Table of Contents
ভূমিকা
ইউক্রেনে (Ukraine) রাশিয়ার (Russia) আগ্রাসন শুরুর পর থেকেই রাশিয়ার অর্থনীতি (Russian Economy) প্রত্যাশার চেয়ে ভালো পারফর্ম করেছে—কম-বেশি চাপে থেকেও রুশ তেল ও গ্যাস রপ্তানি থেকে বড় অঙ্কের মুনাফা অর্জন করে এসেছে, পশ্চিমা বিশ্বের একাধিক নিষেধাজ্ঞা (Western Sanctions) সত্ত্বেও। কিন্তু সাম্প্রতিক তথ্য ও রাশিয়ান সরকারের খসড়া বাজেট (Draft Budget) অনুযায়ী, আগামী দুই বছরে রাশিয়ার জ্বালানি খাত থেকে রাজস্ব উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে পারে। আজকের নিবন্ধে আমরা দেখব:
- কীভাবে রাশিয়া এতদিন তেল-গ্যাস খাত থেকে আয় অব্যাহত রাখতে পেরেছে।
- কেন এই আয় শিগগিরই কমে যেতে পারে।
- ভবিষ্যতে ক্রেমলিনের (Kremlin) আর্থিক অবস্থার অবনতি ঠিক কতটা গুরুতর হতে পারে।
রাশিয়া এতদিন তেল-গ্যাস থেকে আয় ধরে রাখল কীভাবে
সাধারণ অনুমান অনুযায়ী, ইউক্রেনে আক্রমণের (Invasion of Ukraine) পর রাশিয়ার জ্বালানি থেকে আয় অনেকটাই কমে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে সেটা ঘটেনি—বরং অবিশ্বাস্যভাবে ভালো অবস্থায় ছিল।
ইউরোপ ছিল মূল ক্রেতা:
- আক্রমণের আগে ইউরোপ (Europe) ছিল রাশিয়ার তেল-গ্যাস রপ্তানির প্রধান বাজার। ইউরোপ রাশিয়ান গ্যাসের প্রায় ৭৫% আমদানি করত (Gas Exports) এবং ইউরোপের গ্যাস আমদানির (Gas Imports) ৪০% এর বেশি আসত রাশিয়া থেকে।
- অস্ট্রিয়া (Austria) ও লাটভিয়া (Latvia)-র মতো দেশ ৮০%-এরও বেশি গ্যাস রাশিয়া থেকে পেত।
নিষেধাজ্ঞার প্রভাব আংশিক সফল: ইইউ (EU) আক্রমণের পর রাশিয়ান জ্বালানির ওপর নির্ভরতা (Reliance on Russian Energy) কমানোর জন্য বেশ কিছু ব্যবস্থা নেয়—যেমন সমুদ্রপথে (Seaborne) রাশিয়ান ক্রুড তেলের উপর নিষেধাজ্ঞা, ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলার (Price Cap) মূল্যসীমা ইত্যাদি। এতে ইউরোপ সফলভাবে রাশিয়ান পাইপলাইনের গ্যাস আমদানি প্রায় ৮০% কমিয়েছে। তবে তাতেও রাশিয়া তেল-গ্যাস রপ্তানি থেকে বেশ বড় আয় ধরে রাখতে পেরেছে।
- অক্সফোর্ড ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি স্টাডিজ (Oxford Institute for Energy Studies) জানায়, ২০২২ সালে রাশিয়ার জ্বালানি আয় বরং বেড়েছিল, এবং ২০২৩ সালে কিছুটা কমলেও তা এখনো ২০২১ সালের তুলনায় প্রায় একই মাত্রায় রয়ে গেছে।
- সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের (CREA) ফসিল ট্র্যাকার (Fossil Tracker) অনুযায়ী, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়া প্রায় ৮১৯ বিলিয়ন ইউরো আয় করেছে জীবাশ্ম জ্বালানির (Fossil Fuel) রপ্তানি থেকে। এর ফলে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে (War in Ukraine) অর্থায়ন চালিয়ে যেতে পেরেছে।
নিষেধাজ্ঞা অকার্যকর হওয়ার কারণ:
- ১) কিছু ইউরোপীয় দেশের বিশেষ ছাড় (Exemption): চেকিয়া (Czechia), অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি (Hungary), স্লোভাকিয়া (Slovakia) ও বুলগেরিয়া (Bulgaria)-কে রাশিয়ান গ্যাস আমদানিতে পুরো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। ফলে রাশিয়া সেসব দেশে গ্যাস বেচতে পেরেছে।
- ২) নিষেধাজ্ঞার ফাঁকফোকর (Loopholes): ইউরোপ সরাসরি রাশিয়ান তেল কিনতে নিষিদ্ধ (Ban on Russian Oil Imports), কিন্তু তৃতীয় কোনো দেশে প্রক্রিয়াকৃত (Refined) পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানিতে বাধা নেই। ফলে তুরস্ক (Turkey) ও ভারত (India) রাশিয়ান ক্রুড পরিশোধন করে ইউরোপে রপ্তানি করছে, আর ইউরোপ তাদের কাছ থেকে ক্রয় করছে।
- ৩) তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসে (LNG) বিধিনিষেধ নেই: ইউরোপে রাশিয়ান এলএনজি (Liquefied Natural Gas) আমদানি নিষিদ্ধ নয়। ফলে ২০২৪ সালে ইউরোপে রাশিয়ান এলএনজি আমদানিতে রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি ঘটে, যা পাইপলাইন গ্যাসের হ্রাস পুষিয়ে দেয়।
- ৪) বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়া (Price Increase): নিষেধাজ্ঞা ও যুদ্ধের জেরে সারা দুনিয়ায় তেল-গ্যাসের দাম বেড়ে যায়। রাশিয়াকে ডিসকাউন্টে বিক্রি করতে হলেও দাম যখন উচ্চমাত্রায়, বিক্রি করলেই বেশ ভালো আয় হয়। তেল ও গ্যাস আধুনিক অর্থনীতির কেন্দ্রীয় উপাদান বলেই ক্রেতা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়নি।
- ইউরোপীয় নিষেধাজ্ঞার পর রাশিয়া এশিয়ায় (Asia)—বিশেষত ভারত (India) ও চীনে (China)—তেল রপ্তানি দ্রুত স্থানান্তর করে।
- ২০২৪ সালের নভেম্বরে, রাশিয়ান ক্রুড রপ্তানির ৪৭% কিনেছে চীন, ৩৭% কিনেছে ভারত। আগে ভারতের মোট তেল আমদানিতে রাশিয়ার তেলের অংশ ছিল ১%-এর নিচে, এখন প্রায় ৪০%।
কেন ২০২৫ সালে রাশিয়ার তেল-গ্যাস আয় পতন ঘটতে পারে
অবশ্য ২০২৫ সালে এসে (রাশিয়ান খসড়া বাজেটের ইঙ্গিত মতে) রাশিয়ার জ্বালানি আয়ে ১৪% পর্যন্ত হ্রাস (Fall) ঘটতে পারে। এমনকি বাস্তবে এ হ্রাস আরও বেশি হতে পারে। অন্তত তিনটি প্রধান কারণ এখানে কাজ করছে:
- বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমতে পারে (Global Oil Price Decrease)।
- চীনের সঙ্গে গ্যাসের দামে সমঝোতা নিয়ে বিরোধ (Gas Pricing Dispute)।
- ইউক্রেনের মাধ্যমে পাইপলাইনে গ্যাস রপ্তানির চুক্তি শেষ হওয়া (Transit Deal Expiry)।
১) বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমবে (Global Oil Prices Likely to Fall): রাশিয়ার রাজস্ব (Revenue) কতটা হবে, তা মূলত তেল দামের ওপরই নির্ভর করে। যেমন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক (World Bank) পূর্বাভাস দিয়েছে, ব্রেন্ট ক্রুডের (Brent Crude) দাম ৮০ ডলার থেকে গড়ে ৭৩ ডলারে নেমে আসতে পারে ২০২৫ সালের মধ্যে। এর মধ্যে রাশিয়ান তেলে “সাশ্রয়মূল্যের ছাড়” (Sanctions Discount) যোগ করলে—তাদের আয় আরও কমে যাবে।
- চীনের অর্থনৈতিক মন্দা (China’s Ongoing Economic Crisis): চীনের দুর্বল চাহিদা (Weak Demand) তেলের দামের ওপর চাপ ফেলতে পারে।
- ওপেকের (OPEC) উৎপাদন বৃদ্ধি: সৌদি আরব (Saudi Arabia) ও রাশিয়ার ঐচ্ছিক উৎপাদন কমানোর (Production Cuts) উদ্যোগ খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ধারণা করছে, ওপেক যোগান বাড়ালে (Increase Supply), তেলের দাম আরও কমে যাবে।
- ট্রাম্পের প্রো-অয়েল নীতি (Trump’s Pro-Oil Agenda): অনেকে বলছেন, “ড্রিল, বেবি, ড্রিল (Drill, Baby, Drill)” স্লোগান নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন বাড়িয়ে দেন, বিশ্ববাজারে সরবরাহ আরও বাড়বে, দাম আরও পড়বে।
কিছু বিশ্লেষক (যেমন OPIS) মনে করেন, তেলের দাম নেমে ৩০-৪০ ডলার পর্যন্ত যেতে পারে, যদি ওপেক সমন্বয়হীনভাবে উৎপাদন বাড়িয়ে ফেলে। এতে রাশিয়ান বাজেটে ঘাটতি (Budget Deficit) জিডিপির ০.৫% থেকে প্রায় ৩%-এ উঠে যাবে, যা অর্থায়ন করা কঠিন হবে (কেননা বিদেশি ঋণও এখন সীমিত)।
২) চীনের সঙ্গে গ্যাস-দাম বিরোধ (Gas Pricing Dispute with China): চীন (China) এখন রাশিয়ার প্রধান জ্বালানি ক্রেতা হলেও, দু’পক্ষের মধ্যে দাম নিয়ে (Pricing) বড় মতবিরোধ চলছে।
- ইউরোপীয় বাজার হারানোর বিকল্প: রাশিয়া ইউরোপীয় পাইপলাইনে (Pipeline to Europe) যে বিপুল পরিমাণ গ্যাস রপ্তানি করত, সেটি বন্ধ হওয়ার পর আশা করছিল চীনের দিকে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে “পাওয়ার অব সাইবেরিয়া ২ (Power of Siberia 2)” পাইপলাইন দিয়ে।
- পাওয়ার অব সাইবেরিয়া ১ (Power of Siberia 1): ২০১৯ সালে চালু হওয়া এ পাইপলাইনে চীনে বছরে সর্বোচ্চ ৩৮ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস সরবরাহ সম্ভব, যেখানে রাশিয়া একসময় ইউরোপে ২০০ বিলিয়ন ঘনমিটার পর্যন্ত রপ্তানি করত।
- পাওয়ার অব সাইবেরিয়া ২ নির্মাণে অগ্রগতি নেই: দুই বছর পরও প্রকল্পের কাজ শুরুই হয়নি, ফাইনানশিয়াল টাইমস এক প্রতিবেদনে বলেছে, চীন সস্তায় (Unpalatably Low Price) গ্যাস কিনতে চাইছে। কারণ চীনের বিকল্প সরবরাহ আছে (Diversified Pipeline & LNG), কিন্তু রাশিয়ার তেমন বিকল্প নেই। ফলে মস্কো (Moscow) চীনের প্রস্তাবে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হতে পারে।
৩) ইউক্রেনের সঙ্গে গ্যাস ট্রানজিট চুক্তির মেয়াদোত্তীর্ণ (Transit Deal Expiry): ২০২৪ সালের শেষে ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার গ্যাস ট্রানজিট চুক্তি শেষ হয়েছে, যা আর নবায়ন হয়নি। ফলে রাশিয়া ইউক্রেনের মাধ্যমে ইউরোপে গ্যাস পাঠাতে পারবে না।
- এই পাইপলাইনটি ছিল “Brotherhood pipeline,” যার মাধ্যমে রুশ রাষ্ট্রীয় জ্বালানি জায়ান্ট গ্যাজপ্রমের (Gazprom) রাজস্ব আসত।
- গ্যাজপ্রম ২০২৩ সালে ৬০০ বিলিয়ন রুবল লোকসান (Loss) করেছে, আর এই ট্রানজিট চুক্তি না থাকা মানে তাদের বাড়তি ৭-৮ বিলিয়ন ডলার হারানোর শঙ্কা, যা রাশিয়ান গ্যাস রপ্তানির (Gas Exports) প্রায় ১০%।
এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন – ইউরোপে রাশিয়ান গ্যাস যুগের সমাপ্তি
ভবিষ্যতের পরিণতি: কতটা খারাপ হতে পারে
অনেকে বলছেন, তেল ও গ্যাসের দাম আগামী কয়েক মাসে কীভাবে রূপ নেয়, তার ওপরই রাশিয়ান অর্থনীতির ভাগ্য নির্ভর করছে।
- মধ্যপ্রাচ্যের (Middle East) অস্থিরতা: মধ্যপ্রাচ্যে ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা (Geopolitical Turbulence) বাড়লেও তেলের দাম আপাতত বড় কোনো ঊর্ধ্বগতির দিকে যায়নি।
- নানামুখী ঝুঁকি: ওপেক যদি উৎপাদন সমন্বয়ে ব্যর্থ হয়, চীনের চাহিদা কম থাকে, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন আরও বাড়িয়ে দেন—এসব কিছু মিলে রাশিয়ান তেল ও গ্যাস আয়ের বড় পতন ঘটতে পারে।
- রাশিয়ান বাজেট ঘাটতি (Budget Deficit) ও অর্থায়নের চ্যালেঞ্জ: রাশিয়ান সরকারি আয় যদি যথেষ্ট না থাকে, তখন যুদ্ধ পরিচালনা ও অভ্যন্তরীণ ব্যয় সমন্বয় করা ক্রেমলিনের জন্য কঠিন হবে।
সর্বোপরি, ২০২৫ সাল হতে পারে সেই বছর, যখন রাশিয়ার জ্বালানি খাত থেকে আসা রাজস্ব সত্যিকার অর্থে মারাত্মক একটা ধাক্কা খাবে—আর সেই ধাক্কা মোকাবিলায় পুতিন প্রশাসনকে (Putin Administration) কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে।
আরও পড়ুন –
- ইউরোপে রাশিয়ান গ্যাস যুগের সমাপ্তি (২ জানুয়ারি, ২০২৫)
- বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের শক্তির পরিবর্তন: যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও রাশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা (৩০ নভেম্বর, ২০২৪)
- অর্থনৈতিক সংকটে রাশিয়া (১৯ নভেম্বর, ২০২৪)
রাশিয়া সম্পর্কে আরও সংবাদ ও বিশ্লেষণ সম্পর্কে জানতে যান এখানে – রাশিয়া ও ইউক্রেইন সংবাদ
তথ্যসূত্র
Europe-Russia energy dependence
https://www.statista.com/statistics/1201743/russian-gas-dependence-in-europe-by-country/
https://www.bruegel.org/dataset/european-natural-gas-imports
Russia energy export revenues
https://www.oxfordenergy.org/wpcms/wp-content/uploads/2024/03/Follow-the-Money-Russian-Oil.pdf
Russian-Azeri oil
European imports of Russian LNG
https://www.ft.com/content/ef4230c1-befa-4053-97b2-397c69c20002
India and China Russian oil imports
Russian energy revenues set to decrease
Global oil prices https://www.cnbc.com/2024/11/13/oil-could-plunge-to-40-in-2025-if-opec-unwinds-voluntary-production-cuts-analysts-say.html
https://theins.ru/en/economics/277728
China-Russia gas pipeline dispute
https://www.ft.com/content/f37f4b84-0d2c-4e7b-882c-3fb26822bb9c
Leave a Reply