Table of Contents
১. বসতি, অঞ্চল ও পরিচিতি
১.১ বসতি ও অঞ্চল
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে গারো অন্যতম। নৃ-তাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদদের মতে, গারোরা মঙ্গোলয়েড মহাজাতির টিবেটো-বার্মান দলের টিবেটো-চাইনিজ পরিবারের সদস্য। সাধারণত দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সীমান্তবর্তী বৃহত্তর ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল, শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা; বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার, গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলাতে গারোদের বাস করতে দেখা যায়।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা, অরুণাচল প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহারে গারোদের বসবাস রয়েছে। এছাড়াও কিছু সংখ্যক গারো অভিবাসী হিসেবে আমেরিকা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াতে বসবাস করছে। ভারতে বসবাসকারী গারোদের বেশিরভাগ পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করলেও বাংলাদেশের গারোরা সাধারণত সমতলেরই বাসিন্দা।
১.২ জনসংখ্যা
২০০১ সালের আদমশুমারিতে জাতিভিত্তিক লোকসংখ্যার হিসাব না থাকায় বাংলাদেশে গারো জনসংখ্যা কত তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে গারোদের জনসংখ্যা ৬৮,২১০ জন। চলমান জন্মহার বিবেচনায় নিলে ২০০১ সালে গারোদের জনসংখ্যা হওয়ার কথা ১০০,৯৫১ জন। কিন্তু ২০০১ সালের আদমশুমারিতে গারোদের আলাদা গণনা করা হয়নি কিন্তু গারোরা মনে করে গারোদের জনসংখ্যা কমিয়ে দেখানো হয়েছে বা গারোদের জনসংখ্যা সঠিকভাবে গণনা করা হয়নি। গারোরা মনে করে যে, বর্তমানে বাংলাদেশে তাদের সংখ্যা আনুমানিক ১ লক্ষ ২০ হাজারের মতো।
১.৩ স্থানান্তর
বর্তমান বসতি এলাকায় এক সময়কার প্রভাবশালী ও বিপুল ভূমির স্বত্বাধিকারী গারোরা বিভিন্ন সময়ে নানান কারণে বিভিন্ন স্থানে বসবাস করে। ১৯৪৭, ১৯৫০, ১৯৬৪ ও ১৯৭১-এ যথাক্রমে দেশ-বিভাগ, টংক আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় সারা দেশে, বিশেষ করে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অনেক অস্থিরতা বিরাজ করে। এসময় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আদিবাসী বিশেষ করে গারোরা এদেশ ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নেয় এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ৭০-এর দশকে জীবিকার সন্ধানে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা অঞ্চলের কিছু গারো পরিবার জীবিকার সন্ধানে সিলেটের চা-বাগানগুলোতে কাজের সন্ধানে গমন করে। পরবর্তীতে তারা সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। আবার ৮০-র দশকের দিকে কাজের সন্ধানে কিছু কিছু গারো নারী-পুরুষ ঢাকা শহরের দিকে গমন করে। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে এই প্রবাহ ব্যাপক আকার ধারণ করে। নব্বই দশক থেকে ঢাকা ছাড়াও অন্যান্য শহর, যেমন-চট্টগ্রাম, পাবনা, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি জায়গাতেও ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে এবং গ্রামে জনসংখ্যা তুলনামূলকভাবে কমে যাচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা শহরেই প্রায় পনেরো হাজারের মতো গারো বসবাস করছে।
১.৪ নামকরণ
বাংলাদেশে গারো নামে পরিচিত গারোরা সাধারণত গারো নামে নিজেদের পরিচয় দিতে পছন্দ করে না। কারণ গারো ভাষায় ‘গারো’ নামের কোনো অর্থ নেই। বিশ্বে এবং অন্যদের কাছে ইতোমধ্যে তারা ‘গারো’ নামে পরিচিত হয়েছে বলেই শুধু পরিচয় দেবার জন্যই তারা ‘গারো’ নামটি ব্যবহার করে থাকে। আসলে তারা এ নামটি নিয়ে সুখী নয়। তারা মনে করে এ নাম অন্যদের দেয়া এবং ব্যাঙ্গাত্মক।১ তারা নিজেদেরকে বলে ‘মান্দি’ বা ‘আ. চিক’। নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় এবং স্থানীয়ভাবে ভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর লোকজন যারা শব্দটি সম্পর্কে অবগত রয়েছেন তাদের নিকটও ‘মান্দি’ শব্দটিই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যারা বাংলাদেশের বাইরে, বিশেষ করে ভারতের মেঘালয়ে বসবাস করে তারা নিজেদের ‘আ.চিক’ বা পাহাড়ি মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। ২
গারোদের গারো নামটি কোথা থেকে এসেছে বা কে দিয়েছে এ নিয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে। তবে বোঝা যায় যে, এ নামটি অন্যদের দ্বারা বিশেষ করে গারোদের নিকটতম প্রতিবেশী ‘বাঙালিদের’ দেয়া। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখতে পাওয়া যায় যে, ভারতের গারো হিলস এবং অন্যান্য স্থানে যেখানে গারোদের বাস সেগুলো এক সময় বাঙালি জমিদারদের অধীনে ছিল। এভাবে কড়ইবাড়ি, শেরপুর, সুসং প্রভৃতি এলাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর বাজার, গ্রাম ব অঞ্চলের নাম যেমন-মহাদেও, দুর্গাপুর, বাঘমারা, শিববাড়ি, গারোবাধা, রাজাবালা, ফুলবাড়ি ইত্যাদি বাঙালিদের দেওয়া। গারো হিলসে ১৯০৩-০৪ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ‘বাংলা’ চালু ছিল এবং এটি ১৯২৮ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। সেই সময়ে হিল মৌজাদাররা ‘আ. খিং’ সম্বন্ধীয় প্রতিবেদন দাখিল করতো বাংলায়। সেসময়েও এ অঞ্চলে বাংলা ভাষা ও বাঙালিদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ৩
বাঙালিরা বনাঞ্চলকে ‘গড়’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। যেমন ভাওয়াল গড় মধুপুর গড়, জয়েনশাহি গড় ইত্যাদি। মান্দিদের বসতি এলাকাগুলো ছিল মূলত বনাঞ্চল বা গড় এলাকা। যেহেতু গারোরা বনাঞ্চল বা গড়ের অধিবাসী, এজন্যই গড়বাসী হিসেবে তাদের ‘গারো’ নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকতে পারে।৪
গারো হিলসের দক্ষিণাংশে ‘গারা গানচিং’ নামে গারোদের একটি দল ছিল। এ দলটির সঙ্গেই ইউরোপীয় ও বাঙালিদের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটেছিল। দলটির নামের প্রথমাংশ ‘গারা’ বিকৃত হয়ে হয়ে গারো হিলসে বসবাসকারী পুরো দলটির নামই ‘গারো’ হয়ে যায়।৫
বঙ্গদেশের সমতলে যখন গারোরা বাস করছিল সে সময়ে ‘সাংখা’ (Sangka) নামে একজন গারো রাজা উত্তর বঙ্গে বর্তমান ‘মালদা’ জেলাতে ‘Gaur’ নামে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সে সময় প্রতিবেশী লোকজন এদের উক্ত এলাকার আদি বাসিন্দা ‘Gaur’ বলতো। এই ‘Gaur’ নামটিই পরবর্তী সময়ে ‘গারো’ হয়ে যেতে পারে। ৬
গারোদের ঐতিহ্যবাহী গানের মধ্যে তাদের এদেশে আগমনের সময়কাল সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘Do.reng noktopgita, kilding jakbogita.’ অর্থাৎ সে সময় ‘চিলগুলো ছিল একটি ছোট্ট কুটিরের মতো, আর মাকড়সার জালের সুতা ছিল এক একটি হাতের মতো বড়।’ এই দৈত্যাকৃতির চিলগুলো মাঝে মাঝে লোকালয়ে এসে গৃহপালিত পশুপাখিগুলোকে এবং ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ছোঁ মেরে নিয়ে যেত। এই চিল পাখি পরিচিত ছিল ‘Garrurh’ বা ‘Garuda’ নামে যার মিল ছিল শ্রীকৃষ্ণের বাহনের নামের সঙ্গে। সমতলের লোকজন বড় পাখিটির নামেই পাহাড়কে বলতো ‘Garrurh Pahar’ আর ‘Garrurh Pahar’-এর বাসিন্দাদের বলতো ‘Garrurhs’। বাংলার শাসক ব্রিটিশগণই এইসব পাহাড়ি লোকদের বলতো ‘Garrurh’ এবং পরে তা হয় ‘Garrows’ বর্তমানে ‘Garo’৭ মান্দে বা মান্দি শব্দের উৎপত্তি: ‘Manni de’ বা ‘মানবসন্তান’ শব্দটির সংক্ষিপ্ত রূপ ‘মান্দি’। আরেকটি মতে বলা হয় যে, রাজা সিরামফার নেতৃত্বে একদল গারো পূর্ব তিব্বত হতে বার্মার দিকে রওনা হয়ে ইরাবতি নদীর তীরবর্তী ‘মান্দালয়’ নামক স্থানে বহুদিন ধরে বসবাস করে। তখন থেকে সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা তাদেরকে জানে মান্দালয়ের বাসিন্দা হিসেবে। সেসময় থেকে তারা পরিচিত হয়েছে ‘Mandalayas’, ‘Manday’ শেষে ‘Mande’ হিসেবে। গারোদের একজন পূর্ব পুরুষের নাম ছিল ‘নরমান্দে’। তাদের গান এবং লোককাহিনীতে তারা নিজেদের ‘নরমান্দি দিমা রিসি’ বলে অভিহিত করেছেন। ক্রমান্বয়ে প্রথমাংশ এবং শেষাংশের শব্দগুলো বাদ গিয়ে শুধু ব্যবহৃত হলো ‘মান্দে’। এভাবে তারা নিজেদের অভিহিত করল ‘মান্দে’ বা ‘মান্দেই’ হিসেবে।৯
আ.চিক শব্দের উৎপত্তি: ভারতের মেঘালয়ের পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসকারীরা গারোরা নিজেদের ‘আ. চিক’ বলে থাকে। এ শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে দু ভাবে এর অর্থ পাওয়া যায়।
- ১ ‘আ.আ’ মানে মাটি এবং ‘চিক’ বা ‘চিক্কা’ মানে কামড়ানো;
- ২. ‘আ.আ’ মানে মাটি আর ‘চিক’ বা ‘বোচিক’ মানে উঁচু খাড়া পাহাড়।
‘আ. চিক’ নামের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি জনপ্রিয় উপকথা হলো-একবার গারোরা ‘Matcha Melaram A.abri’ বা ‘Matcha Marunı A.song’ অঞ্চলে বসতি গেড়েছিল। এই স্থানটি বর্তমানে ‘বাঘমেলা পাহাড়’ নামে আসামের কামরূপ জেলার বোকো থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে ‘কিনাগাঁও’ নামক স্থানে অবস্থিত। এখানে এক সময় গারো নেতা ‘রাংবিলদি রাংবিলদা’ অর্থাৎ বনে- জানেফার সভাপতিত্বে এক বিশাল সমাবেশ হয়েছিল। সেই সময়ে সমাবেশে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সবচেয়ে প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন ও দূরদর্শী বলে সুপরিচিত ‘রাজিদফা’ বা রাজিদের বাবা কয়েকটি বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য নিম্নরূপ প্রস্তাবনাগুলো উপস্থাপনা করেছিলেন-
- ১ নিজেদের জন্য স্থায়ী আবাসভূমি ‘আ খিংভূমি’ গড়ে তুলতে হবে,
- ২. চাৎচি-মাহারীর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা, বোঝাপড়া ও সদ্ভাব গড়ে তুলতে হবে;
- ৩ বিভিন্ন চাৎচি-মাহারীর মধ্যে বিবাহ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে;
- 8 ‘নকম’ প্রথা বা উত্তরাধিকার প্রথার উপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
সেই সম্মেলনে সকলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল এবং উত্থাপিত বিষয়গুলোর উপর বিস্তারিত আলোচনা শেষে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো সবাই মেনে চলবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তারা প্রত্যেকেই এক মুঠো মাটি নিয়ে কামড়ে প্রতিজ্ঞা করে যে, কেউ আর এ স্থান অর্থাৎ ‘গারো পাহাড়’ ছেড়ে আর অন্য কোথাও যাবে না এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ কিংবা জবরদখলের বিরুদ্ধে তারা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। মাটি কামড়ে প্রতিজ্ঞা করার পর থেকেই তারা ‘A chik’ বা ‘A ako chike mikchetgiparang’ (মাটি কামড়ে শপথ গ্রহণকারী) এবং তারা যেখানে বসবাস করছে তা ‘A.chik A.song’ (আ.চিক রাজ্য) নামে পরিচিত হয়। ১০
মোগলরা যখন গারো হিলস আক্রমণ করে সেসময় এখানকার অধিবাসী অর্থাৎ গারোরা পাহাড়ে থেকেই প্রচণ্ড প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেই পাহাড়ি এলাকা থেকে তাদেরকে কোনো ক্রমেই বিতাড়ন করা যায়নি। তখন থেকেই মোগলরা এই ধারণা পোষণ করেছিল যে, জাতি হিসেবে এরা পাহাড়েই থাকতে পছন্দ করে এবং এখানকার মাটি কামড়েই তারা থাকতে চায়। এরূপ পাহাড়প্রিয় জাতি বলেই তাদের নাম হয়েছে ‘A.chik’। ১১
২. ঐতিহাসিক পটভূমি
ইতিহাসবিদ, সমাজচিন্তাবিদ, নৃ-বিজ্ঞানীদের তথ্যমতে, গারোরা ভারত উপমহাদেশে আর্যদের আগমনের পূর্ব থেকেই বসবাস করে আসছে। সে সময়ে তাদের পরিচয় হয়ত ‘গারো’ নামে ছিল না। গারোদের বসতি স্থান সম্পর্কে তাদের যাযাবরীয় বৈশিষ্ট্য ও স্থানান্তর গমনের ঐতিহাসিক তথ্যাদি তুলে ধরা হলেও এরা যে আর্যদের আগে থেকেই এসব অঞ্চলে বসবাস করে আসছে এ বিষয়ে ১৮৭২ সালে প্রকাশিত Descriptive Ethnology of Bengal নামক পুস্তকে Edward Tuite Dalton, C.S.I তুলে ধরে বলেছেন- ‘There is doubtless an intimate connection between the Indo-Chinese population of Assam, and some of the people that formed nation in the Gangetic Provinces before the Aryans appeared in them…. It is probable that the hill people of lower Assam, now known as Garos and Khasias, were earlier settlers, for we find them holding an isolated position, as if the Aryan invasion pushing in like a wedge had cut them off from communication with the parent northern nation but otherwise the plains of Assam appear to have been unoccupied, and to the Aryans may be ascribed the honor of first peopling them ‘১২
Dr Parimal Chandra Kar১৩ বলেছেন, ‘এদের তিব্বত থেকে গারো হিলসে আসার কোনো লিখিত দলিলাদি নেই। তবে এরা গারো হিলসে যেভাবেই আসুক না কেন, এরাই যে সবার আগে এ স্থানটিকে নিজেদের আবাসভূমি করে নিয়েছিল তা বোঝা যায়।’ এ বিষয়ে Dalton লিখেছেন- ‘The Garos have no tradi- tion regarding migration; they imagine themselves to be autochtho- nous. ‘১৪
গারোদের স্থানান্তর গমনের ইতিহাস তাদের ‘katta agana’ বা epic lore বা লোক-কাহিনীসমূহের পঙ্ক্তিগুলোর ছন্দে ছন্দে এবং গদ্যের মাধ্যমে পুরুষ পরম্পরায় হস্তান্তরিত হয়েছে। তবে ‘katta agana’-তে যে ভাষা বা শব্দসমূহ ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো archaic যুগের এবং সেসব বস্তু, ব্যক্তি বা স্থানের নামগুলো চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। কারণ দীর্ঘ সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এসবের নাম পরিবর্তিত হয়েছে। তবে এটি উল্লেখ্য যে, তিব্বত থেকে আসাম উপত্যকায় তাদের আগমনের কাহিনী মুখে মুখে এখনও প্রচলিত। ১৫
গারোদের পূর্ব-পুরুষদের ধারণা মতে, তাদের পূর্ব-পুরুষদের আদি বাসস্থান ছিল তিব্বত যা ‘Torua’ নামে পরিচিত ছিল । ১৬ তিনটি পথ দিয়ে তিন দলে বিভক্ত হয়ে গারোদের পূর্ব-পুরুষরা এ উপমহাদেশে আসে। প্রথম দলটি অগ্রসর হয় জাপফা জালিমফা এবং সুকফা বঙ্গিফার নেতৃত্বে তিব্বতের দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে তোরসা বা তিস্তা নদীর উৎস মুখ বরাবর; দ্বিতীয় দলটি অগ্রসর হয় আউক রাজা, আসিলিক গিত্তেল প্রমুখদের নেতৃত্বে মধ্য তিব্বত থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের উৎসমুখ দিয়ে দক্ষিণ দিক বরাবর; আর তৃতীয় দলটি অগ্রসর হয় রাজা সিরামফা, কতা নাংরেফা প্রমুখের নেতৃত্বে তিব্বতের দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে চিন্দুইন, সালউইন ও ইরাবতী নদীর উৎসমুখ বরাবর।১৭
গারোদের পূর্ব-পুরুষরা প্রধানত তিব্বতের পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চল থেকে তোরসা বা তিস্তা নদী বরাবর পথ ধরে ভুটান পাহাড়ে এসে বসবাস শুরু করে। ভুটানের রাজা তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করলেও পরবর্তীতে আবার তাদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে সেখানে থাকার অনুমতি আর দেননি। তাই সেখান থেকে তারা পশ্চিম দিকে তিস্তা নদীর ভাটির দিকে ‘নকচলবাড়ি’ (বর্তমান কালিমপং, পশ্চিমবঙ্গ) এসে বসবাস করতে শুরু করে। সেখানে বেশ কিছু কাল বসবাস করে আবার দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে ‘A.song Patari Chiga Sulunchi’ নামক স্থানে অর্থাৎ বর্তমান কুচবিহারে তারা বসতি শুরু করে। এখানে তারা প্রায় ৪০০ বছর ধরে বসবাস করে। এ সময়েই তারা ধন-সম্পদে সমৃদ্ধ এবং যুদ্ধাস্ত্র চালনায় দক্ষ ও দুর্ধর্ষ হয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠে। এ কারণে কোচ ও কাছাড়ি রাজারা তাদেরকে ভয় পেয়ে তাদের রাজ্যে বেশিদিন থাকার অনুমতি দেননি। ১৮
এরপরে তারা রাঙ্গামাটি নামক স্থানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) এসে বসবাস করে। বলা হয়ে থাকে যে, এখানে বসবাস করার সময়ে গারোদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এখানকার সমাজব্যবস্থার সঙ্গে অর্থাৎ তাদের সমাজ-সংস্কৃতি, খাদ্য, ধর্মীয়-বিশ্বাস প্রভৃতি নিয়ে এদের সঙ্গে মতভেদ দেখা দেয়। এদের সঙ্গে গারোরা খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। এ কারণে এ ভূখণ্ডের রাজা এদের ওপর ঈর্ষান্বিত ও ক্রোধান্বিত হয়ে উঠে এবং এরা দেশের জাতি-বর্ণ-প্রথা ও নিয়ম-নীতি মানে না এই অজুহাতে তাদেরকে সেখানে আর থাকতে দেয়নি। এখান থেকে রাজ Dhobani-র রাজ্য Dhubri-তে আগমন করেন। ১৯ এখানকার রাজাও তাদের স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি না দেয়ায় তারা ব্রহ্মপুত্র নদের তীর বরাবর উজানের দিকে মানস নদীর অববাহিকায় এসে বসতি স্থাপন করে। কিন্তু এখানকার রাজা খাংরে-জিংরে’র মেয়ে ‘জুগী-সিলচি’ নামক একজন সুন্দরী-রূপবতী গারো মেয়ের রূপে বিমোহিত হয়ে জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। গারোরা মেয়েটিকে সেই রাজার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ‘জুগীগোপা’ নামক স্থানের একটি পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে রাখে। সে থেকে জায়গাটির নাম হয় ‘জুগীগোপ্পা’ ২০ এখান থেকে তারা পরে তিনশতটি কলা গাছের ভেলায় করে সাত দিন সাত রাত ধরে কঠোর পরিশ্রম করে বড় ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে ‘দলগুমা’ নামক স্থানে ‘দুধনই’ ও ‘কৃষ্ণাই’ নদীর মোহনার কিছু উজানের দিকে এসে তীরে উঠে। তীরে এসে যখন তারা ‘গারোমারি’ নামক স্থানে দুপুরের খাবার খাচ্ছিল ঠিক সেই সময় অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ করে রাজা থুবানি বা নেতা ধুবিনি এবং রাজা বেহারি গারোদের আক্রমণ করেন। গারোরা প্রচণ্ড প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং আক্রমণকারীদের পরাজিত করে। গারোদের নিকট স্থানটির নাম ছিল ‘Topla Banda Misal Kawa’ বা ‘Nengabat Nengchibat’। এ স্থান আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় অবস্থিত। ২১
এরপর তারা ব্রহ্মপুত্রের উজানের দিকে বাম দিকের তীর ধরে অগ্রসর হয়ে অহোম রাজা লীলাসিং-এর রাজ্যে এসে বসবাস করতে থাকে। এই রাজা ছিল খুবই নিষ্ঠুর প্রকৃতির এবং গারোদের খুবই অত্যাচার-নিপীড়ন করতো। সমসাময়িক সময়ে পার্শ্ববর্তী রাজ্যের রাজা Arambit যুগী-সিলচি (সম্ভবত সেই একই যুবতী মানসসরোবরে যাকে দেখে সেখানকার রাজা মুগ্ধ হয়েছিলেন) নামক সুন্দরী যুবতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করেন রাজা লীলাসিং-এর অত্যাচারের হাত থেকে তিনি গারোদের রক্ষা করেন এবং গারো যুবকদের তার সৈন্যদলের অন্তর্ভুক্ত করেন। পরবর্তীতে লীলাসিং-এর সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে তিনি সেই যুঅন্তর্ভুক্ত দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখেন এবং তাদেরকে কামরূপ জেলার পূর্বে অবস্থিত বোকো থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে ‘বাঘমেলা’ পাহাড়ে তাদেরকে থাকতে দেওয়া হয়। এ পাহাড়টি ছিল ব্যাঘ্র-মানব ও ভূতপ্রেত পরিপূর্ণ, যা তাদেরকে আবার আগের মতো দুরবস্থায় ফেলে দেয়।১ এখান থেকে পরবর্তীতে তারা “Saljong Patra Rongdogachol’ নামক স্থানে বসবাস করে (বর্তমানে কামরূপ জেলার কামাখ্যা)। এ স্থানে তারা একশত বছরেরও অধিক সময় ধরে বসবাস করে। ২
পতিত দুরবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তারা আবার পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যাত্রাপথে তারা অনেকগুলো জায়গার মধ্য দিয়ে আগমন করে, বসবাস করে কিন্তু সবগুলো জায়গার নাম ও জায়গা চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। সেগুলোর মধ্যে একটি উলেখযোগ্য স্থানের নাম হলো ‘Ola-Olding Tebrong Changsım’। পরবর্তীতে চিহ্নিত করা সেই স্থানটি হচ্ছে Tukeswar পাহাড়, যেটি গোয়ালপাড়া জেলার কৃষ্ণাই-এর কাছাকাছিতে অবস্থিত। এখানে এসে তারা সম্পদশালী হয়ে উঠে এবং নিজেদের জন্য একটি রাজ্য গড়ে তোলে। এ রাজ্যটির প্রথম রাজা ছিলেন Abra বা Abrasen এবং তার রাজধানীর নাম ছিল Sambol Ading, যা হাবরাঘাটের (নামটি তার নামানুসারে রাখা হয়েছিল) Dakaitdol নামক স্থানের কাছাকাছিতে অবস্থিত। এ সময়ে আবার পরস্পরের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। এ কারণে তারা আবার বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং ভিন্ন ভিন্ন স্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। তাদের মধ্যে একটি দল, যার নেতৃত্বে ছিল Abing-Noga নামক একজন নেতা, গারো পাহাড়ের Nokrek আ.ব্রিতে এসে বসতি গড়ে তোলে। এখানেই রাজার জীবনাবসান ঘটে। পরবর্তীতে গারোরা গারো পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।৩ গারো পাহাড়ের পাদদেশে ও সন্নিকটবর্তী সমতলে বসবাসকারী এ উপদলগুলো হলো ‘আউই’ ও ‘চিসাক’।৪
গারোদের আরও দুইটি দল রাজা আবং-নগা এবং বনে-জানের বাবা রাংবিলদি রাংবিলদার নেতৃত্বে গারো হিলসের মধ্যবর্তী অঞ্চল ও পরে জেলার পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে নিজেদের দখলে নিয়ে বসবাস করে এ দুটো দল হলো ‘আবেং’ ও ‘মাতাবেং ৫
আরেকদল গারো বার্মা হয়ে নাগাল্যান্ডের পাহাড়-জঙ্গলপূর্ণ অঞ্চলসমূহ ঘুরে এসে আসামে প্রবেশ করে। এখানে তার শক্তিশালী কাছাড়ি ও অহোম রাজাদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল আসামের মধ্যাঞ্চলে ‘গঙ্গাদল’ ও ‘সিবদল’ নামক এলাকাগুলোতে বসতি স্থাপন করে। আরেকদল দক্ষিণ দিকে সুরমা ও বরাক নদী বরাবর হয়ে কাছাড় ও সিলেটে প্রবেশ করে। এই দলই পরবর্তীতে ‘বঙ্গে’ অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। রাজা Sangka-র নেতৃত্বে তারা মালদা জেলাতে ‘Gaur’ নামে প্রথম একটি গারো রাজ্য স্থাপন করেছিল। গারোরা এ রাজ্যে অনেক বছর ধরে বসবাস করেছিল। হিন্দু রাজাদের রাজত্বের সময়ে এ স্থানটির নাম ছিল ‘গৌড়ীয় বাংলা’। পরবর্তীতে ১১৯৮ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্মণ সেনের কাছ থেকে এ অঞ্চলটিই দখল করে নেন মুসলমান সম্রাট ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি। বাংলায় বসবাসরত গারোরা মুসলমানদের দ্বারা নানাভাবে অত্যাচারিত হয়ে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে বসতি গড়ে তোলে। শেষের দিকে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে ‘ঢাকা রন ভাওয়াল’ অর্থাৎ ঢাকা দখল করে। পরে গারোদের কাছ থেকে এটি দখল করে নেয় মোগলরা এবং ‘গৌড়’ থেকে বাংলার রাজধানী ‘ঢাকা’-তে স্থানান্তরিত করা হয়। বাংলাদেশে গারোরা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিশেষ করে তারা পাহাড়ি অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হয়ে ময়মনসিংহ ও রংপুর জেলার অনেক স্থান দখল করে নেয়। গারো রাজা Monsing-এর নামানুসারেই বর্তমান ‘ময়মনসিংহের’ নামকরণ হয়েছে বলে বলা হয়ে থাকে। ৭
আংশিক শাসন বহির্ভুত এলাকা স্বাধীনচেতা গারোরা জমিদারদের কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া কর প্রদান করতে এবং জমিদারদের অধীনতা স্বীকার করতে চায়নি। ফলে জমিদারদের সাথে ও সমতল মানুষদের সাথে গারোদের প্রায়ই দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম হতো। এসবের মাধ্যমে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে যে অশান্ত, অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল তা ব্রিটিশ শাসকদের গারো হিলস ও এর নিকটবর্তী গারো এলাকাগুলোকে নিজেদের আয়ত্তে ও নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল। এরই ফলশ্রুতিতে গারোদের ওপর জমিদারদের নিয়ন্ত্রণ ও কর আদায় ক্ষমতা রহিত করে Regulation X of ১৮২২ জারি করা হয়, যা Non Regulation System নামে পরিচিত। এই আইনের মাধ্যমে গারোদের উপর বাংলার জমিদারদের নিয়ন্ত্রণ রহিত করা হয় এবং করদ গ্রাম ও স্বাধীন এলাকাসমূহ জমিদারদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়। পরবর্তীতে ১৯৩৫ সালে আসামের গারো হিলস অঞ্চল এবং পূর্ববঙ্গের শেরপুর, শ্রীবর্দী, নালিতাবাড়ি, হালুয়াঘাট, দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা এই ছয়টি অঞ্চলের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাসমূহকে ‘আংশিক শাসন বহির্ভূত এলাকা’ (Partially Excluded Area) ঘোষণা করা হয়। এরূপ ঘোষণার পেছনে কারণ ছিল দুর্গম পার্বত্যাঞ্চল, অনগ্রসর আদিবাসী সমাজ এবং স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করা। ঘোষিত আইনটি কার্যকরী হয় ১৯৩৭ সালে। পাকিস্তানের পরবর্তীতে রক্ষা কাঠামোতে উক্ত এলাকার জন্য এই ঘোষণা আর কার্যকর থাকেনি।
গারো রাজ্য ও রাজাদের বিবরণ : গারো নেতৃত্ব ও রাজাদের সম্পর্কে ইতিহাসবিদ ও গবেষকরা তেমন গুরুত্বারোপ না করলেও এবং ইতিহাসে তাদের বিবরণ লিপিবদ্ধ না করা হলেও এদের পূর্বপুরুষদের মুখে মুখে তাদের নাম উচ্চারিত হয়েছে এবং গারোদের নিজস্ব লেখাগুলোতে সেগুলো উঠে এসেছে। সবার ইতিহাস বিস্তারিত না পাওয়া গেলেও উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে কয়েকজনের নাম প্রায় সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। যেমন রাজা জাপফা, জালিনফা, বনে-জানেফা, রাজা আব্রাসেন বা আব্রা, রাজা শাংখা, রাজা রেংখা, রাজা আবং নগা, রাজা উসং মান্দা, রাজা বাসে, রাজা পেরে প্রমুখের নাম প্রায় সময়েই বয়স্ক গারো ব্যক্তিদের মুখে উচ্চারিত হয়ে থাকে।
সংগ্রাম ও আন্দোলন: ব্রিটিশ শাসকদের কাছে গারোরা স্বাধীনচেতা ও পাহাড়বাসী হিসেবে পরিচিত ছিল। তারা ভূমিকে মনে করতো ঈশ্বর প্রদত্ত দান এবং এটির জন্য কর দেয়া তারা পছন্দ করতো না। হিন্দু জমিদাররা যখন তাদের উপর কর দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করতো, তারা তা সহজে দিতে চাইতো না। এ কারণে জমিদাররা অত্যাচার জুলুম চালাতো। ইংরেজদের সাহায্য নিয়ে স্থানীয় জমিদারদের গারোদের ওপর শোষণ, অত্যাচার ও করারোপ বৃদ্ধির প্রতিবাদে ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে এতদঞ্চলের গারোরা প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলে। সুসং দুর্গাপুরের শংকরপুরের ‘আখিং নকমা’ ‘ছপাতি’র নেতৃত্বে প্রথম সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। তিনি ছিলেন অসীম সাহসী এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন। তিনি মনে করেছিলেন পাহাড়ি অঞ্চলের সকল গারোদের সংগঠিত করে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে এবং একটি স্বাধীন রাজ্য গড়ে তুলতে পারলে জমিদারদের উৎপীড়ন, অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। ছপাতি নকমা এই উদ্দেশ্যে ব্যাপক জনসংযোগ করেন এবং আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলো সফর করে সুসং, শেরপুর, কড়ইবাড়ির জমিদারি অঞ্চলগুলোর গারো, হাজং, হদি, বানাই, প্রভৃতি আদিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালান এবং তিনি অনেকাংশে সফলতাও অর্জন করেছিলেন। ছপাতি নকমার এ প্রচেষ্টার কথা জানতে পেরে জমিদাররা প্রচারণা চালায় যে, ছপাতি নকমা এ আদিবাসীদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। তার কথায় কাউকে কান না দিতে ও তার সঙ্গে যোগ না দিতে বলা হয়। তাদের এই প্রচারণা স্থানীয় আদিবাসীদের মধ্যে ছপাতি নকমার বিরুদ্ধে গভীর সন্দেহের উদ্রেক হয়। এ কারণে ছপাতি নকমা আর সফলকাম হতে পারেননি।৩৬
গারো রাজ্য স্থাপনে ছপাতি নকমার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর ব্রিটিশদের ছত্রছায়ায় জমিদারদের অত্যাচার, শোষণ, কর আদায় বহুগুণে বেড়ে গিয়েছিল। জমিদাররা ব্রিটিশদের নামমাত্র কর দিয়ে পার্বত্য অঞ্চল নিজেদের পদানত রেখে ভোগদখল করতে চেয়েছিল। তারা দশশালা বন্দোবস্তের মাধ্যমে বিরাট এলাকা নিজেদের করায়ত্ত করে বহুগুণে কর আদায় করতো। যেখানে সেসব এলাকার কর ছিল মাত্র বারো টাকা সেখানে জমিদাররা আদিবাসীদের কাছ থেকে সে সময়কালে বিশ হাজার টাকা পর্যন্ত কর আদায় করতো। স্বাধীনচেতা আদিবাসী জমিদারদের এই অন্যায় শোষণ মেনে নেয়নি। তাই সুসং দুর্গাপুরের লেটিয়াকান্দা গ্রাম নিবাসী টিপু গারোর নেতৃত্বে গারোসহ অন্য আদিবাসীরা আন্দোলন গড়ে তোলে। গারোরা জমিদারদের খাজনা দেয়া বন্ধ করে দেয়। টিপুর নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয়ে সহস্রাধিক গারো শেরপুরের ‘গড়দলিপায়’ জমিদারদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং জমিদাররা পরাজিত হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হয়। জমিদাররা ইংরেজদের সহায়তা কামনা করলে ইংরেজ বাহিনী তাদের সহায়তা করতে আসে। ইংরেজদের সাথেও কয়েক দফা খণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইংরেজ বাহিনীও পরাজয় বরণ করে। পরে ইংরেজরা ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে গারোদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু এবারে গারোরা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের কাছে টিকতে না পেরে ইংরেজদের নিকট পরাজয় বরণ করে এবং শেরপুর ছেড়ে চলে যায়। ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে টিপু গারো ইংরেজদের হাতে বন্দি হয়ে বিচারে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে বন্দি অবস্থাতেই মারা যান। ৩৭
১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে আবার জানাকু পাথাং ও দুবরাজ পাথাং নামক দুজন গারো নকমার নেতৃত্বে গারো বিদ্রোহ শুরু হয়। নালিতাবাড়িতে ঘাঁটি স্থাপন করে এ দুজন নকমার নেতৃত্বে দুজনে দু দিক থেকে কড়ইবাড়ির জমিদারবাড়ি আক্রমণ করে জমিদারবাড়ি ও কাছারি লুণ্ঠন করে। এই খবর পেয়ে ময়মনসিংহের ম্যাজিস্ট্রেট মি. ডারবান শেরপুরে এলে গারোরা তাকেও আক্রমণ করে। তিনি পলায়ন করে বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে নালিতাবাড়ির ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হলে দুবরাজ পাথাং তাকে আক্রমণ না করে পলায়ন করেন। এরূপ আয়াসসাধ্য বিজয়ে সরকারি বাহিনী যখন আনন্দ-উল্লাসে মত্ত ঠিক সে সময়ে দুবরাজ পাথাং সদলবলে তাদের আক্রমণ করেন। এতে সরকারি বাহিনী ও জমিদারের অনেক লোক প্রাণ বিসর্জন দেন। পরবর্তীতে সুসজ্জিত সৈন্যদলের সঙ্গে গারোরা কিছুদিন গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে টিকতে না পেরে পলায়ন করে। আর সৈন্য বাহিনী বিক্ষুব্ধ হয়ে গারোদের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, আর নিরীহ গ্রামবাসীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালাতে থাকে। এ কারণে অনেক গারো নকমা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় এবং গারো বিদ্রোহের অবসান ঘটে। তারপরও পরবর্তীতে ১৮৩৭, ১৮৪৮, ১৮৬১, ১৮৭১ এবং ১৮৮২ সালে গারোরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল তাদের ওপর শোষণ, অত্যাচারের বিরুদ্ধে। পরে আর কোনো গারো বিদ্রোহের কথা শোনা যায়নি। এসব বিদ্রোহের কারণে পরবর্তীতে ইংরেজ শাসকরা করের পরিমাণ কমানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল এবং গারোরা কিছুটা শান্ত হয়। এসব বিদ্রোহকে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন নামে অভিহিত করলেও সেসব সংগ্রাম ও বিদ্রোহ ছিল গারোদের উপর জমিদারদের অন্যায় অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন, নিজেদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, ন্যায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। ৩৮
মুক্তিযুদ্ধে গারোদের ভূমিকা তারই রেশ ধরে ১৯৭১ সালেও পাকিস্তানি শাসকদের অন্যায় অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে এ দেশের আপামর জনসাধারণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গারো আদিবাসীরাও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। পরিমল দ্রং, আরং রিছিলের মতো বেশ কজন বীর গারো মুক্তিযোদ্ধা সম্মুখসমরে শহীদও হয়েছেন। গারো মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কোম্পানি কমান্ডার দীপক সাংমা, মুক্তিযোদ্ধা থিয়ফিল হাজং, প্লাটুন কমান্ডার ধীনেন্দ্র রিছিল, প্লাটুন কমান্ডার যতীন্দ্র সাংমা, প্লাটুন কমান্ডার স্তেফান নকরেক, সেকশন কমান্ডার ভদ্র মারাক, নারী মুক্তিযোদ্ধা ভেরেনিকা সিমসাং প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধার নাম উল্লেখযোগ্য। ২৯
তারা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে যে, এ দেশ তাদেরও দেশ, এ দেশ তাদের জন্মভূমি। তাই এ দেশের মুক্তির ও স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে পেরে তারা নিজেদের গর্বিত মনে করেন।
৩. সামাজিক কাঠামো
৩.১ গোত্র ও পরিবারের ধরন
গারোদের সমাজ ব্যবস্থা মাতৃসুত্রীয় (matrilineal)। মায়ের বংশ পরিচয়েই সন্তানদের বংশ পরিচয় গণনা করা হয়। তবে পারিবারিক ও সামাজিক কাজে মেয়েদের পরামর্শ ও সহযোগিতা থাকে কিন্তু চূড়ান্তভাবে পরিবার ও সমাজ পরিচালনার ভার পুরুষদের ওপরই ন্যস্ত। মাতৃসূত্রীয় সমাজব্যবস্থায় মায়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে থাকে মেয়েসন্তানরা।
গোটা গারো সমাজ তিনটি চাৎচি বা গোত্রে বিভক্ত; যথা-সাংমা, মারাক ও মোমিন। শেষোক্ত চাৎচির আবির্ভাব ঘটে সবার পরে এবং মিশ্র বিবাহ সংঘটিত হওয়ার মধ্য দিয়েই এ চাৎচির আবির্ভাব বলে মনে করা হয়ে থাকে। গারো হিলস, কামরূপ ও গোয়ালপাড়া জেলায় বসবাসরত গারোদের সঙ্গে অ-গারোদের বিবাহের ফলশ্রুতিতেই ‘মোমিন’ চাৎচির উদ্ভব হয়েছে বলে মনে করা হয়। ৩৯ কিন্তু অন্য দুটি চাৎচি পাহাড় বা সমতল সবখানেই দেখা যায়। তবে দলটি মিশ্র বিবাহের মাধ্যমে হয়েছে বলে এটির কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণাদি পাওয়া যায় না। এই তিনটি চাচি ছাড়াও শিরা, আরেং ও এবাং নামে আরও তিনটি চাৎচি রয়েছে। এগুলোর আবির্ভাব ঘটেছে অনেক পরে। এসব ছোট দলগুলো মূলত সাংমা ও মারাক থেকেই উদ্ভব হয়েছে। যেমন দালবৎ ও নংবাক এসেছে সাংমা ও চিরান থেকে। এভাবে বড় দল থেকেই ছোট দলগুলোর উদ্ভব ঘটেছে বলে জানা যায় ৪০
প্রতিটি গোত্র অসংখ্য মাহারী বা মাচং-এ বিভক্ত। গোত্র বা চাৎচি আর মাহারী বা মাচং প্রতিটিই exogamous বা বহির্গোত্র বিবাহ রীতি অনুসরণ করে। সাংমা সাংমাকে, মারাক মারাককে কিংবা মোমিন মোমিনকে বিয়ে করতে পারে না। অন্যদিকে সাংমা চাৎচিভুক্ত যে সমস্ত মাহারী রয়েছে তাদের মধ্যেও বিয়ে নিষিদ্ধ। কারণ বাস্তবিক পক্ষে, সেই মাহারীগুলো ‘সাংমা’। যারা একই মাহারী থেকে বিয়ে করে তারা সমাজে ঘৃণিত হয়। সমাজে নেতিবাচক অর্থে তাদেরকে ‘মাদং’ (মাকেই বিয়ে করেছে) বলে আখ্যায়িত করা হয়। আর যারা একই চাৎচিভুক্ত ভিন্ন মাহারী থেকে বিয়ে করে তাদেরকে বলা হয় ‘বাকদং’ (আপন আত্মীয়কে বিয়ে করেছে)। সমাজে উভয় ধরনের বিয়ে নিষিদ্ধ এবং অগ্রহণযোগ্য। যারা এরূপ বিয়ে করে বিশেষ করে ‘মাদং’ বিয়ে করে তাদেরকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করা হয়। এ কারণে তারা যদি অন্য গ্রামে গিয়েও বসবাস করে, সেখানকার গ্রামবাসী যদি জানতে পারে তারা মাদং বিয়ে করেছে, তবে সেই গ্রামকে অপবিত্র করার দায়ে তাদেরকে ‘সংমারাং’ নামক জরিমানা দিতে হয়। পূর্বে সমাজের এই নিয়ম ভঙ্গকারীদের তাড়িয়ে দেয়া হতো, এমনকি মেরেও ফেলা হতো । ৪১ একই চাৎচিভুক্ত অন্য মাহারীর মধ্যে বিয়ে বর্তমানে বহুল প্রচলিত হলেও একই মাহারীর মধ্যে বিয়ে অর্থাৎ ‘মাদং’ বিয়ে এখনও সমাজের চোখে ঘৃণিত এবং সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এজন্য বর্তমানে গ্রাম থেকে বহিষ্কার করা ও জরিমানা আদায় করা না হলেও ‘মাদং’ বিয়েকারীরা নিজেরাই নিজেদের অপকর্মের জন্য লজ্জিত হয়ে অন্যত্র গিয়ে বসবাস করে। ‘মাদং’ ছাড়াও সমাজে আপন ভাই-বোন, সৎ ভাই-বোন, মায়ের বোনের ছেলে-মেয়ে, বাবার ভাইয়ের ছেলে-মেয়ে, কাকা, মামা, খালা, ফুফু সম্পর্কীয় আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ।
চাৎচি ও মাহারীভিত্তিক ভাগ বিভাগ ছাড়াও গারোদের আরো উপদল রয়েছে সেগুলোকে বলা যায় Lingua-Cultural Sub-division। অনেকে এদেরকে ‘ভাষাভিত্তিক দল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ৪২ কারণ এদের মধ্যে ভাষা ও আচারানুষ্ঠান পালনগত কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এ দলগুলো হলো-আখাওয়ে বা আউই, আত্তং, আমবেং বা আবেং, চিসাক, রূগা, চিবক, মেগাম বা লিঙাম৩০ খাসি জাতিতাত্ত্বিক পরিচিতিতে লিংগামদের খাসি জাতিভুক্ত জনগোষ্ঠী হিসেবে বলা হয়েছে। লিংগামদের মধ্যেও কেউ কেউ নিজেদেরকে গারো আবার কেউ কেউ খাসি জনগোষ্ঠীভুক্ত বলে দাবি করে। এ নিয়ে আরো নিবিড় গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
দুয়াল মাৎচি, মাতাবেং বা মাতজাংচি, কচু বা কচু আউই, আতিয়াগ্রা, গারা গানচিং, জারিয়াদং, সমন, মালং, দামেলিয়া ও বারঘরিয়া। গবেষকরা মনে করেন, দামেলিয়া ও বারঘরিয়াদের ভাষায় বাংলা ও অহমীয়া ভাষার সংমিশ্রণ ঘটেছে।৪৩ কারো মতে এগুলো ছিল পেশাভিত্তিক দল। গারোদের বিভিন্ন উপদলের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ হতো। এতে অপেক্ষাকৃত সবল দলগুলো অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলগুলোকে পরাজিত করে নিজেদের সেবক ও দাস হিসেবে খাটাতো এবং বিভিন্ন দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে সেগুলো করতে বাধ্য করত। পরবর্তীতে চাপিয়ে দেয়া দায়িত্বাবলি পরাজিত দলগুলো নিজেদেরই দায়িত্ব ও কর্তব্য মনে করে পালন করতে থাকে। সময়ের পরিক্রমায় নিজেদের আলাদা একটি দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে আবেংরা তুলা চাষ করতো; গারা দল wakkong তৈরি করতো, কচু দল মাছ ধরত; চিসাক দল ভুট্টা চাষাবাদ করতো। তাদের কাজ ও পেশার ভিত্তিতে কৃত দায়িত্বাবলি অনুসারে পরবর্তীতে এরা আলাদা একটি দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ৪৪
অনেকে মনে করেন, উপদলগুলোর নাম কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের বসবাসকারী সংশ্লিষ্ট জায়গার নাম অনুসারে হয়েছে। তারা একেকটি আলাদা দল হিসেবে আলাদা স্থানে দলবদ্ধ হয়ে বসতি গড়ে তুলেছিল। আউইদের বেশিরভাগের বসতি হলো গোয়ালপাড়া গারো হিলসের পাহাড়ি এলাকায়। ফলে এদের সাথে আমেরিকান ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিদের প্রথম দেখা হয় এবং এদের ভাষাই লিখিত গারো ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। গারা-গানচিং দলের লোকেরা বাস করত গারো হিলসের দক্ষিণ অঞ্চলে। আর এদের সাথেই ব্রিটিশ প্রশাসকদের প্রথম পরিচয় ঘটে। ব্রিটিশ শাসনের শেষদিন পর্যন্ত এ অঞ্চলগুলো ব্রিটিশের অধীন থাকা এ দলটি তেমন অগ্রসর হতে পারেনি। মেগাম যাদেরকে লিঙামও বলা হয় এরা গারো হিলস ও খাসিয়া হিলসের মধ্যবর্তী বা কাছাকাছি স্থানে বসবাস করার ফলে এদের জীবনধারায় খাসিয়া সংস্কৃতির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। আমবেংদের বসতি গারো হিলসের মধ্যবর্তী স্থানে। ফলে অনেক বছর ধরেই এরা শিক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিত রয়ে যায়।৪৫ আন্তঃগোত্রীয় বা আন্তঃদলীয় বিবাহ এবং ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতার পর পার্বত্যাঞ্চলে নতুন নতুন রাস্তা নির্মাণ করে যোগাযোগের উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, প্রশাসনিক কাঠামো এগুলোর কারণে দলগুলোর মধ্যেকার পার্থক্য অনেকটা কমে এসেছে বলে মনে করা হয়। ৪৬
গারো সমাজে যৌথ পরিবারই বেশি দেখা যায়। পরিবারে মা-বাবা, ভাই-বোন ছাড়াও, বাবার ভাই-বোন, অথবা মায়ের বোন-ভাই, দাদা-দাদিরাও পরিবারে থাকে। বিশেষ করে যারা জীবিকার সন্ধানে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বাস করে, তারা সেখানে একক পরিবারে থাকলেও গ্রামের পরিবারের দেখাশোনা ও বিভিন্ন খরচের দায়িত্ব নিয়ে থাকে। ফলে এটিকে সম্প্রসারিত যৌথ পরিবার বলা যেতে পারে। তবে বর্তমানে একক পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। গ্রামীণ সমাজে যৌথ পরিবারভিত্তিক অবকাঠামোই দেখা যায় বেশি। অন্য স্থানে জীবিকার উদ্দেশ্যে যাওয়া বিশেষ করে শহরে যারা থাকে তাদের মধ্যে একক পরিবারই বেশি দেখা যায়।
৩.২ ব্যক্তির জীবনচক্র
ক. জন্ম: কোনো ব্যতিক্রমী ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছাড়া মানবসন্তানের জন্ম সব সময়ই সুসংবাদ নিয়ে আসে। গারো সমাজও এর ব্যতিক্রম নয়। কোনো স্ত্রী সন্ত নিসম্ভবা হলে তার বিশেষ যত্ন নেওয়া হয় এবং তাকে বিভিন্ন বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়। প্রসূতি যাতে সুষ্ঠুভাবে সন্তান প্রসব করতে পারে, সেজন্য সাংসারেক গারো ৬ মাসের গর্ভাবস্থাতেই ‘নকচুঙ্গুয়া মিদ্দিকে’ আমুয়া বা পূজা করে। ৫৭ প্রসব বেদনা শুরু হলে আর যদি সন্তান ভূমিষ্ঠ হতে দেরি হয় তখন ‘দারিচিক’, ‘সালবামন আনথাম’, ‘সুসিমি আনথাম’ এই মিদ্দিদের আমুয়া (মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে উপাসনা ও উৎসর্গ) করতে হয়। অবশ্যই ‘দারিচিক’ মিদ্দিকে আমুয়া করতে হয়, তা না হলে পেটের বাচ্চাটিকে গর্ভে থাকা অবস্থাতেই দারিচিক নষ্ট করে দেয় বলে গারোদের বিশ্বাস।৫৮ সন্তান জন্ম নেয়ার সাতদিন বা চৌদ্দ দিন পর চার মিদ্দির আমুয়া করা হয়। সেই চার মিদ্দি হলো সালজং, বাগুয়া, রাকগুসী ও সুসাঙ্গি। এদের আমুয়া করার জন্য সাতটি মোরগের প্রয়োজন হয়। সন্তান যাতে সুষ্ঠু, সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে পারে সেজন্যই মিদ্দিদের আমুয়া করা হয়ে থাকে। এইদিন খামালকে এক মটকি মদ, এক সের চাল এবং দাইমাকে একটি কাপড়, এক মটকি মদ, একসের চাল সম্মানী হিসেবে দিতে হয়। এটিকে বলা হয় ‘চদিফেয়া’ বা ‘সুতিফেয়া’। এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা না পর্যন্ত প্রসূতি নিজ বাড়ির বাইরে গ্রাম, হাট-বাজার বা কাজের জন্য অন্য কোথাও যেতে পারে না ৫৯ উল্লেখ্য যে, সাংসারেক গারোদের জন্ম সম্পর্কিত এসব সামাজিক প্রচলনগুলো বাংলাদেশের গারোরা আর পালন করে না বললেই চলে। তারা এখন স্থানীয় ধাত্রী, ডাক্তারদের পরামর্শ ও চিকিৎসা অনুসারে জন্ম ও জন্ম পরবর্তী ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।
খ. বিাহ ব্যবস্থা : সমাজে বর্তমানে খ্রিস্টিয়ান রীতিতে বিবাহ বহুল প্রচলিত হলেও পূর্বে গারোদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বিবাহ রীতি প্রচলিত ছিল। সেগুলো সংক্ষেপে এখানে আলোচনা করা হলো-
- দো.দক্কা বা দো.সিয়া: সাংসারেক গারোদের৩১ মধ্যে বহুল প্রচলিত ও সাধারণ (common) বিয়ে হচ্ছে দো.দক্কা বা দো.সিয়া। এটি গারোদের সামাজিক নিয়মকানুনের দ্বারা স্বীকৃত একটি বিয়ে। এরূপ বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার জন্য প্রয়োজন হয় একটি মোরগ ও একটি মুরগি। বর-কনেকে খামাল বা পুরোহিতের সামনে বসানো হয়। অতপর খামাল দুই হাত দিয়ে সেই দুটি মোরগ-মুরগির ডানায় ধরে উপরে উঠিয়ে ধরে এবং মন্ত্রোচ্চারণ করে। এ সময়ে খামাল বর-কনের সকলের সামনে তাদের সম্মতি জিজ্ঞেস করে। এরপর মোরগ-মুরগির সামনে কিছু খাবার রেখে দেয়া হয়। মোরগ-মুরগিটি যখন খেতে আরম্ভ করে তখনই খামাল দুটি প্রাণীর মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে। অতপর দুটি প্রাণীকে একটু দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। প্রাণী দুটো যদি ছটফট করতে করতে কাছাকাছি এসে প্রাণত্যাগ করে বুঝে নেয়া হয় যে, বিয়েতে দুজনের মিলন শুভ। তারপর গ্রামের সকলের জন্য ভূরিভোজের আয়োজন করা হয়। সকলেই আমোদ-ফুর্তি করে। ৪৭
- চা.সেংআ: কোনো মেয়ের যদি কোনো ছেলেকে পছন্দ হয় কিন্তু তার পক্ষে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার মতো কোনো ট্রা-পান্থি বা পুরুষ আত্মীয় (মামা, ভাই) না থাকে তবে তার পিতামাতা সেই মেয়েটিকে ছেলের বাড়িতে গিয়ে তার মা-বোনকে এবং ছেলেকে কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য পাঠিয়ে দেয়। তবে ছেলেটির মেয়েটিকে পছন্দ হবে কিনা বা বিয়ে করবে কিনা তার নিশ্চয়তা থাকে না। নিও- সারিগণের (ছেলের মা-বোনের) যদি মেয়েটিকে পছন্দ হয় বা তার কাজ ও ব্যবহার দেখে পছন্দ হয় তবে তারা মেয়েটিকে নকপান্থেতে ছেলেটির জন্যে খাবার নিয়ে যেতে বলে। নকপান্থেতে গিয়ে ছেলে ও মেয়েটিকে একই পাতে খেতে হয়। ছেলে যদি রাজি না হয় তবে তার মা-বোনেরা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। অনেক সময় চা.সেংআর জন্য ১ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করা হয়ে থাকে। ছেলে যদি রাজি থাকে তবে দ.সিয়ার মাধ্যমে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করা হয়। ৪৮
- নবম্ভ্রমনা সাল্লা : গারো সমাজের নিয়ম অনুযায়ী ‘নকনা’র স্বামীকে অবশ্যই হতে হবে তার বাবার আপন ভাগিনেয় অর্থাৎ আপন বোনের ছেলে। নকনার জন্য আপন ভাগিনেয়কে জামাই নিয়ে আসাকেই বলা হয় ‘নকমনা সাল্লা’। আপন ভাগিনেয়কে ‘নকগ্রম’ আনা গারো নিয়ম অনুসারে বাধ্যতামূলক এবং ‘আধিম’ (সামাজিক ও আত্মীয়তার বন্ধন)। কোনো কারণে যদি আপন ভাগিনেয়কে পাওয়া না যায় এবং বাবার মাহারী থেকে না হয়ে অন্য মাহারী থেকে আনা হয় তবে সেই ছেলের ড্রা-পান্থেদের সঙ্গে পরামর্শ করে ও আলোচনার মাধ্যমে ‘নকনার’ মা-বাবাকে দেখাশোনা করতে হবে, লালনপালন করতে হবে, নিজের ভাগিনেয়’র মতোই বিবেচনা করা হবে এগুলো বলে সেই ছেলেটিকে আনা হয়। এটিকে বলা হয় ‘দে বাআ’। এই ‘দে বাআ’র মধ্য দিয়ে সেই ছেলেটির আর অন্য মাহারীর থাকে না কিন্তু আপন ভাগিনেয় হিসেবে গৃহীত হয় যে নাকি সেই ঘরের এবং সম্পত্তির অধিকার সংরক্ষণের পূর্ণ অধিকার লাভ করে। ৪৯
- নাপপে থুয়া বা থুনাপা: যদি কোনো মেয়ের কোনো ছেলেকে পছন্দ হয় এবং নিজ থেকে তাকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে কিংবা অভিভাবক পছন্দ হবে কিনা এ নিয়ে দোটানায় থাকে তবে সেই মেয়ে রাতের অন্ধকারে ছেলের সঙ্গে ঘুমিয়ে রাত কাটায়। এটিকেই বলা হয় নাপপে থুয়া বা থুনাপা (একই কাঁথায় ঘুমানো)। এটিকে ‘নাপগ্রিকে থুয়া’ও বলা হয়। এমন অবস্থায়, ছেলের ড্রা ও মাহারীর পক্ষ থেকে যদি কোনো আপত্তি না থাকে তবে বিয়ে হয়ে যায়। যদি সম্মতি না থাকে তবে ছেলে-মেয়েকে আলাদা করে দেয়া হয়। এটিকে বলা হয় ‘সালসেকা’।৫০
- চামে জি.কা: প্রাচীন গারো সমাজে ছেলে-মেয়ের মধ্যে অবাধ মেলামেশা করা ও নিজ পছন্দের মাধ্যমে সঙ্গী নির্বাচন করার তেমন সুযোগ ছিল না বড় বড় সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠান যেমন ওয়ানগালা, গানা, মাংওনা, চুগান রিংআ এসব ছাড়া। এসব অনুষ্ঠানেই ছেলে-মেয়েদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ ঘটতো, তারা একসাথে নাচতো-গাইতো। কোনো ছেলের কোনো মেয়েকে পছন্দ হলে ছেলেটি মেয়েটির সম্পর্কে নানারকম প্রশস্তি গায়, তার মতামত জানতে চায়, তার নাচের-গানের প্রশংসা করে, প্রেম নিবেদন করে আর এ সময়ের মধ্যেই মেয়েটির অন্য কোনো পছন্দ আছে কিনা এগুলোর খোঁজ নেয়। এভাবে এক সাথে নেচে-গেয়ে, মদ পান করে সারা রাত কাটিয়ে দেয়। এক সময়ে ছেলেটি ঘুমিয়ে পড়লে মেয়েটি ছেলের খথুপ বা কাপড় নিয়ে গিয়ে নকমার কাছে দেয়। এ অবস্থায় ছেলেটি মেয়েটিকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। পরে দ.সিয়ার মাধ্যমে তাদের বিয়ে হয়। ৫১
- দকচাপা বা অন.চাপা: গারো সমাজে স্ত্রী বা স্বামী মারা গেলে মৃতের ড্রা ও মাহারীকে মৃতের স্ত্রী বা স্বামীর জন্য আরেকজন স্ত্রী বা স্বামী দিতে হয়। বিশেষ করে স্বামীর স্ত্রী মারা গেলে প্রদত্ত স্ত্রী’র বয়স যদি খুব বেশি হয় বা বৃদ্ধা হয়, সংসারের কাজ-কর্ম করতে অক্ষম থাকে তখন অন্য আরেকজন যুবতী মেয়েকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে দেয়া হতো। যুবতী দ্বিতীয় স্ত্রী দেয়াকেই বলা হয়ে দকচাপা বা অন, চাপা। ৫২
- জিকগিদে রা. আ: স্ত্রীর যদি সন্তানাদি না থাকে তবে ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীর কথা চিন্তা করে স্ত্রীর ড্রা-মাহারী সেই পুরুষের জন্য দ্বিতীয় স্ত্রী নেয়ার জন্য অনুমতি দেয়। কখনও কখনও স্বামীকে চুা-মাহারীগণ বাধ্য করে। এ ক্ষেত্রে প্রথমা স্ত্রীর অনুমতি নিতে হয়। তার অনুমতিক্রমে ট্রা-মাহারী কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় স্ত্রী নিতে পারে। যদি প্রথমা স্ত্রী নিমরাজি হয় তবে সেই পুরুষের দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ সম্ভব হয় না। এখানে উল্লেখ্য, দ্বিতীয় স্ত্রীকে অবশ্যই প্রথমা স্ত্রীর পরিবারের অথবা মাহারীর মধ্যে হতে হয়। অন্যথায় নয়। এভাবে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণকেই বলা হয় ‘জিকগিদি রা.আ’।৫৩
- সেকে খিম্মা: এটি মূলত পালিয়ে বিয়ে করা। ছেলে-মেয়ে উভয়ে যদি উভয়কে পছন্দ করে তবে অনেক সময় তারা পালিয়ে বিয়ে করে। উভয়ের ড্রা-মাহারী অভিভাবকগণ পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী করণীয় ঠিক করে। যদি ড্রা-মাহারী ও অভিভাবকগণের পক্ষ থেকে এই পালিয়ে বিয়েকে মেনে না নেয় তখন ছেলে-মেয়েকে সালসেকার মাধ্যমে উভয়কে পৃথক করা হয়।
- নকফান্থে গা.আ: অবিবাহিত যুবকরা বিয়ের আগ পর্যন্ত মা-বাবার সঙ্গে পরিবারের মধ্যে বাস করতে পারত না। তাদেরকে ‘নকফান্থেতে’ থাকতে হতো। নকফান্থেতে কোনো মেয়ের প্রবেশাধিকার ছিল না বিশেষ কোনো উৎসব, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া। কোনো মেয়ের কোনো ছেলেকে পছন্দ হলে সে নকফান্থেতে ছেলে খুঁজে যেত এবং নকফান্থেতে যেখানে ছেলেটি ঘুমাতো সেখানে উঠে চলে যায়। ছেলেটি যদি মেয়েটিকে পছন্দ হয় এবং তার প্রস্তাবে রাজি হয় তবে পরদিনই ছেলেটি মেয়ের বাড়িতে চলে যায় এবং একসাথে বসবাস করা শুরু করে। সমাজে তারা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পরিগণিত হয়। মেয়েটি যদি অভিভাবকদের অমতে ও অজ্ঞাতে এ কাজটি করে তবে ছেলেটিকে অভিভাবকরা প্রত্যাখ্যান করে ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারে জরিমানা ছাড়া। ৫৪
- চা.দিলা: ‘চা.দিলা’ বিয়েটি গারোদের দুয়াল বা মাৎচি দুয়াল, মাৎচি, চিসাক, আত্তং এবং গারা-গানচিং উপদলগুলোর মধ্যে দেখা যায়। কোনো মেয়ের যদি নকফাস্থেতে বসবাসরত কোনো ছেলেকে মনে ধরে তবে মেয়েটি তার পছন্দের ছেলের জন্য নিজের বোন অথবা অন্য কোনো মহিলা আত্মীয়কে দিয়ে নকফান্থেতে সেই ছেলের জন্য খাবার পাঠাতো এবং নিজে তাদের অনুসরণ করে লুকিয়ে থাকতো। যদি সেই ছেলেটি মেয়েটির পাঠানো খাবার খেতো তবে মেয়েট লুক্কায়িত স্থান থেকে বের হয়ে এসে ছেলেটির সঙ্গে একসাথে খেত। ছেলেটি খেতে অস্বীকার করলেও মেয়েটি হাল না ছেড়ে দিয়ে রাত্রী পর্যন্ত অপেক্ষা করত। রাত্রীতে ছেলেটি যেখানে ঘুমায় সেখানে গিয়ে তার সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ত। সেই রাত থেকে তারা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পরিগণিত হতো অন্য কোনো অনুষ্ঠান ছাড়াই। অপছন্দ হলে ছেলেটি গ্রাম ছেড়ে দূরে কিছুদিনের জন্য চলে যেত। ৫৫
- কোর্ট ম্যারেজ: অভিভাবকবৃন্দ অসম্মত হলে; অভিভাবকদের সম্মতি বা অনুমতি পাওয়া যাবে না এমন আশংকা থাকলে; নিজ নিজ গ্রাম থেকে অনেক দূরে একত্রে থেকে পরিচয় হলে; অভিভাবক সম্মত থাকলেও তাদের চাপের মধ্যে ফেলার অভিপ্রায় না থাকলে এভাবে বিভিন্ন কারণে বর্তমানে যুবক-যুবতীরা কোর্টে গিয়ে বিয়ে করে থাকে। এরূপ বিয়ে মূলত সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত নয়।
- খ্রিস্টীয় মতে বিবাহ: বর্তমানে গারোদের প্রায় ৯৯% খ্রিস্টান। তারা বিভিন্ন খ্রিস্ট সম্প্রদায়ে (denomination) বিভক্ত। যেমন-রোমান ক্যাথলিক, ব্যাপ্টিস্ট, চার্চ অফ বাংলাদেশ, সেভেন্থ-ডে-এডভেন্টিস্ট, প্রেসবিটারিয়ান ইত্যাদি। পরিবারগতভাবে স্বাভাবিক আয়োজনকৃত বিয়েতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মতাদর্শ অনুসারে ও বিধি অনুসারে ফাদার, পালক, পাদ্রী বা পুরোহিত বিয়ে অনুষ্ঠান পরিচালনা করে থাকে। বর্তমানে এরূপ বিয়েই বহুল প্রচলিত বিয়ে। বিয়েতে অনেক আমোদ-ফুর্তি, গান, নাচ ইত্যাদি বিনোদনমূলক আয়োজন থাকে। বিয়ে অনুষ্ঠানের পর আমন্ত্রিতদের আপ্যায়ন করা হয়ে থাকে। গারোদের মধ্যে বিয়ের আগের দিন অথবা দুই কি তিনদিন আগে মাত্র ‘বাগদান’ অনুষ্ঠান হয়ে থাকে বাঙালি সংস্কৃতি অনুযায়ী। এ যুগেও গারোদের মধ্যে থুনাপা, সেক্কে খাত্তা, চাপা এধরনের বিয়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে। তবে থুনাপা ও সেক্কি খাতা বিয়ে সমাজে স্বীকৃত নয়। যারা থুনাপা বা সেক্কে খাতা করে তাদেরকে আবার সংশোধনের মাধ্যমে খ্রিস্টিয়ান নিয়মানুসারে বিয়ে কার্য সম্পাদন করতে হয়। ‘চাপ্পা’ সামাজিকভাবেই স্থিরীকৃত হয়ে থাকে।
গারোদের মধ্যে একক বিবাহ প্রথাই প্রচলিত। বহু বিবাহ হয়ই না বলা চলে। তবু কদাচিত দুটি বিবাহ করতে দেখা যায়।
বিয়ে বিচ্ছেদ: গারোদের মধ্যে বিয়ে বিচ্ছেদ হয়ই না বলা চলে। তবু যে হয়ই না তাও বলা যায় না। গারো সমাজে বিয়ে বিচ্ছেদকে নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে তবু কয়েকটি কারণে বিয়ে বিচ্ছেদ হয়ে থাকে। এক, স্বামী-স্ত্রী পরস্পর সম্মত হয়ে যদি আলাদা থাকতে রাজি থাকে; দুই, স্বামী বা স্ত্রীর যে কোনো একজন বা উভয়ই দোষী বা ব্যভিচারে ধরা পড়লে; তিন, স্বামী বা স্ত্রীর কেউ যদি পরিবারের জন্য কাজ করতে না চায়। আবার কোনো কোনো সময় স্বামী বা স্ত্রী হঠাৎ করে একজন আরেকজনকে ছেড়ে চলে যায় কাউকে না বলে এবং অনেকদিন পরিবারের কোনো খোঁজ না নেয়। এ অবস্থাকে বিচ্ছেদ বলা যায় না। তবে অনেকদিন এভাবে থাকলে বিচ্ছেদের মতোই হয়ে যায়। স্বামী-স্ত্রী পরস্পর বিচ্ছেদ ঘটাতে সম্মত হলেও গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ কারণসমূহ অনুসন্ধান করে বলসেক্কি দেন.আ (Bolsekki den.a) অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিয়ে বিচ্ছেদের ব্যবস্থা করে। ৫৬
গ. মৃত্যু ও সৎকার অনুষ্ঠানাদি : সাংসারেক গারোরা মৃতের পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে আর খ্রিস্টান গারোরা বিশ্বাস করে আত্মার পুনরুত্থানে। গারোদের বিশ্বাস মানুষের দেহে আত্মা থাকে, মৃত্যুর পর নশ্বর দেহ ত্যাগ করে সেটি চলে যায় আত্মার আবাসস্থল মাং-মাংগ্রাম-এ (mangru-mangra)। মৃত্যুর পর আত্মার সুখ, শান্তি, ভালো ঘরে আত্মার পুনর্জন্ম এসবের জন্য গারোরা বিভিন্ন ধরনের আচার-অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। মৃত্যুকে ঘিরে কৃত সেসব অনুষ্ঠানকে বলা হয় ‘মীমাংখাম’ অর্থাৎ আত্মার সদ্গতির কর্ম। মীমাংখাম কয়েকটি পর্যায়ে বিভক্ত। সেগুলো হলো-মাংগিসি ফুজুয়া, মাংসওয়া, চিআংগাল, নাখালচিক্কা ও মীমাংওয়াত্তা।
গারোরা মৃতদেহকে বলে ‘মাংগিসি’। মাংগিসি মৃতদেহ, ফুজুয়া মানে শোয়ানো। মৃতদেহ শোয়ানোর প্রক্রিয়াকেই বলা হয় ‘মাংগিসি ফুজুয়া’। মৃত্যুর পরপরই মৃতদেহকে স্নান করানো হয়। মৃত পুরুষ হলে তার ‘মানক’ (মা, মায়ের বোন, বোন বা মাহারীর নিকট আত্মীয়) আর মহিলা হলেও তার নিকট আত্মীয় বিশেষ করে মাহারীর মহিলারা স্নান করায়। প্রথম অবস্থায় পানি দিয়ে এবং পরবর্তীতে রাং-এ (কাঁসার তৈরি থালার মতো দেখতে একটি বাদ্যযন্ত্র ও মূল্যবান সাংস্কৃতিক সম্পদ) পরিমাণ মতো তেল নিয়ে মৃতের বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করে কান্নার গীত গেয়ে তেল মাখিয়ে দেয়া হয়। জল ও তৈল স্নান শেষ হওয়ার পর মৃতদেহকে কাপড় পরিয়ে দেয়া হয়। পুরুষ হলে মাথায় ‘খফিং’ বা পাগড়ি বেঁধে দেয়া হয়। অতপর মাংগিসির মাথা পূর্ব দিকে অথবা উত্তর দিকে রেখে শুইয়ে দেয়া হয়। তারপর যতক্ষণ পর্যন্ত না দাহ কার্য শেষ হবে ততক্ষণ আত্মীয়স্বজনের আনা কাপড় মৃতদেহের উপর সাজিয়ে দেয়া হয়। মৃত্যুর খবর শুনে যতজন আসে একেবারে নিকট আত্মীয়সহ সবাই একটি করে কাপড় নিয়ে আসে মৃতকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্য।
বর্তমানে গারোরা মৃতদেহ কবর দিলেও পূর্বে সাংসারেক গারোরা মৃতদেহ পোড়াত। সকল আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের আসা শেষ হলে মাংসওয়া বা মৃতদেহ পোড়ানোর আয়োজন করা হয়। যে স্থানে মৃতদেহ পোড়ানো হয়, সেই স্থানকে বলা হয় ‘মাংরুদাম’ বা শ্মশান। মাংরুদামে নির্দিষ্ট করা স্থানে মৃত দেহের মাপে প্রস্থ ১ ফুট ও দৈর্ঘ্য ৫ ফুট পরিমাপের ২ ফুটের মতো গভীর একটি গর্ত করা হয়। সেই গর্তের উপর মৃতদেহ পোড়ানোর জন্য একটি মাচা তৈরি করা হয়। এই মাচাটিকে বলা হয় ‘গানচি’। মৃত পুরুষ হলে তার মামা, বাবা, ভাই, কাকা সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন আর মহিলা হলে চা-পান্থেগণ (মামা, ভাই) মৃতদেহ ‘মাংরুদাম’-এ বয়ে নিয়ে যায়। মৃতদেহ পোড়ানোর জন্য দুইজন লোককে ঠিক করা হয়। এদেরকে বলা হয় ‘মাংসোয়া’। প্রথমে ‘ট্রা’ পক্ষকেই মৃতদেহ পোড়ানোর শুরু করতে হয়। মৃতের ছেলে সন্তান থাকলে সেই ছেলে সন্তানটিকেই প্রথমে আগুন দিতে হয়। ‘গানচির’ চারিদিকে আড়াইবার ঘুরে ঘুরে মৃতদেহের মাথার দিকে আগুন দেয়া হয়। মৃতদেহ পোড়ানোর কাজ শেষ হলে ‘মাংসোয়া’রা স্নান করে নিজেদের শুচি করে নেয়। তারপর একটি নতুন হাঁড়িতে কিছু চাল ও একটি ডিম রেখে জ্বাল দিয়ে রান্না ও সেদ্ধ করা হয়। মৃতের উদ্দেশ্যে রান্না করা এই ভাতকে বলা হয় ‘মিখিংখাং’। ‘মিখিংখাং’ রান্না হয়ে গেলে ‘মাংগিসি’ পোড়ানোর ছাই এক মুঠো নিয়ে এসে ভিটেমাটির নির্দিষ্ট করা স্থানে এনে পুঁতে রাখা হয় এবং সে স্থানে চার কোণাকৃতির বেদির মতো ছোট একটি স্থান তৈরি করা হয়। এটিকে বলা হয় ‘খাথিক’ বা ‘খরম’। মৃতের আত্মার উদ্দেশ্যে রান্না করা ‘মিখিংখাং’ ও সেদ্ধ ডিম এনে এখানে মৃতের জন্য ‘ছিন্না’ বা উৎসর্গ করা হয়। মৃতের আত্মা তাৎক্ষণিকভাবে ‘চিৎমাং’-এ (মৃত আত্মাদের থাকার স্থান) চলে যায় না। চূড়ান্তভাবে ‘মীমাংখাম’ বা ‘মিমাংওয়াৎতা’ অর্থাৎ মৃতের আত্মাকে ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত এটিই মৃতের আত্মার ঘরবাড়ি বলে মনে করা হয়।
মৃতদেহ পোড়ানোর পরদিনকে বলা হয় ‘চিআংগাল’ অর্থাৎ পানি দিয়ে মৃতদেহ পোড়ানোর কাঠকয়লা নেভানো। মৃতদেহ পোড়ানোর সময় গানচির নিচে যে গর্ত করা হয়েছিল সেখানে অংগারগুলি পড়ে থাকে এমনকি পরদিন পর্যন্ত সেখানে আগুন থাকে। গ্রামবাসী সকলে এসে পরদিন পানি ছিটিয়ে আগুন নিভিয়ে দেয় এবং মাটি চাপা দিয়ে দেয়। এটিকেই বলা হয় ‘চিআংগাল’। এইদিন গ্রামের কেউ কোনো কাজ করে না, মৃতের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানায় এবং অন্য কোথাও কাজ করার জন্য যায় না।
মৃত্যুর দিন থেকে সাত বেলা অর্থাৎ তিনদিন অর্ধ বেলা মৃতের বাড়ির সকলে কোনো মাছ বা মাংস খেতে পারে না। তাদেরকে নিরামিষ খেতে হয়। এটিকে বলা হয় ‘নাখালনিম্মা’। চতুর্থ দিনে ‘নাসিনথাক’ (কানপোনা মাছ) ও ‘গংথিক’ (চিংড়ি মাছ) আস্ত আস্ত করে কোনো কিছু না ফেলে তেল ছাড়া রান্না করা হয়। পরে তা ‘খাথিক’-এ মৃতের উদ্দেশ্যে ‘ছিননা’ বা উৎসর্গ করে সবাই অল্প অল্প করে খেয়ে নিরামিষ পর্ব শেষ করে মাছ খাওয়া আরম্ভ করে। এটিকে বলা হয় ‘নাগাতা’ বা না গাদ্দা’ অর্থাৎ মাছ পাতে তোলা।৬০
মাগাতা’র পরদিনই হয় ‘নাখালচিক্কা’ বা ‘নাখালফিয়া’। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নাগাদা’ ও ‘নাখালচিক্কা’ একই দিনে করা হয়। নাখালচিক্কার দিনই ‘খরম খাথিক’-এর উপর একটি ছোট ঘর তৈরি করা হয়। এটিকে বলা হয় ‘দেলাং’। ঘর তৈরির পর সেই ঘরের চারকোণায় দশহাতি কাপড় দিয়ে তৈরি চারটি নিশান উড়িয়ে দেয়া হয়। এই নিশানগুলোকে বলা হয় ‘ফরফরা’ ‘দিংগারা’। বড় দশ হাতি কাপড় দিয়ে বানানো নিশানকে বলা হয় ‘ফরফরা’; আর ধুতি থেকে ছোট করে তিন কোণাকৃতির কাপড় কেটে তার চারিপাশে লাল কাপড় দিয়ে সেলাই করা বানানো নিশানকে বলা হয় ‘দিংগারা’। এগুলো টানিয়ে দেয়ার পরই সেই ছোট ঘরটি ‘দেলাং’ নামে পরিচিত হয়। ৬১
একটি গেলেক (ছোট খাঁচা), আমখেলতাক (ছোট পাটি বিশেষ), একটি খদো (পরিমাপক), দুকখুলি (পানি রাখার পাত্র) ভিতরে রেখে দেয়া হয় এবং মৃত জীবিতাবস্থায় যা যা খেত, পান করত প্রতিদিন খাওয়ার সময় সেসব দ্রব্য ‘ছিননা’ বা উৎসর্গ করে যাওয়া হয় ‘দেলাংফ্রাকা’ বা ‘দেলাং’ পোড়ানোর দিন পর্যন্ত।
সাধারণত এক বছর পর ‘দেলাংফ্রাকা’ বা ‘মীমাংওয়াত্তা’র অনুষ্ঠান করা হয়। এটিই ‘মীমাংখাম’ বা মৃতের আত্মার উদ্দেশ্যে কৃত আচারানুষ্ঠানের শেষ পর্যায়। প্রথমে মৃতের প্রতীকী হিসেবে ‘মাংসি’ বা ‘মীমাং’ তৈরি করা হয়। এই মাংসি রাং, কাপড় ও অলংকারাদি দিয়ে তৈরি করা হয়ে থাকে। মৃত ব্যক্তি পুরুষ হলে দশহাতি ধুতি ২টি এবং মহিলা হলে দশহাতি ২টি শাড়ির দরকার পড়ে। ‘নাখালচিক্কার’ দিন থেকে ‘মীমাংখাম’ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এটি দেলাং-এর ভেতরেই থাকে। যেদিন মীমাংখামের শেষ করা হয় সেদিন হয় ‘মীমাংওয়াত্তা’ বা ‘দেলাংফ্রাকা’ বা ‘দেলাংসওয়া’ অনুষ্ঠান। এর আগের দিন হয় ‘হাখারা’। এইদিন ‘মীমাং’ বা ‘মাংসি’ নিয়ে গ্রামের ঘরে ঘরে যাওয়া হয় এবং প্রত্যেকেই সেই ‘মাংসি’র জন্য শেষবারের মতো ছিননা (নিজেদের খাদ্যের ও মদের কিছু অংশ উৎসর্গ করা) করে। সারারাত ধরে গ্রাম ঘোরে ‘মীমাং’। ব্রাকগণ এটিকে বলে ‘মেলখালা’। ‘মীমাংকে ঘরে এনে শেষবারের মতো ছিননা করা হয়। ছিননার পর পরই দেলাং পুড়িয়ে দেয়া হয়। এটিই ‘দেলাং ফ্রাকা’। তারপর গ্রামের সবাইকে ভোজে আপ্যায়ন করা হয়। অতপর খামাল ও তার একজন সহযোগী ‘খাবি’ (মৃতের আত্মাকে বিদায় জানানোর গীত) গেয়ে মৃতের আত্মাকে ‘চিকমাং’-এ পৌছে দিয়ে আসে। ‘খাবি রিংআ’ শেষ হলেই ‘মীমাংওয়াত্তা’র কাজ শেষ হয়।
বর্তমানে গারোদের অধিকাংশই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। তারা মৃতদেহকে কবর দিয়ে থাকে। তারা পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার ত্রিত্ব গুণে সমন্বিত এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করে। তারা যীশু খ্রিস্টের অনুসারী হিসেবে মৃতের আত্মার পুনরুত্থানে বিশ্বাস করে এবং খ্রিস্টের দ্বিতীয় আগমন বিশ্বাস করে। অর্থাৎ যীশু মরেছেন, মৃত্যুকে জয় করে আবার পুনরুত্থিত হয়েছেন এবং আবার তিনি পৃথিবীতে আগমন করবেন-এই সত্যে বিশ্বাস করে। তাই মৃতের আত্মা পুনরুত্থানের পর যেন খ্রিস্টের সঙ্গে থাকতে পারে, স্বর্গবাসী হয়, সেজন্য যীশুর কাছে প্রার্থনা উৎসর্গ করে মৃতকে কবর দেয়। অনেকেই মৃত্যুর এক বছর পর মৃত্যুবার্ষিকীতে আবার প্রার্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। মৃতের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করে। আবার বছরের বিশেষ দিনে কবরে গিয়ে প্রার্থনা করে।
৩.৩ ঐতিহ্যগত সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও বিচারিক ব্যবস্থা গারোদের সমাজ
পরিচালনার ক্ষেত্রে গারো সমাজের আখিং নকমা (আখিং প্রধান), সংনি নকমা (গ্রাম প্রধান), চা-পান্থে (মেয়ে পক্ষের পুরুষ আত্মীয়) ও গ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সাধারণ বিষয়গুলো নিয়ে মীমাংসা করে থাকেন। পরিবারে স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া, গ্রামে এক মাহারীর সঙ্গে আরেক মাহারীর ঝগড়া, সম্পত্তির বাটোয়ারা, ছিঁচকে চুরি, সিকখাল-গিন্নাল ফতা, বিয়ে নিয়ে সমস্যা, এসব বিষয় গ্রামের সবাইকে নিয়ে ‘সংনি নকমা’ মীমাংসা করে দিতেন।
তবে বর্তমানে গ্রামগুলোতে সংনি-নকমা বা গ্রাম প্রধান আর নেই। গ্রামের ছোটখাটো সামাজিক ও পারিবারিক বিষয়াদি গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গই মীমাংসা করে থাকেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরোহিত, ড্রা-পান্থে (পুরুষ আত্মীয়বর্গ) পারিবারিক সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা ও উত্থিত সমস্যা মোকাবেলায় ভূমিকা পালন করেন। আপত্তিকৃত বিষয়টির গুরুত্ব অনুসারে আদালতে যাওয়ার পূর্বেই নিজেদের মধ্যেই বিষয়টির মীমাংসা করার চেষ্টা করা হয়। এ পর্যায়ে নিজ গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দদের নিয়ে আলোচনা করে মীমাংসার ব্যবস্থা করা হয়। সাম্প্রতিককালে সময়ের প্রেক্ষাপটে এবং অস্তিত্বের প্রয়োজনে গারোরাও আধুনিক আইন-আদালতের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হচ্ছে। যেমন তাদের বিরুদ্ধে কৃত অন্যায়ের প্রতিবাদে, বন বিভাগের মিথ্যা মামলা রুজুর বিরুদ্ধে, গারো-বাঙালিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও জমি সংক্রান্ত বিরোধে, নিজেদের মধ্যে বিরোধে এভাবে জটিল সমস্যার উদ্ভব হলে বাংলাদেশ সরকারের আইন- আদালতের সাহায্য নেয়া ছাড়া উপায়ও থাকে না বিচার-সালিস প্রক্রিয়া: গারোদের লিখিত আইন না থাকলেও অলিখিত নৈতিক আইন ও প্রথা-পদ্ধতিগুলো লিখিত আইনের চেয়েও শক্তিশালী এবং কার্যকরী। সমাজে সংগঠিত অভিযোগ বা অপরাধ বিচারের জন্য এক সময় সমাজে প্রচলিত কয়েকটি বিচারিক ব্যবস্থার উদাহরণ দেওয়া হলো-
- ক. চি রিপ্পা (Chi Rippa): ‘চি’ মানে পানি বা জল, ‘রিপা’ মানে ডুব দেওয়া। অভিযুক্ত ও অভিযোগকারী উভয়ের মধ্যে যে বেশিক্ষণ ডুব দিয়ে থাকতে পারতো সেই পক্ষই নির্দোষ বলে প্রমাণিত হতো। গারোদের বিশ্বাস যে, যে ব্যক্তি দোষী সে অথবা তার প্রতিনিধি বেশিক্ষণ পানিতে থাকতে পারে না। কারণ জলজ প্রাণী, কীট-পতঙ্গ, পোক-মাকড়গুলো তাকে পানিতে ঠাঁই না দেয়া এবং আক্রমণ করার কারণে সে বেশিক্ষণ পানিতে থাকতে পারে না। এভাবে ‘চি রিপ্পা’ পদ্ধতিতে দোষী-নির্দোষ সাব্যস্ত করে বিচার করা হতো।
- খ. ওয়াল সোওয়া (Wal So.a): ‘ওয়াল’ মানে আগুন এবং ‘সোওয়া’ জ্বালানো বা পোড়ানো। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত ও অভিযোগকারী উভয়ের জন্যই বাজার থেকে একদামে মাটির একটি পাত্র কেনা হতো। তারপর তিন হাত লম্বা তিনটি গাছের ডাল চুলার মতো আকৃতিতে মাটিতে পুঁতে অর্থাৎ যাতে একটি হাঁড়ি বসানো যায় এই অবস্থানে সেগুলোকে রাখা হতো এবং তার উপর নতুন মাটির হাঁড়িটি পানি ভর্তি করে সেখানে একটি ডিম রেখে দেয়া হতো। তারপর তার নিচে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়ালে যতখানি লম্বা হতে পারে ততখানি লম্বা তিনটি জ্বালানি কাঠ মন্ত্র পড়ে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হতো। যে পরিমাণ জ্বালানি কাঠ জ্বালিয়ে দেয়া হলো এর বেশি লাকড়ি বা জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করা যেতো না। সেই কাঠ দিয়েই যদি পানি ফুটে উঠত এবং ডিম পেকে যেতো তবে ধরে নেয়া হতো যে অভিযুক্ত ব্যক্তি সত্যিকারেই দোষী; অন্যথা নির্দোষ মনে করা হতো।
- গ. আ.খ্রম (A.krom): যে স্থানে বাঘের আক্রমণে মানুষ মারা যেতো সেই স্থানকে বলা হতো ‘আ.হ্রম’। এই বিচারের প্রক্রিয়ায় অভিযুক্তের নামে সেই আশ্রমে রাত্রে একটি মোরগ বা ছাগল সারা রাত্রের জন্য বেঁধে রেখে আসা হতো। খুব প্রত্যুষে গিয়ে যদি সেই মোরগ বা ছাগলটিকে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যেত তবে ধরে নেয়া হতো যে, অভিযুক্ত ব্যক্তিটি নির্দোষ। আর যদি মোরগ বা ছাগলটি আক্রান্ত হতো তবে ধরে নেয়া হতো যে, অভিযুক্ত ব্যক্তিটি সত্যিকারেই দোষী
- ঘ. খুমিচেতা (Ku.micheta) (শপথ করা): এই বিচারিক প্রক্রিয়ায় অভিযুক্ত ব্যক্তি গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সামনে এই বলে দিব্যি করতো যে, ‘যদি আমি কোনো অন্যায় করে থাকি তবে যেন বাঘ বা হাতির আক্রমণে আমার মরণ হয়।’
অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী সাতদিন, পনেরদিন কিংবা এক বছর সময় নির্ধারণ কর। হতো; আর এই সময়ের মধ্যে যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি বাঘ বা হাতি দ্বারা আক্রান্ত হতো তবে ধরে নেয়া হতো যে, সেই ব্যক্তিটি সত্যিকার অর্থেই দোষী। অন্যথায় সেই ব্যক্তিটি নির্দোষ হিসেবেই গণিত হতো।
৪. ধর্মীয় অবস্থা
৪.১ ধর্ম ও ধর্মীয় আচার
গারোদের আদি ধর্মের নাম ছিল ‘সাংসারেক’ বা ‘সংসারেক’। তাদের অনেক দেব-দেবী ছিল। তাতারা-রাবুগা তাদের প্রধান দেবতা। ৬৯ তার ৮টি নাম আছে। যেমন-স্তুরা পাস্তুরা, জিপজিনি জিপজানা, খুরাদক-খুরাফিন, চানদাসি- গংগংরিগিপা, আজানজান বুলজানজান, সেফিরা-বলিরা, জামনকগিপা-জাংগিনি বিয়ামবি, বুলগিপা-ইমবাংগিপা। গারোরা দেবদেবীদের ‘মিদ্দে’ বলে থাকে মিদ্দেদের ক্রোধ থেকে বাঁচার জন্য এবং তুষ্ট রাখার জন্য এদের পূজা বা আমুয়া করতে হয়। ৭০
সাংসারেক গারোরা প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তুকে শক্তি আরোপ করে পূজা করে, যেমন বজ্রপাত, বিদ্যুৎ, বৃষ্টি, বাতাস, ভূমিকম্প, গ্রহণ (eclipse) এগুলো আসলে ‘মিন্দে’ নয় কিন্তু এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে একেকজন মিদ্দে। প্রয়োজনের সময় সেসব মিদ্দেদের পূজার্চনা ও বলি উৎসর্গ করা হয়ে থাকে। তাদের সবচেয়ে বড় দেবতা (supreme god) তাতারা রাবুগা স্তরা-পান্তরার নির্দেশে নস্ত্র-নপাত্ত ও মাচি পৃথিবী সৃষ্টি করেন। ৭১ বিভিন্ন মিদ্দে বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত। চোরাবুদি শস্য রক্ষা করেন, সালজং উর্বরতার দেবতা; গয়রা বজ্রপাত, বিদ্যুৎ ও শক্তির দেবতা। কালকামে গয়রার ভাই মানুষ ও প্রাণের রক্ষক; সুসিমে ধনদেবী-খোঁড়া, মুলা, অন্ধত্ব তার কারণেই হয়ে থাকে; আসিমা-দিংসিমা সুসিমের মা, তার নাম উচ্চারণ করা অপয়ার লক্ষণ; নাওয়াং জীবন হরণকারী দেবতা ৭২
বর্তমানে প্রচলিত ধর্ম: বর্তমানে গারোদের প্রায় ৯৯ ভাগই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। এরা বিভিন্ন খ্রিস্টীয় সম্প্রদায়ে বিভক্ত। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য খ্রিস্টীয় সম্প্রদায়গুলো (denomination) হলো রোমান ক্যাথলিক, ব্যাপ্টিস্ট, সেভেন্থ-ডে- এডভেন্টিস্ট, চার্চ অফ বাংলাদেশ, ফেলোশিপ চার্চ, প্রেসবিটারিয়ান ইত্যাদি গারো অঞ্চলে প্রথমে খ্রিস্টের বাণী নিয়ে এসেছিলেন ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিরা। তারা গারো অঞ্চলে কাজ করা শুরু করেন ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে রোমান ক্যাথলিক মিশনারিরা তাদের মিশন স্থাপনসহ কাজ আরম্ভ করেন ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে। এডভেন্টিস্ট মিশনারিরা আসেন অনেক পরে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে। এ্যাংলিকান চার্চ কাজ শুরু করেন ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে। ৭৪ এভাবে বিভিন্ন মিশনারিদের আগমন ও খ্রিস্টের বাণী প্রচারের মাধ্যমে গারোরা খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং ব্যাপকভাবে খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়।
গারোদের মধ্যে এখন খ্রিস্ট ধর্মের প্রভাব খুবই প্রবল। খ্রিস্ট ধর্মের প্রভাবে তাদের সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সেই সঙ্গে আচরণগত ও পরিবেশগত ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। গারোদের জীবনে লেখাপড়া শিক্ষা, চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তি, উন্নয়ন এসবই খ্রিস্ট ধর্মের অবদান বলে গারোরা মনে করে। অন্যদিকে গারো সমাজে ব্যাপক সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের জন্যও ধর্মান্তরকে দায়ী করা হয়।
গারো খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব বড়দিন। প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বর তারিখে পালিত হয়ে থাকে। বড়দিন ছাড়াও খ্রিস্টানদের উৎসবের মধ্যে রয়েছে গুড ফ্রাইডে, ইস্টার সানডে, নিউ ইয়ার। এসব উৎসবে খ্রিস্টানগণ প্রভু যিশু খ্রিস্টের উদ্দেশ্যে গান, প্রার্থনা, ধন্যবাদ উৎসর্গ করে এবং সারারাত ধরে সংকীর্তন করা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করত এবং সর্বশেষে একটি বাড়িতে মহাভোজের আয়োজন করে উদযাপিত হয়ে থাকে।
৫. ভাষা ও বর্ণমালা
বাংলাদেশের গারোদের ভাষা তাদের নিকট ‘মান্দি খুসিক’, আর ভারতের মেঘালয়ের গারোদের ভাষা তাদের নিকট ‘আ.চিক’ বা ‘আ.চিক খুসিক’ নামে পরিচিত। তাদের নিজস্ব বর্ণমালা নেই। তবে ব্রিটিশদের আসার পর থেকেই মেঘালয়ের গারোরা রোমান অক্ষরকে পড়ালেখার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে আসছে প্রায় শত বছর ধরে। রোমান অক্ষর দিয়ে লেখাপড়া করার জন্য তাদের নিয়মিত পাঠ্যক্রম রয়েছে।
গারো ভাষা ‘টিবেটো-বার্মান’ ভাষাগোষ্ঠীর ‘বোডো’ উপবিভাগের অন্তর্গত। বোডো গ্রুপের ভাষাগুলোর অধিকাংশই আসামের ব্রহ্মপুত্র নদের উপত্যকাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন পার্বত্যাঞ্চলে বিস্তৃত হয়ে পড়ে। বোডো ভাষাভাষীদের অনেকেই বর্তমানে আসামি ও বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে মিশে আছে। বিগত শতাব্দীতে কিংবা সম্ভবত তার আগে থেকেই ‘বোডো’ বা ‘টিবেটো-বার্মান’ ভাষাভাষীদের মধ্যে আসামী এবং বাঙালিদের ভাষার (ইন্দো-এরিয়ান) দিকে ঝোঁক ছিল। বর্তমানে বেশ কিছু সংখ্যক বোডো ভাষাভাষী লোক তাদের পূর্ব-পুরুষদের ভাষার ব্যবহার বন্ধ করে দিয়ে আসামি বা বাংলা ব্যবহার করছে। ৭৬ রবিনস বার্লিং-এর কথার প্রমাণ পাওয়া যায় গারোদের ভাষার মধ্যে। এখন মান্দি ভাষাতে অনেক বাংলা শব্দের ব্যবহার, এমনকি বাক্যগুলোর গঠন প্রক্রিয়াতেও বাংলার ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বাংলার প্রভাব বেশি পড়ছে। গারো ভাষার বেশ কয়েকটি উপ-ভাষা (dialect) আছে। সেগুলো হলো-আউই, আবেং, মেগাম, আজ, দুয়াল, ব্রাক, চিবক, বাবিল। এর মধ্যে মেঘালয়ের গারোদের মধ্যে ‘আউই’ সাধারণ লেখ্য ও কথ্য ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয় আর বাংলাদেশে ‘আবেং’ সাধারণ (common) কথ্য ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। উপ-ভাষাগুলোর প্রত্যেকটির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বিদ্যমান। একমাত্র ‘মেগাম’ ছাড়া এই উপভাষাগুলোর সবকটিই টিবেটো-বার্মান ভাষাগোষ্ঠীর ‘বোডো’ উপ-দলের অন্ত র্ভুক্ত। অন্যদিকে, মেগাম ‘মন খেমের’ ভাষা-দলের সাথে যুক্ত।
ভারতের মেঘালয়ে রোমান অক্ষর দিয়ে গারো ভাষার মাধ্যমে লেখা-পড়ার পাঠ্যক্রমসহ সরকারিভাবে শিক্ষা দেয়ার বিদ্যালয় আছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের সুযোগ নেই বললেই চলে। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত বিরিশিরিতে বালক ও বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে গারো ভাষায় একটি বিষয়ে শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা ছিল বলে জানা যায়। তারপর বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তি পর্যায়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বিচ্ছিন্নভাবে গারো ভাষা শিক্ষা দানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা গেলেও সেগুলো স্থায়িত্ব পায়নি। ময়মনসিংহে অবস্থানরত তেইজে ব্রাদার্সগণের (ফ্রান্সের তেইজে থেকে আগত ব্রাদার সম্প্রদায়) মধ্যে ব্রাদার গিউমের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও গারোদের ব্যাপকভাবে বাংলা ভাষার ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ করে তিনি ৯০-এর দশক থেকে গারো অধ্যুষিত বিভিন্ন গ্রামে সীমিত পরিসরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য নিজ মাতৃভাষায় গারো ভাষা শিক্ষাদানের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এখন পর্যন্ত তা অব্যাহত আছে। আনুমানিক ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত গারো ব্যাপ্টিস্ট খ্রিস্টানদের মধ্যে গারো ভাষায় গান, প্রার্থনা ও গির্জা পরিচালনার প্রবণতা ছিল কয়েকটি গারো ভাষার শব্দ নিম্নে দেয়া গেল-
- ক্রিয়াবাচক শব্দ: চা. আ = খাওয়া; রিংআ = পান করা; রি.ংআ = গান করা; খাৎতা = দৌড়ানো; খাল্লা = খেলা করা; সেয়া = লেখা; আৎচংআ = বসা; থুয়া = ঘুমানো।
- অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ : জাক = হাত; জাথেং = পা; মিখাং = মুখ; স্খো = মাথা; খিন্নি = চুল; গিং = নাক; মিকরোন = চোখ; নাচিল = কান।
- সংখ্যা গণনা: সা = এক; গ্নি = দুই; গিৎথাম = তিন; ব্রি = চার; বংআ = পাঁচ; দক = ছয়, স্নি = সাত; চেত = আট, স্খু = নয়; চিখিং = দশ।
- কয়েকটি পাখির নাম: দো.অ = পাখি; দোনক = মুরগি; দোগেপ (গাগাক) = হাঁস, দমাস্খি = দোয়েল; পাইপরত = বুলবুলি, ফারোয়া = কবুতর; দখ্রু = ঘুঘু: সারু = শালিক।
- কয়েকটি ফলের নাম: থেগাচু = আম; থিব্রং = কাঁঠাল; নারাং = কমলা; থিসেংখি = বড়ই; থেরিক = কলা; লেচু = লিচু, দ্রাক্খা= আঙ্গুর, চিনারা = লেবু; থিমিত = শশা; থিরাজা = তরমুজ।
- কয়েকটি পশুর নাম: মাচ্চু = গরু; দোবক = ছাগল; মেরি দোবক = ভেড়া; গুরে = ঘোড়া, ওয়াক = শূকর; মাৎমা = মহিষ; মংমা = হাতি; মাৎছা = বাঘ; আচাক = কুকুর; মেংগং = বিড়াল।
৬. শিক্ষা
সুদূর অতীতকাল থেকেই গারোদের নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা ও সংস্কৃতি ছিল। তাদের শিক্ষা ছিল মৌখিক এবং অনুশীলনের মাধ্যমে তা ব্যবহারিক রূপ পেত। গারো সমাজে অবিবাহিত যুবকদের থাকার ঘর ‘নকফান্থে’ শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নকফান্থের দুটো অংশ থাকতো। প্রথম অংশে যুবকগণ ঘুমাতো, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরস্পরের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করত, তাদের পূর্ব-পুরুষদের বীরত্বের কাহিনী যা তারা বয়স্কদের কাছ থেকে শুনে এসেছে, বীরত্বগাথার উপর রচিত গান ও অন্যান্য গানগুলো ঘুমানোর আগে গাইত। দ্বিতীয় অংশ খোলা বারান্দা শিক্ষালয়ের মতো ব্যবহৃত হতো।
গারোদের পুঁথিগত শিক্ষা ও জ্ঞানার্জন এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আরম্ভ হয় মূলত ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকে। রংপুরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিটিশ কমিশনার ও ম্যাজিস্ট্রেট ডেভিড স্কট-ই প্রথম গারোদের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি ফ্রন্টিয়ার পুলিশের কাজে এবং কোর্ট ও সরকারি অফিসসমূহে বাংলা ভাষার কথা গারো ভাষাতে এবং গারো ভাষার কথা বাংলা ভাষাতে অনুবাদের জন্য গারোদের শিক্ষা দানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। ১৮২২ সালে তিনি প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনজন গারো যুবককে শ্রীরামপুরে পাঠিয়ে নিজ খরচে শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। তাঁরই উদ্যোগে ১৮৮১ সালে বাংলাদেশের বিরিশিরিতে স্কুল স্থাপিত হয়েছিল। পরে মিশনারিদের সহায়তায় এবং নিজেদের উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। ৮৫ এই সময়ের মধ্যে গারোরা আস্তে আস্তে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে এবং ব্যাপকভাবে মিশনারিদের। প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ পায়।
বাংলাদেশে গারো শিক্ষার হার সরকারি তথ্যে কোনো কিছু জানা যায় না। তবে বিভিন্ন বেসরকারি জরিপে জানা যায় যে, গারোদের বর্তমান স্বাক্ষরতার হার প্রায় ৯০%। সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে গারোদের শিক্ষার হার দেখে বেশি মনে হলেও উচ্চ। শিক্ষার হার খুবই কম। বর্তমানে প্রতি বছর কিছু কিছু গারো ছাত্র-ছাত্রী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেখাপড়া করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এই হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু আর্থিক দুরবস্থা, অসচেতনতা, সঠিক গাইডের অভাব, কাছাকাছি অবস্থানে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবে গারো ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এসএসসি পর্যায়ে এসে ঝরে পড়ার প্রবণতা অনেক। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী ইন্ডিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি দেশে লেখাপড়া করছে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সাথে সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে গারোদের পেশা, জীবিকা ও নেতৃত্বের ধারাও।
৭. সামাজিক উৎসব
গারোদের সামাজিক উৎসবগুলো সাধারণত তাদের জীবিকা ও কৃষিকেন্দ্রিক। গারোদের জুম চাষাবাদ শুরুর সময় থেকে শেষ পর্যন্ত মোট সাতটি প্রধান আচারানুষ্ঠান পালনের কাজ সম্পাদন করতে হতো। সেগুলো হলো-আ.আ ওফাতা, দে. নবিলসিয়া, আ.গালমাকা, মি আমুয়া, রংচু গাল্লা, জামেগাপ্পা এবং ওয়ানগালা। বর্তমানে গারোরা জুম চাষাবাদের উপর নির্ভরশীল নয়। এখানে এখন আর জঙ্গল পরিষ্কার করার, গাছ কাটার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি ও সামাজিক হিসেবে শুধু ‘ওয়ানগালা’ ও ‘রংচুগালা’ এ দুটো অনুষ্ঠানই বাংলাদেশের গারোদের এখনও করতে দেখা যায়।
ওয়ানগালা: ‘ওয়ানগালা’ গারোদের প্রধান সামাজিক ও কৃষি উৎসব। গারোদের বিশ্বাস ফসল লাগালেই আপনা আপনি ফলন ভালো হয় না। লাগানোর পরপরই সেগুলো বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, নষ্ট হয়ে যেতে পারে কিংবা ফসলের ফলন তেমন আশানুরূপ নাও হতে পারে। দেব-দেবীর আশীর্বাদ ও ফসলের প্রতি তাঁদের সুদৃষ্টি না থাকলে আশানুরূপ ফসল পাওয়া যায় না এবং মানুষের শারীরিক অবস্থাও সব সময় ভালো থাকে না। তাই ওয়ানগালা শুধু পানাহার, আনন্দ-উৎসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধতা নয়, বরং দেব-দেবীদের সুদৃষ্টি কামনা ও তাদের প্রতি ধন্যবাদ-কৃতজ্ঞতা প্রকাশই এর প্রধান উদ্দেশ্য। যেসব দেবদেবী সুস্বাস্থ্য দিয়ে থাকেন, রক্ষক হয়ে রক্ষা করেন, ফসল উৎপাদনে বর দিয়ে থাকেন, সারা বছর ভালো থাকার জন্য আশীর্বাদ করেন, সেসব দেবদেবী যেমন সালজং, সুসিমে, রক্ষিমেমা ইত্যাদি দেব-দেবীর আশীর্বাদ লাভ করাই ওয়ানগালার মূল বিষয়। মিসি সালজং উর্বরতার দেবতা, রক্ষিমেমা ফসলের জননী, সুসিমে শস্য রক্ষাকারী ও ঐশ্বর্যের দেবী। তাই জীবন ধারণের জন্য সালজং, সুসিমে ও রক্ষিমেমার আশীর্বাদ প্রয়োজন। জানুয়ারি মাসে আখিং নকমা কর্তৃক আ. দাং বণ্টন হতে শুরু করে অক্টোবর মাসে ঘরে ফসল তোলার পর ওয়ানগালা উৎসবের মাধ্যমে পালনীয় কৃষি উৎসব শেষ হয়।
বর্ষাকালের ফসল ঘরে তোলার পরপরই শীতের আগমনের আগে গারো বর্ষ পঞ্জিকার সপ্তম (মতান্তরে দশম) মাস মেজাফাং৯০ (অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ) মাসে বাংলা ঋতু শরৎকালে এই ওয়ানগালা উৎসব পালিত হয়ে থাকে। ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের সময় সম্পর্কে আমেরিকার নৃবিজ্ঞানী Robbins Burling বলেছেন, ‘বছরের সর্ববৃহৎ উৎসব ওয়ানগালার শুভাগমন ঘটে বছরের ইন্দরতম সময়ে …দিন থাকে একদম বৃষ্টিহীন এবং আবহাওয়া থাকে ফুরফুরে ঝরঝরে নির্মল; রাত যেন কুঁকড়ে যায় আর দিন থাকে মৃদু রৌদ্রকরোজ্জ্বল।’ উল্লে- খ্য, ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের নির্দিষ্ট কোনো তারিখ নেই। তবে ওয়ানগালার শুরু হওয়া ও শেষ করার সময় সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘megong bibal balo, jajong jarambong.o’ অর্থাৎ বনের মেগং নামক পাহাড়ি ফুল ফুটতে শুরু করে তখনই ওয়ানগালা আয়োজনের সময় হয় এবং পূর্ণিমা চাঁদের আলো থাকতে থাকতেই ওয়ানগালা শেষ করতে হয়। গ্রামের সকলের ফসল ঘরে তোলা হলে এর পরই নকমা সকলকে ডেকে এনে ভোজে আপ্যায়ন করান এবং ওয়ানগালার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তুতি শুরু করেন। ওয়ানগালার তারিখ ঘোষণার পরপরই গ্রামের সকলের মধ্যে অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির সাজ সাজ রব পড়ে যায়।
ওয়ানগালা অনুষ্ঠান মূলত তিনটি পর্বে বিভক্ত-রুগালা, সা.সাৎ স.ওয়া এবং ‘দামা গগাতা’ বা ‘জলওয়াত্তা’ বা ‘রুদ্রতা’। ‘রূগালা’র সারমর্ম হচ্ছে এই দিন রক্ষিমেমা ও রংদিক মিৎদিকে আমোয়া গ্রিক্কা (মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে উপাসনা) করা হয়। এরপর নকমার ঘরের মাঝখানে দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে রক্ষিত নতুন শস্য, শাক-সবজি, কৃষি সরঞ্জাম ও বাদ্যযন্ত্রগুলোর ওপর ‘রুগালা’ (অল্প মদ ঢেলে উৎসর্গ করা) করে দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য উৎসর্গ করা হয়। এভাবে নকমার বাড়ির পর পর্যায়ক্রমে গ্রামের সবার বাড়িতে এ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। দ্বিতীয় দিন হয় ‘সা.সাৎ স.ওয়া’ (ধূপারতি উৎসর্গ)। মিসি সালজং-এর উদ্দেশ্যে এই নৈবেদ্য উৎসর্গ করা হয়। এই দিনই হয় ‘ফুরা ওয়াস্থি থক্কা’ (দেব-দেবীর জন্য পবিত্ররূপে পৃথকীকৃত করা) এবং ‘গুরে রদিলা’ (রাজকীয় বেশে নকমা ও খামালের কৃত্রিম ঘোড়ায় চড়ে নৃত্য)। এটি ‘গুরে ওয়াৎত্তা’ নামেও পরিচিত। তৃতীয় দিনের অনুষ্ঠান হলো ‘দামা গগাতা’ বা ‘জলওয়াত্তা’ বা ‘রুদ্রতা’। এ অনুষ্ঠান শেষে নকমার বাড়িতে দামা, গ্রাম, কাল, রাং প্রভৃতি ওয়ানগালা উৎসবে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রগুলো নকমার বাড়িতে এনে জমা দিয়ে দেয়া হয়। তারপর নকমা সমবেত জনতার সম্মুখেই সালজং মিৎদে ও অন্নদেবী রক্ষিমেমার উদ্দেশ্যে শেষবারের মতো মদিরা ও ধূপ নৈবেদ্য উৎসর্গপূর্বক প্রার্থনা জানান এবং তাদের বিদায় জ্ঞাপন করেন। এর মধ্য দিয়েই ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়।
৮. অর্থনৈতিক সংগঠন
৮.১ আর্থসামাজিক অবস্থা
গারোদের প্রধান উপজীবিকা ছিল কৃষিকর্ম গারোরা অধিকাংশই ছিল কৃষিজীবী ভূমিই ছিল তাদের জীবন ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রধান অবলম্বন। কারণ ভূমি ও জীবন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। শতকরা ৯০ জনই প্রত্যক্ষভাবে কৃষিকাজ করতো। অন্য পেশায় তেমন ছিল না। মোটামুটি হিসেবে দেখা যায়, আগে শতকরা নব্বই কি পঁচানব্বই ভাগ গারো পরিবারেই ভূমি ছিল। কিন্তু এখন মাত্র শতকরা ১০-১২টি পরিবারের ভূমি আছে। বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রতিকূল পরিবেশ, সচেতনতার অভাব, শিক্ষার অভাব, দূরদর্শিতার অভাব, ভূমি রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে উদাসীনতা, ভূমি আইন সম্পর্কে না জানা ইত্যাদি কারণে গারোরা তাদের ভূমি ও সম্পদ হারিয়েছে। গারোদের মাতৃসূত্রীয় প্রথানুসারে মাহারীর জমি কেউ বিক্রয় করতে পারত না। শুধু ভোগই করতে পারতো। তবে বাংলাদেশে মালিকানার ধরন ছিল পারিবারিক ও ব্যক্তিগত। বাংলাদেশে গারো সমাজে যেটিকে মাহারী সম্পত্তি বলে দাবি করা হয় তা মূলত ব্যক্তিগত সম্পত্তি। কারণ বাংলাদেশ সরকারের ভূমি আইনের অধীনেই সেগুলো ব্যক্তিগতভাবে নিবন্ধিত করা, নাম জারি করা মাহারীগতভাবে নয়।
বর্তমান প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগেও গারোদের অর্থনীতি কোনো রকম জীবন-ধারণ অর্থনীতিই (subsistence economy) রয়ে গেছে। এদের শতকরা ৯০ জনই এখন ভূমিহীন এবং পরোক্ষভাবে কৃষিকর্মের উপর নির্ভরশীল। এরা প্রায়ই শ্রমজীবী। শুধু শ্রমজীবী ও কৃষিকর্মের উপর নির্ভরশীল সমাজ অনুন্নত ও অনগ্রসর সমাজের বৈশিষ্ট্য। তাই বাধ্য হয়েই বর্তমানে অনেকে পেশার পরিবর্তন করছে এবং একটি সমাজে নানামুখী পেশাজীবী ও বৃত্তীয় মানুষের প্রয়োজন বটে। জীবন-জীবিকার সংস্থানের অব্যাহত চাপে গারোদের জীবন সংগ্রামের ধারা পাল্টে গেছে। ঘরকুনো গারোরা এখন বহির্মুখী হচ্ছে। তারা বিভিন্ন পেশায় কাজ করছে যেমন সরকারি ও বেসরকারি অফিসসমূহে, গার্মেন্টস, বিউটি পার্লার, মৎস্য খামার, দোকান, চা বাগান, পানপুঞ্জি, কল-কারখানা, সামরিক, আধা-সামরিক ও পুলিশ বাহিনী ইত্যাদিতে।
৮.২ গারোদের প্রথাগত ভূমি ব্যবস্থা
গারোদের প্রথাগত ভূমি ব্যবস্থা বিভিন্ন প্রকার। যেমন-আ. খিং, আ. মিলাম, উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রাপ্ত জমি, খাজনা-প্রদত্ত জমি ইত্যাদি।
আ.খিং ভূমি: আ. খিং ভূমির মালিক মাহারী। এটি মাহারীর যৌথ সম্পত্তি। সাধারণ উত্তরাধিকারী নিয়ম অনুসারে প্রজন্মান্তরে হস্তান্তরিত হয়ে থাকে অন্যান্য সম্পত্তির মতোই। ‘নকনার’ স্বামীই হচ্ছে আ. খিং ভূমির অভিভাবক ও তত্ত্বাবধায়ক। আর প্রকৃত মালিক হচ্ছে ‘নকনা’। প্রাচীনকালে গারোদের কোনো ম্যাপ বা দলিলাদি ছিল না আ.খিং-এর সীমানা নির্ধারণ করার জন্য। প্রাকৃতিক সীমানা যেমন কোনো নদী, ঝরনা কিংবা গাছ সীমানা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মালিকানার প্রকৃতি অনুসারে গারো সমাজে কয়েক ধরনের প্রথাগত ভূমি মালিকানার ধরন দেখা যায়। ১০০ যথা-
- ক. আআ মাথে (A.a Matte): কোনো পুরুষ কর্তৃক কাউকে সেবা দেয়ার বিনিময়ে উপহার হিসেবে প্রাপ্ত জমি কিংবা অন্য মাহারীর কাছ থেকে ক্রয়কৃত জমি এটি। যে ব্যক্তিটি উপহার হিসেবে প্রদত্ত সেই ভূ-সম্পত্তিটি গ্রহণ করেছে বা ক্রয় করেছে সে তার নামে সেই জমিটি রাখতে পারে না কিন্তু তা বৈবাহিক সম্পর্কের সূত্র ধরে তার স্ত্রীর নামে অর্থাৎ স্ত্রীর মাহারীর নামের ভূমির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়।১০১
- খ. আ.জিনমা বা আ.জমা (A. jinma or A.joma): কোনো মাহারীর অধিকারে থাকা কমন জমি। এই জমির উপর সর্ব ক্ষেত্রে মাহারীর সকলের অধিকার স্বীকৃত। এরূপ জমির ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হলে বা কোনো সমস্যা দেখা দিলে সে ব্যাপারে মাহারীর সকলের সর্ব সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। সেই আ.খিং-এর ‘নকমা’ মাহারীর ড্রা-মাহারীর ইচ্ছানুসারেই পরিচালিত হয়ে থাকে। ১০২
- গ. আ.আ জিকসে (A.jikse): স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের মাহারীর অধিকারে থাকা common জমি। এ জমি দুটো মাহারীর ‘আন্তঃমাহারী সম্পর্কের বন্ধন’ (aka chagrika jamna ra.grika ev chanrıma banrıma galna ekna manja) হিসেবে পরিগণিত। ১০৩
- ঘ. আ. মিলাম (Amillam): দুটো আ. খিং-এর মধ্যখানে অবস্থিত জমি যা কোনো মাহারীর অধিকারভুক্ত নয় অর্থাৎ যা no man’s land হিসেবে চিহ্নিত। যে ব্যক্তি এই জমি দখলে নিতে পারে সেই-ই হবে তার মালিক।১০৪
- ঙ. উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রাপ্ত জমি: প্রথাগত আইন ও উত্তরাধিকার বিষয়ক আইন অনুসারেই আখিং-এর উত্তরাধিকার বর্তায়। ‘নকমা’ হয়ে সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব লাভের বিষয়টি ‘নকনা’র পিতা-মাতা, ড্রা-মাহারীর উপর নির্ভর করে। ব্রিটিশ আমলে নকমাদের স্বীকৃতি দিত ডেপুটি কমিশনার আর বর্তমানে তা করা হয় জেলা পরিষদ থেকে। ১০৫
- চ. খাজনা প্রদত্ত জমি: একটি জেলার চৌহদ্দির মধ্যে অবস্থিত যে জমিগুলো নকমার অধীনে আ. খিং ভূমির সঙ্গে যুক্ত নয় সেগুলো সরকারি জমিরূপে পরিগণিত। এরূপ জমিগুলো হলো যেমন বনভূমি এবং সাধারণ জনগণ কর্তৃক ভোগদখলকৃত জমি যা প্রজাস্বত্ব নিয়মানুসারে রেকর্ডকৃত। এ ধরনের জমির মালিকরা তাদের প্রয়োজন অনুসারে বিক্রয়ও করতে পারে।১০৬
৮.৩ বন ও বনবাসী গারো এবং অধিগ্রহণ
গারোদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও জীবন-যাত্রা প্রণালী পর্যালোচনা করলেই দেখা যায় যে, গারোরা যেন আজন্ম বনবাসী। গড় অঞ্চল তথা বনের অধিবাসী বলেই তাদের নাম ‘গড়’ থেকে ‘গারো’ হয়েছে বলে বলা হয়ে থাকে। এখান থেকেই বোঝা যায় বনকে তারা কত ভালোবাসে, বনবাসী হিসেবে বনে গাছপালা রক্ষায় তারা কত আন্তরিক। কারণ তারা জানে বন তাদের আশ্রয় দেয়, বন তাদের জীবনোপায় করে দেয়, বন তাদের চিকিৎসার ওষুধ দেয়, বন তাদের পরিধেয় যোগায়, সর্বোপরি তাদের স্বাতন্ত্র্য তথা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করে। কাজেই বনকে ধ্বংস করা মানে তাদের জীবনকে-অস্তিত্বকে বিপন্ন করা; সংকটাপন্ন করা; পঙ্গু করা। তাই তারা বনকে বন্ধু ভাবে, বনকে শ্রদ্ধা করে, বনকে পূজা করে, বনের সঙ্গে বাস করে। কিন্তু বনবাসী গারোদের জীবন-অস্তিত্ব আজকে বিপন্ন হয়ে পড়েছে বনবিভাগ কর্তৃক ন্যাশনাল পার্ক, ইকোপার্ক, ট্যুরিস্ট স্পট, সামাজিক বনায়ন ইত্যাদি তৈরির নামে বনবাসী গারোদের উচ্ছেদ, মিথ্যা মামলা রুজুকরণ, উৎপাদিত ফসলসমূহের ক্ষতিসাধন করা, অনাকাঙ্ক্ষিত পুলিশি হয়রানি, ধর্ষণ এমনকি হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার মাধ্যমে। বর্তমানে অনাকাঙ্ক্ষিত এসব দৃশ্যপট যেন গারোদের স্বাভাবিক, এ যেন তাদের জন্য নির্ধারিত এবং গারো হয়ে জন্মে বনবাসী হওয়া যেন আরো অপরাধ।
বাৎসরিক ভিত্তিকে খাজনা বা কর প্রদানের ভিত্তিতে তাদের ভিটেমাটি ও তাদের অধিকারে থাকা উর্বর নিচু জমিগুলো নিজেদের নামে এবং ১৮৭৯ সালে মধুপুরের গারোরা তাদের বসবাস করে আসা ভিটেমাটি, উর্বর নিচু জমি ও কিছু উঁচু জমি নিজেদের নামে বিশেষ করে স্ত্রীলোকদের নামে রেকর্ডভুক্ত করে নেয়। বার্ষিক ভিত্তিতে কর ধার্য করে জমিদাররা তাদের বসতভিটা হিসেবে রেকর্ডভুক্ত করে থাকতে দেয়। জমিদারদের সময়ে করা পূর্ববঙ্গ প্রজাস্বত্ব আইনের অধীনে এখনও সেই জমিগুলো রেকর্ডভুক্ত করা আছে। বন বিভাগ পূর্ববঙ্গ প্রজাস্বত্ব আইনকে অকার্যকর করে উচ্ছেদকে সহজতর করার লক্ষ্যে ১৯৫৬ সালে মধুপুরের গড়বাসী গারোদের প্রথম উচ্ছেদ নোটিশ জারি করে। ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ন্যাশনাল পার্ক গড়ে তোলার উদ্ধেশ্যে ১৯৬৩ সালে ‘খোলা উচ্ছেদ নোটিশ’ (Overt Eviction Nouce) জারি করে উক্ত এলাকায় বসবাসকারী গারোদের প্রতি।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসকের প্রস্তাবনায় ১৯৭৮ সালে ৮০০ পরিবারের প্রায় ২০০টি বাড়িতে ন্যাশনাল পার্ক করার জন্য ‘খোলা উচ্ছেদ নোটিশ’ জারি করা হয় ব্যাপকভাবে। সেই নোটিশে প্রতি পরিবারকে এক একর জমি এবং ১০০০ টাকা করে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়ার ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু এটি ছিল হাস্যকর বিষয় কারণ যে জমিগুলো ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়ার কথা হয়েছিল তার ২০০ একর জমিই পূর্ব থেকেই বাঙালিদের দখলে রেকর্ডভুক্ত ছিল। ১৯৭৯ সালে আবারও থানারবাইদ, সাইনামারি এবং পীরগাছার ২০০ পরিবারকে উচ্ছেদ নোটিশ প্রদান করা হয়। ১৯৮১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে রসুলপুর রেঞ্জকে জয়নাগাছা, বানদারিয়াখোলা, খেজাই থেকে ১০৮ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য নির্দেশ দান করে। আদিবাসীদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও কোনো ক্ষতিপূরণ ছাড়াই বন বিভাগ সেই জমি দখল করে নেয়।
১৯৯২ সালে ‘জাতীয় পরিবেশ নীতি’ ঘোষণা করে পরিবেশ রক্ষার নামে ১৫টি বিষয়কে চিহ্নিত করে যেমন জমি, জীব, জীববৈচিত্র্য, মাছ, প্রাণীকুল এসব রক্ষার নামে আইন করালেও বনের অধিবাসীদের বিষয়ে কোনো রক্ষাকবচই রাখা হয়নি। উল্টো বন বিভাগ বনবাসী আদিবাসীদের যাযাবর, অবৈধ স্থাপনকারী, অবৈধ দখলদার, অন্যের সম্পত্তি অনধিকারভাবে ব্যবহারকারী ইত্যাদি ভাষায় অপবাদ দেয়।
২০০৩ সালে ৬১,০০০ ফুট ইটের দেয়াল দিয়ে ভিতরের আদিবাসীদের ৩,০০০ একর জমি ঘের দেয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করে বনবিভাগ। ২০০৩ সালের ৩ জানুয়ারি ইকোপার্ক প্রকল্পের বিরুদ্ধে হাজার হাজার গারোর শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশ এবং বনরক্ষীদের অতর্কিত আক্রমণের গুলিতে জালাবাদা গ্রামের পীরেন স্নাল তৎক্ষণাৎ মারা যায়। পুলিশের গুলিতে আহত ছাত্র উৎপল নকরেক অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে চিরদিনের জন্য পঙ্গু ও পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ২০০৭ সালে গারোদের ওপর এসব অবিচার, অন্যায়ের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর চলেশ রিছিলকে পুলিশ হেফাজতে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ১০৭
৯. লোক-সংস্কৃতি ও লোকাচার
৯.১ খাদ্যাভ্যাস
সাধারণ খাবারের পাশাপাশি গারোদের নিজস্ব খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া রয়েছে। গারোদের রান্নায় সাধারণত কোনো তেল ব্যবহার করা হয় না। তাদের জাতীয় খাবার সবগুলোই তেল বর্জিত। উল্লেখযোগ্য খাবারের মধ্যে রয়েছে বিন্নি চালের ভাত মিমিল, গুলথুম মাছি, গানথং মাস্থি, মাস্থি আংপাকা, মেগারু জওয়া, মেখপ জওয়া, মেখপ রিতা, ওয়াক খারি, ওয়াক ফুরাখারি, খিওয়েক খারি, সথুপা, উথেপা, ব্রেংআ, খাপ্পা, সংগ্রপা, মিব্রাম, মেওয়া, গ্রাম, নাসুকুতি, নাখাম ইত্যাদি। এসব তরকারি গারোদের নিকট খুবই প্রিয়। সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠানে এবং অতিথি আপ্যায়নে জনপ্রিয় পানীয় ‘চু’ বা মদ। কিছু চার্চের অনুসারী ও শিক্ষিত গারোদের মধ্যে এর বিরূপ প্রভাব ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য ‘চু’ গ্রহণের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখা যায় না।
৯.২ পোশাক-পরিচ্ছদ
পূর্বে গারো পুরুষদের পোশাক ছিল খুবই সাধারণ। তারা গান্দো ও গাংগট, খফিং, খখুপ, জাকসিল, ধুতি ইত্যাদি পরিধান করতো। গারো মেয়েদের পোশাকের মধ্যে আছে দকবান্দা বা দকমান্দা, দকসারি, গেনা বা গাননা, দলাজিন, টপস, স্কার্ট, ব্লাউজ। আর অলঙ্কারের মধ্যে আছে খকাসিল, রিকমাচু, খাদিসিল, পেনতা, নাথাপসি, নাদিরং, জাস্রেং, জাকসান, বয়লা, জাকসিদেম, রুব্বক, সেংখি, সিলিদিং ইত্যাদি। বর্তমানে বিভিন্ন উৎসব ও নিজস্ব পরিবেশে এগুলোর কিছু কিছু পরিধান করলেও অধিকাংশ গারো বাংলাদেশে ব্যবহৃত পরিধান করে থাকে।
৯.৩ আসবাবপত্র ও তৈজসপত্র
গারোদের ব্যবহার্য আসবাবপত্র খুবই সাধারণ। পূর্বে রান্নার জন্য তারা ব্যবহার করত মাটির হাঁড়ি-পাতিল, বাঁশের চোঙ, কলার পাতা; বসার জন্য আমফক, আমখালথাক (ছোট পাটি), আমবুক, আমপাতি, মুরা, কাঠের গুঁড়ি; মাছ ধরার জন্য ব্যবহার করত জাকখা, খকসী, লেফাই, আপুন, নাদাংখল, থোসক, চেক; পাত্র হিসেবে ব্যবহার করতো খক বা ধরা, খকজেং, খকরেং, গাচেক, খদো, খাসা; ঘুমানোর সময় ব্যবহার করত আমবুক, গানসাং নক, জুম চাষাবাদে ব্যবহার করতো আৎথে, মংরেং, গিৎছি, রুয়া, মাথা, রাংগাচেক, কুথি, জাকেংব্রাক, যুদ্ধের সময় ব্যবহার করত মিলাম, সেফি, সেলু, জাৎথি, দানিল, ব্রা, ছি; বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে আছে রাং, গ্রাম, দামা, গ্রাম আচক, শ্রাম নাদিক, আদুরু, বাংসি, সিঙ্গা, সানাই, উথাকরু, গংগিনা, দিমচাং, সরাস, কাল, নাগ্রা, চেংচাপ, জান। বর্তমানে গারোরা আধুনিক, টেকসই ও সহজলভ্য জিনিসপত্রই বেশি ব্যবহার করে।
৯.৪ খেলাধুলা
গারোদেরও নিজস্ব বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা আছে। সেগুলোর মধ্যে মিসি মেংগং, গাংগিসিক্কা, থুম্মুয়া, বিনবিনজারি, গিলাখালা, আংখিখেপ্পা, জিক চলা, চাগ্রিপা, ওয়াফাং সালা, হাডুডু, বুদু সালগ্রিকা, খাৎসুসা, গোল্দাবারি ইত্যাদি। বর্তমানে তাদের খেলাধুলাতেও পরিবর্তন এসেছে। তারা এখন ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, টেনিস, দারিয়াবান্দা, হাডুডু, গোল্লাছুট ইত্যাদি খেলা খেলে থাকে।
৯.৫ লোকসাহিত্য
গারো সাহিত্য মৌখিক ঐতিহ্য নির্ভর হলেও লিখিত সাহিত্যের মূল্যমানের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় বরং তুলনামূলক বিচারে অনেক বেশি। কারণ যে সাহিত্যের উপাদানগুলোর লৈখিক রূপ আছে সেগুলো সহজভাবেই প্রজন্মান্তরে বিকশিত হয়েছে। আর অন্যদিকে, গারো সমাজের মৌখিক নির্ভর সেসব সাহিত্যিক উপাদানও অবিকৃতভাবেই বিকশিত হয়েছে, হস্তান্তরিত হয়েছে প্রজন্মান্তরে। গারোদের মিদ্দে আমুয়ার মন্ত্র (পূজার্চনার মন্ত্র), আজিয়া (মিদ্দিদের উদ্দেশ্যে গীতস্তোত্র), দরোয়া, রে রে, খাবিগান (মৃতের আত্মার উদ্দেশ্যে গীত গান), গন্দা রিংআ, কাঙ্খা দক্কা বা কাৎথা আগানা, খুরামা সাল্লা এসব লোকগীতির উদাহরণ।
গারো সাহিত্যে গীতি-নৃত্য-নাট্য ‘সেরেনজিং’, সোনাজিং খুব জনপ্রিয় একটি প্রেমকাহিনী। সেরেনজিং গারো লোক-সাহিত্যের একটি অমূল্য সৃষ্টি। সেরেনজিং ও সেরেনি দুই বোন। ছোটবেলাতেই মা-বাবাকে হারায়। তাদের খালা-খালু নরেং-সিমরেং মা-বাবা-হারা দুবোনকে তাদের গ্রাম বালস্রিগিথিম-এ নিয়ে আসে। নরেং ও সিমরেং একদিন বনে কাঠ কেটে ফেরার সময় কিসের যেন আওয়াজ শুনতে পায়। সেই আওয়াজের উৎস ধরে গিয়ে দেখে এক যুবক বাঘের সাথে মরণ-পণ লড়াই করছে। নরেং সেই যুবকের সাহায্যে এগিয়ে এসে বাঘের আক্রমণ থেকে যুবকটিকে রক্ষা করে। শ্রান্ত-ক্লান্ত-আহত যুবকটির পরিচয় জানতে চাইল তারা। যুবক তাদেরকে বলল তার নাম ওয়ালজান। মেগাম গ্রামের ছেলে মা-বাবা হারা আশ্রয়হীন একজন। তার কেউ নেই। তাই সে মনের দুঃখে অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করছিল। তার দুঃখের কাহিনী শুনে নরেং ও সিমরেং তাকে নিয়ে আসে তাদের সাথে। নিঃসন্তান নরেং ও সিমরেং ওয়ালজানকে নিয়ে আসল নিজেদের পুত্র করে। ওয়ালজানও নরেং-সিমরেং-এর ছেলে হয়েই সেই পরিবারের সদস্য হয়ে থাকল। সেরেনজিং-সেরেনি-ওয়ালজান একত্রে দিন কাটাতে থাকে।
গারোদের সামাজিক নিয়মানুসারে খালাতো ভাই-বোন আপন ভাইবোনের মতোই। সে হিসেবে তারা তিনজন পরস্পর ভাইবোন। একত্রে থাকতে থাকতে সেরেনজিং ও ওয়ালজানের মধ্যে পরস্পর পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা জেগে উঠে তারা একে অপরের প্রেমে পড়ে যায়। তারা বিষয়টি লুকানোর চেষ্টা করলেও ব্যাপারটা আর চাপা থাকে না। একদিন বনে কাঠ কাটতে গিয়ে নরেং সেরেনজিং ও ওয়ালজানের অন্তরঙ্গ আলাপচারিতা শুনে ফেলে এবং তাদের মধ্যে যে একটা নিষিদ্ধ প্রেমের উন্মেষ ঘটেছে তা জানতে পারে। ওয়ালজানকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেয় এবং ওয়ালজানকে বাড়িতে থাকতে না দিয়ে জুম ক্ষেত পাহারা দেয়ার ঘর বরাং-এ থাকতে বলা হয়।
গারোদের সামাজিক নিয়ম অনুসারে তারা ভাইবোন। ভাইবোনের মধ্যে এ প্রেম নিষিদ্ধ। তাই সেরেনজিং-এর খালা-খালু বিষয়টি বুঝতে পেরে সেরেনজিংকে নানাভাবে অত্যাচার শুরু করে। অধিক হারে খাটায়, খেতে না দিয়ে রাখে; কথার বাণে জর্জরিত করে এভাবে মানসিক-শারীরিক অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয় সেরেনজিংকে। এরই মধ্যে নরেং-এর ভাগিনেয় খরা’র সাথে জোর করে সেরেনজিং-এর বিয়ে দিয়ে দেয়। থরা ছিল হাবা-গোবা ধরনের এবং সরল প্রকৃতির। থরাকে ভুলিয়ে সেরানজিং দুই তিন রাত আলাদা থাকার ব্যবস্থা করে। সেরেনি ওয়ালজানকে আদাং-এর বরাং-এ (জুমক্ষেতস্থিত পাহারা দেয়ার ঘর) খাবার পৌছে দেয়। তার কাছ থেকেই ওয়ালজান সেরেনজিং-এর সব খবর পায়। সেরেনজিং-এর অনেক কষ্ট হচ্ছে শুনতে পেরে ওয়ালজানও খুব দুঃখ পায়। একদিন সুযোগ বুঝে সেরেনজিং ও ওয়ালজান পালিয়ে যায়। ওয়ালজান প্রশ্ন তুলে কারণ সেরেনজিং বিবাহিত ও পর-স্ত্রী। সে অন্যের অঙ্গ-শায়িতা হয়েছে। সে ধরাকে কীভাবে ঠকিয়ে সতি থেকেছে তা ওয়ালজানকে বলে। কিন্তু ওয়ালজান বিশ্বাস করতে চায় না। এ জন্য সেরেনজিং আগুনে আত্মাহুতি দিয়ে পরীক্ষা দিতে চায়। আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। সেরেনজিং সেখানে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দিতে চায়। এটি দেখে ওয়ালজান অনুভব করতে পারে সেরেনজিং সতি নারী। ওয়ালজান সেরেনজিংকে ঝাপ্টে ধরে, আলিঙ্গনাবদ্ধ করে। পরে তারা দূর দেশে পালিয়ে যায়। এ হলো সংক্ষেপে ‘সেরেনজিং’-এর কাহিনী। এরূপ আরো কাহিনী আছে যেমন দিগ্নি-বান্দি, খালসিন সোনাচি, সোনাজিং ইত্যাদি।
গারোদের কথা সাহিত্যে অনেক লোককাহিনী আছে যেগুলো শুধু মুখের কথার মাধ্যমেই পুরুষানুক্রমে চলে এসেছে। লোক-কাহিনীগুলোর মধ্যে আছে যেমন আনাল-গুনাল, মাৎছাদু-মাছাবেত, দখুয়া আরো মিসি, দুরামুং সংদুমুং দাকগ্রিকা ইত্যাদি কাহিনী।
৯.৬ লোকসংস্কার
বিভিন্ন সমাজের মতোই গারো সমাজেও রয়েছে বিভিন্ন লোক সংস্কার। লোকসংস্কার এমন সব বিশ্বাস ও ধারণা যা মানুষের আচরণকে ও জীবনকে প্রভাবিত করে। লোক-সংস্কার সমাজের ব্যক্তির চেতনে ও মননে সুদূরপ্রসারী ক্রিয়াশীল থাকে। এভাবে গারো সমাজে অনেকগুলো সংস্কার প্রচলিত আছে। যেমন-ক. রাত্রে চুনকে চুন বলতে নেই। খ. রাতে কীটপতঙ্গকে মারতে নেই। গ. রাত্রে ঘর ঝাড়ু দিয়ে ময়লা বাইরে ফেলতে নেই। ঘ. সন্ধ্যায় গর্ভবতী মহিলার বাইরে বেরুতে নেই। ৬. সন্ধ্যার পর মাছ ধরার আলাপ করতে নেই।
লোক-বিশ্বাস:
- ক. স্ত্রী লোক গাছে উঠলে সেই গাছ মরে যায়।
- খ. গোবরের উপর থুথু ফেলতে নেই, ফেললে গলা ব্যথা করে।
- গ. রজঃস্রাবকালে ব্যবহৃত ন্যাকড়া যেখানে সেখানে ফেলতে নেই। সেটি অন্য কেউ পেলে সেই নারীকে বশে আনতে পারে।
- ঘ. ছাতার উপর বসতে নেই, বসলে মাথা ব্যথা করে।
- ঙ. বালিশে বসতে নেই, বসলে ঘাড় ব্যথা করে।
সাধারণ বিশ্বাস:
- ক. সকাল বেলা কাক ডাকলে অমঙ্গল হয়।
- খ. অসময়ে যদি কুকুর লম্বা স্বরে ডাক দেয় তবে অশুভ লক্ষণ।
- গ. যাত্রার প্রাক্কালে কেউ হাঁচি দিলে যাত্রা নাস্তি হয়।
- ঘ. চলার পথে ডান দিকে হোঁচট খেলে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়
স্বপ্ন বিষয়ক বিশ্বাস:
- ক. স্বপ্নে মাছ দেখলে ধন লাভ হয়।
- খ. স্বপ্নে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা দেখলে ধন লাভ হয়, উন্নতি হয়।
- গ. সাপের দংশন দেখলে শত্রুর আক্রমণ হয়।
- ঘ. উড়োজাহাজ উড়তে দেখলে সুখবর পাওয়া যায়।
- ঙ. কলম দেখলে পত্র প্রাপ্তি ঘটে। ১১৩
৯.৭ প্রবাদ-প্রবচন
গারোদের অনেক প্রবাদ প্রবচন রয়েছে। বংশ পরম্পরায় নানা সামাজিক অনুশীলনের মধ্য দিয়ে এসব প্রবাদ প্রবচন গড়ে উঠেছে। নিম্নে কয়েকটি প্রবাদ প্রবচন দেয়া গেল-
- ক. আনথাংনাদে চিজং গিত্তক, গিপিনচানাদে বগা গিত্তক। (প্রতিটি মানুষই নিজের স্বার্থ চেনে।)
- খ. রিংজকনা ফেকজক, চাজকনা অকখাজক। (কাজ ধরলেই কাজ শেষ হয়ে যায়।)
- গ. খুসিকো বিজা বিচ্চি, অকনিংও মাছা বিসি। (বাহ্যিক চেহারা দেখে মানুষ চেনা যায় না।)
- ঘ. গ্রংথাংআন মাতা, জাচিংথাংআন বুআ। (আকাশের গায়ে থুথু দিলে নিজের গায়েই পড়ে।)
- ঙ. মিকখাবা ওয়াজক, রামাবা রিম্মিলজক। (অলস কাজ দেখলেই ছুঁতা খোঁজে।)
৯.৮ লোকগীতি
গারো সাহিত্যে বিভিন্ন ধরনের লোকগীতি আছে। সেগুলো যেমন রেরে, খাবি, কাংখা আগানা, গন্দা রিংআ, আজিয়া, দরোয়া, আমুয়া ইত্যাদি। বর্তমান আধুনিক গান ছাড়া অন্য লোকগীতিগুলো মুখে মুখেই রচিত ও চর্চিত হয়ে আসছে। কয়েকটি লোকগীতির নমুনা দেয়া গেল।
রে রে: সাধারণত দুইজন অথবা দলবদ্ধভাবে দুই দলে বিভক্ত হয়ে গাওয়া হয়। একদল যখন রে রে গায়, সাথে সাথে তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি করে অন্যদল প্রতিউত্তরে গায়। যেমন-
ছেলে: বরুয়া ওয়ানি রগ্নিও (চিচরৎ মাংগিনিং) ॥
হাই ননো রিবাবো, রে রে রিংনা সাকগিনিং, হারেরে হারেরে।
মেয়ে: রে রে খালনান রিবানু (রাং খারাম গাম্মানা) ॥
নাম্মেন খুসি হংবিজক রে রে খালনা রিকগামানা, হারেরে হারেরে।
ছেলে: রে রে খালনা ব্রাংআনু, (দও নাংখো মাননিফিজক) ॥
মানাসা জারোনা, হাই রে রে খালনাজক হারেরে হারেরে।
মেয়ে: মানাসা জারোনা (হাই রেরে খালনাজক) ॥
রাং খারামনি গাম্মানা আর দংনা মানজাংজক, হারেরে হারেরে। ১১৪
আজিয়া: আজিয়া সাধারণত পবিত্র অনুষ্ঠানে মিদ্দিদের উদ্দেশ্য করে তাদের নিকট আশীর্বাদ যাঞ্চা করে, তাদের আহ্বান জানিয়ে করা হয়। আজিয়া সচরাচর করা হয় না। রংচুগাললা অনুষ্ঠানে কীভাবে আজিয়া করা হয় তা উপস্থাপন করা হলো-
আমানি ফিলজিনি সাসিয়ান ওয়াসি ওয়াচেং রামরামারি চেংখালা রিৎচকসি দংআনা। আমানি ফিলজিনি সিও বননো জা. জা. জি.জি. দাক্কে দংআনা। মাংওয়া মাংদাকে দংআনা। আমাখো ফুজুনা ফিলজিখো মাংরোংনা জা. জা. জি.জি. দাক্কে দংজকনা। উয়া মিকখাং গিসিম উরুসা খালাখো খকখো আমমে অননে নিয়ামুংনা। আননোবা দিলগিপজানা ফিননোবা জা সকজানা। উয়া গাদিলাখোবা সালদ্রায়ে রাবাএ আননে নিয়া- মুংনা। গাদিলাবা আনগিলখোন গিপজানা। ফিননে নিও বিয়াপেন জাসকজানা। উয়া সু.রিবা উয়া রিপবনচিবা আন্নোন গিলগিপজানা ফিল্মোন জাসকজানা। উয়া পাইপ্রৎসা নাথেং নাসাংফিললাকসা বিনা মা. নবানা সানবানা। বিয়াসা নিকবানা বিয়াসা জা.সনবানা। থেপসা ইসাল ইগিচি রাবানা, বিয়াপখোবা বিয়াসা থারিয়ানা। ইসাল ইগিচিখো আননে নিয়ামুংনা। আন্নোন গিলগিপজকনা ফিল্মোন জা. সকজকনা। ইনদাকেসা আমাখো ফুজুজকনা আমাখো মাংরংজকনা ইনদাকেন ইসাল ইগিচিও ফুজুয়ে মাংরংএ আমাখো বিমাখো দেলাং জা চাং রিককানা আমাৎ গিৎচাক সওয়ানা আমাখো। ১১৫
৯.৯ আদিবাসী চিকিৎসা জ্ঞান
পূর্বে গারো সমাজে ডাক্তার ছিল না বা চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা ছিলই না বদলা চলে। তখন গারোদের একমাত্র ভরসা ছিল স্থানীয় কবিরাজি চিকিৎসা এবং ‘মিথে আমুয়া’।
চিকিৎসা: পূর্বে গারোদের সমাজে আধুনিক ডাক্তারিবিদ্যা ও চিকিৎসাব্যবস্থা না থাকলেও তাদের মধ্যে কবিরাজ বলে পরিচিত ব্যক্তিগণ ভেষজ বা গাছ-গাছড়ার ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করত। এ ধরনের চিকিৎসা তারা সাধারণত নিজেদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে লব্ধজ্ঞান ও পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত জ্ঞানের মাধ্যমেই করতো। উল্লেখ্য যে, অনেক ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত অনেক লতা-পাতা গাছ-গাছড়ার বাংলা নাম তাদের জানা নেই কিংবা গারো ভাষাতেও সেগুলোর নাম তাদের জানা নেই। কিন্তু তারা সেগুলো দেখলেই চিনতে পারে এবং কোনটি কী রোগের জন্য কাজে লাগে তা বলতে পারে। কোন রোগের চিকিৎসায় কোন ভেষজ ওষুধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে তার কয়েকটি উদাহরণ এখানে দেয়া হলো-
পেট ব্যথার জন্য কালোমেঘ পাতার রস, দিগ্নির রস; পেট চিন চিন করে ব্যথা হলে ল্যাংড়া বনের মূলের রস; আমাশয় হলে সামথাককুরির পাতা, সিপফল; বড় বড় বিষফোঁড়া হলে জয়ন্তী পাতার রস; গর্ভে বাচ্চা না টিকলে মোরগ ফুল ও লাল শাপলার শালুক; ছোট বাচ্চাদের হাঁপানি ও নিউমোনিয়া হলে হরিণের শিং, এক চোখা নারিকেলের খোল, ফাঁসের দড়ি, বাঘের দুধ মিশিয়ে খাওয়ানো হয়; মাথার চাঁদি গরম হলে কালিজিরা বেটে মাথায় দেয়া হয়; জণ্ডিস হলে অড়হর পাতার রস, ইসবগুলের ভূসির গুড় মিশিয়ে খাওয়ানো হয়, আখের রস খাওয়ানো হয়, ধাতুর হলে পাথরকুচি পাতার রস, শিমুল গাছের মূলের রস ও শতমূলীর রস ব্যবহৃত হয়; হার্ট দুর্বলতার জন্য অর্জুন গাছের ছালের রস, হরতকি, আমলকি, বহেরা একসাথে বেটে মধু দিয়ে ব্যবহার করা হয়; হাত-পা কিংবা দেহের অন্যান্য অংশে কেটে গিয়ে রক্ত ঝরলে দূর্বা ঘাসের রস, গাঁদা ফুলের রস, কচুর ডাটা ব্যবহার করা হয়; পা ফুলে গিয়ে ব্যথা হলে দজাগুপ্তি পাতা ও কাঁচা হলুদ একসাথে বেটে মালিশ করা হয়; জণ্ডিস হলে চীনা শাপলার ডাটা সমেত পাতা, পদ্ম গুলঞ্চি পাতা, কলমি শাক, গুড়, অড়হর পাতা এগুলো একসাথে বেটে ছেঁকে তার রস খাওয়ানো হয়। ১১৬
১০. নারীর অবস্থান
গারোদের সমাজব্যবস্থা মাতৃসূত্রীয় হওয়ায় সমাজে নারীদের পরামর্শ ও সামাজিক ভূমিকার মূল্যায়ন করা হয় নারীরাও সম্পত্তির অধিকারী হতে পারে এখানে যৌতুকের জন্য মেয়েদের বিয়ে ভেঙে যায় না অথবা যৌতুকের জন্য মেয়েদেরকে অত্যাচারিত হতে হয় না। পরিবারের সন্তানেরা মায়ের বংশ পরিচয়ে পরিচিতি লাভ করে। সন্তানরা মায়ের পদবি গ্রহণ করে।
গারো সমাজে ছেলে কিংবা মেয়ে উভয় সন্তানকেই সাদরে গ্রহণ করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেয়েসন্তান জন্ম গ্রহণ করাকেই আরো বেশি সাদরে গ্রহণ করা হয়। মাহারীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রবাহিত হয় মেয়েদের মাধ্যমেই। এজন্যই কারো মেয়ে সন্তান না থাকলে মাহারীর মধ্য থেকে মেয়ে দত্তক নেয়া হয়। গারো সমাজে কাজের ক্ষেত্রে পুরুষ-নারীর সম-অংশগ্রহণের ভিত্তিতে কর্ম সম্পাদন করা হয়। তবে জন্মগত কারণে এবং পরিবেশগত কারণে যে কাজগুলো নারী ও পুরুষভেদে পার্থক্য করা হয় বা প্রকৃতিগতভাবেই কাজগুলো নির্ধারিত হয়ে যায় সেগুলো নারী- পুরুষ যার যেমন ভূমিকা ঠিক সেইভাবেই সম্পাদন করে। উদাহরণস্বরূপ- মেয়েরাই গারো সমাজে রান্নার কাজ করে, ঘর-দোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ করে, সন্তান লালনপালনের দায়িত্ব পালন করে; অন্যদিকে বাইরের কাজগুলো পুরুষ করে। যেমন-হালচাষ করা, ধান কাটা, বাজার করা, ভার বহন করা ইত্যাদি। তারপরও সবগুলো কাজই গারো সমাজে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে উভয়েই করে থাকে।
তবে গারো সমাজে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠিত নয়। সমাজে পুরুষদের সম্পত্তির অধিকারকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত করা হয়েছে। এ কারণে বর্তমানে যুব সমাজের মধ্যে এ নিয়ম পরিবর্তনের ব্যাপারে বেশ চাপ আসছে। মডারেট সমাজ হিসেবে পরিবার প্রধান হওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের ব্যাপারে কোনো আপত্তি মেয়েদের আছে বলে জানা যায় না। সম্পত্তির অধিকার না থাকায় কোনো কোনো সময় স্ত্রীর মৃত্যুর পর কোনো পুরুষকে নিজের অনেক দিনের গড়া ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়। আবার সমাজে প্রচলিত দকচাপ্পা বা অনচাপা বিয়ের মাধ্যমে মেয়েদের মতামতকে অগ্রাহ্য করা হয়। মদ্যপানের প্রতিক্রিয়ায় মাঝে মধ্যে নির্যাতন দেখা যায় তবে যৌতুকের জন্য কিংবা সন্তানাদি না থাকার জন্য নির্যাতনের বিষয়ে তেমন শোনা যায় না।
শিক্ষা ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েদের সমান পদচারণা থাকলেও চাকরি ও সামাজিক নেতৃত্বে তারা পুরুষের সমতালে আসতে পারেনি। শহরে আগত নারীদের অনেকেই বিউটি পার্লার ও বিভিন্ন বিদেশি হাউজ/এ্যামবাসিগুলোতে কাজ করে পরিবারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বেশ ভূমিকা রাখছে। তবে এখনও চলমান মাতৃসূত্রীয় সমাজে গারো নারীদের অবস্থানকে ধরে রাখতে হলে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি গারো নারীদের নিজেদের কথা নিজে বলতে হবে এবং পারিবারিক ও সামাজিক নেতৃত্বে আরো ভূমিকা রাখতে হবে। শহরে আগত গারো নারীরা সমাজে ভূমিকা রাখলেও নিজেদের নিরাপত্তা, সামাজিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি ধরে রাখতে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।
১১. রাজনৈতিক সংগঠন
জমিদার ও ব্রিটিশদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে অনেকবার সংগ্রাম করেছে গারোরা। বিভিন্ন রাজনৈতিক উত্থান-পতন গারোদের নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন না থাকলেও নিজেরা সংগঠিত হওয়ার জন্য, গারোদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে করা অবিচারের প্রতিবাদ জানাতে ও নিজেদের উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য নিজেদের বিভিন্ন ধরনের সংগঠন গড়ে তুলেছে। আ.চিক সংঘ, ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন ও ছাত্র সংগঠনগুলো এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ১৯২০ সালের দিকে ললিত মারাকের উদ্যোগে গারোদের মধ্যে আ.চিক সংঘ নামে একটি সংগঠন গঠিত হয়। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল গারো জনগোষ্ঠীর মধ্যে অধিকার ও রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে তোলা এবং শিক্ষা বিস্তারে সহায়তা করা। গারো সমাজে এই সংগঠনটির ব্যাপক জনপ্রিয়তা এবং জনসমর্থন ছিল। পরবর্তীতে দেশ বিভাগের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দাঙ্গা ও গণ্ডগোলের কারণে, নেতৃত্বের ধারাবাহিকতার অভাবে, মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরোধী হওয়ায় আস্তে আস্তে এ সংগঠনের জনপ্রিয়তা কমে যায়।
দেশ স্বাধীনতার পর বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের আদিবাসী সমাজের মধ্যে বৃহত্তর সাংগঠনিক কাঠামো, ঐক্য ও পরিচিতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলের সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠীই এ সংগঠনের সদস্য হতে পারে। গারোরা সংগঠনটির গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বে থাকায় জাতির নেতৃত্ব বিকাশ ও অধিকার সচেতনতা বৃদ্ধিতে এর ভূমিকা রয়েছে। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন (বাগাছাস) ও ১৯৮০ সালে গারো স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (গাসু) দুইটি ছাত্র সংগঠনই গারোদের যুব নেতৃত্ব বিকাশে ভূমিকা রাখে। ছাত্র-যুবকদের মধ্যে যোগাযোগ ও শিক্ষা বিষয়ক কার্যক্রম ছাড়াও জাতীয় ইস্যু ভিত্তিক আন্দোলনে এই সংগঠনগুলোর ভূমিকা রয়েছে গারোরা রাজনৈতিক চিন্তায় সচেতন হলেও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, দরিদ্রতা, বৃহত্তর সমাজের অসহযোগিতা ও জাতীয় রাজনীতির ভয়াবহতা দেখে সরাসরি রাজনীতির সাথে জড়িত হয় খুব কম। বর্তমানে অনেকে বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত হচ্ছেন। প্রমোদ মানখিন ময়মনসিংহের একটি আসন থেকে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। গারো জনগোষ্ঠী থেকে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় পর্যায়ে অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি রয়েছে।
গারো জনগোষ্ঠী থেকে অনেকে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সর্বনিম্ন ইউনিট ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান-মেম্বার পদে নির্বাচিত হয়েছেন। অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কয়েকজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও একজন মহিলা সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন। তবে আগের মতো এসব পরিষদে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ গারোদের সীমিত হয়ে আসছে। বিশেষত সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে গারোদের স্বল্প জনসংখ্যা, রাজনৈতিকভাবে সচেতনতা ও ঐক্যের অভাব, দেশের উদার গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাব ইত্যাদি কারণে গারো জনগোষ্ঠী থেকে স্থানীয় সরকার পরিষদে নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে এসব স্থানীয় সরকার পরিষদে আদিবাসীদের জন্য চেয়ারম্যান-মেম্বার পদ সংরক্ষিত করার প্রস্তাব থাকলেও বিদ্যমান নানা রাজনৈতিক বাধার মুখে তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি বা আইন আকারে গৃহীত হয়নি। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় তথা দেশের শাসনব্যবস্থায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এরূপ আসন সংরক্ষণের কোনো বিকল্প নেই বলে গারোরা মনে করে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন বিশেষ কার্যাদি বিভাগ সমতল অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের কাজ পরিচালনা ও দেখাশোনা করে থাকে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, গারোসহ সমতল অঞ্চলের কোনো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সেই বিশেষ কার্যাদি বিভাগে সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগই নেই। স্থানীয় পর্যায়ে উপজেলা স্তরে আদিবাসীদের কিছুটা ভূমিকা থাকলেও অনেক সময় আমলাদের মর্জির উপর যাবতীয় সিদ্ধান্ত নির্ভর করে। তাই জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ কার্যাদি বিভাগে এবং স্থানীয় পর্যায়ে উপজেলা স্তরে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ, প্রণয়ন ও বাস্তবায়নসহ সকল সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী পর্যায়ে গারোসহ সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক বলে গারোরা মনে করে।
টীকা
- ১. Major A. Playfair তার সুবিখ্যাত যুগান্তকারী রচনা The Garos নামক গ্রন্থে এ ব্যাপারে উলেখ করেছেন ” the Garos never use the name except in conversation with a foreigner, but always call themselves A.chik (hill man), Mande (the man), or A.chik mande.” (Playfair, MA The Garos, p.7)
- ২. এ প্রসঙ্গে আমেরিকান নৃ-তত্ত্ববিদ Robbins Burling-ও তার The Strong Women of Madhupur গ্রন্থে লিখেছেন “The people I have come to know more recently in Bangladesh, however, no longer like to be called ‘Garos’. This is the outsiders word, not their own, and since their experience with outsiders has sometimes been unhap py, the outsider’s word has come to be resented.” (Burling Robbins: The Strong Women of Modhupur, p. 3)
- ৩. Kar, Parimal Chandra: A.chik ar A.chik A.song, p. 3
- 8. দিনাং সাংমা, উদ্ধৃতি ‘জানিরা’ ১১তম সংখ্যা, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী, বিরিশিরি, ১৯৯৫, পৃ. ১
- ৫. Playfair, M. A. The Garos, p.7, Sangma, Mihir N.: Unpublished Documents on Garo Affairs, p. 3
- ৬. Mihir N. Sangma Unpublished Documents on Garo Affairs, p. 3
- ৭. Op.cit.
- ৮. Op.cit.
- ৯ Op.cit
- ১০. Op.cit.
- ১১. রবার্ট টি. সাংমা, গ্রাম: দফাগ্রাং, বাঘমারা, মেঘালয়, ভারত।
- ১২. Dalton, E.T.: Descriptive Ethnology of Bengal, (reprint), p.1
- ১৩. Parimal Chandra Kar লিখেছেন, ‘Uamangni Tibetoni Garo-Hillsona reba anı gımmin mamung serikani dongja. Uamang Garo-Hillsona jegitaba ia a brirangona napbaoba ia A.chikrangan ia biapko an tangna rachenggipa onga ine uina mana.” (Kar, Parimal Chandra: A.chik aro A chik A song, p. 1)
- ১৪. Dalton, E.T. Descriptive Ethnology of Bengal, (reprint), p.65
- ১৫. Marak, Julius L. R. Garo Customary Laws and Practices, p. 15
- ১৬. Mihir N. Sangma Unpublished Documents on Garo Affairs p. 6
- ১৭. Ibid p.7
- ১৮. Ibid. Pp. 7-8
- ১৯. Ibid. p. 8, Milton Sangma, cited in Gassah, L.S. Garo Hills Land and the People, p. 123
- ২০. Milton Sangma, cited in Gassah, L.S. Garo Hills Land and the People, p. 123
- ২১. Playfair, M. A.: The Garos, p.9, Sangma, Mihır N.: Unpublished Documents on Garo Affairs, p. 10, Milton Sangma, cited in Gassah, L.S. Garo Hills Land and the People, p. 124
- ২২. Playfair, MA: The Garos, p.10; Milton Sangma, cited in Gassah, L.S. Garo Hills Land and the People, p. 123
- ২৩ Mihir N.: Unpublished Documents on Garo Affairs, p. 10
- ২৪. Playfair, M. A. The Garos, p.10; Milton Sangma, cited in Gassah, LS. Garo Hills Land and the People, p. 124
- ২৫. Milur N. Unpublished Documents on Garo Affairs, p. 11
- ২৬. Ibid. p.14
- ২৭. Ibid. Pp.15-16
- ২৮. Ibid. p.16
- ২৯ মেসবাহ কামাল ও জান্নাত-এ-ফেরদৌসী, অশ্রু-সাগরে মিলিত প্রাণ, মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী ও চা-জনগোষ্ঠী, ২০০৮, পৃ. ২৭, উৎস প্রকাশন
- ৩০. Sangma, Milton: History and Culture of the Garos, cited in Garo Hills Land and the People, pp. 124-126
- ৩১ Parimal Chandra Kar, Introduction, cited in Major A. Playfair: The Garos, pp. VI-X
- ৩২. রেভারেন্ড মনীন্দ্র নাথ মারাক, গ্রাম: দক্ষিণ ভবানীপুর, ডাকঘর: বিরিশিরি, জেলা: নেত্রকোনা
- ৩৩. Sonaram Rongrokgre Sangma, cited in Dewansing Rongmuthu: Apasong Agana, pp. 249
- ৩৪. বিধি পিটার দাংগ, উদ্ধৃতি জানিরা, ২য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা, পৃ. ৫২-৫৪
- ৩৫. প্রাগুক্ত
- ৩৬. জেংচাম, সুভাষ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪
- ৩৭. প্রাগুক্ত।
- ৩৮. প্রাগুক্ত।
- ৩৯. Kar, Parimal Chandra A chik ar A.chik A song, p. 3
- 80 Op.cit.
- 8১. Julius, L. R (Dr.) Garo Customary Law and Practices, p. 97
- ৪২. Playfair, MA The Garos, p.
- 8৩. Sangma, Milton S. History and Culture of the Garos, cited in Garo Hills Land and the People, p. 16
- 88. Kar, Parimal Chandra A.chik ar A chik A song, p. 2
- ৪৫. Kar, Parimal Chandra Achik ar A chik A song, p. 1
- 8৬. Ibid. p.7
- ৪৭. খামাল টুকিয়া রেমা, গ্রাম পরাভিটা, দুর্গাপুর, নেত্রকোনা।
- ৪৮. Julius, L. R. (Dr.): Garo Customary Law and Practices, p.107-108
- ৪৯. Ibid. p.109
- ৫০. Ibid. Pp.110-111
- ৫১. Ibid. Pp.111-112
- ৫২. Ibid p.113
- ৫৩. Ibid. p.114
- ৫৪. Ibid. Pp.115-116
- ৫৫. Ibid. p.116
- ৫৬. Playfair, M. A.: The Garos, p.67-68
- ৫৭. খামাল টুকিয়া রেমা, গ্রাম পরাভিটা, দুর্গাপুর, নেত্রকোনা।
- ৫৮. জনিক নকরেক, গ্রাম চুনিয়া, ডাক পীরগাছা, মধুপুর, টাঙ্গাইল।
- ৫৯. খামাল টুকিয়া রেমা, গ্রাম পরাভিটা, দুর্গাপুর, নেত্রকোনা।
- ৬০. চামেলী রেমা, উদ্ধৃতি ‘জানিরা’ ১ম সংখ্যা, পৃ. ২৩১ Ibid. p.70
- ৬১. প্রাগুক্ত।
- ৬২. Playfair, M. A. The Garos, p.74
- ৬৩. Julius, L. R. (Dr.): Garo Customary Law and Practices, Pp.20-21
- ৬৪. Ibid. p.21
- ৬৫. কিবরিয়াউল খালেক, জানিরা, ৩য় সংখ্যা, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী, • বিরিশিরি, নেত্রকোনা, পৃ. ৩০-৩৩।
- ৬৬.০ রেভা, মণীন্দ্র নাথ মারাক, সাং দক্ষিণ ভবানীপুর, ডাকঘর বিরিশিরি, প্রাক্তন সুপারিনটেন্ডেন্ট বিরিশিরি পিটিআই।
- ৬৭. প্রাগুক্ত।
- ৬৮. কেনেসিউস হাগিদক, সেক্রেটারি জেনারেল, ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন, কেন্দ্রীয় কমিটি, ময়মনসিংহ।
- ৬৯. Ibid. p.51, Playfair, M. A.: The Garos, p. 80
- ৭०. Ibid. p.51, Playfair, M. A. The Garos, p. 80
- ৭১. Playfair, M. A. The Garos, p. 80
- ৭২. Ibid. p. 84
- ৭৩. Ibid. p. 88
- ৭৪. Kar, Parimal Chandra: Achik ar A.chik A.song, p. 77
- ৭৫. Rongmuthu, Dewansing: Traditional Dances of the Garos, 1996. p. 34-35
- ৭৬. রবিনস বার্লিং, উদ্ধৃতি জানিরা, ৭ম সংখ্যা, ১৮৬, পৃ. ১০
- ৭৭. প্রাগুক্ত, পৃ. ১০-১১
- ৭৮. প্রাগুক্ত, পৃ. ১১
- ৭৯. রেভা, মনীন্দ্র নাথ মারাক, গ্রাম দক্ষিণ ভবানীপুর, বিরিশিরি, নেত্রকোনা
- ৮০. সারজিয়াস এস. মারাক, গ্রাম দক্ষিণ ভবানীপুর, বিরিশিরি, নেত্রকোনা
- ৮১. Sangma, Milton, History of Educaton in Garo Hills, 1985, p. 2
- ৮২. Ibid. p. 3
- ৮৩. Ibid. p. 7
- ৮৪. Ibid. p. 12
- ৮৫. রেভা, মনীন্দ্র নাথ মারাক, গ্রাম দক্ষিণ ভবানীপুর, বিরিশিরি, নেত্রকোনা
- ৮৬. প্রাগুক্ত।
- ৮৭. Julius, L. R. (Dr) Garo Customary Law and Practices, p. 69
- ৮৮. Rongmuthu, Dewansing: Manianı Bıdık (Skanggıpa Bak), Garo Hills Book Emporium, Tura, 1989
- ৮৯, Ibid.
- ৯০. Julius, L. R. (Dr.): Garo Customary Law and Practices, p. 34
- ৯১. lbid., p.69
- ৯২. Rongmuthu, Dewansing Traditional Dances of the Garos, p. 41-53
- ৯৩. রেভা, মনীন্দ্র নাথ মারাক, আদিবাসী সাংস্কৃতিক উৎসব ২০০৫, পৃ. ১৩
- ৯৪. প্রাগুক্ত।
- ৯৫. প্রাগুক্ত; পৃ. ১২-১৩
- ৯৬. সুভাষ জেংচাম, অংশীদার, ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন, পৃ. ৩২
- ৯৭. প্রাগুক্ত।
- ৯৮ প্রাগুক্ত।
- ৯৯. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩
- ১০০. Julius L. R. Marak: The Garo Customary Laws and Practices, p. 150
- ১০১. Op.cit, p. 151
- ১০২. Op.cit, pp. 151-152
- ১০৩. Op.cit, p.152
- ১০৪. Ibid.
- ১০৫ Ibid.
- ১০৬, Ibid.
- ১০৭, IPDS Report, Uncertain future of Indigenous Peoples in Modhupur (Unpublished).
- ১০৮. Eugene E. (Rev): Homrich,, CSC, St. Paul’s Church, Pirgacha, Tangail, September 5, 1997
- ১০৯. Sattar, Fazlous: Struggle for Survival, Shrabon Prokashoni, Dhaka, 2006, page 74
- ১১০. Ibid., p. 80
- ১১১. lbid., pp. 81-82
- ১১২. Ibid., p. 83
- ১১৩. জেমস জর্ণেশ চিরান, জানিরা, ৭ম সংখ্যা, পৃ. ১১৩-১১৮
- ১১৪. সৃজন সাংমা, জানিরা, ১৯৯৯, পৃ. ৪৩
- ১১৫. প্রতাপ চাম্বুগং, উদ্ধৃতি গারো লোক সাহিত্য ও লোকগীতি সংকলন, তর্পণ ঘাগ্রা (সম্পাদিত), তেইজে ব্রাদার্স, ২০০৮, পৃ. ১৮
- ১১৬. কালীচরণ রাংসা, গ্রাম পূর্ব উৎব্রাইল, বিরিশিরি; রুদেশ মান্দা, গ্রাম বারইপাড়া, ডাক • বিরিশিরি; ফলীন্দ্র রেমা, গ্রাম তেলুঞ্জিয়া, বিরিশিরি, নেত্রকোনা।
- ১১৭. জনিক নকরেক, গ্রাম চুনিয়া, ডাক পীরগাছা, মধুপুর, টাঙ্গাইল।
উৎস ও সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
- ১. Playfair, Major A The Garos, United Publishers, Gauhati, 1995, Reprint.
- ২. Sangma, Mihır N.: Unpublished Documents on Garo Affairs, Scholar Publishing House, New Delhi, 1993
- ৩. Sangma, Dewansing Rongmutu: The Traditional Dances of the Garos, shri Salseng C. Marak, MLA, East Garo Hills, Meghalaya, 1996
- 8. Marak, Julius L. R Garo Customary Laws and Practices, Vendramme Missiological Institute, Shillong, 1985
- ৫. Rongmutu, Dewansing Apasong Agana
- ৬. Burling, Robbins The Strong Women of Modhupur, The University Press Limited, Dhaka, 1997
- ৭. Rongmuthu, Dewansing: Manıanı Bidik (Skanggipa Bak), Garo Hills Book Emporium, Tura, 1989 ৮
- ৮. Dalton, Edward Tuite: Descriptive Ethnology of Bengal, Indial Studies, Calcutta, reprint, 1960
- ৯. Kar, Parimal Chandra (Prof) A.chik aro A.chik A song, Catholic Church, Tura, 1973
- ১০. Sattar, Fazlous: Struggle for Survival, Shrabon Prokashani. Dhaka, 2006
- ১১. Dr Mizanur Rahman, The Garos: Struggling to Survival in the Valley of Death, ELCOP, Dhaka2006
- ১২. সুভাষ জেংচাম বাংলাদেশের গারো সম্প্রদায় (পুনর্মুদ্রণ), রেভারেন্ড ইউজিন হোমরিক সিএসসি, পীরগাছা ক্যাথলিক মিশন, টাঙ্গাইল, ২০০৬
- ১৩. মাহবুবুল হক (সম্পাদিত): জানিরা, ১ম সংখ্যা, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী, বিরিশিরি, ১৯৭৮
- ১৪. মাহবুবুল হক (সম্পাদিত) জানিরা, ২য় সংখ্যা, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী, বিরিশিরি, ১৯৭৯
- ১৫. দাংগ, বিধি পিটার (সম্পাদিত) জানিরা, ৭ম সংখ্যা, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী, বিরিশিরি, ১৯৮৬
- ১৬. সৃজন সাংমা (সম্পাদিত) জানিরা, ১৭তম সংখ্যা, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী, বিরিশিরি, ২০০৬
- ১৭. সৃজন সাংমা (সম্পাদিত) জানিরা, ১৮তম সংখ্যা, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী, বিরিশিরি, ২০০৭
- ১৮. তর্পণ ঘাগ্রা (সম্পাদিত) গারো লোকসাহিত্য ও লোকগীতি সংকলন, তেইজে ব্রাদার্স, ময়মনসিংহ, ২০০৮
- ১৯. সৃজন সাংমা (সম্পাদিত) বার্ষিক আদিবাসী সাংস্কৃতিক উৎসব ২০০৫, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী, বিরিশিরি
- ২০. সৃজন সাংমা (সম্পাদিত) বার্ষিক আদিবাসী সাংস্কৃতিক উৎসব ২০০৬, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী, বিরিশিরি
- ২১. অংশীদার, প্রকাশনা ও মিডিয়া উপকমিটি, ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন, ময়মনসিংহ, ১৯৯৩
সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও আলোচনা
- ১. খামাল টুকিয়া রেমা, গ্রাম পরাভিটা, ডাকঘর বিরিশিরি, জেলা নেত্রকোনা
- ২. খামাল জনিক মৃ, গ্রাম চুনিয়া ডাকঘর পীরগাছা, জেলা টাঙ্গাইল
- ৩. রেভারেন্ড মনীন্দ্র নাথ মারাক, গ্রাম দক্ষিণ ভবানীপুর, ডাকঘর বিরিশিরি, জেলা নেত্রকোনা
- ৪. সারজিয়াস এস, মারাক, গ্রাম দক্ষিণ ভবানীপুর, ডাকঘর বিরিশিরি, জেলা: নেত্রকোনা
- ৫. তর্পণ ঘাগ্রা, গ্রাম বারোমারি, ডাকঘর কালিকাপুর, জেলা: নেত্রকোনা
- ৬. সহিন মৃ, গ্রাম: পীরগাছা, ডাকঘর: পীরগাছা, জেলা: টাঙ্গাইল
- ৭. রেভারেন্ড ক্লেমেন্ট রিছিল, পূর্ব উৎব্রাইল, দুর্গাপুর, নেত্রকোনা
- ৮. কালীচরণ রাংসা, গ্রাম: পূর্ব উৎরাইল, ডাকঘর: বিরিশিরি, জেলা: নেত্রকোনা
- ৯. ফলিন্দ্র রেমা, গ্রাম: তেলুঞ্জিয়া, ডাকঘর: বিরিশিরি, জেলা: নেত্রকোনা
- ১০. রুদেশ মান্দা, গ্রাম: বাড়ইপাড়া, ডাকঘর: বিরিশিরি, জেলা: নেত্রকোনা
Leave a Reply