হিস্ট্রি #১ কৃষি বিপ্লব বা এগ্রিকালচারাল রেভোল্যুশন

ডাবল চিজবার্গারের অবিশ্বাস্য যাত্রা

মাত্র পনেরো হাজার বছরে মানুষ শিকার ও খাদ্যসংগ্রহ থেকে এতদূর এগিয়ে গেল যে উড়োজাহাজ (airplane), ইন্টারনেট (Internet) কিংবা আমেরিকার ৯৯ সেন্ট মূল্যের ডাবল চিজবার্গারের মতো অবিশ্বাস্য জিনিস পর্যন্ত তৈরি সম্ভব হলো (ডাবল চিজবার্গারটা অবিশ্বাস্য না, সেটা ৯৯ সেন্ট মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে সেটা অবিশ্বাস্য, যার ফলে আমেরিকায় সর্বনিম্ন মজুরির চাকরিটিও মাত্র ১১ মিনিটের জন্য করে এই ডাবল চিজ বার্গারের ৪৯০ ক্যালোরির খাবার খাওয়া সম্ভব হচ্ছে)। এই ব্যাপ্তিকে বোঝাতে আমি নিজেও একটা ছোট যাত্রা শুরু করা যাক …

শুরুতেই ডাবল চিজবার্গারের উদাহরণটাই ধরি। এটায় প্রায় ৪৯০ ক্যালোরি (calories) আছে। এই চিজবার্গার হাতে পেতে আমাদের প্রথমে গরু বা মুরগি লালনপালন (feed, raise) করে জবাই (slaughter) করতে হবে, তারপর সেই মাংস পিষে (grind) হিমায়িত অবস্থায় চালান করতে হবে। একই সঙ্গে গম (wheat) চাষ করে সেগুলোকে এমনভাবে প্রক্রিয়াজাত (process) করতে হবে যাতে সেগুলো রানি প্রথম এলিজাবেথের (Queen Elizabeth the First) চেয়েও সাদা হয়ে যায়। এরপর গরুর দুধ থেকে চিজ (cheese) বানাতে হবে, শসা ফলিয়ে সেটার আচার (pickling) করতে হবে, টমেটো মিষ্টি (sweetening) করতে হবে, সরিষা (mustard seeds) পিষে সরিষার মসলা বানাতে হবে—ইত্যাদি আরও প্রচুর ধাপ আছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বা কীভাবে আমরা এমন এক পৃথিবী তৈরি করেছি যেখানে এত জটিল খাদ্যও সহজে তৈরি করা যায়? এবং কীভাবে এই ৪৯০ ক্যালোরির খাবার আমেরিকায় (U.S.) সর্বনিম্ন মজুরি (minimum wage) পেলে মাত্র ১১ মিনিট কাজ করে কেনা সম্ভব? আর সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন যেটা সেটা হলো: এত অনায়াস প্রাচুর্যের (relative abundance) মাঝে আমরা আনন্দিত হব, নাকি আতঙ্কিত?

এই প্রশ্নের উত্তর পুরোনো লিপিবদ্ধ ইতিহাস (written record) থেকে পাওয়া কঠিন, কারণ এইসব প্রাচীন অবস্থার বিষয়ে তেমন দলিল নেই। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব (archaeology) ও প্যালিওবায়োলজির (paleobiology) সাহায্যে আমরা ইতিহাসের অনেক গভীরে যেতে পারি।

শিকারি-সংগ্রহকারী মানুষের যুগ (Early Humans: Hunting and Foraging)

পনেরো হাজার বছর আগে মানুষ মূলত খাদ্য সংগ্রহ (foraging) ও শিকার (hunting) করে বেঁচে থাকত। খাদ্য সংগ্রহের মানে হলো ফল, বাদাম, বুনো শস্য (wild grains) ও ঘাস (grasses) কুড়িয়ে বেড়ানো। আর শিকার প্রোটিন (protein)-সমৃদ্ধ খাবারের জোগান দিত, যদি আদৌ মাংস পাওয়া যেত। তখনকার সময়ে সবচেয়ে লাভজনক শিকার ছিল মাছ ধরা (fishing), কারণ—

  • প্রথমত, জলে (marine) খাবার প্রচুর
  • দ্বিতীয়ত, মাছ বা সামুদ্রিক জীব তুলনামূলকভাবে মানুষকে খেয়ে ফেলার চেষ্টা করে না

আমরা ধারণা করি যে সেই যুগের মানুষের জীবন ছিল ‘নোংরা, বন্য ও স্বল্পায়ু’ (nasty, brutish and short), কিন্তু জীবাশ্ম (fossil) বিশ্লেষণের ফলে দেখা গেছে কৃষি-যুগের মানুষের তুলনায় তাদের হাড় ও দাঁত ভালো অবস্থায় ছিল। আবার নৃবিজ্ঞানীরা (anthropologists) খাদ্যসংগ্রহকারী সম্প্রদায়সমূহের (forager peoples) যেসব শেষ অবশিষ্ট খুঁজে পেয়েছেন, সেগুলোতে দেখা যায় এর লোকেরা অপেক্ষাকৃত কম সময় কাজ করেও শিল্প (art), সঙ্গীত (music), গল্প (storytelling) ইত্যাদিতে বেশি সময় ব্যয় করতে পারতেন। ।

কিন্তু তারপর নানা অঞ্চলে, যেমন আফ্রিকা থেকে চীন পর্যন্ত বা আমেরিকা মহাদেশ জুড়ে, স্থানীয় ফসল থেকে স্বাধীনভাবে কৃষিকাজ (agriculture) শুরু হয়। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ধান (rice), মেক্সিকোতে ভুট্টা (maize), আন্দিজে আলু (potatoes), ফার্টাইল ক্রেসেন্টে (Fertile Crescent) গম (wheat), পশ্চিম আফ্রিকায় ইয়াম (yams) ইত্যাদি বেছে বা সিলেক্টিভলি চাষ হয়েছে। ফলে শিকারের উপর নির্ভরতা কমিয়ে মানুষ ধীরে ধীরে কৃষির দিকে ঝুঁকতে থাকে। এভাবে এত জায়গায় স্বতন্ত্রভাবে একই সিদ্ধান্ত নেওয়া মানে নিশ্চয়ই এতে প্রচুর সুবিধা ছিল, তাই না? কিন্তু আসলে এই সিদ্ধান্ত অনেকভাবেই আগের মতো অধিক অবসর—জীবনযাত্রা, সঙ্গীত ইত্যাদির পরিমাণকে কমিয়ে দেয়।

কৃষির সুবিধা ও অসুবিধা

সুবিধা (Advantages)

  1. নিয়ন্ত্রিত খাদ্য সরবরাহ (Controllable food supply): হ্যাঁ, শস্যক্ষেতে খরা (drought) বা বন্যা (flood) হতে পারে, কিন্তু ফসলের জাত নির্বাচন করে (breeding to be hardier) মানুষ সেই সমস্যার কিছুটা সমাধান করতে পারে।
  2. খাদ্য উদ্বৃত্ত (Food surplus): বিশেষ করে শস্য (grain) উদ্ভাদনে উদ্বৃত্ত খাদ্য পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে বড় জনবসতি বা শহর (cities) গড়ে তোলা সম্ভব হয়, শ্রমিকদের মধ্যে পেশাভিত্তিক বিভাজন (specialization of labor) আসে। কৃষির আগে সবাইকে খাদ্যের সন্ধানে ছুটতে হতো—এক হাজার ক্যালোরি খাবার পেতে প্রায় এক হাজার ক্যালোরি শ্রমই লাগত। স্বাভাবিকভাবেই বড় জনগোষ্ঠী বা নগর গড়ে তোলার সুযোগ ছিল না। কিন্তু কৃষির কল্যাণে উদ্বৃত্ত খাদ্য তৈরি হলে, জনসংখ্যার একটা বড় অংশ সরাসরি খাদ্য উৎপাদনের সাথে যুক্ত না থেকে অন্য কাজে মনোযোগী হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বণিক (tradespeople) বা কারিগররা উন্নত কৃষি-সরঞ্জাম বানাতে পারেন, যা আবার কৃষিকে আরও ফলপ্রসূ করে তোলে। এর দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল হলো কেউ কেউ একসময় ৯৯ সেন্ট মূল্যের ডাবল চিজবার্গার বেচেও লাভবান হতে পারে!

অসুবিধা (Disadvantages)

  1. পরিবেশের র‍্যাডিক্যাল রূপান্তর: জনসংখ্যা বাড়লে তাদের খাওয়ানোর জন্য প্রকৃতিকে (environment) অনেকটাই রদবদল করতে হয়—বনভূমি ধ্বংস, জলাধার বা বাধ (dam) নির্মাণ ইত্যাদি।
  2. কঠোর পরিশ্রম (Farming is hard): এটা এতটাই শ্রমসাধ্য যে অনেকে অন্য মানুষকে দাস (slavery) বানিয়েছে যাতে তারা জোরপূর্বক সেই কাজ করিয়ে নিতে পারে। এটা নিঃসন্দেহে একটি ‘অসাম্যের’ (non-ideal social order) উদাহরণ, যা অনেক কৃষিভিত্তিক সমাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে।

পশুপালন বা গোচারণ (Herding): বিকল্প পন্থা

আসলে আমি এখনো হের্ডারদের (herders) কথা বলিনি, যাদের সবসময় ছোট করে দেখা হয়। গোচারণ বা পশুপালন একটা দুর্দান্ত বিকল্প (interesting alternative) হতে পারে। তোমার গৃহপালিত প্রাণী (domesticate some animals) আছে, সুতরাং তাদের নিয়ে তুমি পথে পথে ঘোরো। সুবিধাগুলো কী?

  • পশুদের থেকে মাংস (meat) ও দুধ (milk) সরাসরি পাওয়া যায়।
  • আশ্রয় (shelter) বা পোশাকের জন্য লোম (wool) এবং চামড়া (leather) পাওয়া যায়।

তবে এক্ষেত্রে পশুর পাল (herd) নিয়ে সব সময় তাজা ঘাসের (new grass) খোঁজে ঘুরে বেড়াতে হয়, যার ফলে বড় স্থায়ী শহর তৈরি করা কঠিন, যদি না তুমি মঙ্গোল (Mongols) হও!

কেন সারা বিশ্বে পশুপালন তেমন জনপ্রিয় হলো না? কারণ বশে আনা যায় এমন প্রাণী (lend themselves to domestication) খুব বেশি নেই: ভেড়া, ছাগল, গরু, শুকর, ঘোড়া, উট (camels), গাধা (donkeys), রেনডিয়ার (reindeer), জল মহিষ (water buffalo), ইয়াক (yaks)—এগুলো এক জায়গায় সীমিত। আমেরিকা মহাদেশে (the Americas) কিন্তু স্থানীয়ভাবে খুব কম প্রাণী ছিল। সেখানে শুধু লামা (llama) ছিল যাদের কিছুটা কাজে লাগানো যেতে পারে। হিপোপটামাস (hippos) বিশাল মাংসের উৎস হতে পারত, কিন্তু, মুশকিল হচ্ছে তারা মানুষকেই খেতে পছন্দ করে। জেব্রা (zebras) ভীষণ খিটখিটে (ornery), ভাল্লুক (grizzlies) একেবারেই বশ মানতে চায় না, আর হাতির (elephants) মতো অসাধারণ প্রাণী অত্যন্ত ধীরগতিতে বংশবৃদ্ধি করে। ইশ, হাতিরা কত সুন্দর, বুদ্ধিমান, এবং দারুণ সব প্রাণী! কিন্তু এরা ২২ মাস গর্ভধারণ (pregnant) করে মাত্র একটিমাত্র শাবক জন্ম দেয়!

কেন কৃষি বিপ্লব ঘটল?

আসলে কৃষি বিপ্লব কেন ঘটল, সে বিষয়ে আমাদের হাতে নিশ্চিত কোনো লিপিবদ্ধ প্রমাণ (written record) নেই। তাই ইতিহাসবিদরা (historians) নানান ব্যাখ্যা হাজির করেন:

  1. জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার (population pressure) ফলে বাধ্য হয়ে মানুষকে কৃষির (farming) মতো পরিশ্রমী কাজে নামতে হয়।
  2. খাদ্যের প্রাচুর্য (abundance) মানুষকে অবসর (leisure) দেয়, আর তখন তারা ফসল ফলানো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে।
  3. কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন, বীজ রোপণ সম্ভবত কোনো উর্বরতা (fertility) বা ধর্মীয় আচার (rite) থেকে শুরু হয়।
  4. কারও মতে, শস্য (grains) পোষ মানানো (domesticate) শুরু হয়েছিল মদ (alcohol) তৈরির উদ্দেশ্যে।
  5. চার্লস ডারউইন (Charles Darwin) বলেছিলেন, কৃষির উদ্ভব একটি দুর্ঘটনার ফল—“কোনো গাছের (native plant) অস্বাভাবিক ভালো বৈশিষ্ট্য নজরে এলে কোনো ‘জ্ঞানী বন্য মানুষ’ বা ‘ওয়াইজ ওল্ড স্যাভেজ’ (wise old savage)’ সেটাকে যত্নে লালন করতে থাকে।”

আবার আরেক তত্ত্ব হলো, এটা আসলে কোনো ‘বিপ্লব (revolution)’ ছিল না, বরং মানুষ চিরকালই বেশি খাবার পাওয়ার উপায় খুঁজে বেড়ায়। আদিম শিকারি-সংগ্রহকারী জানতো, বীজ মাটিতে পুঁতলে গাছ জন্মায়। আর যখন তুমি বুঝবে কোনো ব্যবস্থায় বেশি খাবার মেলে, তখন সেটাই বারবার করতে চাইবে। ব্যাস! আজকের যুগে যারা হেলথ কনসার্ন তারা অবশ্যই ডাবল চিজবার্গারের মতো খাবার চাইবে না। কিন্তু আগের যুগের মানুষেরা ‘আরও বেশি খাবার’ পাওয়ার পথই বারবার বেছে নিয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে, গ্রীসের (Greece) ফ্রাঞ্চথি গুহায় (Franchthi Cave) ১৩ হাজার বছরের পুরনো শামুকের (snails) খোলসের বিশাল স্তূপ পাওয়া গেছে। দেখা যায়, সেই শামুকগুলোর আকার আজকের চেয়ে বড়; অর্থাৎ তখনকার মানুষ সম্ভবত বড় বড় শামুক বেছে খেত বা বংশবিস্তার করাত, যেন সেগুলো থেকে আরও বেশি ক্যালোরি পাওয়া যায়। শামুককে গৃহপালিত করার একটা বড় সুবিধা হলো—তারা পলায়ন করতে পারে না, সামান্য পরিখা (ditch) করলেই আটকে রাখা যায়, এবং তারা নিজস্ব বাড়ি নিয়েই ঘোরে! মানে তাদের শেলের কথা বলছি আরকি…

সুতরাং, এটা কোনো “হুট করে ঘটে যাওয়া বিপ্লব” ছিল না। বরং ধাপে ধাপে মানুষের ‘আরও খাবার চাই’ প্রবণতা থেকে শুরু হয়ে একসময় পৃথিবীতে সর্বত্র শস্যক্ষেত আর চারণভূমি বিস্তৃত হয়।

কৃষি-নির্ভর সভ্যতার পটভূমি

অনেক ঐতিহাসিক যুক্তি দেন—কৃষি ছাড়া বড় ও জটিল সভ্যতা গড়ে ওঠা সম্ভব হতো না; শহর, প্রযুক্তিগত উন্নতি, এমনকি সস্তায় মাংস, স্যান্ডউইচ সবই কৃষিকাজের সুফল। কিন্তু একই সঙ্গে এর সাথে যুক্ত হয়েছে পিতৃতন্ত্র (patriarchy), বৈষম্য (inequality), যুদ্ধ (war), এমনকি দুর্ভিক্ষ (famine)। তাছাড়া, পরিবেশের জন্য কৃষি ছিল বেশ ক্ষতিকর—বন ও নদীগুলিকে বদলে দেওয়া, বাঁধ নির্মাণ করা, তেল (oil) উত্তোলন করা, সার (fertilizer) তৈরি করা ইত্যাদি মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে একটা অস্বস্তিকর ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছে।

মানুষ তো স্বাধীনভাবেই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষি নির্বাচন করেছিল। কিন্তু সেটি কি “সঠিক পছন্দ” ছিল? হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না; তবে এটাকে তো আর পেছনে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। ইতিহাস তাই গুরুত্বপূর্ণ—এটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বিপ্লব এককালীন কোনো ঘটনা নয়; বরং দীর্ঘ একটা প্রক্রিয়া, যেখানে মানুষ শত শত বছর ধরে ছোট-বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে গিয়েছে, যার ফলে বর্তমান পৃথিবী গড়ে উঠেছে। তেমনি আমরা আজকেও এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, যা ভবিষ্যতের মানুষ “বিপ্লব” নামেই জানবে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.