অবশেষে কি ডেনমার্ক থেকে গ্রিনল্যান্ড স্বাধীন হবে?

ভূমিকা

নতুন বছরের ভাষণে (New Year’s address), গ্রিনল্যান্ডের (Greenland) প্রধানমন্ত্রী ডেনমার্কের (Denmark) কাছ থেকে স্বাধীনতা (independence) এবং উপনিবেশিক যুগের (colonial era) “শিকল ছুঁড়ে ফেলার” কথা বলেছেন। এর মাধ্যমে বহুদিনের যে স্বাধীনতা-পিপাসা  গ্রিনল্যান্ড লালন করে আসছে, সেটি আবারও উজ্জীবিত হয়েছে। এই সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের (Donald Trump) আগ্রহ গ্রিনল্যান্ডকে আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রে এনেছে। এখনো প্রশ্ন থেকে যায়—গ্রিনল্যান্ডের স্বাধীনতার অনবরত দাবি আসলে কী, কীভাবে এ স্বাধীনতা পেতে পারে, এর চ্যালেঞ্জগুলো কী, আর আদৌ এটা বাস্তবে ঘটার সম্ভাবনা কেমন?

গ্রিনল্যান্ডের ইতিহাস ও বর্তমান স্বায়ত্তশাসন (autonomous status)

প্রথমে এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক, গ্রিনল্যান্ডের ইতিহাস ও কিভাবে এখনকার “ডেনমার্কের রাজত্বের (Kingdom of Denmark)” অন্তর্ভুক্ত একটি স্বায়ত্তশাসিত এলাকা (autonomous territory) হিসাবে তার অবস্থান তৈরি হল।

  • আদিম বসতি: গ্রিনল্যান্ডে মানুষের বসতি হাজার হাজার বছরের পুরনো। কয়েকটি ঢেউয়ে ইনুইট (Inuit) জনগোষ্ঠীর অভিবাসন (migrations) ২৫০০ BCE থেকে ১১শ শতাব্দী পর্যন্ত ঘটে। গ্রিনল্যান্ডের বর্তমান ইনুইট জনগোষ্ঠী (মোট জনসংখ্যার ৯০%-এর একটু কম) হলো ১৩শ শতকের দিকে আসা সর্বশেষ ইনুইট অভিবাসনের বংশধর।
  • নর্স (Norse) বসতি: আইসল্যান্ড (Iceland) ও নরওয়ে (Norway) থেকে আগত নর্স জনগোষ্ঠী ১০ম শতাব্দীর শেষভাগে বসতি গড়ে তোলে। এই সমাজ চার শতাব্দীরও বেশি টিকেছিল, কিন্তু ১৬শ শতকের শুরুতে অদৃশ্য হয়ে যায়—সম্ভবত ঠাণ্ডা জলবায়ু (cold climate) এর একটি প্রধান কারণ।

কীভাবে ডেনিশ অধীনে আসল?

  • ১৭২১ সালে, ডেনমার্ক-নরওয়ের (Denmark-Norway) অধীনে গ্রিনল্যান্ডে একটি বাণিজ্য কোম্পানি ও লুথেরান মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়, যা দ্বীপের ঔপনিবেশিক যুগ (colonial period) সূচিত করে।
  • ১৯৫৩ সালে, গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের সাথে একীভূত হয় (একটি কাউন্টি হিসাবে)।
  • পরের দশকগুলোতে গ্রিনল্যান্ড ধীরে ধীরে বেশি স্বায়ত্তশাসনের দিকে এগোয়। ১৯৭৯ সালে “হোম রুল (home rule)” পায়, যেখানে স্বায়ত্তশাসন কিছু বাড়ে, তবে পররাষ্ট্রনীতি (foreign relations), প্রতিরক্ষা (defence), সংবিধান (constitutional affairs), মুদ্রা (currency) ও আইনি ব্যবস্থা (legal system) ডেনমার্কের হাতে থেকে যায়।

কেন গ্রিনল্যান্ড স্বাধীনতা চায়?

১৯৭৯ সালের হোম রুলের পর থেকেই গ্রিনল্যান্ডে স্বাধীনতার পক্ষে দাবিগুলো একের পর এক বড় হয়েছে। প্রো-ইনডিপেনডেন্স (pro independence) রাজনৈতিক দলগুলো ধারাবাহিকভাবে নির্বাচনে জিতেছে। ২০০৮ সালের এক গণভোটে (referendum), ৭৫% ভোটার গ্রিনল্যান্ডের “সেল্ফ গভর্নমেন্ট অ্যাক্ট (Greenland Self Government Act)” সমর্থন করেন, যা দ্বীপটির পুলিশের (police), আদালতের (courts), কোস্টগার্ডের (coast guard), খনিজ সম্পদ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম (mineral resource activities) ও আরও অনেক কিছুতে বৃহত্তর নিয়ন্ত্রণ দেয়।

Self Government Act-এ বলা আছে, গ্রিনল্যান্ডের আত্মনিয়ন্ত্রণ (self determination) স্বীকার করে এবং স্বাধীনতার (independence) সিদ্ধান্ত গ্রিনল্যান্ডের জনগণের হাতে, অর্থাৎ গণভোটের মাধ্যমে স্থির হবে। গণভোটে যদি স্বাধীনতার পক্ষে রায় পড়ে, তাহলে ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ডের সরকারের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীনতা বাস্তবায়ন হবে।

গ্রিনল্যান্ডের মানুষ ভাষা, সংস্কৃতি এবং ভৌগোলিক দূরত্ব (geographic distance from Denmark) ইত্যাদির কারণে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় (distinct identity) ধারণ করে, আর এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া ঐতিহাসিকভাবে ডেনমার্কের অধীনে থেকে তারা নানা মাত্রার শোষণ ও বৈষম্যের (colonial maltreatment) শিকার হয়েছে বলে অনেকের ধারণা, তাই পূর্ণ স্বাধীনতাই চূড়ান্ত লক্ষ্য।

কেন এখনো স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি?

যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বাধীনতা (independence) চান, আসলে প্রধান অন্তরায়—গ্রিনল্যান্ড এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। স্বাধীনতাপন্থীরা সাধারণত একে “ভবিষ্যতের লক্ষ্য” হিসেবে দেখেন, যার জন্য অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিকল্পনা দরকার।

সেই কারণেই গত অর্ধশতকে গ্রিনল্যান্ডের স্বায়ত্তশাসন ধাপে ধাপে বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে পূর্ণ স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল অর্থনীতি (economy)।

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ

৫০,০০০-এর সামান্য বেশি জনসংখ্যার (population) এই বিশাল, বরফাচ্ছন্ন দ্বীপে (icy, rugged island) অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ছোট ও ভঙ্গুর। দ্বীপরাষ্ট্রের প্রধান আয় মাছ ধরা (fisheries) থেকে আসে। সেইসঙ্গে ডেনমার্কের থেকে প্রাপ্ত বার্ষিক অনুদান (block grant) প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলারের সমান—যা গ্রিনল্যান্ডের জিডিপির (GDP) প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এবং সরকারি বাজেটের (public budget) অর্ধেকের কাছাকাছি। স্বাধীনতা পেলে সেই অনুদান আর পাবে না।

যদিও এই অনুদান জিডিপির অনুপাতে ক্রমশ কমছে, এখনো গ্রিনল্যান্ডের জন্য এটি বিশাল সহায়তা। তবে তেলের সন্ধান, বিরল খনিজ (rare earth metals) রপ্তানি, পর্যটন (tourism) বৃদ্ধির সুযোগ ইত্যাদি ক্ষেত্র ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য আশাব্যঞ্জক হতে পারে। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বরফ গলে মেরুর (Arctic) নতুন জাহাজ চলাচলের পথ খুলছে, যা সম্ভাবনা বাড়াচ্ছে।

ভবিষ্যতে কী?

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্বাধীনতা নিয়ে কিছু অগ্রগতি দেখা গেছে:

  • ২০২১ সালে, স্বাধীনতাপন্থী (pro independence) দলগুলো সম্মিলিতভাবে ৮০% ভোট পায়।
  • ২০২২ সালে, গ্রিনল্যান্ডের সংসদ (parliament) একটি খসড়া সংবিধান (draft constitutional report) প্রকাশ করে, যা স্বাধীনতার দিকে আরেক ধাপ।
  • ২০২৪ সালের নববর্ষের ভাষণে, গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ঔপনিবেশিক যুগের “শিকল” সরানোর সময় এসেছে এবং ২০০৯ সালের সেল্ফ গভর্নমেন্ট অ্যাক্টকে উদ্ধৃত করে উল্লেখ করেছেন যে স্বাধীনতার আইনি ভিত্তি সেখানেই রয়েছে। তিনি বলেছেন, “আমাদের বড় পদক্ষেপ নিতে হবে, পরবর্তী নির্বাচনী মেয়াদে (new election period) নাগরিকদের সঙ্গে মিলেই নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”

এ বছর এপ্রিলের মধ্যে গ্রিনল্যান্ডে সাধারণ নির্বাচন (general election) হওয়ার কথা। কেউ কেউ ভাবছেন, হয়তো এ উপলক্ষে একটি স্বাধীনতা গণভোটও (referendum) হতে পারে। তবে ওই গণভোট জয়ী হলেও, তা শুধু ডেনমার্ক-গ্রিনল্যান্ড সরকারের মধ্যে আলোচনা শুরু করবে; পুরো স্বাধীনতা বাস্তবায়নে হয়তো ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ডের পার্লামেন্ট ও পুনরায় জনমতের (people’s) সম্মতি লাগবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকা

এখন elephant in the room হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে না বললেই নয়। আপনি হয়তো জানেন, ইতোমধ্যেই গ্রিনল্যান্ডে একটি মার্কিন বিমান ঘাঁটি (US Air base) আছে। ট্রাম্প দু’বার স্পষ্ট করে বলেছেন, তিনি চান গ্রিনল্যান্ড “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশ” হোক।

  • ২০১৯ সালে, তিনি দ্বীপটি কিনতে চেয়েছিলেন, তবে গ্রিনল্যান্ড ও ডেনমার্ক উভয়েই তা প্রত্যাখ্যান করে।
  • সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে আবারও এই ইচ্ছাকে জোরদার করেছেন, কিন্তু গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী আবার বলেছেন, “গ্রিনল্যান্ড আমাদের, এটি বিক্রির জন্য নয়, কখনোই হবে না।”

এই ঘটনাগুলো দেখায় যে, গ্রিনল্যান্ড স্বাধীন হলে একেবারে একা নিশ্চিন্তে থাকবে তা নয়; বরং এটি ভূকৌশলগত (geopolitical) দিক থেকে খুবই আকর্ষণীয় স্থান, যেখানে বহু দেশের স্বার্থ ও সম্পদের আগ্রহ থাকবে। স্বাধীন গ্রিনল্যান্ড ন্যাটো (NATO)-তে যোগ দেবে কি না, যুক্তরাষ্ট্র কি সামরিক ঘাঁটি রেখে দেবে, অন্য কোনো দেশ কি সেখানে উপস্থিতি বাড়াবে—এসব বড় প্রশ্ন। তাছাড়া কে সেখানে বিনিয়োগ করবে বা খনিজ সম্পদের সুবিধা পাবে—এগুলোও গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিবেচ্য বিষয়।

উপসংহার

গ্রিনল্যান্ড বহু বছর ধরে ধীরে ধীরে স্বায়ত্তশাসন (autonomy) বাড়াচ্ছে। আজ, স্বাধীনতা (independence) এক বড় স্বপ্ন, যেটি সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, ভূকৌশলগত কারণ—সবকিছুর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অর্থনৈতিক বাধাগুলো (Denmark-এর অনুদান থেকে সরে গিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া) ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর স্বার্থের সংঘাত এটির পথকে জটিল করে তুলেছে।

তবু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বার্তাগুলো (Greenlandic PM’s statements, draft constitutional report) ইঙ্গিত দিচ্ছে, আসন্ন নির্বাচনে বা ভবিষ্যতে স্বাধীনতার দাবিতে অগ্রসর হতে পারে। এ নিয়ে ডেনমার্কের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনাপ্রক্রিয়া লাগবে; আবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বিশ্বের বড় খেলোয়াড়েরা এখানে আগ্রহী থাকায় ভূরাজনৈতিক উত্তেজনাও এড়ানো যাবে না।

ফলে গ্রিনল্যান্ডের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হতে পারে, কিন্তু সেটা ঠিক কবে আর কিভাবে—তার ওপর নির্ভর করছে দ্বীপের অর্থনৈতিক প্রস্তুতি, ডেনমার্কের সহযোগিতা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির টানাপোড়েনের ওপর।

গ্রিনল্যান্ড সম্পর্কিত অন্যান্য সংবাদ ও বিশ্লেষণের জন্য এখানে যান – উত্তর আমেরিকা (কানাডা, মেক্সিকো, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল) সংবাদ

তথ্যসূত্র

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.