Table of Contents
ভূমিকা
২০২৫ সালের ১৬ জানুয়ারিতে, রয়টার্স (Reuters) জানায় যে ইসরায়েল (Israel) ও হামাস (Hamas) এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা নিস্ফল আলোচনার পর গাজায় (Gaza) চলমান যুদ্ধের অবসান ঘটানোর কাছাকাছি অবস্থানে পৌঁছেছে। বাইডেন (Joe Biden) ও তার সমর্থকরা এই অগ্রগতির কৃতিত্ব নিজের নামে নিতে আগ্রহী হলেও, বাস্তবে সাম্প্রতিক কয়েক মাসে আলোচনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) ও তার নতুন মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ হুইটকফ (Steve Whitkoff)। এখনো পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো চুক্তি সই হয়নি, তবে বিভিন্ন সূত্র বলছে, চুক্তি এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে কাছে। এই নিবন্ধে আমরা এই সম্ভাব্য নতুন চুক্তির খুঁটিনাটি, এটি কেন বাইডেনের জন্য বিব্রতকর (Embarrassing) হতে পারে এবং সামনে কী ঘটতে পারে তা বিশদভাবে তুলে ধরব।
পটভূমি: ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে শান্তি আলোচনার সূচনা
হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি (Ceasefire) নিয়ে আলোচনা আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে শুরু হয়। কিন্তু প্রায় ছয় মাস ধরে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। মে মাসে এসে পরিস্থিতি খানিকটা বদলাতে থাকে, যখন কাতার (Qatar) ও মিশরের (Egypt) মধ্যস্থতায় একটি তিন-পর্যায়ের (three-phase) চুক্তির খসড়া তৈরি হয়। প্রেসিডেন্ট বাইডেন নিজে ২০২৪ সালের জুনে এই তিন-পর্যায়ের পরিকল্পনাকে ভিত্তি করে একটি সমঝোতা প্রস্তাব ঘোষণা করেন।
এই তিন-পর্যায়ের প্রস্তাবে বড় স্তরে তিনটি দিক উল্লেখ ছিল—
- প্রথম ধাপ: একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি (Temporary Ceasefire), পাশাপাশি কিছু ইসরায়েলে আটক ফিলিস্তিনি ও হামাসের হাতে আটক ইসরায়েলি জিম্মিদের (Hostages) বিনিময়।
- দ্বিতীয় ধাপ: অবশিষ্ট সমস্ত জিম্মির মুক্তি, পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতি (Permanent Ceasefire) স্থাপন।
- তৃতীয় ধাপ: গাজার ভবিষ্যৎ প্রশাসনিক কাঠামো (Governance Structure) নির্ধারণের জন্য চূড়ান্ত আলোচনা এবং গাজা পুনর্গঠন (Reconstruction) পরিকল্পনার বাস্তবায়ন।
উভয় পক্ষই (হামাস ও ইসরায়েল) নীতিগতভাবে এই তিন-পর্যায়ের প্রস্তাব গ্রহণ করে, কিন্তু তারপরও মূল চুক্তি নিয়ে দীর্ঘ অচলাবস্থা দেখা দেয়। আলোচনা একাধিকবার আটকে যায়।
তিন-পর্যায়ের চুক্তির কাঠামো: মে মাসের খসড়া ও বাইডেনের ঘোষণা
মে মাসে কাতারি ও মিশরীয় মধ্যস্থতাকারীরা যে কাঠামো পেশ করেন, সেটি প্রেসিডেন্ট বাইডেন জুনে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দেন। এটির সারকথা সংক্ষেপে ছিল:
- প্রথম পর্যায় (First Phase):
- একটি স্বল্প-মেয়াদি যুদ্ধবিরতি (অধিকাংশ প্রতিবেদনে ৪২ দিনের কথা উল্লেখ)।
- আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা (Humanitarian Aid) বৃদ্ধি।
- কিছু সংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দি ও ইসরায়েলি জিম্মির বিনিময়।
- দ্বিতীয় পর্যায় (Second Phase):
- স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতি (Permanent Ceasefire)।
- অবশিষ্ট সব জিম্মির মুক্তি।
- ইসরায়েলি বাহিনীর (IDF) আরো সম্পূর্ণ বা পর্যায়ক্রমে গাজা থেকে সরে আসা।
- তৃতীয় পর্যায় (Third Phase):
- গাজার ভবিষ্যৎ প্রশাসনিক কাঠামো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা।
- মিশর, কাতার ও জাতিসংঘ (UN) সমন্বয়ে গাজা পুনর্গঠন পরিকল্পনা।
এই কাঠামো উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হলেও, বেশ কয়েকটি মৌলিক মতবিরোধের কারণে চূড়ান্ত সমঝোতা বাধাগ্রস্ত হয়।
বড় বাধাগুলো কী ছিল: জিম্মি, প্রশাসনিক কাঠামো ও নিরাপত্তা
আলোচনার বড় অন্তরায় গুলোর মধ্যে ছিল:
- জিম্মি (Hostages) ইস্যু: হামাস স্পষ্ট করে বলছিল না, আটক জিম্মিদের সবাই জীবিত ফেরানো যাবে কিনা। ফলে ইসরায়েলের দিক থেকে এ নিয়ে গুরুতর সন্দেহ তৈরি হয়।
- গাজার ভবিষ্যৎ প্রশাসন (Postwar Governance Structure): যুদ্ধের পর গাজায় হামাসের ভূমিকাটি ঠিক কী হবে? হামাসের জড়িত থাকার বিষয়টি ইসরায়েলের বড় অংশ গ্রহণ করতে চাইছিল না। ইসরায়েল কোনো বিকল্প পরিকল্পনা হাজির করেনি; অন্যদিকে হামাস হুঁশিয়ারি দেয়, যুদ্ধের পরে গাজার পুরোপুরি কর্তৃত্ব তারাই থাকবে।
- গাজায় আইডিএফ (IDF) এর উপস্থিতি: হামাস চায় ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) পুরোপুরি প্রত্যাহার করুক। কিন্তু ইসরায়েলি সরকারের একাংশ চায় শর্তসাপেক্ষে কিংবা সীমিতসংখ্যক বাহিনীর উপস্থিতি বজায় রাখতে, বিশেষত “ফিলাডেলফিয়া করিডোর” (Philadelphia Corridor) নামে পরিচিত গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী এলাকায়।
- ইসরায়েলি সরকারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব: প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু (Benjamin Netanyahu) একাধিকবার সমঝোতায় এগোলেও, তার ডানপন্থী মন্ত্রীরা—ইতমার বেন গাভির (Itmar Ben Gvir) ও বেজালেল স্মোটরিচ (Bezalel Smotrich)—বারবার আপত্তি জানিয়েছেন। নেতানিয়াহুর সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাদের ওপর নির্ভরশীল। ফলে তিনি তাদের অগ্রাহ্য করতে গিয়ে সরকারের পতনের আশঙ্কায় পড়েন। ক্নেসেটে (Knesset) সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর ভয়েই নেতানিয়াহু পূর্বে চূড়ান্ত চুক্তিতে সই করতে পারেননি।
এভাবে বারবার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় পুরো প্রক্রিয়া প্রায় অচলাবস্থায় ছিল। বেন গাভির নিজেই প্রকাশ্যে বলেছেন যে তিনি একাধিকবার সম্ভাব্য চুক্তি “টর্পেডো” (torpedo) করেছেন—অর্থাৎ ইচ্ছাকৃতভাবে ভেস্তে দিয়েছেন।
হঠাৎ অগ্রগতি: টানাপড়েনের মধ্যে চুক্তির খসড়া
সাম্প্রতিক সময়ে (এই সপ্তাহের গোড়ায়) একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়, হঠাৎ করেই দুপক্ষ চূড়ান্ত চুক্তির খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। কয়েকটি সংবাদমাধ্যম চুক্তির খসড়া পত্রও (Draft Agreement) হাতে পেয়েছে বলে দাবি করে।
খসড়া অনুযায়ী, প্রতিটি পর্যায় ৪২ দিন স্থায়ী হবে।
- প্রথম পর্যায়ে:
- অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি।
- বৃহত্তর মানবিক সাহায্য (Humanitarian Aid) প্রবাহ।
- হামাস ৩৩ জন জিম্মিকে মুক্তি দেবে (মাল্টিপল সূত্র বলছে সংখ্যাটি ৩৩)। বিনিময়ে অজ্ঞাতসংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দিকে ছাড়া হবে।
- দ্বিতীয় পর্যায়ে:
- স্থায়ী যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা।
- বাকি সব জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে।
- তৃতীয় পর্যায়ে:
- গাজার পুনর্গঠন পরিকল্পনা (Reconstruction Plan), যা তদারকি করবে মিশর, কাতার ও জাতিসংঘ।
খসড়ায় উল্লেখযোগ্য দিক হলো, ইসরায়েল কিছু পূর্বশর্ত থেকে সরে এসেছে বলেই মনে হচ্ছে। যেমন, ইসরায়েল প্রথম পর্যায়েই মৃত জিম্মিদের দেহ ফেরত নেওয়ার বিষয়ে রাজি হয়েছে, যদিও এতে বিনিময়ে কতজন ফিলিস্তিনি বন্দি ছাড়া হবে, তা কমতে পারে। এছাড়া ইসরায়েল সম্মত হয়েছে ধাপে ধাপে গাজা থেকে “সম্পূর্ণ প্রত্যাহার” (Total Withdrawal) করতে এবং খসড়ায় কোথাও বলা হয়নি যে হামাসকে ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা থেকে বাদ দেওয়া হবে। শেষ পর্যন্ত ১৭ জানুয়ারি ইসরায়েলের মন্ত্রীসভা চূড়ান্তভাবে এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুমোদন করে। এরপর ১৯ জানুয়ারি, রবিবারে গাজায় (Gaza) ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি (Ceasefire) চালু হয়েছে। এতে প্রথম তিনজন ইসরায়েলিকে (Israelis) হামাসের বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে; অন্যদিকে ইসরায়েলি জেল থেকে ৯০ জন ফিলিস্তিনিকে (Palestinians) মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
অনেকেই বলছেন, এটি প্রায় ওই একই চুক্তির মতো যেটি নেতানিয়াহু ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গোড়ায় নাকচ করে দিয়েছিলেন।
তো কেন নেতানিয়াহু এরকম ইউ টার্ন নিলেন? সেই প্রশ্নের উত্তরে যাবার আগে তার ও ইসরায়েলের সাথে ট্রাম্পের সম্পর্কের ব্যাপারে একটু জেনে নেয়া যাক।
ইজরায়েলে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা এবং নেতানিয়াহু ও ট্রাম্প সম্পর্কের পটভূমি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (US) বাইরে, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে (Western World), ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) খুব বেশি জনপ্রিয় রাজনীতিক নন। তার প্রথম মেয়াদে আমেরিকার বৈশ্বিক মর্যাদা (America’s Global Reputation) উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়—অন্তত মিত্রদেশগুলোর (Allies) দৃষ্টিতে। ইউগভ (YouGov) ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগের জনমত জরিপ অনুযায়ী, যুক্তরাজ্য (UK), ফ্রান্স (France), জার্মানি (Germany), ইতালি (Italy), স্পেন (Spain), সুইডেন (Sweden) ও ডেনমার্কে (Denmark) ভোটারদের বড় অংশ যদি ভোট দিতে পারতেন, তবে তারা হ্যারিসকে (Harris) ব্যাপক ব্যবধানে জিতিয়ে দিতেন।
কিন্তু যেখানে ট্রাম্প খুবই জনপ্রিয়, সেটি হল ইসরায়েল (Israel)। ইসরায়েলি চ্যানেল ১২-এর (Channel 12) অক্টোবরের শেষদিকের এক জরিপ বলছে, ৭৩% ইসরায়েলি ভোটার ট্রাম্পকে পছন্দ করছেন, মাত্র ১৭% ইসরায়েলি হ্যারিসকে পছন্দ করছেন। ট্রাম্পের পুনরায় নির্বাচনে ইসরায়েলি রাজনীতিকদের উচ্ছ্বাস লক্ষ করা গেছে—উদাহরণস্বরূপ, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু (Benjamin Netanyahu) এক্সে (X, আগে টুইটার) পোস্টে এটিকে “সবচেয়ে বড় প্রত্যাবর্তন” বলে আখ্যা দিয়েছেন। আর তার কট্টরপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচ (Bezalel Smotrich) ঘোষণা দিয়েছেন ২০২৫ সাল হবে “জুডিয়া ও সামারিয়ায় (Judea and Samaria) সার্বভৌমত্বের বছর,” ইঙ্গিত করছেন যে ইসরায়েল পশ্চিম তীর (West Bank) দখলের জন্য ট্রাম্পের ফের ক্ষমতায় আসাকে কাজে লাগাতে চায়। এর ফলে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা উঠেছে। আজকের এই নিবন্ধে আমরা দেখব কেন ইসরায়েলে ট্রাম্প এত জনপ্রিয়, তার ইসরায়েল বিষয়ক নীতিমালা (Israel Policy) কেমন হতে পারে, এবং কেন তিনি নেতানিয়াহু (Netanyahu) ও তার মিত্রদের ধারণার চেয়ে কম ইসরায়েলপন্থী হতে পারেন।
তো প্রশ্ন হচ্ছে, কেন ইসরায়েলে ট্রাম্প এত জনপ্রিয়? ইসরায়েলে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তার পেছনে প্রধান দুটি কারণ রয়েছে:
- নেতানিয়াহু ও ইসরায়েলি ডানপন্থীদের (Israeli Right) চোখে বাইডেন বা হ্যারিসের সমালোচনা: তারা মনে করেন, বাইডেন (Biden) ইসরায়েলের উপর খুব বেশি “সমালোচনামূলক” অবস্থান নিয়েছেন। আর কমলা হ্যারিস (Harris) প্রেসিডেন্ট হলে আরো বেশি কড়া হবেন বলে শঙ্কা আছে।
- ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে “প্রো-ইসরায়েল” নীতিমালা (Pro-Israel Policies):
- যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস (US Embassy) তেল আভিভ থেকে জেরুজালেমে (Jerusalem) স্থানান্তর (Moving Embassy to Jerusalem)
- ফিলিস্তিনি শরণার্থী বিষয়ক জাতিসংঘ সংস্থার (UNRWA) ফান্ডিং কেটে দেওয়া
- গোলান মালভূমিতে (Golan Heights) ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃতি (Recognizing Israeli Sovereignty)
- ইসরায়েলি বসতিকে (Israeli Settlements) “আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন” হিসেবে আর গণ্য করা হবে না বলে ঘোষণা—যা পূর্বের মার্কিন অবস্থান থেকে বড় পরিবর্তন
- ২০২০ সালের শুরুতে পশ্চিম তীরের (West Bank) দখলকৃত অঞ্চল (Annexation) নিয়ে “আনুষ্ঠানিক সমর্থন” দেওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন
এসব পদক্ষেপে ইসরায়েলের ডানপন্থীরা (Right Wing) ভীষণ উল্লসিত, কারণ তারা মনে করেন, ট্রাম্প ইতিহাসে সবচেয়ে ইসরায়েলপন্থী (Pro-Israel) মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মধ্যে অন্যতম।
কেন ট্রাম্প হয়তো এতটা “প্রো-ইসরায়েল” নাও হতে পারেন?
এখন প্রশ্ন হলো, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর আশাবাদ সত্ত্বেও, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে তার ইসরায়েল-বান্ধব মনোভাব আসলেই প্রথম মেয়াদের মতো অতটা সমুজ্জ্বল হবার কথা? কয়েকটা পয়েন্ট খেয়াল করুন:
১) নেতানিয়াহুর সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সম্পর্কে ফাটল (Personal Relationship with Netanyahu): নেতানিয়াহু ও ট্রাম্প আগে ভালোই মৈত্রীপূর্ণ সম্পর্ক দেখালেও, ২০২০ সালের নির্বাচনে বাইডেন জিতে যাওয়ার পর নেতানিয়াহু দ্রুত বাইডেনকে অভিনন্দন জানান। ট্রাম্প এতে ক্ষুব্ধ হন। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ইসরায়েলি সাংবাদিক বারাক রাভিদকে (Barak Ravid) দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন: “আমি নেতানিয়াহুকে পছন্দ করতাম। কিন্তু সে বাইডেনকে অভিনন্দন জানিয়ে অবিশ্বাস্য ভুল করেছে।”
২) নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্পের কিছু দ্বিধান্বিত মন্তব্য (Ambiguous Statements): বেশিরভাগ সময় ট্রাম্প বলছেন, তিনি যে কোন মার্কিন প্রেসিডেন্টের তুলনায় ইসরায়েলের জন্য বেশি কিছু করেছেন। আবার তিনি বলেন, গাজায় (Gaza) ভবনধসের ভিডিও প্রকাশ করে ইসরায়েল নিজেই “পিআর যুদ্ধে” (PR War) হারছে। এমনকি এক সমাবেশে “জেনোসাইড জো (Genocide Joe)” স্লোগানে তিনি কিছুটা সায় দেন এই বলে যে, “They’re not wrong” (তারা ভুল বলেনি)।
৩) “ডিলমেকার” হিসেবে ট্রাম্পের ভাবমূর্তি (Trump as the Dealmaker): ট্রাম্প সবসময় নিজেকে “সমঝোতার রাজা” (No-Nonsense Dealmaker) হিসেবে তুলে ধরেছেন। প্রচারণার সময় তিনি বলেছিলেন, “যুদ্ধ শেষ করতে হবে (End the Wars),” এবং এপ্রিল মাসে ইসরায়েলকে উদ্দেশ করে “শান্তিতে ফিরতে হবে (Get back to peace)” বলে, “মানুষ হত্যা বন্ধ করো (Stop killing people)” মন্তব্যও করেন। এদিকে নেতানিয়াহু কট্টর অবস্থানে (Maximalist War Aims) ছিলেন। গাজায় হামাসকে (Hamas) “ধ্বংস” করার লক্ষ্য নেয় নেতানিয়াহুর সরকার, যা দ্রুত অর্জনযোগ্য নয়। আর যদি ট্রাম্প একটি অল্প সময়ের মধ্যে “ডিল” চাপিয়ে দিতে চান, নেতানিয়াহুরও মানার কথা ছিল না, কারণ মাঝপথে যুদ্ধ থামালে তার সরকারের ভাবমূর্তি ও রাজনৈতিক ভাগ্য হুমকির মুখে পড়বে। একই অবস্থা লেবানন (Lebanon) নিয়েও। ইসরায়েলি পক্ষ হিজবুল্লাহকে (Hezbollah) পুরোপুরি উচ্ছেদের কথা বলছে। সেটি দ্রুত সম্ভব নয়, তাই কোনো “মধ্যবর্তী সমাধান” (Pause) নেতানিয়াহুকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলবে।
৪) আগের মেয়াদে ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন চুক্তির প্রয়াস ব্যর্থতা (Failed Peace Attempt): প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংকট সমাধান করতে চেয়েছিলেন। তবে তিনি মূলত ফিলিস্তিনিদের (Palestinians) সঙ্গে না কথা বলে, শুধুমাত্র নেতানিয়াহু ও জারেড কুশনারকে (Jared Kushner) নিয়ে একপেশে পরিকল্পনা করেন। এটি ছিল চরমভাবে ইসরায়েলপন্থী। ইসরায়েল পশ্চিম তীরের বিভিন্ন এলাকা (Settlements) ও জেরুজালেম (Jerusalem) প্রায় পুরোটাই রাখতে পারত, ফিলিস্তিনিরা পেত মাত্র ৭০% পশ্চিম তীর, অনিয়মিত সীমানার (Non-Contiguous) ভূখণ্ড। ফিলিস্তিনি ও আন্তর্জাতিক মহল একে অগ্রহণযোগ্য (Unfair) মনে করে। কিন্তু মজার ব্যাপার, নেতানিয়াহুর সরকারে উগ্র বসতি-পন্থীরা (Pro-Settler Right-Wingers) মনে করে যে এভাবে সামান্য অঞ্চল ছাড় দিলে ভবিষ্যতে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পথ খুলে যাবে—তাও তারা মানতে চায়নি! পরিস্থিতি সামাল দিতে নেতানিয়াহু “আব্রাহাম চুক্তি (Abraham Accords)” নিয়ে এগোন, যেখানে ফিলিস্তিনি ইস্যু পাশ কাটিয়ে অন্য আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে জোর দেওয়া হয়। এই অবস্থায় দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প যদি আবার কোনো “সম্মুখীন সমাধান” (Direct Deal) চাপিয়ে দিতে চান, তবে তা আরও কঠিন হয়ে যায়, কারণ ইসরায়েল এখন অনেক বেশি কট্টরপন্থী সরকারের অধীনে।
ধরে নেওয়া যায়, ট্রাম্প পুরোপুরি ইসরায়েল-বিরোধী হবেন না। কেউ ঠিক জানে না, তার ইসরায়েল নীতি কী হবে। তার মন্ত্রিসভা (Cabinet) খুব সম্ভবত প্রো-ইসরায়েল ব্যক্তিতে (Overwhelmingly Pro-Israel) ভরা থাকবে—যেমন:
- পররাষ্ট্রমন্ত্রী (Secretary of State): মার্কো রুবিও (Marco Rubio) – একজন দৃঢ় ইসরায়েল সমর্থক।
- ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত (Ambassador to Israel): মাইক হাকাবি (Mike Huckabee) – যিনি একবার বলেছিলেন, “ফিলিস্তিন (Palestinian) বলে কিছু নেই… পশ্চিম তীরকে (West Bank) ‘জুডিয়া ও সামারিয়া (Judea and Samaria)’ বলে, সেটি দখল করা হয়নি—এগুলো আসলে ইসরায়েলের আবাস… ‘অকুপেশন’ বলে কিছু নেই।”
অনেকেই আশা করতে পারেন যে এত প্রো-ইসরায়েল লোকেদের সঙ্গে, ট্রাম্প হয়তো অনেক পদক্ষেপেই ইসরায়েলকে সমর্থন করবেন। কিন্তু এটাও বুঝতে হবে যে ট্রাম্প নিজের “সমঝোতার রাজা” ভাবমূর্তি ধরে রাখতে চান। সেক্ষেত্রে এটা খুব স্বাভাবিক ছিল যে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে (Middle East) একটি চুক্তি (Deal) বা শান্তিপ্রক্রিয়া (Peace Process) চাপিয়ে দিতে চাইবেন, আর এর ফলে নেতানিয়াহু ও তার সরকার অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়বে—কারণ তারা অতি কট্টর লক্ষ্য নিয়ে চলেছে।
নেতানিয়াহুর “ইউ-টার্ন”: ট্রাম্পের ভূমিকা
আশা করি ইসরায়েল ও নেতানিয়াহুর ব্যাপারে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মনোভাব সম্পর্কে ভাল ধারণা পাওয়া গেল। এটাই অনেকটা বলে দেয় যে, নেতানিয়াহু কেন হঠাৎ এই অবস্থান বদলালেন? বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ক্ষমতায় বসার আগে আগেই ট্রাম্প তার নতুন মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ হুইটকফের মাধ্যমে সরাসরি এই আলোচনার হাল ধরেছেন। সম্ভবত, ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে কোনো বিশেষ ছাড় (Concessions) দিয়েছেন, যেমন:
- পশ্চিম তীরের (West Bank) দখলকৃত বা সংযুক্ত (Annexed) কিছু এলাকা ইসরায়েলের অধীনে মার্কিন স্বীকৃতি।
- ইরানের (Iran) ওপর আগাম হামলা (Preemptive Strike on Iran) চালানোর নিশ্চয়তা।
এছাড়া আরও একটা সম্ভাবনা হলো, নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের মধ্যে পূর্বপরিকল্পিত একধরনের “রাজনৈতিক নাটক” চলছে, যেখানে ট্রাম্প সব কৃতিত্ব নিচ্ছেন, আর নেতানিয়াহু নিজের ডানপন্থী জোটের কাছে পরে দোষ চাপাতে পারবেন “ট্রাম্পের প্রয়োজনে” বা “ট্রাম্পের চাপে” চুক্তি করতে হয়েছে বলে।
তবে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা হচ্ছে, ট্রাম্প বাইডেনের চেয়ে অনেক বেশি “শক্তভাবে চাপ” দিয়েছেন। ট্রাম্প সরাসরি হুমকি দিয়েছেন যে, তার ক্ষমতায় বসার আগেই চুক্তি না হলে “ভয়ানক পরিণতি” (All Hell to Pay) হবে। এমনকি কয়েকদিন আগে ট্রুথ সোশ্যাল (Truth Social)-এ নেতানিয়াহুকে “dark son of a bitch” বলে আক্রমণমূলক মন্তব্যও পোস্ট করেছেন।
হা’আরেতজ (Haaretz) জানায়, স্টিভ হুইটকফ নেতানিয়াহুকে সাবাথ (Sabbath) ভেঙে বৈঠকে বসতে বাধ্য করেন, যা ইসরায়েলি ঐতিহ্যের দিক থেকে বেশ অস্বাভাবিক। টাইমস অফ ইসরায়েল (Times of Israel) জানায়, ঐ বৈঠকটি ছিল খুবই রূঢ়, যেখানে হুইটকফ কঠোর অবস্থান নেন এবং নেতানিয়াহুকে বড় ধরনের ছাড় দেওয়ার জন্য চাপ দেন। নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠরা সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ট্রাম্পের এই চাপ নেতানিয়াহুর প্রত্যাশার চেয়েও বেশি।
এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করছে, যুক্তরাষ্ট্রের (US) ইচ্ছা থাকলে ইসরায়েলের ওপর পরোক্ষ প্রভাব বিস্তার করতে পারে। বিগত এক বছরে ওয়াশিংটন নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বিতর্ক চলছিল, বাইডেন আসলে ইসরায়েলকে কতটা প্রভাবিত করতে পারেন। সমালোচকরা বলছিলেন, বাইডেন পর্যাপ্ত চাপ প্রয়োগ করছেন না। বাইডেনপন্থীরা যুক্তি দিয়েছিলেন, সামরিক সহায়তা (Military Support) পুরোপুরি কেটে দেওয়া ছাড়া বাস্তবে খুব একটা উপায় নেই, যা বাইডেন কখনোই করবেন না। এখন ট্রাম্পের এই সাফল্য দেখাচ্ছে, অন্য কোনো পন্থায়ও ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব ছিল, যা বাইডেন হয়তো করতে চাননি বা করেননি।
বাইডেন-প্রশাসনের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি
এটি বাইডেনের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক পরিস্থিতি। এক বছর ধরে তিনি ও তার মিত্ররা আলোচনা চালিয়েও সফল ফল পাননি, অথচ ট্রাম্প এখনো দায়িত্বভার গ্রহণের আগেই চুক্তি সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন বলে মনে হচ্ছে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এই ব্যর্থতা ডেমোক্র্যাটদের (Democrats) নির্বাচনে হারার অন্যতম কারণ হতে পারে। বিশেষ করে তরুণ ভোটার বা কিছু উদারপন্থী (Progressive) ভোটার হয়তো মনে করেছিলেন, ডেমোক্র্যাটরা ইসরায়েলের পক্ষে অতিরিক্ত সমর্থন দিচ্ছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা নাকি বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির ফল। এর ফলে একটি অংশ ভোট দিতেই আসেনি, অথবা তৃতীয় কোনো প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে, যার প্রভাব নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফলে পড়েছে।
পরবর্তীতে কী ঘটতে পারে?
বেন গাভির (Ben Gvir) ইতিমধ্যে বলেছেন যে তিনি এই চুক্তির বিরুদ্ধে ভোট দেবেন। তবে নেতানিয়াহুর সরকারে অন্য কিছু দল যোগ দিয়েছে, ফলে বেন গাভিরের বিরোধিতা সত্ত্বেও চুক্তি পাস হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না—বিশেষত যদি বেজালেল স্মোটরিচ (Smotoric) এতে সমর্থন দেন।
যদি শেষ পর্যন্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে পরবর্তী দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, ট্রাম্প আদৌ কোনো “গাজরের মতো লোভনীয় প্রস্তাব” (Proverbial Carrots) দিয়েছিলেন কি না—যেমন সৌদি আরবের (Saudi Arabia) সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন (Normalization Deal) অথবা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার (Iran’s Nuclear Facilities) ওপর আগাম হামলার নিশ্চয়তা। এই ধরনের বড় কোনো পদক্ষেপ ভবিষ্যতে পরিষ্কার হয়ে উঠতে পারে।
এছাড়া ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নেতানিয়াহু কিভাবে যুদ্ধবিরতি ও সম্ভাব্য চুক্তির ফলাফল সামলান, সেটিও দেখার বিষয়। ডানপন্থী দলগুলো নেতানিয়াহুকে “বিক্রি হয়ে যাওয়া” বলে নেতানিয়াহুকে দুষতে পারে, আর সেক্ষেত্রে নেতানিয়াহুর জবাব হতে পারে যে তাকে ট্রাম্প চাপে ফেলে এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছেন।
উপসংহার
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সম্ভাব্য শান্তিচুক্তি (Peace Deal) এখন হাতের নাগালে বলে মনে হচ্ছে। দীর্ঘ এক বছরে বারবার আটকে যাওয়া আলোচনা হঠাৎ করেই এগিয়ে এসেছে—এবং অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের মতে, এর পেছনে অন্যতম চালিকাশক্তি নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের “শক্ত চাপ” (Strong Pressure)। বাইডেন প্রশাসনের পক্ষে বিষয়টি অবশ্যই বিব্রতকর, কারণ তারা এতদিন চেষ্টা করেও সাফল্য পায়নি।
এখন বড় প্রশ্ন হলো, চুক্তি বাস্তবায়ন কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে, এবং ভবিষ্যতে ট্রাম্প ইসরায়েলকে কী কী সুবিধা বা নিশ্চয়তা দেবেন। গাজা পুনর্গঠন, হামাসের ভবিষ্যৎ ভূমিকা, ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টানাপড়েন—সবকিছু মিলিয়ে আগামী কয়েক মাস উত্তেজনায় ভরপুর থাকবে। একদিকে ইসরায়েলের ডানপন্থী জোটের সামর্থ্য ও স্থায়িত্ব, অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি—উভয়ই নির্ধারণ করবে গাজার ১৫ মাসের যুদ্ধের পর অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।
যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে আরও সংবাদ ও বিশ্লেষণ জানতে চাইলে দেখুন – যুক্তরাষ্ট্র সংবাদ
ইজরায়েল ও প্যালেস্টাইন সম্পর্কে আরও সংবাদ ও বিশ্লেষণ জানতে চাইলে দেখুন – ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইন সংবাদ
Leave a Reply