কানাডায় কুইবেক স্বাধীনতা আন্দোলন কি বৃদ্ধি পাচ্ছে?

ভূমিকা

কানাডার (Canada) প্রদেশগুলোর মধ্যে কুইবেক (Quebec) আকার, সংস্কৃতি (Culture) এবং প্রধানত ফরাসি ভাষার (French Language) প্রাধান্যের কারণে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বহন করে। পুরো কানাডায় ফরাসি ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশই কুইবেকবাসী, এবং ৮৫% এরও বেশি কুইবেক নাগরিক (Quebecers) বাড়িতে নিয়মিত ফরাসি (French) ব্যবহার করেন। এছাড়া কানাডার মোট দ্বিভাষিক (bilingual: English-French) জনগোষ্ঠীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ কুইবেকেই বাস করেন।

দীর্ঘ শতাব্দী ধরে ভাষা ও সংস্কৃতির এই বিভাজন কানাডায় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও উত্তেজনার বিষয় হয়ে উঠেছে। যদিও এখন পর্যন্ত বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে একটি সমন্বিত কাঠামোয় বিরাজ করছিল, তবু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবেশে মনে হচ্ছে কুইবেকের স্বাধীনতাপন্থী মতাদর্শ নতুন করে গতি পাচ্ছে।

কানাডার রাজনৈতিক পূর্বাভাস ও নির্বাচনী বিশ্লেষক প্ল্যাটফর্ম ৩৩৮ কানাডার (338 Canada) তথ্য অনুযায়ী, কুইবেকের স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক দল ব্লক কুইবেকোয়া (Bloc Quebecois) আসন্ন কানাডীয় ফেডারেল নির্বাচনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পেতে পারে, যার ফলে তারা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সরকারিভাবে বিরোধী দলের (Official Opposition) মর্যাদা লাভ করতে পারে। একইসঙ্গে প্রাদেশিক পর্যায়ে পার্টি কুইবেকোয়া (Parti Quebecois) ২০২৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে (Provincial Election) সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করার মতো পর্যায়ে রয়েছে বলে বিভিন্ন জরিপ ইঙ্গিত দিচ্ছে।

১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এর আগেও স্বাধীনতাপন্থী দলগুলো উল্লেখযোগ্য অবস্থান অর্জন করেছিল, যার ফলে ১৯৯৫ সালে কুইবেকের স্বাধীনতা (Quebec Independence) নিয়ে এক গণভোট (Referendum) অনুষ্ঠিত হয়। ওই গণভোটে দলটি অতি অল্প ব্যবধানে পরাজিত হয়, কিন্তু এর মাধ্যমে ক্যানাডার ভেতরে কুইবেকের আলাদা পরিচয় ও স্বাধীনতার সম্ভাবনা সামনে এসেছিল। বর্তমানে আবারও সেই প্রসঙ্গ জোরালো হচ্ছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

এই প্রতিবেদনে আমরা কুইবেক জাতীয়তাবাদের (Quebec Nationalism) ইতিহাস, এটার সাম্প্রতিক উত্থানের পেছনের কারণ, এবং বাস্তবে কুইবেকের কানাডা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার (Leaving Canada) সম্ভাব্যতা নিয়ে বিশদ আলোচনা করব।

কুইবেকের অনন্যতা ও আলাদা পরিচয়

কানাডা অনেক প্রদেশ নিয়ে গঠিত হলেও কুইবেক তার ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের কারণে বরাবরই খানিকটা আলাদা। ১৮৬৭ সালে কানাডা কনফেডারেশন (Canadian Confederation) আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হওয়ার সময় থেকে ফরাসিভাষী (Francophone) ও ইংরেজিভাষী (Anglophone)—এই দুই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

  • ভাষার (Language) গুরুত্ব: কানাডার দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হলো ফরাসি। কিন্তু কুইবেক হলো এমন প্রদেশ, যেখানে ফরাসি ভাষায় কথা বলা শুধু সরকারের আনুষ্ঠানিক ভাষাই নয়, বরং দৈনন্দিন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম।
  • সংস্কৃতি (Culture): ফরাসি ভাষাভিত্তিক নাটক, গান, সাহিত্য, চলচ্চিত্র—কুইবেকের সংস্কৃতি সবসময় স্বতন্ত্র। কানাডার অন্যান্য প্রদেশে ইংরেজি সংস্কৃতির প্রভাব অধিক থাকলেও, কুইবেক তার ফরাসি ঐতিহ্য দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছে।

এ কারণে, ঐতিহাসিকভাবেই কানাডার কেন্দ্রীয় সরকারের (Federal Government) নীতিনির্ধারণে ইংরেজিভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রভাব বেশি থাকায়, কুইবেকবাসীর মধ্যে সময়ে সময়ে একধরনের ‘বৈষম্যের অনুভূতি’ (Sense of Alienation) তৈরি হয়েছে।

কুইবেক জাতীয়তাবাদের (Quebec Nationalism) ঐতিহাসিক পটভূমি

কানাডা প্রতিষ্ঠা ও প্রাথমিক বৈষম্য: কানাডা ১৮৬৭ সালে যখন গঠিত হয়, তখন ধারণা করা হয়েছিল—এটি ফরাসিভাষী ও ইংরেজিভাষী উভয় সম্প্রদায়ের সমান অধিকার ও শক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি দেশ হবে। কিন্তু ১৮৬৭ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত প্রথম এক শতাব্দীতে কানাডার প্রধানমন্ত্রীদের (Prime Ministers) মধ্যে মাত্র দুইজনই ছিলেন ফরাসিভাষী (Francophone) ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা। বাকিরা প্রায় সবাই ইংরেজিভাষী (Anglophone)। এই সংখ্যাগত ভারসাম্যহীনতা ও কেন্দ্রীয় সরকারের ফেডারেল পলিসিতে (Federal Policy) ইংরেজিভাষীদের প্রাধান্য, পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা সমস্যায় ফরাসিভাষী কুইবেকবাসীর মধ্যে বঞ্চনার অনুভূতি বৃদ্ধি পায়।

শার্ল দ্য গল-এর মন্তব্য ও উগ্রপন্থী আন্দোলন: ১৯৬০-এর দশকে কানাডায় জাতীয়তাবাদী আলোচনা আরও তীব্র হয়। বিশেষ করে ১৯৬৭ সালে ফ্রান্সের (France) প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গল (Charles de Gaulle) মন্ট্রিলে (Montreal) এক বিশাল জনসমাবেশে বলেছিলেন, “Vive le Quebec libre” অর্থাৎ “স্বাধীন কুইবেক জিন্দাবাদ” বা “Long live a free Quebec”। এই মন্তব্য কানাডার রাজনীতিতে আলোড়ন তোলে। পরবর্তী সময়ে, ১৯৭০ সালের দিকে কিছু কুইবেকবাসী সহিংস উপায়ে (Violent Means) স্বাধীনতার দাবি আদায়ের চেষ্টা করে। এদের মধ্যে ফ্রঁ দ্য লিবারেসিয়ঁ দ্য কুইবেক (Front de libération du Québec) নামে একটি উগ্রপন্থী গোষ্ঠী ছিল, যারা ১৯৭০ সালের অক্টোবর সংকটে (October Crisis) কুইবেকের উপপ্রধানমন্ত্রী (Deputy Premier) ও একজন ব্রিটিশ কূটনীতিককে (British Diplomat) অপহরণ করে। পরবর্তীতে উপপ্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করা হয়, যা পুরো কানাডা জুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই ঘটনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিয়ের ট্রুডো (Pierre Trudeau) ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শান্তিকালীন অবস্থায় (Peacetime) ওয়ার মেজার্স অ্যাক্ট (War Measures Act) প্রয়োগ করেন। পুলিশকে দেয়া হয় ব্যাপক ক্ষমতা, যা প্রায় সামরিক শাসনের (Martial Law) কাছাকাছি। এই অভিযানে উগ্রপন্থীরা ধরা পড়ে। জনমনে সহিংস স্বাধীনতাপন্থী মতবাদ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়।

রাজনৈতিক স্বাধীনতাপন্থী আন্দোলনের উত্থান: সহিংস পন্থায় যখন জনসমর্থন ক্রমশ কমে যাচ্ছিল, তখন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টায় গড়ে ওঠে পার্টি কুইবেকোয়া (Parti Quebecois)। ১৯৭৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে দলটি জয়ী হয়ে ১৯৮০ সালে প্রিমিয়ার রেনে লেভেক (René Lévesque) কুইবেকের কানাডা থেকে আলাদা হওয়ার বিষয়ে একটি গণভোট (Referendum) আয়োজন করেন। তবে সেই গণভোট বড় ব্যবধানে পরাজিত হয়। এরপর কানাডিয়ান সংবিধান (Canadian Constitution) সংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগে কুইবেককে যথেষ্ট গুরুত্ব না দেয়া এবং সংশোধনের আলোচনায় (Subsequent Negotiations) ব্যর্থতা—এসব কারণে ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আবারও কুইবেক জাতীয়তাবাদ জোরালো হয়ে ওঠে। তখন লুসিয়েন বুশার (Lucien Bouchard) ব্লক কুইবেকোয়া (Bloc Quebecois) গঠন করেন ফেডারেল পর্যায়ে, আর কুইবেকের প্রিমিয়ার জ্যাক পারিজো (Jacques Parizod) প্রাদেশিক পর্যায়ে স্বাধীনতার কথা জোরেশোরে উত্থাপন করেন। ১৯৯৫ সালে দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীনতা সংক্রান্ত গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এইবার ফলাফল অত্যন্ত কাছাকাছি ছিল, তবুও স্বাধীনতাপন্থীরা বিজয়ী হতে পারেনি। ২০০৩ সালে পার্টি কুইবেকোয়া প্রাদেশিক নির্বাচনে লিবারেলদের (Liberals) কাছে হেরে গেলে স্বাধীনতার প্রশ্নটি আবার অন্তরালে চলে যায়।

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক আবহ ও জরিপের ফলাফল

ফেডারেল পর্যায়ে ব্লক কুইবেকোয়া (Bloc Quebecois): বর্তমানে ব্লক কুইবেকোয়া (Bloc Quebecois) দলের নেতৃত্বে রয়েছেন ইভ ফ্রঁসোয়া ব্লানশে (Yves-François Blanchet)। গত কয়েক বছরে ব্লক কুইবেকোয়া ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে।

  • ২০১৯ সালের কানাডিয়ান ফেডারেল নির্বাচনে তারা ২২টি আসন পায়।
  • ২০২১ সালের নির্বাচনেও তারা তাদের আসন সংখ্যা মোটামুটি স্থিতিশীল রাখতে সক্ষম হয়।

যদি সামনের ফেডারেল নির্বাচনে সমর্থনের এই ধারা অব্যাহত থাকে বা বাড়ে, ব্লক কুইবেকোয়া দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পেয়ে সরকারিভাবে বিরোধী দলের মর্যাদা পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কানাডার বর্তমান লিবারেল সরকার (Liberal Government) এবং প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর (Justin Trudeau) জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে—এটি ব্লকের পক্ষে কাজ করতে পারে।

প্রাদেশিক পর্যায়ে পার্টি কুইবেকোয়া (Parti Quebecois): কুইবেকের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পার্টি কুইবেকোয়া (Parti Quebecois) পুনরায় ক্ষমতার ধারেকাছে চলে এসেছে। পল সাঁ পিয়ের প্লামোন্দঁ (Paul St. Pierre Plamondon), যাকে সংক্ষেপে পিএসপিপি (PSPP) বলা হয়, ২০২০ সালে দলের নেতৃত্বে আসেন। তার নেতৃত্বে পার্টি কুইবেকোয়া এখনকার ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ ঘরানার ক্যাক (Coalition Avenir Québec, সংক্ষেপে CAQ) সরকারকে জনপ্রিয়তায় পেছনে ফেলতে শুরু করেছে। বর্তমান জরিপ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, পার্টি কুইবেকোয়া ১০-পয়েন্টের মতো ব্যবধানে এগিয়ে আছে। যদি এখনই নির্বাচন হতো, তারা সহজেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার (Majority Government) গঠন করতে পারত। আর ২০২৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে এই চালচিত্র বজায় থাকলে কুইবেকের ক্ষমতায় পার্টি কুইবেকোয়া আসতে পারে।

ভোটারদের অসন্তোষ ও তার উৎস: বিশ্বজুড়ে বর্তমান সময়ে বিদ্যমান সরকারগুলোর (Incumbent Governments) বিরুদ্ধে জনঅসন্তোষ একটি সাধারণ প্রবণতা। কানাডার বেলায়ও তার ব্যতিক্রম নয়।

  • কুইবেকের প্রিমিয়ার ফ্রঁসোয়া লেগো (Francois Legault) বর্তমানে ৩০ শতাংশের আশপাশে জনপ্রিয়তা নিয়ে লড়ছেন, যা আগে থেকে অনেক কম।
  • ফেডারেল পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও বেশ অপ্রিয় হয়ে উঠেছেন।

এই পরিস্থিতিতে আরও কট্টরপন্থী (Hardline) বা স্বাধীনতাপন্থী (Separatist) ফরাসিভাষী জাতীয়তাবাদীরা পার্টি কুইবেকোয়া এবং ব্লক কুইবেকোয়ার দিকে ঝুঁকছেন। ফেডারেল লিবারেলরা যদি নতুন কোনো দলনেতা বেছে নেয় যিনি প্রধানত ইংরেজিভাষী (Anglophone) পটভূমি থেকে আসেন, তবে ফরাসিভাষী জাতীয়তাবাদী মনে আরও হতাশা তৈরি হতে পারে—যা ব্লক কুইবেকোয়ার পক্ষে কাজ করবে।

কুইবেক স্বাধীনতা (Quebec Independence) কি নিকট ভবিষ্যতে বাস্তবসম্মত?

জনমতের সর্বশেষ চিত্র: ধর্মভিত্তিক, ভাষাভিত্তিক বা অন্য কোনো ঐতিহাসিক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে গণভোট (Referendum) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কুইবেকের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু স্বাধীনতার পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আদৌ আছেন কি না, সেটি বড় প্রশ্ন।

  • ২০২৪ সালের শেষের দিকে করা এক অ্যাংগাস রিড (Angus Reid) জরিপ অনুযায়ী, ৬৯% কুইবেকবাসী কানাডার অংশ হতে পেরে গর্বিত (Proud to be Canadian)।
  • সাম্প্রতিক বছরগুলোতে (গত ২০ বছরের মধ্যে) স্বাধীনতার প্রশ্নে জনসমর্থন ৩০% এর কাছাকাছি ঘোরাফেরা করছে।

এমনকি পার্টি কুইবেকোয়াকে সমর্থন করা ভোটারদের মধ্যে প্রায় এক-চতুর্থাংশ (২৫%) বলছেন যে, যদি আবার গণভোট হয়, তারা “না” ভোট দেবেন। এর মানে, অনেক ভোটার পার্টি কুইবেকোয়াকে পছন্দ করেন মূলত তাদের ‘কুইবেক-অংশীকেন্দ্রিক’ (Quebec Nationalist) ও ‘ফরাসিভাষী স্বার্থরক্ষাকারী’ (Francophone Interests) অবস্থানের জন্য, কিন্তু তারা আসলে কানাডা ত্যাগ করার পক্ষপাতী নন।

রাজনৈতিক নেতাদের পরিকল্পনা: যদিও জনমত স্বাধীনতার পক্ষে এখনো দৃঢ় নয়, তবুও পিএসপিপি (PSPP) অর্থাৎ পল সাঁ পিয়ের প্লামোন্দঁ স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, তিনি নির্বাচিত হলে আবার একটি গণভোট আয়োজনের পরিকল্পনা রেখেছেন। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলে আসছেন যে, সময়োপযোগী পরিস্থিতি হলে এই গণভোটে স্বাধীনতাপন্থীরা জিততে পারেন। এর পেছনে তাদের যুক্তি হলো, যদি ব্লক কুইবেকোয়া ফেডারেল নির্বাচনে বড় জয় পায় এবং কুইবেক প্রাদেশিক নির্বাচনে পার্টি কুইবেকোয়া ক্ষমতায় আসে, তাহলে তাদের ‘গণতান্ত্রিক বৈধতা’ (Democratic Legitimacy) অনেক বাড়বে। আর তখন স্বাধীনতার প্রশ্নে জনমতও পরিবর্তিত হতে পারে। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝিতে লুসিয়েন বুশার (Lucien Bouchard) এবং জ্যাক পারিজো (Jacques Parizod)-এর মতো অনুপ্রাণিত নেতাদের নেতৃত্বে স্বাধীনতাপন্থীরা শক্তিশালী অবস্থানে ছিল। দীর্ঘদিন পর আবার ব্লানশে (Blanchet) ও প্লামোন্দঁ (Plamondon)-এর মতো নেতারা একযোগে সক্রিয় হওয়ায় আন্দোলনটিতে নতুন গতির সঞ্চার হতে পারে।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, কানাডার সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলো (Economic and Social Challenges) মিটে গেলে কিংবা উন্নতি ঘটলে স্বাধীনতাপন্থী দলগুলোর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে পারে। কারণ তখন মানুষ হয়তো আর “বিকল্প” বা “বিক্ষুব্ধ” ধারা খুঁজবেন না। কানাডার অন্যান্য অংশের জনগণও চান না কুইবেক বেরিয়ে যাক, কারণ কানাডিয়ান ফেডারেশনের (Canadian Federation) সমন্বয়মূলক কাঠামো ভেঙে গেলে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক (International Relations)–সব ক্ষেত্রেই বড়ধরনের জটিলতা তৈরি হবে।

স্বাধীনতার আইনি (Legal) ও সাংবিধানিক (Constitutional) চ্যালেঞ্জ

কানাডিয়ান সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান: কানাডিয়ান সুপ্রিম কোর্ট (Canadian Supreme Court) পূর্বে রায় দিয়েছে যে, কোনো প্রদেশ একতরফাভাবে (Unilaterally) বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। অর্থাৎ সংবিধানের আওতায় একটি প্রদেশ চাইলেই গণভোট করে আলাদা হয়ে যেতে পারবে না।

ক্ল্যারিটি অ্যাক্ট (Clarity Act of 2000): ২০০০ সালে কানাডীয় সংসদে (Canadian Parliament) পাস হওয়া ক্ল্যারিটি অ্যাক্ট (Clarity Act) স্পষ্টভাবে বলে যে, যদি কোনো প্রদেশ স্বাধীনতার পক্ষে গণভোট আয়োজন করে, তাহলে সেটি “পর্যাপ্তভাবে স্পষ্ট প্রশ্ন” (Clear Question) এবং “পর্যাপ্তভাবে স্পষ্ট ফলাফল” (Clear Majority) দিয়ে হতে হবে। যদি ফেডারেল সরকার মনে করে যে, গণভোটের ভাষা পরিষ্কার নয় বা জনমতের ব্যবধান যথেষ্ট নয়, তাহলে তারা ফলাফল অগ্রাহ্য করতে পারে।

অর্থাৎ, গণভোট পাস করলেই কুইবেক স্বাধীন হয়ে যাবে—বিষয়টি এত সহজ নয়। প্রদেশের ইচ্ছা, ফেডারেল সরকারের পারস্পরিক আলোচনা এবং সার্বিক সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই যে কোনো বিচ্ছিন্নকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে হবে।

ভবিষ্যৎ প্রেক্ষাপট ও সম্ভাবনা

কুইবেকের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় ও ভাষাগত দাবি নিঃসন্দেহে কানাডিয়ান ফেডারেশনে বড় এক প্রভাবক হিসেবে কাজ করে আসছে। স্বাধীনতার প্রসঙ্গ সামনে এলেই কানাডিয়ান রাজনীতিতে আলোচনা তুঙ্গে উঠে।

  • পরিবর্তনশীল রাজনীতি (Changing Politics): রাজনীতিতে পরিস্থিতি খুব দ্রুত পরিবর্তিত হতে পারে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, মহামারী-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, বা অন্য কোনো বড় ঘটনায় জনমতের মোড় ঘুরে যেতে পারে।
  • জনমতের বাস্তবতা (Public Opinion): এখনকার জরিপ বলছে, বেশিরভাগ কুইবেকবাসী কানাডার অংশ হিসেবেই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তবু, রাজনৈতিক নেতৃত্বের পালাবদল ও অর্থনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন জনমতকে প্রভাবিত করতে পারে।
  • আন্দোলনের গতি (Momentum of the Movement): যদি ব্লক কুইবেকোয়া ফেডারেল নির্বাচনে বিরোধী দলের অবস্থান পায় এবং পার্টি কুইবেকোয়া প্রাদেশিক নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে, তবে স্বাধীনতার বিষয়টি ফের রাজনৈতিক এজেন্ডায় জোরালোভাবে ফিরে আসবে।

অন্যদিকে, উন্নত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ফেডারেল সরকারের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষণ, অথবা অন্য কোনো দল/নেতার জনপ্রিয়তা বেড়ে গেলে স্বাধীনতার দাবি আবারও স্তিমিত হয়ে যেতে পারে।

উপসংহার

কানাডার (Canada) সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে কুইবেকের (Quebec) স্বাধীনতার প্রশ্ন আবারও আলোচনায় এসেছে। ফরাসিভাষী জাতীয়তাবাদ (Francophone Nationalism) কানাডিয়ান ইতিহাসে বহুবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে—কখনো সহিংস রূপে, কখনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়।

  • ১৯৮০ সালে একবার এবং ১৯৯৫ সালে আরেকবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দ্বিতীয়বারে ফলাফল ছিল বেশ হাড্ডাহাড্ডি, কিন্তু তবুও স্বাধীনতার পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা মেলেনি।
  • সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, এখনও কুইবেকবাসীর বড় একটা অংশ কানাডার সাথেই থাকতে চান।
  • তবুও, পার্টি কুইবেকোয়া (Parti Quebecois) ও ব্লক কুইবেকোয়া (Bloc Quebecois)–এ দুটি স্বাধীনতাপন্থী দলের পুনরুত্থান (Resurgence) অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে:
    ১. আগামী ফেডারেল নির্বাচনে ব্লক কুইবেকোয়া কি সত্যিই বিরোধী দলের মর্যাদা পাবে?
    ২. ২০২৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে পার্টি কুইবেকোয়া কি সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠন করবে?
    ৩. জনমত যদি এখনই অতটা অনুকূল না-ও হয়, কুইবেকের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কীভাবে স্বাধীনতার পক্ষের সমর্থন বাড়ানোর চেষ্টা করবে?

কানাডিয়ান সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court) ও ক্ল্যারিটি অ্যাক্ট (Clarity Act) অনুযায়ী, একতরফাভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়া (Unilateral Secession) সম্ভব নয়। তবু, যদি গণভোটে (Referendum) স্বাধীনতার পক্ষে পরিষ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠতা (Clear Majority) পাওয়া যায় এবং প্রশ্নের ভাষাও পরিষ্কার থাকে, তাহলে ফেডারেল সরকারকে (Federal Government) কুইবেকের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, নেতা-নেত্রীদের জনপ্রিয়তার ওঠানামা, এবং জনমতের দ্রুত পরিবর্তন—সবগুলো উপাদান মিলে কানাডার ভবিষ্যৎ রাজনীতি অনিশ্চয়তায় ঘনঘন রঙ বদলাতে পারে। আপাতত, জরিপে দেখা যায় অধিকাংশ কুইবেকবাসী কানাডিয়ান পরিচয় (Canadian Identity) নিয়ে গর্ববোধ করেন, কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা চলতে থাকলে এই মতামত কত দ্রুত পাল্টে যেতে পারে, সেটিই এখন পর্যবেক্ষণের বিষয়।

সংক্ষেপে বলা যায়, কুইবেক স্বাধীনতা (Quebec Independence) প্রশ্নটি বরাবরই কানাডার রাজনীতির একটি সংবেদনশীল অধ্যায়। আজকের পরিস্থিতিতে এটি আবারও সামনে আসছে মূলত বিদ্যমান সরকারগুলোর জনপ্রিয়তা কমে যাওয়া, স্থানীয় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং কুইবেকের ঐতিহাসিক স্বাতন্ত্র্যবোধের পুনরুত্থানের কারণে। আগামী নির্বাচনী চক্রে ব্লক কুইবেকোয়া ও পার্টি কুইবেকোয়া যদি শক্তিশালী অবস্থান অর্জন করে, তাহলে স্বাধীনতার সম্ভাব্য গণভোটের প্রসঙ্গ আরও বেশি গুরুত্ব পেতে পারে। তবে এখনই চূড়ান্তভাবে বলা সম্ভব নয় যে, কুইবেক আদৌ কানাডা থেকে বেরিয়ে যাবে কি না। রাজনৈতিক পালাবদলের হিসাব-নিকাশ, জনমতের বাস্তবতা, ফেডারেল আইনি কাঠামো—সবকিছুই শেষ পর্যন্ত নির্ধারক ভূমিকা রাখবে।

কানাডা সম্পর্কে আরও সংবাদ ও বিশ্লেষণ জানতে যান এখানে – উত্তর আমেরিকা (কানাডা, মেক্সিকো, গ্রিনল্যান্ড, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল ইত্যাদি) ও আর্কটিক সংবাদ

তথ্যসূত্র

1 – https://www.cbc.ca/news/canada/montreal/statistics-canada-language-census-2021-1.6553939

2 – https://www.theguardian.com/world/2020/oct/16/october-crisis-canada-quebec-separatist-50-years

3 – https://en.wikipedia.org/wiki/1980_Quebec_referendum

4 – https://www.thecanadianencyclopedia.ca/en/article/quebec-referendum-1995

5 – https://www.ctvnews.ca/montreal/article/pq-leads-in-quebec-voting-intentions-as-caq-loses-more-support-poll/

6 – https://338canada.com/quebec/

7 – https://montreal.citynews.ca/2024/12/11/quebec-legault-approval-rating-december-2024/

8 – https://www.timescolonist.com/local-news/liberal-fortunes-in-quebec-may-be-troubled-as-third-minister-ends-leadership-bid-10072059

9 – https://cultmtl.com/2024/05/quebec-has-more-canadian-pride-than-alberta-and-saskatchewan/

10 – https://en.wikipedia.org/wiki/Quebec_sovereignty_movement#Opinion_polls

11 – https://www.montrealgazette.com/news/article131530.html

12 – https://www.cbc.ca/news/canada/montreal/pq-leader-promises-another-independence-referendum-1.7173574

13 – https://www.ctvnews.ca/montreal/article/parti-quebecois-leader-remains-convinced-he-can-win-a-sovereignty-referendum/

14 – https://modusresearch.com/an-ever-larger-majority-of-canadians-are-unhappy-with-the-direction-of-the-country/

15 – https://en.wikipedia.org/wiki/Reference_Re_Secession_of_Quebec

16 – https://laws-lois.justice.gc.ca/eng/acts/c-31.8/page-1.html

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.