কেন যুক্তরাষ্ট্রে বন্ডের ইল্ড বা সুদের হার বাড়ছে আর কেন তা ট্রাম্পের জন্য খারাপ?

ভূমিকা

২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসের ২১ তারিখে প্রকাশিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে এক নজরে বড় খবর হলো যুক্তরাষ্ট্রের (United States) দীর্ঘমেয়াদি সরকারি বন্ডের (Government Bonds) সুদের হার (Interest Rate) অর্থাৎ ট্রেজারি ইয়িল্ড (Treasury Yields) উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প (Trump) পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর তার বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতি, যেমন বড় অঙ্কের ট্যারিফ (Tariffs) আর ট্যাক্স কাট (Tax Cuts) প্রস্তাব, অনেক অর্থনীতিবিদের ভাষায় আর্থিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন অর্থনীতির দুর্বল দিকগুলো প্রকট হয়ে উঠছে, বিশেষ করে সরকারের ঋণ-জিডিপি অনুপাত (Debt-to-GDP ratio) ও বাজেট ঘাটতি (Deficit) বৃদ্ধির দিকে ইঙ্গিত করছে। এর মধ্যে ট্রাম্পের নতুন কোষাধ্যক্ষ (Treasury Secretary) মনোনীত স্কট বেসান্ট (Scott Besant) কংগ্রেসের সামনে শুনানিতে হাজির হন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ ও আর্থিক কাঠামো নিয়ে সতর্কতা জানান। এই নিবন্ধে আমরা দেখব কী কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ইয়িল্ড বাড়ছে, কেন এটি ট্রাম্পের জন্য অস্বস্তিকর, এবং সংকট নিরসনের সম্ভাব্য পথগুলো কী হতে পারে।

ট্রেজারি মার্কেটে কী ঘটছে

ট্রেজারি (Treasury) বলতে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি বন্ড বোঝায়, যা বিভিন্ন মেয়াদে ইস্যু করা হয়। এর মাঝে ১০ বছরের ট্রেজারি (10-year Treasury) ও ৩০ বছরের ট্রেজারি (30-year Treasury) বেশ উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদি এসব ট্রেজারির দাম (Price) পড়ে গেছে, ফলে ইয়িল্ড (Yield) বা সুদের হার বেড়ে গেছে। সাধারণত, বন্ডের দাম কমে গেলে তার ইয়িল্ড বা সুদের হার বাড়ে, আর দাম বাড়লে সুদের হার কমে।

১০ বছরের ট্রেজারি ইয়িল্ড (10-year Treasury yield) ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ৩.৬% (percent) থেকে বেড়ে চলতি মাসের গোড়ার দিকে ৪.৮%-এর মতো উচ্চতায় পৌঁছায়। একইভাবে, ৩০ বছরের ট্রেজারি ইয়িল্ড (30-year Treasury yield) ৪%-এর নিচ থেকে প্রায় ৫%-এর কাছাকাছি উঠে আসে। যদিও সাম্প্রতিক কিছুদিনে হারের ওঠানামা সামান্য কমেছে, তবু গড়ে এটি ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দার (Financial Crisis of 2008) পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করছে।

গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এ সময়ে ফেডারেল রিজার্ভ (Federal Reserve) সুদের হার (Interest Rate) কাটছাঁট করছে বা কমানোর দিকে যাচ্ছে, অথচ ট্রেজারি ইয়িল্ড বিপরীতভাবে বাড়ছে। সাধারণত ফেড যখন নীতি সুদহার (Policy Interest Rate) কমায়, তখন সরকারি ও বেসরকারি—উভয় ক্ষেত্রেই ঋণ নেওয়ার খরচ কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন সরকারের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেওয়ার খরচ বাড়ছে। কেন এমন ঘটছে, সে বিষয়ে বিশ্লেষকরা ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।

বাড়তি ইয়িল্ডের সম্ভাব্য কারণ

১. শক্তিশালী অর্থনৈতিক তথ্য (Strong Economic Data): কিছু বিশ্লেষকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সূচক বা জিডিপি (GDP) প্রবৃদ্ধি বেশ শক্তিশালী। মানুষ অনেক কেনাকাটা করছে, ভোক্তা আস্থা (Consumer Confidence) ভালো অবস্থায় রয়েছে। অর্থনীতি যখন শক্তিশালী হয়, তখন মুদ্রাস্ফীতির (Inflation) ঝুঁকি বাড়তে পারে। ফেডের পক্ষে তখন অতিরিক্ত হার কাটছাঁট করে অর্থনীতিকে উদ্দীপিত করার প্রয়োজনীয়তা থাকে না। বরং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়ানোই সাধারণত জরুরি হয়ে পড়ে। এতে বাজার প্রত্যাশা করে যে ফেড হয়তো সুদহার অতিদ্রুত কমাবে না, বরং বেশ কিছুদিন উচ্চ রাখবে। এই প্রত্যাশাই দীর্ঘমেয়াদি ট্রেজারি ইয়িল্ড বাড়িয়ে দিচ্ছে।

২. ট্রাম্পের নীতিগত প্রভাব (Trump’s Policies): অন্যদিকে, আরেক দল বিশ্লেষকের দাবি, ইয়িল্ড বাড়ার পেছনে ট্রাম্পের নীতিও (Policy) বড় ভূমিকা রাখছে। তার আমলে বড় মাত্রার ট্যারিফ ও কর ছাড় (Tax Cuts) প্রস্তাব করা হয়েছে। কর ছাড় বাড়লে সাধারণ মানুষের হাতে অর্থ বেশি থাকে, যা ভোগ্যপণ্যে ব্যয় বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতির চাপ তৈরি করে। আবার ট্যারিফ বৃদ্ধির ফলে আমদানি (Import) ব্যয় বেড়ে যায়, বা মানুষকে তুলনামূলক বেশি দামে স্থানীয় পণ্য কিনতে বাধ্য করে, যা পণ্যের সাধারণ মূল্যস্তর ওপরে তোলে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ফেড সুদহার বাড়ানোর ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিতে পারে, যার পরোক্ষ প্রভাব ট্রেজারি ইয়িল্ডের উপর পড়ছে। এছাড়া আরও এক কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে যে কিছু বিদেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক (Foreign Central Banks) দীর্ঘমেয়াদি ইউএস ট্রেজারি ধরে রাখতে হয়তো আগ্রহ হারাচ্ছে। ভবিষ্যতে ট্রাম্প প্রশাসন তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে—এই আশঙ্কায় তারা যুক্তরাষ্ট্রের বন্ড বিক্রি করে দিচ্ছে। এ বিষয়টিও বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ (Supply) তৈরি করে ট্রেজারি মূল্যে চাপ ফেলে, ফলে ইয়িল্ড বাড়ে।

কেন এটা ট্রাম্পের জন্য খারাপ খবর

ঋণ-জিডিপির উচ্চ অনুপাত (Debt to GDP Ratio): যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ-জিডিপি অনুপাত (Debt-to-GDP ratio) ১৯৮০ সাল থেকে ধাপে ধাপে বাড়ছে। বর্তমানে এটি প্রায় ১২৩%-এ দাঁড়িয়েছে, যা বিশ্বে অন্যতম উচ্চ অনুপাত। বাজেট ঘাটতি (Budget Deficit) এবং প্রচুর সরকারি ব্যয় (Government Spending) বাড়ায় এটি কমারও কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সম্প্রতি, ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট (Inflation Reduction Act) সহ বিভিন্ন বড় মাপের ব্যয় প্রকল্পে যুক্তরাষ্ট্র অর্থ বিনিয়োগ করছে। গত বছরে (২০২৪ সালে) যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট ঘাটতি ছিল প্রায় জিডিপির ৬%। ট্রাম্প আবারও বড় ধরনের কর ছাড় (Tax Cuts) বজায় রাখার পক্ষে, অথচ ব্যয় কমানোর সুস্পষ্ট পরিকল্পনা দেননি। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, ট্রাম্পের প্রস্তাবিত নীতিগুলো কার্যকর হলে (উদাহরণস্বরূপ, বেশি ট্যারিফ ও নবায়নযোগ্য কর ছাড়), বাজেট ঘাটতি আরও বড় হতে পারে—কমিটি ফর অ্যা রেসপন্সিবল ফেডারেল বাজেট (Committee for a Responsible Federal Budget) হিসেব করে দেখিয়েছে, এভাবে চললে ঘাটতি ১০%-এ পৌঁছতে পারে, যা শান্তিকালীন সময়ে (Peacetime) রেকর্ড পর্যায়ের ঘাটতি।

ঋণের সুদ পরিশোধ ও ‘ডুম লুপ’ (Doom Loop): সুদের হার বেড়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইতোমধ্যেই বিশাল ঋণের সুদ পরিশোধ আরও ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র শুধু আগের ঋণের সুদ মেটাতে প্রায় এক ট্রিলিয়ন (Trillion) ডলার ব্যয় করেছে। তুলনামূলকভাবে, এটি মেডিকেয়ার (Medicare) ও প্রতিরক্ষা (Defense) বাজেটের মতো বড় খাতগুলোর সঙ্গে তুলনীয় ব্যয়। যদি ট্রাম্প প্রশাসন নতুন করে আরও বেশি ঋণ নেয়, তখন সুদের খরচ (Interest Payments) বেড়ে যেতে থাকে। এটি একটি ‘ডুম লুপ’ (Doom Loop) তৈরি করতে পারে: বেশি ঋণ নিতে গিয়ে সুদের খরচ বাড়বে, যা পরিশোধ করতে হলে আবার আরও ঋণ নিতে হবে, এবং ক্রমাগত ঋণ-সুদ দুটোই বেড়ে যেতে থাকবে।

স্কট বেসান্টের সতর্কবার্তা

ট্রাম্পের কোষাধ্যক্ষ পদপ্রার্থী স্কট বেসান্ট (Scott Besant) সেনেটের শুনানিতে বলেছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল ঋণের বোঝা আরও সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। তিনি জোর দিয়েছেন, “ফিসকাল হাউস ইন অর্ডার” (fiscal house in order) বা আর্থিকভাবে একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় ফিরতে হবে। তার এই মন্তব্য বাজারকে সামান্য স্বস্তি দিলেও বাস্তব চিত্র হলো ট্রেজারি ইয়িল্ড এখনো বেশ উঁচু পর্যায়ে রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে তার সতর্কবার্তা আমলে নেওয়া না হলে আর্থিক ঝুঁকি বাড়তেই থাকবে।

বেসান্ট আরও উল্লেখ করেন যে এত বড় ঋণের বোঝা থাকায়, জরুরি বা সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে নতুন করে সহজে অর্থ ধার করা কঠিন হবে। বাজারকে আস্থা দেওয়ার জন্য তিনি স্পষ্ট করে বলেন যে যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই ঋণখেলাপি (Default) হবে না। তবু তিনি এ-ও মানেন, বাজেট ঘাটতির হার এত বেশি রাখলে স্থায়িত্ব বজায় রাখা কঠিন হবে।

কীভাবে এই সংকটের সমাধান হতে পারে

বিশ্লেষকরা বলছেন, মোটামুটি তিনটি প্রধান পথ রয়েছে যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এই ঋণ ও উচ্চ সুদের ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসতে পারে।

১. সার্বভৌম ঋণ খেলাপি (Sovereign Default): প্রথম পথটি হলো, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি বলবে যে তারা আর ঋণ শোধ করবে না বা আংশিকভাবে শোধ করবে। এটি অত্যন্ত অবাস্তব ও অস্বাভাবিক একটি পরিস্থিতি, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের (Dollar) ওপর বিশ্ব অর্থব্যবস্থা অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাছাড়া, কৌশলগত, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক—সবদিক থেকেই এটি অসম্ভবের কাছাকাছি। স্কট বেসান্টও তার বক্তব্যে এটি স্পষ্টভাবে নাকচ করে দিয়েছেন। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণখেলাপি অর্থনীতিতে বিশাল ধস ডেকে আনতে পারে, বিশ্ববাজারও চরম অনিশ্চয়তায় পড়বে।

২. আর্থিক সংহতি বা শৃঙ্খলা (Fiscal Consolidation): দ্বিতীয় পথ হলো, ট্রাম্প প্রশাসন ঋণসুবিধা ক্রমশ সীমিত করতে সরকারি ব্যয় (Spending) কমানো বা বাড়তি কর (Tax) আরোপের মাধ্যমে আয় (Revenue) বাড়ানোর চেষ্টা করবে। এভাবে বাজেট ঘাটতি কমে গেলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে এবং ট্রেজারি ইয়িল্ড কমতে পারে। সেনেট শুনানিতে বেসান্ট বলেছেন যে তিনি ব্যয় সংকোচনের (Spending Cuts) পক্ষে। বিশেষ করে, ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট (IRA) এর অধীনে যে উদার ভর্তুকি (Subsidy) দেওয়া হচ্ছে, সেটিকে তিনি “অতিমাত্রায় ব্যয়বহুল” বলে সমালোচনা করেন। অন্যদিকে, ট্রাম্পের করছাড়কে (Tax Cuts) নবায়ন না করলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটতে পারে বলেও বেসান্ট আশঙ্কা প্রকাশ করেন। ফলে, কর বাড়ানোর সম্ভাবনা তিনি কার্যত অস্বীকারই করেছেন। বরং, তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের একটি “খরচের সমস্যা” রয়েছে, আয়-সংক্রান্ত সমস্যা নয়। অনেকে বলছেন, বাজেটে ‘অপ্রয়োজনীয় ব্যয়’ চিহ্নিত করতে ট্রাম্প হয়তো ইলন মাস্ক (Elon Musk) ও তার “ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি” (Department of Government Efficiency) বা সংক্ষেপে ডোজ (Doge) এর সাহায্য চাইতে পারেন। সেখানে এমন কিছু ‘ব্যয় হ্রাসের’ পরিকল্পনা করা যেতে পারে, যা রাজনীতিকভাবে গ্রহণযোগ্য এবং সাধারণ মানুষের কাছে “সাশ্রয়” (Savings) হিসাবে উপস্থাপন করা সম্ভব। তবে সমস্যা হলো, যদি তেমন বড় কোনো ব্যয় সংকোচনের সুযোগ না পাওয়া যায় এবং ট্রাম্প প্রশাসন কঠিন সিদ্ধান্তে যেতে না চায়, তখন তৃতীয় পথটিই একমাত্র উপায় হতে পারে।

৩. ফিসকাল ডমিনেন্স (Fiscal Dominance): তৃতীয় পথটি হলো, ট্রাম্প প্রশাসন নিজেদের ইচ্ছামতো বিপুল ব্যয় (Spending) ও ঋণ (Borrowing) বাড়াতে থাকবে, আর একই সঙ্গে ফেডারেল রিজার্ভের (Federal Reserve) ওপর চাপ সৃষ্টি করবে তাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য। ফেডকে অনুরোধ করতে পারে আরও বেশি পরিমাণে অর্থ সরবরাহ (Money Printing) বাড়াতে, সুদহার কমিয়ে আনতে, যাতে সরকার কম খরচে ঋণ নিতে পারে। একে ফিসকাল ডমিনেন্স (Fiscal Dominance) বলা হয়—যেখানে মৌলিকভাবে সরকারের ঋণ ও ব্যয় নীতিই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (Central Bank) নীতি নির্ধারণে প্রাধান্য বিস্তার করে। তবে ফেডের সামনে এখানে বড় দ্বিধা। ফেডের আইনগত দায়িত্ব হলো মুদ্রাস্ফীতি ২%-এ (Inflation Target) রাখার চেষ্টা করা এবং দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল মুদ্রানীতি বজায় রাখা, সরকারের ঋণ মেটানোর জন্য টাকা ছাপানো নয়। কিন্তু যদি সরকার সত্যিই বড় অঙ্কের ঋণের চাপে পড়ে, আর ফেড সহযোগিতা না করে, তবে এক ধরনের ঋণ-সংকট (debt crisis) সৃষ্টি হতে পারে, যা পুরো মার্কিন অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে। আবার উল্টোদিকে, যদি ফেডের স্বাধীনতা (Federal Reserve’s independence) প্রশ্নবিদ্ধ হয়, বাজারের আস্থা কমতে পারে। তখন বিদেশি ও দেশীয় বিনিয়োগকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের বন্ড কেনা কমিয়ে দিতে পারে, যার ফলে সুদের হার আরও বেড়ে ঋণ সংকট আরও খারাপ হতে পারে।

ভবিষ্যতের সম্ভাব্য চিত্র

সব মিলিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ পরিস্থিতি বেশ অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। একদিকে, ঋণ-জিডিপির উচ্চ অনুপাত, বাজেট ঘাটতি বৃদ্ধির প্রবণতা, অন্যদিকে ট্রাম্পের প্রতিশ্রুত খরচ ও করছাড়ের সিদ্ধান্ত—সব মিলিয়ে অর্থনীতি খুবই জটিল পথের দিকে এগোচ্ছে। সরকার যদি দ্রুত কোনো “ফিসকাল কনসলিডেশন” বা ব্যয়হ্রাস/আয়বৃদ্ধির সমন্বয়কৃত পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে উচ্চ হারে ট্রেজারি ইয়িল্ড বজায় থাকলে সরকারের ঋণের সুদ পরিশোধের বোঝা বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।

তাছাড়া বৈদেশিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর (Foreign Central Banks) আস্থা হারানোর প্রশ্নও আছে। যদি তারা আমেরিকান ট্রেজারি ধরে রাখতে অনীহা দেখায়, তাতে বাজারে সরবরাহ বেড়ে বন্ডের দাম পড়ে যাবে এবং ইয়িল্ড উঠবে আরও ওপরে।

ফেডের (Federal Reserve) স্বাধীনতার ওপর সংকট তৈরি হলে বাজার দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। ট্রাম্পের অতীতের রেটোরিক বা বাগাড়ম্বর থেকে বোঝা যায় যে তিনি ফেডকে চাপ দিতে পারেন। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্প তার কড়া মনোভাব সামান্য নমনীয় করেছেন, তবু ফেডের ওপরে রাজনৈতিক প্রভাব পড়লে বাজার সেটিকে ভালো চোখে দেখবে না।

সারসংক্ষেপ ও উপসংহার

১. ট্রেজারি ইয়িল্ড বাড়ছে কেন?

  • অর্থনীতি শক্তিশালী থাকলে মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কায় সুদহার কমানোর দরকার পড়ে না, ফলস্বরূপ দীর্ঘমেয়াদি ট্রেজারি ইয়িল্ড বেড়ে যায়।
  • ট্রাম্পের ট্যারিফ ও করছাড়ের মতো নীতি মুদ্রাস্ফীতিকে বাড়াতে পারে—ফেড বাধ্য হবে সুদহার উঁচু রাখতে।

২. এতে ট্রাম্পের সমস্যা কোথায়?

  • যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ-জিডিপির অনুপাত আগে থেকেই খুব বেশি (১২৩%)।
  • ট্রাম্প আরও করছাড় রাখতে চায় ও ব্যয় কমানোর কোনো কঠোর সিদ্ধান্ত এখনো দেয়নি। ঘাটতি ১০%-এ পৌঁছতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
  • ট্রেজারি ইয়িল্ড বাড়তে থাকলে সরকারের সুদ পরিশোধের খরচ বৃদ্ধি পায় এবং একটি ‘ডুম লুপ’ তৈরি হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

৩. সমাধানের পথ কী?

  • ডিফল্ট (Default): যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ও স্পষ্টতই অগ্রহণযোগ্য।
  • ফিসকাল কনসলিডেশন (Fiscal Consolidation): সরকারি ব্যয় কাটছাঁট বা কর বৃদ্ধি করে ঘাটতি কমানো, যাতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরে ও ইয়িল্ড কমে। স্কট বেসান্ট ব্যয় হ্রাসের পক্ষে হলেও করছাড় বাতিলের বিপক্ষে, ফলে কতটা ব্যয় কাটছাঁট করা যাবে, সেটি বড় প্রশ্ন।
  • ফিসকাল ডমিনেন্স (Fiscal Dominance): সরকার ব্যয় বাড়াতে থাকবে আর কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বাধ্য করবে টাকা ছাপাতে বা সুদহার কমিয়ে দিত। কিন্তু এতে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সংকট ও ফেডের স্বাধীনতা প্রশ্নের মুখে পড়বে।

মোট কথা, ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য সামনে কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। বিপুল ঋণ ও উচ্চ ইয়িল্ডের কারণে ভবিষ্যতে বাজেট ঘাটতি আর বেশি সময় ধরে রাখা সম্ভব নাও হতে পারে। একদিকে ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্টের (IRA) মতো বড় ব্যয় কর্মসূচি, অন্যদিকে মার্কিন জনগণের কাছে দেওয়া করছাড়ের প্রতিশ্রুতি—এই দুইয়ের সমন্বয় অর্থনীতিতে বাড়তি মুদ্রাস্ফীতি ও ঋণের সম্ভাব্য ফাঁদ তৈরি করছে। স্কট বেসান্ট সামনের দিনে সরকারি ব্যয় হ্রাসের উদ্যোগ নেবেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন; কিন্তু সে উদ্যোগ কতটা কার্যকর ও রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে, সেটাই দেখার বিষয়।

সবশেষে, যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কীভাবে তাদের বিশাল ঋণ ও উচ্চ ঘাটতির ব্যাপারটি সামলাবে, সেটির ওপর দেশটির আর্থিক স্থিতিশীলতা অনেকাংশে নির্ভর করবে। উচ্চ বন্ড ইয়িল্ডের যুগ চালু থাকলে শুধু ট্রাম্প নন, ভবিষ্যৎ যেকোনো মার্কিন প্রশাসনের কাছেই এটি একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। বিপুল ঋণভার ও সম্ভাব্য মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে, বিশ্ব অর্থনীতিতেও এর কম-বেশি প্রভাব পড়তে বাধ্য।

তথ্যসূত্র

1 – https://www.marketwatch.com/investing/bond/tmubmusd10y?countrycode=bx
2 – https://www.ft.com/content/72019cc6-89f9-453c-9955-4cc26be3de3e
3 – https://privatebank.jpmorgan.com/nam/en/insights/markets-and-investing/tmt/why-have-10-year-us-treasury-yields-increased-since-the-fed-started-cutting-rates
4 – https://www.ft.com/content/6ab2a61b-eebd-4d8d-887c-f2dcae937a39
5 – https://cepr.org/voxeu/columns/reverse-conundrum-and-foreign-official-demand-us-treasuries
6 – https://www.ceicdata.com/en/indicator/united-states/government-debt–of-nominal-gdp
7 – https://www.crfb.org/papers/fiscal-impact-harris-and-trump-campaign-plans
8 – https://www.pgpf.org/article/what-is-the-national-debt-costing-us/
9 – https://www.ft.com/content/25c94540-114e-4c1b-8d92-4c0cc4e6ef6d

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.