প্লেটোর শিল্পচিন্তা ও অ্যারিস্টোটলের প্রত্যুত্তর

ভূমিকা

পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্বের প্রাচীনতম গ্রন্থ রচনার কৃতিত্ব অ্যারিস্টোটলের। এই তথ্য সর্বজনবিদিত। তবে এটাও আমাদের জানা যে, শিল্পতত্ত্ব ও কাব্যতত্ত্ব নিয়ে স্বতন্ত্র কোনো গ্রন্থ রচনা না করলেও অ্যারিস্টোটলের শিক্ষক প্লেটো তার বিভিন্ন গ্রন্থে এ বিষয়ে মন্তব্য রেখে গেছেন। তিনি শিল্প ও কাব্যের প্রকৃতি, উদ্দেশ্য এবং তার সমাজে প্রভাব সম্পর্কে সুস্পষ্ট মতামত প্রকাশ করেছিলেন। তার এই মতামতকে অবজ্ঞা করা যায় না, কারণ তা শুধু দর্শন বা সাহিত্যতত্ত্বের বিচারে নয়, বরং প্রাচীন গ্রিসের চিন্তাধারার ধারাবাহিকতায়ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

প্লেটোর ভাবনার গুরুত্ব বোঝার আরেকটি কারণ হলো, অ্যারিস্টোটল তার শিল্পতত্ত্বের সূত্রপাত করেছিলেন প্লেটোর মত খণ্ডন করবার অভিপ্রায়ে। প্লেটো তার রচনায় শিল্প ও কাব্য সম্পর্কে যে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন এবং যেসব সমালোচনা করেছিলেন, অ্যারিস্টোটল তা যুক্তির মাধ্যমে খণ্ডন করতে চেয়েছিলেন। সুতরাং, অ্যারিস্টোটলের তত্ত্বের স্বরূপ পুরোপুরি উপলব্ধি করতে হলে প্লেটোর অভিমতও গভীরভাবে বোঝা প্রয়োজন। এটি কেবল তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি প্রাচীন গ্রিসের সাহিত্য ও শিল্পবিষয়ক চিন্তার ধারাবাহিকতাও পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করে।

এই আলোচনায় তাই প্লেটো ও অ্যারিস্টোটল—উভয়ের অভিমত অনুধাবনের চেষ্টা করা হবে। এতে একদিকে গ্রিসের শিল্পতত্ত্ব ও কাব্যতত্ত্বের বিকাশের ক্রমধারা বুঝতে সুবিধা হবে, অন্যদিকে প্লেটোর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অ্যারিস্টোটলের দৃষ্টিভঙ্গির তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে অ্যারিস্টোটলের সাহিত্য ও শিল্পতত্ত্বের প্রকৃত অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

প্লেটোর শিল্পচিন্তা

গ্রিসে দার্শনিক চিন্তার একটি সুনির্দিষ্ট, শৃঙ্খলাবদ্ধ ধারা গড়ে ওঠে, যা দার্শনিক পরম্পরার ভিত্তি স্থাপন করে। এই পরম্পরার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল শিল্প ও সাহিত্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। মানব জীবন এবং সমাজ নিয়ে কিছু মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন সক্রেটিস (৪৭০-৩১১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। তিনি ন্যায়, নীতি এবং জ্ঞানের প্রকৃতি নিয়ে গভীর আলোচনা করেছিলেন এবং চিন্তাশীল মানুষদের যুক্তির মাধ্যমে সত্য অনুসন্ধানে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। সক্রেটিসের চিন্তাধারা সরাসরি লিখিত আকারে লিপিবদ্ধ হয়নি, বরং তার শিষ্যদের মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়েছে। এই ধারার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উত্তরাধিকারী ছিলেন প্লেটো (৪২৭-৩৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। সক্রেটিসের চিন্তার গভীর প্রভাব তার ওপর পড়েছিল, কিন্তু তিনি ছিলেন তুলনামূলকভাবে বেশি সংগঠিত ও শিক্ষাগতভাবে বিশদ। তিনি তার গ্রন্থগুলোর মাধ্যমে দার্শনিক তত্ত্বগুলিকে সুনির্দিষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করেন এবং ইউরোপের চিন্তাধারার ভিত্তি স্থাপন করেন। তার দর্শন কেবল গ্রিস নয়, পরবর্তী সময়ের ইউরোপীয় দর্শন ও শিল্পভাবনার মূল উৎস হয়ে ওঠে। বিশেষত তার লেখার মধ্যেই শিল্প ও সাহিত্য সম্পর্কে প্রাচীন ইউরোপীয় সভ্যতার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির সন্ধান পাওয়া যায়।

প্লেটোর জন্ম আনুমানিক ৪২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্সে, এক সম্ভ্রান্ত ও ধনী পরিবারে। তার পরিবার রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল, যা তাকে শৈশব থেকেই শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ প্রদান করে। ব্যক্তিগত মেধা ও অসাধারণ পাণ্ডিত্যর কারণে তিনি এথেন্সের অন্যতম প্রধান চিন্তাবিদ হয়ে ওঠেন। জ্ঞানের প্রচার ও বিস্তারের উদ্দেশ্যে তিনি স্থাপন করেন আকাদেমি নামক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যা ছিল গ্রিসের প্রথম উচ্চতর শিক্ষাকেন্দ্র। এই প্রতিষ্ঠানেই তার অন্যতম ছাত্র হিসেবে অধ্যয়ন করেন অ্যারিস্টোটল (৩৮৪-৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), যিনি প্রায় বিশ বছর ধরে প্লেটোর শিক্ষালাভ করেন। অ্যারিস্টোটলের শিল্প ও সাহিত্য সম্পর্কিত দর্শন ও বিশ্লেষণের পেছনে প্লেটোর শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। তবে, এটি বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে শিল্প ও সাহিত্য সম্পর্কে প্লেটো ও অ্যারিস্টোটলের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। অনেক ক্ষেত্রে তাদের মতামত একেবারে বিপরীত ছিল, যা তাদের দার্শনিক মানসিকতার পার্থক্যের কারণে সৃষ্টি হয়েছিল। প্লেটো বাস্তবতার পরিবর্তে ভাববাদী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিলেন, অন্যদিকে অ্যারিস্টোটল ছিলেন বস্তুবাদী বিশ্লেষণধর্মী দার্শনিক, যিনি বাস্তবতার অভিজ্ঞতা ও যুক্তির ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

প্লেটোর রচিত গ্রন্থগুলোর বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার। প্লেটো ছিলেন এক মহান দার্শনিক, যিনি বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছিলেন এবং তার সময়ের বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে শিক্ষা দিয়েছেন। গ্রিসের শাসনব্যবস্থা ও প্রশাসনের সঙ্গে তার সংযোগ ছিল ঘনিষ্ঠ। তার রচনাগুলোর মধ্যে নগর-শাসকদের প্রতি একধরনের পক্ষপাত লক্ষ্য করা যায়। গবেষকেরা তার সমগ্র রচনাকর্মকে চারটি প্রধান পর্যায়ে ভাগ করেছেন, যেগুলো ক্রমান্বয়ে তার চিন্তার বিকাশকে তুলে ধরে –

  • প্রথম পর্যায়ে রয়েছে ৩৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগের রচনা, যা ‘প্রাথমিক দ্বিরালাপ’ (Early Dialogue) নামে পরিচিত। এই পর্যায়ের রচনাগুলোতে প্লেটোর চিন্তার সূচনা ও সক্রেটিক পদ্ধতির প্রভাব স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। গুরুত্বপূর্ণ রচনার মধ্যে রয়েছে অ্যাপোলজি (Apology), ইঅন (Ion), লাইসিস (Lysis) এবং রিপাবলিক-এর প্রথম খণ্ড (Republic, Book 1)। এই রচনাগুলোতে দর্শনচর্চার মৌলিক দিকগুলো এবং নীতিশাস্ত্রের প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়।
  • দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে ৩৮৭ থেকে ৩৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে রচিত গ্রন্থগুলো, যা ‘প্রথম পর্বের পরিবর্তনমুখী দ্বিরালাপ’ (Early Transitional Dialogue) নামে পরিচিত। এই পর্যায়ের লেখাগুলোতে প্লেটোর চিন্তায় কিছু পরিবর্তন দেখা যায়, তবে পরবর্তী সময়ে এগুলোর প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম ছিল। দার্শনিক বিশ্লেষণে এই রচনাগুলো অতটা গুরুত্ব পায়নি, কারণ প্লেটো তখনও তার পরিপূর্ণ দার্শনিক কাঠামো নির্মাণের পর্যায়ে ছিলেন।
  • তৃতীয় পর্যায়, যা ৩৮০ থেকে ৩৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে রচিত, তা ‘মধ্যবর্তী দ্বিরালাপ’ (Middle Dialogue) নামে পরিচিত। এটি প্লেটোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা পর্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। এই পর্যায়ের রচনাগুলোতে তার দার্শনিক চিন্তা সুসংহত ও পরিণত রূপ পেয়েছে। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিদো (Phaedo), ফিদরাস (Phaedrus), রিপাবলিক (Republic, Book 2 – Book 10), সিম্পোসিয়াম (Symposium) ইত্যাদি। এই রচনাগুলোতে রাষ্ট্রদর্শন, আত্মার অমরত্ব, প্রেম, জ্ঞানতত্ত্ব এবং আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
  • চতুর্থ ও শেষ পর্যায়ে রয়েছে ৩৬০ থেকে ৩৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে রচিত রচনাগুলো, যা ‘অন্তিম দ্বিরালাপ’ (Late Dialogues) নামে পরিচিত। এই পর্যায়ে প্লেটোর দার্শনিক তত্ত্বগুলোর আরও গভীর বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। শেষ দিকের রচনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল দ্য লজ (The Laws), যা তার জীবনের অন্তিম পর্যায়ে লেখা হয়। এটি তার দীর্ঘতম রচনা এবং আইনের গুরুত্ব ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে তার চূড়ান্ত মতামত প্রতিফলিত করে।

অ্যাপোলজি থেকে শুরু করে প্লেটোর সমস্ত লেখায় শিল্প, সাহিত্য এবং কবিদের প্রতি তার বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও সিদ্ধান্ত প্রতিফলিত হয়েছে। প্লেটোর লেখায় শিল্প-সাহিত্য নিয়ে তার নানা ভাবনার ছাপ রয়েছে। এসব ভাবনা একেকটি গ্রন্থে একেকভাবে এসেছে, কখনো স্পষ্টভাবে, কখনো প্রসঙ্গক্রমে। দ্য রিপাবলিক এবং দ্য লজ – এই দুই গ্রন্থে প্লেটো বিশেষভাবে শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি শিল্প এবং সাহিত্যকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন এবং কবিদের সমাজের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করেছেন। তা সত্ত্বেও তার দর্শন শিল্প-সাহিত্যের বিকাশে প্রভাব বিস্তার করেছে। তার সমালোচনাগুলো শিল্পতত্ত্বের ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করেছে, কারণ এসব আলোচনা থেকে শিল্পের প্রকৃতি, কার্যকারিতা এবং নৈতিক অবস্থান নিয়ে পরবর্তী দর্শনচর্চায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।

শিল্প কী, এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। প্লেটো এক্ষেত্রে সুসংগঠিত বিশ্লেষণ দেননি, বরং তার গ্রন্থে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শিল্প সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। তুলনামূলকভাবে অ্যারিস্টোটল শিল্প সম্পর্কে বেশি কাঠামোগত আলোচনা করেছেন। প্লেটোর লেখায় মূলত নীতিশাস্ত্র, রাষ্ট্রনীতি, শিক্ষানীতি এবং দর্শনের প্রসঙ্গগুলো গুরুত্ব পেয়েছে। এসব বিষয় বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি প্রসঙ্গত কবি ও কবিতার বিষয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। প্লেটোর আগে ইউরোপীয় ভাষায় কবিতা ও কবির ভূমিকা নিয়ে এমন সুস্পষ্ট ও লিখিত কোনো আলোচনা পাওয়া যায় না। তার জীবনকাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের প্রথমার্ধে ছিল। তার লেখাগুলো বিভিন্ন গ্রন্থে ছড়িয়ে আছে, এবং কবিতা ও কবিদের প্রসঙ্গ এসেছে নানা দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে। একদিকে তিনি কবি ও কাব্যের বিষয়ে মতামত দিয়েছেন, অন্যদিকে শিল্পের মৌলিক সংজ্ঞা ও তার কার্যকারিতা সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। শিল্পের মূলগত রূপ এবং কাব্যের সামাজিক ও নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা – এই বিষয়গুলো নিয়েই প্লেটো তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন।

প্রথমে দেখা যাক, প্লেটো কবিতা ও কবিদের বিষয়ে কী মত প্রকাশ করেছিলেন। সাধারণভাবে, তিনি কবিতা এবং কবিদের সম্পর্কে কঠোর মনোভাব প্রকাশ করেছেন এবং তার আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের স্থান দেননি। তবে এই দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে একটি বিশেষ কারণ কাজ করেছিল। প্লেটো শুধুমাত্র কবিতাকে প্রত্যাখ্যান করেননি, বরং তার সমসাময়িক কবিতার অনেক দিক তাকে অসন্তুষ্ট করেছিল। যদিও তিনি নিজেও কবিতা লিখতেন এবং তার গদ্যরচনার ভাষাতেও কাব্যময়তা ছিল, কিন্তু তিনি মনে করতেন যে শিল্প ও সাহিত্য সমাজের উপর গভীর প্রভাব ফেলে এবং সঠিকভাবে পরিচালিত না হলে তা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে। তার দ্য রিপাবলিক গ্রন্থে তিনি কবিতা ও কবিদের বিরুদ্ধে তার সবচেয়ে শক্তিশালী আপত্তি উত্থাপন করেছেন। তবে এই আপত্তির মূলে ছিল রাজনৈতিক কারণ, শৈল্পিক কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। প্লেটো মনে করতেন, সাহিত্য ও শিল্প মানুষের আবেগ ও অনুভূতিকে এমনভাবে আলোড়িত করতে পারে যা একটি আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। বিশেষত, শিল্পকলা এমন সব আবেগকে জাগিয়ে তুলতে পারে যা রাষ্ট্রের শৃঙ্খলার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। তার মতে, কবিতায় এমন অনেক বিষয়বস্তু থাকে যা সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে এবং মানুষের চিন্তাভাবনাকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পারে। তবে এই মতবাদ থেকেই বোঝা যায় যে, প্লেটো কবি ও সাহিত্যিকদের শক্তি ও প্রভাবকে পুরোপুরি স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি কবিদের রাষ্ট্র থেকে নির্বাসিত করলেও, তাদের ক্ষমতার প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ স্পষ্ট ছিল। এই নির্বাসনের মধ্য দিয়েই তিনি কবিদের বিশাল সামাজিক প্রভাব ও শক্তির স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার সিদ্ধান্ত, যদিও কঠোর মনে হতে পারে, তবু এটি প্রমাণ করে যে, তিনি কবিতার জনচিত্ত জয়ের ক্ষমতাকে অস্বীকার করেননি।

প্লেটোর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে একেবারে ভিত্তিহীন বলা যায় না। রাষ্ট্রের শাসকদের কাছে নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ বা বিদ্রোহ সর্বদাই একটি ভয়ের কারণ। সাহিত্য ও শিল্পশৈলী অনেক সময় সেই বিদ্রোহী চেতনার জন্ম দেয়। ইতিহাসে দেখা গেছে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সৃষ্টির আশঙ্কায় বহুবার সাহিত্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং লেখকদের কারারুদ্ধ বা নির্বাসিত করা হয়েছে। বাংলার ইতিহাসেও এমন দৃষ্টান্ত দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ উপন্যাস ব্রিটিশ শাসকদের দৃষ্টিতে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল, কারণ এটি স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনাকে উসকে দিয়েছিল। এমন অনেক সাহিত্যিক ও শিল্পী রয়েছেন যাদের সৃষ্টি রাষ্ট্রের শাসকদের পক্ষে সহনীয় ছিল না, এবং তাই তাদের লেখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে প্লেটোর ধারণা যে বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না, তা স্পষ্ট হয়ে যায়।

প্লেটোর দ্য রিপাবলিক গ্রন্থে কবিতা সংক্রান্ত আলোচনা মূলত দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং দশম খণ্ডে স্থান পেয়েছে। এই আলোচনার সূত্রপাত শিক্ষাব্যবস্থার পর্যালোচনা থেকে। তিনি বলেছেন, তরুণদের শিক্ষা দিতে হলে তাদের সাহিত্য পাঠ করানো উচিত নয়, কারণ সাহিত্যে দেবতাদের সম্পর্কে এমন সব সমালোচনা থাকে যা দেবতাদের দোষত্রুটিকে প্রকাশ করে। এর ফলে তরুণদের মনে দেবতাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে যেতে পারে। প্লেটো মনে করতেন, সাহিত্য ধর্মীয় মূল্যবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, এবং এজন্য এটি আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়াও, সাহিত্যে অনেক সময় নায়কদের চরিত্রের দুর্বলতাকে তুলে ধরার পরেও তাদের মহত্ত্বের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এই কারণে তরুণদের মনে নৈতিক দুর্বলতার প্রতি সহনশীলতা জন্মাতে পারে। দ্য রিপাবলিক-এর তৃতীয় খণ্ডে শিল্পের প্রকৃতি ও তার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি ‘মাইমেসিস’ (Mimesis) বা ‘অনুকরণ’ (Imitation) শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এই ধারণাটি পরবর্তীতে দ্য রিপাবলিক-এর দশম খণ্ড এবং অ্যারিস্টটলের পোয়েটিক্স গ্রন্থে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ইউরোপীয় নন্দনতত্ত্বে ‘অনুকরণ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এবং তা শিল্পের মৌলিক চরিত্রকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে।

প্লেটো তার রিপাবলিক-এর তৃতীয় খণ্ডে ‘মাইমেসিস’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন এমন এক প্রক্রিয়া বোঝাতে, যেখানে একজন ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির আচরণ, বাগভঙ্গি ও ব্যক্তিত্বের প্রতিলিপি তৈরি করে। ইংরেজিতে এই ধারণাটির যথার্থ অনুবাদ হওয়া উচিত ‘ইমপারসোনেশন’ (Impersonation)। সাধারণত, যখন কেউ অন্য ব্যক্তির ভূমিকা গ্রহণ করে, তার স্বর ও ভাষারীতি নকল করে, তখন তাকে ইমপারসোনেশন বলা হয়। ব্যক্তিগত কবিতায় কবি সরাসরি নিজের অনুভূতি ও চিন্তাভাবনা ব্যক্ত করেন, কিন্তু নাটকে তিনি নিজের বদলে বিভিন্ন চরিত্রের মুখে ভাষা বসান এবং তাদের আচরণ ফুটিয়ে তোলেন। যখন নাটকে অভিনয় করা হয়, তখন একজন অভিনেতাকে অন্য ব্যক্তির চেহারায়, গলায় ও শরীরী ভাষায় আত্মপ্রকাশ করতে হয়। প্লেটোর মতে, এই ধরনের অনুকরণ রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। কারণ, প্রথমত, প্রত্যেক নাগরিকের উচিত শুধু নিজের বক্তব্য প্রকাশ করা। যদি কেউ অন্যের মতামত বা আচরণ নির্ধারণের চেষ্টা করে, তবে তা রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। প্রত্যেক নাগরিককে তার নিজস্ব ভূমিকা পালন করতে শিখতে হবে, অন্যের ভূমিকা নির্ধারণ করা হলে তা অন্যায় হস্তক্ষেপ বলে বিবেচিত হবে। এর ফলে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে এবং সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।

রিপাবলিক-এর দশম খণ্ডে প্লেটো সাহিত্য ও শিল্পের অনুকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। এই প্রসঙ্গেই প্লেটো ও অ্যারিস্টোটলের চিন্তাভাবনার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। প্লেটোর মতে, কোনো অনুকরণই সত্য নয়; বরং প্রতিটি অনুকরণ সত্যের একটি বিকৃত বা অবিকশিত প্রতিচ্ছবি মাত্র। অনুকরণ করা বিষয়গুলিকে তিনি ‘ইলিউশন’ বা দৃশ্য-মায়া বলে বর্ণনা করেছেন। সাহিত্যে ও শিল্পকর্মে জীবনের যথাযথ রূপ প্রতিফলিত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু প্লেটো মনে করেন, এই প্রচেষ্টা বাস্তব সত্যকে উপলব্ধি করার পথ নয়। তার এই মতামত ‘থিয়োরি অব আইডিয়াজ’ (Theory of Ideas)-এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই তত্ত্ব অনুসারে, আমাদের বাস্তব ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ ছাড়িয়ে এক উচ্চতর ‘আইডিয়া’ বা আদর্শ ধারণার জগৎ বিদ্যমান, যেখানে প্রত্যেক অস্তিত্বের নিখুঁত ও বিশুদ্ধ রূপ উপস্থিত থাকে। আমাদের পার্থিব জগতে যা কিছু বিদ্যমান, তা সেই আদর্শ ধারণার একটি অসম্পূর্ণ অনুকরণ মাত্র। শিল্পী ও কবিরা বাস্তব পৃথিবীর এই অসম্পূর্ণ অনুকরণকে পুনরায় অনুকরণ করেন, যার ফলে তাদের সৃষ্টি মূল সত্যের থেকে আরও বেশি দূরে সরে যায়। এই প্রক্রিয়ায় তাদের শিল্পকর্ম মূল সত্যের এক তৃতীয় পর্যায়ের বিকৃত প্রতিলিপি হয়ে দাঁড়ায়, যাকে প্লেটো ‘থার্ড হ্যান্ড কপি’ (Third Hand Copy) বলেছেন। তিনি মনে করেন, এই কারণে কবি ও শিল্পীদের সৃষ্টি প্রকৃত সত্যের বোধ জাগাতে ব্যর্থ হয় এবং আমাদের বাস্তব জীবনের প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে সাহায্য করে না।

প্লেটোর এই দার্শনিক ধারণা আধুনিক যুগের মানুষের কাছে আর ততটা গ্রহণযোগ্য নয়। তবে প্রাচীনকালে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন ছিল। সে সময় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বাস্তব জগতের তুলনায় অতীন্দ্রিয়, অলৌকিক জগতের অস্তিত্বকে অধিকতর সত্য বলে গ্রহণ করত। তারা বিশ্বাস করত যে পার্থিব জীবন ক্ষণস্থায়ী, আর প্রকৃত সত্যের অবস্থান এক উর্ধ্বতন, অপার্থিব জগতে। এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলে স্বর্গ এবং পরলোক সংক্রান্ত ধারণাগুলি মানুষের মনে গভীরভাবে প্রোথিত হতে পেরেছিল। ভারতীয় ধর্মীয় দর্শনেও এই চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায়, যেখানে বলা হয় “ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা”—অর্থাৎ পার্থিব বাস্তবতাকে ক্ষণস্থায়ী ও অবাস্তব মনে করা হয় এবং চিরন্তন সত্য কেবল ব্রহ্ম বা নিরাকার চেতনার মধ্যে নিহিত থাকে। এই ধরনের ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গেই প্লেটোর দর্শনের মিল ছিল, আর এখান থেকেই শুরু হয়েছিল প্লেটোর চিন্তার সঙ্গে অ্যারিস্টোটলের দ্বন্দ্ব।

প্লেটো ছিলেন একেবারে নিখাদ ভাববাদী, যিনি বিশ্বাস করতেন যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তব জগতের চেয়ে আদর্শ বা বিমূর্ত জগতই প্রকৃত সত্য। অন্যদিকে, অ্যারিস্টোটল ছিলেন একজন বাস্তবতাবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক দার্শনিক, যিনি বিমূর্ত আদর্শের পরিবর্তে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎকেই একমাত্র সত্য বলে মনে করতেন। প্লেটো যেখানে ধারণার জগতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন, সেখানে অ্যারিস্টোটল এই ধারণার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বস্তুগত বাস্তবতাকেই প্রামাণ্য বলে গ্রহণ করেছিলেন। প্লেটোর মতে, শিল্প ও সাহিত্য মানব মনের আবেগ ও কল্পনার জগতকে শক্তিশালী করে, যা যুক্তিনির্ভর চিন্তাকে দুর্বল করে দেয়। তার মতে, সাহিত্য মানুষের আবেগকে উসকে দেয় এবং যুক্তিবাদী মনোভাবকে ব্যাহত করে। বিশেষ করে, তিনি বিশ্বাস করতেন যে, নাটকীয় কবিতা মানুষের মনে অবাঞ্ছিত নৈতিক প্রভাব ফেলে, কারণ দর্শক ও পাঠকরা নাট্যচরিত্রদের গুণাগুণ, এমনকি তাদের ত্রুটি ও দুর্বলতাও অনুকরণ করতে প্রবৃত্ত হয়।

এই কারণে, প্লেটো সাহিত্যের নেতিবাচক দিকগুলোকেই অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি সাহিত্যের সৃজনশীল ও মহান দিকগুলোর উল্লেখ করেননি, যা মানুষের মনকে ঋদ্ধ করে এবং সমাজের নৈতিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করতে পারে। তার দার্শনিক অবস্থান রাষ্ট্রনীতির ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করত, এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে সাহিত্যের মোহময় আকর্ষণ নাগরিকদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এজন্য, তিনি তার কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্র থেকে এমন কবিদের বর্জন করতে চেয়েছিলেন, যারা দেবতাদের প্রশস্তি গায় না কিংবা মানুষের সদগুণাবলির সঠিক রূপায়ণ করে না। তবে, তার কাছে মানুষের সদগুণ বলতে মূলত রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও আনুগত্যের মধ্যে থাকা বোঝাত, যা তার দার্শনিক চিন্তাধারার একটি সীমাবদ্ধতা।

প্লেটো তার দ্য লজ বা আইন গ্রন্থে আবারও সাহিত্য, নাগরিক জীবন ও অনুকরণের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছেন। তিনি মনে করেন, নাগরিকদের অবশ্যই সৎ এবং সুন্দর শিল্পের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা উচিত, যাতে তারা নৈতিকভাবে উন্নত হতে পারে। শিল্প মূলত অনুকরণের মাধ্যম হওয়ায়, যে বিষয় বা ব্যক্তির অনুকরণ করা হবে, সেটিও হতে হবে ভালো এবং সুন্দর। এই প্রসঙ্গে প্লেটোর দৃষ্টিভঙ্গিতে শিল্পের কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা প্রতিফলিত হলেও, তার অন্যান্য গ্রন্থে শিল্প, সাহিত্য ও শিল্পস্রষ্টাদের প্রতি তিনি আরও কঠোর মনোভাব পোষণ করেছেন। প্রোটাগোরাস (Protagorus) গ্রন্থে, প্রোটাগোরাস চরিত্রটি কবিদের সম্পর্কে বলেছে যে, হোমারের সময় থেকে কবিরা শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃত এবং তাদের শিক্ষা ভালো নাগরিক গঠনে সহায়ক। লাইসিস (Lysis) গ্রন্থে কবিদের “জ্ঞান প্রচারকারী” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু, প্লেটো নিজে এই প্রশংসামূলক ধারণাকে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিয়েছেন এবং কবিদের প্রতি তার সংশয় প্রকাশ করেছেন।

কবিরা মানুষের আচরণ ও নৈতিকতার যথাযথ বিশ্লেষণ করতে সক্ষম নয়—এমন মত পোষণ করেন প্লেটো। অ্যাপোলজি (Apology) গ্রন্থে তিনি বলেছেন, কবিরা সাহিত্য রচনা করেন না যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ বা জ্ঞানচর্চার জন্য, বরং তারা আবেগ ও অনিয়ন্ত্রিত অনুভূতির মাধ্যমে সৃষ্টিশীলতা প্রকাশ করেন। প্লেটোর মতে, কবিরা যুক্তিহীন প্রেরণার দ্বারা চালিত হন এবং তাদের শিল্পকর্ম শুধুমাত্র আবেগ-উদ্দীপনার (Non-rational inspiration) ফল। এই মতাদর্শ ফিদরাস (Phaedrus) এবং ইঅন (Ion) গ্রন্থেও আরও বিস্তৃত হয়েছে, যেখানে কবিদের “উন্মাদ” বলা হয়েছে। প্লেটোর ব্যাখ্যায়, কবিরা কলা দেবীদের (Muse) প্রভাবে একপ্রকার ভাবোন্মত্ত অবস্থায় সৃষ্টিশীল হন, যা তাদের যুক্তিবিচারবিহীন ও নিয়ন্ত্রণহীন করে তোলে। তদুপরি, প্লেটোর কাছে কবিতার রূপকার্থ বা তার অন্তর্নিহিত অর্থ বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। তা সত্ত্বেও, কিছু ক্ষেত্রে তিনি শিল্পের অনুকরণাত্মক প্রকৃতির পক্ষে কথা বলেছেন। তার মতে, মহাকাব্য ও নাটকের শিল্পীদের উচিত “ভালো” বিষয়ের অনুকরণ করা, তবে “ভালো” বলতে তিনি সেইসব বিষয় বোঝাতে চেয়েছেন, যা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের জন্য প্রশাসনিকভাবে উপযোগী।

ফিদরাস (Phaedrus) গ্রন্থে প্লেটো আবেগ-উদ্দীপনার একটি ধর্মীয় ব্যাখ্যাও প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, গভীর আবেগের প্রকাশ মানুষের আত্মাকে প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতির বন্ধন থেকে মুক্ত করে এবং একপ্রকার স্বর্গীয় মুক্তির (Divine release of the soul) অনুভূতি দেয়। এই গ্রন্থেই তিনি শিল্প সম্পর্কে এমন কিছু ধারণা উপস্থাপন করেছেন, যা পরবর্তী কালে এতটাই প্রচলিত হয়ে যায় যে, অনেকেই ভুলে যান যে প্লেটোই এসবের প্রথম প্রবক্তা। উদাহরণস্বরূপ, তিনি প্রথম বলেন যে, শিল্পের ধারণায় জীবদেহের মতো সমগ্রতা (Organic unity) থাকা আবশ্যক। দ্য রিপাবলিক (The Republic) গ্রন্থে তিনি শিল্পের বিভিন্ন রূপবন্ধ—যেমন এপিক (Epic), লিরিক (Lyric) এবং নাটক (Drama)—এই ভিন্নতাগুলোর উপস্থাপনার ধরন অনুসারে পার্থক্য বিশ্লেষণ করেছেন। দ্য লজ (The Laws) গ্রন্থে তিনি বলেন, প্রকৃত ট্র্যাজেডি জীবনের গভীরতম এবং মহত্তম রূপকে প্রকাশ করে। এই মতবাদ পরবর্তী সময়ে অ্যারিস্টোটল এবং রেনেসাঁস পর্বের পণ্ডিতরা আরও বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।

দ্য রিপাবলিক এবং ফিদরাস—উভয় গ্রন্থেই প্লেটো উল্লেখ করেছেন যে, ট্র্যাজেডি মানুষের মনে বিশেষভাবে করুণা ও ভয়ের অনুভূতি সৃষ্টি করে। ফিলেবাস (Philebus) গ্রন্থে তিনি আরও বলেন, একটি ভালো ট্র্যাজেডি দেখার অভিজ্ঞতা এক বিশেষ ধরনের আনন্দ দেয়, যাকে “ট্র্যাজিক প্লেজার” (Tragic pleasure) বলা হয়। একই গ্রন্থে তিনি কমেডির বিষয়েও কিছু কথা বলেছেন। সমকালীন ট্র্যাজেডি লেখকেরা যেভাবে নাটকে উত্তেজনার উপাদান সংযোজন করে দর্শকদের অনুভূতিতে তীব্র প্রভাব ফেলতে চেয়েছেন, সেই প্রবণতাকেও তিনি সমালোচনা করেছেন। প্লেটোর মতে, শিল্পকে যদি নাগরিকদের জন্য নৈতিক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত করতে হয়, তবে তা অবশ্যই সংযত ও কাঠামোগতভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে হবে।

প্লেটো ও অ্যারিস্টোটলের শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কিত ধারণার তুলনা

দেখা যায়, প্লেটো অনেক মৌলিক ধারণার প্রথম প্রবক্তা ছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে তার ছাত্র অ্যারিস্টোটল এবং অন্যান্য শিল্পতাত্ত্বিকদের চিন্তায় আরও বিস্তৃত ও পরিপূর্ণ রূপ পেয়েছে। প্লেটো যেভাবে শিল্প, কবিতা এবং সাহিত্যকে ব্যাখ্যা করেছেন, অ্যারিস্টোটলের দৃষ্টিভঙ্গি তার থেকে অনেকটাই ভিন্ন ছিল। প্লেটোর মতে, শিল্প এবং সাহিত্য ছিল এমন কিছু যা বাস্তবতার নিখুঁত প্রতিফলন নয়; বরং এগুলো বাস্তবতার অনুকরণ মাত্র। কিন্তু অ্যারিস্টোটল বাস্তব জগৎ এবং মানুষের জীবনকেই শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেখেছিলেন এবং শিল্পের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। প্লেটো ছিলেন ভাববাদী ও অতীন্দ্রিয়বিশ্বাসী, তিনি বাস্তব জগতের বাইরে এক নিখুঁত, চিরস্থায়ী ভাবাদর্শের অস্তিত্ব মেনে নিয়েছিলেন, যা এই পৃথিবীর চেয়ে অধিকতর সত্য। অ্যারিস্টোটল, বিপরীতে, ছিলেন যুক্তিবাদী এবং বৈজ্ঞানিক মানসিকতার অনুসারী। তিনি অতীন্দ্রিয় জগতের ধারণাকে পুরোপুরি অস্বীকার না করলেও, তার শিল্পতত্ত্বে এই বিষয়গুলোর জন্য কোনো স্থান রাখেননি। তার মতে, বাস্তব জগৎ এবং মানবসমাজের বাস্তব অভিজ্ঞতাই শিল্পের প্রধান উৎস। ট্র্যাজেডির মধ্যে যেসব দেবদেবীর প্রসঙ্গ উঠে আসে, তিনি সেগুলোকে মানুষের কল্পনার ফসল এবং পুরাণকথার অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

প্লেটো এবং অ্যারিস্টোটলের মধ্যে সবচেয়ে সুস্পষ্ট পার্থক্যের একটি দিক ছিল অনুকরণকে গ্রহণ করার ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। এই বিষয়টিই মূলত শিল্প ও সাহিত্য সম্পর্কিত তাদের মতপার্থক্যের প্রধান কারণ। প্লেটো অনুকরণের ধারণার প্রতি অত্যন্ত সন্দিহান ছিলেন। তিনি মনে করতেন, যেহেতু শিল্প এবং সাহিত্য বাস্তবতার অনুকরণ, তাই এগুলো মূল সত্য থেকে আরও দূরে সরিয়ে দেয় এবং মানুষের মনকে বিভ্রান্ত করে। তিনি মনে করতেন, শিল্পের ফলে মানুষ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে এবং বাস্তব সত্য থেকে বিচ্যুত হয়। তাই তিনি শিল্প-সাহিত্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও সন্দিহান ছিলেন। অপরদিকে, অ্যারিস্টোটল অনুকরণের গুণাবলী সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন ছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে অনুকরণ মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করে। তার মতে, শিল্প বাস্তবতার অনুকরণ করলেও, সেটি শুধু বাস্তবতার প্রতিফলন নয়, বরং বাস্তবের গভীরতাকে তুলে ধরে এবং মানুষের নৈতিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধন করে। তাই, শিল্প এবং সাহিত্যকে তিনি মানুষের জন্য শিক্ষণীয় এবং ইতিবাচক বলে মনে করতেন।

প্লেটো এবং অ্যারিস্টোটল উভয়েই শিল্পকে অনুকরণ হিসেবে বিবেচনা করলেও, শিল্প আসলে কী অনুকরণ করে – এই প্রশ্নে তাদের মতবিরোধ ছিল ব্যাপক। প্লেটোর মতে, যে বাস্তব জগৎ আমরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভব করি, সেটি প্রকৃত সত্য নয়। এই পৃথিবীর প্রতিটি বস্তু এবং ঘটনা আসলে অনুকরণের ফল, যা ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এই অনুকরণ সম্ভব হয়েছে এক বিশেষ ধারণার জগত থেকে, যা প্লেটো ‘ভাবাদর্শ’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, এই ভাবাদর্শ বা ‘আইডিয়ার জগতই’ প্রকৃত সত্য, যা ঈশ্বরের চিত্তে বিদ্যমান। ঈশ্বর এই আদর্শ জগতের অনুকরণে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু যেহেতু অনুকরণ কখনো মূল আদর্শের মতো নিখুঁত হতে পারে না, তাই এই পার্থিব জগৎও ত্রুটিমুক্ত নয়। তার মতে, যেকোনো অনুকরণই মূল সত্য থেকে বিচ্যুত হয় এবং কখনোই পরিপূর্ণ সত্য হয়ে উঠতে পারে না।

এখানেই অ্যারিস্টোটল সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান প্লেটোর দর্শন থেকে। প্লেটোর মতে, বাস্তবতার বাইরে আরেকটি ভাবাদর্শের জগত বিদ্যমান, যেখানে প্রতিটি বস্তুর আদর্শরূপ বা নিখুঁত ধারণা বিদ্যমান থাকে। কিন্তু অ্যারিস্টোটলের দৃষ্টিতে এই ভাবাদর্শের জগতের কোনো বাস্তবতা নেই। তার দর্শনে এমন কোনো ঈশ্বরের কথা নেই, যিনি অদৃশ্য কোনো আদর্শ অনুসারে এই বাস্তব জগতকে সৃষ্টি করেছেন। অ্যারিস্টোটলের কাছে কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তব জগতই একমাত্র সত্য। মানুষের কাছে যা প্রতীয়মান হয়, তাই বাস্তব এবং সেই বাস্তব থেকেই শিল্পীরা তাদের অনুকরণমূলক কাজ করে থাকেন। তারা বস্তুকে পর্যবেক্ষণ করে, মানুষের কার্যকলাপ ও অনুভূতিকে অনুধাবন করে এবং সেগুলোর শিল্পরূপ প্রকাশ করে। এখানে প্লেটো এবং অ্যারিস্টোটলের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে মূল পার্থক্যটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্লেটো ছিলেন ভাববাদী, যিনি দৃশ্যমান বাস্তবতার বাইরে একটি পরম সত্যের অস্তিত্ব বিশ্বাস করতেন, আর অ্যারিস্টোটল ছিলেন বাস্তববাদী, যিনি সরাসরি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতকেই সত্য বলে স্বীকার করতেন।

প্লেটোর মতে, যেকোনো অনুকরণই আসলে ত্রুটিযুক্ত, অসম্পূর্ণ এবং প্রকৃত সত্যের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। তার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, অনুকরণ কখনোই মূল সত্যের মতো যথাযথ হতে পারে না, কারণ এটি মূলের একটি অসম্পূর্ণ ছায়ামাত্র। প্লেটোর দর্শনে, ঈশ্বর আদর্শ জগতের ভিত্তিতে একটি বাস্তব জগৎ সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু সেই বাস্তব জগৎও নিখুঁত নয়, বরং তা আদর্শ সত্য থেকে এক ধাপ সরে গেছে। বাস্তব জগৎ থেকে যখন শিল্পী বা কবি তাদের অনুকরণ তৈরি করেন, তখন তারা প্রকৃত সত্য থেকে আরও দূরে সরে যান। এ কারণে প্লেটো মনে করেন, কবি ও শিল্পীদের সৃষ্টিকর্ম প্রকৃত সত্য থেকে দুই ধাপ দূরে অবস্থান করে। এই ধারণা তিনি তার রিপাবলিক গ্রন্থের দশম অধ্যায়ে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, শিল্পীরা প্রকৃতির অনুকরণ করে এবং তা মানুষের সামনে উপস্থাপন করেন, কিন্তু সেটি প্রকৃত বাস্তবতার অনুরূপ নয়। তাই তাদের সৃষ্টি মূলত বিকৃত ও বিভ্রান্তিকর।

প্লেটোর এই তত্ত্বের মধ্যেই একটি অন্তর্নিহিত অসংগতি লক্ষ্য করা যায়। একই গ্রন্থের একই অধ্যায়ে, যখন তিনি ট্র্যাজেডির কথা বলছেন, তখন তিনি উল্লেখ করেছেন যে ট্র্যাজিক কবিরা সাধারণ শিল্পীদের মতোই সত্য থেকে আরও এক ধাপ দূরে অবস্থান করেন। অর্থাৎ, তারা তিন ধাপ দূরে চলে যান। একবার দুই ধাপ, আরেকবার তিন ধাপ বলার বিষয়টি তিনি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেননি। তবে এখান থেকে একটি অনুমান করা যায়। একজন শিল্পী যখন প্রকৃতির কোনো বস্তু যেমন বৃক্ষ, পর্বত বা সমুদ্রের অনুকরণ করেন, তখন তা মূল সত্য থেকে দুই ধাপ দূরে থাকে। কারণ এই বস্তুগুলো আদতে ঈশ্বরের সৃষ্টি, আর শিল্পীরা এগুলো অনুকরণ করে শিল্পসৃষ্টি করেন। কিন্তু মানুষ যখন নিজে কিছু তৈরি করে, যেমন চেয়ারের মতো বস্তু, তখন সেটি মূল সত্য থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই দুই ধাপ দূরে অবস্থান করে। মানুষের তৈরি করা এই বস্তুগুলো মূলত আদর্শ ধারণার বাস্তবায়ন হলেও তা আদর্শের নিখুঁত প্রতিরূপ নয়।

এখানে খাটের উদাহরণ প্লেটো বিশেষভাবে ব্যবহার করেছেন। তার মতে, আদর্শ খাটের ধারণাটি ভাবাদর্শের জগতে বিদ্যমান, কিন্তু মানুষ সেই ধারণা অনুসরণ করে কাঠ, পাথর বা ধাতুর মাধ্যমে বাস্তবে খাট তৈরি করে, যা মূল আদর্শ থেকে দুটি ধাপ দূরে থাকে। এরপর একজন শিল্পী যখন সেই খাটের চিত্র আঁকেন বা তার সম্পর্কে সাহিত্য রচনা করেন, তখন তা সত্য থেকে আরও এক ধাপ দূরে সরে যায়। অর্থাৎ, প্লেটোর মতে, শিল্পীদের অনুকরণীয় বস্তু দুটি ভাগে বিভক্ত—একটি হলো প্রকৃতির উপাদান এবং অন্যটি মানুষের নির্মিত বস্তু ও মানবীয় আচরণ। এই মানবীয় আচরণকেও অনুকরণ করা হয় নাটকে ও কবিতায়। তাই নাট্যকাররা বাস্তবতা থেকে তিন ধাপ দূরে চলে যান। নাটকের মাধ্যমে শুধুমাত্র বস্তুগত বাস্তবতাই অনুকৃত হয় না, বরং মানুষের চিন্তাভাবনা, আবেগ ও সামাজিক সম্পর্কও শিল্পের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়। প্লেটোর দৃষ্টিতে, এটি সত্যকে আরও বিকৃত করে এবং দর্শকদের বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে। এজন্যই তিনি কবি ও শিল্পীদের সমাজ থেকে বিতাড়িত করতে চেয়েছেন, কারণ তাদের সৃষ্টি বাস্তবতার পরিবর্তে ছায়ামাত্র উপস্থাপন করে, যা সত্যের পরিবর্তে মিথ্যার প্রসার ঘটায়।

অ্যারিস্টোটল ছিলেন প্লেটোর দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত মেরুতে অবস্থানকারী একজন দার্শনিক। আগেই বলা হয়েছে, অ্যারিস্টোটল বিশ্বাস করতেন না যে কোনো ভাবাদর্শিক জগত বাস্তবে বিদ্যমান। তার মতে, বাস্তব জগতের বাইরেও কোনো স্বতন্ত্র আদর্শের জগৎ নেই, যেখানে বস্তুগত জগতের নিখুঁত রূপ বিদ্যমান। এই কারণে, তিনি প্লেটোর মতো শিল্প ও কবিতাকে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো বিভ্রম বা মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করেননি। বরং তিনি বিশ্বাস করতেন যে কবি ও শিল্পীদের সৃষ্টি সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত বা ত্রুটিপূর্ণ নয়, বরং তা এক ধরনের সত্য, যা সম্ভাব্য সত্য এবং বাস্তব সত্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। প্লেটো এবং অ্যারিস্টোটলের মধ্যে মূল পার্থক্য এখানেই: প্লেটো যেখানে অনুকরণকে বিভ্রান্তিকর এবং ত্রুটিযুক্ত বলে মনে করেছিলেন, অ্যারিস্টোটল সেখানে অনুকরণকে স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয় বলে দেখেছিলেন।

প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে অনেকেই কবিদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন। তারা মনে করতেন, কবিরা বাস্তবতার অপব্যাখ্যা করে এবং বিশেষ করে নাট্যকার ও অভিনেতারা মিথ্যাচারী, কারণ তারা অন্য চরিত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং নিজেদের প্রকৃত সত্তার পরিবর্তে কল্পিত চরিত্রের মুখে কথা বলেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বোঝা যায় যে, তখনো শিল্পের সত্য ও নান্দনিক সত্য সম্পর্কে কোনো পরিপূর্ণ তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে ওঠেনি। অথচ, এই নান্দনিক সত্যের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন অ্যারিস্টোটল। অনুকরণের প্রতি প্লেটোর নেতিবাচক মনোভাবের বিপরীতে, অ্যারিস্টোটল কখনোই অনুকরণকে হীন বা অবমূল্যায়নযোগ্য বলে মনে করেননি। তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ Poetics-এর চতুর্থ অধ্যায়ে অনুকরণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

অ্যারিস্টোটল তার বিশ্লেষণে কয়েকটি মৌলিক বক্তব্য দিয়েছেন, যা মানবচিন্তা ও মনস্তত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রথমত, তিনি বলেন, “শৈশব থেকেই অনুকরণ মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি”। এখানে তিনি বুঝিয়েছেন যে অনুকরণ মানুষের সহজাত স্বভাব এবং এটি কোনো কৃত্রিম অভ্যাস নয়। প্রকৃতিগতভাবে মানুষ অন্যদের অনুসরণ করেই শিখতে শুরু করে, যা একেবারে মনস্তাত্ত্বিকভাবে সত্য। দ্বিতীয়ত, তিনি বলেন, “অন্য প্রাণীদের তুলনায় মানুষের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো সে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অনুকরণশীল প্রাণী, এবং অনুকরণের মাধ্যমেই তার শিক্ষার সূচনা ঘটে”। তার এই পর্যবেক্ষণ নৃবিজ্ঞান ও মানব-মনস্তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি বোঝায় যে মানুষের শেখার প্রাথমিক ভিত্তি অনুকরণ।

অ্যারিস্টোটল আরও বলেন, “অনুকরণ থেকে আনন্দ পাওয়া আমাদের স্বভাব, এবং এই উক্তির সারসত্য আমরা আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতায় প্রতিনিয়ত অনুভব করি”। এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি বুঝিয়েছেন যে, মানুষ শুধুমাত্র অনুকরণের মাধ্যমে শিখেই না, বরং এটি তার জন্য আনন্দেরও উৎস। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, বাস্তবে কোনো শবদেহের দৃশ্য আমাদের জন্য শোকাবহ বা অস্বস্তিকর হতে পারে, কিন্তু যখন সেই শবদেহ শিল্পের মাধ্যমে নিখুঁতভাবে উপস্থাপিত হয়, তখন আমরা সেটিকে উপভোগ করতে পারি। এর অর্থ হলো, অনুকরণ কেবল শিক্ষার মাধ্যম নয়, বরং এটি আমাদের অভিজ্ঞতাকে নান্দনিকভাবে সমৃদ্ধ করে এবং আনন্দদায়ক করে তোলে।

অতএব, প্লেটো এবং অ্যারিস্টোটলের অনুকরণ-সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য আমাদের মনে রাখা জরুরি। প্লেটো অনুকরণকে ত্রুটিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর বলে মনে করতেন, কারণ তিনি বাস্তবতার বাইরে একটি আদর্শিক জগতের অস্তিত্ব বিশ্বাস করতেন। বিপরীতে, অ্যারিস্টোটল বাস্তবতার মধ্যেই শিল্পের সত্য খুঁজে পেয়েছিলেন এবং তিনি দেখিয়েছিলেন যে অনুকরণ মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি এবং শিক্ষার একটি অপরিহার্য অংশ। এ কারণেই, শিল্পের সত্য ও নান্দনিক সত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অ্যারিস্টোটলের অবদান অনস্বীকার্য।

তৃতীয়ত, প্লেটো ও অ্যারিস্টোটলের শিল্প সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য ছিল শিল্পীদের মিথ্যাচারের ধারণা। প্লেটো লক্ষ্য করেছিলেন যে কবি ও শিল্পীরা বাস্তবের মানুষ ও ঘটনাবলির অনুকরণ করলেও তা সবসময় সরাসরি বাস্তবের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায় না, বরং কিছুটা সরে আসে। এই সরে আসাকে তিনি কল্পনার অতিরঞ্জন ও বিকৃতি হিসেবে দেখেছিলেন এবং এজন্য তিনি কবিদের মিথ্যাচারী বলে অভিহিত করেছিলেন। তার মতে, শিল্প বাস্তবকে যেমন আছে তেমনভাবে প্রতিফলিত করতে ব্যর্থ হয় এবং তাই সেটি সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। তার সমসাময়িক অনেক দর্শনবিদও একই মত পোষণ করতেন।

অন্যদিকে, অ্যারিস্টোটলের মতে, শিল্প নিছক বাস্তবের অনুকরণ নয়, বরং সেটি বাস্তবকে এক নতুন রূপে প্রকাশ করে, যা অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবের চেয়েও গভীর এবং তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে। তার কাব্যতত্ত্ব গ্রন্থে এই বিষয়টি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, কখনো কখনো কাব্য বা চিত্রকলায় মানুষকে বাস্তবের তুলনায় আরও মহৎ ও সুন্দর করে উপস্থাপন করা হয়, আবার কখনো তাকে বাস্তবের তুলনায় হীনতর দেখানো হয়। ট্র্যাজেডিতে মানুষের মহত্ত্বের রূপ প্রকাশ পায়, আর কমেডিতে মানুষকে হাস্যকর ও নিচুস্তরের চরিত্র হিসেবে চিত্রিত করা হয়। তাছাড়া, ট্র্যাজেডির কাঠামো সুসংহত করার জন্য বাস্তবের ঘটনাকে সরাসরি প্রতিফলিত না করে শিল্পীকে কিছুটা রূপান্তর ঘটাতে হয়। ইতিহাসে যেমন প্রতিটি ঘটনার নিরপেক্ষ বিবরণ দিতে হয়, ট্র্যাজেডিতে তা প্রয়োজন হয় না। বরং শিল্পের অভিপ্রায় অনুসারে কিছু ঘটনা বর্জন করা যেতে পারে এবং বাস্তবে যা ঘটেনি কিন্তু ঘটতে পারত, তাকেও কাব্যে স্থান দেওয়া যেতে পারে। ফলে, অ্যারিস্টোটল শিল্পকে কখনোই মিথ্যাচার বলে মনে করেননি, বরং তিনি একে সৃষ্টিশীলতার মর্যাদা দিয়েছেন। তার মতে, কাব্য ইতিহাসের তুলনায় বেশি দার্শনিক এবং বেশি গভীর, কারণ ইতিহাস কেবল নির্দিষ্ট ঘটনার বিবরণ দেয়, কিন্তু কাব্য সার্বজনীন সত্যকে প্রকাশ করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি প্লেটোর অনুকরণ-সংক্রান্ত তত্ত্বের বিপরীতে অ্যারিস্টোটলের চিন্তার মৌলিক পার্থক্যকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে।

চতুর্থত, শিল্প সম্পর্কে প্লেটোর আরেকটি গুরুতর আপত্তি ছিল নৈতিকতার প্রশ্নে। তিনি বলেছিলেন, কাব্যে দেবতাদের চরিত্রকে হীনভাবে উপস্থাপন করা হয়। কবিরা তাদের নিষ্ঠুরতা, আধিপত্যকামিতা ও ব্যভিচারকে তুলে ধরেন, যা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। প্লেটোর মতে, রাষ্ট্রশাসকরা দেবতাদের প্রতিনিধি এবং যদি দেবতাদের প্রতি মানুষের আনুগত্য নষ্ট হয়, তবে তা রাষ্ট্রের প্রতি তরুণ সমাজের আনুগত্যকেও দুর্বল করে দেবে। প্রাচীন গ্রিসে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য নাগরিকদের প্রধান কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত হত, তাই প্লেটো মনে করেছিলেন, কাব্যে দেবতাদের হেয় করা মানে সমাজে বিদ্রোহের বীজ বপন করা।

এছাড়াও, প্লেটো মনে করতেন যে কবিরা মানুষের কামনা-বাসনা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে অতিরঞ্জিতভাবে চিত্রিত করেন। ট্র্যাজেডিতে প্রায়শই দেখা যায়, এক ব্যক্তি মহান হয়ে ওঠে এবং অনেক সময় রাষ্ট্রীয় বিধানকেও অমান্য করে। এই ধরনের কাহিনি মানুষের মধ্যে শৃঙ্খলাহীন প্রবৃত্তির উত্থান ঘটাতে পারে এবং সমাজে স্বেচ্ছাচারকে উৎসাহিত করতে পারে। প্লেটোর এই আশঙ্কা একেবারে ভিত্তিহীন ছিল না, কারণ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই রাষ্ট্রশাসক ও সমাজবিধায়কেরা সাহিত্য, নাটক ও চলচ্চিত্রের প্রতি সন্দেহপ্রবণ ছিলেন এবং এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন।

কিন্তু প্লেটোর এই আপত্তির বিরুদ্ধে অ্যারিস্টোটল পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন। তার মতে, শিল্প কেবল বাস্তবের অনুকরণ নয়, বরং সেটি বাস্তবকে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করে। তিনি বলেন, শিল্প নিছক জাগতিক বাস্তবের পুনরাবৃত্তি নয়, এটি শিল্পীর নিজস্ব সৃষ্টিকর্ম। ফলে বাস্তব সমাজের নৈতিকতার সঙ্গে শিল্পের নৈতিকতাকে একেবারে সমান মানদণ্ডে বিচার করা যায় না। যদিও তিনি সরাসরি এটি বলেননি, তার বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে সাধারণ মানুষ বাস্তবের নীতি ও শিল্পের নীতিকে একইভাবে গ্রহণ করে না। এইভাবে, অ্যারিস্টোটল শিল্পের জন্য এক স্বতন্ত্র শৈল্পিক মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করেন, যা নন্দনতত্ত্বের ক্ষেত্রে নতুন চিন্তার দ্বার উন্মোচন করে।

কাব্যতত্ত্ব গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ে অ্যারিস্টোটল উল্লেখ করেছেন যে অনুকরণ মানব প্রকৃতির একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। মানুষ স্বভাবতই অনুকরণে পারদর্শী এবং শিক্ষাগ্রহণের জন্য এটি তার অন্যতম প্রধান উপায়। অনুকরণ থেকে মানুষ আনন্দও পায়। ট্র্যাজেডির ক্ষেত্রে দর্শকের মনে কোনো অনৈতিক আবেগের উদ্ভব হয় না, বরং এতে করুণা এবং ভয়ের অনুভূতি জাগ্রত হয়। যখন দর্শক মঞ্চে চরিত্রগুলোর দুর্দশা ও করুণ পরিণতি প্রত্যক্ষ করে, তখন তাদের মনে সহমর্মিতা ও আতঙ্কের অনুভূতি প্রবলভাবে দোলা দেয়। এই দুই ধরনের আবেগ যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন এক ধরনের মানসিক মোচন বা শুদ্ধিকরণ ঘটে, যা ক্যাথারসিস নামে পরিচিত। ক্যাথারসিসের ফলে দর্শকের মনে একধরনের প্রশান্তি ও ভারসাম্য তৈরি হয়। অ্যারিস্টোটল মনে করেন যে, শিল্প এই মানসিক শুদ্ধিকরণের মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতাদের জন্য আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে। অনেক পণ্ডিত মনে করেন, প্লেটো যে অভিযোগ করেছিলেন যে শিল্প মানুষের চরিত্র নষ্ট করে, অ্যারিস্টোটল তার ক্যাথারসিস তত্ত্বের মাধ্যমে সেই অভিযোগের যথার্থ উত্তর দিয়েছেন।

শিল্পের অনুকরণতত্ত্ব নিয়ে অ্যারিস্টোটলের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অ্যারিস্টোটলের পূর্ববর্তী গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যেও অনুকরণ তত্ত্বের ধারণা ছিল, যার প্রমাণ প্লেটোর লেখার মধ্যে পাওয়া যায়। তবে সেই ধারণা ছিল মূলত ভাববাদী ও অতীন্দ্রিয়বাদী, যা বস্তুজগতের পরিবর্তে এক উচ্চতর ধারণাগত জগতের অস্তিত্বের উপর নির্ভর করত। অ্যারিস্টোটল এই অনুকরণ তত্ত্বকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছেন, যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি বাস্তবসম্মত এবং বিজ্ঞানসম্মত। তিনি শুধুমাত্র শিল্পকে অনুকরণ বলে ঘোষণা করেননি, বরং তিনি এক মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন— যদি সব শিল্পই অনুকরণ হয়, তাহলে বিভিন্ন শিল্পের মধ্যে পার্থক্য কীভাবে নির্ধারিত হবে? তার বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় যে, শিল্পগুলোর পার্থক্য নির্ধারিত হয় তিনটি প্রধান ভিত্তির ওপর: অনুকরণের বিষয়বস্তু, অনুকরণের মাধ্যম এবং অনুকরণের পদ্ধতি। যদিও অ্যারিস্টোটল তার এই ব্যাখ্যা সংক্ষেপে উপস্থাপন করেছেন, তবে তার এই শ্রেণিবিন্যাস এতটাই যৌক্তিক এবং গভীর যে আজও তা শিল্প বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কাব্যতত্ত্ব গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়েই অ্যারিস্টোটল সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, শিল্পের বিভিন্ন শ্রেণি রয়েছে এবং তিনি এই শ্রেণিগুলোর পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করবেন। তিনি শিল্পকে সাধারণভাবে অনুকরণের একটি রূপ বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন যে মহাকাব্য, ট্র্যাজেডি, কমেডি, দিথুরামব কাব্য, সংগীতশিল্প, বাঁশি বা কিথারা বাজানো— সবকিছুই অনুকরণের মধ্যে পড়ে। তবে এগুলোর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি হয় তিনটি কারণে: অনুকরণের মাধ্যম, অনুকরণের বিষয়বস্তু এবং অনুকরণের রীতির ভিন্নতার কারণে। এই ব্যাখ্যার মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো শিল্পের সুনির্দিষ্ট শ্রেণিবিন্যাসের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়।

অ্যারিস্টোটল অনুকরণের বিষয়বস্তু সম্পর্কে দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলেছেন যে, অনুকরণের প্রধান বিষয়বস্তু হল মানুষ এবং তার কর্মকাণ্ড। এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, শিল্পের মূল কেন্দ্রবিন্দু মানুষ এবং মানুষের কর্মকাণ্ড ব্যতীত কোনো শিল্পসৃষ্টি সম্ভব নয়। যদিও অ্যারিস্টোটল তার বক্তব্য সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করেছেন, তবে একে আরও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ভাষাশিল্প, চিত্রকলা এবং মূর্তিকলায় সরাসরি মানুষের অবয়ব বা কর্মকাণ্ডকে অনুকরণ করা হয়। কিন্তু এমন অনেক শিল্প আছে, যেখানে সরাসরি মানুষের অনুকরণ না করেও প্রকৃতি বা অন্য বস্তুকে উপস্থাপন করা হয়। যেমন, চিত্রকলা বা ভাস্কর্যে কোনো গাছ, নদী বা পর্বতকে উপস্থাপন করা হলেও তা আসলে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমেই উপস্থাপিত হয় এবং সেই কারণেই তা মানুষের কর্মকাণ্ডের এক প্রকার অনুকরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। একই যুক্তি পশু-পাখির অনুকরণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ, শিল্পচর্চার মূল উপজীব্য মানুষের জীবন ও তার কর্ম এবং এই ধারণাই অ্যারিস্টোটলের অনুকরণ তত্ত্বের মূল ভিত্তি।

এরপর অ্যারিস্টোটল অনুকরণের ধারণার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষ প্রধানত দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত—ভালো ও মন্দ। এই শ্রেণিবিন্যাস নির্ধারিত হয় সাধুতা ও নীচতার ভিত্তিতে, অর্থাৎ নৈতিকতার মানদণ্ড অনুযায়ী। মানুষের চরিত্রের এই বিভাজন কেবল বাস্তব জীবনে সীমাবদ্ধ নয়, শিল্পেও প্রতিফলিত হয়। শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে এই দুই শ্রেণির মানুষের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। কাব্য, চিত্রকলা এবং সংগীত—এই প্রতিটি শিল্পেই এই নৈতিক দ্বৈততা ধরা পড়ে। এখানে অ্যারিস্টোটল বোঝাতে চেয়েছেন যে, শিল্প বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি এবং সেই বাস্তবতার সব দিকই এতে প্রতিফলিত হয়।

প্রথম পরিচ্ছেদে অ্যারিস্টোটল অনুকরণের মাধ্যম নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, অনুকরণ কখনো রং ও রূপের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, আবার কখনো তা প্রকাশ পায় কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে। এটি সুস্পষ্ট যে, এখানে তিনি মূলত চিত্রশিল্প এবং কণ্ঠসংগীত বা আবৃত্তির প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি অনুকরণের অন্যান্য মাধ্যমের কথাও বলেছেন, যেমন—ছন্দ, ভাষা ও সুর। কখনো অনুকরণ কেবল ছন্দের মাধ্যমে হয়, কখনো শুধুমাত্র ভাষার মাধ্যমে, কখনো আবার সুরের মাধ্যমে, আবার কখনো এ তিনটির সংমিশ্রণে। তিনি কেবল ছন্দের মাধ্যমে অনুকরণের একটি উদাহরণ হিসেবে নৃত্যের কথা বলেছেন। নৃত্যে মূলত ছন্দোময় দেহভঙ্গি ব্যবহার করে চরিত্র, অভিজ্ঞতা এবং ঘটনার অনুকরণ করা হয়। নৃত্যের সময় সুর ব্যবহার করা হয় না, বরং ছন্দই এখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তবে মনে রাখতে হবে, নৃত্যে নর্তকের দেহই প্রধান অনুকরণ-মাধ্যম। অন্যদিকে, কেবল সুর ও ছন্দের মাধ্যমে অনুকরণ করা হয় বাঁশি, কিথারা, পাইপ এবং অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের সংগীতে।

এরপর অ্যারিস্টোটল সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার সময়ে “সাহিত্য” শব্দটি প্রচলিত ছিল না, তাই তিনি ভাষার মাধ্যমে তৈরি হওয়া শিল্পের প্রসঙ্গ এনেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, এমন একটি শিল্প রয়েছে, যেখানে অনুকরণ করা হয় কখনো পদ্যে, কখনো গদ্যে। কখনো এক ধরনের ছন্দ ব্যবহৃত হয়, আবার কখনো একাধিক ছন্দের সমন্বয়ে এই শিল্প গঠিত হয়। তিনি বলেছেন, এই শিল্পটির এখনও কোনো নির্দিষ্ট নামকরণ হয়নি। এটি স্পষ্ট যে, এখানে তিনি ভাষাভিত্তিক শিল্পের কথা বলেছেন। উদাহরণ হিসেবে তিনি মহাকাব্য, এলিজি, নোম কবিতা, ট্র্যাজেডি এবং কমেডির কথা বলেছেন।

এই প্রসঙ্গে অ্যারিস্টোটল একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা প্রদান করেছেন—মাধ্যম ও কাঠামোগত মিল দেখে যেন বিষয়ের পার্থক্য ভুলে না যাওয়া হয়। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, বিজ্ঞানের বইও ছন্দোবদ্ধ হতে পারে, কিন্তু তা কবিতা নয়। একজন লেখক যদি পদ্যে চিকিৎসাবিদ্যা বা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান সম্পর্কিত বই লেখেন, তাহলে তাকে কবি বলা সঙ্গত নয়। এই প্রসঙ্গে অ্যারিস্টোটল হোমার এবং এমপেদোক্লেসের তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, হোমার কবি, কিন্তু এমপেদোক্লেস বিজ্ঞানী, যদিও তাদের রচনাগুলোর মধ্যে ছন্দের মিল রয়েছে। এখানে মূল কথা হলো, কবিতা বা শিল্পকে সংজ্ঞায়িত করতে গেলে কেবল ছন্দকে মানদণ্ড হিসেবে ধরা উচিত নয়; বরং বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্য বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, যদি কোনো রচনার মূল বিষয়বস্তু মানবজীবন এবং তার ক্রিয়াকলাপ না হয়, তাহলে তাকে প্রকৃত অর্থে শিল্প বলা যায় না।

অ্যারিস্টোটল অনুকরণের পদ্ধতি নিয়ে মূলত তার Poetics (কাব্যতত্ত্ব) গ্রন্থের তৃতীয় পরিচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় পরিচ্ছেদেও অনুকরণের পদ্ধতি সংক্রান্ত কিছু বিষয় আলোচনা করেছেন। তিনি ভাষাশিল্পের পরিধির মধ্যেই তার ব্যাখ্যাকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন এবং এই বিষয়ে তার প্রথম বক্তব্য হল—একই বিষয়কে বিভিন্ন পদ্ধতিতে উপস্থাপন করা সম্ভব। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, কোনো রচনাকে সরাসরি বর্ণনার মাধ্যমে উপস্থাপন করা যায়, আবার কিছুটা হোমারের মতো কৌশল অবলম্বন করে লেখক নিজেকে কোনো চরিত্রের ভূমিকায় স্থাপন করে তা পরিবেশন করতে পারেন, কিংবা সম্পূর্ণ চরিত্রগুলির মাধ্যমে কাহিনির গতি নির্ধারণ করাও সম্ভব। এই প্রসঙ্গে অ্যারিস্টোটল মূলত মহাকাব্য ও নাটকের মধ্যে অনুকরণের পদ্ধতিগত পার্থক্য স্পষ্ট করেছেন।

মহাকাব্যের অনুকরণ পদ্ধতি হলো যেখানে লেখক সরাসরি বর্ণনা করেন কিংবা কোনো নির্দিষ্ট চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনা বর্ণিত হয়। অন্যদিকে, নাটকের অনুকরণ পদ্ধতি এমন যেখানে চরিত্ররা নিজেরাই ঘটনাগুলি পরিচালনা করে এবং লেখকের হস্তক্ষেপ অনুপস্থিত থাকে। এই পার্থক্যের ভিত্তিতেই তিনি মহাকাব্য ও নাটককে পৃথক শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। যদিও তৃতীয় পরিচ্ছেদে অনুকরণের পদ্ধতি নিয়ে কেবল এতটুকু আলোচনা করেছেন, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে তিনি আরও গভীর বিশ্লেষণ করেছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, মানুষের অনুকরণ তিনটি পদ্ধতিতে করা সম্ভব—বাস্তবের চেয়ে মহত্তর, বাস্তবের চেয়ে হীনতর, এবং যথাযথ বাস্তব। ট্র্যাজেডির ক্ষেত্রে মানুষের অনুকরণ বাস্তবের চেয়ে মহত্তররূপে করা হয়, কমেডিতে মানুষকে বাস্তবের চেয়ে হীনতররূপে দেখানো হয়। এই উপস্থাপনাগুলি আসলে অনুকরণের বিভিন্ন রূপ এবং তা শিল্পের বহুমুখী প্রকৃতির স্বীকৃতি দেয়। অ্যারিস্টোটলের এই বিশ্লেষণ তার সময়ের তুলনায় অত্যন্ত ব্যতিক্রমী এবং অগ্রগামী ছিল।

পরবর্তীকালে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে জার্মান শিল্পতাত্ত্বিক জি. ই. লেসিং অনুকরণ তত্ত্বের এই ব্যাখ্যায় একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি যোগ করেন। তিনি বলেন, অনুকরণের পদ্ধতির পার্থক্য কেবলমাত্র বিষয়বস্তুর পার্থক্যের কারণেই নির্ধারিত হয় না, বরং শিল্পমাধ্যমের ভিন্নতার কারণেও ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, চিত্রকলা ও সংগীতের অনুকরণ পদ্ধতির সঙ্গে সাহিত্যিক অনুকরণের প্রক্রিয়া এক নয়। তাই একে একক মানদণ্ডে বিচার করা উচিত নয়। লেসিংয়ের এই দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক শিল্পতত্ত্বের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

অ্যারিস্টোটলের আগেও অনুকরণ তত্ত্ব নিয়ে কিছু চিন্তাবিদ ধারণা প্রকাশ করেছিলেন। তবে তারা অনুকরণ বলতে যে ধারণাটি বোঝাতেন, তা ছিল মূলত এক অলৌকিক জগতের প্রতিফলন। তাদের মতে, ঈশ্বর একটি আদি নীতির ভিত্তিতে বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন এবং পৃথিবী সেই স্বর্গীয় আদর্শের প্রথম অনুকরণ, যদিও তা অসম্পূর্ণ। এই চিন্তাধারা ছিল গভীরভাবে আধ্যাত্মিক এবং বাস্তবতার সাথে সম্পৃক্ত নয়। কিন্তু অ্যারিস্টোটল তার বিজ্ঞানসম্মত যুক্তির মাধ্যমে অনুকরণকে সম্পূর্ণ বাস্তবতার নিরিখে উপস্থাপন করেন। তিনি মনে করেন, এই বিশ্ব সম্পূর্ণ বাস্তব এবং শিল্পীরা বাস্তব জগতের অনুকরণ করেই শিল্প সৃষ্টি করেন। এই তত্ত্ব আজও অপরিবর্তিত রয়েছে এবং শিল্পতত্ত্বের একটি মজবুত ভিত্তি হিসাবে বিবেচিত হয়।

অ্যারিস্টোটল অনুকরণকে অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি বলেছেন, অনুকরণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, এটি মানুষের শিক্ষার অন্যতম প্রধান মাধ্যম, এটি আনন্দদায়ক এবং সকল সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের মূল। তার বক্তব্য অত্যন্ত যৌক্তিক এবং সুস্পষ্ট। তার আগে কেউ অনুকরণ তত্ত্বকে এত সুসংহত ও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেননি।

অ্যারিস্টোটলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান হলো শিল্পের প্রকৃতি ও অনুকরণের ভূমিকা সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ও যৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রদান করা। তার আগে যেসব দার্শনিক শিল্পের অনুকরণমূলক প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, তারা লক্ষ্য করেছিলেন যে অনুকরণ কখনোই বাস্তবের হুবহু প্রতিরূপ হতে পারে না। এই কারণে প্লেটো অনুকরণকে ত্রুটিযুক্ত, অসম্পূর্ণ এবং একধরনের প্রতারণা বলে মনে করেছিলেন। তবে অ্যারিস্টোটলই প্রথম ব্যক্তি যিনি এই ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন যে অনুকরণের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবতার নিখুঁত প্রতিরূপ তৈরি করা নয়। বরং, অনুকরণ এমন এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষ শুধুমাত্র যা ঘটেছে তা নয়, বরং যা ঘটতে পারে, যা ঘটার সম্ভাবনা আছে এবং এমনকি যা ঘটার প্রয়োজন, সেই সবকিছুকে সংমিশ্রণ করে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারে। এই সৃষ্টির মধ্য দিয়েই অনুকরণ প্রকৃত শিল্পের স্তরে উন্নীত হয়। এই কারণেই অ্যারিস্টোটলের অনুকরণতত্ত্ব শুধু তার সময়ে নয়, বরং আজও শিল্পতত্ত্বের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃত।

অ্যারিস্টোটলের ব্যাখ্যায় অনুকরণতত্ত্ব প্রথম পূর্ণাঙ্গ শিল্পতত্ত্ব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, যা সাহিত্যের প্রকৃতি ও কার্যকারিতা বিশ্লেষণে ব্যবহৃত হয়। তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি সৃষ্টিশীল শিল্পের সঙ্গে কেবলমাত্র প্রয়োজন পূরণের জন্য তৈরি শিল্পের পার্থক্য নির্ধারণ করেন। তার ব্যাখ্যায় তিনি পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছেন যে সাহিত্য ও শিল্পের প্রয়োজনীয়তা রাজনৈতিক, ধর্মীয় কিংবা অন্যান্য সামাজিক প্রয়োজন থেকে পৃথক। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে শিল্পের প্রকৃত সৌন্দর্য নিহিত থাকে তার সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে। শিল্প কেবল ব্যক্তিগত বা বিশেষ কোনো ঘটনার অনুকরণ নয়, বরং এটি এমন এক মাধ্যম যেখানে বৃহত্তর মানব-অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয়। এই ধারণার মধ্য দিয়েই অ্যারিস্টোটল শিল্পের গভীর অনুভূতি ও জীবনের সত্য প্রকাশের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। তার অনুকরণতত্ত্ব সাহিত্য ও শিল্প নিয়ে হাজার বছর ধরে আলোচনা ও বিশ্লেষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। দীর্ঘ সময় ধরে এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই শিল্প ও সাহিত্যের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং আজও এটি অনতিক্রম্য ও অপরিহার্য হিসেবে টিকে আছে। এই কারণেই অ্যারিস্টোটল-বিবৃত অনুকরণতত্ত্বকে সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটি চিরকালীন ও ক্লাসিক তত্ত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.