Table of Contents
ভূমিকা
২৮ আগস্ট ১৮৩৩ তারিখে, ব্রিটেনে “Slavery Abolition Act” রাজকীয় সম্মতি (royal assent) লাভ করে। এই আইন একটি সেই সময়কার বহুল-লাভজনক বাণিজ্য ও অর্থনীতির শিকড়সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠান—দাসপ্রথাকে (slavery)—সমাপ্তির পথে নিয়ে যায়।
আজকের প্রেক্ষাপটে দাসপ্রথার মতো নিষ্ঠুর ও হেয়কারী ব্যবস্থা বন্ধ হওয়া স্বাভাবিক মনে হলেও, ঐতিহাসিক পটভূমিতে দেখতে গেলে বোঝা যায়, চিনি (sugar) ও দাস (slaves) নিয়ে গড়ে ওঠা বাণিজ্য সেসময়ে উভয় আটলান্টিক পারেই একটি ক্ষুদ্র কিন্তু অত্যন্ত প্রভাবশালী সম্প্রদায়ের জন্য বিশাল সম্পদ ও প্রভাব তৈরি করেছিল। আবার সেই যুগে, দাসশ্রমের শোষণ গোটা জাতির সমৃদ্ধিতেও বড় ভূমিকা রাখত।
শুধু ভূস্বামী বা চিনি-উৎপাদক (planters) নয়, বরং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বাণিজ্যের (colonial commerce) “ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান” শাখা থেকে বেনিফিট পেতেন বহুবিধ পক্ষ—ব্যবসায়ী (merchants), চিনি পরিশোধক (sugar refiners), নির্মাতা (manufacturers), বীমা এজেন্ট বা দালাল (insurance brokers), আইনজীবী (attorneys), জাহাজ নির্মাতা (shipbuilders), এমনকি অর্থ-ঋণদাতা (money lenders) পর্যন্ত। এভাবেই ব্রিটিশ সমাজের নানা স্তরে দাসপ্রথা বাণিজ্যিকভাবে শিকড় গেড়েছিল।
তাই দাসমুক্তির (abolition) দিকে পথচলায়, এই ব্যাপক ও তীব্র বিরোধী অবস্থান মাথায় রেখেও, এক বড় প্রশ্ন উঠে আসে: “১৮৩৩ সালে ব্রিটেন কেন দাসপ্রথা বিলুপ্ত করল?”
পটভূমি
১৮০৭ সালে আটলান্টিক পারের দাসপাচার (slave trade) বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে ‘Abolition Society’-এর (যেমন, থমাস ক্লার্কসন [Thomas Clarkson], উইলিয়াম উইলবারফোর্স [William Wilberforce]) সদস্যরা এক অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেন। তবু এটাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল না।
দাসপাচার বন্ধে তারা এক চরম নিষ্ঠুর বাণিজ্যের অবসান ঘটালেও, দাসদের অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। উইলবারফোর্স ১৮২৩ সালে “Appeal” নামক লেখায় বলেছিলেন, “প্রথম দিকের সব বিলোপবাদীই (early abolitionists) সবসময় বলে এসেছেন, দাসপ্রথার সম্পূর্ণ বিলুপ্তিই (extinction of slavery) হলো তাদের মূল ও চূড়ান্ত প্রকল্প।”
ওই একই বছরে (১৮২৩) “Anti-Slavery Society” গঠিত হয়। ১৭৮৭ সালের মতোই, বিপুল জনসমর্থন পেতে বিশেষ প্রচারণার (campaigning) ওপরে জোর দেওয়া হয়—কেবলমাত্র গোপন লবিং (backdoor lobbying) নয়, বরং জনগণের মত ও সমর্থন আদায় করে পার্লামেন্টকে (parliament) প্রভাবিত করা ছিল তাদের মূল কৌশল।
১) “Amelioration” নীতির ব্যর্থতা (Failure of amelioration)
দাসমুক্তির দাবিতে (emancipation) জোরালো যুক্তি উপস্থাপনের একটি প্রধান কারণ ছিল ব্রিটিশ সরকারের “amelioration” নীতির ব্যর্থতা। ১৮২৩ সালে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড ক্যানিং (Lord Canning) কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করেন, যেগুলো মহামান্য রাজ্যের উপনিবেশগুলোতে (His Majesty’s colonies) দাসদের পরিস্থিতি উন্নত করার কথা বলছিল। এর মধ্যে ছিল—দাসসমাজে খ্রিস্টধর্মের প্রচার, দাসদের জন্য আরও বেশি আইনি সুরক্ষা ইত্যাদি।
তবে বাস্তবে, অনেক বিলোপবাদী (abolitionists) দেখিয়েছেন, উপনিবেশগুলোতে এই নীতিগুলো অগ্রাহ্য করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ওয়েস্ট ইন্ডিজে (West Indies) দাসসংখ্যা ক্রমে কমে যাওয়া, বিয়ের হার (marriage rates) পড়ে যাওয়া, ‘Obeah’ নামক স্থানীয় সাংস্কৃতিক চর্চা আগের মতোই চলা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা – দাসবিদ্রোহ (slave uprisings) অব্যাহত থাকা—এসবই প্রমাণ করছিল পরিকল্পিত পরিবর্তনগুলো ঠিকমতো বাস্তবায়িত হয়নি।
২) দেরিতে সংঘটিত দাসবিদ্রোহগুলো (Late slave rebellions)
১৮০৭ থেকে ১৮৩৩ সালের মধ্যে, ব্রিটেনের সবচেয়ে মূল্যবান ক্যারিবীয় (Caribbean) উপনিবেশগুলোর তিনটিতেই বড় দাসবিদ্রোহ হয়। বার্বেডোজ (Barbados) ছিল প্রথম, ১৮১৬ সালে সেখানে বিদ্রোহ ঘটে; এরপর ব্রিটিশ গায়ানার (British Guyana) ডেমেরারায় (Demerara) পুরো মাত্রার বিদ্রোহ শুরু হয় ১৮২৩ সালে। তবে সবচেয়ে বড় দাসবিদ্রোহ হয় জামাইকার (Jamaica) ১৮৩১-৩২ সালে—৬০,০০০ জন দাস প্রায় ৩০০টি এস্টেটে (estates) লুট ও অগ্নিসংযোগ চালায়।
বিদ্রোহীরা বিশাল সম্পত্তি ধ্বংস করলেও এবং গোষ্ঠীগতভাবে উপনিবেশিকদের সংখ্যায় ছাড়িয়ে গেলেও, তিন ক্ষেত্রেই বিদ্রোহ নির্মমভাবে দমন করা হয়। বিদ্রোহী বা সন্দেহভাজন দাসদের (rebel slaves) নির্যাতন (torture) ও শাস্তি (execution) দেওয়া হয়। প্রত্যেক ডোমিনিয়নে (dominions) ধর্মপ্রচারকদের (missionary communities) ওপর প্রতিশোধ নেওয়া হয়, কারণ ধারণা করা হয় যে তারাই হয়তো বিদ্রোহের সূচনা করেছে—এমন সন্দেহ স্থানীয় ভূস্বামীদের (planters) মধ্যেই ছিল।
এই বিদ্রোহগুলো, ও সেগুলো দমনে ব্রিটিশ উপনিবেশিক কর্তৃপক্ষের বর্বর দমন-প্রক্রিয়া, বিলোপবাদীদের দাবিগুলোকেই জোরালো করেছিল, যেখানে তারা দাবি করছিল যে ক্যারিবীয় উপনিবেশগুলো (Caribbean dominions) ক্রমেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে এবং দাসপ্রথা বজায় রাখা নতুন নতুন সহিংসতা ও অশান্তি ডেকে আনবে। একই সঙ্গে, ওই অঞ্চলের দাসপ্রথা নিয়ে দৃশ্যমান রূঢ় চিত্রটি “ওয়েস্ট ইন্ডিয়া লবির (West India Lobby)” বিরুদ্ধে ব্রিটেনে নেতিবাচক মনোভাব বাড়িয়ে তোলে।
৩) ঔপনিবেশিক ভূস্বামীদের (colonial planters) মর্যাদা হ্রাস (Declining image of colonial planters)
ওয়েস্ট ইন্ডিজের শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিকদের (white colonists) ওপর আগে থেকেই ব্রিটেনে সন্দেহ ও বিরূপ মনোভাব ছিল। তাদের অতিরিক্ত চাকচিক্যময় (ostentatious) জীবনযাপন ও ভোগবিলাস (gluttonous habits) নিয়ে বহু অভিযোগ ছিল।
বিদ্রোহ-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া (backlash) আরও চরম হয়ে উঠলে সেসব অভিযোগ জোরালো হয়। ফলে ব্রিটেনে সাধারণ মানুষের কাছে ঔপনিবেশিক ভূস্বামীদের “অভিজাতবোধ” ও স্বাদবোধ (taste) নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পোক্ত হয়।
এছাড়া ওয়েস্ট ইন্ডিয়া লবি (West India Lobby)-র অভ্যন্তরেও ভাঙন দেখা দেয়: স্থানীয় বা “ক্রেওল (creole)” ভূস্বামীরা—যারা আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দাসপ্রথার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত—তারা লন্ডনের “অনুপস্থিত ভূস্বামী” (absentee proprietor) সম্প্রদায়ের ওপর বিরক্ত হয়। কারণ, পরের দলটি যদি পারিশ্রমিক বা ক্ষতিপূরণ (compensation) ঠিকমতো দেয়, তাহলে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হতে পারে, আর তারা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু স্থানীয়রা, যারা জীবনযাপনের সব দিকেই দাসপ্রথার ওপর নির্ভরশীল ছিল তাদের জন্য সেটি মেনে নেওয়া কঠিন ছিল।
৪) অতিরিক্ত উৎপাদন ও অর্থনৈতিক অবনতি (Overproduction and economic deterioration)
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের দাসমুক্তি (emancipation) আলোচনায় এক বড় যুক্তি ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান উপনিবেশগুলোর অর্থনৈতিক দুরবস্থার (economic deterioration) বিষয়টি। ১৮০৭ সালে, ক্যারিবীয় ডোমিনিয়নগুলো ব্রিটেনের জন্য বাণিজ্যে সবচেয়ে লাভজনক ছিল, কিন্তু ১৮৩৩ সালের মধ্যে সেটি আর সত্য ছিল না।
এর কারণ ছিল প্লান্টাররা চিনি (sugar) অতিরিক্ত উৎপাদন করছিল (overproduction)। পরিসংখ্যান মতে, উপনিবেশ সচিব (Colonial Secretary) এডওয়ার্ড স্ট্যানলি (Edward Stanley) উল্লেখ করেছেন—১৮০৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে রপ্তানিকৃত চিনি ছিল ৭২,৬৪৪ টন, যা ১৮৩১ সালে ১,৮৯,৩৫০ টনে পৌঁছে। এটি দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে ছাড়িয়ে যায়, ফলে চিনির দাম পড়ে যায়। দাম পড়ে গেলে প্লান্টাররা বেশি উৎপাদন করে বড় পণ্যসংখ্যাকে কাজে লাগিয়ে খরচ কমাতে চায়—ফলে এক চক্রবৃদ্ধি সমস্যা তৈরী হয়।
তাছাড়া চিনিতে অনেক প্রতিযোগিতাও ছিল। কিউবা (Cuba), ব্রাজিল (Brazil) ইত্যাদি অন্য উপনিবেশ থেকেও চিনি আসত—সেই বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে (West Indian colonies) সুরক্ষা দিতে ব্রিটেন স্বল্প শুল্ক বা শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার (monopoly) দিয়েছিল। কিন্তু এতে করে ব্রিটিশ তহবিল থেকে নানা সুবিধা নিতে নিতে এরা ধীরে ধীরে “মূল্যবান সম্পদ” (valued asset) না হয়ে “বোঝা” (burden) হয়ে উঠছিল।
৫) মুক্ত শ্রমের মতবাদ (Free labour ideology)
অর্থনীতিকে (Economics) প্রথমদিকে “সামাজিক বিজ্ঞান (social science)” হিসেবে ব্যবহার করে বিলোপবাদীরা যুক্তি দেখাতে চেয়েছিলেন, অ্যাডাম স্মিথের (Adam Smith) ‘Free Market’ মতাদর্শের দ্বারা তারা বোঝাতে চেয়েছিলেন যে দাসশ্রম (slave labour) থেকে “মুক্ত শ্রম (free labour)” আরো লাভজনক, কার্যকর ও উৎপাদনমুখী। উদাহরণ হিসেবে তারা দেখিয়েছেন—প্রাচ্য উপনিবেশগুলোতে (East Indies) “মুক্ত শ্রম” ব্যবস্থায়ও (free labour system) সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে।
৬) নতুন হুইগ সরকার (A new Whig government (Whig government))
রাজনৈতিক পরিবেশের (political environment) প্রভাব এখানে অসীম গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৩২ সালের “Great Reform Act” এবং লর্ড গ্রে (Lord Grey) নেতৃত্বাধীন হুইগ সরকার (Whig Government) গঠনের পরের বছরই দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়—এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়।
- রিফর্ম অ্যাক্ট (Reform Act): এটি হাউস অব কমন্সে হুইগদের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনে দেয়, আর সেই সাথে “rotten boroughs” বিলুপ্ত করে, যেখানে আগে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ধনী ব্যক্তিরা আসনে বসতেন।
- ১৮৩২ সালের নির্বাচন: নতুন পার্লামেন্টে দাসপ্রথা-বিরোধী (anti-slavery) প্রার্থীর সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। পার্লামেন্টে প্রায় ২০০ জন সাংসদ ছিলেন যাদের অবস্থান সরাসরি দাসপ্রথা বিলোপ করার পক্ষে ছিল।
৭) ক্ষতিপূরণ (Compensation)
অনেক ইতিহাসবিদের মতে, দাস-মালিকদের (slaveholders) জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি না থাকলে দাসপ্রথা বিলুপ্তির বিল সম্ভবত পাস হতো না। প্রথমে ১৫,০০০,০০০ পাউন্ডের ঋণ (loan) প্রস্তাব করা হয়েছিল, পরে সরকার ২০,০০০,০০০ পাউন্ডের অনুদানের (grant) প্রতিশ্রুতি দেয়, যাতে প্রায় ৪৭,০০০ মালিক ক্ষতিপূরণ পান। এদের কেউ কেউ অল্প দাসের মালিক ছিলেন, কেউ কেউ সহস্রাধিক দাসের মালিক ছিলেন।
এই ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার অনেক অনুপস্থিত ভূস্বামীর (absentee proprietors) সমর্থন আদায় করে, যারা আর্থিক ফেরত পেয়ে অন্য ব্যবসায় বা খাতে বিনিয়োগ (re-invest) করতে পারবে—এমন নিশ্চয়তা পেয়েছিল।
উপসংহার
১৮৩৩ সালে ব্রিটেনে “Slavery Abolition Act” পাস হওয়ার পেছনে নানা ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণ মিলেমিশে কাজ করেছে। একদিকে ছিল দাসবিদ্রোহ ও তার নৃশংস দমন, যা দাসপ্রথার অস্থিতিশীলতা ও নিষ্ঠুরতাকে সামনে এনেছিল; অন্যদিকে অর্থনৈতিক কর্মকাঠামোর পরিবর্তন, মালিকদের মধ্যে ভাঙন, হুইগ সরকারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আর ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি—সব একত্রে এনে শেষপর্যন্ত বিলুপ্তির রাস্তা প্রশস্ত করেছে।
বিলোপবাদীদের (abolitionists) দীর্ঘদিনের লড়াই ও সাধারণ জনমতের সমর্থন ছাড়া এটি সহজে সম্ভব হতো না। এভাবেই ব্রিটিশ ইতিহাসে দাসপ্রথার অবসান এক যুগান্তকারী অধ্যায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা শুধু নৈতিকতা ও মানবিকতার ক্ষেত্রে নয়, বরং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতিকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।
Leave a Reply