কানাডার অর্থনৈতিক পতন ও তার কারণ

ভূমিকা

কোভিড-১৯ (COVID-19) মহামারির সমাপ্তির পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের (United States) অর্থনীতি অসাধারণ মাত্রায় প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। অর্থনীতিবিদেরা “আঙ্কল স্যাম” (Uncle Sam) নামেও যাকে সম্বোধন করে, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সাফল্য এতটাই বিস্তৃত যে উত্তর আমেরিকার আরেক শক্তিশালী দেশ কানাডার সাফল্য যেন ছায়াচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। অথচ কানাডার অর্থনীতি বরাবরই এক সুসংগঠিত, ভালোভাবে চলমান এক “ইঞ্জিন” হিসেবে পরিচিত ছিল। জি-সেভেন (G7) অন্তর্ভুক্ত বেশিরভাগ দেশের তুলনায় কানাডার জিডিপি (GDP) বরাবরই তুলনামূলক দ্রুত হারে বেড়েছে। তাছাড়া ২০২০ সালের মহামারিজনিত সংকটের সময় অন্যান্য দেশের তুলনায় কানাডা তুলনামূলক দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল।

এই সাফল্যের পেছনে কী আছে? অনেকে হয়তো বলবেন, এর কৃতিত্ব কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর (Justin Trudeau) সরকারের নীতিমালার। আবার কেউ হয়তো বলবেন, এর পেছনে রয়েছে কানাডার ঐতিহাসিকভাবে শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামো। আসলে সত্যটা হলো—কানাডায় প্রগতিশীল (Progressive) বা রক্ষণশীল (Conservative) যেই দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, বিগত কয়েক দশক ধরে বিশ্বের অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব কানাডার ওপর তুলনামূলক কম পড়েছে। ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দার (Global Financial Crisis) সময়ও দেখা গেছে, কানাডার জিডিপি অন্য জি-সেভেন দেশের তুলনায় অনেক কম মাত্রায় কমে গেছে।

কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি অনেকটা বদলে গেছে। এখন যদি আপনি কোনো কানাডিয়ানের সঙ্গে আলাপ করেন এবং বলেন—“কানাডা এখনো বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধশালী (Prosperous) দেশ,”—তবে হয়তো সেই ব্যক্তি আপনার মুখের ওপর হেসে ফেলবেন। কারণ, মাথাপিছু সম্পদ (Wealth per person) গত কয়েক বছর ধরে স্থবির হয়ে আছে, এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে এর প্রকৃত প্রবৃদ্ধি (Real GDP per capita growth) ঋণাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ সালে, ২০২২ সালের তুলনায় কানাডার প্রকৃত জিডিপি পার ক্যাপিটা (Real GDP per capita) প্রায় ২% কমে গেছে, যা স্পষ্টত একপ্রকার মন্দার (Recession) ইঙ্গিত দেয়।

অর্থাৎ প্রশ্ন স্পষ্ট: কেন কানাডার অর্থনীতি পতনের দিকে যাচ্ছে? কী বদলে গেছে? এবং এর ভবিষ্যৎ কী?

কানাডার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও বর্তমান বাস্তবতা

অনেক বছর ধরে কানাডার অর্থনীতি “যেন রকেটের মতো উঠে চলা”—এমন ভাবমূর্তি পোষণ করে এসেছে। কিন্তু কেন হঠাৎ এমন মন্থরতা? এর পেছনে আছে কানাডার মাথাপিছু উৎপাদন (Per capita production) এবং উৎপাদনশীলতার (Productivity) দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলো। গত এক দশকে কানাডার মাথাপিছু উৎপাদন বেশ কয়েকটি বড় অর্থনীতির চেয়ে খারাপ পারফর্ম করেছে। এমনকি যুক্তরাজ্যের (United Kingdom) মতো “সমস্যায় জর্জরিত” অর্থনীতির থেকেও কিছু সময়ে পিছিয়ে পড়েছে।

যেখানে সামষ্টিক জিডিপি (Aggregate GDP) এক ধরণের প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে, সেখানে মাথাপিছু আয় বা উৎপাদনে আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। ফলে সাধারণ কানাডিয়ানদের মধ্যে ক্রয়ক্ষমতা (Purchasing power) এবং জীবনমান (Standard of living) রীতিমতো ঝিমিয়ে পড়েছে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি বনাম উৎপাদনশীলতা (Population Growth vs. Productivity)

কানাডা দীর্ঘদিন ধরে অভিবাসীদের (Immigrants) জন্য এক স্বাগত-উন্মুক্ত দেশ হিসেবেই পরিচিত। ২০১৪ সালেই কানাডা প্রায় দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষকে স্থায়ীভাবে গ্রহণ করেছিল। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের (World Bank) তথ্য অনুসারে, ২০১৫ সালে কানাডায় বসবাসরত প্রতি পাঁচজন মানুষের মধ্যে একজন ছিলেন অন্য দেশে জন্মগ্রহণকারী।

প্রথমেই আমাদের মনে হতে পারে, এত বিপুল সংখ্যক অভিবাসীর আগমন বুঝি দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তবে সিঙ্গাপুর (Singapore) বা হংকং (Hong Kong)-এর মতো উদাহরণগুলো বলে যে, স্রেফ অভিবাসী প্রবেশই অর্থনীতিকে ধ্বংস করে না; বরং সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারলে বিদেশি জনশক্তি GDP বৃদ্ধি ত্বরান্বিতও করতে পারে।

কানাডার ক্ষেত্রে সমস্যা হলো, ইতিবাচকভাবে অভিবাসী প্রবেশ ঘটলেও, অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতা বা প্রযুক্তিগত উন্নতি (Technological advancement) সে অনুপাতে বাড়েনি। ফলে সামগ্রিক জিডিপি বাড়লেও, তা মাথাপিছু আয়ের উন্নতি বা অর্থনৈতিক মূল্যসংযোজন (Value addition) বাড়ানোর ক্ষেত্রে তেমন কার্যকর হচ্ছে না।

উৎপাদনশীলতার ক্রমধারা ও ১৯৮০–পরবর্তী বদল

অনেক অর্থনীতিবিদ ইঙ্গিত দেন যে, ১৯৮০ সালের পর থেকে কানাডার উৎপাদনশীলতার ধারা (Productivity trajectory) নিম্নমুখী হতে থাকে। অথচ ১৯৮০ সালের আগ পর্যন্ত কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে বেশি ফারাক ছিল না। প্রশ্ন জাগে, ঠিক কী ঘটেছিল ১৯৮০’র দশক থেকে, যার ফলে কানাডার উৎপাদনশীলতা স্থবির হতে থাকে?

আধুনিক অর্থনীতিতে উচ্চ উৎপাদনশীলতার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো “পুঁজি সঞ্চয় ও বিনিয়োগ (Capital accumulation and investment)”—যার মাধ্যমে কলকারখানা, যন্ত্রপাতি, নেটওয়ার্ক অবকাঠামো (Network infrastructure), গবেষণা ও উন্নয়ন (Research and Development) ইত্যাদিতে টেকসই বিনিয়োগ করা হয়। এসব বিনিয়োগের মাধ্যমে শ্রমিকদের দক্ষতা বেড়ে যায়, উৎপাদন বাড়ে এবং মাথাপিছু আয়ও বৃদ্ধি পায়।

কিন্তু কানাডায় সাম্প্রতিক সময়ে বিনিয়োগের (Investment) অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। দেশটির প্রাইভেট সেক্টর (Private sector), বিশেষ করে উদ্যোক্তা (Entrepreneurs) ও ব্যবসা-বাণিজ্যের (Business investment) ক্ষেত্রে উদ্যম আশানুরূপ নয়। বিদেশি বিনিয়োগের (Foreign investment) ক্ষেত্রেও এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

বিনিয়োগ সংকট ও এর কারণ

বেসরকারি বিনিয়োগের ঘাটতি (Lack of private investment): উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে কানাডার ব্যবসা খাত তুলনামূলকভাবে ছোট এবং বিনিয়োগে “সাবধানী”। ব্যক্তিগত বিনিয়োগ ৫০ শতাংশের নিচে থেকে গেছে, যা অন্য অনেক উন্নত দেশের তুলনায় কম। ফলস্বরূপ, দীর্ঘমেয়াদি মূলধনি পণ্য (Capital goods) কেনা, প্রযুক্তি খাতে (Technology sector) বিনিয়োগ করা কিংবা পণ্যে নতুনত্ব আনার কাজ পর্যাপ্ত হারে হচ্ছে না।

বিদেশি বিনিয়োগের পতন (Decline in foreign capital inflow): অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের মত বিদেশি বিনিয়োগও (Foreign capital inflow) কমতির দিকে। ২০১৬ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত কানাডায় বিদেশি বিনিয়োগ থেকে প্রায় ২২৫ বিলিয়ন (Billion) ডলারের ঘাটতি হয়েছে বলে কিছু প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। ২০০০ সালের দিকে যেখানে জিডিপি’র ৯% এর বেশি বাইরে থেকে বিনিয়োগ আসত, এখন তা ৩%-এর নিচে নেমে গেছে। এ ধরনের পতন এককথায় উদ্বেগজনক।

অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ (Overregulation) ও ব্যুরোক্রেসি

রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ (State interventionism): অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ (Overregulation) যে কোনো অর্থনীতির জন্য একটি বড় অন্তরায়। কানাডার ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি প্রকট। একদিক থেকে দেখলে, বিধিনিষেধ কিছুটা থাকা ভালো—কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত নিয়মকানুন কার্যত একটি অর্থনীতিকে শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলে।

বিদেশি বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা (Restrictiveness toward foreign investment): কানাডা বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দুনিয়ার মধ্যে অন্যতম “বন্ধ” (Closed) দেশ। বিশ্বের ওইসিডি (OECD) ভুক্ত দেশগুলোর গড়ের তুলনায় কানাডায় কয়েকগুণ বেশি বিধিনিষেধ আরোপিত আছে। পেপারওয়ার্ক (Paperwork), লাইসেন্স (License), ফি (Fees), পারমিট (Permits), সর্বত্র করের (Taxes) জটিলতা—এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে কেউ সহজে এখানে বিনিয়োগ করতে ভয় পায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে দুগ্ধ (Dairy) ও পোল্ট্রি (Poultry) পণ্যের সাপ্লাই ম্যানেজমেন্ট (Supply Management) ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় কৃষকদের জন্য নির্ধারিত কোটা (Quota) রয়েছে, যা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি পণ্য উৎপাদন করতে দেয় না। ফলে বাজারে প্রতিযোগিতা কমে যায়, দাম চড়া থাকে এবং ভোক্তারা কম মূল্যে কেনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। একই সঙ্গে বিদেশি পণ্যের আমদানিতেও কড়াকড়ি থাকে, যা মুক্তবাজারের (Free market) মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

প্রদেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যবাধা (Interprovincial trade barriers): আইএমএফ (IMF) এর গবেষণা বলছে, কানাডার বিভিন্ন প্রদেশের (Provinces) মধ্যে যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা (Bureaucratic complexity) বিরাজ করছে, তাতে দেশটির অভ্যন্তরীণ বাজার প্রায় ২০ শতাংশ শুল্ক দেয়ার মতো বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাঝেও যে মাত্রার অভ্যন্তরীণ মুক্ত বাণিজ্য আছে, কানাডার প্রদেশগুলোর মধ্যে সেটুকুও সুষ্ঠুভাবে নেই।

অপর্যাপ্ত গবেষণা ও উন্নয়ন, শিল্পখাতের সংকোচন, উচ্চ কর ও কঠোরতা, এবং মেধাপাচার

গবেষণা ও উন্নয়নে (Research and Development) কম ব্যয়: উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে কানাডা গবেষণা ও উন্নয়নে সবচেয়ে কম ব্যয়কারী দেশগুলোর একটি। জি-সেভেনের মধ্যে ইতালির (Italy) পরেই কানাডার অবস্থান। আধুনিক বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক প্রযুক্তির দুনিয়ায় গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় কম হলে উচ্চমূল্য সংযোজন (High value addition) বা উচ্চ-প্রযুক্তি পণ্যের (High-tech products) দিকে এগিয়ে যাওয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।

শিল্পখাতের সংকোচন (Shrinkage of manufacturing sector): ২০০০-এর দশকের শুরু থেকে শুরু হওয়া এক প্রক্রিয়ায় কানাডার ম্যানুফ্যাকচারিং (Manufacturing) খাত ক্রমশ ছোট হয়ে এসেছে। শিল্পউৎপাদন দেশের জিডিপির ১০%-এরও কমে নেমে এসেছে, যেখানে ২০ বছর আগে তা ১৭%-এর কাছাকাছি ছিল। আধুনিক অর্থনীতিতে উৎপাদন খাত (Manufacturing sector) একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ; কারণ এখানে ব্যাপক কর্মসংস্থান, দক্ষতা উন্নয়ন ও রফতানিযোগ্য পণ্যের সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু বিনিয়োগ ও উদ্ভাবনে দুর্বলতার কারণে কানাডা এই খাত সঠিকভাবে টিকিয়ে রাখতে পারছে না।

কর ও নিয়মকানুনে উচ্চমাত্রার কঠোরতা (High Tax and Regulatory Burden): প্রশ্ন আসে—কানাডিয়ান উদ্যোক্তারা (Entrepreneurs) কেন উঁচুমূল্যের প্রযুক্তি (High-tech) বা অত্যাধুনিক খাতগুলোতে (Cutting-edge sectors) বিনিয়োগে উৎসাহী নন? কারণ, কঠোর নিয়মকানুন ও করের বোঝা (Tax burden) তাদের বেশিরভাগ মুনাফাই (Profit) কেড়ে নেয়। পণ্য বা সেবা বের করার আগে নানা ধরণের অনুমোদন (Approvals) ও খরচের কারণে বিনিয়োগ ঝুঁকি (Risk) বাড়ে। ফলে সেই ঝুঁকি নিতে অনেকেই ভয় পান। একই সঙ্গে, উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের বদলে অপেক্ষাকৃত কম উদ্ভাবনী (Less innovative) কিন্তু নিরাপদ বাজারে (Safe market) বিনিয়োগের প্রবণতা দেখা যায়। যেমন, আবাসন খাত বা নির্দিষ্ট সেবাখাতে (Services) যেখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ অপেক্ষাকৃত বেশি, কিন্তু প্রতিযোগিতা অপেক্ষাকৃত কম। ফলস্বরূপ, কানাডা উচ্চ-প্রযুক্তির রপ্তানি (High-tech export) বৃদ্ধিতে পিছিয়ে গেছে। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকট (Financial crisis) পরবর্তী সময়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরও শক্ত হওয়ায় অবস্থার উন্নতি হয়নি, বরং অবনতিই হয়েছে।

মেধাপচার (Brain Drain) সমস্যা: অতিরিক্ত রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ (Excessive state intervention) আর নিয়ন্ত্রণের (Regulation) পাশাপাশি আরেকটি বড় অন্তরায় হলো মেধাপচার (Brain drain)। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান এতটাই কাছাকাছি যে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন পেশাজীবীরা (Highly skilled professionals) অনেক সহজেই সীমান্ত পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারেন। সেখানে বেতন (Salary) তুলনামূলক অনেক বেশি, কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সুযোগ (Promotion opportunities) বেশি, এমনকি অনেক অঙ্গরাজ্যে করের হার (Tax rate) কানাডার তুলনায় কম। ফলে কানাডায় প্রতিনিয়ত যে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ বা অন্যান্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পেশাজীবী তৈরি হচ্ছে, তাদের একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে, সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, কেবল ১০,৪১৫ জন আমেরিকান (American) কানাডায় এসেছেন স্থায়ীভাবে বসবাসে, অথচ ১,২৬,৫৪০ জনের বেশি কানাডিয়ানই যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হয়েছেন। ফলে কানাডিয়ান কোম্পানিগুলো সবচেয়ে মেধাবী ও দক্ষ জনশক্তি ধরে রাখতে পারছে না। এতে দেশের উদ্ভাবনী খাত দুর্বল হয়ে পড়েছে, আর সামগ্রিক অর্থনীতির সক্ষমতা (Overall economic capacity) স্থবির হয়ে আছে।

সবমিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, কানাডার অর্থনৈতিক সমস্যার মূল মানদণ্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে—

  1. নিম্ন বিনিয়োগ (Low investment)
  2. অতিরিক্ত সরকারি নিয়ন্ত্রণ (Excessive regulation)
  3. উন্নয়ন গবেষণায় কম বরাদ্দ (Low R&D spending)
  4. বাণিজ্যিক উদ্ভাবনের অভাব (Lack of commercial innovation)
  5. প্রতিযোগী বাজারের অনুপস্থিতি (Absence of competitive market in some key sectors)
  6. মেধাপচার (Brain drain) ও দক্ষ জনশক্তির অভাব (Shortage of skilled professionals)

অভিবাসনের কারণে সামষ্টিক (Aggregate) অর্থনীতি কিছুটা বাড়লেও, প্রতিটি নাগরিকের আয় বা জীবনমান এক জায়গায় আটকে আছে। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে ব্যর্থ হওয়ায় দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ঝুঁকির মুখে। গড়ে মাথাপিছু জিডিপি (GDP per capita) কমার অর্থ হলো, বেশিরভাগ মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা বা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য (Financial comfort) কমছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও করণীয়

এই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার জন্য কানাডার নীতি-নির্ধারকদের (Policymakers) বেশ কিছু বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে:

  1. নিয়ন্ত্রণ হ্রাস ও বাজার উন্মুক্তকরণ (Regulatory reform and market liberalization)
    • অপ্রয়োজনীয় লাইসেন্স ফি, আমলাতান্ত্রিক বাধা ইত্যাদি কমানো প্রয়োজন।
    • ডেয়ারি ও পোল্ট্রি কোটা সিস্টেমের মতো সাপ্লাই ম্যানেজমেন্টে (Supply Management) সংস্কার আনতে হবে, যাতে বাজারে অধিক প্রতিযোগিতা আসে।
    • প্রদেশগুলোর মধ্যে আন্তঃবাণিজ্য সহজীকরণ করে একটি অভ্যন্তরীণ মুক্তবাজার (Internal free market) তৈরি করতে হবে।
  2. কর কাঠামোর সংস্কার (Tax reforms)
    • করের হার (Tax rate) ও প্রক্রিয়া আরও সহজসাধ্য ও প্রতিযোগিতামূলক (Competitive) করতে হবে, যাতে দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যায়।
    • ব্যবসায়িক মুনাফা (Business profit) বা উৎপাদন খাতের (Manufacturing) আয় থেকে বেশি কর কেটে রাখলে বিনিয়োগ কমে যাবে, তাই এখানে ভারসাম্য রক্ষা জরুরি।
  3. গবেষণা ও উন্নয়নে গুরুত্ব বৃদ্ধি (Boosting R&D)
    • সরকার ও বেসরকারি খাত উভয়কেই গবেষণা ও উন্নয়নে (Research and Development) বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
    • উচ্চ-প্রযুক্তি (High-tech) শিল্প ও স্টার্টআপ (Startup) গুলোকে আর্থিক প্রণোদনা ও ভর্তুকি (Subsidy) দিলে উদ্ভাবন বাড়তে পারে।
  4. মেধাপচার রোধ ও দক্ষতা উন্নয়ন (Retaining talent and upskilling)
    • উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন পেশাজীবীদের দেশে ধরে রাখতে আর্থিক বা অন্যান্য সুযোগসুবিধা (Financial and professional incentives) বাড়াতে হবে।
    • কর কাঠামো ও চাকরির সুযোগ এমন হতে হবে, যাতে তারা সহজে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি না জমান।
    • অভিবাসী শ্রমশক্তিকেও (Immigrant workforce) সঠিক প্রশিক্ষণ ও কারিগরি শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে, যাতে তারা দ্রুত উৎপাদনশীল খাতে অবদান রাখতে পারে।
  5. বহুমুখী অর্থনীতির দিকে প্রত্যাবর্তন (Diversifying and reviving manufacturing & high-value sectors)
    • তেল ও গ্যাসের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতাকে কমিয়ে প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা (Healthcare), ও পরিবেশবান্ধব শিল্প (Green industry) ইত্যাদিতে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার।
    • নগর ও আঞ্চলিক প্ল্যানিং (Urban and regional planning) এমনভাবে সাজাতে হবে, যাতে শিল্পবিকাশ সম্ভব হয়।

কানাডার পুনরুত্থানের সম্ভাবনা (Possibility of Canada’s Comeback)

অনেকেই প্রশ্ন করেন—“কানাডা কি আবার ১৯৮০’র দশকের আগের মত উদীয়মান ও উচ্চ উৎপাদনশীলতার দেশে পরিণত হতে পারবে?” অর্থনীতিবিদদের মতে, যদি সঠিক নীতিমালা (Policies) গ্রহণ করা হয়, তবে তা সম্ভব। কেননা কানাডায় প্রাকৃতিক সম্পদের (Natural resources) প্রাচুর্য আছে, শিক্ষিত জনসংখ্যা (Educated population) আছে, অবকাঠামো (Infrastructure) মোটামুটি ভালো।

সমস্যা হলো, সরকার ও ব্যবসায়ী সমাজের মধ্যে সমন্বয়হীনতা (Lack of coordination) এবং অতি-কেন্দ্রিক (Over-centralized) নিয়ন্ত্রণ। এসব জটিলতা কাটিয়ে উঠতে পারলে অন্তত মাথাপিছু আয় ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পথ সুগম হবে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.