Table of Contents
ভূমিকা
২০১৮ সালে, যুক্তরাষ্ট্র (United States) বিশ্বের বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়। এর এক বছর পরেই তারা সর্বকালের রেকর্ড ভেঙে দৈনিক ১২.৩ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন করতে সক্ষম হয়—যা পূর্বে বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী অসম্ভব বলে মনে করা হয়েছিল। কোভিড-১৯ মহামারির সময় তেলের দাম স্বল্প সময়ের জন্য নেতিবাচক হয়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের তেল উৎপাদন আবারও বৃদ্ধি পেতে থাকে। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো, গত এক দশকে দেশটিতে তেল রিগের (Oil Rigs) সংখ্যা কমতে থাকা সত্ত্বেও উৎপাদন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
মাত্র দশকের ব্যবধানে রাশিয়া (Russia) ও সৌদি আরব (Saudi Arabia)-এর মতো ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে বৈশ্বিক তেলশক্তির নেতৃত্বে। আমদানি-নির্ভরতা থেকে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তারা হয়ে উঠেছে বিশ্বের প্রভাবশালী তেল-সুপারপাওয়ার (Oil Superpower)। এমনকি ১৯৪০-এর দশকের পর প্রথমবারের মতো দেশটি এখন নেট রপ্তানিকারক (Net Exporter)। অতীতে তেল আমদানির জন্য যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই ভঙ্গুর (Geopolitically Tenuous) সরবরাহকারীদের ওপর নির্ভর করত, যারা ইচ্ছে হলেই তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারত। কিন্তু আজ যুক্তরাষ্ট্র একই সঙ্গে বিশ্বের বৃহত্তম তেল উৎপাদক ও ভোক্তা—বিশ্ববাজারে শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখছে এবং ওপেক (OPEC: Organization of Petroleum Exporting Countries)-এর মতো সংঘের বাজার নিয়ন্ত্রণের সম্ভাব্য প্রভাব থেকেও অনেকাংশে সুরক্ষিত।
তেলের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের এই পুনরুত্থান (Renaissance) দেশের শিল্প খাত ও সাধারণ মানুষের জ্বালানি নিরাপত্তা (Energy Security) জোরদার করেছে। এটি অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার মানকে সহায়তা করছে এমন এক সময়ে, যখন জ্বালানি নিরাপত্তা সরকারি এজেন্ডাগুলোর শীর্ষে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, নিজেরা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি তেল উৎপাদন করার পরও যুক্তরাষ্ট্র এখনও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক (Importer)। আর বাস্তব সত্য হলো, তেল একটি সীমিত সম্পদ (Finite Resource)। পূর্বানুমান অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের হাতে প্রায় ১১ বছরের সমপরিমাণ তেল-সংরক্ষণ (Reserves) অবশিষ্ট থাকতে পারে। সুতরাং এত দ্রুত হারে তেল উত্তোলন চললে কত দিন এভাবে উৎপাদন বজায় রাখা সম্ভব? এর সঙ্গে পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির (Renewable Energy) ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা তো রয়েই গেছে।
এই প্রেক্ষাপটে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়:
- কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র সর্বকালের বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী হয়ে উঠল?
- এত তেল উৎপাদনের পরও যুক্তরাষ্ট্র কেন এত তেল কিনছে?
- বাস্তবিক অর্থে এই উচ্চপর্যায়ের উৎপাদন কত দিন অব্যাহত থাকবে?
তেল উৎপাদন প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব সম্পর্ক
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের তেল উৎপাদনের উচ্চপর্যায় দেখে মনে হতে পারে এটি নতুন কোনো ঘটনা। কিন্তু আসল গল্পটি কিছুটা অন্য রকম। বর্তমান বৈশ্বিক শক্তি সরবরাহের ক্ষেত্রে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রকে যেরকম প্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থায় দেখা যায়, দেশ দুটো কখনোই এমন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। আসলে তেলের বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সম্পর্ক প্রায় ১০০ বছরের পুরনো, এবং শুরুতে তা ছিল পারস্পরিক লাভজনকতার ভিত্তিতে। মহামন্দা (Great Depression) কাটিয়ে ওঠার সময় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি যখন দ্রুতগতিতে শিল্পায়িত হচ্ছিল, তখন জ্বালানির চাহিদা বাড়তে থাকে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের তেল কোম্পানিগুলো বিদেশি উৎসে তেল খুঁজতে ঝুঁকে পড়ে।
এরপর আসে ১৯৩২ সাল। মধ্যপ্রাচ্যের (Middle East) চারটি অঞ্চলকে একীভূত করে ইবনে সাউদ (Ibn Saud) নামে এক শাসকের অধীনে জন্ম নেয় নতুন একটি দেশ—যা আজকের সৌদি আরব। সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজ্যটি উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের স্বপ্ন দেখছিল। তাই ১৯৩৩ সালে সৌদি আরব স্ট্যান্ডার্ড অয়েল অব ক্যালিফোর্নিয়াকে (Standard Oil of California) তাদের ভূখণ্ডে তেল অনুসন্ধানের অধিকার দেয়। এর মাধ্যমেই তৈরি হয় ক্যালিফোর্নিয়া-আরাবিয়ান স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি, যা পরে অ্যারাবিয়ান-আমেরিকান অয়েল কোম্পানি নাম নেয়। সংক্ষেপে যার নাম—আরামকো (Aramco)। আজকের দিনে সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি (State Control Industry) আরামকো একসময় ১০০% আমেরিকান মালিকানাধীন ছিল, এবং এর নামেই সেই ঐতিহাসিক বন্ধনের ছাপ রয়ে গেছে।
১৯৩৮ সালে প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় এবং এর পরবর্তী কয়েক দশক ধরে সৌদি আরবের তেলশিল্প দ্রুত প্রসারিত হয়। এ সময়টি ছিল সৌদি সরকারের, যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় তেল কোম্পানি এবং মার্কিন সরকারের পরস্পর নির্ভরশীলতার যুগ—সৌদি শাসকের নিরাপত্তায় (Military Protection) সাহায্য করত যুক্তরাষ্ট্র, আর বিনিময়ে তারা পেত তেল। কিন্তু সৌদিরা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে যে তাদের কাছে বিশাল সম্পদ রয়েছে, আর এ সম্পদ অন্যের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তারা নারাজ। ফলে ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে তেলের মালিকানা আস্তে আস্তে মার্কিন কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সৌদি সরকারের হাতে চলে যায়। সৌদির তেলমন্ত্রী আহমেদ জাকি ইয়ামানি (Ahmed Zaki Yamani) এই পথনির্দেশনা দিয়েছিলেন।
সে সময় শুধু সৌদিতেই নয়, আরও অনেক দেশে—যেমন ভেনেজুয়েলা (Venezuela), লিবিয়া (Libya), ইরাক (Iraq), কুয়েত (Kuwait)—তেলশিল্প জাতীয়করণ চলছিল। একই সময়ে, সৌদি আরব সোভিয়েত ইউনিয়নের (Soviet Union) প্রভাব থেকেও রেহাই পাচ্ছিল না। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে সোভিয়েতরা নিজেদের স্যাটেলাইট রাষ্ট্রগুলো (Satellite States)—পূর্ব ইউরোপ (Eastern Europe), উত্তর কোরিয়া (North Korea), কিউবা (Cuba)—এসব জায়গায় তেল সরবরাহ করত। সেই বাড়তি তেল তারা বিশ্ববাজারে ছেড়ে দিয়ে দাম কমিয়ে দিত। এতে সৌদির রপ্তানি (Export) আয়ে চাপ পড়ে। সৌদিরা এই অতিরিক্ত সরবরাহের প্রতিক্রিয়ায় অন্যান্য বড় তেল-রপ্তানিকারী দেশের সঙ্গে সমন্বয় শুরু করে, যাতে তারা নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলো পুরণ করতে পারে। এভাবেই ১৯৬০ সালে তৈরি হয় অর্গানাইজেশন অব পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ (OPEC), যা আজকের দিনে বিশ্বের প্রমাণিত তেল মজুদের (Proven Oil Reserves) ৮০%-এর বেশি উত্তোলনের হার নিয়ন্ত্রণ করে।
১৯৭৩-এর আরব অয়েল এমবার্গো, নিক্সনের ‘প্রজেক্ট ইন্ডিপেনডেন্স’ ও ব্যর্থতা
১৯৭৩ সালে আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে ইয়ম কিপুর যুদ্ধ (Yom Kippur War) চলাকালীন, মিশর (Egypt) ও সিরিয়ার (Syria) বিপরীতে ইসরায়েলকে (Israel) পশ্চিমা বিশ্বের সামরিক সহায়তার প্রতিবাদে সৌদি আরব এবং অন্যান্য আরব ওপেক দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে তেল এমবার্গো (Embargo) বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলস্বরূপ তখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম দ্রুত আকাশচুম্বী হয়, মার্কিন ব্যবসাগুলো তেল-সংকটে ধুঁকতে থাকে, আর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। দৈনন্দিন জীবনে দেখা যায়, পেট্রোল স্টেশনে সংকট দেখা দেয়। ড্রাইভিংয়ের গতি-সীমা (Speed Limit) ৫৫ মাইল-এ নামিয়ে আনতে হয়। এর ছয় বছর পর ইরানে (Iran) বিপ্লব দেখা দিলে আরও একবার বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বেড়ে যায়। এটি ছিল প্রথমবারের মতো, কিন্তু শেষবার নয়, যখন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর মধ্যপ্রাচ্যের তেলনির্ভরতাকে নগ্নভাবে প্রকাশ করে দিল।
১৯৭৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (United States) প্রেসিডেন্ট এমন একটি কাজ করেছিলেন, যা সে সময় “অচিন্তনীয়” বলে বিবেচিত হয়েছিল। তিনি আক্রমণ করেছিলেন আমেরিকার সবচেয়ে পবিত্র প্রতীকগুলোর একটিকে। আর সেটা ছিল গাড়ি (automobile)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সাবারবান-বুম (suburban boom) চলাকালীন, অর্থাৎ একের পর এক উপশহর গজিয়ে উঠছিল যখন, তখন জাতীয় টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সময়, নিক্সন (Nixon) নাগরিকদেরকে (যারা কিনা অত্যন্ত স্বাধীনতাপ্রেমী ও অধিক জ্বালানি ব্যবহারকারী (gas-guzzling)) কারপুল (carpool) করতে—অথবা বিশ্বাস করা আরও কঠিন যেটা – প্রয়োজন হলে গণপরিবহন (public transit) ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলছিলেন, “আমি আজ রাতে আপনাদের সঙ্গে একটি জাতীয় সমস্যার বিষয়ে কথা বলতে চাই। কতবার আপনারা মহাসড়ক বা ফ্রিওয়ে দিয়ে গিয়েছেন আর দেখেছেন, শত শত গাড়ি চলছে, কিন্তু প্রতিটিতে মাত্র একজন করে মানুষ?”
নিক্সন সেসময় যা করেছিলেন, আজকের দিনে কোনো রাজনীতিবিদ সেটি করার সাহস পেতেন না: একটি জাতীয় গতিসীমা (speed limit) নির্ধারণ করেছিলেন, যা ছিল ঘণ্টায় মাত্র ৫৫ মাইল। এটা পরিবেশের প্রতি আকস্মিক সহমর্মিতা বা আমাদের সম্মিলিত স্বাস্থ্যের ব্যাপারে উদ্বেগ ছিল না। বরং এটা ছিল এক জরুরি অবস্থা—একটি জ্বালানি-সংকট (energy emergency)। সৌদির (Saudi Arabia) নেতৃত্বে একটি তেল-নিষেধাজ্ঞা (oil embargo) আরোপিত হওয়ায় সিয়াটল (Seattle) থেকে সাভানা (Savannah) পর্যন্ত বহু পেট্রোল পাম্পে তেল বলতে গেলে ছিলই না। আর পর্যাপ্ত তেল ছাড়া, দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকার যে সমৃদ্ধ জীবনধারা (lifestyle of abundance) চর্চিত হচ্ছিল, তা হঠাৎ করেই থেমে গিয়েছিল।
এতে আমেরিকার মতো একটি সুপারপাওয়ার (superpower) প্রথমবারের মতো তার দুর্বলতার মুখোমুখি হয়েছিল। তারা প্রতিজ্ঞা করেছিল যে এ রকম অবস্থা আর কখনোই হতে দেওয়া যাবে না। তাই নিক্সন ঘোষণা করলেন “প্রজেক্ট ইন্ডিপেনডেন্স” (Project Independence)। তিনি বলেছিলেন, ১৯৮০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র অন্য কোনো দেশের ওপর জ্বালানির (energy) জন্য নির্ভর করবে না।
তবে বাস্তবে তা ঘটেনি। নিক্সন যে “এনার্জি রেনেসাঁ” (energy renaissance) কথা দিয়েছিলেন, সেই প্রতিশ্রুতির ফলাফল হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। তেল-সংকটের (oil crisis) পর আমেরিকার জন্য শুরু হলো এক পতনের পর্ব—এটি ছিল বিজ্ঞানী এম. কিং হাবার্ট (M. King Hubbert) প্রদত্ত ১৯৫৬ সালের একটি চাঞ্চল্যকর পূর্বাভাসের বাস্তব রূপ, যার নাম “পীক অয়েল” (peak oil)। এই ধারণা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত তেলের (crude oil) উৎপাদন প্রায় ১৯৭০ সালের দিকে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাবে, তারপর তা দ্রুতহারে কমতে থাকবে। তখন যে সামান্য তেল বাকি থাকবে, সেটি তুলতে একপ্রকার দৌড়ঝাঁপ শুরু হবে।
কিন্তু এখন পীক অয়েলকে আমরা একরকম মজার ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবেই দেখি—যেমন উড়ন্ত গাড়ি (flying cars) বা অতিজনসংখ্যা (overpopulation) নিয়ে অতীতে ভয় পাওয়া হতো। তেলের সর্বনাশ বা “অয়েল অ্যাপোক্যালিপস” (oil apocalypse) যদি এসে থাকে, তাহলে আমেরিকানরা সেটি টের পায়নি। আজ আমেরিকানরা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি বড় এসইউভি (SUV) ও ট্রাক চালায়। তবে উৎপাদনের হিসাব দেখলেই পার্থক্য বোঝা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের (lower 48 states) তেল উৎপাদন দেখলে দেখা যায়, সেখানে পীক অয়েল সত্যি ছিল। ১৯৭০ সালে সর্বোচ্চ উৎপাদনের পর তা হুবহু পূর্বাভাস অনুযায়ী কমতে থাকে—১৯৭০ সালে ১১ মিলিয়ন ব্যারেল প্রতিদিন থেকে ২০০৮ সালে মাত্র ৭ মিলিয়ন ব্যারেল প্রতিদিনে পৌঁছায়। অন্যদিকে, “প্রজেক্ট ইন্ডিপেনডেন্স” একেবারে ব্যর্থ হয়েছিল—ছয় বছরের মধ্যেই তেল আমদানি (imports) দ্বিগুণ হয়ে যায়। এমনকি ১৯৭৬ সালের তুলনায় ২০০৬ সালে সৌদি আরব থেকে যুক্তরাষ্ট্র আরও বেশি তেল কিনেছিল। তারপর কিছু একটা পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে।
যাই হোক, এই দুর্যোগ সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্র দেশের অভ্যন্তরীণ তেলের ওপর ৪০ বছরের জন্য রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা (Export Ban) দেয়। সৌদি আরব বিশ্বকে দেখিয়ে দিল যে তারাই প্রধান তেল-ক্ষমতা এবং বিশ্বপরিস্থিতিকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে তারা নির্দ্বিধায় নিষেধাজ্ঞা ব্যবহার করতে পারে। পরবর্তী কয়েক দশক এভাবেই চলতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের (Collapse of the USSR) আগে এবং পরে, রাশিয়ায় (তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন) তেল উৎপাদন কমতে থাকে—বিশেষত ১৯৮০-এর দশকের শেষ ভাগ থেকে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত—যার ফলে ওপেকের হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ আরও মজবুত হয়।
এদিকে, ওপেকের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে যেন আর বিপাকে পড়তে না হয়, যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি আমদানি (Import) বৈচিত্র্যময় করার কৌশল নেয়। তাদের অভ্যন্তরীণ তেল উৎপাদনও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে বিশ্লেষক ও সামরিক বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছিলেন—যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি নিরাপত্তা (Oil Security) এবং বিদেশি জ্বালানি উৎপাদনের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনতা তাদের একটি প্রধান দুর্বলতা হয়ে উঠেছে। অনেকে মনে করেন, ২০০৩ সালে ইরাকে (Iraq) মার্কিন হামলার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল ইরাকের তেলক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। কারণ ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সেখানে মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোর কাজ করার সুযোগ ছিল না। পরবর্তীতে সেখানে হলিবার্টন (Halliburton) নামের একটি তেল পরিষেবা কোম্পানি—যার সঙ্গে তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির (Dick Cheney) সংশ্লিষ্টতা ছিল—তারা আবারও কাজ শুরু করে।
রাষ্ট্রীয়ভাবে তখন যুক্তরাষ্ট্র বলছিল, ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হুসেইনের (Saddam Hussein) কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র (Weapons of Mass Destruction) আছে এবং তিনি বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে দাবির কোনো প্রমাণ মেলেনি। যাই হোক, ইরাকে ঢোকার পর যুক্তরাষ্ট্র ইরাকি তেল-আমদানি বাড়ানোর সুযোগ পেল। যদিও এর ফলে বাইরের তেলের ওপর মার্কিন নির্ভরশীলতা বড় কোনো পরিবর্তন হয়নি।
তো, সব মিলে ১৯৭০ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৮ বছর দেশটির তেল উৎপাদন ক্রমাগত হ্রাস পায়। এ সময় বিশ্ববাণিজ্য আরও আন্তঃসম্পর্কিত হয়ে উঠছিল, বাণিজ্য সংক্রান্ত বিধিনিষেধও কমছিল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সহজে উত্তোলনযোগ্য তেলের মজুদ (Easily Accessible Reserves) কমে আসতে থাকে। ফলে তেল আমদানি করা তুলনামূলক সাশ্রয়ী হয়ে দাঁড়ায়—বিশেষ করে কানাডা (Canada), ভেনেজুয়েলা (Venezuela), মেক্সিকো (Mexico), সৌদি আরব এবং ইরাক (Iraq)-এর মতো দেশে তেল সহজলভ্য ও কম খরচে উত্তোলনযোগ্য ছিল। যদিও এই আমদানি-নির্ভরতা পুরোপুরি নিরবচ্ছিন্ন ছিল না। ওপেক (OPEC)-এর মতো সংস্থা তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেখিয়ে দেয়।
জর্জ বুশের ভবিষ্যদ্বাণী, শেল (Shale) বিপ্লবের সূচনা ও অপ্রত্যাশিত জ্বালানি পুনর্জাগরণ
২০০৭ সালে, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (George Bush) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র কিছু প্রযুক্তিগত সাফল্যের (technological breakthroughs) দ্বারপ্রান্তে রয়েছে, যা আমাদের বিদেশি তেলের (foreign oil) উপর নির্ভরতা নাটকীয়ভাবে কমিয়ে দেবে। তবে সত্যি কথা বলতে, তখন তেমন কোনো কারণ ছিল না যে আমরা তার কথা বিশ্বাস করব। এর আগেও ৩০ বছর আগে রিচার্ড নিক্সন (Richard Nixon) একই রকম দাবি করেছিলেন, অথচ সেসময় যুক্তরাষ্ট্রের তেল ব্যবহার (oil consumption) প্রায় সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছিল। একই সময়ে, মার্কিন তেল উৎপাদন (US oil production) টানা চার দশক ধরে নিয়মিতভাবে হ্রাস পাচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে দেশটির অভ্যন্তরের অধিকাংশ সম্ভাব্য জায়গা থেকে তেল উত্তোলন শেষ করে ফেলেছিল, সমুদ্রের গভীরে খনন কাজও অনেক দিন ধরেই চলছিল, এমনকি আলাস্কার (Alaska) শেষ সঞ্চিত উৎস থেকেও প্রায় সবটুকু তেল তুলে নেওয়া হয়েছিল। ফলে তেলের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ এতটাই অন্ধকার মনে হচ্ছিল যে, তেল কোম্পানিগুলো হাজার হাজার মাইল দূরের সেন্ট্রাল এশিয়া (Central Asia), ওয়েস্ট আফ্রিকা (West Africa) ও সাউথ আমেরিকার (South America) মতো এলাকায় ‘সবুজ চারণভূমি’ খুঁজতে পাড়ি জমিয়েছিল।
পরিস্থিতি এমন ছিল যে, অঙ্ক কষলে নিশ্চিতভাবেই মনে হতো যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে কম নয়, বরং আরও বেশি পরিমাণে বিদেশি তেলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। কিন্তু সবার বিস্ময় সত্ত্বেও, বুশ (Bush) ঠিকই বলেছিলেন।
এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে, মধ্যপ্রাচ্যের (Middle East) ওপর তেল-নির্ভরতা যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতা হিসেবে গণ্য হতে থাকে। বিশেষ করে ২০০০-এর দশকে প্রেসিডেন্ট বুশের (Bush) ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ (War on Terror)’ শুরুর পর এটি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের তেল শিল্পের স্বপ্ন ছিল ঘরোয়া মাটিতেই “কঠিন শিলাস্তরে (Tight Rock Formations)” আটকে থাকা তেল উত্তোলন করা। তবে সেসবে কারিগরি (Technology) ও লাভজনকতার (Profitability) বড় সীমাবদ্ধতা ছিল।
দীর্ঘ দিন ধরেই তাই নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছিল। এরপর আসে ২১ শতকের hydraulic ফ্র্যাকিং (Fracking) আবিষ্কার ও শেল বুম (Shale Boom)। ২১শ শতকের শুরুর দিকে জর্জ মিচেল (George Mitchell) এবং বারনেট শেল (Barnett Shale) সংক্রান্ত গবেষণায় বড় ধরনের সাফল্য আসে। দেখা গেল শেল শিলাস্তর (Shale Rock) ভেঙে তেল ও গ্যাস উত্তোলন সম্ভব—একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে জল, বালি এবং রাসায়নিক (Chemicals) মিশ্রণ পাম্প করে শিলা ভেঙে ফেলে তেলের প্রবাহ তৈরি করা হয়, যাকে বলা হয় হাইড্রোলিক ফ্র্যাকিং (Hydraulic Fracking)। পরে এতে যোগ হয় অনুভূমিক খনন বা ড্রিলিং (Horizontal Drilling) প্রযুক্তি—ফলে একটিমাত্র কূপ থেকেই অনেক বেশি পরিমাণ তেল তুলতে শুরু করে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ তেল মজুদ এত বেড়ে গেল যে, ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা (Barack Obama) প্রায় ৪০ বছর পর কাঁচা তেল রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। যুক্তরাষ্ট্র আবার বড়সড় তেল রপ্তানিকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। কিন্তু একই সময় সৌদি আরবসহ বড় সব তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোও বিপুল পরিমাণে তেল সরবরাহ বাড়িয়ে দিচ্ছিল, যার ফলে ২০১৪-১৫ নাগাদ তেলের দাম প্রায় ৭০% পর্যন্ত পড়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে ওপেক (OPEC) বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। তারা অতিরিক্ত ১০টি তেল-উৎপাদক দেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়—যাকে এখন ওপেক প্লাস (OPEC Plus) বলা হয়—যাতে মিলিতভাবে উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে দাম স্থিতিশীল রাখা যায়। ওই ১০টি দেশের মধ্যে রাশিয়া অন্যতম বড় উৎপাদক। সৌদি আরব ও রাশিয়ার এই ঐক্য প্রমাণ করে যে, যুক্তরাষ্ট্রের শেল বুম তাদের জন্য কতখানি হুমকি তৈরি করেছে।
যাই হোক, এভাবে ২০০৭ সালে বুশের করা ভবিষ্যদ্বাণীর এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে, একটি জ্বালানি ‘পুনর্জাগরণ’ (energy renaissance) শুরু হয়। মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের তেল উৎপাদন দ্বিগুণ হয় এবং ১০ বছরের মধ্যে প্রায় তিন গুণ বেড়ে যায়। এটি আমেরিকান অর্থনীতি (American economy) এবং বিশ্বের বুকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে আমূল বদলে দেয়। ২০২৩ সালের মধ্যে, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার (Russia) তুলনায় দ্বিগুণ পরিমাণ পেট্রোলিয়াম (petroleum) উৎপাদন করছিল— অথচ কিছুদিন আগেই রাশিয়াকে (Russia) একটি “দেশের ছদ্মবেশে গ্যাস স্টেশন (gas station masquerading as a country)” বলে ব্যঙ্গ করা হতো।
প্রায় ২০০৮ সালের কাছাকাছি সময়ে, যুক্তরাষ্ট্রের তেল শিল্পে (oil industry) এমন এক চমকপ্রদ প্রত্যাবর্তন শুরু হয়েছিল, যা কেউই প্রত্যাশা করেনি। আমেরিকা রাতারাতি এক ধরনের জ্বালানি-সুপারপাওয়ার (energy superpower) হয়ে উঠল। দীর্ঘ চার দশকের উৎপাদন-পতন মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই উল্টে গেল এবং দিনে ১২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদনের নতুন রেকর্ড তৈরি হলো। বছর-কিছু পরপর উৎপাদন শুধু বাড়তেই থাকল। ২০১৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর এক নম্বর তেল উৎপাদক হয়ে উঠল—কানাডা (Canada), রাশিয়া (Russia), এমনকি তার পুরোনো তেলপ্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরবকেও (Saudi Arabia) পেছনে ফেলে। এখন সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের তেলের চাহিদার ৩%-এরও কম সরবরাহ করে। এর ঠিক দুই বছর পরেই, যুক্তরাষ্ট্র যে পরিমাণ তেল ব্যবহার করে, তার চেয়ে বেশি উৎপাদন শুরু করে—অথচ যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি ব্যবহার ভারতের (India) ও চীনের (China) সম্মিলিত ব্যবহার থেকেও বেশি। শুধু টেক্সাসের (Texas) একটি তেলক্ষেত্র (oil field) এখন এত বেশি তেল উত্তোলন করে যা বিশ্বের মধ্যে মাত্র দু-একটি দেশের সামগ্রিক উৎপাদনের সমান।
ঐতিহ্যবাহী তেল উত্তোলন বনাম ফ্র্যাকিং (Fracking)
তো কী ঘটেছিল? ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত, সবচেয়ে প্রচলিত তেল উত্তোলন পদ্ধতিটি খুব সহজ ছিল:
- ১. মাটিতে একটি গর্ত (well) খনন করা।
- ২. সেখান থেকে পাম্পের সাহায্যে তেল (oil) উপরিভাগে তুলে আনা।
এটি যেমন সস্তা, তেমনি সহজ। দি তেল কোম্পানিগুলো চিরকাল এভাবেই করে যেতে পারত, তারা তাই করত। কিন্তু ১৯৭০-এর দশক থেকেই ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে তেল (conventional oil) কমে আসতে শুরু করে। ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে সবাই ধরে নিয়েছিল যে আমেরিকার সেরা তেল দিনগুলো শেষ। মনে হচ্ছিল, ১৯৭০ সালে পীক ছোঁয়ার পর থেকে যে গতিতে পতন হচ্ছে, সেটি আর থামবে না। আসলে তেলের অভাব ছিল না; বরফে ঢাকা আর্কটিকের (Arctic) নিচে এখনো প্রচুর তেল আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কী পরিমাণ খরচ করলে সেই তেল উত্তোলন অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক (commercially viable) হবে?
তেল বিক্রির সময় আন্তর্জাতিক বাজার (international market) অনেকাংশে তেলের একটি একক দর (global price) নির্ধারণ করে। কিন্তু যখন উত্তোলনের কথা আসে, তখনই বোঝা যায় সব তেল সমান নয়। কিছু তেল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০,০০০ ফুট নিচে জলরাশির (underwater) তলায় আটকে থাকে—যা তুলতে প্রচুর খরচ হয়। কিছু তেল গর্ত ফেলে তুলতে গেলে সহজে উঠে আসে—যেখানে খরচ প্রায় নেই বললেই চলে। আবার কিছু তেল ওকলাহোমা (Oklahoma) অঙ্গরাজ্যের রাজধানী ভবনের নিচে আটকে আছে—অবস্থা বেশ বিব্রতকর।
স্বাভাবিকভাবেই, যেখানে খরচ কম—সেই সহজ তেল (conventional oil) সবার আগে উত্তোলন করা হয়। এটি আসে সুবৃহৎ ভূগর্ভস্থ “ঝাঁকে” (vast underground pools) জমা হয়ে থাকা তেল হিসেবে। একটা গর্ত করলেই দ্রুত ও সহজে সেই তেল তোলা যায়। যুক্তরাষ্ট্র এই সহজ-তেল উৎপাদনের সর্বোচ্চ বিন্দুতে (peak conventional) পৌঁছেছিল ১৯৭০ সালে—তারপর থেকেই পতন। পরে তারা আরও ব্যয়বহুল অফশোর (offshore) ড্রিলিংয়ের পথে যায়। আশির দশকে শীতল আলাস্কার (Alaska) তেলখনি থেকে যতটুকু পারা যায় উত্তোলন করা হয়। সব মিলিয়ে যখন এসব উৎস ফুরিয়ে আসে, তখন বাকি ছিল কেবল কঠিন ও ব্যয়বহুল উৎস—“স্ক্র্যাপস”।
যেমন, তেলের বড় একটা অংশ আটকে ছিল শেল (shale) নামে পরিচিত একধরনের ঘন স্তরে (dense sedimentary rock)। ফলে প্রথমে সেই শেল ভাঙতে হবে, তারপর সেখান থেকে তেল বের করতে হবে। মার্কিনিরা জানত কীভাবে তা করা যায়—হাইড্রোলিক ফ্র্যাকচারিং (hydraulic fracturing) বা ফ্র্যাকিং (fracking) যুগান্তকারী কোনো নতুন পদ্ধতি নয়। পঞ্চাশের দশক থেকে এ ধারণা বিদ্যমান। এই পদ্ধতিতে, উচ্চচাপের জল ও বালি (high pressure water and sand) ভূগর্ভস্থ শেল পাথর (shale rock) ভেঙে দেয় এবং এর ভেতরে আটকে থাকা তেলকে বের করে আনে। সাধারণ ড্রিলের মতোই প্রথমে খাড়াভাবে ভূগর্ভে ড্রিল করা হয়। এরপর উচ্চচাপের জল (high-pressure water) পাম্প করা হয়, যা পাথর ভেঙে দেয়। বালি (sand) ছোট ফাটলগুলো খোলা রাখে। তারপর শেলের ভেতরে আটকে থাকা তেল উপরে তোলা হয়। বিষয়টা রকেট বিজ্ঞানের (rocket science) চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, আবার খরচ কিন্তু প্রায় রকেট বানানোর মতোই ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। কারণ প্রচলিত বা অফশোর ড্রিলিংয়ের চেয়ে এটি আরও ব্যয়বহুল। কিন্তু তেলের বাজারমূল্য যদি কম হয়, তখন এই পদ্ধতি লাভজনক হয় না। সেই কারণে একসময় ফ্র্যাকিংকে একরকম “অ্যাকাডেমিক কৌতূহল” হিসেবেই দেখা হতো।
এদিকে তেল জগতের বড় বড় প্রতিষ্ঠান (Big Oil) তখন আরও বড় হচ্ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৮ সালে এক্সন (Exxon) ও মোবিল (Mobile) মিলে এক্সনমোবিল (ExxonMobil) তৈরি করে। এ ধরনের মেগা-কর্পোরেশনগুলো নতুন, বিশাল তেল-ফিল্ড (oil field) আবিষ্কারের জন্য আরও আগ্রহী ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে যে সামান্য তেল পড়ে আছে, তা তুলতে গেলে লাভের চেয়ে খরচই বেশি মনে হচ্ছিল। তখন ব্রাজিল (Brazil), কাজাখস্তান (Kazakhstan), কিংবা ঘানার (Ghana) মতো জায়গায় সহজেই বড় আকারে তেল উত্তোলন করে প্রচুর লাভ করা যেত। ফলে এই বিশাল কোম্পানিগুলো আমেরিকার “পেছনের উঠোন” ফেলে রেখে বিদেশে চলে গিয়েছিল।
ওয়াইল্ডক্যাটার (Wildcatters) ও শেল বিপ্লব
এসবের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কমে যায়। তখন দেখা দিল ওয়াইল্ডক্যাটাররা (অর্থাৎ ব্যক্তিগতভাবে ড্রিলিং করার উদ্যোগ যাদের) আশায় থাকে তারা “সোনার খনি” (strike gold) আবিষ্কার করবে। তারা ছোট, ক্ষিপ্র ও সর্বোপরি আগ্রহী। এদিকে অন্য এক কারণে চীনের (China) মতো দেশে তেলের চাহিদা বাড়ছিল, ফলে তেলের দাম বাড়ছিল দ্রুত। শেল থেকে তেল উত্তোলনের খরচ আর বিক্রয়মূল্যের মধ্যে আগে যে ব্যবধান, বা “গ্যাপ” অনেক ছিল, সেটি এখন অনেকটাই কমে আসে।
তাই তারা ফ্র্যাকিংয়ের খরচ কমাতে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করে। তাদের প্রথম বড় সাফল্য এলো “হরাইজন্টাল ড্রিলিং” (horizontal drilling) থেকে। ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে “শেল গেইল (Shale Gale)” নামে পরিচিত এই ফ্র্যাকিং প্রযুক্তির প্রসার ঘটে। অনেকে একে বলতেন “ওয়াইল্ডস্পিরিট (Wild-Spirit) স্বাধীন অপারেটরদের যুগ”, যাদের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা আসে ব্যক্তিগত ইকুইটি (Private Equity) এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদের (Venture Capitalists) কাছ থেকে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের স্থবির (Stagnant) তেলশিল্প আবারও সচল হয়।
কেবল খাড়াভাবে (vertical) ড্রিল করলে টার্গেট ফসকে গেলে আবার নতুন করে শুরু করতে হতো। কিন্তু শেল (shale formations) ভূমির সমান্তরালে (parallel to the ground) স্তরে থাকে। কাজেই অনুভূমিক ড্রিল করলে (drill horizontally) সেই শেল-স্তরের বৃহৎ অংশ থেকেই তেল তোলা যায়। তারপর তারা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর ড্রিল ব্যবহার শুরু করে—এক মাইল, দুই মাইল, তিন মাইল, এমনকি চার মাইল দূর পর্যন্ত। তারা ক্রমে জানতে পেরে গেল কীভাবে “সুইট স্পট” (sweet spots) চিহ্নিত করতে হবে, কতটা দূরত্বে প্রতিটি ড্রিল বসাতে হবে যাতে একটির সাথে আরেকটির মধ্যে কম বিরোধ সৃষ্টি হয়। তারা জল, বালি ও রাসায়নিকের (chemical mixture) মিশ্রণকেও উন্নত করে তোলার পদ্ধতি বার করল, যাতে শেল সহজে ভেঙে তেলের প্রবাহ আরও বেড়ে যায়। প্রতিটি উদ্ভাবন ব্যয় কমিয়েছে আর উৎপাদন বাড়িয়েছে। পাশাপাশি “একটি করতে গেলে আরেকটি ফ্রি”—তেল উত্তোলনের সময় কিছু প্রাকৃতিক গ্যাস (natural gas) বিনামূল্যে উঠে আসে, যা অনেক সময় বিশাল বোনাস হিসেবে দেখা যায়। কিন্তু একে ঠিকমতো ধারণ (capture) না করলে এটি উল্টে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, কারণ তখন মিথেন (methane) জাতীয় গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বেড়ে যায়।
টেক্সাসের (Texas) পারমিয়ান বেসিন (Permian Basin) হয়ে ওঠে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেলক্ষেত্র। উত্তর ডাকোটার (North Dakota) বাক্কেন শেল (Bakken Shale) এলাকাও হয়ে ওঠে তেলের স্বর্ণখনি (Modern-Day Gold Rush)। চাকরির সুযোগ, উচ্চ মজুরি আর নতুন নগরায়ণের (Urban Sprawl) জোয়ারে ছোট ছোট শহরগুলো রাতারাতি বদলে যায়। উইলিস্টন (Williston) আর ওয়াটফোর্ড সিটি (Watford City)-তে মানুষের ভিড় এত বেড়ে গিয়েছিল যে, উত্তর ডাকোটা ছিল একমাত্র অঙ্গরাজ্য যার জনসংখ্যা ২০১০-এর তুলনায় ২০২১ সালে তুলনামূলকভাবে কম বয়সী হয়ে উঠেছিল। ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত রাজ্যটির ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সর্বনিম্ন বেকারত্ব (Unemployment) এবং তেল রাজস্ব থেকে তারা বিশাল বাজেট উদ্ধৃত্ত (Fiscal Surplus) উপভোগ করে।
তবে এই সাফল্যের সাথেই এসেছিল চ্যালেঞ্জ। তেল মজুত কেন্দ্রগুলো (Oil Storage Facility) দ্রুত পূর্ণ হয়ে যেতে থাকে। ওকলাহোমার (Oklahoma) কুশিং (Cushing) কেন্দ্র, যেটি উত্তর আমেরিকায় পাইপলাইনের (Pipeline) মূল সংযোগস্থল এবং বৈশ্বিক তেলের বেঞ্চমার্ক নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়, ২০১৭ সালে রেকর্ড ৬৯ মিলিয়ন ব্যারেল তেল মজুতের মাইলফলক অতিক্রম করে।
উত্তর ডাকোটার সেই ‘বুম (Boom)’ খুব দ্রুত থেমে যায়—২০১৫ সালে উৎপাদন প্রবৃদ্ধি থমকে যায়। তবে টেক্সাসের উত্থান এখনো অব্যাহত রয়েছে। ২০১০ সাল থেকে টেক্সাসের তেল উৎপাদন পাঁচ গুণ বেড়ে গেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের মোট তেল উৎপাদনের ৪৩%। ফ্র্যাকিং এত দ্রুত বেড়েছে যে, উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় বালির (Sand) অভাব এখন প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে—কারণ শিলাস্তর ভাঙতে প্রচুর বালি লাগে।
ফলাফলস্বরূপ, পুরনো ঐতিহ্যবাহী (Traditional) পদ্ধতিতেও সামান্য উৎপাদন হয় বটে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের মোট উৎপাদনের দুই-তৃতীয়াংশই এখন ফ্র্যাকিং থেকে আসে।
কেন ফ্র্যাকিং (Fracking) যুক্তরাষ্ট্রে এত সফল?
কানাডা (Canada) বা আর্জেন্টিনা (Argentina)-তেও ফ্র্যাকিং আছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মতো সাফল্য সেখানে দেখা যায়নি। মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- বড় আকারের শেল অঞ্চলের প্রাপ্যতা (Large Shale Formations): যুক্তরাষ্ট্রে বড় বড় শেল ক্ষেত্র আছে, যা অনেক দেশেরই নেই।
- প্রযুক্তিতে প্রথম উদ্যোগ (First-Mover Advantage): ফ্র্যাকিং-এর উদ্ভাবন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে, তাই শুরু থেকেই তারা সব সুযোগ কাজে লাগাতে পেরেছে।
- দক্ষ শ্রমশক্তি ও বিদ্যমান অবকাঠামো (Skilled Labor & Infrastructure): দেশটিতে আগে থেকেই পর্যাপ্ত পাইপলাইন (Pipelines) ছিল, যা তেল পরিবহনে কাজ দিয়েছে।
- শিথিল নিয়ন্ত্রক পরিবেশ (Favorable Regulatory Environment): ভূমির মালিকরা (Land Owners) খুব দ্রুত কোম্পানিকে জমি ইজারা দিতে পেরেছেন।
- উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগ (Venture Capital & Private Equity): যুক্তরাষ্ট্রের ফাইন্যান্সিয়াল মার্কেটে প্রচুর বেসরকারি বিনিয়োগকারীর উপস্থিতি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে ত্বরান্বিত করেছে।
এসব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র খুব দ্রুত ফ্র্যাকিং বুম ঘটাতে পেরেছে। আজ দেশটির তেল উৎপাদন দেশে ভোগের (Consumption) চাহিদার সমান হয়ে গেছে। একসময়কার মার্কিন বাজার যেখানে বৈশ্বিক অস্থিরতার (Market Instability) কারণে তেলের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী ছিল, এখন তারাই শীর্ষ উৎপাদক।
পরিবেশগত বিতর্ক
যথাযথভাবে ধরতে পারলে ফ্র্যাকিংয়ের সময় পাওয়া প্রাকৃতিক গ্যাস কয়লার (coal) বিকল্প হয়ে দূষণ অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। কিন্তু লিক হলে (leaked) মিথেন বায়ুমণ্ডলে যায়, যা কার্বন ডাই-অক্সাইডের (carbon dioxide) চেয়ে ৮০ গুণ বেশি উষ্ণতা ধরে রাখতে পারে। যথেষ্ট পরিমাণে মিথেন নিঃসরণ হলে কয়লার বিকল্প হিসেবেও এটি আর পরিবেশবান্ধব থাকে না—বরং ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। এখানেই শেষ নয়। তেল বা গ্যাসের জন্য ফ্র্যাকিং করা বেশ জল (water) ও বালি-নির্ভর (sand-intensive)। একটি কূপে (well) কমপক্ষে ১.৫ মিলিয়ন গ্যালন জল লাগে। কোনো কোনো ড্রিলার কিছুটা জল পুনরায় ব্যবহার করলেও, এই ফ্র্যাক ফ্লুইড (frac fluid) অত্যন্ত বিষাক্ত, এমনকি তেজস্ক্রিয় (radioactive) হতে পারে, যা ছড়িয়ে পড়লে (spilled) ভূগর্ভস্থ জল দূষিত করার ঝুঁকি থাকে। ২০০৯ সালে পেনসিলভানিয়ার (Pennsylvania) একটি ছোট শহরে এমন ঘটনাই ঘটেছিল।
এসব কারণে এবং আরও নানা উদ্বেগ থেকে ফ্র্যাকিং নিয়েই বিতর্ক বয়ে চলে। কিন্তু কোটি কোটি ডলার লবিংয়ে (lobbying) ব্যয় করা ছাড়াও, এই শিল্পের (industry) হাতে রয়েছে আরেকটি শক্তিশালী হাতিয়ার—একটি চমৎকার গল্প। যখন বিশ্বের বড় বড় কর্পোরেশন আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাহত ছিল, তখন সাধারণ ব্যক্তি উদ্যোগপতিরা সেটাকে ভুল প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছে যে, এখান থেকে প্রায় শূন্য হাতে এসে কোটি কোটি ডলার আয় করতে পারে, এমনকি পুরো দেশকেই জ্বালানি সুপারপাওয়ার (energy superpower) এ রূপান্তরিত করা সম্ভব। আর সত্যিকার অর্থে, এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে ছোট ছোট উদ্যোগের (scrappy entrepreneurial underdogs) অবদান। এমনটা অন্য কোথাও সহজে সম্ভব হতো না।
আমেরিকার অনন্য ভূগোল এবং শেল বিপ্লবের প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৮টি সংলগ্ন অঙ্গরাজ্য (contiguous 48 states) পূর্ব দিকে অ্যাপালাচিয়ান (Appalachian) ও পশ্চিমে রকি পর্বতমালা (Rocky Mountains) দ্বারা পরিবেষ্টিত। মাঝের বিশাল সমতলভূমিকে (Great Plains) বলা হয় “গ্রেট প্লেইনস।” ৭ কোটি বছর আগে এই এলাকা ছিল জলমগ্ন। সেখানে মাছ, উদ্ভিদ ও শেওলা (algae) মারা যাওয়ার পর ভূগর্ভে চাপা পড়া জৈব পদার্থ ধীরে ধীরে তেলে পরিণত হয়। এর ফলে জমে ওঠে একের পর এক শেল স্তর, যা ফ্র্যাকিংয়ের জন্য আদর্শ। তাই আজ যে বড় বড় শেল-ফিল্ড দেখা যায়, সেগুলো মূলত মন্টানা (Montana) ও ড্যাকোটা (Dakotas) থেকে শুরু করে দক্ষিণে পশ্চিম টেক্সাস পর্যন্ত বিস্তৃত—সবই এই গ্রেট প্লেইনসের মধ্যে অবস্থিত।
আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়। এই অঞ্চল অধিকাংশই জনবিরল (pretty much empty)। ফ্র্যাকিং একটি উচ্চ শব্দযুক্ত, ময়লা সৃষ্টিকারী ও দেখতে বিশ্রী প্রক্রিয়া। মিলিয়ন মিলিয়ন গ্যালন জল বহনকারী ট্রাক চলাচল করবে, কখনো কখনো বিস্ফোরণও (explosion) ঘটতে পারে। জনবহুল এলাকায় হলে প্রতিবাদ বা বিরোধের মাত্রা অনেক বেশি হতো। কিন্তু পার্মিয়ান বেসিন (Permian Basin) (যেখানে আমেরিকার সবচেয়ে বড় শেল তেলক্ষেত্র) যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনশূন্য অঞ্চলগুলোর মধ্যে পড়ে। অন্যদিকে শেল উত্তোলনকারীদের কিছু অবকাঠামো (infrastructure) প্রয়োজন—যেমন কর্মী, কর্মীদের জন্য দোকান, সড়কপথ ইত্যাদি। পশ্চিম টেক্সাস একেবারে জনশূন্য নয়— সেখানে ওয়ালমার্ট (Walmart) আছে, মহাসড়ক আছে। কিন্তু রাশিয়ার অনেক তেলক্ষেত্র তো উত্তর মেরু অঞ্চলে (Arctic Circle) অবস্থিত, যেখানে কেবল প্লেনে করেই যাওয়া যায়। ফলে ভৌগোলিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র অদ্ভুতভাবে অনেকটা “লটারি জিতেছে” (geographic lottery) — শেল উত্তোলনের জন্য পারফেক্ট গোল্ডিলক্স জোন (perfect Goldilocks zone) পেয়ে গেছে।
এর সঙ্গে যোগ করুন ১৯৭০-এর দশকের ঐতিহ্যবাহী ড্রিলিং পরিকাঠামো, যা তখন থেকেই বিদ্যমান ছিল। সব মিলিয়ে, আমেরিকার নিখুঁত ভূগোল, শেলের “গল্পগাথা,” ২০০০-এর দশকের শুরুর উচ্চ তেলের দাম, এবং বড় সংস্থাগুলোর ফাঁকা করে দেওয়া প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র – এসব মিলে গড়ে উঠেছে ইতিহাসের অন্যতম বড় জ্বালানি-বিপ্লব। আর এটি বন্ধ করার মতো রাজনৈতিক সদিচ্ছাও (political appetite) বিশেষ দেখা যায়নি।
রাজনৈতিক সমর্থন ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার
একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্রে দুটি দলই (দুই রাজনৈতিক শিবির) শেলের পক্ষে ছিল—কেউ নীরবে, কেউ প্রকাশ্যে। জর্জ বুশ (George Bush) নিজেই একজন “অয়েল ম্যান” ছিলেন। বারাক ওবামা (Barack Obama) দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে “প্রো-ফ্র্যাকিং” (pro-fracking) আইন সই করেছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump) তো এ শিল্পের একরকম মুখপাত্র হিসেবেই কথা বলতেন। এমনকি জো বাইডেন (Joe Biden) তেলের উৎপাদন বাড়াতে কোম্পানিগুলোকে অনুরোধও করেছিলেন।
শেল প্রযুক্তি যেভাবে দেশকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, তাতে দুই দলই একরকম উপকৃত হয়েছে—বিশেষত ২০০৮ সালের মহামন্দা (Great Recession) যখন দেশ কাঁপাচ্ছিল। এ সময়ে শিল্প-কারখানাগুলো চীনে চলে যাচ্ছিল। তখন শেল শিল্প (fracking alone) ২০০৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত আমেরিকার মোট জিডিপি (GDP) বৃদ্ধির ৪০%-এর জন্য একাই দায়ী ছিল বলে একটি বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দেয়। অর্থাৎ প্রায় সব খাত যখন ধুঁকছিল, শেলই অর্থনীতিকে (economy) চাঙা রেখেছিল। নির্মাণ (manufacturing) খাতে তখন প্রায় ২০ লাখ চাকরি হারিয়েছিল দেশ, কিন্তু শেল শিল্প প্রায় ১০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান (সরাসরি ও পরোক্ষ) সৃষ্টি করে, যেটি ক্ষতি পোষাতে অনেকটা সহায়ক হয়েছিল। বিশেষ করে পশ্চিম টেক্সাস, নর্থ ড্যাকোটা, ওকলাহোমা (Oklahoma), কলোরাডো (Colorado), আর নিউ মেক্সিকো (New Mexico)-তে এ প্রভাব বেশি দেখা যায়।
উদাহরণ হিসেবে নর্থ ড্যাকোটা রাজ্যের ছোট্ট শহর উইলিস্টনে (Williston) ২০০৬ সালেই ম্যাকডোনাল্ডস (McDonald’s) কর্মচারীদের ঘণ্টায় ১৫ ডলার দিত, যা সে সময়ের রাজ্যের ন্যূনতম মজুরির দ্বিগুণ। ২০১২ সালে সেখানে কর্মসংস্থানের হার আরও বেড়ে যায়। স্থানীয় বাসিন্দা হন বা বহিরাগত শ্রমিক, সবাই কোনও না কোনওভাবে উপকৃত হয়েছে শেল বুম থেকে। বিশাল রাজস্ব এসেছে কর বাবদ, আমেরিকানরা পেয়েছে তুলনামূলকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা জ্বালানি (OECD দেশগুলোর মধ্যে)। বাণিজ্য ঘাটতি (trade deficit) কমেছে, উৎপাদন শিল্প (manufacturers) আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসার কথা ভাবছে, এবং প্রত্যক্ষভাবে করদাতাদের (taxpayers)-ও সাশ্রয় হয়েছে। কারণ মার্কিন সামরিক বাহিনী (US Military) বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল-ভোক্তা।
যুক্তরাষ্ট্রের লাভ
যুক্তরাষ্ট্র এমনিতেই একটি সুপারপাওয়ার ছিল, এখন হয়েছে “এনার্জি সুপারপাওয়ার” (energy superpower)। এর ফলে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে তাদের প্রভাব বেড়েছে, মধ্যপ্রাচ্যে (Middle East) লেভারেজ পেয়েছে, আর বিশ্ববাজারে তেলের দাম অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল রাখতে অবদান রেখেছে, যা ঠাণ্ডা যুদ্ধ-পরবর্তী (post–Cold War) তুলনামূলক স্থিতিশীল সময়কে দীর্ঘায়িত করেছে। সেই সাথে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ তেলের দাম আরেকটু কম হলে খুশি হত ঠিকই, কিন্তু ১৯৭৩ সালের মতো সংকট তাদের জীবনে আর আসেনি। ২০২০ সালে তো তেলের দাম কিছু সময়ের জন্য শূন্যের নিচে (negative) নেমে গিয়েছিল। কিন্তু সময়ের সাথে তেলের দামের গ্রাফ দেখলেই বোঝা যায়, এখানে কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটছে—বড়সড় রকমের অনুদান (subsidized) বা ঋণনির্ভর ও টেকসই নয় এমন কিছু।
তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এত তেল কিনছে কেন?
অনেকেই ভাববেন—“এত তেল যখন নিজেরাই উৎপাদন করে, তাহলে আর আমদানি করার দরকার কী?” বাস্তবে, যুক্তরাষ্ট্র এখনও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক; শুধু চীনই (China) তাদের চেয়ে বেশি তেল আমদানি করে। যুক্তরাষ্ট্রের মোট পেট্রোলিয়াম (Petroleum) চাহিদার ৪১% এখনও আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়। ফ্র্যাকিং বুমের পর আমদানি কিছুটা কমলেও পরিমাণ এখনো উল্লেখযোগ্য। এর কারণ:
- তেলের বিভিন্ন গ্রেড (Grades of Crude Oil): ফ্র্যাকিং থেকে যে তেল পাওয়া যায়, তা “লাইট সুইট (Light Sweet)”, অর্থাৎ ঘনত্ব কম এবং সালফার (Sulfur) কম। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ পরিশোধনাগার (Refinery) তৈরি হয়েছে “হেভি সাওয়ার (Heavy Sour)” তেলের জন্য।
- প্রচলিত পরিশোধনাগারের সীমাবদ্ধতা (Refinery Limitations): ২০ শতকে আমদানিকৃত তেল ছিল ঘনত্ব ও সালফার বেশি, যেমন মেক্সিকো, ভেনেজুয়েলা, সৌদি আরব, কানাডা থেকে আসা তেল। সেই অনুযায়ী পরিশোধনাগারগুলো দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা হয়েছে।
- নতুন পরিশোধনাগার তৈরির ঝুঁকি (Risk of Building New Refineries): ফ্র্যাকিং যুগ কত দিন টিকবে, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে (Renewables) যাওয়ার গতি কেমন হবে—এসব অনিশ্চয়তা থাকায় বিশাল বিনিয়োগে নতুন পরিশোধনাগার তৈরি রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ।
- রপ্তানি-আমদানির সমন্বয় (Export-Import Coordination): তাই যুক্তরাষ্ট্র লাইট সুইট তেল রপ্তানি করে এবং বদলে হেভি সাওয়ার তেল আমদানি করে। এর ফলে পরিশোধনাগারগুলোর বিদ্যমান অবকাঠামো চালু থাকে এবং একই সঙ্গে লাভজনক ব্যবসায়িক মডেল টিকে যায়।
এছাড়া লাইট সুইট তেলের বাজারদর স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা বেশি—কারণ পরিশোধনের প্রক্রিয়া অপেক্ষাকৃত সহজ। অপরদিকে হেভি সাওয়ার সস্তা হলেও পরিশোধন অনেক জটিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উভয় তেল থেকেই প্রায় একই ধরনের পণ্য তৈরি হয়। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র তুলনামূলক উচ্চমূল্যের লাইট সুইট রপ্তানি করে, আবার কমদামি কাঁচামাল আমদানি করে নিজেরাই পরিশোধন করে। ফলে দেশের ভেতরে শিল্প ও শ্রমবাজার সচল থাকে, আর মুনাফাও বাড়ে। এক্সনমোবিল (ExxonMobil) এবং শেভরন (Chevron)—যুক্তরাষ্ট্রের এই দুই বৃহত্তম তেল কোম্পানিরই লাভ গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বিনিয়োগকারীদের গোপন ক্ষতি ও ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল ঋণ
শেল শিল্পের উত্থানে যদিও প্রায় সব আমেরিকান কোন না কোনভাবে লাভবান হয়েছে, তবে একটি পক্ষ ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে— আর এই পক্ষটি হচ্ছে বিনিয়োগকারী পক্ষ (the investor)। এই অপ্রত্যাশিত ১৫ বছরের বুমের (boom) চেয়েও অবাক করা বিষয় হলো, সম্প্রতি পর্যন্ত এই উত্থান তেল কোম্পানিগুলোকে (oil companies) বিন্দুমাত্র লাভ দিতে পারেনি। বরং ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে তারা প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার (বিলিয়ন=১০^৯) খরচ করে ফেলেছে, যা আবার পুরো পর্তুগালের (Portugal) জিডিপি (GDP) এর চেয়েও বেশি। এই ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে, শেল শিল্প প্রতি ১ ডলার আয়ে ১.১৮ ডলার ব্যয় করেছে। অর্থাৎ উৎপাদনের জন্য যত ব্যয় হয়েছে, আয় তার চেয়ে কম ছিল। এত বিশাল উৎপাদন (যা ইতিহাসের যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি) করতে প্রচুর বিনিয়োগ (spending) করতে হয়েছে। ২০২০ সাল নাগাদ ৩০০ বিলিয়ন ডলার কার্যত আগুনে পোড়ানোর মতো (set on fire) ব্যয় হয়ে যায়।
এই বিষয়টি অথচ খুব বেশি প্রচার পায়নি। উদাহরণ হিসেবে ধরুন উবার (Uber) এবং উইওয়ার্কের (WeWork) মতো কোম্পানির আর্থিক লস; শেল (shale) ক্ষেত্রে তার তুলনায় যেন শিশুদের খেলা। “উইওয়ার্ক” (Wework), যা অলাভজনকতার (unprofitability) আইকন হিসেবে পরিচিত, ২০১৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৫ বিলিয়ন ডলার লোকসান করেছে। অন্যদিকে, আমেরিকানদের গত ১৫ বছরের স্বাচ্ছন্দ্য অনেকাংশে এসেছে এই ৩০০ বিলিয়ন ডলারের ঋণের (debt) ওপর ভর করে—গাড়িতে কম দামে জ্বালানি পেয়েছে তারা, তেল কোম্পানির সিইওরা (CEOs) বিগত দিনের উৎপাদনভিত্তিক বোনাস (production, not profit) পেয়ে মিলিয়ন ডলার আয় করেছেন, এবং জ্বালানি-নির্ভর ব্যবসাগুলো সস্তা জ্বালানি পেয়ে রমরমা ব্যবসা করেছে।
যাই হোক, সত্য কথা হলো, শেল বুম (shale boom) সব সময়ই ছিল কিছু নির্দিষ্ট ও সাময়িক অবস্থার ফল। আজ সেই অবস্থার অনেকটাই বদলে যাচ্ছে। ৩০০ বিলিয়ন ডলারের ঋণের বোঝা এখন মিটিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে। আমেরিকা ফ্র্যাকিং শিল্পের দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করতে চলেছে—যেখানে মৌলিক আর্থিক বাস্তবতা (financial reality) এই খাতকে আঁকড়ে ধরবে, বিনিয়োগকারীরা লাভ (positive returns) চায়। এই ধাপটিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে নতুনভাবে বদলে দেবে, তবে আগের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতিতে।
ফ্র্যাকিং-এর সমস্যাটা কী? কেন লোকশান হয়? কেনই বা এটা টিকিয়ে রাখতে ঋণের দরকার হয়?
প্রশ্ন ফ্র্যাকিংয়ের একটি বড় সুবিধা হলো এটি অত্যন্ত দ্রুত সময়ের মধ্যে অনেক বেশি তেল উৎপাদন করতে সক্ষম।
উদাহরণস্বরূপ, ঐতিহ্যবাহী একটি তেল কূপ (conventional well) খনন ও তেল ওঠানোর ক্ষেত্রে কিছু সপ্তাহ সময় লাগতে পারে, এরপর একটি মাঝারি মানের উৎপাদন শুরু হয় এবং সেটি ধীরগতিতে কমতে থাকে বহু বছরের ব্যবধানে। অন্যদিকে, ফ্র্যাকিং পদ্ধতিতে একটি শেল কূপ (shale well) স্থাপন করতে মাত্র কয়েক দিন সময় লাগতে পারে, এবং শুরুতেই এটি দুই গুণের বেশি তেল দিতে সক্ষম হতে পারে।
কিন্তু এর একটি বড় সমস্যা আছে। এই উৎপাদন বেশিদিন স্থায়ী হয় না। ঐতিহ্যবাহী কূপগুলোও (conventional well) সময়ের সাথে সাথে উৎপাদন কমে যায় বটে, কিন্তু সেখানে প্রতিবছর প্রায় ১০% হারে ধীরগতির নিম্নগতি দেখা যায়, যা কয়েক দশক ধরে চলতে পারে। অন্যদিকে, ফ্র্যাকিং কূপগুলোর (fracking wells) উৎপাদন শুরুতেই খুব দ্রুত নেমে আসে। প্রথম কয়েক মাস বা এমনকি কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এর উৎপাদন অনেকখানি কমে যায়। এক বছরের মাথায়, অনেক ক্ষেত্রেই কূপটি অর্ধেকেরও কম উৎপাদন দেয়।
এই পার্থক্য—যদিও ছোটখাটো বলে মনে হতে পারে—তেল শিল্পের অর্থনৈতিক মডেলে (economic model) আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে তেল উত্তোলন করা অনেকটা “সেট ইট অ্যান্ড ফরগেট ইট” (set it and forget it) ব্যবসার মতো। বড়সড় মূলধনী বিনিয়োগ (capital investment) দিয়ে একবার কূপ খনন করে নিলে, বহু দশক ধরে একটি স্থিতিশীল আয় পাওয়া যায়। এটা অনেকটা প্যাসিভ ইনকামের (passive income) মতো।
কিন্তু শেল তেলের (shale oil) ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। এখানে উৎপাদন এত দ্রুত কমে যে, একই মাত্রার তেল পেতে হলে বারবার নতুন কূপ খনন করতে হয়। অর্থাৎ, যেখানে দাঁড়িয়ে আছ, সেখানেই থাকতে গেলেও ‘ফ্র্যাকিং ট্রেডমিল’ (fracking treadmill) নামক এক অবিরাম প্রক্রিয়ায় লিপ্ত থাকতে হয়। এটি অনেক বেশি ম্যানুফ্যাকচারিং ব্যবসার মতো—মেশিন চালিয়ে পণ্য বানানো থামিয়ে দিলে আর অর্থ আসে না। এখানে কোনো প্যাসিভ ইনকামের সুযোগ নেই। এই কারণে, শেল বেশিরভাগ সময়েই উৎপাদন ব্যয় (production cost) তুলনায় কম দামে তেল বিক্রি করে এবং লোকসান দেয়।
শেল (Shale) শিল্পের লোকসান সত্ত্বেও চলার কারণ
তাহলে প্রশ্ন হলো, লোকসান সত্ত্বেও কেন তেল কোম্পানিগুলো খনন (drilling) অব্যাহত রাখে? এর একটি কারণ হলো ম্যানুফ্যাকচারিং ব্যবসার মতোই তারা মনে করে, স্কেল বা বড় আকারে কাজ করলে খরচ (cost) ধীরে ধীরে কমবে, অর্থাৎ ইকনমিজ অব স্কেল (economies of scale) তৈরি হবে। প্রত্যেকটি নতুন কূপ থেকে তারা নতুন কিছু শিখবে, নতুন নতুন ডেটা যোগ হবে, এবং প্রক্রিয়া আরও নিখুঁত হবে।
আসলেই, শিল্পটি তাদের কৌশলে উন্নতি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, গড়পড়তা একটি শেল কূপ ২০০৯ সালে যে উৎপাদন দিত, ২০১২ সালে সেটি বেড়েছে, আর ২০১৫ সালে এর উৎপাদন আরও বেড়েছে। রিয়েল-টাইমে শেল কোম্পানিগুলো অগ্রগতি করেছে, যদিও প্রত্যেকটি নতুন উদ্ভাবনের ফল পূর্বের তুলনায় কিছুটা কমে আসছিল (diminishing returns)।
তবে এই আশাবাদের মাঝেই শিল্পটি দুটি বড় সমস্যার সম্মুখীন হয়। প্রথমটি হলো জমি (land) সংক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পত্তি আইন (U.S. property law) ভিন্নধর্মী—যে কেউ চাইলে নিজের বাড়ির নিচের খনিজ সম্পদের (mineral rights) মালিকানা বিক্রি করতে পারে। এমনকি সেজন্য বাড়ি ছাড়তে পর্যন্ত হয় না। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র বড়, জনবহুল (high population) এবং ছড়ানো এলাকা নিয়ে গঠিত, তেল কোম্পানিরা সর্বদাই কাউকে না কাউকে খুঁজে পায় যে জমি বিক্রিতে আগ্রহী।
সমস্যা হলো, মানুষ খুব দ্রুতই বুঝে ফেলে এই জমি কতটা মূল্যবান। এটির ফলে একধরনের বিপরীত ইকনমি অব স্কেল (opposite of an economy of scale) তৈরি হয়: জনপ্রতি জমির মালিক বা জমির দামের দাবিদারদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, আর তারা বেশি ভাগ নিতে শুরু করে। ফলে তেল কোম্পানিগুলোর লাভ কমে আসে। উদাহরণস্বরূপ, ২০ বছর আগে ওয়েস্ট টেক্সাস (West Texas) এবং সাউথইস্ট নিউ মেক্সিকোর (southeast New Mexico) জমির দাম ছিল খুবই সস্তা—প্রতি একর মাত্র ৪০০ ডলার। ওই অঞ্চলে বিদ্যুৎ, জল এমনকি ওয়াই-ফাই (wifi) সুবিধা ছিল না, তাই জমির দামও ছিল কম। কিন্তু ২০১৪ সালের দিকে এসেই তা দেশের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত জমিতে পরিণত হয়, যেখানে এক একরের দাম ৫০,০০০ ডলার পর্যন্ত উঠে যায়।
দ্বিতীয় কারণ—সৌদি আরব (Saudi Arabia)। ২০১২ সালে প্রতিটি শেল তেলের ব্যারেলে (barrel) প্রায় ৬ ডলার লোকসান হতো (ফ্রি ক্যাশ ফ্লো বা free cash flow হিসেবে)। ২০১৪ সালের দিকে এসে এই লোকসান কমে অর্ধেকেরও নিচে নেমে আসে। যদিও তখনো কোম্পানিগুলো তেমন কোনো লাভ করেনি, বরং ঐতিহ্যবাহী তেল যেখানে প্রতিটা ব্যারেলে ১-২ ডলার লাভ করত, সেখানে শেল এখনো আরো খারাপ অবস্থায় ছিল। তবু, শেল শিল্পের জন্য এটি ছিল একপ্রকার সাফল্য; তারা সেই বছর প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার লোকসান দিয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ছিল কম। ফলে শিল্পটি আশার আলো দেখতে শুরু করে।
কিন্তু সৌদি আরবের ব্যাপারটা ছিল অন্যরকম। তারা এমন এক সংস্থা—অপেক (OPEC)—এর অনানুষ্ঠানিক নেতা, যেখানে তেল রপ্তানিকারক দেশগুলো একত্রে তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কোনো দেশ আসায় সৌদি আরবের কাছে বিষয়টি ছিল এক বিব্রতকর ব্যাপার। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয়, বাজার প্লাবিত করে দাম নামিয়ে দেবে। এটি সবার জন্যই খারাপ হবে, তবে সবার জন্য সমানভাবে নয়। মধ্যপ্রাচ্যে (Middle East) তেল উত্তোলন তুলনামূলকভাবে অনেক সস্তা—দাসশ্রম (slave labor), বিনামূল্যের জমি (free land) সহ ভৌগোলিক সুবিধা তো রয়েছেই। ফলে শেল উৎপাদনকারী আমেরিকান কোম্পানিগুলো সম্পূর্ণ ধসের মুখে পড়বে, যেখানে সৌদিকে সাময়িক লোকসান দিলেও পরে তারা বাড়তি মুনাফার জন্য বাজার কুক্ষিগত করতে পারবে—সেটাই ছিল সৌদি আরবের পরিকল্পনা।
২০১৬ সালের শুরুর দিকে, অপেক (OPEC) মিলে তেলের দামকে ৭৫% পর্যন্ত কমিয়ে প্রতি ব্যারেল মাত্র ২৫ ডলারে নামিয়ে আনে। এর ফলে ২০০টির বেশি মার্কিন তেল ও গ্যাস কোম্পানি দেউলিয়া (bankrupt) হয়ে যায়, হাজার হাজার মানুষের চাকরি চলে যায়, অনেক শহর বা জনপদ কার্যত বিলুপ্ত হয়ে যায়।
কিন্তু তাদের সবার ভাগ্য একই রকম হয়নি। সৌদি আরবের পরিকল্পনায় একটি বড় ফাঁক ছিল। তারা আমেরিকান শেল বিপ্লবকে (shale revolution) ভুলভাবে বুঝেছিল।
শেল বিপ্লবের (Shale Revolution) আসল চরিত্র: প্রযুক্তিগত নয়, আর্থিক
শেল বিপ্লব আসলে কখনোই বিশাল প্রযুক্তিগত বিপ্লব ছিল না। ফ্র্যাকিং (fracking) কিন্তু অন্তত ১৯৪০-এর দশক থেকে চলে আসছে। দেখতে গেলে, হাইড্রোলিক ফ্র্যাকচারিং (hydraulic fracturing) আগে থেকেই ছিল। তবে গত কয়েক বছরে উৎপাদনশীলতা কিছুটা বেড়েছে, নতুন কৌশল উদ্ভাবিত হয়েছে বটে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শেল শীর্ষে উঠে এসেছিল মূলত তেলের দামের ঊর্ধ্বগতির সুবাদে।
স্মরণ করুন, ২০১৪ সালের দিকে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি (barrel) প্রায় ১০০ ডলারে উঠেছিল, যখন শেল তেল প্রায় লাভজনক হওয়ার পথে ছিল। অর্থাৎ, তেলের উচ্চমূল্য ছিল একটি ঘটনার সমাপতন (accident)। আসলে, শেল বিপ্লব ছিল একটা আর্থিক বিপ্লব (financial revolution)।
শেল খাতে সবচেয়ে সফল ড্রিলাররা (drillers) ছিল তারা, যারা সবচেয়ে দক্ষতার সাথে বিনিয়োগকারী (investors) আকর্ষণ করতে পেরেছিল। কারণ ফ্র্যাকিং ট্রেডমিলে (fracking treadmill) টিকে থাকতে লাগাতার মূলধন লাগত। এভাবেই এই খাতে সফল হওয়ার মানে দাঁড়ায় মূলত “কিভাবে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসা যায়”—এই গল্প শোনানোর আর্ট। প্রকৃত তেল উত্তোলন যেন কেবল এক আনুষ্ঠানিকতা। যে কোম্পানিগুলো ব্যাপারটি বুঝতে পারেনি বা খরচ কমবে ভেবে সবকিছু বাজি ধরেছিল, তারা শীঘ্রই দেউলিয়া হয়ে গেছে। বাকিরা “গ্রোথ অ্যাট অল কস্টস (growth at all costs),” “ইনভেস্টর মার্কেটিং (investor marketing),” ও “স্টোরিটেলিং (storytelling)”-এর খেলায় লিপ্ত ছিল।
এমনকি সৌদি আরবের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার পরও তারা বিনিয়োগকারী টানতে আরও পারদর্শী হয়ে ওঠে, কারণ তখন তাদের প্রমাণ দেখানোর মতো ছিল— “আমরা এত বড় ঝড়ের মধ্যেও টিকেছি, নিশ্চয়ই আমাদের ‘কম্পেটিটিভ অ্যাডভান্টেজ (competitive advantage)’ আছে!” বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পারেনি, এই অ্যাডভান্টেজটির মূল ছিল আসলে বড় পকেটওয়ালা মানুষজনকে (deep-pocketed investors) আকর্ষণ করার ক্ষমতা।
সৌদি আরব যা বুঝতে পারেনি, তা হলো এই যে, শেল কোম্পানিগুলো এতদিন লাভ করেনি কারণ তাদের লাভ করতে হয়নি। আগের ঋণ (loan) শোধ করার জন্য তারা নতুন ঋণ গ্রহণ করতে পারত। যে কারণে উইওয়ার্কের (WeWork) প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডাম নিউম্যান (Adam Neumann) কোম্পানি দেউলিয়া হওয়ার পরেও ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদশালী, সেই একই কারণে তেল কোম্পানির সিইও’রাও বিনিয়োগকারীদের জন্য এক টাকাও মুনাফা না করেও বিপুল ধনী হয়ে গেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৮ সালে চেসাপিক এনার্জির (Chesapeake Energy) সিইও ১০০ মিলিয়নের (million=১০^৬)ও বেশি উপার্জন করেছিলেন, যা ওই বছরের সর্বোচ্চ— অথচ সেই বছর তার কোম্পানি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার হারাচ্ছিল।
ফলে, অজান্তেই, গত ১৫ বছর ধরে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী (international investors), তেল সিইও (oil CEOs), এমনকি সৌদি আরব পর্যন্ত মিলে মিশে যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ির গ্যাসের খরচ কমিয়ে দিয়েছে এবং দেশটিকে একটি শক্তিশালী জ্বালানি পরাশক্তিতে (energy superpower) পরিণত করেছে। যেভাবে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা (venture Capitalists) দেশটির লসের বিনিময়ে মাত্র ১০ ডলারে উবার (Uber) রাইড উপভোগ করার সুযোগ দিয়েছে, ঠিক সেভাবেই শেল বিনিয়োগকারীরা দেশটির জনগণের ২-৩ ডলারে গ্যালন প্রতি গ্যাস পেতে সাহায্য করেছে।
অস্থায়ী সহাবস্থান, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী নয়
সেইসব সময়ের পরিস্থিতি কতটা নড়বড়ে ছিল—এটা ভাবতে হলে মনে রাখতে হবে, বিনিয়োগকারীরা মূলত ৩০০ বিলিয়ন ডলার আমাদের মতো সাধারণ ভোক্তাদের হাতে হস্তান্তর করেছিলেন। গত ১৬ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে তেল উৎপাদনের যে অভাবনীয় উল্লম্ফন ঘটেছে, তা দেখে অনেকেই মনে করছেন—“অর্থনীতিতে তেল সম্পদ থাকলে সমৃদ্ধি আসবেই।” কিন্তু ইতিহাস বলে, পৃথিবীর অনেক দেশে তেল সম্পদই হয়ে উঠেছে অভিশাপ। মনে রাখা দরকার, এই সম্পদ (Resource) সীমিত (Finite)। শেল শিলাস্তর (Shale Formations) কখনো না কখনো শেষ হয়ে যাবে। এটা স্পষ্ট যে, শেয়ারবাজারের (S&P 500) উল্লম্ফন সত্ত্বেও তেল ও গ্যাস কোম্পানির শেয়ার (oil and gas stocks) একইভাবে বাড়ছিল না। তবু বিনিয়োগকারীরা হন্যে হয়ে অন্য কোথাও বিনিয়োগের সুযোগ না পেয়ে শেল খাতে টাকা ঢেলেছিল।
এর পেছনে বড় কারণ ছিল ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা (recession)। তখন বিনিয়োগকারীরা মরিয়া হয়ে এত বড় বড় প্রকল্পে টাকা ঢেলেছিল, কারণ তখনকার সুদের হার (interest rate) ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়, আর বিনিয়োগের মানদণ্ডও ছিল ঢিলেঢালা। তবে শেষমেশ, শেল বিনিয়োগকারীরাও ধৈর্য হারায়। কয়েক বছর আগে তারা চাপে ফেলে কোম্পানিগুলোকে লাভজনক হওয়ার (deliver financially) জন্য চাপ দিতে শুরু করে।
একই সময়ে, যেই আর্থিক পরিবেশের ওপর শেল নির্ভর করেছিল, সেটিও বদলে যায়।
- প্রথমত, এখন আর ‘প্রায় বিনা সুদে’ ঋণ পাওয়া যায় না; ব্যাংকে টাকা রাখলেও সুদ অনেক বেশি।
- দ্বিতীয়ত, উপকরণ ও শ্রমের খরচ (material and labor costs) বেড়েছে।
- তৃতীয়ত, তেলের বাজার সংক্রান্ত যে ‘বৃহত্তর গল্প’ বা ন্যারেটিভ (narrative) ছিল, সেটিও পাল্টে যেতে শুরু করে।
বর্তমানে বাজার কিছুটা একীভূতকরণের (Consolidation) মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শীর্ষ বড় কোম্পানিগুলো আরও কার্যকরী উৎপাদনের দিকে মনোযোগী হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এক্সন (Exxon) সম্প্রতি ৬০ বিলিয়ন ডলারে পারমিয়ান বেসিনের শীর্ষস্থানীয় তেল উত্তোলক পাইওনিয়ার ন্যাচারাল রিসোর্সেস (Pioneer Natural Resources) কিনে নিয়েছে। শেভরনও (Chevron) ৫৩ বিলিয়ন ডলারে হেস (Hess) অধিগ্রহণের চেষ্টায় আছে। মূল উদ্দেশ্য হলো আয়তনে (Economies of Scale) বড় হয়ে উৎপাদন খরচ কমানো ও মুনাফা বাড়ানো। গত পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত (Publicly Traded) তেল ও গ্যাস কোম্পানির সংখ্যা ৬৫ থেকে ৪১-এ নেমে এসেছে, মূলত অধিগ্রহণ (Acquisition) এবং একীভূতকরণের কারণে।
উৎপাদনের ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকারি সংস্থা ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (US Energy Information Administration) বলছে, ২০৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তেল ও লিজ কনডেনসেট (Lease Condensate) উৎপাদন সর্বোচ্চে পৌঁছাতে পারে এবং তারপর কয়েক দশক ধরে সেটি মোটামুটি একই পর্যায়ে থাকতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ফ্র্যাকিং দ্রুত তেল উত্তোলনে সক্ষম, ফলে মজুদও দ্রুত শেষ হতে পারে।
অনেক হিসাব বলছে, বর্তমান হারে উত্তোলন চললে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে প্রমাণিত (Proven) তেল মজুদ প্রায় ১১ বছর টিকবে। অবশ্য ঐতিহ্যবাহী প্রযুক্তির (Traditional Technology) মজুদ হিসাবেই এই গণনা; ফ্র্যাকিং প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন মজুদ উত্তোলন সম্ভব। তবুও এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, এই শিল্প শিগগির পরিণতির দিকে এগোচ্ছে এবং যত দিন পারা যায়, তত দিন দ্রুত উত্তোলন করে লাভ তোলাই ব্যবসায়িক কৌশল হয়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (International Energy Agency বা IEA) পূর্বাভাস অনুযায়ী, বৈশ্বিক তেলের চাহিদা (global oil demand) শীর্ষে পৌঁছবে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে—যা প্রায় ২০২৯ সালের কথা বলে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো অবশেষে পিক অয়েলের (peak oil) মুখোমুখি হবে, যদিও আগেরবারের মতো সরবরাহের (supply) অভাবে নয়, বরং চাহিদার (demand) সম্ভাব্য নিম্নমুখিতার কারণে। অনেকে অবশ্য এই ২০২৯ সাল নিয়ে একমত নন। এর বড় অংশ নির্ভর করছে একটি মাত্র ব্যক্তি এবং একটি মাত্র দেশের উপর—চীনের (China) সিদ্ধান্তের উপর। বিগত বছরগুলোতে বেইজিং (Beijing) নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে (renewables) সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে এবং বৈদ্যুতিক গাড়ির (electric vehicles) সবচেয়ে বড় বাজারও সেখানে। এর মানে হতে পারে, চীনের তেলের ক্ষুধা আস্তে আস্তে কমছে। আবার কেউ কেউ বলেন, এটি ভুল হতে পারে।
তবু এসব পূর্বাভাসই তেল বাজারের গল্পটা বদলে দিচ্ছে। অনেক মার্কিন তেল কোম্পানি (US oil companies) এখন আর দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করতে চাইছে না, কারণ তারা জানে না যে দীর্ঘমেয়াদি বাজার আদৌ থাকবে কিনা।
শেল বিপ্লবের দুই ধাপ: শুরুর উত্থান ও পরবর্তী নগদায়ন
এখন পর্যন্ত, “শেল বিপ্লবের প্রথম ধাপ” হিসেবে যা বলা যায়, সেখানে কোম্পানিগুলো প্রায় ১৪০% নগদ প্রবাহ (cash flow) পুনঃবিনিয়োগ করে গেছে (ঋণ নিয়ে), নতুন নতুন কূপ খননে। কিন্তু ২০২০ সালের দিকে এসে, তারা ক্যাশ আউট (cashing out) করা শুরু করে। অর্থাৎ, যতক্ষণ সংগীত বাজছে, ততক্ষণ নাচার মতোই যত বেশি সম্ভব অর্থ উপার্জন করে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
আগে তারা ধীরে-সুস্থে অনেক জায়গায় কূপ খনন করত, কারণ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল। এখন তারা দ্রুত সবচেয়ে লাভজনক (tier one sweet spots) জায়গাগুলো খুঁজে খুঁজে শেষ করছে, যা সাময়িকভাবে লাভ বাড়াবে ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে শেল রিজার্ভের সুযোগ কমিয়ে দিচ্ছে।
একই সময়ে, কোম্পানিগুলো একীভূত হয়ে যাচ্ছে (consolidation)। বড় কোম্পানিগুলো ছোট শেল কোম্পানিগুলোকে কিনে নিচ্ছে, ফলে প্রতিযোগিতা (competition) কমে যাচ্ছে। এটিই দ্বিতীয় ধাপ বা ‘ফেজ টু’ (phase two)। পূর্বের মতোই, এটি ভূ-রাজনৈতিকভাবে (geopolitically) বিরাট প্রভাব ফেলবে।
যুক্তরাষ্ট্রের “শক্তি স্বয়ংসম্পূর্ণতা” (energy independence) মিথ
যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু এখনই তার জ্বালানি স্বাধীনতা হারাবে না, কারণ আসলে সত্যিকার অর্থে সে কখনোই এককভাবে স্বাধীন ছিল না। আজকের দিনে যুক্তরাষ্ট্র যত তেল ব্যবহার করে, প্রায় সমপরিমাণই উৎপাদন করে বটে, কিন্তু তবুও তারা সম্পূর্ণ আত্মনির্ভর নয়।
সমস্যাটি হলো, কাচা তেলকে (crude oil) ব্যবহারযোগ্য জ্বালানিতে (fuel) পরিণত করতে প্রথমে তা শোধন (refine) করতে হয়। উপরন্তু, সব ধরনের কাচা তেল এক রকম নয়—তেল হতে পারে সুইট (sweet) বা সাউর (sour), লাইট (light) বা হেভি (heavy)।
২০০৮ সালের আগে যুক্তরাষ্ট্র যে কাঁচা তেল উৎপাদন করত, তা তুলনামূলকভাবে সাউর ও হেভি ছিল। সে অনুযায়ী দেশের বেশিরভাগ রিফাইনারি (refinery) এই ধরনের তেল প্রক্রিয়াকরণের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু শেল তেল (shale oil) সাধারণত লাইট ও সুইট (light and sweet), যা ঐতিহ্যবাহী রিফাইনারিগুলো ব্যবহারের উপযোগী নয়।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র চাইলে নতুন রিফাইনারি বানাতে বা পুরোনোটি সংস্কার করতে পারত। দেশটি ইচ্ছা করলে তার বন্দর বন্ধ করে নিজের ভেতরেই সবকিছু প্রক্রিয়াকরণ করে নিতে পারত—একধরনের পূর্ণাঙ্গ শক্তি স্বনির্ভরতা (energy independence)। কিন্তু রিফাইনারি বানানো খুব ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। সাম্প্রতিক পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র দুটি রিফাইনারি যোগ হয়েছে, আর শতাব্দীর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত হয়েছে মাত্র সাতটি।
ফলে, প্রতিটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট (নিক্সন থেকে শুরু করে পরবর্তীরা) মুখে মুখে শক্তি স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বললেও, কেউই সত্যিকারের পদক্ষেপ নিয়ে গ্যাসের দাম বাড়াতে রাজি হয়নি। অতএব, যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদিন প্রায় ১০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল আমদানি ও রপ্তানি (import and export) করে—সারা বিশ্বের নানা রিফাইনারিতে পাঠায় ও নিয়ে আসে।
শেল যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্য (Middle East) থেকে পুরোপুরি মুক্ত করেনি, বরং একে দিয়েছে বিশাল নমনীয়তা (flexibility) ও স্থিতিশীলতা (stability)। যুক্তরাষ্ট্রে তেল কোম্পানিগুলো ব্যক্তিমালিকানাধীন হওয়ায়, সরকার ইচ্ছেমতো ফোন করে তাদেরকে উৎপাদন বাড়াতে বা কমাতে বলতে পারে না—যেমনটি সৌদি আরব সরকার সরাসরি আরামকোর (Aramco) মাধ্যমে করতে পারে। তারপরও, বিশ্ব তেলের বাজার (global oil market) একটি শূন্য-ফলাফলপূর্ণ বা জিরো-সাম প্রতিযোগিতা (zero-sum competition)। এখানে নতুন সরবরাহ যুক্ত হলে, অন্য সরবরাহকারীদের ক্ষমতা আপনা-আপনি কমে যায়।
শেল তেল ও সৌদি আরবের ক্ষমতার সীমা
২০১৪ সালের দামের যুদ্ধ (price war) থেকেই আমরা সৌদি আরবের ক্ষমতার একটা সীমা দেখতে পেয়েছি। আগে অপেক (OPEC) প্রায় ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করে ফেলতে পারত, কিন্তু এখন তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রের শেল প্রযোজকদের সঙ্গে পাল্লা দিতে হচ্ছে। শেল কোম্পানিগুলো দ্রুত ও স্বাধীনভাবে উৎপাদন বাড়াতে বা কমাতে পারে, সৌদির পরিকল্পনাকে বানচাল করে দিতে পারে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র কতটা দ্রুত তেল উৎপাদন বাড়াতে বা কমাতে পারে। ঐতিহ্যবাহী তেল স্থাপনা শুরু করতে বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে, কিন্তু শেল কূপ (shale wells) তুলনামূলকভাবে অনেক দ্রুত স্থাপনযোগ্য। আগে সৌদি আরবকে (Saudi Arabia) বলা হতো বিশ্বের ‘সুইং প্রডিউসার’ (swing producer), কারণ তারা উৎপাদন বাড়িয়ে বা কমিয়ে বিশ্ব বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। কিন্তু শেল আসার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এই সুবিধাটা অনেকাংশে পেয়ে গেছে।
যদিও মার্কিন তেল কোম্পানিগুলো সরাসরি ওয়াশিংটনের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের (geopolitical interests) পক্ষে কাজ করে না—তারা নিজেরাই লাভের আশায় দ্রুত সরবরাহ বাড়ায়। এর ফলেই বিশ্ব বাজার তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকে। অন্যথায় নানা আন্তর্জাতিক সংকটে তেলের দাম প্রচণ্ড ওঠানামা করত।
উদাহরণস্বরূপ, আরব বসন্ত (Arab Spring) চলাকালীন লিবিয়া, ইরান, সিরিয়া ও সুদান অঞ্চলে তেলের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এটা বিশাল ধাক্কা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অতিরিক্ত তেল সরবরাহ বিশ্ববাজারে যোগ হওয়ায়, দাম বেশি অস্থির হয়নি।
একইভাবে, ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমা (Fukushima) পরমাণু দুর্ঘটনার (disaster) পর, মার্কিন প্রাকৃতিক গ্যাস (natural gas) জাপানকে অনেক সাহায্য করে। এটি জাপানের জন্য ভালো ছিল, শেল কোম্পানিগুলোর জন্যও লাভজনক ছিল, আমেরিকান ভোক্তারা পাম্পে (pump) কম দাম দিয়েছে, এবং বিশ্বের চোখে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হয়েছে।
এমনকি ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের (invasion of Ukraine) পর ইউরোপে রাশিয়ান তেলের রপ্তানি (exports) কমে গেলে আবারও যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে এসে যোগান দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই নমনীয়তা (flexibility) জার্মানির মতো দেশগুলিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নৈতিক অবস্থান নিতে সহায়তা করেছে।
কিন্তু ড্রিলাররা যারা এতদিন দাম বাড়লেই হুরমুর করে উৎপাদন বাড়াত, বিনিয়োগকারীরা যারা অপেক্ষাকৃত কম দামে তেল সরবরাহ করত, আর সরকার যেটা এই বাজার চাপে রাজনৈতিক সুবিধা পেত—এই সাময়িক মিলন আর স্থায়ী হচ্ছে না।
পরিবেশগত বিবেচনা ও রাজনৈতিক চাপে ভবিষ্যৎ
ফ্র্যাকিং-এর ভবিষ্যৎ অনুমান করা কঠিন, কারণ এর সঙ্গে পরিবেশ রক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন (Global Warming), এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির (Renewable Energy) উন্নয়নের মতো বিষয় জড়িত। একদিকে সরকার (Federal Administration) বলছে, তারা এই শিল্পকে সমর্থন দিচ্ছে। অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের (Long-Term Investment) ক্ষেত্রে নানা বিধি-নিষেধ বা নিয়ন্ত্রণ (Regulation) ভবিষ্যতে কঠোর হতে পারে।
কার্বন নিঃসরণ (Carbon Emissions) কমানোর পরিকল্পনায় (Net Zero Ambitions) যুক্তরাষ্ট্র ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্য নিঃসরণে পৌঁছাতে চায়। তেল জ্বালানোই শুধু নয়, ফ্র্যাকিং চলাকালে প্রায়ই মিথেন (Methane) গ্যাস লিক হয়, যা কার্বন ডাই-অক্সাইডের (CO₂) চেয়ে ৩০ গুণ বেশি গ্রিনহাউস (Greenhouse) প্রভাব সৃষ্টি করে। তেল উত্তোলনের সময় মাটির নিচের চাপ কমাতে ন্যাচারাল গ্যাস ফ্লেয়ারিং (Natural Gas Flaring) করা হয়, যা আবার বাতাসে গ্যাস জ্বালিয়ে দেয়—ব্যবহার করা হয় না। এ ছাড়া ফ্র্যাকিং-এ প্রচুর পরিমাণে পানি লাগে এবং ব্যবহৃত পানি মাটির নিচে পুনরায় পাম্প করলে তা ভূগর্ভস্থ জল দূষণ (Groundwater Contamination) করতে পারে। এ সব কারণে অনেক উন্নত দেশে ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অঙ্গরাজ্যে ফ্র্যাকিং নিষিদ্ধ (Ban) বা সীমিত (Moratorium) করা হয়েছে।
এ ছাড়া পারমাণবিক শক্তি (Nuclear Energy) নতুন করে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির পাশাপাশি এটি “নেট জিরো (Net Zero)” লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কার্যকর হতে পারে—যুক্তরাষ্ট্র ২০৫০ সালের মধ্যে পারমাণবিক শক্তিকে তিন গুণ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। কাজেই, ভবিষ্যতে তেলশিল্পকে বা ফ্র্যাকিংকে নানা চাপে পড়তে হবে এটা স্পষ্ট।
রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ, ইউরোপীয় বাজার ও মার্কিন ভূমিকায় পরিবর্তন
যুক্তরাষ্ট্রের শেল বুমের আরেকটি ফলাফল হলো—পশ্চিমা বিশ্ব এখন তেলের উৎস নির্বাচন করতে আরও সাবধানী হতে পারছে। রাশিয়া ২০২২ সালে ইউক্রেইনে (Ukraine) আগ্রাসন শুরু করলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) রুশ তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়া ছিল ইইউর একটি প্রধান জ্বালানি সরবরাহকারী। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, রাশিয়ান তেল ও গ্যাস আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা (Sanction) আরোপ করে ইইউ—তাদের ছয় দফা প্যাকেজে (যা ২০২২ ও ২০২৩ সালে কার্যকর হয়) রাশিয়ান সিবর্ন (Seaborn) অপরিশোধিত তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। এর ফলে ইইউতে রাশিয়ান তেল আমদানি ৯০% পর্যন্ত কমে যায় এবং গ্যাসের ক্ষেত্রেও রাশিয়ান আমদানির হার ৪০% থেকে ১৫%-এ নেমে আসে। এটি আগামীতে আরও কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, কারণ ইইউ প্রথমবারের মতো রুশ গ্যাসের ওপরও সরাসরি নিষেধাজ্ঞা চাপাতে শুরু করেছে।
এই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্র। শেল বুমে তাদের উৎপাদিত অতিরিক্ত তেল ও এলএনজি (LNG) অর্থাৎ লিকুইফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস (Liquefied Natural Gas) রপ্তানি করে ইউরোপে বড় সরবরাহকারী হয়ে ওঠে তারা। ইউরোপের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের তেল ও গ্যাস কেনা ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ একটি সমাধান—কারণ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ অনেকটাই সমমনা। এছাড়া সৌদি আরব বা রাশিয়ার মিত্র কাজাখস্তানের (Kazakhstan) মতো রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার ঝুঁকি ইউরোপ চায়নি। তাই শুধু নতুন এলএনজি টার্মিনালগুলো দ্রুত তৈরি করে ইউরোপ রাশিয়ান গ্যাসের পরিবর্তে মার্কিন গ্যাস আমদানি শুরু করে। ফলস্বরূপ, রাশিয়া যেসব দেশে মোটামুটি অর্ধেক তেল ও তার বেশি গ্যাস রপ্তানি করত—সেই ইউরোপীয় বাজারে বড় ধাক্কা খায়। নতুন ক্রেতা হিসেবে ভারত (India), চীন (China) ও তুরস্ক (Turkey) রাশিয়ান তেল কিনতে এগিয়ে এলো বটে, তবে রাশিয়াকে তখন বিশ্ববাজারে ব্যাপক ছাড় দিতে হলো।
সৌদি আরবের অবস্থান: ১৯৭৩-এর পুনরাবৃত্তি নেই কেন?
সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের ডি-ফ্যাক্টো (De Facto) নেতা এবং ওপেকের মূল চালিকাশক্তি। ১৯৭৩ সালে তারা ইসরায়েলকে সমর্থনকারী পশ্চিমাদের ওপর তেল নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। এবার যদিও ইসরায়েলের সঙ্গে আবার সংঘাত চলছে, সৌদি আরব এখনো আক্রমণাত্মকভাবে কার্ড খেলেনি। এর কারণ একাধিক। একদিকে, বিগত কয়েক দশকে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। সৌদি আরব এখন বিনিয়োগে বৈচিত্র্য আনতে চায়—তেলনির্ভরতা কমিয়ে বিনোদন (Entertainment), পর্যটন (Tourism), প্রযুক্তি (Technology) প্রভৃতি ক্ষেত্রে এগোতে চায়। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শত্রুতা তাদের ক্ষতি করতে পারে।
অন্যদিকে, পশ্চিমা বিশ্ব এখন সৌদি তেলের ওপর সেই পর্যায়ের নির্ভরশীল নয়। যুক্তরাষ্ট্রের শেল বুমের কল্যাণে আজ ১৯৭০-এর দশকের মতো তেলের ঘাটতি হলে পশ্চিমারা অচল হয়ে যাবে—এমন আশঙ্কা নেই। কাজেই, এখন সৌদি আরব যদি আরেকটি তেল অবরোধ (Embargo) চাপায়ও, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ সহজেই অন্য উৎস থেকে জোগান পেতে পারে। এতে সৌদির নিজেরই ক্ষতি হবে বেশি। তাই এমন কোনো চরম পদক্ষেপ নেওয়া এখন তাদের পক্ষে সঙ্গত নয়।
বিশ্ববাজারে দর-যুদ্ধ: সৌদি আরব বনাম যুক্তরাষ্ট্র
সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দৃশ্যমান মিত্রতা থাকলেও, তেল ও গ্যাসের বিশ্ববাজারে দুটি পক্ষই প্রতিযোগী। গত দুই বছর ধরে সৌদি আরবের নেতৃত্বে ওপেক তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারে নিয়ে যেতে চায়। বাজারে সংকট তৈরি করে দাম বাড়াতে তারা উৎপাদন কেটে (Production Cut) সরবরাহ কমাচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা (Canada) এবং নতুন খেলোয়াড় গায়ানা (Guyana)—যার তেলশিল্প মূলত মার্কিন কোম্পানিগুলো পরিচালনা করে—তারা উৎপাদন বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে বিশ্ববাজারে দাম তেমন বাড়ছে না; ব্যারেলপ্রতি ৭০-৮০ ডলারের আশেপাশেই আটকে থাকছে।
এছাড়া চীনের (China) অর্থনীতিতে চাহিদা দুর্বল হয়েছে, তারা বিশ্ববাজারের সবচেয়ে বড় তেল আমদানিকারক (Importer)। ফলে সৌদির আয় কমছে, আর বাজেট ঘাটতি (Budget Deficit) সামাল দিতে তাদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এখন সৌদি আরবের কাছে দুটি পথ খোলা। এক, তারা চায় যদি মার্কিন শেলের বাজারদখল আর না বাড়ে, তাহলে ওপেক ও ওপেক প্লাসকে (OPEC Plus) নিয়ে করা উৎপাদন কাটা প্রত্যাহার করে তারা উৎপাদন বাড়াতে পারে। সৌদি আরব একাই প্রতিদিন ৩০ লাখ ব্যারেল বেশি তেল উত্তোলন করতে সক্ষম। এমনটা করলে বাজারে সরবরাহ বেড়ে দামের পতন হবে, যাকে বলে প্রাইস ওয়ার (Price War)। স্বল্প মেয়াদে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তবে উচ্চ খরচের (High-Cost) মার্কিন শেল উৎপাদন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বে। আর রাশিয়ার (Russia) ক্ষেত্রেও এই কম দাম যুদ্ধ অর্থায়নে বড় ধাক্কা দেবে।
দ্বিতীয় বিকল্প হলো, সৌদি আরব ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবে। শেল বুমের চূড়ান্ত স্তর প্রায় পার হয়ে গেছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্রের পারমিয়ান বেসিনে (Permian Basin) নতুন কূপের উৎপাদনও কমতে শুরু করেছে। ওয়াল স্ট্রিট (Wall Street) বিনিয়োগে সংযমী হচ্ছে। সৌদি আরবের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে প্রায় সাত গুণ বেশি প্রমাণিত তেল মজুদ রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ উৎপাদন রাখার সক্ষমতা তাদের আছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের রিসার্ভ (Reserve) শেষ হতে শুরু করলে সৌদি আরব বিশ্ব তেলের “লিডিং পাওয়ার (Leading Power)” হিসেবে পুরনো অবস্থান ফিরে পেতে পারে।
২০২২: ভিন্ন রূপের মার্কিন শেল
২০২২ সালে, রাশিয়ার যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১৩০ ডলারে উঠে, যা ২০১৪ সালের পর সর্বোচ্চ। আগের ১৫ বছরে এমন হলে, মার্কিন তেল কোম্পানিগুলো দ্রুত নতুন কূপ খনন করত বাড়তি মুনাফা লুফে নেওয়ার জন্য। কিন্তু এ সময় তারা বর্ধিত তেলের দাম সত্ত্বেও আগের মতো উৎপাদন বাড়ায়নি। বরং আগের চেয়ে কম উৎপাদন করেছে।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন (President Biden) এর জেরে প্রকাশ্যে এই কোম্পানিগুলোকে উৎপাদন বাড়ানোর আহ্বান জানান এবং সরাসরি বলেন, “তারা যুদ্ধের সুযোগে মুনাফা নিচ্ছে।” একেবারে পরিষ্কার ভাষায় তিনি দায় চাপান। এক্সন (Exxon) ও শেভরন (Chevron) কিন্তু কাঁধ ঝাঁকিয়ে চুপ করে থাকে। ভবিষ্যতেও এ ধরনের অবস্থাই অব্যাহত থাকবে।
এর মানে এই নয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের তেল উৎপাদন একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে বা কমতে থাকবে। বরং দ্রুত বৃদ্ধির যুগ (rapid growth) শেষ হয়ে গেছে। কোম্পানিগুলো এখন আর ভোক্তাদের স্বার্থে বা বেশি উৎপাদনের জন্য হন্যে নয়; তারা এখন লাভ (profit) চাইছে। ২০২১ ও ২০২২ সালে তারা আগের ১৫ বছরে যত লোকসান করেছিল, তার প্রায় সমপরিমাণ মুনাফাই তুলে নিয়েছে—এটা বিশাল অঙ্ক। ফলে বাজারে সহজলভ্য ‘বাফার’ বা ‘কুশন’ আর থাকছে না, বিশ্ববাজারে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনামূলক ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। সৌদি আরবের মতো অন্য উৎপাদনকারীরা তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
এতে একটি ইতিবাচক দিকও আছে—পরিষ্কার জ্বালানিতে (clean energy) পরিবর্তন হয়তো আরো ত্বরান্বিত হবে। শেল বিপ্লব ছিল একধরনের ‘মিষ্টি বিষ’ (sweet poison)। শেল পাথর (shale rock) ভেঙে তেল ওঠানোর ফলে যুক্তরাষ্ট্র আসলে কয়েক দশক ব্যবহারযোগ্য নতুন তেলের মজুত পেয়েছিল, যার ফলে আবেশে তারা ভুলতে বসেছিল যে তেল একদিন ফুরিয়ে যাবে, এবং তারা ধ্বংস করছে তাদের একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহকেই।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের বড় এসইউভিগুলো (SUV) আর আগের মতো সস্তায় বা অনায়াসে জ্বালানি পাবে না। অনেকটা ঝড়ের বেগে বাস্তবতার সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটতে যাচ্ছে। এই পরিবর্তন অবশ্যই বেদনাদায়ক হবে, তবে হয়তো এই ‘ব্যথা’ই যুক্তরাষ্ট্রের দরকার, যেন তারা টেকসই ভবিষ্যতের দিকে দ্রুত অগ্রসর হতে পারে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ও সম্ভাবনা
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence, AI) সাম্প্রতিক সময়ে প্রযুক্তি শিল্পের অন্যতম আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে এবং এর প্রকৃত সক্ষমতা এখন আমরা বাস্তবে উপলব্ধি করতে শুরু করেছি। বিশ্ব যখন আরও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে, তেল ও গ্যাস শিল্পেও বড় ধরনের রূপান্তর ঘটছে। এআই এই খাতে খরচ কমানো, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তেল ও গ্যাস শিল্প বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলেও এটি বেশ কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং আরও টেকসই হওয়া, পাশাপাশি অভিজ্ঞ শ্রমিকদের অবসর ও নতুন কর্মীর অভাবজনিত সংকট এর মধ্যে অন্যতম।
এআই বিভিন্নভাবে এই শিল্পকে সাহায্য করতে পারে। ভূতাত্ত্বিক তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে নতুন তেল ও গ্যাসের মজুদের সম্ভাব্য অবস্থান দ্রুত শনাক্ত করে অনুসন্ধান খরচ কমানো সম্ভব। উৎপাদন প্রক্রিয়া অপ্টিমাইজ করতে এআই যন্ত্রপাতির ব্যর্থতার পূর্বাভাস দিতে পারে, যা সময়মতো রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করে উৎপাদন বিঘ্নের ঝুঁকি কমায়। এআই সম্ভাব্য নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি শনাক্ত করে দ্রুত সতর্কবার্তা প্রদান করতে সক্ষম হওয়ায় দুর্ঘটনা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এই খাতে এআই’র প্রয়োগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো স্বয়ংক্রিয় ড্রিলিং ব্যবস্থা, যা ড্রিলিং প্রক্রিয়াকে নিরাপদ ও কার্যকর করতে এআই অ্যালগরিদম ব্যবহার করে যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ এবং ঝুঁকি শনাক্ত করে। এর ফলে উৎপাদনশীলতা বাড়ে এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমে। প্রেডিক্টিভ মেইনটেন্যান্সের মাধ্যমে এআই যন্ত্রপাতির সম্ভাব্য ত্রুটি শনাক্ত করে আগে থেকেই মেরামতের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করতে পারে, যা অপারেশনাল খরচ ও অচলকাল কমিয়ে কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। ভূগর্ভস্থ রিজার্ভের আচরণ নির্ধারণেও এআই ব্যবহৃত হয়, যার ফলে উত্তোলন কার্যক্রমের সময় এবং পরিমাণ নির্ধারণ আরও কার্যকর হয়।
এআই ব্যবহারের মাধ্যমে খরচ সাশ্রয়, উৎপাদন প্রক্রিয়া উন্নতকরণ এবং দুর্ঘটনা প্রতিরোধের পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে টেকসই উন্নয়নের পথে এগোনো সম্ভব। তবে এআই ব্যবহারে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বিশাল আকারের ভূতাত্ত্বিক তথ্য ও সেন্সর ডেটা সঠিকভাবে আয়ত্তে নিয়ে কার্যকর মডেল তৈরি করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তেল ও গ্যাস শিল্পের ঐতিহ্যবাহী কর্মীরা প্রযুক্তিগত দক্ষতায় অভ্যস্ত না হওয়ায় ডেটা সায়েন্টিস্ট, মেশিন লার্নিং ইঞ্জিনিয়ার এবং সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞদের পুনরায় প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে থেকে কাজ করতে হবে, যা আইনগত কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিকল্পনা প্রণয়নকে আরও কঠিন করে তুলেছে। তাছাড়া এআই-চালিত সিস্টেম সাইবার আক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে, যা মোকাবিলার জন্য উপযুক্ত সাইবার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি।
তেল ও গ্যাস শিল্পে এআই’র বিপ্লব ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে এবং এটি দক্ষতা বাড়ানো, খরচ কমানো এবং নিরাপত্তা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিচ্ছে। স্বয়ংক্রিয় ড্রিলিং, প্রেডিক্টিভ মেইনটেন্যান্স এবং রিজার্ভ অপ্টিমাইজেশনের মতো উদ্ভাবনী পদ্ধতির মাধ্যমে অনুসন্ধান খরচ কমছে, উৎপাদন প্রক্রিয়া আরও উন্নত হচ্ছে এবং কার্বন নিঃসরণ কমানোর পথ সুগম হচ্ছে। এআই-নির্ভর উদ্ভাবন তেল ও গ্যাস খাতের ভবিষ্যতকে আরও সমৃদ্ধ ও ঝুঁকিহ্রাসকারী করে তুলেছে। টেকসই ভবিষ্যতের অভিযাত্রায় শামিল হতে এই শিল্পকে প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি, ডেটা ব্যবস্থাপনা এবং সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তবে একসঙ্গে সঠিক পরিকল্পনা ও প্রয়োগের মাধ্যমে এআই এই শিল্পকে আরও প্রতিযোগিতামূলক ও টেকসই করতে সহায়তা করবে।
উপসংহার
যুক্তরাষ্ট্র জানে যে তারা অনন্তকাল তেলের ওপর নির্ভর করে থাকতে পারবে না। তবুও বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় তারা তেল উৎপাদন, রপ্তানি ও পরিশোধন খাতে ব্যাপকভাবে লাভ করছে। ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিশ্ববাজারের চাহিদা বিবেচনায়, দেশে প্রচুর তেল উৎপাদন করার সক্ষমতা তাদেরকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে গেছে। আমদানি নির্ভরতা এখন অনেক কমে গেছে, তবে পরিশোধনাগার কাঠামো ও ব্যবসায়িক কৌশলের কারণে আমদানি পুরোপুরি বন্ধও হচ্ছে না।
এর পাশাপাশি পরিবেশগত ঝুঁকি, ভবিষ্যৎ মজুদের সীমাবদ্ধতা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকাশ—এই সবকিছুর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের তেলশিল্পকে মানিয়ে নিতে হবে। এখন পর্যন্ত তারা সুপ্রিম (Supreme) ভুমিকায় থাকলেও, দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে হলে উৎসবের পাশাপাশি প্রস্তুতি ও রূপান্তরের পথও খুঁজতে হবে।
তথ্যসূত্র
- The Boom: How Fracking Ignited the American Energy Revolution and Changed the World, Russell Gold
- Windfall: How the New Energy Abundance Upends Global Politics and Strengthens America’s Power, Meghan L. O’Sullivan
- The New Map: Energy, Climate, and the Clash of Nations, Daniel Yergin
- Saudi America: The Truth About Fracking and How It’s Changing the World, Bethany McLean
- https://www.eia.gov/tools/faqs/faq.php?id=709&t=6.
- https://www.oecd-ilibrary.org/docserver/dbf6150b-en.pdf?expires=1728925419&id=id&accname=guest&checksum=58F02ED908492563E05DACF00C1A87D6
- https://ourworldindata.org/grapher/installed-solar-pv-capacity?time=2008..latest&country=CHN~USA
- https://www.wsj.com/business/energy-oil/americas-oil-power-might-be-near-its-peak-5d956a24
- https://www.ft.com/content/84e228a9-9e97-4445-9527-2b7ed80283a7
- https://www.wsj.com/articles/u-s-oil-boom-blunts-opecs-pricing-power-472567f?mod=article_inline
- https://www.wsj.com/articles/the-texas-well-that-started-a-revolution-1530270010?mod=article_inline&mod=article_inline
- https://www.wsj.com/articles/taking-the-fracking-boom-global-1529409963?mod=article_relatedinline
- https://pubs.geoscienceworld.org/aapg/aapgbull/article/107/6/851/623376/M-King-Hubbert-and-the-rise-and-fall-of-peak-oil
- https://www.aei.org/economics/this-is-not-the-world-that-the-peak-oil-energy-doomer-promised/
- https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S2214629621004941?via%3Dihub
- https://www.forbes.com/sites/davidblackmon/2024/09/24/california-targets-exxonmobil-with-plastics-recycling-lawsuit/?
- https://iea.blob.core.windows.net/assets/6ff5beb7-a9f9-489f-9d71-fd221b88c66e/Oil2023.pdf
- https://www.wsj.com/articles/fracking-oil-prices-shale-boom-11643824329
- https://www.bloomberg.com/news/articles/2022-02-18/shale-wildcatters-send-bullish-oil-price-signal-with-output-restraint
- https://www.ft.com/content/030dc3c8-0f25-483e-91aa-9dbd9abc5c4d
- https://www.nytimes.com/2022/07/27/opinion/environment/energy-crisis-oil-gas-fracking.html
- https://www.desmog.com/2015/08/02/once-burned-twice-shy-utica-shale-touted-investors-shale-drillers-continue-posting-losses/
- https://www.desmog.com/2018/04/18/finances-great-american-fracking-bubble/
- https://www.npr.org/2023/06/09/1179415899/oil-production-gas-prices-opec-climate-change-permian-basin-texas
- https://www.gao.gov/products/gao-21-118
- https://www.propublica.org/article/frack-fluid-spill-in-dimock-contaminates-stream-killing-fish-921#photo_correx
- https://apnews.com/article/gas-drilling-fracking-water-pollution-dimock-378d15157b7a53bb34f3633f99f5228f
- https://www.wsj.com/articles/wall-streets-fracking-frenzy-runs-dry-as-profits-fail-to-materialize-1512577420
- https://www.wsj.com/articles/investors-question-oil-output-in-permian-basin-americas-fastest-growing-field-1502325779?mod=article_inline
- https://www.wsj.com/articles/shale-produces-oil-why-not-cash-1498486995?mod=article_inline
- https://www.bloomberg.com/news/articles/2022-05-05/u-s-shale-s-cash-bonanza-is-about-to-wipe-out-300-billion-loss
- https://www.desmog.com/2022/12/07/peak-us-oil-production-shale-boom-ends-bakken-permian/
- https://www.desmog.com/2021/01/28/us-crude-oil-exports-hasten-demise-oil-industry/
- https://www.economist.com/business/2017/03/25/americas-shale-firms-dont-give-a-frack-about-financial-returns
- https://oilprice.com/Energy/Crude-Oil/US-Shale-Oil-Production-Growth-Is-Slowing-Down.html
- https://prospect.org/environment/frackers-restrict-the-flow-and-raise-the-price/
- https://www.wsj.com/articles/SB10000872396390444549204578020602281237088
- https://www.nytimes.com/2019/06/30/business/energy-environment/oil-companies-profit.html
- https://www.bloomberg.com/news/articles/2020-03-09/shale-s-new-reality-almost-all-wells-drilled-now-lose-money
- https://www.economist.com/graphic-detail/2024/03/27/three-reasons-why-oil-prices-are-remarkably-stable
- https://www.wsj.com/business/energy-oil/peak-oil-demand-isnt-on-the-horizon-opec-says-e643ac82?st=GUpwUN&mod=googlenewsfeed
- https://www.economist.com/special-report/2024/03/11/why-oil-supply-shocks-are-not-like-the-1970s-any-more
- https://www.nytimes.com/2024/08/30/business/oil-prices.html
- https://www.nytimes.com/2024/07/16/business/energy-environment/oil-company-profits.html
- https://www.bloomberg.com/news/articles/2024-09-12/us-oil-boom-turns-kamala-harris-into-an-unlikely-fracking-supporter
- https://www.eia.gov/todayinenergy/detail.php?id=61545#
- https://www.eia.gov/todayinenergy/detail.php?id=57020
- https://www.nytimes.com/2023/12/01/business/energy-environment/us-oil-production-record-climate.html
- https://www.bloomberg.com/news/articles/2018-01-25/the-dark-side-of-america-s-rise-to-oil-superpower
- https://www.nytimes.com/interactive/2024/02/03/climate/us-lng-natural-gas-leader.html
- https://www.bakerinstitute.org/research/us-lng-exports-supply-siting-and-bottlenecks
- Oklahoma State Capitol imgae: This file is licensed under the Creative Commons Attribution-Share Alike 4.0 International license. Jno.skinner. Changes were made. https://creativecommons.org/licenses/by-sa/4.0/deed.en
Leave a Reply