু কুলিজ তা প্রত্যাখ্যান করেন। এটি রিপাবলিকান ভোটারদের একাংশকে ক্ষুব্ধ করে এবং যদিও এই দলটি নির্বাচনে আবার জিতেছিল, কুলিজ বাড়ি ফিরে যান এবং তার স্থলাভিষিক্ত হন এই গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র হার্বার্ট হুভার (Herbert Hoover)।

হুভার নিজে শুল্কের খুব বড় প্রবক্তা ছিলেন না, কিন্তু এটি ছিল তার প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে একটি। আর যেই কথা সেই কাজ। ১৯২৯ সালে, শুল্ক বাড়ানোর জন্য একটি কনভেনশন শুরু হয়েছিল, যেখানে শুল্ক ইতিমধ্যেই বেশ উঁচু ছিল। স্মুট-হলি আইনটি এভাবে আকার নিতে শুরু করে। তবে একটি জিনিস আমাদের স্বীকার করতেই হবে: এই শুল্কের আইন প্রণয়ন (Legislation) ট্রাম্পের শুল্কের চেয়ে অনেক কম বিশৃঙ্খল ছিল, অন্তত শুরুর দিকে।

স্মুট-হলি আইনের বিশদ বিশ্লেষণ

প্রথমত, একটি সাক্ষাৎকারের পর্ব ছিল যেখানে ১,০০০ জনেরও বেশি লোকের সাথে পরামর্শ করা হয়েছিল। এই সাক্ষাৎকারগুলোর ফলে একটি ১০,৭০০ পৃষ্ঠার রিপোর্ট তৈরি হয়েছিল, যা ১৮টি ভলিউমে প্রকাশ করতে হয়েছিল। যেখানে ট্রাম্পের শুল্ক একটি টুইটে (Tweet) এঁটে যায় কারণ সেগুলি মূলত একটি শতাংশ যা পুরো দেশের উপর প্রযোজ্য, সেখানে স্মুট-হলি বিলটি ছিল ২০০ পৃষ্ঠা দীর্ঘ, যা পূর্ববর্তী শুল্ক আইনের চেয়ে অনেক বেশি। আমরা এমন শুল্কের কথা বলছি যা একেক পণ্যে একেক রকম হলো, আর এই তারতম্যের ব্যাপারটাও ছিল বিশাল। রাজনীতিবিদরা ভালভাবেই জানতেন যে একটি পাগলাটে শুল্ক মার্কিন শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে, কারণ এতে মার্কিন কারখানাগুলো বাইরে থেকে যে কাঁচামাল কেনে তা আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে।

হার্বার্ট হুভার বলেছিলেন, “আমাদের শুল্কের পরিবর্তন নির্ধারণ করার সময়, আমাদের অবশ্যই সামগ্রিকভাবে দেশের বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনা করতে হবে। এটি স্পষ্টতই অবিবেচনাপ্রসূত সংরক্ষণবাদ (Unwise Protection) যা আমদানিতে কম কর্মসংস্থান লাভের জন্য রপ্তানিতে বেশি কর্মসংস্থান উৎসর্গ করে।”

বলা বাহুল্য, পরিস্থিতি যতটা ভাল শোনালো ততটা ছিল না। এরা ধারণা করেছিল কৌশলগত শুল্ক (Strategic Tariffs) আরোপ করার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপকার হবে। তবে, এই মনোভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আইনটি এক চেম্বার থেকে অন্য চেম্বারে পাস হতে থাকে এবং প্রতিটি সংশোধনে বা রিভিশনে কিছু শুল্ক যোগ করা বা সরানো হয়, যা নির্ভর করত কোন লবি বেশি শক্তিশালী তার উপর। ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানদের একটি দল অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ইনপুট বা কাঁচামাল, যেমন লোহার আকরিক (Iron Ore) এর উপর শুল্ক কমানোর জন্য বাহিনী গঠন করে। তারা এটিকে প্রতি টন ১.৫০ ডলার থেকে ০.৭৫ ডলারে নামাতে সফল হয়েছিল। কিন্তু পরে আরেকদল রাজনীতিবিদ এই পরিবর্তনটি উল্টে দেয়।

শেষ পর্যন্ত, এটি একটি খুব দীর্ঘ এবং খুব বিস্তারিত আইন ছিল। কিন্তু এটি অর্থনীতিবিদদের দ্বারা তৈরি হয়নি, বরং রাজনীতিবিদ এবং লবিস্টদের দ্বারা তৈরি হয়েছিল। স্মুট (Smoot)-এর নামে আইনটির নামকরণ করা হয়েছে। তিনি একজন মরমন নেতা ছিলেন এবং ‘সংরক্ষণবাদের প্রেরিত পুরুষ’ (Apostle of Protectionism) নামে পরিচিত ছিলেন। চিনির শুল্কের সমালোচনা করা একটি অর্থনৈতিক গবেষণার বিষয়ে স্মুট রিপোর্টটি প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন যে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা কিছু নির্বোধ ত্রুটি (Idiotic Errors) করেছেন এবং “যদি তারা চিনির ক্ষেত্রে যতটা ভুল করেছে, তার অর্ধেকও ভুল করে থাকে, তবে সেই ট্র্যাক্টের প্রতিটি লাইনই মৌখিক আবর্জনা (Verbal Rubbish)।” পরিচিত শোনাচ্ছে, তাই না? ট্রাম্পের কথার ধরণের সাথে কত মিল! কিছু জিনিস কখনই বদলায় না।

শেষ পর্যন্ত, শুল্ক আকাশছোঁয়া হয়ে ওঠে, যদিও সেগুলি আগে থেকেই বেশ উঁচুতে ছিল, বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের স্তরের তুলনায়। গড়ে, সমস্ত রপ্তানির উপর শুল্কের হার (Tariff Rate) ১৫% থেকে ২০% এ, অর্থাৎ ৫ শতাংশ পয়েন্ট (Percentage Points) বৃদ্ধি পায়। আইনটিতে বিভিন্ন পণ্যের জন্য ৩,৩০০ টিরও বেশি শুল্ক তালিকাভুক্ত ছিল। তবে এটাই এই আইনের একমাত্র ত্রুটি নয়। ইতিমধ্যে যে শুল্কগুলো এখানে দেখানো হলো সেগুলো মোট মূল্যের শতাংশ ছিল না, বরং একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ছিল। যেমন, চিনির শুল্ক ছিল প্রতি পাউন্ডে ২.৫ সেন্ট, ২০% নয়। এটি দেখতে সাধারণ মনে হলেও, এটিই ছিল এই আইনটিকে এত ক্ষতিকর করে তোলার কারণ।

মহামন্দা ছিল মুদ্রাস্ফীতি-বিরোধী (Deflationary), অর্থাৎ দাম হু হু করে কমে গিয়েছিল। এদিকে, শুল্কের একটি নির্দিষ্ট মান (Fixed Value) ছিল। সুতরাং, সময়ের সাথে সাথে শুল্কের পারসেন্টেজও বাড়তে থাকে। গাণিতিক অনুমান অনুসারে, স্মুট-হলি আইন একাই আমদানি ৪ থেকে ৫% কমিয়েছিল। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির কারণে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। শুল্কের আওতায় থাকা পণ্যগুলির উপর প্রভাব খুব খুব শক্তিশালী ছিল। প্রায় রাতারাতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুল্কের আওতায় থাকা প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি বন্ধ করে দেয়।

মোট আমদানি ৪০% কমে গিয়েছিল এবং স্মুট-হলি আইন এর জন্য কেবল ১০% দায়ী। জিডিপির উপর এর প্রভাব আরও কম ছিল। শুল্কের আওতায় থাকা পণ্যগুলো মার্কিন জিডিপির মাত্র ১.৩% ছিল। সুতরাং আপনি ভাবতে পারেন যে এসব মার্নিক অর্থনীতিতে খুব বেশি ক্ষতি করতে পারেনি, বা অন্তত সরাসরি ক্ষতি করতে পারেনি। কিন্তু শুল্ক প্রথম নজরে যতটা নিরীহ মনে হয় তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর। উদাহরণস্বরূপ, বাণিজ্য হ্রাস করার মাধ্যমে, সেই বাণিজ্যের সাথে যুক্ত সুবিধাগুলোও অদৃশ্য হয়ে যায়। সেই সুবিধাগুলি অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করা যেত, যা আরও বেশি সম্পদ তৈরি করত। একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুসারে, এই শুল্ক এইভাবে জিডিপি আরও ২% কমিয়েছিল। এবং হ্যাঁ, দেশের জিডিপি ২৫% হ্রাসের তুলনায় ২% খুব বেশি নয়। কিন্তু মনোযোগ দিন, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে, এই পতনটি একটি মোটামুটি স্ট্যান্ডার্ড প্রবৃদ্ধি হার থেকে মন্দায় যাওয়ার মতো হবে।

কিন্ডলবার্জার স্পাইরাল ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

কিন্ডলবার্গার স্পাইরাল (Kindleberger Spiral) বলে একটা বিষয় আছে যা দেখায় কিভাবে বিশ্ব বাণিজ্য (Global Trade) জানুয়ারী ১৯২৯ সালের ৩ বিলিয়ন ডলার থেকে সংকুচিত হয়ে ১৯৩৩ সালে মাত্র ১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। এর কারণও ছিল সেই স্মুট-হলি ট্যারিফ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিরুদ্ধে বাণিজ্য যুদ্ধ (Trade War) ঘোষণা করেছিল এবং বিশ্ব এর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল।

শুল্ক আমেরিকান উৎপাদন খাতকে (Manufacturing Sector) শক্তিশালী করতে বা এমনকি কৃষি খাতকে খুশি করতেও সাহায্য করেনি। কিন্তু একটি পণ্য ছিল যা তারা রপ্তানি করতে সাহায্য করেছিল – তা হলো আমেরিকা-বিরোধিতা (Anti-Americanism)। উদাহরণস্বরূপ, কানাডায়, প্রগ্রেসিভ পার্টির (Progressive Party) সভাপতি একজন মুক্ত বাণিজ্য প্রবক্তা ছিলেন। এই শুল্কের কারণে নির্বাচনে হেরে যান এবং তার উত্তরসূরি এর প্রতিক্রিয়া জানাতে দ্বিধা করেননি। কিন্তু বাকি বিশ্বে যা ঘটেছিল তার তুলনায় কানাডা একটি ছোট ঘটনা মাত্র। শুরুতেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের মহাদেশের এবং ইউরোপেরও সমর্থন হারিয়েছিল। ইম্পরটেন্ট বিষয় হচ্ছে, এই মহামন্দা ছিল নাৎসিবাদের (Nazism) উত্থানের অন্যতম কারণ এবং সেটা শুল্ক পরিস্থিতিকে ভালো করতে সাহায্য করেনি।

অর্থনীতিবিদ চার্লস কিন্ডলবার্গার (Charles Kindleberger) যেমনটা বলেছেন: “বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অস্থিতিশীল ছিল যতক্ষণ না কোনো দেশ এটিকে স্থিতিশীল করে, যেমন ব্রিটেন উনিশ শতকে এবং ১৯১৩ সাল পর্যন্ত করেছিল। ১৯২৯ সালে ব্রিটিশরা তা করতে পারেনি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা করতে চায়নি। যখন প্রতিটি দেশ তার জাতীয় ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা করতে ঝুঁকেছিল, তখন বিশ্বের জনস্বার্থ (Public Interest) রসাতলে গিয়েছিল এবং এর সাথে সকলের ব্যক্তিগত স্বার্থও।” যখন একটি বিশাল অর্থনৈতিক সংকটকে ইন্ধন দেওয়া হয়, তখন রাজনৈতিক অবস্থানগুলো উগ্র (Radicalized) হয়ে ওঠে এবং ঠিক এটাই আজ ঘটছে।

সবচেয়ে ভয়ের বিষয় ২রা এপ্রিলের শুল্ক নয়, বরং এই যে আমরা জানি না বিশ্বের বাকি অংশের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধ কতটা বাড়বে। কানাডা, মেক্সিকো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (European Union) ইতিমধ্যে প্রতিক্রিয়া ঘোষণা করেছে এবং চীন সমস্ত মার্কিন আমদানির উপর ৩৪% প্রতিশোধমূলক শুল্ক (Retaliatory Tariffs) ঘোষণা করেছে।

দেখা যাক, এর শেষ কেবল চারটি সম্ভাব্য উপায়ে হতে পারে:

  • ১. প্রথমত, সবাই রাজা ট্রাম্পের কাছে আত্মসমর্পণ করবে এবং হয়তো মার-এ-লাগো চুক্তির (Mar-a-Lago Accord) মতো কিছুতে স্বাক্ষর করবে।
  • ২. দ্বিতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নতি স্বীকার করবে এবং শুল্ক প্রত্যাহার করবে। মার্কিন স্টক মার্কেটের দিকে তাকালে এটিই সবচেয়ে সম্ভাব্য বলে মনে হয়। তবে আবার, ট্রাম্পের ক্ষেত্রে কিছুই নিশ্চিত করে বলা যায় না।
  • ৩. আরেকটি বিকল্প হলো, বিশ্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়াই এগিয়ে যাবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, ভারত, চীন এবং বিশ্বের বাকি দেশগুলো একে অপরের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। চীন ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে যে তারা দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের সাথে তাদের সম্পর্ক জোরদার করতে চায়। এবং ইউরোপে, মারিও দ্রাঘি (Mario Draghi)-র মতো ভয়েসগুলো অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যকে উদার করার (Liberalize internal trade) জন্য দাবি জানাচ্ছে যাতে একবারের জন্য একটি প্রকৃত একক বাজার (Single Market) তৈরি হয়।
  • ৪. কিন্তু অবশ্যই, চতুর্থ বিকল্পও রয়েছে – সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলা (Total Chaos)। বিশ্ব বাণিজ্য ভেঙে পড়ুক, যেমনটা মহামন্দার সময় হয়েছিল। এটি হবে সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং এটি কেবল অর্থনৈতিকই হবে না। ফরাসি অর্থনীতিবিদ ফ্রেডেরিক বাস্তিয়া (Frédéric Bastiat) বলেছিলেন: “যখন পণ্য সীমান্ত অতিক্রম করে না, তখন সৈন্যরা করবে।” (When goods do not cross borders, soldiers will.) এবং ১৯৩০-এর দশকে যুদ্ধ ও সংরক্ষণবাদের (Protectionism) বৃদ্ধি এটাকেই কনফার্ম করে বলে মনে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বলছি আরকি।

ট্রাম্পের শুল্কনীতি বনাম স্মুট-হলি: সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য

এই সমস্ত প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে, এখন পরবর্তী প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময়: ট্রাম্পের শুল্ক কি সত্যিই স্মুট-হলি আইনের মতো? স্পষ্ট উত্তর হল হ্যাঁ। ট্রাম্প ১৯৩০ সালের তুলনায় অনেক বেশি শুল্ক আরোপ করার পরিকল্পনা করছেন – ১০ শতাংশ পয়েন্ট বেশি।

তবুও, আশাবাদী হওয়ার কারণ থাকতে পারে। আজকের বিশ্ব এক শতাব্দী আগের থেকে অনেক আলাদা এবং প্রধান পার্থক্য হলো মুদ্রাভিত্তিক (Monetary)। ১৯৩০-এর দশকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক ধরণের স্বর্ণমানে (Gold Standard) ছিল, যা পরিস্থিতিকে অনেক, অনেক বেশি খারাপ করে তুলেছিল। আমরা বলতে পারি যে স্বর্ণমান একটি যান্ত্রিক বেল্টের (Mechanical Belt) মতো কাজ করেছিল যা একটি স্থানীয় মার্কিন সংকটকে বিশ্বব্যাপী সংকটে পরিণত করেছিল। আজকাল, যাইহোক, আমরা এমন একটি বিশ্বে বাস করি যেখানে মুদ্রা বাজারে লেনদেন হয় (Currencies are traded on the market) এবং আমরা জানি যে শুল্কের প্রায় এক তৃতীয়াংশ বিনিময় হারের (Exchange Rate) বৃদ্ধির দ্বারা শোষিত হয়। অবশ্যই, এটি ঘটার জন্য, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি (Appreciate) হতে হবে এবং ট্রাম্পের শুল্ক ঠিক এর বিপরীত অর্জন করেছে। তত্ত্ব অনুসারে, শুল্ক স্থানীয় মুদ্রাকে শক্তিশালী করার কথা, তাই বিনিয়োগকারীরা সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে কী করতে চায় তা নিয়ে ভীত এবং অনিশ্চিত।

সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ও উপসংহার

যাই হোক না কেন, এই বিষয়টি কীভাবে সামনে এগোয় তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। চারটি সম্ভাব্য পথের কথা উল্লেখ করলাম – বিশ্বের আত্মসমর্পণ, আমেরিকার পিছু হটা, আমেরিকাকে ছাড়া বিশ্বের এগিয়ে যাওয়া অথবা সম্পূর্ণ বাণিজ্য যুদ্ধের মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়া। এর যেকোনো একটি বা একাধিকের সংমিশ্রণ আগামী দিনের বাস্তবতা হতে পারে। স্মুট-হলি আইনের অভিজ্ঞতা আমাদের শেখায় যে সংরক্ষণবাদ এবং একতরফা বাণিজ্য যুদ্ধ কেবল অর্থনৈতিক সংকটই গভীর করে না, বরং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে বিষাক্ত করে তোলে এবং এমনকি সংঘাতের দিকেও ঠেলে দিতে পারে। বাস্তিয়ার সেই বিখ্যাত উক্তিটি আবারও স্মরণ করা যেতে পারে।

ট্রাম্প প্রশাসনের বর্তমান পদক্ষেপগুলো ১৯৩০-এর দশকের ভুলের পুনরাবৃত্তি কিনা, তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিলে যে মারাত্মক পরিণতি হতে পারে, সেই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশ্ব অর্থনীতি একটি অত্যন্ত নাজুক সুতোয় ঝুলে আছে এবং একটি ভুল পদক্ষেপ সেই সুতো ছিঁড়ে দিতে পারে, যার ফলস্বরূপ নেমে আসতে পারে আরও একটি বিশ্ব মহামন্দা। পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং এর ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি বিশ্বের প্রতিটি দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.