Table of Contents
প্রেক্ষাপট
আফ্রিকার কেন্দ্রীয় অঞ্চলের অন্যতম বড় দেশ ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব দ্য কঙ্গো (Democratic Republic of the Congo) বা সংক্ষেপে ডিআরসি (DRC)-র পূর্বাঞ্চলে দীর্ঘ সময় ধরে সহিংসতা ও মানবিক সংকট চলছে। এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শহর গোমা (Goma), যা প্রায় ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষের আবাসস্থান, আবারও অস্থিরতায় আক্রান্ত। সাম্প্রতিক সময়ে এম২৩ (M23) নামে পরিচিত একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী (যাদেরকে রুয়ান্ডার (Rwanda) সমর্থিত বলে অভিযোগ করা হয়) গোমা দখলের হুমকি দিচ্ছে এবং ইতোমধ্যে নগরীর আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকার নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়েছে।
জাতিসংঘ (United Nations) সতর্কবার্তা দিয়েছে যে, এই সংঘাতের তীব্রতা আরো বেড়ে গেলে অঞ্চলটি একটি বড় আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কায় পড়তে পারে। বহুদিন ধরে চলে আসা এবং মাঝে মধ্যে উপেক্ষিত হওয়া এই সংঘাতের পেছনে জাতিগত বিভাজন, আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন ও ব্যবসা—সব মিলিয়ে পূর্ব ডিআরসি-তে (eastern DRC) এক জটিল মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে।
এম২৩ (M23) বিদ্রোহের উৎপত্তি ও লক্ষ্য
গোষ্ঠীর নাম এবং গঠন: “এম২৩ (March 23rd Movement)” নামটি এসেছে ২০১২ সালে, যখন সংগঠনটি আনুষ্ঠানিকভাবে তৈরি হয়। এটি প্রধানত তুতসি (Tutsi) জাতিগোষ্ঠীভুক্ত সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত। এই বিদ্রোহীরা কঙ্গোর সরকারকে (Congolese government) অভিযুক্ত করেছিল যে, তারা পূর্ববর্তী এক শান্তিচুক্তি কার্যকরভাবে পালন করেনি। ওই শান্তিচুক্তিতে কঙ্গোলিজ তুতসিদের (Congolese Tutsis) সেনাবাহিনীতে পূর্ণাঙ্গভাবে একীভূত করার কথা ছিল।
২০১২ সালের বিদ্রোহ: ২০১২ সালে এম২৩ একটি প্রধান বিদ্রোহ গড়ে তোলে এবং ডিআরসি-র পূর্বাঞ্চলে বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে। ঐ বছর তারা গোমা শহরও (Goma) এক সপ্তাহেরও বেশি সময়ের জন্য নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছিল। তখন আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে বড় দাতারা রুয়ান্ডাকে (Rwanda) দেয়া অর্থসহায়তা বন্ধ করে দেয়, কারণ অভিযোগ ছিল যে রুয়ান্ডা এম২৩-কে সরাসরি সহায়তা দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কঙ্গোর সেনাবাহিনী (Congolese army) এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীরা (UN forces) সম্মিলিতভাবে এম২৩-কে দমিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে এম২৩ প্রায় এক দশক নিষ্ক্রিয় ছিল।
আবারও সক্রিয়তা: দীর্ঘ বিরতি শেষে ২০২২ সালে এম২৩ আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিদ্রোহের তীব্রতা বেড়ে যায়, এবং বহু এলাকায় নতুন করে সংঘাত শুরু হয়। অভিযোগ অনুযায়ী, এই নতুন বিদ্রোহেও রুয়ান্ডা (Rwanda) সক্রিয়ভাবে এম২৩-কে সহায়তা দিচ্ছে। বিশেষ করে ডিআরসি-র (DRC) উত্তর কিভু (North Kivu) প্রদেশে এই সংঘাত জোরালো হয়ে উঠে। এম২৩ পূর্বের মতই বিস্তৃত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়, অনেক মানুষ বাসস্থান হারিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছে।
পূর্ব ডিআরসি (DRC)-তে দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের ইতিহাস
ডিআরসি-র পূর্বাঞ্চল বহু বছর ধরেই সহিংসতায় জর্জরিত। প্রায় ৩০ বছর ধরে এই অঞ্চল নানাবিধ বিদ্রোহী গোষ্ঠীর তৎপরতায় অস্থির। গোলযোগের মূলে রয়েছে জাতিগত দ্বন্দ্ব, প্রতিবেশী দেশের নিরাপত্তা উদ্বেগ, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে মূল্যবান খনিজ সম্পদ। টিন (tin), টাংস্টেন (tungsten), ট্যান্টালাম (tantalum) ও বিশেষভাবে কোল্টান (coltan) এখানকার গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, যা আধুনিক ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ব্যাটারি, সার্কিট বোর্ড, ক্যাপাসিটার ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়।
খনিজ সম্পদে ভরপুর এই অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করে। এম২৩-ও তার ব্যতিক্রম নয়। আগে যেমন তারা একবার গোমা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে আলোড়ন তুলেছিল, তেমনই এখন আবার সেই পথে এগুচ্ছে।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি এবং গোমা (Goma)-র বর্তমান অবস্থা
দ্বিতীয় দফার বিদ্রোহ ও নতুন করে অগ্রযাত্রা: ২০২২ সালে নতুন করে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর থেকে এম২৩ উত্তর কিভু প্রদেশের (North Kivu Province) বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে নেয়। সংঘাতের তীব্রতা মাঝেমধ্যে কিছুটা কমলেও, বহুবার যুদ্ধবিরতি (ceasefire) ও সমঝোতা (truce) চেষ্টায় ব্যর্থতা দেখা গেছে। গত বছরের গ্রীষ্ম থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধ ডজনেরও বেশি যুদ্ধবিরতি কার্যকরভাবে ভেঙে গেছে।
গোমা শহরের চারপাশে ঘিরে ফেলা: ২০২৩ সালের শেষভাগ থেকে ২০২৫ সালের শুরুতে, এম২৩ আবারও অগ্রসর হয়ে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু শহর ও রুট দখল করে। গোমা শহরের চারদিকে এখন কার্যত এম২৩-এর অবস্থান। শহরের উত্তরে ও পশ্চিমে এম২৩, পূর্বে রুয়ান্ডার সীমানা (Rwandan border), আর দক্ষিণে কিভু লেক (Lake Kivu)। এম২৩ প্রকাশ্যেই জানিয়েছে যে তারা গোমা দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাই কমিশনার (UN High Commissioner for Human Rights) সতর্ক করে দিয়েছে—যদি এম২৩ সত্যিই গোমায় প্রবেশ করে বা দখলে নেয়, তবে বহু মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। একদিকে শহরের নিজস্ব জনসংখ্যা, অন্যদিকে ইতোমধ্যে যুদ্ধের ভয়ে ঘর ছাড়া লাখো মানুষ গোমায় আশ্রয় নিয়েছে। সব মিলিয়ে এর পরিণতি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
মানবিক সহায়তার কেন্দ্র: গোমা শহর পূর্ব ডিআরসি-র একটি প্রধান মানবিক ও কূটনৈতিক কেন্দ্র। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এখানে ঘাঁটি গেড়েছে, যাতে স্থানীয়দের মানবিক সহায়তা দেওয়া যায়। সুতরাং, এই শহরটি হাতে হারানো মানে অঞ্চলব্যাপী সাহায্য কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়া।
সাম্প্রতিক সংঘর্ষ এবং হতাহতের চিত্র
প্রায় ২০ জন সৈন্য এম২৩-এর সাথে সংঘর্ষে নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। নিহতদের মধ্যে কেউ কেউ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী (UN Peacekeeping Mission) হিসেবে কাজ করছিলেন, আবার কেউ কেউ দক্ষিণ আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট কমিউনিটি (Southern African Development Community) এর আঞ্চলিক বাহিনীর সদস্য ছিলেন। ডিআরসি-র পূর্বাঞ্চলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন (যা বহু বছর ধরে এখানে উপস্থিত) ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে অন্য আঞ্চলিক বাহিনীও মোতায়েন আছে।
২০২৩ সালের শেষদিকে, যখন সহিংসতা আরো বেড়ে যায়, তখন উত্তর কিভু প্রদেশের (North Kivu Province) সামরিক গভর্নর কঙ্গোলিজ সেনাবাহিনীর ফ্রন্টলাইনে পরিদর্শনের সময় নিহত হন। এই ঘটনা ডিআরসি-র নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলেছে।
কঙ্গো-রুয়ান্ডা কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি
কঙ্গো সরকারের অভিযোগ, রুয়ান্ডা সরাসরি এম২৩-কে সমর্থন দিচ্ছে, অর্থায়ন করছে এবং সামরিকভাবে সাহায্য করছে। ২০২৫ সালের শুরুতে পরিস্থিতি যখন মারাত্মক আকার ধারণ করে, কঙ্গোর সরকার রুয়ান্ডার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার (severing diplomatic ties) ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে, রুয়ান্ডা বরাবরই বলে আসছে যে তারা এম২৩-কে কোনোভাবে সমর্থন করে না। তবে কঙ্গো এই বক্তব্য মানতে নারাজ, এবং অনেক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকও রুয়ান্ডার বক্তব্যকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করে না।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (US) এবং আরও বেশ কিছু দেশ ও সংগঠন সরাসরি রুয়ান্ডার বিরুদ্ধে এম২৩-কে সহায়তার অভিযোগ এনেছে।
রুয়ান্ডার ভূমিকা: সমর্থন ও স্বার্থ
প্রত্যক্ষ সামরিক সহায়তা: শুধু অর্থসহায়ন বা প্রশিক্ষণ নয়, জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা জানান যে রুয়ান্ডার প্রায় ৪,০০০ সেনা সরাসরি ডিআরসি-র পূর্বাঞ্চলে অবস্থান করছে। এমনকি এম২৩-এর সামরিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে রুয়ান্ডার সৈন্যরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে অভিযোগ রয়েছে। উন্নত অস্ত্র পরিচালনা থেকে শুরু করে লক্ষ্যবস্তু নির্বাচন—এসবই রুয়ান্ডার সামরিক পর্যায়ের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে বলে জাতিসংঘের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক স্বার্থ: ডিআরসি-র পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে উত্তর কিভু (North Kivu) প্রদেশের রুবেয়া (Rubeah) এলাকা কোল্টান (coltan) সহ অন্যান্য মূল্যবান খনিজের জন্য বিখ্যাত। এম২৩ গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই এলাকাটির নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে। জাতিসংঘের হিসাব মতে, স্থানীয় খনিজ উত্তোলন ও ব্যবসা থেকে এম২৩ মাসে প্রায় ৮০০,০০০ ডলার আদায় করে থাকে। এম২৩ সেখানে তথাকথিত “উৎপাদন ও বাণিজ্য কর” (production and trade tax) আরোপ করে, আর এই সমস্ত কোল্টান মূলত রুয়ান্ডায় চলে যায়। সেখান থেকে “জালিয়াতিমূলক পন্থায়” (fraudulent extraction) রপ্তানি ও বিক্রি করা হয়। এতে লাভবান হয় এম২৩, এবং রুয়ান্ডার অর্থনীতি। সুতরাং রুয়ান্ডার স্বার্থ এখানে দ্বিমুখী—একদিকে খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ এবং অন্যদিকে সেই সম্পদের বৈদেশিক বিক্রয় থেকে রাজস্ব বা আর্থিক সুফল পাওয়া।
রুয়ান্ডার রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থ
প্রতিদ্বন্দ্বী মিলিশিয়া ও জাতিগত বিবাদ: রুয়ান্ডা সরকারের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, ডিআরসি-র পূর্বাঞ্চলে রুয়ান্ডাবিরোধী বাহিনী, বিশেষত এফডিএলআর (FDLR) নামে পরিচিত হুতু (Hutu) মিলিশিয়া সক্রিয় রয়েছে। এফডিএলআর-এর অনেক সদস্য ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডায় সংঘটিত তুতসি গণহত্যার (Rwandan Genocide) সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত। রুয়ান্ডার আশঙ্কা, এই গোষ্ঠীগুলো তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। অন্যদিকে, ডিআরসি-র সামরিক বাহিনী (Congolese military) তাদের লড়াইয়ে এফডিএলআর বা একই ধরনের হুতু মিলিশিয়াদের মাঝে মাঝে পাশে পায়। এই বিষয়টি রুয়ান্ডাকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। কারণ, রুয়ান্ডা মনে করে ডিআরসি ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের শত্রুদের সাহায্য করছে।
আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা: উগান্ডা (Uganda) বনাম রুয়ান্ডা: আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল রুয়ান্ডা ও উগান্ডার মধ্যে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ডিআরসি সম্প্রতি উগান্ডার সৈন্যদের ডেকেছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ডিআরসি-তে অবস্থান নিয়ে এডিএফ (Allied Democratic Forces) নামে পরিচিত আইএস (IS) সংশ্লিষ্ট একটি গ্রুপকে মোকাবেলা করতে। এছাড়া ডিআরসি ও উগান্ডা একসঙ্গে সড়ক নির্মাণ ও পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যা সম্ভবত রুয়ান্ডার আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে যে, এই অঞ্চলের সম্পদ আহরণ ও বাণিজ্যে তারা কোণঠাসা হয়ে যাবে। রুয়ান্ডা মনে করতে পারে যে, ডিআরসি-র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সামরিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে উগান্ডা রুয়ান্ডার নিজের স্বার্থসিদ্ধির এলাকায় প্রবেশ করছে। এম২৩-কে পুনরায় সক্রিয় করা হয়তো রুয়ান্ডার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ, যাতে তারা আঞ্চলিক আলোচনায় ও ক্ষমতার বিন্যাসে বড় ভূমিকা নিতে পারে।
এম২৩-এর অগ্রযাত্রা বেড়ে যাওয়ার পেছনে কারণ
২০২৫ সালের শুরুর দিকে এম২৩-এর অগ্রযাত্রা কেন আবার তীব্র হলো? অনেক বিশ্লেষকের মতে, গত ডিসেম্বর মাসে (২০২৪ সালের ডিসেম্বর) আঙ্গোলা (Angola) নেতৃত্বাধীন শান্তি আলোচনায় (peace talks) অগ্রগতি না হওয়ায় রুয়ান্ডা চায় নিজস্ব অবস্থান আরো শক্ত করতে। আলোচনার টেবিলে যদি তাদের স্বার্থ বা শর্ত ঠিকমতো না মানা হয়, তাহলে তারা সামরিক শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজেদের সক্ষমতা এবং “দাবি” স্পষ্ট করতে চায়।
আঙ্গোলা-নেতৃত্বাধীন এই শান্তি প্রক্রিয়া ভেঙে যাওয়ার পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। রুয়ান্ডা এবং ডিআরসি-র মধ্যে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কও বিধ্বস্ত হওয়ার পথে। এদিকে এম২৩ গতি বাড়িয়ে গোমা দখলে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে, যা অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকেও উদ্বিগ্ন করেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ (UN Security Council) এম২৩-এর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড এবং রুয়ান্ডার ভূমিকা নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছে। যুক্তরাষ্ট্র (US), যুক্তরাজ্য (UK) ও ফ্রান্স (France) এখানে রুয়ান্ডার প্রতি নিন্দা জানালেও এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো নিষেধাজ্ঞার (sanctions) সুপারিশ করেনি।
এর পেছনে কারণ হিসেবে পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামে (Paul Kagame) দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা বিশ্বে (Western community) “সংঘাত-পরবর্তী পুনর্গঠন ও উন্নয়নের রোল মডেল” হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। রুয়ান্ডাও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উদ্যোগে অবদান রেখে পশ্চিমাদের আস্থাভাজন হয়ে উঠেছে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে যেমন সরাসরি তহবিল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তেমন ধরনের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সম্ভবত কঠিন হয়ে পড়েছে।
ফলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে—আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কি আবারও ২০১২ সালের মতো সক্রিয় ভূমিকা নেবে? নাকি রুয়ান্ডা তার অঘোষিত সামরিক পদক্ষেপ চালিয়েই যাবে? উত্তর খুঁজে পাওয়া খুব সহজ নয়।
মানবিক সংকটের পরিণতি
ডিআরসি-র পূর্বাঞ্চল ইতোমধ্যেই এক ভয়াবহ মানবিক সংকট মোকাবেলা করছে। জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, দেশটির অভ্যন্তরে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ৫০ লক্ষেরও বেশি, যার বড় অংশ রয়েছে পূর্বাঞ্চলেই। এম২৩-এর সাম্প্রতিক বিদ্রোহ নতুন করে আরও লক্ষাধিক মানুষকে ঘরছাড়া করেছে।
গোমা শহর বরাবরই এ ধরনের শরণার্থীদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করেছে। যদি এম২৩ শহরটি পুরোপুরি দখল করে নেয় বা শহরের চারদিকে স্থায়ীভাবে ঘাঁটি স্থাপন করে, তাতে শহরে অবরুদ্ধ অবস্থা তৈরি হবে। আন্তর্জাতিক ত্রাণ কার্যক্রমও বাধার মুখে পড়বে। এ পরিস্থিতিতে আরও বেশি মানুষ অনাহার, রোগব্যাধি আর সহিংসতার শিকার হবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
উপসংহার
পূর্ব ডিআরসি-তে (Eastern DRC) নতুন করে জোরালো হয়ে ওঠা সংঘাত শুধুই স্থানীয় বা আঞ্চলিক কোনো সমস্যা নয়; এটি একটি বৈশ্বিক উদ্বেগের বিষয়। জাতিগত বৈরিতা, মূল্যবান খনিজের নিয়ন্ত্রণ, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা শঙ্কা—সবকিছু মিলে এই অঞ্চলটিকে স্থায়ী অস্থিরতায় ফেলে দিয়েছে। রুয়ান্ডা নিজেদের সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা বলে ডিআরসি-তে “হস্তক্ষেপমূলক” ভূমিকা নিয়ে চলছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা ও পর্যবেক্ষকরা উল্লেখ করেছেন।
কঙ্গো সরকারের পক্ষে মনে হচ্ছে, তারা একাধারে এম২৩-এর সাথে লড়াই করছে এবং অন্যদিকে রুয়ান্ডার সক্রিয় সমর্থনজনিত চাপে পর্যুদস্ত হচ্ছে। এম২৩ বিদ্রোহীরাও আগের তুলনায় আরও সুসজ্জিত ও সুসংগঠিত। রুয়ান্ডার সেনাবাহিনীর “কারিগরি প্রশিক্ষণ ও সরাসরি অংশগ্রহণ” (direct involvement) এম২৩-কে দ্রুততার সাথে অগ্রসর হতে সাহায্য করছে বলে অভিযোগ উঠে আসছে।
যে হারে সহিংসতা বাড়ছে এবং গোমা শহরকে ঘিরে ফেলা হয়েছে, তাতে বড় পরিসরে আঞ্চলিক যুদ্ধের ঝুঁকি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। অঞ্চলটির ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ়তা, প্রতিবেশী দেশগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং ডিআরসি সরকারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ওপর।
নানামুখী স্বার্থ, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট এবং বাইরের শক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ এখানে জড়িয়ে আছে। যতোদিন না সুষ্ঠু শান্তি আলোচনার (peace talks) মাধ্যমে অস্ত্র বিরতি বাস্তবে কার্যকর হয় এবং প্রত্যেকটি পক্ষের যৌক্তিক উদ্বেগ মেটানো যায়, ততোদিন পূর্ব ডিআরসি এই সহিংসতার দুষ্টচক্রে বন্দি থেকেই যাবে। আর এর মাশুল গুনবে মূলত সাধারণ জনগণ, যাদের জীবন ও নিরাপত্তা ক্রমাগত হুমকির মুখে।
আফ্রিকা সম্পর্কিত আরও সংবাদ ও বিশ্লেষণ জানতে যান এখানে – আফ্রিকা সংবাদ
Leave a Reply