মিথোলজি #৩: মহাজাগতিক যৌনতা, ডিম, বীজ ও জল

ভূমিকা

সৃষ্টিকাহিনীর (creation myths) নানা ধরন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে একটা বিশেষ প্রসঙ্গ এড়ানো খুবই কঠিন: যৌনতা (sex)। বিশেষত, যৌন প্রজনন (sexual reproduction) অনেক সৃষ্টিকাহিনীতেই অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। অবশ্যই এটি সামান্য অস্বস্তিকর আলোচনা হতে পারে—কিন্তু মানুষ তো এভাবেই জন্মায়! তাই পৌরাণিক গল্পেও যৌনপ্রক্রিয়া রূপক বা সরাসরি আকারে চলে এসেছে।

পৌরাণিক বা মহাজাগতিক যৌনতা (cosmic sexual reproduction) অবশ্য মানুষের যৌনতার মতো সবসময় সরল নয়। কখনো তা অনেক বেশি রূপকধর্মী বা কখনো অনেক অদ্ভুত আঙ্গিকে উপস্থাপিত হয়। এই “অদ্ভুত” কাহিনীগুলোতে জড়িয়ে থাকে দেব-দেবীর কার্যকলাপ, লালাসৃষ্ট স্রোত, বীজ (seeds), ডিম (eggs), সহিংসতা (violence)—আরও কত কী!

আজকের পর্বে আমরা যৌনতার সঙ্গে যুক্ত সৃষ্টিকাহিনী নিয়ে কথা বলব, যার মধ্যে থাকছে মিশরীয় সৃষ্টিতত্ত্ব (Egyptian creation myth), আফ্রিকার (Africa) বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি-আখ্যান, গ্রীক (Greek) পুরাণে অ্যাফ্রোডাইট (Aphrodite)-এর জন্মগাথা, ভারতীয় (Indian) ও পারস্যের (Persian) ডিম-ভিত্তিক সৃষ্টিকাহিনি, আর চীনা (Chinese) পৌরাণিক কাহিনীতে ফ্যান কু (Phan Ku)-র গল্প। এসব কাহিনীতে জলের (water) গুরুত্ব, যৌন রসায়ন, রূপকধর্মী জন্ম-প্রক্রিয়া—সবই মিলেমিশে এক স্বতন্ত্র মহাজাগতিক চিত্র তৈরি করে।

তবে শুরুতেই একটা হালকা সতর্কীকরণ: আজকের বিষয়বস্তু কিছুটা অস্বস্তিকর বা বিচিত্র লাগতে পারে। দেবতারা কীভাবে একা হাতে (কিংবা অন্য ভাবে) বিশ্ব সৃষ্টি করলেন, কীভাবে বীজ বা লালা বা বমি থেকে মহাবিশ্বের জন্ম হলো—এসবই এসেছে মৌখিক ও লিখিত কাহিনীতে। সুতরাং পড়ার সময় মনে রাখতে হবে, এগুলো প্রতীকী (symbolic) কিংবা পৌরাণিক বর্ণনা। চলুন, একে একে খুঁটিনাটি দেখা যাক।

যৌনতা ও সৃষ্টিতত্ত্ব (Sex and Creation Myths)

প্রথমেই বলা দরকার, যৌনতা বা যৌন প্রজনন (sexual reproduction) আমাদের জীববৈচিত্র্যের মূল উপাদান। আমরা সবাই মূলত এই প্রক্রিয়ায় জন্মেছি (যদিও পৌরাণিক চরিত্রদের নিয়ে কিছু ব্যতিক্রমী কাহিনি আছে, যেমন কারো জন্ম দেবতার মাথা ফাটিয়ে বা হাড় থেকে)। তাই ঐতিহাসিকভাবেই মানবসমাজ বুঝতে চেয়েছে: যদি মানুষের জন্ম যৌনতার মধ্য দিয়ে হয়, তাহলে পুরো মহাবিশ্বও কি এ-ভাবে সৃষ্টি হতে পারে?

অনেক পুরাণে দেবতারা নিজেরাই এককভাবে সৃজন করেন—একটি পুরুষ বা স্ত্রী সত্তা থেকে সবকিছু উৎপত্তি পায়। অন্যদিকে, কোনো কোনো গল্পে দেখা যায়, দেবতাদের পারস্পরিক মিলন থেকে পৃথিবী ও জীবজগতের সৃষ্টি ঘটে। কখনো তা রূপকধর্মী, কখনো আবার সরাসরি যৌনক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে।

বীজ (Seeds)

যেহেতু গাছপালা বীজ (seed) থেকে জন্মায়, লাতিন ভাষায় “সীড” শব্দকে “সেমেন (semen)” বলা হয়। একই শব্দ থেকে পুরুষ বীর্যকেও (seminal fluid) “সিড” বা “সেমেন” বলে অভিহিত করা হয়। এই বীজ থেকে কিছু উৎপন্ন হওয়া—এটি অনেক পৌরাণিক কাহিনীতে সৃষ্টির (creation) প্রতীক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে।

যেমন, মিশরীয় (Egyptian) সৃষ্টিতত্ত্বে দেখা যায়, দেবতা নিজ দেহের (কিংবা শরীরের কোনো অংশের) তরল থেকেই নতুন দেবদেবীর জন্ম দিচ্ছেন। এই তরল কখনো লালা, কখনো বমি, কখনো আবার ইঙ্গিতপূর্ণভাবে অন্য কিছু। এগুলোকে একধরনের “সৃজনশীল বীজ” হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

মিশরীয় সৃষ্টিকাহিনি ও দেবতার দেহতরল (Egyptian Creation Myth: God’s Fluid)

মিশরীয় সৃষ্টিকাহিনীর বহু সংস্করণ আছে। এর একটিতে সৃষ্টিকর্তা দেবতা বলেন (অনুবাদ অনুসারে):

“আমি সব আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছি যখন আমি একা ছিলাম, তখনো দ্বিতীয় কেউ আমার পাশে উপস্থিত হয়নি… আমি আদি জলে (primeval waters) ছিলাম নিস্ক্রিয়ভাবে, সেখান থেকেই আমি সৃজনশীল কর্ম শুরু করি… তখনই আমি থুতু (spat) করে ‘শু (Shu)’ ও কফ (expectorate) ফেলে ‘তেফনুট (Tefnut)’-কে সৃষ্টি করি…”

আগের অনুবাদে পরিষ্কার বোঝা যায় না, এটি কী ধরনের রস ছিল। কিছু স্থানে একে লালা (saliva) বলা হয়েছে, আবার অন্যত্র ইঙ্গিত করা হয়েছে অন্য কোনো “দেহতরল।” পরবর্তীতে গল্পে বলা হয়েছে:

“আমি যখন আমার মুষ্টি দিয়ে নিজের শরীর ঘষছিলাম, তখন আমার হৃদয় আমার মুখে চলে আসে, আর আমি সেখান থেকে শু ও তেফনুটকে উদ্গীরণ (spit/expectorate) করি।”

এখানে সরাসরি যৌনক্রিয়ার স্পষ্টতা নেই, তবে “নিজের মুষ্টি দিয়ে ঘষা” ও “আকাঙ্ক্ষা পূরণ”—এসব কথা শুনে বোঝা যায়, একাকী পুরুষ দেবতা কোনোভাবে “সৃজনমূলক তরল” উৎপাদন করেছেন। সেই তরল থেকেই নতুন দুই সত্তা জন্ম নিয়েছে। এটি একধরনের পুরুষকেন্দ্রিক (patrilineal) সৃষ্টিকাহিনি—যেখানে কোনো স্ত্রীদেবীর প্রয়োজনই পড়েনি।

আফ্রিকান সৃষ্টিকাহিনি: বোসঙ্গো বান্তু (African Creation Myth: Boshongo Bantu)

আফ্রিকায় বোসঙ্গো বান্তু (Boshongo Bantu) জনগোষ্ঠীর মধ্যেও আমরা দেখি একক স্রষ্টা পুরুষ আছেন, যিনি নিজের শরীরের বীজ থেকে সবকিছু উদ্গীরণ করেন। এ গল্পে আদি অবস্থা হলো অন্ধকার ও জল:

“আদিতে, অন্ধকারে, কেবল জল ছিল। ‘মবোম্বো (Mbombo)’ তখন একা ছিলেন। একদিন মবোম্বোর প্রচণ্ড যন্ত্রণা হলো। তিনি প্রবল বেদনায় কষ্ট পেলেন এবং বমি (vomited) করে ফেললেন সূর্য (sun)। সূর্য উদিত হলে তার আলো সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সূর্যের উত্তাপে জল শুকিয়ে এলে পৃথিবীর (world) কালো প্রান্ত-প্রান্তে বিচ্ছিন্ন ভূভাগ দেখা দিল। কিন্তু তখনো কোনো জীব ছিল না।

“মবোম্বো এরপর চাঁদ (moon) বমি করলেন, তারপর তারকারাজি (stars)। ফলে রাতেও আলো দেখা গেল। কিন্তু ব্যথা থামল না। তিনি আরেক দফা বমি করলেন, তখন নয়টি জীব (creatures) বেরিয়ে এলো। সবশেষে এল মানুষ (man)।”

এখানেও দেখছি, সৃষ্টিকর্তা একাকী, পুরুষ, এবং নিজ দেহের অভ্যন্তর থেকে আক্ষরিক অর্থে সবকিছু উদ্গীরণ করে তোলেন। একে কেউ কেউ বলে থাকেন পুরুষের সন্তানোৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে একধরনের সাদৃশ্য—যদিও গল্পে এটি বমি। অনেকটা যেন প্রসববেদনার (childbirth pain) মতো—কিন্তু একজন পুরুষ সেই বেদনা বহন করছেন।

গ্রীক সৃষ্টিকাহিনি: অ্যাফ্রোডাইট (Greek Creation: Aphrodite and Violent Castration)

যদি গ্রীক পুরাণের কথা ধরি, সেখানে যৌনতা আর সহিংসতা (violence) প্রায়শই মিলেমিশে থাকে। অ্যাফ্রোডাইট (Aphrodite)-এর জন্মকথা তাঁর রূপ, প্রেম, যৌনতার দেবী হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু এই জন্মগাঁথা রীতিমতো রক্তাক্ত ও ভয়াবহ।

হেসিয়ডের (Hesiod) “থিওগনিতে (Theogony)” আছে:

“মহাবিশ্বের আদি আকাশদেবতা (Great Heaven) এলেন, রাত্রিকে (night) সঙ্গে নিয়ে, প্রেমের (love) বাসনায় পৃথিবীকে (Earth) আচ্ছন্ন করলেন। কিন্তু তাঁর পুত্র ক্রোনোস (Chronos) ওত পেতে ছিল। ক্রোনোস এক হাতে লুকিয়ে রাখল একটি বৃহদায়তন কাস্তে (sickle)। যখন সুযোগ এলো, সে সেই লম্বা ধারালো দাঁতের (sharp teeth) কাস্তে দিয়ে নিজের পিতার যৌনাঙ্গ (genitals) কেটে নিল এবং তা ছুড়ে ফেলে দিল সাগরের (sea) মধ্যে।

“এরপর সেই কাটা অঙ্গ থেকে ঝরা রক্তবিন্দুগুলো (blood drops) পৃথিবীর বুকে পড়ে শক্তিশালী ‘এরিনিয়েস (Erinyes)’ আর বর্মধারী ‘জায়ান্টস (Giants)’ জন্মাল। আর জেনিটালস (genitals) সাগরের ফেনায় (foam) পড়ে যেতে সেখান থেকে সাদা ফেনিল বলয়ে এক কুমারী মূর্তি গঠিত হলো। প্রথমে সে ‘সাইথেরা (Cythera)’ দ্বীপে এল, তারপর সেখান থেকে সমুদ্রবেষ্টিত সাইপ্রাস (Cyprus)। আর সেখান থেকেই আবির্ভূত হলেন এক লজ্জাশীলা ও অনিন্দ্যসুন্দর দেবী। ঘাস তার পায়ের নিচে উঁকি দিতে লাগল। দেব ও মানুষ উভয়েই তাঁকে অ্যাফ্রোডাইট (Aphrodite) বলে ডাকে—কারণ তিনি ফেনা (foam) থেকে জন্মেছেন (‘aphros’ মানে ফেনা)।”

এটি এক ধরণের “যৌনতার জন্ম সহিংসতার ভেতর দিয়ে”—যেখানে পিতার যৌনাঙ্গ কেটে ফেলে দেওয়ার পর, সেই অঙ্গের ফেনিল স্পর্শ থেকে প্রেম, সৌন্দর্য ও যৌনতার দেবী উন্মেষ ঘটালেন। গল্পটি simultaneously ভয়াবহ ও রূপকধর্মী—রক্ত-সহিংসতা থেকে এক অপূর্ব দেবীর জন্ম।

ডিম (Egg)

বীজের (seed) পাশাপাশি ডিম (egg)-ও যৌনতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অনেক পৌরাণিক কাহিনীতে থাকে “কসমিক এগ (cosmic egg)”—এক বিশাল ডিম, যেখান থেকে বিশ্ব সৃষ্টির সূচনা।

ডিম হল আরেক প্রতীকী উপাদান: এটি ভিতরে ভ্রূণ (embryo) নিয়ে রাখে, বাইরে কঠিন খোলস। বেশ কিছু সংস্কৃতিতে এই ডিমকে মহাজাগতিক শূন্যের (void) মধ্যে সৃষ্টির সম্ভাবনা হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। ডিম ভাঙলে অভ্যন্তরে যে প্রাণ বেড়ে ওঠে, সেটাই হয় পৃথিবী বা মহাবিশ্ব।

ভারতীয় সৃষ্টি-ডিম (Indian Creation Myth: Cosmic Egg)

উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে শতপথ ব্রাহ্মণ (Satapatha Brahmana) নামক এক প্রাচীন ভারতীয় (Indian) গ্রন্থ, যেখানে “প্রজাপতি (Prajapati)” নামে স্রষ্টা-সত্তা প্রথমে জল (water) তৈরি করেন, তারপর একটি ডিম সৃষ্টি করেন—যেখান থেকে বিভিন্ন জীব জগৎ প্রস্ফুটিত হয়।

১৯শ শতকের এক অনুবাদে পাওয়া যায়:

“তিনি আকাঙ্ক্ষা করলেন: ‘এই জলের (waters) মধ্য থেকেই যেন আমি পুনরায় (reproduced) জন্ম নিই।’ তিনি সেই জলে প্রবেশ করলেন তাঁর ‘ট্রিপল সায়েন্স (triple science)’ নিয়ে। সেখান থেকেই একটা ডিম (egg) উদ্ভূত হলো। তিনি সেটিকে স্পর্শ করে বললেন, ‘আচ্ছা, এটা থাকুক! আরো জন্মাক, আরো বহুগুণে বাড়ুক!’ তখন থেকেই ব্রাহ্মণ (Brahman) প্রথমে জন্ম নিল।

“এবং ডিমের খোলস হয়ে গেল পৃথিবী (earth)। […] ডিম থেকে নির্গত রস (juice) পরবর্তীতে এক কচ্ছপে (tortoise) পরিণত হলো। [… ] সমস্ত পৃথিবী (earth) নিজেকে জলরাশির ওপরে মেলে ধরল: তখন সবকিছুই একরকম একটি রূপে দেখা দিল—জল (water)।”

এখানে দেখা যাচ্ছে, একদিকে জল, অন্যদিকে ডিম থেকে জন্ম হওয়ার ধারণা, পাশাপাশি খোলস হয়ে উঠল পৃথিবী, নির্গত কিছু রস পরিণত হলো কচ্ছপে—এসবই খুব রহস্যময় ও প্রতীকধর্মী। আবার শেষে সব মিলেমিশে আবারও জল! এসবই রীতিমতো গোলকধাঁধার মতো—কিন্তু পুরাণ তো এমনই।

“ট্রিপল সায়েন্স” (triple science) কী, তা স্পষ্ট নয়—কেউ বলেন এটি হয়তো কোনো আধ্যাত্মিক জ্ঞান বা বেদমন্ত্রের (Vedic knowledge) সূক্ষ্ম রূপ। ঐতিহাসিকভাবেই আমরা বুঝতে পারি, জল (water) থেকেই ডিমের জন্ম, ডিম থেকে নানা কিছু বেরিয়ে এলো—আর সেই পৃথিবী বা মহাবিশ্ব উভয়ই আবার জলের অংশ হয়ে রইল।

পারস্যের সৃষ্টিকাহিনি (Persian Creation Myth)

প্রাচীন পারস্যের (Persian) এক সৃষ্টিকাহিনীতেও কসমিক এগের (cosmic egg) কথা রয়েছে। এখানে আবার সেই জলের (water) উপস্থিতি দেখাও মেলে। এই পৌরাণিক ধারা অনেকাংশে “জরথুষ্ট্রীয় (Zoroastrian)” মতবাদের সঙ্গে জড়িত, যেখানে দুই বিপরীত শক্তি একে অপরের বিপরীতে অবস্থান করে:

  • একদিকে আছেন অদ্বিতীয় “আহুরা মাযদা (Ahura Mazda),” যাকে বলা হয় ‘ভালোর দেবতা (god of good)’।
  • অন্যদিকে আছেন “আংগ্রা মেইনিউ (Angra Mainyu)” বা “আহ্রিমান (Ahriman),” যিনি মন্দের (evil) প্রতীক।

গল্পে বলা হয়, আহুরা মাযদা প্রথমে এক নিখুঁত আধ্যাত্মিক বিশ্ব তৈরি করেন। কিন্তু এ বিশ্ব দেখে আহ্রিমান এতটাই ক্রুদ্ধ হলেন যে, তিনি মহাজাগতিক ডিম ভেদ করে (burst through the cosmic egg) প্রবেশ করেন এবং বিশ্বে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। এর ফলে সূর্য (sun) আকাশে ঘূর্ণায়মান হতে শুরু করে (আগে নাকি সূর্য থেমে ছিল!), দিন-রাত্রি (day-night) ও পাহাড়-খাদ ইত্যাদির সৃষ্টি হয়। ফলে নিখুঁত দুনিয়া আর নিখুঁত রইল না—মানুষের জীবনে এলো পরিশ্রম, যন্ত্রণা, মৃত্যু।

এখানেও ডিম ফেটে যাচ্ছে এবং তাতে একধরনের বিপরীতধর্মী শক্তির (duality) সম্মুখীন হচ্ছে বিশ্ব। এক নিখুঁত সৃষ্টিতে দুষ্ট শক্তির সংযোগ ঘটলে বাস্তব পৃথিবীর হাহাকার, কষ্ট, পরিশ্রম—সবই শুরু হয়।

মহাজাগতিক ডিম ও দুই শক্তির দ্বৈরথ (Creation Myth with Dualities)

উপরে পারস্যের গল্পে দুই বিপরীত শক্তির কথা এসেছে। ডিম ভেঙে যাওয়ার ফলে দুই বিপরীত ধারা পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়ায়। “ডিম ভেঙে মহাবিশ্ব তৈরি”—এই মোটিফ স্বাভাবিকভাবেই জড়িয়ে আছে বিপরীতধর্মী শক্তির সম্মিলন বা সংঘাতের সঙ্গে। ডিম না ভাঙলে অমলেট হয় না!, সেই রকমই পুরাণ মতে ব্রহ্মাণ্ডের জন্মও যেন ডিম ভাঙার সঙ্গে যুক্ত।

কৌতুক করে কেউ কেউ বলেন, “মহাবিশ্ব তৈরি করতে গেলে কয়েকটা কসমিক এগ (cosmic eggs) ভাঙতে হবেই!” কিন্তু “কসমিক এগ-ই” কেন, অন্য কোন খাবার নয় কেন? কারণ এগুলো সম্ভবত পরবর্তী মানুষের কল্পনা; প্রাচীন লোকরা ডিমকে একমাত্রিক জন্ম-রূপক হিসেবে দেখেছে, বেকন-টেকন নয়!

চীনা সৃষ্টিকাহিনি: ফ্যান কু (Chinese Creation Myth: Phan Ku)

চীনা পুরাণে (Chinese myth) “ফ্যান কু (Phan Ku)” বা “পানগু (Pangu)” নামের এক সৃষ্টিকর্তা/দৈত্য-সত্তা আছেন, যার জন্ম এক মহাজাগতিক ডিমের ভেতর থেকে। এখানে আবারো আমরা পেলাম ডিম (egg), জল (water), অন্ধকার-আলো, পুরুষ-নারী, ঠাণ্ডা-গরম ইত্যাদি দ্বৈত শক্তির (yin-yang) কথা।

গল্প অনুযায়ী:

“আদিতে ছিল এক বিশাল ডিম, যার মধ্যে ছিল বিশৃঙ্খলা (Chaos)—একটি মিশ্রণ: ই Yin (নারীত্ব, শীতলতা, অন্ধকার, ভেজা) এবং Yang (পুরুষত্ব, উত্তাপ, আলো, শুকনো)। এই ডিমের মধ্যেই ছিল ফ্যান কু, যে তখনো পূর্ণতা পায়নি। ডিম ফেটে বেরিয়ে এলো এক বিরাট দৈত্যাকৃতি সত্তা, সে বিশৃঙ্খলাকে (chaos) ভেঙে পৃথিবী ও আকাশ সহ নানান বিপরীত সত্তায় পরিণত করল।”

“ফ্যান কুর দেহ ছিল লোমে আচ্ছন্ন; মাথায় শিঙ (horns) ও মুখে দাঁত (tusks) গজিয়েছিল। হাতে ছিল বিশাল হাতুড়ি (mallet) আর খোদাই করার চিসেল (chisel), যেগুলো দিয়ে সে পাহাড়, উপত্যকা, নদী, সাগর তৈরি করল। তারপর সূর্য, চাঁদ, তারা বানাল। মানুষকে নানা বিদ্যা শেখাল।”

“ফ্যান কু অবশেষে মারা গেলে, তার মাথার খুলি (skull) হয়ে গেল আকাশের চূড়া, নিঃশ্বাস (breath) হয়ে গেল হাওয়া (wind), কণ্ঠস্বর (voice) হয়ে গেল বজ্রধ্বনি (thunder), তার হাত-পা হয়ে গেল চার দিক (four directions), তার রক্ত (blood) নদী (rivers), আর তার লোম (hair) থেকে জন্ম নিল বনাঞ্চল, গাছপালা। এমনকি তার চুলের উকুন (fleas) থেকে নাকি মানুষের (human beings) উদ্ভব ঘটল।”

“ফ্যান কুর মৃত্যুর পর সেই স্থানটিতে শূন্যতা (vacuum) তৈরি হয়, যা দুঃখ-দুর্দশা ও পাপ (pain and sin) বিস্তার করতে অনুকূল পরিবেশ দিল। আদিতে ছিল বিশৃঙ্খলা (Chaos)–যেখান থেকে আলো হয়ে গেল আকাশ, আর অন্ধকার হলো পৃথিবী। এই অন্ধকার-আলোতে (yin-yang) সবকিছু গড়ে উঠল।”

এখানে ডিম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে একটি দুমুখী শক্তির বিচ্ছেদ দেখা যায়—ইয়িন ও ইয়াং (yin-yang)। এই পুরাণে স্রষ্টা বলতে একজন দৈত্য, যার দেহ খণ্ড হয়ে সৃষ্টির উপাদান হলো, অনেকটা অন্য কিছু পুরাণে দেখা “দেহবিভক্তি”-র (divine dismemberment) মতো। যেমন, ভারতীয় পুরাণে পুরুষ (Purusha) নামের সত্তাকেও খণ্ডিত করে ব্রহ্মাণ্ডের নানা অংশ তৈরি হয়।

দ্বৈততার গুরুত্ব ও বিশ্ব-অভিভাবক (Duality and World-Parent Myths)

চীনা কাহিনীর এই ডিম-কেন্দ্রিক গল্পকে অনেকে “ওয়ার্ল্ড-প্যারেন্ট (world-parent)” মিথের একটি ধরন বলে থাকেন। মানে, এখানে স্রষ্টা সত্তা নিজের থেকেই জন্ম দেওয়া বা খণ্ডিত হওয়ার মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ তৈরি করেন। এটি সরাসরি যৌন প্রজনন না-হলেও, একধরনের “মাতৃ-বা পিতৃ-সত্তা” যিনি নিজ অঙ্গ বা নিজ সত্তা বিলিয়ে বিশ্বের উপাদান তৈরি করেন।

অনেক সময় এই ওয়ার্ল্ড-প্যারেন্ট ধারণায় স্রষ্টা একাকী বা কোনো সঙ্গীর সঙ্গে মিলিত হয়ে জন্ম দেন জীবজগৎকে। অন্য কোনো গল্পে দেখা যায়, স্রষ্টা তার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বিভক্ত করে ধরণী, আকাশ, মানুষ ইত্যাদি গড়ে তোলেন।

ভারতীয় পুরাণে “পুরুষ (Purusha)” নামে এক মহাশক্তিকে এইভাবেই চতুর্ভাগে ভাগ করে মানুষ, দেবতা, গাছপালা ইত্যাদির জন্ম দেওয়া হয়েছে (যেমন ঋগ্বেদে (Rigveda) পুরুষসূক্ত)। চীনা পুরাণে ফ্যান কুর মৃত্যু-পরবর্তী দেহাংশ থেকে সৃষ্টির বর্ণনা অনেকটা একই ছাঁচে গড়া।

রূপকধর্মী ব্যাখ্যা ও সাধারণ মিল (Symbolic Interpretations and Commonalities)

এই নানা সৃষ্টিকাহিনীতে বেশ কিছু সাধারণ সুতো (common threads) পাওয়া যায়। যেমন:

  1. জল (water): বহু পুরাণে মহাবিশ্বের শুরুতে জলই ছিল প্রধান উপাদান। হয় বন্যা, কিংবা বিস্তীর্ণ জলরাশি, অথবা আদি সমুদ্র (primeval waters) থেকে কোনো ডিম বা দেবতার উত্থান।
  2. শূন্যতা ও বিশৃঙ্খলা (void and chaos): সৃষ্টির আগে নিয়মবিহীন বা অবিন্যস্ত একটা অবস্থা ছিল। একে কখনো “কেওস (Chaos)” বলা হয়, কখনো নির্জন জল, কখনো নিরব অন্ধকার।
  3. ডিম (egg) বা বীজ (seed): নতুন সৃষ্টির ধারণায় ডিম ও বীজ বারবার ফিরে আসে। এরা অন্তর্গতভাবে সম্ভাবনা ধারণ করে—ডিম ভেঙে বা বীজ অঙ্কুরিত হয়ে জীব ও বিশ্ব বেরিয়ে আসে।
  4. একক স্রষ্টা পুরুষ (solitary male) বা ওয়ার্ল্ড-প্যারেন্ট: মিশরীয় গল্পে একক পুরুষ দেবতা থুতু বা বীর্যসদৃশ তরল সৃষ্টি করে নতুন দেবতাদের জন্ম দেন, আফ্রিকান গল্পে পুরুষ দেবতা বমি করে সূর্য, চাঁদ, মানুষ সৃষ্টি করেন, কিংবা চীনা গল্পে দৈত্য ফ্যান কুর দেহ ভেঙে সবকিছুর উন্মেষ ঘটে।
  5. যোগাযোগ বা যৌনতার রূপক (sexual or semi-sexual elements): কেউ একাকী “ইচ্ছাপূরণ” করছেন, কেউ বা থুতু, বমি, রক্ত, এমনকি কাটা যৌনাঙ্গ—এসব তরল বা অঙ্গ থেকেই সৃষ্টির সূত্রপাত। এটি একধরনের রূপক, যেখানে যৌনতার মূল উপাদান—উৎপাদন ক্ষমতা (fertility)—কে প্রতীকীভাবে দেখানো হয়েছে।
  6. সহিংসতা ও যন্ত্রণা (violence and pain): গ্রীক পুরাণে পিতাকে অন্যায়ভাবে নির্যাতন করে তার যৌনাঙ্গ কেটে ফেলা, কিংবা আফ্রিকান গল্পে স্রষ্টার বেদনাদায়ক বমি—এসবই একধরনের যন্ত্রণা বা সহিংসতার মধ্য দিয়ে নতুন জীবের জন্মের গল্পকেই প্রকাশ করে, অনেকটা মানব-প্রসবের বেদনার প্রতীক।

যৌনতাত্ত্বিক পাঠ বনাম রূপকধর্মী পাঠ (Sexual vs. Metaphorical Interpretation)

কেউ কেউ এ ধরনের পৌরাণিক কাহিনীতে “অতি-যৌনতাত্ত্বিক” ব্যাখ্যা খোঁজার বিরুদ্ধে সরব হন—ভাবেন, আমরা কি এ-সব গল্পকে “অশ্লীল” দৃষ্টিতে পড়ছি? আবার অন্য পক্ষ বলেন, এই গল্পগুলোর কেন্দ্রে যৌনতার ইশারা খুবই স্পষ্ট, আমরা তা এড়াতে পারি না।

মূলত, যৌনতা (sex) ও প্রজনন (reproduction) জীবনের খুব মৌলিক অংশ। স্বাভাবিকভাবেই, মানবসমাজ বিশ্বের উৎপত্তিকে তার পরিচিত ধারায় ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে। তাই দেবতাদের “দেহতরল” (bodily fluid) থেকে সৃষ্টি, কিংবা “কেটে ফেলা যৌনাঙ্গের রক্তে” নতুন সত্তার জন্ম—এসবই একধরনের প্রতীকী বিশ্লেষণ।

উপসংহার

এখন পর্যন্ত আমরা দেখেছি নানা সৃষ্টিকাহিনি—যেখানে যৌনতা কখনো সরাসরি, কখনো বীজ বা ডিমের রূপকে, কখনো সহিংসতার সঙ্গে মিলেমিশে, আবার কখনো একাকী বা দ্বৈত স্রষ্টার কার্যকলাপের মাধ্যমে ব্যাখ্যা হয়েছে। গ্রিক পুরাণে (Greek myth) ক্রোনোস পিতার যৌনাঙ্গ কেটে ফেলে সাগরে ফেলে দেয়ার পর সেখান থেকে জন্ম হয় অ্যাফ্রোডাইটের—যৌনতার দেবীর। মিশরীয় পুরাণে (Egyptian myth) দেবতা একাকী সন্তুষ্ট হয়ে নিজের লালা বা অন্য দেহতরল উদ্গীরণ করে নতুন দেবতাদের জন্ম দিচ্ছেন। আফ্রিকান বোসঙ্গো বান্তু (Boshongo Bantu) গল্পে পুরুষ স্রষ্টা বমি করে সূর্য, চাঁদ, তারকা ও মানুষ আনলেন। ভারতীয় ও পারস্যের পুরাণে (Indian and Persian myths) মহাজাগতিক ডিম ফেটে বা ভেঙে বেরিয়ে এলো পৃথিবী। চীনা পুরাণে (Chinese myth) ফ্যান কু ডিম থেকে বেরিয়ে বিশৃঙ্খলা ভেঙে আকাশ-মাটি আলাদা করলেন; মৃত্যুর পর তাঁর দেহ থেকেই পৃথিবীর উপাদান গড়ে উঠল।

এসব পৌরাণিক কাহিনীর এক বিশাল কমন থিম হলো জল, ডিম, শূন্যতা, একাকী বা যৌথ সৃজন, দ্বৈততা (yin-yang), আর আদি শক্তির সহিংস বা অদ্ভুত প্রকাশ। এগুলো একদিকে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের পরিচয় দেয়, অন্যদিকে দেখায় মানুষ সার্বজনীনভাবে কিভাবে পৃথিবী-সৃষ্টি আর প্রাণের উত্স নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করেছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা বৈজ্ঞানিক (scientific) কোণ থেকে মহাবিশ্বের জন্ম (Big Bang) নিয়ে ব্যাখ্যা পেয়েছি, কিন্তু প্রাচীনকালের মানুষ এইসব পৌরাণিক কাহিনীর মাধ্যমেই তাদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে—“আমি কোথা থেকে এলাম?”, “পৃথিবীর জন্ম কীভাবে হলো?”, “জীবের উৎপত্তি কোথায়?” ইত্যাদি।

এগুলোকে একেবারে আক্ষরিক অর্থে না নিয়ে, বরং প্রতীকী ও সাংস্কৃতিক দলিল হিসেবে পড়লে দেখতে পাই, যৌনতা (sex), বীজ (seed), ডিম (egg), জল (water), রক্ত, লালা, বমি—এসবই মানুষের জন্ম, মৃতু্য, সৃষ্টি ও ধ্বংসচক্রের (creation-destruction cycle) গভীর উপলব্ধিকে রূপায়িত করছে।

অবশেষে, এ কথাই বলা যায় যে, এই পৌরাণিক গল্পগুলো আমাদের শেখায়—সৃষ্টি (creation) কোনো সরল বিষয় নয়, বরং অজস্র রূপক, প্রতীকী ব্যাখ্যা আর সাংস্কৃতিক উপকথার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক মহাজাগতিক কোলাজ (cosmic collage)। কখনো তা সুন্দর, কখনো রক্তাক্ত, কখনো অদ্ভুতভাবে হাস্যরসাত্মক—কিন্তু সবকটিতেই পৃথিবী ও প্রাণের উৎপত্তিকে একধরনের “অলৌকিক ও ঘটনাবহুল” প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়েছে।

এভাবেই বিশ্বজুড়ে নানা সম্প্রদায়ের সৃষ্টিকাহিনি আমাদের জানায়—যৌনতা আর সৃষ্টির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মানুষের ধারণায় চিরকালের মতো গেঁথে আছে। তা সে বমি, থুতু, রক্ত, বা ডিম—সবকিছুতেই জীবন উদিত হওয়ার সম্ভাবনা নানাভাবে রূপায়িত।

তথ্যসূত্র

  • The World of Myth: An Anthology by David Leeming – https://www.amazon.com/World-Myth-David-Adams-Leeming/dp/1522694676
  • Satapatha Brahmana Part III (SBE41) translated by Julius Eggeling – http://sacred-texts.com/hin/sbr/sbe41/sbe4128.htm

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.