স্ট্রিমিং যুদ্ধে ইউটিউব কীভাবে নেটফ্লিক্স ও ডিজনিকে পেছনে ফেলল?

Table of Contents

ভূমিকা

দীর্ঘদিন ধরে বিনোদন জগতে প্রচলিত টেলিভিশন (television) ছিল গ্রাহকদের কাছে মূল আকর্ষণ। কেবল সংযোগ (cable subscription), উপগ্রহ টিভি (satellite) কিংবা স্থানীয় চ্যানেলে অভ্যস্ত মানুষজন একটা নির্দিষ্ট সময়সূচিতে অনুষ্ঠান দেখেই সন্তুষ্ট থাকতেন। কিন্তু ২১ শতকে এসে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার, ইন্টারনেটের গতি বৃদ্ধি ও স্মার্ট ডিভাইসের সর্বব্যাপী উপস্থিতি পুরো চিত্রটি পাল্টে দিয়েছে। ক্রমেই মানুষ টিভি ছেড়ে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে (streaming platforms) চলে যাচ্ছেন—যাকে বলা হয় “কর্ড-কাটিং (cord cutting)”: অর্থাৎ ঐতিহ্যবাহী টিভি সংযোগ ছাড়াই সরাসরি ইন্টারনেটের মাধ্যমে কনটেন্ট দেখা।

এই পটভূমিতে একদা ডিভিডি ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা থেকে শুরু করে ইন্টারনেট-নির্ভর প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত হওয়া নেটফ্লিক্স (Netflix) বিশাল আলোড়ন তুলে বসে। স্ট্রিমিং বিষয়ে পথিকৃৎ (pioneer) হিসেবে তারা বিনোদনশিল্পকে (entertainment industry) নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। ফলে এমাজন প্রাইম (Amazon Prime), হুলু (Hulu), ডিজনি+ (Disney+), প্যারামাউন্ট+ (Paramount+) প্রভৃতি উত্থান দেখা যায়। বড় বড় কোম্পানিও নিজেদের স্ট্রিমিং সার্ভিস নিয়ে মাঠে নামে। এভাবে একে বলা হয় “স্ট্রিমিং ওয়ারস (streaming wars)”: কে সব থেকে বেশি গ্রাহক বা দর্শক আকর্ষণ করবে, কে সবচেয়ে জনপ্রিয় হবে।

অনেকদিন ধরেই ধারণা করা হচ্ছিল, সম্ভবত নেটফ্লিক্সই এই সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু ও রাজা। কারণ তারাই সাবস্ক্রিপশন-ভিত্তিক (subscription-based) স্ট্রিমিং-এর গোড়াপত্তন করেছে, বিশাল গ্রাহকভিত্তি তৈরি করেছে এবং বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল কনটেন্ট নিয়ে শীর্ষস্থানে উঠেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে অন্য এক প্ল্যাটফর্ম আশ্চর্যজনকভাবে সবাইকে পেছনে ফেলেছে: ইউটিউব (YouTube)। ঠিক কীভাবে এটি ঘটছে, কেন ইউটিউব এখন এত প্রভাবশালী, আর ভবিষ্যতে এর পরিণাম কী—সেই আলোচনাই এই আর্টিকেলের মূল লক্ষ্য।

স্ট্রিমিং যুগে নতুন বাস্তবতা

ঐতিহ্যবাহী টিভির পতন ও স্ট্রিমিং প্রসার

যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে কেবল টিভি বা স্যাটেলাইট টিভির সাবস্ক্রিপশন হ্রাস পেয়ে চলেছে। কারণ মানুষ পছন্দের অনুষ্ঠান যখন-তখন দেখতে চান, বিজ্ঞাপনের বিরক্তি এড়াতে চান, অথবা মাসিক ব্যয় (subscription fee) কমাতে চান। অন্যদিকে, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো (Netflix, Amazon Prime, Disney+, ইত্যাদি) গ্রাহকদের ইচ্ছামতো কনটেন্ট দেখার স্বাধীনতা দেয়, যেখানে আগ্রহী দর্শক মাত্র কয়েকটি বোতাম চেপেই নিজেদের প্রিয় সিরিজ, চলচ্চিত্র বা ডকুমেন্টারি উপভোগ করতে পারেন।

নেটফ্লিক্স এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা খুব অল্প সময়ে বিনোদনশিল্পে “মিডিয়া ডিস্টরাপ্টর (media disruptor)” হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা অন্যদের কনটেন্টের লাইসেন্স (license) কেনার পাশাপাশি নিজস্ব অরিজিনাল সিরিজ ও চলচ্চিত্র (Original Content) তৈরি করে বাজারে সাড়া জাগিয়েছে। এর ফলে ঐতিহ্যবাহী বড় বড় স্টুডিও বা টিভি নেটওয়ার্কও স্ট্রিমিং-এ নিজেদের জায়গা পাকা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অনেকে বলছিলেন, “স্ট্রিমিং যুদ্ধের বিজয়ী তো নেটফ্লিক্সই।”

কিন্তু সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে উঠে আসছে আরেক নতুন (বা বরং পুরোনো) নাম: ইউটিউব (YouTube)। কিছুদিন আগে পর্যন্ত হয়তো কেউ এটিকে “সোশ্যাল মিডিয়া” বা “ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম” হিসেবেই বেশি দেখতেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সময় ব্যয় (time spent) ও মোট ভিউয়িং (viewing) এর বিচারে ইউটিউব সবার চেয়ে এগিয়ে আছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে, ইউটিউব আজ নেটফ্লিক্সকেও পেছনে ফেলেছে।

ইউটিউব: নতুন নয়, তবে নতুন উচ্চতায়

ইউটিউব চালু হয়েছিল ২০০৫ সালে—গুগল (Google) তা কিনে নেয় ২০০৬ সালে ১.৬৫ বিলিয়ন ডলারে। সে সময় কেউ কল্পনাও করেনি যে এটি একদিন সবচেয়ে শক্তিশালী ভিডিও প্ল্যাটফর্মে পরিণত হবে। যদিও শুরুতে ইউটিউবের মূল পরিচয় ছিল: “যে কেউ ভিডিও আপলোড করতে পারে, আর অন্যরা তা দেখে আনন্দ পেতে পারে”—একটি ব্যবহারকারী-সৃষ্ট কনটেন্টের (user-generated content) প্ল্যাটফর্ম। অনেকেই এটিকে হালকাভাবে নিতেন, ভাবতেন এখানে কেবল বিড়ালের ভিডিও বা বাড়তি বিনোদন মেলে।

কিন্তু ২০২০-এর দশকে এসে দেখা যাচ্ছে, ইউটিউব কেবল স্মার্টফোন বা ল্যাপটপে নয়, ঘরের বড় পর্দা—টিভিতেও—ব্যাপকভাবে দেখা হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে এখন ইউটিউবের অর্ধেকের বেশি ভিউ টিভি স্ক্রিন থেকে আসে। বহু মানুষ, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম, কেবল টিভির অনুষ্ঠান দেখার বদলে ইউটিউব চালিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন কনটেন্ট উপভোগ করছেন। ফলত সামগ্রিক টিভি ব্যবহারের (total TV usage) একটি বড় অংশজুড়েই ইউটিউবের আধিপত্য।

হিসাব বলছে, কিছু সময়ের জন্য নেটফ্লিক্স হয়তো সময় খাতে (total usage) ৭%-এর মতো দখল ধরেছিল, কিন্তু ইউটিউব আরো বেশি সময় ও দর্শক ধরে রেখেছে। উপরন্তু, অন্যান্য সব ব্রডকাস্ট বা কেব্‌ল মালিকানাধীন নেটওয়ার্কগুলোর চেয়েও ইউটিউব এগিয়ে—ব্যতিক্রম শুধু ডিজনি, যারা ডিজনি+, হুলু, ইএসপিএন (ESPN), এবিসি (ABC) থেকে শুরু করে আরও বহু কেবল চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ করে।

ইউটিউবের মূল শক্তি: ফ্রি মডেল ও বিশাল কনটেন্ট লাইব্রেরি

বিনামূল্যে প্রবেশ ও বিজ্ঞাপন-নির্ভর আয়

অনেক স্ট্রিমিং সার্ভিসে মাসিক ফি (subscription fee) দিতে হয়, যা অনেকের কাছে বোঝা মনে হতে পারে। গ্রাহকদের কাঁধে বেশি খরচ না চাপিয়ে বিনোদন কীভাবে দেওয়া যায়, ইউটিউব সেটির এক অনন্য নজির। কারণ প্ল্যাটফর্মটি বিনামূল্যে (free) ব্যবহার করা যায়, যদিও বিজ্ঞাপন (advertising) দেখানো হয়। তরুণ দর্শকদের জন্য বিজ্ঞাপন দেখা অনেকটা স্বাভাবিক; তারা সাবস্ক্রিপশন ফি না দিয়ে বিজ্ঞাপন মেনে নিতে রাজি।

ইউটিউবের ব্যবসায়িক মডেল বিজ্ঞাপন-নির্ভর হওয়ায় কনটেন্ট দেখার জন্য গ্রাহককে পৃথক খরচ করতে হয় না। একইসঙ্গে কোম্পানিটি বিজ্ঞাপনের আওতা বাড়িয়ে নিয়ে বিশাল আকারের আয় সৃষ্টি করে। ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে (Q1), ইউটিউব বিজ্ঞাপন রাজস্ব (ad revenue) আগের বছরের তুলনায় ২১% বেড়েছে। এটি দেখায় যে ঐতিহ্যবাহী টিভি-নেটওয়ার্ক বা স্ট্রিমিং সার্ভিস যখন বিজ্ঞাপনদাতাদের ধরে রাখার লড়াইয়ে হিমশিম খায়, ইউটিউব তখন অনায়াসে সেই বাজার দখল করে নিচ্ছে।

দর্শকদের জন্য এটি সুবিধাজনক, কারণ বিনামূল্যে অফুরন্ত কনটেন্ট মেলে। যারা বিজ্ঞাপন এড়াতে চান, তারা চাইলে পেইড (paid) সাবস্ক্রিপশন, যেমন ইউটিউব প্রিমিয়াম (YouTube Premium), বেছে নিতে পারেন—কিন্তু সেটি বাধ্যতামূলক নয়। ফলে প্ল্যাটফর্মের ব্যবহারযোগ্যতা (user friendliness) বহুগুণ বেড়ে যায়।

ব্যবহারকারী-সৃষ্ট কনটেন্টের (User-Generated Content) অফুরন্ত ভাণ্ডার

ইউটিউবের বড় শক্তি হলো, প্ল্যাটফর্মটি নিজে কনটেন্ট তৈরি করে না। গোটা দুনিয়ার কোটি কোটি ক্রিয়েটর (creators) প্রতিদিন লাখ লাখ ভিডিও আপলোড করে। হিসাব বলছে প্রতিদিন প্রায় ৩.৭ মিলিয়ন নতুন ভিডিও যুক্ত হয়, যা দিনে ২,৭০,০০০ ঘণ্টারও বেশি কনটেন্ট! এই বিপুল পরিমাণ কনটেন্টের বৈচিত্র্য অকল্পনীয়—শিক্ষামূলক ভিডিও, ভ্রমণ ব্লগ, গেমিং, ডকুমেন্টারি, রান্না, কমেডি, শর্ট ফিল্ম—যা খুশি।

এই বিশাল লাইব্রেরি তৈরি করতে ইউটিউবের (সংস্থা হিসেবে) আলাদা কোনো বড় বাজেটের সিনেমা বা সিরিজ প্রযোজনা করতে হয় না। স্টুডিও কেনা বা পরিচালনা করা, বড় বড় অভিনেতা-অভিনেত্রী বা নির্মাতাকে চুক্তিবদ্ধ করার ঝামেলা নেই। তারা কেবলমাত্র একটি প্ল্যাটফর্ম সরবরাহ করে, যার প্রযুক্তিগত অবকাঠামো (infrastructure) আর অ্যালগরিদম ভিত্তিক সুপারিশ (algorithmic recommendation) দর্শকদের কাছে কনটেন্ট পৌঁছে দেয়। এতে তারা বিশাল অর্থ সাশ্রয় করে, আর বিজ্ঞাপন থেকে আয় বাড়ায়।

অন্যদিকে, ভিডিও নির্মাতারা স্বতন্ত্রভাবে কাজ করেন, নিজেদের চ্যানেল তৈরি করেন, ভিউয়ারের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করেন। এর ফলে কনটেন্টের বৈচিত্র্য নিরন্তর বাড়তে থাকে। গুগল/ইউটিউব এই বিজ্ঞাপন রাজস্বের একটি অংশ “ইউটিউব পার্টনারশিপ প্রোগ্রাম (YouTube Partnership Program)” এর মাধ্যমে নির্মাতাদের দেয়, যা নিয়ে অনেকেই নিজেদের চ্যানেলকে পেশাগতভাবে পরিচালনা করেন। সাম্প্রতিক তথ্যমতে, গত তিন বছরে ইউটিউব নির্মাতাদের (creators) ৭০ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ প্রদান করেছে।

ক্রমবর্ধমান টিভি উপস্থিতি

প্রথম দিকে ইউটিউবকে অনেকে ফোন বা কম্পিউটারে দেখার প্ল্যাটফর্ম বলে ভাবতেন। কিন্তু এখন অনেক মানুষ স্মার্ট টিভি (Smart TV), অ্যাপল টিভি (Apple TV), রোকু (Roku) কিংবা গেম কনসোলের (game console) সাহায্যে ইউটিউব চালান বড় পর্দায়। এতে ইউটিউব আর আগের মতো ছোটখাটো “সেকেন্ডারি স্ক্রিন”-এর মাধ্যম নয়; এটি হয়ে উঠেছে পারিবারিক বিনোদনের (family entertainment) মূলমঞ্চ। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি মাসে ১৫০ মিলিয়ন মানুষ “কনেক্টেড টিভি” (connected TV) ব্যবহার করে ইউটিউব দেখছেন, এবং এই সংখ্যাটি দ্রুত বাড়ছে।

এমনকি যারা নেটফ্লিক্স বা অন্যান্য স্ট্রিমিং-সার্ভিসের গ্রাহক, তারাও প্রায়শ ইউটিউবে সুইচ করে দীর্ঘ সময় কাটাচ্ছেন। কারণ এখানে পছন্দের কোনো ব্লগার, গেমার, রেসিপি তৈরিকারী বা কমেডিয়ানের ভিডিও ধারাবাহিকভাবে পাওয়া যায়। যেকোনো মুহূর্তে নতুন এপিসোড বা আপডেট সরাসরি আপলোড হয়, যেটা ঐতিহ্যবাহী সিরিজ বা শো-এর তুলনায় অনেক বেশি ফ্রেশ অনুভব করে।

তরুণ দর্শকদের আকর্ষণ: নেটফ্লিক্স ও ডিজনি কেন পিছিয়ে?

জেন জি (Gen Z) ও মিলেনিয়ালদের নতুন রুচি

একাধিক জরিপে দেখা গেছে, কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ইউটিউবের চাহিদা আকাশছোঁয়া। পিউ রিসার্চ (Pew Research) জানায়, ৭১% কিশোর দৈনিক ইউটিউব ব্যবহার করে, আর প্রায় ২০% বলেছে তারা “প্রায়ই সারাক্ষণ” ইউটিউবে থাকে। এই হার উল্লেখযোগ্যভাবে নেটফ্লিক্স, ডিজনি+ বা অন্য প্ল্যাটফর্মগুলোর চেয়ে বেশি।

কারণ, এখন তরুণরা ইউজার-জেনারেটেড কনটেন্টকে (UGC) প্রাধান্য দেয়। তারা মনে করে, ইউটিউবের ক্রিয়েটরের সাথে সরাসরি যুক্ত হওয়া যায়, তাদের জীবনকাহিনি বা নিয়মিত আপডেটের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। এটি একধরনের ব্যক্তিগত সংযোগের (personal connection) অনুভূতি দেয়, যা ঐতিহ্যবাহী টিভি শো-তে তুলনামূলক দুর্লভ।

‘বিগ বাজেট’ বনাম ‘পার্সোনাল টাচ’

নেটফ্লিক্স বা ডিজনির মতো প্ল্যাটফর্মে অসংখ্য বড় বাজেটের সিরিজ ও সিনেমা পাওয়া গেলেও, সেগুলো দেখার জন্য গ্রাহককে মাসিক ফি দিতে হয়, আর সেখানে নির্মাতা ও দর্শকের মাঝে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ থাকে না। অন্যদিকে ইউটিউব ক্রিয়েটরেরা সাধারণত নিয়মিত আপলোড (daily/weekly uploads) করেন, ভিউয়ারের মন্তব্যে (comments) সাড়া দেন, কখনও লাইভ স্ট্রিম (live stream) চালান, কোনো বড় সিজনাল গ্যাপ ছাড়াই কনটেন্ট জারি থাকে। এতে দর্শক এক ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ অনুভূতি পান।

এর পাশাপাশি, কোভিড মহামারির সময় মানুষ ঘরে বন্দি থাকা অবস্থায় ইউটিউব শুধু প্যাসিভ বিনোদন দেয়নি, বরং সামাজিক যোগাযোগের (social connection) একটা বিকল্প হয়ে উঠেছে। কেউ কারও ভিডিওতে লাইভ চ্যাট করে, কেউবা ভ্লগ দেখে একাকিত্ব কাটায়। এতেই বোঝা যায়, তরুণদের কাছে ইউটিউব আরও নৈকট্যময় ও সংগঠিত প্ল্যাটফর্ম।

বিজ্ঞাপনদাতা ও রাজস্বের জোয়ার

টিভি-সাবস্ক্রিপশন ধস নামার ফলে ঐতিহ্যবাহী বিজ্ঞাপনদাতারা নতুন গন্তব্য খুঁজছেন। ইউটিউব অগাধ দর্শকসমুদ্র ও লক্ষ্যভিত্তিক বিজ্ঞাপন (targeted ads) প্রযুক্তি দেয়। তাই এখানে বিজ্ঞাপনকারীরা (advertisers) স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ফলত ইউটিউবের বিজ্ঞাপন আয় ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। শুধু ২০২৩ সালেই ইউটিউবের বার্ষিক গ্লোবাল অ্যাড রেভিনিউ (global advertising revenue) ছিল প্রায় ৩১.৫ বিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মিডিয়া কোম্পানিগুলোর একটির (যেমন প্যারামাউন্ট গ্লোবাল, Paramount Global) পুরো বার্ষিক আয়ের চেয়েও বেশি।

ইউটিউব তার সাফল্য নির্মাতাদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়, একে “রেভিনিউ শেয়ারিং (revenue sharing)” বলে। বিশাল সংখ্যক ক্রিয়েটর এই প্ল্যাটফর্মে আয়ের সুযোগ পেয়ে নিজেদের “ইউটিউব ক্যারিয়ার” গড়ে তুলেছে। এটি এমন এক ইকোসিস্টেম (ecosystem) তৈরি করছে, যেখানে ক্রিয়েটররা ধারাবাহিকভাবে ভালো কনটেন্ট বানাচ্ছেন, দর্শকরা বিনা পয়সায় তা দেখছেন, আর ইউটিউব ও বিজ্ঞাপনদাতা দুই পক্ষই লাভবান হচ্ছে।

ক্রিয়েটর ইকোনমি: ইউটিউবের বড় হাতিয়ার

স্বল্প মূলধনে বিপুল কনটেন্ট

ইউটিউবের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে নির্মাতারা নিজস্ব উদ্যোগে বিভিন্ন আইডিয়া বাস্তবায়ন করতে পারেন। ঐতিহ্যবাহী টিভি নেটওয়ার্কে কাউকে জায়গা পেতে হলে দীর্ঘ প্রক্রিয়া, বাজেট অনুমোদন, প্রযোজক খোঁজা—এত কিছু দরকার হয়। কিন্তু ইউটিউবে কেবল একটা চ্যানেল বানিয়ে, ক্যামেরা ধরেই যে কেউ শুরু করতে পারেন। এই স্বল্প বাধা বা “লো ব্যারিয়ার টু এন্ট্রি (low barrier to entry)” তরুণ নির্মাতাদের জন্য বিশাল সুযোগ তৈরি করেছে।

ফলে আমরা দেখি, এখানে বৈচিত্র্যের কোনো সীমা নেই—গান, নাচ, রান্না, ভ্লগ, অ্যানিমেশন, শর্ট ফিল্ম, গেমিং, টেক রিভিউ, সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট ইত্যাদি অসংখ্য জনরা (genre) সহ সবাই উপস্থিত। অনেকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে প্রায় ‘টিভি শো’ সুলভ মানের অনুষ্ঠানের মতো সিরিজ বানাচ্ছেন। বড় বড় ব্র্যান্ড থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত—সবার কাছে ইউটিউব আজ এক কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্ম।

গুণগতমানের (Quality) বিবর্তন

একসময় টিভি এক্সিকিউটিভরা মনে করতেন, “ইউটিউবে যা হয়, সেটা তো নিম্নমানের বা কেবল সময় পাস করার মতো।” কিন্তু বাস্তবে আজ দেখা যাচ্ছে, অনেক ইউটিউব কনটেন্টই প্রায় টিভি প্রোডাকশনের সমান বা কখনো তার চেয়ে উন্নত—বিশেষ করে “মিস্টার বিস্ট (MrBeast)” বা “ম্যাটপ্যাট (MatPat)” প্রমুখ ক্রিয়েটরদের অনুষ্ঠান। তারা বড় বাজেট নিয়ে ভিডিও বানান, বিশেষ এফেক্ট, লোকেশন, এমনকি অতিথি তারকাদের আনা—সব মিলিয়ে এক টিভির মতো অভিজ্ঞতা দিতে সক্ষম হচ্ছেন। একই সঙ্গে নিয়মিত দর্শক-সম্পৃক্ততা (engagement) থাকে, যা ঐতিহ্যবাহী টিভি বা স্ট্রিমিং সিরিজের চেয়ে অনেক বেশি।

পেশাদারিত্বের বিকাশ ও গ্লোবাল প্ল্যাটফর্ম

ইউটিউবের আরও বড় সুবিধা হলো বিশ্বব্যাপী বিস্তার (global reach)। একজন নির্মাতা (creator) যুক্তরাষ্ট্রে বসে ভিডিও বানালেও সেই ভিডিও বাংলাদেশ, ভারত, ব্রাজিল—যে কোনো জায়গায় দেখা সম্ভব। ঐতিহ্যবাহী চ্যানেলে সাধারণত আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা থাকে, স্ট্রিমিং সার্ভিসেও অনেক সময় নির্দিষ্ট অঞ্চলে কনটেন্ট ব্লক থাকে বা লাইসেন্স সমস্যা থাকে। ইউটিউবে সেই সীমাবদ্ধতা খুব কম।

ফলে একটি ছোট চ্যানেলও হঠাৎ বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পেতে পারে, যদি কনটেন্টটি সত্যিই মানুষের মন জয় করে। এরকম ঘটে বহুবার—কোনো গেমিং চ্যানেল বা রান্নার চ্যানেল হঠাৎ করে বিস্ফোরক গতিতে বেড়ে যায়।

ডিজনি ও নেটফ্লিক্সের চ্যালেঞ্জ: ইউটিউবের সঙ্গে সহাবস্থান

প্রতিদ্বন্দ্বিতা নাকি সম্পূরক?

একসময় ঐতিহ্যবাহী বড় মিডিয়া কোম্পানিগুলো নেটফ্লিক্সকে (Netflix) “সহচর” হিসেবে ভাবত, কারণ তারা ভাবত নেটফ্লিক্স শুধু পুরোনো অনুষ্ঠান বা চলচ্চিত্রের লাইসেন্স কিনবে। কিন্তু পরে নেটফ্লিক্স এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, এসব বড় কোম্পানি বুঝতে পারে, তাদের নিজেদের কনটেন্টও এই প্ল্যাটফর্মে দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। একইভাবে, ইউটিউব এখন একেকটি বড় কোম্পানির জন্য কী—সহচর (companion) নাকি প্রতিদ্বন্দ্বী (competitor)? সেটাই বড় প্রশ্ন।

ইউটিউব আসলে উভয় ভূমিকা পালন করে। একদিকে এটি প্রচার বা মার্কেটিংয়ের প্ল্যাটফর্ম, যেখানে বড় স্টুডিওরা নিজেদের সিনেমা বা সিরিজের ট্রেলার আপলোড করে, এবং বিজ্ঞাপন থেকেও কিছু আয় করতে পারে। অন্যদিকে, ইউটিউব এত বেশি দর্শক ধরে রেখেছে যে, মানুষ সময় কাটাতে ইউটিউব দেখলেই অন্য কোথাও (যেমন Netflix/Disney+) সময় দিতে কমে যায়। অর্থাৎ এটি আবার স্ট্রিমিং-শিল্পের “টাইম শেয়ার”-এ একটা বড় অংশ ছিনিয়ে নিচ্ছে।

প্রচারমাধ্যম হিসেবে ইউটিউব

অনেক টিভি নেটওয়ার্ক বা স্ট্রিমিং সেবা এখন ইউটিউবকে “প্রমোশনাল ডিভাইস (promotional device)” হিসেবে ব্যবহার করে। যেমন, কোনো নতুন শো বা সিনেমার সংক্ষিপ্ত অংশ, ‘বিহাইন্ড দ্য সিনস’ (behind the scenes) ক্লিপ ইত্যাদি আপলোড করে মানুষের আগ্রহ তৈরি করে। এটি বিশেষ করে তরুণ দর্শকদের কাছে পৌঁছাতে কার্যকর। শীর্ষস্থানীয় ক্রীড়া অনুষ্ঠান, অনুষ্ঠানের হাইলাইট, বা ‘লেট নাইট শো’-র (late night show) কিছু ক্লিপ আপলোড করলে সহজেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়, যা ঐ ব্র্যান্ড বা চ্যানেলের জন্য সুসংবাদ।

এছাড়া বহু কেবল নেটওয়ার্ক (যেমন NBC, ABC, CBS) বা নিউজ চ্যানেল (যেমন CNBC) পর্যন্ত নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ সেগমেন্ট ইউটিউবে আপলোড করে, যাতে টিভি দর্শক ছাড়াও নতুন এক প্রজন্মের কাছে পৌছানো যায়। ইউটিউব এভাবে তাদের “রিচ (reach)” বা বিস্তৃতি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। আবার এর ফলাফল হলো, মানুষ বাস্তবে ওই অনুষ্ঠান লাইভ টিভিতে না দেখেও পরে ইউটিউবে দেখে নেয়, ফলে ঐতিহ্যবাহী টিভি রেটিং ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

ক্রীড়া সম্প্রচার ও ছোট ক্লিপের জনপ্রিয়তা

আরেকটি বড় ক্ষেত্র হলো স্পোর্টস (Sports)। ঐতিহাসিকভাবে সরাসরি খেলা দেখার জন্য মানুষ টিভিতে নির্ভর করত, কিন্তু এখন অনেকে শুধু হাইলাইট (highlights) বা “স্ন্যাপশট” দেখতে পছন্দ করে। ডিজনি বা ESPN বড় ম্যাচ সম্প্রচার করতে পারে বটে, কিন্তু তরুণ প্রজন্ম অনেক সময় ৯০ মিনিটের খেলায় বসে থাকে না; বরং ৫-১০ মিনিটের হাইলাইট ইউটিউবে বা অন্য কোথাও খুঁজে নেয়। এতে করে লাইভ ব্রডকাস্টের চাহিদা কমে গিয়ে সাধারণ টিভি রাজস্বে প্রভাব ফেলে।

অনেকে ধারণা করছেন, ভবিষ্যতে হয়তো বড় বড় মিডিয়া কোম্পানি আরও সাশ্রয়ী বাজেটে “ইউজার-জেনারেটেড কনটেন্ট” ধরন ব্যবহার করে নিজেদের প্ল্যাটফর্ম সমৃদ্ধ করবে। অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ জমকালো প্রযোজনা না করে, নিম্নবাজেটের কিন্তু তরুণদের প্রিয় “ইন্টারনেট-স্টাইল” অনুষ্ঠান যুক্ত করবে, যাতে লোকসান (loss) কম হয়।

ভবিষ্যতের চিত্র: ইউটিউবের উত্থান ও স্ট্রিমিং ল্যান্ডস্কেপ

দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব

ইউটিউবের বিকাশ ক্রমাগত বাড়ছে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, এর প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, ব্যাপক ডেটা অ্যানালিটিক্স ও পার্সোনালাইজেশনের (personalization) ক্ষমতা ওদের আর থামতে দেবে না। অন্যদিকে, ডিজনি বা নেটফ্লিক্সের মতো প্রতিষ্ঠান এখন টের পাচ্ছে যে, নতুন প্রজন্মের চোখে বিনোদন অনেক বেশি নমনীয় ও আকর্ষণীয় হতে হবে—তারা একঘেয়ে লম্বা সিরিজে মনোযোগ দিতে চায় না, বা বিপুল সাবস্ক্রিপশন ফি দিতে চায় না।

নেটফ্লিক্স ও এমাজন প্রাইম (Amazon Prime) যদিও বিজ্ঞাপন-মডেল (ad-supported model) চালু করে নতুন দর্শকদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু সেখানে ইউটিউবের সঙ্গে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে গেলে হিমশিম খেতে হতে পারে। কারণ ইউটিউব তার বিস্তীর্ণ ক্রিয়েটর নেটওয়ার্ক ও বিনামূল্যে ব্যবহারযোগ্য সেবার মাধ্যমে দর্শকদের সম্পূর্ণ অন্যরকম অভিজ্ঞতা দিচ্ছে।

সম্ভাব্য পদক্ষেপ

  • অধিগ্রহণ বা অংশীদারিত্ব (Acquisition/Partnership): বড় কোনো মিডিয়া কোম্পানি হয়তো ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্ম তৈরির চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু বাস্তবে সেটি কার্যত অসম্ভব—ইতিমধ্যে ইউটিউব বিশ্বব্যাপী এত শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে যে, এর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া দুঃসাধ্য। ফলে ঐতিহ্যবাহী কোম্পানিরা ইউটিউবকে শত্রু ভাবার চাইতে বরং অংশীদার হিসেবে ব্যবহার করতে চায়—প্রমোশনাল মাধ্যম, ক্লিপ আপলোড, ইত্যাদির মাধ্যমে দর্শক ধরার উপায় হিসেবে।
  • নতুন টেক প্ল্যাটফর্মের উদ্ভব: কখনোই অবমূল্যায়ন করা যায় না যে ভবিষ্যতে অন্য কোনো টেক জায়ান্ট নতুন কোনো ভিডিও সার্ভিস চালু করবে না। হয়তো মেটাভার্স (metaverse) বা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR)-কেন্দ্রিক কিছু আসবে, যেখানে আরও ইন্টারঅ্যাক্টিভ (interactive) বিনোদন সম্ভব হবে। কিন্তু বর্তমানে ইউটিউবের একচ্ছত্র আধিপত্যকে হুমকি দেওয়া সহজ নয়।
  • কনটেন্টের ধরণে বৈচিত্র্য: স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলো এখন বুঝে গেছে, মানুষের সময় তো ২৪ ঘণ্টাই। তাই ঐতিহ্যবাহী দীর্ঘ সিরিজ, চলচ্চিত্রের পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত স্বল্পদৈর্ঘ্য, দ্রুত-উপভোগ্য বা ইন্টারঅ্যাক্টিভ কনটেন্ট তৈরির চেষ্টা চলছে। এ কারণেই দেখা যায় ডিজনি+ কিংবা হুলু নানা রকম স্পিন-অফ সিরিজ, শর্ট ফরম্যাট শো বের করছে। সম্ভাবনা আছে যে ইউটিউবের বিশাল ‘UGC ইকোনমি’ থেকে প্রতিভা শোষণ করতে পারে এসব প্ল্যাটফর্ম।

সহাবস্থান নাকি সংর্ঘষ?

ইউটিউব ও ঐতিহ্যবাহী মিডিয়া কোম্পানির সম্পর্ক একদিকে সহযোগিতামূলক, অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। উদাহরণস্বরূপ, অনেক কেবল নেটওয়ার্ক বা নিউজ চ্যানেল ইউটিউবে নিজেদের ক্লিপ প্রকাশ করে বিশ্বব্যাপী দর্শক আকর্ষণ করে—যা ব্র্যান্ডিং ও প্রচারের পক্ষে ভালো। একই সঙ্গে, সেই একই সময়ে মানুষ যদি ইউটিউবে ব্যস্ত থাকে, তাহলে হয়তো ঐতিহ্যবাহী চ্যানেল বা স্ট্রিমিং সার্ভিসের সামনে বসছে কম। এভাবেই ইউটিউব “ফ্রেনেমি (Frenemy)” হিসেবে আবির্ভূত—একই সঙ্গে বন্ধু ও প্রতিদ্বন্দ্বী।

তবে সব মিলিয়ে একথা বলাই যায় যে, ইউটিউব ভবিষ্যতে তার আধিপত্য আরও বাড়াবে। কারণ যেকোনো ইন্টারনেট-সংযুক্ত ডিভাইস (smartphone, smart TV, laptop, console) থেকে সহজে অ্যাক্সেস, বিনামূল্যে কনটেন্ট, বিশাল ক্রিয়েটর নেটওয়ার্ক, বিজ্ঞাপন আয়—এসব মিলিয়ে এর আলাদা এক্ষেত্রে দাঁড়িয়েছে। ডিজনি বা নেটফ্লিক্সের মতো কোম্পানি অবশ্যই মহাশক্তিশালী, কিন্তু ইউটিউবের অবস্থান আসলে একটু আলাদা। যেটাকে কাঁচা চোখে স্রেফ “সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম” ভেবেছিল অনেকে, সেটিই এখন বিশ্বের অন্যতম প্রধান স্ট্রিমিং মাধ্যম।

উপসংহার

“স্ট্রিমিং ওয়ারস (Streaming Wars)” বলতে এতদিন মানুষ ভেবেছিল, নেটফ্লিক্স বনাম ডিজনি বনাম এইচবিও ম্যাক্স বনাম প্যারামাউন্ট ইত্যাদির লড়াই। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ইউটিউব (YouTube) এক অসামান্য প্রতিদ্বন্দ্বী—কিংবা বলা যায়, তারা অন্য লেভেলের খেলোয়াড়। কারণ তাদের আদি কাঠামো ও ব্যবসায়িক মডেল অন্যদের থেকে আলাদা। তারা মূলত বিজ্ঞাপন-ভিত্তিক (ad-based) ফ্রি (free) পদ্ধতিতে খেলে, এবং কোটি কোটি ক্রিয়েটরের কাজকে ব্যবহার করে বিশাল এক ভিডিও ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে, যা প্রতিদিন আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে।

অন্যদিকে, স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলোর মৌলিক চালিকাশক্তি হল গ্রাহকদের সাবস্ক্রিপশন ফি আর নিজেদের প্রযোজিত বা লাইসেন্স করা বিশাল বাজেটের কনটেন্ট। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের এক বিশাল অংশ বিনামূল্যে, ব্যবহারকারী-সৃষ্ট (UGC) ভিডিওকে সমর্থন করছে। তাদের কাছে কেবলমাত্র বড় তারকা বা বড় বাজেটের সিনেমা সবসময় আকর্ষণীয় নয়, বরং একজন স্বতন্ত্র ক্রিয়েটরের ব্যক্তিত্ব, নিয়মিত কনটেন্ট, কমিউনিটির অন্তর্ভুক্তি—এই সবকিছুই মুখ্য।

ফলে ভবিষ্যতে ঐতিহ্যবাহী মিডিয়া কোম্পানি, এমনকি নেটফ্লিক্সও এক ধরনের কৌশলগত পুনর্বিন্যাসের কথা ভাবতে বাধ্য হতে পারে:

  • ইউটিউবকে কীভাবে নিজেদের বিপণন (marketing) বা প্রমোশনাল কাজে ব্যবহার করা যায়?
  • কীভাবে তরুণদের মনোযোগ ফেরানো যায়, যাদের বিশাল অংশ গিয়েছে ইউটিউব ও টিকটকের (TikTok) দিকে?
  • অনবরত গভীরতর ইন্টারঅ্যাকশন, দ্রুত আপডেট ও দীর্ঘমেয়াদী “বন্ধু-সুলভ” উপস্থিতি—এসব দিতে পারবে তো ট্র্যাডিশনাল স্ট্রিমিং পদ্ধতি?

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পরবর্তী দশকে ঐতিহ্যবাহী টেলিভিশন আরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এমাজন প্রাইম ও নেটফ্লিক্স ইতিমধ্যে বিজ্ঞাপন-সমর্থিত (ad-supported) সাবস্ক্রিপশন প্যাকেজ চালু করেছে, যাতে কিছুটা খরচ কমিয়ে তরুণদের আকৃষ্ট করা যায়। কিন্তু ইউটিউবের মতো একটা বিলিয়ন-ডলার আয়ের জায়ান্ট, যেখানে গ্রাহকরা কোনো চার্জ ছাড়াই আনলিমিটেড কনটেন্ট পায়—সেটিকে সরাসরি হারানো খুব কঠিন।

পরিস্থিতি এমন যে, ইউটিউব একদিকে মিডিয়া কোম্পানিদের কনটেন্ট প্রচার করে তাদের সাহায্য করছে, অন্যদিকে নিজেই তাদের শ্রোতা-দর্শক চুরি করে নিচ্ছে। সমালোচকরা বলে থাকেন—এটা ডিজনির “সহযোগী” না “প্রতিযোগী?” আসলে উত্তরটি দুটোই। স্ট্রিমিং ল্যান্ডস্কেপে এই সহাবস্থান ও সংঘর্ষ চলতেই থাকবে।

সব মিলিয়ে, ইউটিউব এখন আর কোনো “নতুন প্ল্যাটফর্ম” নয়। তবে তারা ২০০৫ সালে শুরু হয়ে আজ ২০২০-এর দশকে এক নতুন উচ্চতায় উঠেছে। ওদের কাছে এখন অগণিত ব্যবহারকারী, বহুমুখী কনটেন্ট, সুদৃঢ় বিজ্ঞাপন পদ্ধতি, বৈশ্বিক উপস্থিতি এবং আনলিমিটেড স্কেলিং-এর সুযোগ রয়েছে। আর এ কারণেই “স্ট্রিমিং ওয়ারস”-এর সত্যিকারের রাজা (বা অন্তত বর্তমান সময়ের শীর্ষস্থানীয় খেলোয়াড়) হিসেবে ইউটিউবের নাম উঠে আসছে—নেটফ্লিক্স কিংবা ডিজনি নয়।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.