Table of Contents
ভূমিকা
আমরা কর (tax) দিই কেন? সাধারণ যুক্তি হলো, সরকারের কিছু কার্যক্রম পরিচালনা জরুরি, যা ব্যক্তি বা সমাজের সমগ্র কল্যাণে লাগে—যেমন রাস্তাঘাট নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষককে বেতন প্রদান, হাসপাতাল ও চিকিৎসাসেবা ইত্যাদি। কিন্তু অনেকের কাছে বিস্ময়কর হতে পারে, সরকারের মালিকানাধীন একটি “বহুতল লন্ডন-আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াইন সেলার” (massive multi-million pound underground wine cellar) কেন দরকার!
এই অংশে আমরা দেখতে চেষ্টা করব:
- কেন সরকারের একটি ওয়াইন সেলার (wine cellar) রয়েছে,
- তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস,
- এবং এটি কীভাবে/কতটা মূল্যবান বা অপ্রয়োজনীয়—অর্থাৎ, করদাতার (taxpayer) জন্য আদৌ কোনো সুবিধা আনে কিনা।
সরকারের ওয়াইন সেলার: সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
সরকারের ওয়াইন সেলারের যাত্রা শুরু ১৯০৮ সালে। তখন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (international conferences) ব্রিটিশ প্রতিনিধিদের আনাগোনা বেড়ে যাচ্ছিল। অতিথি-অভ্যাগতদের আপ্যায়নের জন্য ভালো মদ/ওয়াইন দরকার হতে লাগল। ফলে এ ধরনের অতিথি আপ্যায়নের এক কেন্দ্র হিসেবে এই সেলার তৈরি হয়।
১৯২২ সালে সেলারটির অবস্থান স্থানান্তর ও সম্প্রসারণ করা হয়, এবং সে সময় থেকে এটি ল্যাঙ্কাস্টার হাউসের (Lancaster House) বেজমেন্টে (basement) অবস্থিত—যার অবস্থান বাকিংহাম প্যালেসের কাছেই। স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো সরকারী সংস্থার জন্য এটি সুবিধাজনক; কাছাকাছি স্থান থেকে অভ্যাগতদের আপ্যায়নের ওয়াইন সহজে সরবরাহ করা যায়।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (World War II) শুরুর পর, ১৯৩৯ সালে, রাজধানীর কেন্দ্রে দামি ওয়াইনে ঠাসা একটি কক্ষ রাখা আর নিরাপদ মনে হয়নি। তাই সরকার সেই ওয়াইন স্টক ওয়ারউইকশায়ারে (Warwickshire) সরিয়ে নেয়। মজার ব্যাপার, আশপাশের বিল্ডিংয়ের লোকজনকে নয়, বরং প্রথমেই নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিল এই ওয়াইনগুলোকে! আরও মজার হলো, জার্মান এম্বাসিতে (German Embassy) থাকা ওয়াইনও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ নিয়ে এসেছিল এবং নিজেদের সংগ্রহে যুক্ত করেছিল। যুদ্ধ শেষে আবার সেলার ফিরিয়ে আনা হয় ল্যাঙ্কাস্টার হাউসে।
এই ওয়াইন সেলার কি আদৌ দরকারি?
সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন আসতে পারে—“এত ঝামেলা না করে সরকার চাইলেই কি গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টের সময় কাছাকাছি কোনো দোকান বা সুপারমার্কেট, যেমন টেসকো (Tesco), থেকে সস্তায় ওয়াইন কিনে আনতে পারে না?”
- প্রথমত, এটা হয়তো খুব ‘সাধারণ আইডিয়া’, কিন্তু কার্যকর নাও হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের (international relations) ফোরামে অভ্যাগতদের জন্য রীতিমতো উঁচুমানের ওয়াইনের প্রয়োজন হতে পারে।
- দ্বিতীয়ত, সরকারের দাবী এই যে, ওয়াইন সেলারটি আসলে উচ্চমূল্যের ওয়াইন বিক্রির মাধ্যমে লাভের উৎস হিসেবেও কাজ করে।
বিনিয়োগ হিসেবে ওয়াইন কিনা: সরকারি হসপিটালিটি ওয়াইন সেলার (Government Hospitality Wine Cellar, সংক্ষেপে GHWC) নীতিগতভাবে ওয়াইনকে বিনিয়োগের মতো ব্যবহার করে। আমরা জানি, অনেক ওয়াইন বয়স বাড়লে দামও বাড়ে (“বয়স্ক ওয়াইন” বেশি দাম পেতে পারে)। GHWC পুরোনো ওয়াইন কখনো কখনো বিক্রি করে, সেই আয় দিয়ে তুলনামূলক সস্তা ওয়াইন কিনে মজুত করে। এ জন্য সরকারের একটি ওয়াইন কমিটি (Government Wine Committee, সংক্ষেপে GWC) আছে—যারা ঠিক করে কখন কোন ওয়াইন বিক্রি হবে বা কেনা হবে। ২০১০ সালে এ কমিটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে এক ধরনের সরকারি সংস্থার মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল, পরে আবার সেই মর্যাদা বাতিল করা হয়। কিন্তু কমিটি এখনো কার্যকর আছে।
GWC-এর সাফল্য: জানা গেছে, জিডব্লিউসি-তে (GWC) চারজন “মাস্টার অব ওয়াইন” (Masters of Wine) আছেন, যারা বছরে তিনবার বৈঠকে বসেন। তাদের কোনো বেতন-ভাতা নেই, সরকারের হিসেবে এ কমিটির কোনো আলাদা বাজেটও নেই। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী (অর্থবছর ২০২৩-২৪), GHWC-এর সংগ্রহে যে ওয়াইনগুলোর ক্রয়মূল্য প্রায় ৭৯৫,৯৯৯ পাউন্ড, সেগুলোর বাজারমূল্য এখন ৩.৮০৩ মিলিয়ন পাউন্ড, অর্থাৎ প্রায় চারগুণেরও বেশি। ফিনানশিয়াল টাইমস (FT)-এর এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত দশকে এই “কস্ট টু ভ্যালু” (cost-to-value ratio) ক্রমে উন্নতি করছে। অর্থাৎ, সরকার পুরোনো দামি ওয়াইন বিক্রি করে, সেই অর্থ দিয়ে অপেক্ষাকৃত সস্তা ওয়াইন কিনছে। শোনায় অদ্ভুত হলেও, এতে করে সরকারের খরচ মোটের ওপর কিছুটা সাশ্রয় হচ্ছে বলে তারা দাবি করে।
সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড
২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার প্রায় ৪৯,৮৯০ পাউন্ড মূল্যের ওয়াইন বিক্রি করে এবং ৪৯,৮৬০ পাউন্ড মূল্যের ওয়াইন ক্রয় করে—এতে নেট লাভ দাঁড়ায় ৩০ পাউন্ড। শুনতে খুব বেশি নয়, কিন্তু মনে রাখতে হবে, এটা শুধু “ক্রয়-বিক্রয়” চক্রের হিসাব।
গড়ে সরকার যে ওয়াইন কিনেছে, তার বোতলপ্রতি দাম প্রায় ২৪.৬৬ পাউন্ড। আর সরকার যে ওয়াইনগুলো বিভিন্ন ইভেন্টে ব্যয় করেছে, সেগুলোর গড় দাম একেক বোতলে প্রায় ১৬ পাউন্ড। এছাড়া অন্যান্য সরকারি দফতর (ডিপার্টমেন্ট) সেলার থেকে ওয়াইন নিলে সেই খরচের টাকা ফেরত দিয়েছে—এবছর যেমন ৩২,১২৫.৪৭ পাউন্ড ফেরত এসেছে। এতে বোঝা যায়, তারা পুরোনো মূল্যবান ওয়াইন বিক্রি করে নতুন সস্তা ওয়াইন কেনে। অর্থনীতির দৃষ্টিতে দেখলে, এটি অদ্ভুত শোনা গেলেও “ট্যাক্সপেয়ারের টাকা” বেশি খরচ না করে আপ্যায়ন চালানোর একটি উপায়।
সেলারস্থিত ওয়াইনের বিবরণ
অদ্ভুততম বোতল: স্মিরনফ ভদকা (Smirnoff Vodka): সেলারে সবচেয়ে অদ্ভুত ওবjekte সম্ভবত একটি কোয়ার্টার বোতলের স্মিরনফ ভদকা (Smirnoff Vodka)। কারা কেন কিনল, কেনই বা রাখা হলো, বা স্বাদ “মাস্টার অব ওয়াইন”রা কীভাবে মূল্যায়ন করেন—এসব প্রশ্নের উত্তর অজানা।
সবচেয়ে দামি ওয়াইন: দুটি পদ্ধতিতে দাম মাপা যায়—“নিলামমূল্য (auction value)” ও “কমিউনিটি ভ্যালু (community value)”। নিলামমূল্য হিসেবে সবচেয়ে দামি শাতো লাফিট রথশিল্ড গ্রাঁ ভিন (Château Lafite Rothschild Grand Vin) ২০১০ রিলিজ। সরকারের কাছে এর ১০৭টি বোতল আছে, যার মোট মূল্য প্রায় ৩৭৯,০০০ পাউন্ড। এটি সেলার-সমগ্র মূল্যের প্রায় ১০%। কমিউনিটি ভ্যালু হিসেবে সবচেয়ে দামি ক্রুগ শ্যাম্পেইন ভিনটেজ ব্রুট (Krug Champagne Vintage Brut)। প্রতিটি বোতলের দাম আনুমানিক ৮,৭০২ পাউন্ড। এর ১৩টি বোতল সেলারে আছে, যা সামগ্রিক সংগ্রহের একটি বড় অংশের মূল্য বহন করে।
সবচেয়ে জনপ্রিয় ওয়াইন: সবচেয়ে বেশিবার ব্যবহৃত বা জনপ্রিয় হলো “ল শাপেল ড’অ্যামবাক্কাস” (Chapelle d’Ambeucqus) নামের একটি ইংলিশ ওয়াইন, যা সাধারণত সংবর্ধনা (reception events) বা আপ্যায়নে ব্যবহৃত হয়। দাম প্রায় ২২.৫৫ পাউন্ড, এবং সরকার এটির ৭২০টি বোতল কিনেছে।
মোট সংগ্রহে ফরাসি আধিপত্য: মোট ৩২,২৫৯ বোতলের ভেতর বেশিরভাগই ফরাসি রেড ওয়াইন (French red wines)। কিছু ফরাসি সাদা ওয়াইনও (French white wines) আছে। বিস্ময়করভাবে, ব্রিটিশ ওয়াইনের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। সরকার সম্ভবত পুরোনো, বিখ্যাত ফরাসি ব্র্যান্ডের প্রতি বেশি আগ্রহী।
কেন এই সেলার “মজার” হলেও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হতে পারে
যুক্তরাজ্যে অনেক রাজকীয় ঐতিহ্য বা সরকারি রীতিনীতিকে বেশ খামখেয়ালি মনে হতে পারে। কিন্তু এই GHWC-এর ক্ষেত্রে সরকারের যুক্তি হলো, এটি একটা আর্থিকভাবে লাভজনক মডেল:
- পুরোনো হয়ে দামি হওয়া ওয়াইন সময়ে সময়ে বিক্রি করে, সেই অর্থ দিয়ে তুলনামূলক সস্তা ওয়াইন কিনছে।
- অতিথি আপ্যায়নের ওয়াইন সরাসরি সুপারমার্কেট থেকে ক্রয়ের তুলনায়, দীর্ঘমেয়াদে কম খরচ হচ্ছে (কমপক্ষে সরকার এমনটাই দাবি করে)।
বছরে তিনবার বিশেষজ্ঞদের বৈঠক, অন্য সরকারি বিভাগকে বিক্রি করে কিছু অর্থ ফেরত পাওয়া—সব মিলিয়ে ট্যাক্সপেয়ারের টাকায় যেন অতিরিক্ত অপচয় না হয়, সে চেষ্টাই করছে বলেই সরকার দাবি করে।
তথ্যসূত্র
1 – https://www.ft.com/content/496a5f8c-49df-4714-b6d6-2b9e248ecbbe
2 – https://vinalchemy.com/blogs/blogs-from-winewizard-3/the-wine-cellar-of-the-houses-of-parliament-a-hidden-gem
3 – https://www.telegraph.co.uk/food-and-drink/features/british-government-wine-cellar-fortune-westminster/
4 – https://en.wikipedia.org/wiki/Government_Wine_Cellar
5 – https://www.bbc.co.uk/news/magazine-13378301
6 – https://www.gov.uk/government/publications/government-hospitality-wine-cellar-biennial-report-2022-to-2024/government-hospitality-wine-cellar-biennial-report-2022-to-2024
Leave a Reply