Table of Contents
রোমান্টিক যুগের সাহিত্য
ক্লাসিক ও রোমান্টিক
ক্লাসিক এবং রোমান্টিক শব্দ দুটি নিয়ে এত বেশি বাক-বিতণ্ডা হয়েছে যে শব্দ-দুটির প্রকৃত অর্থ, সংজ্ঞা ও স্বরূপ নির্ণয় করা যেন এক দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে উঠেছে। আবার এই দুটি শব্দকে কেন্দ্র করে যুগ বিভাগও হয়েছে। যেমন ক্লাসিক্যাল যুগ ও রোমান্টিক যুগ, ক্লাসিক্যাল যুগকে কোন কোন সমালোচক “যুক্তির যুগ” বা Age of Reason বলে উল্লেখ করেছেন।
যাইহোক ক্লাসিক্যাল শব্দের প্রথম ব্যবহার করেন Aulus Gellius এবং তিনি দুটি ভিন্ন জাতের শিল্পের উল্লেখ করেছেন, যেমন, Scriptor classicus এবং scriptor prolatarius তিনি Scriptor classicus-কে শিক্ষিত সমাজের সাহিত্য এবং scriptor prolatarius-কে প্রাকৃত জনগণের সাহিত্য বা লৌকিক সাহিত্য বলে উল্লেখ করেছেন, Scriptor classicus-এর স্বরূপ হল যে শব্দটির অর্থের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের কোন পরিবর্তন যেখানে কোনদিন সম্ভব নয় এবং যা ‘প্রথম শ্রেণীর’ শিল্পের গুণধর্ম বলে চিহ্নিত। এই অর্থে ক্লাসিক শব্দটিকে ‘চিরায়ত’ বলা যেতে পারে। যা কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ অর্থাৎ যা মৌলিক, যা পরিবর্তনহীন এবং শাশ্বত। এই শাশ্বত কালের সাহিত্য হল তাই যে সাহিত্য ক্লাসিক্যাল সাহিত্যের আদর্শ অনুযায়ী রচিত। ক্লাসিক্যাল সাহিত্যের সাহিত্যাদর্শ হল এরিষ্টটল প্রবর্তিত সাহিত্যতত্ত্ব। এরিষ্টটল সাহিত্য রচনার যে নীতি নিয়ম এবং অনুশাসন রচনা করেছেন তা রোম সম্রাট অগাষ্টাসের রাজত্বকালে বিভিন্ন কবি কর্তৃক অনুসৃত হয়, লাতিন সাহিত্যের অগাষ্টান যুগকেও ক্লাসিক্যাল যুগ বলা হয়। অর্থাৎ গ্রীক সাহিত্যকে ক্লাসিক্যাল সাহিত্য বলা হয়, কারণ গ্রীক সাহিত্যের রূপ ও রীতি বিশুদ্ধ মানবিকতার আলোকে সমুজ্জ্বল এবং যার আবেদন বিশ্বজনীন, এর ফলে গ্রীক সাহিত্যের রীতির অনুকরণ করা হল ক্লাসিক্যাল রীতি, গ্রীক সাহিত্যের ক্লাসিক্যাল রীতির অনুকরণে লাতিন সাহিত্য রচিত হল। আবার লাতিন সাহিত্যের ক্লাসিক্যাল রীতির অনুকরণ করা হল ফরাসী সাহিত্যে। ফরাসী সাহিত্যের ক্লাসিক্যাল রীতির অনুকরণ হল ইংরাজী সাহিত্যে। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন কবি বা সমালোচক এরিষ্টটলের তত্ত্বকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ফলে এরিষ্টটলের সাহিত্য তত্ত্বের নীতি নিয়মেরও যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটে গেছে। পণ্ডিত সমালোচকদের মধ্যে গড়ে উঠেছে মত পার্থক্যের সু-উচ্চ প্রাচীর। গ্রীক সাহিত্যের সাহিত্যাদর্শ যেমন লাতিন সাহিত্যে যথাযথভাবে অনসৃত হয়নি তেমনি লাতিন সাহিত্যের সাহিত্যাদর্শও ফরাসী সাহিত্যে অনুসৃত হয়নি। ইংরাজী সাহিত্যের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়।
গ্রীক সাহিত্যের মৌল প্রেরণা ছিল সৌন্দর্য সৃষ্টি, সুবিন্যাস, সুসজ্জিত শব্দের পরিমিত আয়তনের মধ্যেই সৌন্দর্যের বিকাশ। পরবর্তী কালে লাতিন সাহিত্যে গ্রীক সাহিত্যের সৌন্দর্য সৃষ্টি অনুকরনের সঙ্গে সংযোজিত হল বুদ্ধিদীপ্ত চোখ ঝলসানো ব্যঙ্গের রীতি। ফরাসী সাহিত্যে লাতিন রীতি অনুকরনের সঙ্গে সংযোজিত হল যুক্তিবাদী অতিনিষ্ট মননশীলতা এবং সুমার্জিত তীক্ষ্ণতা। ফলে ক্লাসিক্যাল রীতি বলতে এক নতুন জাতের কৃত্রিম রীতির আবিষ্কার হল। এবং এই কৃত্রিম রীতিকেই এরিষ্টটল প্রবর্তিত ক্লাসিক্যাল রীতি বলে প্রচার করা হল, এই কৃত্রিম রীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষিত হল, এরিষ্টটল হলেন নিন্দিত। সাহিত্যের জগতে নুতন একটি দলের সৃষ্টি হল, তা হলো রোমান্টিক দল। যদিও অষ্টাদশ শতাব্দীর নবজাগরণের অন্যতম প্রেরণা ছিল গ্রীক ও রোম সাহিত্যের পুনরুদ্ধার এবং প্রাচীন সাহিত্যাদর্শের অনুকরণ। তবুও পরবর্তীকালে রোমান্টিক কবিদর এরিষ্টটল প্রবর্তিত সাহিত্যের নীতি নিয়মকে অস্বীকার করে নতুন রোমান্টিক রীতির প্রবর্তন
করলেন। বিদ্রোহের প্রধানতম কারণ হল অষ্টাদশ শতাব্দীর কৃত্রিম ক্লাসিক্যাল রীতির প্রচণ্ড দাপট এবং অত্যধিক শাসন। ‘ত্রয়ী-ঐক্য’ যা এরিষ্টটলের নামে প্রচলিত তা এরিষ্টটলের নিজস্ব সৃষ্ট জীতির মধ্যে অনুপস্থিত। কষ্টেলভেট্রো, ত্রিসিনো, প্রমুখ সমালোচকেরা নিজেদের স্ককপোল কল্পিত ব্যাখ্যার মাধ্যমে এরিষ্টটলের রীতির নামে এই কৃত্রিম ধারণাটুকুর অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে দিলেন। এর ফলে, একটি বিরোধী দলের জন্য হল সে দলটি হল রোমান্টিক দল। এবং লোকে এখনও ক্লাসিক্যাল রীতি বলতে এরিষ্টটল প্রবর্তিত রীতিকেই মনে করে।
এরিষ্টটল অবশ্য সাহিত্যের দুটি রীতির কথা বলেছেন। একটি রীতিতে কাব্য হচ্ছে কবি স্বভাবের একটি সুখী অবদান। অন্যটিতে কবি আপন সত্তা ভুলে আবেগে আত্মহারা। Hence poetry implies either a happy gift of nature or a strain of madness. In the one case man can take the mould of any character, in the other, he is lifted out of his proper self প্রথম রীতিটির ক্ষেত্রে কবির আবেগ সংযত সংহত এবং আত্মনির্লিপ্ত। জীবন জিজ্ঞাসার যথাযথ রূপদানের জন্য কবি পরিমিত আয়তনের মধ্যে সুবিন্যাস ও সুসজ্জিত ঘটনার সম্ভাব্য ও অপরিহার্যতার নীতি নিয়ম অনুসারে সৌন্দর্যের সৌধ নির্মাণ করেন। কারণ জীবন সৌধের সৌন্দর্য নির্ভর করে প্রতিটি অঙ্গের সঙ্গে প্রতিটি অঙ্গের ঘনীভূত এবং সুনিবিড় ঐক্যের উপরে। সুতরাং এই সমুন্নত সৌন্দর্য্যের রূপনির্মাণের সাধনা করেন গুরুগম্ভীর প্রকৃতির কবি। যেমন, হোমার, ইস্কাইলাস, সফোক্লিস, এরিষ্টফেনিস, পেত্রার্কা, সেক্সপীয়র, ইবসেন, প্রভৃতির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। কারণ এরা প্রত্যেকেই গুরু গম্ভীর বিষয়ের রূপদান করেছেন এবং সম্ভাব্যতা ও অপরিহার্যতার নীতি নিয়ম অনুসারে পরিমিত আয়তনের মধ্যে ভাব ও ভাবনার সুগভীর পরিণতি এবং রূপ রীতির সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন।
অন্য রীতিটিতে যে সমস্ত কবির রচনায় উন্মাদনার সুর লক্ষ্য করা যায় সেই সমস্ত কবি আপন আবেশে আত্মহারা হয়ে জীবনের সুগম্ভীর রূপদান করতে সক্ষম হন না। সক্ষম হন না রীতির সৌন্দর্য্যের বিকাশ সাধন করতে; তাদের রচনা একটি সৌন্দর্য্যের তাজমহল হয়ে ওঠে না। পরিবর্তে নানা বৈচিত্র্যের রূপে ও রঙ্গে বর্ণময় হয়ে ওঠে। অসংযত কল্পনার সীমাহীন আবেগে একটি অখণ্ড জীবন ভাবনার পরিবর্তে খন্ড, ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত ভাব বা ভাবনার বিকাশ ঘটে থাকে, ফলে পরিমিত আয়তনের মধ্যে সুবিন্যস্ত ঐক্যের পরিবর্তে শিথিল রূপের মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র, খন্ড খণ্ড, ভাবনার বিকাশ ঘটানোই হল এইসব কবির লক্ষ্য। কারণ চঞ্চল কবি-মন আবেগের প্রচণ্ড তাড়নায় ঘর ছাড়া দিশেহারা হয়ে সীমা হারিয়ে ফেলে, সৌন্দর্যের চিরস্থায়ী পিরামিড রচনার পরিবর্তে জীবনের বালুচরে ক্ষণস্থায়ী কুঞ্জকুটীর রচনা করে। তাই এরিষ্টটলের যুগে যদিও গীতি কবিতার কোন প্রচলন ছিল না তবুও অনেক কবি কল্পনার প্রচণ্ড আবেগে গুরুগম্ভীর জীবনরূপের সার্থক সৃষ্টির সুকঠিন নির্মাণ কৌশল বুঝতে না পেরে আপনসত্তা ভুলে আবেগে আত্মহারা হয়েছেন। এমনকি এরিস্টটলের গুরু প্লেটো নিজেই ছিলেন জন্ম রোমান্টিক। পরবর্তীকালের অনেক কবিই প্লেটোর স্বপ্ন কল্পনার পথের পথিক হয়েছেন। আধুনিক কালেও প্লেটোর শিষ্যের অভাব নেই। প্লেটো নিজেও বিশ্বাস করতেন যে For a poet is indeed a thing ethereally light, winged and sacred… these souls flying like bees from flower to flower and wandering over the gardens and meadows and honey flowing fountains of the muses returned to us laden with the sweetness of melody, and arrayed as they are in the plumes of rapid imagination, they speak the truth বাস্তবিক পক্ষে কবি হল একটি স্বর্গীয় আলোক, একটি স্বর্গীয় দেবদূত, একটি স্বর্গীয় পবিত্রতার প্রতিমূর্তি। এইসব কবির আত্মা মৌমাছির মত ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায় সুরলোকের
পুষ্পোদ্যানে, উন্মুক্ত প্রান্তরে আর মধু নিস্যঙ্গী ঝর্ণা ধারার বুকে, আমাদের জন্য বহন করে আনে সুরের মাধুর্য্য, আর দ্রুতগতি কল্পনার পালকে সেই সৌন্দর্যকে মেলে ধরে প্রকৃত সত্যকেই প্রকাশ করে।
সুতরাং রোমান্টিক স্বপ্ন কল্পনার কথা এরিষ্টটলও উল্লেখ করেছেন। তাঁর প্রবর্তিত রূপের রীতির দুই রূপের একটি গুরুগম্ভীর আর একটি লঘু প্রকৃতির। বিশুদ্ধ রোমান্টিক, কবি জীবনের লঘু রূপকে লঘু ছন্দেই প্রকাশ করেন। কারণ মনে রাখতে হবে যে কবি মাত্রেই কাল্পনিক। গুরুগম্ভীর কবি সংযত কল্পনার সংহত রূপের সৃষ্টি করেন। আর বিশুদ্ধ রোমান্টিক কবি অসংযত কল্পনার বিপুল বিলাসকেই রূপদান করেন অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারে। তাই রোমান্টিক রীতির ধারণা নতুন কিছু নয় তবুও আধুনিক কালে রোমান্টিক ও ক্লাসিক্যাল রীতির সংজ্ঞা ও স্বরূপ নির্ণয়ের প্রচেষ্টা ও উদ্যম সমান ভাবেই চলেছে। কোন এক সমালোচক বলেছেন In general a theme is romantic, when as Aristotle would say, it is wonderful rather than probable; in othe words, when it violates the normal sequence of cause and effect in favour of advanture. সুতরাং ক্লাসিক কথটার সঙ্গে উন্নত রীতির প্রসঙ্গ মিশে আছে। আবার রোমান্টিক শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিয়ম শৃঙ্খলাবিহীন একটা উদ্দামতা। এই অর্থে ক্লাসিক্যাল শব্দটি রোমান্টিক শব্দের বিপরীতার্থক শব্দরূপে প্রচলিত হয়েছে। ক্লাসিক এবং রোমান্টিক রীতির প্রধান পার্থক্য হল রূপরীতি, বিষয় ও উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ‘রোমান্টিক’ শব্দটির আবির্ভাব ঘটেছে ফরাসী শব্দ ‘রোমাঞ্চ’ থেকে, যার অর্থ হল লাতিন শব্দের পরিবর্তে গ্রাম্য কথ্য ভাষায় রচনা করা। মধ্যযুগীয় ফরাসী মহাকাব্যগুলিকে এই অর্থে ‘রোমান’ বলা হত, ১৬৫৪ সালে ‘রোমাঞ্জের মত’ এই অর্থে ইংরাজী সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়। ১৭৪৮ সালে রোমান্টিক শব্দটি একাডেমি কর্তৃক স্বীকৃত হয়, আবার কেউ কেউ শব্দটির আরও প্রাচীনতম রূপের সন্ধান করতে গিয়ে উত্তর ইটালীর একটি আঞ্চলিক ভাষা “লিঙ্গুয়া রোমানিক”র উল্লেখ করেছেন। সম্ভবতঃ সেই ভাষায় ব্যবহৃত হয়েছে। স্প্যানিশ একটি ছন্দের নাম হল “রোমান্স”। সুতরাং রোমান্স শব্দটির প্রথম ব্যবহার প্রসঙ্গে নানা মুনির নানা মত থাকতে পারে। যাইহোক রোমান্টিকতার স্বরূপ সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।
রোমান্টিক শব্দটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে, তার স্বরূপটি, সেই স্বরূপটি হল ক্লাসিক্যাল শব্দের পরিবর্তে প্রাকৃত ভাষার ব্যবহার। ক্লাসিক্যাল রীতির শব্দ রচনার মধ্যে অলংকরণের প্রাবল্য দেখা যায়, “রোমান্টিক” রীতির মধ্যে সহজ সরল অনাড়ম্বর অনলংকৃত কথ্য ভাষার প্রয়োগের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। কথ্য ভাষার কাব্যিক প্রয়োগই হ’ল রোমান্টিক ভাষার অন্যতম লক্ষণ। কাব্যে
অভিজাত ভাষার পরিবর্তে অনভিজাত শব্দের কাব্যময়তায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল। ফলে রোমান্টিক ভাষার মধ্যে প্রাণ প্রাচুর্য্যের কলকল্লোল ও কলরব শোনা গেল। অর্থাৎ ভাষা তার অলংকরণের সজ্জিত রূপের আড়ষ্টতা থেকে মুক্তি পেয়ে মুক্তির ভরা আনন্দে নেচে উঠল, কারণ প্রচলিত একঘেয়ে ছন্দের পরিবর্তে নানা ছন্দ বৈচিত্র্যের প্রকাশ ঘটল। প্রচলিত ছন্দের বন্ধন ভেঙ্গে নবতম ছন্দের সৃষ্টির ফলে রোমান্টিক ভাষা ঝর্ণা ধারার মত চপল নৃত্যে নেচে উঠল। তাই ছন্দে নব নব সৃষ্টি ভাষাকে করল চঞ্চল, প্রবহমান, গতিমুখর, অন্যদিকে ক্লাসিক্যাল ছন্দ বলতে একটিমাত্র ছন্দকে বোঝাত। ভাষা যেন সেই ছন্দের কঠিন নিগড়ে আবদ্ধ ছিল। সেই প্রচলিত ছন্দের গণ্ডির মধ্যেই কাব্যের ভাষাকে আপন কর্তব্য পালন করতে হত। তাই ছন্দোবদ্ধ নয়, ছন্দের বন্ধনকে
অস্বীকার করে নতুন ছন্দের ভরা আনন্দে ভেসে চলাই হল রোমান্টিক ভাষার দ্বিতীয় লক্ষণ। তৃতীয়ত, প্রচলিত ক্লাসিক্যাল রীতি অনুযায়ী প্রতিটি স্তবকে একটি করে বক্তব্য শেষ হত। তার
ফলে একটি বিশেষ ভাবকে প্রকাশকে স্তবকের সীমার মধ্যেই বন্দী করে রাখত। স্তবকের সীমাকে অতিক্রম করে ব্যাপ্তিলাভের কোন অবকাশই ছিল না। কিন্তু ছন্দের বন্ধন মুক্তির ফলে ভাব প্রকাশের বন্ধন মুক্তি ঘটল। ছন্দের নৃত্যের তালে তালে ভাব ও নদীতরঙ্গের মত স্বচ্ছন্দ গতিতে প্রবাহিত হল। ভাবের এই প্রবাহধর্মিতা ছন্দের প্রবাহমানতার সঙ্গে এক সুনিবিড় বন্ধনহীন মুক্তির আনন্দ বিজড়িত। ফলে স্তবকের সীমা গেল ঘুচে, ভাষা হয়ে উঠল অসীমের ব্যঞ্জনায় মুখর, ভাবও হয়ে উঠল সীমাহীন আবেগে সুদূরের পিয়াসী।
চতুর্থত, ক্লাসিক্যাল রীতির বুদ্ধি-প্রধান বাগবৈদগ্ধের উজ্জ্বল্য অপেক্ষা আবেগ প্রধান সরল, স্বচ্ছ ও বর্ণময়তার রূপ লাভ করল রোমান্টিক ভাষা। ক্লাসিক্যাল রীতির মধ্যে প্রধানত ছিল wit বা বুদ্ধিপ্রধান চটকদার ভাষা। অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি এবং শিল্পীরা ল্যাটিন ভাষার পূজারী ছিলেন। ল্যাটিন ভাষার যথাযথ প্রয়োগ এবং ওজস্বিতার দিকেই এঁদের প্রধান লক্ষ্য ছিল। ফলে কবির ভাষার মধ্যে শাণিত বুদ্ধির চমকিত দীপ্তির বিকাশ ঘটত। এই বুদ্ধি-দীপ্ত ভাষার প্রয়োগ কৌশলের মধ্যে একটা সপ্রশংস বিশ্বয় এবং পাণ্ডিত্যের গৌরব ছিল। পাণ্ডিত্যের সুকঠিন আবরণ উন্মোচন করে ভাষার প্রকৃত অর্থোদ্ধার করা এক দুরূহতম সমস্যা। ভাষার মধ্যে না ছিল নিগূঢ় প্রাণস্পন্দন, না ছিল স্বতঃ উৎসারিত হৃদয়াবেগ। বরং কিছুটা কৃত্রিমতায় ভরা ছিল। কিন্তু “রোমান্টিক” ভাষা যেহেতু ল্যাটিন ভাষার অনুকরণের বিরোধী এবং সহজ, সরল, দৈনন্দিন জীবনের ভাষা সেইহেতু ‘রোমান্টিক ভাষার’ মধ্যে বুদ্ধির কারুকার্য খচিত শিল্প কৌশল প্রয়োগে প্রয়াস নেই বরং পুরাণের রঙে নিজেকে রঙিন করে তোলাই তার ধর্ম। এই ভাষার প্রকাশ ঘটেছে বুদ্ধি বা নীরস পাণ্ডিত্যের কুস্তির আখড়ায় নয়, রাজসভার সাহিত্যের মণিময় কক্ষের অভ্যন্তরেও নয়, “রোমান্টিক ভাষা”র প্রকাশ ঘটেছে কবির হৃদয়ানুভূতির ঝর্ণাধারায় অবগাহন করে বা কবির বুকের লালিমা রঙে রঙিন হয়ে বিকশিত হয়েছে মানব হৃদয়ের আবেগের শিহরিত স্পর্শে।
পঞ্চমত, রোমান্টিক ভাষা গঠন শিল্পের ছক বাঁধা সুনির্দিষ্ট সৌন্দর্যের পরিবর্তে অনির্দিষ্ট আকার প্রকারহীন সৌন্দর্যের বাতাবরণ সৃষ্টি করল। ক্লাসিক্যাল ভাষা একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যেই অসীমের ব্যঞ্জনাকে প্রকাশ করত। রোমান্টিক ভাষা নির্দিষ্ট সীমাহীন অবয়বের মধ্যে জীবনের সূক্ষ্ম অপ্রত্যক্ষ ভাব ব্যঞ্জনাকে প্রকাশ করল। অর্থাৎ জীবনের একটি ক্ষুদ্র ক্ষণস্থায়ী ভাব পল্লবিত ও বিস্তাবিত হল সীমাহীন অবয়বের মধ্যে। অন্যদিকে ক্লাসিক্যাল রীতিতে ভাষা ছিল সংযত, সুগম্ভীর উচ্ছ্বাসবিহীন সম্ভাব্য এবং অপরিহার্যতার নীতি নিয়মকে লঙ্ঘন করে ভাষার উদ্দামতা ছিল নীতি বিরুদ্ধ। কারণ ক্লাসিক্যাল কাব্যের গঠন সৌষ্ঠবের দিকে তীক্ষ্ণ লক্ষ্য রাখা হত। কিন্তু রোমান্টিক কাব্যের ক্ষেত্রে অতি সুকঠিন নীতি নিয়মকে অস্বীকার করা হল।
ক্লাসিক্যাল রীতির এই অনুশাসনকে অস্বীকার করার ফলে ভাষা এবং রীতি হয়ে উঠল চিত্রধর্মী, ভাস্কর্যধর্মী নয়, কারণ ভাস্কর্য শিল্পের মধ্যে প্রত্যেকটি বর্ণ, রেখা, শব্দ এবং ভাষার যে গাঁধুনী এবং ঐক্য আছে, রোমান্টিক ভাষা বা রীতির মধ্যে সেই নিবিড় ঐক্যের বা সঙ্গতির অভাব লক্ষ্য করা যায়। রোমান্টিক ভাষার মধ্যে রয়েছে ঊষাকালের অথবা প্রদোষকালের অস্পষ্টতা। যেন কোন এক রহস্যের কুহেলিকার আবরণে আচ্ছন্ন, ক্লাসিক্যাল ভাষা এবং রীতির মধ্যে জীবন রূপ যেমন দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠে, রোমান্টিকতার মধ্যে জীবন যে অনেকখানি না বলা বর্ণী বা অকথিত কাহিনী বা রহস্যের আবরণে মণ্ডিত থাকে। তাই রোমান্টিক ভাষার রীতি ও শব্দ ধারাগের মধ্যে বর্ণনীয় বস্তুর চারিদিকে এক অপরূপ রঙীন আলোক চিত্র রচনা করা হয়। আবেগের অতিশয্যজনিত এক অস্পষ্ট ধুম্রময়তা বা ধূসরতার সৃষ্টি হয়। ক্লাসিক্যাল রীতির মধ্যে যে মুন্সিয়ানা যায়ে সে মুন্সিয়ানার অভাব রোমান্টিক রীতির ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। ক্লাসিক্যাল রীতির ক্ষেত্রে ভাষা যেমন সুনির্বাচিত এবং সুবিন্যাসে চারুত্ব লাভ করে তেমনি রোমান্টিক রীতির ক্ষেত্রে ভাষা অসীমের ব্যঞ্জনায় বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠে। ক্লাসিক্যাল রীতির মধ্যে জীবনের গুরুগম্ভীর বিষয় বস্তুর যে উপস্থাপনা ঘটে রোমান্টিক রীতির ক্ষেত্রে জীবনের একটি ভাবকে আবার সেই ইঙ্গিতে কতক ভাষায় কতক ভাষাতীত ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করা হয়। রোমান্টিক কবির বিষয় হচ্ছে কবির আত্মমুখ্য জীবন। কারণ কবি আপন মনের মাধুরী বা স্বপ্নলোকের মাধুর্য দিয়ে কাব্য সৃষ্টি করেন, এই অবাধ কল্পনার রাজত্বেই এদের বিচরণ। কবিকে এখানে আত্মনির্লিপ্ত থাকতে হয় না। কবি এখানে যতখানি আত্মনিষ্ঠ ততখানি সার্থক। ক্লাসিক্যাল রীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজ জীবনের একটি সুমহান চিত্রকে পূর্ণাঙ্গ রূপদান করা যার মধ্য দিয়ে পাঠক সমাজ জীবন সম্বন্ধে একটি সামগ্রিক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। আর রোমান্টিক রীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের টুকরো টুকরো কথাকে ব্যক্তিগত অনুভূতির রঙে রঞ্জিত করে প্রকাশ করা। Romanticism can be defined only in terms of pure psychology, any other formula alters or limits arbitrarily its very essence.
ঐতিহাসিক পটভূমি
ফরাসী বিপ্লব
The storm centre of the political unrest was the French Revolution. অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ১৭৮১ সালে ফরাসী বিপ্লবের ফলে যে নবমন্ত্রের বাণী বিঘোষিত হল, মানবতার যে নব মূল্যায়ন রচিত হল, ইউরোপের জনগণ মানসে বন্ধন মুক্তির যে বিপুল বিস্ফোরণ ঘটল, তার ফলে ইউরোপীয় সমাজ ও জীবনে এক ক্রান্তিকারী যুগান্তর ঘটে গেল। ফরাসী বিপ্লবের আদর্শবাদ সেদিন ইউরোপের আদর্শ, সেই আদর্শের মায়াঞ্জন সমগ্র ইউরোপের আঁখিতে, সমগ্র ইউরোপের মর্মমূলে যে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করল তাতে পুরাতন যুগের অবসান ঘটে গেল এবং নতুন যুগের প্রভাত সূর্যালোকের গরিমা উজ্জ্বলতর হল।
প্রথমতঃ এই যুগে প্রচলিত রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপুল বিস্ফোরণ ঘটল, মানব চেতনায় এতদিন পর্যন্ত রাজমহিমা সম্বন্ধে যে ধারণা বদ্ধমূল ছিল সেই হীন চেতনার ভিত্তিভূমি নবজাগ্রত চেতনার প্রচণ্ড আঘাতে কেঁপে উঠল। এতদিন পর্যন্ত মানুষ রাজাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি ভেবে পূজা করেছে, ভয়ে ভক্তি করেছে এবং তার শাসনকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলেই গ্রহণ করেছে। কিন্তু রাজার সেই অলৌকিক মহিমাকে আর মানুষ স্বীকার করল না, কোন মূল্য দিল না। রাজমহিমার দুর্গতোরণ ধূলিতলে বিলীন হয়ে গেল, জীর্ণ চীরবাসের মত পরিত্যক্ত হল, আর তারই ভগ্ন ভিত্তিমূলে রচিত হল নব প্রজাতন্ত্র। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণতন্ত্রের এই নব অভ্যুত্থানে সমাজের বঞ্চিত, অবহেলিত, উপেক্ষিত এবং নির্যাতিত মানবের অধিকার সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হল। রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে নতুন যুগের নব অভ্যুদয় গণতন্ত্রের পাদপীঠ রচনা করল। মানব অভ্যুদয়ের মন্ত্রধ্বনি সমগ্র ইউরোপের আকাশে-বাতাসে মন্দ্রিত হল, সাম্য-মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণী দিক-দিগন্তে ধ্বনিত হল, মানব হৃদয়তন্ত্রে রণিত হল। The Social contract was an attempt to construct politics on the basis of the principal that everyman has equal and inalienable rights.
মানব-মৈত্রীর নতুন বাণীমন্ত্র সেদিন উচ্চারিত হল। ফরাসী বিপ্লবের ঋষি ও স্রষ্টা রুশো মানব মর্যাদার নতুন ভিত্তি স্থাপন করলেন-The worth and dignity of man and man. এতদিন পর্যন্ত মানুষ আপনার মর্যাদা ও স্বাধিকার সম্পর্কে আদৌ সচেতন ছিল না। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে মানুষের যে স্বতন্ত্র দাবী আছে একথা ফরাসী বিপ্লবের পূর্বে মানুষের চেতনায় ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করেনি। রুশোর জাগ্রত জীবনের আহ্বান সেদিন সমগ্র জাতিকে নতুন চেতনায় ভরিয়ে তুলল, রুশো বললেন, Man is born free but man is chained by the chain of custom. তাই সেদিন বেড়া ভাঙ্গার পালা শুরু হল। জীর্ণ অচলায়তনকে ভাঙ্গা মহাআনন্দে কল্লোলে কোলাহলে এক ধ্বনি জাগ্রত হল। অর্থাৎ-মানুষ আপন মর্যাদার স্বাদ উপলব্ধি করল এবং মানব মর্যাদার এক নতুন মূল্যবোধ সৃষ্টি করল। প্রত্যেক মানুষের সমান অধিকার সমাজে এবং রাষ্ট্রে স্বীকৃত হল।
অন্যদিকে মানুষ মানুষকে ভালবাসতে শিখল। মানুষ মানুষকে দেখল এক নতুন দৃষ্টিতে। এই নবজাগ্রত দৃষ্টির গভীরে জেগে উঠল মানবপ্রেম, দীপ্যমান হয়ে উঠল বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ। মানুষে মানুষে ঘৃণা নয়, বিদ্বেষ নয়, এক বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ ও মৈত্রীর বন্ধন গড়ে তোলাই হবে মানবের একমাত্র কাম্য। ফলে নবতন মানব মৈত্রীর দ্বার উন্মোচন হল। এই নবতন মানবমৈত্রীর পাদপীঠ রচিত হল ফরাসী বিপ্লবের রক্তাক্ত দিনের আলোকে, বন্ধন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হল গণতন্ত্রের
ভিত্তিভূমিতে। এই যুগের মানব মর্যাদা মানবের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা ও মানবপ্রেম গণতান্ত্রিক চেতনার আলোকে সমুজ্জ্বল হল।
সুতরাং ফরাসী বিপ্লব সাম্য মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণীকে বিশ্বময় ব্যাপত করে দিল ছড়িয়ে দিল মানব মনের গভীরে। পৃথিবীর অন্ধকার যুগের অবসান ঘটিয়ে নতুন সভ্যতার সূর্যালোক বহন করে আনল।
শিল্পবিপ্লব
এই যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল শিল্প বিপ্লব। এতদিন পর্যন্ত মানব সভ্যতা একটা বিশেষ ব্যবস্থার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সেই বিশেষ ব্যবস্থাটি হল সামন্ততান্তিক কৃষিব্যবস্থা। সমাজ ও রাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষ ছিল কৃষিজীবী, ফলে কৃষি উৎপাদনই ছিল প্রধান বিষয়। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে মানব চেতনায় জাগ্রত হল বিজ্ঞান চেতনা। আর এই বিজ্ঞান চেতনাই মানুষকে করল চঞ্চল মুখর, সুরু হল বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। নব নব আবিষ্কারের ফলে গ্রামীন কৃষি সভ্যতার পরিবর্তে শহরকেন্দ্রিক যন্ত্রসভ্যতার আবির্ভাব ঘটল। পূর্বে যেখানে ছিল শুধু ঘন জঙ্গল, শ্যাম অরন্যানী, সবুজ শস্য ক্ষেত শুষ্ক মরুপ্রান্তর সেখানে বিশাল বিশাল কল আর কারখানা গড়ে উঠল, চিমনির কালো ধোঁয়ায় আকাশের রং গেল বদলে, কারখানার ভেঁপুর শব্দে গ্রামের নীরবতা হল ভগ্ন। নগরালী সভ্যতার দীপ্তিতে মানুষ হল বিস্মিত। নির্যাতিত কৃষক গ্রাম ছেড়ে হল শ্রমিক। নতুন যন্ত্রসভ্যতার যুগ শুরু হল। যে সভ্যতার দুটি প্রধান স্তম্ভ হল ধনিক ও শ্রমিক। শিল্পবিপ্লব যেমন রাজনৈতিক জীবনে পরিবর্তন এনেছে তেমনি পরিবর্তন এনেছে সমাজ জীবনে ও অর্থনৈতিক জীবনে। সমাজ জীবনে যেমন রাজনৈতিক জীবনে পরিবর্তন তেমনি পরিবর্তন এনেছে সমাজ জীবনে ও অর্থনৈতিক জীবনে। সমাজ জীবনে যেমন একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে পড়ল, গড়ে উঠল আত্মসর্বস্ব ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ। তেমনি অর্থনৈতিক জীবনেও কৃষি-অর্থনীতি রূপান্তরিত হল ধনতান্ত্রিক-অর্থনীতিতে।
এ্যাডাম স্মিথের Wealth of nations এবং টম পেইনের Rights of man গ্রন্থের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। স্কটল্যাগুনিবাসী স্মিথ প্রথমে ঘোষণা করলেন যে, জাতীয় সম্পদ গড়ে ওঠার প্রধান কারণ হল শ্রমিক। শ্রমিকশ্রেণীর মর্যাদা এবং ন্যায্য অধিকার সম্বন্ধে তিনি জাতিকে সতর্ক করে দিলেন এবং নতুন অর্থনীতির নব মূল্যায়ন রচনা করলেন।
অন্যদিকে ১৭৯১ সালে টম পেইনের Rights of man প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জনগণমানসে এক বিপুল আলোড়ন দেখা দিল। ঘৃণিত দাসত্বপ্রথার বিরুদ্ধে তিনি গর্জে উঠলেন। ফলে দাসত্বপ্রথার বিরুদ্ধে জাগ্রত জনমত সৃষ্টি হল। পরাধীন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এই গ্রন্থটির দাম অপরিসীম।
শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে বিজ্ঞানের যে বিজয়-বৈজয়ন্ত্রী উড্ডীন হল তাতে মানবের দৃষ্টিকে করল সুদূরের পিয়াসী। জানার অসীম আগ্রহ নিয়ে আকাশ ও সমুদ্রের কিনারা খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল মানুষ। মানবচিত্তলোকে ধ্বনিত হল সেই অতৃপ্ত কামনার বাণী: for my purpose holds to sail beyond the sun set. নব নব দেশ আবিষ্কারের জন্যে সমুদ্রবক্ষে তরণী ভাসল। কলম্বাস আবিষ্কার করল আমেরিকা। ভাস্কো-ডা-গামা আবিষ্কার করল ভারতবর্ষ। পৃথিবীর পরিধি গেল বেড়ে। ব্যবসা-বাণিজ্যে যে বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিল তাতে এই বিশাল পৃথিবীর সম্পদকে করায়ত্ত করার প্রতিযোগিতা শুরু হল, বিজ্ঞান হল তার বাহন।
শিল্পবিপ্লব এবং বিজ্ঞানচেতনার ফলে ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষিত হল, এতদিন পর্যন্ত মানবচেতনা ধর্মীয় কুসংস্কারের আবিলতায় আবিষ্ট হয়েছিল। ধর্মযাজক আর পুরোহিতদের প্ররোচনায় মানববুদ্ধি সংস্কারের জীর্ণ দেব-দেউল আর গীর্জার মধ্যে বন্দী হয়েছিল। সেই কুসংস্কারের গণ্ডি আর রুদ্ধ কারার দ্বার ভেঙ্গে মানববুদ্ধি মুক্তধারার মত প্লাবিত হল। অর্থাৎ বিজ্ঞানচেতনা মানববুদ্ধিকে মুক্তি দিয়ে সৃষ্টির পথ উন্মুক্ত করল। ধর্মযাজক আর পুরোহিতদের শাসনের যুগ হল পরিবর্তিত। মানুষ স্পষ্টতঃ উপলব্ধি করল ধর্মযাজক আর পুরোহিতদের অন্তঃসার শূন্য অলৌকিক কার্যকলাপের স্বরূপকে। তাই অলৌকিক ধ্যান-ধারণাকে জীর্ণবস্ত্রের মত ত্যাগ করল মানুষ। আর অন্ধের মত অনুসরণ নয়। বিজ্ঞানদৃষ্টির আলোকে যাচাই করে সত্যকে অনুসরণ করতে হবে। এই আত্মপ্রত্যয়ের রাঙ্গা মশাল হাতে নিয়ে মানুষ গর্জে উঠল তথাকথিত ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। কারণ এই ধর্মই মানুষের চলার পথকে রুদ্ধ করেছিল এবং মানব বুদ্ধির বিকাশের পথে বাধার হিমাচল হয়ে দাঁড়িয়েছিল, এই বিদ্রোহের ফলে ধর্মকে পরবর্তীকালে যুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করার অর্থ Nationalised করার একটা প্রচেষ্টাও দেখা দিল।
অপরদিকে christianity condemned and strove to repress the Ideal of Personal prowess and honour, the Ideal of passionate love and devoted service, not of good but of a woman. ব্যক্তিগত আবেগ, ক্ষমতা এবং সম্মান ও ভালবাসা ধর্মের কাছে ছিল অপরাধ, অহংবোধ ছিল দূষনীয়। নারীর প্রতি প্রেমও ছিল ধর্মের কাছে নিন্দনীয়। শিল্পবিপ্লব এবং বিজ্ঞানচেতনা জনগণ মানসে যে নতুন বাণী বহন করে আনল। সেই চেতনার আলোকে চার্চের ক্ষয়িষ্ণু ক্ষমতাকে অস্বীকার করে মানুষ তার ব্যক্তিসত্তার জয় ঘোষণা করল। So far Romanticism appears as an expansion of the Revoloutionary individualism of Rousseau, ব্যক্তিসত্তার অভিব্যক্তির মধ্যে নিহিত হয়েছে ধর্মীয় কুসংস্কারকে বর্জন করার মনোবৃত্তি। আর এই মনোবৃত্তির উদ্ধত প্রকাশ ঘটেছে Auccasion এর কণ্ঠে। “In paradise what I have I do win? There in I seek no eter but only to have Nicolette, my sweet lady that I have so well” সুতরাং বিজ্ঞানচেতনা মানুষকে শিখিয়েছে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে, নরনারীর প্রেমকে দিয়েছে অনেক বেশি মূল্য, শিল্প-বিপ্লব মানব মহিমার জয়গান করেছে, শিখিয়েছে ঈশ্বরীয় চেতনার নব মূল্যায়ন করতে।
জাতীয় মুক্তি আন্দোলন
পরদেশ বা পরজাতির কাছে আত্মসমর্পণ নয়। অধীনতা স্বীকার নয়, স্বাধীন দেশের নাগরিক এবং স্বাধীন মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার এক প্রচণ্ড আবেগ এই যুগেই ধ্বনিত হল। Nationalism বা জাতীয়তাবোধের উন্মেষ, বিকাশ ও পরিণতি এই যুগেই ঘটল। ইতিপূর্বে জাতীয়তাবোধের স্বরূপ সম্বন্ধে মানুষের কোন ধ্যান-ধারণাই ছিল না। গণতান্ত্রিক চেতনার প্রসারই মানুষকে স্বাধীন তথা জাতিকে স্বাধীন করার স্বপ্নে উদ্বোধিত করল। Liberty-র স্বপ্নই হল এ যুগের স্বপ্ন। ১৭৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম জগৎ জুড়ে একটি, ক্রান্তিকারী অধ্যায়ের সৃষ্টি করল। ১৭৮৩ সালের নভেম্বর মাসে কুয়াশাবৃত এক সকালে লর্ডসদের সভায় প্রবেশ করে কিং জর্জ কম্পিত স্বরে ঘোষণা করল আমেরিকার স্বাধীনতার স্বীকৃতি, আমেরিকা স্বাধীন দেশে পরিণত হল।
আমেরিকার অধিবাসী স্বাধীন নাগরিক হিসাবে আত্মপ্রতিষ্ঠিত হল। পৃথিবীর দেশে দেশে এই স্বাধীনতার বাণী বজ্রবিদ্যুতের মত ঘোষিত হল। সারা পৃথিবীর সুপ্ত আত্মা স্বাধীনতার নবমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে চঞ্চলতায় ভরে উঠল। স্বদেশ স্ব-ধর্ম এবং স্ব-সমাজের প্রতি মানুষের একটা সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধার নিবিড় অনুভূতি জেগে উঠল। স্বদেশের প্রতি একান্ত অনুরাগ, স্বাজাত্যবোধ এবং
স্বাজাত্যাভিমান যুগ চেতনার রঙে রঙ্গিন হয়ে উঠল। ইংলণ্ড দীর্ঘদিন ধরে যে গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখছিল সেই গণতন্ত্রের প্রথম পরীক্ষায় সিদ্ধিলাভ করল আমেরিকাকে স্বাধীনতা দান করে। ফরাসী দেশের বিপ্লবের শিক্ষা সেই গণতন্ত্রকে আরো বেশি করে উজ্জ্বল করল। ইংলণ্ড বিপ্লবের বিরোধী, তাই শান্তিপূর্ণ উপায়ে গণতন্ত্রের সার্থক রূপদান করল। নেপোলিয়নের পতনের পর অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে গণতন্ত্রের ভিত্তিভূমিকে মজবুত ও সুদৃঢ় করা হল। যাই হোক, মুক্তি সংগ্রামের উদ্বোধনই হল এ যুগের জাতীয় আকাঙ্খা, গণতন্ত্র হল জাতির স্বপ্ন ও সাধনা। জাতীয়তাবোধই পুরাতন অতীতকে খাঁটি সোনার ঔজ্জ্বল্যে প্রতিষ্ঠা করার বেগবান প্রভাব সৃষ্টি করেছিল। সুদূর অতীত স্বাজাত্যবোধের সোনার কাঠির স্পর্শে এক নতুন জীবন লাভ করল। National Sentiment of this type was a direct Stimulus to the study of the national past, and it was one of the sources of the romantic revival of history কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক প্রভৃতি প্রতিটি স্তরের মানুষই অতীত চারণা শুরু করলেন। অতীতের বিপুল সম্ভারকে উদ্ধার করে তার গৌরব ও মহিমাকে পুনরুদ্ধার করার প্রচেষ্টা এই যুগে লক্ষ্য করা যায়। জার্মানী ও ফরাসীতে ইতিহাস রচনার এক বেগবান প্রচেষ্টা এই যুগে লক্ষ্য করা যায়। জাতির ইতিহাস রচনার মধ্যে রয়েছে স্বাজাত্যবোধের প্রেরণা। শুধু ঐতিহাসিক নয়, কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকারও কল্পনার ডানায় ভর করে সুদূর অতীতে পাড়ি জমালেন। শুধু অতীত নয়, স্বদেশ প্রেমেরও কাব্য রচনা করলেন তাঁরা। মনে রাখতে হবে অতীত চারণা রোমান্টিকতা একটি লক্ষণ।
ফরাসী বিপ্লব ও ইংলণ্ড
এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে ফরাসী রিপ্লব সারা পৃথিবীতে যে আলোড়ন তুলেছিল তা থেকে ইংলণ্ড আদৌ মুক্ত থাকেনি। বরং ইংলণ্ডকে বেশী চঞ্চল করে তুলেছিল। কেন, কি কারণে ইংলণ্ডকে চঞ্চল করে তুলেছিল?
প্রথমতঃ ফরাসী বিপ্লব ফরাসী দেশের রাষ্ট্রিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল। সেখানকার রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্র ধ্বসে পড়েছিল, মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া শ্রেণী দখল করেছিল ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা দখলে রাখার জন্য ক্যাষ্টিটুয়েন্ট এসেম্বলীয় মারফৎ সংসদীয় আইন প্রবর্তন করা হয়েছিল। ইংলণ্ডেও কি এই ধরনের পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়েছিল। যাঁরা রক্ষণশীল চিন্তানায়ক তাঁরা ফ্রান্স ধরনের বিপ্লব ও পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করেননি। কারণ তাঁরা মনে করেছিলেন, ফ্রান্সে যা ঘটেছে তা ইতিপূর্বে ১৬৮৮ সালে ইংলণ্ডে ঘটে গেছে। অর্থাৎ রক্তপাতহীন গৌরবজনক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পার্লামেন্টের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং রাজতন্ত্র হয়েছে পরাভূত। সুতরাং মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া ব্যবসায়ী শ্রেণীর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাষ্ট্রে। রাজার হাতে কোন ক্ষমতা রইল না, সে হল পার্লামেন্টের অধীন এবং প্রথম শ্রেণীর নাগরিক মাত্র।
অতএব ফ্রান্স নতুন কিছু করেনি। তার বরং শিক্ষাগ্রহণ করা উচিত ইংলণ্ডের কাছ থেকে। রক্ষণশীল দলের নেতা এণ্ডমণ্ড বার্ক ঘোষণা করেছিলেন যে ফরাসী বিপ্লব একটা নৈরাজ্যবাদী বিপ্লব ছাড়া আর কিছু নয়। তাঁর এই বক্তব্য অনেক চিন্তাশীল মানুষকে প্রভাবিত করেছিল এবং সত্যে পরিণত হয়েছিল পরবর্তীকালে।
অন্যদিকে হুইগ দলের অন্যতম নেতা ফক্স ঘোষণা করেছিলেন, “এটাই হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ঘটনা, “যা অভিনন্দন যোগ্য। জেমস ম্যাকিনটস, টমাস পেন প্রভৃতি চিন্তানায়কেরা ফরাসী বিপ্লবকে সমর্থন জানালেন। গডউইন মানব অধিকারের সপক্ষে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের জয় ঘোষণা করলেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরীজ সমর্থন জানালেন। কিন্তু ঘটনার গতি যেভাবে মোড় নিল তাতে ফরাসী
বিপ্লবের প্রতি অনুরাগ-বিরাগে পরিণত হতে বেশি সময় লাগেনি। বিপ্লবের প্রতি বিরাগ জন্মালেও বিপ্লব-মন্ত্রে ঋষি ও উদ্গাতাদের প্রতি কোন বিরাগ জন্মায়নি গণতন্ত্রপ্রিয়, মানব অধিকারের মন্ত্রে দীক্ষিত তরুণ রাজনীতিবিদ ও কবি সাহিত্যকদের মনে। সাহিত্যিকদের ভাবনার ভিত্তিমূলে ফরাসী দার্শনিকরা প্রবলভাবে নাড়া দিলেও ইংলণ্ডের জনগণমানসে তার কোন প্রতিফলন ঘটেনি। বরং নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে সমস্ত জাতি ঐক্যের এক সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
যাঁরা ফরাসী বিপ্লবের সমর্থক ছিলেন তাঁরা জাতীয় ঐক্যকে বজায় রেখে মানব অধিকারের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। রুশোর বজ্রবাণী, “Man was born free, yet everywhere he is in chains” সেদিন ইংলণ্ডের উদারদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। মানুষে-মানুষে মান-মর্যাদা গড়ে তোলার স্বপ্নকে উদ্বোধিত করেছিল। অন্যদিকে ভলতেয়ার, দিদ্যেরা, মঁটেকু প্রভৃতি মনীষীদের যুক্তিবাদী সমাজবিজ্ঞান অনেকের মনে দাগ কেটেছিল। ভলটেয়ারের সেই অগ্নিগর্ভগর্জন, “Destroy the old edifice of deception” “ভেঙ্গে ফেল সেই পুরাতন প্রতারণার প্রাসাদ” অথবা “crush that imfamous thing” “চূর্ণ কর সেই ঘৃণ্য বস্তুগুলিকে”, সেদিন সমস্তরকম বন্ধনের বিরুদ্ধে। ইংলণ্ডের ভাবুক কবিদের মনে আর দেহের শিরায় শিরায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল।
তাঁরা চেয়েছিলেন, এই আগুনের লেলিহান শিখায় সমাজের যা কিছু জীর্ণ পুরাতন, যা কিছু ধূলি মলিন, অমর্যাদাকর এবং অবমাননাকর সব কিছু পুড়িয়ে, ভগ্ন করে তারি উপর নতুন সমাজ গড়ে তুলতে হবে। কেন, ইংলণ্ডের সমাজ কি আদর্শ সমাজ ছিল না। নিশ্চয় ছিল না। যদি থাকত তাহলে ওয়ার্ডসওয়ার্থকে বলতে হত না যে ইংলণ্ড একটা পচা নর্দমা।
যদিও ইংলণ্ডে যন্ত্রযুগের অগ্রগতি ছিল অব্যাহত। কল-কারখানার চিমনির ধোঁয়া সেদিন আকাশকে কালো করছে, টেমস নদীর জলকে করছে বিষাক্ত, বাতাসকে তুলছে ঘুলিয়ে, ইট, কাঠ, পাথরের বাড়ীগুলির মধ্যে মানুষ কীটগুলির নিঃশ্বাস অবরুদ্ধ, পথে চলতে শুরু করেছে ইঞ্জিনওয়ালা গাড়ী, তবু মানুষের সঙ্গে মানুষের মৈত্রীর অভাব ছিল প্রকট, একশ্রেণীর মানুষদের প্রতি সবল মানুষের ছিল কঠিন অবজ্ঞা ও অত্যাচার। মজুরের জীবন সেদিন ছিল পশুর জীবনের মত।
তাই সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে ওয়ার্ডসওয়ার্থের মত কবির, সাম্যের গান গাইতে চেয়েছেন শেলীর মত কবি এবং কৃত্রিম মানবপ্রেমকে ব্যঙ্গ করতে চেয়েছেন বায়রণ।
আসলে ফরাসী বিপ্লবের মন্ত্রধ্বনি সেদিন ইংলণ্ডের মানব-প্রেমিক মানুষদের মনে মানব অধিকার, নতুন সাম্যবাদী সমাজ, মানব মর্যাদা ও মানব-মৈত্রীর স্বপ্নকে জাগিয়ে তুলেছিল।
বিষ্ময় রসের পুনুরুদ্ধোন
রোমান্টিকতার সংজ্ঞা ও স্বরূপ নির্ণয় করতে গিয়ে থিওডোর ওয়াটস্ ডাল্টনের মতে, রোমান্টিকতা হল বিস্ময়রসের উদ্বোধন। বিশ্বজগৎ সম্বন্ধে বিস্ময়বোধ জীবন-জিজ্ঞাসার মতই হল মানুষের প্রকৃতিগত। জগৎ সম্পর্কে মানুষের মনের মধ্যে রয়েছে অপার বিস্ময়। এই অপার রহস্যের সমুদ্রতীরে বসে মানুষের নির্বাক মনের জিজ্ঞাসাই হল বিস্ময়রস। শেলীর ভাষায়: Oh! What is life?
মানব মনে এই বিশ্বয় রসের উদ্বোধনের প্রধান কারণ হল আধুনিক সভ্যতা। যে সভ্যতার মর্মকথা হল বিজ্ঞান। অর্থাৎ প্রকৃতির জড় রাজত্বের আবরণ উন্মোচন করে নিত্য নতুন রহস্যোর উদঘাটন করা। বিজ্ঞানচেতনাই মানুষের মনকে বিশ্বয়রসে উদ্বোধিত করেছে। মানুষ আপনার
কৃতিত্বে তাই বিস্ময় বিমুগ্ধ। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের ফলে মানুষের চেতনায় লেগেছে চমক, মনে লেগেছে শিহরণ, দেহে জেগেছে চাঞ্চল্য, আঁখিতে ফুটে উঠেছে বিস্ময়ের সীমাহীন ছায়া। রোমান্টিকতার বিশ্বয় বিজ্ঞানের ডানায় ভর করে সুদূরের পিয়াসী বা সুদূরের যাত্রী। এই অর্থে অজানাকে জানাই হচ্ছে বিজ্ঞানের ধর্ম। বিজ্ঞানের এই ধর্মকে বলা যায় Nostalgia. The essence of nostalgia is the desire for the unknown অজানা রহস্যের প্রতি বিজ্ঞানের একান্ত মোহ। তাই বিজ্ঞানের দৃষ্টি পৃথিবীর বিপুল রহস্যের প্রতি নিবন্ধ। পৃথিবীর অভ্যন্তরে পাতালপুরীর অন্তরলোকে, পৃথিবী ছাড়িয়ে দূর নক্ষত্র লোকে আর রহস্যাবৃত মহাকাশের আনন্দলোকে, নিবদ্ধ অতীতের অনাবিষ্কৃত ধ্বংসস্তূপের উদ্ধারকর্মে, নিবদ্ধ অতলান্ত সমুদ্রের অন্তঃস্থলের রহস্যের আবিষ্কারে। এমনি করেই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি প্রসারিত হয়েছে সমাজ, রাষ্ট্র এবং মানব জীবন ও জীবনের আচার-আচরণের প্রতি। সুতরাং এই বিস্ময়রসের মূলে রয়েছে বিজ্ঞান আর গণতান্ত্রিক চেতনা, বিস্ময়রসের আকণ্ঠ পিপাসা নিয়ে আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞান চলেছে অপ্রতিহত গতিতে, উদ্দেশ্যের স্থির লক্ষ্যে। অন্যদিকে কবি এবং সাহিত্যিকের অন্তর্লোকে যে বিশ্বয় রসের উদ্বোধন হল সেই বিস্ময়বোধ কবির আঁখিতে মায়াঞ্জন হয়ে চিরন্তন হল। কবির কাছে জগৎ ও জীবন বিস্ময়ের বস্তু। কিন্তু কবি জগৎ ও জীবনের অপার রহস্যের স্বরূপ উদঘাটন করতে চান না। কারণ স্বরূপ উদঘাটন করলে তার রহস্যাবরণ খসে পড়ে, ফলে তার মধ্যে কোন charm বা যাদু থাকে না। রহস্য যদি রহস্যের আবরণে মণ্ডিত থাকে তাহলে বিস্ময়বোধও-চিরন্তন হয়ে থাকবে। তাই অশ্রুত সঙ্গীত, অজানা নক্ষত্রলোক, মনুষ্য পদচিহ্নহীন বনভূমি, এমন-কি রহস্যমণ্ডিত মানব জীবন কবির কাছে বিস্ময়ের বস্তু। কবিও অজানাকে জানতে চান। জানার তীব্র আর্তি নিয়ে কবি যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু জানতে পারেন না বলেই কবির জীবন জিজ্ঞাসার বিস্ময়বোধের ফ্রেমে আটকা পড়ে যায়’। আগেই বলেছি, অজানাকে জানার আগ্রহই হল Nostalgia. অজানার পরিচয় আবিষ্কার করতে পারে না বলেই কবির হৃদয় বেদনায় ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত। তাই কবির কাছে এই বিশ্বজগতের সমস্ত কিছু-ই অদ্ভুত এবং বিস্ময় বিজড়িত।
সুতরাং কবি এই অদ্ভুত আর বিস্ময়রসের আদিম দৃষ্টিতে দেখেছেন জগৎ ও জীবনকে। ফলে পরকে করেছেন আপন, দূরকে করেছেন নিকট, পরিচিতি বস্তুর মধ্যেও দেখেছেন অপরিচিতের ছায়া। আবার অতি তুচ্ছ সাধারণ বস্তুর মধ্যেও উপলব্ধি করেছেন অসাধারণ মহিমা। এই বিস্ময়রসের বোধন ঘটেছে প্রকৃতির অপার রহস্যের মধ্যে। এই প্রকৃতির ফল-হাওয়া-জল-তৃণ-মরু-প্রান্তর-পর্বত-অরণ্য আর নদী-নির্ঝরের মধ্যে কান পেতে শুনেছেন কবি তার রহস্যাবৃত বাণী। দুই চোখে সীমাহীন বিস্ময় নিয়ে দেখেছেন তার অপরূপ অনির্বচনীয় সৌন্দর্য। তাই প্রকৃতি কবির কাছে খেলার সঙ্গিনী, কখনও মর্মের গৃহিণী, কখনও জীবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বা প্রেরণাদাত্রী, কখনও বা শিক্ষয়িত্রী। প্রকৃতি রহস্যময়ী বিশেষ করে মনুষ্য প্রভাবহীন প্রকৃতি কবির কাছে আরও বিস্ময়ের বস্তু। শহর থেকে দূরে যে প্রকৃতির গভীরে আজও মানুষের পদচিহ্ন পড়েনি, যে গভীর অরণা-প্রকৃতি কবি মনকে যাদুমন্ত্রে আবিষ্ট করে দেয় সেই প্রকৃতি কবির বিস্ময় বিমুগ্ধ আঁখিতে পরিয়ে দেয় মায়াকাজল। তাই প্রকৃতির রাজত্ব এক বিস্ময়ের রাজ্য, কি মনুষ্য পদচিহ্নহীন গভীর অরণ্যানী, কি দক্ষিণ মেরুর উর্দ্ধে নিঃসঙ্গ তারকা, কি মেরুলোকের অপরিচিত জীবন কাহিনী।
শুধু প্রকৃতির নয়, মানুষকেও কবি দেখেছেন এক বিশ্বয় ভরা দৃষ্টিতে। বিশ্বয় ভাবের কচি সোনার আলোকে মানুষ এক অনিবচনীয় সৌন্দর্যে ভরে উঠেছে। চাষী, পশুপালক, কাঠুরিয়া, ভবঘুরে এমন কি আদিম যুগের বর্বর মানুষকেও কবি আদিম বিশ্বয় ভরা নগ্ন সুকুমার দৃষ্টিতে দেখেছেন। এই মানুষগুলিও প্রকৃতির মতই জীবন্ত বিগ্রহরূপে প্রতিভাত হয়েছে। অতি তুচ্ছ নগণ্য মানুষও কবির বিস্মিত দৃষ্টিতে হয়ে উঠেছে অসামান্য।
এমনি এক বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে কবি মানব শিশুকে দেখেছেন। মানব শিশুর মনোরাজ্যের গভীরে প্রবেশ করে কবি বিস্মিত নয়নে দেখেছেন ঐশী লীলার মহিমা। রোমান্টিকতার বিরোধ প্রৌঢ়তার সঙ্গে, পরিণত বাস্তববুদ্ধির সঙ্গে, কল্পনাশূন্য ব্যবহারিক জ্ঞানের সঙ্গে। তাই রোমান্টিক কবি পূর্ণবয়স্ক মানবকে নয়, শিশুকেই স্বর্গ রাজ্যের আদিমতম অধিবাসী বলে কল্পনা করেছেন। কারণ শিশুই হল সব পেয়েছির দেশের অধিবাসী। কবি শিশুর মধ্যে কেবল মাত্র বিশ্বরূপের ছায়াই দেখেননি, দেখেছেন, “শিশুর পিতা ঘুমিয়ে আছে সব শিশুরই অন্তরে।” দেখেছেন শিশুকে মানবশক্তির মায়াময় রাজত্বরূপে।
কবি হৃদয়ের বিস্ময়বোধের উদ্বোধন হল অপার্থিব রূপকথার রাজত্বের স্বপ্নলোকে। এ রাজত্ব অতিপ্রাকৃতের রাজত্ব। এই অপার্থিব রাজত্ব পার্থিব জগতের ধুলি অঙ্গে লেপন করে অপ্রাকৃত-সৌন্দর্যে ভরে উঠল। ইন্দ্রজাল, যাদুবিদ্যা, ডাকিনী-তন্ত্র, ভৌতিক এমন কি অলৌকিক কাহিনীও কবি মনকে অদ্ভুত রসের আনন্দে বিচলিত ও বিমুগ্ধ করেছিল। কবির বিস্ময় উদ্বোধন ও অজানাকে জানার জন্য সেই অজানাকে হল অতীত-মধ্যযুগ। The longing for the Middle age is merely a very frequent form of Nostalgia. মধ্যযুগের জীবনযাত্রা, শিভালরি, প্রেম, দুঃসাহসিক অভিযান, বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম এই সমস্ত বিশেষত্বই রোমান্টিক যুগের কবিদের পক্ষে বিশ্বয়রসের পুনরুদ্বোধনের উৎস ছিল। প্রাচীন গ্রীক সৌন্দর্যপ্রিয়তা অতীতে প্রত্যাবর্তনের একটা বিশেষ দিক। এই সুদূর অতীত আপনার ঐশ্বর্য এবং প্রাণ প্রাচুর্যের বিপুল গরিমা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। কবির বিস্ময়রসে রঞ্জিত হয়ে বর্ণালী আর বর্ণাঢ্যতায় অতীত রঙ্গীন হয়ে উঠেছে।
বিশ্বয়রসের উদ্বোধনের উৎস হল প্রেম। যে প্রেম চিরজনমের কামনার আর্তি নিয়ে প্রেয়সী নারীর নয়ন অধরে অনাস্বাদিত সৌন্দর্যের আস্বাদে ভরে উঠেছে। তাই প্রেম কেবল মাত্র দেহসর্বস্ব নয়। দেহাতীত অপার্থিব কামনার আগুনে সমুজ্জ্বল। যে প্রেম কাম কলুষতা থেকে মুক্ত, যে প্রেম মানুষকে দিয়েছে কল্যাণে দীক্ষা, সুখে-দুঃখে বেদনায় বন্ধুর যে পথ সেই দুর্গম পথে যে প্রেমের অভিসার সেই প্রেমকেই কবি বিস্ময় বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেছেন।
“সেই সত্য যা রচিবে তুমি”-কবির অন্তরের উপলব্ধি সত্যই হচ্ছে কবির কাছে একমাত্র সত্য। কবির কাছে বাইরের জগতের সত্য হচ্ছে তটভূমি। অন্তর জগতের সত্য হচ্ছে সমৃদ্ধ। কবি বিশ্বয়রসের সমুদ্রে আত্মহারা, কবির অন্তরের সমুদ্র সফেন। এই সমুদ্রের গভীর অন্তঃস্থল থেকে যে সত্য আবিষ্কৃত হয় কবির কাছে সেই সত্যই একমাত্র সত্য, অর্থাৎ কবির মনোভূমি কাব্যসত্যের জন্মভূমি। বহির্মুখিন বাস্তববুদ্ধির চেয়ে অন্তর্মুখিনতাই এখানে মুখ্য। কারণ বাইরের জগৎ কবির কাছে অত্যন্ত স্কুল বলেই মনে হয়। এই পৃথিবীর নিরেট স্থল বাস্তব সত্যের প্রতি কবির কোন মোহ নেই। স্থূল বাস্তবসত্য কবিকে কোন প্রেরণাই দেয় না। রোমান্টিক কবির কাছে বাস্তব জগৎ হল মৃত মানুষের কংকাল। আপন অন্তরের কথাকে একান্তভাবে প্রকাশ করতে চান কবি। তাই কবি হৃদয়ের জগৎ হচ্ছে কবির ভাবের জগৎ বা ভাবসত্যের জগৎ।
তবুও মনে রাখতে হবে যে কবির হৃদয় সঞ্জাত সত্য নিছক ব্যক্তিগত নয়। যা ব্যক্তিগত তা সাহিত্য নয়। কবির হৃদয়-সত্য হল ব্যক্তি নিরপেক্ষ শুভ্র নিরঞ্জন। কারণ ভাব, বিষয়, তত্ত্ব সাধারণের। সাধারণের সত্যকে নিজের মত করে অ-সাধারণ করে তোলাই হল কবির ধর্ম। সুতরাং দত্য কবি হৃদয়ের গভীর থেকে আত্মপ্রকাশ করলেও তা হয়ে ওঠে বিশ্বজনীন। রোমান্টিক কবি বিশ্বজনীনতার প্রতীক। কবির হৃদয়লোকে উদ্ভুত সত্যের সঙ্গে বাস্তবের পুরোপুরি মিল না
থাকলেও তা কল্পনার বরণে আদর্শায়িত এবং বৈচিত্র্যময়। কবির চিত্তই হল মুখ্য। তবুও কবি যখন বলেনঃ To strive, to seek, to find and not to yield তখন কবির ব্যক্তি-হৃদয়ের ব্যক্তিগত কথা না হয়ে বিশ্বজনীন হয়ে ওঠে। এখানে একটি যুগের বাণীই কবির হৃদয়ের উত্তাপে বিকীর্ণ। অথবা কবি যখন বলেন:
Where king first leagued against the rights of men, And priests first Traded with the name of God. তখন রাজা এবং পুরোহিততন্ত্রের প্রতি কবির অন্তরের এই ঘৃণা কেবল মাত্র কবির ব্যক্তিগত ঘৃণাকেই প্রকাশ করে না। একটি যুগের ধ্যান-ধারণাকেই প্রকাশ করে। সমাজের যেখানে অন্যায়, যেখানে অবিচার, যেখানে নির্দয় নিষ্ঠুরতার প্রকাশ দেখেছেন, কবি সেখানেই প্রতিবাদ করে গর্জে উঠেছেন,
For I will teach, if possible the stones
To rise against Earth’s tyrants.
কবি হৃদয়ের ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে কল্পনার প্রসারে। রোমান্টিক কবিও বস্তু রসের কারবারী। বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্যের সন্ধান করতে হলে কল্পনার সাহায্য ব্যতিরেকে তা সম্ভব নয়। সুতরাং সত্যের সঙ্গে কল্পনার কোন বিরোধ নেই। যে হেতু কল্পনা ব্যতিরেকে কবির কাব্য রচনা সম্ভব নয় তাই কবি আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে যে সত্যই রচনা করুন না কেন সেই সত্যের সঙ্গে মর্ত্যলোকের মাটির গন্ধ অবশ্যই থাকবে। বিস্ময়রসের মূল লক্ষণ কল্পনা, বেগের স্বচ্ছন্দ প্রকাশ। কল্পনার প্রকাশ ঘটে অতি তুচ্ছ জিনিসের মধ্যেও। এমন কি ঘরের দুয়ারের পাশে ধানের শীষের উপর যে শিশির বিন্দু কাঁপছে তার মধ্যেও বিস্ময়রসের কল্পনার বিলাস লক্ষ্য করা যায়।
মনে রাখতে হবে, কাব্যে অতিমাত্রায় কল্পনার অতিরেক ঘটলে কাব্য হয়ে উঠবে কাল্পনিক। সে কল্পনা স্বভাবতই রুগ্ন, জীর্ণ, অস্থিচর্মসার। কারণ জগৎ ও জীবনের বাস্তবতার ছায়াটুকুরও সেই কল্পনার মধ্যে দর্শন মেলে না। তাই সত্য ব্যতিরেকে কল্পনার যেমন অস্তিত্ব নেই তেমনি কল্পনার আতিশয্য হচ্ছে এক ধরনের জীবন বিমুখতা। দার্শনিকতাবিহীন ব্যক্তিগত ভাবনা। যাকে বলা পলায়নী বৃত্তি।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ
১৭৭০ সালে ৭ই এপ্রিল কাম্বারল্যান্ডের অন্তর্গত ককারমাউথে ওয়ার্ডসওয়ার্থ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ইংলণ্ডের উত্তরে হ্রদ অঞ্চলের কাছাকাছি ছিল ঐ শহরটা। বাবা জন ওয়ার্ডখওয়ার্থ ছিলেন আইনজীবী। উইলিয়মের বয়স যখন তের তখন তিনি মারা যান। উইলিয়ম মাকেও হারিয়েছিলেন শৈশবে। উইলিয়মেরা ভাইবোনে মিলে পাঁচজন। যা কিছু সামান্য অর্থ বাবা রেখে গিয়েছিলেন তাও যখন হাতে এলো না তখন ওয়ার্ডসওয়ার্থকে আত্মীয়-স্বজনের সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হল। স্কুলের খরচ জোগালেন তাঁরাই। উইণ্ডারমেয়ার হ্রদের নিকটবর্তী ইকস্ জেড স্কুল থেকে পড়া শেষ করে ওয়ার্ডসওয়ার্থ ১৭৮৭ সালে কেমব্রিজের অন্তর্গত সেন্টজন কলেজে ভর্তি হলেন। এখানকার জীবন গতানুগতিক। কোন বৈশিষ্ট্যের ছাপ তিনি রাখতে পারেন নি। ছাত্র হিসাবে অসাধারণ একটা কিছু ছিলেন না। ১৭৯০ সালে এক ছুটিতে ঘুরে এসেছিলেন সুইজারল্যাণ্ড আর ফ্রান্স। এ সময়ে ফরাসী দেশে বিপ্লবের ঝঞ্ঝা বায়ু বয়ে চলেছে তড়িৎ গতিতে।
ওয়ার্ডসওয়ার্থের যৌবন-চঞ্চল মনের পালে তার হাওয়া লেগে মাতাল হয়ে উঠল। তাই ১৭৯১ সালে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করে দীর্ঘ একটানা কর্মবিহীন জীবনের প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠে একসময় ফ্রান্সে চলে এলেন। উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লবী কাজকর্মে আত্মনিয়োগ করা। যৌবন ধর্মের প্রচণ্ড আবেগে রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে জড়িয়ে পড়লেন। বিপ্লবের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। এক বছর
পড়ে রইলেন অরলিয় আর ব্লইস-এ। একবছর পরে ফিরে এলেন প্যারিসে। সেটা ১৭৯২ সাল। সেদিন প্যারিসের পথে পথে চলেছে নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। হত্যার তাণ্ডবলীলায় প্যারিসের পথগুলি হয়ে উঠেছে রক্ত পিচ্ছিল। বিপ্লবের ধুমাগ্নিতে ভস্মীভূত হচ্ছে রাজতন্ত্রের সমর্থকেরা। প্যারিসের বুক জুড়ে এক শ্বাসরোধকারী অবস্থা। চমকে উঠলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ। মৃত্যুর হাত এড়াবার জন্য চরমপন্থীদের সঙ্গে সকল সংস্রব ত্যাগ করে মধ্যপন্থী জিরোত্তিষ্ট দলে যোগ দিলেন। ফলে চরমপন্থীরা তাঁকে দেখল সন্দেহের চোখে। একদিকে বাজরোষ অন্যদিকে চরমপন্থীদের সন্দেহ এই দুই সঙ্কটের মধ্যে পড়ে ওয়ার্ডসওয়ার্থ হলেন দিশেহারা। এ সময় আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে তাঁর অর্থ সাহায্যও বন্ধ হয়ে গেল। ওয়ার্ডসওয়ার্থ পড়লেন দুর্দিনের অকুল সমুদ্রে। বিপ্লবের অনুরাগ বাষ্প হয়ে মিলিয়ে গেল। পালিয়ে আসার পথ খুঁজতে লাগলেন তিনি। পালিয়ে এলেন যাঁর সাহায্যে সেই অ্যানিটি ভেলনকে ফেলে গেলেন ফ্রান্সে। কথা দিয়ে গেলেন তিনি ইংলণ্ডে ফিরে তাঁর প্রিয়া ও প্রিয়তমা কন্যাকে সেখানে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবেন। ইতিমধ্যে ইউরোপের রাজনৈতিক জীবনে দ্রুত পট পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। ১৭৯৩ সালে ফ্রান্সে বিপ্লবী প্রজাতন্ত্ররাজ প্রতিষ্ঠা হবার পর অস্ট্রিয়া প্রুশিয়ার সঙ্গে সংঘাত শুরু হল, শুরু হল যুদ্ধ। ইংলণ্ড ফরাসীদের বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে যোগদান করল। ১৮০৩ সালে সন্ধি স্থাপিত হলেও নেপোলিয়ন সেই সন্ধিভঙ্গ করে পুনরায় যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। ফলে অ্যানিটি ভেলনকে ফিরিয়ে আনার পথ রুদ্ধ হয়ে গেল।
একদিকে অ্যানিটিকে হারানোর বেদনা অন্যদিকে নেপোলিয়নের অভ্যুত্থানে ফরাসী বিপ্লবের সকরুণ পরিসমাপ্তি দেখে বিপ্লব সম্বন্ধে ওয়ার্ডসওয়ার্থের মোহভঙ্গ হল। বিপ্লবের আসল উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তাঁর সঠিক ও সুনির্দিষ্ট কোন ধারণা ছিল না। স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর মন্ত্র চঞ্চল যৌবনের আবেগ ও উচ্ছ্বাসের মধ্যে কোন পরিণত আকার নিতে পারেনি বলেই নেপোলিয়নের বিশ্বগ্রাসী রূপ দেখে তিনি সে পথ ও আদর্শ ত্যাগ করেছিলেন এবং এডমন্ড বার্কের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে তিনি ইংলণ্ডকেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কবল থেকে স্বাধীনতার রক্ষক রূপে গণ্য করেছিলেন।
যাই হোক ওয়ার্ডসওয়ার্থের জীবন এখন সব উচ্ছ্বাস ও সব আবেগের অবসান হয়ে শান্ত স্তিমিত। এখন শুধু অখন্ড অবসর। এই মুহূর্তে এক মূল্যবান সুযোগ মিলে গেল তাঁর। বন্ধু রাইজলে কলভার্ট তাঁকে বেশ কিছু অর্থ ও সম্পত্তি দিয়ে অনুরোধ জানালেন, “কবিতার রাজত্বে সম্পূর্ণরূপে অবগাহন কর”। এই সুযোগ কবির জীবনে সূর্যোদয়ের সম্ভাবনাকে দ্রুততর করে দিল। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদ নেই, নেই তার জন্য উপার্জনের ভাবনা, আছে শুধু কবিতার রাজ্য, যেন স্বপ্নময়। ভগ্নী ডরোথির সাহচর্যে ও সেবায় তাঁর চিত্তলোক স্থিতধী হয়ে আনন্দের অমৃতলোকের সন্ধ্যানে যাত্রা শুরু হল। সে যাত্রাপথে আরো একজন সহযোগী তাঁর মিলে গেল, তিনি হলেন কোলরীজ। সমাজ-রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক জীবনের জটিল ভাবনা, নিপীড়িত মানুষের মুক্তি সংগ্রামের দুঃসহ চেতনাকে সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে, মনের থেকে সে সব ধারণা মুছে ফেলে কবি আশ্রয় নিলেন প্রকৃতির অলৌকিক প্রাসাদে। তারই স্তব গানে বিভোর হয়ে গেলেন তিনি।
১৭৯৮ সালে কবির জীবনের স্মরণীয় কাল, জাতিরও জীবনে স্মরণীয় কাল। কবি প্রকাশ করেছেন লিরিক্যাল ব্যালাড, নীলনদের যুদ্ধে নেলসন পরাজিত করেছেন নেপোলিয়ন বোনাপার্টকে। লিরিকাল ব্যালাড রোমান্টিক যুগের আত্মাগত ভাবগত কল্পনার দ্বারোদঘাটন করল। ১৭৯৮-৯৯ সালে জার্মানি পরিভ্রমণ শেষ করে তিনি হ্রদ অঞ্চলে বসবাস করে কিছু দিন কাটালেন। তারপর গ্রাসমেয়ারে বেশ কিছুদিন অতিবাহিত করলেন। ১৮০২ সালে তিনি মেরী
হাচিনসনকে বিবাহ করেন। ১৮০৮ সালে তিনি অ্যালেন ব্যাংকে, ১৮১১ সালে গ্রাসমেয়ার পারসোনেমে, সবশেষে রাইডল মাউন্টে ১৮১৩ সালে বসবাস শুরু করলেন। মৃত্যুর শেষদিন পর্যন্ত তিনি এখানেই ছিলেন। এরপর একেবারে নিস্তরঙ্গ জীবন। মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়াতেন নানা দেশে। ১৮৩৯ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি সি এল উপাধিতে ভূষিত করে। ১৮৪২ সালে সরকার তিনশত পাউণ্ড অবসরকালীন ভাতা হিসাবে মঞ্জুর করেন, ১৮৪৩ সালে কবি সাদের মৃত্যুর পর তিনি “পোয়েট লরেট” হন। ১৮৫০ সালে কবি পরলোকগমন করেন। উনবিংশ শতাব্দীর অর্ধ শতাব্দী কাল ধরে কবি বেঁচেছিলেন। বহু ঘটনার স্রোত ইংলণ্ডের জীবনের উপর দিয়ে বয়ে গেছে। বয়ে গেছে বিশ্ব ইতিহাসের বুকে। তবু কবি যেন নিজেকে এ সব থেকেই নিস্পৃহ করে রেখেছিলেন। কেবল ১৮৩২ সালে বিখ্যাত প্রথম সংস্কার আইন যখন পাশ হয় তখন তিনি তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন। প্রথম সংস্কার আইনের উদ্দেশ্য ছিল ব্যাপক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন। যুগের দাবীকে অস্বীকার করে তিনি যেন রক্ষণশীলতাকেই সমর্থন করেছেন। এছাড়া রাজনৈতিক বিষয়ে তিনি ছিলেন একেবারেই নিস্পৃহ।
রচনা ও সাহিত্য: ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাঁর অধিকাংশ কবিতা রচনা করেছেন ১৭৯৮ থেকে ১৮০৮ সালের মধ্যে। এটাই তাঁর রচনার স্বর্ণযুগ। ১৭৯৮ সালে কবি কোলরীজের সঙ্গে যুক্তভাবে “লিরিক্যাল ব্যালাড” রচনা করেছেন এবং রোমান্টিক তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই গ্রন্থে তাঁর রচিত কবিতাগুলি হল Goody Blake, The Thorn, The Idiot boy. Tintem Abbey, ১৭৯৮ সালে Recluse. কবিতা রচনার পরিকল্পনাও করেছিলেন। অবশ্য কাব্যটির রচনা শুরু করেছিলেন ১৮০০ সালে। ইংরাজি সাহিত্যের প্রথম দর্শনতত্ত্বের কাব্য। ১৭ বছর ধরে কাব্য রচনার চেষ্টা করেছেন তবুও এই কাব্যটি অসমাপ্ত থেকে গেছে। ১৭৯৮ থেকে ১৮০৫ সালের মধ্যে রচনা করেছেন তাঁর আত্মজীবনীমূলক কাব্য The Prelude (দি প্রিলিউড)। The Excursion (দি এক্সকারসন) কবিতাটি ১৭৯৭ সাল থেকে শুরু করে শেষ করেছেন ১৮১৪ সালে। প্রায় এক শতাব্দী ধরে ওয়ার্ডসওয়ার্থ জগত ও জীবনকে দেখেছেন। কিন্তু কাব্যের ফসল তুলেছেন মাত্র দশ কি বার বছরের মধ্যে। সেই রচনার মধ্যেই তিনি একটি যুগের স্রষ্টারূপে চিহ্নিত হয়েছেন। অবশ্য ১৮০৮ সালে ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবি কল্পনা যে একেবারে বন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল এমন নয়। কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁর রচনার মধ্যে সেই উত্তাপ, সেই ঘন নিবিড়তা, সেই নিস্তরঙ্গ মুখর স্তব্ধতা ছিল না।
যাই হোক ১৭৯৬ সাল থেকে কোলরীজের সঙ্গে বন্ধুত্ব কবির জীবনে এক সুগভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কবির কাব্য সাধনার আত্মপ্রত্যয়ের পাদপীঠ হয়েছিল সুদৃঢ়। দুই কবির নিবিড় বন্ধুত্ব, ভাব ও ভাবনার আদান-প্রদানের মধ্যে দিয়ে কাব্য সৃষ্টির পরিকল্পনা জয়লাহ করেছিল। সেই পরিকল্পনার প্রকাশ ঘটেছিল “লিরিক্যাল ব্যালাডের” মধ্যে। ১৭৯৮ সালে লিরিক্যাল ব্যালাডের আত্মপ্রকাশ বিপুল সমাদর লাভ করেনি। বরং তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এমনকি এর প্রত্যেকটি কবিতাই উপেক্ষিত হয়েছিল। তা সত্ত্বেও পরবর্তী কালে এই কাব্যগ্রন্থটি একটি যুগের উচ্চমিনার রূপে স্বীকৃতি পেয়েছিল।
এই কাব্যগ্রন্থটির রূপায়ণে দুই কবির শিল্পকর্ম ও শিল্পভাবনা প্রকাশ পেয়েছে। কোলরীজ তাঁর বায়োগ্রাফিয়া লিটারিয়া’তে বলেছেন যে, “সারা প্রথম বছরটা ধরে ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও আমি ছিলাম প্রতিবেশী। কবিতার দুটি প্রধান বিষয় নিয়ে প্রায়ই আমাদের মধ্যে আলোচনা হত, একটি হব প্রকৃতির যথাযথ সত্যের প্রতি একনিষ্ঠ থেকে পাঠকের সহানুভূতিকে উদ্দীপিত করার ক্ষমতা, ও অপরটি হল কল্পনার রঙকে পরিবর্তিত করে পাঠকের আগ্রহের অভিনবত্বকে উদ্দীপিত করা। এই
ভাবনার মধ্য দিয়ে স্থিরীকৃত হয়েছিল যে দুই ধরনের কতকগুলি কবিতা রচনা করতে হবে। একটার মধ্যে ঘটনা ও চরিত্র হবে অংশতঃ হলেও অতিপ্রাকৃত; সেই সমস্ত ভাবগুলিকে নাটকীয় সত্যের দ্বারা কৌতূহল জাগানোর রসপরিণতির দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে, যে ভাবগুলি মনে হবে বাস্তব। দ্বিতীয় শ্রেণীর জন্যে বিষয়বস্তু বেছে নিতে হবে সাধারণ প্রাকৃত জীবনের মধ্য থেকে, যার চরিত্র ও ঘটনাগুলিকে ঘটতে দেখা যাবে গাঁয়ের ও তার আশে-পাশের প্রাত্যহিক জীবনের মধ্যে। এই ভাবনা থেকেই “লিরিক্যাল ব্যালড” রচনার উৎপত্তি এবং এটাই গৃহীত হয়েছিল যে আমার প্রচেষ্টা হবে অতি প্রাকৃত চরিত্র ও মানুষ সৃষ্টি করা…. এবং মিঃ ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রচেষ্টা হবে প্রাত্যহিক বিষয়বস্তুর উপর অভিনবত্বের যাদু সৃষ্টি করা।”
সুতরাং লিরিক্যাল ব্যালাডের মধ্যে দুই জাতের কবিতা থাকবে। একটির বিষয়বস্তুর মধ্যে বাস্তব ও পরিচিত প্রাকৃত জীবন হয়ে উঠবে মোহনীয়; অন্যটির বিষয়বস্তুর মধ্যে অবাস্তব বা অতিপ্রাকৃত জীবন হয়ে উঠবে বাস্তবের মত স্পষ্ট ও স্বচ্ছ। অর্থাৎ যা অস্পষ্ট তাকে স্পষ্ট, যা অলৌকিক ডাকে লৌকিক, যা অপরিচিত তাকে পরিচিত এবং যা অবিশ্বাস্য তাকে বিশ্বাস্য করে তোলাই হল কোলরীজের কাজ। আর ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিকর্ম হবে পরিচিত বাস্তব, প্রাত্যহিক জীবনকে এক অপার বিস্ময়ে মণ্ডিত করে অসামান্য রূপে সৃষ্টি করা।
এই লক্ষ্যের প্রতি স্থির দৃষ্টি রেখে দুই কবি কাব্য রচনা করবেন। কিন্তু কাব্যের ভাষা কি হবে তাই নিয়েও একটা সিদ্ধান্তে তাঁরা উপনীত হয়েছিলেন। এবং সেই সম্পর্কে ওয়ার্ডসওয়ার্থ লিরিক্যাল ব্যালাডের ভূমিকায় বলেছেন যে, “এর অধিকাংশ কবিতাকেই একটা পরীক্ষারূপে গ্রহণ করতে হবে। প্রধানতঃ এগুলি এই উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল, সমাজের মধ্য ও নিম্নশ্রেণীর মানুষের প্রাত্যহিক ব্যবহৃত ভাষাকে শৈল্পিক আনন্দ দান করার জন্যে কাব্যে গ্রহণ করা যায়।” অর্থাৎ কাব্যের ভাষা হবে সাধারণ মুখের ভাষা যা কবি হৃদয়ের আবেগের স্পর্শ পেয়ে হয়ে উঠবে প্রাণচঞ্চলতায় অপূর্ব অদ্ভুত। শিল্পের মোহময় যাদুমন্ত্রে প্রচলিত প্রাত্যহিক ভাষা পাবে কাব্যের রূপসৌন্দর্য, সে নববধুর বিবাহের রঙিন সাজে হবে সজ্জিত। ওয়ার্ডসওয়ার্থ কাব্যের ভাষার সঙ্গে গদ্যের ভাষার কোন পার্থক্য স্বীকার করেননি। কারণ গদ্যেও রঙ ধরে পদ্যের। অর্থাৎ যে কোন ভাষার মধ্যে শিল্পীর রং ভরানোর মধ্যেই নিহিত আছে শিল্পদক্ষতা। এর ফলে ওয়ার্ডসওয়ার্থ অষ্টাদশ শতাব্দীর গুরুগম্ভীর, কৃত্রিম আড়ম্বরপূর্ণ ভাষাকে বর্জন করলেন। এমন কি ছন্দের বন্ধনকেও মেনে নিলেন ন।
কবি কোলরীজ রোমান্টিক কল্পনার ডানায় ভর করে সুদূরের পানে যাত্রা শুরু করলেন। তাঁর কল্পনার অশ্ব ছুটে চলল অজানা, অদেখা, অপরিচিত দক্ষিণ মেরু প্রদেশের সমুদ্রলোকে, কুহেলীঘেরা রহস্যাবৃত মধ্যযুগীয় জীবনযাত্রার মধ্যে ছুটে চলল অস্পষ্ট অতীতের ধূসর ইতিহাসের রাজকীয় জীবনের মধ্যে। কল্পনার রঙে এসবকে উজ্জ্বল, বাস্তব করে তোলার কঠিন দুরূহ কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করলেন এবং তাতে তিনি সাফল্যও লাভ করেছেন। অতিপ্রাকৃত বর্ণনায় তিনি willing suspensions of disbelief নীতিকে যেভাবে সূক্ষ্ম অথচ ত্রুটিহীনভাবে রূপদান করেছেন তা সত্যিই অবিস্মরণীয়। কারণ এই ব্যাপারে তাঁর আন্তরিকতা ছিল প্রবল, নিষ্ঠা ছিল অপরিসীম। তবে কবি কোলরীজ কীটসের মত তৈলচিত্রকর ছিলেন না। তিনি ছিলেন জাত শিল্পী। তাই তুলির একটি টানে আভাসে, ইঙ্গিতে একটি সমগ্র পরিবেশকে পূর্ণাঙ্গ রূণ দিতে পেরেছেন। কোলরীজের সাধনা ও সৃষ্টির এখানেই সার্থকতা। রোমান্টিক সাহিত্যে কোলরীজের দান অপূর্ব, অদ্বিতীয়। ওয়ার্ডসওয়ার্থ যদিও প্রথমে কোলরীজের সঙ্গে একযোগে “Ancient mariner” রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন, পরে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর শিল্প সৃষ্টি ভাবনার সঙ্গে
কোলরীজের ভাবনার একটা বিরাট পার্থক্য রয়েছে। সুতরাং তিনি “অ্যানসেন্ট মেরিনার” রচনায় ইস্তফা দিয়ে নিজের মনের মত কাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করলেন। রচনা করলেন ‘পিটার বেল’ (Peter Bell)। পিটার বেল একজন মাতাল মৃৎশিল্পী, সে তার জীবনে বহু পাপ করেছে। কাহিনীর শুরুতেই দেখানো হয়েছে যে সে রাস্তার একটা গাধাকে চাঁদের আলোয় নির্মম প্রহার করছে। অবশ্য এনসেন্ট মেরিনারের মত তাকে কোন অনৈসর্গিক শক্তির প্রভাবে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়নি। সে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছে চাঁদের আলোয় অতি সাধারণ কতকগুলি ঘটনার মধ্য দিয়ে। যেমন, একটা বিবর্ণ ঝরা পাতা তাকে তাড়া করে চলেছে, পাথরের উপর একবিন্দু রক্ত দেখে তার মনে হয়েছে, ওটা যেন এই গাধাটারই দেহের রক্ত, অথবা খনি শ্রমিকদের পাথরের চাঁই উড়াবার গুরুগম্ভীর গর্জন তার মনে জাগিয়েছে এক ভয়ঙ্কর ভীতি যার ফলে অনুশোচনার মাধ্যমে এসেছে কারুণ্য ও সমবেদনা। এখানে ওয়ার্ডসওয়ার্থ এক সাধারণ ঘটনাকে অসামান্য চমৎকৃতি দান করেছেন। পরিচিত, চেনা, জানা চরিত্র ও ঘটনাকে কবি অপরূপ ভাবগভীরতায় ভরিয়ে দিয়েছেন। আর এই সৃষ্টির মধ্য দিয়েই একটি রোমান্টিক যুগের পত্তন করেছিলেন তিনি। ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতাগুলিকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমতঃ সম্পূর্ণভাবে নিসর্গ প্রকৃতির কবিতা, দ্বিতীয়তঃ মানবের সঙ্গে প্রকৃতির সম্বন্ধ, তৃতীয়তঃ মানব প্রেমের কবিতা।
‘লিরিক্যাল ব্যালাড’ যে যুগের সূচনা করেছিল সে যুগ ‘প্রকৃতির যুগ’ বলে বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়েছিল। রোমান্টিক যুগের কাব্য কবিতায় প্রধান স্থান দখল করে আছে প্রকৃতি। প্রকৃতিই মুখ্য; মানুষ গৌণ। এমন কি ঈশ্বরও। নিসর্গ প্রকৃতির সান্নিধ্য ব্যতিরেকে মানুষ এবং ঈশ্বরের স্বতন্ত্র কোন অস্তিত্ব নেই। তেমনি নিসর্গ প্রকৃতির উল্লেখ ব্যতিরেকে ওয়ার্ডসওয়ার্থকে কল্পনা করা যায় না।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রকৃতিকে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক জীবনের জীবন্ত সত্তা রূপে দেখেছেন। A winning Power, beyond all other Power. আর এই শক্তির সঙ্গে কবির পরিচয়ের বিবরণটি কবি লিপিবদ্ধ করেছেন The Prelude কবিতা বা Tintern Abbey কবিতাটির মধ্যে। প্রথম জীবনে প্রকৃতি ছিল কবির কাছে কৈশোরের ক্রীড়াক্ষেত্র। পবর্তবক্ষ নিঃসৃত ঝরনাধারার কলগুঞ্জন, বৃক্ষসমাচ্ছন্ন পর্বতের ছায়া সুনিবিড় নদী মর্মর ধ্বনি, কিশোর বালকের স্বপ্নের জগতে এক অনাস্বাদিত শিহরণ জাগিয়ে তুলত। ভগ্নী ডরোথিকে সঙ্গে নিয়ে কবি কখনও নদীপ্রান্তে, কখনও বনের পথে ঘুরে বেড়াতেন, কখনও বা ছুটে বেড়াতেন উড়ন্ত প্রজাপতির পিছে। এই প্রকৃতি ছিল কবির কাছে-“The coarser pleasure of my boyish days and their glad animal movement” বাল্যজীবনের স্থূল আনন্দের প্রতীক।
একসময় ধীরে ধীরে শৈশবের প্রাণের উদ্দামতা স্তব্ধ হয়ে এল। জাগ্রত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যভাব তন্ময়তা। কেবলমাত্র আবেগে ছুটে বেড়ান নয়, ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করা, তাকে দুচোখের তারার মধ্যে ধরে রাখা, তাকে হৃদয়ের মধ্যে চিরন্তন করে রাখাই হল তাঁর আসল উদ্দেশ্য। যদিও কবি নির্জন প্রান্তবাসী তবু তিনি কখনও প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করেন নি। তিনি প্রকৃতির একটি জীবন্ত সত্তাকে যেন অনুভব করেছেন। নিসর্গ প্রকৃতির কবি হিসাবে প্রকৃতির অতি ক্ষুদ্র, অতি ক্ষীণ স্থায়ী প্রতিটি বস্তুকে কবি ভালবেসেছেন। প্রকৃতির রূপ সৌন্দর্য সম্ভোগের কবি তিনি ছিলেন না। প্রকৃতির বহিরিপ্রিয় গ্রাহ্য রূপের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হননি। তুষার স্তূপের বজ্রনির্দোষধ্বনি, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের নানান রঙের ছবি, জ্যোৎস্না-পুলকিত যামিনীর অতীন্দ্রিয় রহস্যময়তা, অভ্রভেদী পর্বতের মহিমায় সৌন্দর্য কবির কল্পলোকে কোন ছায়াপাত করেনি। পরন্তু নির্জন তুষারাবৃত হ্রদের বুকে শীতকালীন দিবসের স্নান ছায়া, অসীম শূন্য নীলিমার নীরব শূন্যতা, মনুষ্য পদচিহ্ন বিহীন অরণ্যলোক, উষার আলোকে ঘুমন্ত মহানগরীর সুগভীর শাস্তি, উদার উদাস
আনন্দের সুর কবির মনে রোমান্টিক বিষাদ জাগিয়ে তুলত। প্রকৃতির অতি তুচ্ছাতিতুচ্ছ বস্তু ও প্রাণীর বেদনা কবিকে ব্যথিত করত। শিকারীর তাড়ায় একটি হরিণ শিশুর প্রাণভয়ে পলায়ন ও তার মৃত্যু কবি চিত্তকে কেবল ব্যথিত করেনি বরং তার স্মৃতিতে সে বেদনা চিরন্তন হয়ে থেকেছে। কবি যেন আজও কান পেতে শোনেন সেই হরিণ শিশুর পূর্ব মুহূর্তের সকরুণ কাতর আর্তনাদ। এ যেন প্রকৃতির প্রতি মানুষের নির্মম আচরণের সুতীব্র নীরব প্রতিবাদ। সমগ্র চিত্তভরে কবি প্রকৃতিকে ভালবেসেছেন,
To me the meanest flower that blows can give Thoughts that do often lie to deep for tears.
ঠিক একই ভাবনা নিয়ে কবি কান পেতে শুনেছেন মানব জীবনের সকরুণ সঙ্গীত ধ্বনিকে।। কবির ভাষায়-“For I have learned to look on nature, not as in the hour of thoughtless youth but hearing often times the still sad music of humanity.” কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ উপলব্ধি করলেন যে প্রকৃতি কেবলমাত্র তাঁর নয়, সমস্ত মানুষের জীবনের জীবধাত্রী, পথ-প্রদর্শিকা, প্রতিপালিকা এবং নৈতিক আত্মা। প্রকৃতির গোপন আত্মার সচেতন বিকাশ হল মানুষ। ওয়ার্ডসওয়ার্থ মানুষকে দেখেছেন প্রকৃতির সন্তানরূপে। প্রকৃতি সযত্নে মানুষকে লালন-পালন করে এবং মানুষগুলিও হয়ে ওঠে প্রকৃতির মত সহজ সরল। প্রকৃতির সান্নিধ্যেই মানুষের হৃদয় সৌন্দর্য্যের বিকাশ ঘটে। মানুষ যতই প্রকৃতি থেকে দূরে সরে যায় ততই সে হয়ে ওঠে বিকৃত, বিকারগ্রস্ত। আধুনিক নগরালি সভ্যতা মানুষকে করেছে কৃত্রিম, বীভৎস। তাই মানুষকে তিনি দেখেছেন প্রকৃতির পরমাত্মার অংশরূপে। ফেরীওয়ালা, ভ্রমণকাবী, গ্রাম্যশিক্ষক, প্রভৃতি চরিত্রগুলিও কবি কল্পনার প্রকৃতির সান্নিধ্যে যেন হয়ে উঠেছে কবি ও দার্শনিক। এই চরিত্রগুলির মধ্যে ইন্দ্রিয়াতীত অনুভূতির তীব্রতা, গভীর মননশীলতা, এবং দুঃখ, জীবনের প্রতি উদার উদাস করা বৈরাগ্যের সমবেদনার রূপ প্রকাশ পেয়েছে। এমনই এক মানবীর চিত্র অঙ্কন করেছেন কবি যেখানে প্রকৃতির আত্মার প্রকাশ ঘটেছে, তা হচ্ছে লুসি। লুসি সাধারণ মানবী নয়। সে যেন প্রকৃতির নীরব সকরুণ সুর,। একটা অশ্রুত সঙ্গীত। একটা নিঃসঙ্গ শুচিশুভ্র অনাঘ্রাতা পুষ্প। একটি অর্ধপাগল বালকের অকারণ উল্লাস, গরুর গাড়ীর চাকায় লেগে একটি দরিদ্র বালিকার গাত্রাবরণ ছিঁড়ে যাওয়ার মত সামান্য ঘটনাকেও তিনি অসামান্য রূপদান করেছেন। কবি বলেছেন:
“Thanks to the human heart by which we live
Thanks to its tenderness, its joys and fears.”
কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ মানুষের প্রতি দরদী ছিলেন। কিন্তু সমাজসেবীর মত দরদী নয়। এ দরদ যেন সকল কালের সব মানুষের জন্য স্বতঃ উৎসারিত হয়েছে। এবং সে দরদও উৎসারিত হয়েছে মানুষকে নির্জন প্রকৃতির মধ্যে দেখে। Solitary Reaper-এর solitary কথাটার মধ্যেই নির্জন মুহূর্তের মানবিকতার রূপটি যেন তাতে প্রকাশ পেয়েছে। শুধু মানবিকতা নয়, করুণাঘন মানবিকতা।
প্রকৃতির মধ্যে জীবন্ত আত্মার অনুভবের ফলে কবি সেই আত্মার সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে বিলীন হতে চেয়েছেন। কারণ আত্মার সঙ্গে আত্মার মহামিলনের মধ্যে রয়েছে মুক্তি, মুক্তি চেতনার চিনয়লোকে, আনন্দলোকে। প্রকৃতির এই প্রাণরহস্যের উদ্বোধনে প্রকৃতির নৈতিক সত্তাকে কবি আবিষ্কার করেছেন, যে সত্তা মানুষের জ্ঞানরূপিণী আনন্দস্বরূপিণী, মানুষের হৃদয়কে নববলে বলীয়ান করে তাকে কলুষতা থেকে মুক্তি দেয়, তার ধর্ম বিশ্বাসকে দৃঢ় করে এবং আধ্যাত্মিকতাকে করে জ্যোতির্ময়। প্রকৃতির স্থাবর, জঙ্গম সমস্ত কিছুর মধ্যেই জীবন্ত সত্তার প্রকাশকে দেখেছেন কবি
ধ্যানের নয়নে। তাই কবি ‘ডেইনী’ ফুলের মধ্যে একটি প্রাণসত্তা আবিষ্কার করেছেন। ‘সিলেনডাইন’ ফুলের মধ্যে কবি প্রকৃতির বিনম্র আত্মাকে অনুভব করেছেন। “ড্যাফোডিলস” ফুল কবির কাছে বিষাদঘন চিত্তের সকরুণ মূরতি। প্রত্যেকটি ফুলকেই জীবন্ত সত্তার-বিচিত্র রূপের প্রকাশ বলেই গ্রহণ করেছেন। শুধু ফুল নয়, কবি প্রকৃতির ফুল-হাওয়া জল-তৃণ-তরুর মধ্যে এমনকি মানবের মধ্যেই এক পরমাত্মার প্রকাশ অনুভব করেছেন এবং সেই আত্মার সঙ্গে নিজেকে সাযুজ্য করে কবি আপনার হৃদয়ের নির্মল সৌন্দর্য্যে কাব্যের ডালি ভরেছেন।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ যতই প্রকৃতিপ্রেমিক হন, যতই বাস্তব জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আধ্যাত্মিক অরণ্যের গুহায় বসে পরমাত্মার ধ্যান করুন না কেন তবুও তাঁর কাব্যের ফাঁকে ফাঁকে ধ্বনিত হয়েছে সেই জীবনের কথা যে জীবনের বিপ্লবমন্ত্রে তিনি একদা দীক্ষিত হয়েছিলেন, যে যৌবনের ললাটে রাজটিকা এঁকে দিয়ে তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলেন পথে। তাই আবেগদীপ্ত কণ্ঠে বলতে পেরেছেন,
Bliss was it in that drawn to be alive,
But to be young was very heaven!
সেই বিপ্লবের উষালগ্নে বেঁচে থাকাটা যেমন ছিল আশীর্বাদ, তেমনি সেকালে তরুণ হওয়াটা ছিল ঈশ্বরের প্রসাদ।
কবি ভুলতে পারেননি তাঁর কালের সমাজকে যে সমাজকে তিনি দুর্নীতির পচা নর্দমা বলে অভিহিত করেছেন। সে সমাজের ব্যভিচারকে তিনি সহ্য করতে পারেননি, চেয়েছেন সে সমাজের পরিবর্তন, আশা করেছেন যোগ্য নেতৃত্বের, আকুল কণ্ঠে তাই আর্তনাদ করে উঠেছেন তিনি- “মিলটন, এসময়ে তুমি যদি থাকতে।”
কোলরীজ
১৭৭২ সালে ডিভনশায়ারের অন্তর্গত ওটারি সেন্টমেরিতে কোলরীজ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবা রেভারেও জন কোলরীজ ছিলেন প্যারিস চার্চের ভাইকার এবং স্থানীয় গ্রামার স্কুলের শিক্ষক। কোলরীজ শৈশব থেকেই ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন। পাঁচ বছর বয়সেই বাইবেল আর আরব্য রজনীর গল্পগুলি পড়ে ফেলেছিলেন। ছ’বছর বয়স পর্যন্ত একটা “ডেম” স্কুলে পড়েছেন। নয় বছর বয়েস পর্যন্ত বাবার স্কুলেই পড়েছেন। এসময় ওঁর পিতৃবিয়োগ ঘটে। এর পর লন্ডনের চ্যারিটি স্কুল অব ক্রাইষ্ট হসপিট্যালে ভর্তি হন। এখানে প্রায় আট বছর কাটিয়েছেন। আর এখানেই চার্লস ল্যাম্বের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকার ঘটে। উনিশ বছর বয়সে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। তিনবছর সেখানে অতিবাহিত করার পর সামান্য দেনার ভয়ে পালিয়ে গিয়ে লাইট ড্রাগুনে ভর্তি হন। কয়েকমাস পরে সেখানে ছাত্র হিসাবে ধরা পড়ার পর আবার ফিরে আসতে হয় কেমব্রিজে। ৭৯৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। পরে কবি সাদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। সাদে ফরাসী বিপ্লবের সমর্থক ছিলেন। কোলরীজও ফরাসী বিপ্লবের সমর্থক হন। বিট্রলে সাদের সঙ্গে তিনি বাস করতেন। এখানে সাদের শ্যালিকাকে তিনি বিবাহ করেন। বিষ্ট্রলে কোলরীজ নানা বিষয়ে বক্তৃতা করতেন, কবিতা রচনা করতেন, এবং ‘ওয়াচম্যান’ নামে একটি পত্রিকা চালাতেন। পরে তিনি ১৭৯৪ সালে ওয়ার্ডসওয়ার্থের সঙ্গে পরিচিত হন। দুজনে এত বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন যে দুজনে মিলে নবতন কাব্য সৃষ্টির একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন। ‘লিরিক্যাল ব্যালাড’ সেই পরিকল্পনার ফাল। দুজন ধনী বন্ধুর কাছ থেকে সাহায্য পেয়ে কোলরীজ জার্মানীতে গিয়ে জার্মান দর্শন অধ্যয়ন করেন। ১৭৯৯ সালে ইংলণ্ডে ফিরে আসেন। এসময় তিনি কিছুদিন লেক-ডিস্ট্রিক্টে বাস করেছিলেন। সাংবাদিকতার দিকে ঝুঁকেছিলেন কিন্তু শরীরের অক্ষমতার জন্য তা পরিত্যাগ করতে
বাধ্য হন। ১৮০০ সালে যখন তিনি কেশউইকে বসবাস করছিলেন তখনই তিনি তাঁর ‘ক্রিষ্টা বেল’ ও ‘ডিজেক্সান’ কবিতা রচনা করেন। এ সময় তিনি অনবরত রোগে ভুগতে থাকেন এবং রোগের হাত থেকে সাময়িক উপশমের জন্য আফিম সেবন করতেন। ১৮০৩ সালের পর থেকে তিনি একেবারে আফিমখোর হয়ে উঠলেন। একদিকে ব্যাধির যন্ত্রণা অন্যদিকে অর্থের অনটন সাংসারিক জীবনেও আনল বিপর্যয়। সাংসারিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তিনি নিজের মত বসবাস করতে লাগলেন। তাঁর সংসারের অনেকখানি দায়-দায়িত্ব বহন করে চললেন সাদে। ১৮০৪-০৬ সাল পর্যন্ত তিনি ইটালীর মালটাতে অতিবাহিত করলেন। ফিরে এসে সারা দেশটা পরিভ্রমণ করতে লাগলেন। ১৮০৮ সালে রয়েল ইনষ্টিটিউশন থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটা জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়ালেন। ১৮১১ সালে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল তাঁর শেক্সপীয়র সম্বন্ধে বক্তৃতাগুলি। ১৮১২ সালের মধ্যেও অন্যান্য কবি ও শেক্সপীয়র সম্বন্ধে তাঁর বক্তৃতাগুলিও বেশ উল্লেখযোগ্য। প্রায় পনের বছর ধরে আফিমের নেশায় উন্মত্ত থেকে স্বাস্থ্যহানি ঘটায় তিনি বেশ ভেঙ্গে পড়েছিলেন। এ সময় তিনি আফিমের নেশা ত্যাগ করার জন্য চেষ্টা করলেন এবং হিলগেটের মিঃ গিলম্যান নামে এক ডাক্তারের হাতে নিজেকে সমর্পণ করলেন। ধীরে ধীরে নেশার হাত থেকে মুক্ত হলেন, রোগও কিছুটা উপশম হল এবং জীবনের শেষকটা বছর একটা সংযত শান্তির পরিবেশের মধ্যে কাটিয়ে দিতে লাগলেন। বহু বন্ধুবান্ধব, শিল্পী, দার্শনিকরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন এবং তাঁদের সঙ্গে পাণ্ডিত্যপূর্ণ, জ্ঞানগর্ভ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। আর রচনা করতেন আপনার ভাবনা দিয়ে প্রবন্ধসাহিত্যগুলি। ১৮৩৪ সালে কোলরীজ মারা গেলেন। হাইগেট চার্চে তাঁকে সমাধিস্থ করা হল।
রচনা ও সাহিত্য:-
কোলরীজ রচনা করেছেন গদ্য, পদ্য ও প্রবন্ধ। অবশ্য সাহিত্যের জগতে পদ্য দিয়েই তাঁর পদযাত্রা শুরু হয়েছে। তরুণ যৌবনের কবি রচনা করলেন বেশ কিছু কবিতা। গ্রন্থাকারে তা প্রকাশিত হল পোয়েমস্ অন ভেরিয়াস্ সাবজেক্ট’ (‘Poems on various Subject’) নামে ১৭৯৬ সালে। রোমান্সের বর্ণচ্ছটায় সেগুলি হয়েছে বর্ণময়। যে সব কবিতার মধ্যে শিশুর উলঙ্গ উদার দৃষ্টির প্রকাশ ঘটেছে সেগুলি হল, “দি ডে ড্রিম” (The day dream), “দি ডেভিল। ঘট” (The Devil’s Though), “দি সুইসাইড আরগুমেন্ট” (The Suicide arguments), “দি ওয়ান্ডারিংস ও ক্যেন” (The Wanderings of Cain). “যদি রিলিজিয়স মিউজিংস” (The Religious Musings), “দি ডেসটিনি অফ নেশনস্” (The destiny of Nations), এবং “ওড টু ডিপারটিং ইয়ারস” (Ode to departing years). এছাড়া কোলরীজ পরিণত মানসের ফসল তুলেছেন ১৭৯৭ সাল থেকে ১৭৯৮ সালের মধ্যে। কারণ কোলরীজের মধ্যে তখন বুদ্ধি ও কল্পনার এক সামঞ্জস্যপূর্ণ সংমিশ্রণ ঘটেছে। ঘটেছে দৃষ্টিভঙ্গীর এক পরিণত রূপ। ওয়ার্ডসওয়ার্থের সান্নিধ্য এবং সহযোগিতা কবিকে দিয়েছে সেই পরিণত পথে চলার প্রেরণা। ‘লিরিক্যাল ব্যালাড’ (Lyrical Ballad) রচনার পরিকল্পনার মধ্যেই রয়েছে কবির এক স্থির দৃষ্টির প্রকাশ। এই সংকলনে কবির রয়েছে চারটি কবিতা। তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা হল “দি রাইম অব দি এনসেন্ট মেরিনার”, এই কবিতাটির জন্মবৃত্তান্ত সম্বন্ধে কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন যে, “কোয়ান্টক পাহাড়ে ভ্রমণ করবার সময় তিনি এবং কোলরীজ কবিতার একটা খসড়া পারকল্পনা করেছিলেন। কোলরীজ সমুদ্র অভিযানের পরিকল্পনা করেছিলেন আর আমি সেই অভিযানের পূর্ণাঙ্গ রূপ বর্ণনা করেছিলাম। কথা ছিল দুজনে মিলেই কবিতাটি রচনা করব। কিন্তু কোলরীজের সঙ্গে
কোন কোন বিষয়ে ঠিক মিল না হওয়ায় আমি শেষ পর্যন্ত কবিতাটি পূর্ণাঙ্গ রচনার দায়িত্ব কোলরীজের ওপরেই ছেড়ে দিই।” ১৭৯৭ সালে কোলরীজ “ক্রিষ্টা বেল” কবিতাটির প্রথমাংশ রচনা করেন। দ্বিতীয়াংশটি ১৮০০ সালে রচনা করেন। কবিতাটিকে কবি পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে পারেননি। অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। ১৭৯৮ সালে রচিত ‘কুবলাখান’ কবিতাটিও অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। বৃহৎ কবিতা রচনার বেগবান প্রবাহ কোন কারণে স্তিমিত হয়ে এলেও ক্ষুদ্র কবিতা রচনার ধারাটি কোনক্রমেই ক্ষীণ হয়নি। রচনা করেছেন, “ফ্রষ্ট এ্যাট মিউনাইট”, ‘ফ্রান্স’ প্রভৃতি কবিতা। “ডিজেকসান” কবিতাটি রচনা করেন ১৮০২ সালে। ছোট মাপের কবিতা রচনা করেছেন। কিন্তু সেও রচনা করেছেন। কিন্তু সেও রচনা করেছেন প্রতিভার স্তিমিত প্রদীপে। ১৮১৩ সালে ডুরিলেন থিয়েটারের অনুরোধে “রিমোর্স” নামে নাটকটি রচনা করেছিলেন। নাটকটি মঞ্চ সফল হলেও সাহিত্যমূল্য ছিল নগণ্য। এরপর আর রচনা বা সৃষ্টি সম্ভব হয়নি।
সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য:-
কোলরীজের রচনার বা সাহিত্য ভাবনার মূল বৈশিষ্ট্য হল প্রকৃতি প্রেমের অপ্রাকৃত রূপকে প্রাকৃতের আধারে পরিবেশন করা। কোলরীজ প্রধানতঃ প্রকৃতি প্রেমিক। তিনি প্রকৃতিকে জীবনের প্রেরণাদাত্রীরূপে গ্রহণ করেছেন। প্রকৃতিকেই জীবনের ধ্রুবতারারূপে গ্রহণ করে তিনি জীবনের সব অবসাদ, অবসন্নতার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন, পেয়েছেন উদার প্রেমের উজ্জ্বল আলোর পরশ, পেয়েছেন মধুময় পৃথিবীর বুকভরা স্নেহের পরশ, পেয়েছেন ভাগবতী চেতনার মধ্যে মধু রসের আনন্দধারা। প্রকৃতি যেন সব কিছু উজাড় করে দিয়েছেন কোলরীজকে। কোলরীজ ভক্ত প্রেমিকের মত গ্রহণও করেছেন দুই হাত ভরে। তাই কবি প্রকৃতির উদ্দেশ্যে বলেছেন,
O. Lady! We receive but what we give?
And in our life alone does nature live.
প্রকৃতির কাছ থেকে দান গ্রহণ করে আপনার হৃদয়পাত্রটিকে পূর্ণ করে তুলেছেন কবি। কিন্তু প্রকৃতিকে দেবার মত তাঁর কিছু নেই বলেই দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু কবি কোলরীজ যে প্রকৃতিকে আমরা দু-চোখ ভরে দেখি সেই প্রকৃতি জগতের মধ্যে বিচরণ করেননি, তার রূপের পাথারে আঁখি ডুবিয়ে সৌন্দর্য্য উপভোগ করেননি, তাঁর লেখনীতে তাকে জীবন্ত করে তোলেননি। ওয়ার্ডসওয়ার্থ যেমন চেনা-জানা প্রকৃতি জগতের মধ্যে হৃদয় ডুবিয়ে ভাবমুগ্ধতায় বিভোর হয়েছেন, তেমনভাবে কবি কোলরীজ হননি। তিনি যে তা হতে পারেন না। কারণ বন্ধু ওয়ার্ডসওয়ার্থের সঙ্গে তাঁর চুক্তি আছে যে তিনি সেই প্রকৃতি জগতের রহস্যের আবরণকে উন্মোচিত করবেন; যে প্রকৃতি অজানা-অচেনা-অদেখা-অগম-অনাবিষ্কৃত। যা অস্পষ্ট তাকে স্পষ্ট; যা অতিপ্রাকৃত তাকে প্রাকৃত, যা অলৌকিক তা লৌকিক, যা অবিশ্বাস্য তাকে বিশ্বাস্য করে তোলাই হল কোলরীজের কাজ। এবং এ কাজ যেমন দুরূহ তেমনি কঠিন। প্রকৃতি প্রেমের আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে তিনি পরিচিত ফুল-ফল হাওয়া জল-তৃণ-তরু-হ্রদ-অরণ্য পর্বত-নদী-প্রান্তর অতিক্রম করে পাড়ি জমালেন কখনও তুষারাবৃত মেরুপ্রদেশে, কখনও মধ্যযুগের কোন এক নির্জন দুর্গের মধ্যে, কখনও বা অতীতের কোন রণাঙ্গনে। অর্থাৎ পরিচিত জগৎ ছেড়ে তিনি চলে গেলেন অচেনা অদেখা অপরিচিতি জগতে। কেন তিনি পাড়ি জমালেন অচেনা জগতে। যেহেতু অতিপ্রাকৃত তাঁর কাছে ছিল একটা “Poetic truth” এই কাব্যসত্য কবির কাছে ছিল এক দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। তিনি বেশ ভালভাবেই জানতেন, যে অতিপ্রাকৃত নিছক অতি প্রাকৃত নয়, তা মাকৃত জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। অর্থাৎ প্রাকৃত জীবনের সঙ্গে সে গড়ে তোলে নিবিড় সমন্বয়। এই সমন্বয়ের অভাব যেখানে সেখানে অতিপ্রাকৃত কেবলমাত্র ভৌতিক বিশ্বাসেই পরিণত হয়। তাতে
প্রাকৃত জীবনের মাটির গন্ধ থাকে না। তাই “প্রাচীন নাবিক” কবিতায় তুষারাবৃত মেরুপ্রদেশে নাবিকের পাপের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ চোখের সামনে যে সব অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটেছিল সেগুলিকে প্রাকৃত বলেই মনে হয়। মধ্যযুগের জনমানবহীন অরণ্য-বেষ্টিত নির্জন প্রাসাদের মধ্যে রাত বারটার পর অশুভ আত্মার আবির্ভাবের বিষয়টিকেও অবাস্তব বলে মনে হয় না।
অতিপ্রাকৃতকে দক্ষতার সঙ্গে কাব্যে রূপদান করলেও কবির কাব্যের মুখ্য বাণী হল ঈশ্বর প্রেম। যে প্রেম মানুষকে মহৎ করে, একের সঙ্গে অপরের বন্ধনকে করে সুদৃঢ়। যে প্রেমের আলোকে বিশ্ব আলোকিত, মানব হৃদয় পুলকিত এবং পরিশুদ্ধ, সে প্রেমের অভাবে মানুষের হৃদয় বরে ওঠে বন্য হিংস্রতায়, নিষ্ঠুর নির্দয়তায়, সেই প্রেমেরই সাধক হলেন কবি কোলরীজ। কবি বলেছেন,
“All thoughts, all passions, all delights, Whatever stirs this mortal frame, All are but ministers of love. And feed his sacred flame.”
“প্রাচীন নাবিক” কবিতার মধ্যে এই মূল ভাবটি প্রকাশ পেয়েছে। প্রকৃতির ‘পবিত্র আত্মা’, ঈশ্বরের মহান সৃষ্টি ‘এলবাট্রস’ পাখীটিকে হত্যা করার পর থেকেই নাবিকের জীবনে শুরু হয়েছিল যে প্রচণ্ড পাপের দুঃসহ দহন, সেই দহনের অবসান ঘটেছে পুনরায় তার হৃদয়ে প্রেমের আবির্ভাবে, ঈশ্বরের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাসের নতুন চেতনায়।
He Prayeth best, who loveth best, All things both great and small, For the dear God who loveth us. He made and loveth all.
ক্ষুদ্র বৃহৎ সব কিছুই তো ঈশ্বরের সৃষ্টি। তাই ক্ষুদ্রকে ভালবাসার অর্থ ঈশ্বরকে ভালবাসা। মানুষের হৃদয়ে এই ভালবাসা আছে বলেই মানুষ সকল রকম অশুভ শক্তির হাত থেকে মুক্তি পায়। যেমন ক্রিষ্টা বেল পেয়েছে অশুভ শক্তির প্রতীক জিরালডাইনের হাত থেকে মুক্তি।
কোলরীজের রচনার আর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নাটকীয়তা। কাব্যের মধ্যে তিনি নাটকীয় উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেছেন। যেমন “Is the night chilly and dark?” “রাত্রিটা কি ভীষণ ঠাণ্ডা এবং অন্ধকার” এই প্রশ্ন করার মাধ্যমে যেমন পাঠকের মনে একটা উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেন তেমনি পরিবেশটুকুকেও ভয়াতুর করে তোলেন। নাটকীয় পরিস্থিতি নাটকীয় উৎকণ্ঠা সৃষ্টির কেন্দ্র। তাই কবি নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতেও বিশেষ দক্ষ।
চিত্রধর্মিতাও কোলরীজের কাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এক্ষেত্রে তিনি স্কুল নন, মসৃণ। একটি রেখার টানেই সমগ্র চিত্রটি ফুটিয়ে তোলেন। পাতার পর পাতা বর্ণনা করা তাঁর ধর্ম নয়। সহজ সরল ভাষার সুনিপুণ প্রয়োগ সত্যই অনবদ্য।
বায়রণ (১৭৮৮-১৮২৪)
পুরো নাম জর্জ গর্ডন বায়রন। পরে লর্ড বায়রন। বংশ মর্যাদায় তিনি ছিলেন অভিজাত পরিবারের সন্তান। জন্ম-লগুন শহরে। বিদ্যাশিক্ষা স্কটল্যান্ডে। শৈশব জীবন কবির কেটেছে সেখানেই। কারণ বাবা ছিলেন অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন এক মানুষ। বায়রনের মায়ের সমস্ত সম্পত্তি তিনি একদিন উড়িয়ে নিঃশেষ করে দিয়ে ওদের পথে বসিয়ে সরে পড়েন। বায়রনের মা ছিলেন অত্যন্ত কোপনস্বভাবা নারী। বায়রন ছিলেন জন্ম থেকেই খোঁড়া। বদমেজাজী মা খোঁড়া ছেলেটির প্রতি ছিলেন অত্যন্ত নির্মম, কঠোর। ছেলেটিকে তার খঞ্জতার জন্য খোঁটা দিতেন সর্বসময়। অস্থির
জ্বালাতন করতেন সন্তানকে; এবং খঞ্জতার ত্রুটি সংশোধনের জন্য তিনি দৈহিক ক্লেশ দিতেন তাতে স্বীয়রনের শিশু মনকে করে তুলেছিল একগুঁয়ে, বদমেজাজী এবং উগ্রপ্রকৃতির। দশবছর বয়সে পিতামহের সূত্রে লর্ড উপাধি পেয়েছিলেন। স্কটল্যাও ছেড়ে চলে এসেছিলেন লণ্ডনে। এখানে তিনি বিদ্যালাভ করেছেন হ্যারো এবং কেমব্রিজে। সুপুরুষ চেহারার অধিকারী ছিলেন বায়রন। ক্রিকেট, সাঁতার, ঘোড়ায় চড়া, লড়াইয়ে সব কিছুতেই ছিল অপূর্ব দক্ষতা। সকলের দৃষ্টি কেড়ে নেবার মত ছিল তাঁর আচার-আচরণ। নারীপ্রেমেও তিনি কম দক্ষ ছিলেন না। বার বছর বয়েস থেকে মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করতে শুরু করেছেন। উল্টোভাবে বলা যায় যে বুড়ো, ধাড়ী মেয়েরা তাঁর সঙ্গে প্রেম করতে শুরু করেছেন। ফলে প্রাণচঞ্চলতায় উদ্দাম এই তরুণটির মন রোমান্টিক আবেগের উষ্ণতায় ছিল গনগনে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাঁর প্রথম কাব্য প্রকাশিত হয়। কাব্যটির নাম হল “আওয়ার্স অব আইডেলনেস”। সমালোচনা পত্রিকা “এডিনবরা রিভিউ” বায়রনের কাব্যটির তীব্র সমালোচনা করে। বায়রন রুখে দাঁড়ালেন। সমালোচকদের বিরুদ্ধে এমনই ব্যঙ্গের মূষল নিক্ষেপ করলেন যে সমালোচকরা তাতেই আহত হয়ে নীরব হয়ে গেল। ব্যঙ্গ রচনাটি হল “ইংলিশ বার্ডস এবং স্কচ রিডিয়ার্স (১৮০৯)। শুধু তাই নয় রচনাটিও ব্যঙ্গ রচনা হিসাবে সাহিত্যে নিজের স্থান করে নিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষে ১৮০৯ সালে বায়রন ‘হাউস অব লর্ডসে’র সভায় যোগ দিতে লাগলেন। এতে কোন আনন্দ পেলেন না তিনি। বন্ধুকে নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লেন। নানা দেশ ভ্রমণ করে ইংলণ্ডে ফিরে এলেন ১৮১১ সালে। এ সময়ে তাঁর ঘটল মাতৃবিয়োগ। বায়রন মায়ের কাছ থেকে অনেক যন্ত্রণা পেয়েছেন। তবুও তিনি ছিলেন মাতৃভক্ত। কারণ মা শুধু গঞ্জনা দিতেন না, ভালবাসতেনও বায়রনকে। তাই বায়রন বিদেশে মাকে চিঠি লেখেন মনের কথা প্রকাশ করে। যে সব স্থানগুলি তিনি পরিভ্রমণ করেছেন তার কতকগুলিকে নিয়ে তিনি “চাইন্ড হ্যারল্ড পিলগ্রিমেজ” নামে কাব্য প্রকাশ করেন (১৮১২)। দু-সর্গের এই কাব্যটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে খ্যাতির শিখরে উঠে গেলেন বায়রন। ভক্ত এবং স্তাবকের দলের অভাব হল না। প্রাচ্য ইতিহাস পাঠে গভীর আগ্রহ ছিল বায়রনের। প্রাচ্যের জীবন নিয়ে কাব্য রচনা করতে লাগলেন। ইউরোপ এবং প্রাচ্যে বায়রনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। বায়রনের সঙ্গিনীর অভাব ছিল না। বহু নারী তাঁর সঙ্গে প্রেমে লিপ্ত ছিল। তা সত্ত্বেও বায়রন এমন একজনকে জীবনসঙ্গিনীরূপে বেছে নিলেন যার ব্যক্তিত্বের কাছে তিনি পরাভূত হলেন। দাম্পত্য জীবন একবছরের বেশী স্থায়ী হয়নি। বৈমাত্রেয় ভগ্নীর সঙ্গে বায়রনের অবৈধ প্রেমের সম্পর্ক থাকার জন্য লেডি বায়রন ১৮২৬ সালে বায়রনকে চিরকালের জন্য ছেড়ে চলে যান বাপের বাড়ীতে। এরপরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে যায়। সারা দেশে এই নিয়ে ঢি ঢি পড়ে যায়। লোকালয়ে হেয় হওয়ার ফলে এবং চরিত্রহীনতার মুখর নিন্দায় অতিষ্ঠ হয়ে তিনি চিরকালের জন্য ইংলণ্ড ত্যাগ করেন। কিন্তু সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন প্রচণ্ড ক্রোধ, ঘৃণা আর প্রতিহিংসা।
বায়রন ছিলেন অদম্য উদ্দাম প্রাণের অধিকারী। কোন প্রতিকূল অবস্থাতেই তিনি ভেঙ্গে পড়তেন না। বেপরোয়া জীবনের জটিল আবর্তের মধ্যে পড়েও তিনি নিজেকে ঠিক রেখেছেন। কাব্যের পর কাব্য রচনা করেছেন। ইতালিতে শেলীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছেন। শেলীর মরদেহ নিয়ে শবানুগমন করেছেন। জীবনের শূন্যতাকে মানব প্রেমের রসে পূর্ণ করেছেন। মুক্তির আলোকমত্রে দীক্ষিত কবি গ্রীসের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়ে স্বাধীনতার বেদীমূলে আত্মদান করে শহীদের মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৩৬ বৎসর। তাঁর মরদেহ ইংলণ্ডে এনে সমাধিস্থ করা হয়েছিল।
বায়রন একটা নির্ভীক উদ্দাম, মুক্ত প্রাণবন্যার আবেগে প্রদীপ্ত কবি। সব কিছুতেই তাঁর বাঁধনহারা উদ্দামতা, একাত্মতা। তরুণ যৌবনের বাউল আপন মনের একতারাতে বিদ্রোহের সুর বেঁধে নিয়ে জীবনের পথে যাত্রা শুরু করেছিল। যাত্রা শুরু করেছিল নতুন জাগরণের, নতুন সমুদ্রতীর পানে। “চাইল্ড হ্যারল্ড পিলগ্রিমেজ” কাব্যে সেই জাগরণের মন্ত্রধ্বনি ঘোষিত হয়েছে। এই কাব্যের শুরুতেই তাই শোনা যায় সেই জাগরণের ঘোষণা-“জাগো। জাগো স্পেনের পুত্ররা। জাগো। অগ্রসর হও!” প্রথম দুটি সর্গে কবি যেন সকল মুক্তিকামী মানুষকে সংগ্রামের তরে ঘরে ঘর প্রস্তুত হতে বলেছেন। আবার এখানে প্রকৃতির সঙ্গে মিলে মিশে একাত্ম হয়ে গিয়েছেন। এখানে কবি সত্যিই মুক্তিপথের তীর্থযাত্রী ছিলেন। তৃতীয় এবং চতুর্থ সর্গ অনেক পরে রচিত। জীবনের এক দুঃসহ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন তখন। তাই তার প্রভাব এই সর্গগুলিতে থাকা অসম্ভব কিছু নয়। কখনও মনে হতে পারে যে কবির মন বিষণ্ণতার ভারে আচ্ছন্ন, কখনও মনে হতে পারে, তিনি দিশেহারা, লক্ষ্যহারা। মনে হতে পারে, তিনি তাঁর স্বহস্তে রচিত দুঃসহ জীবনের জন্য আক্ষেপই করেছেন- “The thorns which I have reaped are of the tree 1 planted, they have torn me, and bleed”, কিন্তু এই আক্ষেপ, বিষাদ, অবসাদ, ব্যর্থতা এবং হতাশার সুর সব নয়। কবির মনের ইচ্ছা তিনি হবেন পৃথিবীর পদানত মানুষের মুক্তি সংগ্রামের যোদ্ধা। তাঁর বাণী তিনি প্রচার করে যাবেন বলিষ্ঠ ভাষায়। তার জন্যেই তো কাব্য রচনা। কাব্যের বাণীতে তাই বজ্রনির্ঘোষ ধ্বনি শোনা যায়, শোনা যায় উত্তেজনার তীক্ষ্ণ তীব্রতা। তিনি একজন স্পার্টার যোদ্ধার মত মৃত্যু বরণ করতে চেয়েছেন। মৃত্যুর পর তাঁর ইচ্ছা-And be the Spartan’s epitaph on me!”
বায়রন অতীতের সমস্ত কিছুকে অস্বীকার করে নতুনকে বরণ করে নিয়েছেন। তাই ওয়াটারলুর যুদ্ধের বিজয়ী নায়ককে আক্রমণ করতে তিনি দ্বিধা করেন না। বায়রন রেখে ঢেকে কিছু বলেননি। প্রাণ যা চেয়েছে তাই বলেছেন। “ডন জুয়ান” কাব্যে কবি ইংলণ্ডের সমাজের রীতিনীতি, আচার-আচরণ, প্রেম-ভালবাসা, রাজনীতি, অর্থনীতি সমস্ত কিছুকেই ব্যঙ্গের কশাঘাতে জর্জরিত করেছেন। ভদ্রতার আবরণে ভণ্ডামির কালো কুৎসিত চেহারাটাকে সব মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। নারীদের মধ্যে তিনি কোথাও প্রেমময়ী খুঁজে পাননি। অধিকাংশ নারীই যেন কপট প্রেমের প্রতিমূর্তি। কবি ‘সাদে’ এবং ‘কোলরীজকে’-ও আক্রমণ করেছেন তাঁদের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের জন্য। “এ ভিশন ও জাজমেন্ট” কাব্যে বায়রন ‘সাদেকে’ গণতন্ত্রের শত্রু এবং রাজতন্ত্রের চাটুকার রূপে বর্ণনা করেছেন। বায়রনের কাছে রাজতন্ত্র মানেই স্বৈরতন্ত্র। বায়রন স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে জ্বলে উঠে বলেছেন:
For I will teach, if possible,
The stones of rise against earth’s tyrants.
বায়রন ধর্মের ভণ্ডামিকে সহ্য করেননি। “ম্যানফ্রেড” এবং ‘কেঈন’ কাব্যে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। ধর্মকে এমনভাবে আঘাত করেছেন যে রক্ষণশীল সমাজ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। এখানেও সেই একই মুক্তির জন্য তাঁর প্রবল আর্তি। কোন প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে ও ব্যবস্থাকে তিনি মেনে নিতে রাজি নন। কারণ তিনি সেগুলিকেই মনে করেন একটি শৃঙ্খল বিশেষ।
অবাধ স্বাধীনতার পূজারী বায়রন প্রেমের ক্ষেত্রেও কোন নীতি নিয়মকে মানেননি। প্রেমকে নীতি নিয়মের নিগড়ে বেঁধে রাখলে প্রেম তার সৌন্দর্য্য, তাঁর প্রাণোত্তাপ হারায় তার সহজ বিকাশের পথকে করে রুদ্ধ। প্রেম সব সময়েই নির্দোষ, পবিত্রা। নীতি নিয়মের মধ্যে তাকে রুদ্ধ করলেই সে পবিত্রতা হারায়।
সব কিছু সম্বন্ধে এত বাধাবন্ধন হীন উদার ভাবনাকে অনেকেই স্বীকার করে নিতে পারেননি বলেই বায়রনকে কেউ বলেছেন শয়তান, কেউ বিদ্রোহী ও ভয়ানক। আসলে বায়রন একটা আগ্নেয়গিরি, একটা কালাপাহাড়।
পার্শি বিশী শেলী (১৭৯২-১৮২২)
গ্রামের এক অভিজাত পরিবারে শেলীর জন্ম। আদর্শবাদী পিতার সন্তান। আপন গৃহের মধ্যে বোনদের সঙ্গে শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছে। তারপর ইটন স্কুলে। সেখানে শেলীর অভিজ্ঞতা ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। কোন রকম জোরজুলুমের তিনি ছিলেন বিরোধী। স্কুল শিক্ষকের হাতের বেতকেও তিনি ঘৃণা করতেন। তিনি আর সব ছাত্রদের থেকে একটু স্বতন্ত্র ধরনের ছিলেন। তাই শেলীর সঙ্গে তাদের বনিবনা ছিল না। স্কুল জীবন সমাপনান্তে তিনি ১৮০৮ সালে অক্সফোর্ডে ভর্তি হন। বয়স আঠার। ক্লাসিক্যাল সাহিত্যে তখন তিনি যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছেন। এখানেই তাঁর ভাগ্নী হ্যারিয়েট যোভের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পরিচয় হয়েছিল টমাস জেফারসন হগের সঙ্গে। হগ ছিলেন সংশয়বাদী, টোরী দলের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। সব কিছুতেই সংশয় প্রকাশ করা ছিল তাঁর অভ্যাস। শেলীর মধ্যে তা প্রভাব বিস্তার করেছিল। ফলে শেলী রচনা করে ফেললেন “দি নেসেসিটি অব এ্যাথেইজম” (নাস্তিকতার প্রয়োজনীয়তা)। আত্মপ্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে ঝড় উঠল।
শেলী এবং তাঁর বন্ধু টমাস হগকে বিদায় নিতে হল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত শেলীর জীবন এক অনিশ্চিত ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে জড়িয়ে পড়ল। বাবা চেষ্টা করলেন হগের সংসর্গ থেকে মুক্ত করতে কিন্তু আস্কারা দিলেন শেলীকে শেলীর খুড়ো পিলফোল্ড এবং বোনেরা। ফলে শেলী অতি উৎসাহে বোন এলিজাবেথকেই ‘নাস্তিক’ বানিয়ে তুলতে চেষ্টা করল। শুধু বোনকে নয়, বোনের সহপাঠিনী বন্ধু হ্যারিয়েটকেও। হ্যারিয়েট ওয়েষ্টব্রক সম্ভ্রান্ত কফি হাউস মালিকের সন্তান। শেলী যখন হ্যারিয়েটকে ‘নাস্তিক’ বানালেন তখন দেখা গেল যে দুজন দুজনকে ভালবেসে ফেলেছেন। ফলে দুজনেই বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। ১৮১১ সালে এডিনবরায় বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হলেন। অনভিজ্ঞ দম্পতি। কষ্টের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে প্রথম প্রণয়ের উন্মাদনা গেল কেটে। প্রথমা কন্যার আবির্ভাবের সাথে সাথে দুজনের
মধ্যে অভাবের খুঁটিনাটি নিয়ে শুরু হল বিবাদ। তা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে দুজনকে বিচ্ছেদের প্রান্ত সীমায় টেনে আনল। এই সময় শেলীর সঙ্গে প্রখ্যাত লেখক উইলিয়ম গউইনের পরিচয় হয়। তাঁর ষোড়শী কন্যা মেরির সঙ্গে শেলী পড়লেন প্রেমে। আর এই প্রেম হ্যারিয়েটকে হানল প্রচণ্ড আঘাত। সহ্য করতে না পেরে হ্যারিয়েট আত্মহত্যা করে বসলেন। ফেলে রেখে গেলেন, দুটি
সন্তান যাদের ভার নেবার দায়িত্বও আদালত শেলীকে দিল না। হ্যারিয়েটের মৃত্যুর কয়েক মাস পরে শেলী মেরীকে বিবাহ করেন। সেটা ১৮১৬ সাল। বেশ কিছুদিন ধরে শেলীর শরীর ভাল যাচ্ছিল না। দেশভ্রমণে বেরিয়ে ইতালিতে এলেন। এখানেই বসবাস করতে লাগলেন। এখানে লে হান্ট, পিকক্, হগ প্রভৃতি বন্ধু জুটেছিল। ইতালির জীবন শেলীর বেশ সুখেই কাটছিল। কিন্তু সে জীবনেও এল সমাপ্তি। শেলী চিরকালই অস্থির মতি। ১৮২২ সালের জুন মাস। লে হান্ট বায়রনের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। জুলাই মাসের ৮ তারিখ। শেলী বন্ধু উইলিয়মকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ক্ষুদ্র নৌকাটা আনার জন্যে বেরিয়ে গেলেন। সেদিন সন্ধ্যায় শুরু হল প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি। সেই ঝড়ের মুখে পড়ে শেলীর নৌকা গেল ডুবে। পনের দিন পরে তাঁদের মৃতদেহ ভেসে উঠল সমুদ্রের তটভূমিতে। শেলীর পকেটে তখনও ছিল সফোক্লিস ও কীটসের কবিতার বই।
শেলীর রচিত কাব্য কবিতা, নাটক ও প্রবন্ধ:-
শেলীর প্রথম রচিত কাব্য হল “কুইন ম্যাব” (১৮১৩)। পরবর্তী কাব্য হল “অ্যালাষ্টার” (১৮১৫), “দি রিভোল্ট অব ইসলাম” (১৮১৭) ইতালিতে বাস করার সময় শেলী যে কাব্য এবং নাটকগুলি রচনা করেছেন তা হলো, “প্রমিথিউস আনবাউণ্ড” (১৮১৮-১৯), “দি চেনসি” (১৮১৯), “জুলিয়ান এও ম্যাউডালো” (১৮১৮), “দি মাস্ক অব এনাকি” (১৮১৯), “দি উইচ অব এটলাস” (১৮২০), “এপিসাইচিডিয়ন” (১৮২১), “এডোনিস” (১৮২১) এছাড়া বেশ কয়েকটি নীতিকবিতা। তাঁর সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ হল “দি ডিফেন্স অব পোয়েট্রি’ (১৮২১)।
শেলীর কাব্যজীবন চেতনার মূল সুর:
শেলীর কবি জীবনকে দুটি অধ্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম অধ্যায়ের মধ্যে ফুটে উঠেছে তারুণ্যের স্বভাবধর্ম। তিনি প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। সেদিন শেলীর জীবনের মূলমন্ত্র ছিল “ভাঙ্গ, ভাঙ্গ কারা, আঘাতে আঘাত কর”। ভগবানের নামে যাজক সম্প্রদায়ের ভণ্ডামিকে তিনি সহ্য করতে পারেননি। শুধু যাজক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করেননি, খোদ ঈশ্বরের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করেছেন। এই বিদ্রোহের রাঘামশালের আগুনে প্রাণহীন জীর্ণ সমাজের বুকে আগুন লাগাতে চেয়েছেন, নতুন সমন্ধ গড়তে চেয়েছেন পশ্চিমাঝড়ের তাণ্ডব নৃত্যে সব কিছুকে ভেঙ্গেচুরে দিয়ে। সেদিন শেলী ছিলেন ফরাসী বিপ্লবের সমর্থক, রুশো প্রবর্তিত আদর্শের পূজারী।
কিন্তু শেষ অধ্যায়ে শেলীর জীবনের ভাবনা ভিন্নপথে পরিবর্তিত হয়েছে। প্রথমতঃ, গডউইন পরিবারের প্রভাবের ফলে শেলীর তরুণ বয়সের বিশ্বাসের মূলে দোলা লেগেছে। দ্বিতীয়তঃ, ইতালির হৃদয়হরণকারী প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সুনীল আকাশের রৌদ্রকরোজ্জ্বলতা, পাইন সমাচ্ছন্ন অরণ্যের সবুজ ঔজ্জ্বল্য কবিকে মুগ্ধ করেছিল। প্লেটোর দার্শনিক মতবাদ সেদিন কবি চিত্তকে অধিকার করেছিল। এর ফলে কবির কাছে ফরাসী বিপ্লবের বাণী ও রুশোর আদর্শ যা একান্তভাবে সত্য ছিল তা মিথ্যায় পরিণত হল। যে জীবনকে তিনি সমাজের মৃত্তিকায় বিকশিত হতে দেখেছিলেন, মানুষের প্রতি সুগভীর প্রেম নিয়ে, আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান হয়ে যে জীবনকে তিনি দেখেছিলেন, সংশয়হীন চিত্তে যে জীবনের স্বরূপকে আরতি করেছেন, সেই জীবন ও জগৎকে ত্যাগ করে তিনি আধ্যাত্মিক চেতনার তরণীতে চেপে আত্মার রহস্য-সন্ধানে অনির্দেশ্য লোকে যাত্রা শুরু করলেন। তাঁর কাছে মনে হল, জীবন রহস্যময়। আত্মার অমরত্বের সন্ধানে যাত্রা করে তিনি উপলব্ধি করলেন, যে “The one remains, the many change and pass.” তিনি জানতে পারলেন, যে আত্মা পরমাত্মার অংশ বিশেষ। জাগতিক বন্ধনের মধ্যেই তার মহিমা ক্ষুণ্ণ হয়। মৃত্যুর পর সেই আত্মা পরমাত্মায় বিলীন হয়ে হয় মহিমান্বিত। তবু কুহেলিকার পর্দাখানা ছিঁড়ে ফেলে সত্যের অখণ্ড মূর্তি দেখবার জন্যে তাঁর একটা ব্যাকুলতা ছিল। সেই ব্যাকুলতর জিজ্ঞাসার আকুলতর আর্তি হল, “Then, what is life?”
সুতরাং যে ফরাসী বিপ্লবের মন্ত্রধ্বনিকে জীবনের পাথেয় করে একদিন তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “Master theme of Epoch in which we live” জীবনের আর এক অধ্যায়ে তাকে অস্বীকার করে তিনি ব্যক্ত করলেন, “The doctrine of the French and the material philosophy are as false as they are.” শেলী যেন নিজের হাতে নিজেই মর্তের মৃত্তিকার পরে প্রস্ফুটিত পুষ্প তরুটিকে ধ্বংস করেছেন।
প্লেটোর দার্শনিক মতবাদের প্রকাশ ঘটেছে তাঁর “এডোনিস” কাব্যে। কাব্যটি শোকগাথা। কবি কীটসের মৃত্যু উপলক্ষে রচিত। কিন্তু কাব্যটির মধ্যে যে সত্যের মর্মকথা তিনি প্রকাশ করলেন তা হল মানুষের জীবন ছায়াবাজির মত চঞ্চল, ও ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু আত্মাই অবিনাশী। মৃত্যুও তাকে ধ্বংস করতে পারে না। মৃত্যু তাকে মুক্ত করে অনন্তের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। মৃত্যুর পর আত্মা পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যায়। এই পরমাত্মা হল স্বয়ং ঈশ্বর। “The pure spirit shall flow back to the burning fountain when it came a portion of the eternal.” তাই মৃত্যু তো মৃত্যু নয়, কেবল স্বপ্ন হতে জেগে ওঠা।
শেলীর প্রেম আত্মপ্রত্যয় দৃঢ়। কারণ শেলী প্রধানতঃ মানবপ্রেমিক। এই মানব প্রেমই শেলীকে বিদ্রোহী হতে শিখিয়েছিল। মানব প্রেমের রক্ষা কবচ অঙ্গে ধারণ করে শেলী পশ্চিমাঝড় হতে চেয়েছিলেন। ‘প্রমিথিউস আনবাউণ্ডে’ তিনি প্রমিথিউসকে একজন আপসহীন মানব প্রেমিকরূপে চিত্রিত করেছেন এবং বিশ্বকে মুক্ত করে প্রেমের দ্বারা পরিশোধিত করতে চেয়েছেন। শেলীর প্রেম মৃত্যুঞ্জয়ী, সর্বজয়ী। মৃত্যু, দুঃখ, বেদনায় বন্ধুর যে পথ সেই দুর্গম পথেই শেলীর প্রেমরথ ছুটে চলে। প্রেম মানুষের শুভ বুদ্ধিকে, নৈতিক চেতনাকে করে উদ্বোধিত। প্রেম মানুষকে স্বার্থপরতা, নীচতা, বর্বরতার হাত থেকে মুক্তি দেয়। “Love is celebrated everywhere as the sole law which should given the moral world.”
শেলী আপসহীন রোমান্টিক কবি। রোমান্সের ডানায় ভর করে কবি প্রকৃতির মধ্যে আশ্রয় নিয়েছেন। রোমান্টিক কবির কাছে প্রকৃতি হল মুখ্য, মানুষ গৌণ। তাই শেলী যেখানে প্রকৃতি প্রেমে আত্মহারা সেখানে বাস্তব পৃথিবীর মানুষগুলিকে ভুলে গিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে এক হয়ে গেছেন। তিনি চলে যেতে চেয়েছেন মনুষ্য বসবাসহীন সেই অরণ্যলোকে যেখানে সমাজ ও সমাজের বিধি-নিষেধের কঠিন বাঁধন নেই, আছে শুধু মুক্তির আনন্দ।
Away, away, from men and towns To the wild wood and the downs To the silent wilderness
Where the soul need not repress
its music.
নিসর্গ প্রকৃতি শেলীর কাছে সান্ত্বনার স্থল, বেদনার প্রলেপ, প্রেরণার উৎস, দুঃখরাতের তারা। তবুও শেলীর মন রোমান্টিক বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন। কি যেন চেয়েছেন অথচ পাননি। এই না পাওয়ার বেদনাই কবিকে করেছে পীড়িত, রক্তাক্ত। অথচ যা পেয়েছেন তা তিনি চাননি। হয়ত অনেক কিছুই চেয়েছেন যা পাওয়া সম্ভব ছিল না। শেলীর কামনার অতৃপ্তির ব্যাকুল বাঁশরী বিশ্বজগতকে বেদনায় মূহ্যমান করে দেয় যখন তিনি ক্ষোভের সঙ্গে উচ্চারণ করেন,
Move my faint heart with grief, but with delight
No more Oh never more!
শেলী অতিমাত্রায় অতিন্দ্রিয়বাদী। সৌন্দর্য্যের অতিন্দ্রিয় জগতে তিনি তাঁর আসন পেতেছেন। তাই শেলী অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য। প্রমিথিউস আনবাউণ্ড হল নাট্যগীতি। এই গীতি নাট্যটির রচনাকাল ১৮১৮-১৮১৯। শেলী তখন ইতালিতে। চিরকালের জন্য তিনি ছেড়ে চলে গেছেন ইংলণ্ড। অথবা ইংলণ্ড ছেড়ে চলে যেতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু শেলী যে অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন তাতে তিনি নিজেকে প্রমিথিউস-এর মতই মনে করেছেন। মানব-প্রেমিক প্রমিথিউস মানবের কল্যাণের জন্য দেবতাদের নিজস্ব ধন আগুনকে আহরণ করে মানুষকে তা উপহার দিয়েছিলেন। মানব বিদ্বেষী দেবরাজ জুপিটারের কড়া আদেশ ছিল মানুষকে আগুনের ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। সে আদেশ অমান্য করেছিলেন প্রমিথিউস। ফলে জুপিটারের
নির্দেশে প্রমিথিউসকে বন্দী করে হাতে-পায়ে শিকল এঁটে পাহাড়ের গায়ে বেঁধে রাখা হয় এবং প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয়। কিন্তু প্রমিথিউস শত দুঃখ-কষ্ট, বেদনা ও নির্যাতন সহ্য করেছেন তবু নতজানু হয়ে দেবরাজের কাছে আত্মসমর্পণ করেন নি। বরং বুক পেতে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে মৃত্যুকে অমৃতের মত পান করে তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে গেলেন। প্রমিথিউসের সংগ্রাম ছিল অত্যাচারী স্বেচ্ছাচারী শাসকের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম। তাই প্রমিথিউস দেবরাজ জুপিটারকে স্বেচ্ছাচারী টাউরান্ট বলে অভিযুক্ত করেছেন। মানব-বিদ্বেষী বলে তাকে নিন্দা করেছেন। প্রমিথিউসের এই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কাহিনীকে প্রথম রূপদান করেন গ্রীক নাট্যকার ইস্কাইলাস। শেলী গ্রীক নাট্যকারের সেই ভাবনাকে যুগোপযোগী করে আরো তীক্ষ্ণ তীব্র করে নাট্যরূপ দিয়েছেন। শেলী নিজেই তাঁর সমাজের অন্যায়, অত্যাচার, কপটতা, ভণ্ডামি, ধর্মের নামে শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন তাই তাঁকে ইংলণ্ড ছাড়তে হয়েছিল। তিনিও প্রমিথিউসের মত অনমনীয় চিত্ত এবং ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তায় দৃপ্ত। তাই তিনি আত্মসমর্পণ করবেন না। কারণ তিনি জানেন, পৃথিবীর কোন শক্তিই মানবপ্রেমের দুর্ভেদ্য দূর্গকে ধ্বংস করতে পারবে না। মানবপ্রেম মৃত্যুঞ্জয়ী, চিরজয়ী। অত্যাচার নিপীড়নকে অবজ্ঞা করে মানবপ্রেম যুগে যুগে হয়েছে জয়ী, উড়িয়েছে তার বিজয়-বৈজয়ন্তী। সেই আপসহীন সংগ্রাম এবং চিরজয়ী প্রেমের বাণী ঘোষিত হয়েছে “প্রমিথিউস আনবাউণ্ডে”।
জন কীট্স্ (১৭৯৫-১৮২১)
জন্ম লণ্ডনে। তাও আবার সোয়ান ও হুপইন আস্তাবলের মধ্যে। বাবা টমাস কীট্ট্স ছিলেন প্রথমে ভাড়াটে ঘোড়ার আস্তাবলের কর্মচারী পরে সেই আস্তাবলের মালিকের কন্যা জেনিংসকে বিবাহ করে সেই ব্যবসায়ের মালিক হয়ে যান। কীটস্ এরা চার ভাই, এক বোন। একভাই শৈশবে মারা যায়। কীটসের বাবার আর্থিক অবস্থা বেশ ভাল ছিল। অবস্থাপন্নই ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন যে ছেলেদের লেখাপড়ার জন্য তাদেরকে হ্যারোতে পাঠাবেন কিন্তু তা হোল না। এনফিল্ড-এর একটা নামকরা স্কুলে ছেলেকে ভর্তি করে দিলেন। এখানে প্রধান শিক্ষকের ছেলে চার্লস কাউনডেন ক্লার্ক-এর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে। কাউনডেন ক্লার্ক ছিলেন একজন পণ্ডিত ব্যক্তি এবং সঙ্গীতজ্ঞ। তিনি কীসের মনে কবি কল্পনা বা কাব্য রচনা ও আস্বাদনের প্রেরণা জুগিয়ে দেন। ছোটবেলায় অবশ্য কীটসের পড়াশুনায় মন ছিল না। কেবল মারপিট আর মারামারিতে তাঁর উৎসাহ ছিল। কিন্তু স্কুলে এসে কাউডেন ক্লার্ক-এর সান্নিধ্যে তিনি এলিজাবেথীয় কবি স্পেন্সার ও নাট্যকার শেক্সপীয়রের কাব্য ও নাটকের সঙ্গে পরিচয় লাভ করেন। চ্যাপম্যান অনুদিত হোমারের ইলিয়াড-এর সঙ্গেও তাঁর পরিচয় ঘটে। ১৮০৪ সালে বাবা মারা যান। মা দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিবাহ সুখের না হওয়ায় তিনি বাপের বাড়ী চলে আসেন। ১৮১০ সালে তিনি ক্ষয়রোগে মৃত্যুমুখে পতিত হন। কীটস-এর সেবা এ সময় তুলনাহীন। যাই হোক দিদিমা কীট্ট্সকে স্কুল ছাড়িয়ে একজন চিকিৎসকের অধীনে শিক্ষানবিসের কাজে নিযুক্ত করে দেন। কিন্তু কীটস কিছুদিন পরে ডাক্তার হ্যামণ্ডের সঙ্গে ঝগড়া করে শিক্ষানবিসি ছেড়ে দিয়ে ১৮১৪ সালে লণ্ডন চলে আসেন। এখানে সেন্ট টমাস হাসপাতালে বেশ কিছুদিন ধরে হাতে-কলমে ডাক্তারি বিদ্যা শিখলেন। কিন্তু কীটসের জন্য এসব নয়। তাঁর ভাবুক মন তখন ছুটে চলেছে কাব্যের মায়াময় জগতে। ১৮১৭ সালে ওসব ছেড়ে দিয়ে কাব্যের জগতে পুরোপুরি আত্মনিমগ্ন হলেন। এ সময়ে তিনি যাঁদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন তাঁরা হলেন কবি জন হ্যামিলটন রেনল্ড, চিত্রশিল্পী সেভার্ণ, সমালোচক হ্যাজলিট, কোলরীজ, ল্যাম্ব, শেলী। কীট্স-এর জীবনে প্রথম আঘাত এল যখন
মেজভাই জর্জ কীটস আমেরিকা চলে গেল এবং ছোটভাই টম কীটস ক্ষয়রোগে মারা গেল। কীটসের জীবনে শূন্যতা। সাধারণ মেয়ে ফ্যানী ব্রনীর প্রেমে পড়লেন। কিন্তু ইতিমধ্যে ক্ষয়রোগে তাঁকেও আক্রমণ করেছে ফলে কীটসের জীবনে প্রেমের মাধুর্য্য অপেক্ষা যন্ত্রণাই বৃদ্ধি পেল। বন্ধুরা তাঁকে নিয়ে এলেন স্বাস্থ্য পরিবর্তনের জন্য ইতালিতে। কোন সুরাহা হল না। ১৮২১ সালে ২৮শে ফেব্রুয়ারী মাসে ২৫ বছর বয়সে কীটস ইহলোক ত্যাগ করে চলে গেলেন। রোমের প্রোটেস্টান্ট সমাধিভূমিতে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর স্বরচিত বাণী লেখা হল সমাধিভূমির উপর “এখানে এমন একজন শায়িত, যাঁর নাম বারি ধারায় লেখা হয়েছিল।
কীসের রচনা:-
তাঁর প্রথম রচনা “ইমিটেশন অব স্পেন্সার” (১৮১৩) আঠার বছর বয়সে রচিত। ১৮১৭সালে তাঁর কবিতার প্রথম খণ্ড আত্মপ্রকাশ করে। খণ্ডটির নাম “পোয়েমস”। এই গ্রন্থটি লে হান্টের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। এর কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা হল “অন ফাস্ট লুকিং ইনটু চ্যাপম্যানস হোমার”, “স্লিপ এন্ড পোয়েট্রি”, এবং “আই স্টুড টিপ-টো আপন এ লিট্ল হিল”। পরবর্তী খণ্ড ১৮১৮ সালে “এণ্ডাইসিয়ন” নামে প্রকাশিত হয়। এই কাব্যটির কাব্যমূল্য সম্বন্ধে সমালোচকদের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও কাব্যের প্রথম ছত্রটি “A thing of beauty is a joy for ever” (সুন্দর বস্তু মাত্রই চিরকালে আনন্দ) কেবলমাত্র কবি কীসের কাব্যজীবনের মন্ত্রধ্বনি ছিল না, এর মর্মসত্য অনেক কবিকেই করেছে উদ্বোধিত, জুগিয়েছে প্রেরণা, করেছে সুন্দরের পূজারী। ব্ল্যাকউড ম্যাগাজিন এবং কোয়াটার্লি ম্যাগাজিনের কঠিন সমালোচনার তীক্ষ্মধার দাঁতের আঘাতেও তা বিক্ষত হয়নি। বরঞ্চ ঐ একটিমাত্র ছত্রই কালের কপোলতলে সমুজ্জ্বল হয়ে রইল। তাঁর শেষ কাব্যখণ্ড “লামিয়া এণ্ড আদার পোয়েন্স” প্রকাশিত হয় ১৮২০ সালে। তিন খণ্ডে তাঁর সমগ্র রচনা প্রকাশিত হয়। শেষের খণ্ডটিতে রয়েছে কীটসের পরিণত প্রতিভার আলোকে সৃষ্ট কাব্যগুলি। যেমন, “ইসাবেলা” (১৮১৮), “হাইপেরিয়ান” (শুরু ১৮১৮, পরিত্যক্ত ১৮১৯) “দি ইভ-অব সেন্ট অ্যাগনেস” (১৮১৯), “দি ইভ অব সেন্ট মার্ক” (১৮১৯), “লামিয়া” (১৮১৯), “দি ফল অব হাইপেরিয়ন” (১৮১৯)। এ ছাড়াও বিখ্যাত ওডগুলি যেমন, “টু এ নাইটিঙ্গেল”, “অন এ গ্রেসিয়ান আর্ন”, “টু সাইকি”, “অন মেলানকোলি”, “টু আটম” ইত্যাদি। তাঁর মৃত্যুর পর যে কবিতাগুলি প্রকাশিত হয় তার মধ্যে “লা বেলে ডেম সানস্ মারসি” অন্যতম। আর আছে তাঁর অতুলনীয় পত্রাবলী। চেষ্টা করেছিলেন নাটক রচনা করতে; পারেন নি। “কিং ষ্টিফেন” এবং “ওথো দি গ্রেট” অসমাপ্ত রয়ে গেল।
কীসের কাব্যচেতনার স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য:
কীটস রোমান্টিক যুগের সর্বকনিষ্ঠ কবি। তাঁর আবির্ভাব রোমান্টিক যুগের মধ্যাহ্নক্ষণে। কারণ এই সময়ে ইংরাজি সাহিত্যের জলাভূমিতে রোমান্টিকতার প্লাবন, উঠেছে তুফান। যাঁরা এনেছেন, তাঁরা শিক্ষা-দীক্ষায় ছিলেন অনেক বেশি উচ্চে। কিন্তু কীটস কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সদর দেউড়ি পার হয়ে আসেন নি। এমন কি স্কুলের গণ্ডীও পার হতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী থাক বা নাই থাক বিশ্বসাহিত্যের দরবারে আসন প্রতিষ্ঠা করে নেবার মত প্রতিভা কীটসের ছিল। তিনি অজস্র পড়েছেন এবং যা পড়েছেন তাকে আত্মসাৎ করে নেবার মত ক্ষমতা তাঁর ছিল। তাঁর জানার আগ্রহে যেমন ত্রুটি ছিল না, তেমনি ছিল না আয়োজনের। তিনি স্পেন্সারের কাব্যের পরীরাজ্যের স্বপ্নলোকেও উধাও হয়েছেন, চ্যাপম্যান রচিত মোমরের ইলিমিড কাব্যের প্রাচীন ও অতীত যুগে যাত্রী করেছেন, তিনি মিলটনের মহাকাব্যের হোমারের ইলিয়াতেছেন। আকণ্ঠ ভরে
পান করেছেন শেক্সপীয়রের সৌন্দর্যসুধাকে। ওয়ার্ডসওয়ার্থের নির্জন প্রকৃতিলোকে তিনি অভিসার করেছেন। সবশেষে লে হান্টের প্রভাব থেকেও তিনি মুক্ত নন। সুতরাং মাত্র পাঁচ বছরের সীমিতকালের মধ্যে কবি যে ফসল তুললেন এবং কাব্যের যে রূপমূর্তি রচনা করলেন তা যেন স্পেন্সার, হোমার, শেক্সপীয়র, মিলটন, ওয়ার্ডসওয়ার্থের থেকে সংগৃহীত বিচিত্র উপাদান নিয়ে সৃষ্টি এক অপূর্ব সৌন্দর্য্যময় মুরতি। সেই সঙ্গে কীট্স গড়ে তুলেছিলেন নিজের মত করে একটি ভাবসত্য। আবিষ্কার করেছিলেন জীবনের একটি নিখুঁত সত্যকে। সেখানে সংশয়, দ্বিধা, দ্বন্দু কিছুই ছিল না, ছিল বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয়। তাঁর প্রতিভার মণিদীপ দীপ্ত কক্ষে, জীবন জিজ্ঞাসার ধ্যানে গৃহে বসে যে সত্যকে জেনেছিলেন তা হচ্ছে “Beauty is truth, Truth beautiy” অর্থাৎ সৌন্দর্যাই সত্য, সত্য সুন্দর। ফরাসী বিপ্লবের কোন প্রভাব কীটসের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। তিনি আত্মসচেতন সমাজ-সংস্কারকও ছিলেন না। নতুন যুগের বাণীকে পাথেয় করে বিদ্রোহের রাঙা মশাল হাতে নিয়ে কাব্যে ওয়াটারলু সৃষ্টি করতে চাননি। তিনি কোন তত্ত্ব বা দর্শনকে কাব্যের মধ্যে প্রচার করতে বসেননি। তিনি আসলে হলেন আত্মভাবমুগ্ধ সৌন্দর্য্যরস-সম্ভোগের কবি। সৌন্দর্য্য পিপাসাই কীট্সকে মর্তমাধুরীর মহিমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। নিসর্গ প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্যের পাথারে আঁখি ডুবিয়ে কবি প্রাণের পাত্রটি পূর্ণ করেছেন। প্রকৃতির সৌন্দর্য্যকে পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে আরতি করেছেন। সে সৌন্দর্য্য নিছক সৌন্দর্য্য, বিশুদ্ধ সৌন্দর্য্য। সৌন্দর্য্যেই তার বিকাশ, সৌন্দর্য্যেই তার পরিণতি। তিনি কল্পনার কল্পলোকে বসে সেই সৌন্দর্য্যের ধ্যান করেছেন। তাঁর কাছে কল্পনার সৌন্দর্য্যই হল সত্য, বাস্তবে সে সত্যের অস্তিত্ব থাক বা না থাক। What the imagination on seizes as beauty must be the truth whether it existed or not. কবি চিরন্তন সৌন্দর্য্যের রূপকে ধ্যানের নয়নে দেখেছেন, সে সৌন্দর্য্য মৃত্যুহীন, ধ্বংসহীন। তাই কবির কল্পনার আকাশে যে নানা রঙের ছবি ভেসে ওঠে তার সৌন্দর্য্যই সত্য ও সুন্দর। কবির জীবনভিত্তিক সাধনা হল সত্য ও সুন্দরের সাধনা, যা কল্পনার বরণে রঞ্জিত। কীসের এই সৌন্দর্য্য-সম্ভোগকে বলা যেতে পারে- Disinterested love of beauty, প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ও বর্ণের বিচিত্র সমারোহের মধ্যে শিশুসুলভ উলঙ্গ দৃষ্টি তটস্থ, সমাহিত। তার দৃষ্টিতে ছিল সহজ-সরল-আদিম মানবের বিস্ময়ভরা ব্যাকুলতা। কবির দৃষ্টিতে এই যে wild surmise-এটাই ছিল তাঁর সৃষ্টির অমরীদুর্লভ প্রেরণা। তাঁর বিশেষত্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের সূক্ষ্ম ও সুকুমার ইন্দ্রিয়ানুভূতির। Oh! for a life of sensation, rather than thought অর্থাৎ চিন্তা বা কোন ভাবনা নয় শুধু অনুভূতির উচ্ছ্বাসই হল জীবন। এই সত্যকে অবলম্বন করে তিনি সৌন্দর্য্যের ধ্যান করেছেন।
কীটস খাঁটি কাল্পনিক ও রোমান্টিক। লঘু কল্পনার বিলাস কবিকে করেছে উন্মনা এবং সেই কল্পনার তীব্র অনুভূতি কবিকে করে চঞ্চল। কল্পনা সুন্দরীকে তিনি ধরতে চান, কিন্তু পারেন না। রহস্যময়ী কল্পনাসুন্দরী মাঝে মাঝে দেখা দিয়ে আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। অধরার মত সে রহস্যময়ী। প্রেমের অতৃপ্ত কামনার তীব্র আর্তি প্রকাশ পেয়েছে “লা বেলে ডেম স্যান্স মারসি”তে। “ইভ অব সেন্ট অ্যাগনেস” কবিতায় কবির অতৃপ্ত প্রেমের কামনার আর্তি তীব্রতর। ঝড়-ঝঞ্ঝা; বিপদ-আপদ, মৃত্যুকে তুচ্ছ করে, শত শত্রুর তরবারি হৃদয় বিদ্ধ করবে জেনেও প্রেমিক চলেছে প্রেমিকার সাথে মিলনের উদ্দেশ্যে। প্রেমের পথ মসৃণ নয়, বন্ধুর। দেহ মিলনের আত্যন্তিক আর্তি থাকলেও কবি জানেন তা সম্ভব নয়। কারণ প্রেমের আর্তি ততক্ষণই থাকে যতক্ষণ তাদের দেহ নিলনে পর্যবসিত হয় না। তাই প্রেমের আর্তিকে চিরন্তন করে রাখার জন্য কবির প্রেমিক-প্রেমিকা বানরকুঞ্জ রচনা করবে পরিচিত পৃথিবীর কোন চেনা স্থানে নয়; অচেনা, অদেখা দুর্গম কোন স্থানে। নায়ক পরফিরোর ভাষায় “For over the southern moons I have a home for
thee” এখানে কল্পনা লীলাছন্দে দোলায়িত। মোহময়ী কল্পনা, ছলনাময়ী কল্পনা কখনো কবিরে প্রতারিত করতে পারে না। কারণ কবির দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়- The fancy can not cheat so well
কল্পনার ডানায় ভর করে কবি পাড়ি জমালেন সুদূর অস্পষ্ট অতীতে। সে অতীত হল গ্রীসের সৌন্দর্য্যলোক। শেলী বলেছেন, “Keats was a Greek”, কীটসের প্রাচীন গ্রীক সৌন্দর্য্যপ্রিয়তার উৎসমুখ প্রধানতঃ তিনটি। প্রথমতঃ, গ্রীক সাহিত্যের প্রতি প্রবল অনুরাগ, দ্বিতীয়তঃ, গ্রীক ভাস্কর্য শিল্পের প্রতি প্রগাঢ় মোহ; তৃতীয়তঃ, তাঁর জন্মগত সৌন্দর্য্য সাধনা। “অন সিইং দি এলগিন মার্বেল”, “ওড ওন এ গ্রীসিয়ান আর্ন”, “ইভ অব সেন্ট অ্যাগনেস”, “হাইপেরিয়ন” প্রভৃতি কাব্য ও কবিতায় কবি গ্রীসের ভাস্কর্য শিল্পের পেলব মসৃণতা, সূক্ষ্ম কারুকার্য ও অসামান্য রূপকে নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। “ইভ অব সেন্ট অ্যাগনেস” কবিতায় চ্যাপেলের অভ্যন্তরে নানা দেবদেবীর মূর্তিগুলিকে জীবন্ত করে বর্ণনা করেছেন। সেই কক্ষের বাতায়নে নানারকম ফল-পল্লব ও লতার চিত্রাঙ্কন, নানা রত্ন ও প্রবালখচিত, সহস্র নাইট ও বিষণ্ণময়ী সন্ন্যাসিনীর চিত্র অতি সুন্দরভাবে ভাষায় অঙ্কন করেছেন। কীট্ট্স গ্রীক সৌন্দর্যের অমরাবতীতে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে প্রবেশ করেছেন। কোন জড়তা তাঁর মধ্যে ছিল না। তিনি যেন ডাগর ডাগর দুচোখে গ্রীক সৌন্দর্য্যকে দেখেছেন এবং দেবদেবী ও নরনারীর সঙ্গে তাদেরই ভাষায় কথা বলেছেন। বায়রন বলেছেন, “Keats has contrived to talk about the gods much as they might have been supposed to speak” কীটস পরিপূর্ণভাবে গ্রীক। গ্রীসের সৌন্দর্য্য কেবলমাত্র মায়াময় স্বপ্নরাজ্য নয়, তা বাস্তব। কীট্স অতীতের সঙ্গে একাত্মতা অর্জন করেছেন। যে অতীত তাঁর কাছে মনে হয়েছিল পবিত্র, শুদ্ধ, সুন্দর।
কীটসের প্রতিভার সম্যক স্ফূরণ ঘটেছে তাঁর ode-গুলির মধ্যে। কীট্ট্স যদি কেবলমাত্র ode-গুলি রচনা করতেন তাহলেও ইংরাজী সাহিত্যে প্রতিভাবান শ্রেষ্ঠ শিল্পীরূপে পরিগণিত হতেন। ১৮১৯ সালের এপ্রিল ও মে মাসে, কীটসের শিল্পী জীবনের ক্রান্তিকাল। এই সময়ে কবির জীবনে দুর্যোগের ঘনঘটা। কিন্তু কবি সেই দুর্যোগের শিয়রে বসে যা রচনা করলেন তা প্রাণের আভায়, স্বপ্নের রঙে রঙ্গীন করা রক্তদীপ। ode শব্দটির অর্থ সঙ্গীত। সঙ্গীতের জন্য রচিত কবিতাগুলিকে বলা হত ode. ইংরাজী সাহিত্যে একজাতীয় গীতি-কবিতাকে বলা হয় “ওড্”।
যাইহোক কীটসের ওড়গুলি যেন স্বর্গীয় মদের ফেনপুঞ্জ। এ যেন কবি কীটসের ভাব জীবনের সমুদ্র মন্থনজাত অমৃত। Ode-গুলির মধ্যে একটি জাগর চৈতন্যের সৌন্দর্য্য-মাধুর্য্য ও রসোজ্জ্বলতার সকরুণ মর্মোশ্বাস ঘটেছে। কবি এখানে সৌন্দর্য্য-মাধুর্য্যের পুরোহিত ও পূজারী। তাঁর সমস্ত হৃদয় মন সৌন্দর্য্যের নন্দলোকে আবদ্ধ। রূপ-রস-বর্ণের বিপুল সমারোহের মধ্যে কবি আত্মনিমগ্ন। “ওড় টু ‘সাইকি'” তে তিনি সাইকির সৌন্দর্য্যের ধ্যান করেছেন, কিন্তু সেই সৌন্দর্য্যের মধ্যে একটা সকরুণ বিষাদের ছাপ আছে। সাইকি হল বিষণ্ণ প্রেমের প্রতিমূর্তি। বিষণ্ণ বলতে কোন দুঃখজনক ঘটনাকে বোঝায় না। কবি মনে করেন, “True melancholy lies not in the sad and ugly things of life, not in death or the accompaints of death but in everything that is beautiful and joyful” বিষণ্ণতা জীবনের কোন দুঃখজনক অথবা কুৎসিত ঘটনার মধ্যে নেই, নেই মৃত্যু ও মৃত্যুর সম্বন্ধে। তা আছে যা কিছু সুন্দর এবং আনন্দের মধ্যে। এই একুই ভাবের প্রবাহ তাঁর সমস্ত ode-গুলির মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। “ওড অন মেলানকোলি’তে কবি বিষণ্ণতার স্বরূপ উদ্ঘাটন করে বলেছেন, যে বিষণ্ণতার আবাস আনন্দের মন্দিরে। “ওড টু নাইটিঙ্গেল” কবিতায় সেই প্রচ্ছন্ন বিষাদের সুর লক্ষ্য করা যায়, যদিও বিহঙ্গের সঙ্গীত সুরে কবি জীবনের আনন্দলোকে উত্তরণ করেছেন। বিহঙ্গ আনন্দের প্রতিমূর্তি। তার সঙ্গীত আনন্দ রসের ধারা। তবুও সেই আনন্দের মধ্যে বিষণ্ণতা আছে বলেই কবির মনে হয়েছে, বিষণ্ণময়ী রূপের কথা, মনে হয়েছে বিষণ্ণ বাতায়নের কথা;
“Charmed magic casement, opening on the foam Of perilous seas, in faery lands forlon.”
“ওড় টু গ্রীসিয়ান আর্ন” কবিতায় কবি নিঃসঙ্গ প্রকৃতি জগতের মধ্যে Cold pastoral চিত্র অঙ্কন করেছেন। “ওড টু অ্যাটম” কবিতায় কবি ঋতুবর্ণনার মধ্য দিয়ে মানবের মানসচেতনার সঙ্গে প্রকৃতির গভীর শান্তি ও সরস পুষ্প সম্ভারের নিবিড় একাত্মতা স্থাপন করেছেন। শরতের পরিপূর্ণ সৌন্দর্য্যের মধ্যে একটা সুগভীর শান্ত সমাহিত শান্তির ভাব আছে। শরতের কন্ঠ বসন্তের মত মুখর নয়, শান্ত-মধুর। শান্ত সৌন্দর্য্যের মধ্যেও যেন বিষন্নতার সুর বিদ্যমান। এই বিষণ্ণতা এসেছে কবির মনে সৌন্দর্য্যের স্বল্পায়ু জীবনের নশ্বরতা, মানব-নিয়তির নিষ্ফলতা বোধ থেকে। অথবা জীবন ভোরে সৌন্দর্য্যকে না দেখতে পাবার জন্যে। তবুও পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে যে সৌন্দর্য্যকে তিনি সম্ভোগ করেছেন, আস্বাদন করেছেন যে রূপমাধুরী, তাকেই তিনি চিরন্তন করে রেখে গেছেন তাঁর ওড়গুলির মধ্যে।.
কীট্ট্স অনেকগুলি সনেট লিখেছেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রচিত। সনেটগুলির মধ্যে কবির মনের ছোট ছোট ভাবগুলি মুক্তোর মত ঝক্ করে উঠেছে। এখানেও সেই আদিম সুকুমার কল্পনার বিশ্বয়করতা, নির্জন প্রকৃতির আসঙ্গ লিন্সার আর্তি, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতি, গ্রীক সৌন্দর্য্যপ্রিয়তা ইত্যাদি প্রকাশ পেয়েছে। দেশ বলতে নিজের জন্মভূমি ইংলণ্ডকে বুঝতেন। ইংলণ্ডের গৌরবে তিনি গৌরবান্বিত। ইতালিতে বাস করার সময় ইতালির সৌন্দর্য্য কবিকে মুগ্ধ করলেও কবি ভুলতে পারেননি ইংলণ্ডকে। “হ্যাপি’ ইজ ইংলণ্ড” কবিতায় তারই কথা প্রকাশ পেয়েছে। কীটস্ ছিলেন শান্তির পূজারী। ‘শান্তি’ সনেটে তিনি শান্তির কথাকে প্রকাশ করেছেন।
এই যুগের আধা-রোমান্টিক কবি
শেলী, কীট্স, বায়রনের সমসাময়িক কয়েকজন দ্বিতীয় শ্রেণীর কবি আছেন যাঁদের প্রতিভা ঐসব কবির প্রতিভার কোন নির্দিষ্ট স্বাক্ষর না থাকলেও, যাঁদের প্রতিভা ঐসব কবির প্রতিভার দীপ্তিতে ম্লান হয়ে গেলেও, তাঁরা যেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দীপশিখার মত আপনার মহিমাতে মহনীয়। কারণ তাঁদের রচনার মধ্যে ক্লাসিক্যাল ভাবনার যে মন, সংহত রূপ দেখা যায় তেমনি দেখা যায় শিল্প ও জীবনের মধ্যে বাস্তব সমন্বয়। এঁদের কারো কারো মধ্যে রয়েছে লক্ষণীয়ভাবে কাব্যিক সৌন্দর্য্য ও প্রাচুর্য্য।
টমাস মূর (১৭৭৯-১৮৫২)
জন্ম, ডাবলিনে। জাতিতে, আইরিশ। ট্রিনিটি কলেজ থেকে স্নাতক হবার পর তিনি লণ্ডনে ইনার টেম্পলে আইন পড়তে যান। তরুণ কবির মনে ফরাসী বিপ্লবের হাওয়া দোলা লাগিয়েছিল। আয়ার্ল্যাণ্ডে চেষ্টাও করেছিলেন বিপ্লবের ঝড় তুলতে, পারেননি। চাকরি পেয়েছিলেন। পেয়েছিলেন বায়রনের মত বন্ধু। আর একনিষ্ঠ সাধকরূপে স্থান পেয়েছিলেন সারস্বত সাধনার মন্দিরে। কারণ জীবিত কালেই তিনি সার্থক কবি হিসাবে প্রচুর সম্মান পেয়েছিলেন। যদিও পরবর্তীকালে তাঁর সে খ্যাতি একেবারে নিঃশেষে উবে গিয়েছিল। ১৮০০ সালে “অ্যানাক্রিয়নের” কাব্য অনুবাদ করে তিনি পণ্ডিত হিসাবে খ্যাতিলাভ করেন। তিনি অনেক কিছুই রচনা করেছেন। তার মধ্যে “আইরিশ মেলডি’ (১৮০৭-৩৪) বিশেষ প্রসিদ্ধ। আইরিশ জাতীয় সুরে গান গাওয়া হতো। অভাব ছিল
জাতীয়তাবোধের তীব্র আত্যন্তিকতা। তাঁর “লাল্লা রুক” (১৮১৭) প্রাচ্য বিষয়বস্তু নিয়ে রচিত রোমান্টিক কাব্য। এই কাব্য রচনায় ‘সাদে, বায়রন এবং বেকফোর্ড-এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কবি প্রতিভার যথার্থ বিকাশ ঘটেছে এই কাব্যে। বস্তু কম থাকা সত্ত্বেও রূপকথার ঐ গল্পগুলি আপন মনের মাধুরী মিশে এক অপূর্ব মায়াময় রোমান্স সৃষ্টি করেছে। মাঝে মাঝে গদ্যে রয়েছে মন্তব্য। মূর কেবলমাত্র কাব্য রচনা করেননি, বন্ধু বায়রনের জীবনচরিত রচনা করেছেন এবং বায়রনের রচনাবলীর সম্পাদনাও করেছেন। রাজনৈতিক ব্যঙ্গ রচনাতেও তিনি দক্ষতা দেখিয়েছেন।
টমাস ক্যাম্পবেল (১৭৭৭-১৮১৪)
জন্ম, গ্লাসগোর এক প্রাচীন পরিবারে। পরিবারটি ছিল দরিদ্র। গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা শেষে তিনি এক বাড়ীতে গৃহ শিক্ষক নিযুক্ত হন। তিনি ইউরোপ ভ্রমণ করেছিলেন এবং সেখানকার রাজনৈতিক আবর্তকে স্বচক্ষে দেখেছিলেন। ইউরোপ থেকে ফিরে তিনি লণ্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন এবং “দি নিউ মান্থলি ম্যাগাজিন” পত্রিকার সম্পাদক পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। অবশ্য তাঁর রচিত কাব্য “প্লেজার্স অব হোপ” তাঁকে খ্যাতিসম্পন্ন করেছিল। কবি বেশ কয়েকটি দীর্ঘ কবিতা রচনা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সাফল্য এসেছে ছোট কবিতায় যে সব কবিতায় তিনি স্বদেশ প্রেমের জাগরণের সুর শুনিয়েছিলেন উদাত্ত কণ্ঠে। তাঁর সবচেয়ে সার্থক রচনা হল, “ইউ মেরিনারস অব ইংলণ্ড” এবং “দি ব্যাটল অব দি বালটিক’। এই সব কবিতায় দম্ভ ও বাগাড়ম্বর নেই, আছে আবেগ স্পন্দিত ভাব ও ভাবনা।
স্যামুয়েল রোজার্স (১৭৬৩-১৮৫৫)
জন্ম, ষ্টোক নিউইংটন-এ ধনী বন্ধকী কারবারের সন্তান। সুতরাং ব্যবসাটা ভালই বুঝেছিলেন, এবং তাতেই সাফল্যলাভ করেছিলেন। শুধু ব্যবসাতে নয়, কাব্য রচনাতেও তিনি সাফল্যলাভকরেছিলেন ফলে সেই যুগের বহু শিক্ষিত ব্যক্তি এবং কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল ঘনিষ্ঠ। তিনি ব্যবসাতে যেমন নিষ্ঠা দেখিয়েছেন, কাব্য রচনাতেও তেমনি নিষ্ঠা দেখিয়েছেন। তাঁর কাব্য “দি প্লেজার্স অব মেমারি” (১৭৯২) চোখে পড়ার মত কিছু নয়। তবে তাঁর কাব্য ‘ইতালি’ দৃষ্টিতে পড়ার মত। কারণ এই কাব্যটি হল ভ্রমণ কাহিনী, অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত। বর্ণনার গুণে, প্রকাশের ভঙ্গিমায় এবং ভাষার বর্ণাচ্যে কাব্যটি হয়ে উঠেছে রোমান্টিক কল্পনায় সমৃদ্ধ।
রবার্ট সাদে (১৭৭৪-১৮৮৩)
জন্ম ব্রিষ্টল শহরে। শিক্ষা, ওয়েষ্ট মিনিষ্টার স্কুলে এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফরাসী বিপ্লবের দ্বারা তিনি দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। একসময় সমাজবাদী রাষ্ট্রগঠনের পরিকল্পনাও করেছিলেন। সঙ্গী হিসাবে পেয়েছিলেন কোলরীজকে যিনি তাঁর শালীকে বিবাহ করেছিলেন। পরে সে পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ায় তিনি কাব্য রচনায় মনোনিবেশ করলেন। যেমন অতি বিপ্লবী হয়েছিলেন, রাতারাতি তেমনি গোঁড়া রক্ষণশীল হতেও তাঁর বেশি সময় লাগেনি। এই রক্ষণশীলতার জন্যই তিনি ইংলণ্ডের রাজকবি পদে নিযুক্ত হন। উনি জীবিত থাকতে ওয়ার্ডসওয়ার্থ বা কোলরীজের পক্ষে সম্ভব হয়নি ঐ সম্মানিত পদে নিযুক্ত হবার। যাইহোক সাদে রাজকবিরূপে সম্মানিত হলেও কবি হিসাবে তাঁর খ্যাতি কোনদিনই ছিল না। আজ তো লোকে তাঁকে চেনেই না। সাদে অনেক কষ্ট করে, অনেক পরিশ্রম করে কয়েকটি দীর্ঘ কবিতা করেছেন। কিন্তু সে সব কবিতা কোন কাজে আসেনি। যেমন, “ম্যাডক” বা “রোডারিক দি লাস্ট অব দি গথস” প্রভৃতি। তবে সাদের কিছু কিছু ছোট ছোট কবিতা আছে সেগুলি আজও তার কাব্যমূল্য হারায় নি। যেমন, “দি ইনচকেপ রক” কবিতাটি। দুষ্কৃতকারী নিজেই নিজের জীবনে কিভাবে করুণ বিপর্যয় ডেকে এনেছিল তারই বর্ণনা নাটকীয় উৎকণ্ঠায় রচিত হয়েছে। “মাই ডেস এমং দি ডেড আর পাষ্ট” কবিতাটি বেশ সুখপাঠ্য।
রাজকবি হিসাবে তিনি রাজা তৃতীয় জর্জের প্রশস্তি করে একটি কবিতা রচনা করেছেন। কবিতাটির নাম হল, “এ ভিসন অব জাজমেন্ট”। ঐ একই নামে একটি কবিতা রচনা করে কবি বায়রন সাদের চাটুকারিতার তীব্র ব্যঙ্গ করেছেন।
তবে সাদে একেবারে পরিত্যক্ত নন। মাঝে মাঝে তাঁকে স্মরণ করতে হয় যে দুটি গ্রন্থের জন্য, সে দুটি গ্রন্থ হল “লাইফ অব নেলসন” এবং “লাইফ অব জন ওয়েলেসলি”। “নেলসনের জীবনী”-তে জাতীয় বীরকে দুঃসাহসিক ঘটনার পটভূমিকায় অত্যন্ত জীবন্ত করে বর্ণনা করেছেন। এসব সত্ত্বেও তাঁকে প্রথম শ্রেণীর কবি বলা যায় না। তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। কারণ তাঁর কাব্যে না আছে জীবনের সুগভীর ভাবব্যঞ্জনা, না আছে শিল্পের চমৎকারিত্ব।
টমাস হুড (১৭৯৯-১৮৪৫)
জন্ম লণ্ডনে। পুস্তক ব্যবসায়ীর সন্তান। কাব্য রচনাতেই তিনি উৎসাহী। “দি লণ্ডন ম্যাগাজিনের” তিনি সম্পাদক ছিলেন। ভীষণ রুগণ ছিলেন। ফলে অকালেই মারা যান। যাইহোক দীর্ঘ কবিতায় তিনি সফল হননি। আসলে তিনি হাস্যরসিক কবি। কৌতুকরসের গভীরতায় আছে কারুণ্য। যাই থাক, তিনি ট্র্যাজিক রসের কবিতায় সাফল্য অর্জন করেন। “দি ব্রিজ অব সাইস্” কবিতাটি উল্লেখযোগ্য। ভৌতিক বিষয় নিয়েও তিনি কাব্য রচনা করেছেন। “দি হনটেড হাউস” উল্লেখযোগ্য। “দি সঙ অব দি সার্ট” কবিতাটিতে দর্জি মেয়ের নিষ্পিষ্ট জীবনের করুণ কাহিনী বর্ণিত।
এছাড়া যে সমস্ত কবির নাম কেবলমাত্র উল্লেখ করা যায়, তাঁরা হলেন-লে হান্ট (১৭৮৪-১৮৫৯), মিসেস হিমনেস্ (১৭৯৩-১৮৩৫), উইলিয়ম কম্বে (১৭৪১-১৮২৩) প্রভৃতি। এঁদের রচনা আজ স্কুলপাঠ্য পুস্তকেই শোভা পায়।
রোমান্টিক যুগের উপন্যাস: স্যার ওয়ালটার স্কট (১৭৭১-১৮৩২)
স্কটের জন্ম স্কটল্যান্ডের এডিনবরায়। তাঁর শিক্ষা, এডিনবরা স্কুলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেড় বছর বয়সে পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে চিরকালের জন্য খঞ্জ হয়ে গেলেন। কিন্তু দেহ ও মনের শক্তি ছিল অদম্য ও অসাধারণ। বাবা ছিলেন আইনজীবী। আইন বিষয় নিয়ে পড়াশোনাও করেছিলেন; আদালতে যোগও দিয়েছিলেন, কিন্তু সাফল্যলাভ করতে পারেননি। ১৭৯৯ খ্রীষ্টাব্দে
সেলকার্কশায়ারের শেরিফ হিসাবে কর্মে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাতেই তিনি খুশী। এর কিছু পূর্বে পার্থশায়ারের এক তরুণীর সঙ্গে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ফরাসী প্রবাসী এক ভদ্রলোকের কন্যাকে বিবাহ করেন। ১৮০৬ সালে তিনি একটি মূল্যবান পদে নিযুক্ত হলেন। পদবীর নাম “ক্লার্ক অব সেশন”, ছ’বছর কোন মাহিনা পাননি। ১৮১২ সালে যখন প্রথম মাহিনা পেলেন তিনি “অ্যাবটফোর্ড” চলে গেলেন এবং এখানে একজন প্রাচীন “লেয়র্ড” বা দুর্গের অধিপতির মত মহা আড়ম্বরে বসবাস
করতে লাগলেন। খরচের সীমা নেই। পয়সার অভাব ছিল না। ব্যবসায়ে টাকা লগ্নী করেছিলেন। ব্যবসাটি হল মুদ্রণশিল্পের। নিজে অংশীদার ছিলেন। শুধুমাত্র কবিতা ছেপেই প্রচুর পয়সা রোজগার করেছিলেন। আর বাবুগিরি করে তা জলের মত ব্যয়ও করেছেন। হঠাৎ একদিন সে ব্যবসায় এল বিপর্যয়। দেনার দায়ে দেউলে হয়ে গেলেন। অংশীদার জন ব্যালেন্টাইন এবং স্কট উভয়েরই দোষ ছিল ব্যবসা উঠে যাওয়ার জন্য। দুজনেই ব্যবসার টাকা ভেঙ্গে খেয়েছেন খুশীমত। বিরাট দেনার
দায় স্কট ঘাড়ে তুলে নিলেন এবং তা পরিশোধ করার জন্য উপন্যাস রচনা করে চললেন। ফলে তাঁর শরীর ভেঙ্গে পড়ল। ১৮৩০ সালে পক্ষাঘাত দেখা দিল। মস্তিষ্কও আক্রমিত হল। তবু লিখে চললেন। খঞ্জত্ব আরো বৃদ্ধি পেল। ইতালি গিয়েছিলেন রোগ সারাতে। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলেন। এবং টুইড নদীর ধারে তিনি তাঁর যে মনোরম প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন মধ্যযুগীয় দূর্গের অনুকরণে, সেই প্রাসাদের কক্ষে আরামদায়ক শয্যায় শায়িত থেকে নদীর মর্মর গীতি শুনতে শুনতে রোগযন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে ইহলোক ত্যাগ করে চলে গেলেন। তবে মৃত্যুর আগে জেনে গিয়েছিলেন, যে তাঁর ঋণ সব শোধ হয়ে গেছে। যদিও মৃত্যুর পূর্বে একলাখ সতের হাজার পাউণ্ডের দেনার মধ্যে প্রায় সত্তর হাজার পাউণ্ড তিনি শোধ করেছিলেন। বাকিটা তাঁর মৃত্যুর পরে শোধ হয়েছিল।
স্কটের সাহিত্য:
স্কট জার্মান ভাষা শিখেছিলেন। জার্মান ভাষা থেকে অনুবাদ করেছিলেন জার্মান কাবা “লেনোর (১৭৯৫), গ্যেটের কাব্য (১৭৯৯)। ১৮০২-৩ সালে তিনি জনপ্রিয় লোককাব্যের সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। সংকলনটির নাম “দি মিনিট্রেলসী অব দি স্কটিশ বর্ডার’। অবশ্য এর মধ্যে সব কবিতাই সংগৃহীত ছিল না। কিছু কিছু তাঁর নিজস্ব রচনাও ছিল। যেমন, “দি ঈত অব সেন্ট জন”। এরপর তাঁর স্বরচিত কাব্য প্রকাশিত হয়। “দি লে অব দি লাষ্ট মিটস্ট্রেল” (১৮০৫), “মার্কিয়ন” (১৮০৮), “দি লেডি অব দি লেক” (১৮১০), “দি ভিশন অব ডন রোডারিক” (১৮১১), “রোকেবাই” (১৮১৩), “দি ব্রাইডেন অব ট্রিআরসেন” (১৮১৩), “দি লর্ড অব দি আইলস” (১৮১৫), “হ্যারল্ড দি ডন্টলেস” (১৮১৭)। এরপর তাঁর সেই বিখ্যাত উপন্যাসগুলি আত্মপ্রকাশ করে। এই উপন্যাসগুলি “ওয়েভার্নি” নামে খ্যাত। উপন্যাস রচনার ফাঁকে কিছু কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কবিতা রচনা করেন। সেই কবিতাগুলি “মিল্লোখিয়ান পোয়েমস্” নামে ১৮২০ সালে প্রকাশিত হয়।
স্কটের প্রথম উপন্যাস “ওয়েভার্নি” (১৮১৪), “গাই ম্যানারিং” (১৮১৫), “দি এন্টিকোয়ারি” (১৮১৬), “টেলস অব মাই ল্যাণ্ডলর্ড” (১৮১৬), “দি হার্ট অব মিডলোথিয়ান” (১৮১৮), “দি ব্রাইড অব ল্যামারমুর” (১৮১৯), “রব রয়” (১৮১৮), “অ্যাইভ্যানহো” (১৮২০), “দি মনাষ্ট্রি” (১৮২০), “দি অ্যাবট” (১৮২০), “কেনিলওয়ার্থ” (১৮২১), “দি পাইরেট” (১৮২২), “দি ফরচুনস অব নাইজেল” (১৮২২), “পেভেরিল অব দি পিক” (১৮২২), “কুইনন্টিক ডারওয়ার্ড (১৮২৪), “সেন্ট বোনানসওয়েল” (১৮২৪), “রেডগান্টলেট” (১৮২৪), “টেলস অব দি ক্রুসেড” (১৮২৫), “উডষ্টক” (১৮২৬), “দি বিথ্রটেড” (১৮২৫), “দি ট্যাকিসম্যান” (১৮২৫), “দি ফেয়ার মেড অফ পার্থ” (১৮২৮), “অ্যানি অব গ্রিয়ারস্টাইন” (১৮২৯), “কাউন্ট রবার্ট অব প্যারিস’ (১৮৩২) এবং “ক্যাসল ডেঞ্জারাস” (১৮৩২)।
এ ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন “ড্রাইজেন” (১৮০৮), “সুইফট” (১৮১৪), ‘দি লাইভস অব দি নভেলিষ্ট” (১৮২১-২৪), “দি লাইফ অব নেপোলিয়ন” (১৮২৭) এবং “টেলস অব এ গ্রান্ডফাদার” (১৮২৮-৩০)। রয়েছে অসংখ্য প্রবন্ধ, রচনা ইত্যাদি।
স্কটের প্রতিভা ও রচনার বৈশিষ্ট্য:-
স্কট প্রথমতঃ কবি, তারপর ঔপন্যাসিক। স্কটের কবি জীবনের কাল-পরিধি ১৮০৫ সাল থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সময়ের মধ্যে তিনি বর্ণনাত্মক কাহিনী কাব্য রচনা করেছেন, রচনা করেছেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গীতিকবিতা। এইসব কবিতার বিষয়বস্তু হচ্ছে প্রেম ও বীরত্ব। প্রেম ও বীরত্বের গরিমাময় রূপের বর্ণনার জন্য কবি পাড়ি দিলেন সুদূর অতীতলোকে। এই অতীতলোকে প্রত্যাবর্তন
বাতীত কবির উপায় ছিল না। কারণ বর্তমানের সঙ্গে কবির কোন যোগ ছিল না। বর্তমান সম্বন্ধে তিনি একেবারে নিস্পৃহ ছিলেন। ফরাসী বিপ্লব তাঁর মনে কোন দাগ কাটতে পারেনি। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, এবং শিল্পবিপ্লবের ভাবনা তাঁকে বিচলিত করেনি। তিনি সমাজ-সংস্কারকও ছিলেন না। তাঁর প্রকৃতিই ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল। রক্ষণশীলের মত জীবনযাপন করেছেন, যদিও শিল্প সভ্যতাকে সেই প্রয়োজনে কাজে নিযুক্ত করেছেন। ব্যবসায়িক বুদ্ধি ছিল না, উদ্যোগ ছিল। মোহ ছিল অভিজাততন্ত্রে। ভাব ও ভাবনাকে পাথেয় করে জীবনকে রোমান্সের স্বপ্ন দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন এবং রোমান্সের সুরে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন। রোমান্সের সেই সুরলোক থেকে মাটির পৃথিবীতে তিনি কোনদিন নেমে আসেননি। মাটির পৃথিবীর সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক ছিল না বলেই তাঁকে অতীতে আশ্রয় নিতে হয়েছে এবং অতীত লোকেই তিনি চিরকালের বাসগৃহ নির্মাণ করেছিলেন। স্কট মাত্রাতিরিক্ত রোমান্টিক। রোমান্টিক যুগের সমস্ত উপাদানের সমন্বয় ঘটেছে তাঁর কাব্যে। কল্পনাময় আবেগ, অতীতের প্রতি মোহ, মধ্যযুগীয় শিভ্যালরিক প্রেম এবং বীরত্বের প্রতি অনুরাগ, যুদ্ধ-উন্মাদনা, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের প্রতি ভাবপ্রবণ শ্রদ্ধা, এবং নিসর্গ প্রকৃতিপ্রেম, এবং সর্বোপরি স্কটল্যাণ্ডের সামাজিক জীবন এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের সঙ্গে মিলে মিশে তিনি তাঁর স্বকীয় বৈশিষ্ট্যকে প্রকাশ করেছেন। তবুও অতিপ্রাকৃত বর্ণনায় তিনি কোলরীজ নন। কোলরীজের মত তত্ত্বকে তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। তাঁর কাব্য “দিলে অব দি লাস্ট মিস্ট্রেল” মৌলিকতার স্বাক্ষর বহন করে। কোলরীজের ক্রিষ্টাবেল কাব্যের ছন্দে রচিত। স্কটল্যান্ডের প্রাচীন লোক-কথার কাবারূপ। অতি-প্রাকৃত রহস্যময়তাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। “মার্সিয়ন” কাব্যটি বোধ হয় তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। যুদ্ধের পটভূমিকায় রচিত। তাই যুদ্ধ জয়ের বর্ণনার মধ্যে ফুটে উঠেছে বীররসাত্মক ধ্বনিগাম্ভীর্য। “দি লেডী অব দি লেক” কাব্যটির মধ্যে নিসর্গ প্রকৃতির চিত্রময়তা গভীরভাবে রূপ পেয়েছে। “রোকেবাই” কবিতাটি ব্যর্থ।
যাইহোক বর্ণনাত্মক কাহিনী কাব্যরচনায় তিনি শিল্প-সৌন্দর্য্যের রূপায়ণে ব্যর্থ হলেও অনেক সমালোচক তাঁর ঐ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গীতিকবিতাগুলির প্রশংসায় মুখর হয়েছেন। কারণ এখানে কল্পনার সঙ্গে ভাবের সংমিশ্রণ ঘটেছে অতি সুন্দরভাবে। প্রকৃতির সঙ্গে কবি গভীরভাবে মিশে গেছেন। প্রকৃতিকে দেখেছেন দুচোখ দিয়ে। নির্জন প্রকৃতির নীরব সৌন্দর্যকে তিনি বর্ণনায় জীবন্ত করে তুলেছেন। পর্বত শিখরে শিশির বিন্দুর মত, নদী তরঙ্গে ফেনপুঞ্জের মত, ঝরনা ধারায় বুদবুদের মত তিনি হারিয়ে গেছেন প্রকৃতির অন্তরলোকে। তাই গীতিকাব্যে রচনার ক্ষেত্রে তিনি সার্থক। কাহিনী কাব্যের মধ্যে যে উচ্ছ্বাসময়তা প্রকাশ পেয়েছে তা এখানে সংহত, সংযত।
স্কটের উপন্যাস:
কাব্য রচনার জগৎ থেকে কবি সসম্মানে বিদায় নিলেন। কারণ বায়রন। বায়রনের কাব্য কবিতা সেদিন পাঠকের চিত্তকে এত গভীরভাবে অধিকার করেছিল যে স্কটের কবিতা সেখানে আর কোন সাড়া জাগাতে পারেনি। বায়রনের সমুন্নত কবি প্রতিভার কাছে স্কটের স্কুল রোমান্টিক কাব্য ম্লান হয়ে গেল। স্কট ভালভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন যে কাব্যে তাঁর কোন ভবিষ্যৎ নেই। অর্থাৎ কাব্য রচনায় তিনি বায়রনের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবেন না। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তিনি নিজ মুখে একথা স্বীকার করেছিলেন। সুতরাং নতুন কোন উপায়ের সন্ধান করতে লাগলেন যেখানে তিনি তাঁর প্রতিভার স্বতন্ত্র স্বাক্ষর রেখে যেতে পারবেন। নতুন কোন বিষয়ের বা উপাদানের তিনি অনুসন্ধান করেননি। কারণ উপাদান তো তাঁর কাছে মজুত আছেই। সে উপাদান হল ইতিহাসের উপাদান, লোককাহিনীর উপাদান। যে উপাদান দিয়ে তিনি ইতিপূর্বে কাহিনী কাব্য রচনা করেছিলেন। তাই কাব্যরূপ নয়। চাই অন্য কোন রূপ (form) এবং স্কট বেছে নিলেন উপন্যাসের
রূপ। কিন্তু উপন্যাস বললেই যেটা পাঠকের মনে ভেসে ওঠে তা হল পরিচিত বাস্তব জীবনের জটিল ছবি। কিন্তু পরিচিত বাস্তব দ্বন্দ্ব সংঘাতময় জটিলের জীবন্ত রূপচিত্র অঙ্কন করা স্কটের পক্ষে সম্ভব ছিল না, কারণ স্কটের সঙ্গে বাস্তব জীবনের কোন সম্পর্ক ছিল না। তিনি বাস্তব জীবন থেকে দূরে সরে গিয়ে নিজের চারিদিকে গড়ে তুলেছিলেন এক কৃত্রিম কাল্পনিক মধ্যযুগীয় পরিবেশ। এই পরিমণ্ডলের মধ্যে বাস করে বাস্তব কিছু রচনা করা সম্ভব ছিল না। তাই তিনি উপন্যাসের আধারে কাল্পনিক রসের পরিবেশনে মনোনিবেশ করলেন। ফলে তাঁর উপন্যাস রচনায় সবচেয়ে বড় ত্রুটি যা তা হল বাস্তব জীবনবোধের অভাব। এই অর্থে স্কট ঐতিহাসিক বাস্তব উপন্যাস রচনা করেননি, করেছেন ঐতিহাসিক রোমান্টিক উপন্যাস।
যাইহোক উপন্যাস রচনাতেই তাঁর প্রতিভার সম্যক বিকাশ ঘটেছিল। তাঁর উপন্যাসের পটভূমি হল তাঁর সময়ের দুশো বছরের পূর্বেকার ইতিহাস। অর্থাৎ রিফর্মেশন থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ গৃহযুদ্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত। বেশীদূর অতীতের ঘটনা নয়। প্রথম রিচার্ড থেকে শুরু করে রাণী এলিজাবেথ, প্রথম জেমস্, প্রথম চার্লস, রাজা তৃতীয় জর্জ (১৭৬০) পর্যন্ত। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা তিনি মানেন নি। যে যুগ পছন্দ করেছেন সেই যুগকেই বেছে নিয়েছেন। এ ছাড়া আছে স্কটল্যান্ডের ইতিহাস। প্রধানতঃ পিউরাটানইজম ও জেকোবাইট আন্দোলনের সময়কার দুশো বছরের স্কট দেশীয় ঘটনাই তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের অবলম্বন। তবে ইতিহাসকে যথাযথ অক্ষুন্ন রেখে তিনি উপন্যাস রচনা করেন নি। ইতিহাসের ছায়া অবলম্বনে তিনি রচনা করেছেন তাঁর কাল্পনিক কাহিনী। ফলে তাঁর উপন্যাসে ইতিহাস খুঁজতে যাওয়া বৃথা। তবে সেই যুগের মানুষ, তার আচার-আচরণ, তার ভাবভাবনাকে খুঁজে পেতে অসুবিধে হয় না। খুঁজে পেতে অসুবিধে হয় না সে যুগের সামাজিক প্রথা ও নীতি নিয়মকে। তবে যে সমস্ত উপন্যাসে স্কটল্যাণ্ডের অতীত জীবনের চিত্র এঁকেছেন সেগুলি যেমন যথাযথ ও প্রকৃত হয়েছে তেমন যথাযথ হয়ে ওঠেনি যখন ইংলণ্ড ও ফ্রান্সের অতীতের চিত্র অংকন করেছেন। এমন কি ভারতবর্ষের চিত্র অংকনও তিনি করতে পারেন নি।
উপন্যাসের কাহিনী নির্মাণের ব্যাপারে স্কট কোন দক্ষতা দেখাতে পারেননি। কোন সন্দেহ নেই যে ঘটনাগুলি বৈচিত্র্যময়। কিন্তু কোন ঘটনার সঙ্গে ঘটনার অনিবার্য যোগ নেই। ঘটনা যেন আকস্মিকতায় ভরা। কোথাও কোথাও অলৌকিক অতিপ্রাকৃতের ছড়াছড়ি। কাহিনীর আদি অন্ত থাকলেও তা যেন জোড়াতালি দিয়ে রচিত। চরিত্র চিত্রণেও স্কট ব্যর্থ। কারণ স্কটের অভিজ্ঞতার অভাব। প্রধান চরিত্রগুলির রূপায়ণে কৃত্রিমতা ও জড়তা দেখা যায়। চরিত্রের অ্যাকশন বিশেষ কোথাও প্রকাশ পায়নি। চরিত্রের মধ্যে যেমন অন্তর্দ্বন্দ্বের অভাব তেমনি তারা যেন আকস্মিক ঘটনার শিকার। দৈননির্ভরতা, আকস্মিকতা, চরিত্রগুলিকে গতিশীল ও চঞ্চল করেছে। আসলে স্কট প্রকৃতভাবে চরিত্র অংকন করতে চাননি। তাঁর মোহ ছিল রাজারাজড়ার জীবনের প্রতি। সেই মোহের বশবর্তী হয়ে তিনি উপরতলার মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতিকে মহনীয় করে অংকন করেছেন। এর বেশি কিছু নয়। যে সব চরিত্র বাস্তব, ক্রিয়াশীল, ও জীবন্ত হয়ে তাঁর উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়েছে সেগুলি হল সাধারণ। নিম্নশ্রেণীর মানুষের চরিত্র অংকনে তিনি দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাদের আচার-আচরণ হাস্য-পরিহাস যেন সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে।
স্কটের উপন্যাসে বিষয়বস্তু হল প্রেম ও যুদ্ধ। আর কিছু নয়। অবশ্য কোন কোন উপন্যাসে মানবিক মহত্ত্বের ছাপ আছে। যেমন “ব্ল্যাক ডোয়ার্ক” বা কালো বামন উপন্যাসে। মনুষ্য বিদ্বেষী বামনটি মানুষকে ঘৃণা করে। তবু যে মানুষকে সে ঘৃণা করে সেই মানুষকে বাঁচাবার জন্য এগিয়ে যায়। অর্থাৎ তার অন্তরের গভীরে রয়েছে মনুষ্যপ্রীতি। কিন্তু এই মানবপ্রীতিটুকুকে প্রকাশ করার
সুযোগ পেয়েছিল ভাগ্যিস তার ম্যাজিক জানা ছিল। তা না হলে কি হত? এসব কাহিনী অত্যন্ত স্কুল। তাঁর উপন্যাসের মধ্যে স্থূলত্বই বেশি। জীবনের সুগভীর ভাবব্যঞ্জনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেখানে প্রেমের ঘটনা সেখানে প্রেম নায়ক-নায়িকার মিলনের মধ্যে শেষ হয়েছে। আর সেই মিলন ঘটেছে আকস্মিকভাবে। একেবারে মেলোড্রামাটিক। যেখানে বীরত্বকে প্রকাশ করেছেন সেখানে বীরত্বের গরিমাকে প্রকাশ করেছেন কোন মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য নয়। বীরত্বের জন্যই বীরত্ব। যেমন *এ লিজেন্ড অব মনট্রোজ” উপন্যাস। কেবল যে তিনি কমেডি রচনা করেছেন তা নয়। ট্র্যাজেডি রচনাও করেছেন। “কেনিলওয়ার্থ” উপন্যাসটিতে নায়িকা অ্যামির মৃত্যু ঘটেছে কোন অনিবার্য কারণে নয়। নির্দোষ নায়িকা অ্যামিকে হত্যা করে নায়ক লিষ্টারের মনে কি কোন প্রতিক্রিয়া জাগে নি? স্কুল উপন্যাস। আর স্থূলতার জন্যই আজকের যুগের মননশীল পাঠকের কাছে স্কটের উপন্যাস কোন সাড়া জাগায় না। অথচ এককালে পাঠকেরা তাঁর উপন্যাস গোগ্রাসে পাঠ করত। এমনকি স্কটের উপন্যাসের প্রভাব দেশের সীমা ছাড়িয়ে পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছিল। তার কারণ স্কটের উপন্যাসের প্রধান গুণ হল ত্রুটিহীন রোমান্সের পরিমণ্ডল সৃষ্টি করা। এত সুন্দররূপে পরিমন্ডল সৃষ্টি করতে পেরেছেন যে সেই পরিমন্ডলে রোমান্টিক প্রেম এবং বীরত্ব চমৎকার ভাবে সমন্বিত হয়েছে। ফলে তাঁর উপন্যাস হয়ে উঠেছে কাব্যধর্মী। স্কটের কাব্য উপন্যাসে মুক্তি পেয়েছে। এইজন্যেই তিনি সার্থক।
স্কটের যুগের অন্যান্য ঔপনাসিক:-
এ যুগের অধিকাংশ উপন্যাসের রচয়িতাদের মন রোমান্সের রসে ছিল পরিপূর্ণ। কাল্পনিক কাহিনী রচনাতে ছিল তাদের আনন্দ। সেই সব কল্পনাপ্রসূত বা স্বকপোলকল্পিত রচনাতে ছিল রোমাঞ্চকর বা লোমহর্ষক কাহিনী-সৃষ্টির মধ্যে শিল্পসৃষ্টির চাতুর্য থাক বা নাই থাক, পাঠকের মনকে সেই স্কুল জগতের স্বপ্নে জাগিয়ে তুলে অবশ করে দেওয়া ছিল তাদের লক্ষ্য। এইসব স্কুল ভয়ঙ্কর কাহিনী কত যে জনপ্রিয় ছিল তা লেখকদের রচনার প্রাচুর্য থেকেই বোঝা যায়। চার্লস রবার্ট মাতুরিন (১৭৮২-১৮২৪)-এর রচিত “ম্যালমথ দি ওয়ান্ডারার” (১৮২০), “দি ফেটাল রিভেঞ্জ” (১৮০৭) গ্রন্থের মধ্যে অতিপ্রাকৃতের ঘনীভূত রহস্যের জগৎ জীবন্ত ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কবি শেলীর পত্নী শ্রীমতি মেরী শেলী কর্তৃক রচিত “ফ্রাঙ্কেনষ্টাইন” ভয়ঙ্করতাকে আদর্শায়িত করে সৃষ্টি করেছেন। বিজ্ঞান ও দার্শনিক ভাবনার যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে লেখিকা রোমান্সের আশ্রয় নিয়েছেন। মানুষের বিজ্ঞানচেতনা ও বৈজ্ঞানিক সৃষ্টিকে ব্যঙ্গ করেই যেন লেখিকা বলতে চেয়েছেন যে মানুষ নিজেই নিজের “ফ্রাঙ্কেনষ্টাইন” সৃষ্টি করবে। অর্থাৎ বিজ্ঞান সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনবে।
যাইহোক এযুগে বিজ্ঞানের অগ্রগতি, শিল্পের ক্রমবর্ধমান স্ফীত রূপকে যেন অনেক কবিই সহ্য করতে পারেননি। শিল্প সভ্যতা তাদের কাছে মনে হয়েছে অভিশাপ স্বরূপ। লেখক-লেখিকারা এরকম একটা ভাবনার দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন।
তবে এই যুগে যে সকলেই রোমাঞ্চের রহস্যের হাতছানির ডাকে বাস্তব ছেড়ে অবাস্তরের পথে পা বাড়িয়েছে তা নয়, কোন কোন লেখক জেন অস্টেনের রচনাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানব মনের জটিল রহস্যের জগৎকে উদঘাটন করতে চেয়েছেন। যেমন মিসেস গোরে (১৭৯৯-১৮৬১)। তাঁর রচিত দুখানি গ্রন্থ হল, “মাদার্স এণ্ড ডটার্স” (১৮৩১) এবং “মিসেস আর্মিটেজ (১৮৩৬)। জেন অষ্টেনের মত দক্ষ শিল্পী না হলেও তাঁর রচনাতে রয়েছে প্রাণশক্তি।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন যে, সাহিত্যের কাব্য ও উপন্যাস শাখায় এত প্রচুর রচয়িতার আবির্ভাব ঘটেছে যে তাদের প্রত্যেকের পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়।
রোমান্টিক যুগের গদ্য সাহিত্য
চার্লস ল্যাম্ব (১৭৭৫-১৮৩৪)
জন্য, লণ্ডন শহরে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা জন ল্যাম্ব একজন ব্যারিষ্টারের সম্ভবতঃ ভূতা ছিলেন। ল্যাম্ব ছিলেন কনিষ্ঠ সন্তান। চার্লস-এর বয়স যখন সাত বৎসর তখন তাঁকে ক্রাইষ্ট হাসপাতালের দাতব্য বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। নিরীহ, লাজুক, শান্ত প্রকৃতির ছেলে চার্লস।
সাত বৎসর বিদ্যালয়ে বিদ্যা-শিক্ষা করেন। এখানে যে কয়েক জনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়েছিল, তাদের মধ্যে কোলরীজ অন্যতম। চৌদ্দ বছর বয়সে ১৭৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসে স্কুল ত্যাগ করেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তাঁর হল না। কারণ প্রধানতঃ সংসারের আর্থিক দুরবস্থা।
চার্লস-এর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা জন ল্যাম্ব ছিলেন অত্যন্ত স্বার্থপর। সাউথ-সী হাউসে তিনি উচ্চপদে চাকুরি করতেন। কিন্তু সংসারের মুখের দিকে তিনি চেয়ে দেখেন নি। ফলে সংসারের সব দায়দায়িত্ব চার্লস ঘাড়ে তুলে নিলেন। সাময়িকভাবে তিনিও একটা চাকরি পেলেন সাউথ-সী-
হাউসে। সেটা কেরানীর কাজ। দুবছর পরে তিনি বিখ্যাত ইন্ডিয়া হাউসে কেরানীর চাকুরি পান। এখানে তিনি তেত্রিশ বৎসর চাকরি করেন। অর্থাৎ ১৮২৫ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে তিনি অবশ্য ছ’সপ্তাহের জন্য পাগলাগারদে ছিলেন। সেটা সম্ভবতঃ ১৭৯৫-৯৬ সালের শীতকালে। ব্যর্থ প্রণয়ের
জন ল্যাম্ব পাগলা হয়ে গিয়েছিলেন। অবশ্য সেরে উঠতে বেশি সময় লাগেনি ল্যাম্বের। কিন্তু ল্যাম্ব আজীবন অকৃতদার রয়ে গেলেন। শুধু কি তাই, বোন মেরী ল্যাম্বকে নিয়ে কম যন্ত্রণা তাঁকে ভোগ করতে হয়নি। বাড়ীর অবস্থা মোটেই ভাল ছিল না। বাবা শয্যাশায়ী, মা পঙ্গু, ভাই জন সংসার থেকে ভিন্ন হয়ে গেছেন, আর্থিক অনটন, তার ওপর বংশগত ব্যাধি। চরম অশান্তি। মেরীর পরিশ্রমের সীমা নেই। এরকম একটা অবস্থায় পড়ে মেরী হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে মাকে করল হত্যা,
বাবাকে করলো আহত। জুরির বিচারে মেরী উন্মাদ রোগগ্রস্ত বলে সাব্যস্ত হল এবং তাকে পাগলা গারদে পাঠানো হল। কিছুটা আরোগ্য হলে চার্লস তাকে বাড়ীতে আনলেন। কিন্তু উন্মাদ রোগে প্রায়ই আক্রান্ত হতেন মেরী। ১৭৯৭ সালে বাবার মৃত্যুর পর উন্মাদিনী বোনের সব দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। এতসব ঝঞ্ঝাট সত্ত্বেও ল্যাম্বের মনে ক্ষোভ বা ক্লান্তি ছিল না। তিনি
হাসিমুখে প্রশান্ত চিত্তে বাণীর সাধনা করেছেন। সেই নিরলস সাধনায় তিনি সিদ্ধিও লাভকরেছিলেন। তবে চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি বেশিদিন জীবিত থাকেন নি। কোলরীজের মৃত্যুতে তিনি বড় বেশি আঘাত পেয়েছিলেন। সেই আঘাত ছিল অত্যন্ত গভীর।
তাঁকে প্রায়ই বলতে শোনা যেত “কোলরীজ নেই”। ইতিমধ্যে মেরী আরও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ১৮৩৪ সালে ডিসেম্বর মাসে হঠাৎ তিনি আছাড় খেয়ে পড়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিষিয়ে উঠল তাঁর শরীর। তাতেই তাঁর মৃত্যু। বোন জানতেও পারল না। কারণ তাঁর তখন বোধশক্তি বলে কিছু ছিলনা। তিনিও মারা যান ১৮৪৭ সালে। মেরী সম্বন্ধে হ্যাজলিটের মন্তব্য হল, “তাঁর জানা মহিলাদের মধ্যে মেরী ছিলেন সব থেকে জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমতী”।
ল্যাম্বের সাহিত্য রচনা:-
ল্যাম্ব কবিতা রচনা করে শুরু করেছিলেন তাঁর সাহিত্যিক জীবন। সনেট রচনা করেছেন। কাবা রচনার প্রেরণা পেয়েছিলেন কোলরীজের কাছ থেকে। তাঁর বিখ্যাত কবিতা হল “দি ওন্ড ফ্যামিলিয়ন ফেসেস” এবং “টু হেক্টর”। কবিতা দুটি প্রথম শ্রেণীর নয়। তবে পরিচিত মানুষের জন্যে রয়েছে এক সুগভীর মর্মবেদনা। এলিজাবেথীয় নাট্যকারদের অনুসারে ট্র্যাজেডী রচনা করার
চেষ্টা করেছিলেন। রচনা করেছিলেন “জন উডভিল” নাটক (১৮০২) কিন্তু সফল হননি। মঞ্চাভিনয় নাটকটি যেমন ব্যর্থ হয়েছে তেমনি ব্যর্থ হয়েছে শিল্পরূপ রচনায়। কিন্তু শেক্সপীয়রের নাটারস আস্বাদনে তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ ভক্ত। তাই ভগ্নী মেরীর সহযোগিতায় তিনি শেক্সপীয়রের নাটকের গল্পগুলির গদ্যরূপ দান করেছিলেন। অনবদ্য, এই রচনা “টেলস্ ফ্রম শেক্সপীয়র” (১৮০৭) গ্রন্থে শেক্সপীয়রের জটিল কাহিনীগুলিকে ভারহীন ভাষায় সহজের রসরূপ জীবন্ত করে তুলেছেন। এই রচনাটি তাঁর শিরে যশের মুকুট পরিয়ে দিয়েছিল। কারণ এইটি তাঁর সত্যকারের সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনা। এর পরেই ল্যাম্ব হয়ে গেলেন সমালোচক। ১৮০৭ থেকে ১৮১৭ সালের মধ্যে অর্থাৎ প্রায় দশ বছর ধরে তিনি সমালোচনা সাহিত্য রচনা করেছেন। শুধু শেক্সপীয়র নয়, শেক্সপীয়রের যুগের নাটক রচয়িতাদের তিনি নতুন করে তাদের শিল্প রচনার চমৎকৃতিকে তুলে ধরলেন। তাঁর সমালোচনামূলক প্রবন্ধ দুটি হল “স্পেসিমেনস্ অব ইংলিশ ড্রামাটিক পোয়েটল হু লিভড এবাউট দি টাইম অব শেক্সপীয়র’ এবং “অন দি ট্রাজেডিস্ অব শেক্সপীয়র কনসিডারড উইথ রেফারেন্স টু দেয়ার ফিটনেস ফর স্টেজ রিপ্রেজেন্টেশন”। প্রথম গ্রন্থটিতে শেক্সপীয়রের যুগের নাট্যকারদের নাটকের বিশেষ বিশেষ অংশ নমুনাস্বরূপ সংকলন করেছেন। টীকা-টিপ্পনীও যুক্ত করেছেন। এই রচনাটি মূল্যবান। কারণ শেক্সপীয়রের যুগের নাট্যকারদের তিনি যথাযোগ্য মর্যাদায় পূনর্মূল্যায়ন ও পুনর্বাসন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। দ্বিতীয় গ্রন্থটিতে তিনি শেক্সপীয়রের নাটকের মঞ্চাভিনয়ে প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন যে, সেক্সপীয়রের নাটক মঞ্চাভিনয়ের চেয়ে পাঠ করে বেশি আনন্দ পাওয়া যায়। বক্তব্য যাই হোক, তাঁর ঐ দুটি রচনাকে সমালোচনা না বলে রসগ্রাহী আলোচনা বলা যেতে পারে। কারণ সাহিত্য সমালোচনা বলতে যা বোঝায় তা হল সাহিত্যের নীতি-নিয়ম অনুসারে সাহিত্যের শিল্প ও রসরূপের আলোচনা। এ আলোচনায় ব্যক্তিগত ভালো-লাগা বা মন্দ-লাগার কোন স্থান নেই। কিন্তু রসগ্রাহী আলোচনা হল কেবলমাত্র ব্যক্তি মনের ভাল-লাগার রসে জারিত করে তার ব্যাখ্যা করা। রসগ্রাহী আলোচনা করা সাহিত্যের বিচার নয়, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নয়, আস্বাদন।
ল্যাম্বের সাহিত্য জীবনের ক্রান্তিকাল শুরু হয়েছে ১৮২০ সাল থেকে, যখন বন্ধু সমালোচক হ্যাজলিট তাঁকে লণ্ডন ম্যাগাজিনের সম্পাদকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এই পত্রিকাতে তিনি “ইলাইয়া” ছদ্মনামে প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। এই প্রবন্ধগুলিই “দি এসেস্ অব ইলাইয়া” (১৮২৩) এবং “দি লাস্ট এসেস অব ইলাইয়া” (১৮৩৩) হল তাঁর সাহিত্যিক জীবনের সোনার ফসল। প্রবন্ধগুলি তিনি তিন বৎসর ধরে রচনা করেছিলেন। এছাড়া অনেকগুলি নাটক রচনা করেছিলেন।
ল্যাম্বের প্রতিভার সম্যক বিকাশ ঘটেছে নাটকে নয়, কাব্য কবিতায় নয়, নিবন্ধ রচনায়। কবি প্রতিভার অভাব ছিল তা নয়, তবে যাঁর জীবনটা ছিল কঠিন কঠোর গদ্যময়, তাঁর পক্ষে কাব্য রচনা করা সম্ভব নয়। তাছাড়া ল্যাম্বের ভাবনার জগৎ কোন অতি উচ্চ আকাঙ্ক্ষার প্রবল তাড়নায় সচকিত হয়ে ওঠেনি। রাজনীতির সঙ্গে কোন যোগ ছিল না ল্যাম্বের। প্রতি বুধবার সন্ধ্যায় যে আলোচনা চক্রে ল্যাম্ব যোগ দিতেন সেখানে আর যারা যোগ দিতেন তাঁর। হলেন হ্যাজলিট, কীন, কেম্বেল, গডউইন, কোলরীজ এবং ওয়ার্ডসওয়ার্থ। এই আলোচনা চক্রে রাজনীতির কোন আলোচনা হত না। ল্যাম্ব রাজনীতি পছন্দ করতেন না। তিনি ছিলেন শান্ত শিষ্ট অতি প্রশান্ত-চিত্ত বিশিষ্ট একজন একনিষ্ঠ চাকুরীজীবী। কিন্তু তাঁর বন্ধুরা কেউ কেরানী ছিলেন না। অনেকেই বরং তদানীন্তন যুগের রাজনীতির চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আবার কেউ কেউ ব্যর্থ রাজনীতিক ছিলেন। যাইহোক ল্যাম্বের রচনায় রাজনীতির গন্ধ নেই। তিনি রাজনীতি, সমাজনীতি, আদর্শ, বা মতবাদের থেকে দূরে বহুদূরে সরে গিয়ে পরিচিত বাস্তব জীবনের বুকে বসে তার জীবন্ত ছবি
একেছেন। যা দেখেছেন তা সমবেদনার স্পর্শে প্রদীপ্ত করে আত্মরস কল্পনায় সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর ইলাইয়া নিবন্ধগুলিতে কি আছে? আছে স্মৃতির পাতা থেকে ছিনিয়ে আনা শৈশব কালের কাহিনী। আছে সাহিত্য সম্বন্ধে সরস আলোচনা, আত্মীয়-পরিজন সম্বন্ধে দরদভরা বর্ণনা, কখনো জীবনের কঠিন অভিজ্ঞতার সকরুণ প্রকাশ, কখনো বা কৌতুক ঘটনার করুণ অভিব্যক্তি। আছেন ল্যাম্ব অর্থাৎ লেখক স্বয়ং এবং তাঁর ভালবাসার বাসভূমি লণ্ডন। লন্ডনকে বড় ভালবেসেছিলেন তিনি। তাই লন্ডনের রাস্তাগুলি ছিল তাঁর কাছে তীর্থপথ, তার সুউচ্চ প্রাসাদগুলি ছিল তাঁর রহস্যের জগৎ। লন্ডনের জীবনকেই তিনি রূপ দিয়েছেন। প্রকৃতি প্রেমিক তিনি ছিলেন না এমন নয় তবে তিনি একান্তভাবে লণ্ডন প্রেমিক। ওয়ার্ডসওয়ার্থকে এক পত্র দিয়ে তিনি লিখেছিলেন, “আপনার সঙ্গ সুখ থেকে বঞ্চিত হয়ে আমার কিছু যায় আসে না যদি আমার জীবনে আমি একটা পর্বত কখনও না দেখি। লণ্ডনেই আমার অতীত দিনগুলি কেটেছে, স্থানীয়ভাবে আরো গভীরভাবে গড়ে তুলব দে সম্পর্ক যতদিন পর্যন্ত না তোমার কোন পর্বতারোহী মৃত প্রকৃতির সঙ্গ ত্যাগ করবে।”
যাইহোক মানবজীবনকে কেন্দ্র করেই তাঁর ভাব ও ভাবনাগুলি প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে হিউমার। হিউমার হচ্ছে স্নিগ্ধ কৌতুকরস। সমবেদনার লোকে বিচ্ছুরিত। অর্থাৎ হিউমার হচ্ছে মুখের হাসি ও চোখের জল মিলিয়ে একপ্রকার করুণ কৌতুক। এমনি এক কৌতুকরসের উদাহরণ হল তাঁর রচিত “দি ডিকে অব বেগার্স”। লন্ডনের রাস্তা থেকে ভিখারী তুলে দেওয়া হবে এই সংবাদ শুনে ল্যাম্ব মন্তব্য করেছেন তাহলে দয়া-দাক্ষিণ্য দেখানোর ব্যাপারটা কি হবে? সেটাও কি দেশ থেকে উঠে যাবে? তার চেয়ে ওগুলিকে থাকতে দাও আর যে যেভাবেই ভিক্ষার আবেদন করুক না কেন তাকে প্রশ্ন না করে সাহায্য দাও। “দি প্রেজ অব চিমনি সুইপারস” নিবন্ধে ঠিক একই কথা তিনি বলেছেন, “দর্শনের কচকচির চেয়ে গরীবদের প্রতি সমবেদনা দেখানো ভাল”। অর্থাৎ ল্যাম্ব যেন বলতে চাইছেন, অবস্থার উন্নতি হলে গরীবদের ভুলে যেও না। ল্যাম্ব রোমান্টিক। রোমান্টিক ভাবাদর্শের দ্বারা পরিচালিত। তাই ঐ সব কথা রোমান্টিক কথা। গরীবদের সাহায্য করার মধ্যেই রয়েছে সহৃদয়তার লক্ষণ, এই ভাবনার দ্বারা তিনি পরিচালিত হয়েছেন। এ তো সেই বাইবেলেরই বাণী। বুর্জোয়া ভাবাদর্শের দ্বারা পরিচালিত বলেই তিনি নতুনকে বা নতুন ধ্যান-ধারণাকে গ্রহণ করতে পারেননি। তাই যেখানে তিনি জন্মেছিলেন সেখানকার ধনী-ব্যক্তিদের পুরাতন প্রাসাদগুলিকে তিনি ভালবাসতেন। ভালবাসতেন পুরাতন গ্রন্থগুলিকে। ভালবাসতেন প্রাচীন লেখকদের, নতুন লেখকদের বই তাঁর হাতে দিলে তিনি ছুঁড়ে ফেলে দিতেন। তবু তিনি ছিলেন মানবতাবাদী। তিনি ছিলেন গরীবদের মরমীবন্ধু। যাই থাকুন, আসল ল্যাম্বের রচনার যে প্রধান গুণ হিউমার, সেই হিউমার ইতিপূর্বে কেউ সৃষ্টি করতে পারেননি। কারণ ল্যাম্বের হিউমারে যেমন বিষয় আছে তেমনি প্রচ্ছন্নভাবে আছে বিষয়ী এবং প্রকাশ্যভাবে আছে মানুষ। সব মিলিয়ে এ এক নবতন সৃষ্টি।
তবে ল্যাম্ব থেকে শুরু হল একটা যুগ। যে যুগে কেরানী, চাকুরিজীবীরা হবে সাহিত্য রচয়িতা।
জন হেনরী লে হান্ট (১৭৮৪-১৮৫৯)
হান্ট জন্মগ্রহণ করেছেন মিড্রসেক্স-এ। শিক্ষালাভ করেছেন ক্রাইষ্ট হসপিটাল-এ। পাদরি পিতার সন্তান। শৈশব কাল থেকেই কবিতা রচনা করতে শুরু করেছেন। রচনা করেছেন সমালোচনামূলক প্রবন্ধ। জন হান্ট-এর সহযোগিতায় প্রকাশ করলেন একটি পত্রিকা “দি এক্সজামিনার্স” বা পরীক্ষক। সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হলেন এবং সারা জীবন সাংবাদিক রয়ে গেলেন। সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন একুশ বছর বয়সে। অবশ্য হান্ট তাঁর ভায়ের পত্রিকা
“নিউজ”-এ নাট্য সমালোচক হিসাবে লিখতে সুরু করেছিলেন। পরে “পরীক্ষক” পত্রিকাতেও নাট্যসমালোচনা করে তিনি নাট্যমঞ্চ ও প্রেসের মধ্যে ষড়যন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে দেন। হান্ট ছিলেন উদারপন্থী বিপ্লবী মতের সমর্থক। তিনি ছিলেন প্রচণ্ডভাবে সরকার বিরোধী। সরকারকে কড়া সমালোচনা করার জন্য দু’বছর কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল। কারাভোগের কাহিনী রচনা করে তিনি ‘হিরো’ হয়ে গেলেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলী, বায়রন, কীটস, নূর প্রভৃতি কবিরা তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বের বন্ধনে বাঁধা পড়লেন। “পরীক্ষক” পত্রিকার পর তিনি “ইন্ডিকেটার” পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। সাফল্যলাভ করেননি। পরে তিনি ১৮২১ সালে রোমে গেলেন “লিবারল” পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়ে। কিছুদিন সগৌরবে চলার পর শেলীর মৃত্যুতে এবং বায়রনের সহযোগিতার অভাবে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন। আর তিনি পারলেন না নিজেকে গৌরবের আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে। যে সরকারের দেওয়া ভাতা একদিন তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, সেই ভাতা পুনরায় গ্রহণ করে জীবনের শেষদিনগুলি কাটাতে লাগলেন।
হান্ট কবি হিসাবে খুব উঁচুদরের ছিলেন না। প্রেমের কবিতার মধ্যে হৃদয়ের উষ্ণ উত্তাপ নেই। আবু-বেন-আদেম কবিতাটি মানব-প্রীতিতে সমুজ্জ্বল। কবিতায় তিনি সাফল্য অর্জন না করলেও প্রবন্ধ ও নিবন্ধ রচনাতে তিনি সফল। প্রথমতঃ, তিনি সাংবাদিক। সুতরাং সাংবাদিকতার তাগিদে তাঁকে প্রবন্ধ রচনা করতে হয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ, তিনি রোমান্টিক যুগের ভাবনার অংশীদার। সুতরাং নিবন্ধ রচনাতে মনোনিবেশ করতে হয়েছিল। নাটক, উপন্যাস রচনাতে হাত দিয়েছিলেন বটে তবে তাতে সফল হননি। তিনি নিবন্ধ রচনায় অনেক বেশি সহজাত ও স্বাভাবিক। তাঁর গদ্যে আছে পদ্যের রঙ ধরা ছন্দ, ধ্বনি, মাধুর্য্য। যদিও আবেগের উষ্ণ উত্তাপ ও বিদ্যুৎ দীপ্তি নেই। সাংবাদিকতার ঢং তাঁর রচনায় থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তা সত্ত্বেও রোমান্সের স্পর্শ বর্জিত নয়। প্রকৃতিপ্রেমিক প্রাবন্ধিক, প্রবন্ধের মধ্যে প্রকৃতির বন্দনা না করে বোধ হয় তৃপ্তি পেতেন না।
সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ক আলোচনাও তিনি করেছেন। যেমন, ‘ইমাজিনেসন এণ্ড ফ্যান্সি’, ‘উইট এন্ড হিউমার’ প্রভৃতি। পাণ্ডিত্যপূর্ণ রচনা। তবে নাট্য সমালোচনার ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন পথিকৃৎ। তাঁর পূর্বে নাট্য সমালোচনা যা ছিল তা নেহাতই যৎসামান্য। তিনি রসগ্রাহী আলোচনা ও অভিনয়কলার সমালোচনা করেছেন। তবে তাঁর যে রচনাটি পাঠক কোনদিন ভুলতে পারবে না সেটি হল তাঁর আত্মজীবনী। এই আত্মজীবনীর মধ্যে তিনি নিজেকে যেমন প্রকাশ করেছেন তেমনি প্রকাশ করেছেন তাঁর যুগকে। তিনি তাঁর পরিচিত জগৎ জীবন ও মানুষদের জীবন্ত করে সৃষ্টি করেছেন।
উইলিয়ম হ্যাজলিট (১৭৭৮-১৮৩০)
হ্যাজলিটের জন্ম, মেইডষ্টোন শহরে। একেশ্বরবাদী পাদরি পিতার সন্তান। সুতরাং যে পরিবেশের মধ্যে তিনি লালিত হয়েছেন তাতে নাগরিক এবং আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার প্রতি প্রবণতা ছিল তাঁর প্রবল। অত্যন্ত কড়া মেজাজের লোক ছিলেন। কোন কিছুকেই তিনি খাপ খাইতে নিতে পারেননি। ষোল বছর বয়সে তিনি একেশ্বরবাদী কলেজের শিক্ষকদের দ্রুত সংস্কারের বিষয় নিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন। সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সম্বন্ধে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন বলে পাদরি হবার বাসনা ত্যাগ করলেন। দার্শনিকদের রচনার মধ্যে ডুবে গেলেন। হবস থেকে হিউম সব কিছু গভীর মনোনিবেশ সহকারে পাঠ করলেন। ১৭৯৬ সালে এডমণ্ড বার্কের রচনা “লেটার টু এ নোবেল লর্ড” তাঁর মনকে প্রচণ্ডভাবে আকৃষ্ট করে। তিনি বার্কের ভক্ত হয়ে গেলেন। তখনও তিনি তাঁর লক্ষ্য স্থির করতে পারেননি। সাহিত্য, রাজনীতি ও দর্শন কোণটিকে যে তিনি বেছে নেবেন তা যখন তিনি স্থির করতে পারছিলেন না তখনই কোলরীজের সঙ্গে পরিচয় ঘটে।
সেটা ১৭৯৮ সাল। হ্যাজলিট পথের নিশানা খুঁজে পেলেন। অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেছেন কোলরীজের ঋণ। শুরু করলেন প্রবন্ধ রচনা। কিন্তু জীবিকার জন্য তিনি বেছে নিলেন চিত্র অঙ্কন। মনপ্রাণে ঢেলে দিয়ে যখন তিনি সিদ্ধিলাভ করলেন তখন তিনি আর এক মানুষ। প্যারিস।
গিয়েছিলেন ছবি আঁকা শিখবার জন্য। কষ্ট করে শিখে ফিরে এলেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থ কোলরীজের ছবি এঁকেছেন। তার জন্য কোন প্রশংসা পাননি। চালর্স ল্যাম্বের ছবি তাঁর সবচেয়ে সুন্দর ছবি।
যাইহোক পোষালো না তাঁর চিত্রাঙ্কন। ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়ে তিনি আবার সাহিত্য রচনায় মন দিলেন। ছবি আঁকা ছেড়েছেন ১৮০৫ সালে। সাহিত্য রচনায় মন দিলেন ১৮১৪ সালে। মাঝের দশটা বছর অর্থনীতিতে ম্যালথুসকে আক্রমণ করেছেন, না হয় রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখেছেন।
তারপর যোগ দিলেন ‘মর্নিং ক্রনিকেল’ এবং ‘এক্সজামিনার্স’ পত্রিকায়। প্রথমে পার্লামেন্টারী সাংবাদিক পরে নাট্যসমালোচক। দু’টোতেই তিনি পারদর্শিতা দেখালেন। এখন থেকে শুরু হল তাঁর সাহিত্য রচনা। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি প্রবন্ধ রচনা করে গেলেন এবং প্রকাশ করে গেলেন “এডিনবরা রিভিযু”, “দি এক্সজামিনার”, “দি টাইমস্” এবং “দি লন্ডন ম্যাগাজিন” পত্রিকায়। ইতিমধ্যে বিয়ে করেছেন দুবার। ব্যর্থ হয়েছেন দুবারই। শেষে নিঃসঙ্গ নির্জনতার রোগে এবং আর্থিক অনটনে ভুগে একদিন বিদায় নিলেন এই পৃথিবী থেকে।
তাঁর রচিত সাহিত্য:-
হ্যাজলিট তাঁর সাহিত্য জীবনের সোনার ফসল তুলেছেন ১৮১৭ থেকে ১৮২৫ সাল পর্যন্ত। তিনি রচনা করেছেন, “ক্যারেকটার অব শেক্সপীয়ার্স প্লেজ” (১৮১৭), “দি ইংলিশ পোয়েটস” (১৮১৮), “দি ইংলিশ কমিক রাইটার্স”, (১৮১৯) এবং “দি ড্রামাটিক লিটারেচার অব দি এজ অব এলিজাবেথ” (১৮২০)। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবন্ধগুলি যে সমস্ত গ্রন্থে সংগৃহীত হয়েছে সেগুলি হল “দি রাউন্ড টেবিল” (১৮১৭), “টেবিল টক” (১৮২১-২২), “দি স্পিরিট অব দি এজ” (১৮২৫)। ১৮২৮ থেকে ১৮৩০ এর মধ্যে তাঁর ব্যর্থ রচনা হল নেপোলিয়নের জীবনী।
তাঁর সাহিত্যের স্বরূপ:-
হ্যাজলিটের সাহিত্যের প্রধান গুণ স্পষ্টবাদিতা। আর এই স্পষ্টবাদিতার জন্য তিনি সকলের শত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন। এমনকি তাঁর বন্ধু ল্যাম্ব বলেছিলেন “সারা বিশ্বের সাথে একভাবে ঝগড়া করেছেন।” ত্রুটি দেখলেই তিনি আক্রমণ করতেন। সে বন্ধুকেই হোক, নিজের স্ত্রীকেই হোক, বড় বড় পন্ডিত হোক কিম্বা হুইগ বা টোরী দলের প্রখ্যাত নেতাই হোক। আর বল্লাবিহীন স্পষ্টবাদিতা তাঁর সাহিত্যকে দান করেছে পুরুষোচিত প্রকৃতি। যে বিষয়ে তিনি আলোচনা করতে চেয়েছেন সেই বিষয়টির গভীর অন্তঃস্থল দেখে তিনি তার স্বরূপকে পরিপূর্ণরূপে প্রকাশ করেছেন। তিনি প্রচণ্ড আবেগ বা সংস্কারের দ্বারা পরিচালিত হননি। বুদ্ধি ও যুক্তির মাধ্যমে প্রকাশ করতেন। তাও কয়েকটি কথার রেখাঙ্কনে। চিত্রশিল্পী তিনি। তাই ভাষার প্রয়োগের ব্যাপারেও তিনি চিত্রশিল্পী। এক একটি রেখার টানে ফুটিয়ে তোলেন এক একটি বক্তব্য। তাঁর রচনাতেও চিত্রের রঙ ধরে। বর্ণের অপূর্ব সমারোহ ঘটেছে তাঁর রচনায়। শুধু তাই নয় শেক্সপীয়রের নাটকের চরিত্রগুলির সমালোচনা তিনি করেন নি। তিনি চরিত্রগুলির অন্তরের মহত্তর প্রকৃতির আস্বাদন করেছেন। তেমনিভাবেই আস্বাদন করেছেন শেক্সপীয়রের যুগের নাট্যকারদের রচনা। সাহিত্যতত্ত্বকে কোনকিছু বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে প্রকাশ করেছেন। “অপরে যা ভাবে ও করে কবিতা তাকেই প্রকাশ করে” একথা দিয়ে তিনি কোন মতবাদ ব্যাখ্যা করেননি। যা ভেবেছেন তা অকপটে বলেছেন, জোরের সঙ্গে বলেছেন, কোন কিছু তোয়াক্কা না করে। আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্রেও তিনি মনখোলা।
– টেবিলটক”, “প্লেন স্পীকার” এ সেই খোলা মনের জীবন রসরসিকতার ছবি ফুটে উঠেছে। সেই স্পর্শ পাওয়া যায় তাঁর “মাই ফাষ্ট একোয়েনটেন্স উইথ পোয়েটস” প্রবন্ধে। এখানে তিনি নিজেকে প্রকাশ করেছেন নিজের মত করে। নিজে যা তাকে প্রকাশ করেছেন কোন কিছু গোপন না রেখে। গোপন রাখা তাঁর স্বভাবের বাইরে।
হ্যাজলিট ছিলেন আসলে মুক্তির পূজারী। কোন কিছুর মধ্যে তিনি নিজেকে ধরা দিতে চাননি। জীবনকে জানার জন্য তিনি হতে চেয়েছিলেন পথের প্রেমিক। সে পথের শেষ নেই, অনন্ত অসীমের পানে যে পথ চলে গেছে। সেই পথের তিনি নিঃসঙ্গ যাত্রী। নিসঙ্গতাকে তিনি নিঃসঙ্গ বলে মনে করতেন না। কারণ নিজেকে তিনি ভুলে যেতেন। রোমান্টিক ভাবনার আতিশয্য হ্যাজলিটকে করেছিল উদার মুক্ত ভয়হীন চিত্তের অধিকারী। হ্যাজলিট চেয়েছেন, “আমাদের রোমান্টিক ও চরৈবেতি সত্তাকে পোষ মানিয়ে রাখা যাবে না”, পোষ মানেননি বলেই তিনি চিরকাল ফরাসী বিপ্লবের সমর্থক থেকে গেছেন, এমনকি নতুন সমাজ গড়ার আশায় নেপোলিয়নকে বীররূপে সম্মান দিতে কসুর করেননি। তিনি সমাজের চারিদিকে যে ব্যভিচার, সংকীর্ণতা ও পরশ্রীকাতরতা, পাণ্ডিত্যের মূঢ়তা দেখেছেন তাকে তিনি সহ্য করতে পারেননি। কোথাও তিনি সৌন্দর্য্যের ছায়া দেখতে পাননি। “The beautiful is vanished, and returns not”, কিছু করার নেই। অসহায় কবির কাছে মুক্তির আনন্দ বার্তা বয়ে আনে নির্জন প্রকৃতি, আর সেই আনন্দ তিনি আকণ্ঠ পান করতে চান।- “I will drink of the water of life freely.” সেই মুক্ত জীবনের আনন্দের ভাবনা হ্যাজলিটের মনকে চিরসবুজ করে রেখেছিল; কারো কাছে মাথা নত করেননি। মৃত্যু-দুঃখ-কষ্টের কাছেও না।
টমাস-ডি-কুইন্সি (১৭৮৫-১৮৫৯)
ডি কুইন্সি জন্মেছেন ম্যাঞ্চেষ্টার-এ। ধনী ব্যবসায়ীর সন্তান। ১৮০০ সালে ম্যাঞ্চেষ্টার গ্রামার স্কুলে তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হয়। এখানে তিনি লাতিন এবং গ্রীক এত দ্রুত এবং সুন্দরভাবে আয়ত্ত করেছিলেন যে শিক্ষকরা রীতিমত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বালক ডি কুইন্সি যেমন চঞ্চল, তেমনি খামখেয়ালী। ১৮০২ সালে হলেন স্কুল পলাতক। পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন। ভবঘুরের মত যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। কখনো খোলা আকাশের নীচে, কখনো রাখালের কুটীরে, কখনো কয়লা কুড়ুনির ঘরে, কখনো যাযাবরদের তাঁবুতে। শেষপর্যন্ত লন্ডন পালিয়ে এলেন। বন্ধুবান্ধবহীন যুবক অর্ধাশন, অনশনের মধ্যে দিন কাটাতে লাগলেন। শেষে বাড়ীর লোকেরা তাঁর সন্ধান পেয়ে তাঁকে অক্সফোর্ডে ভর্তি করে দিলেন। ১৮০৩ থেকে ১৮০৮ সাল পর্যন্ত তিনি ভালভাবে পড়াশোনা করলেন। এমনকি পরীক্ষাও দিলেন। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষার ব্যাপারে অহেতুক ভয় পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে সেই যে পালিয়ে গেলেন আর ফিরলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন তিনি আফিম খেতে শুরু করেছিলেন। উদ্দেশ্য স্নায়বিক পীড়ার যন্ত্রণা উপশম করা। কিন্তু সেটা নেশায় দাঁড়িয়ে গেল এবং নেশা এমন চরমে উঠল যে অনেক বেশি পরিমাণে খেতে লাগলেন। খরচের সীমা নেই। সাংবাদিকতা করে কিছু কিছু আয় করতে লাগলেন। এই সময়ে ওয়ার্ডসওয়ার্থের এবং কোলরীজের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। শুধু পরিচয় নয় নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘ডাভ কটেজ’টি তিনি ভাড়া পেলেন। ১৮১৬ সালে মার্গারেট সিম্পসন নাম্নী এক কৃষক কন্যাকে বিবাহ করেন। আফিমের নেশা কিছুটা কমল। জীবিকা অর্জনের জন্য ১৮১৯ সালে “ওয়েষ্টমোরল্যান্ড গেজেটের” তিনি সম্পাদক নিযুক্ত হন। অন্যান্য পত্রিকা যেমন, লন্ডন ম্যাগাজিন, ব্ল্যাকউড ম্যাগাজিনের তিনি নিয়মিত লেখক ছিলেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনাগুলি
লন্ডন ম্যাগাজিনে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ১৮৩০ সালে লণ্ডন ত্যাগ করে এডিনবরা চলে এলেন। বার বার বাসা বদলাতে লাগলেন। স্ত্রী-বিয়োগ ঘটল ১৮৩৭ সালে। ছেলেরা স্থায়ী বাসা পেলেন “ল্যাস্যাবাদে”। কিন্তু ডিকুইন্সী এদের ত্যাগ করে নির্জন এককুটীরে বাস করতেন। সেখানেই তিনি পরলোকগমন করেন।
ডিকুইন্সীর সাহিত্যঃ-
ডিকুইন্সী অনেক লিখেছেন, কিন্তু তার অধিকাংশ নিকৃষ্ট মানের, বেশ একটা অংশ সাহিত্যগুণ সমৃদ্ধ, ক্ষুদ্র একটা অংশ সত্যিই উন্নতমানের। তবে বিশাল কোন গ্রন্থ তিনি রচনা করেননি। যে গ্রন্থটি তাঁকে অমর করে রেখেছে সেই বিখ্যাত গ্রন্থটি হল “আফিমখোরের স্বীকারোক্তি” বা “কনফেশন অব অ্যান ইংলিশ ওপিয়াম ইটার।” ১৮২১ সালে লণ্ডন ম্যাগাজিনে গ্রন্থটি আত্মপ্রকাশ করে। এছাড়া নানা নিবন্ধের গ্রন্থ হল “দি ইংলিশ মেল কোচ” (১৮৪৯), “সাসপিরিয়া দি প্রোফানডিস” (১৮৪৫), এই দুইখণ্ডে “খুন হল একজাতীয় শিল্প” বা “অন মার্ডার কনসিডারড এস ওয়ান অব দি ফাইন আর্টস্” (১৮২৭) এবং দ্বিতীয় খন্ড (১৮৩৯)।
রচনার বৈশিষ্ট্য:-
সব রচনাই গদ্যে রচিত। গদ্যের সাধক তিনি। কিন্তু “আফিমখোরের স্বীকারোক্তি” গ্রন্থে তাঁর গদ্য সাধনার চরম বিকাশ ঘটেছে। এই গদ্য ছন্দের বন্ধনে মুখরিত, ধ্বনির সামঞ্জস্যে মধুর, সুললিত, বেগবান, কাব্য সুষমামণ্ডিত, আবেগ-স্পন্দিত, নিবিড় অনুভূতির বরণে সমৃদ্ধ। এ যেন কাব্যিক গদ্য। এই গদ্য পাঠককে যেন এক রূপকথার রাজত্বে টেনে নিয়ে যায়। এই গদ্যের যত কিছু শক্তি তা নিহিত আছে আত্মগত রস কল্পনায় ও কাব্যিক মহিমায়। কি নেই তাঁর সৃষ্টিতে? বিষয় আছে, বিষয়ী আছে, কাব্যের গীতরসধারা আছে, আর আছে গদ্যের দুই তীরভূমি যার কোলে মুখরিত হয়েছে জগৎ ও জীবনের রহস্যময়তা। এ রচনায় আফিম উপলক্ষ্য মাত্র, লক্ষ্য স্বপ্নের জগৎ। আফিমের মাত্রা চড়িয়ে নেশার নয়নে তিনি কল্পনার অসীমলোকে বিচরণ করেছেন। কত দেশ তিনি পরিভ্রমণ করেছেন, কত নগর, কত রাজধানী, কত বিচিত্র মানুষকে তিনি স্বপ্নের আকাশে ফুটিয়ে তুলেছেন। আত্মভাব মুগ্ধ কবি নির্জন প্রকৃতির ম্লান সৌন্দর্য্যকে নয়ন ভরে দেখেছেন। মৃত্যু চেতনা তাঁর নিকট সঙ্গীতের সুরের মত সুন্দরী অ্যানির মূর্তি যখনই তাঁর স্মৃতির ভুবনে জেগে উঠেছে তখনই তিনি তাঁর সঙ্গলাভের আশায় চঞ্চল হয়েছেন। ব্যর্থতায় হয়েছেন বির্ষ। প্রেম তাঁর জীবনে অক্ষয় সম্পদ। প্রেমের অনুভূতিই তাঁকে করেছে দিশেহারা। কবি কল্পনার ডানায় ভর করে Wanderlaust-এর নেশায় ঘুরে বেড়িয়েছেন জগৎ পারাবারের তীরে। কোথাও তিনি স্থায়ী হননি। এই ভবঘুরে জীবনযাত্রা তাঁর খেয়ালী মনের ভাবনাকে প্রকাশ করেছে। তাঁর রচনায় জগৎ অখন্ডরূপে নয়, খন্ড সোনার টুকরোর মত কল্পনার অরুণ আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।
এরকম অন্তরঙ্গ রচনা নয় ‘ইংলিশ ডাকগাড়ী’ বা “ইংলিশ মেলকোচ”। না, আর কোন রচনা এমন সহজ সুরে বর্ণময় হয়ে ওঠেনি। সমালোচকেরা তাঁর গদ্যকে বা গদ্য রচনাকে সহজ মনে নিতে পারেনি। কেউ গদ্যের অভাব দেখে মুখ ফিরিয়ে থেকেছেন, কেউ কাব্যের উচ্ছ্বাস দেখে মুখ ফিরিয়ে থেকেছেন, কেউ কাব্যের উচ্ছ্বাস দেখে নাক সটকেছেন। যাইহোক ডিকুইন্সীর রচনায় সমাজ চেতনা বা রাষ্ট্রীয় চেতনা বলতে কিছু নেই। যা আছে তাও গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। তবে সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ রচনা করেছেন তা আজিও সর্বজন স্বীকৃত। তিনি সাহিত্যকে দুইভাগে বিভক্ত করেছেন, Literature of Power এবং Literature of Knowledge রসপ্রধান এবং জ্ঞানের সাহিত্য। রসপ্রধান সাহিত্য হল রসেরই সাহিত্য তা
জ্ঞানের কথা প্রকাশ করে না। রোমান্টিক যুগের অনেকেই মনে করতেন যে সাহিত্য হচ্ছে ভাবের কথা। কল্পনার বরণে রাঙিয়ে তোলাই হচ্ছে কবির কাজ। তবে ডিকুইন্সী শেক্সপীয়র সমালোচনায় অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। এখানে তিনি ভাব নয়, শিল্পের যথার্থ্য বিচার করেছেন যুক্তির মাধ্যমে।
স্যামুয়েল টেলর কোলরীজ
সাহিত্য সমালোচনায় কোলরীজের অবদান কম নয়। ইংরেজি সমালোচনা সাহিত্যে তিনি হলেন আল্পস পর্বত বিশেষ। সর্বক্ষেত্রে তিনি তাঁর দক্ষতার প্রমাণ রেখে গেছেন। কোন সন্দেহ নেই যে তাঁর প্রতিভার বিদ্যুৎ দীপ্তি রোমান্টিক আকাশকে আজো আলোকিত করে রেখেছে। কোন সাহিত্য সমালোচকই তাঁকে অতিক্রম করে নতুন কথা বলতে পারেন নি। কারণ কোলরীজ ছিলেন প্রধানতঃ দার্শনিক। দার্শনিক চিন্তা-ভাবনার আলোকে তিনি তাঁর সাহিত্যতত্ত্ব আলোচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য সমালোচনা গ্রন্থ হল “বায়োগ্রাফিক লিটারারিয়া” (১৮১৭)। এই গ্রন্থটি প্রকাশের পূর্বে তিনি ১৭৯৬ সালে “দি ওয়াচম্যান” বা ‘প্রহরী’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। বেশিদিন তার আয়ু ছিল না। এর “মর্নিং পোষ্ট” পত্রিকার জন্য বেশ কিছু প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। ১৮০৮ সালে তিনি বেশ কিছু বক্ততাদান করেন পরে ১৮০৯ সালে “দি ফ্রেন্ড” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। “বন্ধু” পত্রিকাটি “প্রহরী” পত্রিকার মত ছিল ক্ষণস্থায়ী।
যাইহোক “বায়োগ্রাফিয়া লিটারারিয়া” তাঁর আত্মজীবনী নয়। এটি হল সাহিত্যের জীবনচরিত। এতে চব্বিশটি পরিচ্ছেদ আছে। তার মধ্যে তেরটি পরিচ্ছেদে তিনি কেবল দার্শনিকতা করেছেন। চোদ্দ পরিচ্ছেদে “লিরিক্যাল ব্যালাড”-এর সূচনার বর্ণনা দিয়েছেন, পনের পরিচ্ছেদে শেক্সপীয়রের নাটকের কাব্যশক্তির লক্ষণ সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন, ষোল পরিচ্ছেদে বর্তমানকালের সঙ্গে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর সাহিত্যের পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করেছেন, শেষের সাতটি পরিচ্ছেদগুলিতে সমালোচনার প্রদীপ্ত স্বাক্ষর রেখেছেন। যে দার্শনিক চিন্তার উপর ভিত্তি করে তিনি সাহিত্যতত্ত্বের আলোচনা করেছেন তা হল প্রধানতঃ জার্মান দার্শনিক কাল্টের দার্শনিক তত্ত্ব। কান্ট মনে করেন, “Subjectivity is aesthetic quality” অর্থাৎ আত্মগতভাব হল শিল্পের প্রধান গুণ। কোলরীজ মনে করেন, “কাব্য হচ্ছে বিজ্ঞানের বিপরীতধর্মী এক জাতীয় রচনা যার উদ্দেশ্য হল আনন্দ দান করা, সত্যকে প্রকাশ করা নয়” এ উদ্দেশ্যে সফল করার একমাত্র উপায় হল, আত্মগত কল্পনার আশ্রয় নেওয়া। কল্পনার রঙ দিয়ে যা সৃষ্টি হবে তাই সাহিত্য। যেখানে কল্পনা নেই, আছে শুধু নীতি-নিয়মকে অনুসরণ করে শিল্পরূপ রচনা করা সেখানে কাব্য নেই। এ যেন ক্লাসিক্যাল সাহিত্য শাস্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহ। মনে রাখতে হবে, রোমান্টিক যুগ বিদ্রোহের যুগ।
একই চিন্তার আলোকে তিনি শেক্সপীয়রের সমালোচনা করেছেন। তিনি মনে করতেন শেক্সপীয়র যেমন অ্যারিষ্টটলের পদ্ধতিতে নাটক রচনা করেননি, তেমনি সোফোক্লিসকে অনুসরণ করেননি। শেক্সপীয়ার তাঁর প্রকতিকে অনুসরণ করেই কাব্য রচনা করেছেন। সুতরাং শেক্সপীয়রকে বুঝতে হলে তাঁর প্রকৃতিকে বুঝেই তাঁকে বুঝতে হবে। নাট্যশাস্ত্রের মধ্যেও যেমন তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, তেমনি নিজের মতো করেও তাঁকে বোঝা যাবে না। সাহিত্যের রসতীর্থের যাত্রী ছিলেন কোলরীজ। তাই তিনি শেক্সপীয়রের সমালোচনায় রসের সন্ধান করেছেন। তবে মনে রাখতে হবে, সে রস মানবিক রস। সেই মানবিক রসধারায় পুষ্ট হল “টেবিল টক” গ্রন্থের প্রবন্ধগুলি। এগুলি ঠিক প্রবন্ধ নয়, বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার বিবরণ।
কবি শুধু নন কোলরীজ, তিনি গদ্য শিল্পীও বটে। তাঁর গদ্য রচনার প্রধান গুণ নাটকীয়তা।
বক্তব্যকে জোরালোভাবে প্রকাশ করতে, যুক্তিকে বলিষ্ঠভাবে প্রকাশ করতে তিনি নাটকীয়তার আশ্রয় নিয়েছেন। তাই তাঁর গদ্যে আছে পৌরুষভাব। মনে রাখতে হবে এই গুণটি কিন্তু সর্বক্ষেত্রে প্রকাশ পায়নি।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ
ওয়ার্ডসওয়ার্থ স্বতন্ত্রভাবে কোন গদ্য প্রবন্ধ বা নিবন্ধ রচনা করেননি। কোন সাময়িকপত্রের জন্যেও তিনি লেখেননি। তবে “লিরিক্যাল ব্যালাডের ভূমিকায় তিনি যা লিখেছেন, তা তাঁর সাহিত্য ভাবনার এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর। বিদ্রোহী কবি, যুগের বিদ্রোহী ভাবনাকে তিনি প্রকাশ করেছেন। সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকে কাব্যে স্থান দিয়ে যেমন তিনি সনাতন রীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, তেমনি কাব্যে সম্বন্ধেও তাঁর বিদ্রোহী ধারণাকে প্রকাশ করে বললেন, “কাব্য হচ্ছে শক্তিশালী অনুভূতির স্বতঃ উৎসারিত প্লাবন, যার উৎস আবেগের নির্জন স্মৃতিলোক”। এই ধারণাকে থেকে ওয়ার্ডসওয়ার্থ রোমান্টিক কাব্য এবং বস্তুগত কাব্যের পার্থক্য নির্ণয় করেছেন। রোমান্টিক কাব্যে আবেগানুভূতিই প্রধান। এখানে পরিস্থিতি ও অ্যাকশন আবেগানুভূতির অধীন। অপরদিকে বস্তুগত কাব্যে আবেগানুভূতি পরিস্থিতি ও অ্যাকশনের অধীন। তাঁর মতে আবেগানুভূতি প্রধান রোমান্টিক কাব্য কোন নীতি-নিয়মের অধীন নয়, তা প্রাণের আবেগেই ছুটে চলে। কাব্যের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য হল, ক্লাসিক্যাল সমালোচকদের বিপরীত। হোরেস, স্ক্যালিগার প্রভৃতির মতে সাহিত্যের উদ্দেশ্য হল শিক্ষা দেওয়া। ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলবেন, ‘না’। তাঁর মতে, “কবি কাব্য রচনা করেন মানুষকে আনন্দ দেবার জন্য।” কিন্তু কি ধরনের আনন্দ মানুষ আশা করে কবির কাছ থেকে? ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলবেন, “শৈল্পিক আনন্দ। কারণ কবি তো আর আইনজ্ঞ, চিকিৎসক, জ্যোতিষী, বা বস্তুবাদী দার্শনিক নন। কবি শিক্ষক নন যে শিক্ষা দেবেন। কাব্য হল সমস্ত জ্ঞানের নিশ্বাস এবং সূক্ষ্মতর আত্মা; কাব্য হল আবেগময় প্রকাশ যা সমস্ত বিজ্ঞানের মুখাকৃতি”। অর্থাৎ কবি পারে আবেগানুভূতির প্রকাশ ঘটাতে, বিজ্ঞান পারে না। বিজ্ঞানের সত্যের মধ্যে আবেগানুভূতি নেই, তাতে আবেগানুভূতির সঞ্চার করতে পারে কবি। সুতরাং ওয়ার্ডসওয়ার্থ অনুভূতিকেই কাব্যের প্রাণ বলেছেন।
ঐ একই মতের পথিক হলেন, শেলী, বায়রন ইত্যাদি একই সুর তাঁদের মন্তব্যেও ধ্বনিত হয়েছে।
টমাস লাভ পিকক (১৭৮৫-১৮৬৬)
পিককের জন্ম ওয়েসাউথে। ব্যবসায়ীর পুত্র। গৃহেই শিক্ষালাভ করেছেন। ব্যবসা এবং চাকরীতে ভাগ্য গড়ে তোলার নানাবিধ চেষ্টার পর তিনি ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীতে যোগদান করেন (১৮১৯)। এই কোম্পানীর তিনি একজন সুযোগ্য কর্মচারী ছিলেন। ১৯১২ সালে শেলীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎকার ঘটেছিল, বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল, অক্ষুন্ন ছিল সে বন্ধুত্ব।
সাতখানি উপন্যাস, কিছু কবিতা এবং একটি প্রবন্ধ তিনি রচনা করেছেন। মনে হবে পিকক ছিলেন রোমান্টিক বিরোধী। রোমান্টিকতাকে তিনি যেন সহ্যই করতে পারতেন না। রোমান্টিকতার প্রতি বিদ্বেষবশতঃ তিনি তাঁর “দি ফোর এজেন্স অব পোয়েট্রি” বা “কবিতার চার যুগ” গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন যে, কবিতা শুধু কুসংস্কার ও গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেয়। কবিতা যুক্তিহীন ভাবোম্বাস মাত্র। তাই কবিতার কোন প্রয়োজন নেই। এ শুধু কথার কথা, রাগের কথা। কিন্তু যখন ছোট ছোট টুকরো টুকরো কবিতা রচনা করেছেন তখন রোমান্টিকতার সুর তার মধ্যে ধ্বনিত হয়েছে। এখানেই তিনি ধরা পড়ে গেছেন। কতকগুলি উপন্যাসে তিনি কল্পনাকে আশ্রয় করে সুদূর অতীতে পাড়ি
জমিয়েছেন। পিকক যাই বলুন, যুগের হাওয়া তাঁর সাহিত্য তরণীর পালে লেগেছে, প্রতিকূল প্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে কোন নতুন কথা তিনি বলতে পারেন নি।
ওয়ালটারস্যাভেজ ল্যান্ডার (১৭৭৫-১৮৬৪)
ল্যানডার ছিলেন দীর্ঘায়ু ব্যক্তি। প্রায় নব্বই বছর পৃথিবীর আলো দেখেছেন। দেখেছেন রোমান্টিক যুগ ও ভিক্টোরীয় যুগে ইতিবৃত্তকে। তাঁর জন্মস্থান ওয়ারউইকশায়ার। জন্মেছেন, বনেদি মধ্যবিত্ত পরিবারে। শিক্ষালাভ করেছেন রাগবী এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রজাতান্ত্রিক ভাবধারার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি স্পেনের বিপ্লবকে সমর্থন করেছিলেন। তিনি ভীষণ ক্রোধপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন। বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া লেগেই থাকত। জীবনের মধ্যভাগ ইতালিতে কাটল। ১৮৩৫ সালে ইংলণ্ডে ফিরে এলেন। ১৮৩৮ থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত বাথ শহরে বাস করলেন। কলহের ফলে আদালতে দাঁড়াতে হল। হেরে গেলেন মামলায়। অপমানে ক্ষোভে ইংলণ্ড ত্যাগ করে চলে গেলেন। ফ্লোরেন্সের মাটিতেই শয্যা নিয়েছিলেন।
গদ্য রচয়িতারূপে ল্যাগুরের খ্যাতি থাকলেও তিনি কবিতা রচনাতেই অধিক সময় অতিবাহিত করেছেন। তাঁর কাব্য বা “পোয়েমস্” ১৭৯৫ সালে আত্মপ্রকাশ করে। তারপর “গেবির” (১৭৯৮), ‘হেলেনিকস’ (১৮৪৬, ৪৭, ৫৯), “লাষ্ট ফ্রুট অব এন ওল্ড ট্রী” (১৮৫৩) এবং “হিরোয়িক ইডিলস্” (১৮৬৩), তাঁর গদ্যপ্রবন্ধ ‘ইমেজারি কনভারসেসন” বা কাল্পনিক সংলাপ প্রকাশিত হয় ১৮২৪ এবং ১৮৪৬ সালে।
ল্যাণ্ডর কোন জাতের শিল্পী? রোমান্টিক যুগে ‘বাস করে তিনি কি রোমান্টিক নন? তবে কি তিনি ক্লাসিকপন্থী? তাঁর কাব্যের বিষয়বস্তু ক্লাসিক হলেও তিনি রোমান্টিক কল্পনাকে অস্বীকার করতে পারেননি। প্রেমের ব্যাপারেও তিনি ভীষণভাবে রোমান্টিক। রোমান্টিক কল্পনার আতিশয্যে ভেসে তিনি ভেসে যাননি। তাঁর “কাল্পনিক আলাপের’ মধ্যে প্রাচীন গ্রীস এবং রোমের এবং মধ্যযুগের নরনারীদের কাল্পনিক সাক্ষাৎকার এবং কাল্পনিক আলাপন নিঃসন্দেহে রোমান্টিকতার লক্ষণ, যাইহোক তাঁর রচনায় মুন্সিয়ানার ছাপ আছে। একশ ‘পঞ্চাশটি সংলাপকে তিনি দুশ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন, যেমন নাটকীয় সংলাপ এবং কথকতামূলক সংলাপ। এই দুই শ্রেণীর সংলাপের মধ্য দিয়ে তিনি বেশ কয়েকটি চরিত্রকে জীবন্ত করে সৃষ্টি করেছেন। যেমন, অষ্টম হেনরি ও অ্যানবলিয়নের, সংলাপ, মার্সেলাস হ্যানিবলের সংলাপ, হেলেন এবং একিলিসের সংলাপ, দান্তে এবং বিয়াত্রিচের সংলাপ প্রভৃতি। এসবের মধ্যে ল্যাগুরের কল্পনাশক্তির প্রাচুর্য্য ও বৈচিত্র্য বিপুলভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর গদ্য সংযত, সংহত, ঘনবদ্ধ ও বাক সৌন্দর্য্যে সমুজ্জ্বল। ইংরেজি রোমান্টিক যুগ বলতে রোমান্টিক কাব্য কবিতার যুগকেই বুঝায়। কারণ রোমান্টিক কবিতার মধ্যে ভাবকল্পনার এমন বিশাল বৈচিত্র্যময়তা, এত অপূর্ব বর্ণের মহাসমারোহ, এমন ধ্যানতন্ময়তা, আবেগের এমন বলিষ্ঠ বাঁধ-ভাঙ্গা উচ্ছ্বাস, ব্যাকুল করা মনের এমন আকুল করা আর্তি তীক্ষ্ণ তীব্র রূপে খন্ড খন্ড হয়ে সোনালী আলোর ঝরনা ধারার মত আগে কখনো প্রকাশ হতে দেখা যায়নি। এই রোমান্টিক কাব্য কবিতার কুলপ্লাবী প্লাবনে সব কিছু ভেসে গেল। রোমান্টিক কল্পনার দিগন্তহীন অজানা রাজ্যের সৌন্দর্যে দিশেহারা হয়ে পড়ল যেন সমস্ত জাতি, ফুলে ফুঁসে টগবগিয়ে গর্জে উঠল নবমানবতাবোধ, জাতীয়তাবোধ এবং বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ। এ সবেরই প্রকাশ ঘটেছে কাব্যে। কিন্তু গদ্য সাহিত্যে তার বিশেষ কিছু প্রকাশ ঘটেনি কেন? স্কটের উপন্যাসে বৈচিত্র্য নেই। রোমান্টিক তাবনার সব কিছুর প্রকাশ ঘটেনি তাঁর উপন্যাসে। রোমান্টিক আকাশে স্কট যেন নিঃসঙ্গ তারা। না, উপন্যাসের কোন দাপট নেই। গদ্য সাহিত্যও কি কবিতার সঙ্গে সমানভাবে পাল্লা দিতে পারল?
না, পারল না। কারণ রোমান্টিক যুগের কবিদের কাছে রোমান্টিক চিন্তাভাবনা ছিল একটা দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় যা গদ্য বা উপন্যাস রচয়িতাদের ছিল না। ছিল না যে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। না থাকলেও রোমান্টিক হতে তাদের অসুবিধে ছিল না। আর এখানেই হল কবিদের সঙ্গে রচয়িতাদের পার্থক্য। আত্মপ্রত্যয়হীন, দৃঢ় একটা বিশ্বাসের সমর্থক না হয়ে রোমান্টিক হওয়া আর সেই বিশ্বাসকে রক্ষাকবচ করে রোমান্টিক হওয়ার মধ্যে ব্যবধান থাকবেই। এই ব্যবধানের জন্যই কাব্য যা করতে পারল গদ্য তা পারেনি। সুতরাং রোমান্টিক হতে যখন বাধা নেই তখন কবিরও অভাব হল না, অভাব হল না উপন্যাস রচয়িতার। তাঁদের সবাকার পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়। তবু বলল, রোমান্টিক কবিদল নিজেদের মধ্যে গড়ে তুলেছিল একটা গোষ্ঠী নির্দিষ্ট একটা ভাবনাকে কেন্দ্র করে, যা গদ্য রচয়িতারা পারেনি। তাই তাদের সমালোচনা সাহিত্য বা সাহিত্যতত্ত্ব আলোচনাতেও ছিল সেই নির্দিষ্ট ভাবনাকে রূপ দেবার, যা গদ্য রচয়িতারা দিতে পারেনি।
রোমান্টিক যুগের নাট্য সাহিত্য
কোলরীজ:-নাটক রচনার লোভ কোলরীজও সামলাতে পারেননি। কারণ শেক্সপীয়রের নাট্যরস সম্ভোগে যার হৃদয় পরিতৃপ্ত তার পক্ষে লোভ সম্বরণ করা সম্ভব ছিল না। লোভ এক জিনিস আর নাট্যরচনা আর এক জিনিস। ক্ষমতা নেই তবু লিখলেন। তাঁর নাটক “দি ফল অব রোবপিয়ের” বা “রোবসপিয়রের পতন” “রিমোর্স” এবং “জ্যাপোলিয়া” নেহাতই কথোপকথন আকারে নাটক। তিনি নাট্যকার শীলারের একটি নাটক অনুবাদ করেছিলেন। নাটকটি হল “ওয়ালেনষ্টেন”। কোলরীজের নাটকগুলি ব্যর্থতার নজির হয়ে রইল।
রবার্ট সাদে:-যে নাটকটি রচনা করতে তিনি কোলরীজকে সাহায্য করেছিলেন সে নাটকটি হল “দি ফল অব রোবপিয়ের।” তাঁর স্বরচিত নাটক হল, “ওয়াট টাইলার”। এগুলিও ব্যর্থতার ভারে জর্জরিত।
বায়রন:-নাট্য রচনায় সিদ্ধিলাভ না করলেও, চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর “ম্যানফ্রেড” (১৮১৭), “মেরিনো ফ্যালাইরো” (১৮২০) এবং কেইন (১৮২১) আসলে নাটকাকারে কাব্য বা নাট্যকাব্য। নাটক রচনার জন্য নাটক লিখেছিলেন কয়েকটি। তার মধ্যে “সারদানাপালুস’ এবং “টু ফসকারি” এবং উল্লেখনীয় “ডিফর্মড ট্রান্সফর্মড”।
শেলী :- “প্রমিথিউস আনবাউণ্ড” নাট্যকাব্য, নাটক নয়। তাঁর সার্থক নাটক “চেথিত”। এ নাটক মঞ্চস্থ করা সম্ভব নয়। মঞ্চস্থ করার জন্য নাটকটি রচিত হয়নি। কারণ পাত্রপাত্রীদের মুখের ভাষাকে তিনি আধুনিক ভাষার আদলে সৃষ্টি করেননি। যে কারুণ্য তিনি সৃষ্টি করতে চেয়েছেন তা পরিচিত ভাষার প্রকাশ, নাহলে তার আবেদন বলে কিছু থাকে না। তাঁর এই ত্রুটি তিনি নিজেও স্বীকার করে নিয়েছেন। এখানে শেলী বাস্তবের মাটিতে নেমে এসেছেন। যে কাহিনী অবলম্বন করে নাটক রচনা করেছেন তা বীভৎস কদাকার। কন্যার সঙ্গে পিতার যৌন ব্যভিচারের কাহিনী। পিতাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এ কাহিনীকে করেছে মুখর। মানবতা বোধ এই কাহিনীর মূল সুর। যদিও শেলী দাবী করেছেন নাটকটি ট্র্যাজেডী, তবু বলা যায় যে ট্র্যাজেডির প্রচলিত সুর এখানে অনুপস্থিত। তিনি নাটকটি এরিষ্টটলের পদ্ধতি অনুযায়ী রচনা করেন নি। “হেলাস” তাঁর কাব্য নাটক।
চার্লস ল্যাম্বঃ-শেক্সপীয়রের নাট্যরসতীর্থ পথের পথিক ল্যাম্ব কয়েকটি নাটক রচনা। করেছিলেন। তাঁর রচিত ট্র্যাজেডি নাটক হল “জন উডভিল” (১৮০২)। কাব্য নাটক। নাটকটি মঞ্চ
সফল হয়নি। তাঁর আরো কয়েকটি নাটক হলো, “মিঃ এইচ”, কমেডি নাটক, “রোজামও গ্রে”-একটি কিশোরী কন্যার জীবনের করুণ কাহিনী নিয়ে রচিত, “দি পনব্রোকার্স ডটার” ইত্যাদি। ল্যাম্ব প্রায়ই থিয়েটার দেখতে যেতেন। ল্যাম্ব যখন হলবোর্নে থাকতেন তখন বোন মেরীকে নিয়ে তিনি অভিনয় দেখতে যেতেন। একসময় অর্থের অভাব মেটানোর জন্য তিনি নাটক রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। যদিও নাটক রচনায় তাঁর কোন দক্ষতা ছিল না, তবুও রচিত নাটক “মি এইচ”-এর অভিনয় দর্শকদের বিরক্তি উৎপাদন করেছিল এবং ল্যাম্ব নিজেও বোধ হয় বিরক্ত হয়েছিলেন।
ল্যাওর:- যে কয়েকটি নাটক রচনা করেছেন ল্যাওর, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল “ডন জুলিয়ান” (১৮১২)। এও এক ব্যর্থতার করুণ নজীর।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ: ইনি চেষ্টা করেছিলেন নাটক রচনা করতে। তাঁর নাটক “দি বর্ডারারার্স” নাটক হিসাবে ব্যর্থ।
নাটক রচনায় এ যুগের সকলেই ব্যর্থ। যদিও নাট্যমঞ্চ ছিল, অভিনেতা ছিল, নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ হোত, দর্শক। ছিল, তবু যাঁরা গদ্যে ও কাব্যে দক্ষতা দেখাতে পারলেন তাঁরা নাটক রচনায় বার্থ হলেন কেন? কারণ নাটক হল সাহিত্য জগতের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ শিল্প। এ শিল্প রচনা যে সহজ ব্যাপার নয় তা সহজেই অনুমেয়। তাছাড়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ নাটক রচনার পক্ষে প্রতিবন্ধক। তাই গদ্যে ও কাব্যে যত সহজে দক্ষতা দেখানো যায় তত সহজে নাটক সম্ভব নয়। নাট্য রচনার মেজাজ, ধৈর্য ও অভিজ্ঞতা তাঁদের কারো ছিল না
এ যুগের পত্র পত্রিকা
এ যুগের গদ্য ও কাব্য রচনায় এবং নাট্যসমালোচনা সাময়িক পত্র পত্রিকার অবদান কম নয়। সত্যি কথা বলতে গেলে রোমান্টিক যুগের প্রথমার্ধ-এ কাব্য কবিতার চেয়ে গদ্যের ফলন বেশি। অবশ্য উপন্যাস ছাড়া। আর এই গদ্যের প্রচুর ফলনের জন্য সাময়িক পত্রের অবদানই বেশি। যেমন “এডিনবরা রিভিয়”। পত্রিকাটি প্রকাশ করেছিলেন ফ্রান্সিস নিফ্রে, সিডনি স্মিথ এবং হেনরি বাউহ্যাস। ফ্রান্সিস নিফ্রে ছিলেন এর সম্পাদক। সাঁইত্রিশ বছর ধরে দাপটে রাজত্ব করেছেন। কারণ কবি সাহিত্যিক এবং প্রাবন্ধিকদের প্রতিষ্ঠা পেতে হলে সাময়িক পত্রের সাহায্যে গ্রহণ ছাড়া সম্ভব ছিল না। শুধু তাই নয় এই পত্রিকাতে কাব্য ও পুস্তক সমালোচনা করা হত। তা অত্যন্ত কঠিন ভাবে করা হত। বিশেষতঃ লেখক কবিদের কড়া সমালোচনা করা হত এই পত্রিকায়। অবশ্য এযুগের অনেকেই এই পত্রিকায় রচনা প্রকাশ করেছেন। বায়রন এই পত্রিকার বিরুদ্ধে কঠিন রোষ প্রকাশ করেছিলেন। এই পত্রিকাটি ছিল রক্ষণশীল হুইগ দলের মুখপাত্র।
“কোয়ার্টারলি রিভিউ” পত্রিকাটি ১৮০৯ সালে প্রকাশিত হয়। টোরিদলের মুখপাত্র। সম্পাদক উইলিয়াম গিফোর্ড। কোলরীজ এই পত্রিকাটির কিছুদিন সম্পাদক ছিলেন। সমালোচনায় এই পত্রিকাটি ছিল অত্যন্ত কঠিন ও কঠোর। এই পত্রিকায় কবি কীটসকে প্রচণ্ড সমালোচনা করা হয়েছিল।
‘ব্ল্যাকউড ম্যাগাজিন’ পত্রিকাটি ১৮১৭ সালে আত্মপ্রকাশ করে। সম্পাদক ছিলেন জন উইলসন এবং লকহার্ট। নিরপেক্ষ পত্রিকা-হুইগ বা টোরী কোন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করেনি। তবে সমালোচনার ক্ষেত্রে পত্রিকাটি মোটেই নরমপন্থী ছিল না। এই পত্রিকাটিতেও কোলরীজ ও বীটসকে তীব্র সমালোচনা করা হয়েছিল। কিন্তু ওয়ার্ডসওয়ার্থকে প্রশংসা করা হয়েছিল।
“লগুন ম্যাগাজিন” পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটে কয়েকজন উদারপন্থীর সহযোগিতায়। সাহিত্য জগতে এই পত্রিকাটির অবদান অসীম। কারণ এই পত্রিকায় তরুণদের রচনা প্রকাশ করা হত।
উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কৌতুকরসের রচনা সমস্ত কিছুই এই পত্রিকাতে প্রকাশিত হত। ল্যাম্বের “এসেস অব ইলাইয়া,” ডিকুইন্সীর “ওপিয়াম ইটার” হাজলিট, হুড এবং মিস মিটফোর্ডের রচনা এই পত্রিকায় আত্মপ্রকাশ করেছিল।
“ফেজার্স ম্যাগাজিন” হল আর একটি রুচিসম্পন্ন পত্রিকা। আত্মপ্রকাশ ১৩৮০ সালে। হিউ ফ্রেজারের সহযোগিতায় আইরিশম্যান ম্যাগিন লণ্ডনে পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। বিশুদ্ধ সমালোচনা হত এই পত্রিকায়। যাঁরা লিখতেন তাঁরা হলেন, কার্লাইল, সাদে, কোলরীজ, এনওয়ার্থ, হগ, থ্যাকারে প্রমুখ। বার্নস, সুইফট, স্কটের রচনার রসগ্রাহী আলোচনা এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
“দি পরকুপাইন” এবং “কবেটস্ উইকলি পলিটিক্যাল রেজিষ্টার” পত্রিকা দুটির নামও উল্লেখযোগ্য। শেষের পত্রিকাটি ১৮০২ সালে আত্মপ্রকাশ করে, ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত জীবিত ছিল। সম্পাদক ছিলেন উইলিয়াম কবেট (১৭৬২-১৮৩৫)। নিজের রচনা “রুব্যাল রাইডস্” (১৮৩০) কৃষকের জীবনের এক সুন্দর ছবি এঁকেছেন। কৃষক সমস্যার কথা বলতে গিয়ে লেখক একজন পরিব্রাজকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে সাহিত্যিক ভাষায় প্রকাশ করেছেন। পল্লীপ্রকৃতির বর্ণনা যেখানে তিনি করেছেন সেখানে তিনি যেন কবি হয়ে গেছেন।
রোমান্টিকতা ও যুক্তিবাদ (১৭৯৮-১৮৩২)
যদিও উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধকে “রোমান্টিকযুগ” নামে অভিহিত করা হয় তবুও এই যুগে যুক্তিবাদের ভাবনা একেবারে লোপ পেয়ে যায়নি। বরং বলা চলতে পারে যুক্তিবাদী ভাবনা তার নিজস্ব ধারায় যথারীতি এগিয়ে চলছিল। যুক্তিবাদী ভাবনাকে অস্বীকার করার উপায় ছিল না। কারণ যুক্তিবাদী ভাবনা রাষ্ট্রিক ও সমাজভাবনার সঙ্গে যেমন যুক্ত তেমনি যুক্ত বৈজ্ঞানিক চেতনার সঙ্গে। বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করছিল। ফলে রাজনৈতিক ও সমাজ বিজ্ঞানের চিন্তানায়কদের নানাভাবে চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছিল। চিন্তা করতে হচ্ছিল সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সমস্যাগুলি নিয়ে। প্রথম সমস্যা হচ্ছে ক্রমবর্ধমান শিল্প সমস্যা, দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে সাধারণ মানুষের সমস্যা। যত শিল্পের প্রসার ঘটছে ততই বণিক সম্প্রদায়ের ক্ষমতা বাড়ছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষার সমস্যাও বাড়ছে। এখন অতীতের যে সব সামাজিক প্রথা আছে তা দিয়ে আর সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না। সুতরাং চাই নতুন কিছু যা দিয়ে সমস্যার সমাধান করা যায়। সৃষ্টি হল “ইউটিলিটি দর্শন”। বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখেই এই দর্শন গড়ে উঠল।
এই দর্শনের যাঁরা প্রবক্তা তাঁদের অন্যতম হলেন জেবেসি বেন্থাম (১৭৪৮-১৯৩২)। ইংলণ্ডের রেড-লায়ণ স্কোয়ার-এ জন্মগ্রহণ করেছেন। শিক্ষালাভ করেছেন, অক্সফোর্ডে, আইন ব্যবসায় যোগ দিয়েছেন। কিন্তু আইন ব্যবসার চেয়ে জীবনদর্শনের ভাবনাতেই তিনি মশগুল থাকতেন। কবিতা ভালোবাসতেন না কিন্তু সঙ্গীত ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয়। যে বাড়ীতে বাস করতেন সেটাকে আশ্রম বলা হত। কারণ বাড়িটার চারিদিকে ছিল ফলগাছ, লতা আর নানারকম গাছে ভরা। যাইহোক তিনি হলেন “ইউটিলিটি দর্শনের” স্রষ্টা। তাঁর দর্শনের মূলকথা হল অধিক সংখ্যক লোকের অধিকতর হিত, greatest happiness of the greatest number. সমাজে সকলের হিতের কথা তিনি বলেননি। সকলের হিত সম্ভবও নয় তাই যত বেশি লোককে সুখ দেওয়া যায় তার ব্যবস্থা করা উচিত। আর এই ব্যবস্থা করতে হলে প্রত্যেককেই মনে রাখতে হবে যে নিজের অর্জিত সুখ পরসুখ বর্ধনেই অম্লান থাকে। এই দর্শন সম্বন্ধে তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি হল “লেটার্স অন ইউজারি” (১৭৮৭), “ইনট্রোডাকশান টু দি প্রিন্সিপলস অব মর্যালস এণ্ড লেজিসলেসন” (১৭৮৯), “এ প্লী
ফর দি কনস্টিটিউশন” (১৮০৩) ইত্যাদি। সবই নীতি ও নৈতিকতা সম্পর্কিত আইনের বই। ঝরঝরে চমৎকার গদ্যে রচিত। তাঁর মতবাদ ফরাসী দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ফরাসী নাগরিকত্বও পেয়েছিলেন তিনি।
টমাস রবার্ট ম্যালথাস (১৭৬৬-১৮৩৪)
ম্যালথাস একজন এ্যাংলিকান পাদরি। পণ্ডিত ব্যক্তি। অর্থনীতি, ইতিহাসে তাঁর পাণ্ডিত্য অগাধ। হাইলিবেরী কলেজের অধ্যাপক। গডউইনের সাম্যবাদী মতবাদের বিরুদ্ধে তিনি একটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। প্রবন্ধটি হল “এসে অনদি প্রিন্সিপল অব পপুলেশন” (১৮০৩)। ছদ্মনামে প্রকাশ করেছিলেন। প্রবন্ধটির বিষয়বস্তু হল, “জনসংখ্যার, খাদ্য উৎপাদনের চেয়ে দ্রুত বেড়ে যাবার একটা প্রবণতা আছে।” সুতরাং অভাব থাকবেই। এই অভাবের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য তিনি যে দাওয়াই বাৎলেছেন তা হলো “ছটি ছেলেকে ভরণপোষণ করার ক্ষমতা না থাকলে বিয়ে কোরো না।” জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও তার প্রতিরোধের সমস্যা বুদ্ধিজীবীকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তার ফলে এই তত্ত্ব। রচনার গুণে তা আজো সমাদৃত।
ডেভিড রিকার্ডো (১৭৭২-১৮২৩)
নিজে ব্রোকার ছিলেন। বাবাও ব্রোকার ছিলেন। অর্থনীতিতে অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি ট্যাক্স সংক্রান্ত বিষয় প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। কারণ জমির মালিকের সঙ্গে জমির ভাড়াটিয়াদের ভাড়া নিয়ে একটা সমস্যা ছিল। সেটাই তিনি আলোচনা করেছেন।
অ্যাডাম স্মিথ (১৭২৩-১৮৯০)
স্মিথের জন্ম কার্কেলডিতে। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। শিক্ষা লাভ করেছেন অক্সফোর্ডে। গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে লজিক পরে মর্যাল ফিলজফিতে অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর সর্বশ্রে রচনা “ওয়েলথ অব নেশন” (১৭৭৬)। গ্রন্থটি বুর্জোয়া ধনতন্ত্রবাদের একটি আদর্শগ্রন্থ। তিনি মনে করতেন যে শিল্প বাণিজ্য বিকাশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের একান্ত প্রয়োজন নেই। স্বাধীনভাবে তাকে বিকশিত হতে দেওয়া উচিত। যাই হোক গদ্যের ভাষা প্রয়োজনমাফিক।
ইংরেজি গদ্যের প্রসার কেবল সাহিত্যে ঘটেনি, ঘটেছে রাজনীতিতে, অর্থনীতি বিজ্ঞানে, সমাজনীতিতে, আইনে, দর্শনে ইত্যাদিতে।
বাংলা সাহিত্যে ইংলিশ রোমান্টিকতাবাদের প্রভাব
শেলী ও রবীন্দ্রনাথ
উনিশ শতকের ইংরাজি সাহিত্যের রোমান্টিক সৌরজগতের অন্যতম কবি শেলীর মানস গঠন ছিল ভিন্নতর। তাঁর জীবনের গতিপথ ছিল না মসৃণ। তাই দুস্তর প্রস্তরময় দুর্গম সমাজের কঠিন মৃত্তিকার উপর দিয়ে তিনি জীবনের যাত্রা শুরু করেছিলেন। তাঁর জীবনকে দুটি অধ্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম অধ্যায়ের মধ্যে শেলীর চেতনার মূলে রয়েছে তারুণ্যের স্বভাবধর্ম, প্রচলিত সংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসের প্রতি অস্বীকৃতি এবং যুক্তিহীন আবেগময়তা। শেষ অধ্যায়ে দেখতে পাই মানবিক প্রেম বিশ্বপ্রেমে পরিশুদ্ধ। আত্মার অমৃতত্বের উপলব্ধিতে মুক্তি। প্রথম অধ্যায়ে পরিণতি ঘটেছে হ্যারিয়েটের সঙ্গে বিচ্ছেদে, শেষ অধ্যায়ের শুরু মেরী গডউইনের পবিত্র প্রেরণায়।
জীবনের প্রথম প্রত্যুষে শেলী ফরাসী বিপ্লবের ঋষি ও উদগাতা রুশোর বৈপ্লবিক আদর্শকে গ্রহণ করেছিলেন। রুশোর মতবাদ সেদিন ইউরোপের জনগণমানসে প্রচলিত ধর্ম ও সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রবল ঝঞ্ঝা ও উন্মত্ততা সৃষ্টি করেছিল। যদিও শেলী ফরাসী বিপ্লবের অব্যবহিত পরেই এই পৃথিবীর আলোক দেখেছিলেন তবুও রুশো প্রবর্তিত নবাদর্শ সেদিন তাঁর চিত্তকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকেই ইউরোপের জীবন চঞ্চল ও মুখর। সহজ, শান্ত, নিস্তরঙ্গ জীবনের তটপ্রান্ত ভাঙ্গনের সুরে মুখর। ১৮১৫ সালে Liberal আন্দোলনের আবির্ভাব, utilitarian দর্শনের ব্যাপক জনপ্রিয়তা এবং দীর্ঘ পঁচিশ বৎসর ব্যাপী ইউরোপের রাজনৈতিক আকাশে কালো মেঘের কুটিল ছায়া সমগ্র ইউরোপকে অশান্ত করে তুলেছিল। ব্যক্তি স্বাধীনতার বাণী সেদিন ইউরোপের সাধনা ও স্বপ্ন ছিল। সমাজের অন্যায়, অসত্য, সংকীর্ণতা ও সমস্ত বন্ধনের বিরুদ্ধে শেলী বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। শেলীর চেতনা বিজ্ঞান চেতনা। বৈজ্ঞানিক যুক্তির আলোকে রচনা করেছিলেন “The necessity of Atheism” সেদিন শেলীর জীবনের মূলমন্ত্র ছিল “ভাঙ্গ ভাঙ্গ কারা আঘাতে আঘাত কর।” ভগবানের নামে যাজক সম্প্রদায়ের ভণ্ডামীকে তিনি সহ্য করতে পারেন নি। ভগবানের নামে মানুষের অবমাননাকে তিনি স্বীকার করে নিতে পারেন নি। সমাজের নিপীড়িত মানবের নিদারুণ বেদনায় শেলীর অন্তর বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। তীব্র অপমানের দাহ শেলীর শিরায় শিরায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছ। তাই শেলী ফরাসী বিপ্লবের মন্ত্রকে জীবনের পাথেয় করে মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন “Master theme of Epoch in which we live” শেলীর প্রথম জীবনে এটাই ছিল চরম সত্য ও পরম লক্ষ্য। তারুণ্যের সোনার কাঠির স্পর্শে এবং যৌবন ধর্মের আবেগে ও বিশ্বমানবতা মন্ত্রে দীক্ষিত কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল, “One curse alone was spared –the name of the God.”
শেলী মানবের আর্ত আত্মার রোদনধ্বনিকে কান পেতে শুনেছেন, তাই নিছক কল্পনার ডানায় ভর করে তিনি অসীম শূন্যে যাত্রা শুরু করেননি। পরন্তু মর্ত মানবের নিগ্রহই তাঁর কণ্ঠকে মুখর করেছিল, তারুণ্যকে করেছিল সফেন, যৌবনধর্মকে করেছিল সুতীক্ষ্ণ। তাই শেলী তীব্র ভাষায় বলেছিলেন, “The habitable earth is full of bliss, man was a nobler being, slavery had crushed him to his country’s blood–Stained dust or he was bartered for the fame of power, which an eternal impulses destroying, makes human will an article of trade, or he was led legal butchery, to turn to worms beneith that burning sun, where king first leagued against the rights of man and priests first traded with the name of God.” এই মানবপ্রীতি ও তারই সুরের বন্যা তরুণ যৌবনের বাউলের একতারায় ধ্বনিত হয়েছিল। মর্তের মাটিকে ভালবেসে তিনি মর্তমানবকে ভালোবেসেছেন। এবং এই বসুন্ধরার একান্ত আপনজন মাটির
মানুষকে তিনি সমাজের সমস্তরকম বন্ধন থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন, যে সমাজ ঈশ্বরের নামে পুরোহিত আর রাজতন্ত্রের এক বিভীষিকার রাজত্ব সৃষ্টি করে মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্নকে অমাবস্যার কারা-অন্ধকারে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে। শেলী প্রাণহীন অচলায়তনকে ভেঙ্গে ফেলে মানুষকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন, সে মুক্তি আধ্যাত্মিক মুক্তি নয়-ব্যক্তি স্বাধীনতার মুক্তি, সমাজের চিরাচরিত বদ্ধজীর্ণ প্রাণহীন প্রথা আর বর্বর শাসনের হাত থেকে মুক্তি। অর্থাৎ প্রাণের ও জীবনের সহজ স্বাভাবিক মুক্তি। আর সেই মুক্তির পাদপীঠ হল সুন্দর পৃথিবী। তাই শেলী বলেছেন, “Oh।
happy earh Reality of heaven, Thou art the end of all desire and will the product of an action.”
কিন্তু শেলীর জীবনের গতিপথ ভিন্নদিকে পরিবর্তিত হয়েছে আর একটি বিশেষ সন্ধিক্ষণে।
প্রথমতঃ, গডউইন পরিবারের প্রভাবের ফলে শেলীর তরুণ বয়সের বিশ্বাসের মর্মমূলে দোলা লেগেছে। এতদিন তিনি যা অস্বীকার করে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন আজ তাই জীবনে সত্য হয়ে দাঁড়াল। দ্বিতীয়তঃ ইটালীর হৃদয়হরণকারী প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সুনীল আকাশের মোহমদিরতা, পাইন সমাচ্ছন্ন পর্বতের সবুজ ঔজ্জ্বল্য, কবিকে মুগ্ধ করেছিল। প্লেটোর দার্শনিক মতবাদ সেদিন কবিচিত্তকে অধিকার করেছিল। গ্রীক সৌন্দর্যপ্রিয়তা এর অন্যতম কারণ। এর ফলে কবির নিকটে যে ফরাসী বিপ্লবের বাণী ও বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদ একান্তভাবে সত্য ছিল তা মিথ্যায় পরিণত হল। তাই শেলী জীবনের আর একপ্রান্তে ঘোষণা করলেন, “The doctrines of the French and the material philosophy are as false as they are pernicious.” শেলীর যৌবন ধর্মের চাঞ্চল্য এখানে স্তব্ধ, তটস্থ। কিন্তু জীবন জিজ্ঞাসার প্রচণ্ড আবেগে বেদনার ক্ষ্যাপা সুরে তাঁর হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত। তাই পাড়ি জমিয়েছেন সীমাহীন অনির্দেশ্য লোকে উত্তরের আশায়।
রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবও উনিশ শতকের নবজাগরণের দীপ্ত আলোকে। জাগরণের বহ্নি বন্যায় যখন সমস্ত দেশের মরাগাঙে জোয়ার এসেছে, যখন পাশ্চাত্যের তটপ্লাবী কল-কোলাহলে জীর্ণ লোকাচারের শীর্ণ বাঁধে ভাঙ্গন ধরেছে, যখন সুদূরের পানে উৎকণ্ঠিত তীর্থযাত্রীদের নিরুদ্ধেশ পদযাত্রা শুরু হয়েছে, যখন দেশের মুক্তিকামনায় ভোরের আকাশ রঙ্গীন হয়ে উঠেছে-বাংলার মানস ভূমিতে তখন বিদ্রোহের প্লাবন। কবি বলেছেন, “আমার পরিবার আমার জন্মের পূর্বেই সমাজের নোঙর তুলে দূরে বাঁধাঘাটের বাইরে এসে ভিড়েছিল। আচার অনুশাসন, ক্রিয়াকর্ম সেখানে সমস্তই বিরল।” এটা সম্ভব হয়েছিল রামমোহন শিষ্য দেবেন্দ্রনাথের প্রচেষ্টায়। তিনি হিন্দুধর্মের বাহা আচার-আচরণ আর প্রাণহীন প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। হিন্দুধর্মের নিষ্প্রাণ হৃদয়হীন আচারের নির্দয় নিষ্ঠুরতাকে উপেক্ষা করে তিনি প্রাচ্যের বিশ্বমানব প্রেমধর্মকে পাথেয় করে এবং পাশ্চাত্তের জ্ঞানের আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে নতুন পথে যাত্রা সুরু করেছিলেন। বাংলাদেশের ধর্মের অন্ধ মূঢ়তার উন্মাদনা ও ধর্ম সাধনার নামে আবেগের অত্যাচার থেকে ঠাকুর পরিবার ছিল মুক্ত। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ শান্ত জীবনের উপাসক ছিলেন। তাই ঠাকুর পরিবারের একদিকে যেমন ছিল উপনিষদের মধ্য দিয়ে প্রাক্ পৌরাণিক যুগের সঙ্গে ভাব সম্মিলন অন্যদিকে তেমনি ছিল বিদেশী সাহিত্য ও দর্শনের আনন্দের স্রোতে নিবিড় অবগাহন।
রবীন্দ্রনাথের মানসলোকে জীবন চেতনা ও জীবন জিজ্ঞাসার ধ্যান মন্ত্রটি চিরকালের জন্য এঁকে দিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশ রবীন্দ্রনাথকে শান্তম, শিবম, সুন্দক্রমের সাধনায় সিদ্ধিলাভের পথে উদ্বোধিত করেছিল। তাই রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যৌবন ধর্মের অসংযত চেতনা ও চাঞ্চল্য ও তারুণ্যের সংযমহীন ভাবাবেগের প্রকাশ কোথাও নেই। অধ্যাত্ম শিক্ষাই রবীন্দ্রজীবনের দিগদর্শন। তিনি ধীরে ধীরে সিদ্ধির পথে অগ্রসর হয়েছেন।
“মহর্ষির ব্রাহ্মধর্মাদর্শ রবীন্দ্রনাথের মধ্য দিয়া উজ্জীবিত হইয়া নবকলেবরে বিশ্বধর্মরূপে বিশ্বভারতীর মধ্যে মূর্তি গ্রহণ করে; কবি সেই নবতর ধর্মের নাম দিয়াছেন মানুষের ধর্ম। রবীন্দ্রনাথ সেই ধর্ম তাঁর সাহিত্যের মধ্য দিয়া ব্যক্ত করিয়াছেন।”
শেলী সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তিনি নূতন সমাজের সৃষ্টির প্রেরণায় পুরাতনকে অস্বীকার করেছেন। ধর্মতন্ত্র আর রাজতন্ত্রের নাগপাশ ও সামাজিক বিধি-নিষেধের বিরুদ্ধে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। আঘাত করেছেন ইউরোপের মানবতাঘাতী সমাজের অচলায়তনকে। অস্বীকার করেছেন ভগবানের স্বীকৃতিকে। শেলীর মত অতখানি চরমপন্থী হওয়া রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সম্ভব ছিল না। রবীন্দ্রনাথের পক্ষে ভগবান অস্বীকৃতি কল্পনাতীত। কারণ পরমসুন্দর ভগবান-ই তো তাঁর প্রাণের কর্ণধার। শৈশবকালের বেলাভূমিতে যে দাগ পড়েছিল তাই সর্বকালের হয়ে রইল। সেখানে সংশয় ও সন্দেহের কালো কুটিল ছায়া রেখাপাত করেনি। কিন্তু তিনি হিন্দুধর্মের বাহ্য আচার অনুষ্ঠানের উপর আঘাত হানতে দ্বিধা বোধ করেননি। তিনি আঘাত হেনেছেন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অর্থহীন নিষ্ঠুর মূঢ়তাকে, বহু বিবাহ এবং বাল্য বিবাহের যুক্তিহীন প্রথাকে এবং জীর্ণ লোকাচার ও পৌত্তলিকতার অন্ধ ভক্তির বীভৎসতাকে। হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করার অর্থ ঈশ্বরের প্রতি আস্থাহীনতা নয়, তবুও এর প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। অর্থাৎ হিন্দুধর্মের রক্ষণশীল সমাজ রবীন্দ্রনাথকে কঠোর সমালোচনা করতে কসুর করেনি। কিন্তু ইংরেজ সমাজ শেলীকে ক্ষমা করেনি। ইংরেজ সমাজ শেলীকে কেবলমাত্র ‘নাস্তিক’ আখ্যায় ভূষিত করেই ক্ষান্ত থাকেনি, শেলীকে ইংলণ্ড থেকে বিতাড়িত করেছিল। ইংরেজ সমাজ শেলীর প্রতি শুধু নির্মম অত্যাচারই করেনি, নির্বাসনে পাঠিয়ে সংকীর্ণ বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথকে অপবাদ সহ্য করতে হয়েছে বটে, তবে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের নিষ্ফল অভিশাপে আর রুদ্র রোষে ভস্মীভূত হতে হয়নি।
পূর্বেই বলেছি রবীন্দ্রনাথ শেলীর মত অতখানি বিদ্রোহী হতে পারেননি। কারণ আধ্যাত্মিক চেতনাই কবিকে দুঃসাহসিক হতে বাধা দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথও বিদ্রোহ চাহেন কিন্তু সে বিদ্রোহ আধ্যাত্মিক কল্যাণময় শক্তিতে সমুজ্জল। সে বিদ্রোহে দীপ্ত আছে দাহ নেই, সুর আছে উন্মাদনা নেই, বহ্নি আছে বহ্ন্যুৎসব নেই। তাই দীপ্তি চক্ষু শীর্ণ সন্ন্যাসী রুদ্র বৈশাখ নিখিলের পরিত্যক্ত মৃতস্তূপে শান্তির মন্ত্র পাঠ করেন। বর্ষশেষে উন্মাদিনী কালবৈশাখীর নৃত্য নবজীবনের আহবানকে বহন করে আনে না, পরিবর্তে মহান মৃত্যুর রূপকে আধ্যাত্মিকতায় মহিমান্বিত করে তোলে। দুর্জয়ের জয়মাল্য কবির ডালাকে যতই পূর্ণ করুক তবু রুদ্র সন্ন্যাসী শ্মশানের বৈরাগ্যবিলাসী। তাই রবীন্দ্রনাথ হিন্দুধর্মের তথাকথিত প্রাণহীন আচার অনুষ্ঠানকে আঘাত হেনেছেন, কিন্তু ধর্ম বা ধর্মতন্ত্রের বিরুদ্ধে নয়।
শেলী আরও তীব্র, আরও তীক্ষ্ণ, আরও ক্ষুরধার। Queen Mab এর মধ্যে শেলীর অসহিষ্ণু উক্তি শোনা যায়। তিনি মর্তের মৃত্তিকাকে ভালবেসেছেন সেই ভালবাসার মধ্যে সন্দেহ নেই, সংশয় নেই। আধ্যাত্মিকতার আলোকে সুন্দরী ধরাতলকে তিনি মোহমুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেননি। দেখেছেন, আধ্যাত্মিকতায় মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টির আবরণকে ভেদ করে বৈজ্ঞানিক যুক্তির আলোকে, দেখেছেন বাস্তব পৃথিবীর নির্দয় কঠিন রুঢ় বাস্তবতাকে। তাই দুঃসাহসের সঙ্গে জেরুজালেমের মন্দিরের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন:
“There an inhuman and uncultured race
Howled hideous praises to their demon God.”
তারুণ্যের প্রবল বন্যায় যৌবনধর্মের সতেজ যুক্তির আলোক সৃষ্টির বিপুল নেশায় শেলী প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের মর্মমূলে আঘাত হেনেছেন। কারণ ঈশ্বরকে নিয়েই ধর্ম। ধর্মকে নিয়েই সমাজ
এবং যে সমাজের তথাকথিত বিধিনিষেধ মানুষের চলার পথকে রুদ্ধ করেছে সেই সমাজের ঈশ্বরীয় চেতনার বিরুদ্ধেই শেলী কঠিন আঘাত হেনেছেন। রুশো বলেছেন, Man is chained by the chain of custom, রুশোর এই বাণী শেলীকে দুঃসাহসিক হবার প্রেরণায় উদ্বোধিত করেছিল, আপসহীন সংগ্রামের পথে আহবান জানিয়েছিল। অন্যায়, মিথ্যা, অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য শেলী ডাক দিয়েছিলেন।
“Never: but bravely bearing on, they will Is destined an eternal was to wage With tyranny and falsehood, and uproot The germs of misery from the human heart.”
বিংশতি বৎসরের যুবকের কণ্ঠের বিদ্রোহের সুর সেদিন সমস্ত ইংলণ্ডকে সচকিত করে তুলেছিল। যাজক সম্প্রদায়, চার্চের কর্তৃপক্ষ ও ধর্মভীরু মানুষের বুকে শিহরণ তুলেছিল। শেলী ‘বিদ্রোহী শেলী’ নামে অভিহিত হয়েছিলেন। তাই শেলীর uncontrolable spirit সমাজের সমস্ত রকম বন্ধন থেকে মুক্তি চেয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ সমাজের সমস্ত রকম বন্ধন থেকে মুক্তি চাননি। তবে মনুষ্যত্বের অন্তহীন, প্রতিকারহীন, পরাভবকে চরম বলে স্বীকার করেননি। অন্যায়, অসত্য অত্যচারের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠ বার বার তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত করেছে। যে সমাজের চারিদিকে ধনীর দৈন্যের অত্যাচার, পণ্ডিতের মূঢ়তা আর নাগিনীদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠেছে, সেই সমাজের দিকে তাকিয়ে তিনি শান্তির ললিত বাণী শোনাননি বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে ডাক দিয়েছেন সংগ্রামের তরে। রবীন্দ্রনাথও এক্ষেত্রে আপসহীন সংগ্রামী, দৃঢ়তায় সুকঠিন। অবশ্য বিদ্রোহী আখ্যায় তাঁকে সমাজ ভূষিত করেনি।
কোন একজন বিদগ্ধ সমালোচক বলেছেন: “রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শে, স্বাধীনতার মধ্যে সংযম, আনন্দের মধ্যেও সংযম, জীবনের প্রতি কর্মে ভাবনায় সংযম অর্থাৎ কোন বিষয়ে মাত্রা জ্ঞান হারাইলে ছন্দ ভঙ্গ হয়। কবির কাছে সৌষম্য বা সুষমাই সৌন্দর্য, তথা পরিপূর্ণ জীবনবেদ।” রবীন্দ্রনাথ এই সংযমের তটরেখায় কাব্যের কলতান ফুটিয়ে তুলেছেন। ব্যতিক্রম কোথাও নেই। প্রেমের মধ্যেও সেই সংযমতাকে তিনি রক্ষা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রেম চেতনা এক কথায় বলা যেতে পারে কিছুটা বৈষ্ণব প্রেমের স্বরূপ। কারণ কবির মতে “বিরহই প্রেম কাব্যের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ।” কবির কাছে প্রেমের সার্থকতা বিরহে, মিলনে নয়। প্রেমের মধ্যে সৃষ্টিশক্তির ক্রিয়া প্রবল। “প্রেম সাধারণ মানুষকে অসাধারণ করে রচনা করে, তার নিজের ভিতরকার বর্ণে রসে রূপে।” কবির প্রেমিক-প্রেমিকাগণ কেহই সাধারণ নহেন। সকলেই অসাধারণ। রবীন্দ্রনাথের প্রেম চেতনার মধ্যে সুতীব্র আর্তি নেই, নেই প্রতি অঙ্গ লাগি প্রতি অঙ্গের কান্না, আছে প্রেমের মধ্যে ত্যাগ। সেই ত্যাগে যা কিছু সার্থকতা অর্থাৎ প্রেম কামনা কলুষ মুক্ত একটা স্বর্গীয় আবেগ। রবীন্দ্রনাথের নায়িকা যখন বলে “যাব না বাসর কক্ষে বধূবেশে বাজায়ে কিঙ্কিণী। আমার অমর বীর্যে কর অশঙ্কিণী”। অথবা “তোমারে যে ছেড়ে যাই সে তোমারই প্রেমে”। অথবা যখন বলে, “এ প্রেম আমার সুখ নহে দুঃখ নহে”, তখন সুখ-দুঃখের অতীত সেই প্রেমকে সুগভীর বলে মনে হয় না। বিরহের তীব্রতা যদি মিলনের ব্যাকুলতায় কবিচিত্তকে আকুল না করে তবে বিরহের সব রসটুকু নষ্ট হয়ে যায়। যে প্রেম সর্ববন্ধন থেকে মুক্ত-দেহাতীত নৈর্ব্যক্তিক বিশুদ্ধ প্রেম মাত্র, সেই প্রেমের আত্যন্তিক অনুভূতির তীব্রতা বেশ কিছুটা কম। সেই চিরদিবসের প্রেমের মধ্যে কোন উষ্ণ উত্তাপের চমকিত স্পর্শ লক্ষ্য করা যায় না।
কিন্তু শেলীর প্রেমের মধ্যে সুগভীর বেদনার মর্মোচ্ছাস লক্ষ্য করা যায়। শেলীর প্রেমের আর্তি প্রাণের তাপে বহ্নিমান হয়ে ওঠে, তীব্র ব্যাকুলতায় মর্মের ক্রন্দন জেগে ওঠে। “I die, I faint, । fail, oh! press it close to thing again where it will break at last.” শেলীর মধ্যে রয়েছে অনির্দেশ্য বেদনার ক্ষেপা সুর। যা প্রাণের বেদনার রঙ্গে রঙ্গীন করা। যে প্রেমের অসীম নীড়ে ভীড় করছে সীমার ব্যাকুল স্পর্শ। শেলী ছিলেন আপসহীন অতীন্দ্রিয়বাদী। রবীন্দ্রনাথ শেলীর মত অতখানি অতীন্দ্রিয়বাদী ছিলেন না। তিনি অতীন্দ্রিয় জগতের স্থির বিন্দুতে ক্ষণকালের জন্য অবস্থান করে পুনরায় মাটির জগতে নেমে এসেছেন। সান্ত্বনা লাভ করেছেন ধূলিময় পৃথিবীর কোণে। ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে: “রবীন্দ্রনাথের কল্পনা শেলীর মত অতিদূর নক্ষত্রলোকেও পক্ষ বিস্তার করে নাই বা সাময়িক অক্ষমতার জন্য খুব নিম্ন প্রদেশে অবতরণ করে নাই। একটা সমান অক্লান্ত শক্তি লইয়া মধ্য দেশে বিচরণ করিয়াছে।” শেলী যেন সব কিছুতেই Abnormal. এই Abnormality শেলীকে স্বপ্নময় রহস্যময় করে তুলেছে। শেলীর প্রেমের অতৃপ্তির ব্যাকুল বাঁশরী যেন বিশ্বজগতকে বেদনায় মূহ্যমান করে দিয়েছে।
শেলীর প্রেম আত্মপ্রত্যয়ে দৃঢ়। এই আত্মশক্তির বিপুল প্রেরণায় প্রেমের বিপুল আবেগে শেলী বিদ্রোহী হতে পেরেছিলেন, বিদ্রোহী হতে পেরেছিলেন মানব প্রেমের অমৃত রক্ষা কবচ অঙ্গে ধারণ করে। এই প্রেমই মানুষকে ঘর ছাড়া দিশেহারা করে, মৃত্যুর ফেনিল উন্মত্ততাকে আকণ্ঠভরে পান করে। এই প্রেম মর্তের মৃত্তিকায় বলিষ্ঠ পদচিহ্ন এঁকে দিয়ে যায়, মানবের হৃদি-রক্তে রঞ্জিত করে চরণ-শোণিমা, বহন করে আনে পশ্চিমা ঝড়ের মাঝে নবজীবনের বাণী-“Oh! Wind, if winter comes, can spring be far behind?” প্রমিথিউস আনবাউণ্ডে-এর মধ্যে তিনি আপসহীন শক্তিকে আহ্বান জানিয়েছেন এবং বিশ্বের নূতন সৃষ্টিকে প্রেমের দ্বারা পরিশোধিত করতে চেয়েছেন। কারণ প্রেম সর্বজয়ী। সুখে, দুঃখে, বেদনায় বন্ধুর যে পথ সেই দুর্গম পথেই প্রেমের জয়-রথ ছুটে চলে, প্রেম মানুষকে মহৎ করে, সুন্দর করে। স্বার্থপরতা, নীচতা বর্বরতার হাত থেকে মুক্তি দেয়। “Love is celebrated everywhere as the sole law which should govern the moral world.” তবুও শেলী আবেগের স্রোতে হারিয়ে যান নি। কারণ তাঁর প্রেমচেতনার মধ্যে আবেগও যেমন ছিল তেমনি ছিল যুক্তি। কেবল ভাবাবেগের অবিলতায় প্রেম আচ্ছন্ন নয়। সুতরাং “When love and reason are united evil is doomed.”
রবীন্দ্রনাথের প্রেম চিত্তের মায়ালোকের কাব্য, যার মধ্যে বাসন্তিক স্পর্শ আছে, রসের মধ্যে আছে প্রচ্ছন্ন উন্মাদনা। তাই ধূলির ধরণীতে স্বর্গ-খেলনা গড়বার সাহস ছিল না, ছিলনা বাসর রাত্রি যাপনের কল্পনা। রবীন্দ্রনাথের প্রেমচেতনা যৌবন ধর্মের অমোঘ নিয়মে পরিচালিত নয়, তা শান্ত রস। রবীন্দ্রনাথ প্রেমের ভরা পাত্রকে পথের প্রান্তে ভীরুর মত ত্যাগ করে বিরহের আত্মপ্রসাদের দেউলিয়া হয়েছেন, বলেছেন,
“বিস্তৃত প্রদোষে হয়তো দিবে সে জ্যোতি;
হয়তো ধরিবে সে কভু নামহারা স্বপ্নের মূরতি।”
এই ‘হয়তো’ তাঁর কাছে ‘সবচেয়ে সতা’-সে তাঁর প্রেম। আর এই জন্যই রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতার মধ্যে পার্সোনাল সুরটুকুর গভীরতা অনুভব করা যায় না। কিন্তু শেলীর প্রেমের মধ্যে এই পার্সোনাল সুর লক্ষ্য করা যায়।
শেলীর প্রকৃতি চেতনা ও রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি চেতনার মধ্যেও কিছুটা পার্থক্য আছে।
রবীন্দ্রনাথ মানবকে ভালবেসে প্রকৃতিকে ভালবেসেছেন। এই পৃথিবীর ফল-হাওয়া-জল-তৃণ-তরু ও তাঁর একান্ত জন মাটির মানুষগুলির সঙ্গে তিনি গভীর আত্মীয়তা অর্জন করেছেন। কবি বলেছেন, ‘অহরহ সুখ দুঃখের বাণী নিয়ে মানুষের জীবন ধারার বিচিত্র কলরব এসে পৌছাচ্ছিল আমার হৃদয়ে মানুষের পরিচয় খুব কাছে এসে আমার মনকে জাগিয়ে রেখেছিল। সেই মানুষের সংস্পর্শে সাহিত্যের পথ এবং কর্মের পথ পাশাপাশি প্রসারিত হল আমার জীবনে।’ রবীন্দ্রনাথের চেতনা প্রকৃতি সর্বস্ব নয়। কারণ রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন,
“দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর লহ যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর চাই স্বাধীনতা চাই পক্ষের বিস্তার বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার পরাণে স্পর্শিতে চাই ছিঁড়িয়া বন্ধন অনন্ত এ জগতের হৃদয় স্পন্দন।”
তখন এটা কবির চিরকালের আকাঙ্খার প্রকাশ নয়, এটা নেহাতই ক্ষণিকের। কারণ মাটির মানুষ ও সমাজকে ত্যাগ করে শুধু অরণ্য জীবন কবির নিকট কল্পনাতীত। তিনি মানুষের মাঝে বাঁচতে চেয়েছেন। মানুষের জীবন্ত হৃদয়ের মাঝে স্থান করে নিতে চেয়েছেন। তাদের হাতে হাত দিয়ে দিনের আলো থাকতে থাকতে কন্ঠভরে গান গেয়ে নিতে চেয়েছেন। অন্যদিকে শেলীর কামনার মধ্যে কোন জাগতিক জীবনের বন্ধন নেই। তিনি বাস্তব পৃথিবীকে ত্যাগ করে সুদূর শান্ত সমাহিত অরণ্যলোকে চলে যেতে চেয়েছেন। যান্ত্রিক যুগের কৃত্রিম সভ্যতার নিষ্পেষণ থেকে মুক্তি চেয়েছেন। তিনি চলে যেতে চেয়েছেন মনুষ্য, বসবাসহীন সেই অরণ্যলোকে যেখানে সমাজ এবং সমাজের বিধিনিষেধের কঠিন শাসন নেই, আছে শুধু মুক্তির আনন্দ।
Away, away, from men and towns To the wild wood and the downs To the silent wilderness Where the soul need not repress Its music, but it should not Find an echo in anothers mind, While the touch of natures art Harmonises heart to heart.
শেলী এটা মনে প্রাণে চান। কারণ তিনি জানেন এবং তাঁর মর্মের পীড়া যা অত্যন্ত তীব্র তীক্ষ্ণরূপে প্রকাশ পেয়েছে তা হল, “I fall upon the thorns of life, I bleed.” মানুষের সমাজ যখন তাঁকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, সমাজের বাঁধন যখন চিত্তকে করেছে শাসন, তখন তিনি প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নিতে চেয়েছেন। এবং প্রকৃতির নগ্ন সৌন্দর্যের রূপের পাথারে আঁখি ডুবিয়ে হৃদয়-মন হারিয়েছেন। শেলী বলেছেন, “He, as I guess, had gazed on Nature’s naked loveliness. Actaeon like” প্রকৃতি শেলীর কাছে সান্ত্বনার স্থল, বেদনার প্রলেপ, প্রেরণার উৎস এবং দুঃখরাতের তারা।
আধ্যাত্মিক চেতনার স্বরূপ ও বিকাশের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ও শেলীর মধ্যে পার্থক্য সুগভীর। শেলীর অধ্যাত্ম চেতনার মূলে দ্বন্দ্ব দেখা যায়। তিনি রবীন্দ্রনাথের মত অধ্যাত্মচেতনায় ধ্রুবলোকে অধিষ্ঠান করতে পারেন নি, সংশয়, ব্যাকুলতার আবেগে কম্পমান। রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মচেতনা
নগাধিরাজ হিমাচলের তুষার শুভ্র শৃঙ্গের মত, স্বচ্ছতোয়া জাহ্নবীর মত। তাই রবীন্দ্রনাথ এখানে পরিপূর্ণ, কিন্তু শেলী অপূর্ণ। শেলীর এই অপূর্ণতার সুর তাঁর জীবনের মধ্যেই নিহিত। প্রথম জীবনে রুশো, ভলতেয়ারের প্রভাব ও শেষ জীবনে প্লেটোর মতবাদের প্রতি আনুগত্যই তার কারণ। জীবনের এক সন্ধিক্ষণে মেরী গডউইনের পবিত্র সান্নিধ্যে প্রেমের নবতন রূপ শিবজটা মুক্ত হয়ে পর্বতবক্ষ নিঃসৃত জাহ্নবী ধারার মত প্রবল আকার ধারণ করল। সে প্রেম আধ্যাত্মিক চেতনায় পরিশুদ্ধ হল। শেলী এই প্রেমের উপলব্ধিতে আর একটি সত্তাকে আবিষ্কার করলেন। তিনি মৃত্যুর আলোকে আত্মার অমরত্ব এবং অমৃতত্বকে আবিষ্কার করলেন। দেখলেন, “The one remains, the many change and pass”-মৃত্যুচেতনা কবির নিকট অমৃত চেতনারই স্বরূপ। তখন তিনি প্লেটোর দার্শনিক মতবাদ দ্বারা প্রভাবান্বিত। তিনি জেনেছিলেন যে, মানবাত্মা পরমাত্মার অংশবিশেষ। জাগতিক বন্ধনের মধ্যেই তার মহিমা ক্ষুন্ন হয়। মৃত্যুর পর সেই আত্মা পরমাত্মায় বিলীন হয়ে হয় মহিমান্বিত। তাই তিনি বলেছেন:
“The pure spirit shall flow back to burning fountain whence it came, a portion of the eternal.”
“বিচিত্র সুখ-দুঃখময় মানুষের জীবনটাকেও শেলী যেন একটা পর্দার মত করে দেখেছিলেন। এর খণ্ডতা, এর স্থূলতা যেন সত্যকে আবৃত করে রেখেছে। এই কুহেলিকার পর্দাখানা ছিড়ে ফেলে সত্যের অখণ্ড নির্মল মূর্তি দেখবার জন্যে কবির ভারি একটা ব্যাকুলতা ছিল। কতবার সেইজন্য তিনি মৃত্যুর মধ্যে উকি মেরে দেখবার চেষ্টা করেছেন। মানুষের জীবনের খণ্ড-চেতনা বিরাট সত্যের উপলব্ধি থেকে আমাদের চিত্তকে যে গণ্ডীবদ্ধ করে রেখেছে এও তিনি সহ্য করতে পারেননি। এইখানে যেন শেলীর মনের সঙ্গে ভারতীয় মনের মিল দেখতে পাওয়া যায়। ভারতবর্ষও এই ব্যবহারিক জগতকে এই স্থূল জগতকে সম্পূর্ণ সত্য বলে স্বীকার করে না এবং এর ভিতরে অন্তরতম অন্তর্যামী যে সত্য আছে তাকেই সন্ধান করে বেড়ায়।”
কবি রবীন্দ্রনাথও মৃত্যুর আলোকে জীবনকে অবলোকন করেছেন। তা’হল নানা বর্ণে বিকশিত জীবনকাব্যের চলচ্চিত্রপটে আত্মার নিশ্চল, নীরবতা-নিষ্কম্প জ্যোতিঃশিখা। “ঘূর্ণীর মাঝখানে একটি বিন্দুর মত”। এই মহান মৃত্যুর সাথে মুখোমুখি হয়ে কবি জীবনের অভয়মন্ত্র ও অমৃতত্বকে উপলব্ধি করেছেন।
“মহাসম্পদ তোমারে লভিব সব সম্পদ খোয়ায়ে
মৃত্যুরে লব অমৃত করিয়া তোমার চরণ ছোঁয়ায়ে।”
গৃঢ়তর তত্ত্বদৃষ্টির সাহায্যে কবি জীবন মৃত্যুর দ্বন্দ্বহীন একটি মূর্তি রচনা করেছেন। এবং কবির আত্মা জীবনের সকল ঋণ পরিশোধ করে নিত্য মৃত্যুস্নানে নির্মল ও শুচিশুভ্র হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রকাব্যে এ সত্য শুরু থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত আত্মপ্রকাশ করেছে কিন্তু শেলী যখন জীবন রহস্যের স্বরূপ জানবার জন্য, জীবনের দুর্গম দূর্গের রহস্যের আবরণ উন্মোচন করবার জন্য নিত্য নুতন নেশায় আকুল, তখনই তাঁর জীবনের বালুবেলায় মৃত্যুদূত এসে নির্মমভাবে তাঁকে পরপারে আহ্বান জানিয়েছিল। এই জীবন জিজ্ঞাসার সত্যকে তিনি আংশিকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, নিত্যকালের প্রশ্নের ব্যাকুলতায়,
“Then, what is life?”
তবুও মনে রাখতে হবে রবীন্দ্রনাথ সুদীর্ঘকাল ধরে চিন্তা করতে করতে লিখেছেন এবং জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছেন। তাই রবীন্দ্রনাথ জীবনের পরিণত ফসল তুলেছেন। আর শেলী ক্ষণস্থায়ী জীবনের মধ্যে এক বলিষ্ঠ তরঙ্গসংকুল জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন। দুই কবির এই সীমিত জীবনের মধ্যে পার্থক্যটা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়ঃ “শেলী ত্রিশটা বছর প্রতিদিন সহস্র কাজে সহস্র প্রয়াসে জীবনধারণ করে দুটি মাত্র ভল্যুম জীবন-চরিত্রের সৃষ্টি করেছেন; তার মধ্যেও ডাউডেন সাহেবের বাজে বকুনি বিস্তর আছে। আমার জীবনের ত্রিশটা বছরে বোধ করি একখানা ভলুমও পোরে না।”
সাহিত্যে অতিপ্রাকৃত
অতিপ্রাকৃত বর্ণনা ইংরাজি সাহিত্যের ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রাচীন সাহিত্যে অতিপ্রাকৃতের বর্ণনা অনেকখানি স্থান জুড়ে আছে। এ্যাংলো-স্যাক্সন যুগে যে সমস্ত সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে তার অনেকখানি স্থান অধিকার করে আছে অতিপ্রাকৃত। Bewolf কাব্যে যে অতিপ্রাকৃতের বর্ণনা রয়েছে তা’ প্রাচীন সাহিত্যের ক্ষেত্রে অনবদ্য। চসারের কাব্যেও এই অতিপ্রাকৃতি বা অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা দেখা যায়। কিন্তু এই সমস্ত কাব্যে অতিপ্রাকৃতের বর্ণনা শিল্প চমৎকারিত্বের সার্থকতা বহন করেনি। কারণ, অতিপ্রাকৃতের স্কুল বর্ণনাই এই সব কাব্যে স্থান লাভকরেছে। ষোড়শ শতাব্দীতে সেক্সপীয়রেরর নাটকগুলিতে অতিপ্রাকৃত বর্ণনায় ত্রুটিহীন কলাকৌশল লক্ষ্য করা যায়। অতিপ্রাকৃত ঘটনার উপস্থাপনা ও বর্ণনার নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে তাঁর নাটকে। Mid-Summer-Nights Dream, The Tempest, Macbeth, Hamlet প্রভৃতি নাটকে অতিপ্রাকৃতের বর্ণনা হল-‘A type of dramatic creation’ নাটকীয় সৃষ্টি। সেক্সপীয়র দক্ষ শিল্পীর মত বলিষ্ঠ হাতে অতিপ্রাকৃত ঘটনাগুলিকে প্রাকৃতের উপাদান দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ প্রাকৃতের ধুলি অঙ্গে লেপন করে অতিপ্রাকৃত হয়ে উঠেছে প্রাকৃত, unreal হয়ে ওঠে real. কোলরীজের ভাষায়: “It tends to produce the sense of reality.” অতিপ্রাকৃত বর্ণনার ক্ষেত্রে শুধু ভাব ও কল্পনার সমুন্নতি নয়, কবি চিত্তের সহজ উল্লাস ও বাস্তব পরিবেশ রচনার গৌরব সমুন্নতি লক্ষ্য করা যায়। “It was bitter cold and they were sick at heart and not a mouse stirring.” নির্জন নিস্তব্ধ রজনীর ভয়াল চিত্ররূপ পাঠকের মনেই জাগিয়ে তোলে শিহরণ। দূর্গের অভ্যন্তরে মধ্যরাত্রির সুগভীর নির্জন রহস্যময়তাকে করে তোলে জীবন্ত। মধ্য-যুগের বাস্তব প্রতিবেশ রচনায় সেক্সপীয়র সার্থক শিল্পী।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ অধ্যায় এবং উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইংরাজি সাহিত্যের জলাভূমিতে রোমান্টিকতার প্লাবন–রোমান্টিক ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। সেই যুগের সাহিত্যের দিগচক্রবালে দিগবধূর মায়াবী অঙ্গুলির সংকেত। ষোড়শ শতাব্দীতে নব জাগরণের ফলে কবির চিত্তসীমা প্রসার লাভ করেছিল। কিন্তু এই যুগে প্রকৃতির সঙ্গে কবি বা শিল্পীর অন্তরের মিলন-তীর্থে সপ্তপদীগমন সম্পূর্ণ হয়নি। অর্থাৎ প্রকৃতির জন্য কবির অন্তরের হাহাকার শোনা যায়নি। প্রকৃতির আসঙ্গ লিন্দায় প্রতি অঙ্গ লাগি প্রতি অঙ্গ কেঁদে ওঠেনি। প্রকৃতির অন্তর্নিহিত রহস্যের রূপের নেশায় কবি বা শিল্পী দিশেহারা হয়নি। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীতে কবির নিকট মানব জীবন যত না সত্য হল, সত্য হল প্রকৃতি। প্রকৃতির মর্মলোকের রহস্যের সন্ধানে, রহস্যাবৃত আত্মার আবিষ্কারে, অন্তরের সঙ্গে অন্তরের মিলনের ব্যগ্র-ব্যাকুলতায় যাত্রা শুরু হল রোমান্টিক কবিদলের। আর এই যাত্রা পথের যাঁরা প্রথম যাত্রী তাঁরা হলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরীজ। একথা অনস্বীকার্য যে কোলরীজ সেক্সপীয়রের ভাবশিষ্য। প্রকৃতির অতীন্দ্রিয় অলৌকিক রহস্যময় জগতের সন্ধান পেয়েছেন তিনি সেক্সপীয়রের কাব্যের অমৃতলোক থেকে। কোলরীজ আত্মভাব মুগ্ধ প্রকৃতির কবি নন, আত্মগত রসকল্পনায় বস্তুর স্বরূপকে তিনি ম্লান করে দেননি। তাঁর মেজাজ ছিল নাট্যকারের, অর্থাৎ তিনি ছিলেন Dramatic Poet এবং কাব্যের লক্ষ্য সম্বন্ধে তাঁর বিশ্বাস-“The willing suspension of disbelief is all important.”
সেক্সপীয়রের কাব্যের সোনার কাঠির স্পর্শ কোলরীজের কল্পনার বাতায়ন পথকে উন্মুক্ত করেছিল। এবং কোলরীজের কাব্যসত্যের পথনির্দেশ করেছিল। সেক্সপীয়রের কাব্যের এই বিশেষ অংশটিকে সত্যমূল্য দিয়েই কোলরীজের কাব্য সাধনা শুরু হয়েছিল।
তাই ক্রিষ্টাবেল কাব্যের প্রথমেই কবি যে মধ্যরাত্রের বর্ণনা করেছেন ও মধ্যযুগের দূর্গপ্রাকারের প্রতিবেশ রচনা করেছেন তা সেক্সপীয়রের পূর্ব উল্লিখিত বর্ণনার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
“Ancient Mariner”-এ সমুদ্রবক্ষে পরীদের ও অশরীরীদের পদচারণা, কথোপকথন, ক্রিয়াকলাপ প্রভৃতির সঙ্গে Mid-Summer-Night’s-Dream ও Tempest-এর বিশেষ বিশেষ ঘটনার সাদৃশ্য দেখা যায়। এমন কি পরিবেশকে গভীরতর করে তোলার কলা-কৌশলও সেক্সপীয়রের অনুরূপ। আগেই বলেছি সেক্সপীয়র তাঁর কাব্যে সৃষ্টি করেছেন “feeling of reality in unreality” কোলরীজ তাঁর কাব্যে এই কাব্যসত্যকেই রূপায়িত করেছেন। তাই কোলরীজ হলেন ভাব, ভাষা, কল্পনা, কাব্যসত্য ও আঙ্গিক রচনায় সেক্সপীয়রের মন্ত্রশিষ্য।
১৭৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে Lyrical Ballad-এর আত্মপ্রকাশ। যদিও বিপুলভাবে সমাদর লাভ করেনি তবুও পরবর্তীকালে এই কাব্যগ্রন্থটি একটি সমগ্র যুগের উচ্চ মিনার রূপে স্বীকৃত হয়েছে। কাব্যগ্রন্থটির রূপায়ণে ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরীজ এই দুই কবির শিল্পকর্ম প্রকাশ পেয়েছে। স্বভাবতঃই সেই রোমান্টিক যুগধর্ম গঠনে ওয়ার্ডসওয়ার্থের যেমন নিজস্ব দান আছে সেই তুলনায় কোলরীজের দানও নিতান্ত কম নয়। ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরীজের নিবিড় বন্ধুত্ব সে কথা প্রমাণ করে। Lyrical Ballad-এর পরিকল্পনার মধ্যেই সেকথা আরও সুস্পষ্ট। কোলরীজ তাঁর Biographia Literaria-তে বলেছেন: “During the first year that Mr. Wordsworth and I were neighbours, our conversation turned frequently on the two cardinal points of poetry, the power of exciting the sympathy of the readers by a faithful adherence to the truth of Nature and the power of giving the interest of novelty by the modifying colours of imagination. These are the poetry of Nature. The thought suggested itself that a series of poem might be composed of two thoughts, in the one the incidents and agents were, to be in part at least, Supernatural; and the interest aimed at was to consist in the interesting of the affections by the dramatic truth of such emotions as would naturally accompany such situation, supposing them real…….. For the second class the subjects were to be chosen from ordinary life, the characters and incidents were to be such as will be found in every village and its vicinity where there is a meditative and feeling mind to seek after them when they present themselves, in this idea originated the plan of the Lyrical Ballad.”
সুতরাং “লিরিক্যাল ব্যালাড”-এ দুই ধরনের কাব্যরূপ থাকবে। একটির বিষয়বস্তু বাস্তব, পরিচিত চেনা জগতের অতি ঘরোয়া বস্তুকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হবে; অপরটি বিষয়বস্তু অতিপ্রাকৃত ঘটনাকে বিবৃত করবে। স্বভাবতঃই ওয়ার্ডসওয়ার্থ অতিপরিচিত জীবনের মধ্যে প্রকৃতির অসীম রহস্য ঘেরা জীবনের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। অন্যদিকে কোলরীজ সুদূর অতীতের নীরব কাহিনীকে অবলম্বন করে দুঃসাহসিক অভিযান সুরু করলেন। অতীতের অস্পষ্ট রহস্যঘেরা কুহেলীর মধ্যে যে জীবন তাকে পরিচিত বা familiar করে তোলবার জন্যই কোলরীজের সাধনা সুরু হল। যা অস্পষ্ট, ‘তাকে স্পষ্ট; যা অতিপ্রাকৃত তাকে প্রাকৃত, যা অলৌকিক তাকে লৌকিক, যা অবিশ্বাস্য তাকে বিশ্বাস্য করে তোলবার জন্যই কোলরীজ কাব্য সরস্বতীর অঙ্গনে সাধনায় মগ্ন হলেন। কোলরীজের রোমান্টিক মানস সুদূরের পানে উৎকণ্ঠিত। কখনও যাত্রা করেছেন অপরিচিত মেরুপ্রদেশের তুষারলোকে। কখনও রূপদান করেছেন মধ্যযুগীয় জীবনযাত্রার সহজ সরল আদিম
সংস্কারকে। উনবিংশ শতাব্দীতে সমস্ত রোমান্টিক কবির নিকট মধ্যযুগ ছিল রোমান্সের উৎস। মধ্যযুগের জীবন রহস্য, নীতি ও মর্মকথা হল রোমান্সের জগৎ। মধ্যযুগের কতকগুলি সংস্কার ছিল সহজ সরল ও কৃত্রিমতাবিহীন। এই সকল সংস্কার প্রবণতা ও ভাববৈশিষ্ট্য আধুনিক কবিদের প্রেরণার আদিম উৎস ছিল। মধ্যযুগের জীবনযাত্রা ছিল উঁচু সুরে বাঁধা। রণ উন্মাদনা, দুঃসাহসিক অভিযান, শিভালরি, প্রেম ও ভালবাসা, মধ্যযুগের জীবন-যাত্রার শিরায় শিরায় উচ্চ শোণিত প্রবাহমান ছিল। মধ্যযুগীয় জীবন যাত্রার মধ্যে রোমান্সের প্রচুর উপাদান ছিল। তাই রোমান্টিসিজমের দেশ। উনিশ শতকের রোমান্টিক কবির দৃষ্টিকে করেছিল মোহমুগ্ধ।
স্বভাবতঃই কোলরীজের সাধনা যেমন কঠিন তেমনি দুরূহ। এবং দুরূহ কার্যে তিনি সফল হয়েছেন। কোলরীজের অতিপ্রাকৃত বর্ণনায় যে সূক্ষ্ম অথচ ত্রুটিহীন (flawless) দক্ষতা লক্ষ্য করা যায় তা অনবদ্য। কারণ এই ব্যাপারে তাঁর আন্তরিকতা ছিল প্রবল এবং কোলরীজের এই সুর সাধনায় কোন ফাঁক ছিল না। কোন সমালোচকের মতেঃ “Coleridge does not use the spells of medivalism as so many stage properties, he absorbs them into hinisell and they reappear rarely disfilled and inextricably blended with the poets exquisite perceptation of the mysteries that surrounded the common place, things of every day life.”
মধ্যযুগের বর্ণনায় তিনি কাল্পনিক। অতিপ্রাকৃতের বর্ণনার তিনি একক ও অদ্বিতীয়। তিনি কীটসের মত তৈলচিত্রকর নন, তিনি Skatcher। ছত্রের পর ছত্র ধরে তিনি মধ্যযুগের ছবি আকতে বসেন নি। কয়েকটি রেখার টানেই তিনি মধ্যযুগীয় পরিবেশটিকে মূর্ত করে তোলেন। তিনি নিপুণ চিত্রশিল্পী। তাঁর চিত্রে কোথাও রং জোবড়া হয়ে ওঠেনি। বরং অত্যন্ত মসৃণ অথচ অত্যন্ত উজ্জ্বল। পরিবেশ রচনায় দক্ষ শিল্পীর মত তিনি অনেকখানি আভাসে ইঙ্গিতে প্রকাশ করেছেন। এই যে প্রচ্ছন্ন আভাস এবং ইঙ্গিত এটাই কোলরীজের পরিবেশ রচনাকে সার্থকতায় ভরে তুলেছে। তিনি অত্যন্ত সুকৌশলে লৌকিক ও অলৌকিকের সংমিশ্রণ করেছেন। কোলরীজ অলৌকিক বর্ণনার মধ্যে সম্ভাব্য এবং অপরিহার্যতার নীতি-নিয়মকে অস্বীকার করে আবেগে আত্মহারা হননি। বরং কার্য-কারণ সূত্রের পারম্পর্য তিনি রক্ষা করেছেন। তিনি কেবলমাত্র মধ্যযুগীয় জীবনচিত্রের ছবি আঁকতে বসেন নি, শুধুমাত্র অতিপ্রাকৃত বর্ণনায় সমগ্র কাব্যটিকে ভারাক্রান্ত করে তোলেন নি, তিনি মানব জীবনের একটি নিখুঁত সত্যের বাণীকেও আবিষ্কার করেছেন। অলৌকিক, অবাস্তব, অসাধারণ রহস্যমূলক কল্পনার অন্তরালে একটি জীবন সত্য নিহিত রয়েছে। পাঠকের মনের সংবেদনশীলতাকে তিনি কাব্যেই জাগিয়ে তুলেছেন। মননশীলতা, অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন চিন্তা তাঁর মনে জাগরুক ছিল। এই মননশীলতার মাধ্যমেই তিনি রহস্যের পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন। এবং ভাষায় ও ছন্দে কবির বাণী সার্থক হয়ে উঠেছে। “It is not only that he eliminates from supernaturalism the crude material horrors then popular with Romantic Schools he also gives it a psychological foundation.”
কোলরীজের কাব্যে এই জীবনসত্যের বাণী হল প্রেম। এই প্রেম কবির কাছে কল্যাণময়, মঙ্গলময় এবং সুন্দরময়। হৃদয়ের নিষ্ঠায় এই প্রেম হয়ে ওঠে অনন্যসাধারণ। প্রেমের মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানুষের অসাধারণ শক্তি। প্রেমই মানুষকে মহৎ করে, সুন্দর করে, মনুষ্যত্বের অমরত্ব দান করে। তাই কোলরীজের কাছে প্রেম হচ্ছে জীবনের শুকতারা।
“All thoughts, all passions, all delights,
Whatevere stirs this mortal frame.
All are but ministers of love,
And feed his sacred flame. (Love)”
এই প্রেমের মধ্যে আবেগের উচ্ছ্বাস আছে উত্তাপ নেই। একটা প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বীরগাথা গেয়েছেন। আর এই বীরত্বের মধ্যে রয়েছে প্রেমের নিবিড় স্পর্শ। যে প্রেমের কল্যাণকে পৃথিবীর কোন শক্তিই কলুষিত করতে পারে না। আবার যে প্রেমের অভাবে মানুষের হৃদয় ভরে ওঠে বন্য হিংস্রতায়, হৃদয়ের রসটুকু নিংড়ে নিয়ে মানুষকে এক অর্থহীন জড় পদার্থে পরিণত করে। প্রেম বিশ্বের সর্বময় পরিব্যাপ্ত। প্রেমের আলোকেই বিশ্ব আলোকিত, মানবহৃদয় পুলকিত এবং প্রেমের পবিত্রতায় মানবজীবন পরিশুদ্ধ। ‘ক্রিষ্টাবেল’ কবিতাটির মধ্যে আমরা লক্ষ্য করি যে, দুর্জন অশরীরী আত্মা প্রেমের কল্যাণময় রূপকে কলুষিত করতে পারেনি। আবার অনুশোচনা বা প্রায়শ্চিত্তের আগুনে পুড়ে হৃদয়ের মধ্যে প্রেমের আবির্ভাব ঘটলে মনুষ্যত্বের অমরত্ব লাভ করা যায়। যেমন Ancient Mariner-এর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। তাই কোলরীজের কাব্যে জগৎ এবং জীবনের প্রকৃতি জীবনের প্রতি একান্ত ভালবাসার প্রবল আর্তি লক্ষ্য করা যায়।
কোলরীজ Ancient Mariner, Christabel, এবং Kubla Khan প্রতিভার মধ্যাহ্ন আকাশে বসে রচনা করেছেন। তাঁর সাহিত্য কর্মের ও কৃতির সমুন্নত বিকাশ ঘটেছে এই তিনটি কাব্যের মধ্যে। “All good poetry must be simple sensuous and passionate”–বলেছেন মিল্টন, সৎকাব্য সরল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আর আবেগময় হওয়া চাই। কোলরীজ মিল্টনের পথের পথিক। তাই তাঁর কাব্য হয়ে উঠেছে simple, sensuous এবং passionate, শুধু তাই নয় কোলরীজ দার্শনিক হিসাবে অতীন্দ্রিয়বাদী। অতীন্দ্রিয় রসের ভাবে তাঁর মন সব সময় নিমগ্ন থাকত। এই অতীন্দ্রিয় জগতের মধ্যে বাস করে কোলরীজ সোনার ফসল তুলেছেন মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে। রোমান্টিক জগতের দীপ্তাকাশে এই তিনটি কাব্য তাই স্বতন্ত্র মহিমায় প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু রোমান্টিক যুগ ধর্মের গঠনে ওয়ার্ডসওয়ার্থের যেমন দান আছে তেমনি আছে কোলরীজের।
কোলরীজ মধ্যযুগীয় জীবনের চিত্রাঙ্কনে একটি শিশুসুলভ দৃষ্টির অধিকারী ছিলেন। সেই দৃষ্টির মধ্যে ছিল যাদু। যাদুকরের যাদুকরী সৃষ্টি কোলরীজের প্রতিভার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কোন সমালোচকের মতে, “The essential Coleridge is the magic image of the magic child,” তাই কোলরীজের কল্পনার জগৎ ছিল বিশাল। সেই সীমাহীন কল্পনার উচ্চগ্রামে একটা সীমিত জীবনের ছবিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাঁর প্রাণের প্রবল পিপাসাই তাঁকে বিশ্বের বিশাল আয়োজনের সভায় আমন্ত্রণ করেছিল। শিশুর মত বিশ্বগ্রাসী কল্পনা আর জিজ্ঞাসা নিয়ে তিনি প্রকৃতিরাজ্যে বিচরণ করেছেন। Charles Lamb-এর কথায় বলা যায়, “He had a hunger for eternity.”
কোলরীজ ছিলেন আত্মসচেতন কবি। দার্শনিক কবির কাছে জগৎ ও জীবনটা কেবলমাত্র ঘনীভূত রহস্যের কল্পনা বলে মনে হয়নি, নিজের দার্শনিক প্রতীতি দিয়ে যুক্তির মাধ্যমে তিনি দেখতে চেয়েছেন। জার্মান দার্শনিক কান্টের মতবাদ সম্ভবতঃ কোলরীজকে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু কোলরীজ নিজের মত করেই তাকে প্রকাশ করেছেন। কোলরীজের এই যুক্তি আর বিশ্বাস ছিল অমৃতত্বে পরিশোধিত। তাই, “Coleridge at his best is both philosopher and poet he must see infinity in a grain of sand, simultaneously actually.” কিন্তু কোলরীজ মিষ্টিক ছিলেন না। কারণ কোলরীজের মন মিষ্টিসিজমের বিরোধী। চিন্তাশীল, দার্শনিক কোলরীজের পক্ষে পুরোপুরি মিষ্টিক হওয়া অসম্ভব ছিল। যদিও কোথাও কোথাও মনে হয়েছে কোলরীজ মিষ্টিক হয়ে উঠেছেন তবুও কোলরীজ মিষ্টিসিজমের কুয়াশা কাটিয়ে অরুণ আলোকের বন্যা এনে দিয়েছেন, “All knowledge rests on the coincidence of an object with subject.” কল্পনা কেবলমাত্র নিছক কল্পনা নয়, তার সঙ্গে willing-এর সমাবেশ ঘটেছে আর অনুভবগম্যতার স্পর্শে সে হয়ে উঠেছে যাদুকরী।
তাই কোলরীজ এই বিশ্বসৃষ্টির অন্তর্লোকের মর্মকথা কেবলমাত্র কান পেতে শোনেন নি, তিনি দুই আখি দিয়ে সেই রহস্যের বিশালতাকে দেখেছেন, অর্থাৎ চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করেছেন। তিনি পৃথিবীর নানা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। সেই ঐক্যের ভিত্তিতে শ্রবণ এবং দর্শনের মিলন ঘটেছে কোলরীজের কাব্যে। তাই কোলরীজের বাণী; “Oh! waht a life is the eye what a strange and inscrutable essence.”
কোলরীজের কাব্য তাই চিত্রধর্মী। যেমন কান পেতে শুনেছেন মেরুপ্রান্তের বজ্রনির্ঘোষ ধ্বনি তেমনি দু’ চোখ মেলে দেখেছেন বিশাল সমুদ্রের অপরূপ সৌন্দর্য। পরিবেশ রচনায় কোলরীজ নিপুণ শিল্পী। কোলরীজ যখন বর্ণনার পর বর্ণনা করেন সেই বর্ণনায় কোথাও কোন ফাঁক থাকে না। তিনি একদিকে দর্শক, অন্যদিকে শ্রোতা। তাই কোলরীজ কেবলমাত্র কাল্পনিক ছিলেন না, ক্লাসিক্যাল মনন নিষ্ঠতাই তাঁর কাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
‘Ancient Mariner’ কাব্য রচনার পরিকল্পনাতে কোলরীজ জীবন সমালোচনার পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। জ্ঞান পিপাসার অদম্য জিজ্ঞাসাই কবিকল্পনার বাতায়ন পথকে উন্মুক্ত করেছিল। জীবন রূপের চিত্রাঙ্কনে কবিকে মুক্তপক্ষ বিহঙ্গের মত সুদূরের পিয়াসী করে তুলেছিল। ‘Ancient Mariner’ কাব্যে অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ঘটনার পরিবেশ রচনা করেছেন জ্ঞানগোচর পরিদৃশ্যমান জগতের বাইরে। যেখানে প্রকৃতির অসীম রহস্য জমাট বেঁধে আছে সে জগৎ কল্পনার জগৎ। সেই জগতে তিনি পাঠককে নিয়ে গেছেন। প্রকৃতির অসীমতার রাজত্বে অবিশ্বাস্য ঘটনাও বিশ্বাসের অনির্বাণ দীপশিখার মত জ্বলতে থাকে। সেখানে প্রশ্ন নেই, আছে নিগূঢ় অন্তরের বিস্ময়বোধ ও রহস্যের জগতজোড়া ব্যাকুলতা। তাই বিরাট তৃষারস্তূপের কুহেলীঘেরা প্রদেশ, জীবনের সেই দুর্যোগের শিয়রে এ্যালবাট্রাসের আবির্ভাব, প্রকৃতির ‘পবিত্র আত্মা’ বিহঙ্গের নির্মম পরিণতি ও পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড, নাবিকদের জীবনে এনেছে দুঃখদাহন এবং দুঃসহ অভিশাপ। সেই দুঃসহ অভিশাপের ক্রিয়া নিঃসঙ্গ সমুদ্রের মাঝে সুরু হয়েছে। সুরু হয়েছে বিশ্বপ্রকৃতির বেদনার নির্মম প্রতিশোধের মধ্যে দিয়ে। শেষ হয়েছে পুনরায় প্রকৃতির পবিত্র আলোকের স্পর্শে, অন্তরের বিশুদ্ধতায়, জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ ধনে,
“He prayeth best, who loveth best, All things both great and small, For the dear God who loveth us,
He made and loveth all.”
কোলরীজ একদিকে যেমন জীবন সমালোচনা করেছেন, অন্যদিকে তেমনি প্রকৃতির অদ্ভুত রাজত্বে জীবনের জীবন্তরূপকে ফুটিয়ে তুলেছেন। দৃষ্টি এবং সৃষ্টির যাদুদণ্ডের স্পর্শে সমগ্র পরিবেশ এবং ঘটনা অপার্থিব চেতনার সীমার মধ্যে অখণ্ডরূপ গ্রহণ করেছে। এখানেই কোলরীজ সার্থক। তাঁর এই সার্থকতম রূপ ফুটে উঠেছে ‘ক্রিস্টাবেল’ কবিতাটির মধ্যে। ‘ক্রিষ্টাবেল’ কবিতাটির মধ্যে তিনি মধ্যযুগীয় জীবনের রূপকে ফুটিয়ে তুলেছেন। সুদূর অতীতের জীবনযাত্রার মধ্যে তিনি পাঠককে টেনে নিয়ে গেছেন। মধ্যযুগীয় জীবনচিত্রের বর্ণনায় কোলরীজ দক্ষ শিল্পীর মত রেখার টানে স্পষ্ট করে তুলেছেন।
‘ক্রিষ্টাবেলের’ রজনী অভিসারের পূর্বেই রাত্রির তৃতীয় যামে দূর্গপ্রাকারের বাইরে অকস্মাৎ পেচকের অশুভ আর্তনাদ, মৃত্যুর ঘন্টাধ্বনির মত গীর্জার ঘড়ির বক্ষপন্দিত ঢং ঢং আওয়াজ, মোরগের ভৌতিক কর্কশ ডাক, তন্দ্রালস কুকুরের চাপা গর্জন নীরব নিস্তব্ধ রাত্রির বুক চিরে সমস্ত পরিবেশটিকে ভয়াতুর করে তোলে। শহর থেকে দূরে সুদূর নিভৃত পল্লীর পাষাণঘেরা জনবিরল
প্রাসাদের মধ্যরাত্রের পরিবেশটিকে ভীতির রাজত্বে পরিণত করে। আমাদের সহজাত সংস্কার মনের ভীতির বাতায়ন পথে কোলরীজ মধ্যযুগীয় স্তব্ধ রাত্রির বর্ণনাকে জীবন্ত করে তুলেছেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগিয়ে দিয়ে ভীতির ভাবকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন।
Is the night chilly and dark?
The night is chilly but not dark?
কোলরীজের এই কৌশল অনবদ্য। দূর্গের অনতিদূরে আবছা জোৎস্নালোকে আলো-আঁধারির ছায়ালোকে বৃদ্ধ ওক গাছটা যেন ভূতের মত দাঁড়িয়ে থাকে। তারই তলে প্রার্থনারতা ক্রিষ্টাবেল অকস্মাৎ চাপা কণ্ঠের আর্তনাদ শুনে সচকিত হয়ে ওঠে। কিন্তু কবি প্রশ্ন করেন, “Is it the wind that moaneth bleak”? অথবা “what she sees there”? তখন পাঠকের রুদ্ধ হৃদয়ে ঘন নিঃশ্বাসে বুকের কাঁপন যায় বেড়ে, হয় দ্রুততর। তাই কোলরীজের বর্ণনার মধ্যে যে subtleness এবং fineness দেখা যায় এমনটি আর কোথাও দেখা যায় না।
এই কাব্যে শুভাশুভের দ্বন্দ্বটি সুন্দরভাবে কবি বর্ণনা করেছেন। আমাদের জীবনের আশেপাশে যে সমস্ত ছদ্মবেশিনী অমঙ্গলরূপিণী ডাকিনীর দল ঘুরে বেড়ায়, জিরালডাইন যেন সেই ডাকিনীর প্রতীক। মানুষের বিশ্বাস এই সব অপদেবতার আবির্ভাব ঘটে রাত্রির দ্বিতীয় যামে। মানুষের সেই বিশ্বাসকে পাথেয় করে ডাকিনী জিরালডাইনকে মধ্যরাত্রির পরিবেশে স্থাপন করেছেন এবং ক্রিষ্টাবেলের জীবনের চারিদিক ঘিরে আসন্ন বিপদের পটভূমিকার তাকে বর্ণনা করেছেন কোলরীজ। জিরালডাইনের দৃষ্টির মধ্যে একটা ভৌতিক ক্রুরতা, নিশ্বাসে একটা বিষাক্ত বাষ্প আচরণে একটা নিষ্ঠুর পৈশাচিকতা পাঠকের মনকে ভীতিবিহ্বল করে তোলে। কিন্তু নির্দোষ, নিষ্কলঙ্ক শিশুর মত সরল, ফুলের মত কোমল; জলের মত স্বচ্ছ পূজার ধূপের মত পবিত্র যাদের মন, তাদের চারপাশে ঘিরে আছে একটা অপ্রত্যক্ষ আশীর্বাদ যার ফলে বাস্তব জগতের মঙ্গলময় শক্তি, শুভশক্তির জয়বার্তা ঘোষণা করা হয়েছে এই কাব্যে;
“That saints will aid if man will call
For the blue sky bends over all.”
“কুবলাখান” কবির স্বপ্নালোকের রোমান্টিক কল্পনার ও সুষমার সৌন্দর্যময় প্রকাশ। প্রকৃতির খণ্ড ছিন্নরূপের অন্তরালে, প্রকৃতির রূপময় পরিবেশের মধ্যেও ‘কুবলাখান’ যেন অতীতের আদিম যুদ্ধের মন্ত্রধ্বনিকেই কান পেতে শুনতে পায়। এক কথায় “A vision in dream a fragment.” কবির স্তব্ধ চিত্তের কল্পনার বেগবান উচ্ছ্বাসের সংযত রূপ।
প্রকৃতিপ্রেম কোলরীজকে অদেখা, অজানা প্রদেশে আহ্বান করেছিল। প্রকৃতির বহিরঙ্গ রূপের সৌন্দর্যে কোলরীজ মুগ্ধ। এই মোহমুগ্ধতা কোলরীজকে প্রকৃতির সান্নিধ্য লাভের জন্য ব্যাকুল করে তুলতো। তাই প্রকৃতিকে জীবনের প্রেরণাদাত্রীরূপে গ্রহণ করেছেন। প্রকৃতির প্রাণের আলোকে আলোকিত কবিচিত্ত তাই বলে ওঠে:
“Oh Lady! we receive but what we give?
And in our life alone does nature live.”
অবসাদ আর অবসন্নতা যখন চিত্তকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে তখন প্রকৃতিই জীবনের রসকল্পলোককে করেছে উদ্বোধিত, দিয়েছে জীবনে অমর প্রেম। প্রকৃতির রহস্যের উদঘাটনে কবি যাত্রা করেছেন অতিপ্রাকৃতের জগতে।
বাংলা সাহিত্যে অতিপ্রাকৃত বর্ণনা অনেকখানি স্থান অধিকার করেছে। প্রাচীন সাহিত্যের ভটপ্রান্ত দেবতার জয়গানে মুখরিত বাংলা সাহিত্যে আধুনিককালের পূর্ব পর্যন্ত দেবমাহাত্ম্য ও দেবতার কাহিনীই রূপ পেয়েছে। আর সেই সব দেবতা সমাজে নিজেদের স্থান অধিকার করতে গিয়ে নানা অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত ঘটনার মধ্যে মানুষকে টেনে এনেছে। মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে এই অতিপ্রাকৃতের বর্ণনা একাট বিরাট অংশ জুড়ে আছে। সেই যুগের কবিদল খুব একটা কবিত্বের অমরীদুর্লভ সৃষ্টি-শক্তির অধিকারী ছিলেন না। বরং কিছুটা স্কুল। সূক্ষ্ম কবি কল্পনার বশবর্তী হয়ে তাঁরা কাব্য রচনা করেন নি। তাই অতিপ্রাকৃত বর্ণনা কোথাও সূক্ষ্ম না হয়ে একেবারে স্থূল হয়ে গড়েছে। মনসামঙ্গল কাব্যে মনসার অলৌকিক কাহিনী আমাদের চিত্তকে অসাড় করে দেয়, বোধশক্তিকে করে আচ্ছন্ন, সচেতন করে না। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে চণ্ডীর গোধিকারূপ ধারণ করার কল্পনা, বিরাট মহানদী সংঘের শোভাযাত্রা ধনপতি সদাগর ও শ্রীমন্তের সাগরবক্ষে “কমলে-কামিনী দর্শন ও চণ্ডীর সিংহলরাজের সহিত যুদ্ধ আমাদের প্রচলিত জীবনধারার ভগবদ্ভক্তিকে উজ্জ্বল মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করলেও, সাহিত্যের শিল্পকলামণ্ডলের ক্ষেত্রে যেন অনেকখানি রসমন্থর হয়ে ওঠে। মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে অলৌকিকতা কাব্যের আর্টের কোন গুণ নয়। অলৌকিকতা এই সব কাব্যের প্রাণ। তবে অলৌকিকতা অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে এই সমস্ত কাব্যে। কারণ কবিরা মনেপ্রাণে দেবতার অলৌকিকত্বে বিশ্বাস করতেন। বিশ্বাস করতেন বলেই আন্তরিকতার সঙ্গে তার বর্ণনা করেছেন।
আধুনিককালের এই অতিপ্রাকৃত বর্ণনা একেবারেই লুপ্ত হয়নি। বরং অতিপ্রাকৃত বর্ণনাও সাহিত্যের বা আর্টের একটা গুণ বলে স্বীকৃত হয়েছে। আধুনিক সাহিত্যে পাশ্চাত্যের সোনার কাঠির স্পর্শে নবজাগরণ ঘটেছে। আধুনিক সাহিত্য তার পোশাক-পরিচ্ছদ, ধ্যান-ধারণা সম্পূর্ণরূপে পালটে ফেলেছে। আধুনিক কালের কথাসাহিত্য আর নাটকে অতিপ্রাকৃত বর্ণনা অনেকখানি স্থান অধিকার করেছে। বিশেষ করে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙ্গালীর ভাবজীবন যেখানে হিন্দুধর্মের প্রবলস্রোতে প্রবাহিত হয়েছে সেখানে অতিপ্রাকৃত ঘটনা প্রাধান্য লাভ করেছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে একদিকে নবজাগরণ, অন্যদিকে Revivalism, একদিকে নবতন সৃষ্টির প্রেরণা, অন্যদিকে প্রাচীন ও অতীতের প্রতি একটা মোহ। এই সময়ের সামাজিক নাটক আর উপন্যাসগুলির মধ্যে অতিপ্রাকৃতের কোন প্রাধান্য নেই, কিন্তু যেখানে পৌরাণিক কাহিনী নিয়ে উপন্যাস আর নাটক সৃষ্টি হয়েছে, সেইখানেই অতিপ্রাকৃতের স্রোতে তাঁরা ভেসে গেছেন। কোথাও তাঁরা সংযম মেনে চলতে পারেননি। অনেক ক্ষেত্রে এই অতিপ্রাকৃতের সমাবেশ নাটকের গতিকে করেছে শৈবালাচ্ছন্ন, তার রসপরিণতির ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে মন্থর। মাইকেল মধুসূদনের নাটকে অতিপ্রাকৃতের সমাবেশ লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু অতিপ্রাকৃত কোথাও পরিণতির ক্ষেত্রে বাধাস্বরূপ হয়ে ওঠেনি। কারণ মাইকেল মধুসূদনের সামঞ্জস্যবোধ ছিল। অতিপ্রাকৃতের প্রয়োজন সীমা ছাড়িয়ে যায়নি। মাইকেল চিরকালই গ্রীক সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। পদ্মাবতী, মায়াকানন প্রভৃতি নাটকে নিরুপায় মানবের দৈবের নিকট আত্মসমর্পণ ঘটেছে। কিন্তু গিরীশচন্দ্র ঘোষের ও ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদনের নাটকে অতিপ্রাকৃতের বাহুল্য দেখা যায়। পৌরাণিক নাটকগুলিতে দেবমহিমা বা দেবতার অলৌকিক কাহিনী বর্ণনা ছাড়া নূতন কিছু হয়ে ওঠেনি। বৈষ্ণবভক্তি প্রেমভক্তির বন্যায়, অতিপ্রাকৃতের প্লাবনে নাটকীয় গতি রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে একথা বলতেও বাধা নেই। সেক্সপীয়রের নাটকে যে অতিপ্রাকৃতের সমাবেশ নেই এমন নয়। কিন্তু অতিপ্রাকৃত বর্ণনায় সেক্সপীয়র দক্ষ শিল্পী। ‘ম্যাকবেথ’ নাটক অতিপ্রাকৃত দিয়ে শুরু অতিপ্রাকৃতে শেষ। কিন্তু ‘ম্যাকবেথ’ চরিত্রের বিকাশের ক্ষেত্রে অতিপ্রাকৃত প্রাধান্য বিস্তার করতে পারেনি, বরং ট্র্যাজিক পরিণতির ক্ষেত্রে
অতিপ্রাকৃত সাহায্যই করেছে। কিন্তু গিরীশচন্দ্রের পৌরাণিক নাটকগুলিতে সেই দক্ষতার অভাব। ক্ষীরোদপ্রসাদ যেন সামঞ্জস্যহীন। উপন্যাসের ক্ষেত্রে অবশ্য বঙ্কিমচন্দ্র সব্যসাচী। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলিতে অতিপ্রাকৃতের
বাহুল্য লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র আত্মসচেতন শিল্পী। তিনি উপন্যাসের গতি ও পরিণতি সম্পর্কে দৃষ্টি রেখেই কাহিনী গঠন ও চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। কাহিনীর গতিবেগ ও চরিত্র সৃষ্টির সার্থকতায় যেখানে যতটুকু অতিপ্রাকৃত বর্ণনার ও ঘটনার প্রয়োজন আছে, ততটুকুই তিনি অতিকৌশলে প্রয়োগ করেছেন। যা সহজ সরল স্বাভাবিক বা স্বভাবানুকারী, যা কাহিনীর পক্ষে সামঞ্জস্যপূর্ণ সেইটুকুই তিনি বর্ণনা করেছেন। মাত্রাতিরিক্ত কোথাও কিছু ঘটেনি। “সীতারাম” উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র অতিপ্রাকৃতের অপূর্ব সামঞ্জস্যবোধের পরিচয় দিয়েছেন। জয়ন্তীর মধ্যে অলৌকিকত্ব প্রচুর পরিমাণে থাকলেও আমাদের সমাজের আচারবিধি ও গৃহী জীবনের পটভূমিকায় তা বেশ মানিয়ে গেছে। জয়ন্তীর অলৌকিকত্ব তার বিচার দৃশ্যেই বাস্তব প্রধান হয়ে উঠেছে। বঙ্কিমচন্দ্র দারুণ পরীক্ষায় জয়ন্তীর অলৌকিক মহিমার মর্যাদাকে রক্ষা করেছেন। ‘সীতারাম’ উপন্যাসে জয়ন্তীর ভূমিকা ও গুরুদেবের অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ অবাস্তবতার গভীর নৈরাশ্যে পরিণত হয়নি।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রায় অধিকাংশ উপন্যাসেই অতিপ্রাকৃত ঘটনাগুলি কাহিনীর অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে প্রতিভাত হয়েছে। অতিপ্রাকৃত সাহিত্যের বা আর্টের একটা গুণ, তার প্রয়োগও Artistic হওয়া প্রয়োজন। বঙ্কিমচন্দ্রের সেই Artistic প্রয়োগ নৈপুণ্যের অভাব রয়েছে। স্কট পরিপূর্ণভাবে মধ্যযুগীয় জীবনাচরণের কবি। “Scott had a very keen eye for the picturesque features of ancient buildings of their situation and surroundings.”
সেই অভিজ্ঞতালব্ধ ধনে স্কট কল্পনার বরণে স্পষ্ট করে তুলেছেন মধ্যযুগীয় জীবনচিত্র। স্কট নিপুণ শিল্পী। তবুও বঙ্কিমচন্দ্রের অতিপ্রাকৃত কেবলমাত্র নিছক অতিপ্রাকৃত নয়। কোন এক বিদগ্ধ সমালোচকের মতে, সেক্সপীয়রের নাটকের কায়াহীন ছায়াগুলির ন্যায় বঙ্কিম সাহিত্যেও অতিপ্রাকৃত স্বীকৃত।
কিন্তু মধ্যযুগীয় জীবনের পরিবেশ রচনায় কোলরীজ যেমন কয়েকটি রেখার টানে তা ফুটিয়ে তুলতে পারেন, বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যে তার কিছুটা অভাব। এমনকি মধ্যযুগের জীবনযাত্রা সম্পর্কেও বঙ্কিমচন্দ্রের অভিজ্ঞতা ছিল না গভীর। স্কটের মধ্যে যে অভিজ্ঞতা ছিল ব্যাপক, রোমান্সের কল্পনায় যা হয়ে উঠেছে স্বচ্ছ, বঙ্কিমচন্দ্রের কল্পনায় তা কিছুটা স্কুল। তবুও বঙ্কিমচন্দ্রের অভিজ্ঞতার পরিধি কম নয়। তিনি তাঁর উপন্যাসের মধ্যে মধ্যযুগীয় জীবনের খুঁটিনাটির বর্ণনা করেন নি, পরন্তু মধ্যযুগের সেই উপাদানও বঙ্কিমচন্দ্রের সম্মুখে ছিল না। তাই অনুভূতির ক্ষেত্রে, চিত্রাঙ্কনের ক্ষেত্রে, তা অনেকটা অস্পষ্ট হয়েই দেখা যায়। একটা বুদ্ধিদীপ্ত কলাকৌশলের নির্মাণক্ষম প্রজ্ঞার অনুপস্থিতি চোখে পড়ে। কারণ পূর্বেই বলেছি যা সহজ সরল স্বাভাবিক ততটুকুই তিনি কাহিনীর সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন। “দেবী চৌধুরাণী”, ‘আনন্দমঠ”, “ইন্দিরা” প্রভৃতি উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র অতিপ্রাকৃত অলৌকিক ঘটনাকে উপস্থাপিত করেছেন। কাহিনীর অনেকখানি স্থান অধিকার করে আছে এই সমস্ত অলৌকিক ঘটনা। কিন্তু এই অলৌকিক কাহিনীতে লৌকিকতার স্পর্শ যেন অনুভব করা যায় না। বঙ্কিমচন্দ্রের কল্পনার সংযম যেন মাত্রা হারিয়েছে। দেবী চৌধুরাণীতে প্রফুল্লর মৃত্যু সংবাদ সেই কথাই প্রমাণ করে। ডাঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, “সাধারণতঃ প্রাকৃতিক ঘটনাই অতিপ্রাকৃতের স্পর্শে অলৌকিকে রূপান্তরিত হয়। ইহার বিপরীত রকমের পরিবর্তন বড় একটা হয় না। সাধারণ রোগে মৃত্যু অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কারের দ্বারা ভৌতিক ঘটনাতে রূপান্তরিত
হইতে পারে। কিন্তু ভৌতিক ঘটনা যে লোকমুখে প্রচারিত হইতে হইতে তাহার অতিপ্রাকৃত অংশ বর্জন করিয়া স্বাভাবিক মৃত্যুতে রূপান্তরিত হইবে, তাহা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া মনে হয় না।”
আনন্দমঠের মধ্যেও অতিপ্রাকৃত ঘটনার সমাবেশ বা সুর প্রধান অংশরূপে স্বীকৃত। অলৌকিক কীর্তিকলাপও আনন্দমঠে প্রচুর। আনন্দমঠেও এই অলৌকিকত্বের রাজত্ব কিছুটা বিসদৃশ ও সামঞ্জস্যহীন। রজনীর লবঙ্গলতার অতিপ্রাকৃতের প্রতি যে প্রবণতা তা অনেক স্বাভাবিক। লবঙ্গ-লতার প্রবৃত্তির মধ্যে একটা অসংস্কৃতবাক্ গ্রাম্য রমণীর আদিমতাকেই লক্ষ্য করা যায়। যাই হোক অতিপ্রাকৃত সৃষ্টিতে বঙ্কিমচন্দ্র কোন সচেতন সৃষ্টির কৌশল অবলম্বন করেননি। কল্পনার রোমান্সের আতিশয্যে objectivity কিছুটা ক্ষুন্ন হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথও অতিপ্রাকৃত বর্ণনার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। বাঙ্গালী জীবনের কতকগুলি সহজ সরল সংস্কার ও বিশ্বাসকেই তিনি গল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। ভৌতিক বিশ্বাস বাঙ্গালী জীবনের সহজাত সংস্কার বা হাড়েমাসে জড়ানো সংস্কার। এই সমস্ত সংস্কারের প্রতি আমাদের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা আছে। এই সংস্কার এত প্রবল যে ইহা যুক্তিতর্কের অবকাশ রাখে না। যত অলৌকিকত্ব থাক না কেন এবং তা যতই অবিশ্বাস্য হোক না কেন তা স্বীকার করতে কোথাও বাধা নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অতি সহজেই মানবমনের সংস্কারকে কয়েকটি গল্পে অদ্ভুতভাবে অংকন করেছেন। ক্ষুধিত-পাষাণ, নিশীথে, মণিহারা, কংকাল, গুপ্তধন, জীবিত ও মৃত ইত্যাদি গল্পে এই বিশ্বাস ও সংস্কারকে শিল্পকলায় মন্ডিত করেছেন। “ক্ষুধিত-পাষাণ” গল্পটি সর্বাংশে শ্রেষ্ঠ। এই গল্পটির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অতিপ্রাকৃত বর্ণনার রচনার ক্ষেত্রে নিপুণতা দেখাবার চেষ্টা করেছেন। অবশ্য অতিপ্রাকৃত সৃষ্টির ক্ষেত্রে কতখানি সার্থকতা লাভ করেছেন তা বিচার্য বিষয়। কতকগুলি, গল্প অবশ্য ভৌতিক বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। বর্ণনার চাতুর্যে ও রচনার সমৃদ্ধিতে সেই গল্পগুলি মানবিক আবেদনে পরিপুষ্ট। এই মানবিক আবেদন যদি অনুপস্থিত থাকত তাহলে গল্পগুলির কোন মূল্য থাকত না।
অবশ্য অতিপ্রাকৃত বর্ণনার ক্ষেত্রে একটা কথা পরিষ্কার বুঝে নেওয়া প্রয়োজন যে অতিপ্রাকৃত কেবলমাত্র আর সীমাটুকুর মধ্যে আবর্তিত হবে না। পরিবর্তে প্রাকৃত জীবনের সঙ্গে গড়ে তুলবে সমন্বয়। এই সমন্বয় সাধনের অভাব যেখানে ঘটবে সেখানে অতিপ্রাকৃত কেবলমাত্র ভৌতিক বিশ্বাসেই পরিণত হবে, মানব মনের রহস্যের সন্ধান ব্যর্থ হবে এবং ইহা আয়াসসাধ্য। রবীন্দ্রনাথ ‘মনিহার’ গল্পের মধ্যে মণিমালিকার বিয়োগ স্বামী ফণিভূষণের বিরহ বিধুর হৃদয়ের আত্যন্তিক দুঃখের ও মৃত্যুরহস্যের প্রবল জিজ্ঞাসার নিদারুণ পরিণতি দেখানো হয়েছে। ফণিভূষণ মৃত্যুর রহস্য জানতে চায়। সে মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করতে গিয়েই মৃত্যুর কবলে আত্মদান করেছে। ফণিভূষণ একাগ্রচিত্তে স্ত্রী মণিমালিকার ধ্যান করেছে, কিন্তু তার সামনে রাতের অন্ধকারে যিনি উপস্থিত হলেন তিনি একটি কংকাল। গল্পটির মধ্যে সত্যকার ঘনীভূত রহস্যময়তা গড়ে উঠেছিল কিন্তু কংকালের আবির্ভাবে সেই রসটুকু নষ্ট হয়ে গেল। অর্থাৎ সমগ্র পরিবেশটির মধ্যে যে অতীন্দ্রিয় ভয়াবহ শিহরণ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল, যে অশরীরিণীর পদসঞ্চার সমগ্র পরিবেশকে কঠিন তুষার শীতল ভীতির রাজ্যে পরিণত করেছিল, নদীর ঘাট থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে শয়নকক্ষের অভ্যন্তরে অদৃশ্যচারিণীর গতিবিধি এবং অলংকার ও আভরণের ঝম ঝম শব্দ সমস্ত স্থানটিকে রহস্যঘন করে তুলেছিল। অকস্মাৎ কংকালবেশিনীরূপে তার আবির্ভাব এবং কংকালের অদৃশ্য ইঙ্গিতে নদীস্রোতের মধ্যে ভূতাবিষ্ট ফণিভূষণের মৃত্যু অনেকটা স্কুল বলেই মনে হয়। এ যেন চিরাচরিত কাহিনীর অতি স্কুল পরিণতি। কোন সূক্ষ্ম কারুকার্য বা শিল্পকলার পরিচয় এখানে পাওয়া যায় না। গল্পটির মধ্যে সন্দেহ বিজড়িত অনিশ্চয়তা কোথাও নেই। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে জীবনকে
উৎসর্গ করেই ফণিভূষণকে মূল্য দিতে হয়েছে, মৃত্যু রহস্য উদঘাটন করার চেষ্টার জন্য। ফণিভূষণের পক্ষে এই নির্মম পরিণতির প্রয়োজন ছিল কি, না, তাই জিজ্ঞাস্য। অতিপ্রাকৃত ঘটনার রসপরিণতিও এখানে সার্থক হয়ে ওঠেনি।
এ সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ যে “ক্ষুধিত পাষাণ” রচনার ক্ষেত্রে কোলরীজের প্রভাব অনেক বেশিভাবে পড়েছিল। অর্থাৎ কোলরীজ এবং কীটসের মধ্যযুগীয় অতীতচারণাই রবীন্দ্রনাথকে অতীতের পথে পথে আহ্বান করেছিল। ক্ষুধিত পাষাণের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ প্রায় আড়াই শত বৎসর পূর্বের সুস্তা নদীর তটপ্রান্তে নির্জন পাহাড়ের নীচে দ্বিতীয় শা মামুদের ভোগবিলাস কুঞ্জ ধুলি ধুসরিত প্রাসাদের বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এই বর্ণনার মধ্যে সেই প্রাচীন অট্টালিকা অভ্যন্তরের চিত্র কোথাও সুন্দররূপে ফুটে ওঠেনি। এমনকি শতকক্ষময় প্রাসাদের সুগভীর বিজনতা তেমন ভয়াবহ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি। কীটসের Eve of St. Agnes যথাযথ প্রেমের কাব্য নয়। কিন্তু-এই কাব্যেও কীটস্ ভুলত্রুটি সত্ত্বেও এটা মধ্যযুগীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন, বর্ণাঢ্য এবং বর্ণালীর রঙে রাঙ্গা করে। এক দারুণ শীতের রাতে যখন Beadsman-এর আঙ্গুলগুলি কনকনে ঠান্ডায় হয়েছে অসাড়, নিশ্বাসও যখন ঘনবাষ্পে পরিণত, বাইরে শীতের আঘাতে যখন নিশাচর পেচক ও খরগোশগুলিও অর্ধমৃত, সেই পরিবেশ রচনায় কীটস দক্ষতা দেখিয়েছেন। দক্ষতা দেখিয়েছেন যখন তিনি চ্যাপেলের অভ্যন্তরে ব্যারণ পরিবারের নাইট ও রমণীদের মর্মর মূর্তিগুলিকে জীবন্ত করে তুলেছেন। এমনকি কার্ণিশের বর্ণনাও সেই সূক্ষ্ম senseousness-এর পরিচয় বহন করে। যখন দেখি মর্মরখচিত দেবদূত যাদের অনীমিলিত আঁখিতে চিরকালীন বিস্ময়, যাদের শিরোপরি ভর করে আছে সেই কার্ণিশ, আর যাদের সমস্ত কেশদাম ছড়িয়ে পড়েছে পিছনে, স্বর্ণবর্ণ ডানাগুলি আড়াআড়িভাবে বুকের মাঝে স্থাপিত, তখন মধ্যযুগীয় চ্যাপেলের বর্ণনার কারুকার্যে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। অপূর্ব চিত্র সমন্বিত বাতায়ন পথের বর্ণনা আরও সুন্দর আরও বর্ণময়। সুদূর অতীত যেন কাছে এসে ধরা দেয়। এইখানেই কীটসের সঙ্গে স্কটের সমধর্মিতা। স্কটও মধ্যযুগের জীবনাচরণের বর্ণনা করেছেও মধ্যযুগের কোলাহল মুখরিত উৎসবের মণ্ডপ, শিভালরি প্রেম, • রণোন্মাদনা, রাজসভার চোখ ঝলসানো বর্ণবৈচিত্র্য পোশাক পরিচ্ছদের বিলাস বৈভব, অভিজাত গৃহের ললনা, নাইট ও সেনানীদের কাহিনী, কিন্তু মধ্যযুগের অন্তরের বাণীকে তিনি আবিষ্কার করতে *পারেন নি। মধ্যযুগের বহিরঙ্গরূপের চিত্রাঙ্কনে তিনি দক্ষ শিল্পী। কিন্তু কোলরীজ দু’একটি রেখার টানে শুধু মধ্যযুগ নয়, মধ্যযুগের সমস্ত আত্মাকে সজীব করতে পারেন। এই spiritual element-এর অধিকারী কীটস বা স্কট কেউ-ই ছিলেন না। যেমন ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ। তাই ক্ষুধিত পাষাণের পরিবেশ রচনায় তিনি না পেরেছেন সেই যুগের প্রাসাদের নিখুঁত ছবি আঁকতে, না পেরেছেন অতিপ্রাকৃতের একটা ভীত-চকিত শিহরণ জাগিয়ে তুলতে। তিনি ক্ষুধিত পাষাণের মধ্যে আড়াইশত বৎসর পূর্বেকার বিলাসতরঙ্গ মুখরিত প্রাসাদের জীবনকে যেমন বর্ণনা করতে বা জীবনের চিত্র আঁকতে পারেন নি, তেমনি তিনি আড়াইশত বৎসর পরে সুস্তানদী তীরবর্তী ভগ্ন প্রাসাদের নির্জন পরিবেশকেও সজীব করে তুলতে পারেন নি। সহযাত্রীটিকেও তিনি কোলরীজের Ancient Mariner-এর মত একটা অস্পষ্ট কুহেলিকাময় করে তুলতে পারেন নি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “আমাদের এই সহযাত্রীটির সহিত কোন এক রকমের অলৌকিক ব্যাপারের যোগ আছে”। ট্রেনের কামরায় প্রথম দর্শনে ও কথাবার্তায় সহযাত্রীটিকে একটু ছিটগ্রস্ত বলে ভ্রম হতে পারে কিন্তু অলৌকিকত্বের ছোঁয়াচ কোথাও নেই। পরন্তু ধূসর দীর্ঘ শ্মশ্রু, কোটরগত তীক্ষ্ণ আঁখি, কংকালসার রুগ্ন হস্ত Ancient Mariner-এর আবির্ভাব ভূত দেখার মত বিবাহযাত্রীদের চমকিত করে, পরিবেশ রচনায় এই সূক্ষ্ণ স্পর্শ টুকুই যথেষ্ট। রবীন্দ্রনাথের এটুকু স্পর্শও যেন অমসৃণ।
রবীন্দ্রনাথের অতিপ্রাকৃতের বর্ণনায় প্রাকৃতের মাটির গন্ধ কোথাও নেই। কেবল বাতাসে বাতাসে সে ভেসে বেড়ায়। সেই মায়াময়ীদের পদচারণা মাটির বুকে নয়, অমর্তলোকে। “বাতাসে যেমন করিয়া গন্ধ উড়াইয়া লইয়া যায়” তেমনি করে অতিপ্রাকৃতের সমস্ত গন্ধটুকু বাতাসেই ভেসে বেড়ায়। কীটসও বাতাসে ডানা মেলেছেন কিন্তু মাঝে মাঝে মৃত্তিকার ধুলি অঙ্গে মেখে নিয়েছেন। মধ্যযুগের জীবনকে তিনি বাস্তবতার ছায়াসঙ্গিনী করেছেন। আর রবীন্দ্রনাথ মধ্যযুগের জীবনকে করেছেন অবাস্তবতার স্বপনচারিণী। কীটসের কাছে যা মর্মলোক, রবীন্দ্রনাথের কাছে তা’ স্বপ্নলোক। একজন মর্মের মাঝারে মধ্যযুগকে স্থান করে দিয়েছেন, আর একজন স্বপ্নের মাঝারে মধ্যযুগের স্থান করে দিয়েছেন অর্থাৎ মধ্যযুগ তাঁর কাছে শুধু স্বপ্নময়। অতিপ্রাকৃত একটি বিশেষ রস। প্রাকৃতের হৃদয়রসে জারিত হয়ে সে চরিতার্থতা লাভ করে, লাভ করে অসামান্যতা। কোলরীজ মধ্যযুগের সংস্কারকে কেন্দ্র করে অতিপ্রাকৃত কাহিনী গড়ে তুলেছেন। অর্থাৎ মধ্যযুগের সংস্কার আর বিশ্বাস যাই হোক প্রকৃতি ও মানবজীবনের মধ্যে কল্যাণ ও মঙ্গলময় পরিবেশকে ঘুলিয়ে তোলার জন্য যে সমস্ত ছদ্মবেশী অকল্যাণের ছায়ামূর্তি ঘুরে বেড়ায় তাদের শক্তিকে পরাভূত করে কল্যাণময়ী শক্তির বিজয়বার্তা ঘোষণা করেছেন। নিশীথ রাত্রির অন্ধকারে ডাকিনী জিরালডাইনের শক্তির প্রকাশ, দিব্যলোকে সেই শক্তি নিষ্প্রভ। কল্যাণময়ী প্রেমের জয় চিরকালের, ক্রিষ্টাবেলের আত্যন্তিক প্রেমের জয় সুনিশ্চিত। প্রেমের প্রতীক এ্যালবাট্রসকে যে দস্যুর মত, জিরালডাইনের মত হত্যা করেছিল সেই প্রাচীন নাবিক প্রায়শ্চিত্তের মধ্য দিয়ে জীবনের অমর প্রেমকে লাভ করে হয়েছে অমৃত। এইখানেই বাস্তবতার রসটুকু নিষ্কাশন করে তার নির্যাসটুকুকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অতিপ্রাকৃতের লাবণ্যবিলাসে। কোলরীজ মধ্যযুগের এক মধ্যরাত্রের ক্যাসেলের বর্ণনা করেছেন। দীপহীন বা জনহীন নয়, সর্বত্রই নীরব নিঃস্পন্দ-নিথর। কীটসও উৎসব মুখরিত ক্যাসেলের বর্ণনা করেছেন, স্কটও অনুরূপ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সুরুতেই দীপহীন, জনমানবহীন, পর্বতের তলদেশে একটি পরিত্যক্ত প্রাসাদের কয়েক রজনীর ভূতুড়ে কাণ্ড বা কাহিনীর বর্ণনা করেছেন। বর্ণনা করেছেন ঝর্ঝর শব্দে ফোয়ারার জল, সেতারের সুর, নুপুরের নিক্কণ; নহবতের আলাপ ইত্যাদি যা প্রেতলোকের রাগিণী সৃষ্টি করতেই সক্ষম। কারুকার্য বা বর্ণনার বর্ণচ্ছটা এখানে অনুপস্থিত। Ancient Mariner-সম্বন্ধে কোন এক সমালোচক বলেছেন, “Perhaps the greatest achievement of the poem is the realistic force of its narrative, To achieve this was of course, Coloridges’ main object. He had undertaken to transfer from our inward nature a human interest and a semblance of truth sufficient to procure from this shadows of imagination that willing suspension of disbelieve for the moment which constitutes poetic truth.” আর poetic truth বলতে তিনি imagination-কেই বুঝিয়েছিলেন। এই Imagination-এর উৎস হল প্রকৃতিজগৎ। প্রকৃতির রহস্যময়তা আর কবি কল্পলোকের রহস্যময়তার মিলন ঘটেছে এখানে। আবার ঘটেছে কাব্যের মধ্যে গদ্যের মধ্য নয়। It is easier to undertake the plan than to perform it and much easier to perform it in prose than in verse সর্বশেষে ঘটনার পরিস্থিতি, গতি ও প্রকৃতি, নিষ্করুণ প্রকৃতির হস্তে মানবের কৃতকর্মের নির্যাতন ও দুঃখ, প্রেমের জ্যোতির্ময় আলোকে বিশ্বানুভূতি, Ancient Mariner-কে সার্থক করেছে। In the poem the method of relating nature to moral world is not by dim analogies, nor in the shape of formal similies, but by the poets’ heart and intellect being intimate by combined. নিছক উপমা দিয়ে নয়, অতিপ্রাকৃতের বর্ণনা, হৃদয়ানুভূতি এবং বুদ্ধির অপূর্ব সংমিশ্রণেই তা সম্ভব। এইদিক থেকে
ক্রিষ্টাবেল আরও সুন্দর, আরও মসৃণ। ক্রিষ্টাবেলের মধ্যে অতিপ্রাকৃত লোকের সমুন্নত বিকাশ ঘটেছে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ক্ষুধিত-পাষাণের মধ্যে অতিপ্রাকৃতের বর্ণনাকে কোথাও এত মসৃণ করে তুলতে পারেন নি। তার কারণ রবীন্দ্রনাথ গীতিকবি। একটি সুরের পরশ লহরী কবি-চিত্তকে ব্যাকুল করেছিল। সেই ব্যাকুল করা চিত্ত চির অতৃপ্ত রয়ে গেল, আর সেই বন্ধনের হাত থেকে কোন মুক্তি নেই। “আমার উদ্ধারের কি কোন পথ নেই? শেষ পর্যন্ত উদ্ধারের পথ মেলেনি। অর্থাৎ পাষাণের ক্ষুধিত আত্মার মর্মভেদী হাহাকার যত না কবিকে ব্যথিত করেছে, তার চেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছে খর্জুরকুঞ্জ সমাচ্ছন্ন মরুবাসিনী তরুণী ইরাণীবালার অন্তরের বেদনামথিত হাহাকার। তরুণী ইরাণীর চির অতৃপ্ত বেদনা কবির অন্তরের বেদনা। কবির কল্পনা তাই দিগন্তবিলীন সাহারা প্রান্তে উপনীত। সাহারা মরুপ্রান্তের তরুণী ইরাণীবালার মর্মজ্বালা, নববিকশিত যৌবন সৌন্দর্যের ব্যর্থ পরিণতি, রক্তকলুষিত পুষ্পমঞ্জরীর নিষ্ঠুর মৃত্যু কবি কল্পনার শিরায় শিরায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কবির কল্পনার কল্পলোকে তরুণী ইরাণীর নববিকশিত যৌবন সমাচ্ছন্ন রূপ সৌন্দর্যই এখানে সত্য, কবির মনোভূমি এখানে সত্য, যত না সত্য জীর্ণ পাষাণ প্রাচীরের আঁধারের বিভীষিকা। এই বিভীষিকার রূপ মেহেরআলির কণ্ঠেই ফুটে ওঠে, “সব ঝুট্ হ্যায়, সব ঝুট্ হ্যায়।” অর্থাৎ বিশ্বের সব কিছুই ঝুট বা মিথ্যা কেবল কবির কল্পনা ছাড়া। এই কল্পনাই চির সত্য, চির শাশ্বত, চিরকালীন। প্রাসাদের পাষাণ ভিত্তির আর্দ্র অন্ধকারের গোরের ভিতর থেকে যে ক্রন্দন তা কবির অন্তরের ক্রন্দন, ‘তুমি আমাকে উদ্ধার করিয়া লইয়া যাও, নিষ্ফল স্বপ্নের সমস্ত দ্বার ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া তুমি আমাকে ঘোড়ায় তুলিয়া তোমার বুকের কাছে চাপিয়া ধরিয়া, বনের ভিতর দিয়া, পাহাড়ের উপর দিয়া, নদী পার হইয়া তোমাদের সূর্যালোকিত ঘরের মধ্যে আমাকে লইয়া যাও, আমাকে উদ্ধার করো’। শুধু কল্পনার বিলাস, শুধু স্বপ্নময় মায়ালোকে বিশ্বজীবনের সঙ্গে মিলনের জন্য মর্মের হাহাকার। এখানে তরুণী ইরাণীবালা কেবলমাত্র কল্পনা। আর কল্পনার কুহকে বা মায়ায় যিনি বদ্ধ হয়েছেন তিনিই মেহেরআলির মত পাগল হয়েছেন, উদ্ধারের আর পথ পান নি। তাই সহযাত্রীর আকুল প্রার্থনা, “হে বহ্নি যে পতঙ্গ তোমাকে ফেলিয়া পলাইবার চেষ্টা করিয়াছিল, সে আবার মরিবার জন্য চরিতের উপর রেখাপাত করেছে বলেই মনে হয়। মেহের আলি যেন কীটসের কাব্যের Pole king এবং সে নিষ্ঠুরা সুন্দরীর নির্দয় মোহের কারাগারে বন্দী পাগল। অবশ্য কীটসের এই বর্ণনায় যে সূক্ষ্ম পেলবমসৃণতা আছে, রবীন্দ্রনাথে তা যেন অনেকটা স্কুল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই কল্পনা
আসিয়াছে। এবার তাহাকে মার্জনা কর, দুইপক্ষ দগ্ধ করিয়া দাও, ভস্মসাৎ করিয়া ফেল।” শ্রীপ্রমথনাথ বিশী মহাশয়ের ভাষায়, “মোহন তুলির সাহায্যে কবি আমাদের মনকে এমন কল্পনার স্বর্গে উত্তোলন করেন যেখানে সাংসারিক সুখ-দুঃখ নাই এবং সেই সঙ্গে গা ছম্ ছম্ ভাব যা রক্ত মাংসকে অবলম্বন করিয়া বিরাজ করে তাহাও নাই। অর্থাৎ, The willing suspension of disbelieve মুহূর্তের জন্য বিশ্বাসে বা Poetic Truth-এ পরিণত না হয়ে “সব ঝুট হ্যায়”-এ পরিণত হয়। শুধু কল্পনার অতীন্দ্রিয় উচ্চলোকের সুর ধ্বনিত হয়। অতিপ্রাকৃতের রসপরিণতি অপেক্ষা কল্পনার বা স্বপ্নলোকের নিবিড় সৌন্দর্যানুভূতি এখানে প্রবল। কীটসের La Belle-Dame-Sans-Merci কাব্যের হৃদয়হীনা কল্পনাসুন্দরীর আচার-আচরণ যেন তরুণী ইরাণীবালার
কুশলতা ও কল্পনার বিলাস সাহিত্যে অপূর্ব ও অনবদ্য। কল্পনার সঙ্গীতময় সুর ক্ষুধিত পাষাণ গল্পের নিবিড় মাধুর্যকে অপরূপ করে তুলেছে। অতিপ্রাকৃত জগতের আকর্ষণ আমাদের যত না মুগ্ধ করে, কবির নিবিড় ভাবকল্পনার ঐশ্বর্য মুগ্ধ করে ততোধিক। তাই ক্ষুধিত পাষাণে কবির সমুন্নত কল্পনার বিকাশ ঘটেছে পূর্ণমাত্রায়। এবং তা সার্থক। ক্ষুধিত পাষাণকে ছোট গল্প না বলে গদ্যকাব্য বলাই শ্রেয়।
‘মাষ্টারমশাই’ গল্পটিতে কবি কিছুটা অতিপ্রাকৃত বর্ণনায় সফল হয়েছেন বলে মনে হয়। কারণ অলৌকিক ঘটনাকে তিনি প্রকৃত ও বাস্তব পরিবেশের মধ্যে রূপ দিতে পেরেছেন। একটা অজানা দিহরণ, একটা অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি ও তার ক্রিয়াকলাপ বর্ণনায় কবি অনেকখানি সূক্ষ্ণতা দেখিয়েছেন, ‘মণিহারা’ গল্পের মত স্কুল হয়ে যায়নি। কলকাতা ময়দান। দিনের বেলায় যেখানে জীবন মানুষের মহামেলা গভীর রাতে সেখানে অদৃশ্য আত্মার পদচারণা সমস্ত ময়দানটাকে মহাশ্মশানে পরিণত করে। এমনি এক নির্জন রাত দুপুরে রেড রোডে ঘোড়ার গাড়ীতে পানমত্ত মজুমদার, গ্যাসের মিটমিটে আলো, পথের পাশে অন্ধকারে ভূতের মত গাছ, গাড়ীটা সামনে চক্ষু নাই অথচ একটা চাহনি। সমস্ত পরিবেশটিকে অতিপ্রাকৃতের ছায়াময়ী রাজত্বে পরিণত করেছে। মজুমদারের ভাষায়, “তবে একি শুধু স্বপ্ন”? গাড়োয়ানের, “এ শুধু স্বপ্ন নহে।” এই গল্পের অতিপ্রাকৃতের বর্ণনায় তিনি যে willing suspension of disbelieve-কে বিশ্বাসে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন এবং Realistic setting-এর উপর প্রতিষ্ঠিত বলেই সার্থক হয়ে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথের কংকাল, জীবিত ও মৃত, গুপ্তধন প্রভৃতি গল্পে অতিপ্রাকৃতের ছায়া নেই। সেগুলির মধ্যে অতিপ্রাকৃতের উপাদানও অনুপস্থিত। গল্পগুলি কেবলমাত্র আমাদের সহজ ধারণা সংস্কার বা বিশ্বাসকেই কিছুটা নাড়া দেয়। এছাড়া গল্পের মধ্যে অতিপ্রাকৃতের বর্ণনার কলাকৌশল এমনি যে Spiritual Element-টুকুও নেই।
অতিপ্রাকৃত বর্ণনায় বিভূতিভূষণ দক্ষশিল্পী না হলেও শিল্পগত কলা-কৌশলকে কিছুটা নিপুণভাবে প্রয়োগ করেছেন। এবং তা সম্ভব হয়েছে যেহেতু তিনি প্রকৃতির নির্জন রাজ্যের বাসিন্দা। বিভূতিভূষণ প্রকৃতির নির্জন রূপ ও সৌন্দর্য সম্ভোগের কবি। আদিমের গূঢ় চেতনায় আবিষ্ট মন নিয়ে তিনি আরণ্যক জীবনের সৌন্দর্য্যকে অবলোকন করেছেন। তাঁর ধ্যানময় সত্তা-প্রকৃতি রাজ্যের রহস্যময়তাকে উদঘাটন করতে চায়নি, উপভোগ করতে চেয়েছে। তাই বিভূতিভূষণ দ্রষ্টা, তিনি ওয়ার্ডসওয়ার্থের মত প্রকৃতির আধ্যাত্মিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন নি। আবার কীটসের মত নিছক সৌন্দর্য সম্ভোগের রূপময়তার কবিও তিনি নন। রবীন্দ্রনাথের মত জীবন ও প্রকৃতিকে মিলিয়ে জীবনের সত্য রূপকে তিনি দেখতে চাননি। আসলে তাঁর দৃষ্টিতে আদিম রহস্যের অঞ্জন মাখানো। জীবনকে জানার কোন প্রচেষ্টা, অতি দূর সৌন্দর্যালোকের ধ্যানবিহার করার কোন বাসনা নেই। প্রকৃতির নির্জন ও ম্লান রূপের চেতনায় বন্ধনহীন উদ্দামতা। প্রকৃতির অতীন্দ্রিয় লোকের অধিবাসীও তিনি নন। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য বিভূতিভূষণের অন্তরে জ্বেলেছে প্রাণের পিপাসা। আর সেই পিপাসার্ত মন নিয়ে তিনি প্রকৃতির বিশাল আয়োজনকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে দেখেছেন, উপভোগ করেছেন। তাই বঙ্গপ্রকৃতির শ্যাম সমারোহ তাঁর অন্তরলোকের সহজ সরল রহস্যময়তা, গ্রাম্যজীবন, শান্ত নদীতীর, কাশবন, সুনীল অম্বর, কন্টক পরিপূর্ণ ঝোপ জঙ্গল, লতাগুল্ম, নদীপ্রান্তে প্রাচীন বটবৃক্ষ, ভগ্ন মন্দির, দিগন্তবিলীন কাঁচা মাটির রাস্তা বিভূতিভূষণের চিত্তে শান্ত ছায়ালোক সৃষ্টি করেছে।
বিশ্বপ্রকৃতির অখন্ড সত্তাকে বিভূতিভূষণ অনুভব করেছেন। কেবল কল্পনার আর জগৎ জোড়া বিস্ময়ের বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে দেখেছেন বিশ্বপ্রকৃতির রহস্যময়তা। এই অনুভূতির ক্ষেত্রে কোন বুদ্ধির চাতুর্য বা মস্তিষ্কের নিপুণ কলাকৌশল নেই, নেই অলস কল্পনার বিকলাঙ্গ চিত্ররূপ, নেই সচেতন মনের যত্নলালিত শিল্পকর্ম। বিভূতিভূষণ প্রকৃতির সত্যরূপের পূজারী, যা দেখেছেন তাকেই অন্তর থেকে প্রকাশ করেছেন, যা দেখেননি তাকে কল্পনা দিয়ে রঙ্গীন করেন নি। তাই প্রতি রাজ্যের মানব সন্তানগুলি একেবারে আদিম ও অকৃত্রিম। কল্পনা দিয়ে সৃষ্টি করতে গিয়ে কোথাও তিনি তাদের জীবনকে কৃত্রিম করে তোলেন নি। এই সহজ সরল উলঙ্গ দৃষ্টি দিয়ে প্রকৃতিকে দেখেছেন
বলেই বিভূতিভূষণ মানব চরিত্রগুলিকে এত স্বাভাবিক করে তুলেছেন। এই মানব সন্তানগুলি প্রকৃতির অন্তরের স্নিগ্ধ দীপালোকে প্রাণময় হয়ে উঠেছে। বিভূতিভূষণ প্রকৃতির-রাজত্বের সঙ্গীহীন অধিবাসী। প্রকৃতি চেতনার ক্ষেত্রে তিনি একক। এমন কি ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলী ও কীটসের থেকেও ভিন্ন আপন স্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর।
বিভূতিভূষণের পল্লী প্রকৃতি ও অরণ্য প্রকৃতি বর্ণনায় কোথাও বিশেষ পার্থক্য নেই। পল্লী প্রকৃতি বর্ণনায় রোমান্স রসের যেটুকু অভাব ঘটেছে অরণ্য প্রকৃতির বর্ণনায় সেটুকু তিনি গভীর করে তুলেছেন। আর এই অরণ্যের নিভৃত নির্জন মুখর নীরবতা বিভূতিভূষণকে মোহমুগ্ধ করেছিল। তারই ফলে বিশ্বপ্রকৃতির অখণ্ড রূপের প্রকাশে কোথাও দ্বিধা বা সংশয় ছিল না-“এই বর্বর রুক্ষ বন্যপ্রকৃতি আমাকে তার স্বাধীনতা ও মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষিত করিয়াছে।” প্রকৃতির ঐকতান স্রোতে নানা গান, নানা সুর, নানারকম জীবনের সমাবেশ, কত ক্ষুদ্র, কত অপরিচিত তরুলতা, অজানা বনফুল, কত মরু গিরি-নদী, কত অপার্থিব জীবনের মেলা এক অখন্ড চিত্রময়ী রূপে ফুটিয়ে তুলেছেন বিভূতিভূষণ। আর এই বিরল বসতি পাহাড় জঙ্গল সমাচ্ছন্ন ভয়ংকর নির্জন প্রকৃতি পরিবেশের মধ্যে অতিপ্রাকৃত বর্ণনাকে তিনি সহজ সরল ও স্বাভাবিক করে তুলেছেন।
অতিপ্রাকৃত বর্ণনায় বিভূতিভূষণের শিল্পগত কলাকৌশল যত না আছে, আছে স্বাভাবিক বর্ণনার সহজতম রূপ। অতিপ্রাকৃত পরিবেশ রচনায় বন্যপ্রকৃতি সহায়তা করেছে অনেকখানি। কারণ বন্যপ্রকৃতির অসীম রহস্যঘেরা জগতে সবই সম্ভব-অসম্ভব কিছুই নয়। লৌকিক বিশ্বাস আর সংস্কার যাই থাকুক না কেন, আসলে তাঁর অতিপ্রাকৃত কাহিনী বর্ণনার কৌশল অপূর্ব। ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে বিভূতিভূষণ বোমাইবুরু জঙ্গলের অলৌকিক কাহিনী বর্ণনা করেছেন। ‘গল্পটা বেশ আষাড়ে গোছের বটে।” কিন্তু গল্পটা বলতে গিয়ে বিভূতিভূষণ বোমাইবুরু জঙ্গলের নির্জন প্রান্তরকে
বেছে নিয়েছেন। বোমাইবরু জঙ্গল লোক বসতি শূন্য। বাঘ আর বন্য শূকরের গতিবিধি রাতের অন্ধকারে যায় বেড়ে। পাহাড়ের উপর বটগাছটা বিভীষিকার রাজত্ব সৃষ্টি করে দাঁড়িয়ে থাকে। ঐ বটতলায় জোৎস্না রাত্রে অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়েরা হাত ধরাধরি করে নাচে। জিন পরীদের এই রাজত্বে আমীন সাহেবের উপস্থিতি। গভীর রাত্রে কুকুরের ছদ্মবেশে জিন পরীদের আগমন। আমীন সাহেবের উন্মাদ অবস্থা। এমন কি বৃদ্ধ ইজারাদারের তরুণ পুত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু সমস্ত পরিবেশটাকে ভয়াতুর করে তোলে। প্রকৃতি রাণী এখানে যেন রূপকথার রাজত্বের রাক্ষসী রাণীর মত। বাস্তবতার সঙ্গে অতিপ্রাকৃতের চমৎকার মিলনের দৃষ্টান্তস্থল। প্রকৃতি রাজত্বের নির্জন বিভীষিকা ও ভয়ের পরিণতি কি ভয়ঙ্কর। বৃদ্ধ ইজারাদারের মৃত পুত্রের দেহে কোনরূপ আঘাতের চিহ্ন নেই। মুখে তার ভীষণ ভয় আর আতঙ্কের চিহ্ন। বনঝাউ জঙ্গলে ভীত আতংকিত জীবনের করুণ পরিণতি বাস্তববোধকে ক্ষুন্ন করে না, বরং বাস্তব রসকে উদ্দীপিত করে। ঐ পরিবেশের মধ্যে বৃদ্ধের পুত্রের মৃত্যু যেন বাস্তব সত্য হয়েই ফুটে উঠেছে। লেখক উপসংহারে বলেছেন, “সেই গোপন রাজ্যে মানুষের অনধিকার প্রবেশ তাহারা পছন্দ করে নাই। সুযোগ পাইলেই প্রতিহিংসা লইতে ছাড়িবে
না।” বৃদ্ধ ইজারাদার তরুণ পুত্রের অন্তরে এক অজানা ভীতির সাহারা মরু সৃষ্টি করে প্রকৃতির প্রতিহিংসার বলিরূপে পুত্রকে উৎসর্গ করেছে। এই বাস্তব সত্য ও লৌকিক বিশ্বাসকেই বিভূতিভূষণ বর্ণনায় জীবন্ত করে তুলেছেন। একটানা বর্ণনায় মাঝে মাঝে সংশয়ের জিজ্ঞাসা জাগিয়ে তুলেছেন।
অতিপ্রাকৃতের শিহরণ মনকে বেশ নাড়া দেয়। বিভূতিভূষণ এখানে সার্থক। এই গল্পটি বর্ণনার মধ্যে তাঁর সচেতন শিল্পী মনই কাজ করেছে। কল্পনার বিলাস অপেক্ষা সত্যের নিখুঁত চিত্রাঙ্কনে অধিক যত্নবান হয়েছেন বিভূতিভূষণ। যা অলৌকিক তা অলৌকিক থেকে যায় নি। অলৌকিক রূপকে প্রকৃতির অতিপ্রাকৃত কাহিনীকে বাস্তবিক রূপ দিয়েছেন।
“অভিশপ্ত” গল্পের মধ্যে বাংলার মধ্যযুগের চিত্রাঙ্কন করতে গিয়ে বিভূতিভূষণ অরণ্যসংকুল জনমানবহীন সুন্দরবনের একটি স্তব্ধ নিশীথ রাত্রির ভীষণতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। আর সেই নির্জন নিশীথে একটি প্রাচীন ভগ্ন প্রাসাদের ভগ্নস্তূপের মধ্য দিয়ে প্রেতলোকের বীভৎস আর্তনাদ বিভীষিকার রাজত্ব সৃষ্টি করে। পাঠকের মনে জাগিয়ে তোলে অতিপ্রাকৃতের শিহরণ। মনকে করে তোলে ভীতি-বিহ্বল। অতিপ্রাকৃত এখানে নিছক অতিপ্রাকৃত হয়ে ওঠেনি। বিভূতিভূষণ প্রাকৃতের মৃত্তিকায় গড়ে তুলেছেন তার মূর্তিটি।
সর্বশেষে এই কথাই বলতে হয় যে, কোলরীজের কাছে ‘অতিপ্রাকৃত’ ছিল একটা “Poetic Truth”, কিন্তু অন্যান্য কবিদের কাছেতাআত্ম-প্রত্যয়েররূপ নিয়ে সাহিত্যে দেখা দেয়নি। অর্থাৎ অতিপ্রাকৃত এঁদের কাছে Poetic Truth বলে স্বীকৃতি লাভ করেনি। তাই রচনার ক্ষেত্রে একটা গভীর প্রভেদ লক্ষ্য করা যায়। আর কোলরীজের সচেতন মনের মণিকোঠায় প্রকৃতি ছিল নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখার মত অনির্বাণ। তাই প্রকৃতির রহস্যের রাজত্বে কোলরীজ ধ্যানমন্ত্রের ঋষি।
কীটস ও রবীন্দ্রনাথ
উনবিংশ শতাব্দীর ইংরাজি সাহিত্যের সৈকতভূমি রোমান্টিক স্বপ্ন কল্পনার প্লাবনে প্লাবিত। ইংরাজি সাহিত্যের মালঞ্চে সেদিন বসন্তোৎসব। ইংরাজ কবিদের আঁখিতে রোমান্টিক বিলাস। তাঁর সুদূরের পিয়াসী। কল্পনার ডানায় ভর করে এলিসের মত wonder land-এ তাঁরা ঘুরে বেড়াতে চেয়েছেন। এই “wonder land”-এর নেশাই সেদিনের ইংলণ্ডের কবিদলকে মুক্তপক্ষ বিহঙ্গের মত সুদূর নীহারিকালোকে আহ্বান করেছিল। এই যে অ-জানা অ-দেখা অ-প্রাপ্যের জন্য কবির হৃদয় ক্রন্দনমুখর একেই এককথায় ‘Nostalgia’ বলা যেতে পারে। Irving Babit-এর মতে, “The Essence of Nostalgia is the desire for the unknown.” ঘরছাড়া, দিশেহারা কবির মন অদেখা অগমের জন্য নিরন্তর ছুটে চলে অসীমের প্রান্তে। প্রকৃতি চিরদিনই রহস্যময়ী। প্রকৃতির সঙ্গে মানব-মনের একটা নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে। কবি যখন-ই সেই সম্পর্কটি উপলব্ধি করে তখনই বাস্তব পৃথিবী ত্যাগ করে প্রকৃতি রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে। যখন বাস্তব পরিবেশ অত্যন্ত জটিল হয়ে ওঠে, তখন কবি-মন প্রকৃতির সান্নিধ্যে লাভের নেশায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। শিলারের ভাষায়, “The longing of the modern man for Nature is that of the sick man for health.’
উনবিংশ শতকে এই বিস্ময়বোধের পুনরুজ্জীবন-এর মূলে রয়েছে রুশোর প্রভাব। রুশো ছিলেন খাঁটি Arcadian, তাঁর দূরাভিসারী মন বাস্তব পৃথিবী বিমুখ। ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রত্যক্ষরূপে ফরাসী বিপ্লবের রূপ ও তার মোহ-ভঙ্গজনিত প্রতিক্রিয়ায় প্রকৃতির মর্মলোকে আশ্রয় নিয়েছিলেন। রোমান্টিকতার অন্যতম ধর্ম অতীতে প্রত্যাবর্তন। স্কট অতীতের ধূসর ছায়ালোকে যাত্রা শুরু করেছিলেন। শেলী বিশেষভাবে ফরাসী বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। বায়রণ ফরাসী বিপ্লবের মন্ত্রকে পাথেয় করে সমাজের কারা প্রাচীরকে বিধ্বস্ত করতে চেয়েছিলেন। কোলরীজ একটু ভিন্ন জাতের ভিন্ন স্বাদের। তাঁর সমগ্র জীবনের দিচক্রবালে দিগ্বধুর মায়াবী অঙ্গুলির সংকেত। কবির দৃষ্টিকে রহস্যের আবেদনে মণ্ডিত করেছিল প্রকৃতি। তাই প্রকৃতি কোলরীজের রহস্যময়ী সঙ্গিনী। And in our life alone, does Nature live.
কীটস রোমান্টিক যুগের সর্বকনিষ্ঠ কবি। তাঁর আবির্ভাব রোমান্টিক যুগের মধ্যাহ্নক্ষণে। কারণ এই সময়ে ইংরাজি সাহিত্যের জলাভূমিতে রোমান্টিকতার প্লাবন। ১৭৯৮ সালে ‘লিরিক্যাল ব্যালাডের’ আত্মপ্রকাশ। যদিও প্রথম প্রকাশ বিপুল সমাদর লাভ করে নি তবুও পরবর্তীকালে এই কাব্যগ্রন্থটি উচ্চ মিনাররূপে স্বীকৃত। এই যুগধর্মের নবতন সৃষ্টির মূলে আছেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরীজ। কীটসের কাব্য জীবনের কাল পরিধি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। ১৭৯৫ খ্রীঃ ২৯শে অক্টোবর এক দরিদ্র পরিবারে কীটসের জন্ম। জন্মমুহূর্তের পর থেকে কীটসের জীবনের চারিদিক ঘিরে দুঃখের জমাট আঁধার। জীবনের পরিণতিও বিষাদাত্মক, পরম বেদনাদায়ক। কিন্তু (২৫) পঁচিশ বছরের এই ক্ষুদ্র সীমিত জীবনের মধ্যেই কীটস জগৎ ও জীবন সম্পর্কে একটি পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভকরেছিলেন।
কীটস আত্ম-মুগ্ধ সৌন্দর্যরস সম্ভোগের কবি। ফরাসী বিপ্লবের কোন প্রভাব কীটসের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। তিনি আত্মসচেতন সমাজ সংস্কারক নন। তিনি নূতন যুগের বাণীকে পাথেয় করে কাব্যে ওয়াটারলু সৃষ্টি করেন নি। নিছক সৌন্দর্য পিপাসাই কীটসকে মর্তমাধুরীর মহিমার প্রতি আকৃষ্ট করেছে। নিসর্গ প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের পাথারে আঁখি ডুবিয়ে কবি প্রাণের পাত্রটি পূর্ণ করেছেন। তিনি কোন তত্ত্ব বা দর্শনকে কাব্যের মধ্যে প্রচার করতে বসেন নি। তিনি বাস্তব
পৃথিবীকে অধ্যাত্ম শক্তির লীলাস্থল রূপে গ্রহণ করেন নি। অতীন্দ্রিয়লোকের স্বপ্নচারী তিনি নহেন। প্রকৃতিকে তিনি যেমনটি দেখেছেন তেমনি করেই অংকন করেছেন। কীটসের এই সৌন্দর্যস্বপ্নকে বলা যেতে পারে Disinterested love of beauty, প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ও বর্ণের বিচিত্র সমারোহের মধ্যে কবির শিশুসুলভ উলঙ্গ দৃষ্টি তটস্থ। তাঁর দৃষ্টিতে ছিল সহজ সরল আদিম মানবের বিশ্বয়ভরা ব্যাকুলতা। কীটসের দৃষ্টিতে এই যে wild surmise এটাই ছিল তাঁর সৃষ্টির অমরীদুর্লভ প্রেরণা। তার বিশেষত্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সুক্ষ্ম ও সুকুমার ইন্দ্রিয়ানুভূতির। Oh! For a life of sensation, rather than thought অথবা এণ্ডাইমিয়ন কবিতার প্রথম ছত্র, A thing of beauty is a joy for ever কবির সৌন্দর্য স্বপ্নের উচ্ছ্বাসময় বাণী। প্রকৃতির সৌন্দর্যস্বপ্নে মোহমদিরতা কীটসকে উল্লসিত করত।
রবীন্দ্রনাথ একটি শতাব্দীর জীবনের ইতিবৃত্ত দেখেছেন, দেখেছেন মানব সভ্যতার নানা পরিবর্তনকে। তাই তাঁর অভিজ্ঞতার পরিধি যেমন অসীম ও ব্যাপক তেমনি তাঁর সৃষ্টিও সীমাহীন ও বিচিত্রতর। কীটস-এর জীবন রবীন্দ্রনাথের মত দীর্ঘ নয়। পঁচিশ বৎসর আয়ুষ্কালের পরিধির মধ্যেই জীবনের একটি নিখুঁত সত্যকে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। সেখানে সংশয়, দ্বিধা, দ্বন্দু, কিছুই ছিল না, ছিল বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয়। তাঁর প্রতিভার মণি-দীপ দীপ্তকক্ষে সৌন্দর্যের লাবণ্য বিলাসের যে রূপ ফুটে উঠেছে সেই রূপ সত্য হচ্ছে, “Beauty is truth, Truth is beauty.” ইহাই কবির জীবন বেদ, কবির জীবনভিত্তিক সাধনা। কবি প্রকৃতির সৌন্দর্যকে পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে আরতি করেছেন। সে সৌন্দর্য নিছক সৌন্দর্য, বিশুদ্ধ সৌন্দর্য। সৌন্দর্যেই তার বিকাশ, সৌন্দর্যেই তার পরিণতি। তিনি কল্পনার কল্পলোকে বসে সেই সৌন্দর্যের ধ্যান করেছেন। অর্থাৎ what the imagination seizes as beauty must be the truth whether it existed or not. কল্পনার সৌন্দর্যই হল সত্য, সে সত্যের অস্তিত্ব থাক বা না থাক। কবি চিরন্তন সৌন্দর্যের রূপকে ধ্যান করেছেন যে সৌন্দর্য মৃত্যুহীন ধ্বংসহীন। কবির কল্পনার আকাশে যে নানান রঙের ছবি ভেসে ওঠে সেটাই সত্য এবং সুন্দর। কবির মনোভূমি এখানে সত্য এবং কল্পনার যাদুকরী প্রভাবে যা সৃষ্টি হয় তাই সুন্দর। Garrod-এর ভাষায় বলা যায়, There is nothing real, but the beautiful and nothing beautiful but the real, কীটসের এই সৌন্দর্য সাধনার কেন্দ্রে আছে বিরাট প্রশান্তি ও স্থৈর্য।
রবীন্দ্রনাথ কীটসের মত এতখানি আত্মপ্রত্যয় নিয়ে কোথাও সৌন্দর্যের সীমায় নিজেকে ধরা দেননি। তিনি কীটসের মত এতখানি বিষয় নির্লিপ্ত আপসহীন নিছক সৌন্দর্য সাধনা করেন নি। তিনিও প্রকৃতির সৌন্দর্য মাধুর্যকে দেখেছেন। কিন্তু সেই সৌন্দর্যের মর্মলোকে তাঁর পরিপূর্ণ আত্ম বিলুপ্তি ঘটেনি। কারণ কবির বন্ধন মর্তের মৃত্তিকায়। তিনি কীটসের মত বাস্তববিহীন আপসহীন কাল্পনিক ছিলেন না। তিনি মর্তের মৃত্তিকায় অমরাবতীর নন্দনলোক সৃষ্টি করেছেন। তিনি সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে বসে ধ্যান করেননি। বরং সৌন্দর্যের বিচিত্র প্রকাশের আনন্দলোকে বিচরণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ যখনই প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসেছেন তখনই রূপের মধ্যে অপরূপের সন্ধান করেছেন। সৌন্দর্য যে কেবলমাত্র সৌন্দর্যের মধ্যেই বিকাশ ও পরিণতি লাভ করে তা নয়, বিশ্বের সমস্ত সৌন্দর্যের মধ্যে কবি একটি অখন্ড সত্তাকে আবিষ্কার করেছেন। এই অখন্ড মহান্ সত্তা ও বিশ্বচরাচরের মধ্যে তিনি ঐক্য অনুভব করেছেন। এই প্রকৃতির ফল-হাওয়া-জল-তৃণ-তরুর মধ্যেও সেই মহান সত্তার বিচিত্র লীলাকে তিনি অনুভব করেছেন এবং তারই প্রকাশকে তারই নানা বিকাশকে মহিমান্বিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ এই বিশ্বের সমস্ত খণ্ড সৌন্দর্যের মধ্যে অখন্ড রূপের প্রকাশকে অপরূপ বলে গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ এই পৃথিবীর সৌন্দর্যের সীমাকে অতিক্রম করে
তিনি পরম সুন্দরের সৌন্দর্যলোকে বিচরণ করেছেন। কবি বিশ্বের সমস্ত কিছুর মধ্যেই সেই পরম পুরুষের আবির্ভাবকে অনুভব করেছেন, অনুভব করেছেন সেই পরম সুন্দরের বিচিত্র লীলাকে। মনে রাখতে হবে যে, এই হচ্ছে কবির সীমার মধ্যে অসীমের তত্ত্ব। কারণ রবীন্দ্রনাথের জীবনে ভারতীয় দর্শন উপনিষদের প্রভাব যেমন প্রবল তেমনি বৈষ্ণব ও বাউলের প্রভাবও কম নয়।
কীটস খাঁটি কাল্পনিক ও রোমান্টিক। সেই কল্পনার, রোমান্টিকতার উচ্চগ্রামে রবীন্দ্রনাথ পৌছতে পারেন নি। কীটসের কল্পলোক, Hoodwinked with fairy fancy. সেই লঘু কল্পনার বিলাস কবিকে করেছে উন্মনা এবং সেই কল্পনার তীব্র অনুভূতি কবি চিত্তকে করেছে ক্ষত-বিক্ষত।
এই রোমান্টিক বিলাস কবির কাছে অধরার মত। “La Belle Dame Sans Merci”-তে কবি সেই অধরার রহস্যমণ্ডিত ব্যবহারে স্তব্ধ। এই কবিতায় প্রেমের অতৃপ্ত কামনার রহস্যময়তা প্রকাশ পেয়েছে। “Eve of St. Agnes” কবিতায় কবির রোমান্টিকতা বাস্তবলেশহীন বিশুদ্ধ স্বপ্নময়তা মাত্র। এখানে মধ্যযুগের একটি সংস্কারকে কেন্দ্র করে দূরে বহুদূরে স্বপ্নলোকে বিচরণ করেছেন। কীটস কল্পনার ডানা মেলে দূর অস্পষ্ট, অচেনা, অজানা জগতে বিচরণ করেছেন। অনির্দেশ্য অলক্ষ্যের পথে কবি যে যাত্রা শুরু করেছেন সেই পথের পথিক Porphyro আহ্বান করেছে ম্যাডলিনকে সুদূরের অভিসারে, প্রেমের আত্যন্তিক অনুভূতিতে কবি-হৃদয় আচ্ছন্ন। কবির দৃষ্টিতে ম্যাডলিন Splendid Angel, অর্থাৎ সেক্সপীয়রের জুলিয়েট। এবং Porphyro সেক্সপীয়রের রোমিও। কীটসের প্রেম ইন্দ্রিয়াতীত নহে। যুগ যুগ ধরে নারীর প্রেমের মধ্যে দেহ-মিলনের জন্য যে ব্যাকুল আর্তি সে আর্তিই কীটসের কবিতায় স্থান পেয়েছে। প্রেমের পথ বন্ধুর। তাই আসন্ন মৃত্যুর ভয়াবহতা সত্ত্বেও প্রেমিকের হৃদয় অশান্ত-সমুদ্র-সফেন। তাই যুগে যুগে প্রেমিকের অভিসার ঘটেছে আসন্ন দুর্যোগের ভূমিকায়। Porphyro জানে যে শত শত্রুর তরবারী তার হৃদয় বিদ্ধ করবে এবং Not one breast affords him any mercy একথা জেনেও সে প্রিয়মিলনের ব্যাকুলতায় চিরশত্রুর গৃহে প্রবেশ করতে দ্বিধাবোধ করে না। কিন্তু অনাদি কালের হৃদয় উৎস হতে ভেসে আসা দুটি প্রেমিকের মিলন মেলার বাসরকুঞ্জ মাটির পৃথিবীতে নয়, পরিচিত ভৌগোলিক সীমার মধ্যেও নয়, তা হচ্ছে, “For over the southern moors, I have a home for thee”.
কবি তাঁর প্রণয়িনী Fanney Brawne-এর সঙ্গে ১৮১৮ সালে মিলিত হন। কিন্তু তাঁর পরিণয়ের ব্যাপারে কতকগুলি বাধা ছিল, যা কবিকে দুঃখ ও বেদনা দিয়েছিল। কবি সেই দুঃখ-বেদনার হাত থেকে উদ্ধার পাবার জন্য যেন মধ্যযুগের অস্পষ্ট দূরলোকে পাড়ি দিয়েছেন। কোন এক সমালোচকের ভাষায়, “we may say that Medeline is Fanney and keats Porphyro. ‘ইসাবেলা’ কাব্যে আপন নিঃসঙ্গতার ব্যথা ও বেদনার ব্যাকুল বাঁশরী ধ্বনিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ কীটসের মত প্রেমের আত্যন্তিক ও বিশুদ্ধ রোমান্টিকতার অন্ধ আবেগে অজানা জগতের পানে ডানা মেলে দেননি। পরিবর্তে তিনি পরিচিত জগতের মধ্যে সেই অধরার অন্বেষণ করেছেন। তিনি প্রেমকে একটি তত্ত্বরূপে গ্রহণ করেছেন। তাঁর কাছে প্রেম একটি আইডিয়া। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না, শুধু সুখ চলে যায়, এমনি মায়ার ছলনা।” রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রেমে সুখ-দুঃখ ভুলে তবে সুখ পায়। অর্থাৎ কবির ভাষায়, “সংসারের জমি থেকে প্রেমকে উৎপাটিত করে আনলে সে আপনার রস আপনি জোগাতে পারে না, তার মধ্যে বিকৃতি ঘটতে থাকে।” রবীন্দ্রনাথ সংসারের সীমার মধ্যে প্রেমের অমরাবতী রচনা করতে চেয়েছেন। এ হচ্ছে তাঁর সীমা-অসীমের মিলন সাধনের পালা। পরবর্তী যুগে কবি দেহ কামনার উর্দ্ধে ইন্দ্রিয়াতীত প্রেমের ও প্রণয়ের সাধন আবেগের কথা বলেছেন। যে প্রেম দেহ-
মিলনকে দূরে রেখেই চিরন্তনের নেশায় উন্মত্ত। “তবু সে তো স্বপ্ন নয়; সবচেয়ে সত্য মোর সেই মৃত্যুঞ্জয়, সে আমার প্রেম।” রবীন্দ্রনাথের প্রেমের মধ্যে প্রাণোত্তাপের তীব্র মদিরা নেই, নেই বক্ষের রক্তধারায় মিলনের ব্যগ্রতায় চঞ্চল বসন্তের বিদ্রোহের নাচন। পরিবর্তে তাঁর প্রেমের মধ্যে আছে শান্তরস। যে প্রেমের মধ্যে আছে কল্যাণময় শক্তি, যে শক্তি প্রেমকে মহৎ করে, কামনা কলুষ হতে মুক্ত করে, সুখ-দুঃখে বেদনায় বন্ধুর যে পথ সেই পথপ্রান্তে যে প্রেম আপনার আসন পাতে, যে প্রেম হরকোপানলে ভস্মীভূত হয়ে হয় পরিশুদ্ধ। তাই রবীন্দ্রনাথের প্রেম রোমান্টিক দুঃসাহসিকতার প্রচণ্ড আবেগে মৃত্যুকে অস্বীকার করে দুঃসহ অভিযানের পথে যাত্রা করতে প্রেরণা দেয় না।
বায়রণের সমগ্র ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার স্ফূর্তি যেমন ‘ডনজুয়ান’ কাব্যে ঘটেছিল, কীটসের প্রতিভার সম্যক বিকাশ ঘটেছিল, তাঁর ode-গুলিতে। ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাসে এই ode-গুলি স্বতন্ত্র মহিমায় প্রতিষ্ঠিত। কোন একজন সমালোচক বলেছিলেন যে, কীটস যদি কেবলমাত্র ode-গুলি রচনা করতেন তাহলেও ইংরাজি সাহিত্যে প্রতিভাবান শ্রেষ্ঠ শিল্পীরূপে তিনি পরিগণিত হতেন। কারণ ode-গুলি কীটসের সমগ্র জীবনের সোনার ফসল। অবশ কীটসের সমস্ত ode-গুলিকেই সেই মর্যাদা দেওয়া যায় না। Ode to psyche, Ode to a Nightingale, Ode on Greecian urn, Ode on Melancholy, Ode to Autumn প্রভৃতি সেই মর্যাদার অধিকারী, কারণ এইগুলিতে কীটসের শিল্প সুষমার গৌরব সমুন্নতি লাভ করেছে। একটা মর্মগত বৈরাগ্যের ও বেদনার অপূর্ব ব্যঞ্জনাময় প্রকাশে সমৃদ্ধ।
১৮১৯ এপ্রিল ও মে মাস কীটসের শিল্পজীবনের ক্রান্তিকাল। এই সময়ে কীটসের জীবনাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা। নানা মর্মান্তিক ঘটনার অশুভ পদক্ষেপ কীটসের জীবনে দেখা দিয়েছে। কিন্তু কবি সেই দুর্যোগের শিয়রে বসে যা রচনা করলেন তা প্রাণের আভায় রঙিন করা রক্তদীপ। এই সমযে বিদগ্ধ পণ্ডিত কবি ও সমালোচক কোলরীজের প্রেরণা তাঁকে নুতন পথের দিশারী করে তুলেছিল। সেই অভাবনীয় মুহূর্তে কীটস জীবনের সর্বস্ব উজাড় করে শিল্প সাহিত্যের আঙ্গিনায় চিরন্তনের আল্পনা এঁকে দিলেন। তাই কীটসের ode-গুলি স্বর্গীয় মদের ফেনপুঞ্জ। Ode-গুলির মধ্যে জাগর-চৈতন্যের সৌন্দর্য মাধুর্য ও রসোচ্ছলতার সকরুণ বিষাদের মর্মোচ্ছ্বাস ঘটেছে। Ode-গুলির মধ্যে কবির ধ্যানলোক, প্রকৃতির অফুরন্ত সৌন্দর্যের লীলাক্ষেত্র, তীব্র আবেগানুভূতি ও শিল্পকর্মের অপূর্ব উৎকর্ষ লাভ করেছে। Ode to Psyche-তে সৌন্দর্যলক্ষ্মী Psyche-র সৌন্দর্যের ধ্যান করেছেন। কিন্তু সেই সৌন্দর্য্যের মধ্যেও অতৃপ্তি-জনিত সুদূরব্যাপী বিষাদের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। বিরহকাতরা Psyche, Melancholic Love-এর প্রতিমূর্তি। এই একই ভাবের প্রবাহ তাঁর সমস্ত Ode-গুলিতে লক্ষ্য করা যায়। Ode to Melancholy-তে বিষাদের স্বরূপ উদঘাটন করেছেন। এই একই ব্যথার সুর মূর্ত হয়ে উঠেছে কবি Ode to Nightingale কবিতায়। Ode to Greecien urn কবিতায় কবি cold Pastoral চিত্র অংকন করেছেন। কবির দৃষ্টিতে যে জগৎ ও জীবন ভেসে উঠেছে তা নিঃসঙ্গ প্রকৃতির জগৎ। প্রকৃতির বিপুল নিঃসঙ্গতার মধ্যে তিনি আত্মনিমগ্ন।
রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও বিষাদের সুর লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু কবি কীটসের ode-গুলির মধ্যে যে বৈরাগ্যের সীমাহীন স্পর্শ লাভ করা যায় রবীন্দ্রনাথের মধ্যে তার অভাব। কোন সমালোচক বলেছেন যে, ode-গুলির শিল্প চমৎকারিত্ব ও রসের গভীরতা এত গাঢ় যে ওয়ার্ডসওয়ার্থকেও তুলনা করা যায় না। সুতরাং রবীন্দ্রনাথকেও তুলনা করা যায় না। এক্ষেত্রে কীটস একক এবং অদ্বিতীয়। কিন্তু তবুও রবীন্দ্রনাথ কোন কোন ক্ষেত্রে কীটসের নৈরাশ্যজগতে সীমার মধ্যে ক্ষণকালের জন্য অভিসার করেছেন। তা হল রবীন্দ্রনাথের “ছিন্নপত্র”। ছিন্নপত্রের কয়েকটা পত্রকাব্যে সে বৈরাগ্যের সুর লক্ষ্য
করা যায়। এই বৈরাগ্য ও বিষাদ নিরাশা-ব্যঞ্জক নয়। আত্মপ্রত্যয়ে দৃঢ়। পদ্মার ধু ধু করা সীমাহীন বালুচর, দূরে তরুশ্রেণীর ঘন নীলরেখা, ছোট ছোট গ্রাম আবার পরিপূর্ণ বর্ষায় পদ্মার ভরা যৌবনের পরিপূর্ণ রূপ, শ্যামল শষ্যক্ষেত্রের সৌন্দর্যের পাথারে কবিচিত্ত আত্মহারা। নিরালা নিঃসঙ্গভাবে নির্জনপ্রান্তবাসী কবি সূর্যাস্তের নানান রঙের ছবির মধ্যে দেখেছেন মায়াময় অপরূপতা। প্রকৃতির সৌন্দর্য ও মাধুর্যময় রূপের মধ্যে গভীর গম্ভীর সকরুণ সঙ্গীতধ্বনিকে কবি কান পেতে শুনেছেন। সন্ধ্যার দীপালোকে প্রকৃতির উদার উদাস করা অসীম আনন্দলোকে একটা সঙ্গীহীন বৈরাগ্যের সুর কবিকে উন্মনা করেছে। তাই, “প্রকৃতি সুন্দরী” কুতুহলী পাড়াগাঁয়ের মেয়ের মত আমার জানালা দরজার কাছে উঁকি মারছে, আমার ঘরের এবং মনের, আমার কাজের এবং অবসরের চারিদিকে নবীন ও সুন্দর হয়ে আছে। আকাশ আমার সাকী, স্ফটিকের স্বচ্ছ পেয়ালা উপুড় করে ধরেছে, সোনার আলো মদের মত আমার রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়ে আমাকে দেবতাদের সমান করে দিচ্ছে। সেইখানে আমি কবি, সেইখানে আমি রাজা, সেইখানে আমার সঙ্গে বরাবর ঐ সুনীল নির্মল জ্যোতির্ময় অসীমতার এইরকম প্রত্যক্ষ অব্যবহিত যোগ থাকবে।” (১৪৪)। ছিন্নপত্রের নিসর্গ জিজ্ঞাসার মধ্যে কবির বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের উপলব্ধির ভাবটা ধরা পড়েছে আর একটি পত্রে। যেখানে সন্ধ্যা সন্ন্যাসিনী কিন্তু তার দেহলীতে সচকিত আলোর নাচন; “কেবল নীল আকাশ এবং ধূসর পৃথিবী আর তার মাঝখানে একটি সঙ্গীহীন, গৃহহীন অসীম সন্ধ্যা, মনে হয় যেন একটি সোনার চেলী পরা বধু অনন্ত প্রান্তরের মধ্যে মাথায় একটুখানি ঘোমটা টেনে একলা চলেছে…..। যুগযুগান্তর কাল সমস্ত পৃথিবীমণ্ডলকে একাকিনী স্নাননেত্রে মৌনমুখে শ্রান্তপদে প্রদক্ষিণ করে। তার বর যদি কোথাও নেই তবে তাকে এমন সোনার বিবাহ বেশে সাজিয়ে দিল। কোন্ অন্তহীন পশ্চিমের দিকে তার পতিগৃহ।” কবি এখানে সৌন্দর্যের ধ্যানালোকে বিহার করেছেন। কল্পনার কল্পলোকে স্থায়ী আসন রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সন্ধ্যার রূপ বর্ণনায় যে অখণ্ড সৌন্দর্যানুভূতি লক্ষ্য করা যায় তা যেন কীটসের, “Charmed magic casement in fairy lands forlorn”. কীটসের দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় ছিল “The fancy cannot cheat so well.” রবীন্দ্রনাথেরও এই আত্মপ্রত্যয় ছিল।
প্রাচীন গ্রীক সৌন্দর্যপ্রিয়তা এবং তার অন্তর্লোকে বিহার অতীতে প্রত্যাবর্তনের একটি দিক। এই সুদূর অতীতের ছায়ামূর্তিগুলি রোমান্টিক কবিদের কল্পলোকের বাতায়ন পথকে দক্ষিণের মন্ত্রগুঞ্জরণে সচঞ্চল করে তুলতো। ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলী, কোলরীজ, বায়রণের মধ্যে মধ্যযুগীয় জীবনযাত্রার প্রতি একটা তীব্র আকর্ষণ ছিল। কিন্তু কীটস প্রাচীন গ্রীক সৌন্দর্যের রূপকল্পনায় একক। শেলী বলেছেন, “Keats was a Greek”.
কীটসের প্রাচীন গ্রীক সৌন্দর্যপ্রিয়তার উৎসমুখ প্রধানতঃ তিনটি। প্রথমতঃ গ্রীক সাহিত্যের প্রতি তাঁর প্রবল অনুরাগ; দ্বিতীয়তঃ গ্রীক ভাস্কর্য-শিল্পের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় মোহ, তৃতীয়তঃ জন্মগত সৌন্দর্য সাধনা। হোমারের ইলিয়াড কাব্য কীটসের আদিম মানবের বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে মায়াজন বুলিয়ে দিয়েছিল। On seeing the Elgin Marble, ode on a Greecian urn প্রভৃতি কবিতায় গ্রীসের ভাস্কর্য-শিল্পের পেলব মসৃণতা সুক্ষ্ণ ও অসামান্যতা কীটসকে বিপুলভাবে প্রভাবান্বিত করেছিল।
কীটসের অতীতচারণার মূলে রয়েছে সৌন্দর্য সাধনার স্বভাবানুকারিত্ব। কোন এক সমালোচক বলেছেন, “The Hillenes were lovers of beauty, so also Keats” গ্রীস দেশের দেবদেবীর মূর্তিগুলি কীটসের কল্পনার বরণে প্রকৃতির এক একটি বিশেষ চিত্ররূপ ফুটে উঠেছে। এ হচ্ছে কীটসের নবতন সৃষ্টি। তিনি অতীতের অস্পষ্টতাকে স্পষ্ট ও স্বচ্ছ করে তুলেছেন। গ্রীসের দেবমূর্তিগুলি সজীব হয়ে তাঁর কাব্যে পদচারণা করেছেন।
মধ্যযুগীয় জীবনের চিত্রচারণার ক্ষেত্রে কাঁটস তৈলচিত্রকর। কিন্তু কোলরীজ Skatcher এটিসের চিত্রগুলি জোবড়া রঙে পরিপূর্ণ। কিন্তু কোলরীজ নিপুণ শিল্পী। কোলরীজের তুলনায় রাউস স্কুল। আবার কীটসের তুলনায় রবীন্দ্রনাথ স্কুল। কবি কীটস Eve of St. Agnes কবিতায় একটি গীর্জার শীতকালীন রাত্রির বর্ণনা করেছেন। এই প্রচণ্ড শীতের বর্ণনাকে তিনি তীব্র তীক্ষ্ণ করে তুলেছেন। চ্যাপেলের অভ্যন্তরে নানা দেবদেবীর মূর্তিগুলিকে জীবন্ত করে বর্ণনা করেছেন। ম্যাডলীনের গৃহাভ্যন্তরের বর্ণনাকেও স্পষ্ট করে তুলেছেন। সেই কক্ষের বাতায়নটিতে নানা ফল-পল্লব-লতার চিত্রাঙ্কন, নানা রত্ন ও প্রবালে খচিত, নানা কারুকার্য সমন্বিত দামাস্কাস সিঙ্কের মত প্রজাপতির চিত্র, সহস্র নাইটের ও স্নান সন্ন্যাসিনীর চিত্র সেই বাতায়ন পথ থেকে খসে পড়া আলোকের বরমাল্য অতি সুন্দরভাবে চিত্রিত করেছেন। এই কাব্যের নায়িকা ম্যাডলীনকে অর্ধাঙ্গ আবৃতা মৎসকন্যার ন্যায় ফুটিয়ে তুলেছেন। মধ্যযুগের নায়িকার মূর্তি অংকনে কীটস অপূর্ব দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এবং নিশীথ রাত্রির ঝটিকাহত দুর্যোগে অনাদিকালের স্রোতে ভেসে আসা দুটি হৃদয়ের প্রেমের অমরাবতীর পথে যাত্রা অতি সুন্দররূপে চিত্রিত করেছেন। মধ্যযুগীয় জীবনযাত্রার মধ্যে কীটস নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিলিয়ে দিয়েছেন। আধুনিক জগৎ তাঁর চেতনা থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে। তাঁর চেতনার রাজ্যজুড়ে একটি মধ্যযুগীয় পরিবেশ একটি সহজ সরল বিশ্বাস অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সে বিশ্বাস হল কুমারী সেন্ট এ্যাগনেসের স্মৃতি-সন্ধ্যায় কুমারীগণ যদি শুদ্ধচিত্তে পবিত্র-হৃদয়ে তাদের প্রেমিকের ধ্যান করে তাহলে তাদের মিলন হয়। ম্যাডলীনের অন্তঃকরণ সেই সুখস্বপ্নে বিভোর। এই বিভোরতা তন্ময়তা ও একাগ্রতা নিয়ে শুচি-শুভ্র পবিত্র দেহে রোমান্টিক নায়িকা সেই বিশেষ মুহূর্তটির জন্য প্রতীক্ষামানা। কবি কীটস ম্যাডলীনের মিলন রাত্রির পরিবেশটিকে জীবন্ত উজ্জ্বল করে তুলেছেন।
রবীন্দ্রনাথও অতীত ভারতে মানস ভ্রমণ করেছেন। কবির কাছে অতীতকালের সৌন্দর্য বলতে কালিদাসের কালকে-ই বুঝায়। উজ্জয়িনী কালিদাসের কল্পনায় কেন্দ্রভূমি। সুতরাং রবীন্দ্রনাথেরও। কালিদাসের প্রভাব রবীন্দ্রনাথের উপর প্রবল। সংস্কৃত ভাষায় গুরুগাম্ভীর্য ও ছন্দ মাধুর্য কবিকে মোহমুগ্ধ করেছিল। কবি বলেছেন, “সংস্কৃত বাক্যের ধ্বনি এবং ছন্দের গতি আমাকে কতদিন মধ্যাহ্নে অমরুশতকের মৃদঙ্গঘাত-গম্ভীর শ্লোকগুলির মধ্যে ঘুরাইয়া ফিরিয়াছে”। তাই কবি দূরে বহুদূরে স্বপ্নলোকে উজ্জয়িনীপুরে শিপ্রানদী পারে পূর্বজনমের প্রিয়ার অন্বেষণে যাত্রা করেছেন। কিন্তু কবি প্রিয়ার যে চিত্র অংকন করেছেন তার উপাদান কালিদাসের। কালিদাসের সেই উপাদানকে নিয়ে কবি নুতন সৃষ্টির নবতন সৌন্দর্য প্রকাশ করতে পারেন নি। অনেক ক্ষেত্রে যেন, তিনি সংস্কৃত শ্লোকেরই বঙ্গানুবাদ করেছেন মাত্র। তিনি কীটসের মত পরিপূর্ণভাবে সেকালের কবি হতে পারেন নি। অতীতকালের মধ্যে দ্বিধাহীনভাবে তিনি আশ্রয় নিতে পারেন নি। তিনি সেকালের বাণীকে আপন কণ্ঠে পরিপূর্ণরূপে গ্রহণও করতে পারেন নি। এর কারণ কবিচিত্তে একটা দ্বিধা ছিল। এই দ্বিধার প্রকাশ তখনই ঘটেছে যখন তাঁর পূর্ব জনমের প্রিয়ার মালবিকা হাতে দীপশিখা নিয়ে তাঁরই সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু কবি পারেন নি তাঁর প্রিয়ার সাথে আলাপন করতে। কবি নিজেই বলেছেন,
মুখে তার চাহি
কথা বলিবারে গেনু, কথা আর নাহি।
সে ভাষা ভুলিয়া গেছি-
কবির স্বপ্নের মধ্যেও এটা জাগর চৈতন্য ছিল যার ফলে তাঁর কণ্ঠে সেকালে বাণী স্তব্ধ। এবং সেই বাণীহারা কবির পক্ষে সেকালের প্রিয়া মালবিকার সঙ্গে সম্ভাষণও ছিল অসম্ভব। যেখানে বাণী স্তব্ধ সেখানে প্রেমের পরিপূর্ণ সৌন্দর্যটুকু ম্লান হয়ে যায়। এ যেন দুই বোবার আলাপন। শুধুমাত্র বাণীহারা বেদনার কথাই প্রকাশ পেয়েছে। প্রাচীন জীবনের সঙ্গে তার পরিপূর্ণ মিলন ঘটেনি। বরং ব্যর্থতার কথাই প্রকাশ পেয়েছে। কবির নিজের মনের মধ্যেই দ্বিধা ও প্রশ্ন জেগেছিল যে অতীতের প্রেমজীবনের মধ্যে পুনরায় স্বাভাবিকভাবে ফিরে যাওয়া যায় কিনা? যদি ফিরে যেতে পারতেন তাহলে কবি বলতে পারতেন, “হায়। স্বর্গ আর স্বর্গ নহে”।
দ্বিতীয় কারণ কবি নিজে যে বর্তমানের কবি সে সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ সচেতন। বর্তমান কালকে তিনি পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছেন। ফলে অস্পষ্ট অতীতের ধূসর কল্পলোকে কবিচিত্তে ক্ষণকালের ছায়া ফেলেছে মাত্র। তিনি বর্তমানের কবি বলেই অতীতের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করেছেন। পরিপূর্ণরূপে “অতীত” হতে পারেন নি। কবি বলেছেন,
“আপাতত এই আনন্দে গর্বে বেড়াই নেচে
কালিদাস তো নামেই আছেন আমি আছি বেঁচে”।
সুতরাং রবীন্দ্রবকাব্যে মালবিকার পদচারণা যেমন স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি তেমনি অতীতের সৌন্দর্যলোকও অতিক্রম করতে পারেনি। কারণ মধ্যযুগীয় মালবিকার চেয়েও এই আধুনিক বিনোদিনী দুলিয়ে যারা চলেন বেণী-কবির কল্পনাতে তাদের ছবি ফুটে উঠেছে। তাই নিপুণিকা, চতুরিকা, মালবিকার দল কবি কল্পনায় ব্যর্থ হয়ে গেছে। আধুনিক কালের বিনোদিনীদের তরুণ আঁখির প্রসাদ পাননি বলে বর্তমানের কবি কালিদাসকে যতই ব্যঙ্গ করুন, যতই বলুন যে কালিদাস আগে জন্যে ঠকে গিয়েছেন, একথা সত্য যে কবি অতীত-ভুবনের সৌন্দর্যলোকে উত্তরণ করতে পারেন নি বলেই এই কটাক্ষটুকু করেছেন। অতীত দিনের বিস্তৃত নীরব কাহিনী এবং পুরনারীদের দিকে তাকিয়ে “কথা কও, কথা কও, ভাষা দাও তারে” বলে যতই কবি আবেদন করুন কবিকণ্ঠ কিন্তু বাণীহারা। আগেই বলেছি কীটসকে যেমন বলতে পারি যে, Keats was a Greek রবীন্দ্রনাথকে তেমনি বলতে পারি না, “রবীন্দ্রনাথ উজ্জয়িনী-পুরবাসী”।
কীটসের কাব্যে গ্রীক সৌন্দর্য যেমন অপূর্ব ভাবে প্রকাশ পেয়েছে তেমনি কীটস গ্রীক সৌন্দর্যের মণি দীপ-দীপ্ত কক্ষে স্বাভাবিক ভাবে প্রবেশ করেছেন। অতীতের দেবদেবী এবং নরনারী জীবন্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছে তাঁর বর্ণনায়। কবি যেন তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাদেরই ভাষায় কথাবার্তা বলেছেন। কীটস সম্বন্ধে বায়রণ বলেছেন, “Keatshas contrived to talk about the gods much as they might have been supposed to speak.” কীটস পরিপূর্ণভাবে গ্রীক। কোন দ্বিধা কোন সংশয় নেই, বা বর্তমান কালের জন্য কোন গৌরব নেই। তিনি যে সবকিছু থেকে নির্লিপ্ত হয়ে অতীতের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছেন। যে অতীত তাঁর কাছে অস্পষ্ট নয়, স্পষ্ট ধূসর নয়, আলোকোজ্জ্বল, বাস্তব সত্য নয়, কল্পনার ভাবসত্য। এবং তিনি অতীতের মূর্তিমান প্রতীক, কারণ কীটস নিজেই গিয়েছেন সেই নিরুদ্দেশ অতীতলোকে, যে অতীত-
“When holy were the haunted forest bought
Holy the air, the water and the fire”
পূর্বেই বলেছি রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যসাধনা কীটসের মত এতখানি বিষয়-নির্লিপ্ত আপসহীন নিছক সৌন্দর্য-সাধনা নয়। কারণ মর্ত পৃথিবীর বন্ধন কবিকে দিয়েছে প্রেরণা। এই সমাজ এবং সমাজের মানুষকে অতিক্রম করে শুধু সৌন্দর্যের ধ্যান করা কবির পক্ষে সম্ভব ছিল না। কবি এলেছেন, “স্বর্গ আর কি দিত জানিনে, কিন্তু এমন কোমলতা দুর্বলতাময়, এমন সকরুণ আশঙ্কাভরা অপরিণত এই মানুষগুলির মত আপনার ধন কোথায় দিত?” কবি বলেছেন, “আমার হৃদয় মানব হৃদয়, আমার বুদ্ধি মানব বুদ্ধি, আমার কল্পনা মানব কল্পনা। মানুষকে বিলুপ্ত করে যদি মানুষের মুক্তি তবে মানুষ হলুম কেন?” রবীন্দ্রনাথ মানব প্রেমিক এবং মানুষের কবি। মানব প্রেমই কবি কল্পনাকে শিবজটা মুক্ত করে উদ্দাম করেছে। রবীন্দ্রনাথ মানব প্রেমের চারণ কবি। তাই মানবকে অতিক্রম করে বিশুদ্ধ প্রকৃতি প্রেমের সৌন্দর্য সাধনা কবির কাছে অর্থহীন। কবির কাব্য মানব সৌন্দর্যে ভরা। বলাকা কাব্যে কবি সেই মর্তমানবকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছেন। মানুষ বন্ধনহীন, মানবের হৃদয়ও বন্ধনহীন। তাই সৃষ্টিও তার অসামান্য। কিন্তু রোমান্টিক কবি সেই মানবের পূর্ণ মূল্য দিতে গিয়ে একটি মারাত্মক ভুল করে বসেছেন। বলাকা পর্বে আটাশ নম্বর কবিতাটি সেই ভুলের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। কবিতাটি যেন সরাসরি কবি কীটসের Ode to Nightingale কবিতাটির স্পষ্ট জবাব। এই কবিতাটিতে কবি রোমান্টিকতা বিরোধী মতামত প্রকাশ করে ফেলেছেন। অবশ্য এটাই রবীন্দ্রনাথের সমগ্র কাব্যজীবনের বাণী নয়। ইউরোপের সমস্ত রোমান্টিক কবি মানবকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছেন, কিন্তু মানব প্রেমের আধিক্যে এবং সেন্টিমেন্টের প্রাবল্যে প্রকৃতির বিরুদ্ধে এই ধরনের মন্তব্য কেউ কোথাও করেন নি। এই কবিতায় তিনি প্রকৃতিকে একটি গতানুগতিক নীতি-নিয়মের অনুসরণকারী বলে অভিহিত করেছেন। সৃষ্টিকর্তা এই প্রকৃতিকে যেমন ভাবে ভূষিত করেছেন, যেমন ভাবে প্রকাশ করেছেন তারচেয়ে বেশি কিছু নেই। অর্থাৎ জড়প্রকৃতির যেটুকু আছে সেইটুকু ছাড়া তার আর কিছু দেওয়ার নাই। কবি বলেছেন, “প্রকৃতিতে সব জীবকে তুমি তোমার দানের দ্বারা ভূষিত করলে এবং যাদের যা দিয়েছ তারা সেই সম্পদকেই প্রকাশ করছে। কেবল আমার কাছে তোমার দাবি রয়েছে আমার কাছেই তোমার আকাঙ্খার অন্ত নেই। তুমি আমাকে যা দিয়েছ তার পরিমাণ অল্প, কিন্তু আমি যে দান তোমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি তা অনেক বেশি”। কবির বক্তব্য প্রকৃতি বন্ধ্যা। প্রকৃতির সৃজন ক্ষমতা নেই। মানুষ তার সৃষ্টিতেই অমর। এই কবিতার প্রথম স্তবকে তিনি বলেছেন।
“পাখীরে দিয়েছ গান, গান সেই গান, তার বেশি করে না সে দান আমারে দিয়েছ স্বর, আমি তার বেশি করি দান আমি গাই গান।”
এই প্রসঙ্গে কবি বলেছেন, “আমি কেবল স্বর নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছি কিন্তু তোমার দাবি আছে বলেই তা সঙ্গীত হয়ে প্রকাশিত হয়”। কিন্তু রোমান্টিক কবির দৃষ্টিতে তখন ধরা পড়ে নি যে পাখীর স্বরের মধ্যেও আছে সৃষ্টির অপূর্ব সঙ্গীতধর্মিতা। কবির কাছে প্রকৃতি হয়ে গেছে গৌণ। প্রকৃতির আত্মা বিহঙ্গের সঙ্গীতের মধ্যে নতুন কোন বৈচিত্র্য তিনি অনুভব করেন নি। পাখী যেন নেহাতই প্রকৃতির দেওয়া সম্পদ ও সুরকেই প্রকাশ করেছে। বিহঙ্গের সঙ্গীতের সুর প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টির বৈচিত্র্যে ভরা। বিহঙ্গ নিজেও সুর সৃষ্টি করে। যে সঙ্গীতের সুর কবি কীটসকে উন্মনা করেছিল, মাতাল করেছিল। কারণ কবির কাছে Nightingale পাখীর এই সঙ্গীত আনন্দের প্রতীক, স্বর্গীয় মদের ফেনপুঞ্জ, যৌবন সৌন্দর্যের নন্দনলোক। মানুষের কণ্ঠে যে সঙ্গীতের সুর জাগে তা প্রকৃতির কাছ থেকেই ধার করা। সেই সুর প্রকৃতিকে অস্বীকার করে আপনার চেষ্টায় লাভ করা যায় না। তাই কবি মরণজগতের দুঃখ ভুলবার জন্য কল্পনার ডানায় ভর করে সৌন্দর্যলোকে উত্তরণ করতে চেয়েছেন।
“Away! Away! for I will fly to thee
not charioted by Bacchus and his pards But on the viewless wings of poesy though the dull brain perplexes and retards”.
কবি জানেন এই বিহঙ্গ অমর। যুগ যুগ ধরে এই বিহঙ্গ আনন্দের অমৃতধারা বর্ষণ করবে যা পান করে বাস্তব বিড়ম্বিত জীবনের হাত থেকে মানুষ মুক্তিলাভ করবে। পৃথিবীর সব কিছুই মরণশীল ও ধ্বংসশীল কিন্তু এই বিহঙ্গকুল কখনও ধ্বংস হতে পারে না। কারণ এরা আনন্দের প্রতিমূর্তি। জাগতিক জীবনের দুঃখ ও বেদনা যাদের হদয়কে নির্দয় করেনি, যারা আনন্দরূপের মধ্যে বর্ধিত ও লালিত তাদের মৃত্যু নেই।
Thou wast not born for death, immortal bird! No hungry generations tread the down.
কবির অন্তরস্থিত দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের বাণী। কবি কীটস বিহঙ্গের সঙ্গীত মাধুর্যকে আকণ্ঠভরে পান করেছেন। এবং তারই মদির নেশায় সৌন্দর্যলোকে উত্তরণ করেছেন। কীটসের বিহঙ্গ কেবলমাত্র সঙ্গীতকেই প্রকাশ করে না, সঙ্গীত মাধুর্যের বৈচিত্র্যকেও প্রকাশ করে। রোমান্টিক কবির দৃষ্টি বিহঙ্গের সঙ্গীত মাধুর্যের সুরে সুদূরের পিয়াসী। কবি সেই সৌন্দর্যের জগতে উত্তরণ করেছেন যেখানে রাণী চন্দ্রমা তারকা খচিত আকাশের ভালে স্বর্ণ সিংহাসনে অধিষ্ঠিতা। কিন্তু সে যামিনী জ্যোছনামত্তা নয়। অর্ধপ্রস্ফুটিত গোলাপের অধরে শিশিরবিন্দু। অরণ্য বৃক্ষের পল্লবান্তরাল হতে খসে পড়া আলোকের বরমাল্য, ঝিঁ ঝিঁ পোকার কলতান ও পুষ্পের সুরভীতে আচ্ছন্ন জগতের মধুময় আবেশ কবিকে মুগ্ধ করেছে। কবির মনে হয়েছে এই গহন শীতল স্তব্ধতার মধ্যে বুঝি মরণও ভাল। প্রকৃতি প্রেমিক কবি প্রকৃতিকেই বড় করে দেখেছেন। নিজের সৃষ্টির কৃতিত্বের দাবিকে বড় বড় করে দেখেননি।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, মানবের দুঃখে যে অন্তর তাঁর ব্যথিত, সেই বিধূর হিয়াকে মধুর করে তুলতে পারেন নি পূর্ণিমার উচ্ছ্বসিত হাসির সুখ স্বপ্নরাশিকে অন্তরের মধ্যে নিবিড়ভাবে গ্রহণ করে। তিনি বাতাসকে বলেছেন যে, “তার কোন বাঁধন নেই সে অনায়াসে তোমার সেবা করে বিশ্বকে বেষ্টন করে কাজ করে।” কিন্তু বাতাসও ওই পৃথিবীর বন্ধন থেকে মুক্ত নয়। কবি বাতাসের মধ্যে প্রাণের চঞ্চল আবেগকে উপলব্ধি করতে পারেন নি। তিনি শেলীর মত বলতে পারেন নি।
Be through my lips to unawakened earth the trumpet of prophecy! O wind!
If winter comes, can spring de far behind.”
রবীন্দ্রনাথ ইংলণ্ডের রোমান্টিক কবিদের মতে প্রকৃতি সর্বস্ব নন। তিনি প্রকৃতির চেয়েও চিরদিন ধরে যার ধ্যান করেছেন তিনি হলেন পরম সুন্দর। তাই পরম সুন্দরের কাছেই তিনি তাঁর দাবি উত্থাপন করেছেন। ফলে, প্রকৃতি হয়েছে গৌণ, পরম সুন্দর হয়েছে তাঁর জীবন সর্বস্ব। যার পদপ্রান্তে কবি জন্ম জন্ম ধরে আপনার প্রাণের অর্ঘ্য রচনা করেছেন। কীটস যে প্রকৃতির সৌন্দর্যের সোনার পুরীতে আত্মনিমগ্ন, রবীন্দ্রনাথ সেখানে পরম সুন্দরের ধ্যানে আত্ম সমাহিত। Ode to Autumn কবিতায় কবি কীটস ঋতু বর্ণনার মধ্যদিয়ে মানবের মানস চেতনার সঙ্গে প্রকৃতির গভীর শান্তি ও সরস ফুল পুষ্প সম্ভারের নিবিড় একাত্মতা স্থাপন করেছেন। শরতের পরিপূর্ণ ঐশ্বর্যের মধ্যে যে একটি নিবিড় আত্ম সমাহিত শান্তি একটি সুগভীর তৃপ্তি ও সন্তোষ আছে, যা অতীতের দিকে
তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে না, যা অনাগত ভবিষ্যতের রিক্ততার চিন্তায় বিব্রত হয় না, কবিতাটির মধ্যে, মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে এক প্রকার মিলনের ইঙ্গিত আছে। রবীন্দ্রনাথও শরতের বর্ণনা করেছেন। কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে মানবের মিলনের পাদপীঠ রচনা করেন নি। বরং প্রকৃতি যে পরম সুন্দরের দান এ কথা ভেবেই কবি শরতের রূপ সৌন্দর্যের উদ্দেশ্যে “নম হে নম” বলে প্রণতি জানিয়েছেন। প্রকৃতি ও মানুষের মাঝখানে পরম পুরুষের আবির্ভাব এক বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি করেছে বলেই প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় আত্মীয়তা অর্জন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি, তবুও কবি জন্ম রোমান্টিক। রোমান্টিক ধর্মই কবি জীবনের ঋতু পরিবর্তনের পালাকে জীবন্ত করে রেখেছে। রবীন্দ্রনাথ দখিনা বাতাসের সেই সুরকে কান পেতে শুনেছেন, যা চিরন্তনের ও চিরকালের। ফাগুনের চম্পক পরাগে, কোকিলের কূজনে আর পিয়ালের ছায়াতে পূর্ণিমা তিথি যে রং ঢেলে দেয়, সেই রঙকে তিনি বুকের লালিমা রঙে রাঙিয়েছেন, বলেছেন,
“তব আমি জন্ম রোমান্টিক
আমি সেই পথের পথিক যে পথ দেখায়ে চলে দক্ষিণ বাতাসে পাখীর ঈশারা যায় যে পথের অলক্ষ্য আকাশে।”
ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও রবীন্দ্রনাথ
কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ একটি যুগের স্রষ্টা, সে যুগ হচ্ছে ওয়ার্ডসওয়ার্থের যুগ। রবীন্দ্রনাথও একটি যুগের স্রষ্টা সে যুগ হচ্ছে রবীন্দ্র-যুগ। দুই ভিন্ন যুগের এই দুই কবির জীবনের দৃষ্টিভঙ্গী এবং অভিজ্ঞতায় যেমন গভীরতর পার্থক্য আছে তেমনি কিছু কিছু সাদৃশ্যও আছে। এই দুই কবির রচনাকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমতঃ নিসর্গ প্রকৃতির কবিতা, দ্বিতীয়তঃ মানবের সঙ্গে প্রকৃতির সম্বন্ধ, তৃতীয়তঃ মানব প্রেমের কবিতা।
ওয়ার্ডসওয়ার্থের জীবনের কাল পরিধি হল প্রায় আশি বছর। ১৭৭০ থেকে শুরু করে ১৮৫০ পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রায় এক শতাব্দী জুড়ে ওয়ার্ডসওয়ার্থ জগৎ ও জীবনকে দেখেছেন। কিন্তু কাব্য জগতের সোনার ফসল তুলতে লেগেছে মাত্র বারো বছর। ১৭৯৬ সাল থেকে শুরু করে ১৮০৮ সালের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ। এই স্বল্প পরিসর সীমিত সময়ের মধ্যে ওয়ার্ডসওয়ার্থ যা কিছু রচনা করেছেন সেই রচনার মধ্যেই তিনি একটি যুগের স্রষ্টারূপে চিহ্নিত হয়েছেন। অবশ্য ১৮০৮ সালের পর ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবি কল্পনা যে একেবারে বন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল এমন নয়। কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁর রচনার মধ্যে সেই উত্তাপ, সেই ঘন নিবিড়তা, সেই নিস্তরঙ্গ স্তব্ধতা ছিল না।
অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ সুদীর্ঘকাল ধরে একটি শতাব্দীর জীবনের ইতিবৃত্ত দেখেছেন। দেখেছেন মানব সভ্যতার নানা পরিবর্তনের ধারাকে। রবীন্দ্রনাথের কাব্য প্রতিভা বয়োঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি উজ্জ্বলতর হয়েছে। জীবনের অপরাহ্ন বেলার ম্লান ছায়া তাঁর কাব্য প্রতিভাকে স্নান করেনি। বরং শেষদিন পর্যন্ত তাঁর কাব্য প্রতিভা সমানভাবে উজ্জ্বল ছিল। তাই তার অভিজ্ঞতার পরিধি যেমন ব্যাপক, সৃষ্টিও তেমনি বিচিত্রতর। সমস্ত জীবন ধরেই তিনি ফসল তুলেছেন। কৈশোর শৈশবের শ্যামল সুন্দর কাব্য প্রতিভা পরিণত বয়সে পাকা ফসলের সোনালী রঙে রঙ্গীন হয়ে এক অপূর্ব গরিমায় মহিমান্বিত হয়েছে। অজস্র সৃষ্টির ভাবে পূর্ণ হয়েছে এই কবির কাব্যের শস্যভাণ্ডার। ওয়ার্ডসওয়ার্থের মত তাঁর কাব্য প্রতিভা বর্ষণের পর ক্ষান্ত হয়ে যায়নি।
উনবিংশ শতাব্দীর প্রায় সুরু থেকে যে সাহিত্য বাংলাদেশে রূপ গ্রহণ করতে আরম্ভ করেছিল তার প্রেরণা বহুল পরিমাণে পাশ্চাত্য। আধুনিক বাংলা সাহিত্য অনেকাংশে প্রতীচ্যের ছায়া। মনে রাখতে হকে যে ওয়ার্ডসওয়ার্থ রবীন্দ্রনাথের পূর্বসূরী। রবীন্দ্রনাথেরও বিরাট সাহিত্য পাশ্চাত্য রীতি অনুসরণ করে মহান। ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলী, কীটস, বায়রণের প্রভাব যে রবীন্দ্রনাথের উপর ছিল এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবুও দুই কবি ভিন্ন এবং অভিন্ন। স্থান, কাল, পাত্র, জগৎ ও জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে পার্থক্য থাকার দরুন দুই কবির চেতনায় তার প্রকাশ ঘটেছে ভিন্ন ভাবে।
ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রথম জীবন কেটেছে কাম্বারল্যাণ্ডের অঞ্চলে। পার্বত্য নদী ও ঝর্ণার মর্মর ধ্বনি সবুজ শ্যামল প্রান্তর আর কৃষকদের সহজ সরল জীবনযাত্রা কবির চিত্তকে মুগ্ধ করেছিল। পিতার মৃত্যুর পর ওয়ার্ডসওয়ার্থের স্কুল জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে হ্রদের সৌন্দর্যালোক। ওয়ার্ডসওয়ার্থের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন ঘটনাবহুল। কারণ এই সময় ফরাসী বিপ্লবের আগুন ইউরোপের আকাশকে রাঙা করেছিল। যৌবন ধর্মের প্রচণ্ড আবেগে কবি রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে জড়িয়ে পড়লেন। বিপ্লবে অংশ গ্রহণ করবার জন্য ইংলণ্ড ত্যাগ করে চলে এলেন ফ্রান্সে। যোগ দিলেন জিরোওিষ্ট দলে। বিপ্লবের কাজে আত্মনিয়োগও করলেন। ঠিক এই মুহূর্তে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে তাঁর অর্থ সাহায্য বন্ধ হয়ে গেল। ফলে ইংলণ্ডে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন কবি। এবং ফাঁসির মঞ্চে অনিবার্য মৃত্যুর হাত থেকে ওয়ার্ডসওয়ার্থ বেঁচে গেলেন। কিন্তু তাঁর
চোখের বিপ্লবী মায়াঞ্জন অতি দ্রুত মিলিয়ে গেল। বিপ্লব সম্বন্ধে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই তাকে মোহমুক্ত করেছিল। কবি প্রত্যক্ষ করেছিলেন বিপ্লবের অতিরঞ্জিত রূপকে, দেখেছিলেন চতুর্দশ লুই.. এর ফাঁসি, দেখেছিলেন নেপোলিয়নের রূঢ় বর্বর আত্মপ্রকাশকে। তাই তার চরম প্রতিক্রিয়াস্বরূপ কবি ইংলণ্ডের মাটিতেই গড়ে তুললেন ভাবনার নীড়। এতদিন পর্যন্ত তাঁর হৃদয়াকাশে ফ্রান্সের যে চিত্র উজ্জ্বল মহিমায় উদ্ভাসিত ছিল, জীবনের আর একপ্রান্তে অভিজ্ঞতার মূল্যে সেই পরভূমির ছবি স্নান হয়ে গেল। ইংলণ্ড হল তাঁর বাসভূমি। কিন্তু কবির অন্তর ঝড়ের মতন যখন স্তব্ধ এবং নূতন পথের সন্ধানের আশায় দিশেহারা তখন বন্ধু রাইজলে কলভার্টের অবদান কবির কাছে আশীর্বাদের মত উপস্থিত হল। “কবিতার রাজত্বে সম্পূর্ণরূপে অবগাহন কর”-বন্ধুর এই অনুরোধ কবিকে ধ্রুবলোকের সন্ধান দিয়েছিল। তাই কবি আশ্রয় নিলেন কাব্যের গহনলোকে। এই সময় কোলরীজের সঙ্গে বন্ধুত্বের ফলে কবির কাব্য জগতের পাদপীঠ আত্মপ্রত্যয়ে দৃঢ় হল। ১৭৯৮ সালে “লিরিক্যাল ব্যালাডের” আত্মপ্রকাশ একটি নূতন যুগের সূচনা করল সে যুগ “প্রকৃতির যুগ” বলে বিশেষভাবে চিহ্নিত হল।
রোমান্টিক যুগের কবিতায় প্রধান স্থান দখল করে আছে প্রকৃতি। প্রকৃতিই মুখ্য, মানুষ গৌণ; এমন কি ঈশ্বরও। নিসর্গ প্রকৃতির সান্নিধ্য ব্যতিরেকে মানুষ এবং ঈশ্বরের স্বতন্ত্র কোন অস্তিত্ব নেই। তেমনি নিসর্গ প্রকৃতির উল্লেখ ব্যতিরেকে ওয়ার্ডসওয়ার্থের কল্পনাও করা যায় না। বিপ্লবের ব্যর্থতায় তিক্ত অভিজ্ঞতার ক্ষত চিহ্নগুলিকে মুছে ফেলার জন্য ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রকৃতির অন্তর লোকে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। এবং ঘোষণা করলেন যে, প্রকৃতি-ই হল তাঁর জীবনের জীবনধাত্রী, পথ প্রদর্শিকা এবং প্রতিপালিকা; তাঁর নৈতিক জীবনের আত্মা। তাই ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাছে মানুষ হল প্রকৃতির রাজত্বের একটা সীমান্ত প্রদেশের মত। মানুষের স্বতন্ত্র কোন অস্তিত্ব নেই। মানুষ আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ নয়। প্রকৃতির গোপন আত্মার সচেতন বিকাশ হল মানুষ। ওয়ার্ডসওয়ার্থ মানুষকে দেখেছেন প্রকৃতির সন্তানরূপে। প্রকৃতি মানুষকে সযত্নে লালন-পালন করে এবং মানুষগুলিও হয়ে ওঠে প্রকৃতির মত সহজ সরল স্বাভাবিক। প্রকৃতির সান্নিধ্যেই মানুষের সৌন্দর্যের বিকাশ ঘটে। তাই মানুষ সুন্দর। এই সৌন্দর্য হচ্ছে নৈতিক সৌন্দর্য, তা যেমন স্বাভাবিক তেমনি অকৃত্রিম। আধুনিক নগর সভ্যতার চরম অভিশাপ হচ্ছে প্রকৃতিকে অগ্রাহ্য করা বা প্রকৃতিকে সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হওয়া। এই বিস্মৃতি মানুষের মনের নৈতিক সৌন্দর্যকে কেড়ে নিয়েছে। পরিবর্তে দিয়েছে এক সংকীর্ণ, কৃত্রিম, প্রাণহীন চেতনা। প্রকৃতির শান্ত সংযত নিস্তরঙ্গ স্বভাবের স্নেহস্পর্শ মানুষের মহিমাকে প্রকাশ করে। শহরেরর কৃত্রিম পরিবেশও মানুষকে করে বিকৃত। তাই কবি বলেছেন, “I would rather be a pagan, suckled in a creed outworn.” এই প্রকৃতি সর্বস্বতা এবং প্রকৃতি তন্ময়তাই কবির ধ্যানের জগৎ, মর্মের জগৎ, চেতনার জগৎ, কাব্যের জগৎ এবং নৈতিক জীবনের জগৎ। প্রকৃতিই হচ্ছে কবির অন্তরের কবি। অর্থাৎ প্রকৃতি-ই হল কবির কাছে দার্শনিক, আধ্যাত্মিক ও জাগতিক জীবনের উৎস। এই অর্থে ওয়ার্ডসওয়ার্থ হলেন বিশুদ্ধভাবে প্রকৃতি-পূজারী।
রবীন্দ্রনাথ ওয়ার্ডসওয়ার্থের মত সংশয়বিহীন ভাবে ঘোষণা করতে পারেননি যে প্রকৃতিই তাঁর জীবনে সর্বস্ব। তিনি বিশুদ্ধভাবে ওয়ার্ডসওয়ার্থের মত প্রকৃতি পূজারী নন। বোধহয় তাঁর পক্ষে এটা সম্ভব ছিল না, কারণ, রবীন্দ্রনাথ যে যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং যে পরিস্থিতিতে গড়ে উঠেছিলেন সেখানে আধুনিক নগরালি সভ্যতার প্রতি আস্থা হারিয়ে তার তীব্র প্রতিক্রিয়ায় অরণ্যের গভীর মর্মরলোকে আশ্রয় নিয়ে জীবনের ধ্রুব সত্যকে আবিষ্কার করার কোন কারণও ছিল না। এই বিশ্বভুবনের যা কিছু দেখেছেন এবং যা কিছু পেয়েছেন তাঁর কাছে তার তুলনা নেই। এ সম্বন্ধে তাঁর মধ্যে কোন সংশয় কোন দ্বিধা কোন সন্দেহের অবকাশ ছিল না। কারণ আত্মপ্রত্যয়ের ভিত্তিভূমিতে
দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে তিনি জগৎ ও জীবনকে দেখেছেন। এই আত্মপ্রত্যয় তিনি লাভ করেছিলেন জীবনের প্রথম প্রত্যুষে। কবি বলেছেন, “ঈশোপনিষদের প্রথম যে মন্ত্রে পিতৃদেব দীক্ষা পেয়েছিলেন, সেই মন্ত্রটি বার বার নূতন নূতন অর্থ নিয়ে আমার মনে আন্দোলিত হয়েছে, বার বার নিজেকে বলেছি-তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জিথাঃ, মা গৃধঃ, আনন্দ কর তাই নিয়ে যা তোমার কাছে সহজে এসেছে, যা রয়েছে তোমার চারিদিকে, তারই মধ্যে চিরন্তন, লোভ কোর না। কাব্য সাধনায় এই মন্ত্র মহামূল্য।”
কাব্য সাধনায় এই “মহামূল্য মন্ত্রকে” পাথেয় করে পথ চলার আনন্দে কবি মেতে উঠেছিলেন, জীবনযাত্রার শেষ দিন পর্যন্ত কবি সেই সঞ্জীবনী মন্ত্রকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন। তাই তাঁর চেতনা পরম সুন্দরের ধ্যানে জাগ্রত, পরিশোধিত, অনুপ্রাণিত। যাঁর পদপ্রান্তে জীবন সর্বস্বধন জন্ম জন্ম ধরে কবি অর্পণ করেছেন “যাঁর লাগি রাত্রির অন্ধকারে চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর পানে, যাঁর পদে মানী সঁপিয়াছে মান, ধনী সঁপিয়াছে ধন, বীর সঁপিয়াছে আত্মপ্রাণ, যাঁরই উদ্দেশ্যে কবি বিরচিয়া লক্ষ লক্ষ গান ছড়াইছে দেশে দেশে।” সেই জ্যোতির্ময় পরম সুন্দরের লীলাকে-ই তিনি দেখেছেন এই ধূলিময় পৃথিবীর প্রতিটি বস্তু, প্রতটি অণু-পরমাণুর মধ্যে, দেখেছেন পর্বতের সানুদেশে, চৈতালী ফসলের সোনালী আগুনের মধ্যে, দেখেছেন লীলাময়ী মুনি কন্যাদের মত নৃত্যচপল ঝরনা ধারার মধ্যে, দেখেছেন বনপলাশ কৃষ্ণচূড়া আর শিরীষ গাছের ফুল ফোটানোর পালার মধ্যে; আর দেখেছেন এই প্রকৃতির অভ্রভেদী মন্দিরে প্রাণদেবতার বেদীমূলে ফুল দিয়ে সেই পরম সুন্দরের নিত্য আরাধনায়। কবি বলেছেন- “আমি আত্মাকে, বিশ্বপ্রকৃতিকে, বিশ্বেশ্বরকে স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র কোঠায় খণ্ড খণ্ড করিয়া রাখিয়া আমার ভক্তিকে বিভক্ত করি নাই।” উপনিষদের যে মন্ত্র কবি বার বার উচ্চারণ করেছেন, অনর্গল আবৃত্তি করেছেন যে উপনিষদের শ্লোক, “সেই মহর্ষি ব্রহ্মাদর্শ রবীন্দ্রনাথের মধ্য দিয়া উজ্জীবিত হইয়া নব কলেবরে বিশ্বধর্মরূপে বিশ্বভারতীর মধ্যে মূর্তি গ্রহণ করে, কবি সেই নবতর ধর্মের নাম দিয়াছেন ধর্ম। রবীন্দ্রনাথ সেই মানুষের ধর্ম তাঁহার সাহিত্যের মধ্য দিয়া ব্যক্ত করিয়াছেন।” কবি মানুষকে দেখেছেন সেই আধ্যাত্মিক দৃষ্টি দিয়ে, উপলব্ধি করেছেন যে “জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা” কারণ “পণ্যের পদপরশ রয়েছে তাদের “পরে।” রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “স্বর্গ আর কি দিত জানিনে, কিন্তু এমন কোমলতা দুর্বলতাময় এমন সকরুণ আশংকাতরা অপরিণত এই মানুষগুলির মত আপনার ধন কোথায় দিত। আমাদের এই মাটির মা, আমাদের এই আপনার পৃথিবী, এর সোনার শস্যক্ষেত্র, এর স্নেহশালিনী নদীগুলির ধারে, এর সুখ-দুঃখময় ভালবাসার লোকালয়ের মধ্যে এই সমস্ত দরিদ্র মর্তহৃদয়ের অশ্রুর ধনগুলিকে কোলে করে এনে দিয়েছে।”
রবীন্দ্রনাথ মর্তের মাধুরী আকন্ঠ ভরে পান করেছেন। মর্তের মানুষকেও তিনি ভালবেসেছেন হৃদয় দিয়ে, রবীন্দ্রনাথের মানব প্রেম স্বদেশ প্রেমের দীপ্তিতে সমুজ্জ্বল। একদিকে “উপনিষদের ভিতর দিয়ে প্রাক-পৌরাণিক যুগের ভারতের” সঙ্গে তাঁর যেমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল তেমনি হিন্দুমেলার আয়োজন ও অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পেয়েছিলেন দেশ-মুক্তি কামনার জ্বলন্ত প্রেরণা। তাই তাঁর কাব্যে অধিকাংশ স্থান অধিকার করে আছে মানুষ। মানব প্রেমের সুর কন্ঠে ধারণ করে মানব প্রেমের চারণকবিরূপে মানবের জীবন্ত হৃদয়মাঝে স্থান লাভের প্রবল আর্তি নিয়ে জীবনের অর্ঘ্য রচনা করেছেন মানবের উদ্দেশ্যে। তাঁর হৃদয় স্বদেশ প্রেমের অগ্নিআখরে পরিশুদ্ধ হয়ে মানব-প্রেমের হৃদিরক্তে আঁকা। কবি বলেছেন, “মানুষের সংস্পর্শে সাহিত্যের পথ এবং কর্মের পথ পাশাপাশি প্রসারিত হল আমার জীবনে।” এই মানবজীবনকে অতিক্রম করে অন্য কিছু চিন্তা করা তাঁর পক্ষে সহজসাধ্য ছিল না, সম্ভব ছিল না। তাঁর সমস্ত জীবন চেতনার মূলে ছিল মানব প্রেম।
মানব প্রেমের প্রয়োজন ব্যতিরেকে তিনি স্বর্গকেও স্বীকার করেন নি। তাই তাঁর কাব্যে মানুষ-ই হল “ভূতলের ছোট ছোট স্বর্ণখণ্ডগুলি।” মানুষের মিলন ক্ষুধায় পথে পথে ঘুরে ফিরছেন করি যে মানুষের অতিথিশালায় প্রাচীর নেই, পাহারা নেই। রবীন্দ্রনাথ আপনার চেতনার নিভৃত মন্দিরে মানব প্রেমের প্রদীপালোকে পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে আরতি করে তাঁর পূজা সমাপ্ত করেছেন দেবলোক থেকে মানবলোকে।
সুতরাং ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রথমতঃ এবং প্রধানতঃ হলেন প্রকৃতি প্রেমিক। প্রকৃতি তাঁর কাছে মুখ্য, মানুষ গৌণ। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ হলেন প্রধানতঃ মানবপ্রেমিক। মানবলোকই তাঁর কাছে মুখ্য, প্রকৃতি গৌণ। একজনের পুত্রী সমাপ্ত হয়েছে দেবলোক থেকে মানবলোকে, আর একজনের পূজা সমাপ্ত হয়েছে মানবলোক থেকে প্রকৃতিলোকে। রবীন্দ্রনাথ পরম সুন্দরের লীলার প্রকাশকে দেখেছেন প্রকৃতির মধ্যে। ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রকৃতিকে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক জীবনের জীবন্ত সত্তা রূপে দেখেছেন- A winning power, beyond all other power. একজন আখি দিয়ে আরতি করেছেন আর একজন কান দিয়ে শুনেছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “আমার মধ্যে এই চেয়ে দেখার ঔৎসুক্যকে নিত্য পূর্ণ করবার আবেগ অনুভব করেছি।”
যাইহোক প্রকৃতির সঙ্গে এই দুই কবির পরিচয়ের স্তরগুলি অত্যন্ত সুস্পষ্ট। এই পরিচয়ের পালা ও ক্রমবিকাশের স্তরগুলি সংক্ষেপে জেনে নেওয়া প্রয়োজন। অতি শৈশবকালেই ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাছে প্রকৃতি এক ভাবসত্য রূপে ফুটে উঠেছিল। “The Prelude” হচ্ছে কবির আত্মজীবনীমূলক মহাকাব্য। এই কাব্যে প্রকৃতি কিভাবে কবি জীবনে ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করেছে তার বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া আছে। প্রথম জীবনে প্রকৃতি ছিল কবির কাছে কৈশোরের ক্রীড়াক্ষেত্র। পর্বতবক্ষ নিঃসৃত ঝরনাধারার কলগুঞ্জন, বৃক্ষসমাচ্ছন্ন পর্বতের ছায়া সুনিবিড় নদী মর্মর-ধ্বনি, কিশোর বালকের স্বপ্নের জগতে এক অনাস্বাদিত শিহরণ জাগিয়ে তুলত। ভগ্নী ডরোথিকে সঙ্গে নিয়ে কবি কখনও নদীপ্রান্তে কখনও বনের পথে ঘুরে বেড়াতেন, ছুটে বেড়াতেন উড়ন্ত প্রজাপতির পিছে। প্রকৃতির মধ্যে এই প্রাণভরা পিপাসা নিয়ে কবি ছুটে বেড়াতেন আপন আনন্দে। এই প্রকৃতি কবির কাছে ছিল “The coarser pleasure of my boyish days and their glad animal movement.”
ধীরে ধীরে শৈশবের প্রাণোচ্ছলতা স্তব্ধ হয়ে এল। জাগ্রত হল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপের তন্ময়তা। কেবলমাত্র আবেগে ছুটে বেড়ান নয়, ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করা, তার সৌন্দর্যকে দুচোখের তারার মধ্যে ধরে রাখা, তবে গন্ধের আনন্দকে হৃদয়ের মধ্যে চিরন্তন করে তোলাই হল কবির উদ্দেশ্য। যদিও ওয়ার্ডসওয়ার্থ নির্জন প্রান্তবাসী কবি তবু তিনি কখনও প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করেন নি। তিনি নিসর্গ প্রকৃতির একটি জীবন্ত সত্তাকে যেন অনুভব করতেন। নিসর্গ প্রকৃতির কবি হিসাবে প্রকৃতির অতি ক্ষুদ্র অতি ক্ষণস্থায়ী প্রতিটি বস্তুকে কবি ভালবেসেছেন। প্রকৃতির রূপসৌন্দর্য সম্ভোগের কবি তিনি ছিলেন না। প্রকৃতির বহিন্দ্রিয় গ্রাহ্য রূপের প্রতি তিনি বিশেষ আকৃষ্ট হন নি। তুষারস্তূপের বজ্রনির্ঘোষ ধ্বনি, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের নানা রঙের ছবি, জ্যোৎস্না পুলকিত যামিনীর অতীন্দ্রিয় রহস্যময়তা, মহাশূন্য নীলিমায় সংখ্যাতীত, নক্ষত্রের অসীম রূপময়তা, আল্পস পর্বতের মহিমাময় সৌন্দর্য কবি কল্পলোকে কোন ছায়াপাত করে নি। পরন্তু নির্জন তুষারাবৃত হ্রদের বুকে শীতকালীন দিবসের ম্লান ছায়া, অসীম শূন্য নীলিমার নীরব শূন্যতা, মনুষ্য পদচিহ্ন বিহীন অরণ্যলোক, প্রভাত সূর্যোকিরণোজ্জ্বল ঘুমন্ত মহানগরীর সুগভীর শাস্তি, গৃহহারা উদাস আনন্দের সুর কবির মনে রোমান্টিক বিষাদ জাগিয়ে তুলত। প্রকৃতির অতি তুচ্ছাতিতুচ্ছ বস্তু এমন কি অতি তুচ্ছ প্রাণীর বেদনাও কবির হৃদয়কে ভাবিয়ে তুলত, ব্যথিত করত। একটি হরিণ
শিশুর মৃত্যু কবির স্পর্শকাতর চিত্তকে কেবলমাত্র ব্যথিত করেনি কবির স্মৃতিতে সে বেদনা চিরন্তন হয়ে থেকেছে। কবি যেন আজও কান পেতে শোনেন সেই হরিণ শিশুর মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তের সকরুণ কাতর আর্তনাদ এই নির্দয় আচরণের বিরুদ্ধে এ যেন সুতীক্ষ্ণ নীরব প্রতিবাদ। সমস্ত চিত্ত ভরে কবি প্রকৃতিকে ভালবেসেছেন। তাই কবি বলেছেন,
To me the meanest flower that blows can give Thoughts that do often lie too deep for tears.” শৈশবের অন্ধ আবেগে ভরা আনন্দের এবং তারুণ্যের ইন্দ্রিয়ানুভূতির তীব্র কামনার জগৎ
থেকে কবি সে জগতে জেগে উঠলেন সেখানে সুখে-দুঃখে আঁলী অতি পরিচিত মানুষগুলির জীবনযাত্রা তাঁর দৃষ্টিতে এক অপরূপ রূপময়তা লাভ করল। মানব জীবনের সকরুণ সঙ্গীত ধ্বনিকে তিনি কান পেতে শুনলেন। কবির ভাষায়, “For I have learned to look on nature, not as in the hour of thoughtless youth but hearing often times the still sad music of humanity.” তিনি মানবকে প্রকৃতির অন্তর্লোকের আলোকে উদ্ভাসিত করে তুললেন, আবিষ্কার করলেন প্রকৃতির সঙ্গে মানবচিত্তের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। উপলব্ধি করলেন মানুষ প্রকৃতির সৃষ্টি। প্রকৃতির সযত্ন পালিত, মানব প্রকৃতির কাছ থেকেই পেয়ে থাকে জীবনের প্রেরণা ও শিক্ষা। অর্থাৎ, প্রকৃতি প্রেমই মানবপ্রেমের উদ্বোধন করেছে ওয়ার্ডসওয়ার্থের মনোভূমিতে। তাই, ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রকৃতি ব্যতিরেকে মানবের স্বতন্ত্র কোন অস্তিত্ব স্বীকার করেন নি। কারণ প্রকৃতি-প্রেম কবিচিত্তের রিক্ততাকে দীনতাকে অবসিত করে এনেছে আত্মপ্রত্যয়। যে আত্মপ্রত্যয়ের দৃঢ়তা নিয়ে কবি দেখেছেন মানবকে। “To give the charm of novelty to things of everyday”-এই চেতনার আলোকে কৃষক ও মেষপালকের কাহিনীর মধ্যে প্রকৃতির সহজ, সরল, উদার, অনাসক্ত ও সংযত গভীর ভাবাবেগ মূর্ত হয়ে উঠেছে। ফেরীওয়ালা, ভ্রমণকারী গ্রাম্যশিক্ষক প্রভৃতি অতি সাধারণ শ্রেণীর চরিত্রগুলিও প্রকৃতির অনুগ্রহে কবি ও দার্শনিক হয়ে উঠেছে। এই চরিত্রগুলির মধ্যে ইন্দ্রিয়াতীত অনুভূতির তীব্রতা, গভীর মননশীলতা এবং দুঃখ জীবনের প্রতি উদার উদাস বৈরাগ্যের সমবেদনার রূপ প্রকাশ পেয়েছে। এমন-ই এক অপূর্ব মানবীর চিত্র অংকন করেছেন কবি যেখানে প্রকৃতির আত্মার প্রকাশ ঘটেছে, তা হচ্ছে, লুসী। লুসী মানবী নয়, প্রকৃতির একটি নীরব সকরুণ সুর, একটি অশুভ সঙ্গীত, একটি অনাঘ্রাতা পুষ্প, একটি নিঃসঙ্গ তারকা। মানবের সব কিছু অকিঞ্চিৎকর তুচ্ছ ঘটনাকে তিনি অসাধারণ দরদ দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। অর্থপাগল একটি বালকের অকারণ উল্লাস, গরুর গাড়ীর চাকায় লেগে একটি দরিদ্র বালিকার গাত্রাবরণ ছিঁড়ে যাওয়া ইত্যাদি ঘটনাকে অসামান্য রূপদান করেছেন কবি। কবি বলেছেন,
“Thanks to the human heart by which we live
Thanks to its tenderness, its joys and fears.”
কেবলমাত্র দৈনন্দিন তুচ্ছাতিতুচ্ছ জীবনের অসাধারণ রূপদান করা নয়, কবি ধীরে ধীরে উপলব্ধির আরও গভীরে চলে গেছেন। ধ্যানের দৃষ্টিতে কবি দেখেছেন প্রকৃতির অন্তরতম আত্মাকে। প্রকৃতির মধ্যে জীবন্ত আত্মার অনুভবের ফলে কবি সেই আত্মার সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে বিলীন হতে চেয়েছেন। কারণ আত্মার সঙ্গে আত্মার মহামিলনের মধ্যে রয়েছে মুক্তি, বাস্তব স্কুল জগৎ থেকে মুক্তি চেতনার চিন্ময় লোকে, আনন্দ লোকে। প্রকৃতির এই প্রাণ রহস্যের উদ্বোধনে প্রকৃতির নৈতিক সত্তাকে কবি আবিষ্কার করেছেন, যে সত্তা মানুষের জ্ঞানরূপিণী আনন্দরূপিনী, মানুষের হৃদয়কে নব বলে বলীয়ান করে তাকে সাংসারিক কলুষতা থেকে মুক্তি দেয় তার ধর্ম বিশ্বাসকে দৃঢ় করে, এবং
আধ্যাত্মিকতাকে করে জ্যোতির্ময়। তাই ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাছে প্রকৃতি জীবন্ত সত্তা-ঈশ্বরের বাসভূমি। যদিও প্রকৃতি ঈশ্বরের বাসভূমি কিন্তু প্রকৃতি হল কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের বাসভূমি। তাই প্রকৃতিকে অতিক্রম করে তিনি ঈশ্বরের বাসভূমির সন্ধানে যাত্রা সুরু করেন নি। এই অর্থে ঈশ্বরের চেয়ে প্রকৃতি প্রাধান্য পেয়েছে কবির কাব্যে। তিনি প্রকৃতির গৌরবে গৌরবান্বিত, প্রকৃতির নৈতিক সত্তার উপলব্ধিতে আনন্দিত। এই জীবন্ত সত্তার দিকে তাকিয়ে কবি বলেছেন,
A motion and a spirit that impels
All thinking things, all objects of all thought
An rolls though all things
প্রকৃতির স্থাবর জঙ্গম সমস্ত কিছুর মধ্যেই জীবন্ত সত্তার প্রকাশকে কবি দেখেছেন ধ্যানের নয়নে। এমন কি প্রকৃতির হৃদয়সঞ্জাত ফুলের বর্ণ গন্ধ ও রূপ সৌন্দর্যের প্রতি কবির মন আদৌ আকৃষ্ট হয়নি। তাঁর মন সৌন্দর্যের রূপ বর্ণনায় মুখর হতে চায়নি, বরং বর্ণহীন, রূপহীন অনাদৃত ফুলগুলির মধ্যে এক অনির্বচনীয় সত্তার উপলব্ধিতে মগ্ন থাকতে চেয়েছে। তিনি দরিদ্রের এই দুলালগুলির উপেক্ষিত ম্লান সৌন্দর্য এবং তাদের অবহেলিত মহিমার জয় ঘোষণা করেছেন। “ডেইজি” ফুলের মধ্যে একটি প্রাণসত্তা আবিষ্কার করেছেন। কারণ ডেইজি ফুল সূর্য স্নাতা এবং প্রকৃতির একান্ত প্রিয়। অতি ক্ষণস্থায়ী “সিলেনডাইন” পুষ্পকে কবি প্রকৃতির বিনম্র আত্মা বলে কল্পনা করেছেন। “ড্যাফোডিলস্” ফুল কবির কাছে বিষাদঘন চিত্তের সকরুণ মুরতি। প্রত্যেকটি ফুল প্রকৃতির প্রিয় বলেই কবির কাছেও প্রিয়। তাই কবি প্রকৃতিকে যেমন জীবন্ত সত্তা বলে গ্রহণ করেছেন তেমনি প্রকৃতির ফুলগুলিকেও সেই জীবন্ত সত্তার বিচিত্র রূপের প্রকাশ বলেই কল্পনা করেছেন। কবি এই ফুলগুলির মধ্যে প্রকৃতিকে অতিক্রম করে স্বতন্ত্র কোন অস্তিত্বের স্বীকার করেন নি। কারণ কবির কাছে প্রকৃতি ব্যতিরেকে মানবের যেমন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই তেমনি ফুলগুলিরও নেই। কবি প্রকৃতির মধ্যে যে নৈতিক সত্তার আবিষ্কার করেছেন প্রকৃতির আপন ধন এই ফুলগুলির মধ্যেও মানবের শিক্ষণীয় এবং গার্হস্থ্য জীবনের উপযোগী অনেকগুলি গুণের প্রকাশ ও নীতি কথার প্রচার করেছেন। তাই কবি প্রকৃতির নৈতিক সত্তার পাদপীঠে দাঁড়িয়ে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছেন,-
“Let Nature be your teacher”
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “ওয়ার্ডসওয়ার্থ বিশ্ব প্রকৃতিতে যে আনন্দময় সত্তা উপলব্ধি করেছিলেন সেটাকে প্রকাশ করেছিলেন নিজের ছাঁদে। তাঁর জগৎ ছিল বিশেষভাবে ওয়ার্ডসওয়ার্থীয়।”
প্রকৃতির সঙ্গে কবি রবীন্দ্রনাথের পরিচয়ের স্তরগুলিও অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কবি বলেছেন, “জীবনের প্রথম বয়স কেটেছে বদ্ধঘরে, নিঃসঙ্গ নির্জনে। নিজের মনের ভাবনা নিজের মনের প্রাচীরের মধ্যে প্রতিহত হয়ে আলোড়িত।” কবি বিশ্ব প্রকৃতির মুক্তাঙ্গনে ছুটে যেতে চান, কিন্তু পারেন না। বাইরের প্রকৃতির আকর্ষণ কবিকে ব্যাকুল করে তুলত। “সে যেন গরাদের ব্যবধান দিয়া নানা ঈশারায় আমার সঙ্গে দেখা করিবার নানা চেষ্টা করিত। সে ছিল মুক্ত, আমি ছিলাম বদ্ধ। মিলনের উপায় ছিল না, সেইজন্য প্রণয়ের আকর্ষণ ছিল প্রবল।” কবি সেদিন প্রকৃতিকে ডাগর ডাগর চোখে আড়াল আবডাল থেকে দেখেছেন। এই প্রকৃতির রহস্যময়তা কবি চিত্তকে উন্মনা করেছিল। তারপর কবি যখন গরাদের ব্যবধান থেকে মুক্তি পেলেন, যখন বাইরের প্রকৃতির সান্নিধ্যে এলেন তখন, কবিমনকে প্রকৃতির বর্ণালী স্বপ্নে দিশেহারা করেছিল। সেদিন কবি “পিপাসার জল, ভাঙ্গা কানাওয়ালা পাত্র” থেকেই সংগ্রহ করেছেন। তৃষ্ণা মিটিয়েছেন অরুণ আভায় শিশিরে
ঝলমল করা নারকেল পাতার ঝালর দেখে, পুরানো বিলিতী আমড়ার গাছ, কুলগাছ, জীর্ণ পাতকুয়ার প্রাঙ্গণ, মেঘমেদুর আকাশের বুকে ঘননীলবর্ণ মেঘের পুঞ্জ দেখে।
এর পর কবি মানুষকে ভালবেসেই প্রকৃতিকে ভালবেসেছেন। কবি বলেছেন, “প্রকৃতি তার রূপ-রস-বর্ণ গন্ধ লইয়া, মানুষ তাহার বুদ্ধি-মন তাহার স্নেহ প্রেম লইয়া আমাকে মুগ্ধ করিয়াছে।” রবীন্দ্রনাথও মানব চরিত্র অংকন করেছেন। কিন্তু ওয়ার্ডসওয়ার্থের মত তাঁর মানবগুলি প্রকৃতির সযত্ন লালিত মানব নয়। রবীন্দ্রনাথের মানব চরিত্রগুলি যেন তত্ত্বের প্রতিমূর্তি, জীবন জিজ্ঞাসার আবেগে কম্পমান। তিনি প্রকৃতির আঁখি দিয়ে মানবকে দেখেন নি, দেখেছেন সমাজ জীবনের পটভূমিকায়। তাই রবীন্দ্রনাথের মানুষগুলি সমাজ জীবনের হৃদয় গলান বারিধারায় পুষ্ট হয়েছে। তাঁর মানব চরিত্রগুলি কোলাহল মুখর লোকালয়কে অতিক্রম করে প্রকৃতির জীবন্ত সত্তারূপে প্রকাশিত হয় নি।। কারণ নিঃসঙ্গ নির্জন নিসর্গ প্রকৃতি রবীন্দ্রনাথের মনে যত না দোলা দিয়েছে তার চেয়ে তাঁর রক্তে বেশি দোলা দিয়েছে মানবের জীবন্ত ছবি, এমন কি পটে আঁকা ছবিও। তাই বহুবিচিত্র মানবের জীবন জিজ্ঞাসার অপূর্ব বৈচিত্র্য ঘটেছে তাঁর কাব্যে ও সাহিত্যে। যেহেতু রবীন্দ্রনাথের হৃদয় জীবন জিজ্ঞাসার আত্যন্তিক অনুভূতির আবেগে ঘনীভূত সেই হেতু তাঁর সৃষ্ট মানব চরিত্রগুলিও জীবন জিজ্ঞাসার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। তাই রবীন্দ্রনাথের কাব্যে “লুসীর” আবির্ভাব অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথের ছুটি গল্পের ফটিক গ্রামে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু প্রকৃতির প্রতি ফটিকের আত্যন্তিক ভালবাসা যত না আছে তার চেয়ে বেশি আছে তার সেই গ্রামের সহজ সরল পরিবেশটি, যে চেনা পরিবেশকে সে ফিরে পেতে চায়। কারণ “মাতৃভবন ছাড়া আর কোন অপরিচিত স্থান বালকের পক্ষে নরক।” মামীর স্নেহহীন আচরণ বালকের কাছে নরক। তার আপন ভুবন হল স্বর্গ। এমন-ই এক স্নেহহীন শাসনের কৃত্রিম আচরণে উত্যক্ত বালিকা বধূর চোখে ভেসে উঠেছিল সেই পরিচিত বাঁধাঘাট, অশ্বত্থতল, মাঠের পরে মাঠ, শ্যামল তালীবন, বাঁধের জলরেখা আর দীঘির কালো জল। বালিকা-বধূর কানে ভেসে এসেছিল, “বেলা যে পড়ে এল জলকে চল” প্রকৃতির সান্নিধ্য লাভের জন্য আর্তি নয় আপন পরিচিত মানুষগুলির সান্নিধ্য লাভের আশায় এই বালিকা বধূর হৃদয় কান্নায় ভরে উঠেছিল। এমনি এক বালিকা বধূ হল “সমাপ্তি” গল্পের মৃন্ময়ী। প্রকৃতির মতই সে মুক্ত, বন্ধনহীন। সংসারের কাজে অনাবশ্যক। বেগবান অরণ্য মৃগের মত দুরন্ত অবাধ্য। নৃত্যময়ী প্রকৃতির মতই সে চঞ্চল। সেই মৃন্ময়ী যখন বালিকা বধূ তখন শাশুড়ীর স্নেহহীন আচরণে বিরক্ত হয়ে গভীর রাত্রে সে স্বামীগৃহ ত্যাগ করে। তার অতীত জীবন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। তারপর তার জীবনে এল পরিবর্তন। চাঞ্চল্য গেল থেমে। রমণী প্রকৃতি তার সমস্ত শরীরে ও অন্তরে রেখায় রেখায় উঠল ভরে। সুতরাং মৃন্ময়ীর কাছে তার অতীত জীবনের খেলার সাথী বালক রাখাল ব্যর্থ হয়ে গেল। ব্যর্থ হয়ে গেল নির্জন নদীতীর, রাধাকান্ত ঠাকুরের ভাঙ্গা রথ, গ্রামের পথ ইত্যাদি।
তাই রবীন্দ্রনাথের মানব-মানবী ওয়ার্ডসওয়ার্থের মানব-মানবীর মত প্রকৃতির সুর নয়, ছন্দ নয়, নীরব সঙ্গীতও নয়। প্রকৃতির প্রাণোত্তাপে মানব চরিত্রগুলির বিকাশ ঘটে নি। প্রকৃতি ব্যতিরেকেই মানুষগুলি সামাজিক চরিত্ররূপেই বিকাশ লাভ করেছে। কারণ প্রকৃতিময়তা, প্রকৃতি সর্বস্বতা রবীন্দ্রনাথের পক্ষে অসম্ভব ছিল।
তৃতীয় পর্বে কবি প্রকৃতির মধ্যে পরম সুন্দরের লীলাকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করেছেন। আপন হৃদয়ে শুনেছেন সৃষ্টির প্রথম বাণী যা পরম পুরুষের নিত্যকালের বাণী। বিশ্বব্যাপী প্রাণের প্রকাশ, যদিদং কিঞ্চ সর্বপ্রাণ এজঃ নিসৃতং। কবি বিশ্বের সমস্ত কিছুর মধ্যে সেই পরম পুরুষের আবির্ভাবকে অনুভব করেছেন। অনুভব করেছেন সেই আনন্দরূপের প্রকাশকে। কবি প্রাণের বিপুল প্রকাশের মধ্যেই মহামুক্তির বাণী শুনেছেন। সেই মুক্তি প্রাণের সঙ্গে প্রাণের অবাধ মিলনের। কিন্তু সেই মিলনের মধ্যে আছে প্রাণোত্তাপে পূর্ণ সুগভীর বৈরাগ্য, আছে তপোবন আশ্রিত অতীত জীবনের কামনা। কবি বলেছেন, “পরম সুন্দরের মুক্ত রূপের প্রকাশের মধ্যেই পরিত্রাণ। আনন্দময় সুগভীর বৈরাগ্যই হচ্ছে সেই সুন্দরের চরম দান।” এখানে কবি পরিপূর্ণ অজানা, অদেখা ও অগমের জন্য কবি প্রাণের আর্তি নেই, আছে মোহমুক্ত সুন্দরের দৃষ্টি। কবি প্রত্যক্ষ করেছেন সেই মুক্তিমন্ত্রের কালের রাখালকে যিনি বৈরাগ্যের মধ্যে আপনাকে প্রচ্ছন্ন করে রাখেন, যাঁর লীলা প্রকৃতির নির্মল আনন্দলোকে পরিদৃশ্যমান। কবি সেই লীলার প্রকাশ দেখেছেন, “তরুর মুক্তি ফুলের নাচে, নদীর মুক্তি আত্মহারা নৃত্যধারার তালে তালে।” কবি সেই মুক্ত জীবনানন্দলোকে অভিসার করেছেন। বলেছেন, “অন্তরে বাহিরে মহাকালের এই বিরাট নৃত্যছন্দে যোগ দিতে পারলে জগতে ও জীবনে অখণ্ড লীলার উপলব্ধির আনন্দে মন বন্ধনমুক্ত হয়।” ইহাই কবির মুক্তিতত্ত্ব।
রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে দেখেছেন সুন্দরের দান রূপে। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রকৃতি হয়েছে গৌণ, পরম সুন্দর হয়েছে মুখ্য। সেই পরম সুন্দরের প্রকাশকে দেখেছেন, তার লীলা বৈচিত্র্যকে উপলব্ধি করেছেন উত্তরায়ণের শালবৃক্ষগুলির মধ্যে, লতার শাখায় শাখায়, নাগকেশরের ফুলে ফুলে। প্রকৃতির ঋতুরঙ্গশালায় সন্ন্যাসী নটরাজ প্রাধান্য লাভ করেছে। প্রকৃতি মাঝে মাঝে কবিকে করেছে মোহাবিষ্ট। কবি বলেছেন, “বনের একটা মায়া আছে, গাছগুলির নিঃশব্দ চক্রান্ত আদিম প্রাণের মন্ত্রধ্বনি। দিন দুপুরে ঝা ঝা করে তার উদাত্ত সুর, রাত দুপুরে মন্ত্রগম্ভীর ধ্বনি গুঞ্জন করতে থাকে জীবচেতনায়, আদিম প্রাণের গূঢ় প্রেরণায় বুদ্ধিকে দেয় আবিষ্ট করে।” অর্থাৎ এই আবিষ্টটুকু করা মাত্র, এর বেশি আর কিছু নেই। তবুও এ-টুকুর মধ্যেই আভাষিত হয়ে ওঠে পরম সুন্দরের অখণ্ডিত লীলারস। কবি প্রকৃতির মর্মলোকে সেই পরম সুন্দরের ধ্যানমন্ত্রকে অন্তরে উপলব্ধি করেছেন, এবং সেই উপলব্ধির আনন্দে সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছেন। তাই রবীন্দ্রনাথ ওয়ার্ডসওয়ার্থের মত Pagan নন। ওয়ার্ডসওয়ার্থের মত দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় নিয়ে তিনি বলতে পারেননি যে, Let Nature be your teacher. সম্ভবও ছিল না। কারণ কবি প্রকৃতিকে দেবতা রূপে গ্রহণ করেছেন বলেই প্রকৃতির উদ্দেশ্যে “নম হে নম” বলে প্রণতি জানিয়েছেন। এই ভক্তির আতিশয্যের ফলে প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় একাত্মতা ও আত্মীয়তা অর্জন করা সম্ভব হয় নি। কারণ কবি প্রকৃতির চেয়ে পরম সুন্দরকেই স্থান দিয়েছে সর্বাগ্রে। পরম সুন্দর কবির কাছে প্রাধান্য পাওয়ার ফলে প্রকৃতি এবং কবির মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু পরম সুন্দরের সঙ্গে কবির অন্তরের মিলন আরও নিবিড় আরও ঘনীভূত হয়েছে। তাই কবির কাছে পরম সুন্দরই লক্ষ্য প্রকৃতি উপলক্ষ্য মাত্র। অন্যদিকে ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাছে প্রকৃতিই লক্ষ্য ঈশ্বর উপলক্ষ্য মাত্র।
রোমান্টিক যুগের সমস্ত কবির কাছে প্রকৃতি জগৎ কল্পনার জগৎ, চিত্তের মায়ালোকের জগৎ, স্বপ্নের জগৎ। এই স্বপ্নের জগতকে কবি দেখেছেন স্বপ্নের নয়নে। কবির আঁখিতে তাই বিস্ময়রসের মায়াকাজল লাগানো। এই বিস্ময়রস হল শিশুমনের রস। কারণ কবি জানেন বাস্তব জগতের উপর কল্পনার জগৎ আরোপ করা শিশুমনের ধর্ম। তাই রোমান্টিকতার সঙ্গে একদিকে যেমন তারুণ্য অন্যদিকে তেমনি শৈশবের মিল ও সাদৃশ্য দেখা যায়। রোমান্টিকতার বিরোধ প্রৌঢ়তার সঙ্গে, পরিণত বাস্তব বুদ্ধির সঙ্গে কল্পনাশূন্য ব্যবহারিক জ্ঞানের সঙ্গে। শিশুর কাছে এই পরিদৃশ্যমান বাস্তব কল্পনার জগৎ বা আর্কেডিয়া বলে মনে হয়। কারণ বাস্তব জগৎ সম্বন্ধে শিশুর মনের মধ্যে হাজার প্রশ্ন ভীড় করে থাকে। এই অসংখ্য সীমাহীন প্রশ্নের প্রশ্নাতীত বিস্ময় নিয়ে শিশু জগৎকে দেখে। বিস্ময়ঘন বিজড়িত এই দেখার মধ্যে পরিণত বুদ্ধির কোন সংশয় নেই, দ্বিধা নেই, শংকা নেই। নেই তর্ক তাড়িত বক্তৃতাশ্রান্ত বুদ্ধির কষ্টসাধ্য চাতুর্য। আছে সহজ, সরল, সুকুমার আদিম উলঙ্গ দৃষ্টি।
নিসর্গ প্রকৃতির এই অনাবৃত সুনীল আকাশ, সূর্যকরোজ্জ্বলে উদ্ভাসিত সোনালী শস্যক্ষেত্র শ্যাম সবুজ অরণ্যানী, পর্বতবক্ষ নিঃসৃত খরস্রোতা নদী, মৃত্যচপল ঝরনাধারা, আকাশ ছোঁয়া পর্বতরাজি, বনফুলের সমারোহ, প্রজাপতির ডানার রঙ, ধূ ধূ করা বালুচর প্রভৃতির দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে শিশু। শিশুর মনের গভীর গহনরাজ্যে এই নিসর্গ প্রকৃতির রূপ এক সীমাহীন বিস্ময়ের বস্তু, যা অপার রহস্যের আবরণে মণ্ডিত। এই রহস্যের, এই বিস্ময়ের মধ্যে, শিশুর দৃষ্টিকে করে মোহাচ্ছন্ন। তাই ডাগর ডাগর চোখে বিস্ময়ের সীমাহীন আর্তি নিয়ে সে নিসর্গ প্রকৃতিকে আত্মভাবমুগ্ধ হৃদয়ে অবলোকন করে। এই যে দেখা এই দেখার মধ্যে রয়েছে উলঙ্গ তটস্থ দৃষ্টি যা বিস্ময়ে মন্ত্রমুগ্ধ।
অন্যদিকে শিশু কেবলমাত্র প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বিগলিত চিত্তে ধ্যান করে না। শিশু চায় এই প্রকৃতির রাজত্বে আপন মনের খেয়ালের বশে দাপাদাপি করতে, ছুটে বেড়াতে প্রকৃতির রহস্যে ঘেরা জগৎ শিশুকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। হাতছানির প্রবল আকর্ষণে শিশু প্রকৃতির অসীম রহস্যঘেরা জগতে ঘুরে বেড়াতে চায়। বিস্মিত নয়নে দেখা এবং ঘুরে বেড়ানোর নেশার আবেগে শিশুচিত্ত আত্মহারা। শিশুমন তাই ডানা মেলে উধাও হতে চায় নীল আকাশের বুকে, নক্ষত্রলোকে, রাত্রির রহস্যঘেরা চন্দ্রালোকিত রাজ্যে, ছুটে যেতে চায় ফল-হাওয়া-জল-তৃণ তরু সমাচ্ছন্ন শ্যামল প্রান্তরে, নদী তটপ্রান্তে, ‘রামধনু আঁকা পাখা উড়িয়ে রবির কিরণে হাসি ছড়িয়ে’ ঘুরে বেড়াতে চায় বিকশিত পুষ্প উদ্যানে পার্বত্য উপত্যকা আর ঝরনা ধারার বুকে। শিশুর মন অজানা অদেখা জগতকে দেখার আর্তি নিয়ে কল্পনার পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে রূপকথার রাজত্বে ঘুরে বেড়াতে চায়। এ্যালিসের মত সর্বদাই এবং সমস্তক্ষণই, খাওয়া-দাওয়া ভুলে কল্পনীয় “ওয়ান্ডার ল্যান্ডে” বেড়াতে চায়। এই wonder lust-এর নেশাই হল শিশুমনের নেশা, অবশ্য তারুণ্যের ধর্ম হল রহস্যের আবরণ উন্মোচন করা। কিন্তু শিশুমনের ধর্ম হল রহস্যের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া।
রহস্যের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার মত মনের ধর্ম নিয়ে, সহজ, সরল, বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে জগৎ ও জীবনকে দেখেছেন কবি ব্লেক। ব্লেকের কল্পনা শিশুর মনোরাজ্যের কল্পনা। শিশু যেমন বিস্ময় বিস্ফারিত কৌতূহল ভরা চোখে জগতের সমস্ত কিছুকে দেখে তেমনি করেই ব্লেক দেখেছেন-His subject is the child like vission of existence. হৃদয়ের ব্যাকুল জিজ্ঞাসা নিয়ে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে কবি দেখেছেন শার্দুলের হিংস্র ভয়াল রূপকে, দেখেছেন প্রকৃতির নানা রূপ বৈচিত্র্যকে।
ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাছে শিশুমন বিস্ময়রসের আদিম রহস্যে ভরা। ওয়ার্ডসওয়ার্থ আপন জীবনের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে দেখেছেন অতীতের ফেলে আসা সুদূরের শৈশব জীবনকে। সেই শৈশব জীবনের অতীত চারণার মধ্যে শিশুর মনোজগতের গভীরে তিনি অনুপ্রবেশ করেছেন। বিস্ময়রসের মায়াকাজল ঘন হয়ে উঠেছে শিশুর চোখে। শিশুর দেখার মধ্যে সেই বিস্ময় বিহ্বলতাই প্রকাশ পেয়েছে। এই আদিম উলঙ্গ দৃষ্টির মধ্যে কোন তত্ত্ব নেই, কোন জীবন জিজ্ঞাসা নেই। শিশুর জগৎ ইন্দ্রিয়াতীত স্বপ্নের জগৎ, সত্যের জগৎ, স্বর্গের জগৎ। ওয়ার্ডসওয়ার্থের ভাষায়, “Heaven lies about us in our infancy”-এই অর্থে শিশুরা স্বর্গের অধিবাসী। কারণ শিশুর মন বাধা-বন্ধনহীন উদার। বাস্তব জীবনের পরিকীর্ণ জঞ্জালের স্তূপ তার নিষ্পাপ মনের কোণে ছায়া ফেলতে পারে না। এই জগৎকে দেখার মধ্যেই তার আনন্দ। তাই ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাছে মাতৃবক্ষলগ্ন, পরমনির্ভর চিত্ত শিশুই স্বর্গীয় শিশু, শিশুর অন্তরে রয়েছে পৃথিবীর সম্বন্ধে সুগভীর কৌতূহল।
রবীন্দ্রনাথের চেতনায় যেহেতু প্রথম থেকেই পরম সুন্দরের ধ্যানজাগ্রত, যাঁর পদপ্রান্তে জীবন সর্বস্বধন জন্ম, ধরে কবি অর্পণ করেছেন সেই পরম সুন্দরের লীলাকে তিনি শিশুর মধ্যেও অবলোকন করেছেন। তাই তাঁর শিশু হয়ে উঠেছে, “শিশু ভোলানাথ” বা “বালগোপাল”। তাঁর শিশু ভোলানাথের ছায়া বৃন্দাবনের গোপাল হয়ে কবির কল্পলোকে স্থান পেয়েছে। এবং তাদের অলৌকিক লীলা রহস্যকে তিনি দুচোখ ভরে দেখেছেন। অকিঞ্চন ভোলানাথের নটরাজের রূপমূর্তিতে শিশু আবির্ভূত। সংহার আর সৃষ্টির লীলায় সে যে মত্ত। রবীন্দ্রনাথের শিশু ভোলানাথের গরিমায় অলৌকিক, তত্ত্বের প্রতিমূর্তি। মাটির গন্ধ যেন অনুভব করা যায় না। কারণ রবীন্দ্রনাথের শিশু বাস্তব, অতি পরিচিত জগতের সহজ সরল শিশু নয়। এই শিশুরা জগৎ পারাবারের তীরে খেলা করে বেড়ায়।
রবীন্দ্রনাথের শিশু নানা প্রশ্নের ব্যাকুলতায় বাচাল। সে যেন সব সময় প্রশ্ন করে দার্শনিকের মত। সে যেন অলৌকিক দিব্যদৃষ্টিতে এই পৃথিবীর বহু রহস্যের সন্ধান করে বেড়ায়, তার মর্মোদ্ধার করতে চেষ্টা করে।
খোকা মাকে শুধায় ডেকে “এলেম আমি কোথা থেকে
কোনখানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে?”
মাকে ডেকে শিশুর এই প্রশ্ন শিশুর বলেই মনে হয় না। মনে হয় কোন এক বিজ্ঞ, শিশুর হয়েই এই প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। এই প্রশ্নের মধ্যে শিশুর কৌতুহলের চেয়ে বিজ্ঞতার প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। যদিও কখনও কখনও রবীন্দ্রনাথের শিশু চাঁপা গাছে চাঁপা হতে চেয়েছে অথবা সন্ধ্যাবেলায় ফুল হয়ে মায়ের পায়ের কাছে ঝরে পড়তে চেয়েছে তবুও মনে রাখতে হবে রবীন্দ্রনাথের শিশু অল্পকথায় সন্তুষ্ট নয়, বড় কথায় মুখর। রবীন্দ্রনাথের খোকা যেন কথায় “বীরপুরুষ।”
কিন্তু ওয়ার্ডসওয়ার্থের শিশু শিশুর মতই নগ্ন উদার। প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে শিশুমন নীরব স্তব্ধ। এমনি এক আত্মভোলা বালকের চিত্র অংকন করেছেন কবি। যে আত্মভোলা বালক কবির কাছে ‘Idiot boy” নামে পরিচিত। ডাক্তার ডাকতে পথে বের হয়েছে ছেলেটি কিন্তু অকস্মাৎ রাত্রির অপরূপ নীরব সৌন্দর্য বালকের মনকে অপহরণ করে নিল। বালক ভুলে গেল তার ডাক্তার ডাকার কথা। রাত্রি আটটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত বিস্ময়ে বিহ্বল চিত্তে মুগ্ধ নয়নে স্তব্ধ রাত্রির চাঁদের আলোয় চাঁদকে দেখেছে আর পেঁচকের কন্ঠস্বর শুনেছে। এই বালকের মধ্যে জীবন জিজ্ঞাসার কোন প্রশ্ন জাগেনি। কোন কিছুর জানার আগ্রহে কণ্ঠও তার মুখর নয়। সে শুধু আত্মভোলা সহজ সরল, প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে আদিম প্রাণের গূঢ় চেতনায় আচ্ছন্ন হয়ে হারিয়ে যাওয়া এক বালক। তাই কবি যখন বলেন, “My deeper feelings lay elsewhere”-তখন বাস্তব নিসর্গ প্রকৃতিকে অতিক্রান্ত করে শিশুমন কোথাও যেতে চায় না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের শিশু খেলা ভুলে আত্মভোলা হয় না। নিজেকে প্রকৃতির রহস্যের মধ্যে হারিয়েও ফেলে না। বরং “দূরে কাদের ছাদের পরে বেগুনি রঙের শাড়ী” দেখে তক্ষুনি পক্ষীরাজের ঘোড়ায় চড়ে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে রাজকন্যার উদ্দেশ্যে ছুটে যেতে চায়। অথবা মায়ের হাতে বাবার চিঠি দেখে মায়ের মনের রহস্যের সন্ধান করার জন্য সেই জগতে যাত্রা করতে চায়। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ তন্ময়চিত্ত আত্মভোলা বালকের কোন ছবি আঁকেন নি। এঁকেছেন জ্ঞানগর্ভ মুখর পণ্ডিতের ছবি। এঁকেছেন শিশু ভোলানাথের অলৌকিক ছবি, তত্ত্বের ছবি। কারণ রবীন্দ্রনাথের “Deeper feelings lay else-where”-তা হল এই প্রকৃতির প্রাণের লীলার মধ্যে পরম সুন্দরের লীলাকেই দুচোখ ভরে দেখা। তাই রবীন্দ্রনাথের শিশু প্রকৃতির স্বহস্ত লালিত শিশু নয়। সে রবীন্দ্রনাথেরই শিশু।
রাখালিয়া শোকগাথা
রাখালিয়া কাব্য বলতে বুঝায়, যে কাব্যে মেষপালকের জীবনাচরণের বিষয় বর্ণিত হয়ে থাকে।
খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে সিসিলিয়ান গ্রীক থিয়োক্রীটাসের Idyll কাব্যে এই ধরনের কবিতার নিদর্শন পাওয়া যায়। তাঁর Pastoral চিত্রগুলি গীতিধর্মী। যেমন তৃণ সমাচ্ছন্ন সবুজ প্রান্তরে মেষপালকেরা গান গাইছে। তাদের সেই গানের মধ্যে ফুটে উঠেছে ভালবাসার সঙ্গীত সুর।
কখনও বা পরলোকগত প্রিয় বন্ধুর জন্য দুঃখের সকরুণ সঙ্গীত ধ্বনি, কখনও বা বিশ্বাসঘাতিনী কুমারী কন্যার জন্য বেদনামথিত হৃদয়ের হাহাকার, কখনও বা দেশের কুৎসা নিয়ে আলাপ-আলোচনার ব্যাপারটিও এই সমস্ত কবিতায় লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য এই সমস্ত কবিতায় যেমন প্রকৃতি প্রেম এবং প্রকৃতির বহিরঙ্গ সৌন্দর্যের অপূর্ব বর্ণনা লক্ষ্য করা যায়, তেমনি কৃত্রিমতাকে সম্পূর্ণভাবে পরিহার করতে পেরেছেন এমন কথা বলা যায় না। ক্লাসিক্যাল রাখালিয়া শোকগাথা কাব্যে কেবলমাত্র শোকের কবিতাই ছিল না, নানা বিষয় রাখালিয়া কাব্যে স্থান পেত।
পরবর্তীকালে অবশ্য শোকগাথাই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। সমালোচক কোলরীজের বক্তব্য হল, “Elegy is the form of poetry natural to there flective mind.” সংবেদনশীল মনের গভীরে আরও অনেক বিষয় ছায়া ফেলতে পারে।
কবি Bion এবং Moschus থিয়োক্রীটসের পথই অনুসরণ করেছিলেন। কবি Bion হলেন থিয়োক্রীটসের সমসাময়িক। সম্ভবতঃ তিনি আলেকজান্দ্রিয়াতে বাস করতেন। Moschus নিজেকে Bion-এর শিষ্য বলে স্বীকার করেছিলেন। Bion এবং Moschus দুজনেই রাখালিয়া কাব্যের কবি হিসাবে প্রথম শ্রেণীর। তাঁদের রচনার বৈচিত্র্য অত্যন্ত বিপুল। তাঁদের কাব্যে মেষপালকের জীবন যত না বেশি বর্ণিত হয়েছে তার চেয়ে পুরাণ কাহিনীকে অনুসরণ করেছেন অনেক বেশি। অবশ্য দুই কবির মধ্যে Bion-কেই শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়। কারণ Bion এর কাব্যগ্রন্থ “Lament for Adonis” এর মধ্যে এমন একটা সমুজ্জ্বল বৈচিত্র্য আছে যা পুরাণ বর্ণিত কাহিনীকে অতিসুন্দররূপে উপস্থাপিত করেছে। অবশ্য Bion এর শোক সঙ্গীত হয়ে অপেক্ষা মস্তিকের কাছে আবেদন করে অনেক বেশি। অর্থাৎ Bion এর শোক সঙ্গীত বুদ্ধিপ্রধান; আবেগপ্রধান নয়। Bion এর বিষপানে মৃত্যু ঘটেছিল। এবং তাঁর মৃত্যুতে শোকগাথা রচনা করেছিলেন Moschus, Lament of Moschus for Bion.
এমনি করেই শোকগাথা গ্রীস থেকে রোমে অনুসৃত হল। মেষপালকের জীবনাচরণের আড়ালে মহাকবি ভার্জিল সমসাময়িক সমাজের মানুষ এবং তাদের আচার-আচরণকে তীব্র কটাক্ষ করেছিলেন। রেনেসাঁসের পর জাতীয় শোকগাথার ব্যাপক প্রসার লাভ ঘটল। ইউরোপের কবিদল যেমন স্পেন্সার, সিডনী, সেক্সপীয়র, মিলটন, শেলী প্রভৃতি এই জাতীয় কবিতা রচনায় বিপুল প্রেরণা লাভ করেছিলেন।
মিলটনের ‘লিসিডাস’ রাখালিয়া শোকগাথার কাব্য হিসাবে শ্রেষ্ঠ। তিনি তাঁর বন্ধু এডওয়ার্ড কিং এর মৃত্যুতে এই কবিতাটি রচনা করেছিলেন। এই কাব্যে মিলটন স্বয়ং একজন মেষপালক হিসাবে আর একজন মেষপালকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। উভয়েই একই পর্বতের কোলে লালিত হয়েছেন। একই ছায়াতরুতলে, একই ঝরনার ধারে, নদীপ্রান্তে মেষদলকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এই কাব্যে যেমন প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য ও সৌন্দর্যের এক অপরূপ রূপকথার রাজত্ব সৃষ্টি করেছেন তেমনি এ্যাংলিক্যান ধর্মমণ্ডলীর মিথ্যাচার ও ধর্মহীনতার বিরুদ্ধে মহাকবি তীব্র প্রতিবাদ করে গর্জে উঠেছেন।
ম্যাথু আরনল্ডও রাখালিয়া শোকগাথা রচনা করেছেন। তাঁর ‘Thyrsis’ কবিতার মধ্যে তিনি পরলোকগত বন্ধুর প্রতি শোক জ্ঞাপন করেছেন। কবি কীটসের মৃত্যুতে ‘রাখালিয়া শোকগাথা’ রচনা করেছেন শেলী।
যাইহোক Pastoral Elegy যাকে আমরা ‘রাখালিয়া শোকগাথা’ বলতে পারি তার এত জনপ্রিয়তার কারণ কি? একথা মনে রাখতে হবে যে রাখালিয়া শোকগাথা বন্ধুর বিয়োগে কেবলমাত্র নিছক শোকগাথা নয়- the subject of pastoral elegies is not so much overwhelming personal grief as a obituary tribute ব্যক্তির নিছক ব্যক্তিগত শোক অপেক্ষা আরও অনেক কিছু। কারণ বন্ধুর প্রতি শোক জ্ঞান করতে গিয়ে ব্যক্তির সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বরহস্যের গভীরে যখন কবি প্রবেশ করেন তখন সেই শোক আর ব্যক্তির ব্যক্তিগত শোক থাকে না, তা হয়ে ওঠে শোক কাব্য। এমনই এক শোকের মুহূর্তে কাব্য শ্লোক রচনা করেছিলেন আদি কবি বাল্মীকি।
দ্বিতীয়তঃ এই জাতীয় শোক কাব্য রচনায় প্রধান উৎস হল প্রকৃতি। কল্পনার ডানা মেলে কবি চলে যেতে চান সুদূর গ্রাম্য প্রকৃতির কোলে। নীরব নিস্তব্ধ নির্জন গ্রাম্য প্রকৃতি কবির শোক মুহূর্তগুলিকে চিরন্তন করে রাখে। কবি মন যখন শহরের কোলাহল মুখরিত পরিবেশকে সহ্য করতে পারে না, যখন শহরের কৃত্রিম পরিবেশ কবি হৃদয়কে করে তুলে যন্ত্রণাকাতর তখন শহর থেকে দূরে গ্রামের মধ্যে কবি আশ্রয় নিতে চান এবং গ্রাম্য প্রকৃতির নির্জনতার মধ্যে কবি আপন হৃদয়টিকে ছড়িয়ে দেন। কারণ শহরের কোলাহল শোকের যথাযথ পরিবেশ নয়।
তৃতীয়তঃ এই নির্জন গ্রাম্য প্রকৃতির সঙ্গে কবির নিঃসঙ্গ নির্জন হৃদয়ের যে ভাবসম্মিলন ঘটে তাতে করে কবির অন্তরের শোক আরও নিবিড় ও ঘনীভূত আকার ধারণ করে। নির্জন প্রকৃতিই হল কবি হৃদয়ের শোকোচ্ছাসের জন্মভূমি। জীবনের ফেলে আসা দিনগুলি যেন আরও স্পষ্ট ও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। অর্থাৎ অতীত জীবনের স্মৃতি রোমন্থনের একমাত্র পরিবেশ হল নির্জন প্রকৃতি। এই নির্জন বোবা প্রকৃতিই কবি হৃদয়ের শোককে মুখর করে তোলে। যেহেতু রোমান্টিক কবির কাছে প্রকৃতি প্রেমই হল মুখ্য সেহেতু কবি প্রকৃতির সান্নিধ্যে পরলোকগত বন্ধুর শোককে গভীরভাবে অনুভব করেন এবং নিবিড়ভাবে স্মৃতি রোমন্থন করেন।
চতুর্থতঃ রাখাল বালকের জীবন রোমান্টিক কবির কাছে কল্পনার বস্তু। কারণ ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মত বন্ধনহীন অনাবৃত স্বাধীন জীবন যাপন কবির কাছে একান্তভাবে কাম্য। রোমান্টিক কবি কোন বন্ধনকে স্বীকার করতে চান না। তিনি চান সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্তি। কবি কল্পনায় সেই মুক্ত জীবনানন্দের মূর্ত প্রতীক প্রকৃতির একান্ত আপনজনগুলির মত নিজেকেও সেই সাজে সজ্জিত করে তোলেন, সেই ভাব ও ভাবনায় নিবিড় হয়ে ওঠেন এবং সেই সুরে শোক-সঙ্গীত রচনা করেন।
পঞ্চমতঃ শুধু মৌন মূক গ্রাম্য প্রকৃতি নয়, অতীতের পৌরাণিক জগতেও কবি উত্তরণ করতে চান। সে জগৎ যদিও অলৌকিক দেবতাদের জগৎ তবুও সেখানে আপন জনের বিয়োগ ব্যথায় মর্তের রোদন ধ্বনি শোনা যায়। তাই শোকের আসরে নানা দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটে আর এই সমস্ত দেবদেবী হল গ্রীক। সৌন্দর্যপ্রিয়তা এবং অতীতে প্রত্যাবর্তন রোমান্টিকতার অন্যতম লক্ষণ। শোকগাথার কবি সুদূর অতীতকে বর্তমান কালের আসরে নামিয়ে আনেন এবং তাকে জীবন্ত বিগ্রহরূপে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেন।
শেলীর “এডোনিস” কাব্যটি শোকগাথা। শুধুমাত্র শোকগাথা নয়, “রাখালিয়া শোকগাথা”। যদিও কীটস্ শেলীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন না, তবুও শেলী কীটসের সমালোচকদের সহ্য করতে পারেন নি। শেলীর এই কবিতাটির রচনাকাল ১৮২১। শেলীর কাব্য প্রতিভার মধ্যাহ্নকাল। কবি কীটস্ ১৮২১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে পরলোক গমন করেন। এপ্রিল মাসে শেলী কবি কীটসের মৃত্যু সংবাদ জানতে পারেন। কীটকে স্মরণ করেই শেলী এই শ্লোক কাব্যটি রচনা করেন।
এই কাব্যে কবি কীটকে মেষপালক রূপেই অংকন করেছেন। এবং কীটসের সৃজনশীল প্রতিভা ও কল্পনাকে মেষদল রূপে চিত্রিত করেছেন। শেলী নিজেও মেষপালক রূপে শোক জ্ঞাপন করেছে। শেলী গ্রীক Pastoral Elegy-র আদর্শ অনুসরণ করেছেন। প্রথমতঃ Bion-এর “Lament for Adonis”-এর অনুসরণে “Adonais” (এডোনাইস) নামটি ব্যবহার করেছেন। দ্বিতীয়তঃ- কবি তাঁর প্রথম স্তবকেই Bion-এর “Lament for Adonis”-এর প্রথম স্তবকের পুরোপুরি অনুবাদ করেছেন। তৃতীয়তঃ- Bion এবং Moschus এর কাব্যে শোকার্তদের অনুরূপ বর্ণনা শেলীও করেছেন।
প্রধান শোকার্ত হলেন ইউরেনিয়া। গ্রীক পুরাণে ইউরেনিয়া হলেন জ্যোতির্মগুলের দেবী। কিন্তু প্লেটো এফোরডাইট ইউরেনিয়াকে স্বর্গীয় প্রেমের প্রতীক রূপে বর্ণনা করেছেন। Bion তাঁর কাব্যে ইউরেনিয়াকে এডোনিসের প্রেমিকা রূপে চিত্রিত করেছেন, শেলী করেছেন জননীরূপে। এডোনিসের মৃত্যুতে সমগ্র প্রকৃতি শোকে মুহ্যমানা। ইউরেনিয়ার পুত্রশোকে বিলাপ, Echo-র ব্যথাতুর ক্রন্দন, আলুলায়িত কেশ ও আলুথালু বেশে উষার ক্রন্দন, শোকাতুরা ক্ষণপ্রভার গভীর গর্জন, তরঙ্গহীন সমুদ্র-বক্ষে বসন্তের সীমাহীন কাতর অশ্রুমোচন, হেসিস্থ এবং নার্সিসাস ফুলের ম্লান বিধুর হৃদয়ের অশ্রুবিসর্জন সমস্ত কিছু মিলে বিশ্বপ্রকৃতি শোকাকুলা এবং অশ্রুর বন্যায় বাণীহারা। তাই ইউরেনিয়ার আকুল প্রার্থনা “Kiss me, so long but as a kiss may live.”
শুধু প্রকৃতি-ই ক্রন্দনাতুর নয়, মানবও সেই দুঃখে সমদুঃখী। বায়রণ যাঁকে শেলী “Pilgrim of eternity” বলে উল্লেখ করেছেন, এডোনিসের সমাধিস্থলে শোক নিবেদন করতে তিনিও এসেছেন। যদিও বায়রণ কীটকে গ্রাহ্য করতেন না, তবু বায়রণকে মনে করতেন “Pythian of the age.” যেহেতু বায়রণ স্কচ্ Reviewers এর বিরুদ্ধে প্রবলভাবে সংগ্রাম করে তাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন। সেহেতু শেলী শোকার্তদের নেতারূপে বায়রণকেই উপস্থাপিত করেছেন। কারণ শেলীর ধারণা ছিল কীটসের মৃত্যুর কারণ- সমালোচকদের নির্দয় সমালোচনার সুতীক্ষ্ণ শায়ক।
সমাধিস্থলে এসেছেন টমাস মূর। আয়ারল্যাণ্ডের জাতীয় কবি। কীটস্ সম্বন্ধে মূরের ধারণা খুব একটা উচ্চ ছিল না। এমনকি শেলী সম্বন্ধেও নয়। তবুও শেলী নূরকে উপস্থাপিত করেছেন। সর্বশেষে যিনি শোক প্রকাশ করতে এসেছেন তিনি হলেন লে-হান্ট। তাঁর আঁখি অশ্রুজলে পরিপূর্ণ। তিনি-ই ছিলেন কীটসের যথার্থ বন্ধু Friend, Philosopher এবং Guide, লে-হান্ট সমাজের নিকট আদরণীয় ছিলেন না। ইংলণ্ডের সমাজ তাঁকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। কারণ তিনি সমাজের কু-সংস্কারে এবং প্রাণহীন জীর্ণ প্রথাগুলির বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম করেছিলেন।
শেলী নিজেও অর্থসমন্বিত আভরণে সজ্জিত হয়ে এডোনিসের সমাধিস্থলে শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করতে এসেছেন। প্যানিসিস এবং ভায়োলেট ফুলের চূড়ায় কবির মস্তক সুশোভিত। প্যানসিস ফুল হল চিন্তার প্রতীক, ভায়োলেট ফুল হল মাধুর্যের প্রতীক। একটা হালকা ধরনের বর্শা তাঁর হাতে। বর্শার ফলকে সাইপ্রেস ফল প্রোথিত। সাইপ্রেস ফল মৃত্যুর প্রতীক। বর্শাটি আইভি লতায় মণ্ডিত। আইভি লতা চিরন্তন বন্ধুত্ব এবং জীবনের প্রতীক। সুতরাং শেলীর হস্তধৃত বর্শা একদিকে বিষাদ, অন্যদিকে আনন্দ; একদিকে জীবন, অন্যদিকে মৃত্যু; একদিকে সৃষ্টি, অন্যদিকে সংহারের প্রতীক। শেলীর কপোলদেশ ক্ষতচিহ্ন লাঞ্ছিত। ইংলণ্ডের সমাজের কাছ থেকে যে লাঞ্ছনা তিনি পেয়েছিলেন ঐ ক্ষতচিহ্নগুলি তারই প্রতীক।
এই সমাধিস্থলে তিনি নিজেকে নিঃসঙ্গ একাকীরূপে উপস্থাপিত করেছেন। প্রকৃতি পূজারী কবি আপন অন্তরের অন্তরলোক থেকে শাস্তি খুঁজে পান নি। প্রকৃতির নগ্ন সৌন্দর্যের পাথারে আঁখি ডুবিয়ে সেই আনন্দকে আকণ্ঠ ভরে তিনি পান করেছেন তবু তাঁর হৃদয় চির অতৃপ্ত। Acteaon যেমন পর্বত-দুহিতার স্বচ্ছ জলে কেলিবিলাসরত ডায়ানার নগ্ন সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিল এবং ডায়েনার অভিশাপে মৃগীরূপ ধারণ করলে শিকারীগণ কর্তৃক নির্মমভাবে নিহত হয়েছিল তেমনিভাবে শেলীও প্রকৃতির নগ্ন সৌন্দর্য দর্শন করে আপনার অভিশপ্ত চিত্তকে শরাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করেছিলেন। ফলে, প্রকৃতি সৌন্দর্যের কামনায় তাঁর হৃদয় চির অতৃপ্ত।
কবির এই প্রেম নিঃসঙ্গতার বিষাদে পরিপূর্ণ। সেই বিষাদের হাত থেকে মুক্তি সম্পর্কে কবি সংশয় প্রকাশ করেছেন। কবি আপন মনের এই ক্লান্তি ও বিষাদকে স্তিমিত প্রদীপ, বর্ষণমুখর রাত্রি এবং সমুদ্র তটপ্রান্তের ভগ্ন তরঙ্গের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কবির মনে হয়েছে, শুভ বিবর্ণ ফুলের উপর প্রাণঘাতী সূর্যের হাস্য যেন মূমুর্ষু মানুষের রঙীন অধরের মত। কবির এই রোমান্টিক বিষাদ নিঃসঙ্গতা থেকে উদ্ভুত।
তবুও কবি বিষাদের হাত থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছেন। কারণ কবি বুঝতে পেরেছেন যে এডোনিস মরতে পারে না-সে অমর। He is made one with nature. কবি মানুষকে এক অনন্ত শক্তির অংশ বলে মনে করেছেন এবং আত্মার অমরত্বের বিশ্বাসে সান্ত্বনা লাভ করেছেন। জীবন সেই অবিনাশীকে আবৃত করে রাখে, মৃত্যু তাকে অনাবৃত করে অনন্ত শক্তির সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। অর্থাৎ মৃত্যুর পর আত্মা পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যায়। The one remains, the many change and pass.
বাংলা সাহিত্যে অবশ্য ঠিক এই ধরনের শোকগাথা বলে কিছু নেই। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে তো একেবারেই নেই। আর আধুনিক বাংলা সাহিত্যে যা কিছু আছে তা ইউরোপীয় সাহিত্যের শোকগাথার অনুরূপ নয়। এক কথায় বাংলা সাহিত্যে Pastoral Elegy বা রাখালিয়া কাব্য বলতে কিছুই নেই। তবে এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ রচিত “সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত” কবিতাটির উল্লেখ করা যেতে পারে। কবি হিসাবে সত্যেন্দ্রনাথ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশে যে কজন কবি ও সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থেকেও তাঁর প্রভাব থেকে মুক্ত থেকেছেন এবং যশস্বী হয়েছেন তাঁদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ অন্যতম। ১৯২২ সালে ২৪শে জুন সত্যেন্দ্রনাথের মৃত্যু ঘটে। সত্যেন্দ্রনাথের অকালমৃত্যু রবীন্দ্রনাথকে ব্যথিত করেছিল। সেই ব্যথা এবং বেদনার কাহিনী এই কাব্যের বিষয়বস্তু। যাইহোক কবিতাটি কবি রচনা করেছিলেন মৃত কবির শোক সভার উদ্দেশ্যে। এই কবিতাটির প্রথম স্তবকেই রবীন্দ্রনাথ সত্যেন্দ্রনাথের ছন্দের উল্লেখ করেছেন। আষাঢ় মাসে কবি মারা গেছেন। সুতরাং আষাঢ়ের বর্ষার নবীন মেঘের বজ্রভেরীকে নবীন ছন্দে ধরে রাখার কবি নেই বলে রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করেছেন। দ্বিতীয় স্তবকে কবি সত্যেন্দ্রনাথের নির্ভীকতার উল্লেখ করেছেন। “কুহু ও কেকা” কাব্যের উল্লেখ করে কবি বলেছেন যে সত্যেন্দ্রনাথের কাব্য অনাগত যুগের, চিরন্তন কালের। তৃতীয় স্তবকে কবি স্মরণ করেছেন সত্যেন্দ্রনাথের মধুর ব্যবহার ও জীবনাচরণের কথা ও কাহিনী। চতুর্থ স্তবকে কবি শোকের প্রদোষ অন্ধকারে বসে জীবনের অতীত তীরের, মৃত্যুর স্বরূপকে জানতে চেয়েছেন। কবি বলেছেন সত্যেন্দ্রনাথের মৃত্যুতে যদিও ইহকালের ভৈরবীতে বিদায়ের মূর্ছার সুর বেজেছে, সাথে সাথে পরলোকের ভৈরবীতে মিলনের আগমনী সুর ধ্বনিত হচ্ছে। কারণ স্থল দৃষ্টিতে যাকে জীবনের সমাপ্তি বলে মনে হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে
তা হল “নবতন আরম্ভের মঙ্গল বারতা”। পঞ্চম স্তবকে কবি বলেছেন যে, ভব সিন্ধু পারের খেয়ার কর্ণধারকে তিনি চেনেন। কারণ এই বিশ্বভূবনের প্রতিটি তৃণ-তরু-ফুল পল্লবের মধ্যেই তো তার প্রকাশ। মেঘভরা বৃষ্টিঝরা দিনে সেই মহাপাগল খেয়ালী কর্ণধারকে তিনি আর একবার দু’চোখ ভরে দেখে নিলেন। কারণ ঝরে পড়া কদম্ব কেশরের সুগন্ধি ভরা লিপিখানি সেই মহাপাগল কবির হাতে তুলে দিয়েছেন। সবশেষে স্তবকে কবি পরপারের কবির সঙ্গে মিলনের কথা ব্যক্ত করেছেন। কামনা করেছেন যে মর্ত্যলোকে যেমনভাবে তিনি সত্যেন্দ্রনাথকে দেখেছেন ঠিক সেই বিনম্র স্নিগ্ধ হাস্যমুখেই হয়ত পরপারের কবি অমর্তলোকের দ্বারে অভ্যর্থনা জানাবেন। শোকগাথা হিসাবে এই কবিতাটি অনবদ্য। রবীন্দ্রনাথ সত্যেন্দ্রনাথের প্রকৃতি-প্রীতি ও মানব প্রীতির কথা এই কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন, ব্যক্ত করেছেন আপন মনের কথা। সত্যেন্দ্রনাথের মৃত্যুতে কবির হৃদয় মথিত শোকের গভীর কান্না বা রোদনধ্বনি এই কবিতায় আদৌ শোনা যায় না যদিও “প্রকৃতিরাণী ললাটে কর হানি নিঃশব্দে লুটায় ধরণীতলে” তবুও প্রকৃতির এই নিঃশব্দ কান্না এত নীরব যে তা’ কান পেতেও শোনা যায় না। এই কাব্যে গভীর আবেগও যেমন নেই, তেমনি নেই তীক্ষ্ণ তীব্রতা। তিনি শেলীর মত চিৎকার করে বলতে পারেন নি– “I weep for Adonais–He is dead.” তিনি নিজেও কাঁদতে পারেন নি, অপরকেও কাঁদাতে পারেন নি। এ যেন নেহাতই সত্যেন্দ্রনাথের জীবনেতিহাস রচনা করা হয়েছে। অবশ্য যে বয়সে তিনি এই কবিতাটি রচনা করেছেন তাতে তাঁর কাছ থেকে তীক্ষ্ণ তীব্র আবেগানুভূতি আশা করা যায় না। তাছাড়া তিনি শেলীর মতে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানোর জন্যেও কাব্য রচনা করেন নি।
রবীন্দ্রনাথ শান্ত রসের পূজারী। সমস্ত কিছুর মধ্যেই তিনি একটা সংযম রক্ষা করে চলেছেন। উদ্দামতা ও বিহ্বলতা তাঁর প্রকৃতি বিরুদ্ধ। তাই তিনি মৃত কবির জন্য রক্তমাংসের হৃদয়ের উষষ্ণ উত্তাপ বিবর্জিত উচ্ছ্বাসবিহীন প্রচ্ছন্ন অশ্রুজল বিসর্জন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ যে কথার পরে কথা সাজিয়ে সত্যেন্দ্রনাথের স্মৃতি মন্দির রচনা করেছেন। এবং মন্দিরের পাদদেশে দাঁড়িয়ে একবিন্দু অশ্রুজল মোচনের পরিবর্তে মহান মৃত্যুর অমৃতলোকে কবির সঙ্গে মিলনের আকাঙ্খাই প্রকাশ করেছেন। কবির কাছে মৃত্যু হচ্ছে পরম পুরুষের লীলা। কবি বলেছেন-
হে রুদ্র, তব সঙ্গীত আমি
কেমনে গাহিন কহি দাও স্বামী-
মরণ নৃত্যে ছন্দ মিলায়ে
হৃদয় ডুমরু বাজাব,
ভীষণ দুঃখে ডালি ভরে লয়ে
তোমার অর্ঘ্য সাজাব।
সিন্ধুপারের কর্ণধার সম্বন্ধে কবির কোন সংশয় কোন দ্বিধা ছিল না। সমস্ত জীবন ধরেই কবি জীবনের বেদীমূলে মৃত্যুর অর্ঘ্য রচনা করেছেন এবং মহান মৃত্যুর দীপালোকে জীবনকে বর্ণময় করে তুলেছেন। কবির কাছে মৃত্যুর কোন পৃথক সত্তা নেই। কারণ মৃত্যু ছাড়া জীবনের পরিচয় নেই, জীবন ব্যতিরেকে মৃত্যুর স্বতন্ত্র কোন অস্তিত্ব নেই। কবি বলেছেন,
মোর মরণে তোমার হবে জয়
মোর জীবনে তোমার পরিচয়।
তাই কবি জানেন যে মৃত্যুর পর কবি সত্যেন্দ্রনাথ সেই বিশ্ব চিত্তলোকে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন, যেখানে “সুগম্ভীর বাজে অনন্তের বীণা যার শব্দহীন সঙ্গীত ধারায় ছুটেছে রূপের বন্যা গ্রহে সূর্যে তারায় তারায়।”
অন্যদিকে শেলী জীবন ও মৃত্যুকে পরম পুরুষের লীলা বলে গ্রহণ করেননি। যদিও তিনি আত্মার অমরত্বে বিশ্বাসী, যে আত্মা মৃত্যুর পরমাত্মার বিলীন হয়ে যায়, তবুও তিনি মৃত্যুর পৃথক সত্তায় বিশ্বাসী। শেলী পরম পুরুষের পূণ্য পদ পরশে মৃত্যুকে অমৃতত্বে পরিণত করার স্বপ্ন দেখেননি। ‘মরণ রে তুই মম শ্যাম সমান’ বলে মৃত্যুর মনোহর রূপে মুগ্ধ হন নি। এমনকি, মহান মৃতার অমৃতলোকে কবি কীটসের সঙ্গে মিলনের আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ করেননি। তিনি মৃত্যুকে ভয় মৃতার ডালকাতা বা অর্চনা করেননি। রবীন্দ্রনাথের মত কোথাও তিনি বলেন নি,
মৃত্যুও অজ্ঞাত মোর। আজি তার তরে ক্ষণে কণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে।
শেলী মৃত্যুকে পাত্তা দেননি। কারণ শেলী হলেন জীবনের পূজারী। এই জীবন আবার প্রেমের প্রভাত সূর্যলোকে উদ্ভাসিত। সুখে-দুঃখে বেদনায় বন্ধুর যে পথ সেই দুর্গম পথে প্রেমের বিজয় বৈজয়ন্তী উড়িয়ে জীবনের জয়রথ অপ্রতিহত গতিতে ধাবমান। যে প্রেম মহাকালের ভ্রুকুটিকে অবজ্ঞা ক’রে অজেয়, মৃত্যুকে অস্বীকার করে মৃত্যুহীন। যে প্রেম মানুষকে কল্যাণের পথে প্রেরণা দেয়, যে প্রেম মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের সোংবন্ধন রচনা করে সেই প্রেম মৃত্যুঞ্জয়ী। তাই শেলীর কাছে,
Life is its state of action, and the store Of all events is aggregated there, That variegate the eternal universe, Death is a gate of dreariness and gloom.
মৃত্যুকে তিনি কঠিন স্থল বাস্তব মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই ভাবেন নি। তাঁর কাছে মৃত্যু যেন হৃদয়হীন কঠিন সমালোচক যার নিষ্ঠুর আঘাতে কবি কীটসের মৃত্যু ঘটেছে। শেলীর কাব্যে শোকের উচ্ছ্বাস, হৃদয়ের কান্না আর মর্মের জ্বালা ঘনীভূত হয়ে এক অপূর্ব বিহ্বলতা ফুটিয়ে তুলেছে। সর্বশেষে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে সেই মহান আত্মার স্বরূপকে জানতে পেরেছেন বলেই মৃত্যুকে উপহাস আর তীক্ষ্ণ বিদ্রুপ বাণে জর্জরিত করে গর্জে উঠেছেন-He lives, he wakes, it is death is dead, not he মৃত্যুটারই মরণ ঘটেছে, এডোসিন মরে নি, সে বেঁচে আছে। শেলী হলেন বলিষ্ঠ আশাবাদী। শেলীর নিজের মৃত্যুও জীবনের এই বলিষ্ঠ আশাবাদকে প্রকাশ করে।
এই প্রসঙ্গে কবি নবীনচন্দ্র সেন রচিত “অনন্ত দুঃখ” কবিতাটির উল্লেখ করা যেতে পারে। এই কবিতাটি নাট্যকার কবি দীনবন্ধু মিত্রের মৃত্যুতে রচিত হয়েছিল। ১৮৭৩ সালের ১লা নভেম্বর দীনবন্ধু মিত্রের মৃত্যু ঘটে। নবীন সেনের এই কবিতাটি শোকগাথা। অবশ্য ইংরাজী সাহিত্যে পরবর্তীকালে যে সমস্ত শোকগাথা রচিত হয়েছে তা’ রাখালিয়া শোকগাথা কাব্যের যথাযথ অনুসরণ নয়। অর্থাৎ সেগুলিকে রাখালিয়া শোকগাথা বা Pastoral Elegy বলা যায় না। কেবল মাত্র Elegy বলা যায়। যেমন কবি ‘টেনিসের’ “In Memoriam” এবং কবি “গ্রে”-র “Elegy in a country church yard.” কবিতার উল্লেখ করা যেতে পারে। আধুনিক কালের শোকগাথা কাব্য অনেকখানি কবির মানবিকতার স্পর্শে অনুরঞ্জিত। “গ্রে”-র কাব্য অখ্যাত অজ্ঞাতজনের মর্মের বেদনায় বাঘিত এভং আপনার আশাহত মনের কথাই এখানে প্রকাশিত।
যাই হোক। “অনন্ত দুঃখ” কবিতাটিতে কবির দুঃখ যে অনন্ত তারই কথা প্রকাশ হয়েছে। দীনবন্ধুর মৃত্যুতে কবি-ই য কেবলগাত্র হাহাকার করে উঠেছেন এমন নয়, “বঙ্গঅভাগিনী হয়েছে অনাথা। গ্রামের কৃষক হয়েছে সর্বহারা।” কবি কান পেতে সর্বহারা শোকার্ত কৃষকের কান্না শুনেছেন, শুনেছেন রাখাল বালকের কান্না- “ভাগীরথী তীরে বসি গোপাল কাঁদিছে কেহ আপনার মনে।” সবুজ শ্যামল প্রান্তর নির্জন ভাগীরথী তীর, সেই তীর প্রান্তে রাখাল বালকের কান্না, রাখাল বালকের সঙ্গে দীনবন্ধুর অন্তরঙ্গতা যেন রাখালিয়া কাব্যের অনুরূপ। কবি নবীন সেন দীনবন্ধুর কাব্য প্রতিভার বর্ণনা করেছেন, ব্যথিত চিত্তে আশা প্রকাশ করেছেন যে কবি দীনবন্ধু যদি ইউরোপে জন্মগ্রহণ করতেন তা হলে কবির এই প্রয়াণের সংবাদ বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ত, শোকে জগৎ অভিভূত হত, এবং কবির কাব্য প্রতিভা বিশ্ববাসীর কন্টে সহস্র ভাষায় আখ্যাত হত। সর্বশেষে কবি নবীনচন্দ্র সেন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন, বেদনাবিদ্ধ হৃদয়ে ক্রন্দনাতুর কণ্ঠে বলেছেন, “রে বিধাতঃ অন্ধকার খনির ভিতরে, কেন হেন রত্মরাজি করহ সৃজন।’ স্বজন হারানোর ব্যথায় কবিচিত্ত বিদীর্ণ। কিন্তু কবি এই বলে সান্ত্বনা লাভ করেছেন যে, যদিও কবির বন্ধু দীনবন্ধু চিত্ত শূন্য করে চলে গেছে তবুও কবি স্মরণ পথে চিরদিন জাগ্রত থাকবে।
এই কবিতাটি নিঃসন্দেহে শোকের কবিতা। শোকের কাব্য যদি শোক না জাগাতে পারে তাহলে তার সার্থকতা কোথায়? এখানে কবি নবীন সেন মৃত্যু চেতনা নিয়ে কোন নিগূঢ় তত্ত্বের অবতারণা করেন নি। মৃত্যুকে মৃত্যু বলেই তিনি সহজ সরল সংস্কারের মতন গ্রহণ করেছেন। এবং কবির উদ্দেশ্যে লৌকিক শোকের কথাই ব্যক্ত করেছেন। কবির সহজ সরল চিত্তের এই লৌকিক বিশ্বাস অলৌকিকতাকে পরিহার করেছে। কবি স্বয়ং যেন সাধারণ কৃষকের সাথে একাত্ম হয়ে শোক প্রকাশ করেছেন। এখানে কথার পরে কথা সাজিয়ে তিনি গুরুগম্ভীর কিছু একটা সৃষ্টি করেন নি। অতি সাধারণ সহজ সরল ভাষায় হৃদয়ের উষ্ণ উত্তাপের ক্রন্দনময় বাণীকে রূপ দিয়েছেন। তাই কবির এই শোক যেমন গভীর তেমনি কৃত্রিমতাবিহীন।
এডোনিস কাব্যের ভাব, ভাবনা ও বৈশিষ্ট্য
শেলীর এই কাব্যটির রচনাকাল ১৮২১। শেলীর কাব্য প্রতিভার তখন মধ্যাহ্নকাল। কবি কীটস ১৮২১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে পরলোক গমন করেন। এপ্রিল মাসে তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানতে পেরে শেলী এই শোক কাব্যটি রচনা করেন। ইংরাজী সাহিত্যে এটি শ্রেষ্ঠ শোক কাব্য।
প্রথমতঃ কাব্যটির গঠন প্রকৃতি সম্বন্ধে বলা যায় যে কবি সম্ভবতঃ মিলটনের Lycidas কাব্যের অনুসরণ করেছেন। কাব্যটির বিষয়বস্তুর পরিকল্পনার সঙ্গে মিলটনের শোককাব্য লিসিভাসের সাদৃশ্যও প্রচুর। মিলটনের কাব্য যেমন শোক, দুঃখ, বিষাদ ও ঘৃণার স্তর অতিক্রম করে একটি আধ্যাত্মিক সমুন্নতি লাভ করেছে তেমনি শেলীর কাব্যেও তা লক্ষ্য করা যায়। তবে এডোনিস কাব্য ব্যক্তিগত দুঃখ ও শোকের একটি বিষাদঘনরূপে পর্যবসিত হয়নি কারণ শেলীর শোক প্রকাশের মধ্যে ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। তাই তাঁর কাব্যে জ্বালা আছে, দাহ আছে, আছে কঠোর ভর্ৎসনার সুর। কাব্যটির প্রথম স্তবক থেকে সাঁইত্রিশ স্তবক পর্যন্ত কীটসের প্রতি শোক প্রকাশ ও কীটসের জীবন হরণকারীদের অর্থাৎ প্রাণ হস্তারকদের প্রতি তীব্র ঘৃণার প্রকাশ ঘটেছে। তারপর থেকে কবির ঘটেছে আধ্যাত্মিক চেতনার স্তরে উত্তরণ।
কীটসের মৃত্যুকে রূপক আকারে কবি উপস্থাপিত করলেন। এখানে কীটস্ হল এডোনিস। এডোনিস হল মৃত মেষপালক। তার চারিধারে মেষদল শোকে আকুল। প্রকৃতিও শোকে মুহ্যমান, এমনকি ইংলণ্ডও শোকে অধীর। কবি ইউরেনিয়াকে আহ্বান জানিয়েছেন শোকপ্রকাশের জন্য। ইউরেনিয়া বন্ধুর পথ অতিক্রম করে এডোনিসের সমাধিতে এসে উপস্থিত হল এবং শোকপ্রকাশের মধ্য দিয়ে এডোনিসের প্রাণ বধকারীদের তীব্র ভাষায় আক্রমণ করলো। তাদের “herded wolves”, “obscene ravens”, “vultures”, এবং “ড্রাগন’ আখ্যায় ভূষিত করে নীরব হল। এরপর বিভিন্ন কবিগণ এল শোকপ্রকাশ করতে। তাঁরা একে একে শোকপ্রকাশ করার পর কবির আধ্যাত্মিক উপলব্ধি ঘটলো।
কবি উপলব্ধি করলেন যে এডোনিস মরতে পারে না। সে অমর, সে মৃত্যুঞ্জয়ী। তিনি এই উপলব্ধির মধ্য দিয়ে জগৎ ও জীবনের একটি মর্ম সত্য জানতে পারলেন তাহলো মৃত্যুর আলোকে আত্মার অমরত্ব এবং বিশ্বের মধ্যে যে শক্তি ক্রিয়াশীল তার নব নব বিকাশ। সৃষ্টির মূলীভূত কেন্দ্রে ঐশী শক্তিকে তিনি অনুভব করেছেন এবং বিচিত্র প্রকাশের মধ্যে সেই শক্তির মূর্তি কল্পনা করেছেন।
শেলী এডোনিস কাব্যে মানুষকে এক অনন্ত শক্তির অংশ বলে মনে করেছেন। এবং আত্মার অমরত্বের বিশ্বাসে সান্ত্বনা লাভ করেছেন। জীবন অবিনাশী, আত্মাকে আচ্ছাদিত করে রাখে। মৃত্যু তাকে মুক্ত করে অনন্তের সাথে যুক্ত করে দেয়। দুঃখবাদী কবি জীবনকে দুঃস্বপ্ন বলে মনে করেছেন। অবিনশ্বর অনন্তের অংশ জীবনের দুঃখ কষ্ট নৈরাশ্যের মধ্যে পড়ে তার নির্মল জ্যোতি হয় নিষ্প্রভ। তবে যতই স্নান হোক আত্মার অবিনশ্বরতা তাতে বিনষ্ট হয় না। তাই এডোনিসের মৃত্যু নয়, তা স্বপ্ন হতে জেগে উঠা,
Peace, Peace, he is not dead, he doth not sleep He hath awakened from the dream of life.
সেই শক্তিই একমাত্র সত্য, অনিবাশী। মানুষের মরজীবন ছায়াবাজির মত চঞ্চল ও ক্ষণস্থায়ী। জীবনটা বহু বিচিত্র রঙীন কাঁচের মত। অনন্তের শুভ্র জ্যোতিকে তা কালিমা লিপ্ত করে দেয়। তবু
মহাশক্তি চিরন্তন হয়ে থাকে আর সব কিছুরই ঘটে পরিবর্তন।
The one remains, the many change and Pass,
Heaven’s light for ever shines, earth’s shadow fly,
Life like a dome of many-coloured glass,
Stains the white radiance of Eternity,
Until death tramples if to fragments.
মৃত্যুতে জীবন একটা রূপান্তর লাভ করে। প্রকৃতির মধ্যে যে শক্তি বিরাজমান সেই শক্তির সঙ্গে মিশে রূপান্তরিত জীবন চরাচরে ব্যাপ্ত হয়ে যায়।
He is made one with nature, there is heard his voice in all her mu-sic; from the moan of thunder to the song of night’s sweet bird.
মৃত্যুর পর সেই আত্মা পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যায়। এই পরমাত্মাই হল স্বয়ং ঈশ্বর। আত্মা অবিনশ্বর, অজর, অমর। তা ধ্বংস হতে পারে না। দেহের ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গেই আত্মার ধ্বংস হয় না। কারণ এই জাগতিক জীবনের পরও আর একটা জীবন আছে তা হল স্বর্গীয় জীবন। কবি বলেছেন,
The pare spirit shall flow Back to the burning fountain whence it came A portion of the Eternal.
মানব আত্মা পরমাত্মার অংশ বিশেষ। মৃত্যুর পর সেই জ্যোতির্ময় উৎসে সে ফিরে যায়। অনন্তের অংশ রূপে সে সেই থেকে জন্মলাভ করে এবং পরমাত্মা থেকে পৃথক হয়ে যায়। ফলে জাগতিক বন্ধনের মধ্যে তার মহিমা ক্ষুন্ন হয়। মৃত্যুর পর আত্মা পরমাত্মায় প্রত্যাবর্তন করে সে মুক্তিলাভ করে।
এই কাব্যে শেলীর শোকের অশ্রুবিন্দু মহাসিন্ধুতে পরিণত হয়েছে। কারণ শেলীর দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে নিখিল বিশ্বের চেতনা শক্তির মহিমা। এই চেতনা শক্তির মধ্যে অক্ষয় আত্মা বিরাজমান। সেই অবিনাশী আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি করেছেন কবি। আধ্যাত্মিক ভাবগভীরতাই কাব্যটিকে অপূর্ব সুষমা দান করেছে। এখানেই শেলীর সঙ্গে অন্যান্য কবিদের প্রধান পার্থক্য।
এডোনিস কাব্যে শোকার্তদের শোক বর্ণনার দৃশ্য
এডোনিসের মৃত্যুতে সমগ্র প্রকৃতি মূহ্যমানা। পুত্রশোকে যেন ইউরেনিয়ার করুণ বিলাপ Echo-র ব্যথাতুর ক্রন্দন, আলুথালু বেশ ও অবিন্যস্ত কেশদাম নিয়ে উষার ক্রন্দন, ক্ষণপ্রভার শোকগর্ভ গর্জন, তরঙ্গহীন সমুদ্র বক্ষের নিঃশব্দ বিলাপ, বসন্তের সীমাহীন বেদনাকাতর দুঃখ প্রকাশ, হেসিস্থ এবং নারসিসাস ফুলের ম্লান বিধুর হৃদয়ের অশ্রুবর্ষণ, এই সমস্ত কিছু মিলিয়ে প্রকৃতি শোকাকুলা অশ্রুর বন্যায় বিশ্বপ্রকৃতি যেন বাণীহারা। ইউরেনিয়ার শোক বিদীর্ণ চিত্তের আকুল প্রার্থনা-
Kiss me, so long but as a kiss may live.
শুধু প্রকৃতিই ক্রন্দনাতুর নহে, মানুষও সেই দুঃখে সমদুঃখী। বায়রণ যাঁকে শেলী Pilgrim of Eternity বলেছেন তিনিও এসেছেন কীটসের সমাধিতে শোক নিবেদন করতে। শেলী বায়রণকে অকুণ্ঠভাবে শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখিয়েছেন। বায়রণকে তিনি Pythian of the age বলে অভিহিত করেছেন। বায়রণ স্কচ রিভিযুআরদের প্রতি প্রবলভাবে সংগ্রাম করেছিলেন। যার ফলে সেই সমস্ত নিষ্ঠুর সমালোচকগণ রণে ভঙ্গ দিয়ে নীরব থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু কীটস বায়রণের মত সাহস নিয়ে সমালোচকদের বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ তীব্র বাণ নিক্ষেপ করতে পারেন নি। ফলে সমালোচকদের কঠিন ব্যঙ্গের শরাঘাতে কীটকে ধরাশায়ী হতে হয়েছিল এটাই শেলীর ধারণা। এই ধারণা থেকে শেলী বায়রণকে এই কাব্যে শোকার্তগণের নেতারূপে উপস্থাপিত করেছেন। অবশ্য বায়রণ নিজে কীটসকে বিশেষ গ্রাহ্য করতেন না। Murray-কে একটি পত্রে বায়রণ লিখেছিলেন-“No more Keats, I entreat. Flay him alive. I some of you don’t, I must skin him myself.”
বায়রণের যদিও পরবর্তীকালে কীটস সম্বন্ধে বিরূপ ধারণার কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ঘটেছিল, তবুও তাঁকে দিয়ে শোক নিবেদন ও শোকার্তগণের নেতারূপে স্বীকৃতি দান যেন অসঙ্গতিতে ভরা। সম্ভবতঃ নিষ্ঠুর সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করার ব্যাপারে যেহেতু বায়রণ সে যুগে অগ্রণীর ভূমিকা নিয়েছিলেন সেজন্য শেলী তাঁকেই প্রথম স্থান দিয়েছেন।
বায়রণের পরেই থমাস মুরের নাম উল্লেখযোগ্য। শেলী তাঁকে “The sweetest lyricist of Ireland”s saddest wrong.” বলে অভিহিত করেছেন। মুর আইরিশ কবি, আয়ারল্যাণ্ডের জাতীয় কবি। তিনিও এসেছেন নিবেদন করতে। কিন্তু কীটস্ সম্বন্ধে তাঁর ধারণা খুব একটা উচ্চ ছিল না। এমনকি শেলী সম্বন্ধেও তাঁর ধারণা ছিল অত্যন্ত খারাপ। কীটস্ অবশ্য এক সময় মুরের সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছিলেন। ঐ সূত্রেই সম্ভবতঃ শেলী শোকার্তগণের মধ্যে মুরকে স্থান দিয়েছেন।
শেলী নিজেও একজন শোকার্তরূপে উপস্থিত। শোকার্তরূপে উপস্থিত ছিলেন লে-হান্ট। তাঁর অন্তর অশ্রুজলে পরিপূর্ণ। কীটসের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন লে-হান্ট। সেইজন্য তিনি ছিলেন কীটসের friend, philosopher এবং guide লে-হান্ট ইংলণ্ডের সমাজের কাছে মোটেই আদরণীয় ছিলেন না। কারণ তিনি সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রথাগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। তিনি কীটসের মৃত্যুতে গভীর দুঃখে মৃতদেহের উপর আছড়ে পড়েছেন।
একথা অনস্বীকার্য যে কীটসের সঙ্গে শেলীর বন্ধুত্ব খুব একটা গভীর বা গাঢ় ছিল না। তবু কেন শেলী কীটসের মৃত্যুর শোক কাব্য রচনা করলেন? আসলে শেলী যে ভাবনা থেকে এই কাব্য রচনা করেছেন তা হল অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামের ভাবনা। কীটসের মৃত্যু সম্বন্ধে শেলীর ধারণা ছিল যে কীটসের ‘এন্ডাইসিয়ন’ কাব্যের বিরুদ্ধে সমালোচকদের কঠোর সমালোচনাই তাঁর মৃত্যুর কারণ। এ ধারণা অবশ্য বায়রণেরও ছিল। এমনকি শেলী এও শুনেছিলেন যে সমালোচকদের কঠোর সমালোচনা পড়ে কীটস সাময়িকভাবে উন্মাদগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। শেলীর কাছে সমালোচকদের কঠোর সমালোচনা অত্যন্ত অন্যায় বলে মনে হয়েছিলেন। এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কথা তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। সেই গভীর উপলব্ধি থেকেই এ কাব্যের জন্ম।
কিন্তু কীটসের মৃত্যু সম্পর্কে শেলীর ঐ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কীটস অত দুর্বলচিত্ত ছিলেন না যে সমালোচনার আঘাতে তিনি মারা যেতে পারেন। তিনি আত্মসমালোচক ছিলেন। আপন রচনার ভুলভ্রান্তি সম্বন্ধে ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। একটি প্রবন্ধে কীটস্ লিখেছেন-“Praise or blame has but a momentary effect on a man whose love of beauty in the ab-stract (makes him a severe critic on his own works.”) সুতরাং কীটস্ যে সমালোচকদের সমালোচনায় খুব আঘাত পেয়ে মরেছেন একথা ঠিক নয়। সমালোচকদের সমালোচনা ও তাঁর মৃত্যু এ দুটি ঘটনা এমনভাবে ঘটলো যে তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে সমালোচকদের সমালোচনাই তাঁর মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পিছনে তাঁর ক্ষয়রোগই একমাত্র কারণ। সুতরাং আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে যদিও শেলী ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে এই কাব্য রচনা করেছেন; তবুও কাব্য হিসাবে কাব্যটি সার্থক রূপলাভ করায় তাঁর ভুলের প্রতি পাঠকের কোন বক্তব্য নেই।
‘এডোনিস’ কাব্যে, শেলীর ব্যক্তিগত চিত্র
শেলী গীতিকবি। সুতরাং কাব্যের মধ্যে যে কবির আত্মপ্রকাশ ঘটবে তা অনস্বীকার্য। গীতি কবির স্বভাব ধর্ম হল নিজেকে প্রকাশ করা। নাট্যকার বা মহাকাব্যের কবিগণ কাব্যের অন্তরালে আত্মপ্রকাশ করে। গীতিকাব্যের মধ্যে কবির আত্মপ্রকাশই মুখ্য।
এডোনিস কাব্যটি শোকগাথা। কেবলমাত্র শোকগাথা নয়, এটা হল Pastoral Elegy বা রাখালিয়া শোকগাথা। স্বভাবতই কাব্যটির দেহে যে বিচিত্র প্রকাশ ঘটেছে, যে শৈল্পিক সুষমা লাভকরেছে তা সত্যিই সুন্দর। যদিও তিনি কাব্যের কাঠামোটি প্রচলিত প্রথা অনুসারে সৃষ্টি করেছেন, তবুও কাব্যটি শেলীর মনের মাধুরী মিশে একটি স্বতন্ত্র কাব্য হয়ে উঠেছে। এই কাব্যের অন্তর্নিহিত বাণী হল কবির মর্মবাণী। স্কুল বহিরাবরণের আচ্ছাদন ভেদ করে যা প্রকাশ পেয়েছে তা কবির আপন মনের কান্না ও বেদনা। প্রথমতঃ শেলী নিজেকে শোকাকুল মেষদলের সঙ্গে অভিন্ন করে নিয়ে সমাধিভূমিতে অবতীর্ণ হয়েছেন। সমাধিস্থলে শায়িত এডোনিসের মৃতদেহের সামনে উপস্থিত হয়েছেন শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করতে। তিনি নিজেকে বর্ণনা করেছেন Frail Form এবং নিঃসঙ্গ একাকীরূপে। আঁখিতে তাঁর সৌন্দর্যের অঞ্জন। তাই নিসর্গ প্রকৃতি তাঁর নিকট মহাবিস্ময়। প্রকৃতির মর্ম উদঘাটন করার জন্য তাঁর চিত্ত চির অতৃপ্ত ও অশান্ত। তিনি প্রকৃতির নগ্ন সৌন্দর্যের পাথারে আঁখি ডুবিয়ে আনন্দকে আকণ্ঠ ভরে পান করতে চেয়েছেন। Actacon যেমন পর্বত দুহিতা ঝরনার স্বচ্ছ জলে কেলিবিলাসরত ডায়নার নগ্ন সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং ডায়নার অভিশাপে মৃগীরূপে ধারণ করার ফলে আপন শিকারিগণ কর্তৃক নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন তেমনি শেলীও প্রকৃতির নগ্ন সৌন্দর্য দর্শন করে আপন চিত্তের অশান্ত ও বিক্ষুব্ধ শরাঘাতে নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করেছিল। প্রকৃতির সৌন্দর্য, সান্নিধ্য ও প্রেমের প্রতি কবির যে কি বিপুল উন্মাদনা এ কাব্যে তারি প্রকাশ ঘটেছে।
কবির চিত্ত বন্ধনহীন দুরন্ত ব্যাঘ্রের মত। কবির চিত্তের মধ্যে দুরন্ত প্রেম সঞ্চিত ছিল তা নিঃসঙ্গ তার বিষাদে পরিপূর্ণ। সেই দুরন্ত যৌবন প্রেম জাগতিক জীবনের রক্তাক্ত বেদনায় শৃঙ্খলিত। সেই শৃঙ্খলের গুরুভার কবির জীবন দুর্বিষহ, সে শৃঙ্খলের ভার কবির বুকে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে আছে তা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্পর্কে কবি সংশয় প্রকাশ করেছেন। কবি আপন মনের এই বিষাদকে স্তিমিত প্রদীপ, বর্ষণমুখরিত বর্ষা, এবং তটের প্রান্তে ভগ্ন তরঙ্গের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কবি এই রোমান্টিক বিষাদ নিঃসঙ্গতাকে উদ্ভূত করেছেন। কবি সারা জীবনব্যাপী আপন লক্ষ্যের পানে ছুটে চলেছেন। সেই যাত্রাপথের তিনিই একমাত্র পথিক। তাঁর জীবনের কোন দোসর নেই। তাই কবির নিঃসঙ্গতাকে কবির চিত্তকে বেদনার কালো আলোকে ভরিয়ে তুলেছে।
শেলী অর্থ সমন্বিত আভরণে সজ্জিত। প্যানসিস এবং ভায়োলেট ফুলের চূড়ায় কবির মস্তক শোভিত। প্যানসিস হল চিন্তার প্রতীক, ভালোলেট হল মাধুর্যের প্রতীক। একটি সুক্ষ্ম বা হালকা বর্শা কবির হাতে। বর্শাটির শিরোপরি সাইপ্রেসফল প্রোথিত। সাইপ্রেস ফল মৃত্যুর প্রতীক। আইভিলতা বর্শাটির চতুর্দিকে মণ্ডিত। Ivy-লতা চিরন্তন বন্ধুত্ব এবং জীবনের প্রতীক। সুতরাং শেলীর হস্তধৃত বর্শা, একদিকে বিষাদ, অন্যদিকে জীবনের প্রতীক। একদিকে Destroyer অন্যদিকে Preserver-এর সমন্বিত রূপ।
ইউরেনিয়া যখন কবির পরিচয় জিজ্ঞাসা করেছে তখন কবি তাঁর ক্ষতচিহ্ন লাঞ্ছিত কপোলদেশ দেখিয়ে বলেছেন যে, যীশুখ্রীষ্টের মত তাঁর ক্ষতগুলি জীবস্ত। কারণ লোকে তার প্রতি অন্যায়ভাবে বিশদ আচরণ করেছে এবং তাঁকে যীশুখ্রীষ্টের মতই ক্ষত-বিক্ষত করেছে। শেলী নির্ভীক কবি।
যাকে তিনি পরমসতা বলে মনে করেছেন তাকে প্রকাশ করতে তিনি কোন দ্বিধা করেননি। ইংলণ্ডের প্রথা সর্বস্ব প্রাচীন ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। তার জন্যে কবিকে ঘৃণার পাত্র শিরে বহন করতে হয়েছিল।
এ ব্যাপারে কীটস্ ও মিলটনের সঙ্গে কবির সাদৃশ্য রয়েছে। কীটসকে অপদার্থ পত্রিকাগুলি নখদন্তাঘাতে যেমন ক্ষত-বিক্ষত করেছিল তেমনি শেলী নিজেও তাদের সমালোচনার হাত থেকে নিস্তার পাননি। মিলটন যেমন রাজা ও চার্চের বিরুদ্ধে অনলস সংগ্রাম করেছিলেন, শেলীও তেমনি খ্রীষ্টীয় সংস্কারে আচ্ছন্ন প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। শেলী বায়রণকে একই কারণে Pil-grim of Eternity বলে উল্লেখ করেছেন। বায়রণ সমালোচকদের বরদাস্ত করেন নি। তিনি পত্রাঘাতে তাদের নিরস্ত করেছিলেন। শেলী ইউরেনিয়া বিলাপের মধ্যে দিয়ে তীব্রভাষায় সমালোচকদের নিন্দা করেছেন এবং তাদের ভয়ংকর চিত্র অংকন করেছেন।
শেলী আপন জীবনের অন্তিমকালের শান্তির পারাপার তরুণী ভাসাতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। শেলীর এই কামনা যেন মৃত্যুর পূর্বাভাষ।
প্রঃ Eve of St. Agnes কবিতাটি প্রেম কাহিনী অবলম্বনে রচিত হলেও তা সত্যকার প্রেম কাব্য নহে।
উঃ কবির এই কাব্যের কাহিনীর পটভূমি হল একটি নিশীথ রজনী। প্রেমিক-প্রেমিকার জীবনে সেই বিশেষ রজনীটি একটি গভীর অর্থবহন করে। কারণ প্রেমের চরম পরীক্ষা হবে সেই রজনীতে। প্রণয়িনী ম্যাডলিনের অন্তঃকরণ সেই সুখ স্বপ্নে বিভোর। এত বিভোর যে বাস্তব পৃথিবীর নৃত্য, সঙ্গীত ও কলগুঞ্জন তার কাছে হয়ে গিয়েছে অবাস্তব। তার কর্ণকুহরে সে সব প্রবেশ করে না।
“Full of this whim was thoughtful Madline
The music, yearning like a God in pain
she scarcely heard…..
…..her heart was other where
she sighed for Agnes dream, the sweetest of the year.
এই বিভোরতা, তন্ময়তা ও একাগ্রতা নিয়ে শুচিশুভ্র পবিত্রদেহে রোমান্টিক নায়িকা সেই বিশেষ মুহূর্তটির জন্য প্রতীক্ষমানা। তাই উৎসব মুখরিত রজনী তার কাছে অর্থহীন। তবুও তাকে এই উৎসবে অংশ গ্রহণ করতে হয়েছিল। নিষ্ফল হয়েছিল তার প্রাণহীন প্রচেষ্টা। ফলে ম্যাডলিনের আচরণে সমাগত তরুণ যুবকের দলের মধ্যে কেউ হল ক্ষিপ্ত, কেউ হতাশাগ্রস্ত, কেউ দেখল প্রশংসার দৃষ্টিতে, কারও কণ্ঠ হতে উত্থিত হল চাপা ক্রন্দন। কারণ ম্যাডলিনের অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণের মধ্যে কোন প্রাণ ছিল না।
She danced along with vague regardless eye.
সুতরাং যে উৎসবের সঙ্গে তার প্রাণের সংযোগ নেই সেই উৎসব প্রাঙ্গন প্রতিমূহূর্তে তার কাছে হয়ে উঠে বেদনাদায়ক। সে কামনা করে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে-
So purposing each moment to retire
She lingered still.
তাই সে ভীত চকিত কপোতীর মত- “Like ring-dove frayed and fled”, একসময় উৎসব থেকে পালিয়ে এসে একটা রহস্যময় কক্ষে প্রবেশ করল, যে কক্ষের বাতায়নটিতে নানা
ফুল-পল্লব-লতার চিত্রাঙ্কন, নানা রত্ন ও প্রবালে খচিত, নানা কারুকার্য সমন্বিত দামাস্কাস সিল্কের মত প্রজাপতির চিত্র, সহস্র নাইট ও ম্লান সন্ন্যাসীর চিত্র অঙ্কিত। বাতায়ন পথ দিয়ে চাঁদের জ্যোৎস্না ধারা কক্ষের মধ্যে পড়ে নানান রঙের আলোকের খেলা শুরু করেছিল। সেই আলোকের বন্যা ম্যাডলিনের বক্ষে পড়ে অপূর্ব রূপ ধারণ করেছে। দেবতার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানাতে ম্যাডলিন নতজানু হয়ে বসলো। স্বপ্নলোকের অধিবাসিনী-ম্যাডলিন হয়ে উঠেছে-Splendid angel.
প্রার্থনা শেষে ম্যাডলিন একে একে অঙ্গের আভরণগুলো খুলে ফেললো। প্রায় নিরলিভরণা অর্ধাঙ্গআবৃতা ম্যাডলিন মৎস্য কন্যার ন্যায় প্রতিভাত হল। ধীরে ধীরে দুগ্ধ ফেননিভ শয্যায় শয়ন করে একমনে ধ্যান করতে করতে ম্যাডলিনের আঁখির-পাতায় নেমে এল নিদ্রা। ম্যাডলিন প্রিয়তমের স্বপ্নে ভেসে-চলল দূরে বহুদূরে অচিনপুরে।
অন্যদিকে Porphyro প্রেমের প্রবল আকর্ষণে সেই রজনীতে চিরশত্রুর গৃহে এসে উপস্থিত হল। যদিও পরফাইরো জানে যে এই গৃহের রক্ত-পিপাসু শত্রু যে কোন মুহূর্তে তার জীবন নিতে পারে। সে জানে-hundred swords will strom his heart, প্রেমের পথ বন্ধুর। মৃত্যুর ভয়াবহতা সত্ত্বেও প্রেমিক প্রেমের অভিসারে বাহির হয়। কোন ভয় তার পথরোধ করতে পারে না। পরফাইরো চিরশত্রুর গৃহে মৃত্যুভয় জেনেও প্রবেশ করতে দ্বিধাবোধ করেনি। যেমন করেনি-রোমিও জুলিয়েটদের গৃহে প্রবেশ করতে। কিন্তু গৃহে প্রবেশ করতে গিয়ে তাকে বৃদ্ধার অনুগ্রহ লাভ করতে হয়েছে যে বৃদ্ধা প্রথমে তাকে ম্যাডলিনের কক্ষে প্রবেশ করতে দিতে রাজি হয়নি। পরে যখন পরফাইরো বলেছে-
“I will not harm her, by all saints I swear.”
Good Angela, believe me by these tears.
Or I will, even in a moments, space.
Awake, with horrid shout, my foeman’s ear,
And beard them, though they be more fanged,
than wolves and bears.
বৃদ্ধার হৃদয় তরুণ প্রেমিকের এই আর্তনাদে বিগলিত হয়েছে এবং ম্যাডলিনের কক্ষের নিকটবর্তী গোপনস্থানে তাকে নিয়ে এসে-হাজির করেছে। সেখান থেকে ম্যাডলিনের রূপদর্শন করে নায়ক জ্ঞান হারিয়েছে। মূর্ছাভঙ্গের পর নিদ্রিতা ধ্যানরতা ম্যাডলিনের-কক্ষে প্রবেশ করে তার কর্ণকুহরে কথার মধুবর্ষণ করেছে। তাতেও যখন ম্যাডলিনের ঘুম ভাঙ্গেনি তখন বীণাতন্ত্রে সঙ্গীতের সুর ধ্বনিত করেছে। তখনও ম্যাডলিনের তন্দ্রাজড়িমা আঁখিতে স্বপ্নের রেশ। তাই মনে মনে স্বপ্নে সে Porphyro-র যে মূর্তি অংকন করেছিল তা দেখতে না পেয়ে তার কণ্ঠে করুণ বিলাপ ধ্বনিত হল
“Oh, leave me not in this eternal woe-
for if thou diest my love, in know not where to go.”
তারপর যখন সত্য সত্যই স্বপ্নের আবেশ কেটে গিয়ে তার প্রিয়তমকে চাক্ষুষ করল তখন
পরফাইরো তাকে শুধালো,
“My madeline, sweet dreemer, lovely bride
Say, may I be for aye they vassel blest.”
ম্যাডলিনের সম্মতিলাভের পর Porphyro তাকে গৃহত্যাগের প্রস্তাব করে বলেছে,
Let us away, my love with happy speed,
There are on ears to hear, or eyes to see.
for over the Southers moors, I have a home for theer,
বেরিয়ে যাবার সময় তাদের কেউ দেখতে পাবে না কারণ বাইরে তখন উন্মাদিনী ঝটিকার তাণ্ডব নৃত্য শুরু হয়েছে। উৎসবের সভাস্থল ক্লান্ত। সবাই নিদ্রামগ্ন। কিন্তু কোথায় যাবে? সেও এক অচেনা, অজানা প্রকৃতির রাজত্ব। যেখানে সমাজ নেই, মানুষ নেই, মানুষের কোলাহল। লোকালয়বিহীন নির্জন সেই প্রকৃতি রাজ্যই হবে তাদের বাসভূমি।
সুতরাং এটা একটি সত্যকার প্রেমকাব্য নহে। সত্যকার প্রেম-কাব্যের কাহিনী রচনা করা কবি কীটসের উদ্দেশ্য ছিল না। তাই তিনি বস্তুগত ভাবকল্পনার মনকে নিয়োজিত করে বা আত্মনিরপেক্ষ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ কাহিনী রচনার দিকে নজর দেননি। নজর দেননি চরিত্র-চিত্রণ ও অ্যাকশনের দিকে। নজর দেননি পরিণতির একটা বাস্তব রূপদান করতে। আসলে কবি রোমান্সের স্বপ্ন কল্পনার জগতে ডানা মেলে দিয়েছেন। তাই এ কাব্যে শুধু স্বপ্নের রাজত্ব, মায়াময় কল্পনার জগৎ। এ কাব্যে প্রেমের অনির্দেশ্য বেদনার ক্ষেপা সুর প্রবলভাবে ধ্বনিত। এ কাব্য রোমান্টিক প্রেমের ঘনীভূত নির্যাস।
প্রশ্ন: The Eve of St. Agnes-এর পরিবেশ ইতিহাসের মধ্যযুগ নয়, রোমান্সের স্বপ্নলোক।
উঃ উনবিংশ শতাব্দীতে সমস্ত রোমান্টিক কবির কাছে মধ্যযুগ ছিল রোমান্সের উৎস। মধ্যযুগের জীবন রহস্য, নীতি ও মর্মকথা হল রোমান্সের জগৎ। মধ্যযুগের কতকগুলি সংস্কার ছিল সহজ, সরল ও অকৃত্রিম। এইসব সংস্কার প্রবণতা কবিদের প্রেরণার আদিম উৎস ছিল। মধ্যযুগের জীবনযাত্রা উঁচু সুরে বাঁধা। রণ-উন্মাদনা, দুঃসাহসিক অভিযান ও শিভালরি প্রেম সে যুগের আদর্শকে সম্মুখে রেখে কবি রোমান্সের স্বপ্নলোকে পাড়ি জমিয়েছেন।
কবি তাঁর প্রণয়িনী-Fanny Browne-এর সঙ্গে ১৮৮১ সালে মিলিত হন। কিন্তু তার সঙ্গে ফ্যানীর পরিণয়ের ব্যাপারে কতকগুলি বাধা ছিল। এই বাধা কবিকে দুঃখ ও বেদনা দিয়েছে। কবি সেই বেদনার হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য মধ্যযুগের দূর অস্পষ্টলোকে পাড়ি দিয়েছেন। Isabella কাব্যে আপন নিঃসঙ্গতার ব্যথা ও বেদনার ব্যাকুল বাঁশরী ধ্বনিত হয়েছে। Eve of St. Agnes কবিতায় কবি মধ্যযুগের একটি সহজ সরল অকৃত্রিম সংস্কার ও বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে একটি প্রেমের স্বপ্নলোক রচনা করেছেন।
মধ্যযুগের পরিবেশ রচনায় সূক্ষ্ম কারুকার্য কীটসে-র কবিতায় অভাব। কোলরীজ যেমন মধ্যযুগের পরিবেশ রচনায় একটি রেখার টানে তাকে জীবন্ত করে সৃষ্টি করতে পারেন কীটস্ সেইভাবে বাস্তব চিত্র অংকন করতে পারেন না। কারণ কোলরীজের রচনায় আছে নাটকীয় চমৎকৃতি যা কীটসের মধ্যে ছিল না। মধ্যযুগীয় চিত্র রচনায় কীটস্ হলেন তৈলচিত্রকর। মধ্যযুগের দুর্গের অভ্যন্তরের যে বর্ণনা তিনি করেছেন তা যেন কল্পনার ক্যানভাসে রঙের পর রঙ দিয়ে ছবি এঁকেছেন। প্রত্যেকটি ছবিই কিন্তু স্বচ্ছ, স্পষ্ট। প্রচণ্ড শীতের রাতের নির্জনতার যে ছবি তিনি এঁকেছেন তা জীবন্ত বাস্তব। কিন্তু কোলরীজের সঙ্গে কীটসের পার্থক্য হল এখানে যে কোলরীজ যেখানে আভাষে ইঙ্গিতের মাধ্যমে সমগ্র পরিবেশটিকে রূপ দিতে পারেন কীটস সেখানে পুরো ছবিটা এঁকে পাঠকের দৃষ্টির সম্মুখে তুলে ধরেন। এই কাব্যে কবি পুরোপুরি মধ্যযুগের ছবি আঁকতে সমর্থ হন নি। Boddice, Carpet প্রভৃতি যে শব্দগুলি সে যুগে ব্যবহৃত হতোনা কবি কীটস সেগুলিও ব্যবহার করেছেন।
দ্বিতীয়ত, Porphyro যেন বাস্তব জগতের মানুষ নয়। সে যেন ঠিক মধ্যযুগের বীর নাইট নয়। তার আচরণও বীর নাইটদের মত না। তার আচরণে অলৌকিকতার ছাপ রয়েছে। কারণ যারা তার চিরশত্রু তারা’blood thirsty’, তারা ‘Hayeana Foeman’, তাদের hundred swords will storm his heart, যে বাড়ীতে শুধু কুকুরটা নয়, যেখানে- “Not one breast af fords his any mercy” এইসব জানা সত্ত্বেও, সবার সতর্ক চোখকে ফাঁকি দিয়ে সেই বাড়ীর অভ্যন্তরে তার উপস্থিতি নিঃসন্দেহে একটি অলৌকিক ব্যাপার। তাই বৃদ্ধা Angela বলেছে-
“Thou must hold water in a witch’s sieve And be bige-lord of all the elves and Fays To venture so.”
এরপর কবি ম্যাডলিনের প্রার্থনা ও তার তনুর সুষমার যে বর্ণনা দিয়েছেন তাও রোমান্সের আতিশয্যে ভরা। সে যেন বাস্তব জগতের নারী নয়, সে যেন “mermaid in a sea weed.” অথবা সে যেন একটা ফুটন্ত গোলাপ আবার কুঁড়ি হবার অপেক্ষায় রত-“as though a rose should shut and be a bud again.” ম্যাডলিন কবি মানসের এক বৃত্তহীন গোলাপের লাবণ্য বিলাস। তার মধ্যে যে রহস্য বিজরিত তাতে মাটির গন্ধ আদৌ নেই। মধ্যযুগের রোমান্টিক নায়িকার মত তার আচরণও নয়। সে যেন একটি স্বপ্ন একটি সুর। বাতাসে ভেসে ভেসে বেড়ায় দেয় না তার ঠিকানা।
মধ্যযুগের একটি বাতায়নের সঙ্গে কবি বর্ণিত বাতায়নের যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। কারণ কবির দৃষ্টিতে বাতায়নেও এক অপূর্ব রহস্যময় জগৎ হয়ে উঠেছে। এ যেন “charmed magic case-ment-এর মত, যা opening on the foam of perilious seas, in fairy lands for-lorn.”
সবশেষে পলায়নের জন্য Porphyro-র মিলনের বাসর-কুঞ্জ মাটির পৃথিবীর নির্দিষ্ট কোন পরিচিত ভূমিতে নহে তা অচেনা, অজানা, অদেখা কোন পর্বত সমাচ্ছন্ন উপত্যকা।
এই সব আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে যদিও কবি মধ্যযুগকে বেছে নিয়েছেন তাঁর কাব্যের পটভূমিরূপে, তবুও মধ্যযুগের বাস্তব বর্ণনা দেওয়া বা দুঃসাহসিক কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে ঘটনার বৈচিত্র্য বর্ণনা করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি প্রেমের আত্যন্তিক অনুভূতির আলোকে রোমান্সের জগতে পাড়ি। মোছেন। রোমান্টিক প্রেমের সোনার আলোক যেন নভস্তলে হয়েছে পরিব্যাপ্ত। কোন সমালোচকের মতে “We may say that Madeline is Fanny and Keats Porphyro.” অর্থাৎ ম্যাডলিন হল ফ্ল্যানী এবং পরফাইরো হল কীটস্ স্বয়ং। তাদের প্রেমের রহস্যময়তা যেন এখানে প্রাধান্য পেয়েছে বেশি-Prof. Hales-এর ভাষায়- “We are borne into the land of enchantment. We feel the air of romance blowing around us.”
স্কট ও বঙ্কিমচন্দ্র
বায়রণের কবি প্রতিভার প্রচণ্ড বিস্ফোরণে দিশেহারা হয়ে স্কট কাব্যরচনার জগত পরিত্যাগ করে উপন্যাস জগতে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং নবতন বিষয়বস্তুর রূপসৃষ্টি করে সে জগতে তুলেছিলেন আলোড়ন। কারণ স্কট যে বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করে উপন্যাস সৃষ্টি করেছিলেন সেই একই বিষয়বস্তু নিয়ে কাব্য রচনা করলেও তিনি আলোড়ন তুলতে পারতেন না। উপন্যাসের মধ্যে বিষয়বস্তুকে বৈচিত্র্যে ভরিয়ে জীবন্ত করে তোলার যে সুযোগ ছিল কাব্যের মধ্যে তা ছিল না। স্কট অবশ্য ইতিহাসের ঘটনাকে নিয়ে কাব্য রচনা যে করেন নি এমন নয়। “দি লে অব দি লাস্ট মিনস্ট্রেল” (১৮০৫), “মারমিয়ন” (১৮০৮), “দি লেডী অব দি লেক” (১৮১০) প্রভৃতি কাব্য রচনা করেছেন কিন্তু তাতে পাঠকেরও যেমন মন ভরেনি, তেমনি লেখকেরও ভরেনি। তাই স্কটকে উপন্যাসের জগতই বেছে নিতে হয়। ১৮১৪ সাল থেকে কাব্য রচনা করা ছেড়েই দিলেন।
স্কট ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনার পথিকৃৎ। ইংরাজি সাহিত্যে ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে স্কটই শ্রেষ্ঠ। কারণ যে বৈশিষ্ট্যগুলির জন্যে তিনি শ্রেষ্ঠত্বের আসন লাভ করেছেন, সে বৈশিষ্ট্যগুলি অন্যের রচনায় অনুপস্থিত। প্রথমতঃ, স্কটের পূর্ববর্তী উপন্যাস রচয়িতারা সমসাময়িক বাস্তব জীবনকে বিষয়বস্তু করে কাহিনী রচনা করেছেন যা স্কট করেন নি। তিনি সুদূর অতীতের ইতিহাসের অস্পষ্ট কাহিনীকে অবলম্বন করে উপন্যাস রচনা করেছেন। দ্বিতীয়তঃ, তাঁর পূর্ববর্তী উপন্যাস রচয়িতাগণ বুর্জোয়া সমাজ কর্তৃক সৃষ্ট নবতন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবন চিত্র অংকন করেছেন। কিন্তু স্কট সামন্ততান্ত্রিক যুগের রাজমহিমা ও বীরত্বধর্মের জীবন আলেখ্য রচনা করেছেন। তৃতীয়তঃ, অতীত চারণার ব্যাপারে যেমন তাঁর নিষ্টার অভাব ছিল না, তেমনি ছিল না তাঁর আদর্শের অভাব। একটি সুনির্দিষ্ট আদর্শের ওপর নির্ভর করে তিনি অতীতের জীবনচিত্র রূপায়িত করেছেন। সে আদর্শ হল মধ্যযুগীয় বীরত্ব, প্রেম ও ভালোবাসার আদর্শ। এই আদর্শই ছিল তাঁর কাছে বাস্তব। আর সেই বাস্তবতার মৃত্তিকাতেই তিনি অতীতের অস্পষ্ট জীবনের জীবন্ত ও বাস্তব মূর্তি রচনা করেছেন। সমালোচক উণা পোপ হেনিসির মতে- “For him the past, often by virtue of some chance revolation or contact, ceased to be, the past and became in his conciousness, as immediate as the present… For him dry bones re-assembled themselves and became clothed in flesh. In him the past was re-born, re-animated, re-realised and ceased in any dry-as-dust sense to be history.”
সুতরাং ধূসর ইতিহাসের নিছক যুদ্ধ বিগ্রহের ঘটনা বা নরনারীর নিছক প্রেমের কাহিনীকে অবলম্বন করে তিনি উপন্যাস রচনা করেননি। তিনি নির্দিষ্ট আদর্শকে সম্মুখে রেখেছেন এবং সেই আদর্শকে নিষ্ঠার সঙ্গে বাস্তবায়িত করেছেন। চতুর্থতঃ, এই নিষ্ঠা ছিল বলেই তিনি জীবন চিত্রের সঙ্গে যুগ চিত্র এবং পরিবেশ রচনাকেও যথাযথভাবে অংকন করেছেন। এই যুগ চিত্র রচনায় তিনি এমনই নৈষ্ঠিক যে একটি যুগের ধ্যানধারণা, ভাব-ভাবনা, ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষগুলির চরিত্র নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন, অতীত যুগের মানুষগুলির আচার-আচরণ ও তাদের প্রকৃতিগত ধর্মের জীবন্তরূপ তিনি সৃষ্টি করেছেন। আসলে স্কট মনে-প্রাণে ছিলেন সামন্তযুগের প্রতিনিধি। তাঁর নিজের জীবনাচরণের মধ্যে যেমন তা প্রকাশ পেয়েছে তেমনি বিভিন্ন লোক কাহিনী থেকে সংগ্রহ করেছেন বিপুল উপাদান। যুগে যুগে লোক কাহিনী বা লোক সাহিত্যের মধ্যে বীরত্বের মহিমা ও জয়গান ঘোষিত হয়ে এসেছে। এইসব লোক কাহিনী ছিল তাঁর রচনার উৎস। এই লোক কাহিনীকে অবলম্বন করে তিনি ইতিহাসের সত্যকে কল্পনার রঙে রঞ্জিত করেছেন, তার ফাঁকগুলিকে ভরাট
করে তুলেছেন। ফলে তাঁর রচনায় প্রকাশ পেয়েছে মধ্যযুগীয় জীবনযাত্রার এক বর্ণাঢ্য মিছিল। যেমনি তার বৈচিত্র্য তেমনি তার রাজকীয় ঐশ্বর্য ও ধ্রুপদী গাম্ভীর্য। স্কটের রচনা তাই উঁচুসুরে বাঁধা সে সুর উদাত্ত ধ্বনি গম্ভীরময়।
যেহেতু স্কটের রচনা জীবন সত্যের অনুসারী, সেহেতু স্কট উপলব্ধি করেছিলেন যে মানুষ হল যুগ লালিত, যুগ চালিত এবং যুগ পালিত এবং যুগকে অতিক্রম করে মানুষের স্বতন্ত্র কোন অস্তিত্ব নেই সেইহেতু তিনি মানুষকে যুগ মানব করেই রচনা করেছেন। তাই যুগের পরিবর্তন ঘটে গেলেও অতীত যুগকে জানার জন্যে ইতিহাসের চেয়ে স্কটের উপন্যাসই যেন সে প্রয়োজন মেটাতে পারে। শুধু তাই নয় তাঁর রচনায় একটি যুগের আদর্শায়িত রূপ প্রকাশ পেয়েছে বলে তাঁর রচনা পাঠকের কাছে সেদিক থেকে আদরণীয় হয়ে থাকবে।
কোন কোন সমালোচক মনে করেন যে স্কট ইতিহাসের ঘটনা বা ঘটনা বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন কিন্তু মানব মনের গভীরে প্রবেশ করার সাধ্য তাঁর ছিল না। স্কট মানব মনের গভীরের ভাবনাকে ব্যাখ্যা না করলেও মনের উপরিতলের যে চিত্র অংকন করেছেন তা থেকে গভীরের ভাবনাকে বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না। হ্যাজলিটের ভাষায় বলা যেতে পারে- “Scott drew his charac-ters from nature instead of creating them out of his imagination.”
স্কট চরিত্রের জটিলতাকে কোথাও অবলোকন করেন নি। তিনি মানুষকে সহজ সরল পবিত্রতা ও বীরত্বের প্রতিমূর্তি হিসাবে দেখেছেন। অর্থাৎ মানব প্রকৃতিতে যা তাই তিনি দেখেছেন। দুর্জনকে দুর্জনভাবে দেখেছেন এবং সরলতাকে সরলভাবেই দেখেছেন। এদিক থেকে বিচার করলে হ্যাজলিটের মন্তব্যই যথার্থ-“Sir Walter is an immitator of nature and nothing more.” মানব মনের জটিল রহস্যভেদ করা তাঁর লক্ষ্য ছিল না। চরিত্রকে দুর্জেয় করে তোলাও তাঁর ইচ্ছা ছিল না। তিনি সাধারণ মানুষের জীবন চিত্রকে কয়েকটি রেখার টানে ফুটিয়ে তুলেছেন। আসলে তিনি জীবনের মহত্তর দিকটা ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা তিনি পছন্দ করেন নি। তাছাড়া ঘটনাবহুল ঐতিহাসিক উপন্যাসে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সুযোগও খুব কম।
স্কটের প্রভাব কেবলমাত্র তাঁর দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না তা স্বদেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশেষতঃ বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রভাব অপরিসীম। বাংলা সাহিত্যে ঐতিহাসিক উপন্যাস রচয়িতাদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রই সমধিক প্রসিদ্ধ। রমেশচন্দ্র খাঁটি ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করলেও বঙ্কিমচন্দ্রের খ্যাতিকে অতিক্রম করতে পারেন নি। অন্যদিকে বঙ্কিমও স্কটের খ্যাতিকে স্নান করতে অক্ষম হয়েছেন। কারণ স্কট ও বঙ্কিমের মধ্যে ভাবগত সাদৃশ্যের পরিবর্তে পার্থক্যই ছিল প্রবল ও গভীর। প্রথমতঃ, বঙ্কিমচেন্দ্রর ভাবনার ভিত্তিমূল হল স্বদেশ ভাবনা। স্বধর্ম, স্বদেশ ও অত্যধিক স্বজাতিপ্রিয়তা তাঁর ভাবনাকে করেছে নিয়ন্ত্রিত। সে কথা তিনি কবুল করেই বলেছেন বারম্বার। রাজসিংহ উপন্যাসের ভূমিকায় বলেছেন: “হিন্দুদিগের বাহুবলই আমার প্রতিপাদ্য। উদাহরণস্বরূপ আমি রাজসিংহকে লইয়াছি।” প্রবল দেশভক্তি ও হিন্দুয়ানির প্রতি একান্ত অনুরাগ বঙ্কিমচন্দ্রের পক্ষে সত্যকারের ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। উদ্দেশ্য যেখানে প্রবল সেখানে সাহিত্যসৃষ্টি যথাযথ হতে পারে না। এ ব্যাপারে তিনি নিজেই সচেতন ছিলেন বলেই বলতে পেরেছেন- “পাঠক মহাশয় অনুগ্রহপূর্বক আনন্দমঠ বা দেবী চৌধুরাণী-কে ঐতিহাসিক উপন্যাস বিবেচনা না করিলে বড়ই বাধিত হইব।”
স্কটের মধ্যেও কি স্বদেশ প্রেম ছিল না? স্বদেশপ্রেম না থাকলে পিউরিটানিজম ও জ্যাকোবাইট আন্দোলনের সময়কার স্কটদেশীয় জীবন তাঁর উপন্যাসের বিষয়বস্তু হতে পারতো না। স্বদেশের ইতিহাসের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল বলেই ইতিহাসকে করেছেন তাঁর উপন্যাসের উপাদান। কিন্তু স্কুটের স্বাদেশিক চেতনার সঙ্গে বঙ্কিমের স্বাদেশিক চেতনার প্রভেদ অনেকখানি। বঙ্কিমের স্বাদেশিক চেতনার মধ্যে রয়েছে পরাধীনতার জ্বালা ও সাম্প্রদায়িকতার ছোঁয়া। স্কটের মধ্যে এসব ছিল না। স্কট তাই পরিপূর্ণভাবে অতীতচারী হতে পেরেছিলেন, যা বঙ্কিম হতে পারেন নি। বঙ্কিম আধুনিক কালের স্বদেশ প্রেমের প্রয়োজনে ইতিহাসকে অবলম্বন করে উপন্যাস রচনা করেছেন। কিন্তু স্কট মানবিক আদর্শের প্রয়োজনে অতীতকে জীবন্ত করে সৃষ্টি করেছেন। তাই স্কট অতীতের খুঁটিনাটি জীবন চিত্রের বর্ণনায় যতখানি দক্ষ, ততখানি দক্ষ বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন না। তিনি স্কটের মত মধ্যযুগের জীবন চিত্র বর্ণনায় পাতার পর পাতা ব্যয় করেননি এমনকি মধ্যযুগের জীবনাদর্শকেও স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করে তুলতে পারেন নি। মধ্যযুগের জীবনাদর্শের দৃঢ়ভিত্তি ভূমির উপর দাঁড়িয়ে স্কট যেমন প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অতীতকে সজীব করে রচনা করেছেন, বঙ্কিমচন্দ্র তেমন করে সজীব করে সৃষ্টি করতে পারেন নি। কারণ আগেই বলেছি বঙ্কিমচন্দ্র বর্তমানের পরাধীনতার জ্বালার উপশম হিসাবে অতীত গৌরবকে যেখানে ব্যবহার করেছেন স্কট সেখানে অতীতকে একটি জাতির জীবনাদর্শরূপে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। স্কটের উপন্যাসের মূল সুর হল বীরত্ব প্রেম ও ভালবাসার আদর্শ। সেই আদর্শকে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে গিয়ে তিনি প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। রাজতন্ত্রের বীরত্ব গরিমার সঙ্গে প্রজাসাধারণের যে মধুর সম্পর্কটি অটুট ছিল তাকে তিনি যথাযথভাবে অংকন করেছেন। কারণ প্রজাসাধারণ বীরত্বের গরিমা ও মহিমাকে দেখেছে প্রশংসার দৃষ্টিতে। সেই মহিমার মানবিক মূল্যবোধ সযত্নে রক্ষা করার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত প্রজাসাধারণ। একটা গোটা জাতি মানবিক মূল্যবোধকে কিভাবে রক্ষা করে থাকে তার চিত্ররূপ অংকন করেছেন স্কট। আর বঙ্কিমচন্দ্র স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সংগ্রাম ও তার বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের ঘটনাকে কেবল বর্ণনা করেছেন। এবং তাও করেছেন দুটি পরস্পর বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির মধ্যে। তাই বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে যুদ্ধবিগ্রহ আছে, রণউন্মাদনা আছে, স্বাধীনতা সংগ্রাম আছে, নেই কেবল মানবিক মূল্যবোধকে রক্ষার জন্য রাজার এবং প্রজার মিলিত সংগ্রাম। এইখানেই স্কট এবং বঙ্কিমের পার্থক্য।
‘রাজসিংহ’ উপন্যাসে বঙ্কিম একটি প্রধান ঐতিহাসিক ঘটনাকে করেছেন বিষয়বস্তু। সে ঘটনা হল আওরঙ্গজেবের সঙ্গে রাজসিংহের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে রাজ সিংহের জয় এবং আওরঙ্গজেবের ঘটেছে পরাজয়। ঘটনাটি ঐতিহাসিক সত্য। সুতরাং ‘রাজসিংহকে’ ঐতিহাসিক উপন্যাস না বলে উপায় নেই। কিন্তু স্কটের “আইভ্যানহো”? এখানে যেটি মূল ঘটনা সেটি হয়েছে গৌণ। আর গৌণ ঘটনাটি পেয়েছে প্রাধান্য। মূল রাজনৈতিক ঘটনাটি হল সিংহহৃদয় রাজা রিচার্ড গেছেন ধর্মযুদ্ধে যোগদান করতে। তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে তাঁর ভাই জন কয়েকজন সামন্ত সেনাপতির সাহায্য নিয়ে সিংহাসন দখলের ষড়যন্ত্র করলো। ইতিমধ্যে সিংহহৃদয় রাজা যুদ্ধ থেকে ছদ্মবেশে ফিরে এলেন এবং প্রজাসাধারণের সহযোগিতায় সিংহাসন অধিকার করলেন। রাজা রিচার্ড এর সঙ্গে প্রজাসাধারণের একটা অন্তরের মিল ছিল। কারণ সিংহহৃদয় রাজা রিচার্ড প্রজাসাধারণের মন জয় করতে ইতিপূর্বে সক্ষম হয়েছিল। রাজা রিচার্ড যুদ্ধ থেকে ইংলণ্ডে ফিরে ছদ্মবেশ ধারণ করে আত্মগোপন করে থাকেন। লোকে তাঁকে ‘কৃষ্ণমতি নাইট’ বলেই জানে। যেদিন তিনি ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করলেন সেদিন প্রজাসাধারণের আনুগত্য প্রকাশ পেল তাঁর খ্যাতি। প্রজা-সাধারণ জনকে মেনে নিতে পারেননি। কারণ জন অত্যাচারী ও অন্যায়কারী। জনের অত্যাচারী ও অন্যায়কারী সামন্ত সেনাপতিদের বিরুদ্ধে প্রজাসাধারণ প্রবল সংগ্রাম করে পুনরায় রিচার্ডকে রাজা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে।
এই ধরনের ঘটনা ‘দুর্গেশ নন্দিনীতে’ও নেই। বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনীতে প্রধান ঘটনা হল রাজপুত বীর জয়সিংহের সঙ্গে বীরেন্দ্রসিংহের কন্যা তিলোত্তমা ও কতলুখার কন্যা আয়েষার প্রেম। এখানে প্রেমের ঘটনা যতখানি প্রাধান্য পেয়েছে মোগল ও পাঠানের যুদ্ধ ততখানি প্রাধান্য পায়নি। এই উপন্যাসের কাহিনী আইভ্যানহো উপন্যাসের নায়ক আইভ্যানহো, তার পিতা সেড্রিকের পালিত কন্যা রোয়েনা ও ইহুদী কন্যা রেবেকার প্রণয় কাহিনীর মত। তবে আইভ্যানহোর সঙ্গে রোয়েনার প্রেম বাল্য প্রেম। বাল্যকাল থেকেই দুজনেই প্রেমে আবদ্ধ। কিন্তু তাদের মিলনের পথে বড় বাধা আইভ্যানহোর বাবা সেড্রিক স্বয়ং। তিনি চেয়েছিলেন রোয়েনার সঙ্গে এথেলষ্টেনের বিবাহ দিতে।
আইভ্যানহো ধর্মযুদ্ধে যোগ দিতে যান রিচার্ডকে সমর্থন করে। যেহেতু রিচার্ড স্যাকসন ছিলেন না সেজন্য সেড্রিক তাঁকে সমর্থন করতেন না। রিচার্ডকে সমর্থন করার জন্য আইভ্যানহোকে তার পিতা ‘ত্যাজ্যপুত্র’ বলে ঘোষণা করে। দীর্ঘদিন আইভ্যানহো দেশ ছাড়া। তার ভাগ্যে কি ঘটেছে কেউ জানে না। রাজা রিচার্ডের অনুপস্থিতিতে দেশের শোচনীয় অবস্থা। জন এবং তার অনুচরদের শাসনে ও শোষণে জর্জরিত জনগণ। তবু লিসিষ্টারের অ্যাসবিতে আয়োজন করা হয়েছে ক্রীড়ানুষ্ঠান। সেই ক্রীড়ানুষ্ঠান দেখবার জন্য দেশের লোক ভীড় করেছে। সেখানে সেড্রিক ও রোয়েনা এসেছে, এসেছে ইহুদী আইজ্যাক আর তার মেয়ে রেবেকা। এই ক্রীড়ানুষ্ঠানে সেরা সেরা নাইটগণ যোগদান করেছে। তাদের বিরোধিতা করার কারুর সাহস নেই। আইভ্যানহো ছদ্মবেশ ধারণ করে সেই ক্রীড়ানুষ্ঠানে যোগ দিয়ে নাইটদের পরাজিত করে। এই অনুষ্ঠানে আইভ্যানহো আহত হয়। গুরুতর আহত আইভ্যানহোকে নিয়ে ইহুদী আইজ্যাক আর তার মেয়ে রেবেকা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু জনের সমর্থনপুষ্ট নাইটরা কুমারী রোয়েনা ও রেবেকাকে অপহরণ করে বিয়ে করার মতলব করে এবং পথের মধ্যে তাদের সবাইকে বন্দী করে নিয়ে ফ্রন্ট-ডি-বি অফের দুর্গে বন্দী করে রাখা হল। এখানে রেবেকা পরমযত্নে আইভ্যানহোকে সেবা শুশ্রুষা করে বাঁচিয়ে তোলে। আইভ্যানহোর মনেও ধরে রঙ। রেবেকা ভালবেসে ফেলে আইভ্যানহোকে। কিন্তু আইভ্যানহো যখন জানতে পারে যে রেবেকা ইহুদি কন্যা তখন আইভ্যানহোর চোখে প্রীতিভরা কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে ফুটে উঠেছিল আবেগহীন শুষ্ক ভদ্রতা। আইভ্যানহো বীর হলে কি হবে ধর্মান্ধতা ও প্রচলিত গোঁড়ামি থেকে মন মুক্ত ছিল না। তবু আইভ্যানহো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে কোন দ্বিধা করেনি। সে বলেছে নিরুত্তাপ কণ্ঠে- “প্রিয় রেবেকা, তোমার সৌজন্যকে জানাই ধন্যবাদ।” রেবেকা রুগ্ন আইভ্যানহোর শয়াপার্শ্বে নিরন্তর সেবায় রত। এমনকি দুর্গের বাইরে যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থারও বিবরণ দিয়ে চলেছে রেবেকা। মনে মনে দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠে আইভ্যানহো। গর্বিত কণ্ঠে সে বীরধর্মের জয়গান গাইতে থাকে। আর রেবেকা এই বীরধর্মের অসারত্বকে শান্ত কণ্ঠে প্রমাণ করার চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে দুর্গে লেগেছে আগুন। আইনভ্যানহো চীৎকার করে অনুরোধ করে রেবেকাকে “পালাও, তুমি পালিয়ে গিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাও রেবেকা। আমাকে বাঁচাতে পারবে না।”
রেবেকা দৃঢ় কণ্ঠে জবার দেয়-“আমি পালাব না। হয় দুজনে একসঙ্গে বাঁচব, না হয় দুজনেই একসঙ্গে মরব”। ঠিক সেই মুহূর্তে মূর্তিমান শয়তান টেম্পলার গিলবার্ট সেই ঘরে প্রবেশ করে জোর করে টানতে টানতে নিয়ে চলে যায় রৈবেকাকে। অসহায় আইভ্যানহোর বুক ফেটে যায়। রেবেকাকে সে বাঁচাতে পারে না। বিষম ক্রোধে চীৎকার করে ওঠে- “ঘৃণিত কুকুর, আমি তোর বুক চিরে রক্ত নেব।” এদিকে গিলবার্ট যখন রেবেকার মন জয় করতে ব্যর্থ হল তখন তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করল। পুরোহিত যাজকেরা রেবেকার বিরুদ্ধে ডাইনীর অভিযোগ এনে যখন পুড়িয়ে মারার জন্য শেষ প্রস্তুতি চালাচ্ছে তখন আইভ্যানহো সেই মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত হয়ে গিলবার্টকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে আহবান করে তাকে পরাস্ত করে। রেবেকা পায় মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তি। আইভ্যানহো
তীরধর্মে দীক্ষিত। সুতরাং সে অকৃতজ্ঞ হতে পারে না। তাই অবধারিত মৃত্যু জেনেও সে রেবেকাকে বাঁচাতে ছুটে এসেছিল। কিন্তু শুধুই কি কৃতজ্ঞতা। তার মনের কোণে কোথাও ছিল না রেবেকার জন্য এতটুকু ভালবাসা? তাই সঙ্গত কারণেই লেখক প্রশ্ন তুলেছেন-“একথা নিশ্চয় জানতে কৌতূহল হবে যে রেবেকার সৌন্দর্য ও মহানুভবতার শ্রুতি আইভ্যানহোর মনে চির জাগরুক ছিল কি না?”
কিন্তু জয় সিংহ আইভ্যানহোর তুলনায় একেবারেই নিষ্প্রভ। জয় সিংহ বরং বীরধর্মকে কলঙ্কিত করেছে যখন সে তিলোত্তমাকে রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে তার হৃদয়ে কঠিন আঘাত হেনেছে।
তিলোত্তমার প্রতি তার প্রেম অত্যন্ত দৃঢ়ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। সংশয় ও সন্দেহের আবিলতায় তা কলঙ্কিত। অন্যদিকে আয়েষার প্রতি কি তার মনে সত্যই অনুরাগ জন্মেছিল। আয়েষা সব সময় তার শিয়রে বসে সেবা শুশ্রুষা করেছে তবু জয় সিংহ মুখ ফুটে একটা কৃতজ্ঞতার কথাও প্রকাশ করে নি। চোরের মত একদৃষ্টে তাকিয়ে তাকিয়ে আয়েষার রূপসৌন্দর্য ভোগ করেছে তবু কথাটি না বলে সে নীরব থেকেছে। একি সম্ভব? কথা বলার এতুটুকু কৌতূহলও তার মনে জাগেনি? ভীরু, অবাস্তব, অপদার্থ চরিত্র জয় সিংহ। তাই আইভ্যানহো চরিত্রকে যত জীবন্ত বলে মনে হয় সেই তুলনায় জয় সিংহকে মনে হয় জড়বৎ।
রেবেকা ও আয়েষার চরিত্রের পার্থক্য আকাশ-পাতাল। কারণ জটিল ঘটনার কঠিন জটাজালে আয়েষাকে কখনো জড়িয়ে পড়তে হয়নি। জয় সিংহ আহত হয়ে আসার পর থেকে সে সেবা করে সারিয়ে তুলছে তাকে। মনে মনে হয়তো ভালবেসেছে। ওসমানকে আয়েষা ভালবাসে না। তাই হয়ত ওসমানের মুখের উপর বলতে পেরেছে- “শুন ওসমান আবার বলি এই বন্দী আমার প্রাণেশ্বর।” পরক্ষণেই সে ওসমানের কাছে তার এই প্রগলভতার জন্য ক্ষমা চেয়েছে। জয় সিংহকে বলেছে-“রাজপুত তুমিও অপরাধ ক্ষমা কর। যদি ওসমান আজ আমাকে মনঃ পীড়িত না করিতেন তবে এ দগ্ধ হৃদয়ের তাপ কখনও তোমার নিকট প্রকাশ পাইত না।” আয়েষার এই কথায় জয় সিংহের মনে কোন প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি। সে নিরুত্তর থেকেছে প্রেমের প্রবল উত্তাপে ভরা রোমান্টিকতা? এ যেন “ant Romantic.” একটা বোবা মানুষের সামনে আয়েষার নির্লজ্জ আত্মপ্রকাশ মাত্র। তাই জয় সিংহ যেদিন আয়েষার কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্য তার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করলো তখন আয়েষা তার সঙ্গে সাক্ষাতের প্রার্থনাটি রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল। আয়েষা ও জয় সিংহের প্রেম যেন এক পেশে ব্যাপার। জয় সিংহের দিক থেকে কোন সাড়া নেই। আয়েষা আপন মনের নিভৃতে প্রেমের মৃৎ প্রদীপটি জ্বালিয়ে জীবনের শূন্যতার জগতে বিচরণ করে। বিষ খেয়ে মরতে গিয়েও সে নিজেকে ভুলিয়ে রাখে। আয়েষা কি দেখে যে জগৎ সিংহকে ভালবেসে ছিল সেটাই একটা প্রশ্ন? এবং ওসমানকেই বা সে কেন প্রত্যাখ্যান করেছিল তারও কোন সদুত্তর নেই।
যাই হোক আয়েষার তুলনায় রেবেকা অনেক বেশি প্রাণবন্ত ও জীবন্ত। রেবেকা অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্না নারী। নিজের সম্বন্ধে নিজের দেশকাল, সমাজ ও জাতি সম্পর্কে সে অত্যন্ত সচেতন। যেমন ধর্ম পরায়ণা, তেমনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারিণী। সে ভালভাবেই জানে যে আইভ্যানহো ছিল ধর্মের মানুষ। ক্রীশ্চান ধর্মাবলম্বীরা যে ইহুদিদের ঘৃণা করে এ ব্যাপারে সে সচেতন হয়েও আইভ্যানহোকে ভালবাসে। কারণ আইভ্যানহোর মধ্যে সে দেখতে পেয়েছিল এক মহৎ সুন্দর বীরত্বের গরিমা। তাই সে আইভ্যানহোর জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিল তেমন আইভ্যানহোও তার জন্যে প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু তাদের মিলনের পক্ষে প্রধান বাধা ছিল ধর্ম। সেই প্রচলিত ধর্মকে রেবেকা কোন দিন স্বীকার করে নিতে পারেনি। মানবীয় কল্যাণ ধর্মকেই
সে জীবনের ব্রত করে নিয়েছিল তাই টেম্পলার গিলবার্টের অত্যাচারের কাছে সে মাথা অবনত করে জানু পেতে হার স্বীকার করেনি। মৃত্যু অবধারিত জেনেও সে পরম নির্ভয়ে ঈশ্বরের প্রতি গভীর আস্থা রেখে টেম্পলার গিলবার্টকে বলেছে-“ঐ চিতার আগুনে আমার এই নশ্বর দেহ ভস্মীভূত হয়ে যাবে। তখন সহজে আমি আর এ সুন্দর জগতে প্রবেশ করব।” রেবেকা মৃত্যুভয়ে গিলবার্টের কাছে আত্মসমর্পন করে নি। তার প্রেম মৃত্যুর চেয়ে নির্মম। তাই মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে সে সবার অলক্ষ্যে আইভ্যানহোর দৃষ্টির বাইরে আত্মগোপন করে থাকে। একজন ইহুদী কন্যার জীবনদান করেছে একজন খ্রীষ্টান বীর। একি কম অদ্ভুত কথা? রেবেকা নিজেকে ইচ্ছে করে দূরে সরিয়ে নেয়। আইভ্যানহোর জীবনে সে প্রতিবন্ধক হতে চায় না। রোয়েনা ও আইভ্যানহোর জীবন সুখের হোক্ এটাই সে চেয়েছিল। তাই সে আইভ্যানহোকে কখনো “প্রিয়তম” বা প্রাণেশ্বর বলে সম্বোধন করেনি তার প্রেম হৃদয়ের গভীরে আসন পেতেছিল বলেই সে প্রেমের জন্যেই হয়েছিল সন্ন্যাসিনী। রেবেকা প্রেমের নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান বলেই সে সকলের উর্দ্ধে সব কিছু ছাড়িয়ে প্রভাতের শুকতারার মত দীপ্যমান। তার মৃত্যুহীন প্রেম তাকে অমরবীর্যে করেছে অশঙ্কিনী। তবু রক্তমাংসে গড়া প্রেমের উষ্ণ উত্তাপে ভরা চিত্তে নিয়ে বিদায় নিতে গিয়ে সে নিজেকে গোপন রাখতে পারেনি। তার কথায় রোয়েনা হয় স্বপ্নাচ্ছন্ন। রেবেকার বলিষ্ঠ প্রেম কেবল রোয়েনাকেই আচ্ছন্ন করেনি, আইভ্যানহোর মনে এক চিরন্তন দাগ কেটে দিয়ে গেল।
তিলোত্তমা ও রোয়েনা
রোয়েনা এক ব্যক্তিত্বসম্পন্না নারী। তার গুরুগম্ভীর ব্যক্তিত্ব কোথাও এতটুকু ক্ষুন্ন হয়নি। সে নিজের মর্যাদা সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। তার আচরণে ফুটে উঠে গুরুগম্ভীর ব্যক্তিত্বের মহনীয় রূপ। অ্যাসবির ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সে হয়েছে “প্রেম ও সৌন্দর্যের” রাণী। তার হাত থেকেই বিজয়ীগণ গ্রহণ করবে পুরস্কার। সে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় উপস্থিত সমস্ত বায়রণদের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিল। যাইহোক সেই ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অজ্ঞাত পরিচয় অধিকার বঞ্চিত নাইট যখন বিজয়ীর সম্মান লাভ করার জন্য রোয়েনার কাছে উপস্থিত হল তখন মার্শালরা তার মুখের আবরণ ও শিরস্ত্রাণ খুলে ফেলতেই রোয়েনা চিনতে পারল তার প্রেমাস্পদকে। অস্ফুট চিৎকার করে উঠলো রোয়েনা। কিন্তু তার আত্মবিস্মৃতি ঘটেছিল মূহূর্তের জন্য। তারপর আত্মসংবরণ করে নিয়ে পূর্ণ গাম্ভীর্য সহকারে বিজয় গৌরবের মুকুট পরিয়ে দিয়েছিল প্রেমাস্পদের মস্তকে। কিন্তু প্রেমিক বিজয়ী বীর রোয়েনার হাত চুম্বন করার সঙ্গে সঙ্গে মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেল প্রেমিকার পদপ্রান্তে। চারিদিকে সোরগোল পড়ে গেল। মার্শালরা চিনতে পারল আইভ্যানহোকে। শত্রুরা তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করলো। সেই গণ্ডগোলের মধ্যে রেবেকা আহত আইভ্যানহোকে নিয়ে পালিয়ে গেল। কিন্তু এরপর থেকে আইভ্যানহো সম্বন্ধে রোয়নার মনে কেন যে কোন প্রশ্ন বা কৌতূহল জাগেনি সেটাই একটা আশ্চর্যের ব্যাপার। হয়তো সেড্রিকের ভয়ে সে নীরব থেকেছিল। এরপর তার জীবনে এক গুরুতর সংকট এসে উপস্থিত হল। শয়তান ডিব্রেসি জোর করে বিয়ে করতে চায় রোয়েনাকে যেমন গিলবার্ট জোর করে বিয়ে করতে চেয়েছিল রেবেকাকে। গিলবার্ট, ডিব্রেসি, প্রভৃতি ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের লুট করে নিয়ে গিয়ে ফ্রন্ট-ডি-বি অফ দুর্গে বন্দী করে রাখল। এখানে ডিব্রেসি নানাভাবে রোয়েনার কাছে তার ভালবাসার কথা বলে তার মন পেতে চাইলো। কিন্তু রোয়েনা তার বিপুল ব্যক্তিত্ব নিয়ে ডিব্রেসিকে বার বারে প্রত্যাখ্যাত করতে লাগল। ডিব্রেসি যখন দৈহিক শক্তি প্রয়োগের ভয় দেখাল তখনও সে তার দুরন্ত তেজ প্রকাশ করতে কসুর করেনি। রাজা রিচার্ড যদি
জনগণের সহায়তায় দুর্গ আক্রমণ করে তাদের উদ্ধার না করতো তাহলে হয়তো দানবে হাতে রোয়েনাকে চির কলঙ্কিত হতে হত। রোয়েনা এক প্রচণ্ড দুঃসাহসিকা নারী যার পবিত্রতার কাছে দানবও হয় পরাজিত কিন্তু তিলোত্তমাকে এরকম কোন সংকটের মধ্যে পড়তে হয়নি। যদিও কতলুখী তাকে উপপত্নী করবে বলে মনস্থ করেছিল বিমলা তাকে উদ্ধার হবার পথ দেখিয়ে দিয়েছিল এবং আয়েষা তাকে শেষপর্যন্ত দুর্গের বাইরে এনে মুক্ত করে দিয়েছিল। তিলোত্তমা রোয়েনার তুলনায় একেবারে নিষ্প্রভ।
যাইহোক স্কট এবং বঙ্কিমের দৃষ্টিভঙ্গীর মূলগত পার্থক্য ছিল বলেই স্কট এবং বঙ্কিম একই পথের পথিক নন। স্কট যদিও রাজতন্ত্রের সমর্থক, রাজমহিমার প্রতি যদিও ছিল তাঁর অনুরাগ, বাজানুগত্যের প্রতি ছিল তাঁর যদিও অকুণ্ঠ সমর্থন তবুও স্কট দুর্জন রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন না। তিনি স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রতীক রাজভ্রাতা জনের মুখোস খুলে দিয়েছেন, মুখোস খুলে দিয়েছেন তার অনুগামী অত্যাচারী, নিষ্ঠুর, শোষক, নারী মাংসলোভী, অর্থপিশাচ ধনী ব্যারনদের। এই ব্যারনরা ছিল জনগণের শত্রু। তারা যে সমস্ত দুর্গ নির্মাণ করেছিল সেগুলি ছিল জনগণকে নির্যাতন করার কসাইখানা। এইসব নরম্যান জমিদারদের লাম্পট্যের কাহিনী তিনি বিবৃত করেছেন। নরম্যান ব্যারনরা আইনের ধার যথেষ্ট নষ্ট করেছে। কুমারী মেয়েরা সম্ভ্রম বাঁচাতে গিয়ে বোরখার ভিতরে আশ্রয় নিয়েছে। এতো গেল নারীর কথা। নির্যাতিত কৃষকদের উপর হয়েছে অকথ্য নির্যাতন। কত লোককে মাটির নিচে পুঁতে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলা হয়েছে। কাউকে বা হাত পা বেঁধে গাছের ডালে ঝুলিয়ে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। কাউকে বা ক্ষুধার্ত অজগর সাপের মুখে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। স্কট যে যুগের ছবি এঁকেছেন সেই যুগে নিষ্ঠুর নির্দয় অত্যাচারের কাহিনীকে জ্বলন্ত করে এঁকেছেন। স্কট তাঁর আইভ্যানহো উপন্যাসে কেবলমাত্র প্রেমের রোমান্টিক কাহিনী রচনা করেননি, তিনি অত্যাচারীর বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কাহিনীকে রক্তের অক্ষরে রঞ্জিত করে রচনা করেছেন। তিনি ধর্মের ভন্ডামি ও শাসক শ্রেণীর শয়তানি ও অত্যাচারের কবর রচনা করে জনগণের বিজয় ঘোষণা করেছেন। স্কট একটি যুগের জীবন্ত বাস্তব ছবি এঁকেছেন।
কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাজসিংহ’ বা ‘দুর্গেশনন্দিনীতে’ এ সবের কোন কিছু নেই। বঙ্কিমচন্দ্র কেবলমাত্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কাহিনীকেই রূপদান করেছেন। সামন্ততন্ত্রের শোষনের ঘৃণ্যরূপও যেমন তাঁর চোখে পড়েনি তেমন অত্যাচারিত মানুষের করুণ ইতিবৃত্তও তিনি রচনা করেননি। আসলে স্কটের মত তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী এত বিশাল ও ব্যাপক ছিল না, ছিল না সর্বব্যাপী ব্যাপক সামাজিক চেতনা। তাই তাঁর উপন্যাসে কোন যুগের বাস্তব ছবি নেই। আছে নিছক ঐতিহাসিক ঘটনা। স্কট যেমন নিপীড়িত মানবের হয়ে অতীতকে দেখাবার চেষ্টা করেছেন তেমন বঙ্কিমচন্দ্র নিপীড়িত মানবের হয়ে কোন কথাই বলেন নি। রাজসিংহে নিপীড়িত মানুষের কোন চিহ্নই নেই।
স্কট যেমন সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন শ্রেণীর স্ব স্ব স্বার্থের শ্রেণী দ্বন্দুকে, তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক দ্বন্দুকে, তীক্ষ্ম তীব্র করেছেন, বঙ্কিমচন্দ্রের ভাবনায় এসব কিছুই ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্র বাস্তবের মাটিতে পা দিয়ে যেন হাঁটেন নি। তিনি রোমান্সের ডানায় ভর করে অতীতে পাড়ি দিয়েছেন। রোমান্সের সঙ্গে বাস্তবের কোন সম্মিলন ঘটাতে পারেন নি। স্বাদেশিক চেতনা একটা রোমান্টিক চেতনা মাত্র ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে। তাই স্বাদেশিক চেতনার রোমান্টিক স্তর অতিক্রম করে তিনি বাস্তবের মাটিতে নেমে আসতে পারেননি। লোকজীবনের বিষয়টিকে বৈশ্লেষণিক দৃষ্টিতে সমালোচনা করতে পারেননি।
সর্বশেষে একথা বলা যায় যে-স্কট গণতান্ত্রিক চেতনার নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকেই সমাজ ও জীবনকে সমালোচনা করেছেন। স্কট নৈতিকতাকে এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এতবেশি প্রাধান্য দিয়েছেন, যে তিনি নৈতিক অধঃপতনকে আদৌ সহ্য করতে পারেননি। ইংলণ্ডের নবসৃষ্ট বুর্জোয়া সমাজের নৈতিক অধঃপতনকে, তার দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজ ব্যবস্থাকে তিনি তাঁর “সেন্ট রোমান’স ওয়েল” উপন্যাসে স্পষ্ট করে তুলে ধরে ব্যঙ্গ ও বিদ্রুপের বাণে বিদ্ধ করেছেন। স্কট ছিলেন লোকসাধারণের কবি। জনগণের প্রতি এতখানি নৈতিক দায়িত্ব ও সামাজিক চেতনা নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য প্রেরণার উৎসার ঘটেনি। বঙ্কিম যতখানি না বাস্তবধর্মী তার চেয়ে অনেক বেশি আদর্শবাদী।
সংক্ষিপ্ত টীকা
“দি প্রিলিউড”:
ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবি প্রতিভার সর্বশ্রেষ্ঠ ফসল হল এই কাব্যটি। যদিও ১৮৫০ সালে তাঁর মৃত্যুর পর এই কাব্যটি প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু এই কাব্যটি তাঁর কবি প্রতিভার মধ্যাহ্ন কাল অর্থাৎ ১৭৯৮-১৮০৫ সালের মধ্যে রচিত হয়েছিল। এই কাব্যটিতে কোলরীজকে সম্বোধন করা হয়েছে এবং ১৮৯৭ সালের জানুয়ারী মাসে কোলরীজকে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন এবং কোলরীজও তাঁর চিঠিপত্রে উল্লেখ করেছেন যে, “এই অপ্রকাশিত কাব্যটিতে, ওয়ার্ডসওয়ার্থের ব্যক্তি মনের বিকাশ ও বিপ্লবের প্রকাশ ঘটেছে। যেহেতু ওয়ার্ডসওয়ার্থ এই কাব্যটি কোলরীজকে উৎসর্গ করেছেন, তা থেকে বোঝা যায় যে, এই কাব্য রচনায় কোলরীজের অবদান কতখানি। কবি নিজেও তা স্বীকার করেছেন,
“O honourd friend up hold as here to fore my fainting steps.
who in my thouhts are ever at my side.”
কোলরীজ চেয়েছিলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ পুরোপুরি একটি দর্শনভিত্তিক কাব্য রচনা করুক। কিন্তু কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না বলে তিনি আপন জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে জীবন দর্শনের একটি অখন্ডরূপ সৃস্টি করেছেন। নিছক দর্শনভিত্তিক কাব্য রচনা করা তাঁর কবি প্রতিভাতে খাপ খায় নি। তাই তিনি আপনার জীবনদর্শনকে কাব্যের আকারে রণ দিলেন। কিন্তু এতেও কোলরীজের সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল। যাইহোক এই কাব্যটিতে কবির প্রকৃতি চেতনা, মানবিক চেতনা, এবং আধ্যাত্মিক চেতনায় উন্মেষ, বিকাশ ও পরিণতির এক অখন্ড রূপ লাভকরেছে। কাব্যটি চোদ্দ খণ্ডে বিভক্ত। শৈশব থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বয়েস পর্যন্ত প্রকৃতির সঙ্গে কবি সম্পর্কের বিবর্তন ধারার একটা সুস্পষ্ট রূপ কবি বর্ণনা করেছেন। এই বর্ণনার মধ্যে দিয়ে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রকৃতি চেতনা থেকে আধ্যাত্মিক চেতনায় উত্তরণের কাহিনী রূপ লাভ করেছে। শৈশব কাল থেকে প্রকৃতির সঙ্গে কবির অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছিল। প্রকৃতি তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকতো। কবি সেই ডাকে সাড়া দিয়ে ছুটে যেতেন নদী প্রান্তে। উইলো গাছে বাঁধা নৌকার বাঁধন খুলে দিয়ে তাতে চড়ে বসতেন। দাঁড় বেয়ে চলে যেতেন বহুদূর। তারপর সেই নির্জন সন্ধ্যায় অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন তারকাখচিত ধূসর বর্ণের আকাশের দিকে, তাকিয়ে থাকতেন ধূসরাবৃত পাহাড়ের চূড়ায় দিকে। এই নির্জন সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে করতে রাত যেত ফুরিয়ে। কখনো তুষারঝরা ঋতুর এক সন্ধ্যায় কবি বেরিয়ে পড়তেন অরণ্যের উদ্দেশ্যে। হারিয়ে যেতেন সেই নির্জনতায়। ভরে উঠতো মন বিপুল আনন্দে। Ah! need I say, dear friend! that to brim my heart was full.
বারে বারে কবির সেই শৈশবের দিনগুলি মনে পড়েছে এবং তারই কথা বারে বারে তিনি উল্লেখ করেছেন। প্রিলিউভ কাব্য অনেকখানিই শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন। কল্পনায় ডানা মেলে দিয়ে কবি সে জগতে উধাও হয়ে যেতেন। কিন্তু কবির মনে ধীরে ধীরে আধ্যাত্মিক চেতনার প্রলেপ পড়েছে। সব কিছুর মধ্যেই তিনি যেন ঐশ্বরিক শক্তির আবির্ভাবকে উপলব্ধি করতেন। মানব মনের মধ্যেও তিনি সেই শক্তির রূপকে দেখতে পেতেন। মনে হত মানুষের সব সৌন্দর্য, শক্তির এবং রহস্যময়তা যেন তার মধ্যে নিহিত রয়েছে। প্রকৃতিই মানুষের হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করতে পারে, তাকে উজ্জ্বল আনন্দে আলোকিত ও বর্ণময় করতে পারে, তাকে সুন্দরভাবে মহৎ করতে পারে। প্রকৃতিই প্রেরণাদাত্রী। সেই বিশ্বাস নিয়ে কবি দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন,
By reason and truth, what we Sanctified have loved, others will love, and we will teach them how instruct them how the mind of man becomes A thous and times more beautiful than the earth on which he dwells
ওড টু দি ওয়েষ্ট উইন্ডঃ-রচয়িতা শেলী। রচনাকাল ১৮৯১। প্রকাশিত ১৮২০। এই কবিতায় কবি আপন মনের বিদ্রোহী ভাবনাকে প্রকাশ করেছেন। তিনি পশ্চিমা ঝড়কে একদিকে ধ্বংস অন্যদিকে সৃষ্টির প্রতিমূর্তি রূপে কল্পনা করেছেন। কবি পৃথিবীর বুক থেকে যা কিছু জীর্ণ পুরাতন, যা কিছু প্রাণহীন অসার তা নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে এবং হৃদয়হীন নিষ্ঠুর শোষণের রাজত্বকে ধ্বংস করে নবজীবনের প্রাণের আশ্বাসে ভরা নুতন সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চান। বিদ্রোহী কবি শেলী চির আশাবাদী। তাই তিনি বিশ্বাস করেন শীত যদি আসে তাহলে বসন্ত আসবেই। ০. wind! if winter comes can spring be far behind? আলোর পূজারী কবি শেলী
জানেন যে অন্ধকার কেটে গিয়ে আলোর পৃথিবী ভরে উঠবেই। দানবের রাজত্বের অবসান ঘটবেই। এই আশ্বাস নিয়ে তিনি চেয়েছেন নব জাগরণের বাণী বহন করে নিয়ে যাক পশ্চিমা ঝড় দেশ থেকে দেশান্তরে সমাজ সৃষ্টির জন্য।
অ্যালাষ্টার অব দি স্পিরিট অব সলিটিউড:- রচয়িতা শেলী। রচনাকাল ১৮১৫।
প্রকাশিত ১৮১৬। এই কবিতায় শেলীর রোমান্টিক ভাবনার সবচেয়ে উন্নততর প্রকাশ ঘটেছে। এখানে বাস্তবতার কোন চিহ্ন নেই। কবি বিশুদ্ধভাবে স্বপ্নচারী। নীরব নির্জন প্রকৃতির রাজত্বে তিনি নিঃসঙ্গভাবে ক্লান্তিহীন। বিশ্রামবিহীনভাবে ঘুরে বেড়িয়েছেন একটি প্রেমময়ী স্বপ্নচারিণী কুমারীর সন্ধানে সে তার প্রেমের সৌন্দর্যের জন্য প্রবল তৃষ্ণাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে। কিন্তু কবির জীবনে সে রকম কোন কিছুর সন্ধান মেলেনি। স্বপ্নই দেখে গেলেন সারাজীবন। নিঃসঙ্গতা জীবনকে রইল ঘিরে। পৃথিবী যতই তাঁর কাছে কঠিন মনে হোক তবু আশাবাদী কবি জীবনের নৈরাজ্যের মধ্যে ডুবে যাননি। বলিষ্ঠ আশার বাণীই তিনি এ কাব্যে শুনিয়েছেন।
এ ডিফেন্স অব পোয়েট্টিঃ-রচয়িতা শেলী। রচনাকাল ১৮২১। প্রকাশিত ১৮৪০। সাহিত্য সমালোচনায় শেলী বাস্তবধর্মী। যদিও তিনি রোমান্টিক কবিগোষ্ঠীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী। শেলীর মতে সাহিত্যে কেবলমাত্র ভাবের কথা নহে তা জ্ঞানের কথাও বলে। ভাব ও কল্পনা ছাড়া সাহিত্য যে সৃষ্টি হয় না তা শেলী জানেন। কিন্তু শেলী এও জানেন যে সাহিত্যের মাধ্যমে জ্ঞানের কথা বা জীবনের ভাবনার কথাও প্রকাশ হয়ে থাকে। সাহিত্যের একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে সাহিত্য সৃষ্টি হয় না। সে উদ্দেশ্য কি? সে উদ্দেশ্যে হলো মানুষের নৈতিক উন্নতির বিকাশ ঘটানো। মানবতাবাদী শেলী এই অর্থ Arts far arts sake-এর দলে নন। তিনি হলেন Art for porpose-এর দলে। শেলীর মতে, “Poetry strengthens the faculty which is the organ of the moral nature of man [imagination] in the same man-ner as exercise strengthens a limb.”
“ওড টু এ নাইটিঙ্গেল”:- রচয়িতা কীটস। রচনাকাল ১৮১৯ সালের জুলাই মাস।
১৮১৯ সালে কবির ভ্রাতা টমের মৃত্যুর পর কবি তাঁর বন্ধু ব্রাউনের সঙ্গে হ্যাম্পষ্টেডের অন্তর্গত ওয়েষ্ট ওয়ার্থ প্লেসে কিছুদিন বাস করেন। যে বাড়ীতে বাস করতেন সেই বাড়ীর বাগানের একটি তরুশাখায় একটি নাইটিঙ্গেল পাখি বাসা বুনেছিল। কীটস্ প্রায়ই নাইটিঙ্গেল পাখীর গান গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং ঐ গান তাঁকে দিত প্রচুর আনন্দ। তাই কবির কাছে নাইটিঙ্গেল পাখীর এই সঙ্গীত আনন্দের প্রতীক, স্বর্গীয় মদের ফেনপুঞ্জ, যৌবন সৌন্দর্যের নন্দনলোক। কারণ
কবি বাস্তব জগতের যে ছবি দেখেছেন সে জগতে আছে দুঃখ, আছে জ্বালা, আছে দুঃসহ দারিদ্র, আছে দলিত বুকের চাপা গোঙানি। সেখানে যৌবনের আশা ম্লান হয়ে যায়, ধীরে ধীরে কঙ্কালসার হতে হতে মৃত্যুর বুকে ঢলে পড়ে। কবি এই কদাকার জগত থেকে পালিয়ে যেতে চান সৌন্দর্যের অমরাবতীতে। কবি কীটস্ বিহঙ্গের সঙ্গীত মাধুর্যকে আকণ্ঠভরে পান করেছেন এবং তারই মদির নেশায় সৌন্দর্যালোকে উত্তরণ করেছেন। কবি সেই সৌন্দর্যের জগতে উত্তরণ করেছেন যেখানে চাঁদ তারকা খচিত আকাশের ভালে রাণীর মতন স্বর্ণ সিংহাসনে অধিষ্ঠিতা, সেখানে অর্ধ প্রস্ফুটিত গোলাপের অধরে শিশির বিন্দু, যেখানে ঝিঁ ঝিঁ পোকার কলতান, ও পুষ্পের সুরভীতে আচ্ছন্ন জগৎ। এই সৌন্দর্যের জগতে কবি চিরকাল বাস করতে পারবেন। কারণ কবি জানেন এই বিহঙ্গ অমর। যুগ যুগ ধরে এই বিহঙ্গ আনন্দের অমৃতধারা বর্ষণ করে যাবে আর তা পান করে বিড়ম্বিত জীবনের হাত থেকে মানুষ করবে মুক্তিলাভ। পৃথিবীর সব কিছুই মরণশীল ও ধ্বংসশীল কিন্তু এই বিহঙ্গকুলের ধ্বংস নেই। কারণ এরা যে আনন্দের প্রতিমূর্তি। কবির ভাষায়,
Thou wast not born for death, immortal bird! No hungry generations could tread the down-
ক্রিষ্টাবেল: রচয়িতা কোলরীজ। রচনাকাল ১৭৯৮। এই কাব্যে মধ্যযুগের একটি সংস্কারকে অবলম্বন করে তিনি কাহিনী রচনা করেছেন। সে সংস্কারটি হল পৃথিবীর যাবতীয় অশুভশক্তি রাতের তৃতীয় প্রহর অর্থাৎ মধ্যরাত থেকে মানুষের অনিষ্ঠ সাধন করে। রাত কেটে গেলে আর তাদের দর্শন মেলে না। শুভ পবিত্র শক্তির প্রতীক ক্রিষ্টাবেল আর অশুভ আত্মার প্রতীক জিরালডাইন। জিরালডাইন চেয়েছিলেন ক্রিস্টাবেলের ক্ষতিসাধন করতে কিন্তু তাঁর সমস্ত কৌশল ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল সেহেতু পবিত্রতার প্রতিমূর্তি ক্রিষ্টাবেলের ক্ষতিসাধন করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। পবিত্রতা যার কবচ ক্ষতি করতে পারে তার কে? তাই এ কাব্যে শুভ শক্তির জয়বার্তা ঘোষণা করা হয়েছে।
ওয়ের্ভালি নভেল: কাব্যে ও কবিতা রচনায় বায়রণের সমকক্ষতা অর্জন করা একপ্রকার অসম্ভব ভেবে স্কট উপন্যাস রচনায় মন দিলেন। ছেড়ে দিলেন কবিতা রচনা। কিন্তু স্কট ভীষণভাবে রোমান্টিক। বাস্তবধর্মী উপন্যাস রচনায় নতুন পথ অবলম্বন করলেন। সে পথ হোলো মধ্যযুগীয় জগৎ ও জীবনকে বিষয়বস্তু করে উপন্যাস রচনা করা। ইতিপূর্বে তিনি মধ্যযুগের জীবনকে আশ্রয় করে কাব্য রচনা করেছিলেন। যা কবিতায় তিনি শুরু করেছিলেন তা উপন্যাসে বান ডেকে আনলেন। মধ্যযুগের জীবন অবলম্বনে তিনি যেসব উপন্যাস রচনা করেছিলেন। যা কবিতায় তিনি শুরু করেছিলেন তা উপন্যাসে রচনা করেছেন তা “ওয়ের্ভালি” উপন্যাস নামে খ্যাত। ‘ওয়ের্ভালি’ উপন্যাসের সংখ্যা প্রায় উনত্রিশ হবে। অধিকাংশই ঐতিহাসিক রোমান্স। ‘ওয়ের্ভালি’ উপন্যাস দিয়েই ‘ওয়ের্ভালি’ উপন্যাসমালা শুরু। রচনা করতে শুরু করেছিলেন ১৮০৫ সালে। শেষ করেছেন ১৮১৪ সালে। এই উপন্যাসের নায়ক এডওয়ার্ড ওয়ের্ভালি, নায়িকা রোজ ব্র্যাউওয়ারডাইন। এদের প্রেম ও মিলনের কাহিনী এই উপন্যাসে রূপলাভ করেছে। কিন্তু মিলন তো অত সহজ নয়, তাতেও বাধা আছে। কারণ ওয়েভার্লি রাজা দ্বিতীয় জেমসের বিরাগভাজন হয়েছিলেন, ফলে তাঁকে শাস্তিও পেতে হয়েছিল। হাইল্যাণ্ডের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে তিনি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন। এই হাইলাণ্ডের বর্ণনা স্কট অত্যন্ত নিপুণভাবে বর্ণনা করেছেন। হাইল্যাণ্ডের নির্জন উপত্যকায় আয়ত কালো চোখের অধিকারিণী ক্লোরা ম্যাক-আইভার তার কটাক্ষ দিয়ে ওয়েভার্লিকে বশীভূত করেছিল, তাকে শুনিয়েছিল গেলের অতীত বীরদের গান, বীণাতন্ত্রে সুরারোপিত করে শুনিয়েছিল
দুর্গাগত নির্ঝরের মর্মর ধধ্বনি, সন্ধ্যাকালীন বাতাসের দীর্ঘশ্বাস এবং পত্র পল্লবের মর্মর সুর। শেষ পর্যন্ত ওয়েভালি তার থেকে মুক্ত হয়েছে। নায়িকা রোজকে বিবাহ করে সে জীবনকে করেছে সার্থক। এত বেশী বর্ণনামূলক যে ওয়েভালি উপন্যাসকে “লেডী অব দি লেকের” কাব্যের গদ্যময় রূপ বলা যায়।
“আইভ্যানহো” :- রচয়িতা স্কট। রচনাকাল ১৮১৯।
ঘটনার স্থান হাইল্যান্ড নয়, ইংলন্ড। রাজা প্রথম রিচার্ড-এর রাজত্বকাল। রিচার্ড গিয়েছেন ধর্মযুদ্ধে। তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে তাঁর ভাই জন সিংহাসন দখল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ধর্মযুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর রিচার্ড ছদ্মবেশ ধারণ করে সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন। পরে আইভ্যানহোর সাহায্যে শত্রুদের ধ্বংস করে তিনি সিংহাসন ফিরে পান। এর সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে একটি প্রেমের কাহিনী যুক্ত। সে প্রেমের কাহিনী তিনজনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। এরা হল আইভ্যানহো, লেডী রাইয়েনা এবং রেবেকা। আইভ্যানহো হলেন স্যাকসন অমাত্য সেড্রিক-এর পুত্র। আইভ্যানহো রাজা রিচার্ড-এর পক্ষ থেকে ধর্মযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। ফলে সেড্রিক তাঁকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করেন। লেডী রাউয়েনা হল সেড্রিকের আশ্রিতা। আর রেবেকা হল ইহুদি আইজ্যাকের কন্যা। আইভ্যানহো ও লেডী রাউয়েনা দুজনে দুজনকে ভালবাসে। কিন্তু তাদের মিলনের পথে প্রধান অন্তরায় আইভ্যানহোর পিতা সেড্রিক। যেহেতু রাউয়েনা রাজা আলফ্রেডের বংশোদ্ভূত সেজন্য সেট্রিক চান স্যাকসন রাজবংশের সন্তান এথেলষ্টেনের সঙ্গে বিবাহ দিতে। রেবেকার সঙ্গে আইভ্যানহোর পরিচয় টুর্ণামেন্ট শেষ হবার পর আহত আইভ্যানহোকে সেবা করার মধ্য দিয়ে। টুর্ণামেন্ট জয়ী হয়েছিলেন এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বীররূপে সম্মান পেয়েছিলেন ছদ্মবেশী আইভ্যানহো। কিন্তু আইভ্যানহো হয়েছিলেন আহত। আহত অবস্থায় কারা যেন তাঁকে সকলের অলক্ষ্যে সরিয়ে নিয়ে যায়। এই টুর্ণামেন্ট দেখতে এসেছিলেন সেড্রিক, রাউয়েনা, এথেলষ্টেন, রেবেকা ইত্যাদি। টুর্ণামেন্ট দেখে বাড়ী ফিরে যাবার পথে রাউয়েনা ও রেবেকাকে হরণ করার উদ্দেশ্যে জনের অমাত্যরা তাদের বন্দী করে এনে দুর্গে আটক করে রাখে। এখানে আইভ্যানহো বন্ধী অবস্থায় থাকেন। রেবেকা এই বন্দীকে প্রাণ দিয়ে সেবা করে এবং ভালবেসে ফেলে। ছদ্মবেশী রাজা রিচার্ড, রবীনহুডের সহায়তায় দুর্গ আক্রমণ করে তাদের মুক্ত করেন। কিন্তু রেবেকাকে টেম্পলার নিয়ে সরে পড়ে। যে পাদরিদের আশ্রমে রেবেকাকে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে ডাইনী অভিযোগে তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা হয়। আসন্ন মৃত্যুর হার থেকে তাঁকে বাঁচিয়ে দেন আইভ্যানহো। তবু আইভ্যানহো রেবেকাকে বিয়ে করতে সম্মত হয় নি। কারণ সে ইহুদি কন্যা। রাউয়েনার সাথে আইভ্যানহোর বিয়ে হয়। আর রেবেকা সন্ন্যাসীনির ব্রত গ্রহণ করে নিউইয়র্কে চলে যায়।
বৈচিত্র্যেভরা বিশাল কাহিনী। তবে এ বিশাল কাহিনীতে তিনটি চরিত্রই সমুজ্জ্বল। সে চরিত্রগুলি হল রাজা রিচার্ড, আইভ্যানহো এবং রেবেকা। আবার এই তিনটির মধ্যে রেবেকাই সবচেয়ে সমুজ্জল। তার নারীত্বের মহিমা, প্রেমের গরিমা, তাকে অমরবীর্যে করেছিল অশঙ্কিনী। তাই মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে ভীত নয়, কম্পিত নয়। প্রেমের জন্য সে যেমন মৃত্যুকে বরণ করতে পারে, তেমনি সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে নিঃস্ব হতে পারে। রেবেকা চরিত্রটি লেখক অত্যন্ত দরদ দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। সমস্ত কাহিনীর মধ্যেই রেবেকাই একমাত্র করুণতম চরিত্র। সে যেন প্রেমের বেদীমূলে পড়ে থাকা একবিন্দু অশ্রুজল, কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল।
“দি হার্ট অব মিডলোথিরানমূর”: রচয়িতা স্কট। ১৮১৮ সালের জুনমাস।
আধুনিক কালের ভাষায় এবং পারিবারিক জীবনের বীরত্বপূর্ণ দুঃসাহসিক কার্যকলাপের সবচেয়ে সুন্দরতম কাহিনী হল জেনী ডিনস্-এর কাহিনী। জেনী ডীনস-এর চরিত্র বহু কড়া সমালোচককেও বিচলিত করেছে এবং তাকে প্রশংসা করতে হয়েছে। স্কট যতগুলি নারী চরিত্র অংকন করেছেন তার মধ্যে জেনী ডিনস্ সর্বশ্রেষ্ঠ। জাতীয় চরিত্রের মহৎগুণগুলি দিয়ে লেখক তাকে সৃষ্টি করেছেন। সংক্ষেপে কাহিনীটি হল জেনির ছোট বোন ইফি শিশু হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিল। আইনের বিচিত্র ধারা অনুযায়ী সে যদি একবার স্বীকার করতো যে তার গর্ভসঞ্চারের জন্য কে দায়ী তাহলে বাস্তব প্রমাণের অভাবে তার মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যেত এবং সে ফাঁসীর হাত থেকে মুক্তি পেত। কিন্তু ইফি তা করেনি। কিন্তু সে যে গর্ভবতী ছিল এটা সে জেনীর কাছে প্রকাশ করেছিল। ইফিকে বাঁচাতে পারতো জেনি। কিন্তু সত্যের খাতিরে তা পারেনি। ইফি যে গর্ভবতী ছিল একথা সে জুরীদের সামনে বলেছে। তাতে ইফিই যে তার নিজের সন্তানকে হত্যা করেছে একথা প্রমাণিত হয়েছে। ফলে ইফির হয়েছে প্রাণদন্ড। কিন্তু জেনি তার ছোট বোনকে বাঁচাবার জন্য এডিনবরা থেকে, লন্ডনে ছুটেছে রাজার কাছ থেকে প্রাণদন্ড মওকুবের নির্দেশ আদায় করার জন্য। সুতরাং জেনির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল সে মিথ্যা বলবে কি বলবে না যদিও তার বোনই যে শিশুটিকে হত্যা করেছে এব্যাপারে তার যথেষ্ট সংশয় থাকা সত্ত্বেও সে মিথ্যা বলতে পারেনি। এই নৈতিক দ্বন্দ্বে তার চিত্ত হয়েছে ক্ষত-বিক্ষত। স্কট নীতি বিগর্হিত কোন কাজকে সমর্থন করতেন না। তাই এরকম এক জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের সামনে এক বিরাট প্রশ্ন তুলে ধরেছে।
“দি ব্রাইড অব ল্যামার”: রচয়িতা স্কট। রচনাকাল জুন ১৮১৯। লর্ড র্যাভেনস্টডের সঙ্গে স্যার উইলিয়ম অ্যাসটনের বিরোধ। কারণ ১৬৮৯ সালের গৃহযুদ্ধে র্যাভেনসউড অংশ গ্রহণ করায় স্যার অ্যাসটন আইনের আশ্রয় নিয়ে র্যাভেনসউডকে তার সম্পত্তি ও খেতাব থেকে বঞ্চিত করে তাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। রাগে দুঃখে র্যাভেনস্টন্ড মারা যান। মাস্টার র্যাভেনস্টড পিতার উলফস্ ক্রাগ বাড়ীটা পেয়েছিল আর পেয়েছিল শত্রুর প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা। কিন্তু ঘটনাচক্রে মাষ্টার র্যাভেনস্টড তার শত্রু অ্যাসটন ও তার কন্যা লুসিকে এক দারুণ বিপদের হাত থেকে জীবন রক্ষা করেন। মাস্টার র্যাভেনস্টড লুসির প্রেমে পড়ে যান। রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে র্যাভেনস্টডের বন্ধুরা যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হল তখন অত্যন্ত কৌশলে অ্যাসটন র্যাভেনস্টডের সঙ্গে ঝগড়া মিটিয়ে ফেললো। র্যাভেনস্টডও ভুলে গেল শত্রুতার কথা। লুসির সঙ্গে প্রেম হল গাঢ়তর। কিন্তু তাদের প্রেমের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালো লুসির মা লেডী অ্যাসটন। তিনি তাঁর পছন্দ মাফিক পাত্র বাকল-এর লেয়ার্ডের সঙ্গে কন্যা বিয়ে দিতে চান। এই সময়ে র্যাভেনস্টড কিছু দিনের জন্য বিদেশে চলে যান। যাবার সময় লুসিকে কথা দিয়ে যান যে পত্র দিয়ে তিনি লুসিকে নিশ্চিন্তে রাখবেন। লুসির মা লুসিকে বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকলে লুসি র্যাভেনস্টডকে চিঠি লিখে তাঁর মতামত জানতে চাইলো। কিন্তু চিঠি গিয়ে পড়লো অন্যের হাতে। উত্তর আর এলো না। ফলে লেয়ার্ডের সঙ্গে লুসির বিবাহের দিন স্থির হয়ে গেল। বিবাহের অনুষ্ঠানের অন্তিম মুহূর্তে র্যাভেনস্টড সেখানে উপস্থিত হল এবং দ্বন্দ্ব যুদ্ধে লুসির ভাই ও স্বামীকে আহবান জানালো। পরদিন সকালে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে যোগদান করতে গিয়ে চোরাবালিতে ডুবে মারা গেল র্যাভেনস্টড। অন্যদিকে লুসি তার স্বামীকে হত্যা করে পাগল হয়ে গেল এবং শেষে মৃত্যুবরণ করলো।
কোন কোন সমালোচক বলেছেন এই গ্রন্থটি উপন্যাসের আকারে একটি গদ্য কাব্য। এই কাব্যটি
সেক্সপীয়রের নাটক “রোমিও জুলিয়েটের” অনুসরণে রচিত। তবে স্কট সেক্সপীয়র নন। তাই তাঁর কাহিনী রচনায় ত্রুটি আছে বেশি। ত্রুটি ট্র্যাজিক কাহিনী বলা হয়েছে। যদিও অনিবার্য ও অপ্রত্যাশিত কোন ঘটনা এর ট্র্যাজেডি সৃষ্টিতে কোন সাহায্য করেনি।
কেনিলওয়ার্থঃ-রচয়িতা স্কট। সূচনাকাল ১৮২১।
এলিজাবেথীয় ইংলণ্ডের রূপ এখানে বর্ণিত হলেও একটি পারিবারিক প্রেমের সকরুণ কাহিনী রূপলাভ করেছ। কাহিনীর নায়িকা হল অ্যামি রবসার্ট, নায়ক হল আর্ল অব লিষ্টার। আর্ল অব লিস্টার রাণীর অন্যতম প্রেমিকা। তিনি যে অ্যামিকে বিয়ে করেছেন একথা গোপন রেখেছেন। এদিকে ভার্ণেও অ্যামিকে ভালবাসে। সে রাণীকে বলে আমি তারই স্ত্রী। রাণী নির্দেশ দেন অ্যামিকে কেনিলওয়ার্থ প্রাসাদে আনতে। এই অবস্থায় লিষ্টার বাধ্য হয় অ্যামিকে তার স্ত্রী রূপে ঘোষণা করতে। কিন্তু দুর্বল ভার্ণে অ্যামিকে ব্যাভিচারী বলে ঘোষণা করে। লিষ্টার ক্রুদ্ধ হয়ে অ্যামিকে প্রাণদন্ডাদেশ দেন। অথচ অ্যামি নির্দোষ।
একথা জানা সত্ত্বেও কোন অনুতাপ জাগেনি লিষ্টারের মনে।
ওড টু ইমমর্টালিটিঃ-রচয়িতা ওয়ার্ডসওয়ার্থ। রচনা কাল ২৭ শে মার্চ ১৮০২।
কবিতাটি দশটি স্তবকে এবং ২০৩টি লাইনে রচিত। এই সুদীর্ঘ কবিতাটিতে কবির আত্মগত ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। প্রথম দুটি স্তবকে কবি বলেছেন যে, মানুষ যখন ধীরে ধীরে বয়ঃপ্রাপ্ত হয় তখন বাইরের জগতের সৌন্দর্য ও মাধুর্য তার দৃষ্টিতে স্নান হয়ে যায়। অর্থাৎ বাইরের জগতের সৌন্দর্য আর তার দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। কবির ভাষায়,
“The things which I have seen,
I can now see no more.”
তৃতীয় ও চতুর্থ স্তবকে কবি বলেছেন বসন্তের স্পর্শে প্রকৃতি ও মানুষ আনন্দিত। মেষপালকেরা প্রকৃতির আনন্দ আকণ্ঠভরে পান করছে, তার সৌন্দর্য দুচোখ ভরে উপভোগ করছে কিন্তু কবির মন নিরানন্দ কারণ তিনি যে সেই সৌন্দর্যের সৃষ্টি হারিয়ে ফেলেছেন। এর জন্য কবি হৃদয়ের ব্যথা, বেদনা বিশ্বাস ও কান্না তীব্র হয়ে উঠেছে। কবি বলেছেন,
Whither is fled the visionery gleam?
Where is it now, the glory and the dream?
পঞ্চম স্তবক থেকে অষ্টম স্তবক পর্যন্ত কবি মানুষের জন্ম পূর্ব অস্তিত্ব সম্বন্ধে একটি গূঢ় তত্ত্বের আলোচনা করেছেন। তত্ত্বটি অনেকাংশে দুর্বোধ্য।
নবম ও দশম স্তবকে কবির Robust optimism, দুর্ধর্ষ আশাবাদের কথা প্রকাশ পেয়েছে। কবি আজন্ম প্রকৃতি পূজারী এবং মানবপ্রেমিক। সেই আত্মবিশ্বাস তাঁকে ক্ষণিক সংশয় থেকে মুক্ত করেছে। বাস্তব জীবনের পরিকীর্ণ জঞ্জালের স্তূপ তাঁর হৃদয়ের কল্পলোককে শ্বাসরুদ্ধ করে মরে ফেলতে পারেনা। তাঁর কল্পনার মায়াঞ্জনটিকে মুছে দিতে পারে না। এই দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে তিনি বলেছেন।
Thanks to the human heart by which we live
Thanks to its tenderness its joys and fears.
To me the meanest flower that blows can give
Thoughts that do often lie too deep for tears.
সূত্র
ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস, ডঃ শীতল ঘোষ, ফ্রেন্ডস বুক কর্নার, ২০০৬
Leave a Reply