কেন ইলন মাস্ক ব্রিটেন নিয়ে এত অবসেসড?

ভূমিকা

গত ছয় মাস ধরে টেসলার (Tesla) সিইও (CEO) ও ট্রাম্প (Donald Trump)-সমর্থক ইলন মাস্ক (Elon Musk)-এর আচমকা যুক্তরাজ্য (Britain) নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে। প্রথমে তিনি নতুন লেবার (Labour) সরকারকে সমালোচনা করেন, সাউদপোর্ট দাঙ্গার (Southport riots) পর কিয়ার স্টারমারকে (Keir Starmer) “টু টিয়ার কিয়ার (Two Tier Keir)” বলে ব্যঙ্গ করেন, এরপর নাইজেল ফারাজ (Nigel Farage) নেতৃত্বাধীন ডানপন্থী দল ‘রিফর্ম ইউকে (Reform UK)’-কে সমর্থন দিতে শুরু করেন।

কিছু সপ্তাহ আগে গুঞ্জন উঠেছিল, মাস্ক নাকি রিফর্মকে ১০০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়ার কথা ভাবছেন। কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে, মাস্ক ও ফারাজ ইতোমধ্যেই বিবাদে জড়িয়েছেন—মাস্ক গত সপ্তাহান্তে টুইট (tweet) করে বলেছেন, “রিফর্ম পার্টির (Reform Party) নতুন নেতা দরকার; ফারাজের পক্ষে এটি সামলানো সম্ভব নয়।”

এই নিবন্ধে আমরা পর্যায়ক্রমে দেখব:
১) মাস্ক গত কয়েক মাসে ব্রিটিশ রাজনীতি নিয়ে ঠিক কী কী বলেছেন,
২) ফারাজের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্বের (falling out) সম্ভাব্য কারণ,
৩) এবং রিফর্মের সামগ্রিক ভবিষ্যৎ বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে এসব কী ইঙ্গিত দেয়।

মাস্কের সাম্প্রতিক ব্রিটিশ রাজনীতিতে জড়ানোর পটভূমি

প্রথম পরিচয়: ২০২৩ সালে ঋষি সুনাকের (Rishi Sunak) সঙ্গে সাক্ষাৎ

মাস্কের ব্রিটিশ রাজনৈতিক মহলের সঙ্গে প্রথম দৃশ্যমান সংযোগ ঘটে ২০২৩ সালে, যখন সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক তাকে ডাউনিং স্ট্রিটে (Downing street) আমন্ত্রণ জানান—ইংল্যান্ডের ব্লেচলি পার্কে (Bletchley Park) অনুষ্ঠিত “এআই সেফটি সামিট (AI safety summit)” শেষে এআই (AI) বিষয়ে আলোচনা করতে। তখন অনেকেই সন্দিহান ছিলেন কেন প্রধানমন্ত্রী একজন উদ্যোক্তাকে সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, উল্টোটা না হয়ে। তবে মাস্ক সেসময় সুনাককে প্রশংসা করে বলেছেন, “তিনি যুক্তরাজ্যের জন্য একটি সম্পদ।”

২০২৪-এর মাঝামাঝি: লেবার সরকারকে (Labour government) আক্রমণ

২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে, মাস্কের মনোভাব নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। সাউথপোর্টের ছুরিকাঘাত (Southport stabbing) ও পরবর্তী দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে, মাস্ক এক ভিডিও টুইট করে লেখেন, “Civil war is inevitable” (গৃহযুদ্ধ অনিবার্য)। ওই সময় নতুন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার (Keir Starmer) মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর হামলাকে (attacks on Muslim communities) সমালোচনা করেন। মাস্ক পাল্টায় সাড়া দিয়ে বলেন, “Shouldn’t you be concerned about all communities?”—এরপর তাকে ডাকেন “টু টিয়ার কিয়ার (Two Tier Keir)”— এখানে এই ইঙ্গিত করা হয় যে, ডানপন্থী বিক্ষোভকারীরা (right-wing protesters) পুলিশের কাছে বামপন্থীদের তুলনায় কম সুবিচার পায়।

একই সময়ে, মাস্ক ভুয়ো তথ্যও (misinformation) ছড়ান যে, কট্টরপন্থী (far right) দাঙ্গাকারীদের জরুরি আটক ক্যাম্পে (emergency detainment camps) রাখা হয়েছে। পরে তিনি যুক্তরাজ্যের “হেট স্পিচ আইন (hate speech laws)” নিয়েও আক্রমণ করেন, বলেন, “I don’t think anyone should go to the UK…”— এতেই তার অসন্তোষ পরিস্কার হয়ে ওঠে।

এরপর মাস্ক স্টারমারের উত্তরাধিকার কর (inheritance tax) বৃদ্ধি পরিকল্পনা নিয়ে বলেন, “Britain is going full Stalin.” আর সাম্প্রতিকতম হলো, রদারহ্যাম (Rotherham) শিশু যৌন-নিপীড়ন কেলেঙ্কারি (child sexual abuse scandal) নিয়ে জাতীয় তদন্ত না করায় মাস্ক স্টারমার সরকারকে আক্রমণ করেন। তিনি সুরক্ষা মন্ত্রী বা মিনিস্টার ফর সেফগার্ডিং জেস ফিলিপসকে (Jess Phillips) জেলে পাঠানোর দাবিও তুলেছেন, এমনকি অভিযোগ আনেন যে কিয়ার স্টারমার ডিরেক্টর অব পাবলিক প্রসিকিউশন (Director of Public Prosecutions, dpp) থাকাকালে “ধর্ষক গ্যাং” (rape gangs) দমন করেননি—যদিও বাস্তবে স্টারমারই সিপিএসে (CPS: Crown Prosecution Service) শিশু নিপীড়ন মামলার রূপরেখা বদলান ও ২০১৩ সালে রোচডেল (Rochdale) কেলেঙ্কারির আসামিদের বিচারের উদ্যোগ নেন।

রিফর্ম পার্টির (Reform Party) সঙ্গে মাস্কের সম্পর্ক ও মতবিরোধ

উপরের ঘটনাগুলোর মধ্যে মাস্ক ক্রমে রিফর্ম ইউকে (Reform UK)-কে সমর্থন দিতে থাকেন। তিনি বলেন, “Only reform can save Britain,” ফারাজের (Farage) টুইট শেয়ার করেন, এমনকি ট্রাম্পের মার-আ-লাগো (Mar-a-Lago) রিসোর্টে ফারাজ ও ব্রিটিশ ধনকুবের নিক ক্যান্ডির (Nick Candy) সঙ্গে দেখা করেন (যিনি আগে টরি সমর্থক ছিলেন, এখন রিফর্মের পক্ষে)। শোনা যাচ্ছিল, তিনি রিফর্মকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন, যা ফারাজ বিবিসিতে (BBC) এক সাক্ষাৎকারে আভাস দিয়েছিলেন।

কিন্তু সবকিছু অতি দ্রুত বদলে গেছে—মাস্ক হঠাৎই (গত রোববার) টুইট করে বলেন, রিফর্মের নেতা পদ থেকে ফারাজকে সরে দাঁড়াতে হবে। “He [Farage] doesn’t have what it takes.”

মূল বিবাদ: টমি রবিনসন (Tommy Robinson)-কে নিয়ে দ্বন্দ্ব

এই দ্বন্দ্বের তাৎক্ষণিক কারণ হলো, টমি রবিনসনকে ঘিরে মতানৈক্য। টমি রবিনসন (আসল নাম স্টিফেন ক্রিস্টোফার ইয়াক্সলি-লেনন [Stephen Christopher Yaxley Lennon]) একজন ব্রিটিশ কট্টরপন্থী ডান (far right) কর্মী, বর্তমানে অবমাননার দায়ে (contempt of court) ১৮ মাসের কারাদণ্ডে আছেন। তিনি আগে ব্রিটিশ ন্যাশনাল পার্টির (British National Party) সদস্য ছিলেন, যে দল “অশ্বেতাঙ্গদের বাধ্যতামূলক বহিষ্কার (compulsory removal of non-whites)” চেয়েছিল, এবং পরে ইংলিশ ডিফেন্স লিগ (English Defence League) গড়েন—যা বিদ্বেষী (anti-Islamist) কর্মকাণ্ডের কারণে আলোচিত।

ফারাজ বরাবরই নিজেকে রবিনসনের থেকে দূরে রেখেছেন, তাকে “খুব বেশি চরমপন্থী” (too radical) বলে অভিহিত করে। ২০১৮ সালে ইউকিপ (UKIP) যখন নতুন নেতা জেরার্ড ব্যাটেনের (Gerard Batten) অধীনে রবিনসনকে দলে নেয়, ফারাজ তাকে “thug” বলে বাতিল করেছিলেন। সাউথপোর্ট দাঙ্গায় (Southport riots) রবিনসন পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল, সেসময়ও ফারাজ বলেছিলেন, “আমি ওর সঙ্গে নেই।”

কিন্তু সম্প্রতি মাস্ক ঠিক উল্টো অবস্থান নেন—তিনি রবিনসনকে সমর্থন করছেন, “Free Tommy Robinson” লিখে টুইট করেছেন, এমনকি রবিনসনের তৈরি কিছু ডকুমেন্টারি দেখতে বলছেন। ফারাজ এতে দ্বিমত পোষণ করেন, বলছেন তিনি বোঝেন মাস্ক কেন রবিনসনকে সমর্থন করছেন, তবে রিফর্ম একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে (political party) পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে জয় পেতে চায়, ফলে রবিনসনকে তাদের প্রয়োজন নেই। তিনি মাস্কের স্টারমার ও জেস ফিলিপসকে আক্রমণ করার বিষয়েও সমর্থন দেননি। তারপরই মাস্ক ফারাজের নেতৃত্বে আস্থা হারান।

ফারাজের অবস্থান ও রিফর্মের (Reform) ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

ফারাজ বরাবরই রবিনসনকে অপছন্দ করেছেন; কিন্তু ইদানীং, যখন রিফর্মের জনসমর্থন (polls) বাড়ছে এবং দলটি যথেষ্ট এমপি পেতে পারে—এমন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, ফারাজ তার দলের ভাবমূর্তি “মধ্যপন্থী” (moderate) দিকে ঠেলে দিতে সচেষ্ট।

  • অর্থনৈতিক ইস্যুতে ‘বামঘেঁষা’ রূপান্তর: ফারাজ আগে ‘কম কর, কম ব্যয়’ (low-tax, low-spend) ধরনের ডানপন্থী ছিলেন। কিন্তু এখন সম্ভবত বৃহত্তর ভোটার আকর্ষণে রিফর্ম কিছু বামঘেঁষা অর্থনৈতিক অবস্থান নিচ্ছে—যেমন সম্প্রতি ‘টেমস ওয়াটার (Thames Water)’ রাষ্ট্রায়ত্ত করা উচিত বলে মত দিয়েছে।
  • কনজারভেটিভদের (Conservatives) সমালোচনা: ২০১৯ সালে ফারাজের ব্রেক্সিট পার্টি (Brexit Party) আড়ালে-আবডালে বরিস জনসনকে (Boris Johnson) সুবিধা দেয়, কিন্তু এইবার রিফর্ম সরাসরি কনজারভেটিভদের আক্রমণ করছে। এর মানে তারা সত্যিই নিজেদেরকে একটি প্রধান রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়—কেবল চাপসৃষ্টি বা এক-ইস্যু-ভিত্তিক দল নয়।
  • টমি রবিনসনের অজনপ্রিয়তা: যুক্তরাজ্যে রবিনসনের জনপ্রিয়তা অত্যন্ত কম (-৬০ নেট অ্যাপ্রুভাল রেটিং, ২০১৯ সালের এক জরিপ অনুযায়ী)। ফলে তার সঙ্গে জোট বাঁধলে মূলধারার ভোটার হাতছাড়া হবে। ফারাজও তাই এটা চান না—এমনকি যদি মাস্ক বা পরোক্ষভাবে ট্রাম্প (Trump)-এর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয় তবুও।

উপসংহার

ইলন মাস্কের হঠাৎ করে ব্রিটেনে মনোযোগ দেওয়া, প্রথমে লেবার সরকারকে আক্রমণ, পরে রিফর্ম পার্টিকে সমর্থন—সবই খুব দ্রুত সামনে আসছে। টমি রবিনসনকে নিয়ে মাস্কের উচ্ছ্বাস ও ফারাজের দূরত্ব—এই দ্বন্দ্ব দেখাচ্ছে, রিফর্ম পার্টি একদিকে কট্টর ডানপন্থার (far right) সঙ্গ ত্যাগ করে মূলধারায় পা রাখতে চাচ্ছে, অন্যদিকে মাস্কের মতো ব্যক্তির জন্য এটি রাজনৈতিকভাবে খুব একটা আশাবাদী পথ নয়।

মাস্ক চাইলেও ফারাজকে “নতুন নেতা চাই” বলে সরিয়ে দিতে হয়তো পারবেন না—ফারাজের নিজস্ব নীতি ও ভোটারদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতার রূপরেখা আগের চেয়ে পরিণত। শেষ পর্যন্ত, রিফর্ম কতটা জনপ্রিয় হবে বা পার্লামেন্টে স্থান করে নেবে, তা অদূর ভবিষ্যতই বলে দেবে। কিন্তু মাস্কের এই আকস্মিক “ব্রিটিশ পলিটিক্সে হস্তক্ষেপ”-এর ঘটনা স্পষ্ট করে যে, যুক্তরাষ্ট্রের ধনকুবের ও ট্রাম্পপন্থীরা (Trump ally) ব্রিটেনে ঠিক কী ধরনের রাজনীতি দেখতে চান, আর সেটা বাস্তবে ঘটবে কি না, সে প্রশ্নই থেকে যায়।

যুক্তরাজ্য নিয়ে আরও সংবাদ ও বিশ্লেষণ জানতে চাইলে যান এখানে – যুক্তরাজ্য সংবাদ

তথ্যসূত্র

Wes Streeting Criticises Musk
https://www.bbc.co.uk/news/articles/czxdzng92lno

The New Statesman on why Musk is Tweeting About Grooming Gangs
https://www.newstatesman.com/politics/uk-politics/2025/01/why-elon-musk-tweeting-about-britains-grooming-gangs

BBC News on Musk’s Fixation on Britain
https://www.bbc.co.uk/news/articles/cy7kpvndyyxo

Elon Musk Demands Release of Tommy Robinson
https://www.politico.eu/article/elon-musk-demands-release-uk-far-right-ringleader-tommy-robinson/

Elon Musk Reposts Tommy Robinson
https://x.com/elonmusk/status/1874625291538350372

Tommy Robinson Jailed on Contempt of Court
https://www.bbc.co.uk/news/articles/c704eedkqkvo

The Telegraph on Why Musk Hates Starmer’s Britain
https://www.telegraph.co.uk/news/2024/11/21/why-elon-musk-hates-keir-starmer-britain/

Trailblazer on Why Musk Went from Admirer to Critic of Britain
https://www.thetrailblazer.co.uk/news/elon-musk-from-admirer-to-critic-of-britainwhat-changed

BBC News on How Social Media Fuelled Rioting
https://www.bbc.co.uk/news/articles/c5y38gjp4ygo

YouGov Poll on Whether Speaking Freely or Being Safe From Abuse or Threats is More Important on Social Media
https://yougov.co.uk/topics/society/survey-results/daily/2017/08/02/02088/2

How the Online Safety Act Could Affect Musk
https://inews.co.uk/news/politics/musk-uk-laws-x-collision-3428609

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.