কেন আর্জেন্টিনার অর্থনীতি উন্নতির দিকে গেলেও মুদ্রা এগোচ্ছে না?

ভূমিকা

আর্জেন্টিনার (Argentina) সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক চিত্র খুঁটিয়ে দেখলে মনে হয়, দেশটি ধীরে ধীরে অগ্রগতির দিকে যাচ্ছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট (President) তার প্রথম বছরে দেশটির আর্থিক ঘাটতি (Fiscal Deficit) ও চলতি হিসাবের ঘাটতি (Current Account Deficit) কমাতে সক্ষম হয়েছেন, ২০২৩ সালের শেষার্ধে আকাশচুম্বী মুদ্রাস্ফীতি (Inflation) অনেকটাই নামিয়ে এনেছেন, এমনকি গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে দেশকে মন্দা (Recession) থেকে বের করতেও পেরেছেন। সামগ্রিকভাবে এগুলো ইতিবাচক লক্ষণ।

কিন্তু এতকিছুর পরও এক বড় সমস্যা থেকে যাচ্ছে—আর তা হলো আর্জেন্টিনার মুদ্রা পেসো (Peso)। নির্বাচনী প্রচারণার সময় বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলে (Javier Milei) অঙ্গীকার করেছিলেন, আর্জেন্টিনায় ডলারিকরণ (Dollarization) করবেন, অর্থাৎ পেসোকে বিলুপ্ত করে ডলারে লেনদেন চালু করবেন। এক বছর পার হয়ে গেলেও বাস্তবে তা এখনো অনেক দূরের পথ বলে মনে হচ্ছে। পেসোর প্রকৃত মূল্য (Real Value) কালোবাজারে (Black Market) ক্রমাগত পড়ে যাচ্ছে, আর পেসোর জটিল এক্সচেঞ্জ রেট ব্যবস্থাকে সরলীকরণ করার চেষ্টা—যা ডলারিকরণের পূর্বশর্ত হিসেবে দেখা হয়—সেটিও আশানুরূপ গতি পায়নি।

এই প্রতিবেদনে আমরা জানার চেষ্টা করবো, কেন পেসো মিলে-র (Milei) সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে, পেসো ঠিক করতে তার পরিকল্পনা কী, এবং কেন সেটি এখনো ফলপ্রসূ হচ্ছে না।

পেসো ঠিক করা এত কঠিন কেন?

পেসোর সমস্যার গোড়ায় যেতে হলে আমাদের দেখতে হবে, কেন প্রথম থেকেই আর্জেন্টিনার মুদ্রাব্যবস্থা টলে যাচ্ছিল। অধিকাংশ উন্নত দেশের মতো আর্জেন্টিনার মুদ্রা মুক্তভাসমান (Free Floating) নয়; বরং বহুদিন ধরে দেশটিতে কার্যত দুটি এক্সচেঞ্জ রেট (Exchange Rate) চালু ছিল।

১. অফিশিয়াল রেট (Official Rate): সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত বিনিময় হার।
২. অনানুষ্ঠানিক বা প্রকৃত বাজার হার, অর্থাৎ ব্লু রেট (Blue Rate): বাজারে চাহিদা ও যোগান অনুসারে নির্ধারিত হার।

সরকারি ঘোষণায় পেসোর মান সাধারণত বেশি দেখানো হতো, যা আসলে বাস্তব বাজারদরে প্রতিফলিত হত না। উদাহরণস্বরূপ, মিলে ক্ষমতা গ্রহণের আগে অফিশিয়াল রেট ছিল ডলারের বিপরীতে ৩৭০ পেসো, কিন্তু কালোবাজারে বা ব্লু রেটে ছিল প্রায় ১,০০০ পেসো। অর্থাৎ সরকার পেসোর মূল্যকে আসল বাজারদরের তুলনায় অনেক বেশিতে ধরে রাখছিল।

সরকারের এমন “বাড়িয়ে দেখানোর” প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল, দেশীয় ও সরকারি পর্যায়ে আমদানি সাশ্রয়ী রাখা। পেসোর অফিশিয়াল মূল্য কৃত্রিমভাবে উঁচু রাখা হলে, ডলারে আমদানি করার সময় কম পেসো খরচ করতে হয়। কিন্তু এই ব্যবস্থার ফল ভোগান্তিমূলক।

দ্বৈত বিনিময় হারের (Dual Exchange Rate) সমস্যা:

১. পেসোর সরকারি মূল্য ধরে রাখা কঠিন: অফিশিয়াল রেট ধরে রাখতে আলবার্তো ফার্নান্দেস (Alberto Fernandez) প্রশাসনকে জটিল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, মূল্য-নিয়ন্ত্রণ (Price Freezes), আমদানি সীমিতকরণ (Import Restrictions) ইত্যাদি পদক্ষেপ নিতে হয়েছে, যাতে মানুষ খুব সহজে অফিশিয়াল রেটে পেসো বিক্রি না করতে পারে। তবু পেসোর সরকার-নির্ধারিত মূল্য রক্ষা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (Argentinian Central Bank) রিজার্ভ (Reserves) ব্যাপকভাবে খরচ হয়ে গেছে। তাও অফিশিয়াল রেট অনবরত পড়ে গেছে, আর সরকার রিজার্ভের বড় অংশ পোড়াতে বাধ্য হয়েছে।

২. বিদেশি বিনিয়োগ (Foreign Investment) নিরুৎসাহিত করা: এই জটিল মুদ্রাব্যবস্থার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারিয়েছে, কারণ তারা প্রকৃত মূল্যে মুনাফা ফেরত পাবে কি না, বা লাভের ডলার রূপান্তর কতটা বাস্তবসম্মত হবে—এসব নিয়ে অনিশ্চয়তা কাজ করে।

৩. চলতি হিসাবের স্থায়ী ঘাটতি (Current Account Deficit): রপ্তানির তুলনায় আমদানি বাড়লে (যেহেতু কৃত্রিমভাবে পেসোর মান শক্তিশালী দেখানো হচ্ছে), তাতে বৈদেশিক মুদ্রা-নির্ভরতা বেড়ে যায়। এর ফলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি গুরুতর ঝুঁকিতে পড়ে, এবং আইএমএফের (IMF: International Monetary Fund) কাছ থেকে নিয়মিত ঋণ বা বেইলআউট (Bailout) নিতে হয়।

এসব কারণে, ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মিলে চেষ্টা করছেন অফিশিয়াল রেট ও ব্লু রেটকে একটি বিন্দুতে নিয়ে আসতে, যাতে দ্বৈত বিনিময় হার বিলুপ্ত করা যায়। এটি ভবিষ্যতে ডলারিকরণের (Dollarization) একটি পূর্বশর্ত। যদি পেসো ও ডলারের স্থিতিশীল এক্সচেঞ্জ রেট না থাকে, তবে পেসো পুরোপুরি তুলে দেওয়া অনেক বড় ঝুঁকি হয়ে উঠবে।

মিলে’র (Milei) পরিকল্পনা: কীভাবে পেসো একীভূত করা হবে?

ক্ষমতার প্রথম মাসে মিলে ৫০% পর্যন্ত অফিশিয়াল রেট অবমূল্যায়ন (Devaluation) করে ডলারের বিপরীতে ৮০০ পেসো নির্ধারণ করেন। একইসঙ্গে তিনি ঘোষণা দেন, সরকার প্রতি মাসে আরও ২% করে পেসোর অবমূল্যায়ন করবে, যাকে “ক্রলিং পেগ” (Crawling Peg) বলা হচ্ছে। এই পরিকল্পনার পেছনে যুক্তি ছিল:

১. অফিশিয়াল রেটকে নিচে নামানো: অবমূল্যায়নের মাধ্যমে অফিশিয়াল রেট কমে আসবে।
২. ব্লু রেটকে ওপরে তোলা: সরকারি ব্যয় কমিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা ছাপানো বন্ধ করলে বাজারে পেসোর সরবরাহ কমবে, ফলে পেসোর মূল্য বা বিনিময় হার কিছুটা বাড়তে পারে।

এই দুই প্রক্রিয়া যদি পাশাপাশি চলে, তাহলে এক সময় অফিশিয়াল রেট ও ব্লু রেটের মধ্যে ফারাক কমে আসবে, এবং এরপর মিলে চেয়েছিলেন পেসোকে “মুক্তভাসমান” (Floating Currency) মুদ্রায় পরিণত করতে, যেমনটি অধিকাংশ উন্নত দেশে দেখা যায়।

কেন পরিকল্পনা সফল হচ্ছে না?

বাস্তবে, গত কয়েক মাসের পরিসংখ্যান বলছে—পরিকল্পনাটি আশানুরূপ ফল দিচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, কিছুদিনের জন্য অফিশিয়াল রেট ও ব্লু রেট কাছাকাছি আসার ইঙ্গিত মিললেও, শেষ পর্যন্ত ব্লু রেট আরও দ্রুত নিচের দিকে নেমে গেছে (অর্থাৎ পেসোর মূল্য আরও কমে গেছে), ফলে এই দুই হারের মধ্যে পার্থক্য আবার বেড়ে গেছে।

উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি (High Inflation) ও পেসোর অবমূল্যায়ন: আর্জেন্টিনায় বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি এখনো ১০০%-এর বেশি। মিলে-র অফিসে আসার পরে কিছুটা কমলেও এটি এখনও খুবই উচ্চপর্যায়ে রয়ে গেছে। প্যারাডক্সিকালি, মিলে অফিশিয়াল রেট অবমূল্যায়ন (Devalue) করার ফলে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে, যা আরও মুদ্রাস্ফীতির জন্ম দিচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, যদি সরকার দ্রুত ক্রলিং পেগ বাড়িয়ে (অর্থাৎ অফিশিয়াল রেট আরও দ্রুত হারে নিচে নামিয়ে) ব্লু রেটের সাথে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে আমদানি পণ্যের দাম আরও বেড়ে মুদ্রাস্ফীতি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে, যদি সরকার এই ক্রলিং পেগ ধীরগতিতে বা সীমিতভাবে ধরে রাখে, তাহলে ব্লু রেটের সাথে একীভূত হওয়ার সময় আরও দীর্ঘায়িত হবে। এটা একধরনের Catch-22 পরিস্থিতি:

  • দ্রুত অবমূল্যায়ন: মুদ্রাস্ফীতি বাড়াবে, যা ব্লু রেটকেও আরও নিচে নামাতে পারে, ফলে দুই হার একীভূত হওয়া কঠিন হবে।
  • ধীরে অবমূল্যায়ন: মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও, প্রয়োজনীয় একীভূতকরণ (Unification) পেতে দেরি হবে।

আসন্ন নির্বাচনী (Midterms) হিসাব ও মিলে’র কৌশল

২০২৫ সালের অক্টোবরে আর্জেন্টিনায় মধ্যবর্তী নির্বাচন (Midterm Elections) অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে নিম্নকক্ষের (Lower House) অর্ধেক আসন ও সিনেটের (Senate) এক-তৃতীয়াংশ আসন নবায়ন হবে। বর্তমানে মিলে’র দল কংগ্রেসে খুবই সীমিত প্রতিনিধিত্ব রাখে। এখন পর্যন্ত তিনি প্রশাসনিক দক্ষতায় অনেক দূর এগোলেও, নির্বাচনে ভালো ফল করতে পারলে তার হাতে আরও শক্তিশালী আইনগত ক্ষমতা আসবে।

সেই রাজনৈতিক লক্ষ্যের কারণেই, বলা হচ্ছে, মিলে সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন যে, ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি প্রতি মাসের ক্রলিং পেগ ২% থেকে কমিয়ে ১%-এ নামিয়ে আনবেন। অর্থাৎ, এখন আর পেসোর সরকারি অবমূল্যায়ন অত দ্রুত হবে না। এতে স্বল্প মেয়াদে মুদ্রাস্ফীতির চাপ কিছুটা কম রাখা যাবে, ভোটারদের মাঝে স্বস্তি এনে দেওয়া যাবে—যা হয়তো আসন্ন মধ্যবর্তী নির্বাচনে তার দলকে সুবিধা দেবে।

রিজার্ভ (Foreign Exchange Reserves) সংকট ও এর গুরুত্ব

অর্থনীতির আরেকটি বড় ঝুঁকি হলো—অফিশিয়াল রেট এখনো বাস্তব বাজারমূল্যের তুলনায় অনেক বেশি, মানে পেসোর সরকারি বিনিময় হার অতিরিক্ত শক্তিশালী। এটি ধরে রাখতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জোর করে বাজারে ডলার সরবরাহ করতে হবে বা কোনোভাবে মুদ্রাকে সমর্থন করতে হবে, যাতে অফিশিয়াল রেটে পেসোর দাম না ভেঙে পড়ে। (কারণ এর ফলে সরকারী ডলার সস্তা হওয়ায় মানুষ সরকারের থেকেই বেশি ডলার কিনবে, অর্থাৎ সরকারী ডলারের ডিমান্ড বাড়বে, আর তাই সরকারকে ডলারের সাপ্লাইও বাড়াতে হবে)। কিন্তু এই কাজে পর্যাপ্ত পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকা চাই। আর্জেন্টিনার রিজার্ভ ২০১৯ সালে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার থাকলেও, গত ডিসেম্বরে তা ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল। সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, রিজার্ভ বেড়ে বর্তমানে ২৫ বিলিয়ন ডলারের মতো। তবে এটিও খুব শক্ত অবস্থান নয়।

২০২৬ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে আর্জেন্টিনার ঋণের সুদ (Debt Servicing) পরিশোধের চাপ আরও বেড়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর মানে, যদি কোনো বহিঃশক্তি বা বাইরের ঝাঁকুনি (External Shock) আসে—যেমন বিশ্ববাজারে হঠাৎ ডলারের চাহিদা বেড়ে গেলে, বা কোনো বৈশ্বিক মন্দা দেখা দিলে—আর্জেন্টিনার পক্ষে পেসোর অফিশিয়াল রেট বজায় রাখা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।

ডলারের সম্ভাব্য দাম বাড়লে কী হবে?: এখানে আমেরিকার (United States) সাম্প্রতিক ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। শোনা যাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) হয়তো “সার্বজনীন বিশাল শুল্ক” (Massive Universal Tariffs) আরোপ করতে পারেন, যা বিশ্ববাজারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। কারণ শুল্ক আরোপের ফলে বাজার ধরে নেয় যে, মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক (Federal Reserve) ভবিষ্যতে সুদের হার (Interest Rate) বাড়াবে এবং ডলারের মূল্য আরও চড়া হবে। একটু ব্যাখ্যা করা যাক। শুল্ক বৃদ্ধিতে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষকে বেশি খরচ করতে হয়, ফলে বাজারে বেশি অর্থ পণ্যের তুলনায়, ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে। আর তখন মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। আর ডলারে সুদের হার বাড়া মানে বিদেশীদের ডলারে বিনিয়োগ করায় বা ইউএস-এর বন্ড কেনায় বেশি লাভ পাওয়া, অর্থাৎ ডলারের ডিমান্ড বেড়ে যাচ্ছে, অর্থাৎ ডলারের দাম বাড়ছে বা শক্তিশালী হচ্ছে। এখন ডলার যদি শক্তিশালী হয়, তখন পেসোকে ধরে রাখতে আরো বেশি ডলার খরচ করতে হবে আর্জেন্টিনাকে। এমন পরিস্থিতি যদি সামনে এসে দাঁড়ায়, তাহলে আর্জেন্টিনাকে হয়তো বাধ্য হয়ে দ্রুত এবং বিশৃঙ্খলভাবে পেসো অবমূল্যায়ন করতে হবে, যা অর্থনীতিতে এক নতুন ধাক্কা সৃষ্টি করবে।

আইএমএফ (IMF) এর ভূমিকা: অন্যতম ভরসা

এখানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের (International Monetary Fund) ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আইএমএফের সঙ্গে আর্জেন্টিনার নতুন কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা চলছে। মিলে যেসব সংস্কার (Reforms) করছেন, আইএমএফ মূলত সেগুলোতে বেশ সন্তুষ্ট বলে জানা গেছে। মাঝে মাঝে তারা পেসোর একীভূতকরণ (Unification) দ্রুত করার কথা বললেও, সামগ্রিকভাবে মিলে’র পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে।

যদি মিলে আইএমএফকে রাজি করাতে পারেন, এবং আরও কয়েক বিলিয়ন ডলার ঋণ বা সহায়তা পেতে পারেন, তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা নিশ্চয়তা পাবে। এতে অদূর ভবিষ্যতে যদি কোনো বহিঃশক্তি থেকে আঘাত আসে, পেসোকে রক্ষা করার সামর্থ্য বাড়বে। একইসঙ্গে, এই রিজার্ভ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও কিছুটা সময় দেবে পেসোর বিনিময় হারকে ধীরে ধীরে একীভূত করার প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে।

সামগ্রিক মূল্যায়ন: পেসো আগাতে পারছে না কেন?

১. মুদ্রাস্ফীতি এখনো নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি আসেনি: বার্ষিক হার ১০০%-এর বেশি, মাসিক হারও ২%-এর কাছাকাছি বা তার বেশি ঘোরাফেরা করছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসলে পেসোর মূল্য স্থিতিশীল হবে না।

২. ডাবল এক্সচেঞ্জ রেটের ফাঁদ: অফিশিয়াল রেট ও ব্লু রেটের বিস্তর ব্যবধান ঘোচাতে গিয়ে মিলে একদিকে ধীরে ধীরে অবমূল্যায়ন করতে চাইছেন, অন্যদিকে যদি খুব দ্রুত করেন তবে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে—এই অচলাবস্থা রয়ে গেছে।

৩. রাজনৈতিক বাস্তবতা: অক্টোবরের মধ্যবর্তী নির্বাচনে জয় পেতে হলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সহনীয় রাখতে হবে। ফলে খুব দ্রুত পেসোর অবমূল্যায়ন ঝুঁকিপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হতে পারে।

৪. রিজার্ভের অভাব: বাইরের বড় কোনো ধাক্কা এলে (যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কনীতি বা সুদের হার বৃদ্ধি), পেসোকে রক্ষা করতে আর্জেন্টিনার হাতে যথেষ্ট ডলার রিজার্ভ নেই।

আগামী দিনের সম্ভাবনা: ডলারিকরণ কি আদৌ হবে?

মিলে বলেছিলেন, একসময় পেসোকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে আর্জেন্টিনাকে ডলারে (Dollar) চালাবেন—এটি ডলারাইজেশন নামেই পরিচিত। কিন্তু বাস্তবে এটি করতে গেলে স্থিতিশীল ও একীভূত এক্সচেঞ্জ রেট প্রয়োজন, যাতে সহজে পেসো থেকে ডলারে রূপান্তর ঘটানো যায়।

বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায়, ডলারিকরণ এখনো বহুদূরের ব্যাপার বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। যে গতিতে তিনি এগোতে চাচ্ছিলেন, সেটি মুদ্রাস্ফীতির চাপে আটকে গেছে। উপরন্তু রাজনৈতিক সমীকরণ, আন্তর্জাতিক পরিবেশ, এবং রিজার্ভের স্বল্পতা—সব মিলে এটা পরিষ্কার যে, এর আগে আর্জেন্টিনাকে একীভূত ও সুস্থ মুদ্রাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

ফলে আগামী দিনগুলোতে যদি…

  • মুদ্রাস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে,
  • রিজার্ভ কিছুটা শক্তিশালী হয়,
  • অফিশিয়াল রেট ও ব্লু রেটের ব্যবধান ধীরে ধীরে ঘুচে যায়,
    …তবেই আমরা হয়তো মিলে-র ঘোষিত ডলারিকরণের পদক্ষেপগুলোকে বাস্তবের কাছাকাছি দেখতে পারব।

উপসংহার

আর্জেন্টিনার অর্থনীতি একসময় দেউলিয়াত্বের (Default) দোরগোড়ায় ছিল, সেখান থেকে ধীরে ধীরে উঠে আসার চেষ্টায় বর্তমান প্রেসিডেন্ট বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন। সরকারি ব্যয় হ্রাস, টাকাপ্রিন্টিং বন্ধের চেষ্টা, আমদানি নিয়ন্ত্রণ শিথিলকরণ—এসব পদক্ষেপ সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে আস্থা (Confidence) কিছুটা ফিরিয়েছে, মন্দা থেকে মুক্ত হওয়ার পথ খুলেছে।

কিন্তু পেসো (Peso) আর্জেন্টিনার অর্থনৈতিক মূল ভিত্তি। সেটির বিনিময় হারকে কৃত্রিমভাবে দুই স্তরে ভাগ করে রাখার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবগুলো এক দিনে মেটানো সম্ভব নয়। উপরন্তু, ডলারের (Dollar) মূল্য যদি হঠাৎ বেড়ে যায়—বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের বহির্বাণিজ্যনীতি বা মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের (Federal Reserve) সুদের হার বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে—তাহলে আর্জেন্টিনার পক্ষে পেসোর সরকার-নির্ধারিত হার ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।

অন্যদিকে, আসন্ন মধ্যবর্তী নির্বাচনে (Midterms) জনগণ মুদ্রাস্ফীতি, পণ্যের দাম ও আর্থিক জটিলতার ফলাফল কীভাবে দেখে, সেটিও মিলে’র রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যদি তিনি নির্বাচনে ভালো করতে চান, তাহলে হয়তো তাকে আপাতত মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দিকেই বেশি মনোযোগ দিতে হবে, যা ক্রলিং পেগকে (Crawling Peg) শ্লথ করে রাখার পক্ষে কাজ করবে। কিন্তু এতে আবার সরকার-ঘোষিত ও বাজারদরের পার্থক্য আরো দীর্ঘায়িত হতে পারে।

সবমিলিয়ে, আর্জেন্টিনার অর্থনীতি বর্তমানে এক জটিল সংযোগ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে। একদিকে প্রতিশ্রুত ডলারিকরণ বা অন্তত পেসোকে পোক্তভাবে একীভূত করার লক্ষ্যমাত্রা, অন্যদিকে ভঙ্গুর রিজার্ভ, চলমান মুদ্রাস্ফীতি ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। আইএমএফ (IMF) কতটা সহযোগিতা করবে, বিদেশি বিনিয়োগ আসবে কি না, বৈশ্বিক বাণিজ্যে নতুন কোনো অস্থিরতা দেখা দেবে কি না—এসব বিষয় নির্ধারণ করবে, মিলে সত্যি কি পেসোকে “উদ্ধার” করতে পারবেন, নাকি এই মুদ্রাজটিলতার মধ্যেই আর্জেন্টিনার অর্থনীতি আবারও কোনো এক সংকটের ফাঁদে আটকে পড়বে।

তথ্যসূত্র

1 – https://www.ft.com/content/c92c1c71-99e7-49c1-b885-253033e26ea5

2 – https://tradingeconomics.com/argentina/foreign-exchange-reserves

3 – https://www.ft.com/content/401a85e5-e144-496d-b329-ab9d2eabaecd

4 – Graph comparing blue vs official rate https://bluelytics.com.ar/#!/evolution

5 – PIIE piece on Milei’s 2025 https://www.piie.com/blogs/realtime-economics/2025/milei-2025-between-argentinas-mid-term-elections-and-imf

6 – FT article on changes to crawling peg system https://www.ft.com/content/3a92d395-f4d7-4efc-bc00-1e21e3525069

7 – Argentina’s FX reserves over time https://tradingeconomics.com/argentina/foreign-exchange-reserves

8 – PIEE article on Argentina’s debt servicing costs https://www.piie.com/blogs/realtime-economics/2025/milei-2025-between-argentinas-mid-term-elections-and-imf

9 – Bloomberg article on new IMF/Argentina deal https://www.bloomberg.com/news/articles/2024-12-19/imf-in-talks-with-argentina-on-loan-to-succeed-44-billion-deal

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.