মিথোলজি #২: শূন্যতা থেকে সৃষ্টি

Table of Contents

ভূমিকা

আজ আমরা মিথোলজি (mythology) নিয়ে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় আসছি, যার মূল বিষয় হলো মহাবিশ্ব (Universe) সৃষ্টির গল্প—বিশেষত সেইসব গল্প যেখানে বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে একেবারে ‘শূন্য’ থেকে বা সম্ভবত কোনো এক আদিম পদার্থ থেকে। অনেক সৃষ্টিকাহিনীতে (creation myths) দেখা যায়, এই শূন্যতা (void) কখনো এক বিশাল জলরাশি (primordial water), কখনো বা নিখাদ অন্ধকার। আজকের আলোচনা এই “শূন্য থেকে সৃষ্টি” বা “এক্স নিহিলো (ex nihilo)” কাহিনীগুলোকে কেন্দ্র করে।

অনেকেই এই ধারণাকে একটু ভীতিজনক বলে মনে করেন, কারণ এতে সময় নেই, স্থান নেই—যেন হঠাৎ করেই সবকিছু শূন্যে মিলিয়ে গেছে। কিছুটা আজকের যুগে ইন্টারনেট বা ওয়াই-ফাই (Wi-Fi) বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুহূর্তকে এর সাথে একটু তুলনা করা যায় :p কিন্তু সেটি তো সামান্য বিষয়; আর এখানে কথা হচ্ছে এমন একটা পরিস্থিতির যেখানে একেবারে মহাবিশ্বের অস্তিত্বই নেই—নেই কোন দৃশ্যমান বস্তুর ছিটেফোঁটাও। ভাবুন তো, এক বিস্তীর্ণ শূন্যতায় কেবল নিজে রয়েছেন—এই মানসিক দৃশ্য বহু মানুষের মধ্যেই চরম অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে।

আজকের নিবন্ধে আমরা বেশ কয়েকটি সৃষ্টিকাহিনীর দিকে নজর রাখব যা এই শূন্যতা থেকে সৃষ্টির (creation from nothing) ধারণাকে ব্যাখ্যা করে। কেবল বাইবেল (Bible)-এর আদিপুস্তক (Book of Genesis) নয়, বরং মিশরীয় (Egyptian) পৌরাণিক কাহিনি, গ্রীক (Greek) কবি হেসিয়ডের (Hesiod) বর্ণনা, আফ্রিকার (Africa) কনো (Kono) জনগোষ্ঠীর গল্প, মায়া (Maya) জাতির পপুল ভুহ (Popul Vuh) ইত্যাদি—সবখানেই পাওয়া যায় একই ধরনের মূল কাঠামো, যদিও আঙ্গিক ও পরিবেশে কিছু পার্থক্য আছে। এমনকি আধুনিক মহাবিশ্বতত্ত্বের (cosmology) বিগ ব্যাং (Big Bang) তত্ত্বকেও কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ একটি ‘মিথ’ আখ্যা দিয়ে থাকেন—অবশ্যই ধর্মীয় মিথের মতো নয়, বরং একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী ও টিকে থাকা “উৎপত্তিকাহিনি” হিসেবে।

চলুন, শুরু করা যাক।

শূন্য থেকে সৃষ্টির ধারণা (Ex Nihilo Creation)

“এক্স নিহিলো (ex nihilo)”—লাতিন ভাষায় এই শব্দবন্ধের মানে “শূন্য থেকে (from nothing)।” এটি এমন এক সৃষ্টিবাদী ধারণা যা বলে, মহাবিশ্বের উৎপত্তির আগে কিছুই ছিল না—সময় ছিল না, স্থান ছিল না, কেবল খালি শূন্যতা (void) বা বিশৃঙ্খলা (chaos)। অনেকে এই ধারণায় প্রবল অস্বস্তি অনুভব করেন, কারণ একেবারে “কিছুই নেই” কল্পনা করা আমাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।

অবশ্য আধুনিক যুগে, হঠাৎ করে ওয়াই-ফাই বন্ধ হয়ে যাওয়া বা বড় কোনো প্রযুক্তি-ব্যর্থতাকে (technology failure) আমরা অন্ধকারের সঙ্গে তুলনা করি, কিন্তু সেটাও তুলনায় খুবই সামান্য। গ্রীক পুরাণে (Greek myth) হেফাইস্টাস (Hephaestus) হলেন প্রযুক্তির দেবতা (Greek god of technology) যিনি যন্ত্রপাতি ও লোহা-লক্কর নিয়ে কাজ করতেন। সেখানে তাকে এ নিয়ে কৌতুক করতে দেখা যেতে পারে, কিন্তু মহাজাগতিক শূন্যতার ভয় তার চেয়েও জটিল।

বাইবেলের আদিপুস্তকে (Book of Genesis) শূন্য থেকে সৃষ্টি

পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে প্রচলিত এক্স নিহিলো উদাহরণ সম্ভবত বাইবেলের আদিপুস্তকে পাওয়া যায়, যেখানে লেখা আছে:

“আদিতে ঈশ্বর (God) স্বর্গ ও পৃথিবী সৃষ্টি করলেন। তখন পৃথিবী ছিল শূন্য ও নিরাবয়ব; অন্ধকার ছিল গভীরের ওপর, আর ঈশ্বরের আত্মা জলের ওপর বিরাজ করছিল।”

এই গল্পে কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেন ঈশ্বর—তিনি ঠিক কোথায় ছিলেন, সে বিষয়ে পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই, তবে শূন্যতা (void) ও জল (water) বিদ্যমান ছিল। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে: শূন্য থাকলে এই জল আবার কোথা থেকে এলো? কিন্তু সৃষ্টিকাহিনীর এই ধরনেই দেখা যায় যে, শূন্যতার সঙ্গেই কোনোভাবে জলও প্রায়শই যুক্ত থাকে—হয়তো এটি আদিম জল (primordial water), যা সৃষ্টির আগেই ছিল।

ধর্মীয় ও আধুনিক কাঠামো একসঙ্গে মিশে না ফেলতে সতর্ক থাকতেই হয়। আমরা এখানে পৌরাণিক রূপে এসব ব্যাখ্যা করছি, যাতে গল্পের কাঠামো ও বর্ণনার শৈলী স্পষ্ট হয়। প্রতিটি পৌরাণিক গল্পকে একধরনের সাহিত্যকর্ম হিসেবেই নেওয়া হচ্ছে।

প্রাচীন নিকটপ্রাচ্য ও মিশরীয় সৃষ্টিতত্ত্ব (Ancient Near East & Egyptian Creation Myths)

এক্স নিহিলো (ex nihilo) গল্পগুলো ঐতিহাসিকভাবে প্রাচীন নিকটপ্রাচ্যে (Near East) খুবই জনপ্রিয় ছিল, সেখান থেকেই ইহুদি (Judaism), খ্রিস্টান (Christianity) ও ইসলামিক (Islam) বিশ্বাসের শিকড় গড়ে উঠেছে। একই অঞ্চলের অন্তর্গত ছিল প্রাচীন মিশরও।

মিশরীয় পৌরাণিক কাহিনীতে আমরা দেখি, কিছু সৃষ্টিতত্ত্বে মহাবিশ্বও জন্ম নিয়েছে একেবারে কিছু না থেকে বা নিখাদ শূন্য অবস্থা থেকে। এক খণ্ড লেখা থেকে জানা যায়:

“আমি চিরন্তন আত্মা (eternal spirit), আমি সেই সূর্য (sun) যা উঠে এসেছিল আদিম জলের (primeval waters) ভেতর থেকে। আমার আত্মাই ঈশ্বর (God)। আমি স্রষ্টা (creator) এই বিশ্ববাক্যের (the word)। অশুভ আমার ঘৃণা, আমি তা দেখি না। আমি সেই সৃষ্ট জীববিন্যাসের (order) স্রষ্টা, যার মাঝে আমি বাস করি। আমি বাক্য (the word), যা কখনো বিনাশ হবে না, এই আমার ‘আত্মা’ নামের মাহাত্ম্যে।”

যদি প্রথম পুরুষ (first person) ও ঈশ্বরের দৃঢ় দাবিগুলো সরিয়ে রাখা হয়, তাহলে আদিপুস্তকের সৃষ্টিকাহিনীর সাথে এর যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে এক চিরন্তন সত্তা বা ঈশ্বর আগে থেকেই আছেন; আবার জলও (water) আছে। মিশরে এই আদি জল থেকে সূর্য (sun) উঠে আসে, আর বাইবেলে আলো (light) ও পৃথিবী (Earth) সৃষ্টি হয়।

শূন্যতা ও বিশৃঙ্খলা: কেওস (Chaos) ধারণা

অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, “শূন্যতা কি সত্যিই কিছু না, নাকি সেটি কোনো বিশেষ অবস্থা?” এখানে মিথতত্ত্ববিদ ডেভিড লিমিং (David Leeming) “কেওস (chaos)” শব্দটি ব্যবহার করে বুঝিয়েছেন, এটি হলো “এক আদিম শূন্যতা বা অবিভক্ত অবস্থা (state of uniform nondifferentiation), যা বিশ্বের সৃষ্টির আগে বিরাজ করছিল।”

গ্রিকরা (Greek) এই শব্দের ব্যবহার করেছে হেসিয়ডের (Hesiod) “থিওগনি (The Theogony)”তে। সেখানে আমরা পাই:

“নিশ্চয়ই প্রথমে কেওস (Chaos) এসেছিল, তারপর এল বিস্তৃত বক্ষে ধরিত্রী (Earth)।”

কোনো এক দেবতা বা একদল দেবতা (deities) এসে পরে এই বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে নিয়ম বা শৃঙ্খলা (order) গড়ে তোলেন।

অনেক সৃষ্টিতত্ত্বে অন্ধকার (darkness) থেকে আলো (light) নিয়ে আসাই সৃষ্টির মূল চালিকাশক্তি। উদাহরণস্বরূপ, বাইবেলীয় আদিপুস্তকের মতো অন্যান্য সংস্কৃতিতেও এই আলো আনয়ন (bringing forth light) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আফ্রিকার কনো (Kono) জনগোষ্ঠীর গল্প (Kono Myth of Guinea)

আফ্রিকার গিনি (Guinea)-র কনো জনগোষ্ঠীর এক সৃষ্টিকাহিনীতে অন্ধকার ও শূন্যতার মধ্যে মূল বাসিন্দা হলেন মৃত্যু (Death), যাকে তারা ‘Sa’ বলে। গল্পটি এ রকম:

“শুরুতে ছিল অন্ধকার (darkness)। আর তাতে বাস করত মৃত্যু (Death), যাকে তারা ‘Sa’ বলে, সাথে ছিল তার স্ত্রী ও কন্যা। এর বাইরে আর কিছু ছিল না। কোনো জায়গা ছিল না যেখানে স্বস্তিতে থাকা যায়। তখন Sa তার জাদুশক্তি ব্যবহার করে অফুরন্ত এক কাদার (mud) সাগর তৈরি করল। সেখানেই সে একটি বাড়ি বানাল। তারপর ঈশ্বর আলাতানগানা (Alatangana) এলেন সেই ঘর দেখতে। তিনি দেখলেন, ঘরটি খুব অন্ধকার এবং অপরিচ্ছন্ন। বললেন, ‘এখানে কিছুই ঠিকমতো থাকতে পারবে না; সবকিছুই খুব অন্ধকার।’ আলাতানগানা ভাবলেন, তাঁকেই কিছু একটা করতে হবে। তাই তিনি সেই কাদাকে শক্ত করলেন—যা আমরা এখন পৃথিবী (Earth) বলে জানি। তারপর বললেন, ‘পৃথিবী খুব বিষণ্ন মনে হচ্ছে। আমি এর ওপর উদ্ভিদ ও প্রাণী (plants and animals) সৃষ্টি করব।’ কথা মতই তিনি তাই করলেন।”

এই গল্পে আমরা একই সঙ্গে পাই কাদার সাগর (mud sea) ও অন্ধকারকে, আবার বাইরের কোনো দেবসত্তা (god) এসে তাকে পরিবর্তন করেন। প্রাচীন মিশরীয় গল্পের সঙ্গে এ মিল আছে—দুটি গল্পেই আদি জল বা কাদার সাগর আর এক সৃষ্টিকর্তা আছেন। তবে কনো গল্পে মৃত্যুকেই (Death) প্রথম ও নিশ্চিত অস্তিত্ব হিসেবে উপস্থিত করা হয়েছে, যা একটু ভিন্নতর ও অস্বস্তিকর।

জলের উপস্থিতি: শূন্যতা থেকে গতি (Primordial Water and Cosmic Motion)

অনেক প্রাচীন সৃষ্টিতত্ত্বে জলকে এক অনন্ত উপাদান হিসেবে ধরা হয়। কেন? কারণ যদি আপনি কোনো প্রাচীন সমাজের মানুষ হন, তাহলে সবচেয়ে বিশাল ও রহস্যময় যে জিনিস আপনি দেখতে পান, তা হলো আকাশ (sky) আর সমুদ্র (sea)। সমুদ্রের স্থায়িত্ব ও অনন্ততা, এর সীমাহীন ঢেউ, গভীরতা—এইসব দেখে সহজেই ধারণা হতে পারে যে, এটি হয়তো সময়ের আগেও ছিল কিংবা পৃথিবী সৃষ্টির আগেও বিরাজ করেছিল। বিজ্ঞান যেমন বলে—প্রাণ (life) এসেছে জলের (water) মধ্য থেকে, সেসব প্রাচীন ধারণার সঙ্গে একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

মায়া জনগোষ্ঠী ও পপুল ভুহ (Maya of Guatemala: The Popul Vuh)

পশ্চিম গোলার্ধেও শূন্য থেকে সৃষ্টির ধারণা বিদ্যমান। গুয়াতেমালার (Guatemala) মায়া (Maya) জনগোষ্ঠীর পপুল ভুহ (Popul Vuh) বা “The Book of the Community” নামের গ্রন্থে এই সৃষ্টিকাহিনি রয়েছে। এখানে সৃষ্টি মোট চারবার ঘটেছে বলে উল্লেখ আছে। তবে শুরুটা হয় “শব্দ (the Word)” দিয়ে, ঠিক যেমন বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে (New Testament) “In the beginning was the Word” বলে বলা হয় বা আমরা যেভাবে আদিপুস্তকে “ঈশ্বর কথা বললেন” বিষয়টিকে দেখি।

পপুল ভুহ-এর ভাষ্য থেকে জানা যায়:

“বিশাল প্রাচীনকালে, কিচে (Quiché) নামে এক স্থানে কাউকে দেখা যেত না। কোনো প্রাণী, পাখি (bird), মাছ (fish), বা গাছ (tree)—কিছুই ছিল না। পাথর, বন, উপত্যকা, তৃণভূমি—কিছুই ছিল না। শুধু আকাশ ছিল, আর তখনো পৃথিবীর মুখ অদৃশ্য ছিল। শব্দহীন সেই পরিস্থিতিতে শুধু ছিল সমুদ্র (sea), শান্ত ও নিঃসঙ্গ। ছিল অন্ধকার, ছিল রাত, আর ছিল জলের গুঞ্জরণ। কিন্তু এই অন্ধকার ও রাতের ভেতর, এই সাগরের গর্জনের মধ্যে, ছিল সৃষ্টিকর্তা (the Maker) আর পালক ঢাকা সাপ (the Feathered Serpent)। তারা তাদের ভাবনা ও কথা একত্র করল, পরিকল্পনা করল সৃষ্টির। তাদের চিন্তা এতটাই স্পষ্ট ছিল যে, যা কিছু বলল, তা-ই বাস্তবায়িত হয়ে উঠল। প্রথমে তারা পৃথিবীর উদয় ঘটাল, তারপর পাহাড়-পর্বত, গাছপালা। এরপর এল বন্যপ্রাণী (wild animals)। কিন্তু সমস্যা হলো, এই প্রাণীগুলো সৃষ্টিকর্তাদের নাম উচ্চারণ বা প্রশংসা করতে পারছিল না। ফলে একে ব্যর্থ সৃষ্টি বলে গণ্য করা হলো। তারপর সৃষ্টিকর্তারা আবার শুরু করলেন—সৃষ্টি ২.০, ৩.০… এভাবে মোট চারবার।”

এই গল্পে দৃষ্টান্তমূলক বিষয় হলো, পপুল ভুহ-এও শূন্যতা (nothingness) থেকে সবকিছু তৈরি হয়, কিন্তু সেই শূন্যতার মধ্যে ছিল “শব্দ (Word)” ও চিন্তা। অনেকটা বাইবেলের আদিপুস্তকে ঈশ্বর “আলো হোক” বলার মতো কিংবা যেভাবে আদম (Adam) সব প্রাণীর নামকরণ করে তাদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে, সেভাবে মানবজাতির বড় বৈশিষ্ট্য হিসেবে এখানে ভাষা (speech) ও উচ্চারণকে দেখানো হয়েছে। প্রাণীরা এই ক্ষমতা হারালে তারা ‘নিম্নতর’ অবস্থান পেয়েছে।

আরো লক্ষণীয়, সৃষ্টিকর্তা বা Maker আর Feathered Serpent এককথায় পৃথিবী গড়ছেন, কিন্তু তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন বারবার। প্রথম সৃষ্টির প্রাণীরা পারেনি প্রশংসা বা নাম উচ্চারণ করতে, ফলে ব্যর্থ হলো। এভাবে চতুর্থ চেষ্টায় মানুষ তৈরি হলো, যে সফলভাবে ঈশ্বরদের নাম উল্লেখ ও প্রশংসা করতে পারে। এ যেন এক দীর্ঘ পরীক্ষানিরীক্ষার গল্প।

বিগ ব্যাং (Big Bang): আধুনিক বিজ্ঞানের সৃষ্টিকাহিনি?

শূন্য থেকে সৃষ্টির আলোচনায় আরেকটি উদাহরণ অনেকে টানেন, তা হলো আধুনিক মহাবিশ্বতত্ত্বের (modern cosmology) বিগ ব্যাং (Big Bang)। অনেকে এ ধারণাকে “মিথ (myth)” বলতে নারাজ, কারণ এটি বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু যদি আমরা মিথের মূল বৈশিষ্ট্যটা, অর্থাৎ একটি মৌলিক সৃষ্টিগল্প যা সময়ের পরীক্ষায় টিকে আছে— মিথের এই বৈশিষ্ট্যটা বিবেচনা করি, তবে বিগ ব্যাং-কে ঠিক এভাবে দেখাও সম্ভব। বিগত কয়েক দশকে এটি অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যাখ্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ব্রায়ান সুইম (Brian Swimme), The Universe is a Green Dragon বইয়ে, এই বিগ ব্যাং সম্পর্কে এক রকম “কাব্যিক” বর্ণনা দিয়েছেন:

“কল্পনা করুন সেই মহাতপ্ত চুল্লিকে (furnace), যেখান থেকে সবকিছু বেরিয়ে এসেছিল। এটি ছিল এমন এক অগ্নিঝড় যা সমগ্র মহাবিশ্বকে (universe) ভরিয়ে রেখেছিল—এটাই ছিল মহাবিশ্ব। কোনো বিন্দু ছিল না যেখানে এই আগুন ছিল না। প্রতিটি বিন্দু ছিল সেই বিস্ফোরণের (explosion) আলো (light) ও উত্তাপের অংশ। মহাবিশ্বের সব কণাই (particles) সেই চরম তাপ (heat) ও চাপের (pressure) মধ্যে ঘূর্ণায়মান ছিল। আমরা এখন যা কিছু দেখি—তার সবই ওই সূচনা মুহূর্তে ছিল, সেই মহান আলোর বিস্ফোরণে (burning explosion of light)।”

এক্স নিহিলো (ex nihilo) ধারণার সঙ্গে বিগ ব্যাং-এর কাঠামোগত মিল এখানে স্পষ্ট: সময়ের (time) আগে কিছু একটিকে ঘিরে ছিল অন্ধকার বা শূন্যতা, তারপর হঠাৎ এক ঘটনার মাধ্যমে (origin event) আলো (light) ও কর্মচাঞ্চল্যে ভরে গেল সবকিছু। যদিও এখানে কোনো ঈশ্বর বা আদিম জল নেই, তবে ‘শূন্যতা থেকে আলোর জন্ম’—এই ভাবনায় ঐতিহাসিক সৃষ্টিতত্ত্বের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়।

প্রকৃতি, কাহিনী ও ভাষার শক্তি (Nature, Myth, and the Power of Language)

দেখা যাচ্ছে, শূন্য থেকে সৃষ্টির গল্পগুলো যেন আমাদের চিন্তাশক্তিকেই একটা বড় পরীক্ষার মধ্যে ফেলে। আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখি—গাছ, পাহাড়, সমুদ্র, তারকা (stars), গ্রহ (planets)—এসবের জন্ম যদি হয় সত্যিই একদম কিছু-না-থেকে, তবে সেটা কল্পনা করা কতটা দুরূহ! তাই বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতি এই শূন্যতার ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য শব্দ (word) বা জল (water) বা চিন্তার শক্তি (power of thought) বা এক বা একাধিক স্রষ্টা (creator deity)-কে কাহিনীর কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে।

উদাহরণস্বরূপ, পপুল ভুহ (Popul Vuh)-এর গল্পে আছে, স্রষ্টার “শব্দ (the Word)” এতই শক্তিশালী যে যা উচ্চারণ করা হচ্ছে, তাই-ই বাস্তবে রূপ নেয়। বাইবেলে (Bible) ঈশ্বরের বাক্যই (God’s word) আলোর জন্ম দেয়। আবার গ্রিক বা মিশরীয় কাহিনীতে আমরা দেখি, কোনো দেবতা বা সত্তা শক্তি প্রয়োগ করে শূন্যতা/জল থেকে সবকিছু গড়ে তোলে।

মানুষের পক্ষে “কিছুই ছিল না, তারপর সবকিছু হলো” এই উত্তাল ধারণাকে বুঝতে “কেওস,” “আদিম জল,” “শব্দ,” “আলো,” “মৃত্যু,” “কাদা”—এমন নানান রূপকার এনে কাহিনীগুলোকে রাঙানো হয়েছে।

প্রথম সৃষ্টির ব্যর্থতা ও পুনরাবৃত্তি (Failures of First Creation & Multiple Attempts)

কিছু সৃষ্টিতত্ত্বে একটি মাত্রবারেই সৃষ্টি হয় সবকিছু—যেমন আদিপুস্তকের (Genesis) ঈশ্বর সাত দিনে বিশ্ব ও প্রাণ সৃষ্টি করেন। কিন্তু অন্যদিকে, মায়া (Maya) বা কিছু আফ্রিকান ও আদিবাসী (indigenous) সৃষ্টিকাহিনীতে দেখা যায়, স্রষ্টারা প্রথমবারে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেন না। পপুল ভুহ-এ তো চারবার চেষ্টার কথা বলা হয়েছে। প্রথম জন্ম নেওয়া প্রাণীরা কথা বলতে পারে না—স্রষ্টাদের নাম উচ্চারণ করে সাধুবাদ জানাতে পারে না, ফলে তাদের “অপাংক্তেয়” বা “ব্যর্থ সৃষ্টির নমুনা” আখ্যা দেওয়া হয়। পরের বার তারা মানুষ বানানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু সেটাও হয়তো ত্রুটিপূর্ণ হয়। শেষ পর্যন্ত তারা এমন মানবগোষ্ঠী গড়ে তুলতে চান, যারা সবদিক থেকে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে পুণ্য বা প্রশংসার কথা বলবে।

এটি একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত—অনেক মানবসমাজ নিজেদের “কেবল সৃষ্টি হয়নি, বরং ঈশ্বরের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য বা ঈশ্বরের প্রশংসা করার সক্ষমতা নিয়ে তৈরি” বলে বিশ্বাস করে। কাহিনীগুলো ভাষার (language) শক্তিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। আমরা যদি কথা বলতে বা ভাবতে না পারতাম, তবে “সৃষ্টির মাহাত্ম্য” অনুধাবনের এই গল্পগুলো তৈরি করাই হয়তো সম্ভব হতো না।

আরো কিছু মিল ও পার্থক্য (Similarities and Differences)

সৃষ্টিকাহিনীগুলোতে কিছু সাধারণ মোটিফ (motif) বা প্রতীক (symbol) ঘুরেফিরে আসে:

  1. আদিম জল (primordial water): অনেক জায়গায় দেখা যায়, সৃষ্টির আগে বা মুহূর্তে জলই একমাত্র উপাদান হিসেবে ছিল।
  2. শূন্যতা বা কেওস (void or chaos): স্থান-কালের (space-time) আগের অবস্থা—যেখানে কিছুই ছিল না, অথবা সবকিছু এলোমেলো অবস্থায় ছিল।
  3. আলো (light) ও অন্ধকার (darkness): সৃষ্টি মানেই আলোর আবির্ভাব, অন্ধকার সরে যাওয়া বা আটকে পড়া।
  4. শব্দ (the Word) বা ভাষার শক্তি: ঈশ্বর কিংবা স্রষ্টা কিংবা কোনো শক্তি যখন “বলে,” তখনই সৃষ্টি বা পরিবর্তন ঘটে।
  5. মৃত্যু (Death) ও জীবন (Life): অনেক সময় গল্পে দেখা যায়, মৃত্যুর (Death) উপস্থিতি শুরু থেকেই ছিল—যেমন কনো (Kono) জনগোষ্ঠীর গল্পে ‘Sa’ নামের সত্তা; আবার অন্যরা কখনো সেটিকে “বিশৃঙ্খলা,” কখনো “আদিম অন্ধকার” বলে।
  6. পুনরাবৃত্তি বা একাধিক সৃষ্টির প্রয়াস: কিছু মিথে (myth) দেখা যায়, স্রষ্টারা প্রথমবারেই সন্তুষ্ট হননি; বারবার চেষ্টা চলছে “উত্তম” একটা সৃষ্টি গড়ে তোলার জন্য।

এসব মিল ও পার্থক্য একদিকে যেমন স্থানীয় সংস্কৃতি ও পরিবেশের ছাপ বহন করে, অন্যদিকে দেখায় যে মানুষ চিরকালই মূল বা ভিত্তিগত সেই প্রশ্ন—“কোথা থেকে এলো সবকিছু?”—এর উত্তর খুঁজেছে নানা উপায়ে।

পরবর্তী দৃষ্টান্ত: ডিম, বীজ ও আর্থ-ডাইভার (Eggs, Seeds, and Earth-Divers)

অনেক সৃষ্টিতত্ত্বে শূন্যতা থেকে ডিমের (cosmic egg) জন্ম, বা কোনো এক বিরাট ডিম ফেটে সৃষ্টির প্রসার ঘটে। কোথাও দেখা যায়, বীজ (seed)-এর মতো কিছু থেকে সমস্ত পৃথিবী গজিয়ে ওঠে, আবার কোথাও “আর্থ ডাইভার (earth-diver)” বলে পরিচিত কোনও পাখি বা প্রাণী জলমগ্ন পৃথিবীর তলায় ডুব দেয়, সেখান থেকে কাদা বা মাটি নিয়ে আসে, আর সৃষ্টিকর্তা সেটি দিয়ে জমিন গড়েন। যদিও এগুলো এই পর্বের মূল আলোচ্য বিষয় নয়, পরের পর্বে এগুলো নিয়ে লেখা হবে, তবু এগুলোও সৃষ্টিতত্ত্বের একই বৃহত্তর পরিবারের অংশ।

অন্য কথায়, মানুষ চিরকালই এই ধারণা নিয়ে পরীক্ষা করে গেছে—কীভাবে শূন্যস্থান পূর্ণ হলো, কে পূরণ করল, কী উপাদান নিয়ে শুরু হলো। কখনো ডিম ফেটে জন্ম নিলো ব্রহ্মাণ্ড, কখনো সাপের কুণ্ডলী থেকে, কখনো পাখি ডুবে কাদা তুলে আনল, কখনো এক মহাজাগতিক শব্দ (Word) সবকিছু গড়ল।

উপসংহার

শূন্য থেকে সৃষ্টির (ex nihilo) এই ধারণাগুলো আসলে একইসঙ্গে রোমাঞ্চকর ও অস্বস্তিকর। কারণ, আমাদের চেনাজানা বাস্তবতায় সবকিছুই কোনো-না-কোনো পদার্থের অন্বয় থেকে আসে, সেখানে “কিছুই নেই” বলতে গেলে মাথায়ই ঢোকে না। কিন্তু মানুষ আদিকাল থেকে কল্পনা করেছে—যদি সত্যিই কোনোদিন কিছু না থাকত, সেই দিগন্তে প্রথম আলো বা প্রথম পদার্থ বা প্রথম শব্দ কীভাবে এলো? সে কেওসই বা কত বিশৃঙ্খল ছিল? সেখানে যদি জল থেকে শুরু হয়ে থাকে সবকিছু, সেটা কি আদৌ শূন্য? নাকি জলই সেই আদিতম পদার্থ?

আমরা দেখলাম, আদিপুস্তক (Genesis) ঈশ্বরের হাত ধরে পৃথিবী ও জীবের জন্মের কথা বলে, মিশরীয় মিথ বলছে একইভাবে এক চিরন্তন আত্মা (eternal spirit) আদিম জলের (primordial water) ভেতর থেকে উঠে এলেন। কনো (Kono) গল্পে মৃত্যু (Death) ছিল একমাত্র ধ্রুব সত্য, যিনি কাদামাটির সমুদ্রে বাড়ি বানালেন; মায়া (Maya) গল্পে Maker আর Feathered Serpent পরিকল্পনা করেই ভাষার জাদুতে সৃষ্টি করলেন পৃথিবী। আর আধুনিক বিজ্ঞানের বিগ ব্যাং (Big Bang) তত্ত্বও বলে এক অতি ক্ষুদ্র বিন্দু থেকে সবকিছু প্রসারিত হলো—যেখানে আলো, উত্তাপ, কণা—সবেরই প্রকাশ ঘটল প্রায় মুহূর্তেই।

শেষ পর্যন্ত, এই সৃষ্টিকাহিনীগুলো আমাদের দেখায় যে মানুষ সৃষ্টির (creation) ভিত্তি নিয়ে কত চিন্তাশীল ও কৌতূহলী। শূন্যতা (void) বা কেওস (chaos) কিংবা জলের (water) ভেতর থেকে কীভাবে এমন মহৎ ও সুবিন্যস্ত বিশ্ব (orderly universe) প্রস্ফুটিত হতে পারে—এই প্রশ্নই যুগে যুগে মানুষকে জ্ঞান (knowledge), আস্থা (faith), ও কল্পনাশক্তির (imagination) সন্ধান দিতে বাধ্য করেছে।

এভাবেই শূন্যতা ও জল, শব্দ ও ভাষা, আলো ও অন্ধকার, জীবন ও মৃত্যু—সব মিলে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর নানান জনগোষ্ঠীর সৃষ্টিতত্ত্ব। আর এসব গল্প এক অর্থে আমাদের মৌলিক প্রশ্নের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায়: “আমি কোথা থেকে এলাম?” “আদিতে কী ছিল?” “এতো বিশাল মহাবিশ্বের আসল শুরুটা কেমন ছিল?”

মানুষের এই অনন্ত অনুসন্ধান কখনো শেষ হওয়ার নয়। হয়তো বিজ্ঞান এগিয়ে যাবে আরো, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন (philosophy) আরো ব্যাখ্যা দেবে, কিন্তু মিথের অন্তর্নিহিত আবেদন—এই বিশাল শূন্যতা থেকে জীব ও কল্পনা, রূপ ও রসায়ন তৈরির কাহিনি—আমাদের মুগ্ধ করে যাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

তথ্যসূত্র

  • The Oxford Companion to World Mythology by David Leeming – https://www.amazon.com/Oxford-Companion-World-Mythology-Leeming/dp/0195387082
  • The Theogony of Hesiod translated by Hugh G. Evelyn-White – http://www.sacred-texts.com/cla/hesiod/theogony.htm
  • In the Beginning: Creation Stories from Around the World by Virginia Hamilton and Barry Moser – https://www.amazon.com/Beginning-Creation-Stories-Around-World/dp/0152387420
  • The World of Myth: An Anthology by David Leeming – https://www.amazon.com/World-Myth-David-Adams-Leeming/dp/1522694676

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.