Table of Contents
ভূমিকা
নরওয়ের (Norway) রাজনীতিতে বহুদিন ধরে মূলত দুইটি দল কেন্দ্রে ছিল—সেন্টার-লেফট লেবার পার্টি (Labour Party) ও সেন্টার-রাইট কনজারভেটিভস (Conservatives)। কিন্তু সাম্প্রতিক জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, ডানপন্থী প্রগ্রেস পার্টির (Progress Party) সমর্থন দ্রুত বাড়ছে, আর একসময়ের প্রধান এই দুই দলের সমর্থন ক্রমাগত কমছে। পলিটিকো-র (Politico) “পোল অব পোলস” অ্যাগ্রেগেটর অনুযায়ী, গত কিছু সময়ে লেবার ও কনজারভেটিভস—উভয় দলেরই জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা দেখব নরওয়ের রাজনৈতিক কাঠামো (Political System) কেমন, কেন দুই প্রধান দলের সমর্থন হ্রাস পাচ্ছে, এবং ২০২৫ সাল জুড়ে এ ধারা কি অব্যাহত থাকবে কিনা।
নরওয়ের রাজনৈতিক ব্যবস্থা: সংক্ষেপে পরিচয়
বহুদলীয় কাঠামো ও জোট সরকারের ঐতিহ্য: নরওয়ে একটি বহুদলীয় (Multi-Party) রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে পরিচালিত হয়, যেখানে বেশির ভাগ দল দুটি প্রধান ব্লকে (Blocks) বিভক্ত—একটি সেন্টার-লেফট (Left Wing “Red Bloc”) এবং আরেকটি সেন্টার-রাইট (Right Wing “Blue Bloc”)।
- রেড ব্লক (Red Bloc): সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট (Social Democrat), সোশ্যালিস্ট (Socialist) ও গ্রিন (Green) দলের মতো বামঘেঁষা দলগুলো।
- ব্লু ব্লক (Blue Bloc): লিবারাল (Liberals), নিওলিবারাল (Neoliberals), কনজারভেটিভস (Conservatives) ইত্যাদি ডানপন্থী দলগুলো।
এতে করে, দু’দিকের জোট (Coalition) সমন্বয়ে প্রায়ই সরকার গঠিত হয়।
নির্বাচনী পদ্ধতি (Proportional Representation): নরওয়ের জাতীয় সংসদ স্টোরটিঙ্গে (Stortinget)-এর ১৬৯ জন সদস্যকে (Members of Parliament) আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (Proportional Representation) পদ্ধতিতে নির্বাচিত করা হয়।
ফিলকে (Fylke) ও ভোটের মূল্য:
- নরওয়ে কয়েকটি নির্বাচনী কাউন্টিতে বিভক্ত, যাদের স্থানীয়ভাবে “ফিলকে (Fylke)” বলা হয়। প্রতিটি ফিলকে কতজন সংসদ-সদস্য পাবে, তা নির্ধারিত হয় ওই অঞ্চলের ভৌগোলিক এলাকা ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে।
- নির্ধারণের ধরন: প্রতি বাসিন্দার জন্য ১ পয়েন্ট, আর প্রতি বর্গকিলোমিটারের (Square Kilometer) জন্য ১.৮ পয়েন্ট দেওয়া হয়। ফলে জনবহুল শহুরে এলাকার তুলনায় জনবিরল গ্রামীণ এলাকার ভোট কিছুটা বেশি ওজন পায়।
- সমর্থন ও সমালোচনা: অনেকে বলেন, কেন্দ্র থেকে দূরের অঞ্চলগুলোকে বেশি প্রতিনিধিত্ব দেওয়া উচিত। আবার অন্যদের মতে, এটি গ্রামীণ ভোটারদের “বেশি ক্ষমতা” (More Electoral Sway) দেওয়ার মাধ্যমে একধরনের বৈষম্য তৈরি করছে।
স্ক্যান্ডিনেভীয় বিশেষত্ব: দুই-ব্লক কাঠামো (Two-Block System): নরওয়ে, সুইডেন (Sweden), ও ডেনমার্ক (Denmark)-এ এক ধরনের দুই-ব্লক ব্যবস্থা দেখা যায়—সরাসরি দুই-দলের মতো জবাবদিহি (Direct Accountability) এবং একইসঙ্গে বহুদলীয় (Multi-Party) বৈচিত্র্য। ফলে দলগুলো বড় দুই শিবিরে ভাগ হয়ে একযোগে অথবা আলাদাভাবে নির্বাচন করে, পরবর্তীতে জোট (Coalition) গঠনের চেষ্টা করে।
লেবার ও কনজারভেটিভস: ঐতিহাসিক প্রাধান্য ও সর্বশেষ অবস্থা
নরওয়ের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে লেবার পার্টি (Labour Party) দ্বারা প্রভাবিত ছিল। বিশেষ করে ১৯৪৫ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত লেবার পার্টি একটানা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা (Absolute Majority) ধরে রাখে। পরবর্তীতে কখনো লেবার, কখনো কনজারভেটিভস জোট সরকার গঠন করে। যেমন—
- ২০০১ সালের পরিসংখ্যান: ওই সময় কনজারভেটিভ নেতৃত্বাধীন (Right-Wing) সরকার ক্ষমতায় আসে, পরবর্তী সময়ে ২০০৫-২০১৩ পর্যন্ত লেবার আবার ক্ষমতায় ফেরে।
- ২০১৩-২০২১: কনজারভেটিভ ও প্রগ্রেস পার্টির (Conservative-Progress) জোট সরকার গঠিত হয়।
- ২০২১: লেবার আবার ক্ষমতায় ফেরে, আলাদা একটি সংখ্যালঘু সরকার (Minority Government) গঠন করে, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন ইউনাস গার স্টোর (Jonas Gahr Støre)।
তবে গত প্রায় এক দশকে লেবার পার্টির জনপ্রিয়তা কমছে।
- ২০১৫ সালে লেবার প্রায় ৪০% সমর্থনে শীর্ষে ছিল, কিন্তু এখন তা নেমে এসেছে প্রায় ১৭%-এ।
- সাম্প্রতিক মেয়াদে (ইউনাস গার স্টোরের অধীনে) একের পর এক মন্ত্রীসভার পদত্যাগ (Cabinet Resignations), কেলেঙ্কারি (Scandals) ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব (Conflicts of Interest)—যেমন নকল কাজ (Plagiarism), ইন্সাইডার ট্রেডিং (Insider Trading) ইত্যাদি—নরওয়ের জনগণের সরকারে আস্থা (Trust) কমিয়ে দিয়েছে।
- ওইসিডি (OECD) তথ্য: ২০২১ সালে কনজারভেটিভ সরকারের মেয়াদ শেষের আগে ৬৪% নরওয়েজিয়ান সরকারকে বিশ্বাস করত। এখন লেবার সরকারে এসে ২০২৩ সালে তা ৪৮%-এ নেমে এসেছে। অর্থাৎ ১৬% পয়েন্টের বড় পতন। যদিও ৪৮% আস্থা অনেক দেশের তুলনায় বেশি, তবে অতি অল্প সময়ে এত বড় পতন ওইসিডিভুক্ত অন্য কোনো দেশে দেখা যায়নি।
কনজারভেটিভসের জনপ্রিয়তাও হ্রাস (Decline for Conservatives): কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থনও সাম্প্রতিক সময়ে (বিশেষ করে ২০২৩ সালের শুরুর দিক থেকে) কমেছে। এর বড় কারণ ডানপন্থী ভোটাররা (Right-Wing Voters) তাদের বদলে প্রগ্রেস পার্টি (Progress Party)-তে ঝুঁকছেন।
- প্রগ্রেস পার্টির বর্তমান নেতা সিলভি লিস্তাওগ (Sylvi Listhaug) তুলনামূলক নতুন মুখ (Fresher Face)।
- কনজারভেটিভদের নেতা, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এরনা সোলবার্গ (Erna Solberg)-এর চেয়ে লিস্তাওগের গ্রহণযোগ্যতা বেশি বলেই সমীক্ষা বলছে।
প্রগ্রেস পার্টির উত্থান (Rise of the Progress Party)
প্রগ্রেস পার্টি (Progress Party) সাম্প্রতিক জনমত জরিপে বড় রকমের উত্তরণ দেখছে। গত ছয় মাসে তাদের জনপ্রিয়তা প্রায় ১০% পয়েন্ট বেড়ে ১৬% থেকে ২৬%-এ পৌঁছেছে। এটি লেবার পার্টির তুলনায় প্রায় ১০% পয়েন্ট বেশি, এবং কনজারভেটিভদের চেয়ে অন্তত ৫% পয়েন্টে এগিয়ে।
সংক্ষিপ্ত পটভূমি:
- প্রতিষ্ঠা: ১৯৭৩ সালে “অ্যানডার্স ল্যাঙ্গেস পার্টি (Anders Lange’s Party)” নামে শুরু, পরে এটি প্রগ্রেস পার্টি নাম নেয়।
- ‘Mustafa Letter’ কেলেঙ্কারি: দলের দীর্ঘমেয়াদি নেতা কার্ল হাগেন (Carl Hagen) ১৯৮৭ সালে এক বিক্ষুব্ধ সভায় কথিত “Mustafa Letter” পাঠ করেন, যেখানে দাবি করা হয় একজন মুসলিম অভিবাসী (Muslim Immigrant) চিঠিতে বলেছে, “অভিবাসীরা আমাদের পিতৃভূমি দখল করতে আসছে।” এটি পরে ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়, কিন্তু ততদিনে দলটি “অভিবাসনবিরোধী” (Anti-Immigration) অবস্থানে মূলধারায় প্রবেশ করে।
- মূলধারায় একীভূতকরণ (Mainstream Acceptance): ১৯৯০-এর দশক থেকে দলটি স্থানীয় নির্বাচনে ও জাতীয় নির্বাচনে ভালো ফল করতে থাকে, একাধিকবার কনজারভেটিভদের সঙ্গে জোট গড়েছে। যেমন ১৯৯৭, ২০০৫, ২০০৯ সালের সংসদীয় নির্বাচনে লেবার পার্টির পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পেয়েছিল।
সাম্প্রতিক সমর্থন বৃদ্ধির কারণ:
- লেবার ও কনজারভেটিভদের প্রতি বিতৃষ্ণা (Fatigue with Mainstream Parties): অনেক ভোটার এখন দুই প্রধান দলকে এড়িয়ে বিকল্প হিসেবে প্রগ্রেস পার্টিকে বেছে নিচ্ছে।
- তেল ও গ্যাস রাজস্ব (Oil & Gas Revenues): রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের (Russia-Ukraine War) পর ইউরোপে নরওয়ে এখন সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহকারী (Biggest Supplier of Natural Gas)। তেলের দাম ও গ্যাস থেকে দেশের আয় বেড়েছে প্রায় ১৭০ বিলিয়ন ডলার (পরিবর্তন আগের তুলনায়)। প্রগ্রেস পার্টি বরাবরই তেল ও গ্যাস খাতে আরও বিনিয়োগ চায়, এবং প্রস্তাব করে যে নরওয়ের ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলারের সার্বভৌম তহবিল (Sovereign Wealth Fund) থেকে আরও বেশি অর্থ অবকাঠামোয় (Infrastructure) ব্যয় করা হোক। এদিকে লেবারের নেতৃত্বাধীন জোট এই বিশাল তেল-গ্যাস আয় নিয়ে কী করবে তা নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত।
আগামী নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ধারা
নরওয়ে দ্রুতই নতুন সংসদীয় নির্বাচন (Parliamentary Election) করতে চলেছে—গণমাধ্যম অনুসারে এটা এই বছরেই। লেবার দলের সংকট:
- প্রধানমন্ত্রী ইউনাস গার স্টোরের জনপ্রিয়তা পড়ে যাচ্ছে।
- মিডিয়া রিপোর্ট বলছে লেবারের অন্তত চারটি কাউন্টির (County Coalitions) নেতারা স্টোরকে পদত্যাগ (Step Down) করতে বলেছে।
- যদিও স্টোর নিজে এখনই সরে যেতে চান না, বরং অক্টোবরে তিনি বলেছেন, “লেবারের পক্ষে নির্বাচনে জয় সম্ভব।”
- দলের বর্তমান কৌশল হলো প্রগ্রেস পার্টির কিছু অর্থনৈতিক নীতি (Economic Policies) নকল করা—যেমন সবার জন্য সম্পদ কর (Wealth Tax) কমানো, তরুণদের (Young People) জন্য বাড়তি হাউজিং সহায়তা (Housing Support), আর সার্বভৌম তহবিল (Sovereign Wealth Fund) থেকে আরও সরকারি ব্যয় বাড়ানো।
ইউরোপজুড়ে পপুলিস্ট ডানপন্থার উত্থান (Populist Right Rise Across Europe): এটাও মনে রাখতে হবে, গোটা ইউরোপ ও পশ্চিমা দুনিয়ায় পপুলিস্ট ডানপন্থী (Populist Right) দলের উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদিও নরওয়ের প্রগ্রেস পার্টি আগ থেকেই মূলধারায় জায়গা করে নিয়েছে, অন্য অনেক ইউরোপীয় ডানপন্থী দলের তুলনায় সামাজিকভাবে কিছুটা ভিন্ন হলেও, “এস্টাব্লিশমেন্ট”-বিরোধী হাওয়া (Anti-Establishment Sentiment) এ দলটির পক্ষে কাজ করছে।
কী হতে পারে পরিণতি?: সবকিছু মিলিয়ে ধারণা করা যায়, এবারের নির্বাচনে (উল্লেখ্য: টেক্সটে ‘this year’ বলে উল্লেখ আছে) ডানপন্থী সরকার (Right Wing Government) গঠিত হতে পারে। বড় প্রশ্ন হলো—কনজারভেটিভরা (Conservatives) কি এবার প্রগ্রেস পার্টির নেতৃত্বাধীন জোটে জুনিয়র অংশীদার (Junior Partner) হয়ে যাবে? আগে বরাবরই কনজারভেটিভদের নেতৃত্বে জোট হত, প্রগ্রেস পার্টি থাকত গৌণ ভূমিকায়। এবার অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে পারে।
উপসংহার
- নরওয়ের মূলধারার দুই দল—লেবার ও কনজারভেটিভস—আর আগের মতো জনপ্রিয় নয়।
- লেবার: ক্রমাগত স্ক্যান্ডাল, ভেঙে পড়া আস্থা, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত।
- কনজারভেটিভস: ডানপন্থী ভোটের বড় অংশ প্রগ্রেস পার্টিতে চলে যাওয়ায় চাপে আছে।
- প্রগ্রেস পার্টি: অভিবাসনবিরোধী (Anti-Immigration) অবস্থান, তেল-গ্যাসে আরও বিনিয়োগের আহ্বান, ও সার্বভৌম তহবিলের অর্থ ব্যবহারে দৃঢ় নীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ভোটারদের আস্থা অর্জন করছে।
নরওয়ে সাধারণত শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল রাজনীতির জন্য পরিচিত হলেও, সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ইঙ্গিত দিচ্ছে বড় ধরনের পরিবর্তন সম্ভব—বিশেষ করে এক দশকের মাথায় সবচেয়ে সমর্থিত দুই দলের জনপ্রিয়তা এভাবে কমে যাওয়া একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আগামীর নির্বাচনে ডানপন্থী শিবিরের পুনরুত্থান (Resurgence) ও প্রগ্রেস পার্টির নেতৃত্ব মূর্ত হয়ে উঠতে পারে। লেবার দল কতটা এই প্রবণতার বিপরীতে যেতে পারে, সেটাই দেখতে হবে।
তথ্যসূত্র
Opinion polls
https://www.politico.eu/europe-poll-of-polls/norway/
Norwegian political system
https://en.wikipedia.org/wiki/Politics_of_Norway
https://www.electoral-reform.org.uk/the-two-bloc-system-scandinavias-best-kept-secret/
Norway’s political shift
https://www.newsinenglish.no/2024/11/12/conservative-wave-rolls-over-norway/
https://www.newsinenglish.no/2024/12/16/store-in-a-storm-during-starmers-visit/
https://youtu.be/cA6tC68Redk?si=bnI7gMKoD5Z3Ba6L
https://youtu.be/Mq0ZAi4jfZ8?si=PWEqWm094wcBfYkd
Leave a Reply