যুক্তরাজ্যের পারমাণবিক শক্তিতে সমস্যাটা কোথায়?

ভূমিকা

যুক্তরাজ্যে (UK) অবকাঠামোগত (Infrastructure) নতুন প্রকল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে সবসময় বড় ধরনের সাফল্য দেখা যায় না। রেলপথ (Trains), আবাসন (Houses), জলাধার (Reservoirs)—যে ক্ষেত্রেই হোক, প্রায়শই প্রকল্পগুলো সময়সীমা ছাড়িয়ে যায়, বাজেটও বেড়ে যায়, এবং শেষ পর্যন্ত ফলাফল অনেককে হতাশ করে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো (Nuclear Power Stations) এর সর্বশেষ শিকার বলে মনে হচ্ছে। ব্রিটেন বেশ কিছু পুরনো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের মুখে, তাই ‘হিংকলি পয়েন্ট সি’ (Hinkley Point C) ও ‘সাইজওয়েল সি’ (Sizewell C) নামে নতুন প্রজন্মের দুটি রিঅ্যাক্টর তৈরির পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু ইতোমধ্যেই ব্যয় এতটা বেড়ে গেছে যে দীর্ঘমেয়াদে প্রকল্পগুলোর টেকসইতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাই এই নিবন্ধে আমরা যুক্তরাজ্যে পারমাণবিক শক্তির বর্তমান অবস্থা, নতুন রিঅ্যাক্টরের পরিকল্পনা, এবং কেন দেশটি তার পারমাণবিক কাঠামো উন্নত করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে—তা বিশদভাবে পর্যালোচনা করব।

যুক্তরাজ্যে পারমাণবিক শক্তির বর্তমান অবস্থা

যুক্তরাজ্যে হয়তো ফ্রান্সের (France) মতো ব্যাপকভাবে পারমাণবিক শক্তির উপর নির্ভরশীলতা নেই, তবে তবুও বিদ্যুৎ উৎপাদনের উল্লেখযোগ্য অংশই পারমাণবিক শক্তি থেকে আসে। ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যে প্রায় ১৫% বিদ্যুৎই পারমাণবিক কেন্দ্র থেকে সরবরাহ করা হয়েছিল। অথচ ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে এটি ছিল প্রায় ২৫%। অর্থাৎ দু-দশকের মধ্যে পারমাণবিক শক্তির অনুপাত প্রায় ১০% পয়েন্ট কমে গেছে।

অনেকেই বলবেন, নবায়নযোগ্য শক্তি (Renewables) যেমন সৌর (Solar) ও বায়ু শক্তির (Wind) ক্রমবর্ধমান উত্থানের কারণেই পারমাণবিকের অনুপাত কমেছে। যদিও এটি আংশিকভাবে সত্য, বড় কারণ হলো পুরনো পারমাণবিক কেন্দ্রে একে একে অবসরে (Decommissioning) চলে যাচ্ছে, অথচ সমপরিমাণ নতুন কেন্দ্র সময়মতো তৈরি হচ্ছে না।

বর্তমানে সক্রিয় কেন্দ্র ও বন্ধের সময়সূচি: দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাজ্যে বর্তমানে মোট নয়টি পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর চালু রয়েছে, বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে—হার্টলপুল (Hartlepool) এলাকায় দুটি, হেইশ্যাম (Heysham) এলাকায় চারটি, টনেসে (Taunus) দুটি, এবং সাইজওয়েলে (Sizewell) একটি। তবে এগুলোর বেশ কয়েকটি আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাবে:

  • Hartlepool-এর দুটো রিঅ্যাক্টর ২০২৭ সালে বন্ধ হওয়ার কথা রয়েছে।
  • Heysham 1-এর রিঅ্যাক্টর 1A ও 1B একই সময়সীমায় (২০২৭) বন্ধ হবে।
  • Heysham 2-এর রিঅ্যাক্টর 2 ২০২৮ সালে বন্ধের সময়সূচি রয়েছে।
  • Sizewell B যেটি অপেক্ষাকৃত নতুন, তবুও সেটিও ২০৩৫ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় আর এক দশক পর।

অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে—অবসরে পাঠালেও ক্ষতি কী? বরং সৌর ও বায়ু শক্তির দিকে আরো গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। তবে বিরোধী দলের অবস্থান হলো, যুক্তরাজ্য পুরোপুরি বায়ু ও সৌর শক্তির ওপর নির্ভর করতে পারে না; এই উৎসগুলো পর্যাপ্তভাবে স্থিতিশীল নয় (Variable), অর্থাৎ রোদ না থাকলে সৌর শক্তি বন্ধ, বাতাস না থাকলে বায়ুশক্তি বন্ধ। তাই বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য আরও স্থিতিশীল একটি উৎস দরকার, যা ব্যাকআপ হিসেবে কাজ করতে পারে। গ্যাস (Gas) হতে পারে এক বিকল্প, কিন্তু এর ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে নেট জিরো (Net Zero) অর্জনের পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হবে।

এ কারণেই লেবার নেতা কিয়ার স্টারমার (Keir Starmer) সরকারের পক্ষ থেকে নতুন পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর তৈরির প্রতি সমর্থন রয়েছে। তারা ‘হিংকলি পয়েন্ট সি’ ও ‘সাইজওয়েল সি’—দুটোকেই বাস্তবায়ন করার কথা গত নির্বাচনী ইশতেহার (Manifesto) এ উল্লেখ করেছে। এখন আমরা জানি, যুক্তরাজ্যে পারমাণবিক শক্তির বর্তমান অবস্থা কী এবং কেন সরকার আরো পারমাণবিক কেন্দ্র গড়তে চায়।

হিংকলি পয়েন্ট সি (Hinkley Point C) প্রকল্প: কীভাবে খরচ বেড়ে গেল

‘হিংকলি পয়েন্ট সি’ ইতোমধ্যে সামারসেটে (Somerset) নির্মাণাধীন। প্রকল্পটি সফলভাবে চালু হলে এটি ৭০ বছর পর্যন্ত পরিচালিত হতে পারবে, এবং আনুমানিক ৩.২ গিগাওয়াট (Gigawatts) বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারবে। বর্তমান পারমাণবিক শক্তি সরবরাহের আনুমানিক অর্ধেকের সমপরিমাণ হবে এটি—যা যুক্তরাজ্যের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ৭% পূরণ করতে পারে।

এটি একটি যৌথ উদ্যোগ (Joint Venture)—ফরাসি কোম্পানি ‘ইলেকট্রিসিতে দ্য ফ্রান্স’ (Electricity de France, সংক্ষেপে EDF) রয়েছে ৬৬.৫% অংশীদারিত্বে, আর চায়না জেনারেল নিউক্লিয়ার পাওয়ার করপোরেশন (CGNPC) ৩৩.৫% অংশীদারিত্বে।

প্রকল্প বাস্তবতার সমীকরণ: ২০০৭ সালে EDF-এর প্রধান নির্বাহী বলেছিলেন, ২০১৭ সালের বড়দিনে ব্রিটিশরা (Britons) হিংকলি পয়েন্ট সি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে তাদের টার্কি রান্না করতে পারবে। বাস্তবে কী হলো? মূলত প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরুই হয়নি তার আগে। ২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু হয়। তখন আশা করা হয়েছিল, ২০২৫ সালের মধ্যে কেন্দ্রটি শেষ হবে এবং ব্যয় হবে প্রায় ১৮ বিলিয়ন পাউন্ড।

কিন্তু নির্মাণের গতি ও খরচ নিয়ে বারবার সংশোধনী আসতে থাকে:

  • প্রথমে সম্পন্ন হওয়ার সময়সীমা ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
  • সম্প্রতি, ২০২৯ সাল পর্যন্ত সময় বর্ধিত করা হয়েছে, এমনকি EDF বলছে ২০৩১ সাল পর্যন্তও দেরি হতে পারে।
  • সর্বশেষ তথ্যমতে, প্রকল্পের খরচ এখন প্রায় ৩১ থেকে ৩৫ বিলিয়ন পাউন্ড (২০১৫ সালের দাম অনুযায়ী) হতে পারে, যা বর্তমান মূল্যহার (Today’s Prices) অনুযায়ী প্রায় ৪৬ বিলিয়ন পাউন্ড।

এমনকি এটি আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল পারমাণবিক কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। গড়পড়তা ‘পাউন্ড-প্রতি-মেগাওয়াট’ (Pound per Megawatt) হিসাবে, দক্ষিণ কোরিয়ার (South Korea) একটি সাধারণ পারমাণবিক কেন্দ্রের চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি ব্যয়বহুল। যদিও EDF এই প্রকল্পে বড় ধরনের ঝুঁকি নিচ্ছে এবং খরচ বাড়লে তারাই মূলত বেশি চাপ মোকাবিলা করবে, তবে চুক্তি অনুযায়ী যখন কেন্দ্র চালু হবে, EDF বিদ্যুতের দাম (Energy Price) তুলনামূলক বেশি রাখবে—ফলে শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের (Consumers) বিদ্যুৎ বিল বেড়ে যেতে পারে।

কী কারণে এতো ব্যয় ও দেরি?: কিছু কারণ স্পষ্ট:

  1. লম্বা ব্যবধান: যুক্তরাজ্যে বহুদিন ধরে নতুন কোনো পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণ হয়নি। শেষবার সাইজওয়েল বি (Sizewell B) নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৯৮৭ সালে, যা প্রায় চার দশকের আগের কথা। অভিজ্ঞতা ও ধারাবাহিক নির্মাণের অভাবে দক্ষতা (Efficiency) গড়ে ওঠেনি, যা ব্যয় ও সময়—দুটোই বাড়িয়ে দেয়।
  2. অন্যান্য দেশের তুলনা: দক্ষিণ কোরিয়া নিয়মিত পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণ করে আসছে। ফলে তারা একই ধাঁচের প্ল্যান্ট বারবার বানানোর সুবাদে খরচ কমিয়েছে—কারণ উৎপাদন, নকশা ও সরবরাহ ব্যবস্থা বারবার ব্যবহার করে আরও দক্ষ হয়ে উঠেছে। EDF যদিও ফ্রান্স ও অন্য দেশে পারমাণবিক কেন্দ্র বানিয়েছে, কিন্তু যুক্তরাজ্যের জটিল ও অদ্ভুত কিছু নিয়ন্ত্রক (Regulations) এবং অনুমোদন পদ্ধতির (Approval Process) সঙ্গে তাদের সেভাবে পরিচিতি ছিল না।
  3. বেড়ে চলা নিয়ন্ত্রক চাপ: যুক্তরাজ্যের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো (Regulators) EDF-কে প্রায় ৭,০০০ নকশা সংশোধনী (Design Modifications) আনতে বাধ্য করেছে, যার ফলে ২৫% বেশি কংক্রিট (Concrete) এবং ৩৫% বেশি স্টিল (Steel) প্রয়োজন হয়েছে। এতে নির্মাণের খরচ ও সময় দুটোই অনেক বাড়ে।
  4. অতিরিক্ত বিলম্বের কারণ:
    • কোভিড (COVID) মহামারির কারণে কাজ থেমে থাকা বা ধীর গতিতে হওয়া,
    • মুদ্রাস্ফীতি (Inflation) বৃদ্ধিতে নির্মাণ-সামগ্রীর খরচ বেড়ে যাওয়া,
    • ব্রেক্সিট-জনিত (Brexit) সমস্যা ও শ্রমিক-সংকট (Worker Shortage),
    • আচমকা আরো ৩,০০০ অতিরিক্ত কর্মী দরকার হওয়ায় তাদের আবাসন (Housing) ও সরবরাহ ব্যবস্থার (Supply Chain Disruptions) জটিলতা।

সবমিলিয়ে ‘হিংকলি পয়েন্ট সি’ প্রকল্প এখন ব্যাপক বাজেট ও সময়সীমা পেরিয়ে গেছে। এটি যে কতটা আর্থিক চাপে ফেলতে পারে, সেটা দেখার বিষয়।

সাইজওয়েল সি (Sizewell C) প্রকল্প: নতুন ভুল নাকি পুরনো অভিজ্ঞতা?

হিংকলি পয়েন্ট সি-এর পরে সরকারি পরিকল্পনায় ‘সাইজওয়েল সি’ পরবর্তী বড় পারমাণবিক কেন্দ্র হিসেবে নির্মাণের প্রস্তাবনা রয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আগের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে কি একই ধরনের সমস্যাকে এড়ানো যাবে?

সম্ভাব্য সুবিধা:

  • নকশায় মিল (Similar Design): বলা হচ্ছে, সাইজওয়েল সি-এর নকশা হিংকলি পয়েন্ট সি-এর মতোই হবে। সুতরাং আগে যে ৭,০০০ নকশা সংশোধনী করতে হয়েছে, সেই ধাপগুলো পুনরায় পেরোনোর প্রয়োজন কমবে। এটি নিয়ন্ত্রক অনুমোদন পেতে সহায়তা করবে, কারণ একবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা ডিজাইন আবারও প্রয়োগ করা সহজ হতে পারে।
  • নতুন অর্থায়ন পদ্ধতি (Regulated Asset Base – RAB): পুরনো পদ্ধতিতে নির্মাতা কোম্পানিকে সম্পূর্ণ খরচ তুলে আনতে হতো, পরে বিদ্যুৎ বিক্রি করে সেই বিনিয়োগ ফেরত আসত। এখন RAB স্কিমের আওতায় গ্রাহকেরা (Electricity Customers) আগেভাগেই বিলের মাধ্যমে মূলত প্রকল্পে অবদান রাখবে, যার ফলে ডেভেলপারদের জন্য মূলধন সংগ্রহ সহজ হবে এবং সুদের হারও কমতে পারে। খরচ অনুযায়ী এই পদ্ধতির ফলে প্রকল্পের আর্থিক ঝুঁকি কিছুটা হ্রাস পাবে।

তবু সমস্যা রয়ে গেছে: যদিও এই উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়েছে, সাইজওয়েল সি প্রকল্পেও ব্যয় (Cost) লাফিয়ে বাড়ছে। ধারণা করা হয়েছিল, এটি ২০ বিলিয়ন পাউন্ডে শেষ হবে, কিন্তু নতুন পূর্বাভাস বলছে খরচ ৪০ বিলিয়ন পাউন্ড পর্যন্তও গড়াতে পারে—যা হিংকলি পয়েন্ট সি-কে বাদ দিলে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল পারমাণবিক কেন্দ্র হতে পারে।

যদি এমনটা হয়, তাহলে দুটি প্রশ্ন উঠবে:

  1. প্রকল্পের অর্থনৈতিক টেকসইতা (Viability): অতিরিক্ত ব্যয় এভাবে বাড়লে, প্রকল্পটি আদৌ লাভজনক হবে কিনা বা কার্যকর হবে কিনা সন্দেহের মুখে পড়বে।
  2. পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা না নেওয়া: বারবার একই ভুল করে খরচ বাড়িয়ে তোলা যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা (State Capacity) নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া—অন্যান্য দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্রমবর্ধমান অভিজ্ঞতার মাধ্যমে খরচ কমাতে পেরেছে; অথচ ব্রিটেন বারবার এক ধরণের অনভিজ্ঞতা ও প্রশাসনিক জটিলতায় পড়ছে।

কেন পারমাণবিক বিদ্যুৎ বজায় রাখা জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে

যারা নবায়নযোগ্য শক্তির পক্ষে যুক্তি দেন, তারা বলবেন যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ এমনিতেই ব্যয়বহুল, জটিল ও সময়সাপেক্ষ। তবে লেবার পার্টি কিংবা বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞদের বড় একটি অংশের মত হল:

  • স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতা: সৌর ও বায়ু শক্তি এলেও দিনে-রাতে এবং আবহাওয়ার তারতম্যে উৎসের তারতম্য হয়। ব্যাকআপ হিসেবে কিংবা “বেস লোড” (Base Load) নিশ্চিত রাখতে পারমাণবিক শক্তি একটি নির্ভরযোগ্য উত্স।
  • নেট জিরো লক্ষ্য: যদি গ্রিডে (National Grid) বড় পরিমাণ শূন্য-কার্বন নির্গমনের (Zero Carbon Emission) বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়, তবে গ্যাস বা কয়লার বিকল্প হিসেবে পারমাণবিক উপযোগী হতে পারে। ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন হ্রাসের ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য ও পারমাণবিকের সমন্বয় একটি কর্মপদ্ধতি হতে পারে।

অন্যান্য প্রসঙ্গ: একাধিক ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি?

যুক্তরাজ্যে শুধু পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণেই নয়, বড় প্রকল্প—যেমন উচ্চগতির রেল (High Speed Rail) বা জলাধার নির্মাণ—সব ক্ষেত্রেই প্রায়শই খরচ ও সময়সীমা একের পর এক ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। ফলে প্রশ্ন জাগে, এটি কি প্রশাসনিক অদক্ষতা, না কি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর (Institutional Framework) সমস্যা? পারমাণবিক প্রকল্পের ক্ষেত্রে, ইঞ্জিনিয়ারিং ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ (Safety Regulations) একটু স্বাভাবিকের চেয়ে কঠোর হবে—এটা প্রত্যাশিত। তবু পরিকল্পনার সাথে বাস্তবতার ফারাক এত বিশাল কেন?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন:

  1. অভিজ্ঞ প্রকৌশলী ও কর্মী ঘাটতি: নিয়মিত পারমাণবিক কেন্দ্র বানালে অভিজ্ঞতাও সঞ্চিত হয়। টানা ৩০-৪০ বছর বিরতি থাকায় দক্ষ জনবলও পুরনো হয়ে গেছে বা অন্য খাতে চলে গেছে।
  2. প্রাতিষ্ঠানিক মেমরি (Institutional Memory) লোপ: আগের যেসব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা এসব প্রকল্প চালাত, অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলো আর নেই, বা নেতৃত্বে আমূল পরিবর্তন এসেছে। ফলে পূর্ব-অর্জিত অভিজ্ঞতা হারিয়ে গেছে।
  3. রাজনৈতিক দোলাচল: একেকটি সরকার আসছে, প্রকল্পের প্রতি তাদের অবস্থান বা অর্থায়ন কৌশল ভিন্ন হতে পারে। এটি দীর্ঘমেয়াদি কাজের জন্য বিঘ্ন সৃষ্টি করে।
  4. বিদ্যুৎখাতের বেসরকারীকরণ (Privatisation) ও বৈদেশিক বিনিয়োগ: EDF ও চীনের CGNPC-এর মতো বিদেশি সংস্থা যখন যুক্তরাজ্যে বিনিয়োগ করে, তখন যুক্তরাজ্যের নিয়ন্ত্রক কাঠামোর সাথে মানিয়ে নিতে তাদের অনেক সংশোধনী প্রয়োজন হয়। এতে অতিরিক্ত সময় ও খরচ যুক্ত হয়।

উপসংহার

যুক্তরাজ্যের পারমাণবিক শক্তির ভবিষ্যৎ এখন এক দ্বিধার ক্রসরোডে দাঁড়িয়ে। একদিকে, পুরনো কেন্দ্রগুলো শিগগিরই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ফলে নির্ভরযোগ্য বেস লোড বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নতুন কেন্দ্র দরকার বলে কেউ কেউ মনে করেন—বিশেষত ২০৫০ সালের মধ্যে নেট জিরো (Net Zero) লক্ষ্য পেতে গেলে পারমাণবিক বড় ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যদিকে, নতুন কেন্দ্র নির্মাণ যে পরিমাণ অর্থ ও সময়সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে সমালোচনাও প্রচুর। হিংকলি পয়েন্ট সি (Hinkley Point C) বারবার দেরি হচ্ছে এবং ব্যয় প্রায় দ্বিগুণের বেশি হয়ে যাচ্ছে। সাইজওয়েল সি (Sizewell C) প্রকল্পও একই পথে যাচ্ছে কি না, সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না—কারণ ইতোমধ্যেই সম্ভাব্য বাজেট ২০ বিলিয়ন পাউন্ড থেকে ৪০ বিলিয়ন পাউন্ডে পৌঁছানোর কথা শোনা যাচ্ছে।

অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া (South Korea), ফ্রান্সের (France) মতো দেশ একাধিক কেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে প্রযুক্তি ও অভিজ্ঞতার বিকাশ ঘটিয়ে খরচ কমিয়ে ফেলতে পেরেছে। যুক্তরাজ্যে এত বছর বিরতি দিয়ে হঠাৎ করে বিগ-স্কেল প্রকল্পে আসায় নতুন করে যাবতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে—নকশা সংশোধনী, শ্রমিক ও সরবরাহ ঘাটতি, ব্রেক্সিট-পরবর্তী জটিলতা থেকে শুরু করে কোভিড পরবর্তী মন্দা ও মুদ্রাস্ফীতি।

ফলে, সমাধান সহজ নয়। সরকারি বা বিরোধী দল যা-ই বলুক, বাস্তবতা হলো, হিংকলি বা সাইজওয়েল—সব প্রকল্পের খরচ বেড়ে গেলে এর মূল্য শেষ পর্যন্ত ভোক্তা ও করদাতা—উভয়কেই বহন করতে হবে। কেউ কেউ বলবেন, এর চাইতে নবায়নযোগ্য খাতে আরও ব্যাপক বিনিয়োগ করলে ভালো হতো, আবার অনেকে বলবেন, আবহাওয়া-নির্ভর উৎসের সীমাবদ্ধতা মেটাতে পারমাণবিকই স্থিতিশীল সমাধান।

সব মিলিয়ে, যুক্তরাজ্যে পারমাণবিক শক্তির ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করছে এই নতুন প্রকল্পগুলোর সাফল্য বা ব্যর্থতার ওপর। যদি ‘সাইজওয়েল সি’ আগের সমস্যাগুলোকে পাশ কাটিয়ে তুলনামূলকভাবে সময় ও বাজেটের মধ্যে থেকে শেষ করা যায়, তবে এটা আগামী দিনের আরো পারমাণবিক প্রকল্পের পথ সুগম করতে পারে। কিন্তু যদি ব্যয় আবারো আকাশছোঁয়া হয় এবং সময়সীমা একের পর এক পিছিয়ে যেতে থাকে, তবে যুক্তরাজ্যের নীতিনির্ধারকদের (Policy Makers) কাছে পারমাণবিক বিকল্প আরও অনাকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। এদিকে জ্বালানি নিরাপত্তা (Energy Security) ও নেট জিরো লক্ষ্যের মধ্যে সমন্বয় আনতে নানামুখী সমাধানের প্রয়োজন।

দিনশেষে, “যুক্তরাজ্যের পারমাণবিক শক্তিতে কী ভুল হলো?”—এই প্রশ্নটির পেছনে লুকিয়ে আছে বিপুল শিক্ষা: বড় অবকাঠামো প্রকল্পের পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত ধারাবাহিকতা, দক্ষ জনবল সংরক্ষণ, প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং আর্থিক ঝুঁকি মোকাবিলার সঠিক মডেল নিয়ে ভাবা অত্যন্ত জরুরি। ফ্রান্স বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশ যেখানে অভিজ্ঞতা ও ধারাবাহিক নির্মাণের কারণে সফলতা পেয়েছে, সেখানে যুক্তরাজ্যে বহু দিনের বিরতি ও নতুন নতুন আইনি/নিয়ন্ত্রক জটিলতা প্রকল্পকে বিঘ্নিত করেছে। শেষ পর্যন্ত, এই শিক্ষা কীভাবে কাজে লাগানো হবে, সেটাই দেখার বিষয়। কেননা, পারমাণবিক বিদ্যুৎ নির্মাণে একবার ভুল হলে, আর্থিক ও সময়ের ক্ষতি শুধু দেশীয় অর্থনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও পরিবেশগত লক্ষ্যকেও (Environmental Targets) অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়।

অতএব, ব্রিটেনের পারমাণবিক শক্তি-ভিত্তিক ভবিষ্যৎ এখনো ঝুলে আছে নির্মাণ ব্যয়, সময়সীমা, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের টানাপোড়েনে। ভবিষ্যতে কী ঘটতে চলেছে—আপাতত সে উত্তর সময়ই দিতে পারবে।

যুক্তরাজ্য সম্পর্কে আরও সংবাদ ও বিশ্লেষণ জানতে দেখুন – যুক্তরাজ্য সংবাদ

তথ্যসূত্র

Explainer on the current state of nuclear in the UK:
https://world-nuclear.org/information-library/country-profiles/countries-t-z/united-kingdom

Explainer on Hinkley Point C:
https://www.power-technology.com/projects/hinkley-point-c-nuclear-power-station/?cf-view

Our World in Data on the UK’s Energy Mix:
https://ourworldindata.org/grapher/electricity-mix-uk

BBC News on the Lifespan of current nuclear reactors:
https://www.bbc.co.uk/news/articles/c33dvekx021o

DailyMail on why Sizewell C costs have soared
https://www.dailymail.co.uk/news/article-14285005/Labour-ministers-urged-reveal-true-cost-building-Sizewell-C-cost-building-Suffolk-nuclear-plant-doubles-40BN.html

The Spectator on why Hinkley Point C and Sizewell C
https://www.spectator.co.uk/article/why-britain-is-building-the-worlds-most-expensive-nuclear-plant/

FT on the Hinkley Point C Delay
https://www.ft.com/content/1157591c-d514-4520-aa17-158349203abd

BBC News Explainer on Sizewell C
https://www.bbc.co.uk/news/uk-england-suffolk-62035444

BBC News Explainer on Hinkley Point C
https://www.bbc.co.uk/news/business-68073279

Why Extra Workers were Needed for Hinkley Point C
https://www.constructionnews.co.uk/contractors/bouygues/hinkley-point-c-logistics-challenge-revealed-as-3000-more-workers-needed-04-04-2022/

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.