Table of Contents
ভূমিকা
২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (European Union) ঘোষণা দিয়েছে যে তারা হাঙ্গেরির (Hungary) জন্য বরাদ্দকৃত এক বিলিয়ন ইউরো-র (One billion euros) বেশি পরিমাণ ‘স্ট্রাকচারাল ফান্ড’ (Structural funds) আটকে রাখবে। কারণ ভিক্টর অরবান (Viktor Orban)-এর ফিডেস (Fidesz) সরকারের সঙ্গে আইনের শাসন (Rule of law) সংক্রান্ত বিরোধ বিদ্যমান।
ইইউ (EU) আগেও হাঙ্গেরির অর্থবৃদ্ধি আটকে রেখেছে, তবে এবার শাস্তির মাত্রা বেড়েছে ঠিক এমন সময়, যেখানে অরবান সরকারের হাতে আর্থিকভাবে কোনো অতিরিক্ত অবকাশ (Little room for manoeuvre) নেই। কারণ হাঙ্গেরির বাজেট ঘাটতি (Budget deficit) ৪% ছাড়িয়ে গেছে, আর দেশটি ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ পুনরায় “টেকনিক্যাল রিসেশনে” (Technical recession) ঢুকে পড়ে—পূর্বে তিন বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বার।
এই নিবন্ধে আমরা দেখব, হাঙ্গেরির অর্থনৈতিক দুরবস্থা কেন বাড়ছে, আর এর ফলে কীভাবে ২০২৬ সালের নির্বাচনে ভিক্টর অরবান ও তার দলের পুনর্নির্বাচন (Re-election) অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে।
বাজেট ঘাটতি ও মূল্যস্ফীতি: জনগণের কষ্ট
বিশ্বের অনেক দেশের সরকারের জন্য মূল্যস্ফীতি (Inflation) বিশাল সমস্যা, কিন্তু হাঙ্গেরিতে (Hungary) পরিস্থিতি আরও করুন। কম মজুরি (Weak wage growth)-এর কারণে এখানে লোকজনের প্রকৃত মজুরি (Real wage) সবচেয়ে দ্রুত হারে কমছে ইউরোপের অন্য অনেক দেশের তুলনায়।
অরবান (Orban) সরকার ভোটারদের (Voters) খুশি রাখার চেষ্টায় সরকারি ব্যয় (Government spending) লাফিয়ে বাড়িয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে অরবান পেনশনভোগীদের (Pensioners) অতিরিক্ত অর্থ দিয়েছেন, অল্পবয়সীদের জন্য আয়কর (Income tax) মওকুফ করেছেন, এবং পরিবারগুলোকে (Families) বাড়ি সংস্কারে অনুদান দিয়েছেন—সব মিলিয়ে প্রায় ২ বিলিয়ন ইউরো-র (2 billion euros) মতো।
তার সরকার সেই “পরিবার ভাতা” বা বেনিফিট (Family benefit regime) বৃদ্ধি করেছে, যা এখন প্রায় ৫% জিডিপি (GDP) খরচ করে। একটি ২০২০ সালের জরিপে দেখা গিয়েছে, এই পারিবারিক সুবিধাটি ছিল অনিশ্চিত ভোটারদের (Undecided voters) মধ্যে অরবান সরকারের সবচেয়ে জনপ্রিয় নীতি।
এছাড়াও, রয়টার্স (Reuters) মতে, ইইউর (EU) কোভিড রিকভারি ফান্ড (COVID Recovery Fund) থেকে ১২ বিলিয়ন ইউরোর (12 billion euros) মধ্যে মাত্র এক-চতুর্থাংশ প্রকৃতপক্ষে মহামারী সংশ্লিষ্ট খাতে খরচ হয়েছে, বাকিটা বিভিন্ন কাজে লাগানো হয়েছে—যেমন, প্রতিবেশী দেশে বসবাসরত জাতিগত হাঙ্গেরিয়ান (Ethnic Hungarian diaspora) গোষ্ঠীকে সহায়তা, যারা অতীত নির্বাচনে তাকে সমর্থন করেছে।
কিন্তু এই ব্যয়ের জোয়ারেও সাধারণ হাঙ্গেরীয়দের জীবনযাত্রার ব্যয় (Cost of living) খুব একটা উন্নতি হয়নি। এর পেছনে বড় কারণ হলো মারাত্মক মূল্যস্ফীতি—যার দরুন সরকারের “উপহার” হয়তো নিমেষেই ক্রয়ক্ষমতার (Purchasing power) ঘাটতি পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
২০২৩ সালে, হাঙ্গেরির গৃহস্থালি ভোগ (Household consumption), ক্রয়ক্ষমতা সমন্বয় (Purchasing power parity) করে হিসাব করে, ইইউর গড়ের মাত্র ৭০% ছিল—এবং হাঙ্গেরি ছিল ইউরোপে নীচের সারিতে, বুলগেরিয়ার (Bulgaria) সমপর্যায়ে।
পেনশনভোগীদের প্রতি এত অনুদান দিয়েও, “২০২৩ ইউরোবারোমিটার সার্ভে” (2023 Eurobarometer Survey) বলে, মাত্র ৩০% হাঙ্গেরিয়ান আত্মবিশ্বাসী যে অবসরে (Retirement) তারা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল থাকবে। এই উদ্বেগ জন্মাচ্ছে, মূল্যস্ফীতি তাদের সঞ্চয়কে (Savings) গিলে ফেলবে কিনা।
ঋণ বৃদ্ধির ধারা ও ঝুঁকি
২০১৪ সালের পর ধারাবাহিক ঘাটতি (Steady Deficits Since 2014): হাঙ্গেরির সরকারি ঘাটতি (Public deficit) ২০১৪ সাল থেকে বাড়ছে, ২০২২-এর কাছাকাছি প্রায় ৪% জিডিপির ওপরে পৌঁছেছিল। গত চার বছরে গড়ে প্রায় ৫% ঘাটতি দেখা গেছে, যা ইইউর নির্ধারিত ৩% লক্ষ্য অতিক্রম করে। ২০২৪ সালে অরবান সরকার এটি ২.৯% করার কথা বলেছিল, কিন্তু বাস্তবে আরও বেশি হয়েছে। ফলে দেশটির সামগ্রিক ঋণের অনুপাত (Debt-to-GDP) আজ ভিসেগ্রাদ ৪ (Visegrad 4) দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ, ৭০%+ পৌঁছেছে। শুধু তাই নয়, ঋণের সুদের (Interest) পরিশোধ বাবদ হাঙ্গেরি জিডিপির ৪% এরও বেশি খরচ করে, যা ইইউর মধ্যে সর্বোচ্চ।
ঋণ-দায়ের চক্র (Debt Doom Loop): ঋণ পরিশোধের জন্য আরও ঋণ নেওয়া, ফলে সুদের পরিমাণ বাড়ে—এই “ডেড ডুম লুপ” (Dead debt doom loop)-এ পড়ার আশঙ্কা আছে এখন দেশটির। ইতোমধ্যে ইইউ হাঙ্গেরিকে একাধিকবার সতর্ক করেছে—তাদের ব্যয় সংক্রান্ত নীতি ঠিক করতে হবে, নতুবা বার্ষিক ০.১% জিডিপি পর্যন্ত জরিমানা (Fine) হতে পারে, যদিও এখনো তা বাস্তবে ঘটেনি। মাঝ জানুয়ারির মধ্যে (Mid-January) অরবান সরকারকে বাজেট নমনীয়তা দেখাতে হবে, অন্যথায় ইউরোপীয় কমিশন বাজেট সংক্রান্ত মূল্যায়নে (Assessment) খারাপ নম্বর দিতে পারে। বাজেট ঘাটতি কমাতে ব্যয় কাটছাঁট (Spending cuts), কর বৃদ্ধি (Tax hike), অথবা উচ্চ প্রবৃদ্ধির (High growth) দরকার—কিন্তু হাঙ্গেরির অর্থনীতি এখন স্থবির, তাই কর বাড়ালে তা জনপ্রিয়তা হারানো ও অর্থনীতির আরেক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
অর্থনৈতিক মন্দা ও বিনিয়োগ সংকট (Recession and Investment Shortfall)
পুনরায় মন্দায় পতন (Technical Recession Again): ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে (Q3 of 2024) হাঙ্গেরি আবারও “টেকনিক্যাল রিসেশন” (Technical recession)-এ ঢোকে—তিন বছরে দ্বিতীয়বার। ইউরোপজুড়ে (Across Europe) চাহিদা কম, বিশেষ করে হাঙ্গেরির রপ্তানিমুখী খাত, যেমন গাড়ি শিল্প (Automotive industry), ৪% আউটপুট পতন দেখেছে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে। এমন পরিস্থিতিতে জিডিপি বাড়বার আশা ক্ষীণ, ফলে বাজেট ঘাটতি অনুপাত (Deficit-to-GDP) কমানোও কঠিন হবে। আর অরবান কর বাড়িয়ে (Tax) ঘাটতি মেটাতে চাইলে, লোকের ক্রয়ক্ষমতা আরও কমে যাওয়ার ফলে অর্থনীতি আরও ধীরগতি হবে।
ইইউ অনুদান আটকে যাওয়া (EU Funds Frozen): আরও বিলিয়ন ইউরো মূল্যের প্রকল্প, যা সাধারণত ইইউ অর্থায়নে (EU-funded) হতো, এখন আটকে যাচ্ছে। মোট ৬.৩ বিলিয়ন ইউরো ফান্ড “রুল অব ল” (Rule of law) বিরোধে আটকে আছে। এর মধ্যে ১.০৪ বিলিয়ন ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ ব্যয় বরাদ্দ না হওয়ায় “বাতিল” হয়ে গেছে—ইউরোপীয় নিয়ম অনুযায়ী সময়সীমা পার হলে অনুদান আর পাওয়া যায় না। পাশাপাশ, অভিবাসন নীতি (Asylum policy) নিয়ে বিতর্কে ইইউ প্রতিদিন ১ মিলিয়ন ইউরো করে জরিমানা কেটে রাখছে—এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ মিলিয়ন ইউরো ক্ষতি। এছাড়া “২০১৫ সালের পর থেকে অ্যাসাইলাম আইন লঙ্ঘনের” দায়ে ২০০ মিলিয়ন ইউরো এককালীন জরিমানা (One-off fine) হয়েছে। অতিরিক্ত ১৯ বিলিয়ন ইউরো (19 billion euros) কোভিড রিকভারি ফান্ড ও অন্যান্য তহবিলও (Other EU resources) বরফে বন্দী (Blocked)।
চীনা বিনিয়োগের দিকে অরবান?: এ কমতি পূরণে অরবান “অর্থনৈতিক নিরপেক্ষতা” (Economic neutrality) নীতি নিয়ে এশিয়া, বিশেষ করে চীন থেকে বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য কিছুটা বেড়েছে, তবে চীন এখনো হাঙ্গেরির নবম বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। ইইউর অনুপস্থিতির ক্ষতি চীনের বিনিয়োগে পূরণ হওয়া কঠিন।
রাজনীতিতে প্রভাব: অরবানের ভবিষ্যৎ
অরবানের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা এই অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা ও দুর্নীতির অভিযোগকে কাজে লাগাচ্ছে। পিটার ম্যাগায়ার (Peter Magyar), আগে অরবানের মিত্র ছিলেন, এখন শত্রু; তার দল টিজা (Tisza) এখন জনমত জরিপে ফিডেসের সমান বা এগিয়ে। তিনি দাবি করছেন, অরবানের সরকার “কুড়িয়ে পাওয়া ইইউ অর্থ” ও সরকারি তহবিল অপচয় করছে—যার ফল ভঙ্গুর হাসপাতাল, পর্যাপ্ত শিশু যত্ন কেন্দ্রের অভাব, জরাজীর্ণ রেলস্টেশন ইত্যাদি।
হাঙ্গেরিতে পুরোদস্তুর অর্থনৈতিক ধস (Economic crisis) এখনও ঘটেনি, তবে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা যেভাবে সঙ্কুচিত হচ্ছে, তাতে অরবান যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে “রুল অব ল” (Rule of law) এবং “অভিবাসন নীতি” (Asylum policy) নিয়ে আপসে না আসেন, পরিস্থিতি উন্নত হবে না বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
অরবান হয়তো আবারও “ইইউ আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে” বলে দোষ চাপাতে চাইবেন, কিন্তু বাজেট সংকট (Budget crisis) বা দুর্বল প্রবৃদ্ধি (Weak growth) সমাধান না হলে ভোটাররা তার ওপর আস্থা হারাতে পারেন।
উপসংহার (Conclusion)
হাঙ্গেরির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি (Hungary’s economic situation) ক্রমেই জটিলতর হয়ে উঠছে। অরবান সরকারের অতিরিক্ত ব্যয়, বিদ্যমান ঋণের বোঝা, বন্ধ হয়ে যাওয়া বা আটকে থাকা ইইউ অনুদান, মূল্যস্ফীতি ও মন্দার প্রবণতা—সব মিলে অবস্থা বেশ গুরুতর।
ইইউ’র নিষেধাজ্ঞা ও অনুদান আটকে রাখার হুমকি—আইনের শাসন ও অভিবাসন নীতিতে হাঙ্গেরির অবস্থান পরিবর্তন না হলে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। সরকার যদি অদলবদল (Reshuffle) করে ব্যয় কমাতে না পারে বা ইইউ’র সাথে আপস করতে না চায়, তবে অরবানের জনপ্রিয়তা বেশ ঝুঁকির মুখে।
শুধু ট্রেড পার্টনার হিসেবে চীনের দিকে ঝুঁকে লাভ হবে না, কারণ চীনা বিনিয়োগ ও বাণিজ্য এখনো হাঙ্গেরির অর্থনীতির বড় অংশের ঘাটতি পূরণ করতে পারবে না।
ফলে সামনের নির্বাচনে (সম্ভবত ২০২৬ সালে) অরবান কীভাবে বাজেট ও অর্থনীতি সামাল দেবেন, সেটিই তার ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রধান চ্যালেঞ্জ। বিরোধীদলগুলো ইতিমধ্যেই হাঙ্গেরির আর্থসামাজিক অবকাঠামোর দুর্দশা ও সম্ভাব্য দুর্নীতির বিষয়কে হাতিয়ার করেছে।
শীর্ষ বিশ্লেষকদের পরামর্শ, “যদি অরবান সমঝোতায় না আসেন, অর্থ বরাদ্দের ঘাটতি ও ঋণ সেবা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকবে।” আর সেটি তার পুনর্নির্বাচনকে (Re-election) হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
আরও দেখুন – হাঙ্গেরিতে এটাই কি ওরবান (Orbán)-এর শাসনের অবসানের সূচনা? – বিবর্তনপথ
হাঙ্গেরি সম্পর্কিত আরও সংবাদ জানতে দেখুন – ইউরোপ (অন্যান্য) সংবাদ
তথ্যসূত্র
Hungary technical recession
https://think.ing.com/snaps/hungary-slips-into-technical-recession-again/
Hungary pre-election spending 2022
https://www.reuters.com/world/polls-tighten-hungarys-orban-steps-up-pre-election-spending-2021-02-04/
Hungary low consumption levels
https://www.intellinews.com/hungarian-households-have-joint-lowest-consumption-levels-in-eu-359046/?source=bulgaria
https://ec.europa.eu/eurostat/web/products-eurostat-news/w/ddn-20240619-2#:~:text=In%202023%2C%20actual%20individual%20consumption,across%20the%2027%20EU%20countries.
Pensioner confidence in Hungary
https://www.euronews.com/business/2024/05/31/pensions-in-europe-which-countries-are-best-and-worst-for-retirement
Hungary’s deficit
https://www.bloomberg.com/news/articles/2024-07-08/hungary-raises-windfall-taxes-on-banks-to-plug-budget-deficit?embedded-checkout=true
https://x.com/DanielKral1/status/1802640791795556660/photo/1
https://www.bloomberg.com/news/articles/2024-01-03/hungary-s-debt-servicing-costs-surge-past-italy-s-to-lead-eu
Hungary’s manufacturing sector in decline
https://hungarytoday.hu/challenges-and-uncertainties-facing-the-manufacturing-industry/
Hungary loses EU funds
https://www.ft.com/content/fe893219-7ac3-4ff4-a01f-5cfc3e99be7c
Leave a Reply