বাঙালির খাদ্যের ইতিহাস

লেখাটি গোলাম মুরশিদ রচিত “হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি” গ্রন্থের ত্রয়োদশ অধ্যায় “বাঙ্গালির খাবার” থেকে প্যারাফ্রেইজড করে লেখা হয়েছে।

মূল কথা

কবি ঈশ্বর গুপ্ত বলেছিলেন, “ভাত মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালী সকল।” প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে বাংলায় ধান এসেছিল। চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক স্থানে শুকনো জমিতে ধান চাষ করা হতো। তবে মনে করা হয়, ভারতেই প্রথম জলের জমিতে ধান চাষ শুরু হয়েছিল। এই ধরনের চাষ বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিস্থিতির জন্য খুবই উপযোগী ছিল। এই কারণেই ধীরে ধীরে ভাত বাঙালিদের প্রধান খাবারে পরিণত হয়। চর্যাপদে শুধু চালের কথা বলা হয়েছে, অন্য কোনো শস্যের উল্লেখ নেই। যদিও সেই সময় ভারতের পূর্ব দিকে গম চাষ শুরু হয়েছিল।

বাঙালিদের কাছে ভাত এতটাই প্রিয় ও প্রধান খাবার যে, একজন মানুষের প্রতিদিন যতটুকু ক্যালোরির প্রয়োজন, তার বেশিরভাগই তারা ভাতের মাধ্যমে গ্রহণ করে। গরীব মানুষের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি দেখা যায়। ১৯৪০ সালের একটি সরকারি তথ্য অনুযায়ী, একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন গড়ে ৩৬০০ ক্যালোরি দরকার। কিন্তু গরীব মানুষরা ৩৫০০ ক্যালোরিরও বেশি পেত শুধু ভাত থেকে। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, এই দেশে অনেক মানুষ আধ সের চালের ভাত খায়। এমনকি ধনী লোকেরাও বেশি ভাত খেতে পছন্দ করে। এখনও বাঙালিরা ভাত পেলে রুটি খেতে চায় না।

কখন থেকে মাছ খাওয়া শুরু হয়েছে, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে, বাংলাদেশ নদী ও বিলের দেশ হওয়ায় মনে হয় মাছ সবসময়ই খাওয়া হতো। সে কারণেই ভাত ও মাছের সাথে বাঙালিদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। চন্দ্রকেতুগড়ে মাছের ছবিসহ একটি ফলক পাওয়া গেছে। নীহাররঞ্জন রায় মনে করেন, এই ফলকটি চতুর্থ শতাব্দীর। এছাড়াও, অষ্টম শতাব্দী থেকে পাহাড়পুর ও ময়নামতীতে তৈরি হওয়া অনেক পোড়ামাটির ফলকে মাছের ছবি দেখা যায়। এমনকি, মাছ কাটা ও ঝুড়িতে করে মাছ নিয়ে যাওয়ার ছবিও সেখানে আছে। এগুলো থেকে বোঝা যায় যে, এই অঞ্চলের মানুষেরা মাছ ভালোবাসে। কিন্তু ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষজন বাঙালিদের মাছের প্রতি এই ভালোবাসা ভালোভাবে নেয়নি। তারা এখনও মাছ খায় না। মনে করা হয়, বঙ্গদেশের ধার্মিক ব্রাহ্মণরাও পাহাড়পুরের সময় মাছ খেতেন না।

সুকুমার সেনের মতে, প্রাচীনকালে বাঙালি সমাজে মাছ-মাংস ব্রাহ্মণদের মধ্যে জনপ্রিয় না থাকলেও, অব্রাহ্মণদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। অন্যদিকে, ধার্মিক বৌদ্ধরা প্রথম থেকেই মাছ খেতেন। কিন্তু কই, রুই, ইলিশের মতো সুস্বাদু খাবার অথবা একটি দেশের জনপ্রিয় সংস্কৃতিকে শুধু ধর্মের অজুহাতে দূরে সরিয়ে রাখা সহজ ছিল না। তাই দশম বা একাদশ শতকে ভবদেব ভট্ট নামে এক বাঙালি পণ্ডিত মাছ খাওয়া কতো ভালো, তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন এবং এর পক্ষে অনেক যুক্তিও দিয়েছিলেন। অন্য একটি পুরাণ, বৃহদ্ধর্মপুরাণেও মাছের গুণাগুণ ও গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ব্রাহ্মণরা রুই, পুঁটি, শোল ও সাদা রঙের আঁশযুক্ত মাছ খেতে পারে। জীমূতবাহনও মাছের বিপক্ষে ছিলেন না। তিনি ইলিশ মাছ ও ইলিশ মাছের তেলের প্রশংসা করেছেন। বারো শতকে সর্বানন্দ যখন তাঁর ‘টীকাসর্বস্ব’ গ্রন্থে মাছের সমালোচনা করেছিলেন, তখনও তিনি ইলিশের কথা ভোলেননি। শুনা যায়, বারো শতকে বা তার কিছু পরে উদ্ভট শ্লোক নামে কিছু মজার কবিতা লেখা হয়েছিল। সেগুলোতে মাছের, বিশেষ করে কই মাছের গুণগান করা হয়েছে। এছাড়াও, ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’ নামে একটি বইতে মাছ খাওয়ার যথেষ্ট প্রশংসা করা হয়েছে। সেখানকার একটি পদে বলা হয়েছে, যে নারী প্রতিদিন কলাপাতায় গরম ভাত, ঘি, মৌরলা মাছের ঝোল ও নালিতা শাক পরিবেশন করেন, তার স্বামী ভাগ্যবান।

বাঙালিরা মাছ খুব ভালোবাসে বলেই বাঙালি মায়েরা নানাভাবে মাছ রান্নার নতুন পদ্ধতি তৈরি করেছেন। বাংলা ভাষার সবচেয়ে পুরনো রান্নার বই ‘পাক রাজেশ্বর’ উনিশ শতকে প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর ১৯২৩ সালে বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘পাক-প্রণালী’ প্রকাশিত হয়। এই দুটি বইতেই মাছ রান্নার বিভিন্ন নিয়ম ও পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তবে, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী তাঁর রান্নার বইতে ৫৮ রকমের মাছ রান্নার পদ্ধতি আলোচনা করেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, বাঙালিদের মাছের প্রতি কতটা আগ্রহ রয়েছে।

মাছের প্রতি বাঙালিদের দুর্বলতা বহু আগে থেকেই লোকেদের কাছে তাদের ‘মাছ-খেকো’ দুর্নাম এনে দিয়েছে। সর্বানন্দ ছিলেন সেই সমালোচকদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর ‘টীকাসর্বস্ব’ গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, শুঁটকি মাছ নিম্নবঙ্গের মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয় খাদ্য। এই কারণেই তিনি বাঙালিদের ‘শুঁটকি-খেকো বচ্ছা’ – অর্থাৎ শুঁটকি মাছ খাওয়া বাচ্চা – বলে তিরস্কার করেছেন। আগে আলোচনা করা হয়েছে যে, বঙ্গদেশে বসবাসকারী মোগল কর্মকর্তারাও বাঙালিদের মাছ-ভাত অপছন্দ করতেন। এমনকি ঈসা খান ও তাঁর পুত্র মুসাকেও তাঁরা জেলে অর্থাৎ মৎস্যজীবী বলে অপমান করেছেন। ইংরেজ শাসন শুরু হওয়ার পরেও আগের আমলের কর্মকর্তারা এই ধারণা থেকে বেরোতে পারেননি। গোলাম হোসেন সালিম ১৭৮০ এর দশকে তাঁর ‘রিয়াজ-উস সালাতিন’ গ্রন্থে এই একই মানসিকতা তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন: “এ দেশের উঁচু-নিচু সবাই মাছ, ভাত, সর্ষের তেল, দই, ফল আর মিঠাই খেতে পছন্দ করে। প্রচুর লাল মরিচ এবং লবণ তাদের পছন্দ। তারা আদৌ গম এবং যবের রুটি খায় না। ঘিয়ের রান্না খাসি এবং মোরগের মাংস তাদের মোটেই সহ্য হয় না।”

আগে মাছের মতো ডাল ততটা খাওয়া না হলেও, পরবর্তীকালে এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। চর্যাপদের মতো প্রাচীন গ্রন্থে ডালের উল্লেখ না থাকায়, ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় মনে করেন যে, প্রাচীন বাংলায় ডালের চাষ ছিল না এবং এটি উত্তর ভারত থেকে আমদানি করা হত। তবে, মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে ডালের বহুল ব্যবহার দেখা যায়, যা থেকে বোঝা যায় ডাল ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়েছে। যেহেতু গরীব মানুষেরা আমদানি করা ডাল কেনার সামর্থ্য রাখতেন না, তাই মনে করা হয় ডাল স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য হয়ে গিয়েছিল। চণ্ডীমঙ্গলে কালকেতুর মতো দরিদ্র চরিত্রকে ডায়েটের প্রধান খাবার হিসেবে ডাল খেতে দেখা যায়। মধ্যযুগের অন্যান্য সাহিত্যেও বিভিন্ন প্রকার ডালের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন মুসুর, মুগ, মাষকলাই, ছোলা এবং ফুটকলাই ডাল।

বাঙালি সমাজে মাংস খুব জনপ্রিয় না হলেও, সমাজের গরীব স্তরে শামুক, কাঁকড়া, মুরগি, হাঁস, শুয়োর ও বিভিন্ন পাখির মাংস খাওয়া প্রচলিত ছিল। ভদ্রলোকেরা হরিণ, ছাগল, ভেড়া ও কচ্ছপের মাংস খেতেন। এমনকি ভবদেবের মতে, খরগোশ ও সজারুর মাংস খাওয়াও নিষিদ্ধ ছিল না। পাহাড়পুরের পোড়ামাটির ফলকে হরিণ শিকারের ছবি দেখা যায়। শবরদের প্রধান কাজ ছিল পশু শিকার করা। বিদেশি পর্যটকদের বিবরণে এবং মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল ও নারায়ণ দেবের পদ্মাপুরাণের মতো গ্রন্থেও মুসলমানদের মাংস খাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়। মুকুন্দরাম ও বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল থেকে জানা যায়, মুসলমানরা মুরগির মাংস খেতেন এবং মোল্লারা মুরগি জবাই করে পারিশ্রমিক নিতেন। মুসলমানরা গরুও খেতেন, এবং মুকুন্দরাম বলেছেন যে, গোমাংস বিক্রেতাদের নরকেও স্থান হবে না।

চৈতন্যচরিতামৃত, মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল, নারায়ণদেবের পদ্মাপুরাণ, বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল ও ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল সহ বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগে বাঙালিরা কী খেতেন, তার একটা ধারণা পাওয়া যায়। চৈতন্যচরিতামৃত থেকে জানা যায়, সার্বভৌমের বাড়িতে চৈতন্যদেবের জন্য দশ প্রকার শাক রান্না হয়েছিল, কিন্তু তাঁর মা রান্না করেছিলেন বিশ প্রকার শাক। সেই সময় বিশ রকমের শাক প্রচলিত ছিল। চৈতন্যচরিতামৃত ও অন্যান্য গ্রন্থে অচ্যুতা, কলমি, নটে, নালিতা, নিম, পটল, পাট, পালং, পুঁই, পোর লতার শাক, বেতাগ, বেনাতি, লাউ ডগা ও হেলেঞ্চা সহ বিভিন্ন শাকের নাম পাওয়া যায়। মধ্যযুগের সাহিত্যে মাছের বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়, বিশেষত ভারতচন্দ্রের তালিকাটি বেশ দীর্ঘ। আধুনিক কালে কিছু বিদেশি মাছ যোগ হলেও, সেকালের সাহিত্যে বাঙালি সমাজে পরিচিত প্রায় সব মাছের নাম পাওয়া যায়। পদ্মাপুরাণ, মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ভারতচন্দ্র ও ঈশ্বর গুপ্তের রচনা থেকে বিভিন্ন মাছের নাম জানা যায়, যেমন আড়, ইচা, ইলিশ, উলকা, এলেঙ্গা, কাতল, কালবসু, কুড়িশা, কৈ, খয়রা, খরশোলা, খলিশা, গড়ুই, গাগর, গাঙ্গদাঁরা, চাঁদা, চান্দাগুঁড়া, চিংড়ি, চিতল, চেঙ্গ, চেলা, টেংরা, ডানিকোনা, তাপসে, তেচক্ষা, পাঁকাল, পাঙ্গাস, পাবদা, পার্শে, পুঁটি, ফলুই, বাঁশপাতা, বোয়াল, বাচা, বাটা, বাণ, বানি, বেলে, ভেকুট, ভেদা, ভোলচেঙ্গা, ভোলা, ময়া, মহাশোল, মাগুর, মৃগাল, মৌরলা, রিঠা, রুই, লাটা, শঙ্কর, শাল, শিঙ্গী ও শোল। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে সতীশচন্দ্র শাস্ত্রী আরও কিছু মাছের তালিকা দেন, যেমন অঞ্জনা, আলবুলা, আরশি, কটকটিয়া, করাতি, কাঁকাল, কাঁকাশিয়া, কারসি, কুরচি, ঘাগৌট, ঘারুয়া, চন্দ্রমারা, চাকুন্দা, চাপলি, টেপা, তর, দেওকাটা, দেবারী, নফেলা, পটকা, পান, ফেঁসা, ভাঙ্গন ও শিলন্দ।

প্রাচীন সাহিত্য থেকে শুধু নানা ধরনের মাছের নামই নয়, বরং খাদ্যের স্বাদ বাড়াতে মাছ কত বিচিত্র উপায়ে রান্না করা হত, তাও জানা যায়। মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে মাছ রান্নার বিভিন্ন পদ্ধতির আভাস পাওয়া যায়। খুল্লনাকে ঘরে ফিরিয়ে আনার পর কী কী মাছ রান্না করা হয়েছিল, তার বর্ণনা কবি দিয়েছেন:

সর্ষের তেলে চিতল মাছের কোল ভাজা; কুমড়ো বড়ি আর আলু দিয়ে রুই মাছের ঝোল; আদারস দিয়ে সর্ষে তেলে কই মাছ ভাজা; কাতলা মাছের ঝোল, খরশোলা মাছ ভাজা, আর শোল মাছের কাঁটা বের করে কাঁচা আমের সঙ্গে রান্না।

বিজয়গুপ্তের ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে বিভিন্ন প্রকার মাছ রান্নার উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে রুই মাছের সাথে কলমি শাকের ডগা, মাগুর মাছের সাথে কচুর লতি, সরষের তেল ও ঝাল দিয়ে খরসুন মাছ, চিংড়ি মাছের মুড়োর ভিতরে লঙ্কা গুঁড়ো ভরে সুতো দিয়ে বাঁধা, চিতল মাছের পেটি ভাজা এবং কৈ মাছের ঝাল ঝোলের মতো পদগুলোর বর্ণনা আছে।

সেই সময়ে ওল, কচু, করঞ্জা, কলা, কাঁকরোল, কাঁচকলা, কাঁঠালের বীজ, কুমড়ো, নিম, পটল, বরবটি, বেগুন, মউয়া, মানচাকি, মূলা, লাউ এবং শিমের মতো বিভিন্ন সবজি প্রচলিত ছিল। প্রাচীন ও মধ্যযুগের একটা বড় সময় পর্যন্ত এই অঞ্চলের মানুষেরা আলুর সাথে পরিচিত ছিল না। কারণ পর্তুগিজ বণিকেরা সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আলু বঙ্গদেশে নিয়ে আসে। রান্নার কাজে শুধু সরষের তেলই নয়, তিলের তেলও ব্যবহার করা হত।

আগের দিনে, বিধবা এবং অন্যান্য কিছু মানুষের মাছ-মাংস খাওয়ার বিষয়ে বিধি-নিষেধ থাকায়, সেই সময়ের গৃহিণীরা নিরামিষ রান্না এবং নানা ধরনের মিষ্টি তৈরিতে মাছের থেকেও বেশি নতুনত্ব নিয়ে আসতেন। প্রাচীন সাহিত্যে নিরামিষ রান্নার মধ্যে লাবড়া, চচ্চড়ি, ঝাল ঝোল, মোচার ঘন্ট, মোচা ভাজা, কুমড়োর বড়ি, ভর্তা প্রভৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়। মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে নিরামিষ রান্নার বৈচিত্র্যের একটি উদাহরণ পাওয়া যায়। বাঙালি পরিবারে সাধারণত মহিলারা ঠিক করতেন যে কবে কী রান্না হবে। কিন্তু একদিন শিব গণেশের মা দুর্গাকে কিছু রান্নার আদেশ করেন। সেই আদেশে তিনি যেসব রান্নার কথা বলেছিলেন, তা বেশ আগ্রহ জাগায়। এছাড়াও, সেই তালিকা থেকে তখনকার দিনের “উৎকৃষ্ট খাবার” সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। শিবের ফরমাশ এগুলো:

নিম, শিম আর বেগুন দিয়ে শুক্তো; বেশি পরিমাণে কুমড়ো আর বেগুন রান্না; ফুলবড়ি আর আদার রস দিয়ে নটে শাক আর কাঁঠালের বিচি; সর্ষের তেল দিয়ে সর্ষে শাক আর বাথুয়া শাক; লেবুর রস দিয়ে মসুর ডাল; পলতার কড়ি দিয়ে চচ্চড়ি; কুমড়োর বড়ি আর গুড়ো করা কাঁঠালের বিচি দিয়ে মানকচুর বেসার; ঘি আর জিরে দিয়ে পালং শাক। (মিষ্টির মধ্যে শিব রান্নার আদেশ দিয়েছিলেন মিষ্টি দিয়ে করমচার ফল; ঘিয়ে ভাজা ফুলবড়ি দুধে ডুবিয়ে রান্না; অনেক ক্ষণ জ্বাল দিয়ে মিষ্টি দিয়ে ছোলার ডাল; আর ক্ষীর।)

কালকেতুর মা যখন গর্ভবতী ছিলেন, তখন তাঁর সাধ-ভক্ষণের ইচ্ছার তালিকায় কিছু নিরামিষ খাবারের উল্লেখ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ছিল পাকা চালতার টক ঝোল, হেলেঞ্চা, কলমী, গিমা ও বোয়ালি শাকের পদ, পলতা শাক, পুঁইশাকের ডাঁটা, মুখী কচু ও ফুলবড়ি দিয়ে তৈরি মরিচের ঝাল, এবং বেগুন, শিম ও ডুমুর ফল দিয়ে মুলা মিশিয়ে রান্না করা পদ। নিরামিষ ছাড়াও, বাঙালিরা বিভিন্ন প্রকার টক রান্নাতেও পারদর্শী ছিলেন, যেমন – পাকা কলার টক।

মিষ্টি খাবার সবসময়ই বাঙালির প্রিয়। প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলের মানুষ পায়েস ও পিঠে পছন্দ করতেন। সময়ের সাথে সাথে মিষ্টি রান্নার ধরনে তারা নতুনত্ব এনেছেন। মধ্যযুগের সাহিত্যে বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি ও মিষ্টান্নের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। কার্যত, মিষ্টি ও নিরামিষ রান্নার এমন ঐতিহ্য বঙ্গদেশে গড়ে উঠেছে যা সম্ভবত ভারতবর্ষের অন্য কোথাও দেখা যায় না। এই খাবারগুলি বাঙালি সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে মিশে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, একদিকে শুক্তো ও কাসুন্দীর কথা বলা যায়, তেমনই অন্যদিকে রসগোল্লা ও সন্দেশও জনপ্রিয়। মধ্যযুগের সাহিত্যে নানা ধরনের কাসুন্দীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন আমের কাসুন্দী, আদার কাসুন্দী ও ঝাল কাসুন্দী। বাঙালি বধূরা নানা প্রকার আচারও তৈরি করতেন। বর্তমানে প্রচলিত নোনতা শুকনো খাবার, যেমন কচুরি, নিমকি, পুরি, পরোটা, পাপড়, পেঁয়াজি, বেগুনি, রুটি, লুচি, সিঙ্গাড়া – এগুলোর প্রচলন কবে শুরু হয়েছিল তা বলা কঠিন। তবে মনে করা হয়, এর কিছু পদ মুসলিম আমলে উত্তর ভারত থেকে এসেছে, এমনকি ব্রিটিশ আমলেও এসে থাকতে পারে। মোটের উপর, মধ্যযুগের সাহিত্যে রুটির উল্লেখ থাকলেও, এই খাবারগুলির উল্লেখ তেমন দেখা যায় না। শুকনো খাবারের মধ্যে আতপ চালের চিঁড়া, কোলিচূর্ণ, খই, ফুটকলাই, হুড়ুম ও মুড়কির কথা বলা হয়েছে।

বিভিন্ন প্রকার নাড়ুর কথাও উল্লেখ আছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে চালের নাড়ু, নারকেলের নাড়ু, মুড়ির নাড়ু ও শুণ্ঠিখণ্ডের নাড়ুর কথা বলা হয়েছে। এই নাড়ুগুলিতে কর্পূরের ব্যবহার ছিল প্রচুর। সেকালেও পিঠে খাওয়া বাঙালিদের কাছে বিশেষ আনন্দের বিষয় ছিল। সেই সময়কার জনপ্রিয় মিষ্টি ও মিষ্টান্নগুলির অনেক নাম চৈতন্যচরিতামৃতে পাওয়া যায়। যেমন – অমৃত গুটিকা, আমের খণ্ড, কাঞ্জিবড়া, খিরিসা, ক্ষীরখণ্ড, ক্ষীরপুলি, ঘোল, চন্দ্রপুলি, চন্দ্রকান্তি, ছানাবড়া, ছেনা, দই, দুগ্ধকুষ্মাণ্ড, দুগ্ধচিড়া, দুগ্ধতুম্বী, দুগ্ধলকলকি, নারিকেলপুলি, নালবড়া, পাতপিঠা, পানা, পায়স, পিঠা, পেঁড়া, বেসারি, মণ্ডা, মনোহরা, মাষকলাইয়ের বড়া এবং রসালা। খেজুর রস পান করা এবং তা থেকে গুড় ও পাটালি তৈরি করার রীতি বাঙালি সমাজে বহু বছর ধরে চলে আসছে। এছাড়াও, চালের গুঁড়োর সাথে নারকেল, গুড় ও অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে পিঠে তৈরির ঐতিহ্য বিশেষভাবে বাঙালিদের নিজস্বতা, যা ভারতের অন্য কোথাও এভাবে দেখা যায় না।

গোপাল হালদার রসিকতা করে বাঙালি সংস্কৃতিকে রসগোল্লা ও সন্দেশের সংস্কৃতি বলেছেন। তবে মজার ছলে বললেও, এই দুটি খাবার বাঙালির খাদ্যতালিকায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এবং অন্যান্য অঞ্চলের মানুষও এই মিষ্টি দুটিকে বাঙালি মিষ্টি হিসেবেই চেনেন। তবে অবাক করার বিষয় হল, কয়েক শতাব্দী আগের বাংলা সাহিত্যেও আজকের জনপ্রিয় ছানা দিয়ে তৈরি সন্দেশ ও রসগোল্লার উল্লেখ নেই। রসগোল্লার নাম তো নেই-ই, আর সন্দেশের উল্লেখ থাকলেও তা আজকের সন্দেশ বোঝাত না। বরং আত্মীয় বাড়ি থেকে আসা খাজার মতো মিষ্টিকেও সন্দেশ বলা হত। রসগোল্লার উদ্ভব ঠিক কবে, তা জানা যায় না। তবে মনে হয়, ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার আগেই রসগোল্লার আবির্ভাব হয়েছিল। উনিশ শতকে রসগোল্লার সাথে বাংলার এক গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। বাঙালির খাবার হিসেবে রসগোল্লার এই পরিচিতি পেতে বেশ কয়েক শতাব্দী সময় লাগা স্বাভাবিক। বাঙালি ময়রা রসগোল্লার নানান পরিবর্তন করে আরও অনেক নতুন মিষ্টি তৈরি করেছেন, যেমন – রাজভোগ, কাঁথির স্বরাজভোগ, রসগোল্লার চাটনি, কমলাভোগ, রসমালাই ইত্যাদি। রসগোল্লার শুকনো প্রকারের মধ্যে আছে দানাদার, ক্ষীরমোহন, চমচম ও ছানাবড়া। মধ্যযুগের সাহিত্যে, বিশেষ করে চৈতন্যচরিতামৃতে ছানাবড়ার নাম পাওয়া যায়। বিজ বিহারী ভট্টাচার্য মনে করেন যে, এই ছানাবড়াই হয়তো রসগোল্লার পূর্বপুরুষ।

সন্দেশও রসগোল্লার মতোই জনপ্রিয় একটি বাঙালি মিষ্টি। বিজনবিহারী ভট্টাচার্যের মতে, চৈতন্যচরিতামৃতে উল্লেখিত মনোহরা মিষ্টিটি সম্ভবত সন্দেশের পুরনো রূপ। সন্দেশ ছানা ও ক্ষীর দিয়ে তৈরি হয়। বাঙালিরা বহু বছর ধরে সন্দেশ তৈরিতে দক্ষতা ও নতুনত্ব এনেছে। একই সন্দেশ সামান্য বদলে বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন নামে পরিচিত। কিছু অঞ্চল বিশেষ সন্দেশ তৈরিতে খ্যাতি লাভ করেছে, যেমন নাটোরের কাঁচাগোল্লা। মণ্ডা বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হলেও মুক্তাগাছার মণ্ডা বিখ্যাত। পশ্চিমবঙ্গে নলেন গুড়ের মণ্ডা পাওয়া যায়। নলেন গুড়ের সন্দেশও সর্বত্র পরিচিত। কালাকাঁদ, কড়াপাক, ডিম সন্দেশ, বরফি ইত্যাদি সন্দেশের বিভিন্ন প্রকারভেদ। পেঁড়া মূলত পশ্চিমবঙ্গের মিষ্টি। আগে ক্ষীরের সন্দেশকে পেড়া বলা হলেও, এখন পেড়া ছানার সন্দেশ নামেই পরিচিত।

মনে করা হয়, পান্তুয়া মিষ্টির ধারণা রসগোল্লা থেকেই এসেছে। আঠারো শতকের চণ্ডীমঙ্গল ও ১৮১৩ সালের করুণানিধানবিলাসে পান্তুয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়। এ থেকে বোঝা যায় রসগোল্লা তারও আগের মিষ্টি। পান্তুয়া পুরনো হওয়ার পরে, এতে নানা পরিবর্তন আসে। লেডি কেনি তেমনই একটি প্রকারভেদ, যা উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে লেডি ক্যানিং-এর নামে তৈরি হয়। গোলাপজাম ও কালোজামও পান্তুয়ারই ভিন্ন রূপ। জিলাপি বাঙালিদের আর একটি জনপ্রিয় ও সস্তা মিষ্টি। এর উৎস সঠিকভাবে জানা না গেলেও, মনে করা হয় এটি নবাবী আমলের শেষের দিকে চালু হয়েছে। জয়নারায়ণের লেখাতেও জিলাপির কথা আছে।

মধ্যযুগের কবিরা অনেক ফলের কথা লিখেছেন, যদিও সব ফল বাংলাতেই পাওয়া যেত এমন নয়। যেমন, আঙুর বা কমলালেবু এখানে কম হতো। তবে আম, আমলকী, কলা, কাঁঠাল, কুল, কেসুর, খেজুর, ছোলঙ্গ, ছোহরা, জাম, জামীর, ডালিম, তাল, পানিফল, নারকেল, বাদাম ও বেল সম্ভবত সর্বত্র পাওয়া যেত। প্রাচীন সাহিত্যেও আমের উল্লেখ আছে। তখনকার কবিরা কলার মধ্যে চাঁপাকলার কথা বিশেষভাবে বলেছেন।

আগের দিনে এখনকার মতো এতো মশলা ছিল না। তবে কবিরা কিছু মশলার নাম বলেছেন, যেমন – আদা, এলাচি, কর্পূর, কাবাব চিনি, জিরা, ধনে, গোলমরিচ, মৌরী ও লবঙ্গ। অম্বল রান্নায় আম, আমচুর, আমড়া ও কুল ব্যবহার করা হত। টক ফলের মধ্যে ছিল আমলকী, করমচা, গোঁড়া লেবু, পাতিলেবু, জামির ও তেঁতুল। ঝাল বাঙালিদের রান্নার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। তবে সতেরো শতকের আগে লঙ্কা মরিচ বঙ্গদেশে বা ভারতে ছিল না। পর্তুগিজরা আলুর মতো লঙ্কাও নিয়ে এসেছিল।

মাছ-ভাত সম্ভবত হিন্দু ও দেশীয় মুসলমান উভয়েই খেতেন। অন্যান্য খাবারেও তেমন পার্থক্য ছিল না। তবে মাংসের ক্ষেত্রে কিছু ভিন্নতা ছিল। শহরের মুসলমানরা মাংস এবং গরুর মাংস খেতেন। মুরগি ও ছাগল জবাই করার জন্য মোল্লাদের পারিশ্রমিক দেওয়ার প্রথা ছিল। এ থেকে বোঝা যায় মুসলমানদের খাদ্যাভ্যাস হিন্দুদের থেকে কিছুটা আলাদা ছিল। শাক্ত ধর্মাবলম্বী হিন্দুরা ছাগল, হরিণ ও কচ্ছপের মাংস খেতেন। নিচু শ্রেণির হিন্দুদের মধ্যে সজারু, গোধিকা ও শুয়োরের মাংস খাওয়ার চল ছিল। মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল অনুযায়ী, কালকেতুর মা সাধের অনুষ্ঠানে সজারু ও গোধিকা পোড়া খেতে চেয়েছিলেন।

এত রকমের খাবারের কথা বলা হলেও, এগুলো মূলত ধনী লোকেরাই খেতেন। গরীব মানুষের প্রধান খাবার ছিল পান্তাভাত। ষোড়শ শতাব্দীতে আসা ঐতিহাসিক সাবাস্তিয়ানো মানরিক লিখেছেন, গরীবেরা নুন ও শাক দিয়ে ভাত খেতেন, ঝোল প্রায় জুটতই না। মুকুন্দরামের বর্ণনায় দরিদ্র কালকেতুর খাবার ছিল খুদের জাউ, লাউ দিয়ে রান্না করা ডাল, ওল, কচু, করঞ্জা ও আমড়া। কখনো সখনো দইও পাওয়া যেত। দই ধনী-গরীব সকলের কাছেই প্রিয় ছিল। কালকেতু দই পেয়ে খুশি হত, আবার অনেক শাস্ত্রকারও ভাত, শাক ও দইয়ের প্রশংসা করেছেন। তবে গরীবদের ভাগ্যে সবসময় দই জুটত না। দইয়ের মতো না হলেও, ঘোলও একটি জনপ্রিয় পানীয় ছিল।

প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার সমাজের গরিব মানুষেরা অভাব-অনটনে দিন কাটাতো। প্রাচীন চর্যাপদেও দরিদ্রদের দৈনন্দিন কষ্টের চিত্র পাওয়া যায়, যেখানে খাদ্যের অভাবে প্রায়ই উপোস থাকার কথা বলা হয়েছে। মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম এবং আরো অনেকে সামান্য খুদের জাউ খেয়ে জীবনধারণের কথা লিখেছেন। এমনকি মধ্যযুগের শেষ দিকে ভারতচন্দ্রের লেখাতেও দারিদ্র্যের ছবি দেখা যায়। তিনি অন্নদার দারিদ্র্য বোঝাতে গিয়ে বলেছেন, খাদ্যের অভাবে তাঁর শরীর কঙ্কালসার হয়ে গেছে। ভারতচন্দ্রের সময় চালের দাম কম থাকলেও, অনেক গরিব মানুষ খেতে পেতো না, কারণ তাদের মাসিক আয় ছিল খুবই সামান্য। অন্যদিকে, ধনী সমাজে খাবারের প্রাচুর্য ছিল, যা চৈতন্যচরিতামৃতের খাদ্য তালিকার সাথে তুলনীয়।

খাওয়ার পরে পান-সুপারি ও মৌরি খাওয়ার রেওয়াজ ছিল ব্যাপক। প্রাচীন চর্যাপদে পান ও কর্পূরের উল্লেখ পাওয়া যায়, এবং মুকুন্দরাম গুয়ার কথা বলেছেন। প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত বিভিন্ন কাব্যে মদ্যপানের উল্লেখ পাওয়া যায়, এমনকি বৈষ্ণব পদাবলীতেও নারীদের মদ্যপানের কথা আছে। তবে মনে করা হয়, মদ্যপান প্রকাশ্যে সবার মধ্যে প্রচলিত ছিল না, বরং ধনীদের মধ্যেই বেশি দেখা যেত। ধনী মহিলারাও মদ্যপান করে নেশা করতেন, এমন উদাহরণও আছে। তালের রস, খেজুর রস ও ভাত পচিয়ে মদ তৈরি করা হতো, মহুয়া থেকেও ভালো মদ পাওয়া যেত। এমনকি পান্তাভাত থেকেও সামান্য নেশা হতো। মুসলিম শাসনামলেও ধনীরা মদ্যপান করতেন। হোসেনশাহী আমলে সুলতানদের জন্য ‘খাস শরাবদার’ নামে পদ ছিল, যা থেকে বোঝা যায় সুলতানদের মধ্যে মদ্যপান স্বীকৃত ছিল এবং নিয়মিত চলতো। তবে ধর্মীয় কারণে অনেক মুসলমান মদ্যপান করতেন না এবং অন্যদেরও নিষেধ করতেন। এই নিষেধ সত্ত্বেও, অন্যভাবে নেশা করার চল ছিল। যেমন, অনেকে পচা ভাত রান্না করে খেতেন, যা একপ্রকার মদ্যপান বলেই ধরা হয় এবং এতে নেশা হতো।

ধর্মীয়ভাবে মদ্যপানকে উৎসাহিত করা না হলেও, ধনী ও অভিজাত মুসলমানরা এ ব্যাপারে উদার ছিলেন। সতেরো শতকে বাংলার সুবেদার ইসলাম খানের আমলে তাঁর আমির-ওমরাহদের মধ্যে ব্যাপক মদ্যপান প্রচলিত ছিল। যদিও ইসলাম খান নিজে মদ্যপানের বিরোধী ছিলেন, তাই আমির-ওমরাহরা মজলিশে আসার আগে মদ খেয়ে গন্ধ আতর দিয়ে দূর করার চেষ্টা করতেন। ইসলাম খানের বন্ধু সম্রাট জাহাঙ্গীর প্রচুর মদ্যপান করতেন এবং মুদ্রায় পানপাত্র হাতে তাঁর ছবি আছে। নূরজাহানেরও পানপাত্র হাতে ছবি পাওয়া যায়। জাহাঙ্গীর আফিমও খেতেন। বাংলার হিন্দু সমাজের অনেকে পূজার সময় ভাঙ খেয়ে প্রকাশ্যে নেশা করতেন, যা এখনো কিছু পরিমাণে বিদ্যমান। গাঁজা খাওয়ারও চল ছিল। উনিশ শতকে রাজশাহীর নওগাঁতে প্রচুর গাঁজা উৎপাদন হতো। সেকালে আফিমের ব্যবহারও ছিল। হুতোম প্যাঁচার নকশা ও বঙ্কিমচন্দ্রের লেখায় আফিমখোরের কথা পাওয়া যায়। আঠারো শতকের সংবাদপত্রে আফিম তৈরি ও বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখা গেছে। বেশিরভাগ আফিম রপ্তানি হলেও, দেশেও কিছু ব্যবহার হতো। তবে ইংরেজরা চীনে যেমন ব্যাপকভাবে আফিম চালু করেছিল, ভারতে তেমনটা হয়নি। উনিশ শতকের কলকাতায় নানা ধরনের নেশা প্রচলিত ছিল, যা অরুণ নাগের ‘চিত্রিত পদ্মে’ বইতে আলোচনা করা হয়েছে।

বাংলার খাদ্যাভ্যাসে মুসলমানদের প্রভাব

মধ্যযুগে মুসলিমদের আগমনের কারণে বাঙালি সমাজে নতুন খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্য উপকরণ আসতে শুরু করে। এর ফলে খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে পরিবর্তন শুরু হয়। তবে বাঙালি সমাজে যেখানে খাবারের ঘ্রাণ নেওয়াকেও অর্ধেক ভোজন মনে করা হত এবং এর ফলে জাত চলে যাওয়ার ভয় থাকত, সেখানে রক্ষণশীল হিন্দুরা মুসলিমদের খাবার সহজে গ্রহণ করতে পারেনি।

বিদেশ থেকে আসা বাদশা, নবাব ও রাজকর্মচারীরা উত্তর ভারত এবং পারস্য ও মধ্য এশিয়া থেকে রান্নার নিজস্ব ঐতিহ্য নিয়ে এসেছিলেন। মনে করা হয় যে, তাদের হাত ধরে সেই খাবার প্রথমে দেশীয় গরিব মুসলমান ও নিচু শ্রেণির মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছিল। এছাড়াও, যেসব ধনী হিন্দু মুসলমান হয়েছিলেন বা মুসলিম শাসকদের সাথে কাজ করতেন, তারাও ধীরে ধীরে মুসলিম খাবার গ্রহণ করতে শুরু করেন। তবে এই পরিবর্তন ধীরে ধীরে কয়েক শতাব্দীতে হয়েছিল। কখন থেকে মুসলিম রান্না বৃহত্তর বাঙালি সমাজে প্রবেশ করতে শুরু করে, তা স্পষ্ট করে বলা যায় না। উনিশ শতকের আগে অমুসলিম কবিদের লেখায় মোগলাই খাবারের উল্লেখ পাওয়া যায় না। তাই মনে করা হয় যে, ভারতচন্দ্রের সময় পর্যন্ত মুসলিম খাবার হিন্দু বাড়িতে প্রচলিত ছিল না। তবে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ঈশ্বর গুপ্ত পোলাও ও কালিয়ার কথা লিখেছেন। ধারণা করা হয় যে, ঈশ্বর গুপ্ত যে পলান্নের কথা বলেছেন, তা পোলাও ও বিরিয়ানির বাঙালি সংস্করণ। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঘি-ভাত পরিবেশন করা হত, যা পোলাওয়ের স্থানীয় রূপ। ঈশ্বর গুপ্তের লেখায় শহরের কিছু হিন্দু বাড়িতে পোলাওয়ের জনপ্রিয়তা দেখা যায়।

মুসলমানরা তরমুজ ও খরমুজের মতো ফল নিয়ে এসেছিলেন। পেঁয়াজ ও রসুন আগে থেকে বঙ্গদেশে ছিল কিনা, তা নিশ্চিত নয়, তবে এটা মনে করা হয় যে, মুসলমানরাই এগুলো খাওয়ার প্রচলন শুরু করেছিলেন। হিন্দু সমাজে পেঁয়াজ ও রসুনের প্রতি দীর্ঘকাল ধরে আপত্তি ছিল, এমনকি বিশ শতকেও অনেকে এটা মানতেন। এখনও অনেক হিন্দু রান্নায় পেঁয়াজ-রসুন ব্যবহার করেন না, বিশেষ করে বিধবা মহিলারা এবং পুজোর খাবারে এটা ব্যবহার করা হয় না। পুরীর মন্দিরের খাবারেও পেঁয়াজের উল্লেখ নেই। অন্যদিকে, আইন-ই-আকবরীতে পেঁয়াজের উল্লেখ আছে। রসুনের প্রতি বিরূপ মনোভাবের কারণে এটি সহজে সমাজে পরিচিত হতে পারেনি। বাংলা ভাষায় রসুন শব্দটি এতটাই অপ্রচলিত ছিল যে, বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধানেও রসুনের বানান “লোশুন” লেখা হয়েছে।

বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে পর্তুগীজ এবং ইংরেজদের প্রভাব

নতুন খাবারের আমদানি পর্তুগিজদের হাত ধরেই ঘটেছিল। তারা ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে বিভিন্ন প্রকার ফল ও কিছু শুকনো খাবার এই দেশে নিয়ে আসে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আলু। যদিও বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ১৫০ ধরনের আলু পাওয়া যায় এবং এটি অনেক দেশের প্রধান খাদ্য, তবুও সপ্তদশ শতাব্দীর আগে ভারতবর্ষে আলুর প্রচলন ছিল না। স্প্যানিশরা ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি বলিভিয়া-পেরু অঞ্চল থেকে এই খাবার ইউরোপে নিয়ে যায়, এবং সেখান থেকে পর্তুগিজরা তা ভারতে আনে। পর্তুগিজদের আনা প্রধান ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আনারস, যা প্রচুর রস থাকার কারণে বাংলায় আনারস নামেই পরিচিতি পায়। এছাড়াও, আতা, নোনা ও কাজুবাদামের মতো ফলও তারাই এ দেশে নিয়ে আসে। সম্ভবত সফেদা ফলের আমদানিও তাদের মাধ্যমেই হয়েছিল।

আলুর মতোই, লঙ্কা মরিচ ও তামাকের মতো আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস পর্তুগিজরা ভারতবর্ষে নিয়ে আসে। পেঁয়াজ-রসুনের মতো এই মশলাগুলোর প্রতি তেমন কোনো দীর্ঘস্থায়ী বিরোধিতা দেখা যায়নি। বরং, লঙ্কা মরিচ ও তামাককে ভারতবর্ষের মানুষ খুব সহজেই গ্রহণ করে নেয়। এই দুটি জিনিস এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, এগুলো আসার পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে।

“পাউ রুটি” নামক খাদ্যটিও পর্তুগিজদের আমদানি বলেই মনে করা হয়, কারণ “পাউ” শব্দটি পর্তুগিজ ভাষার, ইংরেজি ভাষার নয়। ধারণা করা হয়, বিস্কুটও তারাই প্রথম এদেশে নিয়ে আসে। তবে পরবর্তীতে দেখা যায়, এই দুটি খাবারের প্রতি দেশীয় মানুষের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ও প্রবল বিদ্বেষ ছিল।

কপি উনিশ শতকে জনপ্রিয় না হলেও, বিশ শতক থেকে বাঙালিদের অন্যতম প্রিয় সবজি হয়ে উঠেছে। ফুলকপি, বাঁধাকপি ও ওলকপি – এই তিনটি সবজির কোনটিই দক্ষিণ আমেরিকার নয়, বরং ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের ফসল। তাই মনে করা হয়, ইংরেজরাই এগুলো এদেশে নিয়ে আসে। কিন্তু কলিফ্লাওয়ার ও ক্যাবেজ না বলে এই সবজি দুটিকে ফুলকপি ও বাঁধাকপি বলা থেকে মনে হয়, এগুলোও পর্তুগিজরাই নিয়ে এসেছিল। কারণ, পর্তুগিজ ভাষায় এদের “কোবি” বলা হয়।

ইংরেজরাও অনেক নতুন খাবার নিয়ে আসে। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি যুবকদের মধ্যে পাউরুটি ও বিস্কুট ছাড়াও চপ, কাটলেট ও পেটিসের মতো খাবারও প্রচলিত হয়। মুসলমানদের মধ্যে গরুর মাংস খাওয়ার চল থাকলেও, মনে করা হয় ইংরেজ শাসনের আমলেই হিন্দু যুবকদের মধ্যে গরুর মাংস খাওয়া জনপ্রিয় হয়, যা আগে দেখা যায়নি। এর কারণ সম্ভবত হিন্দু কলেজের উদারনৈতিক শিক্ষা ও সনাতন ধর্মকে অস্বীকার করার মানসিকতা, যা ইন্দো-মুসলিম আমলে অনুপস্থিত ছিল। “মাটন” শব্দটিও উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করে।

পর্তুগিজরা মদ আমদানি করলেও, মদ্যপানের সঙ্গে ইংরেজি শাসনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করা হয়। কারণ, এই সময়েই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজে মদ্যপান ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পরে। রামমোহন রায় উনিশ শতকের একদম শুরু থেকেই মদ পান করতেন, তবে এর কারণ ফ্যাশন নাকি নেশা, তা বলা কঠিন। উনিশ শতকের প্রথম প্রজন্মের ইংরেজি শিক্ষিতদের মধ্যে মদ্যপান খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। দ্বারকানাথ ঠাকুরও রামমোহনের মতোই, সম্ভবত তার চেয়েও বেশি মদ পান করতেন। প্রথম দিকের এই শিক্ষিত লোকেরা পরিমিত মদ্যপানকে এতটাই স্বাভাবিক মনে করতেন যে, রাজনারায়ণ বসুর বাবা রাজনারায়ণকে তার সাথেই মদ পান করতে বলতেন। বাবার ধারণা ছিল, বাড়িতে মদের ব্যবস্থা না করলে ছেলে বন্ধুদের সাথে বাইরে গিয়ে বেশি মদ পান করবে। রাজনারায়ণ বসু বাবার সাথেও মদ পান করতেন এবং বাবাকে না জানিয়ে বাইরেও পান করতেন। অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে ১৮৪৬ সালে কলেজে থাকা অবস্থাতেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

রাজনারায়ণ বসুর বন্ধু মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন ছাত্র ছিলেন, ১৮৪০ দশকের শুরুর দিকে, রাতে নিয়মিত মদ্যপান শুরু করেন বলে অনেকে মনে করেন। কারও কারও মতে, তিনি নাকি বাবার অনুমতি নিয়েই এটি করতেন। তবে, মাইকেলের লেখা একটি চিঠি এই দাবিগুলোকে ভুল প্রমাণ করে। মহর্ষি হিসেবে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও মদ পান করতেন। আসলে, ১৮৩০ ও ১৮৪০ এর দশকে হিন্দু কলেজে যারা পড়তেন, তাদের মধ্যে খুব কম মানুষই ছিলেন যারা মদ পান করতেন না। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কালীপ্রসন্ন সিংহ, প্রতাপচন্দ্র সিংহ, দীনবন্ধু মিত্র এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো আরও অনেকে সেই সময় অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে অল্প বয়সেই মারা যান। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও মদ্যপান করতেন। যদিও তিনি খুব বেশি দিন বাঁচেননি, তবুও তিনি ইংরেজি শিক্ষিত লোকেদের মদ্যপানের অভ্যাস নিয়ে মজা করতে ছাড়তেন না। মাইকেল নিজে মদ্যপান করা সত্ত্বেও, ‘একে কি বলে সভ্যতা’ নামক প্রহসনে তরুণদের মদ্যপানের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।

শুধু ইংরেজি-শিক্ষিত লোকেরাই নন, বরং সেই সময়ের কম শিক্ষিত ধনী ব্যক্তিদের মধ্যেও মদ্যপান খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল, যা তখনকার পত্রপত্রিকা পড়লে বোঝা যায়। আসলে, বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং ‘একে কি বলে সভ্যতা’ ও ‘সধবার একাদশী’র মতো নাটক থেকে মনে হয় যে, সেই সময়ের বাঙালিরা শুধুমাত্র অতিথি আপ্যায়নের জন্য মদ পান করতেন না, বরং নেশা করাই ছিল তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। তারা ওয়াইন পান করতেন না, তারা এমন মদ খেতেন যাতে নেশা হয়। পর্তুগিজরা মদিরা নামের এক প্রকার মদ নিয়ে এসেছিলেন। ইংরেজরা ব্র্যান্ডি, হুইস্কি, শেরি ও শ্যাম্পেন নামের মদ চালু করেন। তবে, সেই সময় বাঙালিদের মধ্যে হুইস্কি তেমন জনপ্রিয় ছিল না। উনিশ শতকের শেষের দিকে হুইস্কি জনপ্রিয়তা লাভ করে।

উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে মদ্যপান আধুনিক ফ্যাশন হিসেবে প্রচলিত ছিল। কিন্তু ১৮৫০ এর দশক থেকে, মদ্যপানের খারাপ দিকগুলো সম্পর্কে অনেকে জানতে শুরু করেন। একসময় খুব বেশি মদ পান করা রাজনারায়ণ বসু, ব্রাহ্মধর্মে যোগ দেওয়ার সময় মদ্যপান করে হিন্দুধর্মের সাথে নিজের সম্পর্ক শেষ করার একটি প্রতীকী কাজ করলেও, পরে তিনি পুরোপুরি মদ পান করা বন্ধ করে দেন। অক্ষয় কুমার দত্তের প্রভাবে, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও ১৮৫০ এর দশকে মদ্যপান ছেড়ে দেন। রাজনারায়ণ বসুর মতোই, তার বন্ধু প্যারীচরণ সরকারও সমাজের উন্নতির কাজে মন দেন। তারা শুধু নিজেরা মদ পান করা ছেড়ে দিয়েই থেমে থাকেননি, বরং ১৮৬০ এর দশকে তারা যেভাবে মদ্যপানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তা থেকে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, সেই সময়ের বাঙালি সমাজে মদ্যপান কতটা বেশি প্রচলিত ছিল।

পর্তুগিজদের মতো নতুন ফল না আনলেও, ইংরেজরা কিছু শুকনো খাবার নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম ছিল টমেটো। বর্তমানে টমেটো বাঙালি সমাজে খুব জনপ্রিয় একটি খাবার। আলুর মতো টমেটোরও জন্মস্থান দক্ষিণ আমেরিকা। মনে করা হয় যে, ষোল শতকের শুরুতে মেক্সিকো থেকে এই ফল প্রথম ইউরোপে আসে। কিন্তু পর্তুগিজরা এই ফল ভারতবর্ষে নিয়ে আসেননি। এই ফল ইংরেজদের হাত ধরেই ভারতে আসে, এবং সেটিও বেশ দেরিতে। ১৯০৬ সালে সুবল মিত্রের লেখা অভিধানে অথবা ১৯৩৩ সালে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধানে ‘টমেটো’ শব্দটির উল্লেখ নেই। তবে, বিশ শতকের শুরুতে কলকাতার জনপ্রিয় খাবারের তালিকায় রাধাপ্রসাদ গুপ্ত টমেটোর নাম লিখেছিলেন। আমার ছোটবেলায় আমি পূর্ব বাংলার গ্রামে টমেটো খেয়েছি। যতদূর আমার মনে আছে, সেটা ছিল ১৯৪৮ সাল। কিন্তু গ্রামের মানুষজন এটাকে ‘টক বেগুন’ নামেই ডাকতেন।

রেস্টুরেন্ট সংস্কৃতি

একটা বিশেষ কারণ ছিল যার জন্য ইংরেজ শাসনের সময়কালে নিষিদ্ধ অথবা সাধারণভাবে বাঙালি পরিবারে অপরিচিত খাবারগুলো তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। সেই কারণটি হলো, আঠারো শতকে এই বঙ্গদেশে প্রথম রেস্টুরেন্ট স্থাপিত হয়। এই রেস্টুরেন্টগুলো মূলত ইংরেজ গ্রাহকদের প্রয়োজন ও পছন্দের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছিল। তবে, উনিশ শতকের ত্রিশের দশকে, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি যুবকেরাও সেখানে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন। এই ঘটনার মধ্যে দিয়েই বাঙালি সমাজে একটি নতুন রেস্টুরেন্ট সংস্কৃতি জন্ম নেয়। তরুণরা, বাড়িতে যে খাবারগুলো সাধারণত পাওয়া যেত না বা খাওয়ার অনুমতি ছিল না, সেই খাবারগুলো রেস্টুরেন্টে গিয়ে উপভোগ করতে শুরু করেন। উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে রাজনারায়ণ বসু নিজেই লিখেছেন যে তিনি গোরুর মাংসের কাবাব খেয়েছেন, এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত মাংস, পেটিস ও বিস্কুট কিনে খাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁরা দুজনেই সেই সময়ের কিছু দোকানের নামও জানিয়েছেন, যেখানে তৈরি খাবার বিক্রি হতো।

এটা ধরে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত যে, কলকাতার এই রেস্টুরেন্টগুলোর একদম শুরুতে সম্ভবত ইংরেজ বাবুর্চিরাই রান্না করতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে, মুসলমান বাবুর্চিরা এসে রান্নার দায়িত্ব নেন। ঐতিহাসিক ইন্দো-মুসলিম শাসনকালে, উত্তর ভারতীয় অঞ্চলের যে অপরিচিত রান্নাগুলো ছিল, সেগুলো মূলত বাবুর্চিরাই তৈরি করতেন, বাড়ির মহিলারা নয়। সেই সময় থেকেই মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পেশাদার বাবুর্চি শ্রেণির উদ্ভব হয়। এই বাবুর্চিরা চপ-কাটলেট এবং মুরগি-মাটনসহ বিভিন্ন খাবার কোনো রকম দ্বিধা বা ধর্মীয় বাধা ছাড়াই রান্না করতেন। এমনকি পাঁউরুটি ও বিস্কুটও তাঁরাই বানাতেন। হিন্দু সমাজের একটা বড় অংশ দীর্ঘদিন ধরে পাঁউরুটি ও বিস্কুট খাওয়াকে ধর্মবিরোধী কাজ বলে মনে করতেন, এবং এর অন্যতম কারণ ছিল এই খাবারগুলো মুসলমান বাবুর্চিদের হাতে তৈরি হওয়া।

এই বাবুর্চি সম্প্রদায় শুধুমাত্র বিদেশি বা ইংরেজি রান্নাতেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেননি। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যখন তাঁরা ইংরেজি রেস্টুরেন্টের আদলে নিজেদের রেস্টুরেন্ট স্থাপন করেন, তখন তাঁরা সেখানে ইংরেজি খাবারের পরিবর্তে মোগলাই খাবার পরিবেশন করতে শুরু করেন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উনিশ শতকের বাঙালি সমাজে, চিরাচরিত ঐতিহ্যবাহী খাবারের পাশাপাশি, কাবাব, কোর্মা, পোলাও, বিরিয়ানি ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার মুসলমানি খাবার জনপ্রিয় হতে শুরু করে। গরুর মাংসের কাবাব এতটাই সুস্বাদু ছিল যে, এর জন্য অপেক্ষা করতে না পেরে রাজনারায়ণ বসু ও তাঁর বন্ধুরা কলেজের দেওয়াল টপকে কাবাবের দোকানে ছুটে যেতেন। রাজনারায়ণ বসুর আত্মজীবনী থেকে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, মোগলাই খাবার সেই সময় হিন্দুদের মধ্যেও কতটা জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তিনি তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন, ১৮৫০-এর দশকে যখন তিনি মেদিনীপুরে থাকতেন, সেখানে ব্রজেন্দ্রনারায়ণ দেব নামে এক ব্যক্তি বাস করতেন, যিনি ছিলেন এককালের রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের নেতা রাধাকান্ত দেবের নাতি। ব্রজেন্দ্রনারায়ণের বাড়িতে প্রায়ই মদ্যপানের আসর বসতো এবং সেখানে নিয়মিত পোলাওয়ের ভোজ হতো। এটা অনুমান করা অযৌক্তিক হবে না যে, সেই পোলাও সম্ভবত মুসলমান বাবুর্চিরাই রান্না করতেন।

বাস্তবতা হলো, আঠারো শতক এবং উনিশ শতকের কিছু সময় পর্যন্ত মোগলাই খাবার মূলত সুবেদার, নবাব, আমীর-ওমরাহ এবং পরবর্তীকালে অবাঙালি অভিজাত মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কলকাতার রেস্টুরেন্টে মোগলাই খাবার চালু হওয়ার পরে, তা ধীরে ধীরে কলকাতার সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। চোরবাগানের মিত্র পরিবারের একটি ভোজের বিস্তারিত বিবরণ থেকে কলকাতার রেস্টুরেন্টের মাধ্যমে মোগলাই ও ইংরেজি রন্ধনপ্রণালী কতটা বিস্তার লাভ করেছিল, তার একটা ধারণা পাওয়া যায়। দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি’ গ্রন্থে ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত হওয়া এই ভোজের খাদ্যতালিকা উল্লেখ করেছেন। সেই তালিকায় মোট ১১৭টি পদের কথা বলা হয়েছে। এই পদগুলোর মধ্যে যেমন কোর্মা, কাবাব, কোপ্তা, কালিয়া, আলুবোখারা ও মোরব্বার মতো মোগলাই খাবার ছিল, তেমনই চচ্চড়ি, শুক্তো, শাকভাজা, বেগুন ভাজা ও ঝোলের মতো বাঙালি খাবারও ছিল। এমনকি ফ্রাই, গ্রিল, চপ, কাটলেট, কারি, ক্রুকেট এবং লেমনেডের মতো ইংরেজি খাবারও সেই তালিকায় স্থান পেয়েছিল।

বিশ শতকে মোগলাই খাবার মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানে মোগলাই রান্নার জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পায়, কারণ সেই সময়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে একটা নিবিড় যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল। অন্যদিকে, ইংরেজি রান্নার পদ্ধতি বঙ্গদেশে তেমনভাবে জনপ্রিয় হতে পারেনি। তবে, হালকা কিছু খাবার যেমন পাঁউরুটি, চপ, কাটলেট, কেক, বিস্কুট, পেটিস ইত্যাদি বেশ প্রচলিত হয়েছিল। ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর কলকাতার অল্প কিছু রেস্টুরেন্ট ছাড়া, অন্যান্য জায়গায় ইংরেজি রেস্টুরেন্ট প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তপন রায়চৌধুরীর লেখা থেকে জানা যায়, বিশ শতকের প্রথম দিকে তাঁর পৈতৃক পরিবারে একজন মুসলমান বাবুর্চি মোগলাই ও ইউরোপীয় উভয় প্রকার রান্নাতেই পারদর্শী ছিলেন।

বিশ শতকে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন

বিংশ শতাব্দীতে জীবন রক্ষাকারী ঔষধ, যেমন অ্যান্টিবায়োটিক ও টিকার আবিষ্কারের কারণে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়ায় জনসংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে, যা দারিদ্র্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলস্বরূপ, খাদ্যশস্যের উৎপাদনেও পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে মানুষের খাদ্যাভ্যাসের উপর, বিশেষত সাধারণ মানুষের খাদ্যাভ্যাসে। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বহু বাঙালি তাদের দীর্ঘদিনের প্রধান খাদ্য ভাত ছেড়ে আটা খাওয়া শুরু করেন। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, মধ্যযুগের একটি কাব্যে উল্লেখ আছে যে, কোনো অত্যাচারী মুসলমান শাসক হিন্দুদের রুটি খাইয়ে তাদের জাত নষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন। অন্যদিকে, এটা মনে রাখা দরকার যে, ঐতিহাসিক নথিপত্র অনুযায়ী, বাঙালিরা স্বেচ্ছায় রুটি খেতেন, এমন উদাহরণ বিশেষ একটা পাওয়া যায় না।

দেশভাগের পূর্বেই কলকাতায় চিনা রেস্টুরেন্টের প্রচলন শুরু হয়েছিল। তবে, বাংলার অন্যান্য অংশে চিনা ও অন্যান্য বিদেশি রেস্টুরেন্টগুলো মূলত দেশভাগের পরেই বিস্তার লাভ করে। এইভাবেই খাদ্যাভ্যাসে নতুনত্ব ও ভিন্নতা আসে। কলকাতা শহরে দক্ষিণ ভারতীয় ও পাঞ্জাবি খাবারের জনপ্রিয়তা বাড়ে। এমনকি যখন খাদ্য সংস্কৃতিতে জগাখিচুড়ি প্রবণতা দেখা যায়, তখনও ‘আহেলি’-র মতো রেস্টুরেন্ট ঐতিহ্যপূর্ণ বাঙালি খাবার পরিবেশন করে। ঢাকার চিত্রটাও একই রকম, সেখানেও ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারের রেস্টুরেন্ট গড়ে ওঠে।

চিনা রেস্টুরেন্টে পরিবেশিত খাবারের স্বাদ কতটা খাঁটি চিনা, তা হয়তো বিবেচ্য ছিল না, কিন্তু সেখানে শুধুমাত্র জন্মদিন বা বিয়ের মতো অনুষ্ঠানেই নয়, বরং বন্ধুদের সঙ্গে খেতে যাওয়াটাও একটা বিশেষ মর্যাদার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তবে এই ফ্যাশন এখানেই থেমে থাকেনি। আরও আধুনিক ফ্যাশন হিসেবে ঢাকা বা কলকাতার মতো শহরে হ্যামবার্গার, স্প্যাগেটি বা হট ডগের মতো পশ্চিমা ফাস্ট ফুড খাওয়ার চল শুরু হয়। সত্তরের দশক বা আশির দশকের শুরুতে যারা বৃত্তি নিয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য গিয়েছিলেন, তাদের সন্তানরাই মূলত বিদেশে বিভিন্ন নতুন খাবারের স্বাদ পেয়েছিল। দেশে ফিরে আসার পর তারা সেই সব খাবারের প্রতি আগ্রহ দেখাতে শুরু করে। এই চাহিদার ফলস্বরূপ ঢাকা ও কলকাতায় বিদেশি খাবারের কিছু নিম্নমানের রেস্টুরেন্ট তৈরি হতে শুরু করে। এইসব রেস্টুরেন্টে খাবারের গুণগত মান হয়তো খুব উন্নত ছিল না, কিন্তু নামের আকর্ষণীয়তায় বিশ্বনাগরিক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর বাঙালি তরুণ প্রজন্ম হ্যামবার্গার ও হটডগের মতো খাবার কিনতে শুরু করে। বর্তমানে এই খাবারগুলো শুধুমাত্র ফ্যাশনের অংশ নয়, বরং এগুলো রীতিমতো গর্বের প্রতীকরূপেও বিবেচিত হয়।

বর্তমানকালে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে পৃথিবী যেন ছোট হয়ে এসেছে। তাই, এক দেশের খাদ্যাভ্যাস অন্য দেশে প্রভাব ফেলবে, এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তবে এটা মনে রাখতে হবে যে, পোশাক ও অন্যান্য অনেক কিছুর মতোই, বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের উপরও বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের প্রভাব পড়েছে। এত কিছুর পরেও ডাল-ভাত, মাছ, শাক, শুক্তো, কাসুন্দি ও আচারের মতো কিছু খাবার এখনও বাঙালি খাদ্যসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পরিচিত। এই খাবারগুলোর প্রতি সকল সম্প্রদায়ের, সকল অঞ্চলের এবং সকল বাঙালির আকর্ষণ আজও বিদ্যমান। নারকেল কোড়া দিয়ে মুড়ি, মুড়ি-মুড়কি অথবা চিঁড়ের মোয়ার মতো খাবারগুলো বরং বিশেষ সময়ে বাঙালিত্বের পরিচয়কে আরও দৃঢ় করে তোলে। অন্যদিকে, যদি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, তাহলে এটা স্পষ্ট যে বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে এখনও কিছু পার্থক্য রয়ে গেছে। এছাড়াও, পূর্ব বাংলা (বাংলাদেশ) এবং পশ্চিমবঙ্গ (ভারত)-এর খাদ্যাভ্যাসের মধ্যেও যথেষ্ট ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়।

পানীয়

পানীয় গ্রহণ না করা পর্যন্ত আহার পর্ব সমাপ্ত হয় না। সমাজের ধনী ও দরিদ্র সকল স্তরের মানুষই জল পান করে থাকেন। তবে জলই একমাত্র পানীয় ছিল না। প্রাচীন বাঙালিরা জলের পাশাপাশি অন্য আর কী পান করতেন, তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। এটা বলা কঠিন যে তারা দুধ পান করতেন, নাকি দুগ্ধ ও ভাত মিশিয়ে খেতেন। মধ্যযুগের সাহিত্যে ‘পানা’ নামক একটি শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা সম্ভবত সরবতের মতো কোনো পানীয় ছিল। ধারণা করা হয়, মুসলমানরাই ভারতীয় উপমহাদেশে সরবত নিয়ে এসেছিলেন। সেই সময়ে সরবত এবং বিশেষত লেবুর সরবত, মুসলমান সমাজে অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো, যা আজও প্রচলিত আছে।

খাদ্যদ্রব্যের বাইরেও আপ্যায়নের জন্য কিছু উপকরণ ব্যবহৃত হতো, যেমন পান-সুপারি, চা এবং ধূমপান। চর্যাপদের মতো প্রাচীন গ্রন্থে এবং এমনকি তার পূর্ববর্তী সাহিত্যেও পানের উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়াও, আদি বাংলা সাহিত্যে সুপারি বা গুয়ার কথাও উল্লেখ আছে। এই তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, পান-সুপারি সম্ভবত গত এক হাজার বছর ধরে, অথবা তারও আগে থেকে বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মধ্যযুগের সাহিত্যে খাবার শেষে মৌরি দিয়ে আপ্যায়ন করার প্রথাও দেখা যায়। তবে চা একটি অপেক্ষাকৃত আধুনিক সংযোজন এবং এর প্রচলন মূলত ইংরেজদের হাত ধরে শুরু হয়। যদিও চায়ের উৎস বঙ্গদেশের প্রতিবেশী দেশ চীনে, তবুও প্রাচীনকালে বাংলায় চায়ের ব্যবহার প্রচলিত ছিল না।

ভারতবর্ষের সঙ্গে চীনের যোগাযোগ বহু শতাব্দীর পুরনো। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন চীনা পর্যটক এবং রাজদূতেরা ধর্মীয় কারণে অসংখ্যবার বাংলায় এসেছেন। একই সাথে, বাঙালি দূত এবং ধর্মপ্রচারকরাও চীনে গিয়েছেন। কিন্তু তৎসত্ত্বেও, সেই সময় বাংলায় চায়ের আগমন ঘটেছিল, এমন কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। অবশেষে, চা বহু পথ ঘুরে এদেশে প্রবেশ করে। ১৬৫৭ সালে লন্ডনে প্রথম চায়ের দোকান স্থাপিত হলেও, প্রাথমিকভাবে এটি জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি। সেই সময় কফি ছিল ইংরেজদের মধ্যে অধিক জনপ্রিয় পানীয়। অন্যদিকে, ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোতে চা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফলস্বরূপ, চা একটি মূল্যবান আমদানি পণ্য হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এর চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। এই আমদানিকৃত চায়ের মূল্য পরিশোধ করার জন্য ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চীনে আফিমের ব্যবসা শুরু করে। আফিম রপ্তানি করে চা আমদানির এই বাণিজ্য রীতি একটি স্বীকৃত প্রথায় পরিণত হয়। কলকাতা শহর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই সেখানে ইংরেজদের জন্য চা আসা শুরু হয়েছিল কিনা, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে চা নিয়মিতভাবে আসতে শুরু করে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই শতাব্দীর শেষ দিকে ‘চা’ শব্দটি বাংলা ভাষায় প্রচলিত হয়েছিল, এর অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় ১৭৯৩ সালে আপজন কর্তৃক প্রকাশিত ইংরেজি-বাংলা অভিধানে। এই অভিধানে কেবল ‘চা’ শব্দটিই নয়, বরং ‘চা-পানি’ নামক যৌগিক শব্দটিরও উল্লেখ দেখা যায়। জন মিলারের ‘সিক্সাগুরু’ (১৭৯৭) নামক গ্রন্থেও তৎকালীন ইংরেজ কর্মচারীদের মধ্যে চা পানের প্রচলন থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই বইটিতে, জনৈক সাহেব ও তাঁর দেওয়ানের মধ্যে কথোপকথনের একটি অংশে চায়ের প্রসঙ্গ উল্লেখিত হয়েছে:

‘খবর দে তোর সাহেবকে। জে দেওয়ানজি আসিয়াছে আর জিঙ্গাসা কর সে রহিবে কি জাইবে।’

‘আমি আমার সাহেবকে খবর দিয়াছি তিনি কহিলেন তাহাকে বসিতে দেও। আমি চা খাইয়া আশীবো।’

যদিও ব্রিটিশ নাগরিকেরা চা পান করতেন, তারা ১৮২৩ সাল পর্যন্ত অবগত ছিলেন না যে চা গাছ ভারতবর্ষেই জন্মায়। সেই বছর আসামে প্রথম চায়ের গাছ আবিষ্কৃত হওয়ার পরে এই তথ্য জানা যায়। আবিষ্কৃত গাছগুলো বুনো অবস্থাতেই সেখানে বেড়ে উঠছিল। এর এগারো বছর পরে লর্ড বেন্টিংক ভারতে বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদনের অনুমতি প্রদান করেন। এর ফলস্বরূপ, ধীরে ধীরে চা বাগান তৈরি করার কাজ শুরু হয়। ১৮৫০ এর দশকের শেষ দিকে নীল চাষিদের ওপর হওয়া অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। তবে, চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো আন্দোলন দেখা যায়নি। এর প্রধান কারণ ছিল, দাদন প্রথা ব্যবহার করে সাধারণ জমিতে চা চাষের কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও, চা বাগানের শ্রমিকেরা নানা প্রকার নিপীড়নের শিকার হতেন। তাদের দুরবস্থা ও কষ্টের জীবনযাত্রা নিয়ে ১৮৬০ এর দশকের শেষ দিকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু হয়েছিল। এমনকি, চা বাগান মালিকদের অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরে অন্তত একটি বাংলা নাটকও প্রকাশিত হয়েছিল। এই ঘটনাগুলো থেকে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, চা বাগান ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করছিল।

বাঙালিরা ঠিক কবে থেকে চা পান করা শুরু করেছিলেন, তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন, তবে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে এটা স্পষ্ট যে, চা পান করা শুরু হয়ে গিয়েছিল। শুরুতে, শহরের ইংরেজি শিক্ষাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যেই চা খাওয়ার প্রথা বিশেষভাবে প্রচলিত হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে প্রভাত মুখোপাধ্যায় “নিষিদ্ধ ফল” নামে একটি ছোট গল্প লেখেন। এই গল্পের পটভূমি ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের সমসাময়িক কাল, অর্থাৎ গল্পটি লেখার প্রায় ত্রিশ বছর পূর্বের ঘটনা। গল্পে দেখা যায়, রায় বাহাদুর নামের বঙ্কিমচন্দ্রের এক কাল্পনিক বন্ধু বঙ্কিমচন্দ্রকে প্রেমের গল্পের পরিবর্তে অন্য কিছু বিষয় নিয়ে গল্প লেখার উপদেশ দিচ্ছেন, কারণ তিনি মনে করতেন যে, সেই ধরনের গল্প সমাজের উন্নতিতে সাহায্য করবে। সেই বিষয়গুলোর মধ্যে একটি ছিল শিক্ষিত বাঙালিদের চা খাওয়ার অভ্যাস, যাকে তিনি একটি খারাপ অভ্যাস হিসেবে গণ্য করতেন। রায় বাহাদুরের দৃষ্টিকোণ থেকে, চা পান ছিল একটি বিলাসিতা মাত্র। এই গল্পের মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বঙ্কিমচন্দ্রের সময়ে শহুরে শিক্ষিত সমাজে চা পান করা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এমনকি সাধারণ মানুষও চা পানের বিষয়ে অবগত ছিলেন, না হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘চোখের বালি’ অথবা ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসে চায়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতেন না। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে দেখা যায়, চড়ুইভাতির অনুষ্ঠানে মহেন্দ্র ও তার বন্ধু বিহারী চা পান করছেন। এই উপন্যাসটি ১৯০২ সালের কাছাকাছি সময়ে লেখা হয়েছিল। এর দুই বছর পর রচিত ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসের প্রথম পাতা সহ বিভিন্ন অংশে চায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। অতএব, প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, চা পান দ্রুতগতিতে শহরের শিক্ষিত সমাজের মধ্যে বিস্তার লাভ করেছিল। যদিও একটি বিদেশি দ্রব্য হিসেবে চায়ের প্রতি কিছু রক্ষণশীলতা বা সংস্কার থাকা স্বাভাবিক ছিল, এবং সম্ভবত কিছু মাত্রায় ছিলও। কিন্তু সেই সংস্কার থাকা সত্ত্বেও চা পান করা বন্ধ হয়নি। তবে, সেই সংস্কারের কারণেই হোক অথবা অন্য কোনো কারণে, অনেকেই মনে করতেন যে চা পান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। বিশ শতকের তৃতীয় দশকে, প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো দেশপ্রেমিক বিজ্ঞানী ‘চা পান, না বিষ পান?’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। কিন্তু তাঁর আশঙ্কা সত্ত্বেও, চা পান ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। ফলস্বরূপ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৪ সালে চায়ের গুণকীর্তন করে একটি বিখ্যাত গান রচনা করেছিলেন –

হায়, হায়, হায় দিন চলে যায়,
চা-স্পৃহচঞ্চল চাতক দল চলো চলো চলো হে। …
এলো চীন-গগন হতে, পূর্ব পবন স্রোতে শ্যামলরসধরপুঞ্জ।।

কাজের চাপে ক্লান্ত বিভিন্ন পেশার মানুষ, যেমন – সাহিত্যিক, গণিতজ্ঞ, কবি, ভূগোলবিদ, হিসাবরক্ষক, শিল্পী, গায়ক, চিত্রকর, ব্যবস্থাপক এবং সমিতির সদস্য সহ সকল কর্মীকে চা পানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এর কিছুদিন পরেই কাজী নজরুল ইসলামও চা নিয়ে একটি গান রচনা করেছিলেন।

চা-কে জনপ্রিয় করার পেছনে চা কোম্পানিগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তারা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে চায়ের বিভিন্ন উপকারিতার কথা প্রচার করত। শুধু তাই নয়, চা কোম্পানিগুলো গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বিভিন্ন হাট-বাজারে বিনামূল্যে চা খাইয়ে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করত এবং পরবর্তীতে চায়ের প্যাকেট উপহার দিত। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে তারা চায়ের প্রচার চালিয়েছিল। লেখক জানিয়েছেন যে, ১৯৫১ সালে বরিশালের একটি বাজারে তিনি নিজে এমন প্রচারকার্য দেখেছিলেন। প্রসঙ্গত, চা এর আগে কফি বঙ্গদেশে এলেও তা সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন জনপ্রিয় হয়নি। ঐতিহাসিকদের মতে, নবাব আলীবর্দী খান কফি পান করতেন।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস দক্ষিণ আমেরিকাতে পৌঁছানোর অল্প সময়ের মধ্যেই তামাকের সঙ্গে পরিচিত হন। শুধু তাই নয়, খুব দ্রুত তিনি ধূমপানের অভ্যাসে আসক্ত হয়ে পড়েন। তিনিই প্রথম ইউরোপে তামাক নিয়ে আসেন। তবে, সেই সময় ইউরোপে তামাকের চাষ শুরু হয়েছিল কিনা তা জানা যায় না। তবে, জঁ নিকোত নামের একজন ফরাসি দূত, যিনি আমেরিকাতে কর্মরত ছিলেন, তার হাত ধরেই ইউরোপে তামাক ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই জঁ নিকোতের নামানুসারেই তামাকের নেশা সৃষ্টিকারী উপাদানটির নাম নিকোটিন রাখা হয়। ষোড়শ শতাব্দীর ষাটের দশকে স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে তামাকের প্রচলন শুরু হয়। এর কিছুকাল পরেই পর্তুগিজরা ভারতবর্ষে তামাক নিয়ে আসে এবং প্রায় পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এটি পুরো ভারতে ছড়িয়ে পরে। মোগল সম্রাট আকবরও তামাক সেবন শুরু করেন। তাঁর পুত্র জাহাঙ্গীর তামাক পছন্দ না করলেও শাহজাহান তামাক সেবন করতেন। নবাবী আমলের চিত্রকর্মেও হুঁকো টানার ছবি দেখা যায়। বিশেষভাবে, আলীবর্দী খানের তামাকের প্রতি দুর্বলতা ছিল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বিপ্রদাসের মনসামঙ্গল কাব্যে মুসলমানদের হুঁকো সেবনের যে উল্লেখ পাওয়া যায়, সেটি সম্ভবত পরবর্তীকালে যুক্ত হয়েছে। ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষের মধ্যে তামাক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

বাঙালিরা প্রথমে টোব্যাকোকে ‘তামাকু’ নামে ডাকত। উনিশ শতকে বাংলা ভাষার যখন সংস্কৃত শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ে, তখন ‘তামাকু’ শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে ‘তাম্রকুট’ নামে পরিচিত হয়। এই ভাষাগত পরিবর্তন থেকে বোঝা যায় যে, তামাক কিভাবে সমাজে ধীরে ধীরে স্বীকৃতি পেয়েছিল। সাহিত্যেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বিপ্রদাসের মনসামঙ্গল কাব্যে হুক্কা ও তামাকের উল্লেখ থাকলেও, ঐতিহাসিকরা মনে করেন তখনো তামাক বঙ্গদেশে আসেনি, তাই এই অংশটি সম্ভবত পরে যোগ করা হয়েছে। অন্যদিকে, অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি দ্বিজ ষষ্ঠীবরের লেখা থেকে জানা যায় যে, মুসলমান ধর্মগুরুদের মধ্যে তামাক বেশ জনপ্রিয় ছিল। দ্বিজ রামানন্দ নামের আরেকজন কবি তাঁর গানে গাঁজা ও তামাকের গুণগান করেছেন। তবে, শেখ সাদি ও আফজাল আলীর মতো কবিরা তামাকের নিন্দা করেছেন। এছাড়াও, রামপ্রসাদ, শান্তিদাস ও সিত কর্মকার ‘তামাকু মাহাত্ম্য’, ‘তামাকুপুরাণ’ ও ‘হুঁকাপুরাণ’ নামের কাব্যগুলোতে তামাক সেবনের ভালো ও খারাপ দিকগুলো তুলে ধরেছেন। তামাকের উপকারিতা হিসেবে বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের পাশাপাশি, এমনকি অপমৃত্যু থেকেও রক্ষা পাওয়ার নিশ্চয়তাও দেওয়া হয়েছিল।

বলা যায়, উনিশ শতকের একদম প্রথম দিকেই এমন একটি ধারণা প্রচলিত হয়েছিল যে, তামাকের মতো গুরুত্বপূর্ণ বস্তু যদি গুরুজনদের সামনে বসে সেবন করা হয়, তাহলে তা গুরুজনদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের শামিল। ঘটনাটি ১৮৪০ এর দশকের শুরুর দিকের, যখন মধুসূদন দত্তকে তার পিতার সামনে তামাক সেবন করতে দেখে তার বন্ধুগণ বেশ অবাক হয়েছিলেন। এমনকি উনিশ শতকের শেষ দিকে কেউ কেউ তামাক না খাওয়াকে একজন ভালো মানুষের লক্ষণ হিসেবেও বিবেচনা করতে শুরু করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গল্পে, এক নায়কের চরিত্র এতটাই উৎকৃষ্ট যে সে তামাক পর্যন্ত সেবন করে না, এমনটা বলা হয়েছে। মনে করা হয়, এর শুরুটা হয়েছিলো নবাব এবং উচ্চপদস্থ আমীর-ওমরাহদের মধ্যে। তারা তামাক সেবন করতেন এবং তাদের সামনে অধীনস্থ কর্মচারী অথবা অন্য কেউ তামাক খেলে সেটাকে বেয়াদবি হিসেবে ধরা হতো। এই প্রথা থেকেই গুরুজনদের সামনে তামাক না খাওয়ার ধারণা এবং মূল্যবোধ ধীরে ধীরে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়।

পর্তুগীজরাই প্রথম তামাক নিয়ে আসে, তবে ভারতবর্ষে হুঁকো চালু করেছিলেন মুসলমান শাসকেরা। পরবর্তীতে হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে হুঁকো খাওয়ার প্রচলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। হুঁকো-নাপিত প্রথা বন্ধ হওয়ার বিষয়টি কিন্তু খুব বেশি দিন আগের ঘটনা নয়। বাঙালি সমাজে সিগারেটের প্রচলন শুরু হয়েছিলো উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, যা হুঁকোর অনেক পরে। এবং সিগারেট জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে বয়স্কদের চেয়ে তরুণরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন সেই প্রথম সিগারেট সেবনকারীদের মধ্যে অন্যতম।

মোটকথা, গত এক হাজার বছরে খাদ্য, পানীয় এবং আপ্যায়নের বিভিন্ন উপাদানের অনেক পরিবর্তন ঘটলেও, বাঙালি খাবারের একটি স্বকীয়তা দীর্ঘকাল ধরে বজায় ছিল। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞান ও অত্যাধিক ফলন বিষয়ক আন্দোলনের প্রভাবে যখন উভয় বাংলার কৃষিজ ফসলের ধরন পাল্টে যাচ্ছে, বাজারে রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো বিভিন্ন পানীয়ের আধিক্য দেখা যাচ্ছে এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে, তখন বাঙালির চিরায়ত খাদ্য ও পানীয় সংস্কৃতি আর কতদিন টিকে থাকবে, তা বলা কঠিন। বিশেষ করে শহরের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সমাজে এর পরিবর্তন দ্রুত ঘটছে। বর্তমানে জাতিভেদের কঠোরতা কমে যাওয়ায় এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ অন্য অঞ্চলে বসবাস শুরু করায়, খাদ্যাভ্যাসের আঞ্চলিক ও সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যও ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। তবে, প্রধান খাদ্য হিসেবে ভাতের পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম। ফলে বাঙালিদের ‘ভেতো বাঙালি’ অপবাদ সম্ভবত থেকেই যাবে। এক্ষেত্রে সংস্কৃতি সম্ভবত অপরিবর্তনীয়।

বাঙালিদের ভোজনপ্রিয়তা এবং সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতির সঙ্গে খাদ্যের যে সম্পর্ক, তাও সম্ভবত অপরিবর্তনীয় থাকবে। বাঙালিদের উৎসবের শেষ নেই, এবং প্রতিটি উৎসবের সঙ্গেই খাবারের গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। বিভিন্ন পূজা এবং ঈদ সহ মুসলিম সম্প্রদায়ের বিভিন্ন উৎসবে ভিন্ন ভিন্ন খাবারের আয়োজন করা হয়। নবান্ন, বৌভাত, মুখেভাত, জামাই ষষ্ঠী, শবে বরাত ইত্যাদি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রকার খাবার অত্যাবশ্যক। হিন্দুদের মধ্যে তিথি-নক্ষত্র অনুযায়ী উপবাস এবং উপবাস ভাঙার জন্য নির্দিষ্ট খাবারের নিয়ম রয়েছে। মুসলমানদের মধ্যেও একই প্রথা প্রচলিত, তাই রোজা শেষে কিছু বিশেষ খাবার আশা করা হয়। যেমন ঈদে সেমাইয়ের মতো কিছু বিশেষ খাদ্য থাকে এবং দুই ঈদের খাদ্যও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। মোটকথা, ধর্মীয় ও আধা-ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সাধ্যমতো বিভিন্ন ধরনের খাবারের আয়োজন করা হয়। এই খাবারগুলো ছাড়া যেন অনুষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণতা পায় না। এটিও বাঙালির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.