ট্রাম্পের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলো এবং এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে যেভাবে রূপান্তরিত হতে পারে

ট্রাম্পের অর্থনৈতিক রূপরেখা

ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে “অস্বাভাবিক” (unorthodox) অর্থনৈতিক নীতি (economic policy) উপস্থাপন করেছেন বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। এই আর্টিকেলে আমরা ট্রাম্পের প্রস্তাবিত “বন্য” (wild) অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনাগুলোকে ঘনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করব এবং সেগুলো বাস্তবায়িত হলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ও বিশ্ব অর্থনীতিতে ঠিক কী প্রভাব ফেলতে পারে তা জানার চেষ্টা করব।

উল্লেখ্য, এখানে ট্রাম্প যা বলছেন সেটির ওপরই আমরা আলোকপাত করছি। বাস্তবে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় গেলে তিনি হয়তো তার চরম কিছু নীতি বাদ দেবেন, কিংবা কংগ্রেস (Congress) সেগুলো আটকে দিতে পারে। তা সত্ত্বেও, তার দেওয়া বক্তব্যই এখানে আমরা মূল ভিত্তি হিসেবে নিচ্ছি।

ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বক্তৃতা ও বিবৃতি অনুযায়ী তার অর্থনৈতিক রূপরেখা মোটের ওপর দুই ধরনের নীতিকে গুরুত্ব দেয় (১ ও ২ নম্বর), তবে তবে এই দুটো ছাড়াও তার ও তার উপদেষ্টাদের কথাবার্তায় আরও ৩টি থিম (themes) বারবার উঠে এসেছে (৩ থেকে ৫ নম্বর)। এগুলো হচ্ছে —

  • ১. আমদানির ওপর আরও বেশি শুল্ক (tariffs) আরোপ
  • ২. কর (taxes) কমানো
  • ৩. ডলার দুর্বল করা
  • ৪. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন কমানো
  • ৫. ক্রিপ্টো-কারেন্সি-পন্থী নীতি

১. শুল্ক বৃদ্ধির পরিকল্পনা

ট্রাম্প যে শুল্ক পছন্দ করেন, তা স্পষ্ট। প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প যথেষ্ট শুল্কমুখী ছিলেন। তার ধারণা, শুল্ক আরোপ করলে মার্কিন উৎপাদনকারী (American manufacturers) প্রতিষ্ঠানগুলো সুরক্ষা পাবে এবং আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি (bilateral trade deficits) কমবে। তবে এবার তিনি যে ধরনের শুল্ক আরোপের কথা বলছেন, তা অভূতপূর্ব –

  • চীনা পণ্যে ফ্ল্যাট শুল্ক: ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর উচ্চহারে “ফ্ল্যাট শুল্ক” বসানোর প্রস্তাব করেছেন। হারের বিষয়ে তিনি স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। কোনো কোনো বক্তব্যে তিনি ৫০%, ৬০% বা তার বেশি হারেও শুল্ক আরোপের কথা বলেছেন। “দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট” (The Washington Post) প্রথমে জানায়, তিনি ৬০% হারের কথা ভাবছেন। পরে ট্রাম্প দুবার তা অস্বীকার করে বলেছেন, এটি হয়তো ৫০% হতে পারে। আবার অন্য সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “হয়তো ৬০% এর বেশি” হতে পারে। অর্থাৎ, সুনির্দিষ্ট সংখ্যা নিশ্চিত নয়। তবে যেটাই হোক, এত বড় মাপের শুল্ক আরোপ আধুনিককালে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রবাহের এক বিরাট রদবদল তৈরি করতে পারে।
  • চীনা বৈদ্যুতিক গাড়িতে (EV) অতিরিক্ত শুল্ক: ট্রাম্প বাইডেন (Biden) প্রশাসন যে চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেছে, বিশেষ করে জ্বালানি রূপান্তর (energy transition)-সংশ্লিষ্ট পণ্যে, সেগুলো আরও বাড়াতে চান। উদাহরণস্বরূপ, চীনা বৈদ্যুতিক গাড়ির (EV) ওপরে এখন ১০০% শুল্ক বিদ্যমান; ট্রাম্প এটি ২০০%-এ তুলতে চান।
  • সর্বব্যাপী ১০% থেকে ৫০% শুল্ক: ট্রাম্প আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি হওয়া প্রায় “সব ধরনের” পণ্যের ওপর সমান হারে একটি ফ্ল্যাট শুল্ক (flat tariff) বসানো হবে। এক্ষেত্রে সব আমদানি পণ্যের ওপর অন্তত ১০% ফ্ল্যাট শুল্ক আরোপ করা হবে, এমনকি সেগুলো এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU)-এর মতো মিত্র দেশ থেকে এলেও। “আমরা স্কটল্যান্ড ও জার্মানিকে (Germany) ভালোবাসি, কিন্তু বাকিরা আমাদের সহিংসভাবে (violently) আচরণ করে”—এই ভাষায় তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে এক প্রকার “চীনা” শত্রুর সঙ্গে তুলনা করেছেন। বেশির ভাগ সময়ই তিনি এ হার ১০% বলেই উল্লেখ করেছেন। তবে কিছু বক্তব্যে ২০% এবং আরও সাম্প্রতিক এক বক্তৃতায় ৫০% পর্যন্ত শুল্কের কথা বলেছেন।

এ থেকে স্পষ্ট, ট্রাম্পের কাছে শুল্ক একটা বড় হাতিয়ার, যা তিনি প্রয়োজনে মিত্র বা প্রতিপক্ষ—সবাইকে মোকাবেলা করার জন্যই ব্যবহার করতে প্রস্তুত।

২. কর কমানোর প্রস্তাব

শুল্ক বাড়ানোর পাশাপাশি ট্রাম্প কর কমানোকে (tax cuts) খুবই গুরুত্ব দিচ্ছেন। রিপাবলিকান (Republican) হিসেবে ট্রাম্পের অবস্থান বরাবরই কম করের পক্ষে। ট্রাম্পের যুক্তি, কর কমানো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে (economic growth) ত্বরান্বিত করে এবং এটিই তাকে অতীতে জনপ্রিয় করেছে।

২০১৭ সালের করছাড় আইন (Tax Cuts and Jobs Act) বাড়ানো: ২০১৭ সালে পাস হওয়া “ট্যাক্স কাটস অ্যান্ড জবস অ্যাক্ট” (Tax Cuts and Jobs Act)-এর মেয়াদ ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ শেষ হওয়ার কথা। ট্রাম্প এটিকে বাড়ানোর কথা বলেছেন।

করপোরেট ট্যাক্স কমানো: তিনি করপোরেট ট্যাক্স (corporation tax) ২০% বা ১৫%-এ নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করছেন। ২০১৭ সালে তিনি এটি ৩৫% থেকে ২১%-এ নামিয়ে এনেছিলেন। এখন এটি আরও নামানো তার অন্যতম লক্ষ্য।

আয়কর বাতিল ও “সুপার হাই ট্যারিফ” দিয়ে পূরণ: অবশ্য এখানেই শেষ নয়। জুন মাসে কংগ্রেসনাল রিপাবলিকানদের (congressional Republicans) সঙ্গে বৈঠকে তিনি এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, আয়কর (income tax) পুরোপুরি তুলে দেওয়া যেতে পারে এবং শুল্ক অত্যন্ত বাড়িয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে। এরপর জো রোগান (Joe Rogan)-এর অনুষ্ঠানে এসেও তিনি একই কথা নতুন করে জোর দিয়ে বলেছেন। এক্ষেত্রে তিনি ১৮৯৭ থেকে ১৯০১ পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকারী প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাককিনলির (William McKinley) উদাহরণ টেনেছেন। উল্লেখ্য, ১৮৯৭ সালের “ডিংলে অ্যাক্ট” (Dingley Act) আমদানি শুল্ককে (import duty) ৫০%-এর ওপরে নিয়ে গিয়েছিল, যাতে সরকার আয়কর ছাড়াই রাজস্ব ঘাটতি পূরণ করতে পারে। ট্রাম্পের মতে, ম্যাককিনলি যেটা করেছিলেন, সেটি বর্তমান সময়ে আবার করা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সুপার হাই ট্যারিফ দিয়ে আয়কর বাতিলের এই নীতিটির বাস্তবায়ন বাস্তবে কতটা সম্ভব সেটা। আজকের দিনে এসে এটি প্রায় “অসম্ভব” বলে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন। কারণ, ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে এবং একই বছরে প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার রাজস্ব এসেছে আয়কর খাত থেকে। আয়কর পুরোপুরি তুলতে চাইলে ওই ২ ট্রিলিয়ন ডলারের ঘাটতি সামলাতে “গড়ে” কমপক্ষে ৬৭% শুল্ক বসাতে হবে! তাছাড়া শুল্ক হার যতই বাড়বে, আমদানি ওই অনুপাতে কমতে থাকবে, ফলে শুল্ক আয়ও প্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছাবে না।

৩. ডলার দুর্বল করা

যুক্তরাষ্ট্রের ডলার (US dollar) বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা (reserve currency)। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ডলারের চাহিদা বেশি, আর এ কারণে ডলারের মান তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী থাকে। ঐতিহ্যগতভাবে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা এটাকে ভালোই মনে করেছেন; কারণ এতে আমেরিকানরা বেশ সস্তায় আমদানি করতে পারে, আর সরকারও সহজে ঋণ নিতে পারে।

কিন্তু সাম্প্রতিককালে “ট্রাম্পপন্থী” রিপাবলিকানদের মধ্যে এক ধরনের তত্ত্ব জন্ম নিয়েছে যে ডলারের শক্তিশালী অবস্থানই (strong dollar) যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পায়ন (industrialization) ব্যাহত করছে, কারণ রপ্তানিতে (exports) অসুবিধা হয়। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী—উপ-রাষ্ট্রপতি প্রার্থী জে.ডি. ভ্যান্স (JD Vance) এবং অর্থনৈতিক উপদেষ্টা রবার্ট লাইটহাইজার (Robert Lighthizer) সক্রিয়ভাবে ডলার দুর্বল করার কথা বলছেন।

  • কীভাবে দুর্বল করবেন?: ডলার বিশ্বের অন্যতম ফ্রিলি ট্রেডেড (freely traded) রিজার্ভ মুদ্রা, যেখানে মূলত বাজার নিজেই বিনিময় হার (exchange rate) নির্ধারণ করে। তাই সাধারণ পদ্ধতিতে পুঁজি নিয়ন্ত্রণ (capital controls) বা সরকারি হস্তক্ষেপ করে ডলারের দাম কমানো খুব কঠিন। ১৯৮৫ সালের “প্লাজা অ্যাকর্ড” (Plaza Accords)-এর উদাহরণ টেনে লাইটহাইজার বলছেন, মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে “বৃহৎ সমঝোতা” করা যেতে পারে, যাতে তারা সম্মিলিতভাবে ডলারের মান কমাতে সাহায্য করে। কিন্তু সেই চুক্তিটিও সাময়িক ফল দিয়েছিল এবং তখনকার জাপান (Japan) ও ইউরোপ (Europe) ছিল ঘনিষ্ঠ মার্কিন মিত্র।
  • সুদহার (interest rate) কমানো
    ডলার দুর্বল করার আরেকটি উপায় হতে পারে সুদহার ব্যাপকভাবে নামিয়ে দেওয়া। কিন্তু এখনকার নিয়মে ফেডারেল রিজার্ভ (Federal Reserve) বা ফেড স্বতন্ত্রভাবে (operationally independent) এই সিদ্ধান্ত নেয়, যা সরাসরি সরকারের আওতায় নেই।

বিস্তারিত জানতে পড়ুন – কেন ট্রাম্প ডলারের মূল্য কমাতে চান?

৪. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন কমানো

বর্তমানে ফেডারেল রিজার্ভ (Fed) হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যার কার্যক্রমে সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে না। বেশিরভাগ আধুনিক অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতাকে অপরিহার্য মনে করা হয়, কারণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রায়ই “মূল্যস্ফীতি-পন্থী” (pro-inflationary) চাপে থাকে। ফলে তারা সহজে সুদের হার (interest rate) বাড়াতে চায় না, যা মূল্যস্ফীতিকে (inflation) বাড়িয়ে তুলতে পারে।

২০২৪ সালের এপ্রিলে “ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল” (Wall Street Journal) জানায়, ট্রাম্পের উপদেষ্টারা এমন কিছু ব্যবস্থা নিতে চাইছেন, যাতে ট্রাম্প সরাসরি মুদ্রানীতিতে (monetary policy) প্রভাব ফেলতে পারেন। যেমন, ফেডের সুদের হার নির্ধারক কমিটিতে (rate-setting committee) প্রেসিডেন্টের জন্য একটি বিশেষ আসন তৈরি করা, অথবা বর্তমান ফেড চেয়ার জেরোম পাওয়েলকে (Jerome Powell) সরিয়ে দিয়ে আরও বাধ্যকারী কাউকে বসানো।

২০১৭ সালে ট্রাম্পই প্রথম জেরোম পাওয়েলকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প তখনই প্রকাশ্যে পাওয়েলের ওপর অসন্তোষ জানিয়েছিলেন, কারণ পাওয়েল সুদের হার কমাতে নারাজ ছিলেন। এমনকি মহামারির (pandemic) প্রথম দিকে ট্রাম্প তাকে নিচের পদে নামিয়ে দেওয়ার (demote) কথা ভেবেছিলেন। তবে আইনগতভাবে প্রেসিডেন্টের এমন ক্ষমতা আছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।

সাম্প্রতিক ব্লুমবার্গ (Bloomberg) সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি পাওয়েলকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সরাতে চান না। তবে বাস্তবে ক্ষমতায় গিয়ে যদি ট্রাম্প তার অন্য নীতি—যেমন উচ্চ শুল্ক, দুর্বল ডলার— বাস্তবায়ন করতে যান, সেক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা থাকবে। ফেড সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে সুদের হার বাড়ালে ট্রাম্পের সঙ্গে সংঘাত চরমে পৌঁছতে পারে।

৫. ক্রিপ্টো-কারেন্সি-পন্থী নীতি 

ডোনাল্ড ট্রাম্প, ২০১৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, কিন্তু তার ক্রিপ্টোকারেন্সি সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি ২০২১ সাল থেকে পরিবর্তিত হয়েছে। আগে তিনি ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করতেন, কিন্তু এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে “বিশ্বের ক্রিপ্টো রাজধানী” হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলছেন। তার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, তিনি বিটকয়েনকে “চাঁদে পাঠাতে” চান এবং ফেডারেল রিজার্ভকে বিটকয়েন রিজার্ভ রাখতে বলেন। তিনি এমনকি এসইসি (SEC) চেয়ার গ্যারি গেন্সলারকে বরখাস্ত করার হুমকি দিয়েছেন এবং জাতীয় ঋণ ক্রিপ্টো দিয়ে শোধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

ট্রাম্পের ক্রিপ্টো নীতির মধ্যে তিনটি প্রধান প্রস্তাব রয়েছে: প্রথমত, তিনি এসইসি চেয়ার গ্যারি গেন্সলারকে বরখাস্ত করতে চান এবং ক্রিপ্টো-বান্ধব এসইসি চেয়ার বসাতে চান। দ্বিতীয়ত, তিনি ফেডারেল রিজার্ভকে বিটকয়েনকে রিজার্ভ অ্যাসেট হিসেবে সংরক্ষণ করতে বলেন। তৃতীয়ত, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সি (CBDC) বাস্তবায়ন বন্ধ করতে চান, কারণ তিনি মনে করেন যে এটি বিকেন্দ্রীকৃত ক্রিপ্টোকারেন্সির জন্য হুমকি হতে পারে। এই পরিকল্পনাগুলো যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে বিটকয়েনের দাম অনেক বাড়তে পারে এবং মার্কিন অর্থনীতি ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রভাবের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসতে পারে।

তবে ট্রাম্পের এই পরিকল্পনাগুলি বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা রয়েছে। মার্কিন আর্থিক নীতিতে বিটকয়েন এবং অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেলে, ডলারের রিজার্ভ স্ট্যাটাস ক্ষুণ্ণ হতে পারে। ডলার এখনও বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ কারেন্সি, এবং যদি ক্রিপ্টোকারেন্সি সরকারি সমর্থন পায়, তবে এটি বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে এ ব্যাপারে মতপার্থক্য রয়েছে, এবং কংগ্রেস ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমর্থন পেতে হবে। ট্রাম্পের এই “ক্রিপ্টো-উচ্ছ্বাস” বাস্তবায়িত হলে বৈশ্বিক অর্থনীতি বদলে যেতে পারে, তবে তার জন্য অনেক রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

বিস্তারিত জানতে পড়ুন – কেন ট্রাম্পের ক্রিপ্টো পরিকল্পনাগুলো ডলারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে?

সম্ভাব্য প্রভাব: তিনটি বড় প্রভাব

ট্রাম্পের এই অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হলে বিভিন্ন রকমের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বাড়বে, কারণ এত বড় আকারে শুল্ক আরোপ ও ডলারের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেখা যায়নি। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি, কর ব্যবস্থায় অস্থিরতা ইত্যাদি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। সেই সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হলে তা আর্থিক বাজারের আস্থাকে (investor confidence) ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

এগুলোর মধ্যে কেবল প্রধান দুটো বড় পরিকল্পনা, অর্থাৎ শুল্ক বৃদ্ধি ও কর কমানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলেই আমেরিকান অর্থনীতিতে যে অন্তত তিনটি বড় ধরনের প্রভাব দেখা দেবে, সে বিষয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মোটামুটি ঐকমত্য রয়েছে। এই তিনটি প্রভাব হলো—

  • ১. বৈষম্য (inequality) বৃদ্ধি
  • ২. মূল্যস্ফীতি (inflation) বৃদ্ধি
  • ৩. জাতীয় ঋণের (national debt) বোঝা আরও ভারী হওয়া

নিম্নে প্রতিটি দিক বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।

১. বৈষম্য (Inequality) বৃদ্ধি

ট্রাম্পের কর ছাঁটাইয়ের (tax cuts) পরিকল্পনা আমেরিকায় আয়বৈষম্য বাড়িয়ে দিতে পারে। কারণ দুটি—

  • উচ্চ আয়ের ব্যক্তিরা সরাসরি সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। বিশেষ করে যারা বছরে ৮ লাখ ডলারের বেশি আয় করেন, তারা সর্বাধিক কর ছাড়ের (tax breaks) সুবিধা পাবেন।
  • করপোরেট ট্যাক্স কমানো হলে, বড় কোম্পানির মুনাফা বেড়ে যায়। অতীতে দেখা গেছে, এই মুনাফার বেশির ভাগই চলে যায় কোম্পানির নির্বাহী (corporate executives) এবং শেয়ারহোল্ডারদের (shareholders) পকেটে। ২০১৬ সালে ট্রাম্প বলেছিলেন, করপোরেট ট্যাক্স কমালে তা নিম্নআয়ের শ্রমিকদের মজুরি বাড়াবে এবং ভোক্তাদের জন্য সামগ্রিক পণ্যমূল্য কমে আসবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে একাধিক গবেষণা (academic work) দেখিয়েছে যে, এর বেশির ভাগ সুফলই কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের লাভে পরিণত হয়েছে, শ্রমিকদের মজুরি বা ভোক্তার জন্য পণ্যমূল্যের ওপর খুব বেশি ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি।

২. মূল্যস্ফীতি (Inflation) বৃদ্ধি

ট্রাম্পের পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির হারকে বাড়িয়ে তুলতে পারে দুটি কারণে—

  • প্রথমত, কর কমানো হলে মানুষের হাতে ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যায়; ফলে ভোগ ব্যয় (consumer spending) বেড়ে যায়। চাহিদা বেড়ে গেলে স্বাভাবিক নিয়মেই পণ্যের দাম বৃদ্ধির দিকে যায়।
  • দ্বিতীয়ত, শুল্ক বাড়লে আমদানি করা পণ্যগুলো আরো ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। যেকোনো পণ্য আমদানি করতে গেলে বাড়তি শুল্ক দিতে হবে, কিংবা সেই পণ্য দেশীয়ভাবে উৎপাদন করতে হবে, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যয়বহুল।

নিরপেক্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকস (Peterson Institute for International Economics) অনুমান করেছে যে, ট্রাম্পের এইসব শুল্কনীতির কারণে বর্তমান পরিস্থিতির তুলনায় মূল্যস্ফীতি অতিরিক্ত ০.৫% থেকে ১% পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এ হার নির্ভর করবে শুল্কের মাত্রা এবং অন্য দেশগুলো কীভাবে পাল্টা ব্যবস্থা নেয় তার ওপর।

তবে দীর্ঘমেয়াদে কী ঘটবে, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। মুক্তবাণিজ্যের (free trade) পক্ষে থাকা অর্থনীতিবিদদের মতে, শুল্কের কারণে সুরক্ষাবাদ (protectionism) বাড়বে, ফলে যুক্তরাষ্ট্র অনেক পণ্য উৎপাদনে কখনোই বিশ্ববাজারের মতো দক্ষতা অর্জন করতে পারবে না; তাই দাম স্থায়ীভাবে বেশি থাকবে। অন্যদিকে, সুরক্ষাবাদী (protectionist) অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুরুতে দাম কিছুটা বাড়লেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র স্থানীয় উৎপাদনে সক্ষম হয়ে উঠবে। আর স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে দেশের অভ্যন্তরে ভালো মানের ও উচ্চ-মজুরির (well-paid) চাকরি তৈরি হবে, এতে অনেক আমেরিকান ভোক্তা মোটের ওপর উপকৃত হবেন।

৩. ঋণ (Debt) বৃদ্ধি

যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই বিশাল বাজেট ঘাটতি (deficit) এবং মার্কিন জাতীয় ঋণের (national debt) ভারি বোঝা বইছে। কর কমালে স্বাভাবিকভাবেই ফেডারেল সরকারের রাজস্ব (revenue) কমে যাবে, ফলে বাজেট ঘাটতি এবং ঋণের বোঝা বাড়বে। বিশেষ করে যদি আয়কর সম্পূর্ণভাবে তুলে দেওয়ার মতো র‍্যাডিক্যাল (radical) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা ভাবাই কঠিন।

উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে আমেরিকার মোট আমদানি ছিল প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। একই বছরে ব্যক্তিগত আয়কর থেকে এসেছে প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার। তার মানে, শুধু আয়কর বাতিল করে ওই ঘাটতি (২ ট্রিলিয়ন ডলার) পুষিয়ে নিতে হলে আমদানিকৃত সব পণ্যের ওপর গড়ে ৬৭% শুল্ক আরোপ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে, শুল্কের হার যত বাড়বে, আমদানি ততই কমবে, ফলে শুল্ক থেকে আয়ও প্রত্যাশিত পরিমাণে উঠবে না।

অর্থাৎ, আয়কর পুরোপুরি বাতিল করলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট ঘাটতি বিপুলভাবে লাফিয়ে উঠতে পারে। কমিটি ফর রেসপনসিবল ফেডারেল বাজেট (Committee for Responsible Federal Budget) -এর অক্টোবরের শেষের দিকে করা একটি বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ট্রাম্পের সামগ্রিক পরিকল্পনা ২০২৫ থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে মার্কিন জাতীয় ঋণ প্রায় ৮ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়িয়ে তুলতে পারে। এটি কমলা হ্যারিসের (Kamala Harris) প্রস্তাবিত নীতিগুলোর কারণে যে পরিমাণ ঋণ বাড়তে পারে তার প্রায় দ্বিগুণ।

ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাৎসরিক বাজেট ঘাটতি, যা বর্তমানে জিডিপির (GDP) প্রায় ৫% বা ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের সমান, তা প্রায় ১০% বা ৩ ট্রিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকবে।

অবশ্য এখানে বড় একটি “ক্যাভিয়াট” (caveat) আছে। ট্রাম্প বলেছেন, ইলন মাস্ক (Elon Musk) একটি নতুন “ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি” (Department of Government Efficiency) পরিচালনা করবেন, যার কাজ হবে সরকারী ব্যয় ২ ট্রিলিয়ন ডলার কমিয়ে ফেলা। মাস্ক নিজে দাবি করছেন, তিনি ফেডারেল সরকারের প্রায় ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের বার্ষিক বাজেট থেকে ২ ট্রিলিয়ন ডলার কেটে দিতে পারবেন। তবে এটি আদতে বাস্তবায়ন করা সহজ নয়। এর জন্য প্রতিরক্ষা খাত (defense spending) বা সামাজিক নিরাপত্তা (Social Security)-সংক্রান্ত কল্যাণমূলক কর্মসূচিগুলোর বরাদ্দে বড় ধরনের কাটছাঁট প্রয়োজন হতে পারে। ইতিহাস বলে, যিনিই ক্ষমতায় আসুন না কেন, এত বিশাল অঙ্কের সরকারি ব্যয় (government spending) কাটা খুব কঠিন রাজনৈতিক বাধার সম্মুখীন হয়।

উপসংহার

ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতিগুলো “চরমপন্থী” (unorthodox) হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা তার শুল্কনীতি ও করনীতিতে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। আমদানি পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ, আয়কর বাতিলের মতো প্রস্তাব কিংবা করপোরেট ট্যাক্স কমিয়ে আনার ভাবনা—এই সব মিলিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে একটি ভিন্ন অর্থনৈতিক পথে পরিচালিত করার পরিকল্পনা করছেন। তার মতে, এসব পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প পুনর্গঠন, আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং অভ্যন্তরীণ প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সহায়ক হবে। তবে, বাস্তবতা হলো, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় গেয়ে তিনি এ ধরনের পরিকল্পনার কতটা বাস্তবায়ন করতে পারবেন, তা কংগ্রেস ও অন্যান্য রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার ওপর নির্ভর করবে। কংগ্রেসে সমর্থন জোগাড় করা বা নির্বাহী ক্ষমতার মাধ্যমে তার পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে কিনা, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। আবার, ফেডের স্বাধীনতার সঙ্গে তার নীতির দ্বন্দ্ব তৈরি হলে তা কী প্রভাব ফেলবে, তাও দেখার বিষয়। তার নীতিগুলোর বাস্তবায়ন হলে স্বল্পমেয়াদে আয়বৈষম্য, মূল্যস্ফীতি এবং জাতীয় ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা প্রবল, তবে দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় শিল্প-কারখানা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হতে পারে। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা কঠিন হতে পারে, এবং কর-শুল্ক কাঠামোর বড়সড় পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা, মুদ্রানীতি এবং বাণিজ্যে ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে।

তথ্যসূত্র

1 – https://abcnews.go.com/Business/trump-proposes-eliminating-personal-income-taxes-work/story?id=115217463
2 – https://www.bloomberg.com/features/2024-trump-interview-transcript/
3 – https://www.bloomberg.com/news/articles/2024-02-04/trump-floats-chinese-goods-tariff-of-more-than-60-if-elected
4 – https://www.nber.org/system/files/working_papers/w28680/w28680.pdf
5 – https://economics.yale.edu/sites/default/files/2023-01/The%20Efficiency-Equity%20Tradeoff%20of%20the%20Corporate%20Income%20Tax.pdf
6 – https://www.piie.com/blogs/realtime-economics/2024/how-much-would-trumps-plans-deportations-tariffs-and-fed-damage-us
7 – https://www.theatlantic.com/politics/archive/2024/09/economic-arguments-tariffs-trump/680015/
8 – https://www.piie.com/blogs/realtime-economics/2024/can-trump-replace-income-taxes-tariffs
9 – https://www.crfb.org/papers/fiscal-impact-harris-and-trump-campaign-plans
10 – https://x.com/johnauthers/status/1812400675277426710/photo/1
11 – https://www.bloomberg.com/features/2024-trump-interview-transcript/
12 – https://en.wikipedia.org/wiki/Dingley_Act
13 – https://en.wikipedia.org/wiki/Wilson%E2%80%93Gorman_Tariff_Act
14 – https://www.piie.com/blogs/realtime-economics/2024/can-trump-replace-income-taxes-tariffs
15 – https://x.com/GavinBade/status/1812950510372012246/photo/1
16 – https://x.com/DanielaGabor/status/1812973919542124737
17 – https://www.bloomberg.com/news/articles/2020-03-14/trump-says-no-plans-to-demote-powell-but-asserts-right-to

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.