কেন ট্রাম্প ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে নিয়ন্ত্রক যুদ্ধ শুরু করতে চলেছেন?

ভূমিকা

২১ জানুয়ারি মঙ্গলবার, হোয়াইট হাউস (White House) একটি ডকুমেন্ট প্রকাশ করেছে, যেখানে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের (Donald Trump) নতুন ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ (America First) বাণিজ্যনীতির (Trade Policy) বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। এখানে শুল্ক (Tariffs), বাণিজ্য চুক্তি (Trade Deals) সংক্রান্ত পরিচিত আলোচনা থাকলেও, নিচের দিকে একটি তুলনামূলকভাবে ছোট ক্লজ বা ধারা আছে যা মার্কিন অর্থমন্ত্রীকে (Secretary of the Treasury) তদন্ত করতে নির্দেশ দেয়। তদন্তের বিষয় হলো—কোনো বিদেশি দেশ (Foreign Country) যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক বা মার্কিন কোম্পানির ওপর বৈষম্যমূলক বা অতিরিক্ত কর (Extraterritorial Taxes) আরোপ করছে কি না, যুক্তরাষ্ট্রের ট্যাক্স কোডের সেকশন ৮৯১ (Section 891) অনুসারে।

প্রথমে বিষয়টি খুব টেকনিকাল বা তুচ্ছ বলে মনে হলেও, সেকশন ৮৯১ আদতে বেশ অদ্ভুত ও ‘জোরালো’ এক আইন। এটি প্রেসিডেন্টকে পার্লামেন্টের অনুমতি (Congressional Approval) ছাড়াই ক্ষমতা দেয় যে, যদি কোনো দেশ তার ট্যাক্স নীতিতে (Tax Policy) মার্কিন নাগরিক বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে, তাহলে সে দেশের সব নাগরিক ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ওপর দ্বিগুণ হারে কর আরোপ (Double Taxes) করা যাবে।

এই নিবন্ধে আমরা প্রথমে দেখবো সেকশন ৮৯১ (Section 891) কীভাবে কাজ করে, তারপর কোন কোন দেশের ওপর ট্রাম্পের নজর পড়তে পারে—বিশেষত, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) বড় প্রযুক্তি কোম্পানি সংক্রান্ত নিয়মকানুন (Big Tech Regulations) ও ওইসিডি-র (OECD) গ্লোবাল মিনিমাম কর হার (Global Minimum Corporate Tax Rate)–এগুলো ট্রাম্পের উদ্দেশ্য হতে পারে বলে অনেকে ধারণা করছেন। সবশেষে আলোচ্য আইনটি আসলে কতটা কার্যকর হতে পারে, সেটিও আলোচনা করবো।

সেকশন ৮৯১: ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট

সেকশন ৮৯১ আইনটি পাস হয় ১৯৩৪ সালে। এর সূচনা ফ্রান্সের (France) সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব থেকে, যখন ফরাসি কর ব্যবস্থাকে (French Tax System) মার্কিন কোম্পানির ওপর বৈষম্যমূলক বলে মনে করা হচ্ছিল।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, সেই সময়ে ফ্রান্স আমেরিকান কোম্পানি এবং তাদের ফরাসি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের (Subsidiaries) লভ্যাংশ (Dividends) উভয়কেই করের আওতায় আনতো, যা মার্কিন দৃষ্টিতে দ্বিগুণ কর (Double Taxation) হিসেবে বিবেচিত হতো। আবার ফরাসি কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে একটি আইনের মাধ্যমে বিদেশি সহযোগী প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া আয় করমুক্ত রাখা হতো। আমেরিকানরা এটিকে ‘অন্যায্য’ ও ‘দ্বৈত কর’ হিসেবে দেখতো।

১৯৩২ সালের এপ্রিলে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র এ নিয়ে এক নতুন ট্যাক্স চুক্তি (Tax Treaty) স্বাক্ষর করেছিল যা এই বিভেদ দূর করবে বলে আশা করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিটি দ্রুত অনুমোদন করলেও (মে-জুন ১৯৩২ নাগাদ), ফ্রান্স নানা টালবাহানা শুরু করে। এতে বিরক্ত হয়ে আমেরিকানরা সেকশন ৮৯১ পাস করে, যেনো তারা ফ্রান্সকে ‘শাস্তি’ দিতে পারে বা অন্তত শাস্তির হুমকি দিয়ে চুক্তিটি বাস্তবায়নে বাধ্য করতে পারে।

যে উদ্দেশ্যে আইনটি প্রণীত হয়েছিল, তা কার্যকর হয়। সেকশন ৮৯১ ১৯৩৪ সালের মে মাসে কার্যকর হয়, এবং পরবর্তী এক বছরের মধ্যে ফ্রান্স ওই চুক্তি অনুসমর্থন করে (Ratify)। তবে সেকশন ৮৯১-এর ব্যবহার সরাসরি কখনো ঘটেনি। এরপর এটি দীর্ঘদিন আক্ষরিক অর্থেই ‘ধুলোর আস্তরণে’ ঢাকা ছিল, যতক্ষণ না ২০১০-এর দশকে ইউরোপীয় কর ব্যবস্থাকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র আবার সক্রিয় হয়।

সাম্প্রতিক কালে সেকশন ৮৯১-এর পুনর্জাগরণ

বড় প্রযুক্তি কোম্পানির ওপর ইউরোপীয় চাপ: ২০১০-এর দশকে ইউরোপে বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর (Big Tech) ওপর নানা রকম নতুন কর ও জরিমানা আসতে থাকে। এর বেশিরভাগই ছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি, যেমন—অ্যাপল (Apple), গুগল (Google), ফেসবুক (Facebook), আমাজন (Amazon) ইত্যাদি। ২০১৬ সালে ইউরোপীয় কমিশন (European Commission) অ্যাপলকে আয়ারল্যান্ডে (Ireland) ১৪.৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করার নির্দেশ দিলে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ওবামা-যুগের (Obama) তৎকালীন অর্থমন্ত্রী জ্যাক লু (Jack Lew) সরাসরি অভিযোগ করেন যে, ইউরোপীয় কমিশন বিশেষভাবে মার্কিন কোম্পানির ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই সেকশন ৮৯১-এর বিষয়ে আলোচনাও সামনে আসে।

ফ্রান্সের ডিজিটাল সার্ভিসেস ট্যাক্স: ২০১৯ সালে ফ্রান্স ডিজিটাল সার্ভিসেস ট্যাক্স (Digital Services Tax) চালু করে, যা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বড় মাপের রাজস্ব (Revenue) আয় করা কোম্পানিগুলোর ওপর প্রযোজ্য। ফ্রান্স এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের হিসাব মতে, ডিজিটাল কোম্পানিগুলো ইউরোপীয় এসএমইর (SME) তুলনায় গড়ে প্রায় ১৪ পয়েন্ট কম কর দেয়। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ফাইন্যান্স কমিটির (Senate Finance Committee) কিছু সদস্য পরামর্শ দিয়েছিলেন, মার্কিন সরকার সেকশন ৮৯১ ব্যবহার করে ফ্রান্সকে ‘শাস্তি’ দিক। একই রকম আলোচনা হয়েছিল কানাডার (Canada) ক্ষেত্রেও, যখন তারা বড় ডিজিটাল সেবা কোম্পানির ওপর ৩% কর আরোপ করেছিল (যেসব কোম্পানির বৈশ্বিক আয় ৭৫০ মিলিয়ন ইউরো বা তার বেশি এবং কানাডায় ডিজিটাল সেবায় অন্তত ২০ মিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার আয়)। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ—ফরাসি বা কানাডিয়ান ডিজিটাল সার্ভিস কর আদতে মার্কিন বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে লক্ষ্য করে করা, কারণ এই সেক্টরের মূলে তো মূলত অ্যামাজন, গুগল, মেটা (Meta), ইত্যাদি অবস্থান করছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের অ্যান্টিট্রাস্ট জরিমানা ও অন্যান্য নিয়ম

ডিজিটাল মার্কেটস অ্যাক্ট (Digital Markets Act) ও বড় জরিমানা: ফ্রান্স বা কানাডিয়ার দ্বারা আরোপিত ডিজিটাল সার্ভিসেস ট্যাক্স ছাড়াও, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বড় প্রযুক্তি কোম্পানির বিরুদ্ধে একের পর এক অ্যান্টিট্রাস্ট (Antitrust) জরিমানা (Fines) আরোপ করে আসছে। তবে এগুলো কর নয়—বরং বাজারে একচেটিয়া আধিপত্যের (Monopoly Power) অপব্যবহারের অভিযোগে আরোপিত জরিমানা। ডিজিটাল মার্কেটস অ্যাক্ট (Digital Markets Act) নামে একটি নিয়মের আওতায় ইইউ জনপ্রিয় বড় সেবা (যেমন সার্চ ইঞ্জিন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, চ্যাট অ্যাপ) ব্যবহারকারী কোম্পানিগুলোকে (Gatekeepers) প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানের জন্য সমান সুযোগ (Level Playing Field) নিশ্চিত করার শর্ত দেয়। যদি এই শর্ত লঙ্ঘিত হয়, তবে ১০% পর্যন্ত বৈশ্বিক বার্ষিক রাজস্বের (Global Annual Turnover) সমান জরিমানা করা যেতে পারে।

সামাজিক মাধ্যমের (Social Media) নতুন নিয়মাবলি: ইইউ ইলন মাস্ক (Elon Musk) মালিকানাধীন এক্স (X, পূর্বনাম টুইটার) এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ (Content Moderation) বা ভুয়া তথ্য প্রতিরোধ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ জোরদার করতে চায়। মাস্ক ও ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিরোধ চলছে। এনিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের তরফে আশঙ্কা রয়েছে যে, এসব নিয়ম মূলত আমেরিকান কোম্পানিগুলোকেই অগ্রাধিকারহীন অবস্থায় ফেলবে।

ইইউ ও কানাডার পাল্টা যুক্তি

ইউরোপ ও কানাডা দাবি করে, তাদের এসব নিয়ম (Regulations) কোনো নির্দিষ্ট দেশের বিরুদ্ধে নয়। বরং এগুলো সব বড় প্রযুক্তি কোম্পানি বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সবার জন্য প্রযোজ্য। যেহেতু বড় প্রযুক্তির বেশিরভাগ সংস্থা এখনো আমেরিকান, তাই এসব নিয়মে তারা বেশি প্রভাবিত হচ্ছে।

অনেকেই যুক্তি দেন যে, মার্কিন বাজারে ইউরোপীয় কোম্পানিও নানা আইনি বাধার মুখে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১০-এর দশকে ভক্সওয়াগন (Volkswagen) গাড়ির নির্গমন (Emission) সংক্রান্ত নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার জরিমানা দিয়েছে। তাছাড়া, ইউরোপীয়দের ধারণা, আমেরিকান সরকার নিজেই অনেক ক্ষেত্রে রক্ষণশীল শুল্কনীতি (Protectionist Tariffs) ও ভর্তুকি (Subsidies) ব্যবহার করে মার্কিন কোম্পানিকে সুবিধা দেয়।

মার্কিন প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি: সার্বভৌমত্ব ও ‘চুরি যাওয়া’ রাজস্ব

যুক্তরাষ্ট্রের অনেক রাজনীতিক মনে করেন যে, ইউরোপের এই ধরনের জরিমানা বা কর আসলে আমেরিকান সার্বভৌমত্বের (American Sovereignty) ওপর হস্তক্ষেপ এবং এক প্রকারের পদ্ধতিগত কৌশলে ইউরোপ ‘আমেরিকার কর রাজস্ব’ (American Tax Revenues) ছিনিয়ে নিচ্ছে।

বড় প্রযুক্তি কোম্পানির সিইওরা (CEO) যেমন ইলন মাস্ক ও মার্ক জাকারবার্গ (Mark Zuckerberg) সম্ভবত কর বা জরিমানা দিতে মোটেই আগ্রহী নন। তারা ট্রাম্পের কাছে নিজেদের অসন্তোষ তুলে ধরেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ট্রাম্প নিজেও চাইছেন, ইউরোপ বা কানাডা যদি এসব কোম্পানিকে বাড়তি বা ‘ভাষায়’ বৈষম্যমূলক নিয়মের অধীন করে, তবে সেকশন ৮৯১-এর মাধ্যমে তাদের ওপর পাল্টা দ্বিগুণ কর আরোপের হুমকি দিয়ে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করবেন।

বিশ্বব্যাপী ন্যূনতম কর হার (Global Minimum Corporate Tax) চুক্তির বিপরীতে ট্রাম্পের অবস্থান

ওইসিডি (OECD) চুক্তি থেকে সরে আসার সম্ভাবনা: ট্রাম্প সম্প্রতি এক আলাদা নীতিমালা স্মারকে (Policy Memo) ওইসিডির (OECD) গ্লোবাল মিনিমাম কর চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন তুলে নিয়েছেন। এই চুক্তির মূল কথা হলো, কোনো দেশের কোম্পানি গ্লোবালি যদি একটি নির্দিষ্ট ন্যূনতম করের নিচে কর প্রদান করে, তাহলে অন্য অংশগ্রহণকারী দেশগুলো সেই কোম্পানির ওপর বাড়তি ‘টপ-আপ’ কর আদায় করতে পারবে, যেনো কর ফাঁকি দিয়ে কোথাও যেতে না পারে। যদি যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে কর হার কমিয়ে দেয় বা চুক্তির শর্ত না মানে, তবে অন্য দেশগুলো ‘টপ-আপ’ কর আরোপ করবে। ফলে আসলে কোম্পানিগুলো আগের সমপরিমাণ করই দেবে, কিন্তু সেই করের আয় যুক্তরাষ্ট্রের হাতে না এসে ইউরোপ বা অন্য কোথাও যেতে পারে।

সেকশন ৮৯১-এর ‘ভীতি প্রদর্শন’ কৌশল: ট্রাম্পের লক্ষ্য হতে পারে, সেকশন ৮৯১-এর হুমকি দেখিয়ে অন্য দেশগুলোকেও ওই চুক্তি (Global Tax Pact) থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করা, যাতে চুক্তিটি একেবারেই ভেঙে পড়ে। তখন যুক্তরাষ্ট্র নির্দ্বিধায় নিজস্ব করনীতি (Tax Rate) নির্ধারণ করতে পারবে। যদি অন্য দেশগুলো চুক্তিতে টিকে থাকে আর যুক্তরাষ্ট্র একা বের হয়ে যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো কম কর দিলেও সেই করের বাকি অংশ অন্য দেশগুলো আদায় করে নেবে। এতে করে যুক্তরাষ্ট্র কর আয় হারাবে। তবে সেকশন ৮৯১-এর শাস্তির ভয়ে অন্যরাও চুক্তি ত্যাগ করলে, চুক্তিটাই অকেজো হয়ে যাবে।

সম্ভাব্য প্রভাব ও আশঙ্কা

বর্ধিত বাণিজ্যযুদ্ধের (Trade War) আশঙ্কা: যদি ট্রাম্প সত্যিই EU বা OECD জোটভুক্ত দেশের নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানের ওপর দ্বিগুণ কর আরোপের মাধ্যমে সেকশন ৮৯১ কে কার্যকরভাবে ব্যবহার করেন তাহলে এটি বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। ‘শুল্কযুদ্ধ’ (Tariff War) থেকে ‘নিয়ন্ত্রক যুদ্ধ’ (Regulatory War)-এ পরিণত হয়ে একেবারে নতুন মাত্রায় পৌঁছতে পারে।

পূর্ববর্তী পদক্ষেপ ও পটভূমি: ট্রাম্প এর আগের মেয়াদে শুল্ককে (Tariffs) একটি প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন, বিশেষত বাণিজ্যের ভারসাম্য (Trade Imbalances) নিয়ে তার উদ্বেগ ছিল। চীনের (China) সঙ্গে বড় পরিসরে শুল্কযুদ্ধের ধাঁচে লড়াই তিনি করেছিলেন, যাতে আমেরিকান বাণিজ্য ঘাটতি (Trade Deficit) কমানো যায়। তখন অনেক অর্থনীতিবিদের সমালোচনা ছিল যে, শুল্ক বাড়িয়ে হয়তো লক্ষ্য পূরণ হবে না। তবে অন্তত লজিকে ছিল—‘আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি বা চীনের উদ্বৃত্ত যদি শূন্যের কোঠায় নামে, তবে ট্রাম্প শুল্ক থেকে সরে আসবেন।’ কিন্তু এই নতুন ধাক্কা—‘বড় প্রযুক্তি কোম্পানিকে সুরক্ষা দেওয়া’ বা ‘বিদেশি কর নিয়মের থেকে আমেরিকান কোম্পানিকে রক্ষা করা’–এর কোনো স্পষ্ট শেষ বিন্দু নেই। ঠিক কতটা ‘ন্যায়সঙ্গত’ বা ‘মার্কিন কোম্পানির জন্য অনুকূল পরিবেশ’ দরকার, সেটি অস্পষ্ট। ফলে অন্যান্য দেশ সম্ভবত জানে না, কতদূর পর্যন্ত স্বচ্ছতা বা ‘সহনশীলতা’ প্রদর্শন করলে ট্রাম্প সন্তুষ্ট হবেন।

বন্ধুত্বপূর্ণ কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা নাকি সার্বভৌম সিদ্ধান্ত?

এখানে আরও একটি বিতর্ক আছে—ট্রাম্প এই পদক্ষেপগুলো নিচ্ছেন কি কেবল প্রযুক্তি জায়ান্টদের (Tech Giants) স্বার্থ রক্ষার জন্য? ইলন মাস্ক ও মার্ক জাকারবার্গের মতো ধনকুবের সিইওদের অনুরোধে কি এই নীতি হচ্ছে? নাকি সত্যিই মার্কিন সার্বভৌমত্ব ও রাজস্ব সুরক্ষা (Revenue Protection) এর ব্যাপার?

ইউরোপীয় দিক থেকে, তারা বলবে ‘আমরা নির্দিষ্ট কোনো দেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি না। বড় প্রতিষ্ঠান হলে তারা অন্য দেশের হলেও একই নিয়ম প্রযোজ্য।’ কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, এগুলো আসলে মার্কিন প্রযুক্তি খাতের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক আক্রমণ।

ফলে কী ঘটতে পারে?

দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা নাকি সংঘাত?: যদি ট্রাম্প প্রশাসন সত্যিই সেকশন ৮৯১ তদন্ত ও প্রয়োগের হুমকি কার্যকর করে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা কানাডা হয়তো বড় ধরনের বিরোধে জড়িয়ে পড়বে। এগুলো সমাধানে নতুন করে কূটনৈতিক আলোচনা শুরু হতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে, উভয় পক্ষই চায় তাদের বড় প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যের দেশে ব্যবসা করুক। অতএব, একে অপরের বিরুদ্ধে দ্বিগুণ কর (Double Tax) আরোপ করলে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমবে, যা উভয় পক্ষের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

গ্লোবাল মিনিমাম কর ভাঙার সম্ভাবনা: ওইসিডির বৈশ্বিক কর চুক্তি (Global Minimum Tax Deal) সাম্প্রতিক সময়ে বহুপাক্ষিক ঐকমত্যের (Multilateral Consensus) অন্যতম দৃষ্টান্ত। যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে সরে গেলে, শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, আরও কিছু বড় অর্থনীতিও সরে গিয়ে চুক্তিটি ভেঙে যেতে পারে। এতে করে বড় কোম্পানিগুলো ‘কর স্বর্গ’ বা কম করের দেশগুলোয় যাওয়ার সুযোগ পাবে, এবং অন্য দেশগুলো ‘টপ-আপ’ কর আরোপ করতে পারবে না।

দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ও অনিশ্চয়তা: ট্রাম্পের এই নতুন ‘নিয়ন্ত্রক যুদ্ধ’ (Regulatory War) কতটা এগোবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। চীন বা অন্যান্য দেশে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি শূন্যে নামলে ‘লক্ষ্য পূরণ’ বলে ঘোষণা দেয়ার একটি সোজা রাস্তা ছিল। কিন্তু এখানে, ‘যথাযথ নিয়মকানুন’ বা ‘যথেষ্ট সন্তুষ্টি’ বলতে কী বোঝাচ্ছে, সেটি অস্বচ্ছ। এছাড়া, রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থ ও বৈশ্বিক অর্থনীতির পারস্পরিক নির্ভরতা জটিল। বড় শক্তিগুলো পরস্পরকে শাস্তি দিতে গেলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।

উপসংহার

ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ঘোষিত ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বাণিজ্যনীতির (America First Trade Policy) অংশ হিসেবে সেকশন ৮৯১ (Section 891) আবারও রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। এই আইনের আওতায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই যে কোনো দেশের নাগরিক ও কোম্পানির ওপর কর দ্বিগুণ (Double Tax) করার ক্ষমতা রাখেন, যদি সেই দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক বা ব্যবসাকে কর নীতিতে বৈষম্যের শিকার করে।

ইতিহাসে একবারই (১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে) হুমকি হিসেবে আইনটি কার্যকরভাবে ব্যবহারের চেষ্টা হয়েছিল, যদিও বাস্তবে প্রয়োগ করার প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু বর্তমানে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডিজিটাল সার্ভিসেস ট্যাক্স, বড় অ্যান্টিট্রাস্ট জরিমানা, কানাডার ডিজিটাল কর, কিংবা ওইসিডির গ্লোবাল মিনিমাম ট্যাক্স চুক্তি—এসব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি জায়ান্ট ও রাজনীতিকদের মধ্যে ক্ষোভ আছে।

ফলে ট্রাম্প যদি সেকশন ৮৯১ ব্যবহারের হুমকি দেন, তাহলে ইউরোপ, কানাডা বা অন্য কোনো দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে। বিশ্ব অর্থনীতি অস্থিতিশীলতায় পড়তে পারে, এবং বহুপাক্ষিক কর চুক্তি ভেঙে যেতে পারে।

এই নীতির কোনো সুস্পষ্ট ‘শেষ অবস্থা’ বা ‘লক্ষ্য পূরণের মানদণ্ড’ এখনো অনিশ্চিত। শুল্ক যুদ্ধের পেছনে যুক্তি ছিল, ‘বাণিজ্য ঘাটতি কমানো বা শূন্যে নামানো।’ কিন্তু বিভিন্ন দেশ কতটা নিয়ম সহজ করলে বা কতটা নিয়মে পরিবর্তন আনলে ট্রাম্প সন্তুষ্ট হবেন—সেটি পরিষ্কার নয়।

সব মিলিয়ে, ট্রাম্পের নতুন এই ‘নিয়ন্ত্রক যুদ্ধ’ (Regulatory War) বিশ্ব বাণিজ্য কাঠামোতে আবারও বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাৎক্ষণিক ফলাফল কী হবে, তা নির্ভর করছে উভয় পক্ষের (মার্কিন প্রশাসন ও ইউরোপ/কানাডা) মধ্যে কূটনৈতিক সমঝোতা কতটা সফল হয় তার ওপর। বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর ওপর ইউরোপের বিধিনিষেধ কি শিথিল হবে, নাকি যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই দ্বিগুণ কর আরোপ করার মতো কঠোর পথে যাবে—সে প্রশ্নের উত্তর সময়ই দেবে।

ইইউ সম্পর্কিত আরও সংবাদ ও বিশ্লেষণ জানতে দেখুন – ইইউ ও ইউরোপ সংবাদ

যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে আরও সংবাদ ও বিশ্লেষণ জানতে চাইলে দেখুন – যুক্তরাষ্ট্র সংবাদ

ব্যবসা সংক্রান্ত আরও সংবাদ ও বিশ্লেষণ জানতে চাইলে যান এখানে – ব্যবসা সংবাদ

তথ্যসূত্র

1 – https://www.whitehouse.gov/presidential-actions/2025/01/america-first-trade-policy/
2 – https://scholarship.law.duke.edu/cgi/viewcontent.cgi?referer=&httpsredir=1&article=2279&context=lcp
3 – https://taxfoundation.org/blog/us-france-tax-troubles/
4 – https://www.reuters.com/article/business/us-tax-code-may-allow-dramatic-retaliation-in-eu-apple-case-idUSKCN1162ZJ/
5 – https://taxfoundation.org/blog/france-digital-services-tax/
6 – https://mcmillan.ca/insights/the-united-states-challenges-canadas-digital-services-tax/
7 – https://www.france24.com/en/europe/20221216-why-eu-leaders-are-upset-over-biden-s-inflation-reduction-act
8 – https://www.ft.com/content/44610d06-5e20-4b3a-8faf-4d745770d43f

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.