যুক্তরাজ্যে কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রধান বাডেনকের ব্যর্থতার পেছনের কারণ ও ক্ষমতাচ্যুত হবার সম্ভাবনা

ভূমিকা

১৬ই জানুয়ারি কেমি ব্যাডেনক একটি বক্তৃতা দেন, যা তার নেতৃত্বের একটি নতুন দিকনির্দেশনা বা স্পষ্টতা দেওয়ার চেষ্টা ছিল। যারা যুক্তরাজ্যের রাজনীতি অনুসরণ করেন তারা জানেন যে গত বছর সাধারণ নির্বাচনে ঐতিহাসিক পরাজয়ের পর কনজারভেটিভ পার্টি জনমত সমীক্ষায় তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি। এমনকি তারা তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে সর্বনিম্ন সংখ্যক আসনে নেমে এসেছে। 

ইংল্যান্ডের কনজারভেটিভ পার্টির এই নতুন নেতা হিসেবে কেমি বাডেনক (Kemi Badenoch) দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মাত্র কয়েক মাস পেরিয়েছে। গত বছরের নভেম্বর মাসে তিনি দলনেতা নির্বাচিত হন। দলনেতা হিসেবে তিনি এখনো উল্লেখযোগ্য কোনো ইতিবাচক ছাপ ফেলতে পারেননি বলেই ধারণা করছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

বর্তমানে ক্ষমতাসীন লেবার পার্টি জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে, আর টোরি বা কনজারভেটিভদের (Tories) জনপ্রিয়তা দিন দিন কমছে। মতামত জরিপগুলোও (Polls) জানাচ্ছে, বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন—কনজারভেটিভরা এখনো সঠিকভাবে সরকার পরিচালনার জন্য প্রস্তুত নয়। এমনকি ব্যক্তি বাডেনককেও অনেকে সম্ভাব্য একজন ভালো প্রধানমন্ত্রী (Prime Minister) হিসেবে ভাবতে পারছেন না।

এসবের পেছনে মূল সমস্যা হিসেবে উঠে আসছে বাডেনকের রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা (Inaction)। দলনেতা নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এখনো পর্যন্ত তিনি সুস্পষ্ট কোনো নীতি (Policy) বা দিকনির্দেশনা (Vision) দেননি। এমনকি মিডিয়ার (Media) সাথে খোলামেলা আলাপচারিতায়ও তিনি অনাগ্রহী, ব্যতীত ডানপন্থী ম্যাগাজিন ‘দ্য স্পেকটেটর’ (The Spectator)-এর সঙ্গে মাঝে মধ্যে কথোপকথন। স্পেকটেটর পত্রিকায় বাডেনক পূর্বে কাজও করেছেন।

ফলে, বিভিন্ন গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন—এই অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বাডেনকের নেতৃত্ব নড়বড়ে অবস্থায় পড়েছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে আগামী সাধারণ নির্বাচনে (General Election) কনজারভেটিভদের নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ তিনি নাও পেতে পারেন।

অতীত প্রেক্ষাপট: কিভাবে এখানে এলাম

বরিস জনসন (Boris Johnson) ও ক্রিস পিনচার (Chris Pincher) কেলেঙ্কারির পরিণতি: গত কয়েক বছরে যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ পার্টি (Conservative Party) একাধিক বড় কেলেঙ্কারিতে (Scandal) জড়িয়ে জনসমর্থন হারিয়েছে। বরিস জনসন (Boris Johnson) প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ক্রমাগত বিতর্ক ও কেলেঙ্কারি সত্ত্বেও তার জনপ্রিয়তা বেশ কিছুদিন স্থিতিশীল ছিল। তবে ক্রিস পিনচার (Chris Pincher) কেলেঙ্কারি সামনে আসার পর ব্যাপক সংখ্যায় মন্ত্রী-এমপি পদত্যাগ করেন। এরপর জনসনকে বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়। এই ঘটনাপ্রবাহ দেখায় যে, জনগণ কনজারভেটিভদের উপর আস্থা হারাতে শুরু করেছে। জনসনের নানা বিতর্কের সঙ্গে দলও জড়িয়ে পড়ে। ফলে সার্বিকভাবে টোরিদের জনপ্রিয়তার ধস নামে।

লিজ ট্রাস (Liz Truss) ও ঋষি সুনাক (Rishi Sunak) পর্ব: বরিস জনসনের বিদায়ের পর লিজ ট্রাস (Liz Truss) খুব স্বল্প সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে আসেন। তার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং বাজেট-ঘোষণা অস্থিরতা তৈরি করে, যার জেরে পাউন্ডের মান পড়ে যায় এবং আর্থিক খাতে চাপ বেড়ে যায়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনিও পদত্যাগে বাধ্য হন। পরবর্তী সময়ে ঋষি সুনাক (Rishi Sunak) প্রধানমন্ত্রী হন এবং কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু দলীয় বিভক্তি, জনসনের উত্তরাধিকার থেকে যাওয়া নানা বিতর্ক এবং লেবার পার্টির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণে সুনাকের আমলেও দলকে চাঙ্গা করে তোলার সুযোগ তৈরি হয়নি।

বাডেনকের (Badenoch) আবির্ভাব: অবশেষে গত বছর (নভেম্বর ২০২৪) দলনেতা নির্বাচনে এগিয়ে এসে কেমি বাডেনক (Kemi Badenoch) কনজারভেটিভ পার্টির নতুন নেতা হন। সেই সময়ে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, দলকে আরো ডানপন্থী (Right Wing) ঘরানায় পরিচালিত করবেন। ব্রেক্সিট (Brexit) পরবর্তী সময়ে দলটিকে তিনি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ করবেন বলে জানান। পর্যবেক্ষকরা মনে করেছিলেন, বাডেনক হয়তো সংস্কারবাদী (Reformist) ডানপন্থী নেতা নাইজেল ফারাজ (Nigel Farage) ও তার দল রিফর্ম ইউকের (Reform UK) চ্যালেঞ্জকে সরাসরি মোকাবেলা করবেন। কারণ রিফর্ম, মূলত ব্রেক্সিট-পরবর্তী ব্রিটেনের জন্য আরও কট্টর ডানপন্থী অবস্থানের পক্ষে কথা বলে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত বাডেনক সেই প্রত্যাশিত সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন বলে মনে হচ্ছে না।

বাডেনকের রাজনীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি (Badenoch’s Politics and Vision)

নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি: বাডেনক দলনেতা হওয়ার আগেই বেশ কয়েকটি সুস্পষ্ট ডানপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল—

  • সংস্কৃতির (Culture) প্রশ্নে দৃঢ় অবস্থান: তিনি বলেছিলেন, সব সংস্কৃতি সমানভাবে ‘বৈধ’ বা ‘সমমানের’ নয়। অর্থাৎ, ধ্রুপদী ব্রিটিশ রক্ষণশীল মূল্যবোধকে (Conservative Values) সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলেছিলেন।
  • ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়ন্ত্রণমুক্তির (Deregulation) পক্ষে অবস্থান: দীর্ঘকাল ধরে রক্ষণশীল রাজনীতির অন্যতম আগ্রহ হলো ব্যবসার ওপর সরকারি বিধিনিষেধ (Regulation) কমানো। বাডেনক মনে করেন, অতিরিক্ত বিধিনিষেধের চাপে অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বা কাজ চালিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছে।
  • আন্তর্জাতিক ফ্রেমওয়ার্ক ত্যাগের হুমকি: ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটস (European Court of Human Rights) কিংবা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো (International Framework) যুক্তরাজ্যের স্বার্থের বিরুদ্ধাচরণ করলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার কথাও তিনি বলেছিলেন।

নতুন নেতৃত্ব, নতুন দিক (New Direction): নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি জোর দিয়েছিলেন যে, আগের নেতাদের (বিশেষ করে বরিস জনসন ও ঋষি সুনাক) করা ভুল থেকে বেরিয়ে এসে দল নতুন পথে অগ্রসর হবে। ডানপন্থী সদস্যরাও আশাবাদী হয়েছিলেন যে, দলের কেন্দ্রীয় অবস্থান না রেখে আরও কট্টর ডানপন্থী (Hard Right) নীতিতে যাবে। রিফর্ম ইউকের (Reform UK) জনপ্রিয়তাকে রুখে দেওয়ার জন্য এমন পদক্ষেপ জরুরি বলেই তারা মনে করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাস্তবে বড় কোনো নীতিগত পরিবর্তন দেখা যায়নি। যেসব হালকা-পাতলা সমালোচনা বা আক্রমণ তিনি লেবার সরকারের বিরুদ্ধে করেছেন, সেগুলো বরং খুব প্রচলিত ধরনের। সংবাদমাধ্যমেও তার উপস্থিতি তুলনামূলক কম।

ফারাজের জনপ্রিয়তা ও ব্যাডেনক এর নেতৃত্ব

বর্তমানে, রিফর্ম ইউকে (Reform UK) নামক একটি দল জনমত সমীক্ষায় কনজারভেটিভ পার্টিকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নাইজেল ফারাজ (Nigel Farage) এখনও যুক্তরাজ্যে বেশ জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, যদিও তিনি বিতর্কিত, তবে কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে তার জনপ্রিয়তা যথেষ্ট। কেউ কেউ যুক্তি দিতে পারেন যে নাইজেল ফারাজ যুক্তরাজ্যের ডানপন্থীদের কেমি ব্যাডেনকের চেয়ে ভালো প্রতিনিধিত্ব করেন। কেমি ব্যাডেনক বর্তমানে তার নেতৃত্ব নিয়ে সমালোচিত হচ্ছেন, বিশেষ করে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে না পারার জন্য। তার বক্তৃতাটি ছিল এসব সমালোচনা দূর করার এবং কনজারভেটিভদের জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারের একটি প্রচেষ্টা। কিন্তু মনে হয় না তিনি তা পেরেছেন।

কনজারভেটিভ পার্টি এখন প্রধান বিরোধী দল, কিন্তু তারা সরকারের পাশাপাশি রিফর্ম ইউকের (Reform UK) সঙ্গেও প্রচারের আলো কাড়ার জন্য লড়ছে। ব্যাডেনক যখন দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, তখন কনজারভেটিভ পার্টি বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত ছিল। নির্বাচনে এমন ঐতিহাসিক পরাজয়ের পর দলের মধ্যে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

সমস্যাটা কোথায়?

মিডিয়া ইনভিজিবিলিটিতে মগ্ন একজন নেতা: বাডেনকের বড় সমালোচনা হলো—তিনি যথেষ্ট জনসমক্ষে আসছেন না, মিডিয়ার সঙ্গেও বেশি কথা বলছেন না। বিশেষ করে, লেবার সরকারের নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠার বদলে, বেশিরভাগ সময়ে বাইরে থেকে সামান্য বিবৃতি দিয়েই চুপ থাকছেন। অন্যদিকে, নাইজেল ফারাজের মতো ডানপন্থী ব্যক্তিত্ব গণমাধ্যমে নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করছেন। কৃষক বিক্ষোভ (Farmers’ Protests), ব্যবসায়ী সংগঠনের উদ্বেগ, বিভিন্ন সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় বক্তব্য—এসব ক্ষেত্রে ফারাজ অনেক বেশি আলোচনায় রয়েছেন। এটা রিফর্ম ইউকের পক্ষে কাজ করছে এবং তাদের জনসমর্থনও বাড়ছে।

কোনো স্পষ্ট নীতিগত পদক্ষেপ নেই: যে বাডেনক নেতা নির্বাচিত হওয়ার আগে নিজেকে আরও রক্ষণশীল আদর্শের ‘কণ্ঠস্বর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন, তিনি এখনো পর্যন্ত তেমন কোনো কার্যকর নীতি প্রস্তাব বা রোডম্যাপ দেননি।

  • তিনি বলেছেন, “আমি জনগণকে কঠিন সত্য (Hard Truth) জানাব,” কিন্তু কীভাবে সমস্যার সমাধান করতে চান সেই বাস্তব পরিকল্পনা উপস্থাপন করেননি।
  • তিনি উচ্চমাত্রায় ইমিগ্রেশন (High Immigration), ব্যবসার ওপর অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ (Regulation) এবং ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের (ECHR) প্রভাব ইত্যাদি নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে কী করবেন তা স্পষ্ট নয়।

অনেকের ধারণা, তিনি ভাবছেন ২০২৭ সালের আগে কোনো বড় নীতি ঘোষণার প্রয়োজন নেই। কেননা সম্ভবত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন ২০২৯ সালের আগে হবে না। তাই এখনই সবকিছু উন্মুক্ত করে দিলে রাজনৈতিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে—এমন হতে পারে তার কৌশল।

লেবার সরকারের বিরোধিতায় ব্যর্থতা: এখন যুক্তরাজ্যে ক্ষমতাসীন লেবার সরকারের নীতির বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নেওয়া উচিত ছিল টোরিদের। বিশেষ করে, কৃষি খাতে (Farming Sector) সরকারের কিছু নীতি নিয়ে বিতর্ক চলার সময়ে বাডেনককে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়নি। বরং নাইজেল ফারাজ ও তার রিফর্ম দল সামনে থেকে কৃষকদের সাথে মিশে তাদের বক্তব্য প্রচার করেন। ফলে লেবার-বিরোধী (Anti-Labour) ভোকাল শূন্যতা আংশিকভাবে রিফর্ম ইউকে পূরণ করে চলছে। অনেক রক্ষণশীল সমর্থক দেখছেন, বাডেনক কথা বলছেন কম; অন্যদিকে ফারাজ যথেষ্ট সরব। এরফলে তারা ভাবছেন, হয়তো রিফর্ম ইউকেই বাস্তবে ডানপন্থীদের মুখপাত্র।

জরিপের (Polls) ফলাফল ও জনমত

জনমত সমীক্ষায়ও কেমি ব্যাডেনকের (Kemi Badenoch) জনপ্রিয়তা তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। ইউগভের (YouGov) একটি সমীক্ষায় পছন্দের প্রধানমন্ত্রীর তালিকায় নাইজেল ফারাজ (Nigel Farage) কেইর স্টারমারকেও (Keir Starmer) ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। তবে সেখানে “জানি না” উত্তরদাতাদের সংখ্যাও অনেক বেশি ছিল। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ব্যাডেনক এড ডেভির (Ed Davey) সঙ্গে তৃতীয় স্থানের জন্য লড়ছিলেন, যা তার জন্য ভালো লক্ষণ নয়।

যদিও নির্বাচন এখনো অনেক দূরে, সুনির্দিষ্ট নীতি ঘোষণা করার জন্য তাড়াহুড়ো নেই। তবে ব্যাডেনক সম্ভবত নির্বাচনে ক্ষমতা হারানোর চেয়ে দলের ভেতরে নেতৃত্ব হারানোর বিষয়ে বেশি চিন্তিত। ইতিহাস বলে, যদি তিনি দ্রুত পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে না পারেন, তাহলে খুব শীঘ্রই ক্ষমতাচ্যুত হতে পারেন। কাউন্সিল নির্বাচন এবং ওয়েলশ নির্বাচন (Welsh elections) তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হতে পারে।

জরিপে পিছিয়ে পড়া: লম্বা সময় ধরে, কনজারভেটিভরা বিরোধী দলে থাকার ফলে স্বাভাবিকভাবেই জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। কিন্তু প্রথাগতভাবে দেখা গেছে, নতুন নেতা এলে দল সাময়িকভাবে হলেও জনমতে বেশ খানিকটা উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারে। বাডেনকের ক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি।

  • বিভিন্ন সর্বশেষ জরিপে (Opinion Polls) দেখা যাচ্ছে, রিফর্ম ইউকে প্রায়ই কনজারভেটিভদের চেয়েও এগিয়ে বা কমপক্ষে সমান জনপ্রিয় হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
  • অনেক ভোটার, যারা আগে কনজারভেটিভদের সমর্থক ছিলেন, এখন খোলাখুলিভাবে রিফর্ম ইউকে-র দিকে ঝুঁকছেন বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন।

ডানপন্থী ভোটের বিভক্তি: ঐতিহ্যগতভাবে রক্ষণশীল বা ডানপন্থী ভোটাররা (Right-wing Voters) বেশিরভাগ সময় কনজারভেটিভ পার্টিকেই ভোট দিয়েছেন। ব্রেক্সিটের সময়ে ইউকিপ (UKIP) এবং পরবর্তীতে ব্রেক্সিট পার্টির (Brexit Party) উত্থান কিছুটা ডানপন্থী ভোটে ভাগ ঘটালেও, শেষ পর্যন্ত বরিস জনসন ২০১৯ সালের নির্বাচনে বড় জয় এনে দেন। এখন আবার রিফর্ম ইউকে এই ভোটভিত্তির একটা উল্লেখযোগ্য অংশকেই আকৃষ্ট করছে—বিশেষ করে যারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার পরও আরও কঠোর অবস্থান (Hardline Stance) প্রত্যাশা করেছিলেন, কিন্তু কনজারভেটিভদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে হতাশ।

কৃষক বিক্ষোভ (Farmers’ Protests) ও ফারাজের (Farage) উদাহরণ

কৃষক বিক্ষোভের পটভূমি: বর্তমান লেবার সরকারের বিভিন্ন নীতি, বিশেষ করে কৃষি-ভিত্তিক ভর্তুকি ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদন সংক্রান্ত কঠোর বিধিনিষেধ, কিছু কৃষকের মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। তারা মনে করছেন, স্থানীয় কৃষকদের তুলনায় বড় করপোরেশন বা আমদানি নির্ভর ব্যবস্থাকে সরকার সুবিধা দিচ্ছে। এ নিয়ে একাধিক অঞ্চলে কৃষকরা বিক্ষোভ করছেন।

ফারাজের কার্যক্রম: নাইজেল ফারাজের (Nigel Farage) নেতৃত্বে রিফর্ম ইউকে সরাসরি মাঠে নেমে কৃষকদের পাশ দাঁড়িয়েছে। ফারাজ বিভিন্ন খামার (Farms) পরিদর্শন করছেন, তাদের সমস্যার কথা শুনছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় (Social Media) ভিডিও প্রকাশ করছেন। এসব ভিডিও ও সাক্ষাৎকার টিভিতে প্রচারিত হচ্ছে। এতে ফারাজকে এক ধরনের ‘সক্রিয় বিরোধী কণ্ঠস্বর’ হিসেবে গণমাধ্যমে উপস্থাপন করা হচ্ছে।

বাডেনকের অনুপস্থিতি: এই পুরো সময়ে বাডেনক ও তার টোরি দলের দৃশ্যমান অবস্থান ছিল খুবই কম। মিডিয়ায় গুরুত্ব পেতে হলে, জনপ্রিয় জনআন্দোলন বা অসন্তোষকে কন্ঠ দেওয়া দরকার। কিন্তু বাডেনক সেখানে এগিয়ে না এসে বরং নীরব থেকে গেছেন। ফলে, সাধারণ মানুষের চোখে ‘প্রকৃত ডানপন্থী বিরোধী কণ্ঠস্বর’ হিসেবে ফারাজের ভাবমূর্তি আরও শক্তিশালী হয়েছে। এটি রিফর্ম ইউকের পক্ষে কাজ করেছে এবং কনজারভেটিভদের সামগ্রিকভাবে পেছনে ফেলে দিয়েছে।

দলের অভ্যন্তরে বিভাজন ও ঐক্যবদ্ধ রাখার চ্যালেঞ্জ

নির্বাচনের পরপরই কনজারভেটিভ পার্টির মধ্যপন্থীরা বলতে শুরু করেন যে তারা খুব বেশি ডান দিকে ঝুঁকেছিলেন এবং সংস্কৃতি যুদ্ধ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করেছিলেন। অন্যদিকে, ডানপন্থীরা বলেন যে তারা যথেষ্ট ডানপন্থী ছিলেন না, বরং বেশি উদার ছিলেন। রিফর্ম পার্টি ডান দিকে তাদের থেকে বেশি সুবিধা নিয়েছে, যার কারণে তারা হেরেছেন। ব্যাডেনক যখন প্রথম নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, তখন তার প্রধান লক্ষ্য ছিল দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা।

নির্বাচনের পর অনেক মাস পেরিয়ে গেছে, দল এখনও মোটামুটি ঐক্যবদ্ধ আছে, কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো এই পার্টি আসলে কী চায়? বর্তমানে, যখনই লেবার পার্টি (Labour Party) কিছু করে, রিফর্ম ইউকে এবং নাইজেল ফারাজ তার সবচেয়ে ধারালো সমালোচনা করে এবং মিডিয়া তা তুলে ধরে। ডানপন্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে ফারাজের মতামতকেই যেন বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এখানেই ব্যাডেনক ব্যর্থ হচ্ছেন।

গত কয়েক মাসে ব্যাডেনক প্রধানত দুটি কারণে খবরে এসেছেন: প্রথমত, তার স্যান্ডউইচ (sandwich) পছন্দ নিয়ে মন্তব্য এবং দ্বিতীয়ত, রিফর্ম ইউকে তাদের সদস্য সংখ্যা জালিয়াতি করেছে বলে অভিযোগ করা, যা পরে ভুল প্রমাণিত হয়। ফারাজের রাজনৈতিক তৎপরতা অনেক বেশি আকর্ষণীয়। কৃষকদের বিক্ষোভের মতো বিষয়গুলোতে ফারাজ খুব দ্রুত এবং কার্যকরভাবে প্রতিক্রিয়া জানান। ট্রাম্পের (Trump) মতো, ফারাজও টিকটক (TikTok) এর মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সহজেই মানুষের কাছে তার বার্তা পৌঁছে দিতে পারেন। ব্যাডেনক এক্ষেত্রে পিছিয়ে আছেন এবং মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

জানুয়ারি ভাষণ (January Speech): কী ছিল বাডেনকের বার্তা?

ব্যাডেনকের বক্তৃতাটি মনোযোগ দিয়ে দেখলে কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়। তিনি বলেছেন যে লেবার পার্টি ভুল করেছে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে তিনি কনজারভেটিভ পার্টিও (Conservative Party) সরকারে থাকার সময় ভুল করেছে বলে স্বীকার করেছেন। তিনি কেইর স্টারমারের (Keir Starmer) সমালোচনা করে বলেছেন যে স্টারমার মনে করেন তিনি কখনো ভুল করেন না, কিন্তু তিনি (ব্যাডেনক) কনজারভেটিভ পার্টির ভুল স্বীকার করতে প্রস্তুত।

তবে সমালোচকরা বলছেন যে ব্যাডেনক শুধুমাত্র দলের ভুলের কথা স্বীকার করেছেন, কিন্তু সরকারের অংশ হিসেবে তিনি নিজে যে ভুলগুলো করেছেন, সে বিষয়ে কিছুই বলেননি। অথচ তিনি আগের সব কনজারভেটিভ সরকারেই গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন।

ব্যাডেনক পূর্ববর্তী কনজারভেটিভ নেতাদের কিছু নীতির সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (European Union) ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছিলাম, কিন্তু EU-এর বাইরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কোনো পরিকল্পনা আমাদের ছিল না।” এটি ডেভিড ক্যামেরন (David Cameron), থেরেসা মে (Theresa May) এবং বরিস জনসনের (Boris Johnson) প্রতি একটি পরোক্ষ সমালোচনা। তিনি আরও বলেন, “আমরা ২০৫০ সালের মধ্যে নেট জিরো (net zero) কার্বন নিঃসরণ (carbon emissions) অর্জন করার আইন তৈরি করেছি, কিন্তু কীভাবে তা করা হবে, তা নিয়ে পরে চিন্তা শুরু করেছি।” এটি থেরেসা মে-র (Theresa May) প্রতি সমালোচনা। এছাড়া, অভিবাসন কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা পূরণ করতে না পারার জন্য তিনি পূর্ববর্তী সব নেতাদের সমালোচনা করেন।

ব্যাডেনক বক্তৃতাতে লেবার পার্টি (Labour Party) এবং নিজের কনজারভেটিভ পার্টির সমালোচনা করেছেন, কিন্তু নিজের কোনো ভুল স্বীকার করেননি। তার বক্তৃতার মূল বিষয় ছিল: তিনি আলাদা এবং নতুন নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি সততার কথা বলেছেন এবং কনজারভেটিভদের ব্যর্থতা স্বীকার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু শুধু ব্যর্থতা স্বীকার করলেই হবে না, সমস্যা সমাধানের পথও দেখাতে হবে। অভিবাসন কমানোর বিষয়ে বড় কথা বলা সহজ, কিন্তু কিভাবে তা করা হবে, সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা দিকনির্দেশনা না থাকলে তা আগের নেতাদের মতোই ফাঁকা প্রতিশ্রুতি হয়ে থেকে যায়।

বক্তব্যের মূল প্রতিপাদ্য: ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫-এর এই ভাষণটিতে কেমি বাডেনক মূলত তিনটি বিষয় তুলে ধরেন—

  • ১. কনজারভেটিভ পার্টি এখন নতুন নেতৃত্বে (New Leadership)।
  • ২. দল মানুষের কাছে সত্য কথা বলবে, এমনকি তা শোনার পক্ষে “কঠিন” হলেও।
  • ৩. আগের নেতাদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশকে “ফিরিয়ে দেওয়ার” (Give Your Country Back) প্রতিশ্রুতি।

তিনি দেশে বিদ্যমান কয়েকটি সমস্যার কথা উল্লেখ করেন:

  • ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণের (Regulation) অতি-বোঝা বা ওভার-বার্ডেন,
  • শক্তি সরবরাহের (Energy Supply) অনিশ্চয়তা,
  • কম উৎপাদনশীলতা (Lack of Productivity),
  • ক্রমহ্রাসমান জন্মহার (Fertility Crisis),
  • বৈরী বিদেশি শক্তির হুমকি (Hostile Actors Abroad),
  • উচ্চমাত্রার অভিবাসন (High Immigration)।

অতঃপর তিনি বলেন, “আমরা তোমাদের দেশ তোমাদের হাতে ফেরত দেবো”—একটি ডানপন্থী শিবিরে বেশ পরিচিত ধ্বনি, যেটি নাইজেল ফারাজ ব্রেক্সিটের সময়ে “We Want Our Country Back” স্লোগানে ব্যবহার করেছিলেন। বাডেনক সেটিকে উল্টোভাবে কনজারভেটিভ আদলে পুনরায় ব্যবহার করলেন।

ফারাজকে (Farage) কৌশলে সমীহ: ভাষণ-পরবর্তী প্রশ্নোত্তর পর্বে (Q&A) বাডেনককে নাইজেল ফারাজ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি অত্যন্ত সতর্কভাবে তাকে সম্মানজনক ভাষায় উল্লেখ করেন। বোঝা যায়, তিনি ফারাজের বড় ধরনের সমালোচনা করতে চান না, বরং হয়তো তার সমর্থকদের টেনে আনতে চাচ্ছেন।

সীমাবদ্ধতা: অনেকে এই ভাষণকে আশা করেছিল বড় ধরনের নীতিগত (Policy) ঘোষণা বা অবস্থান গ্রহণের ইঙ্গিত হিসেবে। কিন্তু ভাষণে বাস্তবসম্মত কোনো কর্মপরিকল্পনা বা বিস্তারিত উপায় (Detailed Plan) প্রকাশিত হয়নি। বাডেনক শুধু জানান যে, ২০২৭ সালের আগে সম্ভাব্য কোনো ব্যাপক রোডম্যাপ দেবে না টরি পার্টি। ফলে, যারা আশা করছিলেন যে ভাষণের মাধ্যমে তিনি রিফর্ম ইউকের সঙ্গে ‘ভোট-যুদ্ধ’ (Battle for Votes) শুরু করবেন, তারা হতাশ হয়েছেন। কারণ, কেবল সমস্যা চিহ্নিত করাই যথেষ্ট নয়—বরং সেগুলোর সমাধানের রূপরেখা মানুষ জানতে চায়।

ফারাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন

ব্যাডেনক নাইজেল ফারাজের (Nigel Farage) প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার চেষ্টা করছেন। কিছুদিন আগে তিনি রিফর্ম ইউকের (Reform UK) সদস্য সংখ্যা নিয়ে সমালোচনা করে খবরে এসেছিলেন, যা বেশ সংকীর্ণ মনে হয়েছিল। এখন তিনি রিফর্ম ও ফারাজের প্রতি কিছুটা সম্মান দেখানোর চেষ্টা করছেন। বক্তৃতার প্রশ্নোত্তর পর্বে ফারাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন যে ফারাজের তার চেয়ে বেশি নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা আছে।

ব্যাডেনক বোঝাতে চেয়েছেন যে ফারাজ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারদর্শী, বিশেষ করে অভিবাসন নিয়ে। আর তিনি, একজন প্রকৌশলী (engineer) হিসেবে, সেই সমস্যাগুলো সমাধান করবেন। তিনি দাবি করছেন যে পূর্ববর্তী নেতারা সমস্যা চিহ্নিত করেছেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি সেগুলো সমাধান করবেন। তবে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনা ছাড়া এসব যুক্তি দুর্বল হয়ে যায়। অনেকেই আশা করেছিলেন যে এই বক্তৃতায় ব্যাডেনক তার কনজারভেটিভ পার্টির ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা তুলে ধরবেন, কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।

নীতি নির্ধারণে বিলম্ব

কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ব্যাডেনক মন্ত্রিসভাকে (cabinet) বলেছেন যে ২০২৭ সালের আগে কোনো নীতি ঘোষণার আশা করা উচিত নয়। নীতি প্রণয়নে বিলম্ব করা একটি কৌশল হতে পারে। কেইর স্টারমার (Keir Starmer) যখন লেবার (Labour) নেতা হয়েছিলেন, তখন তিনি প্রথমে দলকে পরিবর্তন এবং আস্থা পুনরুদ্ধারের উপর জোর দিয়েছিলেন, পরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে চেয়েছিলেন। তবে ব্যাডেনক এর জন্য এই কৌশল নাও কাজ করতে পারে, কারণ লেবার পার্টি ভুল করলে রিফর্ম ইউকের (Reform UK) মতো দল সেই সুযোগ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত।

কনজারভেটিভ পার্টির ঐতিহাসিক রীতি: ‘নেতাকে সরিয়ে দেওয়া’ (Toppling Leaders)

কনজারভেটিভ পার্টি (Conservative Party) এবং লেবার পার্টির (Labour Party) নেতৃত্ব পরিবর্তনের ইতিহাস ভিন্ন। কনজারভেটিভ পার্টিতে নেতৃত্ব পরিবর্তন খুব দ্রুত হয়, বিশেষ করে নির্বাচন হারার পর। ১৯৯৭ সালে টনি ব্লেয়ারের (Tony Blair) বিশাল জয়ের পর কনজারভেটিভ পার্টি তিনজন নেতা পরিবর্তন করে: উইলিয়াম হেগ (William Hague), ইয়ান ডানকান স্মিথ (Iain Duncan Smith) এবং মাইকেল হাওয়ার্ড (Michael Howard)। নেতারা জনমত সমীক্ষায় উন্নতি করতে না পারলে কনজারভেটিভ পার্টি দ্রুত নেতা পরিবর্তন করে। অন্যদিকে, লেবার পার্টি তাদের নেতাদের বেশি সময় দেয়। উদাহরণস্বরূপ, জেরেমি করবিন (Jeremy Corbyn) ২০১৭ সালের নির্বাচনে হারার পরও দলের নেতৃত্ব ধরে রেখেছিলেন।

কনজারভেটিভ পার্টিতে নেতা সরানো অনেক সহজ, কিন্তু লেবার পার্টিতে নেতা নির্বাচন ও প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া তুলনামূলকভাবে বেশি গণতান্ত্রিক। ইয়ান ডানকান স্মিথ (Iain Duncan Smith) যখন নেতা ছিলেন, তখন ২০০৩ সালের স্থানীয় নির্বাচনে খারাপ ফল করার পর ক্রিস্পিন ব্লান্ট (Crispin Blunt) তার পদত্যাগ দাবি করেছিলেন, কারণ স্মিথ ভোটারদের মন জয় করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। নেতারা দলকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হলে কনজারভেটিভ পার্টিতে তাদের নেতৃত্ব হারানোর ঝুঁকি থাকে।

ঐতিহাসিক উদাহরণ: কনজারভেটিভরা (Tories) দলের মধ্যে অজনপ্রিয় বা ব্যর্থ নেতা বহাল রাখার ক্ষেত্রে বরাবরই কঠোর আচরণ করেছে। উইলিয়াম হেগ (William Hague), যিনি নিজে একসময় দলের নেতা ছিলেন, বলেছিলেন, “কনজারভেটিভ পার্টি হল এক absolute monarchy যা regicide (নেতা অপসারণ বা রক্তপাতহীন ‘রাজহত্যা’) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।” অর্থাৎ, দলের এমপিরা (MPs) বা শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা যদি দেখেন যে নেতা জনপ্রিয়তা ফেরাতে ব্যর্থ হচ্ছেন, তাহলে তারা দ্রুত ঐ নেতাকে সরিয়ে নতুন কাউকে নিয়ে আসার প্রবণতা রাখেন।

বাডেনকের ঝুঁকি: যদি জনমতে কোনো উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন না আসে, এবং রিফর্ম ইউকে ক্রমেই জনপ্রিয়তা বাড়াতে থাকে, তবে বাডেনকের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে পড়তে পারে। দলের অনেকেই হয়তো ভাবতে শুরু করবেন—আরও অপেক্ষা না করে নতুন কোনো নেতাকে নিয়ে আসা উচিত, যিনি পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে (২০২৯ বা তারও আগে) জয় এনে দেওয়ার সম্ভাবনা রাখবেন।

ভবিষ্যৎ চিত্র

নির্বাচন কবে?: যুক্তরাজ্যে সাধারণত পাঁচ বছরের জন্য পার্লামেন্ট নির্বাচিত হয়। লেবার সরকারের মেয়াদ সম্পন্ন হওয়ার সময়সীমা হিসেব করলে, পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন (General Election) হয়তো ২০২৯ সালের দিকে হতে পারে। অর্থাৎ, হাতে এখনো কিছুটা সময় আছে। বাডেনকের কৌশল হতে পারে এখনই বড় কোনো নীতিগত পদক্ষেপ না নিয়ে একটু পরিমিতিমূলক অবস্থান রাখা, যাতে পরে নির্বাচনের সময় বড় চমক আকারে কিছু ঘোষণা দিয়ে ভোটারদের আকর্ষণ করা যায়। কিন্তু এই দীর্ঘসূত্রতা রিফর্ম ইউকের দিকে ডানপন্থী ভোটারদের আরও বেশি সরিয়ে নিতে পারে।

রিফর্ম ইউকের (Reform UK) ভবিষ্যৎ: নাইজেল ফারাজ ও তার রিফর্ম ইউকে আপাতত ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা সরাসরি লেবার সরকারকে আক্রমণ করছে, কৃষক ও ছোট ব্যবসায়ীদের উদ্বেগগুলোকে সামনে নিয়ে আসছে। তারা এমনভাবে ভোটারদের কাছে যাচ্ছে, যেন মনে হয় তাদের ছাড়া “সত্যিকারের ডানপন্থী” কোনো বিকল্প নেই। যদি বাডেনক দেরি করে যান এবং দলীয় সমর্থকরা আরো হতাশ বোধ করেন, তাহলে রিফর্ম হয়তো ডানপন্থী ভোটভিত্তির বড় অংশ কেড়ে নিয়ে পরবর্তী নির্বাচনে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে।

নেতৃত্বের পুনর্বিবেচনা?: টোরি পার্টির ভেতরে অনেকেই মনে করেন, যদি ২০২৬ সালের মধ্যেও জরিপে (Opinion Polls) দৃশ্যমান উন্নতি না আসে, তখনই বাডেনককে সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কোনো স্বীকৃত নেতা—হয়তো সাবেক মন্ত্রী বা পরিচিত মুখ—নতুনভাবে দায়িত্ব নেবেন। এছাড়া বাডেনক যদি নিজে থেকেই বুঝতে পারেন যে, জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য বড় ধরনের নীতিগত ঝুঁকি (Policy Risk) নিতে হবে, তাহলে হয়তো তিনি শিগগিরই কিছু র‍্যাডিকাল পদক্ষেপ ঘোষণা করবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার বক্তব্যে সেই ইঙ্গিত নেই।

সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী ও দলের ভবিষ্যৎ: কনজারভেটিভ পার্টির (Conservative Party) প্রভাবশালী সদস্য রবার্ট জেনরিক (Robert Jenrick) নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। গত বছর ব্যাডেনকের কাছে পরাজিত হলেও, জেনরিক এখন নিজেকে দলের ডানপন্থী প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। তিনি আগে এতটা ডানপন্থী ছিলেন না, কিন্তু এখন তিনি আরও ডান দিকে সরে এসেছেন। ব্যাডেনককে ডান দিকে সরানোর জন্য নির্বাচিত করা হলেও, নীতি ঘোষণা এবং সুনির্দিষ্ট আদর্শের অভাবে যারা তাকে সমর্থন করেছিলেন, তারা জেনরিকের দিকে ঝুঁকতে পারেন। জেনরিক নেতা হলে কনজারভেটিভ পার্টি আরও ডান দিকে ঝুঁকবে, এমন সম্ভাবনা আছে। ব্যাডেনক যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেন, তাহলে তার নেতৃত্ব হারানোর ঝুঁকি বাড়বে।

উপসংহার

কেমি বাডেনক (Kemi Badenoch) যখন কনজারভেটিভ পার্টির নতুন নেতা নির্বাচিত হন, তখন পার্টির ডানপন্থী অংশে বেশ আশাবাদ দেখা গিয়েছিল। অনেকে ভেবেছিলেন, তিনি হয়তো নাইজেল ফারাজের রিফর্ম ইউকের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবেন এবং টোরিদের পূর্বের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও দৃঢ় নীতি-স্ট্যান্স গ্রহণ করবেন।

কিন্তু বাস্তবে, কয়েক মাস পার হওয়ার পরও বাডেনক সেভাবে নিজেকে প্রচার করতে পারছেন না। গণমাধ্যমে তার উপস্থিতি সীমিত, তিনি খুব কম সাক্ষাৎকার (Interview) দিচ্ছেন, লেবার সরকারের আক্রমণাত্মক সমালোচনায় সরব নন, আর রিফর্ম ইউকের সঙ্গে ডানপন্থী ভোটারদের নিয়ে সরাসরি কোনো প্রতিযোগিতায় নামছেন না।

ফলে, রিফর্ম ইউকে-র পক্ষে মাঠ ফাঁকা থেকে যাচ্ছে, নাইজেল ফারাজ কৃষক বিক্ষোভের মতো ইস্যুগুলোতে পুরোদমে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন, এবং জনমতে রিফর্মের উপস্থিতি ক্রমে বাড়ছে। এই প্রেক্ষিতে, কনজারভেটিভরা নতুন সংকটে পড়েছে—তাদের প্রথাগত ডানপন্থী ভোটারদের একটি অংশও রিফর্মের দিকে ঝুঁকছে।

বাডেনক সাম্প্রতিক ভাষণে (১৬ জানুয়ারি, ২০২৫) বলেছেন, তিনি “দেশকে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেবেন” এবং অতীতের ভুল শুধরে নেবেন। কিন্তু কোনো কার্যকর রূপরেখা বা ঘোষণা না থাকায় এই ভাষণকে অনেকেই দেখছেন ‘খালি বাক্যবাণ’ হিসেবে। আর কনজারভেটিভ পার্টির বর্ণাঢ্য ঐতিহ্য অনুযায়ী, দল যদি দেখেও যে তাদের নেতা জনমতে ইতিবাচক ফল আনতে পারছেন না, তাহলে সেই নেতাকে বদলাতে তারা পিছপা হয় না।

এখনকার প্রশ্ন হলো—বাডেনক কি শিগগিরই নতুন কোনো নীতিগত পরিকল্পনা সামনে নিয়ে আসবেন, নাকি এমপিরা (Tory MPs) তাকে বিদায় করে আরেকজনকে নিয়ে আসবেন? সময়ই বলে দেবে। তবে সামনে যেটাই ঘটুক না কেন, বাডেনকের বর্তমান দুর্বল অবস্থান স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, কনজারভেটিভ পার্টির সামনে চ্যালেঞ্জের অন্ত নেই এবং ডানপন্থী রাজনীতির অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাও (Intra-Right Rivalry) বেশ রোমাঞ্চকর মোড় নিচ্ছে।

যুক্তরাজ্য সম্পর্কে আরও সংবাদ ও বিশ্লেষণ জানতে দেখুন – যুক্তরাজ্য সংবাদ

তথ্যসূত্র

Transcript of Kemi Badenoch’s Speech
https://www.conservatives.com/news/kemi-rebuilding-trust-speech

Video of Kemi Badenoch’s Speech
https://www.youtube.com/watch?v=4UwRAKEePU4

Opinion Pieces on Badenoch’s Speech

William Atkinson (ConservativeHome) on Badenoch
https://conservativehome.com/2025/01/17/does-badenoch-realise-just-how-much-trouble-our-party-is-in/

Patrick O’Flynn (the Spectator) on Badenoch
https://conservativehome.com/2025/01/17/does-badenoch-realise-just-how-much-trouble-our-party-is-in/

Rachel Cunliffe (New Statesman) on Badenoch
https://www.newstatesman.com/politics/conservatives/2025/01/kemi-badenoch-still-has-no-ideas

Ben Walker (New Statesman) on Badenoch
https://www.newstatesman.com/politics/polling/2025/01/its-not-all-over-for-badenoch

Polling

Polling on Nigel Farage as best PM
https://yougov.co.uk/politics/articles/51412-nigel-farage-and-keir-starmer-in-close-contest-for-best-prime-minister

General Election Polling
https://en.wikipedia.org/wiki/Opinion_polling_for_the_next_United_Kingdom_general_election

YouGov polling on Kemi Badenoch
https://yougov.co.uk/politics/articles/51179-a-stinging-early-public-verdict-on-the-conservatives-and-badenoch

YouGov polling on Political Favourability
https://yougov.co.uk/politics/articles/51328-political-favourability-ratings-january-2025

News Articles

Kemi Badenoch Explains there Won’t Be Any Policy Plans for 2 Years
https://www.theguardian.com/politics/2025/jan/08/kemi-badenoch-tells-tories-dont-expect-big-policy-plans-for-two-years

Pitches of the Candidates for Tory Leader
https://www.theguardian.com/politics/2024/sep/29/what-are-the-four-candidates-pitches-to-become-next-tory-leader

Badenoch Says Labour are Making Same Mistakes as the Tories
https://www.telegraph.co.uk/politics/2024/11/02/badenoch-labour-repeating-mistakes-fail-new-start-tories/

Nigel Farage Coverage

Nigel Farage LBC Interview on TikTok
https://www.tiktok.com/@lbc/video/7439330202154437920

Nigel Farage Video on Inheritance Tax for Farmers
https://www.youtube.com/watch?v=Ghu-BPKFOXs

Nigel Farage on GB News Discussing Inheritance Tax for Farmers
https://www.youtube.com/watch?v=irT6LMniMDs

The Express Coverage of Farage at Farmers Protests
https://www.express.co.uk/news/politics/1977726/Farmer-protest-London-live

GB News Coverage of Farage at Farmers Protests
https://www.gbnews.com/politics/nigel-farage-backs-farmer-fury-stark-labour-warning

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.