ট্রাম্প কি স্থায়ীভাবে আমেরিকাকে একঘরে করে ফেলছেন?

ভূমিকা

পৃথিবীর অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র (United States) বহু দশক ধরে বৈশ্বিক রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়েছে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর অনেকেই মনে করছেন, তিনি আগের চেয়ে আরও উগ্রপন্থায় ঝুঁকছেন এবং এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বহুদিনের মিত্ররা হয়ত ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে পারে। ট্রাম্প কখনোই নিজেকে একজন “মাল্টিল্যাটারালিস্ট” (multilateralist) হিসেবে দাবি করেননি; বরং তিনি বরাবরই “আমেরিকা ফার্স্ট” (America First) নীতিতে বিশ্বাসী। তার কথাবার্তায় দীর্ঘদিন ধরেই বোঝা গেছে যে, তিনি মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিত্র-রাষ্ট্রই ফ্রিরাইডিং বা নিছক সুবিধাভোগী। এ ছাড়া কূটনৈতিক সৌজন্যপূর্ণ ভব্যতা (Diplomatic Pleasantries) রক্ষার বিষয়টিও তার কাছে সেভাবে গুরুত্ব পায় না।

কিন্তু তবু, সব কিছু ছাপিয়ে যে প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে ফিরছে, তা হলো—ট্রাম্পের সর্বশেষ কিছু পদক্ষেপ কি যুক্তরাষ্ট্রকে স্থায়ীভাবে একঘরে করে ফেলবে? নাকি এটি নিছকই তার কথার শৌর্য প্রদর্শন, আর বাস্তবে হয়তো অন্য রূপরেখা দেখা যাবে? এই প্রতিবেদনে আমরা ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বিদেশনীতি বা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-সংক্রান্ত কড়া অবস্থানগুলোর (Geopolitical Spats) দিকে নজর দেব, সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে তা বিশ্লেষণ করব এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রজোট বা জোটবদ্ধ কূটনীতি কি টিকে থাকতে পারবে সে বিষয়েও আলোকপাত করব।

এক ঝলকে: ট্রাম্পের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক দ্বন্দ্বগুলো

ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই বেশ কিছু আন্তর্জাতিক বিরোধের সূত্রপাত করেছেন। এসব বিরোধের বেশ কয়েকটি বেশ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যার মধ্যে অঞ্চল দখল বা অন্যান্য দেশের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধ (Trade War) শুরু করার হুমকি পর্যন্ত রয়েছে। এই অংশে আমরা সংক্ষেপে তার সাম্প্রতিক দ্বন্দ্বগুলো তুলে ধরছি।

  1. ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ড (Denmark and Greenland): ট্রাম্প বারবার বলে আসছেন যে, তিনি বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপ গ্রিনল্যান্ড কিনতে বা দখল করতে চান। ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ড উভয়ই বিষয়টি একেবারেই ভালোভাবে নেয়নি। গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের স্বশাসিত অঞ্চল; সুতরাং ডেনিশ সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, তাদের ভূখণ্ড বিক্রির প্রশ্নই ওঠে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) অন্যান্য নেতারাও এটিকে সীমান্তের অখণ্ডতা লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস (Olaf Scholz) সীমানা “অবিনাশী ও অপরিবর্তনীয়” বলে উল্লেখ করেছেন, আর ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত বলেছেন, ফ্রান্স গ্রিনল্যান্ডে সৈন্য মোতায়েনের বিষয়টি বিবেচনা করছে।
  2. কানাডা (Canada): ট্রাম্পের আরেকটি উচ্চকণ্ঠ ইচ্ছা হলো, কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের অংশে পরিণত করা—অন্ততপক্ষে শুল্ক আরোপের চাপের মাধ্যমে দেশটিকে শায়েস্তা করা। এটা এতটাই নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে যে, কানাডার সম্ভাব্য পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে পলিয়েভ্র (Pierre Polievre)—যাকে আগে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ হিসেবে দেখা হতো—তিনি এখন বলেছেন, “কানাডা কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম অঙ্গরাজ্য হবে না,” এবং ট্রাম্প যদি শুল্ক আরোপ করেন তবে পলিয়েভ্র তার বিরুদ্ধে পাল্টা-প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেবেন।
  3. পানামা (Panama): পানামা খাল (Panama Canal) ফের দখল বা অধিগ্রহণ করার বিষয়েও ট্রাম্প আগ্রহী বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এতে পানামার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক হুমকির মুখে পড়েছে।
  4. মেক্সিকো (Mexico): ট্রাম্প শুধু যে শুল্ক আরোপের হুমকি দিচ্ছেন, তা-ই নয়, বরং তিনি একটি নির্বাহী আদেশে (Executive Order) মেক্সিকোর মাদক কার্টেলগুলিকে সন্ত্রাসী সংগঠন (Terrorist Organizations) হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ইতিমধ্যে পেন্টাগন (Pentagon) যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে ১,৫০০ সক্রিয় দায়িত্বপ্রাপ্ত (Active Duty) সৈন্য মোতায়েন করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র (Donald Trump Jr.) পর্যন্ত সামাজিক প্ল্যাটফর্ম এক্স (X) এ লিখেছেন, প্রেসিডেন্ট যদি “লেটার্স অব মার্ক অ্যান্ড রিপ্রাইজাল” (Letters of Marque and Reprisal) ইস্যু করেন, তবে বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে অর্থের বিনিময়ে কার্টেলের বিরুদ্ধে লড়তে পাঠানো যেতে পারে।

অভিবাসন ও দক্ষিণ-মধ্য আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক

মেক্সিকোর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতি (Hardline Immigration Policy)। তিনি লক্ষ লক্ষ অনিয়মিত অভিবাসীকে (Undocumented Migrants) তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে চান। এরই মধ্যে হন্ডুরাস (Honduras) হুঁশিয়ারি দিয়েছে, যদি ট্রাম্প তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন, তবে তারা দেশে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করে দেবে।

কয়েক দিন আগে কলম্বিয়ার (Colombia) প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো (Gustavo Petro)-র সঙ্গেও ট্রাম্পের এ নিয়ে একটি দ্বন্দ্ব হয়। কলম্বিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করবে বলে ইঙ্গিত দিচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প পাল্টা শুল্ক আরোপের হুমকি দিলে কলম্বিয়া পিছু হটে।

দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার বহু দেশের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন টানাপড়েনের মধ্যে রয়েছে। এসব দেশে অবস্থানরত বহু মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হিসেবে যান, এবং ট্রাম্প এই অভিবাসীদের বড় একটা অংশকে অবৈধ বলে পুনরায় নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন। ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি ও কূটনৈতিক সম্পর্ক—সবকিছু নিয়েই এখন বিরাট অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের (Allies) সাথে নতুন টানাপড়েন

এখানেই শেষ নয়। ট্রাম্পের শুল্ক (Tariff) আরোপের হুমকির ফলে ঐতিহাসিক মিত্ররাও নাখোশ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU)-এর ক্ষেত্রে ট্রাম্পের দাবি যে, ন্যাটোর (NATO) সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে সামরিক খাতে জিডিপির (GDP) ৫% ব্যয় করতে হবে, অনেক ইউরোপীয় নেতাই এটি মানতে নারাজ। উপরন্তু ইলন মাস্কের (Elon Musk) কিছু বিতর্কিত মন্তব্য এবং মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে তার “অপ্রাতিষ্ঠানিক” ভূমিকার কারণে জটিলতা আরও বেড়েছে।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাইওয়ান (Taiwan) প্রসঙ্গ। সম্প্রতি ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আসা সব ধরনের সেমিকন্ডাক্টর (Semiconductor) পণ্যের ওপর ২৫%, ৫০%, এমনকি ১০০% পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করতে পারেন। পাশাপাশি, বাইডেন আমলে প্রণীত চিপস অ্যাক্ট (CHIPS Act) অনুযায়ী নতুন সেমিকন্ডাক্টর কারখানাগুলোকে যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, সেটিও তিনি বাতিল করতে চান। এ পদক্ষেপ সরাসরি তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (Taiwan Semiconductor Manufacturing Company – TSMC)-কে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, কারণ TSMC বিশ্বের বেশিরভাগ চিপ তাইওয়ানে প্রস্তুত করে এবং যুক্তরাষ্ট্রে নতুন কারখানা স্থাপনে চিপস অ্যাক্টের সহায়তা পাচ্ছিল।

ট্রাম্পের কূটনৈতিক “সাফল্য”? গাজায় (Gaza) যুদ্ধবিরতি ও ইউক্রেনে (Ukraine) অবস্থান

এত কিছুর মধ্যেও ট্রাম্প কিছু ক্ষেত্রে স্বস্তি পেয়েছেন। যেমন গাজায় (Gaza) একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি (Ceasefire) আনতে সক্ষম হয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এতে সৌদি আরব (Saudi Arabia) ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (UAE) মতো মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ স্বস্তি পেতে পারে।

এ ছাড়া ট্রাম্প ইউক্রেন ইস্যুতে বিস্ময়করভাবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকেই (Vladimir Putin) দোষারোপ করেছেন—শান্তি আলোচনাকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য। তিনি রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর আরও চাপ বাড়ানোর কথাও বলেছেন। এখন পর্যন্ত, অন্তত কথার ধারায়, ট্রাম্প ইউক্রেনকে সমর্থন দিচ্ছেন।

পাশাপাশি, কিছু জরিপ দেখাচ্ছে যে, তথাকথিত “গ্লোবাল সাউথ” (Global South)—ভারত, সৌদি আরব, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া এমনকি ইউক্রেনের মতো দেশে—ট্রাম্প তুলনামূলকভাবে জনপ্রিয়। ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেইন রিলেশনস (ECFR)-এর এক জরিপ অনুযায়ী, এসব দেশের বেশিরভাগ মানুষের ধারণা, ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন তাদের দেশের জন্য মন্দ হবে না; বরং “সৎ” এবং “শান্তি-কেন্দ্রিক” (Peace Focused) বিদেশনীতি হতে পারে বলেই তাদের ধারণা। অনেকের মতে, যুক্তরাষ্ট্র “বৈশ্বিক তর্জন-গর্জনকারী” (Geopolitical Bully), আর ট্রাম্প অন্তত সরাসরি স্বীকার করে নেন যে, আমেরিকা ঠিক কী করতে চায়।

সমর্থন ধরে রাখা কঠিন: গাজা, ইউক্রেন, ও সৌদি আরব-সংক্রান্ত জটিলতা

তবে ট্রাম্পের এ জনপ্রিয়তা বেশ বড় একটি “কিন্তু”র মুখে পড়েছে। কারণ, গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে এগোলেও তিনি এখন সেখানকার ফিলিস্তিনিদের (Palestinians) মিশর (Egypt) বা জর্ডানে (Jordan) স্থানান্তর করার কথা বলছেন, যা ওই অঞ্চলের দেশগুলো মোটেও পছন্দ করছে না। এছাড়া রাশিয়ার ওপর দোষ চাপানোর পরপরই তিনি আবার ইউক্রেনের সমস্ত বৈদেশিক সাহায্য (Foreign Aid) ‘অস্থায়ীভাবে স্থগিত’ করার ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে তার “শান্তিপ্রিয়” ভাবমূর্তি ধূলিসাৎ হওয়ার উপক্রম।

একইভাবে, কানাডা বা গ্রিনল্যান্ড দখল করার কথাবার্তা এবং পানামা খাল ফের অধিগ্রহণের উচ্চাশা অনেককেই ভাবাচ্ছে যে, ট্রাম্প “নব্য সাম্রাজ্যবাদী” (Neo-Imperialist) দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছেন। এতে করে গ্লোবাল সাউথের অনেক দেশের ট্রাম্পের প্রতি থাকা আগ্রহও হয়তো স্থায়ী হবে না। সৌদি আরবের ক্ষেত্রে, তিনি একদিকে গাজার মানুষকে উচ্ছেদ করতে চাচ্ছেন, অন্যদিকে তেলের দাম কমানোর জন্য চাপ দিচ্ছেন, আবার সেদেশের কাছে ১ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছেন—এগুলোর কারণে দেশটির নীতিনির্ধারকেরা যে খুশি হবেন এমনটা মনে করার কারণ খুব বেশি নেই।

ট্রাম্প কি শুধু “হুঙ্কার” দিচ্ছেন, নাকি বাস্তবেই পদক্ষেপ নেবেন?

অনেক বিশ্লেষক বলছেন, ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তিনি যতটা উচ্চকণ্ঠ ছিলেন, বাস্তবে অনেক বিষয়ে ততটা এগিয়ে যাননি। হয়তো এবারও (দ্বিতীয় মেয়াদে) দেখা যাবে, বড় বড় কথা বললেও শেষ পর্যন্ত ততটা এগোবেন না। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক জোট (Network of Alliances) অটুট থাকবে। কিন্তু এর বিরুদ্ধ যুক্তি হলো, দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প আর আগের মতো “ব্যবস্থাপনাগত বাধা”র মুখে পড়ছেন না।

  1. বিচারালয় ও কংগ্রেসে (Courts and Congress) নিয়ন্ত্রণ: প্রথম মেয়াদে “দ্য সোয়াম্প” (The Swamp) বা ওয়াশিংটনের প্রাতিষ্ঠানিক বাধাগুলো ট্রাম্পের বহু পদক্ষেপে লাগাম টেনে ধরেছিল। এখন, দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি আরও অভিজ্ঞ; পাশাপাশি আদালতে (ফেডারেল কোর্ট) বহু নিয়োগ ট্রাম্প ঘরানার বিচারপতিদের, আর কংগ্রেসেও (Congress) রিপাবলিকানদের একক আধিপত্য রয়েছে। ফলে সে বাধাগুলো তুলনামূলকভাবে দুর্বল হয়ে গেছে।
  2. এবারের বিজয় ও মিত্রদের দৃষ্টিভঙ্গি: ২০১৬ সালে ট্রাম্প অপ্রত্যাশিতভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয় পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি জনপ্রিয় ভোটে হেরেছিলেন। এরপর ২০২০ সালে তিনি নির্বাচিত হননি। ফলে ইউরোপসহ বহু মিত্র-রাষ্ট্র মনে করেছিল, “ট্রাম্প সাময়িক ব্যতিক্রম”—অপেক্ষা করলে তিনি বিদায় নেবেন, এবং যুক্তরাষ্ট্র পুরনো ধারায় ফিরে যাবে। কিন্তু এবারের বিজয় ব্যাপক ব্যবধানে হয়েছে, যা সবাইকে দেখাচ্ছে, হয়তো এই “আমেরিকা ফার্স্ট” ভাবধারা রিপাবলিকানদের (Republicans) মধ্যে স্থায়ী হয়ে গেছে। সুতরাং, মার্কিন নীতিতে যদি এমন পরিবর্তন স্থায়ী হয়, তবে মিত্ররাও (যেমন ইউরোপ) বিকল্প জোট বা পথ খোঁজার চেষ্টা করবে।

আমেরিকা কি মিত্রদের ছাড়াই শক্তিশালী হবে?

ট্রাম্পের দৃষ্টিতে, ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কটা মোটেও লাভজনক নয়। ন্যাটোর মাধ্যমে ইউরোপের নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যয় করতে হয়, আবার ইউরোপে মার্কিন পণ্য রপ্তানির চেয়ে আমেরিকা বেশি পণ্য আমদানি করে বলে বাণিজ্যঘাটতিও (Trade Deficit) রয়েছে। তিনি হয়তো মনে করতে পারেন, মিত্রদেশগুলোকে আর ‘সাবসিডি’ করার দরকার নেই।

তবে বাস্তবে, দীর্ঘদিনের সামরিক ও অর্থনৈতিক মিত্রতাকে একপাক্ষিকভাবে ছিন্ন করার চেষ্টা করলে বৈশ্বিক ভারসাম্যে (Global Order) বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূরে সরে গেলে ইউরোপ ও এশিয়ার অনেক দেশ হয়তো অন্য শক্তির দিকে ঝুঁকবে—যেমন চীন (China) অথবা নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় মনোযোগ দেবে।

যদি সত্যি আমেরিকা মিত্রদের ছাড়া এককভাবে এগোতে চায়, তা বিশ্ব রাজনীতিতে এক বৈপ্লবিক মোড় আনতে পারে। এটা হতে পারে মার্কিন স্বার্থকেই ক্ষতিগ্রস্ত করার মতো একটা চ্যালেঞ্জ। কারণ ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে, বৈশ্বিক মিত্রজোট (Alliance) ও কৌশলগত অংশীদারিত্ব থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একচ্ছত্র প্রভাব নিশ্চিত হয়।

শেষ কথা

সব মিলিয়ে, মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে একের পর এক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছেন। ডেনমার্ক-গ্রিনল্যান্ডকে ঘিরে ভূখণ্ড দখলের উচ্চকণ্ঠী দাবি, কানাডা ও মেক্সিকোকে শুল্কের মাধ্যমে চাপে রাখা, পানামা খাল ফের “দখলে নেওয়ার” বাসনা, কঠোর অভিবাসন নীতি ও দক্ষিণ-মধ্য আমেরিকাজুড়ে সামরিক ঘাঁটি বা কূটনৈতিক চাপে ফেলা—সব কিছুই দেখা যাচ্ছে বেশ গুরুতর হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এর পাশাপাশি, তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পকে নাকাল করার হুমকি এবং ইউরোপীয় মিত্রদের ওপর উচ্চমাত্রায় সামরিক ব্যয় চাওয়া—এগুলোও অ্যালায়েন্স-ভিত্তিক ব্যবস্থার ওপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি করছে। যদিও গাজায় সাময়িক যুদ্ধবিরতি আনা বা ইউক্রেনকে দোষমুক্ত রাখার মতো কিছু “কূটনৈতিক অর্জন” থাকলেও, দ্রুতই সেগুলোও ট্রাম্পের বিরূপ মন্তব্য ও নীতি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, ট্রাম্প কি সত্যি সত্যি তার কথাগুলো বাস্তবায়ন করবেন, নাকি এগুলো নিছক আলোড়ন তোলার কৌশল? তার প্রথম মেয়াদের তুলনায় এবার তিনি প্রশাসনিক কাঠামোর ওপর অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন। আর মিত্র রাষ্ট্রগুলোও আর আগের মতো মনে করছে না যে, ট্রাম্প সাময়িক ব্যতিক্রম। বরং তারা ভাবছে, এটাই হয়তো রিপাবলিকানদের নতুন মূলধারা। ফলে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক প্রভাব, সামরিক জোট, অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব—সবকিছুই হয়তো আমূল পরিবর্তনের মুখে পড়তে পারে।

ট্রাম্প নিজে হয়তো বলবেন, মিত্রদের সাথে জটিল বোঝাপড়ায় যাওয়ার দরকার নেই, আমেরিকাকে আরও স্বাধীনভাবেই শক্তিশালী হতে হবে। কিন্তু ইতিহাস বলে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জগতে কোনো দেশই একা সবকিছু জয় করতে পারে না। আজকের বহুমুখী বিশ্বে (Multipolar World) কোণঠাসা হয়ে পড়লে যুক্তরাষ্ট্র তার বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের (যেমন চীন বা রাশিয়া) আরও স্পেস ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। এতে বিশ্ব পরাশক্তির ভারসাম্য স্থায়ীভাবে বদলে যাওয়ার ঝুঁকিও থেকে যায়।

তাই সবমিলিয়ে, ট্রাম্প কি তার “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতি প্রয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্রকে সত্যিকার অর্থে শক্তিশালী করবেন, না কি এ পথেই তিনি আমেরিকাকে স্থায়ীভাবে একঘরে (Isolated) করে ফেলবেন—এ প্রশ্নের উত্তর দেবে সময়ই। যাই হোক, ২০২৫ সালে এসে দেখা যাচ্ছে, বৈশ্বিক রাজনীতির মেরুকরণ এখন অনেকটাই ট্রাম্প-কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে, আর বিশ্বের বহু নেতা ও দেশ নিজেদের নতুন পথ খুঁজতে শুরু করেছে। ভবিষ্যতে আমেরিকা ও তার ঐতিহাসিক মিত্ররা কি সম্পর্কোন্নয়নের পথ খুঁজে পাবে, নাকি বিভক্তির ধারা আরও তীব্র হবে—তা বোঝা যাবে সামনের মাসগুলো ও বছরগুলোতে।

তথ্যসূত্র

1 – https://www.politico.eu/article/france-fm-jean-noel-barrot-floats-sending-troops-to-greenland-denmark/

2 – https://www.theguardian.com/us-news/2025/jan/27/mexico-cartels-us-military

3 – https://x.com/BasedMikeLee/status/1883953109443174581

4 – https://x.com/DonaldJTrumpJr/status/1883986978087317960

5 – https://www.aljazeera.com/news/2025/1/5/why-is-honduras-threatening-to-expel-us-troops

6 – https://uk.pcmag.com/computers-electronics/156458/trump-to-tariff-chips-made-in-taiwan-targeting-tsmc

7 – https://ecfr.eu/publication/alone-in-a-trumpian-world-the-eu-and-global-public-opinion-after-the-us-elections/

8 – https://www.theguardian.com/us-news/2025/jan/28/trump-repeats-suggestion-palestinians-should-leave-gaza-for-egypt-and-jordan

9 – https://www.ft.com/content/e122fb95-ae23-4c82-80c8-c8904724131e

10 – https://www.reuters.com/business/energy/trump-calls-1-trillion-saudi-investment-lower-oil-prices-2025-01-23/

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.