Table of Contents
ভূমিকা
ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর, যুক্তরাজ্যের লেবার (Labour) পার্টি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এর প্রধান কারণ হলো—ইতিপূর্বে লেবার পার্টির শীর্ষস্থানীয় কিছু নেতা ট্রাম্প সম্পর্কে বেশ সমালোচনামূলক কথাবার্তা বলেছেন, এবং ট্রাম্পের ডানহাত হিসেবে পরিচিত ইলন মাস্ক (Elon Musk) খোলাখুলিভাবে জানিয়েছেন যে তিনি লেবার নেতা কিয়ার স্টারমারের (Keir Starmer) বড় ভক্ত নন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের (term) মাত্র এক মাস অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও, যুক্তরাজ্য (UK) এখন পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে নিরাপদ অবস্থায় রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী স্টারমার ও নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যে ইতোমধ্যে এক ধরণের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। উপরন্তু, সাম্প্রতিক কিছু বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে যে ট্রাম্পের সম্ভাব্য বাণিজ্য যুদ্ধগুলো (trade wars) যুক্তরাজ্যকে তুলনামূলকভাবে লাভবান করতে পারে।
এই নিবন্ধে আমরা তিনটি প্রধান কারণ ব্যাখ্যা করব, কেন ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ বা নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার নীতি যুক্তরাজ্যের পক্ষে সহায়ক হতে পারে:
১. যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তীব্র কোনো বাণিজ্য যুদ্ধ থেকে যুক্তরাজ্য হয়তো রেহাই পাবে।
২. মার্কিন অর্থনীতিতে ট্রাম্প যে অস্থিরতা তৈরির ঝুঁকি বাড়াচ্ছেন, তার ফাঁক গলে যুক্তরাজ্য সম্ভাব্য সুফল ভোগ করতে পারে।
৩. ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) সঙ্গে নতুন করে চুক্তি পুনরায় নেগোশিয়েট করার প্রয়াসে যুক্তরাজ্যের অবস্থান শক্তিশালী হতে পারে।
নিচে প্রত্যেকটি কারণ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো।
১) যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ট্রেড ওয়ার (trade war) এড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা
ট্রাম্পের জয়ের পর প্রায় সব মার্কিন মিত্রদেশের মধ্যেই উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছিল যে, নতুন এই প্রেসিডেন্ট দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতিকে (bilateral trade deficit) নিজের বড় শত্রু হিসেবে দেখে একের পর এক শুল্ক বা ট্যারিফ (tariff) আরোপ করবেন। এটি চীন (China), মেক্সিকো (Mexico), এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও (EU) ইতিমধ্যে স্পষ্ট করে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু যুক্তরাজ্য সম্ভবত এমন একটি দেশ হতে যাচ্ছে, যেটি হয়তো এই বাণিজ্য যুদ্ধের বড় ধাক্কা থেকে রেহাই পাবে।
কেন যুক্তরাজ্যকে পছন্দ করছেন ট্রাম্প?: প্রথমত, ট্রাম্পের ব্যক্তিগত মনোভাব। তিনি বরাবরই যুক্তরাজ্য সম্পর্কে ইতিবাচক কথা বলে এসেছেন—বিশেষ করে ব্রেক্সিট (Brexit) পরবর্তী সময়ে তিনি বারবার “যুক্তরাজ্যের সার্বভৌমত্ব (sovereignty) পুনরুদ্ধার”-এর প্রসঙ্গটিতে সমর্থন প্রকাশ করেছেন। এমনকি গত মাসে বিবিসি (BBC)-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প সরাসরি বলেছেন যে তিনি মনে করেন, কিয়ার স্টারমার খুব ভালো কাজ করছেন। রাজনীতিতে প্রশংসা অনেক সময়ই কূটনৈতিক লাভ-ক্ষতি হিসাবের অংশ হয়ে থাকে, তবে এটি নিঃসন্দেহে স্টারমার সরকারের জন্য স্বস্তির বার্তা।
বাণিজ্য উদ্বৃত্ত নাকি ঘাটতি? পরিসংখ্যানের ফাঁকফোকর: দ্বিতীয়ত এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো—মার্কিন পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ১৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত (trade surplus) পেয়েছে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য থেকে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করেছে, যুক্তরাজ্য তার চেয়ে ১৫ বিলিয়ন ডলার বেশি মূল্যের পণ্য কিনেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
- যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ: ইউএস ব্যুরো অব ইকোনমিক অ্যানালিসিস (US Bureau of Economic Analysis)-এর তথ্যমতে, যুক্তরাজ্য যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় কম রপ্তানি করে এবং বেশি আমদানি করে। এটি ট্রাম্পের কাছে ইতিবাচক বার্তা পাঠায়, কারণ তিনি যেসব দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি দেখেন, তাদের ওপর শুল্ক আরোপে আগ্রহী।
- অন্যদিক, যুক্তরাজ্যের দৃষ্টিকোণ: ইউকে অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিকস (Office for National Statistics) আবার সম্পূর্ণ উল্টো ছবি তুলে ধরছে। তাদের মতে, ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র বরং যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে ৯০ বিলিয়ন ডলার বেশি পণ্য আমদানি করেছে। এটি একটি ৯০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি (deficit) যুক্তরাষ্ট্রের জন্য, যেটি তাত্ত্বিকভাবে ট্রাম্প সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করবেন।
এই বিশাল ব্যবধান—একপক্ষ বলছে ১৫ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত, অন্যপক্ষ বলছে ৯০ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি—কীভাবে তৈরি হলো? অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের হিসেবে প্রায়ই ভিন্ন ভিন্ন উৎসে ভিন্ন ভিন্ন ফল আসে। পণ্য ও সেবার হিসাব, শুল্ক রেকর্ড, স্থানীয় কর কাঠামো ইত্যাদি মিলিয়ে জটিলতা থাকে। কিন্তু এখানে সবচেয়ে বড় হেরফের ঘটিয়েছে “ক্রাউন ডিপেন্ডেন্সিগুলো (Crown dependencies)”—যেমন জার্সি (Jersey), গার্নজি (Guernsey) ও আয়ল অব ম্যান (Isle of Man)। মার্কিন পরিসংখ্যান এই অঞ্চলগুলোর সঙ্গে হওয়া বাণিজ্যকে যুক্তরাজ্যের আওতায় গণ্য করে, কিন্তু যুক্তরাজ্যের নিজস্ব পরিসংখ্যান তা করে না। এসব দ্বীপাঞ্চলে অনেক আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (finance companies) নিবন্ধিত, যার ফলে বাণিজ্যের হিসাব বড় অঙ্কে এদিক-সেদিক হয়। ফাইনান্সিয়াল টাইমস (Financial Times) জানাচ্ছে, ব্রিটিশ কূটনীতিকরা (British diplomats) ভালোমতোই জানেন যে এই পরিসংখ্যানগত পার্থক্য ট্রাম্পের পক্ষে “মধুর ভুল-বোঝাবুঝি” তৈরি করেছে, যা যুক্তরাজ্যের স্বার্থেই কাজে লাগাতে হবে। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মশকরা করে বলেছেন, “মার্কিনিদের নিজেদের পরিসংখ্যানই আলোচনার ‘শেয়ারড অ্যান্ড স্ট্রং ফাউন্ডেশন’ হিসেবে ব্যবহার করা হবে,” যাতে ট্রাম্পের চোখে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য বাণিজ্যের ছবিটা আরেকটু সুখকর দেখা যায়।
ফলাফল: যুক্তরাজ্যের জন্য ইতিবাচক বার্তা: এতে লাভ হচ্ছে যে, যুক্তরাজ্য এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশ নয়, সুতরাং ইইউকে (EU) শাস্তি দিতে গিয়ে ট্রাম্প যে প্রকার শুল্ক আরোপের হুমকি দিচ্ছেন, তার আওতায় পড়ার সম্ভাবনা যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে কম। উপরন্তু, মার্কিন দৃষ্টিকোণ থেকে (যা হয়তো ট্রাম্পই দেখবেন), যুক্তরাজ্যের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য উদ্বৃত্ত (surplus) রয়েছে, ফলে যুক্তরাজ্য এ যাত্রায় অপ্রত্যাশিত কোনো শুল্কের মুখে পড়বে না বলে আশা করা যায়।
২) মার্কিন অর্থনীতিতে ট্রাম্প-সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা থেকে যুক্তরাজ্যের সম্ভাব্য লাভ
ট্রাম্প অর্থনৈতিক নীতিমালায় (economic policy) এমন কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অস্থিরতা বা অসামঞ্জস্য (dislocation) তৈরি করতে পারে। প্যারাডক্সিকালি, এটি সেবা-ভিত্তিক অর্থনীতির (services-based economy) দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্যের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে।
কেন সেবা খাতে যুক্তরাজ্যের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হলো যুক্তরাষ্ট্র: বর্তমানে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির বড় অংশই সেবা খাত (services sector)-নির্ভর—যেমন আর্থিক সেবা, শিক্ষা, আইনি পরামর্শ, গবেষণা ও উন্নয়ন ইত্যাদি। সেবা রপ্তানিতে (services exporter) বিশ্বে প্রথম স্থান দখল করে আছে যুক্তরাষ্ট্র, আর ঠিক তার পরেই যুক্তরাজ্য। অতএব, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যুক্তরাজ্যকে বরাবরই সতর্ক থাকতে হয়। কিন্তু ট্রাম্পের বাণিজ্যিক পদক্ষেপগুলোর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি (inflation) বাড়তে পারে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির জেরে ফেডারেল রিজার্ভ (Federal Reserve) সুদের হার (interest rate) আরও বাড়াতে বাধ্য হতে পারে। সুদের হার বাড়ানো মানে ডলার (dollar) সঞ্চয় করা আরো লাভজনক হয়ে ওঠা, ফলে ডলারের চাহিদা বাড়বে এবং ডলারের বিনিময় হার আরও শক্তিশালী হবে। ডলারের মান বৃদ্ধির অর্থ হলো, যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য ও সেবা অন্যান্য দেশের নাগরিকদের কাছে অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে, আর যুক্তরাজ্যের পণ্য ও সেবা তুলনামূলক সস্তা হয়ে যাবে। একটি সরল উদাহরণ ধরে ভাবুন:
- যদি একজন বিদেশি শিক্ষার্থী তার উচ্চশিক্ষার গন্তব্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র অথবা যুক্তরাজ্যের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে চায়, ডলারের দাম বেড়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়া আরো ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে।
- অন্যদিকে, পাউন্ড (pound) তুলনামূলকভাবে দুর্বল হলে, যুক্তরাজ্যে পড়তে যাওয়া আপেক্ষিকভাবে সস্তা হবে।
ফলে, শিক্ষার্থী বা পর্যটক কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান—সবার ক্ষেত্রেই যুক্তরাজ্যের সেবা গ্রহণের আগ্রহ বেড়ে যেতে পারে। এটি যুক্তরাজ্যের সেবা রপ্তানির পরিসরকে বড় করতে সহায়তা করবে।
ভিসা নীতি ও অন্যান্য প্রভাব: এছাড়া ট্রাম্প অভিবাসন (immigration) ও ভিসা (visa) পদ্ধতি কঠোর করার চেষ্টা করতে পারেন বলে অনেকে মনে করছেন, বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও কাজের ভিসার (student or work visa) ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়লে অনেক শিক্ষার্থী বা দক্ষ কর্মী যুক্তরাজ্যে যাওয়ার বিকল্প বেছে নেবে। এর মাধ্যমে সেবা খাতে, বিশেষত উচ্চশিক্ষা ও পেশাগত প্রশিক্ষণখাতে, যুক্তরাজ্য অতিরিক্ত সুবিধা পেতে পারে। সব মিলিয়ে, ট্রাম্পের নীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি করলেও, সেবা-রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় শীর্ষস্থানীয় দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্য এ পরিস্থিতিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের সুযোগ পাবে।
৩) ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে নতুন চুক্তির আলোচনায় যুক্তরাজ্যের হাত আরও শক্ত হবে
লেবার সরকার বেশ স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একটি “নতুন এবং সম্ভাব্য আরও গভীর” সম্পর্ক (deeper relationship) গড়ে তুলতে চায়। এটা খানিকটা ‘ব্রেক্সিট পরবর্তী সম্পর্ক পুনর্গঠন’ হিসেবেও দেখা যেতে পারে। প্রস্তাবিত এই সম্পর্কের কাঠামোতে যুক্তরাজ্য, ইউরোপে অন্যতম বড় সামরিক শক্তি হিসেবে, নিরাপত্তা (security) এবং প্রতিরক্ষা বিষয়ে ইইউকে বিশেষ সহযোগিতা দেবে। বিনিময়ে ইইউকে অনুরোধ জানানো হবে সীমান্ত পেরোনোর সময় শুল্ক জটিলতা (border frictions) কমাতে এবং পেশাগত স্বীকৃতির (mutual recognition of professional qualifications) বিষয়ে সহজীকরণ আনতে।
কোথায় আটকে আছে আলোচনা?: শোনা যাচ্ছে, এই আলোচনাগুলো সাময়িকভাবে অচলাবস্থায় পড়েছে। কারণ, ইইউ চায় ২০২৬ সালের পরেও ইইউ-ভুক্ত জেলেদের (fishermen) যেন যুক্তরাজ্যের জলসীমায় মাছ ধরার অধিকার অব্যাহত থাকে—যেটি একটি নতুন মৎস্যচুক্তির (fisheries deal) মাধ্যমে স্থায়ী করা হবে। পাশাপাশি তারা একটি নতুন যুব গতিশীলতা কর্মসূচি (youth mobility scheme) চায়, যাতে তরুণ ইউরোপীয়রা (young Europeans) যুক্তরাজ্যে গিয়ে কাজ ও পড়াশোনার সুযোগ পায়। কিন্তু লেবার ও স্টারমার উভয়েই এখন এই দুই বিষয়ে গা ছাড়া দিতে চাইছেন না। কারণ, ব্রেক্সিট-পরবর্তী সময়ে “ইমিগ্রেশন” (immigration) ও “ফিশিং রাইটস” (fishing rights) নিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিরোধ তারা একদম কাছ থেকে দেখেছেন। আবারও পুরোনো বিরোধ উসকে দিতে তারা অনিচ্ছুক।
ট্রাম্পের ভূমিকায় নতুন মোড়: এমন পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি (foreign policy), বিশেষ করে ন্যাটো (NATO) নিয়ে তার সংশয়, ইউরোপের নিরাপত্তাকে পুনরায় ভাবিয়ে তুলেছে। ট্রাম্প “ড্যানিশ ভূখণ্ড গ্রিনল্যান্ড (Greenland) দখল করতে পারেন” বলে যেসব গুঞ্জন ছড়াচ্ছে—যদিও সেটি সরাসরি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ বা আগ্রাসনে গড়াবে এমন নিশ্চয়তা নেই—তারপরও এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ট্রাম্প আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনকে (international norms) তেমন মর্যাদা দিতে নারাজ। তিনি যে কোনও সময় বড় ধরনের ভূ-রাজনৈতিক (geopolitical) অস্থিরতা তৈরি করতে পারেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলো এখন নিজেদের একটি স্বাধীন নিরাপত্তা কাঠামোর (European security architecture) কথা ভাবছে, যেটি ন্যাটো থেকে পুরোপুরি আলাদা হতে পারে বা অন্তত বড় পরিসরে অভ্যন্তরীণভাবে রক্ষা-কৌশল নির্ধারণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের সামরিক শক্তি খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে—যদিও যুক্তরাজ্য এখন আর ইইউর অংশ নয়, তবু ইউরোপীয় ভূখণ্ডে এর ঐতিহাসিক ও সামরিক ভূমিকা অগ্রাহ্য করা কঠিন। ফলে এই সম্ভাব্য নতুন নিরাপত্তা কাঠামোতে যুক্তরাজ্য যদি বড় ভূমিকা গ্রহণ করে, ইইউর কাছেও যুক্তরাজ্যের কূটনৈতিক গুরুত্ব (diplomatic leverage) বাড়বে। তখন ইইউ হয়তো সীমান্ত শুল্ক সহজীকরণ ও পেশাগত স্বীকৃতির মতো বিষয়গুলোতে যুক্তরাজ্যের অবস্থানকে আগে যা ছিল তার চেয়ে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে বাধ্য হবে।
সামগ্রিক চিত্র: যুক্তরাজ্যের জন্য রূপালী রেখা?
ট্রাম্পের নতুন মেয়াদের প্রেসিডেন্সি আসলে বিশ্বের অনেক দেশের জন্য অস্বস্তিকর বা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। মেক্সিকো ও চীনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের আমদানি শুল্ক (tariff) এরই মধ্যে কার্যকর হচ্ছে বা পরিকল্পনাধীন রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক দেশও শুল্কের হুমকির সম্মুখীন। যেকোনো বড় অর্থনৈতিক শক্তির বাণিজ্য যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি করে, যার নেতিবাচক প্রভাব অনেক দূর পর্যন্ত গড়াতে পারে। কিন্তু যুক্তরাজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু সম্ভাব্য “silver lining” বা রূপালী রেখা দেখা যাচ্ছে:
১. ট্রেড ওয়ার থেকে মুক্তি: যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যানগত “ভুল-বোঝাবুঝি” বা গাণিতিক “সুবিধা” কাজে লাগিয়ে যুক্তরাজ্য নিজেকে এমন এক স্থান ধরে রেখেছে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চোখে যুক্তরাজ্য কোনো বাণিজ্যিক “শত্রু” নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত অর্জনের একটি উদাহরণ।
২. সেবা খাতে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা: ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্রে ডলারের মান বৃদ্ধির সম্ভাবনা যুক্তরাজ্যের সেবা রপ্তানি (services export) খাতে বাড়তি গতি আনতে পারে। উচ্চ শিক্ষা, আর্থিক পরিষেবা এবং বিভিন্ন প্রফেশনাল সার্ভিসে যুক্তরাজ্য তুলনামূলকভাবে কম ব্যয়বহুল গন্তব্য হয়ে উঠতে পারে অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী ও কর্মীর কাছে।
৩. ইইউর সঙ্গে নিরাপত্তা-ভিত্তিক সমঝোতায় শক্তিশালী অবস্থান: ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির অস্থিরতার কারণে ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে যুক্তরাজ্য তার সামরিক সক্ষমতা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এতে ইইউর সঙ্গে চলমান কোনো আলোচনায়—যেমন সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ সহজীকরণ, মুক্তভাবে পেশাগত স্বীকৃতি—যুক্তরাজ্য আরও বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে পারে।
অবশ্যই, এই উপকারী ফলাফলগুলো এখনো নিশ্চিত নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সবকিছুই পরিবর্তনশীল, এবং ট্রাম্প নিজেই খুব অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবু বর্তমান পরিস্থিতির আলোকেই বোঝা যাচ্ছে যে, শুরুর বড় উদ্বেগ সত্ত্বেও ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাজ্যকে বিপাকে ফেলবে না—বরং অভ্যন্তরীণ ও বহির্মুখী নীতির গুঞ্জনে যুক্তরাজ্য নিজেকে কিছু ক্ষেত্রে স্বস্তিতে দেখতে পাচ্ছে।
উপসংহার
বিশ্ব বাণিজ্য ও ভূ-রাজনীতির (geopolitics) প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের নতুন মেয়াদের প্রেসিডেন্ট হওয়া অনেক দেশকে শঙ্কিত করেছে। মেক্সিকো, কানাডা, চীন, এমনকি ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ এখনো শুল্ক আরোপ বা কঠোর আমদানি নিয়ন্ত্রণের হুমকিতে রয়েছে। ট্রাম্প দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি সম্পূর্ণ নির্মূল করার দিকেই যেন বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছেন।
কিন্তু যুক্তরাজ্য এই তালিকায় ব্যতিক্রম হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ দেখাচ্ছে। পরিসংখ্যানগত কারণে (যা মূলত ক্রাউন ডিপেনডেন্সির কারসাজি) যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে যুক্তরাজ্য আমেরিকান পণ্য বেশি আমদানি করে এবং অপেক্ষাকৃত কম রপ্তানি করে—যার মানে “ট্রাম্পের পক্ষে ইতিবাচক” বার্তা। ফলে যুক্তরাজ্য এখন পর্যন্ত শুল্ক যুদ্ধের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়নি। বরং এটি একটি কৌশলগত সুবিধা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
এছাড়া ট্রাম্পের কারণে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি যুক্তরাজ্যের সেবা রপ্তানিকে আরো প্রতিযোগিতামূলক করে তুলতে পারে। অভিবাসন ব্যবস্থা কঠোর হলে, ইউকে শিক্ষার্থীদের জন্য অপেক্ষাকৃত আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। আর ইউরোপের নিরাপত্তা প্রশ্নে নতুন অনিশ্চয়তায়, যুক্তরাজ্যের সামরিক ও কূটনৈতিক ভূমিকা বাড়তে পারে, যা ইইউর সঙ্গে চুক্তি আলোচনা বা সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও আলোচনার হাত শক্ত করবে।
সারসংক্ষেপে বলা যায়, লেবার সরকার শুরুতে ভেবেছিল যে ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক মোটেও সহজ হবে না—বিশেষত দলের শীর্ষ নেতা ও নীতিনির্ধারকরা ট্রাম্প সম্পর্কে সমালোচনামূলক অবস্থান নিয়েছিলেন এবং ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইলন মাস্ক খোলামেলাভাবে স্টারমারের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে যুক্তরাজ্যের জন্য বেশ কিছু “উপকারী সম্ভাবনা” তৈরি হয়েছে।
নিঃসন্দেহে, ট্রাম্প প্রশাসনের বৈদেশিক নীতির অনেক দিকই বিশ্বের জন্য অস্থিতিশীলতা ডেকে আনতে পারে। তবু, এই লেখাটিতে বাস্তবসম্মত কিছু যুক্তি দাঁড় করানো সম্ভব হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে যুক্তরাজ্যের সামনে উন্মুক্ত হচ্ছে এমন কিছু কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ, যা হয়তো অন্য অনেক দেশ ভোগ করতে পারবে না। যেমনটা ওপরের তিনটি কারণ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এটি কোনো স্বপ্নিল চিত্র নয়; বরং ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও পরিসংখ্যানগত বাস্তবতার আলোকে একটি সম্ভাব্য চিত্র।
এখন দেখার বিষয়, ট্রাম্পের নীতি ও বিশ্ব পরিসরে অদূর ভবিষ্যতে নতুন কী পরিবর্তন আসে, এবং যুক্তরাজ্য সরকার (স্টারমার প্রশাসন) কতটা দক্ষতার সঙ্গে এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে পারে। যদি তারা সঠিকভাবে এ সুযোগগুলো ব্যবহার করতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি ও বৈদেশিক বাণিজ্য উভয়ই ইতিবাচক ধারায় প্রবাহিত হতে পারে। আর যদি কোনো অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি সামনে আসে, তখন হয়তো চিত্র পাল্টাতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
আরও পড়ুন –
কেন ট্রাম্প সম্ভবত তার বাণিজ্য-যুদ্ধে হারাবেন? (৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫)
Leave a Reply