২২ জানুয়ারি, ২৫: সপ্তাহের উইনার – ট্রাম্প, ম্যাক্রোঁ; লুজার – ক্রিস্টারসেন, নেতানিয়াহু, পুতিন

উইনাররা: ট্রাম্প, ম্যাক্রোঁ

ডোনাল্ড ট্রাম্পের অপ্রত্যাশিত প্রত্যাবর্তন

এই সপ্তাহের আলোচনার শুরুতেই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সপ্তাহের সেরা উইনার হিসেবে ঘোষণা করা যায়। অনেকের কাছে এটা হয়তো গতানুগতিক পছন্দ মনে হতে পারে, কিন্তু এর পেছনে যথেষ্ট শক্তিশালী যুক্তি রয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্টের (President) দায়িত্ব গ্রহণের দিনটিতে ট্রাম্প ও তার সমর্থকরা স্বাভাবিকভাবেই আনন্দে উদ্বেলিত ছিল। রবিবার ট্রাম্প একটি বিশাল বিজয় র‍্যালির (victory rally) আয়োজন করেছিলেন, যেখানে তার রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং সমর্থকরা উপস্থিত ছিলেন। তবে ট্রাম্পের এই সপ্তাহের সাফল্যের পেছনে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে:

গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি (Gaza ceasefire deal): যদিও গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তিটি প্রযুক্তিগতভাবে জো বাইডেনের (Joe Biden) প্রেসিডেন্সির (Presidency) সময়ে হয়েছে, তবে অনেকেই মনে করেন যে এই চুক্তির পেছনে মূল অনুঘটক ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার দল। ট্রাম্পের দল নেতানিয়াহুর উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করার ফলেই এই চুক্তি সম্ভব হয়েছে। ট্রাম্প এই কৃতিত্ব অনায়াসে নিজের বলে দাবি করতে পারেন এবং বলতে পারেন যে বাইডেন প্রশাসন যেখানে ১৫ মাস ধরে ব্যর্থ হয়েছে, তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগেই সেই কাজ করে দেখিয়েছেন। রাজনৈতিক প্রচারণার (political campaign) ক্ষেত্রে এটা নিঃসন্দেহে ট্রাম্পের জন্য একটি বড় জয়। অনেকেই হয়তো আশা করেছিলেন যে ট্রাম্প ইসরায়েল-পন্থী (pro-Israel) হবেন এবং নেতানিয়াহুর সরকারকে সমর্থন করবেন। তবে বাস্তবে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। ট্রাম্প প্রশাসন নেতানিয়াহুকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করিয়ে কার্যত সবাইকে চমকে দিয়েছেন। হয়তো এটা ট্রাম্পের একটি জনসংযোগের কৌশল ছিল, এবং ভবিষ্যতে তার মধ্যপ্রাচ্য নীতি (Middle East policy) হয়তো আরও বেশি ইসরায়েল-কেন্দ্রিক হবে। তবে এও হতে পারে, গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তিটি হয়তো দ্রুত একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য করা হয়েছে। ভবিষ্যতে ট্রাম্প প্রশাসন হয়তো ইসরায়েলের (Israel) জন্য আরও বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে, যেমন পশ্চিম তীর (West Bank) অধিগ্রহণ অথবা ইরানের (Iran) পারমাণবিক কর্মসূচিতে (nuclear program) হস্তক্ষেপ করা। এখনই ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতি সম্পর্কে কোনো উপসংহারে আসাটা বোকামি হবে।

আরও পড়ুন – ট্রাম্প কি ইসরায়েলকে শান্তিচুক্তিতে বাধ্য করলেন? (২০ জানুয়ারি, ২০২৫)

টিকটক নিষেধাজ্ঞা বিতর্ক (TikTok ban controversy): টিকটকের (TikTok) উপর নিষেধাজ্ঞা জারির বিষয়টি প্রথমবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনকালেই শুরু হয়েছিল। সম্প্রতি, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (USA) টিকটক সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়, তখন আমেরিকান ব্যবহারকারীরা একটি বার্তা দেখতে পান। সেই বার্তায় টিকটক কর্তৃপক্ষ জানায় যে তারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে এই সমস্যার সমাধানে কাজ করছে। এর একদিন পরই টিকটক পুনরায় তাদের কার্যক্রম শুরু করে এবং ব্যবহারকারীদের জানায় যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে তারা ফিরে আসতে পেরেছে। টিকটক কর্তৃপক্ষের এই পদক্ষেপ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল এবং তারা সচেতনভাবে ট্রাম্পের কাছে নিজেদের ইতিবাচক ভাবমূর্তি (positive image) তুলে ধরতে চেয়েছিল। এর ফলস্বরূপ তরুণ প্রজন্মের (young generation) কাছে এই বার্তা পৌঁছাবে যে জো বাইডেন টিকটক নিষিদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে এসে তাদের প্রিয় প্ল্যাটফর্মটিকে বাঁচিয়েছেন। এর মাধ্যমে ট্রাম্প তরুণ ভোটারদের (young voters) মধ্যে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা লাভ করবেন, যা হয়তো চেয়ারম্যান মাওয়ের (Chairman Mao) জনপ্রিয়তাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। ট্রাম্প হয়তো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য তার পূর্বের অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। ডেমোক্রেটরা (Democrats) ভেবেছিল রিপাবলিকানদের (Republicans) সাথে হাত মিলিয়ে চীনের (China) প্রভাব মোকাবেলা করবে, কিন্তু বাস্তবে রিপাবলিকানরাই শেষ মুহূর্তে পিছু হটে যায়। এই পরিস্থিতিতে রিপাবলিকানরা রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন। এটা নিশ্চিত নয়, তবে ট্রাম্পের জন্য এটা নিঃসন্দেহে একটি রাজনৈতিক জয়। ট্রাম্পের এই অবস্থান পরিবর্তনে তাকে কি দ্বিচারী বা দুর্বল মনে হবে কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন। সাধারণ মানুষ হয়তো মনে রাখবে না যে টিকটকের উপর নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব প্রথম ট্রাম্পই এনেছিলেন। চীনের (China) উপর নরম হওয়ার অভিযোগ উঠলেও, ট্রাম্প যদি ক্ষমতায় এসে চীনের উপর নতুন করে বাণিজ্য শুল্ক (trade tariffs) আরোপ করেন, তবে টিকটক বিতর্কের বিষয়টি চাপা পড়ে যাবে। এদিকে ট্রাম্পের সমর্থকরা সম্ভবত তার এই অবস্থান পরিবর্তনকে ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখবে। তবে আগামী একশ দিনের (hundred days) মধ্যে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটবে, যা হয়তো টিকটক বিতর্কের চেয়েও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হবে। ট্রাম্পের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের জন্য নীতি পরিবর্তন করা অস্বাভাবিক কিছু নয়, এবং তার সমর্থকরা এটা মেনে নিতে অভ্যস্ত।

তাই সব মিলে বলা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্প নিঃসন্দেহে এই সপ্তাহের সবচেয়ে বড় জয়ীদের (Biggest Winner) মধ্যে অন্যতম।

ফ্রান্সের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: ম্যাক্রোঁর জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ও বিশ্বে বামপন্থীদের দুর্বল অবস্থানের ট্রেন্ড

এরপর ফ্রান্সের (France) প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে (Emmanuel Macron) এই সপ্তাহের আরেকজন উইনার হিসেবে ঘোষণা করা যায়। সম্প্রতি ফরাসি পার্লামেন্টে (French Parliament) বামপন্থী জোট (left-wing coalition) প্রধানমন্ত্রী গ্যাব্রিয়েল আত্তালকে (Gabriel Attal) ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ম্যাক্রোঁর জন্য এটা একটা বড় রাজনৈতিক সাফল্য। গত কয়েক মাস ধরে ফ্রান্সে রাজনৈতিক অস্থিরতা (political instability) চলছিল, এবং এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর উপর অনাস্থা প্রস্তাব (motion of no confidence) ব্যর্থ হওয়া ম্যাক্রোঁকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে।

বামপন্থী জোট চারটি দল নিয়ে গঠিত হলেও, সোশ্যালিস্ট পার্টি (Socialist Party), যারা এই জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল, শেষ মুহূর্তে অনাস্থা প্রস্তাবের (motion of no confidence) বিপক্ষে ভোট দেয়।  সোশ্যালিস্টদের এই পদক্ষেপ বামপন্থী জোটকে দুর্বল করে দিয়েছে, এবং এর ফলে ম্যাক্রোঁ সরকার বাজেট (budget) পাসের ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা পাবে। কারণ এখন মনে হচ্ছে বিরোধী জোটের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে, এবং বাজেট নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধান সম্ভব হতে পারে।

ফরাসি বামপন্থীদের মধ্যে বিভেদ নতুন কিছু নয়। প্রশ্ন হলো এই বিভেদ কি দীর্ঘস্থায়ী হবে, নাকি তারা আবার একত্রিত হতে পারবে। গত কয়েক বছরে তারা বহুবার নিজেদের মধ্যে কোন্দলে জড়িয়েছে, আবার কখনো কখনো রাজনৈতিক প্রয়োজনে জোটও বেঁধেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ (Ukraine war) এবং গাজা সংঘাতের (Gaza conflict) মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। গত বছর অপ্রত্যাশিত জাতীয় নির্বাচনের (national election) কারণে তারা বাধ্য হয়ে জোটবদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ঐক্য বজায় রাখা কঠিন হবে।

সোশ্যালিস্ট পার্টি হয়তো ২০২৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে (Presidential election) সামনে রেখে এখন থেকে নিজেদের আলাদা রাজনৈতিক পরিচিতি (political identity) তৈরি করতে চাইছে। তারা হয়তো মনে করছে জোটের অংশীদার হয়ে থাকার চেয়ে এককভাবে নির্বাচনে অংশ নিলে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে পারে। তবে বামপন্থীরা যদি আলাদাভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, তাহলে তাদের ভোট ভাগাভাগি হয়ে যাবে, এবং এর সুযোগ নিয়ে মধ্য-ডানপন্থী (center-right) এবং ডানপন্থী (right-wing) দলগুলো লাভবান হবে।

ফরাসি রাজনীতিতে (French politics) স্থিতিশীলতা ফিরে আসা এখনো অনেক দূরের পথ। বামপন্থীদের এই দুর্বলতার উদাহরণ কেবল ফ্রান্সে নয়, বরং এটা বৈশ্বিক। স্পেনের (Spain) রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে তুলনা করে বলা যায়, ফ্রান্সের মতো স্পেনেও রাজনৈতিক বিভাজন দেখা যাচ্ছে, এবং অদূর ভবিষ্যতে এই দেশগুলোতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে কিনা, তা বলা কঠিন। স্পেনের (Spain) রাজনৈতিক অস্থিরতাও (political instability) এখন বেশ তুঙ্গে। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজও (Pedro Sanchez) বর্তমানে রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছেন এবং তার সরকার দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এদিকে জার্মানির (Germany) বামপন্থী দলগুলোও (left-wing parties) দুর্বল হয়ে গেছে। জার্মানির বামপন্থী দল ডি লিঙ্কে (Die Linke) বর্তমানে অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে এবং তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার। একসময় ইউরোপের (Europe) রাজনীতিতে দুটি প্রধান দলের (two-party system) প্রাধান্য ছিল, কিন্তু বর্তমানে সেই কাঠামো ভেঙে গেছে। বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন বাড়ছে, এবং এর ফলে বামপন্থী দলগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে।

এই পরিস্থিতিতে ভোটাররা (voters) হয়তো শেষ পর্যন্ত নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থেই দুটি প্রধান দলের দিকে ঝুঁকবে। কারণ বহু দলীয় ব্যবস্থায় (multi-party system) ভোট ভাগাভাগি হয়ে যায়, এবং কোনো দলের পক্ষেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা (majority) পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তবে ফরাসি বামপন্থীদের (French left) প্রসঙ্গে বলা যায়, বিভিন্ন দল হয়তো জোটবদ্ধ রাজনীতির (coalition politics) সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করতে পেরেছে, এবং তারা হয়তো আবার এককভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠার চেষ্টা করবে।

প্রশ্ন হচ্ছে বামপন্থীদের মধ্যে এই বিভাজন কি শুধুমাত্র ফ্রান্সের (France) চিত্র, নাকি এটা সমগ্র ইউরোপের (Europe) রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। বামপন্থীদের মধ্যে বিভাজন হয়তো একটু বেশি প্রকট হলেও, ডানপন্থী দলগুলোর (right-wing parties) মধ্যেও বিভাজন দেখা যাচ্ছে। বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে আদর্শগত (ideological) এবং নীতিগত (policy-based) মতপার্থক্য বেশি থাকার কারণে তাদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

রাজনৈতিক বিভাজনের (political fragmentation) কারণ হিসেবে বিশ্বায়নের (globalization) প্রভাবের কথাও উল্লেখ করা যায়। বর্তমান বিশ্বায়িত বাজার অর্থনীতিতে (globalized market economy) মধ্য-বামপন্থী (center-left) রাজনীতি করা অত্যন্ত কঠিন। কারণ সম্পদ পুনর্বণ্টন (wealth redistribution) এবং সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের মতো বামপন্থী নীতিগুলো কার্যকর করতে হলে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির (international economics) কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। ফ্রান্সের (France) উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, সেখানেও সমাজতান্ত্রিক সরকারগুলো (socialist governments) অর্থনৈতিক চাপ এবং আন্তর্জাতিক ঋণের (international debt) বোঝায় জর্জরিত ছিল।

কিউবার (Cuba) উদাহরণ টেনে বলা যায়, দেশটি বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন থেকেও বামপন্থী রাজনৈতিক মডেল (political model) ধরে রেখেছে। চীনের (China) প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলা যায়, চীন এখনো পর্যন্ত তাদের অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ (state control) বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে, যা পশ্চিমা দেশগুলোর (western countries) জন্য প্রায় অসম্ভব। বিশ্বায়ন এবং মুক্ত বাজার ব্যবস্থা (free market system) বামপন্থী রাজনীতির জন্য একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

যাই হোক, সব মিলে বলা যায় ম্যাক্রোঁ এই সপ্তাহে একজন উইনার।

আরও পড়ুন –

লুজাররা: ক্রিস্টারসেন, নেতানিয়াহু, পুতিন

সুইডেনের প্রধানমন্ত্রীর পতন? উল্ফ ক্রিস্টারসেনের রাজনৈতিক সংকট

সুইডেনের (Sweden) প্রধানমন্ত্রী উল্ফ ক্রিস্টারসেন (Ulf Kristersson) এই সপ্তাহের একজন লুজার ধরা যায়। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, ক্রিস্টারসেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (national security advisor) হেনরিক ল্যান্ডারহোমের (Henrik Landerholm) সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারি এবং অন্যান্য বিতর্কিত বিষয়গুলো। ল্যান্ডারহোমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় গোপন নথি (classified documents) সরিয়ে ফেলার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, এবং তিনি ব্যক্তিগত ভ্রমণের জন্য সরকারি তহবিল (government funds) ব্যবহার করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এই ধরনের কেলেঙ্কারি (scandal) যেকোনো সরকারের জন্যেই খারাপ বার্তা বহন করে।

উল্ফ ক্রিস্টারসেনের (Ulf Kristersson) দল সুইডিশ পার্লামেন্টে (Swedish Parliament) সংখ্যালঘু সরকার (minority government) পরিচালনা করছে, এবং তার ব্যক্তিগত জনসমর্থনও (public approval) খুব বেশি নয়। সব মিলিয়ে ক্রিস্টারসেনের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ (political future) বেশ অনিশ্চিত মনে হচ্ছে। সুইডেনে অভিবাসন সংকট (migration crisis) এবং ধীরগতির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (slow economic growth) ক্রিস্টারসেনের সরকারের জন্য অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

সব মিলে সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী উল্ফ ক্রিস্টারসেনের (Ulf Kristersson) রাজনৈতিক অবস্থান বর্তমানে দুর্বল হয়ে পড়েছে, এবং তাকে ‘ডাউনস’ অর্থাৎ লুজারদের তালিকাতেই রাখা যুক্তিযুক্ত হবে।

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দুর্বল নেতৃত্ব

ইজরায়েলের (Israel) প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে (Benjamin Netanyahu) এই সপ্তাহের লুজার হিসেবে ঘোষণা করা যায়। যদিও নেতানিয়াহুর গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি (Gaza ceasefire agreement) এবং জিম্মি মুক্তি (hostage release) আপাতদৃষ্টিতে ইতিবাচক ঘটনা, সামগ্রিকভাবে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক নেতৃত্ব (political leadership) বর্তমানে দুর্বল হয়ে পড়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচ্ছন্ন চাপের কাছে নতি স্বীকার করে নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে বাধ্য হয়েছেন, যা আন্তর্জাতিক মহলে তার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে। গাজায় (Gaza) হামাসের (Hamas) সামরিক শক্তি এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী, এবং ইজরায়েল তার সামরিক অভিযানের (military operation) মূল লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। হামাসকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা বা দুর্বল করার উদ্দেশ্য সফল হয়নি। এই সকল কারণ বিবেচনায় নেতানিয়াহুকে এই সপ্তাহের লুজার বলাই যুক্তিযুক্ত।

গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলেও গাজার (Gaza) দীর্ঘমেয়াদী ভবিষ্যৎ শাসন ব্যবস্থা (governance) নিয়ে এখনো কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেই। নেতানিয়াহু বা তার সরকার কোনো বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রস্তাব দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে গাজায় আরও বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকট (political crisis) সৃষ্টি হতে পারে।

যুদ্ধবিরতির পর ইজরায়েলের ডানপন্থী (right-wing) রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে এবং বেন গভিরের (Ben Gvir) মতো কট্টরপন্থী (hardline) মন্ত্রীদের পদত্যাগের গুজবের কারণে নেতানিয়াহুর জোট সরকার (coalition government) আরও দুর্বল হয়ে যেতে পারে। তবে জনমত সমীক্ষায় (opinion polls) দেখা যাচ্ছে নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টি (Likud party) এখনো যথেষ্ট জনপ্রিয়, এবং আগামী নির্বাচনে (elections) ভালো ফল করার সম্ভাবনা রাখে।

নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ মূলত গাজার দীর্ঘমেয়াদী পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল। হামাস (Hamas) যদি গাজায় তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি ধরে রাখতে সক্ষম হয়, তাহলে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক সমস্যা আরও বাড়বে। পাশাপাশি, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন প্রশাসনের সাথে নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক (political relationship) কেমন হবে, সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ট্রাম্প হয়তো নেতানিয়াহুর উপর আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করতে পারেন, অথবা ইজরায়েলের (Israel) উপর নতুন কোনো শর্ত (conditions) চাপিয়ে দিতে পারেন। নেতানিয়াহুর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ইজরায়েলি সরকারের ডানপন্থী এবং কট্টরপন্থী অংশীদারদের সামলানো, যারা কোনো ধরনের রাজনৈতিক আপোষে (political compromise) রাজি নয় এবং তাদের দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক লক্ষ্য (political goals) যে কোনো মূল্যে অর্জন করতে চায়।

গত বছরের ৭ই অক্টোবরের নজিরবিহীন হামলার (attack) পরেও নেতানিয়াহু এখনো পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে আছেন, এটাই হয়তো সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়। তবে এই সপ্তাহে তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুর্বল হয়েছে, এবং তাই তাকে লুজারদের তালিকাতেই গণ্য করা উচিত।

আরও পড়ুন – ট্রাম্প কি ইসরায়েলকে শান্তিচুক্তিতে বাধ্য করলেন? (২০ জানুয়ারি, ২০২৫)

ভ্লাদিমির পুতিনের রাজস্ব সংকট

এই সপ্তাহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে (Vladimir Putin) লুজার হিসেবে ঘোষণা করা যায়। ইউক্রেন যুদ্ধের দীর্ঘসূত্রিতা এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার জ্বালানি খাত (energy sector) বর্তমানে গভীর সংকটে নিমজ্জিত। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় রাজস্বের (state revenue) প্রধান উৎস হলো জ্বালানি তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানি (oil and gas exports), কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোর একের পর এক নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার এই আয়ে বড় ধরনের ধস নেমেছে। বিশেষ করে, আমেরিকার নতুন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাগুলো (economic sanctions) রাশিয়ার তেল কোম্পানিগুলোর (oil companies) উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। পুতিন প্রশাসন এতদিন ধরে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো এড়িয়ে যেতে সক্ষম হলেও, বর্তমানে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত একটি অর্থনৈতিক রিপোর্টে (economic report) দেখা গেছে যে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের বিশাল সামরিক ব্যয় (military expenses) মেটানোর জন্য রাষ্ট্রীয় বাজেট (state budget) এর পরিবর্তে বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণের (commercial bank loans) উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। রাশিয়ার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো (commercial banks) বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা কোম্পানিকে (state-owned defense companies) ঋণ দিতে বাধ্য হয়েছে, যা অর্থনৈতিকভাবে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ভবিষ্যতে এই ব্যাংকগুলোতে ব্যাপক ঋণ খেলাপি (loan defaults) হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এবং এর ফলে রাশিয়ার অর্থনীতি (economy) দীর্ঘমেয়াদী সংকটে পতিত হতে পারে।

পুতিনের ইউরোপীয় মিত্রদের (European allies) দুর্বল হয়ে যাওয়ার বিষয়টিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। সার্বিয়ার মতো দেশ, যারা দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত ছিল, তারাও এখন ধীরে ধীরে রাশিয়ার উপর থেকে অর্থনৈতিক নির্ভরতা (economic dependence) কমানোর চেষ্টা করছে। সার্বিয়ার গ্যাস ও তেল শিল্পে রাশিয়ার যে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল, তা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

সাংস্কৃতিক প্রভাবের (cultural influence) দিক থেকেও ভ্লাদিমির পুতিন (Vladimir Putin) দুর্বল হয়ে পড়ছেন। একসময় পুতিনকে পশ্চিমা বিশ্বে (western world) ‘শক্তিশালী নেতা’ (strong leader) হিসেবে গণ্য করা হলেও, ইউক্রেন যুদ্ধের (Ukraine war) পর সেই ধারণা সম্পূর্ণভাবে পাল্টে গেছে। পুতিনপন্থী (pro-Putin) বুদ্ধিজীবী (intellectuals) এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও (political analysts) এখন আর সরাসরি পুতিনের প্রশংসা না করে ‘শান্তিকামী’ (pro-peace) অথবা ‘নিরপেক্ষ’ (neutral) হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন।

এসব কারণে ভ্লাদিমির পুতিনকে (Vladimir Putin) এই সপ্তাহের লুজার হিসেবে ঘোষণা করা যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ট্রেজারি সেক্রেটারি (Treasury Secretary) পদে মনোনীত স্কট বেসান্ট (Scott Besant) সম্প্রতি রুশ নিষেধাজ্ঞার (Russian sanctions) বিষয়ে যে কঠোর মন্তব্য করেছেন, তা পুতিনের জন্য আরও একটি খারাপ সংকেত। ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেন ইস্যুতে বাইডেন প্রশাসনের (Biden administration) তুলনায় আরও কঠোর নীতি (tougher policy) অনুসরণ করতে পারে, এমন সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে।

আরও দেখুন –

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.