কীভাবে মহান আলেকজান্ডার বৌদ্ধ চিত্রকর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট?

আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট  খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে ভারতবর্ষে পা রাখেন, তখন দুটো ভিন্ন সভ্যতা (ভারতীয় ও গ্রীক) একে অপরের সম্মুখীন হয় এবং একে অপরের দ্বারা প্রভাবিত হয়। বুদ্ধকে প্রথম মানুষের চেহারায়  উপস্থাপনা করা হয় ২য় এবং ১ম শতাব্দী মাঝামাঝি সময়ে বুদ্ধকে প্রথম মনুষ্য প্রতিরূপ (এনথ্রোপোমরফিক রিপ্রেজেন্টেশন) তৈরি করা হয়। তার আগে বুদ্ধকে শুধু বোধি বৃক্ষ, স্তূপ, খালি আসন, পদচিহ্ন এবং চাকার মত চিহ্নের মাধ্যমে চিত্রায়িত করা হতো। গ্রীক সেনারা ব্যাকট্রিয়া রাজ্য জয় করার পর, বুদ্ধের মানব চিত্র অঙ্কিত হয়।

বুদ্ধের এই মানবরূপটি নিঃসন্দেহে হেলেনীয় স্টাইল দ্বারা অনুপ্রাণিত। তার সেই ভাস্কর্যরূপটি অবিলম্বে শিল্পের উচ্চ স্তরে পৌঁছে যায়। এই সময়ের বুদ্ধের স্থাপত্য ও বুদ্ধের ভাস্কর্য বৌদ্ধ শিল্পকে প্রভাবিত করে এবং এটাই বুদ্ধের স্থায়ী রূপ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে যায়। এই সময়ের বুদ্ধকে সুন্দর এবং হেলেনীয় পোশাক পরা অবস্থায় বেলভেদেরে অ্যাপোলোর (৩৩০খ্রিস্টাব্দ) মত দেখাত। তাকে একটি হালকা টোগা পরিহিত, কনস্ট্রাপস্টো ঢঙে সোজা হয়ে দাঁড়ানো ও ভূমধ্যসাগরীয় কোঁকড়ানো কেশবিণ্যাসে দেখানো হয়েছে। বুদ্ধের কিছু মূর্তিতে মার্বেল দ্বারা হাত ও পা তৈরির গ্রিক কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। আজকাল অনেক গবেষকই ভাবছেন, বুদ্ধের মূর্তি কি কোনো একজন প্রাচীন রাজার প্রতিনিধিত্ব করে কিনা যিনি বুদ্ধের প্রতিমূর্তি চিরদিনের জন্য বদলে দিয়েছিলেন।

মহান ম্যাসেডোনীয় রাজার বৌদ্ধ পথচিহ্ন

standing-buddha

৩২৬ অব্দে, আলেকজান্ডার ভারতের উত্তরের রাজ্যগুলো জয় করেন। কয়েক বছর আগে, ৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার ব্যাকট্রিয়া এবং গান্ধার আক্রমণ করেন, যখন এই অঞ্চল সার্মানিক (śramanic) প্রভাবাধীন (সম্ভবত বৌদ্ধ ও জৈন) ছিল। কিংবদন্তী আছে যে ব্যাকট্রিয়া থেকে দুজন যুবক, তাপাস্সু এবং বাহালিকা, বুদ্ধের সঙ্গে সাক্ষাত করে এবং তার শিষ্য হয়ে ওঠে। তারা বৌদ্ধ প্রজ্ঞার প্রশিক্ষক হয়ে নিজ বাড়ি ফিরে আসে। ম্যাসেডোনীয় রাজার সেনাবাহিনী আসার আগ পর্যন্ত এই বৌদ্ধ কেন্দ্র নিরাপদ ছিল। ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে  আলেকজান্ডার এবং পাঞ্জাবের পৌরভাস এর রাজা পোরাসের মধ্যে একটি কঠিন (the Battle of the Hydaspes) যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বিজয়ী হবার পর, আলেকজান্ডার একটি ধর্মের সাথে পরিচিত হন, যা তাকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি এশিয়ার এই অংশের সংস্কৃতি দ্বারাও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

ঐতিহাসিক ভাবে, বিভিন্ন দার্শনিক, যেমন অ্যানাক্সারকাস, পেরো, এবং ওনেসিক্রিটাসকে আলেকজান্ডার আভিযানের সময় তাঁর সফর সঙ্গি হিসেবে রেখেছিলেন। তারা প্রায় ১৮ মাস আধুনিক ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করেন। সেসব জায়গায় তারা বিভিন্ন সাধু সন্ন্যাসীদের সাথে সাক্ষাত করেন। কিন্তু তাদের ছাড়াও তারা ‘নগ্ন দার্শনিক’ বা জিমনোসোফাইটিস নামে পরিচিত সন্নাসীদের সাথে তারা পরিচিত হন।  স্ট্রাবো বলেছেন, ওনেসিট্রিকাস নামক একজন সিনিক দার্শনিক ভারতে শিখেছিলেন যে, যা কিছুই একজন মানুষের সঙ্গে ঘটে তা ভাল বা খারাপ কোনটাই না। বিষয়গুলো নিছকই স্বপ্ন হিসেবে মানুষের কাছে উপস্থাপিত হয়। সেটাই সর্বশ্রেষ্ঠ দর্শন যা মনকে আনন্দ ও বিষাদ উভয় হতেও  মুক্তি দান করে।

পেরো (Pyrrho) একজন সন্দেহবাদী ছিলেন যিনি পাইরোনিজম নামে দার্শনিক ধারা তৈরি করেছিলেন। তিনিও ভারতে ভ্রমনের পর লেখেন, কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এটাও বলেন, মানুষের জীবন প্রচলিত রীতিনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই দুই দার্শনিকদের বিবৃতিগুলো বৌদ্ধ ধর্মের সাথে প্রাচীন গ্রীকদের ধর্মের মধ্যে সংযোগ দেখাচ্ছে। সে সময়ের প্রচলিত অন্যান্য ধর্মের চেয়ে বৌদ্ধধর্ম কতটা আকর্ষণীয় এটি এই বিষয়েও আলোকপাত করে।

বুদ্ধের হেলেনীয় সংরক্ষক

গ্রিকো-বুদ্ধিজম হল হেলেনিস্টিক সংস্কৃতি ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে একটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সমন্বয় (সিনক্রেটিজম),যার অস্তিত্ব ৫ম শতক পর্যন্ত ছিল। এটি শুধুমাত্র একটি গ্রিক বিশ্বাস ছিল না, বরং এটি পাকিস্তান, ভারত ও আফগানিস্তানের অংশেও প্রভাব বিস্তার করেছিল। পরবর্তীতে, এটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতীক ও বিবরণ – চীন, ফিলিপাইন, কোরিয়া, জাপান, সাইবেরিয়া, এবং ভিয়েতনাম মতো মধ্য ও উত্তর এশিয়ার দেশগুলোতে গৃহীত হয়। বৌদ্ধধর্মের উপর হেলেনীয় প্রভাব সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয় গ্রীক বীর, কিউপিড এবং অন্যান্য কিছু প্রতীকের ব্যবহার দ্বারা যা গ্রিক সংস্কৃতির অঙ্গ। সবচেয়ে বিষ্ময়কর সম্ভবত বুদ্ধের রক্ষাকারী বজ্রপাণির রিপ্রেজেন্টেশন যা হেলেনিস্টিক সংস্কৃতির হেরাক্লেসের সাথে মিলে যায়। আবার গ্রিকো-বুদ্ধিজম সংস্কৃতির প্রভাবে গ্রীক দেব বোরিয়াস (উত্তর বায়ুর দেবতা),  জাপানি বায়ু দেবতা ফুজিন-এ রূপান্তরিত হয়। মাতৃ দেবী হারিতি, গ্রিক টাইকে দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়। এটলাসও এই গ্রিকো-বুদ্ধিস্ট সংস্কৃতিতে চলে আসে। তিনি স্থাপত্যের একটি নিরবচ্ছিন্ন উপাদান হিসেবে জড়িত ছিলেন।

প্রচীন ব্যাকট্রিয়ার ধ্বংসাবশেষ

ব্যাকট্রিয়া রাজ্য প্রায় দু’শ বছর গ্রীকদের অধীনে ছিল। ৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের অভিযান থেকে ১২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পর্যন্ত গ্রিকো-ব্যাকট্রিয়ান রাজ্য টিকে ছিল। এই সময়কালে, রাজ্য সীমানার প্রায় সবগুলো এলাকা পুরোপুরি হেলেনীয় ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলাফল হতে জানা যায় যে অক্সাস-এ আলেকজান্দ্রিয়া (আল-খানুম) মত শহরে, গ্রেকো-ব্যাকট্রিয় রাজাদের মুদ্রাসংক্রান্ত শিল্প ছিল, যা হেলেনীয় বিশ্বের সেরা সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত। এছাড়া এটি সাম্রাজ্যের একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল যেখানে গ্রীক ইতিহাসে বৃহত্তম সোনা ও রূপার মুদ্রা তৈরি করা হয়েছিল।

১ম শতাব্দিতে মধ্য এশিয়ায় বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটে এবং এটি ইসলামী আগ্রাসন পর্যন্ত শক্তিশালী থাকে। গ্রিকো-বুদ্ধিস্ট সংস্কৃতির সাথে সংযুক্ত স্থাপনাগুলোর মধ্যে বামিয়ানের মহান বুদ্ধের মূর্তি সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ছিল। এগুলো ৫ম এবং ৯ম শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে তৈরি করা হয়েছিল। এদের স্থাপত্য সৌন্দর্য অতিমাত্রায় হেলেনীয় শৈলীর। ৫ম শতাব্দী থেকে ব্যাকট্রিয়ার অধিকাংশ শিল্পই ধ্বংস হয়ে গেছে।

২০ শতকে আফগানিস্তান যুদ্ধের সময়, প্রাচীন অনেক নিদর্শন ধ্বংস করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০১ সালে, বামিয়ানের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং মূল্যবান বুদ্ধ মূর্তি, তালেবান শাসকেরা ধ্বংস করে দেয়। একসময় ইউনেস্কো দ্বারা সুরক্ষিত, এই মূল্যবান সম্পদ চিরতরে হারিয়ে গেছে।

মহান আলেকজান্ডারের বাণী ও অনুভূতি এখনও এশিয়ার মানুষের অন্তরে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। বামিয়ান বুদ্ধের ধ্বংস বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষের জন্য একটি বেদনাদায়ক ক্ষতি ছিল। তালেবান শাসন দ্বারা ধ্বংসের চৌদ্দ বছর পরে, ৭ জুন ২০১৫ সালে একটি চীনা দম্পতি জিনউ ঝাং এবং হং লিয়াং থ্রিডি লেজার লাইট প্রোজেকশন টেকনোলজি দ্বারা খালি গহ্বরটি পূর্ণ করেছিলেন। সম্ভাব্য ঝুঁকি উপেক্ষা করে প্রায় ১৫০ জন স্থানীয় মানুষ হলোগ্রাফিক মূর্তির অপাবরণ দেখতে ছুটে আসে।


আর্টিকলটির মূল লিংক

—সুস্মিতা দেব

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.