কেন ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ড নিয়ে এত আগ্রহী?

ভূমিকা

ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) যখন প্রথমবার গ্রিনল্যান্ড কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তখন বেশিরভাগ রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সংবাদমাধ্যম এটিকে তার আরেকটি “ট্রাম্পীয় বাড়াবাড়ি” বা “ক্লাসিক ট্রাম্প ব্লাস্টার (classic Trump bluster)” বলে ডিসমিস করেছিলেন। অনেকের মতে, এটি ট্রাম্পের কথিত “উইভ (weave)”—অর্থাৎ তার স্বভাবসুলভ বিতর্কিত ও চমকপ্রদ মন্তব্যের আরেকটি নমুনা। কিন্তু সপ্তাহান্তে বেশ কিছু ঘটনা ইঙ্গিত দিল যে, যদি কারো মনে কোনো সন্দেহ থেকেও থাকে, ট্রাম্প বিশ্বের সবচেয়ে বড় দ্বীপ গ্রিনল্যান্ডকে আসলেই কিনতে আগ্রহী।

ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস (Financial Times) জানায়, সপ্তাহান্তে ট্রাম্প ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেট ফ্রেডরিকসেন (Mette Frederiksen) এর সঙ্গে ফোনে ৪৫ মিনিটের এক “খরস্রোতা” বা রাগান্বিত আলোচনা করেছেন। বিভিন্ন সূত্র এই আলাপচারিতাকে “ভয়াবহ (horrendous)” বলে বর্ণনা করে। একই সঙ্গে, শনিবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এয়ার ফোর্স ওয়ান (Air Force One)-এ সাংবাদিকদের জানান, “আমরা এটা (গ্রিনল্যান্ড) পাবোই (we’re going to have it)।”

এই নিবন্ধে আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করব—কেন ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ড কেনার ব্যাপারে এতটা উৎসাহী? এক কথায় বলতে গেলে, এর পেছনে চারটি প্রধান কারণ থাকতে পারে:

  • ১) আর্কটিক (Arctic) ভূরাজনীতি
  • ২) যুক্তরাজ্য (UK)-আইসল্যান্ড (Iceland) গ্যাপ (gap)
  • ৩) গ্রিনল্যান্ডের খনিজ সম্পদ (mineral deposits)
  • ৪) কানাডা (Canada) প্রসঙ্গ

অনেকেই বলছেন, এর মাঝে কানাডার প্রসঙ্গটিও বড় একটি কারণ হতে পারে। তবে এই সব যুক্তিগুলো আসলেই কতটা বাস্তবসম্মত? চলুন বিস্তারিত দেখে নিই।

কারণ ১: আর্কটিক ভূরাজনীতি

ট্রাম্প যখন তার প্রথম মেয়াদে গ্রিনল্যান্ড কেনার বিষয়ে কথা বলেছিলেন, তখন তিনি এটিকে একটি “বড় ধরনের রিয়েল এস্টেট (real estate) চুক্তি” হিসেবে উপস্থাপন করেন। মূলত অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকেই তিনি সেসময় জোর দিয়েছিলেন। তবে এবারের পরিস্থিতিতে, তিনি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন জাতীয় নিরাপত্তাকে (national security)।

আর্কটিকে উত্তেজনা: রাশিয়া (Russia) ও চীনের (China) ভূমিকা: আসলে, আর্কটিক সাগরে (Arctic Sea) বরফ গলে যাওয়ার কারণে শীতকালে বরফে ঢাকা যে পথগুলি ছিল, সেগুলো গ্রীষ্মে এখন আরো খোলা থাকছে। জলবায়ু পরিবর্তন (climate change) এর ফলে এই এলাকায় টেকটনিক পরিবর্তন ঘটছে। এর ফলে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে—

  • ১. খনিজ ও হাইড্রোকার্বনের (hydrocarbons) অ্যাক্সেস বাড়ছে: বরফ গলার কারণে আর্কটিকে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও অন্যান্য মূল্যবান খনিজের যে বিশাল মজুদ রয়েছে, সেগুলো উত্তোলন করা অপেক্ষাকৃত সহজ হতে পারে।
  • ২. নতুন বাণিজ্যপথ (trade routes) খোলার সম্ভাবনা: বরফ কমে যাওয়ায় আটলান্টিক (Atlantic) ও প্যাসিফিক (Pacific) মহাসাগরকে সংযোগকারী সমুদ্রপথের বিকল্প রুট গড়ে উঠছে। দুইটি গুরুত্বপূর্ণ রুট হচ্ছে—নর্থওয়েস্ট প্যাসেজ (Northwest Passage), যা কানাডা ও আলাস্কার (Alaska) উত্তরের বরফঢাকা সমুদ্রপথ বরাবর গিয়েছে; এবং নর্থ ইস্ট প্যাসেজ (North East Passage), যা রাশিয়া ও নরওয়ের (Norway) উত্তর উপকূল বরাবর যায়। ভবিষ্যতে আরও বরফ গলে গেলে ট্রান্সপোলার রুট (Transpolar Route) বলে একটি সরাসরি পথও চালু হতে পারে, যা এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে পণ্যপরিবহনের সময় অনেকাংশে কমিয়ে দেবে।

এই সম্ভাবনাগুলোকে ঘিরে ইতিমধ্যে রাশিয়া ও চীন উভয়েই আর্কটিকে সক্রিয় হয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে রাশিয়া তাদের পুরনো সোভিয়েত (Soviet) যুগের বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি (bases) পুনরায় চালু করেছে, কিছু নতুন ঘাঁটি তৈরি করেছে, এবং বরফভেদী জাহাজ (icebreaker) সহ নানা ধরনের আর্কটিক উপযোগী সরঞ্জামে বিনিয়োগ করেছে। অপরদিকে, ২০১৮ সালে চীন নিজেকে “নিয়ার আর্কটিক স্টেট (near Arctic state)” বলে ঘোষণা করে এবং প্রথম স্থানীয়ভাবে তৈরি ভারী আইসব্রেকার চালু করে। চীন “পোলার সিল্ক রোড (polar Silk Road)” নামে নতুন একটি বাণিজ্যপথের কথাও বলতে শুরু করেছে।

রাশিয়া ও চীন কিছু ক্ষেত্রে আর্কটিক ইস্যুতে সহযোগিতা করছে, যেমন যৌথ সামরিক মহড়া (joint military exercises)। তবে মনে রাখতে হবে, রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি এখানে বহুগুণ বেশি, এবং আর্কটিকের শাসনব্যবস্থা (governance) সংক্রান্ত বেশ কিছু বিষয়েও দু’পক্ষের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। রাশিয়া চায় এই অঞ্চলের বর্তমান “স্ট্যাটাস কো (status quo)” বজায় থাকুক, অন্যদিকে চীন চায় আরও প্রভাব বা কর্তৃত্ব।

মার্কিন উদ্বেগ: ওয়াশিংটনে (Washington) এই ঘটনাপ্রবাহ উদ্বেগ তৈরি করেছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের (US) আশঙ্কা—

  • রাশিয়া হয়তো নতুন আর্কটিক বাণিজ্যপথগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে
  • রাশিয়া ও চীন সেখানে নতুন প্রাপ্ত খনিজ সম্পদে ভাগ বসাবে
  • এমনকি সামরিকভাবেও এই অঞ্চল হয়ে উঠতে পারে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র

এই সম্ভাব্য হুমকিগুলো উপলব্ধি করেই ট্রাম্প প্রশাসন গ্রিনল্যান্ড নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে গ্রিনল্যান্ডে থুলে এয়ার বেস (Thule Air Base) নামক একটি সামরিক ঘাঁটি (base) পরিচালনা করে যা ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা (missile defense) নিয়ে আগাম সতর্কবার্তা প্রদান করে। তবে ভবিষ্যতে যদি সেখানে আরও ঘাঁটি বা স্থাপনা তৈরি করতে হয়, তাহলে ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ড উভয়ের অনুমতি লাগবে। সাম্প্রতিক সময়ে এই দুটি সরকারই ইঙ্গিত দিয়েছে যে, বড় পরিসরে মার্কিন উপস্থিতি বাড়লে তারা এতে আপত্তি করবে না। সুতরাং গ্রিনল্যান্ড কিনে নেওয়া বা সরাসরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের আর্কটিক উপস্থিতি বহুলাংশে বাড়াতে পারবে।

কারণ ২: যুক্তরাজ্য-আইসল্যান্ড গ্যাপ

দ্বিতীয় যে কারণটি নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন আগ্রহী, তা হলো গ্রিনল্যান্ড-আইসল্যান্ড-যুক্তরাজ্য গ্যাপ যা পরিচিত GIUK Gap নামেও। সামরিক কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে, এই গ্যাপ আটলান্টিক মহাসাগরে (Atlantic Ocean) প্রবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ। যুক্তরাষ্ট্র চায় এই পথের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে, যাতে কোনো বৈরী দেশের নৌবাহিনী—বিশেষ করে রাশিয়ার নর্দার্ন নেভি (Northern Navy)—নরওয়েজিয়ান সাগর (Norwegian Sea) পেরিয়ে সহজে আটলান্টিকে প্রবেশ করতে না পারে, অথবা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে সামরিক ও বাণিজ্যিক পরিবহন হুমকির মুখে না পড়ে।

ঠাণ্ডা যুদ্ধের (Cold War) সময় এই GIUK গ্যাপের গুরুত্ব ছিল অত্যন্ত বেশি। পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এটি কিছুটা কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় আবারও এই পথটির প্রতি মনোযোগ বাড়ছে। তাছাড়া, ব্রিটিশ নৌবাহিনী (British Navy) এখন আর আগের মতো সক্ষম নয় যে, কেবল তারাই পুরো গ্যাপ পাহারা দিতে পারবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র চিন্তা করছে, যদি গ্রিনল্যান্ডে তাদের উপস্থিতি আরও বাড়ানো যায়, তাহলে GIUK গ্যাপ তারা ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। তবে এখানেও প্রশ্ন রয়ে যায়—স্রেফ এজন্য গ্রিনল্যান্ড কিনতে হবে, নাকি সামরিক উপস্থিতি বাড়ালেই যথেষ্ট হবে?

কারণ ৩: গ্রিনল্যান্ডের খনিজ সম্পদ

ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (National Security Adviser) মাইক ওয়াল্টজ (Mike Waltz) ফক্স নিউজ (Fox News)-এ এক সাক্ষাৎকারে সরাসরি বলেছেন যে, গ্রিনল্যান্ডের খনিজ সম্পদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রিনল্যান্ডে তেল (oil) ও গ্যাসের (gas) পাশাপাশি বেশ কিছু মূল্যবান ধাতু, বিশেষ করে রেয়ার আর্থ মেটালস (rare earth metals), উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পাওয়া যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরফ গলে যাওয়ায় এগুলো উত্তোলনও তুলনামূলকভাবে সহজ হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।

রেয়ার আর্থ মেটালস (Rare Earth Metals) ও মার্কিন চাহিদা: রেয়ার আর্থ মেটালস বিভিন্ন উচ্চ-প্রযুক্তি পণ্য, যেমন স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ব্যাটারি, নবায়নযোগ্য শক্তি, সরঞ্জাম ইত্যাদির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে চীন এই রেয়ার আর্থ মার্কেটে প্রায় ৯০% রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করে। যুক্তরাষ্ট্র এই নির্ভরশীলতা কাটাতে আগ্রহী, কারণ ভূরাজনৈতিক কোনো বিরোধ দেখা দিলে চীন হয়তো এ সরবরাহকে চাপ তৈরির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। সুতরাং গ্রিনল্যান্ড যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ রেয়ার আর্থ সরবরাহ করতে পারে, তবে আমেরিকার হাতে একটি বিকল্প উৎস থাকবে।

বাস্তবতার প্রতিবন্ধকতা: তবে এখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা আছে—

  • ১. অ্যাক্সেস ও খনন খরচ: গ্রিনল্যান্ডের খনিজ সম্পদ বহুবার বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে। তেল ও অন্যান্য পণ্যের দাম যখন বাড়ে, তখন এই আগ্রহ আবারও মাথাচাড়া দেয়। কিন্তু প্রায় প্রত্যেকবারই দেখা গেছে, দুর্গম পরিবেশ ও উচ্চ খনন খরচের কারণে প্রকল্পগুলো লাভজনকভাবে চালানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
  • ২. রেয়ার আর্থ আসলে কতটা “রেয়ার”: রেয়ার আর্থ মেটালসের নামের মধ্যে “রেয়ার” থাকলেও এগুলো ভূ-পৃষ্ঠে তুলনামূলকভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সমস্যা হলো সেগুলো বের করে আনা ও প্রক্রিয়াজাত (processing) করা পরিবেশবান্ধব বা সুলভ পদ্ধতিতে করা কঠিন। যুক্তরাষ্ট্র একসময় এই খাতে শীর্ষস্থানীয় ছিল, কিন্তু পরিবেশদূষণের (pollution) ঝুঁকি এড়াতে তারা নিজেদের উৎপাদন হ্রাস করে। এর ফলে চীন এই বাজারের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
  • ৩. গ্রিনল্যান্ডবাসীর (Greenlanders) আপত্তি: গ্রিনল্যান্ডের নিজস্ব স্বায়ত্তশাসিত সরকার (devolved government) ২০১৬ সালে গ্রিনল্যান্ডের ইউরেনিয়াম অ্যাক্ট (Greenland’s Uranium Act) পাস করে। এই আইনের মাধ্যমে ইউরেনিয়ামের (uranium) খনি নির্ণয় ও উত্তোলন বেশ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, কারণ রেয়ার আর্থ উত্তোলনের সময় ইউরেনিয়ামও একসঙ্গে পাওয়া যেতে পারে। একই বছরে সরকার জানায়, তারা নতুন কোনো তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান লাইসেন্স দেবে না। অর্থাৎ ব্যাপক খনিজ প্রকল্প নিয়ে আগ্রাসী পরিকল্পনা থাকলে স্থানীয়দের সমর্থন পাওয়া কঠিন হবে।

সুতরাং, ট্রাম্প চাইলে গ্রিনল্যান্ডকে বড় একটি খনিজ উত্তোলনকেন্দ্রে (mining haven) পরিণত করতে পারেন—এই ধারণা বাস্তবে রূপ দিতে গেলে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হবে। স্থানীয় জনগণ, ডেনমার্ক সরকার এবং পরিবেশগত বিধিনিষেধ—সব মিলিয়ে এটি সহজ কোনো পরিকল্পনা নয়।

কারণ ৪: কানাডা প্রসঙ্গ

ট্রাম্প সম্প্রতি অন্যান্য দেশে “অধিভুক্তি (annexation)” সংক্রান্ত মন্তব্য সরাসরি হয়তো খুব একটা করছেন না, তবে কিছু দিন আগে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, আদর্শ অবস্থায় তিনি পুরো উত্তর আমেরিকাকে (North America) যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত দেখতে পছন্দ করতেন—যার মধ্যে কানাডাও পড়ে।

যদিও এই বক্তব্য সরাসরি বাস্তব পরিকল্পনা কিনা, তা স্পষ্ট নয়, তবু অনেকে ধারণা করছেন—গ্রিনল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের আওতায় এলে কানাডা পুরোপুরি একঘরে হয়ে যাবে। কারণ তখন কানাডার পশ্চিমে আলাস্কা (Alaska), দক্ষিণে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড, আর পূর্বে গ্রিনল্যান্ড—তিনদিকেই থেকে আমেরিকান ভূখণ্ড দ্বারা “বেষ্টিত” হবে।

এর ঐতিহাসিক একটি দৃষ্টান্তও রয়েছে—১৮৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবার গ্রিনল্যান্ড কেনার চেষ্টা করেছিল, যখন তারা রাশিয়া (Russian Empire) থেকে আলাস্কা (Alaska) কিনে নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি ছিল, আলাস্কা ও গ্রিনল্যান্ড একসঙ্গে কিনলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের (British Empire) অধীনে থাকা কানাডার উপর চাপ সৃষ্টি করা যাবে। সেই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র চাইছিল ব্রিটেন (Britain) হয়তো কানাডা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে বা কোনো কূটনৈতিক সমাধান খুঁজতে উদ্যোগী হবে।

সুতরাং অনেকে বলছেন, হয়তো ট্রাম্প ভাবছেন যে, কানাডাকে পরোক্ষ চাপের মধ্যে ফেলতে পারলে তারা বাণিজ্য (trade) ও অন্যান্য ইস্যুতে আরও নমনীয় অবস্থান নেবে। অথবা আরো দূরবর্তী কোনো স্বপ্ন পূরণে, যেমন “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কানাডার অধিভুক্তি”—যা বাস্তবে এখনো পর্যন্ত নিরেট কৌতুক হিসেবেই বিবেচিত।

ট্রাম্পের পরিকল্পনা: কতটা বাস্তবসম্মত?

উপরের চারটি কারণ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, ট্রাম্পের লক্ষ্য হতে পারে বহুমুখী—আর্কটিক অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি জোরদার করা, রাশিয়া ও চীনের আর্কটিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে প্রতিহত করা, খনিজ সম্পদ থেকে লাভবান হওয়া এবং একই সঙ্গে কানাডার উপর একটি কৌশলগত চাপ সৃষ্টি করা।

তবে এগুলো বাস্তবায়ন করা মোটেও সহজ নয়। ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ড কেউই স্পষ্ট করে গ্রিনল্যান্ড বিক্রি করতে ইচ্ছুক নয়। এছাড়া স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের ভূমিকে “পণ্য” হিসেবে হস্তান্তরের বিষয়ে প্রবল আপত্তি জানাতে পারেন—যা ইতোমধ্যেই প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। ডেনিশ সরকারও (Danish government) বারবার বলে আসছে যে, “গ্রিনল্যান্ড বিক্রির জন্য নয় (not for sale)।”

অন্যদিকে, সামরিক দিক থেকে দেখলে, গ্রিনল্যান্ডে অতিরিক্ত ঘাঁটি বা উপস্থিতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দরজা মোটামুটি খোলাই বলা যায়। তাই যেকোনো দিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহযোগিতা বাড়িয়ে সেখানে স্থাপনা তৈরি করতে পারে। সেক্ষেত্রে কেনা বা দখলদারির (annexation) চেয়ে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে চুক্তি করে সামরিক সহযোগিতা গড়ে তোলা অনেক সহজ ও বাস্তবসম্মত।

সারসংক্ষেপ ও ভবিষ্যৎদৃষ্টি

ট্রাম্প প্রশাসনের গ্রিনল্যান্ডে আগ্রহের পেছনে অন্তত চারটি বড় কারণ স্পষ্ট—আর্কটিক ভূরাজনীতি, GIUK গ্যাপ নিয়ন্ত্রণ, খনিজ সম্পদের সন্ধান, আর কানাডাকে ঘিরে একটি পরোক্ষ কৌশলগত পরিকল্পনা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও বরফ গলে যাওয়ার কারণে আর্কটিক অঞ্চল ক্রমেই বৈশ্বিক শক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। রাশিয়া ও চীনের ক্রমবর্ধমান তৎপরতা যুক্তরাষ্ট্রকে আরও বেশি সতর্ক করে তুলেছে।

তবে “গ্রিনল্যান্ডকে কেনা” বা স্রেফ যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম রাজ্য বানানোর স্বপ্ন নানাবিধ বাস্তব সমস্যায় জর্জরিত। স্থানীয় জনমত, ডেনমার্কের সার্বভৌমত্ব, পরিবেশগত বাধা, খনি থেকে প্রকৃতপক্ষে লাভজনক উৎপাদন নিশ্চিত করা—এসবই বড় চ্যালেঞ্জ। উপরন্তু, গ্রিনল্যান্ডের সরকার ও জনগণ অতীতে বিভিন্ন খনিজ প্রকল্পকে আইনগতভাবে আটকে রেখেছে। সুতরাং “গ্রিনল্যান্ড কেনা” নিয়ে ট্রাম্পের জেদী অবস্থান হয়তো রাজনৈতিক আলোচনায় হইচই তুলতে পারে, কিন্তু বাস্তবে এটি রূপ দেওয়া যে খুব কঠিন, তা পরিষ্কার।

অন্যদিকে, কানাডার প্রসঙ্গটি কিছুটা চমকপ্রদ শোনালেও, সেটি মূলত ঐতিহাসিক ব্যাকরণে পড়ে। ১৮৬৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র কানাডাকে “অধিভুক্ত” করার পরিকল্পনা বাস্তবে এগিয়ে নিতে পারেনি। বর্তমানে কানাডা নিজেই একটি স্বাধীন, শক্তিশালী রাষ্ট্র। তাই সেটিকে সহজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঢোকানো বা কৌশলগতভাবে কোণঠাসা করা এতটা সহজ নয়।

ফলত, আসলেই ট্রাম্প কি দীর্ঘমেয়াদি কোনো কৌশলিক পরিকল্পনা করছেন, নাকি এটা তার বিশেষ ধরনের “ট্রাম্পীয় শোরগোল”, সেটা নিয়ে বিশ্লেষকরা দ্বিধাবিভক্ত। তবে যা-ই হোক, গ্রিনল্যান্ড প্রসঙ্গটি আর্কটিক ভূরাজনীতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের নতুন করে সচেতনতা ও আগ্রহ সৃষ্টি করেছে, এবং ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা যে আরও বাড়বে, সেটি প্রায় নিশ্চয়ই বলা যায়।

আরও পড়ুন – 

তথ্যসূত্র

1 – https://www.ft.com/content/ace02a6f-3307-43f8-aac3-16b6646b60f6
2 – https://dgap.org/en/research/publications/disruption-arctic-exceptionalism
3 – https://en.wikipedia.org/wiki/Arctic_shipping_routes
4 – https://www.bloomberg.com/news/features/2023-03-13/nato-russia-are-flexing-their-military-power-in-the-arctic
5 – https://www.twz.com/25875/us-navy-plans-to-send-more-ships-into-the-arctic-as-it-looks-to-establish-new-polar-port
6 – https://www.ui.se/globalassets/ui.se-eng/publications/other-publications/sino-russian-cooperation-in-the-arctic_implications-for-nordic-countries-and-recommended-policy-responses.pdf
7 – https://en.wikipedia.org/wiki/Proposals_for_the_United_States_to_purchase_Greenland
8 – https://twitter.com/ThreshedThought/status/1876886722925002984
9 – https://www.forbes.com/sites/garthfriesen/2025/01/26/why-trump-wants-greenland-and-canada-strategic-and-economic-goals/
10 – https://www.bloomberg.com/opinion/articles/2025-01-15/trump-s-folly-greenland-for-critical-minerals-is-utter-nonsense
11 – https://www.dw.com/en/greenland-stops-oil-and-gas-exploration-climate-costs-too-high/a-58294024

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.