এআই নিয়ে নেটফ্লিক্সের উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা

ভূমিকা

অনেক হইচই চলছে—ভালো ও খারাপ উভয় দিক থেকেই। প্রশ্ন হচ্ছে এটি কীভাবে বিনোদনশিল্পকে (entertainment industry) প্রভাবিত বা রূপান্তরিত (transform) করবে। আমার মনে হয়, ক্রিয়েটরদের (creators) জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই নতুন টুলগুলো কী, কী করতে পারে—এসব নিয়ে সর্বদা কৌতূহলী থাকা।”

সম্প্রতি নেটফ্লিক্স (Netflix)-এর কো-সিইও (co-CEO) টেড সারান্ডোস (Ted Sarandos), কোম্পানির ত্রৈমাসিক (Q3) আয়-সংক্রান্ত আলোচনায় (earnings call) যখন এআই (AI)-এর প্রভাব প্রসঙ্গে বলছিলেন, তখন এই কথাগুলো উল্লেখ করেন। তিনি আশাবাদী হলেও সাবধানী; তার যুক্তিঃ

“AI-কে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় পাশ করতে হবে: এটি কি বাস্তবেই ভালো শো (shows) ও ভালো সিনেমা (films) তৈরি করতে সাহায্য করতে পারবে?”

হলিউড (Hollywood) ইদানীং এই প্রশ্নটিই ঘুরেফিরে দেখছে। সৃজনশীল (creatives) লোকজন উদ্বিগ্ন—স্টুডিও (studios) যদি এআইয়ের মাধ্যমে অতিরিক্ত অভিনেতা (background actors) বাদ দিয়ে মাঝারি মানের স্ক্রিপ্ট তৈরির চেষ্টা করে, তারপর মানব লেখকদের (human writers) কম মজুরিতে সেটাকে পুনর্লিখন করায়, বা অন্য উপায়ে ব্যয় কেটে নেয়, তবে কী হবে? এ কারণেই সাম্প্রতিক হলিউড ধর্মঘটগুলোর (Hollywood labor strikes) কেন্দ্রে ছিল AI। সম্ভবত সেকারণেই সারান্ডোস বিষয়টি আলতোভাবে বলেছেন—নেটফ্লিক্স চায় নতুন প্রযুক্তি যেন কনটেন্টকে “ভালো” করে তোলে, “সস্তা” নয়।

শেষে সারান্ডোস বলেন, “যে কোনো টুল, যা গুণগত মান (quality) আরও উন্নত করবে, শো ও সিনেমাকে ‘ভালো’ করবে, সেটি শিল্পকে (industry) প্রচুর সাহায্য করবে।”

কিন্তু নেটফ্লিক্সের কাছে এটি নিছক দর্শন নয়; এটি কার্যকর বাস্তবতা। গত তিন মাসে নেটফ্লিক্সের চাকরির (job) বিজ্ঞপ্তি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তারা বিভিন্ন কাজে—লাইভ ক্যাপশনিং (live captioning), ব্যক্তিগতকরণ (personalization), কনটেন্ট প্রডাকশন (content production)—এলএলএম (LLM) বা লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল ও জেনারেটিভ এআই (generative AI) ব্যবহার পরিকল্পনা করছে। এমনকি অভ্যন্তরীণভাবে একটি এআই প্ল্যাটফর্ম (AI platform) বানানোর কথা উল্লেখ আছে, যাতে পুরো কোম্পানিতে জেনারেটিভ এআই অ্যাপ্লিকেশন (generative AI applications) তৈরি করা যায়।

১. অতীতের মেশিন লার্নিং ও বর্তমানের এলএলএম গ্রহণ

নেটফ্লিক্স বহুদিন ধরেই নিজেকে প্রযুক্তি কোম্পানি হিসেবে গড়ে তুলেছে, পরে স্ট্রিমিং ও হলিউডে এক প্রভাবশালী পরাশক্তি হয়েছে। তারা দীর্ঘদিন যাবৎ এআই ও মেশিন লার্নিং (machine learning) ব্যবহার করে আসছে—বিশেষ করে রিকমেন্ডেশন সিস্টেম (recommendations) কিংবা ব্যক্তিগতকরণে। নেটফ্লিক্স অ্যাপ খোলামাত্র আপনি যেসব ব্যক্তিগত সাজেশন (personalized suggestions) দেখেন, সবই মূলত মেশিন লার্নিংয়ের ফসল।

কিন্তু এখন তারা আরও এক ধাপ এগিয়ে, এলএলএম (LLM) ও জেনারেটিভ এআই (generative AI)-র সর্বশেষ অগ্রগতি কাজে লাগাতে চাইছে। বেশ কয়েকটি সাম্প্রতিক জব লিস্টিংয়ে বলা আছে, সার্চ (search) ও ব্যক্তিগতকরণ (personalization)-এ এলএলএম প্রয়োগ হবে।

  • যেমন, এক জব লিস্টিংয়ে বলা, “জেনারেটিভ এআই ও এলএলএমের (LLMs) দ্রুত অগ্রগতিতে এখন নেটফ্লিক্স পণ্যের সার্চ ও সুপারিশ (Search and Recommendations) অভিজ্ঞতা বদলে যাচ্ছে—কনটেন্ট আবিষ্কার (content discovery) এবং সদস্যদের জন্য ব্যক্তিগতকরণে (personalization) নতুন সুযোগ আসছে।” সেখানে আরও বলা, এই টিমটি “এলএলএম, এনএলপি (NLP) এবং মেশিন লার্নিং (Machine Learning)-এর অগ্রভাগে থেকে গবেষণা ও উদ্ভাবন করবে।”
  • আরেকটি লিস্টিংয়ে উল্লেখ করা হয়, “আমরা এক্সসেপশনাল অ্যাপ্লায়েড রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার খুঁজছি, যিনি এলএলএম (LLM)-সংশ্লিষ্ট সর্বশেষ উন্নয়ন কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের সার্চ ও রেকমেন্ডেশন অভিজ্ঞতা গড়ে তুলতে সাহায্য করবেন।”

২. এআই দিয়ে ক্যাপশনিং (Captioning) ও লোকালাইজেশন (Localization)

নেটফ্লিক্স বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়: Squid Game, Casa de Papel ইত্যাদি বিভিন্ন দেশে হিট। ফলে বহু ভাষায় (multilingual) সাবটাইটেল, ডাবিং (dubbing), UI লোকালাইজেশন দরকার হয়। এখন এআই দিয়ে এগুলো আরও ত্বরান্বিত করতে চায়।

  • এক জব লিস্টিং-এ বলা, “আমরা অভিজ্ঞ রিসার্চ সায়েন্টিস্ট (Research Scientist) খুঁজছি, যিনি মাল্টিমডাল এলএলএম (Multimodal LLM) নিয়ে কাজ করে স্কেলের মধ্যে উচ্চগুণমানের লোকালাইজেশন (localization) অর্জনে সহায়তা করবেন। এটাই সেই বিরল সুযোগ, যেখানে আপনি গবেষণা করবেন কীভাবে মেশিন লার্নিং (Machine Learning) ব্যবহার করে ‘লোকালাইজেশন’ ও গ্লোবাল এন্টারটেইনমেন্টকে (global entertainment) উন্নত করা যায়।”
  • আরেকটি জব লিস্টিং-এ সরাসরি “মাল্টিলিঙ্গুয়াল লাইভ ক্যাপশন ও অনুবাদ (Multilingual Live Caption and Translation) মডেল” তৈরির কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ লাইভ ক্যাপশনিং (live captioning) নিয়ে সামনের দিনগুলোতে এআই পরীক্ষণ/বাস্তবায়ন হবে।

৩. কনটেন্ট প্রডাকশনে (Content Production) এআই: স্পর্শকাতর আলোচনার ক্ষেত্র

হলিউডের অনেকেই শঙ্কিত—এআই কি অভিনেতাদের (actors), অতিরিক্ত (extras) বা লেখকদের (writers) বদলে দেবে? নেটফ্লিক্সের সাম্প্রতিক জব লিস্টিংয়ে এমন কিছু সরাসরি লেখা নেই, তবে এ-ও স্পষ্ট যে তারা প্রোডাকশনের নানা ধাপ এআই দিয়ে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছে।

  • বহু বছর ধরেই নেটফ্লিক্স নিজস্ব অ্যাপ বানায়, যাতে হলিউডের কাজকর্মে পরিবর্তন আসে (যেমন কাগুজে সময়সূচির বদলে ডিজিটাল পদ্ধতি)। এখন এক নতুন জব লিস্টিংয়ে বলে, “ক্রিয়েটিভদের (creatives) কর্মপ্রবাহে এআই যুক্ত করে নতুন সৃজনশীল সম্ভাবনা আনলক (unlock new creative possibilities) করতে চাই এবং কনটেন্ট সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় (content creation process) দক্ষতা (efficiency) বাড়াতে চাই।”
  • আরেকটি নির্দিষ্ট তালিকায় (listing) জেনারেটিভ এআই (generative AI) ভিত্তিতে সিজিআই (CGI) উন্নয়নের কথা আছে। বলা হয়েছে: “আপনি জেনএআই (GenAI) মডেলকে আর্টিস্টদের ওয়ার্কফ্লোতে (artists’ workflows) সংযুক্ত করবেন, যা সৃষ্টিশীল সুযোগ (creative opportunities) বাড়াবে।” এখানে ইমেজ/ভিডিও জেনারেটিভ এআই (image/video generative AI) সম্পর্কে দক্ষতা থাকলে বিশেষ সুবিধা পাওয়া যাবে।

৪. নিজস্ব এআই অবকাঠামো (AI infrastructure) তৈরি করছে নেটফ্লিক্স

এতসব কাজে নেটফ্লিক্স শুধু ওপেনএআই বা জিপিটি (GPT)-র ওপর ভরসা করবে না; বরং তারা নিজস্ব এআই প্ল্যাটফর্ম তৈরির পথে।

  • এক জব লিস্টিংয়ে লেখা, “আমরা জেনারেটিভ এআই-চালিত অভিজ্ঞতা তৈরি করতে যেসব কাজ দরকার, সেই ‘ভারী বোঝা’ (heavy lifting) আমরা বইছি, যাতে কোম্পানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করা যায়।” সেই প্রোডাক্ট ম্যানেজারকে বলা হয়েছে “মডেল কনজাম্পশন লেয়ার (model consumption layer), কথোপকথনমূলক অ্যাসিস্ট্যান্ট (conversational assistants), এলএলএম অপস (LLMOps), প্রম্পট ম্যানেজমেন্ট (prompt management), প্রোটোটাইপিং টুল (prototyping tools) এবং এআই অ্যাপ উন্নয়ন ফ্রেমওয়ার্ক” পরিচালনা করতে হবে।
  • অন্য একটি তালিকায় ইঞ্জিনিয়ারদের কাজ হবে “থার্ড-পার্টি এলএলএম ও অভ্যন্তরীণ ফাইন-টিউনকৃত এমএল (ML) মডেলের জন্য এপিআই (APIs) ডিজাইন, বিল্ড ও ডিপ্লয়,” এবং “জেনএআই (GenAI) অ্যাপ বানানোর জন্য ফ্রেমওয়ার্ক ও কম্পোনেন্ট ডেভেলপ” করা।

এর মধ্যে কিছু অ্যাপ হয়তো গ্রাহক-সম্মুখীন (consumer-facing) হবে না; “N-Tech” নামের একটি টিম অভ্যন্তরীণ এন্টারপ্রাইজ অ্যাপ তৈরি করে। তারা কোম্পানির বিভিন্ন বিভাগে এআই ও জেনএআইকে “দায়বদ্ধভাবে (responsibly)” প্রয়োগ করবে, এমনটিই বলা আছে।

৫. অতীতের সাফল্য এবং নেটফ্লিক্সের নতুন লক্ষ্যমাত্রা

এআই এখন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে রেখেছে। নেটফ্লিক্সের মতো বড় একটা প্রতিষ্ঠান যে এলএলএম (LLM) ও জেনারেটিভ এআই (generative AI) নিয়ে কাজ করতে চাইছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে নেটফ্লিক্সের উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো—তাদের “টেক ডিএনএ (tech DNA)”। তারা বহু আগেই স্ট্রিমিং প্রতিদ্বন্দ্বীরা ব্যবসায় নেমে পড়ার আগেই কিউরেশন/রিকমেন্ডেশনে মেশিন লার্নিং ব্যবহার করেছে। এখন তারা আবার এআই গবেষণায় আগ্রাসীভাবে (aggressively) নিয়োগ দিচ্ছে। এর মানে, আরেকবার তারা বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলতে পারে।

যদি এআই—চিত্র ধারণ, সৃজনশীল সম্পাদনা, ট্রান্সলেশন, ব্যক্তিগতকরণ ইত্যাদি—সবখানেই মূল ভূমিকা নেয়, নেটফ্লিক্স সময়ের আগেই প্রস্তুত হতে চায়। তবে হলিউডের প্রথাগত শ্রম (labor) ও সৃজনশীলতার প্রশ্নগুলোয় কী প্রভাব পড়বে, সেটাই দেখার। সারান্ডোস বলেছেন, তারা শো আর সিনেমাকে “উন্নততর” করতে চান, “সস্তা” বানাতে নয়। ভবিষ্যৎ বলে দেবে, নেটফ্লিক্স এ ক্ষেত্রে কীভাবে ভারসাম্য রাখে।

উপসংহার

সব মিলিয়ে, নেটফ্লিক্স “এআই সর্বত্র” (AI everywhere)—এই নীতিতে অগ্রসর হচ্ছে। এলএলএম ও জেনারেটিভ এআইকে ব্যবহার করে সার্চ, রেকমেন্ডেশন, ক্যাপশনিং, লোকালাইজেশন থেকে শুরু করে সিজিআই প্রোডাকশন পর্যন্ত বিস্তৃত পরিসরে নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে। এর জন্য তারা নিজস্ব এআই প্ল্যাটফর্মও তৈরির পরিকল্পনা করছে, যেখানে অভ্যন্তরীণ ও তৃতীয়-পক্ষের (third-party) বড় ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল (large language model) ব্যবহারের এপিআই (API) ইত্যাদি থাকবে।

হয়তো তারা ইতিমধ্যে জিপিটি বা অন্যান্য এআই সেবা ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু বড় কোম্পানি হিসেবে তারা নিজস্ব পরিকাঠামো গড়ে তুলতে চায়—মডেল ম্যানেজমেন্ট, এআই অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট থেকে শুরু করে কাস্টমাইজেশন পর্যন্ত। নেটফ্লিক্স যা করছে, সেটি নতুন নয়—তবে তারা অন্যদের তুলনায় বেশি দ্রুতগতিতে করায় আরেকবার “এআই-ভিত্তিক স্ট্রিমিং নেতা” হওয়ার সম্ভাবনা। হলিউডের ট্রেন্ড যেদিকে যাক, নেটফ্লিক্স আপাতত সময়ের আগেই এই পথ পরিকল্পনা করছে।

তথ্যসূত্র

Netflix’s ambitious AI plans

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.