Table of Contents
ভূমিকা
যুক্তরাষ্ট্রের (United States) ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) শপথ নিয়েছেন। তার মেয়াদকাল চার বছরের বেশি সময় পর্যন্ত গড়াতে পারে, যদি তিনি নিজেকে আরও দীর্ঘকাল ক্ষমতায় রাখতে সফল হন। হোয়াইট হাউস (White House) থেকে চার বছরের বিরতি তার কর্মোদ্যমকে মোটেও কমায়নি—তিনি ইতিমধ্যে দফায় দফায় নির্বাহী আদেশ (Executive Orders) সই করছেন, নানা ঘোষণা দিচ্ছেন, ডিক্রি জারি করছেন এবং নিউ ইয়র্ক থেকে ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত প্রায় সব ডেমোক্র্যাটকেই ক্ষুব্ধ করে তুলেছেন।
কিন্তু আসলে গত সপ্তাহে কী ঘটলো? ট্রাম্প কি এক রাতারাতি সস্তা দামের (Dollar Store) কোনো স্বৈরশাসকে (Dictator) পরিণত হলেন? নাকি আমরা একটি সম্পূর্ণ নতুন “আমেরিকান সাম্রাজ্যের” (American Empire) সূত্রপাত দেখছি?
নিচে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো, ট্রাম্প কেন এভাবে শুরুর দিনগুলোতেই এমন ব্যস্ত সময় পার করছেন, কিভাবে প্রেসিডেন্সির ক্ষমতা দিন দিন আরও বিস্তৃত হচ্ছে, কেন তিনি শুধু দেশের ভেতরেই নয়, বাইরেও আক্রমণাত্মক অবস্থান নিচ্ছেন—এবং শেষমেষ কীভাবে এসব আমাদের আমেরিকান রাজনৈতিক কাঠামোকে বদলে দিতে পারে।
ট্রাম্পের ক্ষমতার শুরু: নির্বাহী আদেশের (Executive Orders) ঝড়
ট্রাম্প তার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সির প্রথম দিন থেকেই অনবরত নির্বাহী পদক্ষেপ নিচ্ছেন। প্রথম দিনেই তিনি:
- ২৬টি নির্বাহী আদেশ
- ১২টি হোয়াইট হাউস মেমো (White House Memos)
- ৪টি প্রেসিডেন্সিয়াল প্রোক্লেমেশন (Presidential Proclamations)
ইমিগ্রেশন (Immigration) থেকে বাণিজ্য নীতি (Trade Policy) পর্যন্ত বিস্তৃত এমন বহু ইস্যুতে এই আদেশগুলো দেওয়া হয়েছে। এদের বেশিরভাগই খুব বিতর্কিত নীতিকে ইঙ্গিত করে; তবে একইসঙ্গে একটা বিষয় স্পষ্ট—এসব পদক্ষেপে কংগ্রেস (Congress) ও অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী বাধা বা ভারসাম্যের (Checks and Balances) ওপর তোয়াক্কা করা হচ্ছে না।
ট্রাম্প তো এমন ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন যে, তিনি “এক দিনের জন্য হলেও” স্বৈরশাসকের ভূমিকায় থাকতে চান। সত্যি বলতে, ১৯৭৬ সালের ন্যাশনাল ইমার্জেন্সিস অ্যাক্ট (National Emergencies Act) ব্যবহার করে দক্ষিণ সীমান্তে (Southern Border) জরুরি অবস্থা ঘোষণা (Declare an Emergency) তাকে অনেকগুলো ক্ষমতার দ্বার খুলে দিয়েছে—যেমন কোনো বিচার প্রক্রিয়া ছাড়াই (Without Judicial Process) আমেরিকানদের সম্পদ (Assets) জব্দ করার ক্ষমতা।
অন্য এক মেমোতে তিনি ট্যাক্স কোডের সেকশন ৮৯১ (Section 891) এর কথা উল্লেখ করেছেন, যা ১৯৩৪ সালে তৈরি হলেও কখনো ব্যবহৃত হয়নি। এটি প্রেসিডেন্টকে কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই অন্য কোনো দেশের নাগরিক ও ব্যবসার ওপর দ্বিগুণ হারে কর (Double Taxes) আরোপ করার ক্ষমতা দেয়।
এমনকি “ওয়াশিংটন পোস্ট” (Washington Post) জানাচ্ছে, নতুন প্রশাসন কিছু ফেডারেল এজেন্সিকে (Federal Agencies) নির্দেশ দিয়েছে সাময়িকভাবে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ রাখার জন্য এবং পরবর্তীতে যে কোনো যোগাযোগের আগে ট্রাম্পের দলের অনুমোদন নিতে হবে।
কংগ্রেস বা আদালত (Courts) এ বিষয়ে কী বলবে, সেটাও অনিশ্চিত। কারণ রিপাবলিকান পার্টির (Republicans) ওপর ট্রাম্পের শক্ত নিয়ন্ত্রণ, তাদের গভর্নিং ট্রাইফেক্টা (Governing Trifecta) — (হোয়াইট হাউস, সেনেট এবং হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস—সবই একদলীয় নিয়ন্ত্রণ) এবং সুপ্রিম কোর্টের (Supreme Court) স্পষ্ট ট্রাম্পপ্রীতি—এসবই তাকে অনায়াস ক্ষমতা প্রয়োগে সহায়তা করছে।
“ইমপেরিয়াল প্রেসিডেন্সি” (Imperial Presidency): একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতা
অনেকে ভাবছেন, এটি কি শুধু ট্রাম্পের “স্বতন্ত্র দৃষ্টান্ত” (Trump Specific Phenomenon)? বাস্তবে কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা দীর্ঘদিন ধরেই বাড়ছে, বিশেষ করে ১৯৬০-এর দশক থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে (Constitution) কিছু ফাঁকফোকর বা অস্পষ্টতা আছে, যেগুলো পরপর বিভিন্ন প্রেসিডেন্ট প্রয়োগ করে ক্ষমতার পরিসর বাড়িয়ে তুলেছেন। ইতিহাসবিদ আর্থার স্লেসিঞ্জার (Arthur Schlesinger) একে বলেছিলেন “দ্য ইমপেরিয়াল প্রেসিডেন্সি” (The Imperial Presidency)।
মূলত ৯/১১-এর (9/11) পরবর্তী সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই বা জাতীয় নিরাপত্তা (National Security) ইস্যুতে এক্সিকিউটিভ অথরিটি (Executive Authority) ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে। আজকের তীব্র দলীয় মেরুকরণ (Political Polarisation)-এর যুগে ইমপিচমেন্টের (Impeachment) হুমকি কার্যত আর কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ হিসেবে কাজ করে না।
ট্রাম্প নিঃসন্দেহে এই প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করবেন। কিন্তু তিনি তা পারবেন, কারণ মার্কিন রাজনীতি গত কয়েক দশকে এমন ধারায় গতি পেয়েছে। কংগ্রেস বা আদালত ট্রাম্পের ক্ষমতাকে কোথায় সীমায়িত করতে পারে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। যদি তারা বেশি বাধা না দেয়, তাহলে বোঝা যাবে, যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই স্লেসিঙ্গারের “ইমপেরিয়াল প্রেসিডেন্সি”র আরও একধাপ সামনে এগোল, যেখানে কংগ্রেস ও আদালত মূলত পর্দার পেছনে “সহায়ক ভূমিকায়” রয়ে যাচ্ছে।
ঘরোয়া নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও “মুখ্য চরিত্র” হওয়ার তাড়না
ট্রাম্প শুধু যে দেশীয় ক্ষেত্রে বড় বড় পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তা নয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তিনি প্রবল ইচ্ছা দেখাচ্ছেন, যেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব “নিজের ভূমি (Home Field)” থেকে আরও প্রসারিত হয়।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, গ্রীনল্যান্ড (Greenland) দখলের ইচ্ছা প্রকাশ, পানামা খাল (Panama Canal) পুনরায় দখল করার উচ্চকণ্ঠী পরিকল্পনা, এমনকি কানাডাকেও (Canada) কোনোভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করার ধারণা। পুরোনো প্রেসিডেন্সিতে আমরা ট্রাম্পের এইসব অদ্ভুত মতামত শুনলেও, অনেকেই ভেবেছিলেন তিনি হয়তো কথার কথা বলছেন। কিন্তু সম্প্রতি ডেনমার্ক (Denmark), কানাডা ও পানামা বিষয়ক অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে—তিনি ১০০% সিরিয়াস। শোনা যাচ্ছে, ড্যানিশ প্রধানমন্ত্রীকে (Danish Prime Minister) টেলিফোনে তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, গ্রীনল্যান্ড দখলের ব্যাপারে তিনি সত্যিই মত পোষণ করেন।
গ্রীনল্যান্ড, পানামা, কানাডা: “নব্য সাম্রাজ্যবাদ” নাকি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা?
অনেক আমেরিকান মনে করতে ভালোবাসেন যে, যুক্তরাষ্ট্র “বিরোধী সাম্রাজ্যবাদী” (Anti-Imperialism) রাষ্ট্রের মডেল। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে দেখলে, আমেরিকার আলোচনায় সাম্রাজ্য বিস্তারের উদাহরণ রয়েছে। আজকের যুক্তরাষ্ট্র তো ১৭৭৬ সালের আদলের ১৩টি উপনিবেশ (Colonies) ছিল না—কালের পরিক্রমায় যুক্তরাষ্ট্র প্রবলভাবে পশ্চিমে, উত্তরে, দক্ষিণে বিস্তৃত হয়েছে।
- ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র ছিল কেবল পূর্ব উপকূলের ১৩টি ব্রিটিশ উপনিবেশ।
- ১৭৬৩ সালের রয়্যাল প্রোক্লেমেশন (Royal Proclamation) ছিল এক কারণ, যেখানে ব্রিটিশরা অ্যাপালাচিয়ান পর্বতমালা (Appalachian Mountains) পেরিয়ে পশ্চিমে বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ করেছিল। এটি ছিলেন সেই সময়ের অন্যতম কারণ, যা আমেরিকানদের মধ্যে বিক্ষোভ জাগিয়েছিল।
- ১৮০৩ সালের লুইজিয়ানা ক্রয় (Louisiana Purchase): ফ্রান্সের কাছ থেকে বিশাল অঞ্চল কিনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ড প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।
- ১৯শ শতকের প্রথমার্ধ, বিশেষ করে গৃহযুদ্ধের (Civil War) আগের সময়, যুক্তরাষ্ট্র একদিকে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত উত্তর অঞ্চলের দিকে নজর দিয়েছিল (পরবর্তীতে কানাডা) এবং অন্যদিকে দক্ষিণে মেক্সিকো (Mexico)-র দিকেও বিস্তারের চেষ্টা করেছিল।
একই সময়ে (১৮৬৭ সালে, যেদিন আমেরিকা রাশিয়ার কাছ থেকে আলাস্কা (Alaska) কিনেছিল), গ্রীনল্যান্ডকেও (Greenland) কেনার প্রস্তাব দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তখনকার যুক্তরাষ্ট্র সরকারের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, যদি গ্রীনল্যান্ড কেনা যায়, তাহলে কানাডা চারপাশে আমেরিকান অঞ্চলে বেষ্টিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চাপ বাড়বে। তাই দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্পের সাম্প্রতিক উচ্চকণ্ঠ মূলত ১৮-১৯ শতকের আমেরিকান সম্প্রসারণবাদী (Expansionist) ঐতিহ্যের পুনরাবৃত্তি।
তবে আধুনিক যুগ কিন্তু ১৯শ বা ২০শ শতকের মতো নেই। আঞ্চলিক সীমান্ত (Territorial Border) এখন তেমনভাবে বদল হয় না। ইতিহাসের শিক্ষায় আমরা বুঝে গেছি, সীমানা দখলের পরিণতি নানাভাবে মারাত্মক হতে পারে। তাছাড়া স্ব-নিয়ন্ত্রণ (Self-Determination) বা স্থানীয় জনগণের ইচ্ছাকে এখন অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। গ্রীনল্যান্ড বা কানাডার জনগণ যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হতে আগ্রহী—এমন চিন্তা হাস্যকরই বটে।
আগামী দিনে যদি যুক্তরাষ্ট্র আসলেই গ্রীনল্যান্ড বা পানামা বা কানাডাকে দখল/একীভূত করার পথে এগোয়, বিশ্ব তা কীভাবে গ্রহণ করবে, সেটি বড় প্রশ্ন। আমরা কি সত্যিই আঠারো-উনিশ শতকের ভূখণ্ড-বিস্তারের রাজনীতিকে পেছনে ফেলেছি? নাকি আবারও সেই যুগে ফিরে যাবো?
সাবেক উপদেষ্টাদের সাথে দ্বন্দ্ব: নতুন করে অলিগার্কি (Oligarchy) বিতর্ক
ট্রাম্প এখন শুধু বিদেশি নেতাদের সাথেই নয়, তার একসময়ের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের সাথেও বিরোধে জড়াচ্ছেন। কারণ তার প্রযুক্তি-মহাপ্রভুদের (Tech Bros) সাথে নতুন বন্ধুত্ব অনেকেরই পছন্দ হচ্ছে না। বিশেষ করে, প্রাক্তন ব্রেইটবার্ট (Breitbart) চেয়ার এবং ট্রাম্পের সাবেক প্রধান কৌশলবিদ (Chief Strategist) স্টিভ ব্যানন (Steve Bannon) অভিযোগ তুলেছেন, ট্রাম্প আমেরিকাকে একটি “অলিগার্কিতে” (Oligarchy) পরিণত করছেন।
শুধু ব্যাননই নন, ডানপন্থী (Right) ও বামপন্থী (Left) দুই শিবিরেই এখন “অলিগার্কি” শব্দটি খুব জনপ্রিয়। জো বাইডেন (Joe Biden) বিদায়ী ভাষণে এই শব্দ ব্যবহার করেছেন, বার্নি স্যান্ডার্স (Bernie Sanders) ট্রাম্পের দ্বিতীয়বারের শপথের পর একই অভিযোগ তুলেছেন—“আমেরিকা কি ধনকুবেরদের হাতে শাসিত হচ্ছে?”
যুক্তরাষ্ট্র কি “পুতিনের রাশিয়া”র মতো অলিগার্কি?
অলিগার্কির ধারণা হলো, অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক কাঠামো বা আড়ালের আড়ালে বেশ কিছু প্রভাবশালী ধনী গোষ্ঠী যদি দেশের বাস্তব ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে, তখন তাকে অলিগার্কি বলা যায়। পুতিনের রাশিয়া (Putin’s Russia) সাধারণ উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেখানে কয়েকজন ধনকুবের (Oligarch) এবং রাষ্ট্রনেতা একযোগে দেশের নীতি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় অভিষেকে (Inauguration) পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সত্যিই একধরনের অলিগার্কিক চিত্র চোখে পড়ছে। ভিআইপি আসনে পাশাপাশি বসেছিলেন ইলন মাস্ক (Elon Musk), জেফ বেজোস (Jeff Bezos) ও মার্ক জাকারবার্গ (Mark Zuckerberg)—তিনজনই বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের মধ্যে আছেন, তাদের সম্মিলিত সম্পদ প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার। তারা গত কয়েক বছরে ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন জোরালো করেছেন।
এই দৃশ্য হয়তো ট্রাম্পের কারণে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কিন্তু আমেরিকান রাজনীতিতে ধনকুবেরদের প্রভাব অনেক পুরোনো। বিশেষ করে ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের “সিটিজেন্স ইউনাইটেড” (Citizens United) রায়ের পর কোম্পানি (Corporations) ও ধনীরা রাজনীতিতে ‘অসীম অংকের অর্থ’ (Unlimited Money) খরচ করতে পারে। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (Democratic Party) সাথেও অনেক বিলিয়নিয়ার যুক্ত আছেন, যদিও তাদের অবস্থান বা সমর্থন হয়তো কিছুটা ভিন্ন ধরনের—তবে প্রভাবের বিষয়টি অস্বীকার করা যায় না।
তবে ট্রাম্পের ক্ষেত্রে পার্থক্য হলো, তিনি খুবই খোলাখুলিভাবে ধনী ব্যক্তিদের প্রতি সমর্থন দেখান। উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি বলেছিলেন, “আমি বৈদ্যুতিক গাড়ির (Electric Cars) পক্ষে, আমাকে তাই হতে হবে, কারণ ইলন (Elon) আমাকে খুব জোরালোভাবে সমর্থন করেছে।”
পাশাপাশি, তার নীতিগুলোও বড় ব্যবসা (Big Business) বা ধনীরা যাতে আরও সুবিধা পান সেইদিকে লক্ষ্য রেখে তৈরি হয়েছে। বাইডেন (Biden) প্রশাসনের সময় করা “অ্যান্টিট্রাস্ট (Antitrust) চেষ্টা”—বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে ভাঙার বা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ—ট্রাম্প চালিয়ে যেতে চান না। তিনি বরং সেকশন ৮৯১-এর মতো শুল্ক/কর ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU)-কে চাপে রাখতে চান, যেন তারা আমেরিকান টেক জায়ান্টদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে না পারে।
পার্থক্যটা এখানে “ধরনে” (Difference in Kind) নয়, বরং “মাত্রায়” (Difference in Degree)। আমেরিকায় ধনী-শ্রেণির প্রভাব কোনো নতুন বিষয় নয়, কিন্তু ট্রাম্পের শাসনকালে এ প্রভাব আরও ব্যাপকভাবে ও প্রকাশ্যেই দৃশ্যমান হতে পারে।
বিলিয়নিয়ারদের (Billionaires) আসল প্রভাব কতটুকু?
আগামী চার বছরে ট্রাম্প যে নীতিমালা গ্রহণ করবেন, তার বড় অংশ নির্ভর করবে তার চারপাশের এই বিলিয়নিয়ারদের আগ্রহ বা চাওয়ার ওপর। তারা যদি চায়, ট্রাম্প শুল্ক আরোপ বা বিভিন্ন সংরক্ষণবাদী পদক্ষেপ (Protectionist Measures) নেবেন, যাতে তাদের ব্যবসা উপকৃত হয়। একই সঙ্গে এটিও দেখা যেতে পারে যে, এই ধনী ব্যক্তিরাই হতে পারেন ট্রাম্পের ক্ষমতার ওপর অদ্ভুত এক “নিয়ন্ত্রণকারী” শক্তি, কারণ তাদের অর্থ ও প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক।
অর্থাৎ, শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প কি পুরো উত্তর আমেরিকান মহাদেশের মহারাজ হয়ে উঠবেন, নাকি কোনো এক সময়ে এসব ধনী স্পন্সরদের (Sponsors) স্বার্থের কাছে তাকে মাথা নত করতে হবে—তা এখনো পরিষ্কার নয়।
উপসংহার: সামনের দিনগুলোতে কী দেখার আছে?
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ মাত্র শুরু। ইতিমধ্যে তিনি নির্বাহী আদেশের ঝড় তুলেছেন, জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন, দক্ষিণ সীমান্তে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন, গ্রীনল্যান্ড বা পানামা খাল দখল করার মত পরিকল্পনা পুনরুজ্জীবিত করেছেন, কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের অংশে পরিণত করার রূপরেখা দিয়েছেন, এবং প্রযুক্তি জায়ান্টদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মেলবন্ধন গড়ে তুলছেন।
১. ইমপেরিয়াল প্রেসিডেন্সি (Imperial Presidency): কংগ্রেস ও আদালত তাকে কতটুকু চ্যালেঞ্জ করতে পারবে? যদি তারা ব্যর্থ হয়, তবে আমেরিকান ক্ষমতার ভারসাম্য (Balance of Power) স্থায়ীভাবে প্রেসিডেন্টের দিকে হেলে যেতে পারে।
২. সীমানা সম্প্রসারণের চেষ্টা: যদি সত্যি ট্রাম্প গ্রীনল্যান্ড বা পানামা বা কানাডা সংযুক্ত করার পথে যান, বিশ্ব কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে? এ পদক্ষেপ কি ১৯শ শতকের পরিত্যক্ত ভূখণ্ড-আগ্রাসনের রাজনীতি ফিরে আসার ইঙ্গিত? নাকি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এর দৃঢ় বিরোধিতা করবে?
৩. অলিগার্কির সম্ভাবনা: বিলিয়নিয়ারদের প্রত্যক্ষ সংযোগ, “সিটিজেন্স ইউনাইটেড”-এর পরিপ্রেক্ষিতে অঢেল অর্থব্যবস্থা—এসব মিলিয়ে আমেরিকা কি রাশিয়ান মডেলের (Russian Model) কোনো ধনকুবের-নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রে (Oligarchic State) পরিণত হচ্ছে? নাকি এটি শুধু ট্রাম্পের শো-অফ মাত্র?
৪. বিলিয়নিয়ারদের প্রভাব: ট্রাম্পের চারপাশে মাস্ক, বেজোস, জাকারবার্গদের মতো শীর্ষ ধনীরা অবস্থান করছেন। তারা কতটা নীতি-নির্ধারণে ভূমিকা রাখেন, আর কতটা ট্রাম্পকে নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যে চালিত করেন—সে প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে, এই ধনীরা যদি দেখেন ট্রাম্প তাদের প্রত্যাশা পূরণ করছে না, তখন কী হবে?
৫. ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতি: পরবর্তী কয়েক বছরে যদি সত্যি ট্রাম্প স্বেচ্ছাচারী নীতিকে আরও বাড়ান, বিরোধী দলগুলো (ডেমোক্র্যাটসহ) এবং সাধারণ জনগণ কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে? দলীয় মেরুকরণ বৃদ্ধির পরিণতি কী হতে পারে?
বাস্তবে কী ঘটবে, তা এখনো অনিশ্চিত। ক্ষমতার চাকা ঘুরছে খুব দ্রুত, এবং ট্রাম্প স্বভাবতই চমক-জাগানো ভূমিকা রাখতে পছন্দ করেন। আমেরিকার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, তার সংবিধানিক কাঠামো, আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে ভূখণ্ড-বিস্তারের পরিকল্পনা—সবকিছুই এখন ঝুঁকিপূর্ণ ও অস্থির হয়ে উঠতে পারে। তাই, যুক্তরাষ্ট্র কি অলিগার্কিক ধাঁচে এগোচ্ছে, না কি পরবর্তী পদক্ষেপে ট্রাম্প স্বপ্নের আমেরিকান সাম্রাজ্য গড়ার চেষ্টা করবেন, সেটি বোঝার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আপাতত, আমরা যা দেখছি, তা হলো—ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম সপ্তাহ থেকেই এমন এক নাটকীয় সূচনা, যার পরিণতি কেবল সময়ই বলে দেবে।
Leave a Reply