যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ: বন্ডের ইল্ড বৃদ্ধি ও বাজেট সংকট

এতদিন ধরে জনমত জরিপে (Polls) বেশ ভালো অবস্থান ধরে রেখেছিল ব্রিটেনের (UK) লেবার পার্টি (Labour Party)। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে লেবার নেতা কিয়ার স্টারমার (Keir Starmer) এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন। একদিকে তার জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে ইলন মাস্ক (Elon Musk) সামাজিক মাধ্যমে অবিরাম আক্রমণ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি বড় খবর: আন্তর্জাতিক ও ব্রিটিশ আর্থিক বাজার (Financial markets) হঠাৎ করেই লেবার পার্টির সম্ভাব্য নীতিগুলোকে অপছন্দ করতে শুরু করেছে।

গত কয়েক মাস ধরে যুক্তরাজ্যের দীর্ঘমেয়াদি সরকারি ঋণের (Long-term government borrowing) সুদের হার ধীরে ধীরে বাড়ছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক সপ্তাহে সেই হার আচমকা লাফ দিয়েছে। বর্তমানে সেই হার ২০০৮ সালের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এই পরিস্থিতি শুধু যুক্তরাজ্যের সরকারী অর্থায়ন নয়, বরং লেবার পার্টির নিজস্ব ঘোষিত রাজস্ব (Fiscal) নিয়মগুলোও প্রশ্নের সম্মুখীন করছে।

সপ্তাহের মধ্যেই ঘটনাপ্রবাহ এতটাই খারাপ মোড় নিয়েছে যে, বৃহস্পতিবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস (Liz Truss) (যিনি এখন আইনগত পদক্ষেপ নিচ্ছেন) দাবি করছেন যে স্টারমার যেন তাকে “অর্থনীতি ধ্বংসের জন্য দায়ী” বলে আর অভিযুক্ত করতে না পারেন। তিনি এই নিয়ে একটি বোল্ড ভিডিও প্রকাশ করে রেচেল রিভসকে (Rachel Reeves) দেশকে “অর্থনৈতিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে” নিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী করেছেন।

এই নিবন্ধে আমরা আলোচনা করবো আর্থিক বাজারে কী ঘটছে, কেন এটি স্টারমার ও তার দলের জন্য সত্যিকারার্থে খুবই খারাপ সংবাদ, এবং সামনে কী কী পরিস্থিতি হতে পারে – এসব নিয়ে।

সরকারি বন্ড কী?

সরকারি বন্ড (Government bond) হলো এমন একটি ঋণপত্র যা সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিক্রি করে এবং বিনিয়োগকারীদের কাছে ঋণ নিয়ে থাকে। এর বিনিময়ে সরকার সাধারণত নির্ধারিত সময়ে একটি নির্দিষ্ট সুদের হার প্রদান করে এবং বন্ডটির মেয়াদ শেষে মূলধন (মূল অর্থ) ফেরত দেয়। সরকারি বন্ডে সাধারণত নির্দিষ্ট একটি সুদের হার থাকে, যা নির্ধারিত সময়ে (যেমন, প্রতি বছর বা প্রতি ছয় মাসে) বিনিয়োগকারীদের প্রদান করা হয়। এই সুদকে “কুপন” বা “ইল্ড” বলা হয়। সরকারি বন্ডের একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে, যা হতে পারে কয়েক বছর থেকে দশক পর্যন্ত। বন্ডের মেয়াদ শেষে, সরকার মূলধন ফেরত দেয়। সরকারি বন্ড সাধারণত অত্যন্ত নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হয়, কারণ এটি সরকারের কাছ থেকে আসে এবং সরকার সাধারণত ঋণ পরিশোধে ডিফল্ট (default) করার সম্ভাবনা কম থাকে। তবে, সুদের হার কম হতে পারে, কারণ এর ঝুঁকি কম। সরকারি বন্ডের বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন:

  • ট্রেজারি বন্ড (Treasury bonds): সাধারণত দীর্ঘমেয়াদী (১০ বছরের বেশি) সরকারি বন্ড।
  • ট্রেজারি বিল (Treasury bills): স্বল্পমেয়াদী বন্ড যা এক বছর বা তার কম সময়ে পরিশোধিত হয়।
  • ট্রেজারি নোট (Treasury notes): মাঝারি মেয়াদী বন্ড যা ১ থেকে ১০ বছরের মধ্যে পরিশোধিত হয়।

সরকারি বন্ড সাধারণত একটি দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকলে, ঋণের ক্ষেত্রে খুব নিরাপদ এবং নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হয়।

বন্ডের দামের সাথে ইল্ড বা সুদের হারের একটা সম্পর্ক আছে। সরকারি বন্ডের (গিল্ট) দাম পড়ে যাওয়ার ফলে সুদের হার বা “ইল্ড” বাড়ে, কারণ বিনিয়োগকারীকে আগের রেইটের টাকাই ফেরত দিতে হয়, কিন্তু বন্ডের দামটাই কমে যাবার ফলে যে অর্থ ফেরত দিতে হবে বন্ডের দামের তুলনায় তার পারসেন্টেজ বেড়ে যায়, আর সেটাই ইল্ড। মানে ধরুন, ১০০ ডলারের বন্ড কিনলেন ৬ মাসের জন্য ৫% ইল্ডে। মানে ৬ মাস পর আপনি ৫ ডলার সুদ পাচ্ছেন। কিন্তু পরে বন্ডের দাম কমে ৯০ ডলার হয়ে গেল। কিন্তু আপনাকে ৫ ডলারই ফেরত দিতে হবে। তাই সুদের হার বা ইল্ড বেড়ে এবার ৫/৯০ = ৫.৫৫ হয়ে গেছে। মানে ইল্ড বেড়ে গেছে।

আচমকা ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি: ঘটনাপ্রবাহ

সাম্প্রতিক কয়েক দিনে যুক্তরাজ্যের দীর্ঘমেয়াদি সরকারি বন্ড (Government bonds) বা গিল্ট বা Gilts-এর দাম উল্লেখযোগ্যভাবে পড়ে গেছে। বন্ডের দাম পড়ে গেলে ফলস্বরূপ সুদের হার বা “ইল্ড” (Yield) বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, ১০ বছর মেয়াদি ব্রিটিশ সরকারি বন্ড (10-year gilt) এর সুদের হার বছর শেষে প্রায় ৪.৫% ছিল, যা বর্তমানে প্রায় ৪.৯%-এ পৌঁছেছে—২০০৮ সালের পর সবচেয়ে বেশি। একই সময়ে ৩০ বছরের গিল্টের (30-year gilt) সুদের হার গত বছরের শেষের তুলনায় বেড়ে ৫.৪%-এ দাঁড়িয়েছে, যা প্রায় ২০০৮ সালের পর সর্বোচ্চ।

এর বাস্তব প্রভাব কী?

  • নতুন কোনো দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিতে গেলে সরকারের খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
  • আগের যে বিপুল ঋণের বোঝা (UK’s pre-existing debt pile) রয়েছে, তার সুদ পরিশোধ করতেও সরকারকে অনেক বেশি অর্থ গুণতে হবে।
  • লেবার পার্টির পরিকল্পনামতো, যদি তারা ক্ষমতায় গিয়ে বড় মাপের “উন্নয়ন বা বিনিয়োগমূলক” প্রকল্পে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ওপর নির্ভর করতে চায়, তাহলে এই সুদের হার বৃদ্ধির কারণে সেটি অনেক ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে।

কেন বৃদ্ধি পাচ্ছে এই সুদের হার? কেন কমছে বন্ডের দাম?

আগেই উল্লেখ করেছি ইল্ড বা সুদের হার কমে বন্ডের দাম কমার জন্যই। আর বন্ডের দাম কমে কারণ বিনিয়োগকারীরা সরকারের উপর বিনিয়োগ করতে উৎসুক হয়না। ফলে বন্ডের চাহিদা কমে গিয়ে দামও কমে যায়। কিন্তু কেন বিনিয়োগকারীরা সরকারকে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হয়না? কেন বিনিয়োগকারীরা সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে যে কারণে তারা আর বিনিয়োগ করতে চায় না? এর স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী সব কারণই বলা হবে যুক্তরাজ্যের উদাহরণ দেয়ার মাধ্যমেই। কিন্তু তার আগে একটা কথা বলে রাখতে চাই যে, এটা কেবল যুক্তরাজ্যের জন্য বিশেষ কোনো ঘটনা নয়, মানে কেবল যুক্তরাজ্যের সমস্যা না। বৈশ্বিক অর্থনীতির (Global economy) বর্তমান অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা (Investors) অনেক দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির (Growth prospects) ব্যাপারে সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠেছেন। বিশ্ববাজারে অর্থায়নের খরচ (Global borrowing costs) সমগ্রেই বাড়ছে।

যদি আমরা শুধু যুক্তরাজ্যের ১০ বছরের গিল্টের হার না দেখে, ফ্রান্স (France), জার্মানি (Germany), যুক্তরাষ্ট্র (US)–এদের ১০ বছরের বন্ডের হারের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো, প্রায় সবারই হার সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে। কিন্তু যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি আরও বেশি দৃশ্যমান।

  • সেপ্টেম্বর মাসেও যুক্তরাষ্ট্রের ১০ বছরের ট্রেজারি বন্ডের (Treasury bond) সুদের হার যুক্তরাজ্যের গিল্টের চেয়ে বেশি ছিল। অথচ এখন যুক্তরাজ্যের হার আমেরিকার চেয়েও উঁচুতে উঠে গেছে।
  • ৩০ বছরের বন্ডের (Long-dated bond) ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে; যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের মধ্যে সুদের হারের পার্থক্য (Spread) এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
  • পাউন্ডের (GBP) অবস্থাও নড়বড়ে; ডলারের (USD) বিপরীতে পাউন্ড গত ১৪ মাসের মধ্যে সবচেয়ে নিচু অবস্থানে পৌঁছেছে।

সবমিলিয়ে স্পষ্ট—বিশ্ব অর্থনীতিতে একটা অনিশ্চয়তা থাকলেও, যুক্তরাজ্যের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা (Confidence) বিশেষভাবে কমে গেছে।

তাহলে এবার যুক্তরাজ্যের উদাহরণ দিয়ে সেই সব স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী সমস্যাগুলো নিয়ে জানা যাক যেগুলোর কারণে বিনিয়োগকারীরা যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়ে আর তেমন বিনিয়োগ করতে চাইছেন না, আর সেজন্য বন্ডের দামও কমে গেছে, ইল্ডও বেড়ে গেছে।

স্বল্পমেয়াদি চাপ (Short-Term Pressures):

  • ১. দুর্বল প্রবৃদ্ধির হালনাগাদ তথ্য (Recent growth data): সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি স্থবিরতার (Stagnation) দিকে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের মনে শঙ্কা—এভাবে অর্থনীতি মন্থর হলে ঋণ শোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে।
  • ২. চাকরির বাজারে পতন (Fewer jobs): কিছু ডেটা অনুযায়ী, নতুন চাকরির সংস্থান (Job creation) কমে গেছে। এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে মন্দার (Recession) আশঙ্কা বাড়ে।
  • ৩. প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি (Defence spending pledge): স্টারমার ২.৫% জিডিপি (GDP) প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) ক্ষমতায় বসার পর যদি ন্যাটোকে (NATO) নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করেন, তাহলে প্রতিরক্ষা ব্যয় আরও বেড়ে যেতে পারে। বিনিয়োগকারীরা ভাবছেন, এত বিশাল প্রতিরক্ষা ব্যয় কীভাবে অর্থায়ন করা হবে?
  • ৪. নির্দিষ্ট পণ্যের (বিশেষত জ্বালানি) দাম বৃদ্ধি ও স্থির মূল্যস্ফীতি (Sticky inflation): সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বছরওপরি মূল্যস্ফীতি (Year-on-year inflation) বেড়ে ২.৬%-এ পৌঁছেছে (আগে ছিল ২.৩%)। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের (Bank of England) ২% লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এটি বেশি। বিশেষ করে জ্বালানির (Energy) দাম আবার বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির চাপ কমছে না। তাই সুদের হার (Interest rate) হয়তো আরো দীর্ঘসময়ের জন্য উঁচু থাকবে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা (Long-Term Factors): 

  • ১. ২০০৮ সালের পর থেকে দুর্বল জিডিপি প্রবৃদ্ধি (Weak GDP growth post-2008): একাধিক মন্দা (Recession) ও অর্থনৈতিক ধাক্কার (Economic shock) পর থেকে যুক্তরাজ্যের প্রবৃদ্ধি খুব একটা জোরালো নয়।
  • ২. ঋণের বোঝা (High debt-to-GDP ratio): সরকারি ঋণ ও জিডিপির অনুপাত (Debt-to-GDP ratio) প্রায় ১০০%-এ গিয়ে পৌঁছেছে, যা গত ৬০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০০৮ সালের আগে এটি ছিল ৪০%-এর কম। একের পর এক সংকট মোকাবিলায় সরকারকে প্রচুর ঋণ নিতে হয়েছে, যার চাপ এখন দৃশ্যমান।

কেন এটি লেবার পার্টির জন্য বিশেষভাবে খারাপ খবর?

লেবার পার্টির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে কিয়ার স্টারমার ও ছায়া অর্থমন্ত্রী রেচেল রিভস (Shadow Chancellor Rachel Reeves), গত কয়েক বছর ধরে বাজার ও বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন যে তারা অর্থনীতির দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। (শ্যাডো চ্যান্সেলর (Shadow Chancellor) হল যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ, যা মূলত বিরোধী দলের অর্থনৈতিক নীতির দায়িত্বে থাকে। শ্যাডো চ্যান্সেলর, সরকারি চ্যান্সেলরের ভূমিকা পালন করেন না, তবে তার কাজ হচ্ছে সরকারের অর্থনৈতিক নীতি এবং বাজেটের সমালোচনা করা, বিকল্প নীতি প্রস্তাব করা, এবং সরকারের দিক থেকে অর্থনৈতিক বিষয়গুলোতে চ্যালেঞ্জ তোলা।) শুরুর দিকে বাজার হয়তো সে আশ্বাসে সাড়া দিয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে সেই আস্থা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

লেবার পার্টির অন্যতম রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি হলো নিজেদের আর্থিক দায়-দায়িত্বের ব্যাপারে “বিশ্বাসযোগ্য” হওয়া (Fiscal credibility)। তারই অংশ হিসেবে তারা যে ফিসকাল রুলস (Fiscal rules) বা রাজস্ব-বাজেট বিধিনিয়ম ঘোষণা করেছে, এখন সেই নিয়মগুলো বজায় রাখা অনেক কঠিন হয়ে পড়বে।

ফিসকাল রুলস (Fiscal Rules) ও ঋণের সীমাবদ্ধতা

লেবার বলছে, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই (Before the end of Parliament) যুক্তরাজ্যের ঋণ-জিডিপি অনুপাত (Debt to GDP ratio) তারা কমতে শুরু করবে এমন একটি নীতি বজায় রাখবে। অর্থাৎ Office for Budget Responsibility (OBR) যদি পূর্বাভাসে (Forecast) দেখায় যে পরবর্তী সময়ে ঋণ-জিডিপি অনুপাত কমবে, তবে সেটিই হবে তাদের স্বীকৃত বাজেট কাঠামো।

রেভস শেষ বাজেট পেশ করেছিলেন অক্টোবর মাসে, যখন ঋণ গ্রহণের খরচ তুলনামূলকভাবে কম ছিল। তখন OBR হিসেব করে বলেছিল, রেভসের পরিকল্পনার ফলে সরকারি ব্যয় ও এই “সীমা” (Ceiling) বা ফিসকাল রুলসের মধ্যে ৯.৯ বিলিয়ন পাউন্ডের একধরনের “অতিরিক্ত”—অন্য কথায় “হেডরুম” (Headroom)—অবশিষ্ট আছে। কিন্তু আজকের দিনে সুদের হার বাড়ায় সেই হেডরুম যে দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে—এটা প্রায় নিশ্চিত।

OBR তাদের পরবর্তী পূর্বাভাস (Next forecast) প্রকাশ করবে মার্চ মাসে। ধারনা করা হচ্ছে, তখন যদি OBR ঘোষণা করে যে বাড়তি সুদের কারণে লেবারের সেই বাজেট বাস্তবায়ন করলে ঋণ-জিডিপি অনুপাত আর নামবে না—বরং বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা—তাহলে লেবারকে হয় ব্যয় (Spending) কমাতে হবে, নয়তো কর (Tax) বাড়াতে হবে, নিজেদের ঘোষিত নিয়ম বজায় রাখার জন্য।

ব্যয় কাটা (Spending Cuts) না কর বাড়ানো (Tax Rises)?

রেভস আগেই বলেছেন, তিনি বছরে একবারই (Autumn budget) মূল বাজেট উপস্থাপন করতে চান। তবুও গুঞ্জন আছে, যদি পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়, তাকে হয়তো মাঝপথে “মিনি বাজেট” বা কোনো ব্যয় হ্রাসের ঘোষণা দিতে হতে পারে।

ট্রেজারি (Treasury) সূত্রে বুধবার জানা গেছে, রিভস সম্ভবত কর বৃদ্ধির (Tax rises) চেয়ে ব্যয় ছাঁটাইয়ের (Spending cuts) পথেই হাঁটতে আগ্রহী। কিন্তু যুক্তরাজ্যে ইতোমধ্যে অনেক খাতে (স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার ইত্যাদি) তহবিল সংকট প্রকট; আরও কাটছাঁট রাজনৈতিকভাবে অসুবিধাজনক হতে পারে।

আশঙ্কা: ‘অস্টেরিটি ডুম লুপ’ (Austerity Doom Loop): ব্যয় কাটা হলে তা অল্প-মেয়াদে খরচ কমালেও দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। প্রবৃদ্ধি কমলে কর আদায় (Tax receipts) হ্রাস পায়, ফলে আবারও বাজেটে ঘাটতি (Deficit) দেখা দেয়, এবং সরকারকে আবার ব্যয় ছাঁটাই করতে হয়। এই চক্রকে বলা হচ্ছে “অস্টেরিটি ডুম লুপ।” ২০০৮ সালের পর টোরি (Conservative) সরকার এই পথে হেঁটেও ঋণ-জিডিপি অনুপাত বড় আকারে কমাতে পারেনি বলে অনেকে সমালোচনা করে থাকেন।

লিজ ট্রাসের ছায়া: আদৌ আরেকটি বিপর্যয় আসছে?

বেশ কিছু পর্যবেক্ষক মনে করেন, ২০২২ সালে লিজ ট্রাসের সংক্ষিপ্ত মেয়াদকালে যা ঘটেছিল, সেটির পুনরাবৃত্তি এখনই হবে না। কারণ, লিজ ট্রাসের তথাকথিত “মিনি বাজেট” (Mini budget) ছিল একেবারে অপ্রস্তুত, বাজারকে ঠিকমতো জানানো হয়নি। ফলে বাজারে আকস্মিক চমক লেগে সুদের হার বাড়ে এবং পাউন্ডের মূল্য পড়ে যায়।

এইবারের সংকট ততটা আকস্মিক নয়। বরং এটি ধীরে ধীরে জমে ওঠা আস্থা সংকট (Growing realisation) — যে লেবার পার্টি আগের ধারণার মতো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সৃষ্টিতে এতটা দক্ষ নাও হতে পারে। সুতরাং, “এক রাতের মধ্যে” সুদের হার আকাশচুম্বী হওয়ার মতো বিপর্যয় (Flash crisis) এখানে ঘটেনি।

তবু, পরিস্থিতি যে যথেষ্ট খারাপ, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বাজারের অনাস্থা বাড়লে লেবার পার্টিকে ঐতিহাসিকভাবে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে সরকারব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।

১৯৭৬ বনাম ২০২২: কোনটার সঙ্গে বেশি মিল?

কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতি ২০২২ সালের চেয়ে ১৯৭৬ সালের সংকটের সঙ্গে বেশি মিল খুঁজে পায়। ১৯৭৬ সালে যুক্তরাজ্যের সরকারি ব্যয় এবং বাণিজ্য ঘাটতি (Trade deficit) উভয়ই বড় আকার ধারণ করেছিল। একইসময়ে পাউন্ডের মান কমতে শুরু করে এবং সরকার বাধ্য হয়ে আইএমএফ (IMF)-এর কাছে ৩.৯ বিলিয়ন ডলার ঋণের আবেদন করে, যেটি কঠিন শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদিত হয়েছিল।

আজকের দিনে ঋণ শোধের খরচ বাড়া (Rising borrowing costs) এবং পাউন্ডের দরপতন (Falling pound) একসঙ্গে ঘটছে; বাজেট ঘাটতি (Budget deficit) ও বাণিজ্য ঘাটতি (Trade deficit) বেশ বড় আকারের। যদিও এখনই আইএমএফ বেইলআউটের (IMF bailout) প্রয়োজন হবে, এমন পরিস্থিতি আসেনি, কিন্তু যদি অর্থনীতির ভিত্তি আরো দুর্বল হয়, ভবিষ্যতে এমনও হতে পারে।

লিজ ট্রাসের ‘আইনি পদক্ষেপ’ ও রাজনৈতিক তরজা

লিজ ট্রাস এখন স্টারমারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে চাইছেন, যাতে স্টারমার তাকে “অর্থনীতি ক্র্যাশ” করার জন্য দায়ী করতে না পারেন। ট্রাস দাবি করছেন যে, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জন্য তিনিই একমাত্র দায়ী নন। বরং বর্তমান সরকারের (অথবা আগামী সম্ভাব্য লেবার সরকারের) “অদক্ষ নীতি” বৃহত্তর মাত্রায় দায়ী।

তিনি রেচেল রিভসকে সরাসরি দায়ী করেছেন, বলছেন যে রিভসের বাজেট পরিকল্পনাই ব্রিটিশ অর্থনীতিকে নতুন এক বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাজনৈতিক এই চাপান-উতোরে সত্যিকারের বাস্তবতার চেয়ে দোষারোপের খেলা (Blame game) বড় হয়ে উঠতে পারে।

ভবিষ্যতে কী হতে পারে?

১. সুদের হার স্থিতিশীল নাকি আরও বাড়বে?

  • যদি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়, বা যুক্তরাজ্য সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমতে থাকে, তাহলে সুদের হার (Yield) আরও বাড়তে পারে।
  • অন্যদিকে, যদি কোনোভাবে (যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি, বা আন্তর্জাতিক বাজারে ইতিবাচক পরিবর্তন ইত্যাদি) সুদের হার কমে যায়, তাহলে লেবারের চাপ কিছুটা লাঘব হবে।

২. লেবার কি নতুন কোনো বাজেট বা মিনি-বাজেট নিয়ে আসবে?

  • স্টারমার ও রিভস এর আগে বলেছেন, বড় বাজেট মূলত শরতে (Autumn) আনা হবে। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে তাদের আগেভাগে কিছু পদক্ষেপ নিতে হতে পারে।
  • ব্যয় ছাঁটাই (Spending cuts) করলে রাজনীতিতে বড় প্রতিক্রিয়া আসবে, বিশেষ করে যেসব খাত ইতোমধ্যেই সংকটে রয়েছে।
  • কর বাড়ানো (Tax increases) জনপ্রিয় হবে না, বিশেষ করে এমন সময়ে যখন ক্রয়ক্ষমতা (Purchasing power) কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

৩. অস্টেরিটি (Austerity) নাকি বিকল্প নীতি?

  • লেবার যদি অস্টেরিটির পথে হাঁটে, তাহলে ২০১০ পরবর্তী টোরি সরকারের মতো একই ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে—যেখানে বাজেট কাটছাঁট প্রবৃদ্ধি কমায়, কর রাজস্বও (Tax revenue) কমে যায়, আবারও কাটছাঁটের প্রয়োজন হয়।
  • বিকল্প হতে পারে—“উন্নয়নমূলক বিনিয়োগ ও টেকসই প্রবৃদ্ধি” (Growth-oriented policy), কিন্তু উচ্চ সুদের হার সেটিকে আবার ব্যয়বহুল করে তুলছে।

৪. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাব (International dimension)

  • বিশ্ব অর্থনীতি যদি মন্দার মুখে পড়ে, যুক্তরাজ্যের রপ্তানি (Exports) কমে যাবে, বিনিয়োগ আরও হ্রাস পেতে পারে।
  • অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের অন্য কোথাও যদি আর্থিক নীতি শিথিল হয়, বা আস্থা বৃদ্ধির কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তখন ব্রিটিশ বন্ডের ওপর চাপ কিছুটা কমতে পারে।

উপসংহার

কিয়ার স্টারমার ও লেবার পার্টির জন্য বর্তমান আর্থিক বাস্তবতা এক বড় পরীক্ষা হিসেবে দেখা দিয়েছে। একসময় বাজারে তাদের ভাবমূর্তি ছিল “দায়িত্বশীল ও স্থিতিশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপক,” কিন্তু সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সেই ভাবমূর্তি মারাত্মক চাপে পড়েছে।

  • সুদের হার লাফিয়ে বেড়ে যাওয়ায় ঋণগ্রহীতা হিসেবে যুক্তরাজ্য চড়া মাশুল দিচ্ছে, যা লেবারের প্রতিশ্রুত উন্নয়নমূলক কর্মসূচিগুলোর (Investment plans) ব্যয় বাড়িয়ে তুলবে।
  • ফিসকাল রুলস বজায় রাখতে হলে হয় কর বাড়াতে হবে, নয়তো ব্যয় ছাটাই করতে হবে—দুটোই রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
  • দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে গেলে ঋণ-জিডিপি অনুপাত কমানো কঠিন হয়ে পড়বে। আর সেটি করতে ব্যর্থ হলে লেবারের “বিশ্বাসযোগ্যতা” ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
  • লিজ ট্রাসের ২০২২ সালের “মিনি বাজেট” সংকটের পুনরাবৃত্তি না ঘটলেও, ১৯৭৬ সালের মত আইএমএফ-এ যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে কিনা, সেটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। যদিও তেমন ইঙ্গিত এখনই মজবুত নয়, তবু অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে দিচ্ছেন যে, সামগ্রিক দৃশ্যপট সুখকর নয়।

পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে লেবার পার্টির কাছে অর্থনীতিতে “টার্নঅ্যারাউন্ড” ঘটানোর বিকল্প উপায় খুঁজে বের করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। একদিকে নিজস্ব ফিসকাল রুলস বাস্তবায়ন, অন্যদিকে নাগরিকদের কাছ থেকে রাজনৈতিক সমর্থন ধরে রাখা—দুটোই একসঙ্গে কীভাবে সম্ভব হবে, তা নিয়ে অনেকে সন্দিহান। যুক্তরাজ্যের জনগণ অপেক্ষা করছে এই প্রশ্নের উত্তর কীভাবে স্টারমার ও রিভস দেবেন, এবং ভবিষ্যতের বাজেট ও অর্থনৈতিক নীতিতে কী ধরনের পদক্ষেপ দেখা যায়।

অতএব, সংক্ষেপে বললে, লেবার পার্টি এখন এক নীরব অথচ গভীর অর্থনৈতিক ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তা লিজ ট্রাসের “ঋণ সংকট” মুহূর্তের মতো তীব্র না হলেও, এর ডামাডোলকে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। সময়ই বলে দেবে, এই ক্রমবর্ধমান সুদের হার ও বাজার-অনাস্থার মুখে লেবার পার্টি সত্যিকার অর্থে সফল অর্থনৈতিক মডেল উপস্থাপন করতে পারে কি না।

যুক্তরাজ্য সম্পর্কিত আরও সংবাদ ও বিশ্লেষণ জানতে চাইলে এখানে যান – যুক্তরাজ্য সংবাদ

তথ্যসূত্র

1 – https://www.marketwatch.com/investing/bond/tmbmkgb-10y?countrycode=bx
2 – https://tradingeconomics.com/united-kingdom/government-bond-yield
3 – https://www.worldgovernmentbonds.com/spread/united-kingdom-30-years-vs-united-states-30-years/#google_vignette
4 – https://www.bbc.co.uk/news/articles/czx5w5yl2y7o
5 – https://www.ft.com/content/35f490c5-3abb-4ac9-8fa3-65e804dd158f
6 – https://www.bbc.co.uk/news/business-12196322
7 – https://commonslibrary.parliament.uk/research-briefings/sn02812/
8 – https://www.bloomberg.com/news/articles/2025-01-10/uk-bond-selloff-puts-reeves-economic-project-on-the-brink?srnd=homepage-uk
9 – https://www.bloomberg.com/news/articles/2025-01-09/uk-bond-turmoil-gives-labour-nightmare-of-britain-s-1976-debt-crisis

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.