Table of Contents
ভূমিকা
যুক্তরাজ্যে (UK) সাম্প্রতিক সময়ে একটি গুরুতর অর্থনৈতিক অস্থিরতা চলমান, বিশেষ করে সরকারি বন্ডের (Gilts) সুদের হারের দ্রুত ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে। আগের একটি লেখায় দেখিয়েছিলাম, যুক্তরাজ্যের ঋণগ্রহণের খরচ (Borrowing Costs) গত এক মাসে বেশ তাড়াতাড়ি বেড়েছে। অনেকেই মনে করেন যে, এই সংকটের পেছনে বড় দায় ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের (Bank of England), যা আকারে স্বাধীন (Nominally Independent) কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলেও বাস্তবে নীতিনির্ধারণের মাধ্যমে বাজারকে প্রভাবিত করেছে।
এই লেখায় ব্যাখ্যা করতে চাই কেন অনেকেই মনে করছেন ব্যাংক অব ইংল্যান্ডই সাম্প্রতিক গিল্ট বাজারের অস্থিরতার প্রধান কারণ, সত্যি কি তারা দায়ী, এবং কীভাবে এই পুরো ঘটনাপ্রবাহ যুক্তরাজ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনতা (Central Bank Independence) সম্পর্কে নতুনভাবে প্রশ্ন তুলছে।
সাম্প্রতিক পটভূমি: কী ঘটেছে গত এক মাসে
যারা বিষয়টি প্রথম শুনছেন, তাদের জন্য সংক্ষিপ্ত সারসংক্ষেপ:
- ঋণগ্রহণের সুদের হার বেড়েছে (Borrowing Costs): গত এক বছরে যুক্তরাজ্যের সরকারি বন্ডের সুদের হার ধীরে ধীরে বাড়ছিল; কিন্তু সাম্প্রতিক প্রায় এক মাসে এই হার আরও দ্রুত বেড়েছে।
- ২০০৮ সালের পর সর্বোচ্চ (Highest Level Since 2008): দীর্ঘমেয়াদী সরকারি বন্ডের (Long-Term Gilts) সুদের হার এখন ২০০৮ সালের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
- বিশ্বব্যাপী বাজার চাপে (Global Bond Market Turmoil): গোটা বিশ্বে বন্ডের বাজারে (Bond Markets) সুদের হার বাড়লেও যুক্তরাজ্য যেন তুলনামূলকভাবে বেশি বিপদে। পূর্ববর্তী বিশ্লেষণে বলেছিলাম, যুক্তরাজ্যের খারাপ আর্থিক প্রেক্ষাপট (Dire Fiscal Outlook)—যেমন দুর্বল জিডিপি (GDP) ও কর্মসংস্থানের (Jobs) তথ্য, সঙ্গে পাউন্ডের (Pound) দরপতন—এতে বড় ভূমিকা রেখেছে।
তবে অনেকের দাবি, ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের সাম্প্রতিক “কোয়ান্টিটেটিভ টাইতেনিং” (Quantitative Tightening, সংক্ষেপে QT) প্রক্রিয়াও এই সংকটকে বাড়িয়ে তুলছে।
কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং (QE) থেকে কোয়ান্টিটেটিভ টাইতেনিং (QT): নেপথ্যের গল্প
ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গত এক দশকেরও বেশি সময়ের মুদ্রানীতি (Monetary Policy) বুঝতে একটু পেছনে ফিরতে হবে।
- কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং (Quantitative Easing, QE):
- ২০০৮ সালের আর্থিক সংকট (Financial Crisis of 2008) শুরুর পর থেকেই ব্যাংক অব ইংল্যান্ড বিপুল পরিমাণে সরকারি বন্ড (Government Bonds) কিনতে শুরু করে। এর লক্ষ্য ছিল ঋণগ্রহণের খরচ কম রাখা এবং সরকারকে অর্থ ব্যয় (Government Spending) চালিয়ে যেতে সহায়তা করা।
- বিশেষ করে বড় ধরনের সঙ্কটকাল বা জরুরি পরিস্থিতিতে—যেমন কোভিড-১৯ মহামারি (Pandemic)—ব্যাংক অব ইংল্যান্ড বাজার থেকে প্রচুর সরকারি বন্ড কেনে। কারণ তখন বেসরকারি বাজারে (Private Markets) চাহিদা কমে যায়, অথচ সরকারকে তখনই বেশি টাকা ব্যয় করতে হয়।
- মোট মিলিয়ে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড প্রায় ৮০০ বিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সরকারি বন্ড কিনেছিল এই সময়কালে। এতে সরকারের কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থপ্রবাহের সুবিধা আসে; পাশাপাশি বিনিয়োগকারীরাও আশ্বস্ত হয় যে ব্যাংক কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারকে সহায়তা দিচ্ছে, ফলে সুদের হার তুলনামূলকভাবে কম থাকে।
- কোয়ান্টিটেটিভ টাইতেনিং (Quantitative Tightening, QT):
- ২০২২ সালে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ঠিক করে, বিপরীত পথে হাঁটবে। অর্থাৎ আগে কেনা সরকারি বন্ডগুলো আবার ধীরে ধীরে বেসরকারি বাজারে (Private Market) বিক্রি করবে।
- এই প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে। তখন থেকেই সরকারকে বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।
কেন সমস্যার মুখোমুখি?
- সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় সুদের হার বাড়ে (Higher Interest Rates due to Increased Supply): যখন ব্যাংক বন্ড বিক্রি করে, বাজারে বন্ডের সরবরাহ (Supply) বেড়ে যায়। স্থির চাহিদার (Demand) বিপরীতে সরবরাহ বাড়লে বন্ডের দাম পড়ে যায়। বন্ডের দাম কমা মানে প্রকৃতপক্ষে সুদের হার (Yield) বেড়ে যাওয়া।
- ব্যাংকের বিক্রিতে ক্ষতি, কোষাগারের (Treasury) ওপর চাপ: ব্যাংক অব ইংল্যান্ড যখন উচ্চমূল্যে (Low Interest Rate শাসিত সময়ে) বন্ডগুলো কিনেছিল, এখন সেটা কম মূল্যে (উচ্চ সুদে) বিক্রি করছে। ফলে ব্যাংক এক রকম ‘লোকসান’ (Loss) করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক টেকনিকালি দেউলিয়া (Bankrupt) হতে পারে না বলে সেটি সমস্যার নয়, কিন্তু আইনি ও আর্থিক জটিল কারণে (Complicated and Controversial Reasons) এই ক্ষতি ব্যাংক নয়, বরং ট্রেজারিকেই (UK Treasury) বহন করতে হয়।
- প্রচুর ক্ষতির অঙ্ক: বলা হচ্ছে, শত শত বিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের বন্ড বিক্রি হওয়ার ফলে সরকারের জন্য ৪০ বিলিয়ন পাউন্ড (40 billion GBP) পর্যন্ত লোকসানের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। তুলনার জন্য উল্লেখ্য, ২০২৪ সালে লেবার পার্টি (Labour) যে “ফিসক্যাল ব্ল্যাক হোল (Fiscal Black Hole)” নিয়ে সরব হয়েছিল, তা ছিল প্রায় ২০ বিলিয়ন পাউন্ড। সরকার যে রাজস্ব (Revenue) ও ব্যয় (Spending) পরিকল্পনা করেছে, সেগুলোর সঙ্গে মেলালে এই ৪০ বিলিয়ন পাউন্ডের অতিরিক্ত বোঝা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
লিজ ট্রাস ও ‘মিনি বাজেট’ বিপর্যয়ের যোগাযোগ
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে যখন কোয়ান্টিটেটিভ টাইটেনিং শুরু হয়, তখনই এল এক বিতর্কিত “মিনি বাজেট,” যাকে অনেকেই মনে করেন আর্থিক ও বাজার-সংকটের (Market Meltdown) অন্যতম ট্রিগার। লিজ ট্রাস ক্ষমতায় এসে কর কমানোর (Tax Cut) ও সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির (Increased Spending) কিছু সাহসী পদক্ষেপ নেন, যা বাজারের আস্থাকে নাড়িয়ে দেয়। সুদের হার বেড়ে যায়, পাউন্ডের দরপতন হয়।
ট্রাস তার ব্যর্থতার জন্য বারবার ব্যাংক অব ইংল্যান্ডকে দোষারোপ করছেন, বলেছেন—তারা যদি একসঙ্গে কাজ করত, তবে বন্ড বাজারের এই বিপর্যয় হতো না। আবার ব্যাংক বলছে, বাজারে মূল সমস্যা ছিল সরকারের অতি-উদার বাজেট পরিকল্পনা, তাই তারা স্বাধীনভাবে (Independent) নীতি চালিয়ে গেছে।
প্রশ্ন: ব্যাংক অব ইংল্যান্ড কেন এই ‘QT’ করছে?
অনেকেই যুক্তি দেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংক তো দেউলিয়া হতে পারে না—তাহলে কেন এই বিপুল পরিমাণ বন্ড বিক্রি করে সরকারের ওপর আর্থিক চাপ বাড়ানো? এমার্জেন্সি (Emergency) না থাকলে কী এমন ক্ষতি হতো যদি পূর্বের মতো কোয়ান্টিটেটিভ ইজিং (QE) চালু থাকত?”
সম্ভাব্য উত্তর বা যুক্তি:
- জরুরি অবস্থা (Emergency) শেষে: ব্যাংক অব ইংল্যান্ড মনে করছে, যুক্তরাজ্য এখন আর কোভিড-পরবর্তী জরুরি অবস্থায় নেই। অর্থনীতি স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে এসেছে বলে তাদের ধারণা। তাই রাষ্ট্রীয় ব্যয়কে আর কেন্দ্রীয়ভাবে সহায়তা দেওয়ার দরকার নেই।
- ভবিষ্যতের জন্য জায়গা তৈরি (Creating Space for Future QE): ব্যাংক অব ইংল্যান্ড দাবি করে, তারা বন্ড বিক্রি করে ভবিষ্যতে নতুন কোনো মহামারিতে বা বড় সংকটে আবার QE চালু করার জায়গা তৈরি করছে। তবে সমালোচকরা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে তাৎক্ষণিকভাবেই ইচ্ছেমতো বন্ড কিনতে পারে—এখানে আসলে ‘সীমা’ (Limit) তেমন নেই।
- মুদ্রানীতি ও স্বাধীনতা (Monetary Policy & Independence): সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের স্বাধীনতা রক্ষার (Central Bank Independence) যুক্তি। ঐতিহাসিকভাবে—বিশেষ করে ১৯৯৭ সাল থেকে—ব্যাংকটি “অপারেশনালি স্বাধীন” (Operationally Independent), যার মানে হলো তারা সুদের হার নির্ধারণ ও মুদ্রানীতি পরিচালনায় সরকারের (Treasury) হস্তক্ষেপ ছাড়াই সিদ্ধান্ত নেয়।
এখানে যুক্তি হলো, যদি তারা অব্যাহতভাবে সরকারকে সুবিধা দিতে সরকারি বন্ড কিনতেই থাকে, তবে বাজার বুঝে যাবে ব্যাংক আসলে সরকারের হাতের পুতুল—যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনতার ধারণার বিপরীত। তাই QT চালিয়ে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড দেখাতে চাইছে যে তারা রাজনৈতিক চাপে নয়, বরং নিজেদের ম্যান্ডেট (উদাহরণস্বরূপ, ২% ইনফ্লেশন লক্ষ্য) রক্ষা ও আর্থিক স্থিতিশীলতার (Financial Stability) জন্যই কাজ করছে— এমনকি তাতে সরকারের আর্থিক দিকের ক্ষতি হলেও।
স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বনাম আর্থিক স্থিতিশীলতা (Independence vs. Stability)
এই ব্যাপারে একটু বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়া যাক। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের বর্তমান বিতর্ক বুঝতে গেলে প্রথমে বুঝতে হবে স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকার পেছনের মৌলিক তত্ত্ব কী। সাধারণত বিশ্বজুড়ে সরকারগুলোর হাতে অর্থনৈতিক নীতির (Economic Policy) দুটি প্রধান হাতিয়ার থাকে:
- রাজস্ব নীতি (Fiscal Policy): এখানে কর (Tax) আর সরকারি ব্যয় (Spend) কিভাবে নির্ধারিত হবে, যেমন আয়করের হার বাড়ানো বা কমানো, শিক্ষা বা স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ানো ইত্যাদি।
- মুদ্রানীতি (Monetary Policy): এখানে মূলত মুদ্রার পরিমাণ (Quantity of Money) ও এর মূল্যের (Price of Money) বিষয় জড়িত, অর্থাৎ সুদের হার (Interest Rate) বা মুদ্রা সরবরাহ বাড়ানো-কমানো।
রাজনীতিবিদরা (Politicians) সব সময় গণমঙ্গলের কথা বললেও, বাস্তবে তাদের অন্যতম বড় লক্ষ্য থাকে পুনঃনির্বাচন (Re-election)। নির্বাচন জিততে চাইলে শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (Economic Growth) ও নিম্ন বেকারত্ব (Low Unemployment) দেখা জরুরি। এক্ষেত্রে যদি রাজনীতিবিদদের হাতে উভয় নীতি—রাজস্ব ও মুদ্রানীতি—একসঙ্গে থাকে, তাহলে “Political Business Cycles” নামে পরিচিত এক প্রবণতা দেখা যায়। নির্বাচনের আগে সরকার সুদের হার নামিয়ে অর্থনীতি চাঙ্গা করে; এতে তাৎক্ষণিকভাবে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বাড়তে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়। যদি দল ক্ষমতায় ফিরে না আসে, দায় তখন পরবর্তী সরকারের; আর জিতলেও পরে ধীরে ধীরে সুদের হার বাড়িয়ে অর্থনীতিকে শীতল (Cool Down) করা যায়।
ইনফ্লেশনারি বায়াস বা মুদ্রাস্ফীতিমুখী প্রবণতা: এমনকি কোনো দেশে “Political Business Cycles” পুরোপুরি প্রমাণিত না হলেও ধারণাটির মূল বক্তব্য হলো—অল্পমেয়াদে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের সুফল পেতে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদে বেশি মুদ্রাস্ফীতি বয়ে আনে। এভাবেই অর্থনীতিতে এক ধরনের মুদ্রাস্ফীতিমুখী প্রবণতা (Inflationary Bias) তৈরি হয়। কিন্তু যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বতন্ত্র (Independent) হয়, তাহলে তারা রাজনৈতিক চাপের বাইরে থেকে সুদের হার বাড়ানো বা কমানোর কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের নিয়মিত নির্বাচন জিততে হয় না; তাদের কার্যকাল (Tenure) নির্দিষ্ট থাকে, তারা দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে পারে।
১৯৯৭ সালে টনি ব্লেয়ারের (Tony Blair) নেতৃত্বে নিউ লেবার (New Labor) সরকার ক্ষমতায় আসার পর, তৎকালীন চ্যান্সেলর (Chancellor) গর্ডন ব্রাউন (Gordon Brown) এক বড় চমক দেন। তিনি ব্যাংক অব ইংল্যান্ডকে নীতিনির্ধারক স্বায়ত্তশাসন বা অপারেশনাল ইন্ডিপেনডেন্স (Operational Independence) দেন। ঘোষণা দিতে গিয়ে ব্রাউন বলেছিলেন, তিনি দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ভিত্তি গড়তে চান এবং আগের “বুম অ্যান্ড বাস্ট” (Boom and Bust) অর্থনীতির চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে চান।
এরপর থেকে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড, অন্যান্য আধুনিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো, দুটি প্রধান ম্যান্ডেট (Mandate) পায়:
- প্রাইমারি ম্যান্ডেট: মুদ্রাস্ফীতিকে (Inflation) নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় আটকে রাখা।
- সেকেন্ডারি ম্যান্ডেট: অর্থনীতিকে “পূর্ণ কর্মসংস্থানের” (Full Employment) স্তরে রাখার চেষ্টা করা।
এই দুটি লক্ষ্য আসলে একে অন্যের বিপরীতমুখী—নিম্ন বেকারত্ব প্রায়শই উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সাথে যুক্ত, আর উচ্চ বেকারত্বের সময় মুদ্রাস্ফীতি নিম্নমুখী হতে পারে। অর্থনীতিতে এটিকে বলা হয় “ফিলিপস কার্ভ” (Phillips Curve) সম্পর্ক। ব্যাংক অব ইংল্যান্ড তখন সুদের হার নির্ধারণ করে চেষ্টা করে এই দুটো মানদণ্ডের মধ্যে একটি ভারসাম্য তৈরি করতে—যাতে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং একইসঙ্গে বেকারত্ব খুব বেশি না বেড়ে যায়।
সমস্যা: এ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবেও স্পর্শকাতর: সুদের হার কতোটা বাড়ানো বা কমানো উচিত—এটা একটি মৌলিকভাবে রাজনৈতিক (Political) সিদ্ধান্ত। কারণ দ্রুত মুদ্রাস্ফীতি কমাতে গেলে (যেমন সুদের হার খুব বেড়ে গেলে), অর্থনীতি শীতল হয়ে বেকারত্ব বাড়তে পারে, যা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে, উচ্চ সুদের হার যাদের যথেষ্ট সঞ্চয় ও সম্পদ আছে, তারা সুদের সুবিধা পেয়ে লাভবান হয়। সুতরাং সুদের হার একেবারে সাদামাটা টেকনোক্রেটিক (Technocratic) বিষয় নয়, এর পেছনে সামাজিক ও রাজনৈতিক ফলাফল জড়িয়ে আছে।
সব মিলে বলা যায়, “কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনতা” (Central Bank Independence) ধারণাটি ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে তুলনামূলকভাবে কম বিতর্কিত ছিল। তখন সাধারণভাবে মনে করা হতো, রাজনৈতিক প্রভাবে ব্যয় বাড়লে মুদ্রাস্ফীতি (Inflation) নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়বে; তাই ব্যাংক স্বাধীনতা জরুরি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি কিছু কঠিন প্রশ্ন তোলে—
- স্থিতিশীলতার (Stability) সংজ্ঞা: ব্যাংকের প্রধান কাজ বলে ধরা হয় আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। যদি কোয়ান্টিটেটিভ টাইটেনিং (QT) অর্থনীতিকে মন্দার (Recession) দিকে ঠেলে দেয় বা নতুন করে সরকারি ব্যয় সংকোচন (Austerity) ডেকে আনে, তবে এটা কি সত্যিই স্থিতিশীলতার সহায়ক?
- ব্যবহারিক মানে কী: অন্যদিকে, সরকার যথেচ্ছ ব্যয় করতে থাকলে মুদ্রাস্ফীতি লাগামছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই ব্যাংক তার সুদের হার (Interest Rate) ও পলিসির (Policy) মাধ্যমে এমন অবস্থা তৈরির চেষ্টা করে যে বাজারের আস্থা বজায় থাকে।
- অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তুলনা (ECB & Federal Reserve): ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ECB) ও মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ (Federal Reserve) কোয়ান্টিটেটিভ টাইটেনিং নিয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি সতর্ক। তারাও মাঝে মধ্যে বন্ড বিক্রি করে, কিন্তু ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের মতো আগ্রাসী (Aggressive) অবস্থান নিয়েছে কি না, সে নিয়ে বিতর্ক আছে।
উপসংহার: বিতর্কিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনতার নতুন যুগ
এসব আলোচনা থেকে স্পষ্ট, ২০০০ ও ২০১০-এর দশকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যখন নিম্ন সুদের হার (Lower Interest Rates) দিত এবং সরকারকে সহায়তা করত (যেমন কোয়ান্টিটেটিভ ইজিংয়ে সরকারি ঋণ সহজ করা), তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা বেশ প্রশংসিত ছিল। কিন্তু এখন, যখন তারা সুদের হার বাড়াচ্ছে (Raising Interest Rates) আর বন্ড বিক্রি করে সরকারকে চাপ দিচ্ছে, তখন স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধছে।
মুখ্য প্রশ্নগুলো হচ্ছে –
- ব্যাংক অব ইংল্যান্ড কি সত্যিই যুক্তরাজ্যের সাম্প্রতিক গিল্ট সংকটের জন্য প্রধান দায়ী?
- নাকি সরকারের স্থূল আর্থিক দুরবস্থা (Poor Fiscal Outlook) ও বাজেট ব্যবস্থাপনাই (Fiscal Policy Mismanagement) মূল কাঠগড়ায়?
- আর্থিক ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গিয়ে যদি অর্থনীতি মন্দার মুখে পড়ে, তবে একে স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাফল্য বলব, না ব্যর্থতা?
এর সহজ কোনো উত্তর নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্দেশ্যই হলো, রাজনৈতিক চাপের বাইরে থেকে দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা ও আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা। কিন্তু যখন সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের চাপে সরকারের ঘাড়ে অতিরিক্ত ঋণের বোঝা চাপে, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়, তখন এই ‘স্বাধীনতা’ নিয়েই নতুন করে প্রশ্ন উঠে।
সুতরাং, ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ডকে সম্পূর্ণরূপে দায়ী করা ন্যায়সংগত নাও হতে পারে, তবে এটিও মিথ্যে নয় যে তাদের কোয়ান্টিটেটিভ টাইতেনিং গিল্ট সংকটকে ঘনীভূত করেছে। ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যখন “অপ্রিয়” (Nasty) সিদ্ধান্ত নেবে—যেমন সুদের হার বাড়ানো বা বড় অঙ্কের বন্ড বিক্রি—তখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীনতা (Central Bank Independence) নিয়ে আরও তীব্র বিতর্ক উঠবে। সামনের বছরগুলোতে হয়তো আমরা এই বিতর্কের আরো তীব্র রূপ দেখতে পাব।
আরও দেখুন –
- যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ: বন্ডের ইল্ড বৃদ্ধি ও বাজেট সংকট (১৩ জানুয়ারি, ২০২৫)
- ইংল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি মুদ্রাস্ফীতির জন্য দায়ী? (১ জুলাই, ২০২৩)
যুক্তরাজ্য সম্পর্কে আরও সংবাদ ও বিশ্লেষণ জানতে চাইলে দেখুন – যুক্তরাজ্য সংবাদ
তথ্যসূত্র
1 – https://tradingeconomics.com/united-kingdom/central-bank-balance-sheet
2 – https://www.taxresearch.org.uk/Blog/2024/08/06/has-quantitative-tightening-run-out-of-road/
3 – https://www.ft.com/content/d2b5d61d-bb84-40fa-9234-211dae9bc283
Leave a Reply