কেন চীন বিশ্বের নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে?

ভূমিকা

সারা দুনিয়ায় অসংখ্য সংবাদ প্রতিবেদন দেখেছি, যেখানে চীনের (China) কয়লা (coal), তেল (oil) ও সামগ্রিকভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি (fossil fuels) ব্যবহারের কথা তুলে ধরা হয়। সমালোচকেরা বরাবরই দাবি করেন যে চীনের এই অত্যধিক জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে, এবং তাই দেশটি বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণকারী হিসেবে পরিচিত।

চীনের নিঃসরণ গত কয়েক দশকে দ্রুতগতিতে বেড়েছে। যদি চীনের নিঃসরণকে যুক্তরাষ্ট্র (United States), রাশিয়া (Russia), ভারত (India) ইত্যাদির সঙ্গে তুলনা করি, বুঝতে পারি চীনের নিঃসরণ কীভাবে বৈশ্বিক মানচিত্রে প্রাধান্য বিস্তার করে। অনেকে বলেন, এই বৃদ্ধির পেছনে কারণ হলো বিশাল আকারে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার (fossil fuels usage), যার বেশির ভাগই কয়লা থেকে আসে।

কিন্তু অন্যদিকে, সাম্প্রতিক বছরেও চীনের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বেড়ে চললেও, তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানির (renewable energies) সক্ষমতা নিয়ে প্রচুর অগ্রসর হয়েছে। আসলে, চীন এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির উন্নয়নে বিশ্বনেতা। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের বৃহত্তম দেশ হওয়ার সত্ত্বেও, তারা সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বিনিয়োগ (invested heavily) করেছে সবুজ প্রযুক্তিতে (green technologies)—বিশ্বের সর্বোচ্চ সৌর প্যানেল (solar panels), বায়ুকল (wind turbines), এবং বৈদ্যুতিক গাড়ি (electric vehicles) উৎপাদন করে।

চীনের জ্বালানি মিশ্রণে বদল এবং জীবাশ্ম ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগের তুলনা

চীনের ব্যাপকভাবে জীবাশ্ম জ্বালানিতে নির্ভরতার চিত্র বোঝাতে আমরা একে এক নজর দেখে নিই। দেখা যায় চীনের বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিভিন্ন উৎসের ক্ষেত্রে কয়লা (coal) একসময় প্রাধান্য বিস্তার করলেও এখন ধীরে ধীরে বায়ু (wind), সৌর (solar), জলবিদ্যুৎ (hydropower) ইত্যাদির অংশ বাড়ছে।

২০২৩ সালের শেষদিককার হিসাবে, কয়লা চীনের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৬০.৭% যোগান দেয় (যেখানে ২০১১ সালে এটি ৭৮.৩১% ছিল)। বায়ু শক্তি (wind) এখন ৯.৩৬%, সৌর শক্তি (solar) ৬.১৮%, আর পারমাণবিক শক্তি (nuclear energy) ৪.৬%। এটা স্পষ্ট যে কয়লার ব্যবহার শীর্ষস্থানে থাকলেও তার হার ক্রমে কমছে, আর নবায়নযোগ্য অংশ বেড়ে চলেছে।

আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (IEA) এক ডেটায় “Announced Pledges Scenario” আর “Net Zero Emissions by 2050 Scenario” ক্ষেত্রে চীনের অতীত ও ভবিষ্যৎ জ্বালানি বিনিয়োগের (energy investment) গ্রাফ রয়েছে। সেখানে দেখা যায়, জীবাশ্ম জ্বালানি সরবরাহে এখনো বড় অঙ্কের অর্থ ঢাললেও, স্বল্প-নিঃসরণকারী বিদ্যুৎ (low-emissions electricity) খাতের বিনিয়োগ তার চেয়েও দ্রুতগতিতে বাড়ছে।

২০২১ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত, জীবাশ্ম জ্বালানিতে প্রায় ১৫৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে, যেখানে স্বল্প-নিঃসরণকারী বিদ্যুতে (low-emissions electricity) ২৬৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ভবিষ্যতে জীবাশ্ম জ্বালানি সরবরাহের বিনিয়োগ আরো কমে আসতে পারে। এ ধরনের বড় বিনিয়োগগুলোই চীনের পরিচ্ছন্ন জ্বালানি (clean energy) খাতকে ব্যাপকভাবে উদ্ভাবনমুখী করে তুলছে—আমেরিকার (United States) চেয়েও দ্রুতগতিতে।

কীভাবে চীন নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে এগিয়ে

এই বিনিয়োগের ফলাফল হচ্ছে, চীন এখন অনেক খাতেই যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে এগিয়ে আছে। কিন্তু আসলে কতদূর এগিয়ে? এটা বুঝতে গেলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিভিন্ন ক্ষেত্র—যেমন সৌরশক্তি (solar energy), বায়ুশক্তি (wind), ব্যাটারি (battery) প্রভৃতি—বিশ্লেষণ করতে হবে।

১. সৌরশক্তিতে (Solar energy) চীনের আধিপত্য: সৌর প্যানেল (solar panels) আধুনিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি রূপান্তরের অন্যতম ভিত্তি। সৌর প্যানেল তৈরির প্রক্রিয়া জটিল—উন্নত প্রযুক্তি, সূক্ষ্ম প্রকৌশল (precision engineering), আর বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলা (global supply chain) দরকার হয়। মূলত সিলিকন (silicon) ভিত্তিক সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহার হয় সৌর প্যানেলে। কিন্তু এই প্যানেল তৈরিতে বড় একটা অংশের জোগান আসে চীনা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে। আইইএ (IEA)-এর ২০২১ সালের ডেটায় “সোলার পিভি (Solar PV) ম্যানুফ্যাকচারিং ক্যাপাসিটি” বিষয়ক গ্রাফে দেখা যায়, মডিউল (modules), পলিসিলিকন (polysilicon), ওয়েফার (wafers)—সব জায়গায়ই চীনের অংশ বিপুল। ওয়েফারে ৯৬.৮% পর্যন্ত চীনের দখল, পলিসিলিকনে প্রায় ৭৯.৪%। আইইএ বলেছে, চীন বৈশ্বিক সৌর পিভি (solar PV) খাতে খরচ কমাতে (cost down) বড় ভূমিকা রেখেছে। চীনের প্রধান সৌর প্যানেল কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে LONGi Green Energy Technology, JinkoSolar, Trina Solar। এরা সবাই বিশ্বব্যাপী সৌরশক্তিতে বড় প্রভাবশালী। LONGi-র রেভিনিউ দিয়েই বোঝা যায়, তারা কত বড় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে—সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা মন্দা দেখা গেলেও। তুলনায়, যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ সৌর প্যানেল নির্মাতা First Solar-এর রেভিনিউ অনেক কম। যেমন, ২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, LONGi প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার রেভিনিউ করেছে, আর ফার্স্ট সোলার ৩.৮৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ পার্থক্যটা বিশাল!

২. ব্যাটারি শিল্পে (Battery industry) চীনের নেতৃত্ব: সৌরশক্তির বাইরে, পরিচ্ছন্ন জ্বালানির (clean energy) আরেক মূল স্তম্ভ হলো ব্যাটারি (batteries)। লিথিয়াম-আয়ন (lithium-ion) ব্যাটারি কেবল বৈদ্যুতিক গাড়ি (electric vehicles) নয়, বরং নবায়নযোগ্য জ্বালানির গ্রিড স্থিতিশীলতায় (energy storage) গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাটারি সাপ্লাই চেইনের (battery supply chain) বেশিরভাগই চীনের দখলে। একটি গ্রাফে (global EV battery supply chain for battery cells) দেখা যায়, ব্যাটারি সেল (battery cells) শিল্পে চীনের আধিপত্য স্পষ্ট। শুধু সেল নয়—ক্যাথোড (cathode) ও অ্যানোড (anode) তৈরি করাতেও চীনের বড় ভূমিকা আছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাটারি কোম্পানি Contemporary Amperex Technology Co., Limited (CATL)—একটি চীনা প্রতিষ্ঠান। এর যাত্রা শুরু ২০১১ সালে, যা এখন বৈদ্যুতিক গাড়ি (EV), এনার্জি স্টোরেজ (energy storage) ও আরও নানা ক্ষেত্রে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি সরবরাহ করে। সর্বশেষ তথ্যমতে এর বাজারমূল্য (market capitalization) $১৫৬ বিলিয়নের বেশি, যা অন্য যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে বড়।

৩. বৈদ্যুতিক গাড়িতে (Electric Vehicle) চীনের ধাক্কা: হয়তো মনে হতে পারে, ইভি (EV) মানেই মার্কিন কোম্পানি টেসলা (Tesla)। কিন্তু বাস্তবে চীন বৈশ্বিক ইভি বাজারেও (global electric vehicle market) অনেক বৃহৎ। টেসলা জনপ্রিয় ব্র্যান্ড হলেও, চীনা নির্মাতা ও ব্যাটারি নির্মাতারা উৎপাদনের পরিমাণ (production volume), মূল্যসাশ্রয় (affordability), আর সাপ্লাই চেইন নিয়ন্ত্রণে (supply chain control) আরও এগিয়ে। ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী নতুন ইভি বিক্রির (number of new electric cars sold) ক্ষেত্রে চীন যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ (EU) দু’টির চেয়ে এগিয়ে; এমনকি ইউএস আর ইইউকে একত্র করলেও চীনের সংখ্যা বেশি। কারণ, চীনে বিস্তৃত দামের গাড়ি তৈরি হয়—কম বাজেটের কমপ্যাক্ট থেকে উচ্চ-পারফরম্যান্স এসইউভি পর্যন্ত। বিভিন্ন ব্র্যান্ড যেমন BYD, NIO, Xpeng, SAIC Motor বহুরকম গাড়ি বানায়। এছাড়া এগুলো কেবল চীনের মধ্যেই নয়, আন্তর্জাতিগত বাজারেও সম্প্রসারণ শুরু করেছে, তাও তুলনামূলক কম খরচে, ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে এগিয়ে থেকেই।

চীনের চ্যালেঞ্জ

চীন যদিও নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তিতে (renewable energy technology) বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তাদের কিছু বড় সমস্যাও আছে:

১. এখনও ব্যাপক জীবাশ্ম-নির্ভরতা: চীনের নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়লেও, তারা এখনো ব্যাপকভাবে কয়লা ও অন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। এটি কার্বন নিঃসরণ (carbon emissions) ও পরিবেশগত ক্ষতিসাধন করছে।  চীনের জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের হার কমলেও, যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় তা এখনো বেশি। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রও এখনও জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

২. অতিরিক্ত উৎপাদনক্ষমতা (Overcapacity): চীনের সৌর প্যানেল মডিউল তৈরির ক্ষমতা (solar module production capacity) অনেক সময় অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক চাহিদার চেয়েও বেশি। যদিও রপ্তানির মাধ্যমে কিছুটা শোষিত হয়, তবুও অতিরিক্ত সরবরাহ (overcapacity) এই শিল্পের জন্য চ্যালেঞ্জ। বেশি উৎপাদন মানেই দাম কমে যেতে পারে (downward pressure on prices), যা ছোট বা প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা কোম্পানিগুলোকে বাজার থেকে বিদায় নিতে বাধ্য করতে পারে। হঠাৎ কারখানা বন্ধ, দেউলিয়া, শ্রমিক ছাঁটাই—এসব অস্থিরতা দেখা দেয়।

৩. বাণিজ্য বিরোধ (Trade disputes): চীনের এই আধিপত্য প্রায়ই বাণিজ্য বিরোধ (trade disputes) ডেকে আনে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র (U.S.) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ বারবার চীন থেকে আমদানি করা সৌর পণ্য (Chinese solar products)-এর ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক (anti-dumping duties) বা অনুরূপ ব্যবস্থা এনেছে। এ কারণে চীনা রপ্তানিকারকরা কখনো তৃতীয় দেশে কারখানা স্থাপন করে পরোক্ষভাবে পণ্য পাঠায়, যাতে শুল্ক এড়াতে পারে। শুধু সৌরখাতেই নয়, এমন শুল্ক-সংঘাত (tariff conflict) পুরো নবায়নযোগ্য খাতের গতি প্রভাবিত করতে পারে।

উপসংহার

যদিও চীনের পরিচ্ছন্ন জ্বালানি উদ্যোগ (clean energy sector) এখনো অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে, তবু দেশে-বিদেশে বিরাট বিনিয়োগ (massive investments) ও শিল্প-পরিকাঠামো (industrial infrastructure) গড়ার ফলে তারা বিশ্বে নবায়নযোগ্য শক্তির (renewable energy) বেশ কয়েকটি খাতে স্পষ্টতই শীর্ষস্থানীয়। সৌর প্যানেল, ব্যাটারি, ইভি—সবখানেই চীন নেতৃত্ব দিচ্ছে।

অবশ্য চীনের নিরবচ্ছিন্ন জীবাশ্ম ব্যবহারের (heavy fossil fuel usage) বিষয়টা নবায়নযোগ্য সাফল্যের ছায়ায় চাপা পড়ে না। তারা একদিকে বিশ্বে সর্বোচ্চ কার্বন নিঃসরণ করে, অন্যদিকে নবায়নযোগ্য ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় উৎপাদনকারী। দুটো বাস্তবতা পাশাপাশি চলছে। অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা (overcapacity), বাণিজ্য বিরোধ (trade disputes) ইত্যাদিও গুরুতর সমস্যা।

তারপরও চীনের নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে নেতৃত্ব আগামীতে আরও দৃঢ় হতে পারে, কারণ সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলো বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ করে যাচ্ছে, প্রযুক্তি উন্নত করছে, আর বিশ্বজুড়ে বাজার ধরতে আগ্রহী। বিশ্বের শতাধিক দেশে তারা সৌর প্যানেল, ব্যাটারি ইত্যাদি রপ্তানি করছে; ইভি কোম্পানিগুলোও বহির্বিশ্বে প্রসার করছে। ফলে চীন এই খাতে এগিয়ে থাকবে কি না, সেটা দেখতে হলে কীভাবে তারা জীবাশ্ম জ্বালানির নির্ভরতাও কমিয়ে আনতে পারে, তা গুরুত্বপূর্ণ। সময়ই বলবে, এই নেতৃত্ব কতটা স্থায়ী হয় এবং জলবায়ু (climate) ও বৈশ্বিক বাজারে (global market) কী প্রভাব ফেলে।

বিশ্বের বিভিন্ন ব্যবসা সম্পর্কে অন্যান্য সংবাদ ও বিশ্লেষণের জন্য যান এখানে – ব্যবসা সংবাদ

চীন সম্পর্কিত অন্যান্য সংবাদ ও বিশ্লেষণের জন্য যান এখানে – চীন সংবাদ

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.